আর্কাইভভ্রমণ গদ্য

স্ট্যান্ডিং রক, নক্সী বাঁশরী ও মুখোশ পরা মানুষ

মঈনুস সুলতান

দিন চারেক ধরে ফ্লোরিডায় আমেরিকার আদিবাসীদের মিউজিক ফেস্টিভ্যাল নিয়ে মজে আছি। আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষজন যুক্তরাষ্ট্রে ‘নেটিভ আমেরিকান’ বা ‘আমেরিকান ইন্ডিয়ান’ নামে পরিচিত। এদের নৃত্যগীতের এই বিচিত্র জলসাটি আয়োজিত হয়েছে মেলবোর্ন শহরের প্রান্তিকে, উইকাহাম নামক বিরাট পার্ক সংলগ্ন গাছ-বিরিক্ষ-হ্রদ ও হরিণে ভরপুর একটি উপবনে। আদিবাসীদের হরেক কিসিম গোত্র থেকে আগত নানা ধরনের সমঝদাররা উপবনে ক্যাম্পিং এর কায়দায় তাঁবু খাটিয়ে দিন গুজরান করছেন। আমি তাদের সঙ্গে শরিক হয়ে হাল্কা একটি তাঁবুতে ডেরা বেঁধেছি।

ভরদুপুরে আয়োজিত হয়েছে ড্রাম সার্কোলের। হ্যান্ড-ড্রামের বাদনে পরিবেশ উতরোল হয়ে উঠেছে। দর্শক-শ্রোতাদের অনেকেই নাচছেন আলাদা আলাদাভাবে। তাদের শরীরী সঞ্চালনে ফুটে উঠছে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের নৃত্যশৈলী। কিছু নাচিয়ে দর্শক সমবেত নৃত্যে তৈরি করেছেন অর্ধবৃত্তের আকৃতি, তাতে শামিল হয়েছে বাচ্চারাও। তাদের সুরছন্দে ডাইনামিক দেহগুলোর দিকে তাকিয়ে ঠিক বুঝতে পারি না, শত বছর আগে আদিবাসীদের জীবনে ঘটে যাওয়া বে-ইনসাফের বিরুদ্ধে এরা কী নৃত্যে প্রকাশ করছেন প্রতিবাদ, নাকি তাদের মুদ্রায় বাঙময় হয়ে উঠছে প্রার্থনার আকুতি ?

  নাচতে নাচতে একটি নারী দেহ বেশ খানিকটা বাঁকা হয়ে পরিসরে ছড়াচ্ছে তার উচ্ছ্বসিত যৌবন। মেয়েটি পরে আছে গোলাপি রঙের সিল্কি সানড্রেস। আমার দিকে পেছন ফিরে নাচছে, তাই আমি তার মুখটি দেখতে পাই না, কিন্তু শরীরী মুদ্রার একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিকে ভারি চেনা মনে হয়। ঘাসে ফুটে উঠছে বাতাসে উড়ু উড়ু সানড্রেসে মোড়া ত্রিভঙ্গে শরীরের ক্রমশ বাঁকাচোরা হওয়া লীলারত ছায়া। তার দৈহিক উচ্ছ্বাস এত জ্যামিতিক হয়ে ওঠে যে, মনে হয়, একটি ফ্লেমিঙ্গ পাখি যেন উড়ে যেতে যেতে তালাশ পেয়েছে নরম ঘাস-বীজে ভরপুর প্রান্তরের। আমি ক্যানভাসের ফ্লোল্ডিং চেয়ারটি গুটিয়ে নিয়ে তা স্ট্র্যাপে পিঠে ঝুলিয়ে উঠে পড়ি।

  নৃত্যরতা এ নারীকে সম্মুখ থেকে এক নজর অবলোকন না-করলে যেন চলছে না। আমি ঘুরে কয়েক কদম সামনে বাড়ি। মুখটি এবার পরিষ্কারভাবে দেখতে পাই। চিনতেও কোনও অসুবিধা হয় না। কিন্তু তৎক্ষণাৎ তার নামটি মনে পড়ে না। বড্ড অস্বস্তি হয়, নামটি মনে ফিরে না-আসা অবধি আমি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাকে হ্যালো বলতে চাই না। তো চটজলদি মিউজিক মাইফেলের মঞ্চকেন্দ্রিক পরিসরটি ছেড়ে সংলগ্ন উপবনের দিকে হাঁটি।

