আর্কাইভভ্রমণ গদ্য

ভ্রমণ : নাইট লাইফে জমজমাট পল্লী গুইলুজ : মঈনুস সুলতান

বেলা পড়ে আসতেই মরক্কোর মারাকেশ নগরীর জেমা এল ফিনা নামক পর্যটক-নন্দিত স্কোয়ারটি মৃদু আলোয় কেমন যেন মায়াবী হয়ে উঠতে শুরু করে। রোদের তেজ তেমন প্রখর নয়, মাঝেমধ্যে মরু-সাহারা থেকে ভেসে আসা বিশুষ্ক হাওয়া এসে গতরে ঝাপটা মারছে। আমরা―অর্থাৎ আমি ও আমার ভ্রমণ-সঙ্গী ব্রিয়না ক্যাফে থেকে উঠে পড়ে হাঁটতে শুরু করি। এ মুহূর্তে আমাদের গন্তব্য হচ্ছে―পায়ে হেঁটে চেজ ব্রাহিমের সরাইতে পৌঁছা।

আমার সাথী―অস্ট্রেলিয়ার নারী ব্রিয়না বছর দেড়েক ধরে বসবাস করছে মরক্কোতে। নেশায় প্রকৃতি পর্যবেক্ষক এ মেয়েটি ট্র্যাভেল রাইটার হিসেবে মাঝেমধ্যে তার ভ্রমণ অভিজ্ঞতা পত্রপত্রিকায় প্রকাশ করে। মরক্কোর টুরিস্ট স্পটগুলো সে ভ্রমণ করেছে একাধিকবার, তাই তাকে আমরা তথা জনা কয়েক পর্যটক, আগামীকাল জাবলে আটলাস নামক একটি পর্বতমালায় ভ্রমণের খুঁটিনাটি সমন্বয় করতে দায়িত্ব দিয়েছি।

আমাদের ভ্রমণসঙ্গীদের মধ্যে সব চেয়ে চমকপ্রদ ব্যক্তিত্বের অধিকারী হচ্ছেন ইলিয়ট ল্যাজারস। প্যারিসের বুকিনিস্ত বা গ্রন্থবণিক ইলিয়ট আমার পূর্বপরিচিত। নানা দেশের বিচিত্র সব সূত্র থেকে তিনি খরিদ করেন শত বছরের পুরানো সব বইপত্র। এগুলো নিজ হাতে বাঁধাই ছাদাই করে প্যারিসে আগত পর্যটকদের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করে থাকেন।

এ ছাড়া ডেভিড-নিওম আলদ্রিদ্রি নামক অন্য এক ভ্রমণসঙ্গীর কথাও উল্লেখের দাবি রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের এ নাগরিকের জননী তিউনিসিয়ার নারী, সে সুবাদে তিনি আরবি বলেন চমৎকার। পেশায় আলদ্রিদ্রি মিউজিক জার্নালিস্ট, তবে নেশায় তাকে মেকানিক বলা চলে, মোটরকার থেকে কম্পিউটার―হেন বস্তু নেই যা তিনি সারাই করতে অপারগ। প্রবল ব্যক্তিত্ব নিয়ে আলদ্রিদ্রি ঘোরাফেরা করেন, তাঁর প্রখর পার্সোনালিটি কখনও সখনও চলার পথে তুমুলভাবে আকর্ষণ করে সহযাত্রী নারীদের।।

আগামীকাল আটলাস পর্বতমালার দিকে যাওয়ার আগে আমরা আজ চেজ ব্রাহিমের সরাইতে জড়ো হচ্ছি। আমাদের উদ্দেশ্য―ডিনারের মাধ্যমে পরস্পরের সঙ্গে পরিচিত হওয়া ও যাত্রাবিষয়ক জোগাড়যন্ত্রের খুঁটিনাটি আলাপ করে দিন চারেকের জন্য পার্বত্য লোকেশনে অভার নাইট ট্রিপের প্রস্তুতি নেওয়া।

আমাদের অন্য এক ভ্রমণসঙ্গী সেনেগালের মেয়ে হাবিবাতু হুব্বা ট্রিপ ক্যানসেল করে গতকাল ফিরে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। কাসাব্লাংকায় আমরা সকলে একই হোটেলে থাকার সুবাদে পরস্পরের পরিচিত। যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসী হওয়া হাবিবাতু পেশায় খুদে ব্যবসায়ী। সে মরক্কোতে এসেছিল সুটকেস ভর্তি নানাবিধ শৌখিন ভোগ্যপণ্য নিয়ে। এগুলো বিক্রি করে হাবিবাতু কাসাব্লাংকা ও মারাকেশ থেকে বেশ কিছু সওদাপাতি কিনে ফিরে গেছে যুক্তরাষ্ট্রে। কথা ছিল সে-ও আমাদের সঙ্গে আটলাস পর্বতমালায় বেড়াতে যাবে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বোনের তত্ত্বাবধানে রেখে আসা তার কিশোর পুত্রটি অসুস্থ হয়ে হসপিটালাইজড হলে তাকে ফিরে যেতে হলো। ভীষণ রকমের হাসিখুশি সারাক্ষণ মাতিয়ে রাখা নারী হাবিবাতু। সে সঙ্গে না থাকাতে কেমন যেন খালি খালি লাগে। বিষয়টা আমি ব্রিয়নার সঙ্গে শেয়ার করি। কিন্তু সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে আলোচনার মোড় ফিরিয়ে ডেভিড-নিওম আলদ্রিদ্রির সঙ্গীতপ্রীতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চায়।

