আর্কাইভউপন্যাস

উপন্যাস : দুঃখকথা : হরিশংকর জলদাস

এক

‘তোমার কাছে আমার একটা যাচনা ছিল মা।’ কাতর কণ্ঠে বললেন সুমালী।

চকিত চোখে পিতার দিকে তাকালেন কৈকসী। পিতা তো তাঁর সঙ্গে এরকম ভাষায় কথা বলেন না কখনও! তাঁদের মধ্যে যা কথাবার্তা হয়, তাতে থাকে বাৎসল্য এবং পিতৃশ্রদ্ধা। পিতা আর কন্যার সম্পর্কের মধ্যে যাচনা, প্রার্থনা, ভিক্ষা―এসব শব্দ আসবে কেন ?

মাথা নিচু করলেন কৈকসী। ভাবে, দেহভঙ্গিতে পিতার কথা বুঝতে না-পারার আভাস।

সুমালী বললেন, ‘কিছু বলছো না কেন নিকষা ?’

অন্যরা কৈকসী নামে ডাকলেও মহারাজ সুমালী তাঁর আদরের এই কন্যাটিকে নিকষা বলে সম্বোধন করেন।

‘আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না বাবা!’ মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন কৈকসী।

‘কী বুঝতে পারছো না মা ?’

‘যাচনা শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন বুঝতে পারছি না!’

‘অর্থ তো জানো ?’

‘জানি বাবা। এই শব্দ দিয়ে প্রার্থনা, আবেদন, নিবেদন এমন কি ভিক্ষাও বোঝায়।’

‘তাহলে তো বাক্যটির মর্মার্থ তুমি ঠিকই ধরতে পেরেছো।’

অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে কৈকসী বললেন, ‘যাচনা শব্দটির ওই অর্থ বলেই আপনার কথার মানেটি ধরতে পারছি না বাবা!’

রাজা অথই জলে পড়ে গেলেন। মেয়ের কথাগুলি রহস্যময়, হেঁয়ালিপূর্ণ বলে মনে হতে লাগল সুমালীর।

বিহ্বল চোখে আত্মজার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া তাঁর অন্য কোনও উপায় থাকল না।

এবার কাঁদতে শুরু করলেন কৈকসী। প্রথমে ফুঁপিয়ে, পরে আকুল হয়ে।

ভেবাচেকা খেয়ে গেলেন সুমালী। মেয়ে কেন এরকম ব্যাকুল হয়ে কাঁদতে শুরু করলেন, বুঝতে পারলেন না। কন্যাকে ধমক দেবেন, না ব্যগ্র দু বাহু বাড়িয়ে বুকে জড়াবেন―সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না সুমালী। শুধু বিব্রত, ত্রস্ত চোখে কৈকসীর দিকে তাকিয়ে থাকলেন।

দ্রুত নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে মহারাজ বললেন, ‘তুমি থামো মা। থামো নিকষা। আমি তো তোমায় কষ্ট পাওয়ার মতো কোনও কথা বলিনি! তার পরও তুমি এরকম বুক ভাসিয়ে কাঁদছো কেন বুঝতে পারছি না মা!’

দ্রুত হাতে দু চোখ মুছে নিলেন কৈকসী। অভিমানক্ষিপ্ত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি আমার কাছে প্রার্থনা করলেন কেন বাবা ? আমার কাছে কোনও কিছু চাওয়ার থাকলে নির্দেশ করবেন। প্রাণ দিয়ে আপনার ইচ্ছা পূরণ করব আমি। আপনি যে আমার জন্মদাতা, প্রিয় পিতা!’

হো হো করে হেসে উঠলেন রাক্ষসরাজ সুমালী।

‘ও―! এই কথা! পাগলী মা আমার!’

‘বলুন বাবা, কী বলতে চান, মন খুলে বলুন।’

‘আমার পছন্দের লোকটিকে বিয়ে করবে তুমি নিকষা ?’

কৈকসীর ভাবনার মধ্যে এটা ছিলই না যে তাঁর পিতা তাঁকে সরাসরি বিয়ের কথা বলবেন। ভেবেছিলেন―রাজ্যপাট, প্রাসাদাভ্যন্তরের কোনও সংকটের কথা অথবা তাঁর ভাইবোন বা মায়ের ব্যাপারে কোনও বিষয়ের অবতারণা করবেন। তা না করে পিতা তাঁর পছন্দের লোকটিকে বিয়ে করতে কাকুতি করছেন।

লোকটি! তাঁর ভবিষ্য-বর লোকটি হবে কেন ? যুবক হবে না কেন ? সে নিজে যুবতী এবং অনূঢ়া। সেই সুবাদে তাঁর বরটিও তো যুবক হবার কথা! কিন্তু বাবা যে বললেন লোকটি ? ‘লোকটি’ শব্দের মধ্যে বয়স্ক লোকের অস্তিত্ব অনুমান করলে তো ভুল হবে না! তাহলে কি তাঁর পিতা তাঁকে বয়সী কারও সঙ্গে বিয়ে দিতে চান ? লোকটি নিশ্চয়ই রূপে-যৌবনে তাঁর উপযুক্ত নন। আর উপযুক্ত নন বলেই পিতার কণ্ঠে এরকম মিনতি।

পিতাকে বললেনও তা কৈকসী, ‘বাৎসল্য দিয়ে লালনপালন করেছেন আমাকে। আমি যুবতী এখন। উপযুক্ত বরের সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়া আপনার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বাবা এবং আপনি সেই দায়িত্ব পালন করতে উদ্যোগীও হয়েছেন। কিন্তু একটা ব্যাপার আমি বুঝতে পারছি না।’ বলে থেমে গেলেন কৈকসী।

মহারাজ সুমালী দ্রুত মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোন ব্যাপারটা বুঝতে পারছো না মা ?’

‘আমার বরের কথা বলতে গিয়ে লোকটি বললেন কেন ? কোনও বয়স্ক লোককে কি আপনি আমার ভবিষ্য-স্বামী হিসেবে নির্বাচন করেছেন ?’

চার কন্যার মধ্যে মহারাজ সুমালী দ্বিতীয় কন্যা কৈকসীকে বেশি ভালোবাসেন। কৈকসী বিচক্ষণতায় সবকন্যার মধ্যে সেরা। কুম্ভীনসী, পুষ্পোৎঘটা ও রাকা―সুমালীর এই তিন মেয়েও রূপসী এবং যৌবনবতী। সৌন্দর্যে এই তিন বোনের চেয়ে কৈকসী বেশটুকু বাড়া। তাঁর রূপময়তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বুদ্ধিমত্তা। রূপ ও বিচক্ষণতার সমন্বয়ে কৈকসী রাজকন্যাদের মধ্যে অতুলনীয় হয়ে উঠেছেন। মহারাজ সুমালী তাঁর এই কন্যাটির বিচক্ষণতার কথা আগে থেকেই জানতেন। তাই আজ কৈকসীর কথা শুনে অবাক হলেন না। একটি শব্দের মধ্যে থেকে যে বরটির বয়স অনুমান করে ফেলবে কৈকসী, জানতেন সুমালী। তাই ইচ্ছে করে বর শব্দটি ব্যবহার না করে ‘লোকটিকে’ শব্দ ব্যবহার করেছেন। তাতেই তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়েছে। সুমালী কৈকসীর জন্য যাঁকে স্বামী হিসেবে নির্বাচন করেছেন, আসলেই তিনি বয়স্ক, বিবাহিত এবং অনেক সন্তানের জনক।

কন্যার কথা শুনে মাথা নিচু করলেন সুমালী। তারপর কৈকসীর দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘তুমি যথার্থ বলেছো মা। যাঁকে বিয়ে করার জন্য তোমাকে অনুরোধ করছি, তিনি গৃহজীবী নন, অরণ্যবাসী। তরুণ নন, প্রবীণ। ধনৈশ্বর্য নেই তাঁর, কিন্তু তিনি জ্ঞানবান।’

‘আর শুনতে চাই না বাবা।’ পিতাকে থামিয়ে দিয়ে কৈকসী বললেন, ‘তাঁর নাম-পরিচয়টা কি বলবেন ?’

‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বলছি। তাঁর নাম না বললে চিনবে কী করে তুমি তাঁকে ? আর নাম বললে আপনাতেই তাঁর পরিচয় পেয়ে যাবে।’ ঢোঁক গিললেন মহারাজ। টানাপড়েনে পড়লে মানুষ ঢোঁক গিলে। রাজাও সংকটে পড়েছেন। বরের নাম শুনে যদি কৈকসী তাঁকে বিয়ে করতে রাজি না হন!

কৈকসী অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাঁর দিকে চেয়ে আছেন দেখে সুমালী আর ভূমিকা করতে সাহস করলেন না। সাবধানী কণ্ঠে বললেন, ‘তিনি মহামুনি বিশ্রবা। ঋষি বিশ্রবাকে বিয়ে করতে তোমার কাছে যাচনা করছি মা।’

কৈকসীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘মহামুনি বিশ্রবা! বিবাহিত একজন লোককেই বিয়ে করতে বলছেন আপনি আমাকে!’

‘হ্যাঁ মা। আমি জেনে-বুঝেই বলছি।’

‘কারণ ?’ স্তম্ভিত কৈকসী।

‘এই বিয়ের পেছনে আমার একটা উদ্দেশ্য আছে। বলতে পারো মহাপরিকল্পনা। সুদূরপ্রসারী। তাতে রাক্ষসজাতির অশেষ কল্যাণ হবে ভবিষ্যতে। তুমি রাক্ষসসমাজের ভবিষ্যৎ কল্যাণের জন্য ঋষি বিশ্রবাকে বিয়ে করো মা। তাতে আমি খুশি হব।’

‘আপনাকে অখুশি করব না বাবা। আপনার পছন্দের লোকটিকেই আমি বিয়ে করব। কিন্তু এই বিয়ের পেছনে আপনার উদ্দেশ্যটা কী ? কীসের পরিকল্পনার কথা বলছেন আপনি ?’

‘উদ্দেশ্যের কথাটি আপাতত তোমার অশ্রুতই থাকুক নিকষা। শুধু জেনে রাখো, এই বিয়ের মাধ্যমে তোমার গর্ভজাত সন্তানরা ত্রিভুবন কাঁপাবে। এক নামে সসাগরা পৃথিবীর মানুষ তোমার সন্তানদের চিনবে। রাক্ষসজাতি ভারতবর্ষে বিখ্যাত হয়ে যাবে।’

‘কিন্তু বাবা, ঋষি বিশ্রবা আমাকে বিয়ে করতে সম্মত হবেন কেন ? তিনি তো বিবাহিত! সন্তানও আছে তাঁর।’

‘তোমার বলায় কোনও ভুল নেই নিকষা। ঋষি বিশ্রবা মহর্ষি ভরদ্বাজের কন্যা দেববর্ণিনীকে বিয়ে করেছেন। তাঁদের বৈশ্রবণ নামে একটি পুত্রও আছে।’

‘বৈশ্রবণ! আমি শুনেছি তার নাম…।’

কৈকসীর মুখের কথা কেড়ে নিলেন সুমালী, ‘বৈশ্রবণের আরেকটা নাম আছে―কুবের। ব্রহ্মার তপস্যা করে কুবের এখন অঢেল সম্পদের মালিক। সে এখন লঙ্কার রাজা।’

‘লঙ্কার রাজা! আপনারা তিন ভাই না লঙ্কার রাজা ছিলেন!’

‘তা এখন অতীত হয়ে গেছে মা। লঙ্কা থেকে বিতাড়িত আমরা।’ দীর্ঘ একটা শ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে এল সুমালীর। ডানে-বাঁয়ে জোরে জোরে মাথা ঝাঁকালেন। দুঃসহ এক অপমানকে মাথা থেকে বের করে দিতে চাইলেন সুমালী। মৃদু কণ্ঠে বললেন, ‘ওই কুবেরকে দেখেই বিশ্রবা মুনিকে বিয়ে করতে অনুরোধ করছি তোমায়।’

‘কুবেরকে দেখে!’ বিস্ময়ের ঢেউ একের পর এক কৈকসীর মাথায় আছড়ে পড়ছে যেন।

‘ঋষি বিশ্রবা তোমাকে বিয়ে করতে সম্মত হবেন কিনা, জানতে চেয়েছিলে না তুমি ?’

‘হ্যাঁ বাবা, তা-ই তো জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনাকে!’

‘তিনি সম্মত না হলেও সম্মত করাতে হবে তাঁকে। তাছাড়া মুনিঋষিরা…।’ কথা অর্ধসমাপ্ত রেখে থেমে গেলেন সুমালী।

‘তাছাড়া মুনিঋষিরা বলে থেমে গেলেন কেন বাবা ? আর কী বলতে চেয়েছিলেন ?’

করুণ চোখে কন্যার দিকে তাকালেন একবার সুমালী। মনের জড়তা দ্রুত ঝেড়ে ফেললেন, ‘ঋষিরা কোনও নারীকে না করেন না। বিশেষ করে রূপসী, যৌবনবতী…! ঋষি বিশ্রবা রাজি না হলেও ছলে-কৌশলে তোমাকে বিয়ে করতে তাঁকে রাজি করাবে তুমি।’

কৈকসী বললেন, ‘ঋষি বিশ্রবা কুলীন ব্রাহ্মণ। তার ওপর খ্যাতিমান আর্যমুনি। তাঁকে কী করে অনার্য রাক্ষসকন্যাকে বিয়ে করতে সম্মত করাব! ওঁদের মধ্যে তো কৌলীন্যবোধ আর জাতপাতের চিন্তা অত্যন্ত প্রকট।’ বিদ্যাবতী কৈকসী। তাঁর সমাজাভিজ্ঞতা গভীর এবং পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা তীক্ষè। অভিজ্ঞতা আর পর্যবেক্ষণশক্তির বলে ব্রাহ্মণ্যরীতিনীতি তাঁর ভালো করেই জানা।

মহারাজ সুমালী এবারও না হেসে পারলেন না। টেনে টেনে হেসে গেলেন তিনি কিছুক্ষণ।

তারপর বললেন, ‘সমাজাভিজ্ঞতার জন্য আমি তোমার প্রশংসা করি মা। অধ্যয়নের মাধ্যমে সমাজমানুষের অনেক কিছু জানা হয়ে গেছে তোমার, মানি তা। কিন্তু ঋষিচরিত্র সম্পর্কে তোমার জানাটা সম্পূর্ণ হয়নি। বামুন জাতের এই মানুষগুলি কী পরিমাণ স্বার্থপর এবং কী পরিমাণ লোভী, তা তুমি ভাবতেই পারবে না। অনার্য নারীর কথা বলছিলে না তুমি ? জেনে রাখো, ভোগের ক্ষেত্রে তাঁদের কাছে আর্য-অনার্য বলে কোনও পার্থক্য নেই। সবাই সমান আকর্ষণের। শাস্ত্রে, মন্ত্রে তাঁদের রুচিহীন ভোগবাদিতার ব্যাপারটিকে আইনসিদ্ধ করে রেখেছেন তাঁরা।’

এরপর অনুচ্চ কণ্ঠে মহারাজ সুমালী বললেন, ‘আমার একজন কুবেরের মতন নাতি চাই। শক্তিধর, পৃথিবীকাঁপানো নাতি। রাজ্যহারানোর যে অপমান দীর্ঘদিন ধরে আমাকে চূর্ণ করে যাচ্ছে, সেই অপমানের হাত থেকে আমি মুক্তি চাই মা। একমাত্র তুমিই পারবে সেই অপমান থেকে আমাকে মুক্তি দিতে। তোমার সন্তানই পারবে শুধু আমার হারানো ঐশ্বর্য ফিরিয়ে দিতে।’

কৈকসী বললেন, ‘বাবা বিড়বিড় করে কিছু বলছিলেন ?’

রাজা বললেন, ‘হ্যাঁ, না না মা! তোমার কাছে আমার এইটুকুই চাওয়া―তুমি বিশ্রবার পত্নী হও। আমাকে একজন বীর্যবান নাতি উপহার দাও।’

পিতার পরামর্শে কৈকসী এক সন্ধ্যাবেলায় বিশ্রবার আশ্রমে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন।

দুই

সুকেশ ও দেববতীর সন্তান সুমালী। এই দম্পতির তিন পুত্র―মাল্যবান, সুমালী এবং মালী।

সুকেশ রাক্ষসজনজাতির মানুষ। তাঁর পিতার নাম বিদ্যুৎকেশ। যৌবনকালে বিদ্যুৎকেশের সঙ্গে সন্ধ্যার কন্যা সালকটঙ্কটার বিয়ে হয়। এঁর জীবন বহির্মুখী। ভ্রমণ, বিহার, নাচ-গান―এসবের প্রতি তাঁর অদম্য মোহ। বাৎসল্য তাঁর হৃদয়ে তেমন কোনও স্থান করে নিতে পারেনি। স্বামীর সঙ্গে মন্দর পর্বতে বিহারের সময় সুকেশের জন্ম হয়। ওখানেই পুত্রকে পরিত্যাগ করে বিদ্যুৎকেশের সঙ্গে আনন্দ-উচ্ছলতায় মগ্ন হয়ে যান সালকটঙ্কটা। এবং অচিরেই অন্য স্থানে বিহারার্থে চলে যান। পরিত্যক্ত সুকেশ হর-পার্বতীর ঘরে মানুষ হন। পরবর্তীকালে গ্রামণী নাম্নী এক গন্ধর্বের কন্যার সঙ্গে সুকেশের বিয়ে হয়। এই গন্ধর্বকন্যার নাম দেববতী।

মাল্যবান, সুমালী ও মালী ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলেন। বাল্যকালেই তাঁদের মধ্যে অসহিষ্ণুতা দেখা গেল। যৌবনপ্রাপ্ত হওয়ার পর তাঁরা যেমন তেজস্বী, তেমনি উগ্রস্বভাবসম্পন্ন হয়ে উঠলেন। উৎকট স্বেচ্ছাচারিতা তাঁদেরকে ভয়ংকর করে তুলল। বাহুবল, রণদক্ষতা এবং উচ্চাকাক্সক্ষা সুকেশ রাক্ষসের এই তিন পুত্রকে অন্ধ করে ছাড়ল। মাল্যবান সুবিবেচক, পণ্ডিত ধরনের। ভেবে বুঝে সিদ্ধান্ত নেন তিনি। দূরদর্শিতা তাঁকে অন্য দুই ভাই থেকে আলাদা করেছে। সুমালী প্রতিষ্ঠাপরায়ণ। ক্ষমতার প্রতি তাঁর উদগ্র লোভ। ঈর্ষাপরায়ণও তিনি। আর মালী চণ্ডস্বভাবী। পাণ্ডিত্য, রাজ্য, ক্ষমতা, দূরদর্শিতা, যুক্তিবাদিতা―এসবের ধার ধারেন না মালী। তাঁর চাই রক্ত, চাই যুদ্ধ। তাঁর যত তৃপ্তি ওই যুদ্ধে, ওই মনুষ্যনিধনে।

চরিত্রে তিন ভাই তিন রকম হলেও একটা ব্যাপারে তিনজনের মিল আছে। আর তা হলো―তাঁদের একটা স্বাধীন রাজ্য চাই, একটা রাজসিংহাসন চাই।

মালী বললেন, ‘তা নিয়ে এত ভাববার কী আছে দাদারা ? চলো যুদ্ধে নেমে পড়ি।’

সুমালী বললেন, ‘যুদ্ধে নেমে পড়বে!’

‘তাই তো। আমাদের অগণন যোদ্ধা। সবাই রাক্ষসজনজাতির। ওরা রণদক্ষ। উগ্রস্বভাব তাদের। যুদ্ধলিপ্সুও।’ বললেন মালী।

সুমালী চোখ নাচিয়ে বললেন, ‘তাতেই যুদ্ধে জয় পেয়ে যাবে বলে তুমি মনে করো ?’

‘তাছাড়া আর কী ?’

‘আরে ভাই, শুধু বাহুবল দিয়ে জয় মিলে না! প্রয়োজন বুদ্ধিবলেরও।’ এতক্ষণ পর কথা বললেন মাল্যবান।

‘দাদা, রাজ্যজয়ের জন্য দরকার সৈন্যশক্তি আর রণকুশলতা। ওই দুটিই আমাদের আছে। পররাজ্য দখল আমাদের কাছে একটা চুটকির ব্যাপার মাত্র।’ সদম্ভে বলল মালী।

‘তোমার এ ধারণা ভুল মালী। রণকুশলতার জন্য দরকার বিচক্ষণতা, দূরদর্শিতা। সেটা তোমার নেই।’ মাল্যবানের কণ্ঠস্বর উষ্ণ।

ভড়কে গেলেন মালী। বললেন, ‘আমার নেই!’

‘না নেই। তোমার আছে অশেষ শারীরিক শক্তি। বাহুবলীও তুমি। এই বাহুবলের সঙ্গে যখন বুদ্ধিশক্তির মিশ্রণ ঘটে, তখন ওই ব্যক্তি সমরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। ওই রণবিচক্ষণতা আমরা এখনও অর্জন করতে পারিনি সুমালী।’ মালীর দিক থেকে সুমালীর দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বললেন মাল্যবান।

‘ওটা যে আমাদের বিশেষ প্রয়োজন দাদা! ওটা না হলে আমরা পররাজ্য দখল করব কী করে ? আমার যে রাজা হবার প্রবল বাসনা দাদা!’ মনের কথা খুলে বলতে দ্বিধা করলেন না সুমালী।

মাল্যবান সুমালীর কথার সরাসরি উত্তর দিলেন না, ‘এই ভারতবর্ষের প্রায় সব রাজ্য আর্যশাসকদের কবলে। দেবতারা তাঁদের অকৃত্রিম বন্ধু। অনার্যে-আর্যে যুদ্ধ বাঁধলে ইন্দ্র, বিষ্ণু প্রভৃতি দেবতা আর্যদের পক্ষে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। তাঁদের যুদ্ধবিচক্ষণতার সামনে অনার্যরা দাঁড়াতে পারে না।’

‘তাহলে উপায়!’ হতাশভঙ্গি সুমালীর চোখেমুখে।

‘উপায় একটা আছে।’ বললেন মাল্যবান।

মালী বলে উঠল, ‘আছে! সেটা কী দাদা ?’

‘ইন্দ্র অথবা ব্রহ্মা―এই দুজনের একজনকে তুষ্ট করা।’ মুখ গম্ভীর করে বললেন মাল্যবান।

‘ওঁরা দেবতা! আমাদের মতো রাক্ষসে তুষ্ট হবেন কেন তাঁরা ? আর তুষ্ট করবই-বা কী দিয়ে ?’ সুমালীর প্রশ্ন।

বিজ্ঞের মতো মাথা নেড়ে মাল্যবান বললেন, ‘আরাধনা দিয়ে। কঠোর তপস্যায় তুষ্ট করব আমরা দেবতাকে।’

‘কোন দেবতা আমাদের আরাধ্য হবেন ? কাকে তৃপ্ত করলে আমাদের মনস্কামনা পূরণ হবে দাদা ?’ সুমালী বললেন।

মালী বললেন, ‘তুমি দুজন দেবতার নাম বলেছো―ইন্দ্র আর ব্রহ্মা। দুজনের মধ্যে আমার ব্রহ্মাকে পছন্দ। ইন্দ্র নারীলোভী। ধূর্ত। অনার্য-উত্থান তিনি কিছুতেই মেনে নেবেন না। আমাদের তপস্যায় তিনি কখনও তুষ্ট হবেন না। আমরা কোনওভাবেই তাঁর মন গলাতে পারব না দাদা।’

মাথা নেড়ে মাল্যবান বললেন, ‘এতদিনে তুমি যথার্থ একটা কথা বলেছো মালী। তুমি ভালো করেই ইন্দ্রকে চিনতে পেরেছো। নারীভোগের সময় আর্য-অনার্যের বাছবিচার থাকে না ইন্দ্রের। কিন্তু পক্ষাবলম্বনের ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই আর্য স্বার্থ দেখেন। তাই আমাদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আমরা স্বর্গরাজ ইন্দ্রের দ্বারস্থ হব না। আমরা মহাপ্রতাপশালী দেবতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হব।’ দম নেওয়ার জন্য থামলেন মাল্যবান।

এই ফাঁকে সুমালী বললেন, ‘তাঁর নৈকট্য পাওয়ার জন্য আমাদের করণীয় কী হবে দাদা ?’

‘তপস্যা। তপস্যা ছাড়া আর কোনও কিছু দিয়ে ব্রহ্মার মন নরম করা যাবে না। অনুরাগী ভক্তদের প্রতি তাঁর অপার করুণা। ঐকান্তিক সাধনায় আমরা যদি এই মহাপ্রাণ দেবতাশ্রেষ্ঠের মনতোষণ করতে পারি…।’

‘তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে, মনস্কামনা পূরণ হবে আমাদের, এই তো বলতে চাইছো দাদা তুমি ?’ সুমালী বললেন।

‘অর্থাৎ আমরা রাজ্যজয়ের শক্তি পাব! দুর্দমনীয় হয়ে উঠব আমরা! শত্রুহন্তা হতে পারব!’

মালীকে আর বলার সুযোগ দিলেন না মাল্যবান, ‘তাই রে ভাইয়েরা, তাই! ব্রহ্মার আশীর্বাদ পেলে আমরা অজেয় হব। শত্রুঘ্ন হব। রাজা হওয়া আমাদের জন্য সহজ হবে।’

আবেগে কেঁদে দিলেন সুমালী। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললেন, ‘রাজা হবার বড় বাসনা আমার! আমি সিংহাসনে রাজমুকুট পরে মাথা উঁচু করে বসব, তুমি আমার পাশে মুক্তাখচিত আসনে বসে আমাকে উপদেশ দিয়ে যাবে!’

‘আর আমি সেনাপতি হয়ে তোমার রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করে যাব।’ উচ্ছ্বাসে বিভোর হয়ে মালী বলে উঠল।

মাল্যবান গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘সব কিছু হবে আমাদের। তার আগে যেটা আমাদের করতে হবে, তার নাম―সাধনা। কঠোর তপস্যার মাধ্যমে মহাদেবতা ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে তাঁর আশীর্বাদ নিতে হবে আগে। তার পর রাজ্যজয়, রাজসিংহাসন।’

এরপর তিন ভাই সুমেরু পর্বতের উদ্দেশে রওনা দিলেন। যাত্রার আগে পিতার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন তিনজনে।

তিনপুত্রকে করপুটে সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে বিস্মিত হলেন সুকেশ।

বললেন, ‘কিছু বলবে তোমরা ?’

সুমালী বললেন, ‘হ্যাঁ বাবা। আপনার অনুমতির জন্য এসেছি আমরা।’

‘অনুমতি! কীসের অনুমতি ?’

সুমালী বললেন, ‘আমি ভালো করে গুছিয়ে বলতে পারব না। দাদা মাল্যবান আপনাকে সব বুঝিয়ে বলবে।’

মাল্যবানের ওপর চোখ স্থির করলেন সুকেশ। সেই চোখে জিজ্ঞাসা।

জ্যেষ্ঠ পুত্রটিকে বড় ভালোবাসেন সুকেশ। সুমালী উচ্চাভিলাষী। মালী উগ্র। মাল্যবান শান্ত। সুবিবেচক। অন্য দুই ছেলের মতো এই ছেলেটির শরীরেও প্রচণ্ড শক্তি। শারীরিক শক্তি মালী-সুমালীকে অহংকারী করে তুললেও মাল্যবান নিরহংকারী থেকে গেছেন। এইজন্য মাল্যবান সুকেশের কাছে প্রিয়তর হয়েছেন। প্রিয় পুত্রের বক্তব্য শুনবার জন্য সুকেশ উৎকর্ণ হলেন।

পিতার ঔৎসুক্য দেখে মাল্যবান বললেন, ‘পিতা, আমরা সুমেরু পর্বতের গহিন অরণ্যে যাচ্ছি।’

‘কেন ?’ কম কথা বলা সুকেশের স্বভাব।

পিতার মতো মাল্যবানও সংক্ষিপ্ত জবাব দিলেন, ‘ব্রহ্মার সাধনায়।’

চট করে মাল্যবানের দিকে তাকালেন সুকেশ। বললেন, ‘হঠাৎ ব্রহ্মার প্রতি অনুরক্ত হয়ে পড়লে যে ?’

‘তপস্যায় তাঁকে তুষ্ট করে তাঁর আশীর্বাদ পেলে আমরা রাজ্যপ্রতিষ্ঠা করতে পারব।’ মাল্যবানের কণ্ঠস্বরে মৃদু আবেগের ছোঁয়া।

‘রাজ্য! কোন রাজ্যপ্রতিষ্ঠার কথা বলছো তুমি মাল্যবান!’

এতক্ষণ নিশ্চুপ থাকা সুমালী বলে উঠলেন, ‘রাক্ষসরাজ্য বাবা। আমাদেরই রাজ্য প্রতিষ্ঠা করব আমরা।’

সুকেশ এবার গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাদের কথাকে আমার হেঁয়ালি বলে মনে হচ্ছে। আমার কথা বাদ দাও, আমার বাবার জন্মেও শুনিনি রাক্ষসরাজ্যের কথা! ভারতবর্ষের এই অঞ্চলে অন্যান্য ক্ষুদ্র জনজাতির মতো রাক্ষস জনজাতিও একটি। যুগ-যুগান্তর ধরে বেঁচে আছে এরা, কিন্তু কখনও নিজেদের রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বললে ভুল হবে না যে ভারতবর্ষের প্রায় সমস্তটাই আর্য আর দেবতারা ভাগাভাগি করে নিয়ে নিয়েছেন। সেখানে নাগ, পক্ষী, বানর, দানব, অসুর, রাক্ষস―এসব জনজাতির তেমন কোনও রাজ্য নেই।’ কম কথার সুকেশকে বেশি কথায় পেয়ে বসেছে আজ।

‘আর সেইজন্যই বাবা আমরা তিন ভাই মিলে ঠিক করেছি―এই ভারতবর্ষে রাক্ষসরাজ্য প্রতিষ্ঠা করব। আমরা জানি, তাতে আর্য রাজারা আর দেবতারা প্রবল বাধা দেবেন আমাদের। তাঁদের আক্রমণের সামনে আমরা বেশিক্ষণ টিকতে পারব না।’ বললেন মাল্যবান।

সুমালী বলে উঠলেন, ‘আর এই কারণেই আমাদের ব্রহ্মার বর দরকার। তপস্যা করে তুষ্ট করব তাঁকে। তাঁর আশীর্বাদপুষ্ট হতে পারলে আমরা অপরাজেয় হয়ে উঠব। দেবতাশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মার বর আমাদের প্রচণ্ড শক্তিশালী করে তুলবে। তখন আমাদের রাজ্যজয় কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না বাবা।’

মালী বলে উঠলেন, ‘আপনার ছেলেদের হাত দিয়ে পৃথিবীতে রাক্ষসজাতির নিজস্ব দেশের পত্তন হবে। শুনতে ভালো লাগছে না আপনার ?’