পাম গাছের কুঞ্জবীথি পেরুতেই মোরাম বিছানো পথরেখা ভরে ওঠে ফুলের স্মৃতিপ্রবণ সৌরভে। পায়ে চলা সংকীর্ণ পথের দুপাশে ফুটছে নানা বর্ণের সুইট আলিসুম ফ্লাওয়ার। এ প্রজাতির ফুলের সঙ্গে আমি পরিচিত, এক সময় সাভানা শহরে আমাদের বাংলো-বাড়ির আঙিনায় এদের উদ্বেলিত হয়ে ফুটে উঠতে দেখেছি। কিন্তু আলিসুমদের হরেক প্রজাতিতে যে এতটা বর্ণবৈচিত্র্য হয় তা জানতাম না। যেতে যেতে চোখে পড়ে, কিছু পাপড়ির বর্ণ স্যামোন মাছের লালচে-কমলালেবু রঙের সুস্বাদু মাংসের মতো। তাতে বসে আছে গুচ্ছ গুচ্ছ নীল বর্ণের প্রায় বিরল ফ্লোরিডা ব্লু বাটারফ্লাই। আমি ফুলে তির তির করে ডানা কাঁপানো প্রজাপতিগুলোর দিকে তাকিয়ে একটু আগে যে নৃত্যরতা নারীকে অবলোকন করেছি, তার নামটি স্মৃতিতে ফিরিয়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করি, কিন্তু সফলতা আসে না।

আজকাল মাঝেমধ্যে আমার বিস্মরণ হয়, ডাক্তারেরা এ রোগকে মাইল্ড ডাইমেনশিয়া বলেন, তারা বিশেষ একটা গা করেন না, মৃদু হাসেন, কোনও ওষুধ-বিষুধের বিধান দেন না। ডাইমেনশিয়া অপরাধ নয়, তবে আমি সচেতন যে, এ ব্যাধি আমাকে হামেশা ফেলে অস্বস্তিকর পরিস্থিতিতে। এর একটা বিহিত করতে আমি দাঁড়িয়ে পড়ে মেয়েটির সঙ্গে কোথায় কোন পরিবেশে দেখা হয়েছিল―তা ভাবতে শুরু করি।

হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি সরোবরের পাড়ে। জলে ভাসমান বৃক্ষে বসে আছে একটি বুনোহাঁস ও পাঁচ-পাঁচটি কচ্ছপ। এ দৃশ্যপটের দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়, দিনযাপনে কিছু আকাক্সক্ষা প্রবল ইচ্ছাশক্তিতেও বাস্তবায়িত করা যায় না, ইট সিম্পলি ডাজন্ট ওয়ার্ক। যেমন আমি চাইলেই বিস্মরণ অতিক্রম করে মুছে যাওয়া স্মৃতিকে কিন্তু ফিরিয়ে আনতে পারি না। এই কথাটি হাঁস ও কচ্ছপদের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। তাদের যদি অন্তর থাকে, এবং সেখানে যদি আমার সঙ্গে কমিউনিকেট করার তীব্র বাসনা থাকে, তাহলেও তারা আমার ভাষায় কথা বলতে পারবে না, ইটস্ সিম্পলি নট পসিবল। এ মুহূর্তে আমি সরোবরে যা দেখলাম, তাও হয়ত তলিয়ে যাবে বিস্মরণের অন্তরালে। এ দৃশ্যপটে এমন এক ধরনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ইন্দ্রজাল ফুটে আছে যে, ইচ্ছা হয়, তাকে স্মৃতিসত্তায় ধারণ করে থাকি আরও কিছুকাল। আমি দাঁড়িয়ে পড়ে ইমেজটি টুকে রাখার জন্য নোটবুক বের করি।

   একটি-দুটি বাক্য লিখতে গিয়ে খেয়াল হয়, দাঁড়িয়ে আছি বিচিত্র এক বৃক্ষের সামনে। ফিগ প্রজাতির তরুবরটি আহা মরি রকমের সুদর্শন কিছু না। কিন্তু নিরিখ করে তাকিয়ে বুঝতে পারি, গাছটিকে ডালপালায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আরেকটি বৃক্ষ। লতানো বৃক্ষটি পরগাছা হালতে আদি ফিগ গাছটি থেকে সংগ্রহ করছে প্রয়োজনীয় সঞ্জীবন। মূল বৃক্ষটি চাইলেও পরগাছা উদ্ভিদের হাত থেকে নিস্তার পেতে পারে না, এ ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে প্রকৃতিতে যুগ যুগান্তর ধরে। আমি নোটবুকে ফের আরেকটি বাক্য যোগ করি, দিস ইজ দ্য ওয়ে ইট ইজ, দেয়ার আর থিংকস্, উই ক্যান্ট রিয়েলি চেঞ্জ ইফ উই ওয়ান্ট।

শামান ড্রামের মেঘদল বিস্ফোরিত আওয়াজে আমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। সাথে সাথে জনান্তিকে কারা একত্রে ফুঁকে ওঠে একাধিক শঙ্খ। বুঝতে পারি, দুপুরের অনুষ্ঠানের তামাদি হলো। মাইক্রোফোনে লাঞ্চের দীর্ঘ বিরতির কথা ঘোষিত হয়। আদিবাসীদের মিউজিক মজমার মঞ্চ থেকে বেশ দূরে―উপবনের এক নিবিড় মহলে চলে এসেছি। কোনও সংকটে পড়লে আমার মধ্যে এভোয়ডেন্সের প্রবণতা আছে। নৃত্যে নিমগ্ন হওয়া নারীটির নাম কিছুতেই মনে পড়ছে না। এ হালতে তার মুখোমুখি হতে চাই না, তাই ঘুরে বেড়াচ্ছি দূরে। এতে করে সংকট কিন্তু কাটবে না। বাস্তবতাকে মোকাবিলা না-করে উপায় নেই। তাই ফিরে আসি মঞ্চের পরিসরে।