ডেভিড-নিওম আলদ্রিদ্রি আমার দীর্ঘদিনের চেনা সুহৃদ। লোকগীতি সংগ্রহের উদ্দেশে ইনি চষে বেড়ান আফ্রিকার মাগরেব ও সাহেল অঞ্চল। আমার কর্মস্থল সিয়েরা লেওনেও এসেছেন একাধিকবার, লোকমুখে গীত কোরা মিউজিক সংগ্রহ করতে। একটি ফিল্ড ট্রিপে ডেভিড-নিওম আমার সঙ্গী হয়েছিলেন, এবং পেনডেমবু নামে কাইলাহুন জেলার যে গ্রামে আমি কাজ করতাম, ওখানকার ভিলেজ-হেডের কাছ থেকে―কোরা মিউজিকের হার্প জাতীয় বাদ্যযন্ত্র সংগ্রহ করতে তাকে সাহায্যও করেছিলাম।

ব্রিয়নার সঙ্গে কথা বলতে বলতে আমি নীরবে ডেভিড-নিওম বিষয়ে তার আগ্রহের গভীরতা যাচাই করতে চেষ্টা করি। একটু টুইয়ে দিতেই সে অকপটে স্বীকার করে, ‘ইয়েস আই অ্যাম ইন লাভ উইথ দিস হ্যান্ডসাম মিউজিক জার্নালিস্ট। ইউ আন্ডারস্টন্ড… আই ওয়ান্ট দিস সুপার কুল গাই।’

তার পৌরুষব্যঞ্জক দেহ ও সঙ্গীতপ্রীতি প্রভৃতি যে ব্রিয়নাকে তুমুলভাবে আকর্ষণ করেছে, এ নিয়ে আমার কোনও সন্দেহ থাকে না; কিন্তু বুঝতে পারি না ডেভিড-নিওম যে ইতোমধ্যে আড়ালে আবডালে হাবিবাতুর সঙ্গে গড়ে তুলেছেন অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, এ ব্যাপারে ব্রিয়না ওয়াকিবহাল কি-না। আমাকে কোনও প্রশ্ন করতে হয় না, হঠাৎ করে ব্রিয়না ল্যাম্পপোস্টের তলায় দাঁড়িয়ে পড়ে চোখেমুখে সংকল্প ফুটিয়ে তুলে বলে, ‘আমি অসম্ভব কিছু চাচ্ছি না, ডেভিড-নিওম তো যাচ্ছে আমাদের সঙ্গে আটলাস পাহাড়ে, আই রিয়েলি ওয়ান্ট হিম, ওয়ান্ট হিম ব্যাডলি.. অ্যাটলিস্ট ফর অ্যা কাপোল অব নাইটস্।’

হাঁটতে হাঁটতে আমি ভ্রমণসঙ্গী ব্রিয়নার আকর্ষণীয় পোশাক আশাক ও মেকাপ-জনিত সৌরভ সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠি। পয়দলে গলিঘুঁজিতে চলাচলের সময় পর্যটকরা সচরাচর এ রকম সুচারু পেশাকাশাকের আকর্ষণ ছড়িয়ে ঘোরাফেরা করে না। দিন কয়েক আগে কাসাব্লাংকা নগরীতে আমি ব্রিয়নাকে ডেভিড-নিওম আলদ্রিদ্রির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, পুরুষ হিসেবে আলদ্রিদ্রি ব্রিয়নার মধ্যে সৃষ্টি করেছেন তুমুল আকর্ষণ। সাময়িকভাবে হলেও আলদ্রিদ্রির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আন্দাজ করি, তার পোশাকাশাকের বাহার ও শরীরের ইচ্ছাকৃত অনাবৃতির সঙ্গে মিশে আছে ডেভিড-নিওম আলদ্রিদ্রিকে জয় করার প্রচেষ্টা।

টিমটিমে আলোয় মোটকারবিহীন গলিপথে হাঁটতে ভালোই লাগে। ক্যাবোল স্টোন ধরনের পাথরে বাঁধানো শত বছরের পুরানো সংকীর্ণ সড়কটি একেবারে নির্জন না। কাজ শেষ করে রুটি-কাবাব কিনে ঘরে ফিরছেন মারাকেশ নগরীরর স্থানীয় নাগরিকরা, কারও হাতে কমলালেবুর গুচ্ছ কিংবা তরতাজা ফুল। শিশাহুকা, আগর ও ঝলসানো মাংসের গন্ধে বাতাস খানিক ভারী হয়ে আছে।

দেখা হয় জবরজং পোশাকাশাক পরা চেনা ভিস্তিওয়ালার সঙ্গে। দিন দুয়েক আগে আমি মারাকেশের শাহি জামানার এক সবুজ উদ্যানে তাঁর ছবি তুলেছি। তিনি আধো-আধো ইংরেজি বুলিতে জানতে চান, ‘পিকচার গুড, ইউ হেপি ?’ ‘কাকজান, ছবিটি দারুণ হয়েছে,’ বলে তাঁর হাতে একখানা নোট ধরিয়ে দিলে তিনি খুশি হয়ে আমাকে আলিঙ্গন করেন।