এবার ঠান্ডা গলায় রাক্ষস সুকেশ বললেন, ‘শুধু ভালো লাগছে না, আনন্দে লাফাতে ইচ্ছে করছে আমার।’

তারপর মাল্যবানকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘তুমি কী বলো পুত্র, পারবে তোমরা এই ভারতবর্ষে রাক্ষসরাজ্য স্থাপন করতে ?’

মাল্যবান বিনীত কণ্ঠে বললেন, ‘আপনি আশীর্বাদ করুন বাবা আমাদের। মহাদেবতা ব্রহ্মার দয়া পেলে রাক্ষসরাজ্য প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়ব আমরা।’

দুই বাহু বাড়িয়ে প্রতিটি পুত্রকে নিজের বুকে টেনে নিলেন সুকেশ। বললেন, ‘আশীর্বাদ করি পুত্ররা ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে তাঁর কাছ থেকে বর গ্রহণ করে বাড়ি ফিরে এসো। রাক্ষসরাজ্যের আশায় বুক বেঁধে তোমাদের ফেরার পথের দিকে চেয়ে থাকলাম আমি।’

মাল্যবান, সুমালী, মালী পিতার চরণধুলা মাথায় ঠেকালেন।

তিন

বৈদিক দেবতাদের মধ্যে ব্রহ্মা শ্রেষ্ঠতম।

তিনি ত্রিবেদজ্ঞ। ঋক, সাম এবং যজুর্বেদ তাঁর অধিকারে। দেবতাকুলে তাঁর প্রাধান্য প্রশ্নাতীত। ব্রহ্মার চারটি হাত। চতুরানন তিনি। দেহ রক্তবর্ণ। প্রথম দিকে পাঁচটি মাথা ছিল ব্রহ্মার। শিবের সঙ্গে একদিন তাঁর মনোমালিন্য হলো। মনোমালিন্য রেষারেষিতে গড়াল। ঝগড়া একদিন এমন পর্যায়ে পৌঁছাল যে শিব তাঁর অগ্নিগর্ভ তৃতীয় নয়নটি উন্মীলন করতে বাধ্য হলেন। উভয়ের মধ্যে কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে ব্রহ্মা শিবের উদ্দেশে ভয়ংকর, শ্রুতিকটু, অসম্মানজনক বাক্য উচ্চারণ করেন। এতে অতিশয় ক্রুদ্ধ হয়ে ওঠেন পশুপতি। তৎক্ষণাৎ তাঁর তৃতীয় নয়ন থেকে সর্বগ্রাসী আগুন উদ্গীরিত হয়। তখন তখনই সেই অগ্নির দাহে ব্রহ্মার একটি মস্তক ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেই থেকে ব্রহ্মার চারটি মাথা। ব্রহ্মার বাহন হংস। আরেক দেবীর বাহনও হংস। তিনি সরস্বতী। জগতের প্রাণিসমূহের স্রষ্টা হিসেবে ব্রহ্মাকে কৃতিত্ব দেওয়া হয়। এই জন্য তাঁর অপর নাম―প্রজাপতি। বৈদিক যজ্ঞাদির সকল কর্ম ব্রহ্মার জানা। তাই ব্রহ্মার অন্য একটি নাম―অভিগোপ্তা। ব্রহ্মা অশেষ ক্ষমতাধর। দোর্দণ্ডপ্রতাপী।

এই ব্রহ্মার সঙ্গে আরেক প্রতাপশালী দেবতা বিষ্ণুর বিবাদ বাধল। দুজনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ―এই বিতর্ক থেকে বিবাদের সূচনা। এই বিবাদের সমাধান করার জন্য সকল দেবতা একস্থানে একত্র হলেন। ঠিক হলো―একে অপরের উদরে প্রবেশ করবেন। বেরিয়ে এসে উদরে যা দেখেছেন, দেবতাসমক্ষে খুলে বলবেন। প্রথমে ব্রহ্মার উদরে প্রবেশ করলেন বিষ্ণু। সেখানে ত্রিলোক দর্শন করলেন বিষ্ণু। উদর থেকে বেরিয়ে তার বিবরণ দিলেন। এবার বিষ্ণুর উদরে ব্রহ্মার প্রবেশের পালা। প্রবেশ করলেনও ব্রহ্মা। ঠিক ওই সময় দুষ্টবুদ্ধিটা বিষ্ণুর মাথায় ঝিলিক দিয়ে উঠল। ঠিক করলেন, নিজের পেট থেকে ব্রহ্মাকে আর বেরোতে দেবেন না। তৎক্ষণাৎ তিনি তাঁর দেহের সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে দিলেন। ব্রহ্মার সংকটাপন্ন অবস্থা তৈরি হলো বিষ্ণুর উদরে। কিন্তু বিষ্ণু তো ব্রহ্মার ক্ষমতার কথা সঠিকভাবে ওয়াকিবহাল নন! ব্রহ্মা বিষ্ণুর নাভিমূল বিদীর্ণ করে উদর থেকে বেরিয়ে এলেন। সেই থেকে ব্রহ্মায় আর বিষ্ণুতে বিরোধ। এই বিরোধ শেষ পর্যন্ত নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। শিষ্য, তৎশিষ্য পর্যন্ত এই বিবাদ বিস্তৃত হয়েছে। এমনকি বিষ্ণুর অনুরক্তরা ব্রহ্মার রোষানলে পড়েছে, আর ব্রহ্মার ভক্তরা বিষ্ণুর ক্রোধাগ্নি থেকে রেহাই পায়নি।

মাল্যবান, সুমালী আর মালী প্রবলপ্রতাপী বিষ্ণুবিদ্বেষী ব্রহ্মার অনুরাগ পাওয়ার আশায় সুমেরু পর্বতের গহিন অরণ্যে তপস্যা শুরু করলেন।

বাড়ি থেকে বেরিয়ে রথে চড়ার আগমুহূর্তে মা দেববতী তাঁর সন্তানদের সেই কথাটি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন।

মাকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে উঠে দাঁড়ালে দেববতী বলেছিলেন, ‘তোমাদের উদ্দেশ্য প্রশংসনীয় বাছারা। সাধনায় যদি সিদ্ধিলাভ করতে পারো, তাহলে রাক্ষসজাতির অভূতপূর্ব এক উপকার হবে। কিন্তু এই তপস্যার মধ্যে যে তোমাদের জন্য ভয়ংকর এক বিপদ ওত পেতে আছে!’

চমকে তিন ভাই মায়ের মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন। তাদের চোখেমুখে তখন বিপুল ত্রাস।

মা বললেন, ‘তোমরা তো জানো না―দেবশ্রেষ্ঠ ব্রহ্মার সঙ্গে বিষ্ণুর তীব্র বিরোধ, তোমরা যদি তপস্যাবলে ব্রহ্মাকে সন্তুষ্ট করতে পারো, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে একজন শত্রুও জুটে যাবে তোমাদের।’

‘শত্রু জুটে যাবে! কে সে ?’ তিন ভাই সমস্বরে বললেন।

দেববতী বললেন, ‘সে নয়। তিনি। তিনি আর কেউ নন, প্রবল শক্তিধর দেবতা বিষ্ণু।’

‘কেন মা, বিষ্ণু আমাদের শত্রু হতে যাবেন কেন!’ মালীর বিস্ময়ের সীমা থাকে না।

এবার দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন দেববতী, ‘দেবতা বিষ্ণু ব্রহ্মার অনুরাগীদের নিজের শত্রু বলে বিবেচনা করেন। তাই বলছিলাম, ব্রহ্মার অনুগ্রহপ্রার্থী হতে গিয়ে বিষ্ণুর রোষানলে পড়ে গেলে তোমরা।’

‘তাহলে মা, আমরা কী করব এখন ?’ মরাগলা মাল্যবানের।

‘আমার কথা শুনে ভয় পেয়ো না বাছা। অভীষ্ট লক্ষ্যে এগিয়ে যাও তোমরা। বাধা অতিক্রম করে লক্ষ্যে পৌঁছানোই তো বীরের কাজ! তোমরা আমার বীরসন্তান। তোমাদের মনস্কামনা পূর্ণ হোক―এই আশীর্বাদ করি। শুধু বিষ্ণু থেকে সাবধান থেকো, এই পরামর্শ আমার।’ ধীরে ধীরে বলে গেলেন দেববতী।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিষ্ণুর রোষানল থেকে রেহাই পাননি এই তিন রাক্ষসবীর। সেই কাহিনি পরের। তার আগের কাহিনিটুকু জানা যাক।

সুমেরু পর্বতের পাদদেশে বিশাল এক সরোবর। কাকচক্ষুসদৃশ তার জল। জায়গাটা নির্জন। কিন্তু শ্বাপদসংকুল। সরোবরজলে অবগাহন করে তিন ভাই ব্রহ্মার তপস্যা আরম্ভ করলেন।

তপ্ থেকে তপস্যা শব্দটি তৈরি হয়েছে। তপ্ মানে তাপ। তাপের সঙ্গের অগ্নি বা সূর্যের সম্পর্ক। তপস্যার সঙ্গে যুক্ত দাহ বা ভস্মীকরণ। উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য শরীরশোষক কৃচ্ছ্রতার নামই তপস্যা। তপস্যা মানে ক্লেশজনিত কর্ম। তপস্যার মাধ্যমে ইপ্সিত বস্তু পাওয়া যায়।

প্রথম মাসে তিন ভাই ফলাহার করলেন। পরের মাসে শুধু জল খেয়ে থাকলেন। তৃতীয় মাসে কিছুই না খেয়ে তিন রাক্ষসযুবক ব্রহ্মার আরাধনা করে গেলেন। চতুর্থ মাস থেকে এক পায়ে দাঁড়িয়ে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে থাকলেন এবং মনে মনে ব্রহ্মার নাম স্মরণ করতে থাকলেন। তিন ধারায় সাধনা করা যায়―শারীর, বাচিক এবং মানস তপস্যা। শরীরকে যত প্রকারে কষ্ট দেওয়া সম্ভব, সেরকম কষ্ট দিয়ে উদ্দীষ্ট দেবতাকে ডেকে যাওয়া। কোনও মানুষের উদ্বেগ সৃষ্টি করে না এমন সত্য ও সুপ্রিয় কথাবার্তা বলা। আর মানস তপস্যা হলো―চিত্তের সার্বিক প্রসন্নতা, সৌম্যভাব, মৌনভাব ও চিত্তশুদ্ধি। এই তিন পদ্ধতিতেই মাল্যবান-সুমালী- মালী ব্রহ্মার তপস্যা করে যেতে লাগলেন।

এত সাধনার পরও ব্রহ্মার মন গলে না। রাক্ষসদের ডাকে সাড়া দেন না তিনি। ব্রহ্মা আরও দেখতে চান, তাঁর ভক্তরা তাঁকে পাওয়ার জন্য আরও কত বড় কঠিন তপস্যায় মগ্ন হতে পারেন ?

তিন সহোদর তাঁদের সাধনার তীব্রতা বাড়িয়ে দিলেন। দাবদাহের দ্বিপ্রহরে পলকহীন চোখে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তাতে সূর্যরশ্মির তীক্ষèতায় তাঁদের চোখের মণি ঝলসে যাওয়ার উপক্রম হলো। তাঁদের সর্বাঙ্গ ভাসিয়ে ঝরনাধারার মতো ঘাম ঝরে পড়তে লাগল।

চারদিকে অগ্নিকুণ্ড জ্বেলে মাঝখানে তিন ভাই ঊর্ধ্বপদ অধঃমুণ্ড হয়ে থাকলেন। আগুনে ঝলসে গেল তিন সহোদরের মসৃণ পেলব দেহচর্ম। তাতেও থামলেন না তাঁরা। কঠোর কঠিন তপস্যা চালিয়ে যেতে লাগলেন। গ্রীষ্ম-বর্ষা-শরৎ-হেমন্ত গেল। এল দুঃসহ শীত। হিমালয়ের শৈত্যপ্রবাহ প্রাণিকুলের জীবনকে অসহনীয় করে তুলল। ওই রকম দুঃসহ আবহাওয়ায় তিন রাক্ষসযুবক উদোম শরীরে সরোবর জলে নেমে পড়লেন। দু হাত বুকে জড়িয়ে ব্রহ্মার নাম জপতে থাকলেন তাঁরা। জলের তীব্র শৈত্যে এই তিন যুবকের প্রাণসংশয় দেখা দিল।

ব্রহ্মা আর নির্বিকার থাকতে পারলেন না। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য সহস্র বছর ধরে মানুষ তাঁর সাধনা করেছেন, কিন্তু এই তিন রাক্ষসযুবকের মতো প্রাণ বাজি রেখে কেউ তাঁর তপস্যা করেননি। তৃপ্তিতে চোখ বুজে এল ব্রহ্মার। মাল্যবান-সুমালী-মালীর সামনে আবির্ভূত হলেন ব্রহ্মা। ব্রহ্মার পদতলে লুটিয়ে পড়লেন এই তিন রাক্ষস।

নিমীলিত চোখে ব্রহ্মা জিজ্ঞেস করলেন, ‘কী চাও তোমরা ? তোমাদের অভীষ্ট কী ?’

মাল্যবান বললেন, ‘অজেয় হতে চাই।’

মালী বললেন, ‘শত্রু-সংহারক হতে চাই।’

সুমালী বললেন, ‘আধিপত্য লাভ করতে চাই।’

‘এত সব দিয়ে কী করবে তোমরা ?’ ব্রহ্মার বিস্মিত প্রশ্ন।

‘রাজ্যস্থাপন করব।’

সুমালীর কথার সঙ্গে মালী যুক্ত করল, ‘রাক্ষসরাজ্য।’

এবার চমকে উঠলেন ব্রহ্মা, ‘তা কী করে হয়! তোমরা আর্য নও, দেবতা নও। এমনকি গন্ধর্বও নও। সামান্য রাক্ষসজাতি তোমরা! তোমাদের তেমন উজ্জ্বল অতীত নেই, যোদ্ধাজাতি নও তোমরা! সংখ্যার দিক দিয়েও তো তোমরা তেমন উল্লেখযোগ্য নও! তোমাদের রণকৌশলের কথা তো শুনিনি কখনও! আর সেই রাক্ষসেরা চাইছো নিজস্ব রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে! তা কী করে সম্ভব বলো।’

‘সম্ভব দেবাদিদেব। আপনার আশীর্বাদধন্য হলে আমরা সসাগরা পৃথিবী জয় করতে পারব।’ আস্থার সঙ্গে উচ্চারণ করলেন মাল্যবান।

‘আশীর্বাদ পেলে পারবে ?’ নিজের অজান্তে ব্রহ্মার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল।

সুমালী বললেন, ‘আপনি আমাদের অজেয়, শত্রুঘ্ন এবং চিরজীবী হবার বর দিন প্রভু। দাদা যা বলেছেন, তা করে দেখাব আমরা।’

হেসে উঠলেন ব্রহ্মা এবার, ‘তোমরা আমার কাছ থেকে চিরজীবী হবার বর পাবে না।’

‘আপনি আমাদের বর না দিলে অসুবিধা নেই প্রভু। আপনি নিজ আলয়ে ফিরে যান। আমরা আমাদের তপস্যা আরও কঠোরভাবে শুরু করব।’ মাল্যবান বললেন।

‘আমাকে আর জ্বালাতন করিস না তো বাছারা! আমাকে একটু স্বস্তিতে থাকতে দে না! তোদের কঠোর তপস্যার জন্য তো আমি ঘরে থাকতে পারছি না!’

মালী ত্বরিত বললেন, ‘তাহলে আমাদের চিরজীবী হবার বর দিন।’

ব্রহ্মা ইতস্তত করে বললেন, ‘আচ্ছা, চিরজীবী হবার বর দিচ্ছি তোদের, তবে একটি শর্তে।’

‘কী শর্ত ?’

‘অন্যরা তোদের হত্যা করতে না পারলেও বিষ্ণু কিন্তু তোদের পরাজিত করতে পারবেন, বধও করতে পারবেন।’

‘বধও করতে পারবেন!’ ভড়কানো কণ্ঠ সুমালীর।

ব্রহ্মা উপদেশের ভঙ্গিতে বললেন, ‘সুতরাং বিষ্ণুকে রাগাবার চেষ্টা করিস না। তাতে তোদের সমূহ ক্ষতি হবে।’ বলে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন ব্রহ্মা।

পিতা-মাতার কাছে ফিরে এলেন তিন ভাই। রাক্ষসজাতির মানুষদের দ্রুত সমবেত করলেন। দেশপ্রেমের জোয়ার বইয়ে দিলেন সুমালী সমবেত রাক্ষসদের অন্তরে। অচিরেই রাজ্যজয়ে বেরিয়ে পড়লেন তাঁরা। একের পর এক রাজ্য জয় করে নিজেদের অধীনে নিয়ে এলেন।

ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ করে। এই তিন রাক্ষসও ক্ষমতাবলে সুরাসুরের ওপর অত্যাচার শুরু করলেন। মালীর নিষ্ঠুরতম অত্যাচারে স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালব্যাপী ত্রাহি ত্রাহি রব উঠল।

ইত্যবসরে তিন ভাই বিয়ে করলেন। নর্মদা নামে এক গন্ধর্বের তিন কন্যার সঙ্গে মাল্যবান-সুমালী-মালীর বিয়ে হলো। সুমালীর স্ত্রীর নাম কেতুমতী। মাল্যবানের স্ত্রীর নাম সুন্দরী। তাঁদের সাতজন পুত্র ও এক কন্যা জন্মায়। মালীর স্ত্রী হলেন বসুধা। তাঁদের চারটি পুত্রসন্তান। চারকন্যা ছাড়াও সুমালীর আরও দশজন পুত্র জন্ম লাভ করে।

বহু রাজ্য নিজেদের করতলগত করে বহু ধনসম্পদের অধিকারী হলেন তিন সহোদর। একদিন তাঁরা সুন্দর একটি বাসযোগ্য রাজধানীর প্রয়োজন অনুভব করলেন। যে রাজধানী হবে সৌন্দর্যে অতুলনীয় ও নিরাপদ। ঐশ্বর্যময় এক নগর নির্মাণের অনুরোধ নিয়ে এই তিন রাক্ষসবীর একদিন বিশ্বকর্মার সম্মুখে গিয়ে উপস্থিত হলেন।

চার

বিশ্বকর্মা শিল্পাচার্য।

নিপুণ প্রকৌশলী তিনি। শিল্পকলায় পারদর্শী। তাঁর হাতে নির্মাণ-শিল্পকলার চরম উৎকর্ষ সাধিত হয়েছে। তিনি দেবশিল্পী। দেবতাদের আকাশচারী রথের স্রষ্টা তিনি। বিশ্বকর্মা নগরবিদ। সেই সময়কার পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম কারুকার্যময় ঐশ্বর্যশালী নগরগুলোর নির্মাতা এই বিশ্বকর্মা। স্থাপত্যবিদ্যা তাঁর করতলগত। নগর, প্রাসাদ, ভবন, রাজপথ, উদ্যান প্রভৃতি নির্মাণে তিনি ছিলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী দক্ষ কারিগর।

এই ভুবনবিখ্যাত নির্মাণশিল্পীকে বিনীতভাবে মাল্যবান বললেন, ‘আমাদের জন্য একটি নগরী নির্মাণ করে দিন প্রভু।’

‘নগরী নির্মাণ করে দেব! কে তুমি ? তোমরা কারা ?’ তিন ভাইয়ের ওপর দৃষ্টি প্রসারিত করে বিশ্বকর্মা জিজ্ঞেস করলেন।

মাল্যবান বললেন, ‘আমরা রাক্ষসনন্দন। রাক্ষস সুকেশ আমাদের পিতা। আমি মাল্যবান, ও সুমালী আর ওর নাম…।’

‘ব্যস ব্যস, আর বলতে হবে না। ও মালী। তোমরা তিন ভাইয়ের মধ্যে সবচাইতে বলবান, সবচাইতে নিষ্ঠুর আর হিংস্রও। ভুল বললাম ?’

তিন ভাই বুঝে গেলেন, বিশ্বকর্মা অত্যন্ত স্পষ্টভাষী। কাউকে পাত্তা দিয়ে কথা বলেন না তিনি। কাউকে অপমান করতে মুহূর্তকাল চিন্তাও করেন না।

সতর্ক হলেন মাল্যবান। চোখ-ইশারায় মালীকে সংযত থাকতে বললেন। মাল্যবান ভালো করেই বুঝে নিয়েছেন, কোনওভাবে বিশ্বকর্মা রেগে গেলে, যে উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছেন, তা ব্যর্থ হয়ে যাবে।

হাত কচলে মাল্যবান বললেন, ‘আমরা মস্ত বড় এক আশা নিয়ে আপনার কাছে এসেছি প্রভু। আপনি আমাদের জন্য এমন একটা শিল্পিত নগরী তৈরি করে দিন, যাকে রাক্ষসদের রাজধানী বলে ঘোষণা করব আমরা।’

বিশ্বকর্মা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বললেন, ‘তোমরা ভারতবর্ষে রাক্ষসশক্তির উত্থান ঘটিয়েছো। অনেক দেবরাজ্য দখল করেছো। বহু আর্যদেশকে ছারখার করে দিয়েছো তোমরা। অসংখ্য দেবতা তোমাদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন।’ বলে চুপ করে গেলেন।

বিশ্বকর্মার কথা শুনে তিন সহোদর ভীষণ উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলেন।

নিশ্চিত ধরে নিলেন, বিশ্বকর্মা তাঁদের ফেরাবেন।

অবিশ্বাস্যভাবে হঠাৎ বিশ্বকর্মা গম্ভীর গলায় বলে উঠলেন, ‘আমি তোমাদের ফেরাব না। তাতে শিল্পের অপমান হবে। আমি তো একজন শিল্পী! শিল্পীর ক্রোধ, পরহিংসা থাকা উচিত নয়। যতই তোমরা দেবতাদের ক্ষতি করো না কেন, আমি তোমাদের কাজটা করে দেব। তবে একটা শর্ত আছে আমার।’

এতক্ষণ ভড়কে থাকা সুমালী বললেন, ‘কী শর্ত প্রভু ?’

বিশ্বকর্মা সরাসরি উত্তর দিলেন না, ‘আমার সম্পর্কে ভালো করেই যে খোঁজখবর নিয়ে তোমরা এখানে এসেছো, বুঝতে পারছি। আমি শুধু নগরটাই নির্মাণ করে দেব, তোমাদের জন্য কোনও অস্ত্র তৈরি করে দেব না।’

বিশ্বকর্মার কথা শুনে তিন ভাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলেন। তাঁদের মনে যে ক্ষীণ আশা ছিল না, এমন নয়। তাঁরা ঠিক করে রেখেছিলেন, নগরী নির্মাণ শেষে বিশেষ কিছু অস্ত্র তৈরি করে দেবার অনুরোধ করবেন বিশ্বকর্মাকে। বিশ্বকর্মা যে দক্ষ একজন অস্ত্রনির্মাতা, সেটা তিন ভাই ভালো করে জেনে এসেছেন। তাঁরা জানেন, বিশ্বকর্মা বিষ্ণুর সুদর্শনচক্র, শিবের ত্রিশূল, কার্তিকের শক্তিশেল প্রভৃতি মারাত্মক অস্ত্র নির্মাণ করেছেন। বিশ্বকর্মার কথা শুনে রাক্ষসদের আশায় ঠান্ডা জল পড়ল।

মাল্যবান বললেন, ‘ঠিক আছে প্রভু, আপনি আমাদের জন্য শুধু নগরীটা নির্মাণ করে দিন।’

‘কোথায় বানাব নগরী ?’ জানতে চাইলেন বিশ্বকর্মা। মাল্যবান-সুমালী-মালী কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিশ্বকর্মার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেন। একটি মহানগর নির্মাণের আবদার নিয়ে এসেছেন রাক্ষসবীররা, কিন্তু কোথায় নগরীটি তৈরি করাবেন, তা ভেবে আসেননি। তাই বিশ্বকর্মার প্রশ্নের সামনে দিশা হারিয়ে ফেললেন তাঁরা।

তিন রাক্ষসের নাজুক অবস্থা দেখে বিশ্বকর্মার মনে হঠাৎ করুণার সঞ্চার হলো। বললেন, ‘শোনো তোমরা, ভারতবর্ষের দক্ষিণাংশের মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটাই দূরে লবণসমুদ্রের মাঝে বৃহৎ একটি দ্বীপ আছে। এই দ্বীপের নাম লঙ্কা। চারদিকে সমুদ্রবেষ্টিত এটি। এর প্রস্থ দশ যোজন, দৈর্ঘ্য বিশ যোজন। তোমরা যদি রাজি হও, তাহলে ওখানেই তোমাদের জন্য নগরী নির্মাণ করে দিতে পারি আমি।’

বিগলিত হয়ে তিন ভাই একসঙ্গে বলে উঠলেন, ‘তাতেই আমরা খুশি প্রভু। আমাদের এই রাজধানী হবে দুর্লঙ্ঘ্য সমুদ্রবেষ্টিত। আমরা শত্রুমুক্ত থাকব। আপনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব আমরা। রাক্ষসজাতি থাকবে চিরঋণী।’ হাত তুলে বিশ্বকর্মা থামিয়ে না দিলে ওঁরা আরও অনেক কথা বলে যেতেন।

‘ফিরে যাও তোমরা। অল্পসময়ের মধ্যে আমি লঙ্কাপুরীর নির্মাণকাজ শুরু করব।’ মাথা নেড়ে বললেন বিশ্বকর্মা।

স্বস্থানে ফিরে এসেছিলেন সুকেশপুত্ররা। অপেক্ষা করছিলেন সৌষ্ঠবময় ঐশ্বর্যশালী লঙ্কার জন্য।

অচিরেই বিশ্বকর্মা লঙ্কাপুরীর নির্মাণকাজ শুরু করলেন। শত সহস্র নির্মাণসহকারী তাঁকে সাহায্য করতে থাকল।

মূল প্রাসাদ তৈরি শেষ করে চারদিকে পরিখা খোঁড়ালেন বিশ্বকর্মা। সেই পরিখা কুমিরে পূর্ণ। লঙ্কাকে বেষ্টন করে দুর্ভেদ্য প্রাচীর নির্মাণ করালেন। লঙ্কায় প্রবেশদ্বার থাকল চারটি―স্বর্ণনির্মিত। প্রত্যেক দ্বারে শত্রুবিনাশী যন্ত্রসেতু স্থাপন করলেন বিশ্বকর্মা। নগরীর স্থানে স্থানে সরোবর সৃষ্টি করলেন। সেই সরোবরের চারদিকে বড় বড় বৃক্ষসকল ছায়া দিতে থাকল। নগরজীবনকে সুশৃঙ্খল, আরামপ্রদ, নিরাপদ রাখবার জন্য যতরকম কুশলতা প্রয়োগ করা দরকার, তা সবেরই প্রয়োগ করলেন বিশ্বকর্মা। শেষে নাগরিকদের জন্য অসংখ্য দৃষ্টিকাড়া আবাসন তৈরি করলেন। পয়ঃপ্রণালী, রাস্তাঘাট নির্মাণ করালেন।

একদিন মহানগর লঙ্কা মাল্যবানদের বুঝিয়ে দিয়ে নিজ নিবাসে প্রত্যাগমন করলেন দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা।

মাল্যবান-সুমালী-মালী শুভ একদিনে মাতা-পিতা-পরিবার -পরিজন নিয়ে লঙ্কার রাজপ্রাসাদে উপস্থিত হলেন।

আগে থেকেই লঙ্কায় রাক্ষস প্রজাতির মানুষেরা বসবাস করত। তবে তাদের সংখ্যা ছিল কম। রাক্ষসেরা ভারতবর্ষের নানা অরণ্য-অধ্যুষিত জায়গায় বসবাস করে যাচ্ছিল। রাক্ষস-রাজধানী প্রতিষ্ঠার সংবাদ দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়লে ওই রাক্ষসেরা লঙ্কায় এসে উপস্থিত হতে লাগল। মাল্যবানরা তাদের সাদরে স্বাগত জানাল। সকল রাক্ষস শক্তিকে একত্র করা দরকার―এই তাগিদ থেকেই তিন ভাই আগত রাক্ষসদের লঙ্কায় বসবাস করার অনুমতি দিলেন। রাক্ষসেরা লঙ্কায় বসবাস করতে পেরে উল্লসিত হলো। তাদের মধ্যে স্বদেশবোধের জোয়ার বইল। তিন রাক্ষসপ্রধান স্বদেশপ্রেমকে পুঁজি করে রাক্ষসজনজাতির মধ্যে প্রবল এক সামরিক শক্তির স্ফুরণ ঘটালেন। অল্পসময়ের মধ্যে মালী সুগঠিত রণদক্ষ একটি সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করে ফেললেন। বিশাল এক রাক্ষসবাহিনী নিয়ে মালী-সুমালী-মাল্যবান আরও রাজ্যজয়ে বেরিয়ে পড়লেন। এবার তাঁদের লক্ষ্য―দেবলোক এবং অরণ্যের আর্যঋষিদের তপাশ্রমগুলি।