অনেকেই ক্যাম্পগ্রাউন্ডের তাঁবু বা ক্যাম্পার ভ্যানে ফিরে গেছেন আহার ও বিশ্রামের প্রয়োজনে। বাকিরা হয়ত মোবাইল ফুড কার্ট থেকে কিনছেন হাল্কা খাবার। মঞ্চের সামনে লোকজন তেমন নেই। তবে একজন ঘোড়াপ্রিয় নেটিভ আমেরিকান নিয়ে এসেছেন তার পোষা মিনিয়েচার অশ্বটি। সাদা রঙের তুলতুলে পশমে মোড়া মিনিয়েচার ঘোড়াটি আকারে তাজতনা পাটনাই ছাগলের চেয়ে সামান্য বড়। একটি বাচ্চা-মেয়ে পিঠে চড়েছে, তার ঠিক পেছনে মুখ ভার করে বসে আছে পোষা কুকুরটি। আরেকটি ছোট্ট মেয়ে, সম্ভবত পিঠে চড়া মেয়েটির বড় বোন, কনফিডেন্টলি ধরে আছে লাগাম। খানিক দূরে দাঁড়িয়ে মা-বাবা ফটাফট তুলছেন ছবি।

আমি ঘোড়া-কেন্দ্রিক জটলা পেরিয়ে চলে আসি মেলার মতো নানা রকমের দোকানপাটে জমজমাট প্রাঙ্গণে। তাঁবুর তলায় বসেছে মূলত আদিবাসীদের হস্তশিল্পের ডিসপ্লে সমেত বর্ণাঢ্য কিছু স্টল। তাতে পণ্য আছে হরেক রকমের, কিন্তু খদ্দের নেই তেমন। শুধু ফুড কার্টগুলো ঘিরে জমে উঠেছে হাল্কা ভিড়। ওদিকে আড়চোখে তাকাই, যার নাম মনে করতে পারছি না, তাকে দেখতে না-পেয়ে স্বস্তিবোধ করি। ফুড কার্টের পেছন দিকের তুলনামূলকভাবে বড়সড় তাঁবুতে চলছে আদিবাসীদের জীবন-যাপনের তথ্য সংক্রান্ত ওয়ার্কশপ। একটি তাঁবুর দরোজায় ‘স্ট্যান্ডিং রক’ শব্দ দুটি লেখা দেখতে পেয়ে আমি ঢুকে পড়ি।

এ তাঁবুতে জড়ো হয়েছেন জনাদশেক মানুষ। স্ট্যান্ডিং রক বিষয়ক তথ্য যিনি দিচ্ছেন, তাঁর নাম ফাইটিং বুল ডেভিড ডেলোরা। মানুষটিকে খানিক যেন চেনা মনে হয়। না, তাঁর সঙ্গে আমার কখনও দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি, এ ব্যাপারে আমি হানড্রেড পার্সেন্ট নিশ্চিত। ফাইটিং বুল এগিয়ে এসে হাসিমুখে ‘হ্যালো’ বলেন। তাঁর চোখেমুখে জানাশোনা মানুষের অভিব্যক্তিতে সচরাচর যে ধরনের আলামত ফুটে ওঠে, তা কিন্তু নেই। ভাবি, ঘটনা কী ? তাঁকে পরিচিত মনে হচ্ছে কেন ?

আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের স্ট্যান্ডিং রক নামক স্বশাসিত রিজারভেশনটির অবস্থান নর্থ ও সাউথ ডেকোটা অঙ্গরাজ্য দুটির বেশ খানিকটা অঞ্চল নিয়ে। ওখানে মূলত লাকোটা অয়য়াটে সম্প্রদায়ের বাস। তাঁবুটির দেয়াল লাকোটা গোত্রের বয়ন করা ঐতিহ্যবাহী চাদর দিয়ে সাজানো। তাতে সাদা কাগজে ব্লোআপ করা কিছু তথ্য পিন দিয়ে আটকানো হয়েছে। ফাইটিং বুল ল্যাপটপে তাঁর গোত্রের যন্ত্রসংগীত বাজিয়ে সবাইকে তথ্যগুলো পড়ে নিতে অনুরোধ করেন।