অতঃপর একটি সংকীর্ণ গলিপথ ধরে হাঁটার সময় খেয়াল করি, লালচে ইটের দেয়ালে ঝুলছে অনেকগুলো নক্সাদার কার্পেট। আমি ও ব্রিয়না চিপাচাপা গলিটি অতিক্রম করে চলে আসি নাইট লাইফের জন্য মারাকেশের মশহুর পল্লী গুইলুজের প্রান্তিকে। লালচে-বেগুনি আলোয় ফরাসি আমলের আর্টডেকো কেতার দালানকোঠা রীতিমতো রহস্যময় হয়ে আছে। কোনও কোনও দালানের আঙিনায় জ্বলছে মৃদু আভার ল্যাম্পপোস্ট, তার তলায় ওপেন এয়ার পরিসরে জমে উঠেছে কফি পানের চমৎকার সান্ধ্য পরিবেশ। একটি-দুটি ট্র্যান্ডি ক্যাফে থেকে ভেসে আসছে আভাগার্ড রীতির লাইভ মিউজিকও। 

একটু সামনে আসতেই দেখি, ফুটপাথে এক মহিলা সাজিয়ে বসেছেন জুতার দোকান। ব্রিয়না দাঁড়িয়ে পড়ে জুতাগুলো দেখতে শুরু করে। ঠিক জুতা নয়, বেডরুম স্লিপার বা সফ্ট লেদারে প্রস্তুত চপ্পলগুলো খুবই আরামদায়ক। সে একটি চপ্পল কিনতেই মহিলা ইশারায় আমাকে দেখিয়ে আরেকটি কিনতে আবেদন করেন। যেহেতু পণ্যটি দামে অত্যন্ত স্বস্তা,  সুতরাং আমিও এক জোড়া চপ্পল কিনে ফের হাঁটতে শুরু করি।

হেরেমের নর্তকীর মতো পোশাকাশাকে সজ্জিত দুটি মরোক্কান নারী পাশ দিয়ে হেঁটে যায়। কোমর জড়িয়ে পরা পুঁতি, পাথর ও রুপার চেইনে তৈরি হিপ-স্কার্ফের দোলনে সৃষ্টি হয় জিংলিং সাউন্ড। একটি মেয়ে গ্রীবা বাঁকিয়ে মৃদু হাসলে, সান্ধ্যবাতাসে ছড়িয়ে পড়ে প্রচ্ছন্ন ইনভাইটেশন। আমরা আরেকটু আগাই। এদিককার প্রায় প্রতিটি ক্যাফেতে নারীরা এমন সব পোশাকাশাক পরে ঘোরাফেরা করছেন যে, মনে হয় মরক্কো নয়, স্পেনের বার্সিলোনা নগরীর সরণি ধরে হাঁটছি।

যেতে যেতে খেয়াল করি, আধোন্ধকারে দাঁড়িয়ে, ফিগার খামচে ধরা সিল্কের আঁটোসাটো টাইটস্ পরা অল্পবয়সী মেয়েগুলোর রিং-কর ছুড়ছে হাসিসের ধোঁয়া। আলামত থেকে আন্দাজ করি, পল্লীটি সেক্স-ওয়ার্কারে উপদ্রুত। জনা কতক পুরুষ-পর্যটকও ইঁদুরের সম্ভাবনায় উদ্দীপ্ত হুলোবেড়ালের মতো হামদোহুমদো করে হাঁটছেন। থেকে থেকে শোনা যাচ্ছে মৃদুস্বরে ইংগিত-প্রবণ সিটি। ঘটনাদৃষ্টে ইরাদা হয়, মরক্কোর রয়েল ওয়েবসাইট বাদশাহ ডট কমে ক্লিক করে, এ মুহূর্তের পর্যবেক্ষণটি ম্যাসেজের মারফত রিপোর্ট করতে; যাতে মাগরেবের আলমপনা নৈতিকতা নিশ্চিত করার জন্য কড়া ধাঁচের একটি ফরমান জারি করতে পারেন।

আইফোনের স্ক্রিনে, গুগুলম্যাপের দিকে নজর রেখে ব্রিয়না দক্ষতার সঙ্গে গুইলুজ-পল্লী ছেড়ে আমাকে নিয়ে পথ-কোনাকোনি ঢুকে পড়ে, অন্ধকার একটি সাইড-স্ট্রিটে। পথের পাশে খালি পড়ে থাকা পরিসরে জবর জোশে জ্বলছে গোটা তিনেক মশাল। এদো-পঁচা জলাভূমিতে ভনভনানো মশকের মতো ভিড় করে একাধিক ভাষায় গুঞ্জন তুলছে জনা কয়েক পুরুষ-পর্যটক। এদের দিকে পেছন দিয়ে ঢিমে-তাল স্টেপে ড্যান্স করছে একটি ছায়ামূর্তি, তার গলায় প্যাঁচানো আস্ত সরীসৃপ। নৃত্যরত চরিত্রটি বোধ করি পরেছে স্কিন-কালারের মিহি টাইটস্, এতে আজদাহার লাংগুড়ে জড়ানো তার নিতম্বকে দেখাচ্ছে নিসুতো-নগ্ন।

আচমকা এ দৃশপট চকিতে মনে করিয়ে দেয়, ওরিয়েন্টালিস্ট ধারার চিত্রকলার জন্য খ্যাত শিল্পী জঁ লেওন জিরমের (১৮২৪- ১৯০৪) ‘দ্যা স্নেক চার্মার’ শিরোনামে একটি তৈলচিত্রের কথা। আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায় বিস্ময়বাচক বচন, ‘হলিকাউ’! খিলখিলিয়ে হেসে পাশ থেকে বিদ্রƒপ করে ব্রিয়না বলে, ‘দিস ইজ মরক্কো। হালি কাউ ডাজ নট ওয়ার্ক হিয়ার, ইউ মাস্ট সে হলি ক্যামেল।’