তাঁদের হাতে মুনিঋষিদের অরণ্য-আবাসনগুলি ছারখার হলো। আশ্রমে আশ্রমে তাণ্ডব চালিয়ে রাক্ষসসৈন্যরা ঋষিদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলল। মুনিঋষিদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে উঠল।

এরপর রাক্ষসেরা দেবলোকের দিকে ধেয়ে গেল। একের পর এক দেবতা-প্রশাসিত রাজ্যগুলো দখল করে নিল রাক্ষসেরা। তাদের হাতে বহু দেবদেবী লাঞ্ছিত হলেন। নিহতও হলেন অনেকে।

মাল্যবান-সুমালী-মালীর অত্যাচারে আতঙ্কিত হয়ে অসহায় দেবতা আর ঋষিগণ বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। অন্য দেবতার কাছে না গিয়ে বিষ্ণুর কাছে যাওয়ার কারণ আছে। দেবতা আর ঋষিরা জানেন―এই তিন রাক্ষস ব্রহ্মার কৃপাধন্য। আর ব্রহ্মা এবং বিষ্ণুর বিরোধের কথা তো ভারতবর্ষে কিংবদন্তিতুল্য। তাঁরা অনুমান করলেন, বিষ্ণুকে বুঝিয়ে একবার ক্রোধান্বিত করে তুলতে পারলে তাঁদের উদ্দেশ্য সিদ্ধিলাভ করবে। বিষ্ণুর সুদর্শনচক্রে তিন রাক্ষসের মাথা কাটা পড়বে।

উদ্দেশ্য সার্থক হলো দেবতা-ঋষিদের। মাল্যবান-সুমালী- মালীর নিষ্ঠুরতার কথা ভালো করে বিষ্ণুকে বুঝাতে পারলেন তাঁরা। কথার ফাঁকে এও জানিয়ে দিলেন―এই রাক্ষসেরা অত্যন্ত হীন এক জাতি। এদের উত্থান থামিয়ে না দিলে আর্য আর দেবসংস্কৃতি ধ্বংস হয়ে যাবে। আর যেটা সবচাইতে উত্তমরূপে বোঝাতে পারলেন, তা হলো―এই তিন রাক্ষস বিষ্ণুর শত্রু ব্রহ্মার ভক্ত।

শেষ কথাতেই উত্তেজিত হয়ে উঠলেন বিষ্ণু। শত্রুর অনুরাগীও যে শত্রু! ঋষিদের আশ্বস্ত করে আশ্রমে ফিরে যেতে বললেন। পরে দেবতাদের নিয়ে পরামর্শসভায় বসলেন। দীর্ঘ আলোচনার পর যুদ্ধকৌশল ঠিক করা হলো। দেবতারা নিজেদের সৈন্যসামন্ত নিয়ে বিষ্ণুর সঙ্গে যুক্ত হবেন। সবশেষে এটা সিদ্ধান্ত হলো যে এই তিন রাক্ষসের সঙ্গে যুদ্ধ করবেন স্বয়ং বিষ্ণু।

গুপ্তচরপ্রধান এসে বিষ্ণুর যুদ্ধসিদ্ধান্তের কথা তিন রাক্ষসপ্রধানকে জানাল। দিশেহারা হয়ে পড়লেন সুকেশপুত্ররা। কোনও আর্যনৃপতি নন, কোনও মুনিঋষি নন, অনার্য কোনও জনজাতি নয়, এমনকি দেবরাজ ইন্দ্র, শিব, গণেশ, কার্তিক, যক্ষ, দক্ষ, গন্ধর্বও নন, একেবারে মহাশক্তিধর বিষ্ণু তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধসিদ্ধান্ত নিলেন! এ এক মস্ত বড় সংকটকাল উপস্থিত হলো তাঁদের। ব্রহ্মার কথা মনে পড়ল তিন রাক্ষসের―অন্যরা তোদের হত্যা করতে না পারলেও বিষ্ণু কিন্তু তোদের পরাজিত করতে পারবেন, বধও করতে পারবেন। সুতরাং বিষ্ণুকে রাগাবার চেষ্টা করিস না।

তাঁরা তো বিষ্ণুকে রাগাবার চেষ্টা করেননি। কোনওরূপে শ্রুতিকটু বাক্য বলেননি, কখনও অশ্রদ্ধা করেননি বিষ্ণুকে। উপরন্তু ব্রহ্মার কথা মাথায় রেখে বিষ্ণু সম্পর্কে সতর্ক থেকেছেন সর্বদা। তার পরও তাঁদের ওপর ক্ষুব্ধ হলেন তিনি! ঋষি আর দেবতা দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তাঁদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলেন!

তিন রাক্ষস ব্রহ্মার কাছে ছুটে গেলেন। হত্যে দিয়ে পড়লেন তাঁর পদতলে। ব্রহ্মা উদাসীন। তাঁর বরপুষ্ট এই তিন রাক্ষসের দুর্বিনয়ের কথা, নিরীহ আর্যরাজা এবং দেবতাদের ওপর নির্মমতার বৃত্তান্ত ইতোমধ্যে কানে এসে পৌঁছেছে ব্রহ্মার। তখন তিনি উপলব্ধি করেছেন―ভুল ব্যক্তিদের বর দিয়েছেন তিনি। তাই মাল্যবান-সুমালী-মালীর আকুতিতে সাড়া দিলেন না ব্রহ্মা। অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে থাকলেন।

শত অনুনয়-ব্যাকুলতার পরও ব্রহ্মা কোনও পরামর্শ দিলেন না রাক্ষসভক্তদের। শুধু বললেন, ‘সাবধান করেছিলাম তোদের, শুনিসনি। এখন খেসারত দে।’

সুমালী বলতে চাইল, ‘আমরা তো কোনও দোষ করিনি! দেবতা বিষ্ণুকে কোনও অশ্রদ্ধা…!’

মুখের কথা কেড়ে নিয়ে ব্রহ্মা বললেন, ‘ওসব কথা শুনতে চাই না আমি। সতর্ক থাকিসনি। যা বিষ্ণুর মুখোমুখি হ গে। ভাগ্য ভালো থাকলে প্রাণে রক্ষা পেতে পারিস।’ বলে মৌন হলেন ব্রহ্মা।

তিন ভাই লঙ্কায় ফিরে এসে যুদ্ধপ্রস্তুতি নিলেন।

একদিন দেবসৈন্য আর রাক্ষসসেনা যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। উভয়পক্ষে ঘোরতর যুদ্ধ হলো। সুরাসুরের এই সমর দীর্ঘস্থায়ী হলো।

বিষ্ণু মারাত্মক মারণাস্ত্র সুদর্শনচক্ষের আঘাতে মালীকে হত্যা করলেন একদিন। মালী ছিলেন রাক্ষসবাহিনীর সমরাধ্যক্ষ। মালীর মৃত্যুসংবাদে রাক্ষসসৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। মাল্যবান-সুমালী প্রাণ হাতে নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেলেন।

ওখানেই থামলেন না বিষ্ণু। লঙ্কা আক্রমণের উদ্যোগ নিলেন। মাল্যবান-সুমালী সপরিবারে লঙ্কাপুরী ত্যাগ করে গেলে বিষ্ণু বিরত হলেন। দেবতা-ঋষিরা অরিমুক্ত হলেন।

বিষ্ণু দেবলোকে ফিরে গেলেন।

এদিকে মাল্যবান আর সুমালী সপরিবারে এবং সপারিষদে পাতাল নামক অনুন্নত এক দেশে আশ্রয় নিলেন।

একদিন লঙ্কাপুরী বিশ্রবাপুত্র কুবেরের দখলে চলে গেল। লঙ্কার রাক্ষসেরা কুবেরকে তাদের রাজা হিসেবে মেনে নিল।

গভীর এক বেদনা বুকের তলায় চেপে রেখে সুমালী পাতালদেশে বসবাস করে যেতে লাগলেন।

পাঁচ

মহর্ষি বিশ্রবার পুত্র কুবের।

বিশ্রবার পিতার নাম পুলস্ত্য। পুলস্ত্য মহান এক ঋষি। এমনি এমনি মহর্ষি হওয়া যায় না বা মহর্ষির পুত্র হলেই কেউ মহর্ষি হতে পারেন না। তার জন্য চাই সাধনা। কঠোর তপস্যার মাধ্যমে মহর্ষি হওয়া যায়। ব্রহ্মার মানসপুত্র পুলস্ত্যও তপস্যাবলে মহর্ষি হয়েছিলেন।

পুলস্ত্য এক সময় তপস্যামগ্ন হবার জন্য রাজর্ষি তৃণবিন্দুর আশ্রমে উপস্থিত হন। তৃণবিন্দুর আশ্রমটি একান্তে তপস্যা করার যথার্থ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়েছিল পুলস্ত্যের কাছে। ঋষি তৃণবিন্দু পুলস্ত্যকে সাদর স্বাগত জানালেন।

আশ্রম থেকে অদূরে নির্জন এক স্থানে পুলস্ত্য তপস্যা শুরু করলেন। বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হলো। পুলস্ত্যের সাধনা এগিয়ে চলল। এক অপরাহ্নে হঠাৎ নাচগানের আওয়াজ ভেসে এল পুলস্ত্যের কানে। বড় বিচলিত হলেন তিনি। নৃত্যগীতের শব্দ যে তাঁর তপস্যায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে! তাঁর মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে বারবার। সেদিন সংযত থাকলেন পুলস্ত্য। কিন্তু এই ঘটনা বারবার সংঘটিত হতে থাকল। একদিন তৃণবিন্দুর উঠানে গিয়ে উপস্থিত হলেন পুলস্ত্য। দেখলেন―রাজকন্যা, নাগকন্যা, অপ্সরাকন্যরা উঠানজুড়ে খেলাধুলা-নাচগানে মাতোয়ারা। উচ্চ বাজনাধ্বনিতে কানে তালা লাগার উপক্রম হলো পুলস্ত্যের। নিজের উপস্থিতি জানান দেওয়ার পরও কন্যারা তাঁকে কোনও গুরুত্ব দিল না। ক্ষেপে গেলেন পুলস্ত্য। বালিকা ভেবে নিজের ক্রোধকে সংযত করলেন।

বালিকাদের উদ্দেশে শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘তোমাদের নিত্যদিনের হৈচৈয়ে আমার তপস্যায় বিঘ্ন ঘটছে। তোমরা বাদ্যবাজনা-নাচগান থামাও। নইলে…।’

নাগকন্যা বিশাখা দুঃসাহসী। সে বলল, ‘নইলে কী হবে তপস্বী ?’ টেনে টেনে উপহাসের ভঙ্গিতে বলল বিশাখা।

এবার ক্রুদ্ধ হলেন পুলস্ত্য, ‘যদি আমার কথা না শোনো, যদি তোমাদের গানবাজনা চালিয়ে যাও, তাহলে অভিশাপ দেব আমি।’

‘অভিশাপ দেবেন! তা কী অভিশাপ দেবেন নবতপস্বী ?’ বিশাখার গায়ে ঢলে পড়ে অপ্সরাকন্যা লতিকা বলল। তার কথায় ব্যঙ্গ স্পষ্ট।

এবার প্রতিটি শব্দে শ্বাসাঘাত করে পুলস্ত্য উচ্চারণ করলেন, ‘এরপর যে মেয়ে আমার সামনে আসবে বা যে মেয়ের গান আমি শুনতে পাব, সেই মেয়ে তৎক্ষণাৎই গর্ভবতী হয়ে যাবে।’

সব কন্যা সমস্বরে আঁতকে উঠল, ‘উঃ মা!’

দ্রুত সবাই তৃণবিন্দু মুনির আশ্রম ত্যাগ করে গেল।

সেইবেলা মহর্ষি তৃণবিন্দু আশ্রমে ছিলেন না। আর তৃণবিন্দুর কন্যা ইলবিলা গৃহাভ্যন্তরে ছিলেন। ফলে আশ্রম-উঠানে সংঘটিত ঘটনার কিছুই জানতে পারলেন না মুনি এবং তাঁর কন্যাটি।

পুলস্ত্য তাঁর তপস্যাস্থলে ফিরে গেলেন। দিন গড়াতে লাগল, তপস্যা চলতে থাকল।

এক সকালে আপনমনে ঘুরতে ঘুরতে ইলবিলা পুলস্ত্যের তপস্যাস্থলে উপস্থিত হলেন। তিনি জানতেন না, পুলস্ত্য এখানে সাধনা করছেন। ধ্যানস্থ পুলস্ত্যকে দেখে শিহরিত হলেন ইলবিলা। এত সুন্দর! এরকম মনোহরা দেহগঠন মুনির! নিজের অজান্তে মুনির একেবারে নিকটে চলে এলেন ইলবিলা। ঝরাপাতার খসখস আওয়াজে পুলস্ত্যের ধ্যান ভেঙ্গে গেল। কঠিন চোখে তাকাতে গিয়ে বিমূঢ় হয়ে গেলেন তিনি। এরকম যৌবনবতী, এত সুন্দরী মেয়েটি কে ? তৃণবিন্দুর কন্যাকে আগে দেখেননি পুলস্ত্য। ক্রোধ মন থেকে আপনাতেই উবে গেল। তাঁর মনে ক্রোধের পরিবর্তে প্রেমবোধ সঞ্চারিত হলো।

সেদিন দু-চারটা কথা হলো উভয়ের মধ্যে। এরপর থেকে ঘন ঘন পুলস্ত্যের কাছে আসতে থাকল ইলবিলা। ঋষি তৃণবিন্দুর অজান্তেই ইলবিলার অভিসার চলতে থাকল।

একদিন দুটো শরীর কাছাকাছি এল। ইলবিলা গর্ভবতী হলেন।

রাজর্ষি তৃণবিন্দু মেয়ের গর্ভাবস্থা বুঝতে পারলেন।

জিজ্ঞাসার উত্তরে ইলবিলা বললেন, ‘আমার আগত সন্তানের পিতা ঋষি পুলস্ত্য।’

নির্বাক হয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ ঋষি তৃণবিন্দু। তাঁর আশ্রমে পুলস্ত্যকে তপস্যা করার অনুমতি দিয়ে এই ফল পেলেন তিনি! তাঁর কুমারী কন্যার সতীত্বে হাত বাড়ালেন পুলস্ত্য! তৃণবিন্দুর বুক চিরে গভীর এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল। ভেতরের অস্থির অগোছালো ভাবটাকে সংহত করলেন তিনি। পুলস্ত্যকে ডেকে পাঠালেন।

পুলস্ত্যের সঙ্গে ইলবিলার বিয়ে দিলেন রাজর্ষি তৃণবিন্দু।

যথাসময়ে ইলবিলার এক পুত্রসন্তান জন্মাল।

পুলস্ত্য বললেন, ‘এই পুত্রের নাম হবে―পৌলস্ত্য।’

ইলবিলা বললেন, ‘আর গর্ভাবস্থার সারাটা সময় ধরে যে আমি আপনার মুখনিঃসৃত বেদপাঠ শুনে গেলাম, তার কী হবে ?’

পুলস্ত্য স্ত্রীর কথায় ইতস্ততায় পড়ে গেলেন। চিন্তান্বিত হয়ে চুপ করে থাকলেন।

‘কিছু বলছেন না যে! পিতার দেওয়া নামই থাকবে পুত্রের ? মায়ের বাসনা কোনও গুরুত্ব পাবে না ?’ মৃদু একটু হেসে বললেন ইলবিলা।

চিন্তাসূত্র কেটে গেল পুলস্ত্যের। ত্বরিত বলে উঠলেন, ‘না না, তা হবে কেন ? ছেলের নাম রাখার ক্ষেত্রে মায়ের ইচ্ছা অবশ্যই গুরুত্ব পাবে।’

ইলবিলা বললেন, ‘তাহলে ছেলের আরেকটি নাম দিন। সেটা হবে আমার পক্ষের নাম। দেখি, পৃথিবীতে কোনটা প্রসিদ্ধি পায়! পিতার দেওয়া নাম, না মায়ের দেওয়া নাম!’

এবার হাসতে হাসতে পুলস্ত্য বললেন, ‘তোমার পুত্রের আরেকটা নাম দিলাম―বিশ্রবা।’

‘বিশ্রবা! এরকম নাম কেন ?’ জানতে চাইলেন ইলবিলা।

পুলস্ত্য মাথা নেড়ে বললেন, ‘একে গর্ভে ধারণ করে তুমি বেদপাঠ শ্রবণ করে গিয়েছিলে, তাই তোমার ছেলের অন্য নাম দিলাম―বিশ্রবা।’

পৃথিবীতে পৌলস্ত্যের চেয়ে বিশ্রবা নামটি বিখ্যাত হয়ে গিয়েছিল বেশি। মায়েরই জয় হয়েছিল শেষ পর্যন্ত।

বিশ্রবা তাঁর পিতা পুলস্ত্যের মতোই বেদজ্ঞ ও ধার্মিক হয়ে উঠেছিলেন। কঠোর-কঠিন তপস্যা করে সাধারণ মুনিপুত্র থেকে বিশ্রবা একদা মহর্ষিতে রূপান্তরিত হয়েছিলেন।

ভরদ্বাজ ভুবনপ্রসিদ্ধ ঋষি। মহর্ষি বিশ্রবার কথা একদিন তাঁর কানে পৌঁছাল। এমন গুণান্বিত রূপবান তরুণ ঋষিপুত্র ভূভারতে দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া দায়। ভরদ্বাজের ঘরে তখন পূর্ণযুবতীকন্যা দেববর্ণিনী। তিনি তখন দেববর্ণিনীর জন্য মনে মনে উপযুক্ত বর খুঁজছিলেন। বিশ্রবাকে কন্যার ভবিষ্য-বর হিসেবে পছন্দ হয়ে গেল ভরদ্বাজ ঋষির। বিশ্রবার পিতা-মাতার কাছে প্রস্তাব পাঠালেন। পুলস্ত্য আর ইলবিলা তখনও জীবিত। ঋষি ভরদ্বাজের প্রস্তাব সাদরে গ্রহণ করলেন তাঁরা।

যথাসময়ে বিশ্রবার সঙ্গে দেববর্ণিনীর বিয়ে সম্পন্ন হলো। তাঁদের পুত্রসন্তান জন্মাল। মাতা-পিতা সন্তানের নাম রাখলেন―কুবের। কুবেরের অন্য একটি নাম আছে―বৈশ্রবণ। মহর্ষি বিশ্রবার পুত্র বলে কুবেরের এরকম নাম।

বিশ্রবার তপাশ্রমেই কুবের বড় হতে থাকল। পিতার কাছে আশ্রমশিষ্যদের সঙ্গে বেদাদি শাস্ত্রপাঠ সম্পন্ন করল। কিন্তু তারুণ্য অতিক্রম করার পর দেখা গেল―কুবেরের মধ্যে ঋষিসুলভ ঔদাসীন্য নাই। ঋষিদের মতো ঐশ্বর্য-উদাসীনও নয় সে। তার যত আগ্রহ মণিমুক্তায়, ধনৈশ্বর্যে, প্রাসাদে-অট্টালিকায়। কিন্তু এগুলোর মালিক তো এমনি এমনি হওয়া যায় না! ক্ষমতাবান দেবতার কৃপা লাগে। ব্রহ্মার চেয়ে ক্ষমতাধর দেবতা সমস্ত দেবলোকে আর কে আছেন ?

কুবের ব্রহ্মার আরাধনায় নিজেকে নিয়োজিত করল। বহু বছর ধরে ব্রহ্মার তপস্যা করে গেল কুবের। সন্তুষ্ট হয়ে ব্রহ্মা কুবেরের সামনে আবির্ভূত হলেন।

ব্রহ্মার কাছে বেশ কয়েকটি বর চেয়ে বসল কুবের।

প্রথম বর―অমর হতে চায় সে। দ্বিতীয় বর―প্রভাবশালী নৃপতি হবার বাসনা তার। তৃতীয় বর―অফুরান ধনসম্পদের অধিকারী হতে চায়।

ব্রহ্মা সানন্দে তিনটি বরই প্রদান করলেন কুবেরকে। উপরন্তু স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে কুবেরকে পুষ্পক রথ দান করলেন। এই রথ আকাশে বিচরণ করতে সক্ষম। এই প্রথম দেবলোকের বিমান মানুষের হাতে এল।

ব্রহ্মার আনুকূল্যে কুবের বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক হয়ে গেল। তার ঐশ্বর্যের সীমা থাকল না। দেখতে অত্যন্ত বিশ্রী এই কুবের। ‘কু’ মানে কুৎসিত আর ‘বের’ অর্থ শরীর। ‘কুবেরে’র অর্থ দাঁড়ায় কুৎসিত দেহ যার। কুশ্রী দেহের জন্যই বিশ্রবা পুত্রটির এই নামটি রেখেছিলেন, স্ত্রীর জোরাজুরিতে। শেষ পর্যন্ত ব্রহ্মার বরে কুবেরের বিশ্রী চেহারা ধনৈশ্বর্যের তীব্র আলোতে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।

বিশ্রবার নিকট ফিরে এসেছিল কুবের। তার মনে তখন একটিই বাসনা―বসবাসের জন্য একটি আবাসস্থান চাই। ধনসম্পদ, বিত্তবৈভব, দেবতার আশীর্বাদ, আকাশচারী রথ, দিব্য অস্ত্র―সবই আছে তার, নেই শুধু যথাযোগ্য বাসস্থান। পিতা বিশ্রবার কাছে আবেদন করল কুবের, ‘বাবা আমার বসবাসের ব্যবস্থা করুন।’

ইতোমধ্যে বিশ্রবা পুত্র কুবেরের ব্রহ্মার বর লাভের কথা জেনে গিয়েছেন। অন্যসময় হলে অবাক হয়ে বলতেন, ‘কেন, এই আশ্রমেই থাকবে তুমি! তুমি তো আমার একমাত্র পুত্র! আমার মৃত্যুর পর এই আশ্রমের দায়িত্ব তো তোমাকেই নিতে হবে পুত্র, যেমন করে পিতা পুলস্ত্যের আশ্রমের দায়িত্ব আমি নিয়েছিলাম।’ এই কথাগুলো কুবেরকে বলতে গিয়ে বললেন না বিশ্রবা। কারণ তিনি তো জেনে গেছেন―তাঁর পুত্রটি আর ঋষিধর্ম পালন করবে না। সে এখন ধনলোভী হয়ে গেছে। ব্রহ্মার কাছ থেকে আশীর্বাদ পেয়ে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ ধনীতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে কুবের। তাই কুবেরকে এই আশ্রমে থাকার কথা বলা বৃথা। বিশ্রবা বুঝে গেছেন, কুবেরের জন্য এখন একটা নগরীর দরকার। যে নগরী সুরক্ষিত, যে নগরী সুরম্য প্রাসাদে আকীর্ণ।

হঠাৎ লঙ্কাপুরীর কথা মনে পড়ে গেল বিশ্রবার। এই নগরীটি কিছুদিন আগে রাক্ষসদের রাজধানী ছিল। ব্রহ্মাবরে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছিলেন মাল্যবান-সুমালী-মালী। বিষ্ণুকে রাগিয়েছেন তারা। তাই বিষ্ণু মালীকে হত্যা করে রাক্ষসরাজ সুমালী আর মাল্যবানকে লঙ্কাছাড়া করেছেন। রাজাহীন লঙ্কা এখন। রাজা না থাকলে কী হবে, তাতে লঙ্কার চমৎকারিত্ব বিন্দুমাত্র কমেনি। বিশ্বকর্মার নির্মাণদক্ষতার নিদর্শনসমূহ লঙ্কা এখনও ধারণ করে আছে। কিছু রাক্ষস মাল্যবান-সুমালীর সঙ্গে লঙ্কা ত্যাগ করে গেলেও সাধারণ রাক্ষসেরা এখনও লঙ্কায় বসবাস করে যাচ্ছে। এই লঙ্কাই হবে পুত্র কুবেরের বসবাসের উপযুক্ত স্থান―মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলেন বিশ্রবা।

কুবেরকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘ত্রিকুট পর্বতের শিখরে লঙ্কাপুরী অবস্থিত। একদা রাক্ষসদের অনুরোধে বিশ্বকর্মা এই নগরী বানিয়েছিলেন। লঙ্কার রাজা এখন বিতাড়িত। তুমি ওই লঙ্কানগরীতে গিয়ে বাস করা শুরু করো।’

পিতার নির্দেশে কুবের লঙ্কাপুরীতে উপস্থিত হলো। রাজপ্রাসাদে প্রবেশ করার সময় কেউ তাকে বাধা দিল না। বিনা বাধায় সমস্ত লঙ্কা কুবেরের অধীনে চলে এল। রাক্ষসপ্রজারা কুবেরকে নিজেদের রাজা হিসেবে মেনে নিল। কুবের লঙ্কার শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে থাকল বহুলভাবে। নাগরিক জীবন সুখ ও স্বস্তিতে ভরে উঠল। অরণ্যে-পাহাড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রাক্ষসেরা দলে দলে লঙ্কায় ফিরে এল।

কুবের এখন জগদ্বিখ্যাত একজন নৃপতি। তার অগাধ ধনসম্পদ। তার দেহে এখন দেবতুল্য আভা। আর্য রাজাদের কথা বাদ, দেবতারাও এখন কুবেরকে সমঝে চলেন।

একদিন পিতার সঙ্গে দেখা করার জন্য কুবের বিশ্রবার আশ্রমে যাচ্ছিল। ওইদিন, বহুদিন পর, রাক্ষস সুমালী কন্যা কৈকসীকে সঙ্গে নিয়ে পাতাল থেকে মর্ত্যে ভ্রমণ করতে বেরিয়েছেন। পথে কুবেরকে দেখতে পেলেন সুমালী। দেখেই চিনলেন। তখন তখনই তীব্র এক বাসনা সুমালীর মনে জেগে উঠল। হৃতরাজ্য লঙ্কাকে যে-করেই হোক পুনরায় রাক্ষসদের অধীনে আনতে হবে।

ছয়

তপোবন।

সায়ংকাল।

কিছুক্ষণ আগে সূর্য অস্ত গেলেও পৃথিবী থেকে তার আলো একেবারে বিলীন হয়ে যায়নি। পশ্চিমাকাশ রক্তবর্ণ ধারণ করে আছে এখনও। হেমন্তের মাঝামাঝি এখন। আকাশ স্বচ্ছ নীল। মৃদু শীতল বাতাস বইছে। পাখিরা আকাশ পাড়ি দিয়ে নিজ নিজ নীড়ে ফিরছে।

শিষ্যরা আশ্রমে ধূপ-প্রদীপ জ্বালিয়েছে। সবাই আশ্রম-প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করেছে। অল্পক্ষণ পরে গুরুদেব বিশ্রবা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করা আরম্ভ করবেন। প্রাঙ্গণে অগ্নিহোত্রের আয়োজন করা হয়েছে। বেদপাঠ শেষে মহর্ষি বিশ্রবা অগ্নিহোত্র করবেন।

যথাসময়ে আচমনের মধ্য দিয়ে সমবেত কণ্ঠে ঈশ্বর বন্দনা শুরু হলো। তারপর জলদগম্ভীর কণ্ঠে বিশ্রবা বেদপাঠ আরম্ভ করলেন।

অগ্নিহোত্র সম্পন্ন করার শেষ পর্যায়ে বিশ্রবার চোখ অদূরে দাঁড়ানো এক যুবতীতে আটকে গেল।

কী ভাবলেন কে জানে, শিষ্যদের স্থান ত্যাগ করে যেতে নির্দেশ দিলেন বিশ্রবা।

যুবতীটি বিশ্রবার আরও নিকটে এগিয়ে এলেন। বিশ্রবা দেখলেন―অপরূপ এক রূপময়ী নারী তাঁর সম্মুখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। বাম পায়ের বুড়ো আঙুল দিয়ে মাটিতে আঁকিবুঁকি করছেন।

বিশ্রবা বেশ অবাক হলেন। কে এই যুবতী ? দেখে ঋষিকন্যা বলে মনে হচ্ছে না। আর্যবংশের কোনও নারীও নয় এ! তার দেহগঠন ও গাত্রবর্ণ আর্যনারীসুলভ নয়। একে দেখে বরং অনার্যবংশজাত বলে অনুমান হচ্ছে। কোঁকড়ানো চুল, প্রশস্ত নাসিকা, অনুচ্চ দেহ। শ্যামল দেহরং। সেই শ্যামলদেহে জগতের সকল সৌন্দর্য দ্রবীভূত হয়ে আছে। সারা অঙ্গ জুড়ে যৌবনের ঘনঘটা। স্বল্পবসনের যুবতীটি বিশ্রবার দেহমনে বিপুল এক কম্পন তৈরি করল। যুবতীটি মাথা নিচু করে আছেন বলে বিশ্রবা তাঁর চোখ দুটি দেখতে পাচ্ছেন না। যদি দেখতে পেতেন, তাহলে দেখতেন―হৃদয় বিদীর্ণ করা মায়াময় দুটি নেত্রের অধিকারী এই যুবতীটি।

সংবিতে ফিরলেন বিশ্রবা। বিভোর গলায় বললেন, ‘কে তুমি রমণী ?’

ঋষির দিকে চকিতে চোখ তুললেন নারীটি―রমণী! যুবতী নয়, নারী নয়, ওহে নয়, কে হে নয়! একেবারে ‘রমণী’ বলে সম্বোধন করলেন ঋষি তাঁকে! যুবতীটি বিচক্ষণ এবং শিক্ষিত। তিনি ‘রমণ’ শব্দটির অর্থ জানেন। এই শব্দটির সঙ্গে যে রতিক্রিয়ার ব্যাপারটি জড়িয়ে আছে, তা সম্যক জানেন যুবতী। ঋষি বিশ্রবা তাহলে তাঁকে দেখে বিস্রস্ত হয়েছেন। তাঁর কি রমণেচ্ছা জাগল তাঁকে দেখে ? নইলে ‘রমণী’ বলে সম্বোধন করলেন কেন ?