 আমরা হেঁটে হেঁটে চাদরে সাঁটা তথ্যগুলোতে চোখ বুলাই। আদিবাসীদের সঙ্গে শ্বেতাঙ্গ প্রশাসনের সাম্প্রতিক দ্বন্দ্বের সূত্রপাত হয় তাদের সার্বভৌম ভূমিতে বয়ে চলা মিসৌরী নদীতে পাঁচটি বাঁধ নির্মিত হলে। এর ফলশ্রুতিতে আদিবাসীদের জনপদ প্লাবিত হয়, তারা ক্ষতিপূরণ দাবি করে, এবং তা আদায় না-হলে প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় প্রতিবাদ আন্দোলন। ২০১৪ সালে একই এলাকায় আদিবাসী ট্রাইবাল গভর্নমেন্টের অনুমতি না-নিয়ে নির্মাণ করা হয় ১,১৩৪ মাইল দীর্ঘ এক্সেস পাইপলাইন। যেসব বিশেষজ্ঞরা পরিবেশের ওপর এ পাইপলাইনের নেগেটিভ প্রভাব তথা আবহাওয়া দূষণ নিয়ে স্টাডি করেছেন, তাদের সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে যে, দশ মিলিয়ন মোটরকার থেকে নিসৃত হয় যে দূষিত ধোঁয়া, তার সঙ্গে পনেরোটি কয়লার খনিজাত দূষণকে মিশ্রিত করলে তা পাইপলাইনজনিত দূষণের সমকক্ষ হবে।

গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো পাইপলাইন আদিবাসীদের প্রকৃতি পূজার পবিত্র ভূমি ও গোরস্তান ভেদ করে গেলে, তারা খোঁড়াখুঁড়ির বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানান। ২০১৬ সাল থেকে তাদের লাগাতার প্রতিবাদ ও আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন কিছু প্রগতিশীল এক্টিভিস্ট, সংগীতশিল্পী ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। বুলডোজার দিয়ে পবিত্র ভূমি ও কবরস্থান ভাঙচুর করার সময় কিছু লাকোটা আদিবাসী স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রের সঙ্গে তাদের শরীর চেন দিয়ে বেঁধে প্রতিবাদ করেছিলেন। জোরজবরদস্তিতে তাদের গ্রেফতার করে রিমুভ করা হয়। সমবেত প্রতিবাদীদের  চোখেমুখে মরিচের চূর্ণ স্প্রে করা হয়। এতেও আদিবাসীরা না-হটলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুকুর দিয়ে নৃশংসভাবে তাদের আক্রমণ করা হয়।

 আমি তথ্যগুলো তর্পণ করতে করতে বার বার ফাউটিং বুল ডেভিড ডেলোরার দিকে তাকাই। হঠাৎ করে একটি স্মৃতি যেন অবচেতন থেকে ঘাই মেরে ওঠে। ফাইটিং বুল মহোদয় একটি চলমান বুলডোজারের সামনে দাঁড়িয়ে বাঁকা হয়ে বাজাচ্ছিলেন বাঁশরী। বুলডোজারের চকচকে ব্লেডে পরিষ্কার হয়ে ফুটেছিল তাঁর প্রতিবিম্ব। দৃশ্যটি কোনও এক এক্টিভিস্টের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। যা পরিশেষে ভেসে বেড়িয়েছিল কিছু দিন সামাজিক মাধ্যমে। আমি ওই সূত্রে তাঁর প্রতিবিম্বিত ছবিটি দেখেছিলাম।

যন্ত্রসংগীতের সিডি অফ করে দিয়ে তিনি একটি ব্রিফকেস খোলেন। তাতে সাজিয়ে রাখা চাকতি চাকতি করে কাটা একটি গাছের প্রশাখা। আমরা জানতে পারি যে, এ বৃক্ষকে লাকোটারা পবিত্র বিবেচনা করে থাকেন। এ ধরনের একটি বৃক্ষ তিনি তাঁর পিতামাতার যুগল গোরে লাগিয়েছিলেন। বুলডোজারে কবরস্থান খোঁড়াখুঁড়ি করে পাইপলাইনওয়ালারা পুলিশ প্রহরায় ট্রাকে করে কাটা গাছটি সরিয়ে নিয়ে যায়। এ গাছ ব্যক্তিগত সম্পত্তি দাবি করে ফাইটিং বুল আদালতে মামলা করেন। দীর্ঘ আড়াই বছরের আইনি প্রক্রিয়ার পর উচ্চ আদলত গাছের অবশিষ্টাংশ তাঁর কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। শ্বেতাঙ্গ মালিকানাধীন একটি উডচিপস্ ফ্যাক্টরি অতঃপর তাঁকে চাকতি করে কাটা কয়েকটি টুকরা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

গাছের চাকতিগুলো পবিত্র, তাই ছবি তুলতে নিষেধ করে ফাইটিং বুল যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের কাছে লেখা একটি প্রতিবাদ পত্র টেবিলে মেলে ধরেন। আমরা নীরবে তাতে স্বাক্ষর দিয়ে আমাদের সমর্থন যুক্ত করি।

যুক্তরাষ্ট্রের শ্বেতাঙ্গ প্রভাবিত প্রশাসন ও সংস্কৃতির মূল ধারার সঙ্গে আমেরিকার আদিবাসী নেটিভ আমেরিকানদের দ্বন্দ্বের শেষ কোথায়, বিষয়টি ভাবতে ভাবতে বেরিয়ে আসি স্ট্যান্ডিং রকের তাঁবু থেকে। দোকানপাটের প্রদর্শিত পণ্যের দিকে চোখ রেখে একটু হাঁটি। হ্যাট মাথায় দাড়িওয়ালা বয়স্ক এক লোকের সঙ্গে চোখাচুখি হয়। তিনি হাসিমুখে আমাকে তাঁর বাঁশির দোকানে ঢুকতে আমন্ত্রণ জানান।