তখনই চোখেমুখে এসে লাগে গোলাপজলের ছিটা। ফিল্মে আলিবাবা চরিত্রে অভিনয় করা মারকুটে দেখতে এক বান্দা, পেটিতে রোজওয়াটারের শিশিটি গুঁজে খাপ থেকে বের করেন বাহারে খঞ্জর। আমাদের আঁতকে ওঠার দশা হলে, তিনি অভয় দিয়ে হাসিমুখে বলেন, ‘রাকসাতুল কামারি… মুন ড্যান্স… ফাইভ প্লাস ফাইভ টেন ইউরো।’ আলিবাবাটির সঙ্গে জংয়ে-খঞ্জরে জেতার সম্ভাবনা কম, তাই আমরা পিটটান দেয়ার অভিপ্রায়ে অন্ধকার ফুঁড়ে দৌড় লাগাই।

উস্টাবিস্টা খেয়ে ব্রেক কষতেই, আমাদের ঘিরে ধরে তিন-তিনটি বালক। তারা জিকিরের ভঙ্গিতে জপে, ‘সুইটহার্ট হানি, গিভ আস মানি।’ আবেদনটি বুঝতে কোনও অসুবিধা হয় না। আমি তাদের হাতে তিন ইউরো তুলে দিয়ে নিস্তার পাই; আর হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, ‘ওরিয়েন্টালইজম’ শিরোনামে একটি গ্রন্থের প্রণেতা, প্রাচ্যবাদের বিশ্লেষক হিসাবে খ্যাত ফিলিস্তিনি স্কলার ও লেখক এডওয়ার্ড সাইদ (১৯৩৫-২০০৩) তাঁর বিখ্যাত পুস্তকে ফরাসি পেইন্টার জঁ লেওন জিরমের ‘স্নেক চার্মার’ চিত্রটি প্রচ্ছদ হিসেবে ব্যবহার করে, শিল্পকলায় প্রাচ্যের নিগেটিভ ইমেজ ব্যবহারের তুমুল সমালোচনা করেছিলেন। কিন্তু আজ সন্ধ্যায় মারাকেশের অন্ধগলিতে যা চাক্ষুষ করেছি, তা জানতে পারলে সাইদ কফিনের ভেতর নড়েচড়ে বসে তাঁর রচনাটির সংশোধনী পাঠাতেন।

হেঁটে যেতে যেতে ব্রিয়না বলে, একটি ব্লগে সে পড়েছে, ‘রাকসাতুল কামারি’ বা তথাকথিত ‘মুন ড্যান্স’ নাকি মারক্কোতে আইনিভাবে নিষিদ্ধ, তাই পারফরমেন্সের সময় অন্ধকার গলিঘুঁজির মুখে দাঁড়িয়ে আলগোছে নজরদারি করে ছ্যাঁছোড় গোছের ছোকড়ারা, টহল-পুলিশের কোনও আলামত দেখতে পেলে তারা বিপারের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়। তখন নৃত্যকর্মের উদ্যক্তা চটজলদি মশালটি নিভিয়ে সটকে পড়ে।

আমার নীরবতায় উত্যক্ত হয়ে ব্রিয়না ফের মন্তব্য করে, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, দ্যা ড্যান্সার ইজ অ্যা টিন-এজ বয় ?’ এবার কিছু বলতে হয়, তাই মিনিমিনিয়ে বলি, ‘ইয়েস, আই নো।’

আমি অবগত যে, ফরাসি চিত্রকরের ‘স্নেক চার্মার’ নামক তৈলচিত্রটির মডেলও ছিল নিসুতো একটি কিশোর। কিন্তু এ নিয়ে ব্রিয়নার সঙ্গে কথাবার্তায় এনগেজ হতে ইচ্ছা হয় না। আমি ফের চুপ মেরে যাই, তবে ইমেজটি আমার মধ্যে পীড়াজনকভাবে ঘুরুন্টি দিতে থাকে। এ বাবদে কিছু লিখলে তাতে নেতিবাচক সংবেদন ছড়ানোর সম্ভাবনা থাকে ষোলআনা, কিন্তু মিনিট কয়েক আগে ঘটনাটি তো নিজেই চাক্ষুষ করেছি ?

না ভেবে পারি না, যা দেখছি, তার অধিকাংশই ফেনায় প্রতিফলিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র রঙধনুর মতো, এতে তৈরি হয় বর্ণবিভ্রম, কিন্তু পাওয়া যায় না গভীর জলের তালাশ। দূরের মানুষ আমি, কখনই বোধ করি জানতে পারব না, অপ্রাপ্তবয়স্ক অজানা কিশোরটির পারিবারিক সুখদুঃখের বিষয়-আশয়, কোন পরিস্থিতিতে সে পা বাড়িয়েছে নৃত্য-কণ্টকিত এন্টারটেইনমেন্টের সেক্স-ওয়ার্কারে উপদ্রুত সরণীতে ?

বাতিজ্বলা একটি সড়কে বেরিয়ে আসতেই ব্রিয়না দাঁড়িয়ে পড়ে আমার দিকে তাকায়, ‘হোয়াট হেপেন্ড ? ইউ সিমস্ সো এবসেন্ট… অনমনস্ক হয়ে লেখাজোকার কথা ভাবছ কী ?’ অকারণে খিটমিটিয়ে উঠে বলি, ‘হেল… নো, আই অ্যাম জাস্ট ফিলিং হ্যাংরি।’

চেজ ব্রাহিমের সরাইতে পৌঁছামাত্রই ডিনার সার্ভ করবে না, কিছুক্ষণ অন্যান্য সফরসঙ্গীদের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, টুকটাক কথাবার্তা বলে আমরা অন্তরঙ্গ হওয়ার চেষ্টা করব। ব্রিয়না ফের আমার দিকে তাকিয়ে বলে, ‘ওহ ডিয়ার, তোমার আবার ব্লাড সুগার লো হচ্ছে না তো ?’