মৃদু একটি হাসির রেখা যুবতীটির মুখে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল। ‘আমি সামান্য একজন অনার্যকন্যা। রাক্ষসবংশে জন্ম আমার।’

‘তোমার পিতা-মাতা ?’

‘তার আগে আমার নিজের নামটা বলি ঋষিবর ?’

বিশ্রবা সম্মতির মাথা নাড়লেন।

যুবতী বললেন, ‘আমার নাম কৈকসী। পিতা আদর করে আমাকে নিকষা বলে ডাকেন।’

‘তোমার বাবা… ?’ ঋষি কৈকসীর পিতার নাম জানতে চাইলেন।

কৈকসী বললেন, ‘আমার বাবা সুমালী। রাক্ষসরাজ সুমালী। একদা লঙ্কাধিপতি ছিলেন। লঙ্কা থেকে বিতাড়িত হয়ে এখন পাতালে বাস করছেন। আমার মায়ের নাম কেতুমতী। গন্ধর্বকন্যা তিনি।’

লঙ্কার নাম শুনে বিশ্রবার ভেতরটা একটু নড়ে উঠল। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। তারপর থতমত কণ্ঠে বললেন, ‘তা কৈকসী, আমার কাছে এসেছো কেন ? এই ভর সন্ধ্যাবেলায় ?’

‘পিতার আদেশে।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর কৈকসীর।

‘পিতার আদেশে! কেন, পিতার আদেশে আমার কাছে এলে কেন ? তোমার পিতার আদেশই-বা কী ?’ জানতে চাইলেন বিশ্রবা।

ব্রীড়ানত কৈকসী অনেকটাই স্বগত কণ্ঠে বললেন, ‘আমার বাবার ইচ্ছে আপনার ঔরসে আমার গর্ভে একটি পুত্রসন্তান জন্মাক।’ বলে দ্রুত মাথা নিচু করলেন কৈকসী।

অতি মৃদু স্বরে বললেও বিশ্রবা কৈকসীর কথাগুলো শুনতে পেলেন। বললেন, ‘তোমার বাবার ইচ্ছা আমি তোমাকে বিয়ে করি ?’

‘বিয়ে না করে সন্তান উৎপাদন করবেন কী করে!’ কৈকসীর কণ্ঠে কৌতুক উছলে উঠল।

‘না না! আমি সে কথা বলছি না। একজন ঋষির আর্য-অনার্য-গন্ধর্ব-দেবকন্যা―সবাইকে বিয়ে করবার অধিকার আছে। প্রথাটি শাস্ত্রস্বীকৃত।’

‘জানি আমি মহর্ষি। শাস্ত্রটা তো আপনাদেরই লেখা-রীতি! প্রথাগুলোও আপনাদের সৃষ্ট! সুতরাং সেই প্রথা-রীতি তো আপনাদেরই অনুকূলে থাকবে!’ খাদে নামানো কণ্ঠে বললেন কৈকসী।

কৈকসীর কথা ভালো করে শুনতে পেলেন না বিশ্রবা। বললেন, ‘কিছু বললে তুমি কৈকসী ?’

‘না না, তেমন কিছু নয় ঋষিবর। এবার বলুন, আমাকে বিয়ে করে আমার বাবার আশা পূরণ করবেন তো আপনি ?’

‘এত করে বলছো তুমি! তোমার পিতার দোহাই দিচ্ছ! তোমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করি কী করে বলো!’ কৈকসীর খোলা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে চোখ দিয়ে লেহন করতে করতে বললেন বিশ্রবা।

‘আমার একটা ব্যাপার জানার ছিল মহাত্মন।’ কৈকসীর চোখেমুখে কৌতূহল।

ঘোরলাগা চোখে বিশ্রবা বললেন, ‘বলো, কী জানতে চাও।’

‘আপনার ঘরে স্ত্রী আছেন―দেববর্ণিনী। কুবের নামে আপনাদের একজন সন্তানও আছে। পত্নী থাকা সত্ত্বেও আমাকে বিয়ে করতে আপনার আপত্তি নেই বুঝলাম। কিন্তু মহাপ্রাণা দেববর্ণিনীর তো আপত্তি থাকতে পারে!’

এবার আশ্রম কাঁপিয়ে হেসে উঠলেন বিশ্রবা, ‘আরে, ওর কী আপত্তি থাকবে! আমাদের ঋষিসমাজে একজন পুরুষ বহু বিয়ে করতে পারে। তাতে পূর্বতন পত্নীর কোনওরূপ বাধা দেওয়ার অধিকার নেই।’

‘বলছেন, আমাকে মানে একজন অনার্যনারীকে আপনি বিয়ে করতে চাইলে আপনার বর্তমান পত্নী বাধা দিতে পারবেন না ?’

‘যথার্থ বুঝেছো তুমি।’ বিশ্রবার প্রসন্ন চোখমুখ।

‘হায়রে নারী! হায়রে দেববর্ণিনী!’ স্বগত কণ্ঠে বলে উঠলেন কৈকসী।

‘তবে একটা বিষয় তোমার-আমার বিয়েতে অন্তরায় হয়ে আছে।’

‘কী সেটা ?’ ত্বরিত বিশ্রবার দিকে তাকালেন কৈকসী।

বিশ্রবা বললেন, ‘সময়। তুমি যে সময়টায় আমাকে যাচনা করলে, সেই সময়টা বিয়ের প্রস্তাবের জন্য অনুকূল নয়। এই সন্ধ্যাটায় ত্র্যহস্পর্শ দোষ আছে।’

‘ত্র্যহস্পর্শ দোষ থাকলে কী হবে ?’ জানতে চাইলেন কৈকসী।

‘তুমি এই মহাসন্ধ্যাকালে আমার কাছে সন্তান কামনা করলে, এই সময়কার সন্তানরা ভালো স্বভাবের হয় না। খলস্বভাবী হয় তারা। তাদের চেহারা হয় ভীষণাকার।’

মৃদু একটু হেসে একেবারে নিচু কণ্ঠে কৈকসী বললেন, ‘আপনার ঔরসের সন্তানরা দেবতুল্য হবে কী করে ? কুৎসিতই তো হবে ওরা! কুবেরই তো তার প্রমাণ!’

‘কী, কী বললে তুমি কৈকসী ?’ কৈকসীর কথা স্পষ্ট শুনতে পাননি বিশ্রবা।

‘না, কিছু না।’ কৈকসী এরই মধ্যে বুঝে গেছেন, বিশ্রবা তাঁর যৌবনে মজেছেন। যৌবনমত্ত লোকদের কাছে যে কোনো কথা বলা যায়।

কৈকসী বললেন, ‘আমি তো দুষ্টপ্রকৃতির কোনও সন্তান চাই না মহর্ষি! আমি চাই আমার পুত্ররা কুবেরের মতো ঐশ্বর্যশালী হোক। আপনার মতো ধার্মিক ও তেজস্বী হোক আমার সন্তানরা।’

‘তা তো হবার নয় কৈকসী!’ বললেন বিশ্রবা। ‘সময়টা যে বড় দুঃসময়! দুঃসময়ের সন্তানরা বলবান, বীর্যবান হবে ঠিক; কিন্তু তারা হবে আধিপত্যপরায়ণ, দুর্বিনীত এবং রিরংসু।’

একটু থেমে আবার বললেন বিশ্রবা, ‘তবে একটি ব্যাপারে তোমাকে আশ্বস্ত করতে পারি আমি।’

জলটলমল দৃষ্টি মুনির ওপর ফেলে কৈকসী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কোন ব্যাপারে ?’

বিশ্রবা খুশি খুশি চোখমুখে বললেন, ‘তোমার শেষ সন্তানটি হবে আমার মতো সৎ এবং ধার্মিক।’

নিরুত্তর থাকলেন কৈকসী। কিছুক্ষণ পর কৈকসী বড় একটা শ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘আমি যাই, বাবাকে সংবাদটা দিতে হবে।’ বলে দু কদম এগিয়ে গিয়ে পেছন ফিরলেন কৈকসী, ‘দু দিন পর আমি ফিরে আসব মহর্ষি। বিয়ের জন্য প্রস্তুত হয়েই ফিরব আমি।’

দু দিন পর ফিরে এসেছিলেন কৈকসী। বিশ্রবা তাঁকে বিয়ে করে আশ্রমে থাকতে দিয়েছিলেন। বিগতযৌবনা দেববর্ণিনীর সঙ্গে যৌবনবতী কৈকসীর আশ্রমজীবন শুরু হয়েছিল।

বেশ কিছুদিন অতিক্রান্ত হলো। কৈকসীর গর্ভচিহ্ন স্পষ্ট হলো। যথাসময়ে ভয়ংকরদর্শন এক পুত্রসন্তান প্রসব করলেন কৈকসী। সদ্যোজাত স্বাভাবিক সন্তানের তুলনায় এর আকার বেশ বড়। তাম্রবর্ণের ওষ্ঠ। বিশাল মুখগহ্বর। মাথায় ঝাঁকড়া চুল। পিতার গায়ের রং পায়নি সে। অনার্যদের মতো কালো তার দেহরং। এই সন্তানটির নাম দেওয়া হলো―রাবণ। বছর কয়েক পরে বোঝা গেল, রাবণের শারীরিক গঠন অত্যন্ত পৌরুষেয় এবং তার ব্যক্তিত্ব অধিরাজ-জনোচিত।

কৈকসী তাঁর পুত্রটির এরকম চেহারা দেখে বিচলিত হননি। কারণ তিনি তো জানতেন, তাঁর পুত্রদের অবয়ব আর দেহগঠন এরকমই হবে। যদিও সুপুত্রের মাতা হবার অভিপ্রায় নিয়ে তিনি বিশ্রবার কাছে এসেছিলেন, বিশ্রবা সময়দোষের কথা বলে সেই সময়েই জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর শেষ পুত্রটি ছাড়া অন্য সন্তানরা সুশীল হবে না, সুচেহারার হবে না।

প্রথম সাক্ষাতের দিন বিশ্রবা কৈকসীকে বলেছিলেন, তোমার ছেলেরা হবে অদ্ভুত স্বভাবের এবং ভয়ংকরদেহী। কুম্ভকর্ণের মধ্যে ঋষির কথার অনুপুঙ্খ প্রতিফলন দেখতে পেলেন কৈকসী। কুম্ভকর্ণ কৈকসীর দ্বিতীয় পুত্র।

কুম্ভকর্ণ অন্যান্য রাক্ষসজাতীয় মানুষের তুলনায় অত্যন্ত লম্বা ও অতিশয় স্বাস্থ্যবান। মাত্রাতিরিক্ত আহার করে সে। যে কোনো রকম খাদ্য খেতে কুম্ভকর্ণের আপত্তি নেই। খাদ্যের প্রতি যেমন লোভ কুম্ভকর্ণের, তেমনি ঘুমের প্রতি আসক্তি। শেষ পর্যন্ত তার জীবনে এমন হলো যে খাদ্য আর নিদ্রা ছাড়া অন্য কিছুর অস্তিত্ব অর্থহীন হয়ে গেল।

রাবণ-কুম্ভকর্ণের পরে বিশ্রবার ঔরসে কৈকসীর গর্ভে একটি কন্যাসন্তান জন্মাল। এই কন্যাটিও পিতার গায়ের রং পেল না। চারুদর্শনাও হলো না সে।

এক একটি সন্তান জন্মেছে, ঋষি বিশ্রবা তাদের এক একটা বিচিত্র নাম দিয়েছেন। এই নাম শ্রুতিমধুর নয়। সন্তানদের নামের মধ্যে যেন ঋষির ঘৃণা নিহিত। নাম রাখার ক্ষেত্রে সন্তানদের অঙ্গবিকৃতিকে পুঁজি করেছেন বিশ্রবা। কুম্ভকর্ণের কান কলসের মতো দেখতে। তাই তার নাম রাখার ক্ষেত্রে গুণবাচক কোনও নাম রাখলেন না। নাম রাখলেন বিকৃতিবাচক।

একমাত্র কন্যাটির ক্ষেত্রেও তা-ই করলেন বিশ্রবা। কুবের থেকে আরম্ভ করে এই কন্যাটি পর্যন্ত কেউই সুন্দর চেহারার হলো না। তাই ভেতরে ক্রোধ জন্মেছিল তাঁর। সেই ক্রোধেরই হয়তো প্রতিফলন ঘটিয়েছেন সন্তানদের নাম রাখার ক্ষেত্রে। কন্যাটির নখগুলো কুলোর মতন খানিকটা চ্যাপ্টা। তাই বিশ্রবা তাঁর কন্যার নাম রাখলেন―শূর্পণখা।

পরের যে ছেলেটি জন্মাল, যে স্বভাবে আর আকৃতিতে রাবণ-কুম্ভকর্ণের বিপরীত, বিশ্রবা তারও নাম রাখলেন―বিভীষণ। ভীষণ মানে ভয়াল, ভীতিপ্রদ। বিশেষভাবে ভয়ংকর যে, সে-ই তো বিভীষণ! বিশ্রবার মতে যে ছেলেটি তাঁরই মতো সুশীল ও ধার্মিক হবে, সেই ছেলেটিও পিতার ঘৃণা থেকে রেহাই পেল না।

কৈকসীর চার সন্তান বিশ্রবার তপাশ্রমে ধীরে ধীরে যৌবনপ্রাপ্ত হতে থাকল।

সাত

জ্যেষ্ঠপুত্র রাবণের প্রতি গভীর টান কৈকসীর। এই পুত্রটিকে দেখলে পিতা সুমালীর কথা মনে পড়ে যায় তাঁর। কানে বাজে―আমার একজন কুবেরের মতো নাতি চাই মা। দীর্ঘদিন নিজরাজ্য থেকে বিতাড়িত আমি। তোমার সেই পুত্রটিই পারবে কেবল আমাকে বিতাড়িত হবার অপমান থেকে মুক্তি দিতে। পিতার এই বাসনার বাণী কৈকসীর কানের কাছে বাতাসে ভর করে ঘুরতে থাকে। পিতার অসহায় অপমানিত মুখটি কৈকসীর চোখে ভেসে ওঠে তখন। তাঁর হৃদয়টা ভেঙে চুরমার হতে থাকে। নিজের অজান্তে কৈকসীর মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে, ‘পিতার অপমানের প্রতিশোধ নিতে হবে। বাবার মুখে হাসি ফোটাতে হবে। লঙ্কাকে রাক্ষসদের অধীনে আনতে হবে আবার। লঙ্কাকে ওই দেববর্ণিনীর পুত্র কুবেরের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে।’

রাবণের অতি-বলশালী রূপ দেখে কৈকসীর আশা সুদৃঢ় হয়েছে। এই পুত্রটি পারবে, এই রাবণই পারবে লঙ্কাকে স্বাধীন করতে। পিতা-পিতৃব্য-জেঠা মিলে যে লঙ্কাপুরীর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, বিশ্বকর্মাকে দিয়ে যে রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করিয়েছিলেন, সেই রাজপ্রাসাদের চূড়ায় পুনরায় রাক্ষসজাতির পতাকা উড়াবে তাঁরই গর্ভজাত পুত্র রাবণ। এর জন্য দরকার শক্তির সঙ্গে ঘৃণার মিশ্রণ ঘটানো। মানুষ যখন ঈর্ষান্বিত হয়, অপ্রাপ্তির বেদনায় আক্রান্ত হয়, তখন তার মধ্যে ঘৃণার স্ফুরণ ঘটে। রাবণের মধ্যে অপ্রাপ্তির দুঃখটা জাগাতে হবে, ঈর্ষান্বিত করে তুলতে হবে তাকে। তার কী নেই, চেষ্টা করলে কী পেতে পারে―বোঝাতে হবে রাবণকে। রাবণরা যে এখন অতিদরিদ্র অবস্থায় জীবনযাপন করছে, ইচ্ছে করলে সহজেই অপার ঐশ্বর্যের অধিকারী হতে পারে রাবণ, তা তার মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে। আর তা করতে সক্ষম হলে তাঁর এবং তাঁর বাবার দীর্ঘদিনের মনোবাসনা পূর্ণ হবে। এসব কথা মনে মনে ভাবেন কৈকসী আর সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন।

দ্রুত সেই সুযোগ এসে গেল কৈকসীর হাতে।

একদিন পুষ্পকরথে চড়ে কুবের লঙ্কা থেকে পিতা বিশ্রবার সঙ্গে দেখা করতে এল। আশ্রম-প্রাঙ্গণে পুষ্পকরথ থেকে অবতরণ করল কুবের। উঠানজুড়ে শিরদাঁড়া সোজা করে দেহরক্ষীরা সঙ্গিন উঁচিয়ে আছে। চারদিকে ব্যক্তিত্ব আর আভিজাত্যের আভা ছড়িয়ে পিতার কক্ষে গিয়ে ঢুকল কুবের।

আড়াল থেকে দেখলেন তা কৈকসী। মনের মধ্যে ঈর্ষার আগুন দাউ দাউ করে উঠল। আহা! তাঁর পুত্র রাবণও যদি এরকম হতো! তার অঙ্গে যদি এরকম বহুমূল্যের আবরণ-আভরণ থাকত! তার যদি পুষ্পকরথ থাকত! তাকে ঘিরে যদি এরকম দেহরক্ষীরা থাকত! সে যদি কুবেরের মতো লঙ্কাধিপতি হতো! আর! আর ভাবতে পারছেন না কৈকসী! কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে মাথায় হাত দিয়ে বৃক্ষতলে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। অস্থির মন স্থির হলো একসময়। তাঁর মনে হলো―কুবেরের এই ঐশ্বর্য, এই ক্ষমতা রাবণকে দেখানো দরকার। তাঁর ভেতরে ক্ষমতালোভের সঞ্চার করা প্রয়োজন!

রাবণকে ডেকে আনলেন কৈকসী, ‘দেখো বাছা, তোমার বৈমাত্রেয় ভাই কুবেরকে দেখো। দেখতে পাচ্ছ ?’

‘হ্যাঁ, দেখতে পাচ্ছি মা।’

‘কী দেখতে পাচ্ছ ? কী দেখতে পেলে ?’

পুষ্পকরথ দেখতে পাচ্ছি। সতর্ক দেহরক্ষী দেখতে পাচ্ছি। আর সুসজ্জিত দাদাকে মাথা উঁচু করে পিতার কক্ষে প্রবেশ করতে দেখলাম।’

‘কুবেরকে দেখতে কীরকম মনে হলো ?’

‘অভিজাত। অহংকারী। পিতার প্রতি বিনীত।’

‘অহংকারী মনে হলো কেন কুবেরকে ?’

মায়ের কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ল রাবণ, ‘কুবের দাদা অহংকারী হবে না তো কে হবে! কত বিরাট নৃপতি! কী বিপুল সম্পত্তির অধিশ্বর! আর শ্রেষ্ঠতম নগরী লঙ্কা তার রাজধানী! এত ঐশ্বর্যময় যে-মানুষটি, সে তেজস্বী না হলে কে হবে মা ?’

কৈকসী বললেন, ‘তুমি ভুলে একটা মূল্যবান জিনিসের নাম বলোনি পুত্র।’

বিস্মিত চোখে মায়ের দিকে তাকাল রাবণ।

কৈকসী বললেন, ‘তুমি পুষ্পকরথের কথা উল্লেখ করোনি ভুলে। এই রথটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি যানবাহন। এই ধরনের রথ শুধু প্রভাবশালী দেবতাদের আছে। মানুষদের মধ্যে আছে শুধু কুবেরের। এই রথটি তোমার হতে হবে বাছা।’

‘আমার হতে হবে! পুষ্পকরথের মালিক হব আমি! তা কী করে হয় মা ?’

কৈকসী পুত্রের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বললেন, ‘তোমরা দুজনেই কিন্তু একই পিতার সন্তান। অথচ দেখো―কুবেরের মর্যাদা কোথায়, প্রতিপত্তিই-বা কীরকম! আর তুমি নিজে কোথায় দাঁড়িয়ে আছো!’

মায়ের কথা শুনে রাবণের মাথায় চিড়িক করে উঠল। সারা শরীরে কীরকম একটা জ্বালা অনুভব করতে লাগল সে। ঈর্ষার হাজারো বিছা হুল ফুটিয়ে তার হৃদয়কে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে লাগল। ওই সময় মায়ের আরও কিছু কথা শুনতে পেল রাবণ, ‘চেষ্টা করে দেখো পুত্র, তুমি কুবেরের মতো হতে পারো কিনা। তোমার মায়ের বড় বাসনা পুত্র―বিপুল ক্ষমতাধর রাবণের মা হবার।’

তারপর কণ্ঠকে খাদে নামালেন কৈকসী, ‘পরাধীন লঙ্কাকে স্বাধীন করো রাবণ। এই নগরী রাক্ষসদের। কুবের সেখানে অনধিকার প্রবেশ করেছে। লঙ্কা থেকে কুবেরকে তাড়াও পুত্র।’

রাবণ মায়ের এই কথাগুলোর কিছুটা শুনতে পেল, কিছুটা পেল না। কিন্তু এটা স্পষ্ট করে শুনল―লঙ্কা থেকে কুবেরকে তাড়াও পুত্র।

জন্মগতভাবে রাবণ অতিশয় শক্তিশালী। শক্তিশালী মানুষদের তেজ বেশি। রাবণ অতুলনীয় তেজস্বী। মায়ের প্রচ্ছন্ন ধিক্কারবাণী রাবণকে ক্ষিপ্ত করে তুলল। তার ভেতরের লালসা ধক ধক করে উঠল।

দীপ্ত কণ্ঠে মাকে বলল, ‘তুমি মনে দুঃখ রেখো না মা। দেখে নিয়ো, একদিন না একদিন আমি কুবেরের সমান হব, নতুবা তার খ্যাতি-প্রতিপত্তিকে অতিক্রম করে যাব।’

পুত্রের কথা শুনে পরম আদরে রাবণকে বুকে টেনে নিলেন কৈকসী।

আবেগবশে মায়ের সামনে রাবণ প্রতিজ্ঞা করল ঠিকই, কিন্তু কী করে কুবেরের অধিক প্রতিপত্তি অর্জন করা যাবে, জানা নেই রাবণের। পিতার কাছেও পরামর্শ চাওয়া যায় না। কারণ ওই পরামর্শের মধ্যে যে বিশ্রবার প্রিয়তম পুত্র কুবেরের ধ্বংসবীজ নিহিত!

অনন্যোপায় হয়ে মাকেই জিজ্ঞেস করে বসল একদিন, ‘মা, তুমি তো আমার মধ্যে উচ্চাকাক্সক্ষার আগুন জ্বালিয়ে দিলে! প্রতিজ্ঞাও করে বসলাম মা তোমার সামনে! কিন্তু এই প্রতিজ্ঞা পূরণ করব কী করে ? আমি তো কোনও দিশা পাচ্ছি না মা! তুমি আমাকে পথ দেখাও মা।’

কৈকসী বললেন, ‘অস্থির হয়ো না পুত্র। আমি তোমাকে দু-একটি কথা বলছি, মনোযোগ দিয়ে শোনো।’

করুণ চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে রাবণ বলল, ‘বলো মা। শুনছি।’

‘শোনো পুত্র, বলাধিক্য অথবা মহান প্রতিপত্তির জন্য তপস্যাই একমাত্র পথ। তপস্যা দ্বারা কোনও দেবতাকে তুষ্ট করতে পারলে কাক্সিক্ষত বস্তু তোমার করতলগত হবে।’ বললেন কৈকসী।

রাবণ বলল, ‘তপস্যা বুঝলাম, কিন্তু কোন দেবতার তপস্যা করব আমি ? কোন দেবতাকে আমি সন্তুষ্ট করতে পারব ? আমি যে রাক্ষসীর পুত্র মা! কোন দেবতা এই রাক্ষসীপুত্রকে বর দেবেন ?’

রাবণের কথা শুনে হঠাৎ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন কৈকসী, ‘তুমি প্রবল দেহশক্তির অধিকারী, মানি তা। কিন্তু ছোটবেলা থেকে তুমি বড় অধৈর্য রাবণ। শোনার চেয়ে শোনাতে চাও বেশি।’ বলে থেমে গেলেন কৈকসী!

রাবণের তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা। মা কখনও তার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করেননি।

কৈকসী তা অনুধাবন করলেন, ‘দেখো পুত্র, মহামহিম দেবতাদের কাছে অনার্য-আর্যের ভেদাভেদ নেই। যে ভক্তিসহকারে আরাধনা করে, তার ডাকেই সাড়া দেন তিনি।’

‘সেরকম দেবতা আছেন নাকি ?’

‘আছেন তো! ওই দেবতার তপস্যা করেই তো তোমার মাতামহরা লঙ্কার অধিপতি হতে পেরেছিলেন!’

‘কে তিনি মা ? নাম বলো। আমি তাঁরই তপস্যা করব।’ আবেগাপ্লুত হয়ে রাবণ বলল।

ভক্তিতে মাথা নিচু করে কৈকসী বললেন, ‘তিনি ব্রহ্মা। তুমি তাঁর তপস্যা করো পুত্র। তোমার সমস্যা কঠোর এবং অকৃত্রিম হলে তিনি তোমার সামনে আবির্ভূত হবেনই হবেন।’

ব্রহ্মার উদ্দেশে জোড় হাত কপালে ঠেকিয়ে রাবণ বলল, ‘আমি দেবাদিব ব্রহ্মার আরাধনার জন্য আগামীকালই আশ্রম ছেড়ে যাব মা।’

‘তোমার মনস্কামনা পূর্ণ হোক পুত্র।’

পরদিন কুম্ভকর্ণ এবং বিভীষণ দুই ভাইকে সঙ্গে নিয়ে গোকর্ণ নামের চিরবিখ্যাত পবিত্রভূমির উদ্দেশে যাত্রা করল রাবণ। রাবণ শুনেছে―গোকর্ণ অতি পূত এক ভূমি। এখানে তপস্যা করে কেউ ব্যর্থ মনোরথ হয়নি। যে দেবতার তপস্যা করা হয়েছে, সেই দেবতা বর দান করেছেন। তাই সাধনার জন্য অনেক স্থান থাকা সত্ত্বেও গোকর্ণকে বেছে নিয়েছে রাবণ।

স্বার্থপর নয় রাবণ। নিজের স্বার্থের সঙ্গে সঙ্গে সহোদরদের কথাও ভেবেছে। সে নিজে একা ব্রহ্মার আশীর্বাদপুষ্ট হতে চায়নি। ভাইয়েরাও ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে বর লাভ করুক, মনেপ্রাণে চেয়েছে রাবণ। তাই সসহোদরে তপস্যাস্থলে গেছে।

তিন ভাই মিলে তপস্যা আরম্ভ করল। তপস্যা দ্বারা ব্রহ্মাকে তুষ্ট করে সমৃদ্ধি আর প্রতিপত্তি চায় ওরা। অনাহারে, অনিদ্রায় কঠোর তপস্যা করে যেতে লাগল রাবণ। প্রথম দিকে মাস-বছরের হিসাব রাখলেও শেষের দিকে সময়ের হিসাব রাখা ছেড়ে দিল।

শূর্পণখা তখন বালিকা। ঋষি বিশ্রবার আশ্রমে আশ্রমবালিকার মতো বড় হচ্ছে সে। বিশ্রবা যে তাকে কাছে ডেকে দু-চারটি স্নেহপূর্ণ কথা বলেন, তেমনটি নয়। বিপুল এক ঔদাসীন্যের চোখে মেয়ের দিকে তাকান বিশ্রবা। চার চারটি ছেলের মধ্যে একটিমাত্র মেয়ে এই শূর্পণখা। পিতার অপত্য স্নেহ পাওয়ার কথা তার। কিন্তু কেন জানি, বিশ্রবা এই কন্যাটিকে কাছে ডাকেন না।

শূর্পণখাকে দেখলে মৃদু ঘৃণা তাঁর সারা শরীরে সঞ্চারিত হয়। কেন এরকম হয়, জানেন তিনি। ব্রাহ্মণপুত্র বলে সহজাতভাবে অনার্যদের প্রতি ঘৃণাবোধ তাঁর মধ্যে ছিল এবং আছেও। যৌবনলিপ্সু হয়ে রাক্ষসকন্যা কৈকসীকে বিয়ে করেছেন ঠিক, তাঁর গর্ভে সন্তানও জন্ম দিয়েছেন। কিন্তু সেই সন্তানদের, তারা অনার্যনারীর গর্ভজাত বলে, কাছে টানতে ইচ্ছে করেনি।

তাই শূর্পণখা আশ্রমে একা একা বড় হয়েছে। মা কৈকসী সর্বদা রাবণকে নিয়ে পড়ে থেকেছেন। রাবণের লোভ-ক্রোধ-প্রতিপত্তি লিপ্সাকে জাগাবার জন্য সারাটা সময় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। কন্যার দিকে নজর দেওয়ার প্রয়োজনবোধ করেননি কৈকসী। ফলে শূর্পণখা পিতার ঔদাসীন্য এবং মায়ের অবহেলার মধ্য দিয়ে বালিকা থেকে তরুণী হয়েছে।

বিশ্রবা-পত্নী দেববর্ণিনী শূর্পণখাকে কাছে ডেকেছেন মাঝে মধ্যে। শূর্পণখা যায়নি। জন্মাবধি এই নারীটিকে দেখে আসছে শূর্পণখা। বয়স হয়ে গেলেও দেবীতুল্য চেহারা তাঁর। সৌম্য চাহনি। বিপুল ব্যক্তিত্ব। কিছু মানুষ আছেন, যাঁদের দূর থেকে শ্রদ্ধা করা যায়, কিন্তু কাছে গিয়ে সান্নিধ্য পেতে ভয় লাগে। দেববর্ণিনী সেরকম ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। শূর্পণখা দূর থেকে দেববর্ণিনীকে শ্রদ্ধা করেছে, কাছে যাবার সাহস করেনি। তাই দেববর্ণিনীর স্নেহ থেকেও বঞ্চিত হয়েছে শূর্পণখা।

সারাদিন অরণ্যে-পাহাড়ে ঘুরে বেরিয়েছে শূর্পণখা। পাখিদের সঙ্গে নিজে নিজে কথা বলেছে। হরিণশাবকদের কোলে নিয়ে আদর করেছে। যেদিন মন চেয়েছে, সরোবরে অবগাহন করেছে। সূর্যের কিরণে লম্বা ঝাঁকড়া ভেজা চুল শুকিয়েছে।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে চুপচাপ বসে থেকেছে। মায়ের দিকে তাকিয়েছে বারবার―এই বুঝি মা বলবেন, এই শূর্পণখা সারাটা দিন কোথায় ছিলি ? ইশ, খোলা চুল কেন তোর ? ভরসন্ধ্যাবেলায় মেয়েদের চুল খোলা রাখতে নেই। আমার কাছে আয় মা, তোর চুলটা আঁচড়ে বেঁধে দিই।

কিন্তু কৈকসী তা করেন না। দুপুরে খেয়েছে কিনাও জিজ্ঞেস করেন না শূর্পণখাকে।

এরকম অনাদর-অবহেলার মধ্যে শূর্পণখা বড় হয়ে ওঠে।

আট

রাবণ অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলল।

সাধনাবলে ব্রহ্মার আসন কাঁপিয়ে দিল রাবণ। ব্রহ্মা রাবণাদি থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারলেন না। রাবণের কৃচ্ছ্রসাধন এবং আত্মত্যাগ দেখে পরম তুষ্ট হলেন ব্রহ্মা।

রাবণের সামনে এসে উপস্থিত হলেন একদিন।

বললেন, ‘তোমার কঠোর তপস্যায় আমি সন্তুষ্ট হয়েছি রাবণ। তুমি বর চাও। যা চাইবে, তা-ই দেব তোমাকে।’

রাবণ বলল, ‘আমি অমর হতে চাই প্রভু। আপনি আমাকে অমরত্বের বর প্রদান করুন।’

মিষ্টি হেসে ব্রহ্মা বললেন, ‘দেবতারাই শুধু অমরত্বের স্বাদ পাওয়ার অধিকার রাখে। মানুষেরা নয়। আমি তোমাকে অমর হবার বর দেব না।’

‘তাহলে এমন করুন প্রভু, দেবতা-দানব, দৈত্য-রাক্ষস, সাপ-যক্ষ-গন্ধর্ব―কেউই যেন আমাকে বধ করতে না পারে।’ বলল রাবণ।

ব্রহ্মা বললেন, ‘এরাই শুধু! আর কেউ নয় ? ভেবে দেখ, আর কারও নাম এর সঙ্গে যুক্ত করবে কিনা।’

রাবণ সদর্পে বলল, ‘না না প্রভু, আর কারও নাম উল্লেখ করতে চাই না।’

‘আর্য… ?’ বলে থেমে গেলেন ব্রহ্মা।

বড় অবহেলার কণ্ঠে রাবণ বলল, ‘আর্য কিংবা অন্যান্য প্রাণিকে আমি তৃণসমান জ্ঞান করি। তাদের আমি ভয় করি না, পাত্তা দিই না।’

ব্রহ্মা স্বগত কণ্ঠে বললেন, ‘পচা শামুকেও পা কাটা যায় রাবণ।’

গলাকে উঁচুতে তুললেন ব্রহ্মা, ‘তোমার প্রার্থিত বর আমি তোমাকে প্রদান করলাম রাবণ। ও হ্যাঁ, তোমাকে আরেকটি বর দিতে চাই আমি, নেবে ?’