মানুষটি সদালাপি। তাঁর দোকানটিও সাজানো বিচিত্র রকমের বাঁশরী দিয়ে। আদিবাসী আমেরিকানদের ‘নেজ পার্স’ গোত্রের মানুষ ইনি। বাঁশি নির্মাতা হিসেবে ছোটখাটো এ ব্যবসাটি চালাচ্ছেন বছর বিশেক ধরে। বৃক্ষঘাতক তিনি নন, অর্থাৎ জীবিত গাছের ডাল কেটে বাঁশি তৈরি করেন না। তবে বনানী থেকে সংগ্রহ করেন মরা ডাল। এবং মৃত বৃক্ষশাখাকে বাঁশিতে রূপান্তরিত করে তাকে প্রদান করেন―তাঁর ভাষায়, ‘নিউ লাইফ এন্ড নিউ পারপাস।’

  তাঁর পণ্যসম্ভারের ভেতর বিচিত্র একটি বাঁশরী আমার নজর কাড়ে। গাছের ফাঁপা ডালকে তিনি এমনভাবে কুঁদেছেন যে, বাঁশিটির ডগায় তৈরি হয়েছে একটি কাঠবিড়ালির মৃন্ময় মূর্তি। জানতে পারি, আইডহ অঙ্গরাজ্যের একটি বনানীতে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি বাঁজপোড়া একটি মৃত বৃক্ষের সন্ধান পেয়েছিলেন। বজ্রাঘাতে গাছের শাখাপ্রশাখার সঙ্গে পুড়ে মরেছিল একটি কাঠবিড়ালি। তার পোড়া দেহকে সৎকার করে অতঃপর তিনি বাঁশিটি তৈরি করেন; এবং আচানক এ শিল্পদ্রব্যে মৃত কাঠবিড়ালির মূর্তি কুঁদে তার স্মৃতিকে জিইয়ে রাখার চেষ্টা করছেন।

হ্যাট মাথায় বয়স্ক মানুষটির সঙ্গে আমার বাতচিত জমে ওঠে। এ ভদ্রসন্তানের শরীরে নেস পার্স গোত্রের বেশ খানিকটা রক্ত আছে, তাঁর পিতা ছিলেন হানড্রেড পার্সেন্ট নেস পার্স, তবে জননী ছিলেন কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান। ১৮৭৭ সালে নেস পার্সদের আদি ভূমি―বর্তমানের অরিগ্যান অঙ্গরাজ্যে তাদের রিজারভেশনের জমিজমায় স্বর্ণ আবিষ্কৃত হলে, তৎকালীন শ্বেতাঙ্গ প্রশাসক তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আইডহ অঙ্গরাজ্যের এক বিরান ভূখণ্ডে চলে যেতে হুকুম করেন। ফলশ্রুতিতে যুক্তরাষ্ট্রের সৈনিকদের সঙ্গে নেস পার্সদের সশস্ত্র সংঘর্ষ বাঁধে। তাতে মৃত্যু হয়েছিল তাঁর পিতামহ ও পিতামহীর, তবে বেঁচে ছিলেন আড়াই বছরের শিশুসন্তান তাঁর পিতা। স্থানীয় এক খ্রিস্টান মিশনের এতিমখানায় অতঃপর তাঁর পিতা বেড়ে ওঠেন। তিনি বিবাহিত হয়েছিলেন এক কৃষ্ণাঙ্গ নারীর সঙ্গে।

তো বাঁশিনির্মাতা যুবক বয়সে ফিরে যান আইডহো অঙ্গরাজ্যে তাঁর পিতার সম্প্রদায় নেজ পার্সদের গ্রামে। ওখানে তিনি শেখেন বাঁশি বানানোর কলাকৌশল। আমাদের বাতচিতের উপসংহারে তাঁর কাহিনি আমার কোনও লেখাজোকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুমতি চাই। আমার আগ্রহে তিনি সম্মতি প্রকাশ করেন, তবে কেন জানি তাঁর নামটি ব্যবহার না-করার জন্য অনুরোধ করে গুডবাই জানান।