পথের পাশেই পাওয়া যায় মাহলাবা বা ছাপরা মতো একটি ফুডস্টল। তার উৎসাহে আমি ওখানে ঢুকে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে পড়ি। হঠাৎ করে ব্রিয়নার মধ্যে যেন জেগে ওঠে প্রচ্ছন্ন এক শুশ্রুষাপ্রবণ সত্তা। সে ইয়োগার্ট-বেইসড্ ড্রিংক রাইব-এর অর্ডার করে প্রশ্ন করে, ‘ডু ইউ হ্যাভ ইয়োর সেলফোন উইথ ইউ ?’

ওটিতে চার্জ ফুরিয়েছে জানালে, সে পাওয়ার ব্যাংক বের করে তা প্লাগইন করে। তারপর কপট শাসনের স্বরে বলে, ‘আটলাস পাহাড়ে ট্রিপের সময় এটাতে চার্জ দিয়ে সারাক্ষণ পকেটে রাখবে।’ বুঝতে পারি, যাত্রা লজিস্টিকের খুঁটিনাটি জনে জনে পই পই করে বুঝিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী ব্রিয়না নয়, কমিউনিকেশনের সুবিধার জন্য আমাকে অতিঅবশ্যই মাঝেমধ্যে ফেসবুকে এক্সেস করতে হবে।

পরিবেশিত হয় গেলাস ভর্তি রাইব। পানীয়টির দৈ দিয়ে তৈরি তরল ক্বাথের উপর ছড়িয়ে আছে সিনেমনের গুঁড়া ও অরেঞ্জ ব্লসম। চুমুক দিতেই জিবে ঠেকে মধুমেশানো পেস্তাবাদাম ও টুকরো করে কাটা খেজুরের স্বাদ। তারিয়ে তারিয়ে পান করছি, দেখি ফুটপাথ ধরে লাঠি ঠুকে ঠুকে হাঁটছেন বুকেনিস্ত বা প্যারিসের গ্রন্থবণিক ল্যাজারস সাহেব, হাঁটতে হাঁটতে তিনি বোধ করি আঙ্গুল দিয়ে শূন্যতায় কিছু লিখে চলেছেন। তাঁকে দেখতে পেয়ে ব্রিয়নার মুখে ফুটে ওঠে চাপা বিদ্রƒপের হাসি, তারপর আমার দিকে তাকিয়ে সে ঝাঁঝালো স্বরে বলে, ‘আই নো দিস স্ট্রেঞ্জ গাই ইজ নট গোনা ইউজ ফেসবুক, আই সিম্পলি ডোন্ট নো হোয়াট দ্যা হেল আই শুড বি ডুয়িং টু কমিউনিকেট উইথ হিম।’

‘নেভার মাইন্ড ব্রিয়না, তার সঙ্গে যোগাযোগের কোনও প্রয়োজন পড়লে আমার ওপর ভরসা রাখো, আই উইল টেক কেয়ার অব দ্যাট, ও-কে।’ কোনও প্রতিক্রিয়া না জানিয়ে ব্রিয়না মুখখানা মস্ত করে তুলে অন্য দিকে ফেরায়। তখনই পাওয়ার ব্যাংকের জ্বালানিতে আমার আইফোনটি সতেজ হয়ে উঠে জানান দেয়।

টেক্সট এসেছে হাবিবাতু হুব্বার কাছ থেকে। ফ্লাইট ডিলে হয়েছে, মেয়েটি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বসে যুক্তরাষ্ট্রে অসুস্থ ছোট্ট ছেলেটির দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে লিখেছে, ‘আমি জানি না, কীভাবে ছেলের মুখোমুখি হব ?’ হাবিবাতুর সঙ্গে ব্রিয়নারও চেনাজানা আছে। তাই নিঃসংকোচে টেক্সটটি তাকে দেখাই।

কী একটা ভেবে প্রতিক্রিয়ায় সে বলে, ‘আই অ্যাম সো স্যরি ফর দি পুওর সিঙ্গোল মাদার… কিন্তু একটা কথা তোমাকে বলি, ইন অ্যা সেন্স আই অ্যাম গ্ল্যাড দ্যাট হাবিবাতু ইজ নট হিয়ার, সে আমাদের সঙ্গে আটলাস ট্রিপে যাচ্ছে না, এটা আমার জন্য ভালোই হলো।’

প্রশ্ন না করে পারি না, ‘হোয়াই ইজ দ্যাট ব্রিয়না ? হাবিবাতু আমাদের সঙ্গে যাচ্ছে না, এটা তোমাকে খুশি করছে কেন ?’ জবাব দিতে গিয়ে ব্লাশে গণ্ডদেশে রক্তিমাভা ফুটিয়ে সে বলে, ‘আই অ্যাম বিয়িং অ্যা বিট সেলফিস হিয়ার… তোমাকে তো বলেছি… ডেভিড-নিওম আলদ্রিদ্রিকে আমি চাই, এ নিয়ে হাবিবাতুর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হচ্ছে না, দিস ইজ জাস্ট গুড ফর মি।’

আমার মুখ থেকে আলটপকা বেরিয়ে যায়, ‘ডেভিড-নিওমের সঙ্গে হাবিবাতুর ঘনিষ্ঠতা সম্পর্কে তুমি তা হলে জানো.. ব্রিয়না ?’