উজ্জ্বল চোখ তুলে ব্রহ্মার দিকে তাকাল রাবণ।

ব্রহ্মা বললেন, ‘আজ থেকে তুমি যে রূপ ইচ্ছে, ধারণ করতে পারবে। মনে মনে যার কথা চিন্তা করবে তুমি, তৎক্ষণাৎ তারই রূপ হয়ে যাবে তোমার।’

ব্রহ্মার এই এক বদান্যতা! যার ওপর তুষ্ট হন, তাকে প্রার্থিত বরের চেয়ে বাড়তি বর দেন! যেমন দিয়েছেন কুবেরকে, আজ দিলেন রাবণকে।

কুম্ভকর্ণ দুই হাত জোড় করে ব্রহ্মার সামনে এগিয়ে এল। বলল, ‘প্রভু।’

‘তুমিই তো কুম্ভকর্ণ ? রাবণের সঙ্গে তপস্যা করে গেছো। তা তোমার কী চাওয়ার ?’ কুম্ভকর্ণকে দেখে ভিরমি খাওয়ার উপক্রম হলো ব্রহ্মার। অনেক মানুষ দেখেছেন তিনি, এরকম পর্বতপ্রমাণ মানুষ দেখেন নি! বিস্ময়বোধ তাঁর ঘন দীর্ঘ শ্মশ্রুর মধ্যে লুকিয়ে রাখলেন ব্রহ্মা।

কুম্ভকর্ণের ভয়ংকর ক্ষুধা। মাঝে মাঝে আশপাশের সবকিছুকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে তার। তার বড় বাসনা―বিরতি না দিয়ে, বিশ্রাম না নিয়ে নানা খাবার খেয়ে যাওয়ার।

তা-ই কামনা করে বসল ব্রহ্মার কাছে। কুম্ভকর্ণ বলল, ‘সারাদিনমান খেয়ে যেতে পারলে আমার আনন্দের সীমা থাকবে না প্রভু। আমি যাতে সর্বদা আমার হাতের নাগালে সুস্বাদু খাদ্য পাই।’

কুম্ভকর্ণের কথা শুনে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লেন ব্রহ্মা। বলে কী রাক্ষসটা! তার যে বিরাট মুখগহ্বর, ওই গহ্বরে অবিরত খাদ্য ঢুকতে থাকলে যে পৃথিবীতে খাবারের টান পড়ে যাবে! পৃথিবীর অন্য প্রাণিরা যে না খেয়ে মরবে! এই সংকট থেকে বেরোবেন কী করে তিনি ? হঠাৎ তাঁর সরস্বতীর কথা মনে পড়ে গেল। বাক্দেবীকে ব্রহ্মা মনে মনে বললেন, তুমি কুম্ভকর্ণকে দিয়ে এমন বর প্রার্থনা করাও, যাতে সকলের কল্যাণ হয়।

সরস্বতী তৎক্ষণাৎ কুম্ভকর্ণের জিহ্বায় এসে অবস্থান নিলেন।

ব্রহ্মা এবার চালাকির আশ্রয় নিলেন, ‘বৎস, তুমি কীসের যেন বর চাইলে আমার কাছে ? অন্যমনস্ক ছিলাম বলে ভালো করে শুনিনি। তুমি কি তোমার বাসনার কথা আরেকবার বলবে ?’

তখন সরস্বতী দ্বারা মোহাবিষ্ট কুম্ভকর্ণ। তার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘আমি অনেক অনেক বছর ধরে শুধু ঘুমিয়ে থাকতে চাই।’

‘অনেক অনেক বছর ধরে খেয়ে যেতে চাই’―এর বদলে কুম্ভকর্ণের মুখ দিয়ে ‘ঘুমিয়ে থাকতে চাই’ কথাটি বেরিয়ে এল।

ব্রহ্মা অতি দ্রুত ‘তথাস্তু, তথাস্তু’ বলে বিভীষণের দিকে মাথা ঘোরালেন।

বললেন, ‘বলো বিভীষণ তোমার কী চাওয়ার আছে, আমার কাছে ?’

‘আমার কিছুই চাওয়ার নেই প্রভু। আপনার চরণদর্শনেই আমার সকল পাওয়া হয়ে গেছে।’ ভক্তিতে গদ গদ বিভীষণ।

‘বলো কী! তাহলে এত বছর তপস্যা করলে কেন ? কেন নিজেকে আগুনে পোড়ালে! কেন অসহনীয় শৈত্যে নিজের শরীরকে কষ্ট দিলে! অনাহারে, অর্ধাহারে থাকলে!’ বিহ্বল চোখে বিভীষণের দিকে তাকালেন ব্রহ্মা। বিভীষণের কথার মধ্যে কোনও ছল আছে কিনা অনুধাবন করতে চাইলেন তিনি।

বিভীষণ বুঝতে পারে, দেবাদিদেব তার কথায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারছেন না। ‘আপনি বিশ্বাস করুন প্রভু, আপনার কাছে কিছু পাব বলে স্বার্থপরের মতো আপনার আরাধনা করিনি আমি। আমি আপনাকে স্বচক্ষে দেখতে চেয়েছিলাম শুধু। আমার চাওয়া পূরণ হয়ে গেছে প্রভু।’ মাথা নিচু করে মৃদু কণ্ঠে বলে গেল বিভীষণ।

ব্রহ্মা বিভীষণের কথা শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলেন। সবাই তাঁর কাছ থেকে কিছু না কিছু পাওয়ার জন্যই তপস্যা করে। যেমন অন্য দুই রাক্ষসযুবকও করেছে। কিন্তু এ কোন উদাসীন রাক্ষস যে নিজের স্বার্থ বুঝছে না!

মুগ্ধ হলেন ব্রহ্মা।

বললেন, ‘তা হয় না বিশ্রবাপুত্র। এত বছর ধরে কৃচ্ছ্রতা করে আমার আরাধনা করে গেলে! তোমাকে কিছু না দিয়ে তো আমি ব্রহ্মলোকে ফিরব না বৎস!’

মাথা আনত করে বিভীষণ বললেন, ‘নেহাত যদি কিছু দিতে চান প্রভু আমায়, তাহলে এই আশীর্বাদটুকু করুন যে অত্যন্ত বিপদেও যেন ধর্মে মতি স্থির থাকে আমার।’

কনিষ্ঠের কাণ্ড দেখে চোখ বেরিয়ে আসার উপক্রম হলো রাবণের। ‘বোকার হদ্দ কোথাকার!’ মনে মনে গর্জে উঠল রাবণ।

এই সময় অত্যন্ত নিচু স্বরে বিভীষণ আবার বলল, ‘আমি আপনার কাছে এই বরটুকু চাই প্রভু, আমি জীবনে যে-পর্যায়েই থাকি না কেন, সংশয়ে বা সংকটে অথবা ঐশ্বর্যে, আমার সদ্বুদ্ধির যাতে বিনাশ না ঘটে। এর বেশি কিছু আমি আর বর হিসেবে চাই না। আমি জানি প্রভু, যারা আপন ধর্ম থেকে বিচ্যুত হয় না, তাদের দুর্লভ্য কিছুই থাকে না।’

পলকহীন চোখে বিভীষণের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ব্রহ্মা। এ কে! এই যুবকটি মানুষ না দেবতা! দেবতারা মাঝেমধ্যে নির্লোভতার পরিচয় দেন, কিন্তু লোভী মানুষেরাই তো দেবতার পূজা করে, তাঁদের তুষ্ট করে নিজের স্বার্থ আদায় করে নেয়! কিন্তু এই রাক্ষসযুবকটি, এ তাঁর উদ্দেশে কঠোর তপস্যা করেছে ঠিকই, কিন্তু চাওয়ার বেলায় তো কিছুই চাইছে না! কী অদ্ভুত! কী আশ্চর্য!

ব্রহ্মা নাছোড় গলায় বললেন, ‘তা হবে না বিভীষণ, আমার কাছ থেকে তোমাকে কোনও না কোনও বর নিতেই হবে।’

ব্রহ্মার কথা শুনে বিভীষণ ভেবাচেকা খেয়ে নির্বাক থাকল।

ব্রহ্মা আবার বললেন, ‘আমি তোমাকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিলাম বিভীষণ। সুরাসুরের কেউ, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতালের কোনও প্রাণি তোমাকে মারতে পারবে না। তুমি যেদিন মরার জন্য আপনা থেকে ইচ্ছাপোষণ করবে, কেবল সেদিনই তোমার মৃত্যু হবে।’

বিভীষণকে আর কিছু বলবার সুযোগ দিলেন না ব্রহ্মা। নিমিষে অন্তর্ধান হয়ে গেলেন।

ব্রহ্মার বরপুষ্ট তিন ভাই ফেরার পথ ধরল। যদিও তাদের গন্তব্য হওয়া উচিত বিশ্রবার তপাশ্রম, কিন্তু সেখানে ফিরে যাবে না বলে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল রাবণ। সে ভাইদের তার সিদ্ধান্তের কথা জানতে দিল না।

ব্রহ্মার বর লাভ করার পর রাবণের মধ্যে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেল। অহংকারদীপ্ত। গম্ভীর। তার হাঁটায় রাজকীয়তা। চাহনিতে আধিপত্য। কণ্ঠস্বরও পাল্টে গেছে রাবণের―গুরুগম্ভীর।

হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ থমকে গেল রাবণ। বলল, ‘আমাদের মধ্যে সবচাইতে বোকা কে বল তো ?’

কুম্ভকর্ণ ভাবল প্রশ্নটা তাকেই করা হয়েছে, ‘মানে! তোমার কথা বুঝতে পারলাম না দাদা!’

‘সবার চেয়ে নির্বোধ, বোধবুদ্ধিহীন কে ? আমরা ভাইদের মধ্যে ? জানতে চাইছি।’ প্রতিটি শব্দে জোর দিয়ে বলল রাবণ।

কুম্ভকর্ণ বুঝে গেল, কোনও কারণে দাদা রেগে গেছে। এই রকম পরিস্থিতিতে চুপ থাকে সে। আজও থাকল।

বেশ উষ্মার কণ্ঠে অনেকটা আপনমনেই রাবণ বলল, ‘এত বড় সুযোগ হাতছাড়া করলে তোমরা দুজনে! তুমি চাইলে কী ? ঘুম। প্রভু, সারা জীবন আমি যেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটিয়ে দিতে পারি।’ উপহাস ছলকে উঠল রাবণের কথায়। ‘আর ওই―, ওই ম্যাদামারাটা চাইল কী ? মণি না, মুক্তা না, রাজ্য না, প্রতিপত্তি না, অস্ত্র না, সাহস না! ধর্মে যাতে আমার মতি থাকে প্রভু! যা ইচ্ছে কর তোরা। আমার কী ?’ শেষ দুটো লাইন স্বগত কণ্ঠেই বলল রাবণ।

বড়দাদার তিরস্কারবাক্য শুনেও চুপ থাকল কুম্ভকর্ণ-বিভীষণ। রাবণ যে তাদের কাছে সর্বাধিক মাননীয়!

বেশ কয়েক যোজন পথ অতিক্রম করার পর বিশ্রবার আশ্রমের উল্টো দিক ধরল রাবণ। রাবণ আগে, পেছনে দুই ভাই তাকে অনুসরণ করছিল। দাদাকে উল্টো পথে যেতে দেখে থমকে গেল দুজনে। হতভম্ব চেহারা তখন তাদের। বিপরীত পথে যাচ্ছে কেন দাদা ? পথ ভুলে গেল নাকি!

বিভীষণ চুপ থাকতে পারল না, ‘দাদা, ওটা তো বাবার আশ্রমে যাওয়ার পথ নয়!’

‘জানি আমি।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর রাবণের।

‘তাহলে…!’ বলে থেমে গেল বিভীষণ।

রাবণ এবার চলা থামিয়ে ভাইদের দিকে ফিরল, ‘আমরা আর পিতার আশ্রমে ফিরে যাচ্ছি না। আগামীতে আমাদের বাসস্থান হবে আলাদা। সেখানে আমরা নিজেদের দিকে তাকাবার সুযোগ পাব। আমাদের প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠার ভবিষ্য-কৌশল সম্পর্কে নিজেদের মধ্যে আলাপ করার ফুরসত পাব আমরা ওই নতুন জায়গায়। যেটা আশ্রমে পাওয়ার উপায় নেই। আশ্রমে আমরা আর্যঋষির চাপে থাকব। ফলে আমাদের ভাবনা বিকশিত হবে না ওখানে। তাই আমি অন্য স্থানের সন্ধানে যাচ্ছি। যাবে তোমরা আমার সঙ্গে ? আশ্রমে ফিরে যাওয়ার স্বাধীনতা আছে তোমাদের।’

‘তুমি যেখানে, আমরাও সেখানে দাদা।’ কুম্ভকর্ণ বলে উঠল।

রাবণ দুই ভাইকে নিয়ে শ্লেষাত্মক নামের একটি বনে এসে উপস্থিত হলো।

বলল, ‘আজ থেকে আমরা এই বনে বাস করব।’

ব্রহ্মার বরপুষ্ট তিন ভাইয়ের সৌভাগ্যের কথা ক্রমে মাতামহ সুমালীর কানে পৌঁছাল। অনুর্বর, অনুন্নত, নাগরিক সুবিধাবিচ্ছিন্ন পাতাল নামক দেশে তখন বাস করে যাচ্ছিলেন সুমালী। দৌহিত্র রাবণের বর লাভের সংবাদ পেয়ে সুমালী সপার্ষদে রাবণের উদ্দেশে রওনা দিলেন।

শ্লেষাত্মক বনে উপস্থিত হয়ে রাবণকে জড়িয়ে ধরলেন সুমালী। তাঁর চোখেমুখে তখন বিপুল আনন্দের আভা। মাতামহকে প্রণাম করে উঠে দাঁড়াল রাবণ।

সুমালী বললেন, ‘আমাদের সৌভাগ্য আজ আবার ফিরে এসেছে রাবণ। তুমি ব্রহ্মার আশীর্বাদ লাভ করেছো। তাতে তোমার যতটুকু লাভ হয়েছে, তার চেয়ে অনেক বেশি লাভ হয়েছে সমস্ত রাক্ষসজাতির।’ একটু থেমে দম নিলেন বৃদ্ধ সুমালী।

এর পর বললেন, ‘ওই যে সোনার লঙ্কা, যার কথা ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে শুনে এসেছো, তা কিন্তু আমাদের ছিল একদিন। এখন সেই লঙ্কা তোমার বৈমাত্রেয় ভাই কুবের করতলগত করে নিয়েছে। আমরা রাক্ষসেরা চিরকাল ওই লঙ্কাতেই বসবাস করেছি।’

কথার ফাঁকে সুমালী লক্ষ করলেন―রাবণ তাঁর কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে যাচ্ছে। উৎসাহ পেলেন তিনি, ‘এখন তোমার একমাত্র কাজ হবে, লঙ্কা পুনরুদ্ধার করা। মেরে হোক, ধরে হোক, ভালো কথা বলে হোক―যে কোনও উপায়ে তুমি কুবেরকে লঙ্কা থেকে উচ্ছেদ করবে। তারপর অধোনিমগ্ন রাক্ষসকুলকে লঙ্কায় পুনরায় প্রতিষ্ঠা করবে এবং তুমি হবে লঙ্কার রাজা, রাক্ষসজনজাতির প্রভু।’

মাতামহের কথা বলা থামলে রাবণ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তা কখনও হবার নয় দাদা ঠাকুর।’

নয়

গভীর গম্ভীর চোখে রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকলেন সুমালী।

তাকিয়েই থাকলেন। তাঁর চোখ দুটো পলকহীন। সেই চোখে অবিশ্বাসের গাঢ় ছায়া। রাবণের কথা শুনে বিবশ তিনি।

বহুক্ষণ পর সংবিতে ফিরলেন সুমালী। তাহলে কি তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন-সাধ বিফলে যাচ্ছে! যে-দূরদর্শিতা নিয়ে কৈকসীকে ঋষি বিশ্রবাকে বিয়ে করতে বলেছিলেন, যে-পরিকল্পনার অনুবর্তী হয়ে কন্যার কাছে বলবান বীর্যবান একজন দৌহিত্র কামনা করেছিলেন, তা আজ বুঝি ধূলিসাৎ হয়ে যাবার পথে! প্রবল নৈরাশ্য আর অপ্রত্যয় সুমালীকে ঘিরে ধরল।

বললেন, ‘কী বলতে চাইছো তুমি রাবণ! কী হবার নয় ?’

‘দাদা কুবেরকে ক্ষমতাচ্যুত করে লঙ্কা থেকে তাঁকে বিতাড়িত করতে রাজি নই আমি।’ মাতামহের চোখে চোখ রেখে রাবণ বলল।

‘কেন ? কেন বিতাড়িত করতে চাও না তুমি কুবেরকে ? লঙ্কা থেকে ? যে লঙ্কার প্রকৃত মালিক ছিলাম আমরা!’ এক নিশ্বাসে বৃদ্ধ সুমালী বলে গেলেন।

রাবণ মৃদু কেশে গলাটা পরিষ্কার করে নিল, ‘আপনাকে যেমন শ্রদ্ধা করি দাদাঠাকুর, তেমনি কুবেরদাদাকেও আমি শ্রদ্ধা করি। শুধু শ্রদ্ধা করি বললে ভুল হবে, ভালোবাসি আমি তাকে। সেই শ্রদ্ধা-ভালোবাসার মানুষটিকে লঙ্কা থেকে হঠাব কী করে আমি! আমার মধ্যেও তো মনুষ্যত্ব বলে কিছু আছে!’

রাবণের অনাগ্রহ ও বৈরাগ্য দেখে সুমালীর বিস্ময়ের সীমা থাকল না। বিহ্বল  হয়ে চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ।

না, রাবণের কথায় হাল ছেড়ে দিলে চলবে না। তাহলে রাক্ষসজাতি যে আরও শত সহস্র বছর পরাধীন থেকে যাবে! রাক্ষসদের আলাদা স্বাধীন দেশচিন্তার আশাটা যে নস্যাৎ হয়ে যাবে!

নাতিকে নানা যুক্তি দিয়ে আরও দীর্ঘক্ষণ বোঝালেন সুমালী। স্বাধীনতার আনন্দ, রাক্ষসজাতির অস্তিত্ব সংকট, মাতামহদের দেশান্তরিত হবার নানা দুঃসহ স্মৃতির কথা সুমালী রাবণকে বলে গেলেন। কিন্তু রাবণের মধ্যে কোনও ভাবান্তর হলো না। আগের মতো নিস্পৃহ থাকল সে।

রাবণ দ্বারা প্রত্যাখ্যাত সুমালী মাথা নিচু করে শ্লেষাত্মক অরণ্য পরিত্যাগ করে গেলেন! ফিরে গেলেন তিনি পাতালের সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন বাসভবনে।

পিতার বিপন্ন বিধ্বস্ত চেহারা দেখে প্রহস্ত এগিয়ে এল। প্রহস্ত কৈকসীর সহোদর। কেতুমতীর গর্ভজাত। পিতাকে খুব ভালোবাসে প্রহস্ত। সে জানে―পিতা বহু আশা নিয়ে ব্রহ্মার আশীর্বাদপুষ্ট নাতি রাবণের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। যাওয়ার উদ্দেশ্যের কথাও জানত প্রহস্ত। সে ধরে নিয়েছিল, পিতা আনন্দোৎফুল্ল মুখ নিয়ে ফিরে আসবেন। কিন্তু ফিরে এলেন হতাশাগ্রস্ত, বিপর্যস্ত সুমালী।

বুক কেঁপে উঠল প্রহস্তের। কোনও খারাপ সংবাদ নিয়ে ফিরেননি তো বাবা! তাঁর উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়ে যায়নি তো!

দ্রুত বাবার সামনে এগিয়ে গেল প্রহস্ত। বিষণ্ন কণ্ঠে সব কথা পুত্রকে খুলে বললেন বৃদ্ধ সুমালী। ভেতরে ভেতরে উত্তেজিত হয়ে উঠল প্রহস্ত। কিন্তু ভেতরের উত্তেজনা বাইরে প্রকাশ করল না সে। ঠান্ডা মাথা প্রহস্তের। বড় বড় সমস্যা সে শান্ত মেজাজে মোকাবিলা করে এবং সফল হয়। এবারও নিজেকে শান্ত রাখল প্রহস্ত।

বলল, ‘বাবা, আমাকে একবার রাবণের সঙ্গে দেখা করার অনুমতি দিন।’

প্রহস্তের ওপর সুমালীর গভীর আস্থা। তিনি জানেন, তাঁর এই ছেলেটি বাগ্মী, যুক্তিবাদী। সে শ্রোতার মনে বেশ প্রভাব বিস্তার করতে পারে।

দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে সুমালী বললেন, ‘ভালোবাসা আর অধিকারের দাবি নিয়ে রাবণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম। উড়িয়ে দিল সে আমার কথাকে! বড় ব্যথা পেয়েছি প্রহস্ত রাবণের আচরণে।’ ধপাস করে নিজ আসনে বসে পড়লেন সুমালী। মৃদু মাথা নেড়ে বললেন, ‘দেখো তুমি চেষ্টা করে।’

বাবার অনুমতি পেয়ে রাবণের সঙ্গে দেখা করেছিল প্রহস্ত। এই মামাটিকে রাবণ খুব পছন্দ করে। প্রহস্তের ব্যক্তিত্ব, কণ্ঠস্বর, বাচনভঙ্গি, শান্ত মেজাজ ছোটবেলা থেকেই রাবণকে মুগ্ধ করে রেখেছিল।

প্রহস্ত রাবণকে বোঝাল যে, মাতামহ সুমালীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা রাবণের উচিত হয়নি। মাতামহ তাকে পুত্রের অধিক স্নেহ করেন। এরকম একজন স্নেহের পাত্রের কাছে বৃদ্ধ আত্মীয়টি কোনও কিছু আবদার করার অধিকার তো রাখেনই! উপরন্তু রাবণ হলো সুমালীর সর্বাধিক প্রিয় কন্যার জ্যেষ্ঠ সন্তান। সেই দিক দিয়েও তো রাবণের ওপর সুমালীর একটা অধিকার থেকে যায়! সেই অধিকারবোধ থেকে সুমালী তার কাছে এসেছিলেন। কিন্তু রাবণ কী করল ? অবোধের মতো প্রত্যাখ্যান করে বসল মাতামহকে! কী প্রচণ্ড দুঃখ যে পেয়েছেন তিনি, রাবণ ভেবে দেখেনি তা! এ বড় অন্যায় হয়েছে রাবণের! প্রহস্তের কথা যতই শোনে, রাবণ ততই ম্রিয়মান হয়। সে নিজের ভুল বুঝতে শুরু করে।

ওইটুকু বলে প্রহস্ত কিন্তু থেমে যায়নি। সে রাবণকে উদ্দেশ করে আরও বলল, ‘আমরা হলাম ব্রহ্মাভক্ত। ব্রহ্মার চিরশত্রু বিষ্ণু। বিষ্ণু কখনও রাক্ষসজাতিকে পছন্দ করেননি। তাঁর সকল পক্ষপাত দেবতাদের দিকে। এই বিষ্ণুর আক্রমণে ভারতবর্ষের অনার্যজনজাতিরা বারবার ধ্বংসের কিনারায় পৌঁছে গেছে। এই বিষ্ণুই রাক্ষসজাতির নৃপতি মাল্যবান-সুমালীকে লঙ্কাছাড়া করেছেন। তোমার এমন বলশালী মাতামহ মালীকে হত্যা করেছেন এই বিষ্ণু। এই কষ্ট, এই অপমান বুকে নিয়ে তোমার এই মাতামহটি কোনওরকমে বেঁচে আছেন। তাঁর মনে বিশাল এক স্বপ্ন―মৃত্যুর আগে লঙ্কাকে রাক্ষসদের অধীনে দেখা এবং কী কারণে জানি না, বাবার মনে এ এক গভীর বিশ্বাস যে একমাত্র তুমিই পারবে লঙ্কাকে স্বাধীন করতে, লঙ্কায় পুনরায় রাক্ষস-আধিপত্য স্থাপন করতে।’

প্রহস্ত থেমে থেমে প্রতিটি শব্দে শ্বাসাঘাত করে এই কথাগুলো বলে গেল এবং সর্বক্ষণ রাবণের ভাবান্তর লক্ষ্য করে গেল।

প্রহস্তের জ্বালাময়ী ভাষণে রাবণ বেশ প্রভাবিত হলো। উদ্দীপিত তখন রাবণের চোখমুখ।

সমস্ত আবেগ কণ্ঠে জড়ো করে প্রহস্ত বলল, ‘ভাগ্নে, আমি বড় একটা আশা নিয়ে তোমার কাছে এসেছি। বাবাকে কথা দিয়ে এসেছি যে আমি তোমাকে লঙ্কা অধিকারে সম্মত করাতে সমর্থ হব।’

হেসে উঠল রাবণ। এই হাসিতে সম্মতির আভাস স্পষ্ট। ‘মামা, তাহলে যে তোমার সাহায্যের দরকার হবে আমার!’