বাঁশিওয়ালার দোকান থেকে বেরোতেই আমাকে স্ট্রাইক করে তীব্র ক্ষুধা। ফুড কার্টগুলোর ঝাঁপি বন্ধ দেখে হতাশ লাগে। বুঝতে পারি, মিউজিক মাইফেলের মেলাতে এখন ডাউন টাইম চলছে, অর্থাৎ বেচাবিক্রির সম্ভাবনা নাই দেখে দোকানিরা ঝাঁপ ফেলে দিয়ে তাঁবু বা ক্যাম্পার ভ্যানে ফিরে গেছেন। আবহাওয়া চমৎকার, কেউ কেউ হয়ত ক্যাম্পগ্রাউন্ডের কোনও গাছের ডালায় দড়ির হ্যামোক টাঙিয়ে উপভোগ করছেন অপরাহ্ণের সিয়াস্তা বা ঝিমুনি। হেঁটে হেঁটে অজান্তে চলে আসি আমার প্রিয় ফুড কার্টটির কাছাকাছি। দেখি, কার্টের মালকিন ক্যানভাসের চেয়ারটি প্রসারিত করে তাতে রিল্যাক্স হালতে বসে ট্র্যানজিসটার রেডিওতে শুনছেন সংগীত। গেল দুদিনের মিথস্ক্রিয়ায় ফুড কার্টওয়ালি এই নারীর সঙ্গে আমার বেশ খানিকটা জানাশোনা হয়ে গেছে।

বয়সে ইনি আমারই সমবয়স্ক। এক সময় অক্লহোমার দিকে একটি চেইন রেস্টুরেন্টে ক্যাটারিংয়ে কাজ করতেন। রিটারমেন্টের বয়স হওয়ার আগেই অবসর নিয়ে মোবাইল ফুড কার্টের ব্যবসা খুলেছেন। আমার মতো অযথা ঘুরে বেড়ানো ও গান শোনা পছন্দ করেন ইনি। তো কোথাও গানের মাইফেল বা মেলার সংবাদ পেলে মোবাইল ফুড কার্টটি ড্রাইভ করে গিয়ে হাজির হন। খাবার বিক্রি করতে করতে শোনেন লাইভ মিউজিক। বিক্রিবাট্টা থেকে মুনাফা হলে মেলার পর ওই এলাকায় ঘোরাফেরাও করেন, ঢুঁ মারেন দর্শনীয় স্থানগুলোতে।

গতকাল এ মিউজিক মজমাকে উদ্দেশ করে আমি ফ্লোরিডার মেলবোর্ন শহরের দিকে ড্রাইভ করছিলাম। দক্ষতার অভাবে আমি আইফোনে জিপিএস ইত্যাদি ব্যবহার করি না। হাইওয়েতে সঠিক এক্সিট পেতে অসুবিধা হচ্ছিল। তো মানচিত্র খুঁটিয়ে দেখার জন্য থামি একটি রেস্ট-স্টপে। তখনই সচেতন হই যে, মানচিত্রে অত্যন্ত ছোট ফন্টে ছাপা রোড ডিরেকশন দৃষ্টিস্বল্পতার জন্য আমার পক্ষে পড়া সম্ভব নয়। এ যাত্রায় সঙ্গে করে ম্যাগনেফাইয়িং গ্লাসও আনিনি। কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না।

দেখি, পার্কিং লটে ফুড কার্টটি দাঁড় করিয়ে তার বনেটের ওপর ম্যাপ মেলে ধরে ম্যাগনেফায়িং গ্লাস দিয়ে তা নিরিখ করছেন এ মহিলা। কাছে গিয়ে তাঁর সাহায্য প্রার্থনা করি। মহিলা আতশী কাচ গুটিয়ে চোখ তুলে আমাকে দেখে বলেন, ‘সিমস্ লাইক ইউ ডোন্ট ইউজ আইফোন অর জিপিএস ?’ প্রতিক্রিয়ায় আমি মিন মিন করে বলি, ‘দ্যাটস্ হোয়াই লুকিং ফর আ লিটিল হেল্প।’ তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘আই ডোন্ট নো হাউ টু ইউজ জিপিএস ইদার, আই গেস উই আর সিমিলার, আমরা দুজন আদতে বসবাস করছি গেল শতকে, সো উই ক্যান বি  ফ্রেন্ডস্।’ তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘মাই নেইম ইজ লিন্ডা।’ কথায়বার্তায় জানতে পারি, লিন্ডাও তাঁর ফুড কার্ট নিয়ে যাচ্ছেন মেলবোর্ন শহরে মিউজিকের মজমার দিকে। তিনি অক্লহোমা অঙ্গরাজ্যের বার্টলেসভিল শহর থেকে অভারনাইট ড্রাইভ করে আসছেন। তাঁর বিরতির প্রয়োজন।

আমি ভেন্ডিং মেশিন থেকে পিটা-চিপস্ ও আইস টি নিয়ে এসে মোবাইল ফুড কার্টের জানালায় তাঁর পুরুষ-সঙ্গীকে দেখতে পেয়ে হাত নাড়ি। তিনি রেসপন্স না করে সরে যান। মানুষটি স্পষ্টত মুখে একটি ন্যাচারাল কালারের মুখোশ পরে আছেন। একটু খটকা লাগে! লিন্ডা যেন অজুহাত দিচ্ছেন, এমন ভঙ্গিতে বলেন, ‘লুক, মাই কমপেনিওন ইজ ভেরি শাই, অপরিচিত কারও সঙ্গে কথাটথা বলা তেমন একটা পছন্দ করে না। নেভার মাইন্ড।’