একটু যেন বিরক্ত হয়ে সে জবাব দেয়, ‘আই উড নট কল ইট ইন্টিমেসি, তাদের মধ্যে কোনও ঘোড়ার ডিমের ঘনিষ্ঠতা হয়নি, ডেভিড-নিওম তাকে সুদানের সুগন্ধি কাঠ ডুকান উপহার দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে ডুকান-কাঠের তুমুল চাহিদা, তুমি তো জানোই হাবিবাতু কীরকম বিজনেস মাইন্ডেড, সে সুগন্ধি-কাঠের টুকরোগুলো আমেরিকাতে নিয়ে গিয়ে অভিবাসী হওয়া আফ্রিকান মেয়েদের কাছে চড়া মূল্যে বিক্রি করে দেবে।’

জানতে চাই, ‘হোয়াট এগজেক্টলি ডুকান-উড ইজ, ব্রিয়না ? আই অ্যাম অ্যা বিট কিউরিয়াস।’

দীর্ঘ ব্যাখ্যা থেকে বুঝতে পারি, টাহিহি বলে একটি মরুবৃক্ষের কাঠের সঙ্গে চন্দন প্রভৃতি মিশিয়ে তৈরি হয়, ডুকান নামে ইন্দ্রিয়-উদ্দীপ্ত সুগন্ধি। বস্তুটি মালশায় পুড়িয়ে, সদ্যবিবাহিত যুবতীরা তার আঁচে দাঁড়িয়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গে মাখে সুগন্ধি ধোঁয়া। সুদান থেকে সেনেগাল অবধি সর্বত্র, রোমান্টিক সম্পর্কে আগ্রহী মেয়েরা তাদের ঈপ্সিত পুরুষের কাছ থেকে এ ধরনের কাঠ উপহার হিসেবে পেয়ে থাকে। চোরাগোপ্তাভাবে এটি ঢুকে ইউরোপ ও আমেরিকায়। ওই সব দেশে বসবাসরত আফ্রিকান আভিবাসী নারীদের মধ্যে এ বস্তুর প্রবল কদর।

ব্রিয়নার কাছ থেকে এ ধরনের তথ্য পেয়ে স্রেফ চুপ মেরে থাকতে ইচ্ছা হয় না, বলে বসি, ‘এ ধরনের উপহারাদি আদান প্রদান থেকে কি ধরে নেওয়া যায় না, ডেভিড-নিওম হাবিবাতুর প্রতি রোমান্টিকভাবে আকৃষ্ট ?’

শার্পলি রিয়েক্ট করে ব্রিয়না, ‘পারহেপস ইউ আর রাইট, সো হোয়াট ?… হাবিবাতু তো এখানে নাই, সিচ্যুয়েশন আমার পক্ষে… আই অ্যাম গোয়িং টু কনকোয়ার হিম, ইট ইজ দ্যাট সিম্পোল, ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড দিস ?’

পরিস্থিতি বুঝতে আমার বিশেষ কোনও অসুবিধা হচ্ছে না, তারপরও মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, ‘ডেভিড-নিওম যদি তোমার অ্যাপ্রোচে পজিটিভভাবে সাড়া না দেন ?’

চকিতে চোখমুখে লাস্য ফুটিয়ে ব্রিয়না জবাব দেয়, ‘লুক, আই অ্যাম অ্যা প্রিটি গার্ল, বিলিভ মি, পুরুষকে কীভাবে ক্রেইজি করে তুলতে হয়, এ সব কলাকৌশল আমার জানা আছে.. জাস্ট ওয়াচ মি।’

এ বাবদে আমার বক্তব্য আর বিশেষ কিছু নেই, তাই মাহলাবা বা রোডসাইড ফুডস্টল থেকে উঠে পড়তে পড়তে বলি, ‘গুড লাক সুইট পার্সন।’

পাশের গলিতে চেজ ব্রাহিমের সরাই। ওই দিকে হাঁটতে হাঁটতে ব্রিয়না জানতে চায়, ‘ডেভিড-নিওম কি সিয়েরা লেওনের ডায়মন্ড স্মাগলাগিং টাইপ কোনও রিং-এর সঙ্গে যুক্ত ?’ চমকে ওঠে পাল্টা জানতে চাই, ‘হোয়াই ইজ দিস কোয়েশ্চন, ব্রিয়না ?’

স্ট্রিট-কর্নারে দাঁড়িয়ে পড়ে সে জানায়, ‘ডেভিড-নিওম হাবিবাতুকে সিয়েরা লেওনের একটি আন-কাট ডায়মন্ড উপহার দিয়েছে। তার কাছে শুনলাম, সে কৌটাভর্তি আনকাট ডায়মন্ড নিয়ে ঘোরাফেরা করছে, সিয়েরা লেওনে সে তো তোমার অতিথি ছিল তাই ভাবলাম, ইউ মাইট নো হোয়াট ডেভিড-নিওম ইজ আপ টু ?’