মহানন্দে প্রহস্ত বলে উঠল, ‘তোমাকে সকল প্রকার সাহায্য করতে রাজি আমি ভাগ্নে।’

‘মামা, তোমার মধ্যে দূতের সকল গুণ বর্তমান। আমার দূত হয়ে তোমাকে লঙ্কায় যেতে হবে। কুবের দাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে হবে।’

প্রহস্ত সম্মতির মাথা নাড়ল।

এর পর রাবণ সবাইকে নিয়ে লঙ্কাপুরীর কাছাকাছি একটি বনে অবস্থান নিল। মাতুল প্রহস্তকে নিজের দূত করে লঙ্কাধিপতি কুবেরের কাছে পাঠাল।

প্রহস্ত লঙ্কার রাজসভায় উপস্থিত হয়ে যথেষ্ট বিগলিত কণ্ঠে বলল, ‘লঙ্কাপতি কুবের, এই লঙ্কা আগে রাক্ষসদের অধীনে ছিল। আপনার পূর্বে রাক্ষস সুমালী এই লঙ্কার শাসক ছিলেন!’ কুবেরের কাছে নিজের পরিচয় গোপন রাখল প্রহস্ত। ‘এখন সুমালীর দৌহিত্র রাবণ চাইছেন এই লঙ্কা আগে যাঁদের অধিকারে ছিল, আপনি তাঁদের হাতে ফিরিয়ে দিন। রাবণ আরও বলেছেন যে তিনি মোটেই রক্তপাত চান না। তিনি আশা করছেন, লঙ্কাপুরী শান্তিপূর্ণভাবে ফিরিয়ে দিতে আপনি রাজি হবেন।’ এক মুহূর্তের জন্যও প্রহস্তের মুখমণ্ডল থেকে বিনীত ভাবটা গেল না।

কুবের অতিশয় ভদ্র-প্রকৃতির ব্যক্তি। সেই ভদ্রতা তার কথাতেও, ‘বাহ্, এতো বিশাল এক আনন্দের সংবাদ! আমার ভাই লঙ্কা ছাড়বার জন্য আপনাকে পাঠিয়েছে, তাতে আমি উত্তেজিত হচ্ছি না। সে ব্রহ্মার বরপুষ্ট হয়েছে, শুনেছি আমি। তবে একটা কথা যে আমারও বলার ছিল!’

সভাসদদের ওপর একবার চোখ বুলিয়ে নিল কুবের।

তারপর বলল, ‘লঙ্কাপুরীর সিংহাসন শূন্য ছিল দেখে পিতা বিশ্রবা আমাকে এখানে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। আসল কথা হলো―রাবণ এবং আমি দুজনেই ঋষি বিশ্রবার পুত্র। এই লঙ্কায় আমার যেমন অধিকার আছে, রাবণেরও তা আছে। এই লঙ্কাপুরীতে ধনসম্পদ, রাজ্যপাট―যা কিছু আছে, তা সবের ওপর রাবণেরও অধিকার আছে। আপনি ভাই রাবণকে গিয়ে বলুন, এই লঙ্কা আমি রাবণের সঙ্গে একত্রে ভোগ করতে চাই। নিশ্চয়ই এতে কোনও আপত্তি থাকবে না রাবণের।’

প্রহস্ত কুবেরের রাজসভা থেকে বিদায় নিল।

কুবের তার বৈমাত্রেয় ভাইয়ের প্রতি ভালোমানুষি প্রকাশ করল বটে, কিন্তু মনের মধ্যে প্রচণ্ড এক উদ্বেগ তৈরি হলো তার। এরই মধ্যে রাবণের বেশ কিছু দুর্বিনয়ের ঘটনা তার কানে এসে পৌঁছেছে। রাবণ যে তাঁর সঙ্গেও দুর্বিনীত ব্যবহার করবে না, আশ্বস্ত হতে পারল না কুবের। পিতা বিশ্রবার কাছে ছুটে গেল সে।

পিতার কাছে আনুপূর্বিক সব কথা খুলে বলল। 

মাথা নিচু করে কুবেরের কথা শুনে গেলেন বিশ্রবা। নিজের অন্তরের ভাঙচুরটা কুবেরকে বুঝতে দিলেন না তিনি।

বিহ্বল চোখমুখ তখন বিশ্রবার, ‘তোমাকে কী বলব পুত্র, তোমার কাছে দূত পাঠাবার আগে আমার কাছে এসেছিল রাবণ। বেশ শক্ত গলায় লঙ্কায় তার অধিকারের কথা বলেছিল।’

একটু থেমে বিশ্রবা আবার বলেছিলেন, ‘প্রথমে নরম সুরে তাকে বলেছি, লঙ্কার অধিপতি কুবের। লঙ্কাধিকারের কথা মন থেকে বাদ দাও। তা শুনে বেশ উত্তেজিত হয়ে ওঠে সে। তার ভাবভঙ্গি দেখে আমি শান্ত থাকতে পারিনি আর। আমি ওই দুর্মতি রাবণকে তিরস্কার করেছি। আমার তিরস্কারেও দমেনি সে। ঘাড় শক্ত করে আমার সঙ্গে তর্ক করেছে। রাবণ শোধরানোর নয়।’

কুবেরের চোখেমুখে হতাশা আর ভয়ের মেশামেশি, ‘তাহলে এখন আমি কী করব বাবা ?’

বিশ্রবা অনেকটা আপনমনে বললেন, ‘ব্রহ্মার বরে এখন সে বলীয়ান। অহংকারে মত্ত হয়ে গেছে। তার মধ্য থেকে বিনয় উবে গেছে।  মান্য লোককে সম্মান জানাতে সে ভুলে গেছে। আমার খুব ভয় হয় পুত্র, এই দুর্বিনীতটা কোন সময় আবার তোমাকে অপমান করে বসে! তাহলে তুমি মস্ত বড় এক লজ্জায় পড়ে যাবে কুবের।’

দু হাত বুকে জড়ো করে চিবুক বুকে ঠেকিয়ে কুবের পিতার কথা শুনে গেল।

ওই অবস্থাতেই বলল, ‘এখন আমি কী করব বাবা, বলে দিন।’

‘তুমি এক কাজ করো পুত্র, তুমি লঙ্কার বসতি ছেড়ে দাও। কৈলাসপর্বতে গিয়ে নতুন নগরী নির্মাণ করো। সেখানে গিয়ে নতুন করে রাজত্ব শুরু করো।’ চুরমেরে গলায় বলে গেলেন বিশ্রবা। বোঝা যাচ্ছে, কুবেরকে এ কথা বলতে বুক ভেঙে যাচ্ছে তাঁর।

কুবের আর দ্বিরুক্তি করল না। লঙ্কাপুরীতে ফিরে গেল।

পরে সপরিজনে-সপরিষদে লঙ্কা ত্যাগ করে কৈলাসে চলে গেল কুবের।

উল্লাসে ফেটে পড়ে প্রহস্ত রাবণকে বলল, ‘লঙ্কানগরী এখন আমাদের ভাগ্নে।’

রাবণ তার ভাইদের নিয়ে কুবের-পরিত্যক্ত লঙ্কাপুরীতে প্রবেশ করল।

সহস্র সহস্র রাক্ষসে লঙ্কা ভরে গেল।

রাক্ষসদের রাজা হিসেবে লঙ্কার সিংহাসনে অভিষিক্ত হলো রাবণ।

কুবের যাওয়ার সময় সবকিছু লঙ্কায় ফেলে গেল, কিন্তু পুষ্পক রথটি সঙ্গে করে নিয়ে গেল।

দশ

এর মধ্যে ঋষি বিশ্রবার আশ্রম থেকে মা কৈকসী এবং বোন শূর্পণখাকে লঙ্কাপুরীতে আনিয়ে নিয়েছে রাবণ।

শূর্পণখাকে দেখে রাবণ বেশ অবাক হলো। এ কে! এই যুবতীটিই কি তার সেই ছোট্ট বোন শূর্পণখা! ছোটবেলায় চেহারা ভালো ছিল না তার। মুখের আদলটা ছিল বিশ্রীর দিকে। অন্যান্য অনার্যবালিকার মতো গায়ের রং কালো ছিল ঠিকই, কিন্তু কালোরঙের মধ্যেও যে একটা পেলবঘন সৌষ্ঠব থাকে, তা শূর্পণখার ত্বকে ছিল না। নাকটা বোঁচা ছিল, চোখ ছিল ড্যাবডেবে। কিন্তু এখনকার যে শূর্পণখা, তার সঙ্গে যে বালিকা শূর্পণখার কোনও মিল নেই! যুবতী শূর্পণখার দেহবর্ণ কালো বটে, কিন্তু সেই কালোত্বের কী অপরূপ সৌন্দর্য! বোঁচা নাকটা বর্তমানের শূর্পণখার শ্রী বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে। চেহারাতেও বিপুল এক পরিবর্তন ঘটে গেছে। আগে মুখে যে ভাঙচুর ছিল, যুবতী শূর্পণখার মুখমণ্ডলে এখন তার ছিটেফোঁটাও নেই। সুশ্রী মুখমণ্ডলে তীব্র মোহিনী দুটি চোখ এখন শূর্পণখার। বর্তমানের শূর্পণখা রাবণের কাছে অজানা এক নারী।

লঙ্কায় শক্তি সংহত করার পাশাপাশি নিজের পারিবারিক কর্তব্যকর্মের দিকে নজর দিল লঙ্কাধিপতি রাবণ। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল―শূর্পণখার বিয়ে দেবে। পিতা হিসেবে শূর্পণখাকে বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব ঋষি বিশ্রবার। কিন্তু সেই দায়িত্ব তিনি পালন করেননি, এড়িয়ে গেছেন। অনার্যনারী কৈকসীর গর্ভজাত পুত্রদের প্রতি যেমন করে অবহেলা দেখিয়েছেন বিশ্রবা, শূর্পণখার ক্ষেত্রেও তা-ই করেছেন। তপাশ্রমে তাঁরই চোখের সামনে শূর্পণখা বালিকা থেকে তরুণী, তরুণী থেকে যুবতী হয়ে উঠেছে। বিশ্রবা শূর্পণখাকে দেখেও না-দেখার ভান করে গেছেন। পিতার যে কর্তব্য সন্তানদের ভরণ-লালনের মাধ্যমে বড় করে তোলা, বিয়ের যোগ্য হলে তাদের বিয়ে দেওয়া―সে কর্তব্য কৈকসীর সন্তানদের ক্ষেত্রে পালন করেননি বিশ্রবা। নির্বিকার থেকেছেন। সেটা রাবণ বুঝতে পেরেছিল বলেই বরপ্রাপ্ত হবার পর বিশ্রবা-আশ্রমে আর ফিরে আসেনি। শূর্পণখা বিশ্রবার উদাসীন দৃষ্টির সামনে অনেকটাই বৈরী পরিবেশের মধ্যে যৌবনবতী হয়ে উঠেছে।

কেন বিশ্রবা কৈকসী-সন্তানদের প্রতি অবহেলা দেখিয়েছেন ?

আসলে কৈকসীর অনুরোধে তিনি অনার্যা কৈকসীকে বিয়ে করেছেন ঠিকই, কিন্তু মনে-প্রাণে তাঁকে সহধর্মিণী হিসেবে মেনে নেননি। আর্যসংস্কার-আচ্ছন্ন অন্ধকার হৃদয়কন্দরে কৈকসীর জন্য গভীর এক ঘৃণা লুকিয়ে রেখেছিলেন তিনি। কৈকসী তা বোঝেননি বা কৌশলে বিশ্রবা কৈকসীকে তা বুঝতে দেননি। সন্তানদের ক্ষেত্রে এই ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন বিশ্রবা।

শূর্পণখাকে অনেকদিন আগে পিতার আশ্রমে রেখে ব্রহ্মাসাধনার জন্য বিশ্রবা-আশ্রম ত্যাগ করে গিয়েছিল রাবণ। বহুদিন বোনটিকে নিজ চোখে দেখেনি। আজ শূর্পণখার প্রতি পূর্ণ চোখে তাকাল রাবণ। তাকিয়ে তার মধ্যে কর্তব্যতাড়না সক্রিয় হলো। পিতা যে-কর্তব্য এতদিন সম্পাদন করেননি, সেই কর্তব্য পালনে তৎপর হয়ে উঠল লঙ্কাধিরাজ।

শূর্পণখার উপযুক্ত পাত্রের সন্ধানে নানা স্থানে গুপ্তচর পাঠাল। এক্ষেত্রে দূত বা ঘটক পাঠানোর কথা। কিন্তু রাবণ তা করল না। তার বিশ্বাস―ঘটক বা দূতরা বাড়িয়ে বলবে। যথাযথ সংবাদ তাদের কাছে পাওয়া যাবে না। গুপ্তচররাই পারবে নির্ভেজাল তথ্য সংগ্রহ করতে। তাই দিকে দিকে গুপ্তচর পাঠাল রাবণ।

একসময় এক গুপ্তচর বিদ্যুদ্জিহ্বের সংবাদ এনে দিল রাবণকে।

রাক্ষসদের পালটিঘর দৈত্য-দানবদের ঘর। ঋষি কশ্যপ ও দক্ষরাজকন্যা দিতির বংশধরগণ দৈত্য বা দানব নামে পরিচিত। দৈত্য আর দানব সমার্থক। দেবতাদের সঙ্গে দানবদের চিরন্তন বিরোধ। দীর্ঘকালব্যাপী উভয় জাতির মধ্যে যুদ্ধ চলেছিল। বিদ্যুদ্জিহ্ব এই দানববংশের সন্তান।

কালকাসুর দানবশ্রেষ্ঠ নরপতি। অসীম শক্তিধর এই কালকাসুর। তার ধনসম্পদ-ঐশ্বর্য ঈর্ষাজাগানিয়া। এই পরিবারটিকে, সম্বন্ধ করার জন্য, উপযুক্ত বলে বিবেচনা করল রাবণ। কালকাসুরের পুত্র বিদ্যুদ্জিহ্বকে শূর্পণখার ভবিষ্য-বর হিসেবে নির্বাচন করে ফেলল লঙ্কাপতি। প্রস্তাব পাঠাল রাবণ কালকাসুরের কাছে। প্রস্তাবটা লুফে নিল কালকাসুর। বয়স্ক, অভিজ্ঞ রাজা সে। দূরদর্শীও। কালকাসুর বুঝে গিয়েছিল―এই রাবণ একদিন দুনিয়া কাঁপাবে। স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল নিজের কব্জায় নিয়ে আসবে একদিন। সুর-অসুর তার ভয়ে কাঁপবে এবং সেই দিনটি খুব বেশি দূরে নয়। বিদ্যুদ্জিহ্বের সঙ্গে শূর্পণখার বিয়ের প্রস্তাবটি সাদরে গ্রহণ করল পাতালবাসী কালকাসুর।

বিদ্যুদ্জিহ্বের সঙ্গে শূর্পণখার বিয়ে সম্পন্ন হলো একদিন। অত্যন্ত সাড়ম্বরেই একমাত্র বোনের বিয়েটা দিয়েছিল রাবণ। এই আড়ম্বরতা যে তার আধিপত্য ও ঐশ্বর্যের প্রতীক!

বিয়ের পর থেকেই শূর্পণখা স্বামীর সঙ্গে পাতালরাজ্যে বাস করা শুরু করেছিল। এই রাজ্যের রাজধানীর নাম অশ্মননগরী।

সুখেই কাটছিল শূর্পণখার দাম্পত্যজীবন। কালকাসুরের রাজপ্রাসাদটা লঙ্কাপুরীর মতো ঐশ্বর্যময় নয়। লঙ্কার প্রাসাদের মতো কিংবদন্তিতুল্যও নয়। কিন্তু কালকাসুরের প্রাসাদের বিশেষ একটা গাম্ভীর্য আছে, যা লঙ্কাপুরীর নেই। এই প্রাসাদের রং কালো। এর স্তম্ভগুলো দানব-ঐতিহ্যমণ্ডিত। চাঁদের আলোতে কালকাসুরের কৃষ্ণরাজপ্রাসাদটি ভয়াল এক রূপ ধারণ করে।

এই প্রাসাদের বিশেষভাবে সজ্জিত একটা কক্ষে শূর্পণখা বসবাস করে। স্বামীসঙ্গ তাকে আপ্লুত করে। বিদ্যুদ্জিহ্বও শূর্পণখাকে আদরে সোহাগে ভরিয়ে রেখেছে। স্বামী-সংস্পর্শে শূর্পণখার দেহ জাগে, মনে বসন্তবাতাস বয়। দাম্পত্যজীবনকে সুখময় করবার জন্য শরীর-সান্নিধ্য যে অপরিহার্য, বুঝে গেছে শূর্পণখা। একেবারেই অপরিচিত একজন যুবকের সঙ্গে ঘর করতে এসেছিল সে। বিয়ের আগে এক পলকের জন্যও দেখেনি বিদ্যুদ্জিহ্বকে। নামও শোনেনি কখনও তার। সেরকম অজানা-অচেনা এক যুবকের স্ত্রী হয়ে অশ্মননগরীর রাজপ্রাসাদে এসেছে শূর্পণখা। কিন্তু যত দিন গেছে, বিদ্যুদ্জিহ্বকে দেখবার আর জানবার সুযোগ হয়েছে তার। বিদ্যুদ্জিহ্বের পৌরুষ দেখে বিমুগ্ধ হয়েছে শূর্পণখা। এমন তেজস্বী পরাক্রমশালী মানুষ সে এর আগে কখনও দেখেনি। মুগ্ধতা থেকে ভালোবাসা জন্মেছে। শূর্পণখা বিদ্যুদ্জিহ্বকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছে।

বিদ্যুদ্জিহ্বও ভালোবাসার মতো পুরুষ। সে দৃষ্টিনন্দন। তার বাচনভঙ্গি মনোহর। সে বিচক্ষণ। তার মতো যোদ্ধা গোটা দানবরাজ্যে দ্বিতীয়টি নেই। বীর্যবত্তা আর বুদ্ধিমত্তার জন্য বিদ্যুদ্জিহ্ব পিতা কালকাসুরের প্রিয়পাত্র। কালকাসুরের দ্বিতীয় পুত্র সে। অনেকগুলো পুত্রের মধ্যে এই বিদ্যুদ্জিহ্বই রাজার প্রধান অবলম্বন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংকটে-সমরে এই পুত্রটির পরামর্শ গ্রহণ করে কালকাসুর। বিদ্যুদ্জিহ্ব রণদক্ষ একজন সেনাপতিও। দানবরাজ্যের সামরিকবাহিনীর প্রধান এই বিদ্যুদ্জিহ্ব।

বাইরে যা-ই হোক, প্রাসাদকক্ষে সে একজন প্রেমিক। শূর্পণখার মধ্যে বিদ্যুদ্জিহ্ব জীবনের অর্থ খোঁজে। শূর্পণখাকে সে স্বামীর চোখে দেখে না, রসিক প্রণয়ীর চোখে দেখে। প্রেমিক-প্রেমিকার মতন করেই এরা পরস্পরের দেহসান্নিধ্য উপভোগ করে। প্রাসাদীয় কোনও দ্বন্দ্ব বা জটিলতা এদের দাম্পত্যজীবনে কোনও ফাটল তৈরি করতে পারে না। বিশ্বাসই দাম্পত্যজীবনের একমাত্র শক্তি―বিশ্বাস করে ওরা। তাই বিদ্যুদ্জিহ্ব আর শূর্পণখা পরস্পরকে বিশ্বাস করে এবং ভালোবাসে।

শূর্পণখার পর রাবণের বিয়ে হলো। নিজেই বিয়ে করল রাবণ। মাতা-পিতা-ভাই-আত্মীয়স্বজন―কেউই এই বিয়ে সম্পর্কে জানল না। আসলে হঠাৎ করেই বিয়েটা হয়ে গেল। রাজপ্রাসাদে নয়, একেবারে অরণ্যমাঝেই বিয়েটা সম্পন্ন হলো রাবণের।

বোনকে বিয়ে দিতে পেরে, লঙ্কার রাজা হতে পেরে, রাক্ষসদের সমর্থন পেয়ে রাবণের মন তখন আনন্দে পূর্ণ। ওই আনন্দ নিয়ে একদিন মৃগয়ায় বের হলো রাবণ। এক বন থেকে অন্য বনে, এই অরণ্য থেকে ওই অরণ্যে ঘোড়ায় চেপে ঘুরে বেড়াতে লাগল সে।

সেদিন কোনও পশুকে বধ করতে পারল না রাবণ। সকাল গড়িয়ে বিকেল হলো। মনটা বেজায় খারাপ হয়ে গেল রাবণের। ফিরে আসবার জন্য ঘোড়া ঘোরাতেই অপরূপ রূপসী এক নারীর সামনাসামনি হয়ে গেল সে। ত্বরিত ঘোড়া থেকে মাটিতে লাফিয়ে নামল।

যৌবনবতী এই নারীটির নাম―মন্দোদরী।

মন্দোদরী এক অপ্সরাকন্যা। স্বর্গসুন্দরী হেমা তার মা। দানববংশেরই মেয়ে মন্দোদরী। তার বাবা দানবশ্রেষ্ঠ ময়। নির্মাণশিল্পী তিনি। দেবতা-দানব-রাক্ষস-গন্ধর্ব―সবার কাছে তিনি ময়দানব নামে পরিচিত।

হেমা ময়দানবকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। মন্দোদরী এই মুগ্ধতারই ফসল। অপ্সরা আর দানবে বিয়ে হয়নি। কিন্তু স্বর্গরঞ্জিনী হেমা অনেকগুলো বছর ময়দানবের ভবনে কাটিয়ে দিলেন। মেয়ে জন্মাল তাঁদের। নাম রাখলেন মন্দোদরী। স্বর্গসুন্দরীদের ক্ষেত্রে যা হয়, একদিন ময়দানব থেকে মন উঠে গেল হেমার। দেবকার্যের অজুহাত দেখিয়ে দেবলোকে ফিরে গেলেন হেমা। ময়-ভবনে মন্দোদরীকে ফেলে গেলেন। মাতৃ-পরিত্যক্ত এই কন্যাটিকে স্নেহ-ভালোবাসায় বড় করলেন ময়দানব। চৌদ্দ বছর কেটে গেল। মন্দোদরীর বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়লেন ময়দানব। একদিন ময়দানব মেয়েকে নিয়ে বরের সন্ধানে বেরিয়ে পড়লেন।

সেই বিকেলে অরণ্যের পথ অতিক্রম করছিলেন তাঁরা। ময়দানব একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন। বেশ কিছুটা পথ এগিয়ে এসেছিল মন্দোদরী। এই মন্দোদরীর সঙ্গেই সাক্ষাৎ হয়ে গেল রাবণের। চেতনাহীন হয়ে পড়েছিল রাবণ। বুকে জ্বালা ধরানো এই রূপসীটি কে, তার সামনে! মৃগনয়নী ময়কন্যাটি তাকে বিবশ করে ছেড়েছে।

পরিচয় জিজ্ঞেস করতে গিয়ে জিব জড়িয়ে গেল রাবণের। এই বিভোরতার মধ্যেই ময়দানব সেখানে এসে উপস্থিত হলেন। রাবণ এবং ময়দানব―কেউ কাউকে চেনেন না।

ময়দানবই প্রথমে কথা বললেন। সংক্ষেপে নিজের পরিচয় দিলেন, মন্দোদরীর পরিচয় দিলেন।

এবং বললেন, ‘আমি আমার মেয়ের উপযুক্ত বর খুঁজতে বেরিয়েছি। বিয়ের যোগ্য মেয়ে ঘরে থাকলে বাপের দুশ্চিন্তার অন্ত থাকে না।’

বৃদ্ধ ময়দানব একটু থেমে বললেন, ‘আমাদের সকল কথা তো তোমাকে গড় গড় করে বলে ফেললাম বাপু! তা তোমার পরিচয়টা তো পেলাম না! তোমার পরিচয়টা কি শোনাবে আমাকে ?’

রাবণ সবিনয়ে বলল, ‘আমার নাম রাবণ। পিতা আমার নাম দিয়েছিলেন দশগ্রীব। আমি মহর্ষি বিশ্রবার পুত্র। ব্রহ্মার মানসপুত্র পুলস্ত্যের নাতি আমি।’

‘মানে! তুমি সেই রাবণ, যে এখন লঙ্কার অধিপতি!’ আবেগে ময়দানবের গলা কেঁপে উঠল।

মাথা নিচু করে রাবণ বলল, ‘হ্যাঁ।’

ময়দানব দেখলেন বংশপরিচয়ের নিরিখে রাবণের মর্যাদা কম নয়। তদুপরি বিপুল এক ঐশ্বর্যময় দেশের নরপতি সে। ময়দানব মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললেন―এই রাবণকেই মন্দোদরীর বর করবেন।

মনের কথা বলতে কোনও দ্বিধা করলেন না ময়দানব, ‘আমি চাই, তুমি আমার কন্যাটিকে বিয়ে করো। মন্দোদরীকে পত্নী হিসেবে পেলে তুমি সুখী হবে বাবা।’

ময়দানবের প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করল রাবণ। সেই নির্জন বনের মধ্যেই অগ্নিসাক্ষী করে ময়দানবের সামনে মন্দোদরীর পাণিগ্রহণ করল লঙ্কাপতি রাবণ।

রাক্ষসকুলপতি রাবণের এই বিয়েতে কোনও আড়ম্বর ছিল না। এমনকি সপত্নী লঙ্কায় ফিরে আসার পরও ধুমধাম করে কোনও অনুষ্ঠান করল না রাবণ।

অতি শীঘ্র অন্য একটি কর্তব্য সম্পাদন করল সে। কুম্ভকর্ণ আর বিভীষণকে বিয়ে করিয়ে দিল। কুম্ভকর্ণের স্ত্রীর নাম বজ্রজ্বালা। দৈত্যরাজ বলির দৌহিত্রী সে। সরমার সঙ্গে বিভীষণের বিয়ে হলো।

কুম্ভকর্ণের স্বার্থে রাবণ আরও একটি কাজ করল। বিশাল, সুখৈশ্বর্যপূর্ণ একটি শয়নকক্ষ নির্মাণ করাল। এই শয়নভবনে কুম্ভকর্ণের নিদ্রা যাতে বিঘ্নহীন থাকে, সেই ব্যবস্থাও করল লঙ্কাধিরাজ।

এগারো

এক বছরের মধ্যে শক্ত ভিতের ওপর নিজেকে দাঁড় করিয়ে ফেলল রাবণ।

রাবণের সৌভাগ্য―রাজপ্রাসাদে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার মতো কেউ নেই। কুম্ভকর্ণ জাগতিক বিষয়ের প্রতি একেবারেই নিরাসক্ত। নিজের দৈহিক শক্তি সম্পর্কে সে উদাসীন। তার প্রিয় দুটি বাসনা―খাওয়া এবং ঘুম। রাবণ এ দুটি আসক্তিপূরণের সুব্যবস্থা করে রেখেছে। রাজনীতি, সিংহাসন, রাজক্ষমতা―এগুলোর প্রতি কোনওই আগ্রহ নেই বিভীষণের। তার যত আগ্রহ গার্হস্থ্যধর্মে আর ঈশ্বরভাবনায়। রাজকীয় ঝড়-জটিলতা থেকে যতটুকু সম্ভব নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখে সে। মন্দোদরীর তদারকিপনায় প্রাসাদের অন্দরমহল একেবারেই সুশৃঙ্খল। প্রাসাদীয় কোন্দল-ষড়যন্ত্র থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রাবণ।

সামরিকশক্তি বাড়ানোর দিকে রাবণ নজর দিল। সমস্ত পৃথিবীর ওপর প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা রাবণের। পৃথিবীজয়ের জন্য দরকার দুর্দমনীয় সৈন্যবাহিনী। প্রয়োজন রণদক্ষ বিচক্ষণ সেনাপতি এবং যুদ্ধাস্ত্র। রাজধানীর নানা স্থানে অস্ত্রনির্মাণ কারখানা স্থাপন করল রাবণ। সেসব কারখানায় শতসহস্র রাক্ষস অস্ত্রনির্মাণে নিয়োজিত হলো। গদা, অসি, দণ্ডপাট্টা, শিরোহী, কৃপাণ, আয়ুধ কাট্টি, হালাদি, মাদুভু, খাঁড়া, গুপ্তি, ধনুক, তির, শক্তিশেল, বর্শা, চক্র, ছুরি, খুকরী, কুঠার, বাঘনখ, ঢাল, চাবুক, বর্ম, শিরস্ত্রাণ প্রভৃতি সমরাস্ত্র তৈরি হতে থাকল সেখানে।

একটা সময়ে রণদক্ষ বিশাল এক রাক্ষসবাহিনী তৈরি করে ফেলল রাবণ। তার পর রাবণ দেশজয়ে বেরিয়ে পড়ল। সে জানে, ভিন দেশের রাজার মনোবল ভেঙে দেওয়ার প্রধান হাতিয়ার―অত্যাচার। অত্যাচারে প্রজারা ভয় পায়, রাজা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আক্রমণের আগে পররাজ্যে অত্যাচার শুরু করার আদেশ দিল সৈন্যদের। রাক্ষসসৈন্যদের অত্যাচারের হাত থেকে দেবতা, ঋষি, গন্ধর্ব, যক্ষ―কেউই রেহাই পেলেন না। এরপর একের পর এক রাজ্য জয় করে যেতে লাগল রাবণ। ছোট-বড় কোনও দেশই নিজেদের স্বাধীনতা বজায় রাখতে পারল না। রক্তগঙ্গা বইয়ে দিয়ে রাবণ কোনও রাজ্য নিজ অধিকারে আনল, আবার কোনও নৃপতি যুদ্ধের আগেই রাবণের সামনে হাঁটু গেড়ে বসল। বিজিত প্রত্যেকটি দেশ থেকে মহার্ঘ বস্তুসকল লুণ্ঠন করে লঙ্কায় নিয়ে আসতে থাকল রাবণ।

রাবণের এই নির্যাতন-লুণ্ঠনে কুবের বড় আহত হলো। রাবণ তো ঋষি বিশ্রবারই পুত্র! সে নিজেও তো বিশ্রবার সন্তান! কই সে তো রাবণের মতো দলনপ্রিয় নয়! রাবণের এই অবিচার-অত্যাচারের দুর্নাম তো বিশ্রবার ওপরও বর্তাচ্ছে! আর বিশ্রবার বদনাম হলে সেই বদনামের অংশভাগী তো সে নিজেও! নিজেকে আর স্থির রাখতে পারল না কুবের। রাবণের কাছে দূত পাঠিয়ে পররাজ্য আক্রমণ এবং ধনসম্পত্তি লুণ্ঠন বন্ধ করতে বলল ধনপতি কুবের।

দূতের মুখে কুবেরের খবর্দারি শুনে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে উঠল রাবণ। রাবণের চোখমুখ এত ভয়াল হয়ে উঠল যে, দেখে দূত পালিয়ে যেতে উদ্যত হলো। কিন্তু পালাতে পারল না। তার আগেই তাকে হত্যার আদেশ দিল রাবণ। অবধ্য দূতকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হলো না সে, সসৈন্যে কুবেররাজ্য কৈলাসের দিকে অগ্রসর হলো। কৈলাসে পৌঁছে কুবেরকে যুদ্ধে আহ্বান জানাল রাবণ।

দূতের মাধ্যমে একজন বড়দাদা ছোট ভাইকে সাবধান করার অধিকার রাখে। সেই অধিকারই প্রয়োগ করতে চেয়েছিল কুবের। সামান্য সতর্কবার্তার কারণে কুবেরের রাজ্য আক্রমণ করার কথা নয়। কিন্তু রাবণ তা-ই করল। এ যেন লঘু পাপে গুরুদণ্ড!