যুক্তরাষ্ট্রকে বলা হয় ফ্রি কানট্রি, এখানকার কোনও কোনও প্রাইভেট সমুদ্রসৈকতে যেমন বিবস্ত্র হয়ে হাঁটাচলা করা যায়, তেমনি কেউ দিনদুপুরে মুখোশ পরে ঘোরাফেরা করলেও অন্য কারও এ বিষয়ে ভাবিত হওয়া অনুচিত। তবে লিন্ডার সঙ্গে গালগল্প করতে করতেও আমার খটকা কাটে না। কথাবার্তায় লিন্ডা ভারি ফ্রাংক। তিনিও আমার মতো রিস্টওয়াচে সময় দেখেন, আইফোন নয়―রেডিওতে শোনেন সংবাদ। আমি পত্রিকার প্রিন্ট ভার্সন পড়তে পছন্দ করি শুনে তিনি মৃদু হেসে বলেন, ‘আই গেস উই বোথ আর স্টিল লিভিং ইন লাস্ট সেঞ্চুরি।’ আইস টি’র পুরো ক্যান শেষ করে তিনি চকোলেট বার থেকে বড়সড় একটি টুকরা ভেঙে আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘ইটস্ টাইম টু ড্রাইভ এগেইন। তুমি আমার ফুড কার্টটি ফলো করো।’

লিন্ডা কানের কাছে ট্রানজিসটার লাগিয়ে সম্ভবত সংবাদ শুনছেন। এ সময় খাবার-দাবার কিছু পাওয়া যাবে না। তারপরও মনে হয় তাঁকে একটু হ্যালো বলি। এগিয়ে যেতেই তিনি ট্রানজিসটারটি নামিয়ে বলেন, ‘লুকস্ লাইক ইউ আর হ্যাংরি।’ জবাবে আমি মন্তব্য করি, ‘ফুড কার্ট তো বন্ধ। খাবার না হলেও চলবে, শুধু আপনাকে হ্যালো বলতে এসেছি।’ লিন্ডা আমাকে একটি খালি চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে উঠে ফুড কার্টের জানালায় ঠোকা দেন। টুকটাক কিছু বলে ফিরে এসে জানান, ‘মাই মেইল কমপেনিয়ন ইজ হেপি টু মেক সামথিং ফর ইউ, বিন আর চিজ দিয়ে সে বরিডো তৈরি করে দিচ্ছে, একটু সময় লগবে। বসো, কথাবার্তা বলো।’

আমরা শর্টওয়েভ রেডিও শোনার অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা বলি। লিন্ডা আয়ারল্যান্ডের একটি স্টেশন থেকে বাজানো পল্লিগীতি হামেশা শুনেন। আমারও হবি হচ্ছে হিরাত বেতারে কখনও-সখনও আফগানিস্তানের তাজিক গোত্রের গান শোনা। তার পুরুষ-সঙ্গী জানালা খুলে খাবারের প্লেট বাড়িয়ে দেন। আমি উঠে তাঁর হাত থেকে প্লেটটি নিই, মানুষটি আজও পরে আছেন একটি মুখোশ, তাই আমার উপস্থিতিতে তিনি খুশি না বিরক্ত হয়েছেন ঠিক বুঝতে পারি না।

বরিডো চিবাতে চিবাতে লিন্ডার কাছে জানতে চাই, ‘সো হোয়াট কানেকশন ডু ইউ হ্যাভ উইথ নেটিভ আমেরিকান কালচার ?’ তিনি মাথা হেলিয়ে জবাব দেন, ‘নান, বাট … ইউ নো হোয়াট … তাদের সংগীত আমি খুবই ভালোবাসি। তবে আমার মেইল-ফ্রেন্ড হচ্ছে অক্লহোমার আদিবাসী কামানচি গোত্রের হানড্রেড পার্সেন্ট নেটিভ আমেরিকান।’ শুনে আমার মুখ থেকে বেরিয়ে যায়, ‘কামানচিরা মুখোশ পরে থাকতে পছন্দ করে কী ?’ জবাব দিতে গিয়ে একটু সময় নিয়ে কী যেন ভেবে অতঃপর লিন্ডা বলেন, ‘তোমাকে না-হয় খুলেই বলি, ও যুক্তরাষ্ট্রের মিলিটারিতে কাজ করেছে কয়েক বছর। ইরাকে ডিপ্লোয়েড হয়েছিল তিন বার। শেষবার রোডসাইড বোমায় তার শরীর, বিশেষ করে তার মুখ সম্পূর্ণ ঝলসে যায়। সো হি ইউজেজ আ মাস্ক টু হাইড দিস।’

লিন্ডার পুরুষসঙ্গীর ইরাক-যুদ্ধে আহত হওয়ার সংবাদ শুনে আমি আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করি। তিনি শর্টওয়েভ রেডিওর এন্টেনা গুটাতে গুটাতে বলেন, ‘মিলিটারি হসপিটালের প্লাস্টিক সার্জনরা তার মুখে বার কয়েক অস্ত্রোপচার করে, বাট ইট ডিডন্ট ওয়ার্ক। মুখের চামড়া ও মাংসপেশি এত পুড়ে গেছে যে, তা মেরামত করা যায়নি। দি ট্র্যাজেডি ইজ দ্যাট মাই মেইল-ফ্রেন্ড হেইট দ্য ওয়ার।’