জোর দিয়ে বলি, ‘আই ডোন্ট থিং ডেভিড-নিওম ইজ অ্যা ডায়মন্ড স্মাগলার। সিয়েরা লেওনে পাড়াগাঁ-এর লোকজন হঠাৎ হঠাৎ কপাল জোরে একটা-দুটা ডায়মন্ড পেয়ে যায়, এগুলো আর্টিজানিয়া ডায়মন্ড নামে চোরাগোপ্তাভাবে বিক্রি হয়। ডেভিড-নিওম এ ধরনের বেশ কয়েকটি ডায়মন্ড কিনেছে।’

একটু চিন্তিতভাবে ব্রিয়না বলে, ‘বেশ কিছু দিন ধরে ভাবছি, আফ্রিকার আর্টিজানিয়া ডায়মন্ড নিয়ে আমি একটি ট্র্যাভেল স্টোরি লিখব, কিন্তু তথ্য সংগ্রহের সঠিক কোনও সূত্র খুঁজে পাচ্ছিলাম না।’

হাঁটতে হাঁটতে তাকে উৎসাহ দিয়ে বলি, ‘ডেভিড-নিওমের সঙ্গে কথাবার্তা বললে এ বাবদে প্রচুর তথ্য পেয়ে যাবে ব্রিয়না, আর তোমাকে আরেকটা লিড দিচ্ছি, অপরিশোধিত পাথরগুলো কেটে-ছেঁটে স্বচ্ছ সুন্দর করে তোলার জন্য সে জোহানেসবার্গে যাচ্ছে। চেষ্টা করে দেখো, তুমি তার সঙ্গে যেতে পারো কি না, ইউ উইল ফাইন্ড এনাফ ইনফরমেশন টু পুট টুগেদার অ্যা ট্র্যাভেল স্টোরি। ও-কে।’

ব্রিয়না আমার কব্জি চেপে দিয়ে বলে, ‘খুব জরুরি একটা তথ্য শেয়ার করলে, ম্যান, দিস ইজ ট্রুলি ওয়ান্ডারফুল, ইউ আর গ্রেট।’

চুপচাপ হাঁটছিলাম, দেখি, চলে এসেছি আলো ঝলমলে আপস্কেইল এক রেস্তোরাঁর কাছে। ‘হ্যালো দেয়ার…’ আওয়াজে ঈষৎ চমকে দাঁড়িয়ে পড়ি আমরা। আঙিনার ছায়াচ্ছন্ন বাগিচা থেকে বেরিয়ে আসেন, কাউবয় স্টাইলের হ্যাট পরা যুক্তরাষ্ট্রের মিউজিশিয়ান ডানকান ক্যাম্পবেল। ইনার সঙ্গে কাসাব্লাংকায় বার কয়েক আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে, সুতরাং ইনিও চেনাজানা মানুষজনদের ক্যাটাগরিতে পড়েন। আজ ডানকান ক্যাম্পবেলের সঙ্গে মরোক্কান কেতার কয়েন দিয়ে তৈরি টিকলি পরা একটি মুখচেনা মেয়ে। ঘণ্ঠা দেড়েক আগে, আমরা এদের মারাকেশের কুতুবিয়া গার্ডেনে বোগেনভিলিয়ার কুঞ্জে অন্তরঙ্গতায় নিবিড় হতে দেখেছি। আন্দাজ করি, এ যুগল এদিককার বিলাসবহুল রেস্তোরাঁটিতে ডিনার করতে এসেছেন।

ডানকান মেয়েটিকে নাজিহা বলে পরিচয় করিয়ে দেন। কুতুবিয়া গার্ডেন ছাড়াও এ যুবতীকে আমি কাসাব্লাংকার নটরডেম ক্যাথিড্রালে খানিক দূর থেকে চেলো বাজাতে দেখেছি। এবার কাছ থেকে দেখতে পেয়ে বুঝতে পারি, তাকে যতটা অল্পবয়সী ভেবেছিলাম, হয়তো সে তা নয়, তবে তার উপস্থিতিতে ছড়ায় সহজাত উষ্ণতা।

প্রশ্ন করি, ‘আর ইউ মরোক্কান, নাজিহা ? ইউ হ্যাভ অ্যা ভেরি প্রিটি মুসলিম নেইম ?

স্বচ্ছন্দে সে জবাব দেয়, ‘আমার ফ্যামিলি আন্দুলিশিয়ার মরিস্কোস্। বর্তমানে ক্যাথলিক-খ্রিস্টান হলেও আমাদের পূর্বপুরুষেরা ছিলেন মুসলিম। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়স্বজনরা এখনও বসবাস করছেন মরক্কোতে, অ্যান্ড আই মাস্ট সে দে আর ইনডিড মুসলিম।’

আমরা মরিস্কোস সংস্কৃতি নিয়ে কথাবার্তা বলি। জানতে পারি যে, মরিস্কোসরা হচ্ছেন ধর্মবিশ্বাসে মুসলমান, কিন্তু স্পেনের আন্দুলিশিয়ায় মুসলিম শাসনের অবসান হলে, তারা প্রাণের ভয়ে সামাজিকভাবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন, কিন্তু আড়ালে আবডালে তাদের পূর্বপুরুষরা বহাল রাখছিলেন ইসলামিক আচার-আচরণ। বিষয়টা বেশি দিন গোপন রাখা সম্ভব হয়নি। জানাজানি হতেই স্প্যানিশ রাজা মরিস্কোসদের ঘরবাড়ি ধনদৌলত কেড়ে নিয়ে বহিষ্কার করেছিলেন।

নাজিহার সঙ্গে আমার বাতচিতের তামাদি হলে পর ব্রিয়না জানতে চায়, ‘উড ইউ গাইজ লাইক টু জয়েন আস ফর অ্যা ড্রিংক অ্যান্ড পারহেপ্স ডিনার ? আমরা চেজ ব্রাহিমের সরাইয়ের দিকে যাচ্ছি।’