আসলে রাবণের লক্ষ্য ছিল ওই পুষ্পকরথটি। সেই তরুণবেলায় বাবা বিশ্রবার প্রাঙ্গণে পুষ্পকরথটি দেখে সেটি হস্তগত করার বাসনা সেদিনই রাবণের মনে জেগেছিল। কিন্তু সেদিন রাবণের শক্তি ও সামর্থ্য ছিল না পুষ্পকরথটি দখল নেবার। আজ রাবণের সেই শক্তি অর্জিত হয়েছে। তাই ঠুনকো কারণে সে কৈলাস আক্রমণে উদ্যত হয়েছে। তার উদ্দেশ্য―কৈলাস পদানত করা নয়, পুষ্পকরথটি নিজের দখলে আনা।

রাবণের হুঙ্কার শুনে কুবের আর হাত গুটিয়ে বসে থাকল না। প্রতি-আক্রমণের জন্য নিজের বাহিনীকে দ্রুত প্রস্তুত করল। প্রচুর রক্তক্ষয় হলো রাবণ-কুবেরের যুদ্ধে। বহু যক্ষসৈন্য নিহত হলো। যুদ্ধক্ষেত্রে রাবণ-কুবের মুখোমুখি হলো। রাবণ কুবেরকে আক্রমণের সুযোগ দিল না। গদার এক আঘাতেই ধরাশায়ী করে ছাড়ল কুবেরকে। রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে লুটিয়ে পড়ল কুবের। তার সৈন্যরা অচৈতন্য কুবেরকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে না গেলে রাবণ মেরেই ফেলত তাকে। কুবেরবাহিনী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে প্রাণে রক্ষা পেল। যুদ্ধজয়ের পর রাবণ কুবেররাজ্য অধিগ্রহণ করল না, শুধু পুষ্পকরথটি নিজের অধিকারে নিয়ে নিল। কুবেরের রাজধানী অলকানগরী তছনছ করে দিয়ে পুষ্পকরথে চড়ে রাবণ লঙ্কায় ফিরে এল।

জ্যেষ্ঠভ্রাতা এবং কৈলাস-অধিপতি কুবেরকে পরাস্ত করে রাবণের মধ্যে প্রবল এক শক্তিমত্তার স্ফুরণ হলো। নবগৃহীত পুষ্পকরথটি তার পররাজ্য-আক্রমণের স্পৃহা বহু গুণে বাড়িয়ে দিল। পরদেশলিপ্সায় মাতোয়ারা হয়ে রাবণ পুনরায় বহির্দেশ আক্রমণে বেরিয়ে পড়ল। রক্তনেশা তাকে এমনভাবে পেয়ে বসল যে সে আর্য-অনার্য পার্থক্য ভুলল, দেবতা-অসুরের ভেদাভেদ বিস্মরিত হলো। তার কাছে দেবরাজ্য আর দানবরাজ্যের পার্থক্য ঘুচে গেল।

একের পর এক রাজ্য জয় করে চলল রাবণ। তার পায়ের তলায় অনেক রাজ্যের নৃপতি নিষ্পেষিত হলো। জয়ের নেশায় অনেকটাই উন্মাদ তখন রাবণ।

বহু দেশ দখল করে একদিন সে অশ্মননগরীর প্রান্তে এসে উপস্থিত হলো। এই রাজ্যের যুবরাজ বিদ্যুদ্জিহ্বের সঙ্গে যে সহোদরা শূর্পণখার বিয়ে দিয়েছে, ভুলে থাকল রাবণ। তখন হয়তো তার কাছে বোনের সুখের চেয়ে রাজ্যলিপ্সা বড়।

দানবগোষ্ঠী সহজে রাবণকে অশ্মননগরী অধিকার করতে দিল না। কালকাসুর তখন প্রায়-বৃদ্ধ। রাজ্যপরিচালনার দায়িত্ব তখন বিদ্যুদ্জিহ্বের হাতে। অভিমান প্রবল হয়ে উঠল বিদ্যুদ্জিহ্বের। জ্যেষ্ঠ সহোদর হয়ে ভগিনী শূর্পণখার শ্বশুররাজ্য আক্রমণ! এ কেমন দাদা! যে দাদা বোনের সুখ বোঝে না, যে দাদার কাছে আত্মীয়তার কোনও মূল্য নেই, সেই দাদার কাছে আত্মীয়তার দাবি নিয়ে দূত পাঠাবে না বিদ্যুদ্জিহ্ব। রাবণশক্তির মোকাবিলা করবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল সে।

এই যুদ্ধে সহযোগিতার জন্য সকল দৈত্য-দানবগোষ্ঠীকে আহ্বান জানাল বিদ্যুদ্জিহ্ব। অসুর-দানবদের বিভিন্ন গোষ্ঠী তার এই আহ্বানে সাড়া দিল। সবাই এসে বিদ্যুদ্জিহ্বের পাশে দাঁড়াল। অত্যাচারী রাবণকে যে কোনও মূল্যে প্রতিহত করবে তারা।

কালকেয় দৈত্যদানবরা বীরবিক্রমে রাবণসৈন্যের মুখোমুখি হলো। ঘোরতর যুদ্ধ বেধে গেল দানবে আর রাক্ষসে। দানবদলে গোষ্ঠীর সেনাপতিরা যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিদ্যুদ্জিহ্ব।

যুদ্ধযাত্রার আগে স্বামীকে বাধা দিয়েছিল শূর্পণখা। বলেছিল, ‘যুদ্ধ-উন্মাদ হয়ে গেছে দাদা রাবণ। উন্মাদদের হিতাহিত জ্ঞান থাকে না। রক্তপিপাসুদের কাছে মা-বাবা-ভাই-বোন বলে কিছু নেই। রক্তনেশা পেয়ে বসেছে রাবণকে। দাদা কি জানে না, এই রাজ্যের যুবরাজ বিদ্যুদ্জিহ্বের সঙ্গে তার বোনের বিয়ে দিয়েছে ? মনে আছে তার সব। আমার বড় ভয় করছে বিদ্যুৎ। তুমি যুদ্ধে যেয়ো না। উন্মাদটা কখন কী করে বসে তার ঠিক নেই।’

দাদা রাবণের ওপর প্রচণ্ড রাগ শূর্পণখার। বিয়ের পর এতটা দিন-মাস পেরিয়ে গেল! একবারের জন্যও খোঁজ নেয়নি তার একমাত্র বোনটি কেমন আছে জানবার জন্য ?

কিন্তু বিদ্যুদ্জিহ্ব তো কালকাসুর দানবের পুত্র! তার মধ্যেও তো দানবীয় ক্রোধ বিরাজমান! রাবণ যদি আত্মীয়তা ভুলতে পারে, সে পারবে না কেন ?

এই কথাটিই স্ত্রীকে বলল বিদ্যুদ্জিহ্ব, ‘স্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তুমি আমাকে যুদ্ধে যেতে বারণ করছো, ঠিক আছে। কিন্তু রাজপুত্র হয়ে আমারও তো একটা কর্তব্য আছে শূর্পণখা! এই রাজ্যের স্বাধীনতা রক্ষা করা আমার পরম কর্তব্য। তাতে আমার প্রাণ যায় যাক।’

ত্বরিত বেগে স্বামীর মুখ চেপে ধরল শূর্পণখা, ‘তুমি অমন করে বলো না বিদ্যুৎ। তোমাকে ছাড়া যে আমি বাঁচব না, জানো না তুমি ? তুমিই যে আমার একমাত্র অবলম্বন বিদ্যুৎ।’ বলতে বলতে হাউমাউ করে উঠল শূর্পণখা।

বিদ্যুদ্জিহ্ব শূর্পণখাকে বুকের গভীর টেনে নিল। অধরে চুম্বন করে বলল, ‘তুমি আমাকে যুদ্ধে যেতে দাও শূর্পণখা। তোমার ভালোবাসা যদি নিখুঁত হয়, আমার দেশপ্রেম যদি নিখাদ হয়, তাহলে রাবণকে পরাজিত করে তোমার কাছে ফিরে আসব আমি।’

‘আমি একটা কাজ করি বিদ্যুৎ ?’ অশ্রুভেজা মুখ তুলে বলল শূর্পণখা।

‘আমি দাদার কাছে যাই ? এই যুদ্ধ না করবার জন্য তাকে অনুরোধ করি ?’ শূর্পণখা আবার বলল।

‘না। তা হয় না শূর্পণখা। তাহলে আমি অপমানবোধ করব। দানবশ্রেষ্ঠ কালকাসুরের মাথা নত হয়ে যাবে। সর্বোপরি দানবজাতির জয়ের যে ইতিহাস, তা ধূলিসাৎ হয়ে যাবে। বউকে ব্যবহার করে দেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে আমি রাজি নই শূর্পণখা।’ অভিমানক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলল বিদ্যুদ্জিহ্ব।

আবার ফুঁপিয়ে উঠল শূর্পণখা, ‘অ মা রে, অ ভগবান রে, তোমরাই বলে দাও, এখন আমি কী করব!’

কাঁদতে কাঁদতো ভূমিতে লুটিয়ে পড়ল শূর্পণখা।

পরম আদরে ভূমি থেকে শূর্পণখাকে টেনে তুলল বিদ্যুদ্জিহ্ব। চোখ মুছিয়ে দিয়ে বলল, ‘দেখে নিয়ো শূর্পণখা, আমি ঠিক তোমার কাছে ফিরে আসব।’ কিছুক্ষণ আগে বলা কথাটি পুনরায় বলে স্ত্রীকে সান্ত্বনা দিল বিদ্যুদ্জিহ্ব।

যুদ্ধে বেরিয়ে পড়ল বিদ্যুদ্জিহ্ব। চৌদ্দ হাজার কালকেয় দানবসৈন্য নিয়ে অন্যান্য অসুরবাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হলো। বিশাল এক দানব-দৈত্যবাহিনী রাক্ষসসৈন্যদের দিকে অগ্রসর হলো। অল্প সময়ের মধ্যে দানব আর রাক্ষসদের মেশামেশি হয়ে গেল। কে দানব, কে রাক্ষস বোঝার উপায় থাকল না। কেউ কাউকে চেনারও উপায় নেই। সবার গায়ে বর্ম, মাথায় শিরস্ত্রাণ। হাজার হাজার দানব ও রাক্ষসসৈন্য নিহত হতে থাকল। মানুষের রক্তে গোটা যুদ্ধক্ষেত্রে ভিজে গেল। রাক্ষসদের তুলনায় দানবরা নিহত হতে থাকল বেশি।

একটা পর্যায়ে রাবণ আর বিদ্যুদ্জিহ্ব মুখোমুখি হলো। বিদ্যুদ্জিহ্ব রাবণকে চিনলেও রাবণ শিরস্ত্রাণপরা বিদ্যুদ্জিহ্বকে চিনতে পারল না। উভয়ের মধ্যে ঘোরতর যুদ্ধ শুরু হলো। উভয়ের হাতে তীক্ষè তরবারি।

যুদ্ধের এক পর্যায়ে ধারালো অসির এক টানে বিদ্যুদ্জিহ্বের গলা কেটে ফেলল রাবণ।

যুদ্ধক্ষেত্রে দুজনের মধ্যে যখন যুদ্ধ হয়, প্রতিপক্ষ নিহত হলে বধকারী নিহত শত্রুটির দিকে ফিরেও তাকায় না আর। কারণ তখন তখনই আরেকজন সশস্ত্র শত্রু সামনে এসে দাঁড়ায়। ওই সময় নব-আক্রমণকারীকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে বধকারী।

রাবণের ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। তার অসির আঘাতে বিদ্যুদ্জিহ্ব মাটিতে লুটিয়ে পড়লে অন্য একজন দানব অস্ত্র হাতে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। তার সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে গিয়েছিল রাবণ। ফলে বিদ্যুদ্জিহ্বের চেহারা তার দৃষ্টির অন্তরালেই থেকে গিয়েছিল।

সমরাধ্যক্ষ বিদ্যুদ্জিহ্বের নিহতের সংবাদ দ্রুত যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়ল। দানবসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। যে যেদিকে পারল, পালাল।

যুদ্ধজয় করে রাবণ সেখানে আর থাকেনি। অন্য দেশ জয় করবার অভিলাষে সদর্পে সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। সে জানে না―এই অশ্মননগরীর যুদ্ধে সহোদরা শূর্পণখার কত বড় সর্বনাশ করেছে। শূর্পণখার সুখের দাম্পত্যজীবন ছারখার করে দিয়েছে। অসহায়, স্বামীহীন বৈধব্যজীবনে ঠেলে দিয়েছে সে শূর্পণখাকে। শূর্পণখার ব্যাকুল আর্তনাদ রাবণের কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি।

স্বামীকে হারিয়ে শূর্পণখা নিথর নিস্তব্ধ যখন, রাবণ তখন যুদ্ধমদে মত্ত। নানা দেশের দিকে সসৈন্যে ধেয়ে গেছে। এক একটা দেশ পদানত করেছে আর সে দেশের ধনসম্পদ, যুবতীদের পুষ্পকরথে তুলে নিয়েছে রাবণ।

বহুদেশ জয় করে, বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে অবশেষে রাবণ লঙ্কায় ফিরে এসেছে। তার এই দিগি¦জয় গোটা পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। রাক্ষসজাতিকে করে তুলেছে অহংকারী।

সিংহাসনে বসে তার সাম্প্রতিক দেশবিজয়ের বৃত্তান্ত সভাসদদের সামনে বলে যাচ্ছিল রাবণ। ঠিক সেই সময় রোরুদ্যমান এক যুবতী এসে রাবণের সামনে আছড়ে পড়ল।

লঙ্কাপতি রাবণ সেদিন বড় আনন্দে ছিল।

বারো

রাবণ প্রথমে বুঝতে পারেনি তার সামনে আছড়েপড়া নারীটি কে ?

আলুথালু কেশে তখন তার মুখমণ্ডল ঢাকা।

রাবণ অহংবোধের ঘূর্ণিতে আবর্তিত হচ্ছিল। বিজয়ের উল্লাসে মাতোয়ারা তখন রাবণ।

নারীটির আর্তচিৎকারে রাবণের ঘোর কেটে গেল। ‘দাদা, দাদা রে! এ কী করলে তুমি!’

কণ্ঠস্বরেই রাবণ বুঝতে পারল, ভূলুণ্ঠিত নারীটি তার বোন শূর্পণখা। দ্রুত সিংহাসন থেকে নিচে নেমে এল রাবণ। মাটি থেকে শূর্পণখাকে তুলে স্তম্ভিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল, ‘এ কী অবস্থা তোমার, বোন! কী হয়েছে তোমার ? কে তোমাকে এই দুরবস্থায় ফেলল, বলো আমাকে। আমি এখনই তার মাথা কেটে নামাচ্ছি।’

কাঁদতে কাঁদতে চোখ লাল হয়ে গেছে শূর্পণখার। হিসানো গলায় বলল, ‘তুমি রাজা হয়েছ ঠিক। প্রবল শক্তিধর হয়েছো, তাও মানি। তাই বলে সেই শক্তিতে তুমি আমাকে বিধবা করবে!’

আকাশ থেকে পড়ল রাবণ, ‘মানে! কী বলতে চাও তুমি!’

‘তুমি কালকেয় দানবদের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়েছিলে ?’

‘গিয়েছিলাম।’

‘সেই দানবদের সেনাপতি কে ছিল তুমি জান না বলছো ?’

‘কে ছিল দানবদের সেনাপতি ? জানি না তো!’

এবার সর্পিণীর মতো ফণা তুলল শূর্পণখা, ‘মিথ্যে, মিথ্যে বলছো তুমি আমায়!’

হতবাক হয়ে বোনের দিকে তাকিয়ে থাকল রাবণ। পরে বলল, ‘সত্যি বলছি বোন, কে ছিল সেনাপতি, জানতাম না আমি।’

‘আমার স্বামী বিদ্যুদ্জিহ্ব ছিল দানবদলের সমরাধ্যক্ষ।’

‘তো ?’ ভীষণ উদ্বিগ্ন দেখাল রাবণকে।

‘তুমি আমার স্বামীকে হত্যা করেছো রে দাদা!’

‘আমি ঘুণাক্ষরেও জানতাম না বিদ্যুদ্জিহ্ব ওই সৈন্যদলে ছিল।’

এবার গলায় ঠান্ডা জল ঢেলে শূর্পণখা বলল, ‘তুমি প্রথমে কোন দেশ আক্রমণ করেছিলে ?’

‘অশ্মননগরী।’

‘তোমার বোনকে কোন নগরীর যুবরাজের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলে ?’

থতমত খেয়ে গেল রাবণ। কোনও জবাব না দিয়ে চুপ করে থাকল।

‘চুপ করে আছো কেন ? জবাব দিচ্ছ না কেন ?’ গলা ফাটিয়ে উন্মাদিনীর মতো হেসে উঠল শূর্পণখা, ‘জবাব দেবে কী করে তুমি! কোনও সদুত্তর তো নেই তোমার কাছে! তুমি তো জেনেশুনে সচেতনভাবেই খুন করেছো বিদ্যুদ্জিহ্বকে।’

চট করে সভাসদদের দিকে তাকাল রাবণ। গলা চড়িয়ে বলল, ‘এসব কী বলছো তুমি ?’

‘যা সত্য, তা-ই বলছি।’

‘চুপ কর তুমি শূর্পণখা। মিথ্যে অপবাদ দিয়ে আমাকে অসম্মান কোরো না।’

‘সম্মান! সম্মান জানাব আমি আমার স্বামীর হত্যাকারীকে ?’

ক্রোধান্বিত হয়ে উঠতে গিয়ে নিজেকে সংযত করল রাবণ। বলল, ‘এমনটি বলো না বোনটি।’

‘বিদ্যুদ্জিহ্ব রণদক্ষ একজন দানববীর। তার যুদ্ধকুশলতা আর বীর্যবত্তার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে ছিল যুদ্ধপ্রিয় মানুষ। এ জন্য বিরাট এক সৈন্যবাহিনী তৈরি করেছিল সে। এসব কিছু তোমার কানে পৌঁছে গিয়েছিল দাদা। তুমি ভয় পেয়ে গিয়েছিল। বিদ্যুদ্জিহ্বকে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছিলে। ভেবেছিলে―তাকে এই পৃথিবী থেকে সরিয়ে না দিলে একদিন প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হবে তোমাকে। তুমি তাকে হত্যার পরিকল্পনা করলে এবং অশ্মননগরী আক্রমণ করে বসলে তুমি। তুমি জানতে ওই রাজ্যের পরোক্ষ-কর্ণধার বিদ্যুদ্জিহ্ব। এখন তুমি না-জানার ভান করছো। এ তোমার অভিনয় দাদা। এই রাজসভায় উপস্থিত সভাসদরা তোমার মেকি অভিনয় বুঝতে না পারলেও আমার চোখকে ফাঁকি দিতে পারবে না তুমি।’ বলতে বলতে গলা শুকিয়ে এল শূর্পণখার।

শূর্পণখার মুখে এত ভর্ৎসনা শোনার পরও উত্তেজিত হলো না রাবণ।

স্নেহকাতর গলায় বলল, ‘তুমি আমাকে ভুল বুঝো না বোন। সত্যি বলছি―তোমার স্বামীকে আমি রণক্ষেত্রে চিনতে পারিনি। লোহার বর্ম পরা ছিল বিদ্যুদ্জিহ্ব, মাথা আর মুখমণ্ডল ঢাকা শিরস্ত্রাণ ছিল তার।’

‘তুমি যদি বিদ্যুদ্জিহ্বকে না-ই চিনতে পেরেছো, তাহলে এরকম বিবরণ দিচ্ছ কী করে ?’

শূর্পণখার কথায় চমকে উঠল রাবণ। কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।

ডান হাতের তালু দিয়ে চোখের জল মুছে নিল শূর্পণখা, ‘ধরা পড়ে গেলে তো দাদা ? চিনে-বুঝে যে তুমি বিদ্যুদ্জিহ্বকে হত্যা করেছো, প্রমাণ হয়ে গেল তো ?’

রুক্ষ হয়ে উঠল শূর্পণখার স্বর, ‘তুমি প্রচণ্ড ক্ষমতালোভী। তুমি চাও না তোমার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী এই পৃথিবীতে বেঁচে থাকুক। বিদ্যুদ্জিহ্বকে তুমি প্রতিপক্ষ ভেবে নিয়েছিলে। তাই পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছো তুমি তাকে। তুমি তো জানো না―বিদ্যুৎ তোমাকে কত ভালোবাসে। নিজের দাদার চেয়েও বেশি সম্মান করত সে তোমাকে। তুমি সেই ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার দাম দিলে না দাদা।’ দম নেওয়ার জন্য একটু থামল শূর্পণখা।

তারপর আবার বলল, ‘দাম দেবে কী তুমি! ভালোবাসা-শ্রদ্ধার কোনও মূল্যই তো নেই তোমার কাছে!’

এবার গর্জে উঠল রাবণ, ‘চুপ করো তুমি শূর্পণখা। আর একটাও বাজে কথা বলবে না তুমি।’

শূর্পণখাও ক্ষেপে গেল, ‘ধমক দিয়ে আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে না। মনে রেখো, তুমি যেমন মহর্ষি বিশ্রবার পুত্র, আমিও তেমনি বিশ্রবার কন্যা। আমার তেজ তোমার চেয়ে কম কীসে ? সত্য কথা বলতে আমার গলা কাঁপে না।’

রাবণের চোখ দিয়ে আগুন বেরোচ্ছে তখন। দাঁত কিড়মিড় করছে। পারলে এখনই ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিন্তু আশ্চর্য সহনশীলতায় নিজেকে সংযত রাখল রাবণ। সে বুঝে গেল―শূর্পণখার কথার পিঠে কথা বললে আরও ভয়ংকরী হয়ে উঠবে সে।

শূর্পণখা ওখানে থেমে গেল না, ‘তোমার ক্ষমতালোভ দুর্নিবার। নিজের স্বার্থের জন্য তুমি যে কোনো অন্যায় করতে দ্বিধা করো না। এমন যে আমাদের বড়দাদা কুবের, তুমি তাকে লঙ্কা থেকে উচ্ছেদ করেছো। সেখানে থেমে যাওনি তুমি, কৈলাসে তার রাজধানী আক্রমণ করেছো। গুরুতর আহত করেছো তাকে। বাগে পেলে তাকে মেরে ফেলতে―এ ব্যাপারে আমি নিশ্চিত। পালিয়ে প্রাণ বাঁচাল বড়দাদা। তুমি তার আকাশচারী পুষ্পকরথটা লুণ্ঠন করে নিয়ে এলে। তোমার তো কোনও বিবেক নেই দাদা! তুমি বোঝো শুধু তোমার স্বার্থকে।’

‘ঠিক আছে, ঠিক আছে শূর্পণখা, তুমি এবার চুপ কর বোনটি। তুমি এতক্ষণ যা যা বললে সবই তোমার মনগড়া। সত্যের ছিটেফোঁটাও নেই তোমার কথায়।’ বরফে চুবানো কণ্ঠস্বর রাবণের।

‘মনগড়া কথা আমি কিছুই বলিনি দাদা। তোমার ভাগ্য ভালো যে বিভীষণটা নির্জীব শ্রেণির। রাজক্ষমতা নিয়ে সে মোটেই ভাবে না। যে ভাবত, তাকে কৌশলে তুমি ঘুম পাড়িয়ে রেখেছো।’

‘মানে! কার কথা বলতে চাইছো তুমি ?’

‘দাদা কুম্ভকর্ণের কথা বলছি। এই যে মাসের পর মাস সে ঘুমিয়ে থাকে, তার পেছনে তো তোমার কারসাজি আছে।’

‘আমার কারসাজি আছে!’

‘আছে, আছে তো! একজন মানুষ টানা কি এতদিন ঘুমাতে পারে ? তোমার হাতে পড়েছে বলে দাদা কুম্ভকর্ণ ঘুমিয়ে থাকে।’

‘মানে!’

‘তুমি রাজবদ্যিকে দিয়ে তার খাদ্যের সঙ্গে ওষুধ মেশাও না ? এই ওষুধের প্রভাবেই তো গভীর নিদ্রায় দিনের পর দিন আচ্ছন্ন হয়ে থাকে মেজদা। ও ঘুমিয়ে থাকলে তো তোমারই লাভ!’

‘আমার লাভ! কীসের লাভ ?’

‘ঘুমমগ্ন মানুষেরা জীবনের বাস্তবতা সম্বন্ধে ভাববার অবকাশ পায় না। নিদ্রাচ্ছন্ন মেজদা রাজক্ষমতা, সিংহাসন―এসব কিছু নিয়ে ভাববার সময় পায় না।’ ক্রূর একটু হাসল শূর্পণখা।

‘প্রাসাদে তুমি বিঘ্নহীন। বাইরের প্রতিদ্বন্দ্বীকে একে একে ধ্বংস করছো তুমি। আমার বিদ্যুদ্জিহ্বকে হত্যা করে ছাড়লে রে দাদা!’ বলতে বলতে মাটিতে আবার লুটিয়ে পড়ে গড়াগড়ি দিতে লাগল শূর্পণখা।

রাবণ ধীরে ধীরে বোনকে ভূমি থেকে টেনে তুলল। অনুতাপগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি বোন এমন করে কেঁদো না। তুমি তো জানো―জয়ের জন্য যখন আমি যুদ্ধ করি, মাথা ঠিক থাকে না আমার। আত্মপর বোধও থাকে না। সেই জন্য তোমার স্বামী আমার হাতে মারা পড়েছে। তুমি ভেবে দেখো, আয়ত্তে পেলে বিদ্যুদ্জিহ্ব কি আমাকে ছেড়ে দিত ? দিত না তো ? ভবলীলা সাঙ্গ করে ছাড়ত সে আমার।’

শূর্পণখার বসন থেকে ধূলি ঝাড়তে ঝাড়তে রাবণ আবার বলল, এখন তার কথাগুলো মধুমাখা, ‘যা হবার হয়ে গেছে। এখন বিদ্যুদ্জিহ্বকে তোমার কাছে ফিরিয়ে দিতে পারব না আমি। তবে যে সমূহক্ষতি হয়েছে তোমার, তা পূরণ করে দিতে পারব।’ বলে ইচ্ছে করে থেমে গেল রাবণ। উদ্দেশ্য―তার কথার পরিপ্রেক্ষিতে শূর্পণখা কী বলে শোনা।

চট করে রাবণের দিকে তাকাল শূর্পণখা, ‘ক্ষতি পূরণ করে দেবে ? কী ভাবে পূরণ করবে ? স্বামীর বদলে স্বামী দেবে ?’ শেষের দিকে শূর্পণখার কণ্ঠ হিসহিসিয়ে উঠল।

রাবণ বলল, ‘যা তোমাকে দেব, তাতে বিদ্যুৎ-বিরহ ঘুচে যাবে তোমার।’

শূর্পণখার কণ্ঠস্বর কিছুটা নরম হয়ে এল, ‘তোমার অনেক শক্তি। সেই শক্তি প্রয়োগ করে তুমি আমাকে বিধবা করে ছেড়েছ। তুমি যুদ্ধে চৌদ্দ হাজার দানবসেনা মেরেছ, তাদের মধ্যে আমার প্রাণপ্রিয় স্বামীটিও ছিল। তুমি আমার ভাই, না শত্রু ? আমার স্বামীকে মারলে তুমি, না আমাকে বধ করলে দাদা ? বিপদে ঘরের জামাইকে রক্ষা করে মানুষ। আর তুমি তাকে হত্যা করলে! বিধবা করে আমার জীবন থেকে সকল সুখ ও স্বস্তি কেড়ে নিয়েছো দাদা তুমি। দাদা রে! এ কী করলে তুমি আমার!’ আবার কাঁদতে শুরু করল শূর্পণখা।

শূর্পণখার হাহাকার-আর্তনাদে রাবণ খুব বিচলিত হলো বলে মনে হলো না। ভগ্নিপতিকে মেরে ফেলেছে বলে তেমন কোনও অনুতাপ রাবণের চোখেমুখে দেখা গেল না। শূর্পণখার ধিক্কারে রাবণ কোনও লজ্জাও পেল না।

উপরন্তু শান্তভাবে স্নেহে রাবণ শূর্পণখাকে উদ্দেশ করে বলল, ‘তুমি আর কেঁদো না বোন। স্বামী হারালে নারীরা ভীত হয়ে পড়ে। স্বামীকে বেঁচে-থাকার একমাত্র অবলম্বন ভাবে বলে তাদের এরকম অবস্থা হয়। ভবিষ্য-নিরাপত্তা নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। ভরণপোষণ নিয়েও গভীরভাবে চিন্তিত হয়। তোমার তো সেই ভয় নেই শূর্পণখা! তুমি তো লঙ্কাধিরাজ রাবণের আপন বোন, নাকি ? জেনো, স্বামী মারা গেলে স্ত্রীলোকের সুরক্ষার হানি ছাড়া আর কোনও ক্ষতি হয় না।’

শূর্পণখার চোখমুখ দেখে রাবণের মনে হলো, তার কথাগুলো শূর্পণখার মধ্যে বেশ প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে।

থামল না রাবণ, ‘তোমার সেই ক্ষতিটা আমি পুষিয়ে দেব শূর্পণখা। তোমাকে দান দিয়ে, মান দিয়ে এবং অনুগ্রহ দিয়ে তোমার স্বামীহীনতার ক্ষতি আমি পূরণ করে দিচ্ছি।’

‘স্বামীহীনতার ক্ষতি পুষিয়ে দেবে তুমি! কী ভাবে!’ ত্বরিত জানতে চাইল শূর্পণখা।

রাবণ এবার গম্ভীর হয়ে বলল, ‘বিপুল ধনসম্পত্তি দেব তোমাকে, মর্যাদার উচ্চাসনে বসাব। একটা অঞ্চলের অধিশ্বরী করে দেব তোমায়।’

বিস্ফারিত চোখে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকল শূর্পণখা। তার চোখমুখ থেকে স্বামীশোক কি তিরোহিত হয়ে গেল ? বোঝা যাচ্ছে না। তবে এইটুকু বোঝা যাচ্ছে―দাদার পরবর্তী কথাগুলো শুনবার জন্য সে ভীষণ উদ্গ্রীব।

রাবণ বলল, ‘দণ্ডকারণ্য আমারই শাসনাধীন একটা অঞ্চল। ওই অঞ্চলের শাসনকার্য পরিচালনার জন্য আমি খরকে দায়িত্ব দিয়েছি। খরকে তো চেনো তুমি ?’