শুনে আমি প্রশ্ন করি, ‘আই অ্যাম কনফিউজড্ লিন্ডা, যুদ্ধ ঘৃণা করলে সে মিলিটারিতে জয়েন করেছিল কেন ?’ লিন্ডা যেন একটু বিরক্ত হয়ে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন, ‘লুক, হোয়াট অপশন হি হ্যাড ? আদিবাসী কামানচি গোত্রের দরিদ্র হাড় হাভাতে সন্তান সে। বার্টলেসভিল শহরের একটি রেস্টুরেন্টে হ্যামবার্গার ফ্রাই করত। ওখানে আমি ক্যাটরিং এর সাপ্লাই নিয়ে যেতাম। তখন থেকেই তাকে চিনতাম। শ্বেতাঙ্গ একটি গার্লফ্রেন্ডও তার জুটেছিল। মেয়েটি তাকে বিয়ে করে সংসার করতে চেয়েছিল। তো মাই স্টুপিড মেইল-ফ্রেন্ড মিলিটারিতে নাম লেখায়।’

আমার কৌতূহল এবার উস্কে ওঠে, জানতে চাই, ‘দেন হোয়াট লিন্ডা ? মে আই আস্ক ?’ তিনি জবাব দেন, ‘মিলিটারির উপার্জন দিয়ে মেয়েটাকে সে গাড়ি-টাড়িও কিনে দিয়েছিল। বাট হোয়েন হি ওয়াজ রিটার্নড্ ফ্রম ইরাক, হিজ ফেস ওয়াজ অল বার্নড্-আপ, মেয়েটি তার মুখের দিকে তাকিয়ে এমন ভড়কে গেল যে … সে সপ্তাহ খানেকের ভেতর সম্পর্ককে ব্রেক-আপ করল।’

আমি জানতে চাই, ‘আপনার মেইল-ফ্রেন্ড তার কামানচি গোত্রে ফিরে গিয়েছিল কী ?’ লিন্ডা কপাল কুঁচকে ফের বিরক্তি প্রকাশ জবাব দেন, ‘ইউ হ্যাভ টু আন্ডারস্ট্যান্ড কামানচি কালচার, তারা ভালোবাসে দুটি জিনিস― বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ করা ও র‌্যাগেড প্রান্তরে রেকলেসলি ঘোড়া ছোটানো। ব্যাটোল ফিল্ডে আহত হওয়া সৈনিককে তারা পরাজিত কাপুরুষ বিবেচনা করে। তাদের সমাজে বোমার আগুনে মুখমণ্ডল পোড়া কোনও কাপুরুষের স্থান নেই।’

আমি হাত বাড়িয়ে লিন্ডার কব্জি স্পর্শ করে ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করার জন্য আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ জানাই, বলি, ‘আমি যুদ্ধ-বিগ্রহ পছন্দ করি না, কিন্তু আপনি আহত একজন মানুষকে সাহায্য করছেন, আপনার এ উদ্যোগকে আমি শ্রদ্ধা জানাই।’ আমার হাতখানা মুঠোয় নিয়ে লিন্ডা বলেন, ‘আই হ্যাভ মাই ওউন নিড, হ্যাভ মাই ওউন প্রেফারেন্স …। ও যখন রেস্টুরেন্টে হ্যামবার্গার ভাজত তখন থেকে আমি তাকে চিনতাম। ভালোও লাগত একটু আধটু। নয় বছর আগে আমার হাজবেন্ড আমাকে ডিভোর্স দিয়ে কম বয়স্ক একটা মেয়েকে বিয়ে করে। আই লাভ দিস কামানচি ইয়াংম্যান, খুব খাঁটি মানুষ সে। সো আই অ্যাম লিভিং উইথ হিম। মানষটির মুখ না-হয় ঝলসানোই হলো, আই ডোন্ট রিয়েলি কেয়ার।’

চিজ মেশানো ব্ল্যাক-বিন বরিডোর বিল দিতে গিয়ে ক্রেডিট কার্ড পাঞ্চ করা লিন্ডার দিকে আমি তাকাই। সাদাটে সুতি টপের ওপর ঘিয়া রঙের হাল্কা সুয়েটার পরেছেন তিনি, তাঁর খানিক চিন্তামগ্ন মুখকে ভারি সুন্দর দেখায়। ক্রেডিট কার্ডটি ফেরত নিয়ে আমি তাঁকে বলি, ‘ইউ আর ট্রুলি ওয়ান্ডারফুল লিন্ডা।’  তিনি হাত বাড়িয়ে দিয়ে ‘লাভলি টু টক উইথ ইউ, সুলতান’ বলে উষ্ণ হাগে আমাকে বিদায় জানান।

লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক

——————-

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button