জবাব না দিয়ে নাজিহা তার সবুজাভ আভার অসামান্য চোখ দুটি তুলে ডানকানের দিকে তাকায়। তিনি নার্ভাসভাবে হেসে বলেন, ‘লেট মি শেয়ার উইথ ইউ অ্যা পিস অব পার্সন্যাল নিউজ। আমরা আজ কুতুবিয়া গার্ডেনে বেড়াতে গিয়ে পরস্পরকে কথা দিয়ে এনগেজ হয়েছি… সো…।’

ডানকান কী কারণে জানি তোতলাতে শুরু করেন, আমরা শিষ্টাচারসম্মতভাবে তাদেরকে কংগ্রাচুলেট করি। হঠাৎ করে বাঁধভাঙ্গা জলের মতো ডানকানের চোখমুখে উথলে ওঠে আবেগ, কেঁপে ওঠে তাঁর কণ্ঠস্বর, তিনি নাজিহার গলায় পরা টারকুইজের নেকলেসটি দেখিয়ে বলেন, ‘মরিস্কোসদের সংস্কৃতিতে এনগেজমেন্ট রিং দেওয়ার পরিবর্তে বাগদত্তাকে নেকলেস দেওয়ার রেওয়াজ আছে। এ নেকলেসের প্রতিটি পাথর… ইউ সি অল দিস রাফ-কাট টারকুইজ, ব্ল্যাক মাইকা, গ্রিন হর্নব্লেড ও ক্রিমসন স্যান্ডস্টোন প্রভৃতি পাথর আমি সংগ্রহ করি ওয়াইয়োমিং-এর গ্র্যান্ড টিটন পর্বতে রক-হান্ট করার সময়। একজন নেটিভ আমেরিকান শ্যামানকে দিয়ে বিশেষ ডিজাইনে নেকলেসটিও তৈরি করিয়েছিলাম, তারপর থেকে অনেক বছর ধরে সন্ধান করছি সত্যিকারের আপনজনের। টুডে লর্ড অলমাইটি ইজ গুড টু মি, দেখো কাকে পেয়েছি, নাজিহা রিয়েলি ডিজার্ভস অ্যান অরিজিন্যাল নেকলেস লাইক দিস।’

আমরা ফের তাদের অভিনন্দন জানাতে গিয়ে দেখি, মেঘে মেঘে আবছা হয়ে ফোটা রঙধনুর মতো নাজিহার চোখমুখ থেকে ছড়াচ্ছে খুশি চাপা উচ্ছ্বাস। বলি, ‘গাইজ, এনজয় ইয়োর টাইম টুগেদার। সি ইউ অ্যারাউন্ড দেন।’

নাজিহা ও ডানকান রোস্তোরাঁর বাগিচায় গাছপালার আড়ালে চলে গেলে আমরা পরস্পরের দিকে ইঙ্গিতপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাই, কিন্তু কিছু বলি না, ফের নীরবে পা চালাই।

পা-কয়েক সামনে বাড়তেই আমরা এসে পড়ি কাচের বয়ামভর্তি হরেক রকম ভেষজে পরিপূর্ণ একটি দোকানের সামনে। হিজাব পরা মহিলা-দোকানি একটি তরুণের সঙ্গে চুটিয়ে গল্প করছেন। আর স্টিরিওতে বেজে চলছে চেনা লিরিক, ‘গার্ল, পুট ইয়োর রেকর্ডস অন/টেল মি ইয়োর ফেভারিট সং/ইউ গো এহেড অ্যান্ড লেট ইয়োর হেয়ার ডাউন…।

ব্রিয়না গানটি শুনে দাঁড়িয়ে পড়ে বলে, ‘হাউ ইন্টারেস্টিং, আমি কখনও ভাবিনি, মারাকেশের গুইলুজে এসে ইংলিশ সিংগার অ্যান্ড সং-রাইটার কোরিন বেইলি রে-এর গান শুনব।’ আমাদের কথাবার্তা বোধ করি দোকানির কানে গেছে। তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে আমাদের দোকানে ঢুকতে আহ্বান জানান।

সৌজন্যবশত আমরা দোকানটিতে ঢুকি। কিছু একটা কিনলে কথাবার্তা জমে ওঠার সম্ভাবনা থাকে তাই আল আরকুন বা নিদ্রাহীনতার ভেষজ উপশম খুঁজি। মহিলা আমার ভুলভাল অ্যারোবিকের ইংরেজি তর্জমা করে বলেন, ‘আই সি মিস্টার, ইউ আর সাফারিং ফ্রম ইনসোমোনিয়া।’ তিনি একটি বয়াম থেকে ‘খাঝামা’ নামে একটি বনাজি ঔষধ শুঁকতে দেন। ল্যাভেন্ডারের সুঘ্রাণ ছড়ানো ওষধিটি আমার পছন্দ হলে খানিকটা কিনে আমরা বেরিয়ে আসি। সঙ্গে সঙ্গে পেছন থেকে ভেসে আসে যুগলকণ্ঠে চাপা হাসির আওয়াজ। ব্রিয়না আমার কব্জি চেপে দিয়ে বলে, ‘ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড, দে আর ইন লাভ।’ তার অনুমান সম্পর্কে আমি ঠিক নিশ্চিত হতে পারি না, তবে ইচ্ছা হয়, একবার পেছন ফিরে তাকাতে।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button