শূর্পণখা ডান পাশে মাথা কাত করল।

তেরো

রাবণ বলল, ‘খর আমাদের বৈমাত্রেয় ভাই। পিতা বিশ্রবার অন্য এক স্ত্রী রাকার পুত্র সে। খর একাধারে আমাদের বৈমাত্রেয় ভাই, আবার মাসতুতো ভাইও।’

এই কথাটা শূর্পণখা জানে। জানে না―জনস্থান-মধ্যবর্তী দণ্ডকারণ্যের এই প্রদেশটি কখন রাবণের অধিকারে এসেছে। এও জানত না যে খর রাবণের প্রতিনিধি-শাসক হিসেবে ওই দণ্ডকারণ্যে নিযুক্ত হয়েছে।

চৌদ্দ হাজার রাক্ষসসৈন্য নিয়ে খর দণ্ডাকারণ্য শাসন করে যাচ্ছিল। মহাবীর দূষণ তার সেনাপতি।

‘তুমি দণ্ডকারণ্যে চলে যাও।’

রাবণের কথা শুনে চমকাল শূর্পণখা। বলল, ‘কাকে বলছো ? আমাকে ?’

‘হ্যাঁ তোমাকেই বলছি। সেখানে তুমি সুখে থাকবে। গোটা প্রদেশটা আমি তোমার অধীন করে দিলাম। তোমার আদেশ খর ও দূষণ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।’

‘বলো কী দাদা! দণ্ডকারণ্য আমার অধীন করে দিলে! ওখানকার সকল অধিবাসী আমার প্রজা হবে ? আমি ওখানকার শাসক হব ?’ রাবণের অনুগ্রহে স্বামীশোক বিস্মৃত হতে থাকল শূর্পণখা।

রাবণ জানে, কোন কৌশলে শূর্পণখাকে কব্জা করা যাবে। জানে কীসে লোভাতুর হয়ে উঠবে শূর্পণখা। সম্পদ এবং ক্ষমতা মানুষের সকল দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। রাবণের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ল শূর্পণখা। ভাবতে লাগল―যে গেছে, তাকে তো আর ফিরে পাবে না! বিনিময়ে নগদ যা পাচ্ছে, তা হাত পেতে নিয়ে নেওয়া বুদ্ধিমানের কাজ। শূর্পণখা মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে বসল―দাদার এই দান সে গ্রহণ করবে। কিন্তু দাদাকে সে পুরোপুরি বিশ্বাস করে না। এখন হয়তো কলে আটকে গিয়ে নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে দাদা, সে কিছু সত্য কথা বলেছে বলে তার মুখ বন্ধ করবার জন্য দণ্ডকারণ্যের লোভ দেখাচ্ছে, কিন্তু সে শান্ত হয়ে গেলে ধুম করে মত পালটে ফেলবে। বলবে―তোমার দণ্ডকারণ্যে গিয়ে লাভ কী ? শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্য! স্থানে স্থানে বিপদ ওত পেতে আছে! রাক্ষস ছাড়াও সেখানে নানা হিংস্র জনজাতি বাস করে। ওরা সবাই তো আমার মিত্র নয়! ফলে আমার ক্ষতি করবার জন্য ওরা তোমার দিকে হাত বাড়াবে। দরকার কী ওরকম একটা ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে গিয়ে বাস করার ? তার চেয়ে তুমি একটা কাজ করো বোন, এই রাজপ্রাসাদের একটা কোণে বাস করতে থাকো। বিধবা মানুষ তুমি! তোমার চাহিদাই-বা কত ? যৎসামান্য যা লাগবে, তার ব্যবস্থা করে দিচ্ছি আমি। না না। রাবণদাদার কাছ থেকে পাকা প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিতে হবে। রাজসভার সকল সভাসদের সামনে দিব্যি দিয়ে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিতে হবে যে রাবণ দণ্ডকারণ্যের অধিকার আমাকে দিচ্ছে।

শূর্পণখা গলা উঁচিয়ে বলল, ‘তুমি ঠিক বলছো তো দাদা ? দণ্ডকারণ্য আমার হলো ? এই সভাসদদের সামনে তুমি স্পষ্ট করে স্বীকার যাও কথাটি।’

রাবণের কণ্ঠ এবার আবেগহীন, ‘শোনো শূর্পণখা, আমি লঙ্কাধিরাজ। শুধু তা-ই নয়, পৃথিবীর অনেক দেশ এখন আমার অধিকারে। সেই অধিরাজ সর্বসমক্ষে কথা দিচ্ছি―দণ্ডকারণ্যে তুমি সম্পূর্ণ স্বাধীন। তোমার আদেশে চলবে খর। সে এবং তার সেনাপতি দূষণ তোমার রক্ষাকার্যে সর্বদা নিয়োজিত থাকবে। ওখানে তোমার কোনও ভয় থাকবে না। আমি স্পষ্ট গলায় সবার সামনে বলছি―খর ও দূষণ তোমার আদেশ-নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে।’

রাবণের কথা শুনে তীব্র একটা ক্রোধের আভা শূর্পণখার চোখেমুখে ঝলকে উঠে ত্বরিত মিলিয়ে গেল। দ্রুত নিজেকে সামলে নিল শূর্পণখা। মনে মনে বলল―গরু মেরে আমাকে জুতা দান করলে দাদা! গরুর মর্যাদা আর মূল্য জুতার চেয়ে যে অনেক বেশি, একদিন তোমাকে বুঝিয়ে দেব আমি। এখন আমার শুধু অপেক্ষার পালা।

লোভী দৃষ্টিতে দাদার দিকে তাকিয়ে শূর্পণখা বলল, ‘তুমি মহান দাদা। একমাত্র তুমি বলেই বিধবা বোনটিকে আঁস্তাকুড়ে ছুড়ে দাওনি। তাকে যথাযোগ্য মর্যাদার স্থান দিচ্ছ, শুধু তুমি উদার বলে।’

দাদার উপহার-উপঢৌকনে শূর্পণখার মন থেকে যে স্বামী-হত্যার দুঃখ মুছে গেল, তা নয়। দাদার সামনে লোভীর অভিনয় করে গেল শুধু। শূর্পণখা দাদাকে বিশ্বাস করাতে সক্ষম হলো যে স্বামীর বিনিময়ে পদমর্যাদা পেয়ে সে খুবই আনন্দিত। খুশি খুশি চোখ দুটো দিয়ে শূর্পণখা রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকল।

রাবণ ধরে নিল, শূর্পণখা টোপ গিলেছে। শূর্পণখা আর কোনওদিন তার বিরুদ্ধে মুখ খুলবে না। আজ রাজসভায়, তারই মন্ত্রী-প্রধানমন্ত্রী-অমাত্যসকলের সামনে তাকে বড় অপমান করেছে শূর্পণখা! এরকম অপমানের মুখোমুখি আর কোনওদিন হয়নি সে! কেউ, সে দেবতা হোক বা রাক্ষস-দানব অথবা গন্ধর্ব-যক্ষ―কেউই তাকে অপমান করার দুঃসাহস দেখায়নি কোনওদিন। আজ নিজের সহোদরা হয়ে সেই অপমানটা করে গেল শূর্পণখা! অন্য কেউ হলে তখন তখনই হত্যা করার আদেশ দিত। কিন্তু বোন বলে শূর্পণখা বেঁচে গেল। তারপরও মাঝেমাঝে রাগ মাথায় চড়ছিল। মনে হচ্ছিল―এক চড়ে যমালয়ে পাঠিয়ে দেয় শূর্পণখাকে। তা করলে মস্ত বড় ভুল হয়ে যেত। প্রাসাদে তার শত্রু বেড়ে যেত। খোদ মা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতেন, ভাইয়েরা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠত, ভ্রাতৃবধূরা তার নিন্দামন্দ করত। আর প্রজাদের মধ্যেও ক্ষোভ দানা বাঁধত। সেনাবাহিনীতেও বিদ্রোহের সম্ভাবনা দেখা দিত। বিচক্ষণ বলে শূর্পণখার সকল অপমান সহ্য করে গেছে রাবণ। বাইরে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করেছে। দুঃখী দুঃখী চেহারা করে বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে গেছে।

শূর্পণখাকে সান্ত্বনা দিতে দিতে রাবণ স্থির করেছে―স্পষ্টভাষী শূর্পণখাকে লঙ্কার প্রাসাদে রাখা যাবে না। তার কূটকৌশলের অনেক কিছু জেনে ফেলেছে সে। বিশেষ করে কুম্ভকর্ণ-বিষয়ে অতি গোপন কথাটি কী করে শূর্পণখা জেনে গেল, কে জানে ? তাকে রাজপ্রাসাদে ঠাঁই দিলে খুঁচিয়ে আরও অনেক তথ্য বের করে নেবে সে। বিভীষণকে উসকাবে, তার কুটিলতার কথা জানিয়ে দিয়ে তার বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত করে তুলবে বিভীষণকে। আর মা কৈকসী তো ভীষণ ভালোবাসেন শূর্পণখাকে! সর্বদা তারই পক্ষ নেবেন তার মা। শূর্পণখা কোন সময় মন্দোদরীর মন তার বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলে তার ঠিক নেই। না না, শূর্পণখাকে প্রাসাদের বাইরে নিক্ষেপ করতে হবে। কিন্তু কোথায় পাঠাবে ? বোনের সঙ্গে কথোপকথনে রত রাবণের হঠাৎ করেই দণ্ডকারণ্যের কথা মনে পড়ে গেল। হ্যাঁ, দণ্ডকারণ্যেই পাঠাতে হবে শূর্পণখাকে। ওখানে পাঠালেই জব্দ হবে সে। নগরবিচ্ছিন্ন, সভ্যতাবিযুক্ত, অরণ্যময় শ্বাপদসংকুল ওই দণ্ডাকারণ্যে পাঠালে কোণঠাসা হয়ে পড়বে শূর্পণখা। লঙ্কাপুরী থেকে ওই অঞ্চলটা এত দূরে যে  প্রাসাদীয় কোনও সংবাদ তার কাছে সহজে পৌঁছাবে না। কিন্তু দণ্ডাকারণ্যে যাওয়ার প্রস্তাবটা দেয় কী করে রাবণ ? শূর্পণখা বড় বিচক্ষণ। সরাসরি প্রস্তাব দিলে বুঝে ফেলবে। তৎক্ষণাৎ যেতে অস্বীকার করে বসবে। তাছাড়া এই রাজসভা মন্ত্রী-অমাত্যে ভর্তি। তারাও তো তার কুটিলতার কথা ধরে ফেলবে। নাহ্! একেবারে সরাসরি দণ্ডাকারণ্যে যাওয়ার প্রস্তাব দেবে না শূর্পণখাকে। সঙ্গে অন্য কিছু একটা মিশাতে হবে।

রাবণ দণ্ডকারণ্যের সঙ্গে মর্যাদার প্রস্তাব দিল, সর্বময় ক্ষমতার প্রস্তাব দিল। বলল―গোটা দণ্ডকারণ্যটা আমি তোমার অধীন করে দিলাম। ক্ষমতা আর মর্যাদার প্রলোভন কে অস্বীকার করতে পারে ? শূর্পণখাও অস্বীকার করতে পারল না। বরং সানন্দে রাবণের প্রস্তাব লুফে নিল। কিন্তু এই লুফে নেওয়ার পেছনে যে প্রবল এক প্রতিশোধস্পৃহা সক্রিয়, রাবণকে বুঝতে দিল না শূর্পণখা।

অবিলম্বে শূর্পণখাকে দণ্ডকারণ্যে যাত্রা করিয়ে দিল রাবণ।

বসবাসের জন্য এই দণ্ডকারণ্য অতীব মনোরম এক স্থান। এই অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষ অনার্য জনগোষ্ঠীর।

নর্মদা ও গোদাবরী নদীর মধ্যবর্তী বিশাল এক ভূখণ্ড জুড়ে দণ্ডকারণ্যের বিস্তৃতি। বিন্ধ্য ও ঋক পর্বতের পাদদেশের এই স্থানটির রাজা ছিল দণ্ড নামের একজন। বেশ ঐশ্বর্যময় নগরী ছিল দণ্ডরাজার রাজধানী। রাজা দণ্ড একদিন মস্ত বড় এক অপরাধ করে বসল।  শুক্রাচার্যের কন্যা অরজাকে ধর্ষণ করল দণ্ড। শুক্রাচার্যের অভিশাপে দণ্ডরাজার রাজ্য দগ্ধ হয়ে গেল। পরে জনপদটি অরণ্যে পর্যবসিত হলো। দগ্ধ ভূখণ্ডটির নাম হয়ে গেল দণ্ডকারণ্য। বহু তপস্বী দণ্ডকারণ্যে বসবাস করা শুরু করলেন। পরবর্তীকালে এই অঞ্চলটি জনস্থান নামে পরিচিতি পেল।

অরণ্যের শোভা দেখে ভীষণ উৎফুল্ল হয়ে উঠল শূর্পণখা। এর এক দিকে গভীর হরিৎ অরণ্যানী, অন্যদিকে গোদাবরীর জলোচ্ছ্বাস। এই শোভা মনের বাতাবরণটাই পালটে দিল শূর্পণখার। ধীরে ধীরে মন থেকে বেদনার কালো মেঘ সরে যেতে থাকল। এক ধরনের উতল হাওয়া তার হৃদয়ে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

যেদিন এসেছিল শূর্পণখা এখানে, সাদরে স্বাগত জানিয়েছিল খর আর দূষণে। বয়সে শূর্পণখা খরের জ্যেষ্ঠা। পাদ্য-অর্ঘ্য এগিয়ে ধরেছিল খর দিদির দিকে। তার আগে রাবণের কড়া নির্দেশ পৌঁছে গিয়েছিল খরের কাছে―কোনওভাবেই যাতে শূর্পণখার মর্যাদা ক্ষুণ্ন না হয় দণ্ডকারণ্যে।

বড় সন্তুষ্ট হয়েছিল শূর্পণখা। আবাসন দেখে, নিরাপত্তার ব্যবস্থা দেখে মনে মনে রাবণকে ধন্যবাদ না দিয়ে পারেনি।

ভগিনীর মানসিক গঠন জানত রাবণ। অনুকূল বাতাবরণ পেলে প্রকৃতির উদার সান্নিধ্যে শূর্পণখার মন আনন্দে ভরে উঠবে। আনন্দমগ্ন মানুষ সহসাই অতীত ভোলে। শূর্পণখার ক্ষেত্রেও তা-ই হলো। কিছু সময়ের জন্য সে স্বামীস্মৃতি বিস্মৃত হলো।

তখন শূর্পণখার ভরাযৌবন। প্রাকৃতিক রমণীয়তা সেই যৌবনে আবেগ আনল। তার মন অস্থির হলো। দেহ চঞ্চল হয়ে উঠল। পুরুষস্বাদ-পাওয়া যৌবন শূর্পণখার। বিদ্যুদ্জিহ্বের দেহসান্নিধ্যের নানা স্মৃতি তার মানসপটে ভিড় করল। দিনটা যেভাবেই কাটুক, রাতটা কাটতে চায় না শূর্পণখার। দুগ্ধফেননিভ শয্যায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করে। ঘুম আসে না, সম্ভোগের নানা চিত্র তার চোখের সামনে ভেসে বেড়ায়। ছটফট করতে থাকে সে। উঠে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। বাইরে তখন জোছনার প্লাবন। জ্যোৎস্নালোক তাকে শান্ত করে না, উতলা করে। সম্ভোগ-ইচ্ছা আরও তীব্র হয়ে ওঠে তার দেহমনে। পাশে রাখা পাত্র থেকে ঢক ঢক করে জল খায় শূর্পণখা। এই জল তার মনকে শান্ত করতে পারে না। বিধবা শূর্পণখার ব্যাকুল দেহ রাক্ষসীর ক্ষুধা নিয়ে কাউকে কাছে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

প্রতিদিন সকালে বেরিয়ে পড়ে শূর্পণখা। বনে-প্রস্রবণে, পাহাড়ে-উপত্যকায় ঘুরে বেড়ায়। ফুল দেখে, পাখি দেখে। হরিণশাবক নিয়ে খেলা করে। কখনও কখনও জনবসতিতে ঢুকে পড়ে। তাকে দেখে সসম্ভ্রমে দূরে সরে দাঁড়ায় জনজাতির মানুষেরা। এর মধ্যে তারা জেনে গেছে―এই নারী আর কেউ নয়, তাদেরই নৃপতি লঙ্কাধিরাজ রাবণের সহোদরা। আরও গভীরের সংবাদ যারা রাখে, জানে―জনস্থানের বর্তমান অধিকর্ত্রী এই নারীটি। রাজা রাবণ তার বোনকে গোটা দণ্ডকারণ্য দান করে দিয়েছে।

প্রজাদের আনুগত্য শূর্পণখাকে উৎফুল্ল করে। বেশ খুশি মনে রাজ-আবাসনে ফিরে আসে রাবণভগিনী।

খর জিজ্ঞেস করে, ‘কেমন লাগছে দিদি এই দণ্ডকারণ্য ?’

শূর্পণখা বলে, ‘সত্য বলি ভাই তোমাকে―দাদা যখন এখানে এসে থাকবার জন্য প্রস্তাব দিল, ভালো লাগেনি আমার। রাজপ্রাসাদের মেয়ে আমি। তাকে প্রস্তাব দিল গহিন অরণ্যে জীবনযাপনের! দাদার প্রস্তাবে দুঃখ পেয়েছিলাম খুব।’

‘এখনও কি সেই দুঃখ আছে দিদি ?’ মিষ্টি হাসি মুখে ছড়িয়ে জানতে চাইল খর।

‘না না! তা হবে কেন ? আমার মনে এখন কোনও দুঃখ নেই। বরং রাজপ্রাসাদের কুটিলতা থেকে সরে এখানে আসতে পেরে বেশ ভালো লাগছে আমার।’

‘তাহলে তো লঙ্কাপতি ভুল করেননি তোমাকে এখানে পাঠিয়ে ?’ বলল খর।

‘কী কেড়ে নিয়ে কী যে দিল দাদা আমাকে, বুঝে উঠতে পারছি না ভাই! বিদ্যুদ্জিহ্বের কথা বড্ড মনে পড়ে রে খর! তার সান্নিধ্যের স্মৃতি এখনও আমাকে ব্যাকুল করে তোলে!’ মনে মনে এই কথাগুলো আওড়ে যায় শূর্পণখা।

খরের প্রশ্নের উত্তর দেয় না, চুপ করে থাকে।

চৌদ্দ

লঙ্কাপুরীর রাজমাতা কৈকসী।

প্রবহমান প্রথানুযায়ী রাজপ্রাসাদের অন্দরমহল কৈকসী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কথা। কিন্তু বর্তমানে কৈকসীর বয়স হয়ে গেছে অনেক। চিন্তাশক্তি যথাযথ থাকলেও নানা ব্যাধি তাঁর দেহে বাসা বেঁধেছে। ফলে তাঁর কর্মক্ষমতা অনেকটাই হ্রাস পেয়ে গেছে এখন।

মন্দোদরীকে বড় ভালোবাসেন কৈকসী। নিজে বিয়ে করে রাবণ মন্দোদরীকে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এলে বেশ মনঃক্ষুণ্ন হয়েছিলেন রাজমাতা। রাবণের জন্য বউ তো তাঁরই নির্বাচন করার কথা! রাবণ তাঁর সেই বাসনায় ঠান্ডা জল ঢেলেছে। মন্দোদরীকে মন থেকে স্বাগত জানাননি সেদিন।

কিন্তু যত দিন গেছে, মন্দোদরীর আচরণে মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। পুত্রবধূকে বুকের মাঝখানে টেনে নিয়েছেন। তার অন্য দুই পুত্রের বউ―বজ্রজ্বালা আর সুরমা―এরাও খুব ভালো। কিন্তু মন্দোদরী তাদের চেয়েও ভালো। বেশ কিছুদিন ধরে গভীর অভিনিবেশ সহকারে মন্দোদরীকে লক্ষ করে গেছেন কৈকসী। একটা সময়ে মনে হয়েছে―তাঁর এই বড় বউটি অন্দরমহল পরিচালনা করতে পারবে। কারণ তার ব্যক্তিত্ব আছে, নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা আছে।

একদিন অন্দরমহলের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিলেন তিনি মন্দোদরীকে। মন্দোদরীর হাতে পড়ে রাজ-অন্তঃপুর আরও সুশৃঙ্খল ও সুনিয়ন্ত্রিত হলো।

মন্দোদরী শিল্পীর মেয়ে। বিশ্বকর্মা যেমন দেবশিল্পী, ময়দানবও তেমনি দৈত্যদানবের শিল্পী। ভুবনব্যাপী খ্যাতি ময়দানবের। পিতার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে বড় হয়ে উঠেছিল মন্দোদরী। মন্দোদরীর মনের গড়নও ছিল শিল্পিত। সহনশীলতা তার চরিত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল। সে ছিল স্বামী-অনুরাগী। পরবর্তীকালে রাবণ বহুচারী হয়ে উঠলেও স্বামীনিষ্ঠতা একচুলও কমেনি মন্দোদরীর।

রাবণের পরনারীলোভ যতই থাকুক, মন্দোদরীকে মর্যাদা দিত খুব। অপ্সরাতুল্য সুন্দরী মন্দোদরী সর্বদা রাবণের কাছে প্রধান মহিষীর মর্যাদা পেয়ে এসেছে। রাজপ্রাসাদে এবং রাবণের কাছে মন্দোদরীর মর্যাদা আরও বেড়ে গেল, যখন সে মেঘনাদের মতো এক মহাবীরের জন্ম দিল।

তার পরও মন্দোদরী সৌভাগ্যবতী ছিল না। তার দুর্ভাগ্যের জন্য দায়ী স্বয়ং রাবণ।

ক্ষমতাধর মানুষের কোনও না কোনও চরিত্রদোষ থাকেই থাকে। এই দোষে ওই মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে। এরপরও ক্ষমতাবান মানুষটি সতর্ক হয় না। দিনে দিনে আরও বেপরোয়া হয়ে ওঠে। রাবণ বিপুল ক্ষমতার অধিকারী। কালে কালে তার চরিত্রে নারীলোলুপতা স্পষ্ট হলো। পরনারী-রিরংসু হয়ে উঠল সে। নারীভোগের ব্যাপারে রাবণ হিতাহিতজ্ঞানশূন্য।

প্রবল পরাক্রমে রাবণ সুরলোক, যমলোক জয় করেছে, স্বর্গ-মর্ত্য-পাতাল মথিত করেছে। যখন যে-রাজ্য তার পদানত হয়েছে, সে-রাজ্যের ধনসম্পদ লুণ্ঠন করেছে। আর লুণ্ঠন করেছে সে দেশের যুবতী সুন্দরী নারীদের। সেই নারী রাক্ষসী হোক, দানবী হোক, গন্ধর্বী বা যক্ষী―যেই হোক না কেন, রাবণ তাকে হরণ করেছেই করেছে। দেবকন্যাদের প্রতি তার লোভ ছিল প্রবল। বিবাহিতা-অবিবাহিতা স্ত্রী-কন্যাদের পুষ্পকরথে তুলে লঙ্কায় নিয়ে এসেছে রাবণ। এই নারীরা তার ভোগ-সম্ভোগের উপকরণ হয়েছে। রাবণ ওইসব অপহরিত রমণীদ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতে পছন্দ করত। এই নারীদের অনেকেই রাবণের কামনায় বশীভূত হয়েছে। তারা স্বেচ্ছায় রাবণের সঙ্গে সুখসম্ভোগে অংশ নিয়েছে। আবার অনেকে তার বীরত্বে ও সৌন্দর্যে অভিভূত হয়নি। রাবণ-মিলনে তারা অস্বীকৃতি জানিয়ে রেহাই পায়নি। জোর করে তাদের শরীরের সঙ্গে শরীর মিশিয়েছে রাবণ। সেই নারীদের আর্তনাদে আকাশ-বাতাস আন্দোলিত হয়েছে। রক্ষিতালয়ের দেয়ালে মাথা কোটে তারা। তারপরও রাবণের রমণেচ্ছা মিটাতে বাধ্য হয় সেই রমণীরা।

অপহরিত এই নারীদের আর্তচিৎকার আর অভিশাপকথা মন্দোদরীর কানে আসে। মন্দোদরী বুঝে গেছে―এই মত্ততা থেকে রাবণকে কিছুতেই ফেরানো যাবে না। ঘরের নারীটি রূপসী যৌবনবতী হলেও পরনারীতে পুরুষের  আকর্ষণ দুর্নিবার। অধরা, অস্পর্শিত নারী পুরুষের কাছে বিপুল রহস্যের আধার বলে বিবেচিত হয়। সেই রহস্য উন্মোচনে পুরুষের আগ্রহের অন্ত থাকে না। রাবণের ক্ষেত্রেও তা-ই হয়েছে। প্রাসাদে শ্রীময়ী মন্দোদরীকে রেখে হেরেমের দিকে ছুটে গেছে বারবার। প্রতিদিন নতুন নতুন নারীতে নৌকা ভাসিয়েছে রাবণ।

এত কিছুর পরও মন্দোদরী স্বামীনিষ্ঠ থেকে গেছে। স্বামীর অপকর্ম নীরবে সয়ে গেছে। গুমরে মরেছে সে। কিন্তু সেই মর্মবেদনা বাইরে প্রকাশ করেনি কখনও। স্বাভিমান নিজের মধ্যে গুপ্ত রেখেছে। রাবণের অন্যাসক্তি মন্দোদরীকে ক্রুদ্ধ করেছে, কিন্তু মন্দোদরী আশ্চর্য সংযমবলে সেই ক্রোধকে জনসমক্ষে প্রকাশ করেনি।

স্বামীর লাম্পট্য নিজের বৈদগ্ধ্য দিয়ে ম্লান করে দিয়েছে মন্দোদরী। মন্দোদরী কখনও শাশুড়ির প্রতি অবহেলা দেখায়নি। কৈকসীকে যথাযোগ্য মর্যাদা প্রদর্শন করে গেছে। তার ব্যক্তিত্বে আর স্নেহে মুগ্ধ হয়েছে বজ্রজ্বালা আর সরমা। সাধারণত একই পরিবারভুক্ত ভ্রাতৃবধূদের মধ্যে রেষারেষি থাকে। নানা স্বার্থ নিয়ে এরা ঝঞ্ঝাটে জড়িয়ে পড়ে। কৈকসীর  পুত্রবধূদের মধ্যে এরকম কোনও আক্রোশ-ঈর্ষা নেই। মন্দোদরীর কারণেই রাবণের অন্তঃপুরে নারীকলহমুক্ত। দুই জা-কে সে নিজের বোনের অধিক স্নেহ করেছে। স্নেহ-ভালোবাসায় যে কোনো মানুষকে বশ করা যায়। বজ্রজ্বালা এবং সরমা মন্দোদরীর বশীভূত।

এতকিছুর পরও মন্দোদরীর হৃদয় ভেঙ্গে চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে। রাবণের পরনারীভোগের বৃত্তান্ত যতই তার কাছে এসেছে, ততই কুঁকড়ে গেছে মন্দোদরী। অপমানে-লজ্জায় মুখ লুকানোর জায়গা খুঁজে ফিরেছে।

অপহৃতা নারীতে তৃপ্ত থাকেনি রাবণ। তার কামুকতা এমন যে যেখানেই সুন্দরী নারীর সাক্ষাৎ পেয়েছে, ধর্ষণে উদ্যত হয়েছে। যেমন বেদবতী।

বেদবতী বৃহস্পতির পুত্র ব্রহ্মর্ষি কুশধ্বজের কন্যা। কুশধ্বজ বেদপাঠ বিশেষজ্ঞ ছিলেন। বেদের প্রতি ছিল তাঁর পরম ভালোবাসা। কন্যা জন্মালে তাই কন্যার নাম রাখেন বেদবতী।

বেদবতী যৌবনবতী হয়ে উঠলে হিমালয়ের নিকটে এক বনে গিয়ে কঠোর তপস্যায় রত হয়। রাবণ একদিন ঘুরতে ঘুরতে ওই বনে উপস্থিত হলে বেদবতীকে দেখতে পায়। মুগ্ধ হয় রাবণ। বেদবতীর জন্য তার দেহ চঞ্চল হয়ে ওঠে। বেদবতীকে পাওয়ার জন্য জোর খাটাল না রাবণ। বশ করতে চাইল বেদবতীকে।

ধীর পায়ে বেদবতীর নিকটে গিয়ে বলল, ‘তুমি কে রূপময়ী ? তোমার রূপে যে বনের এই অন্ধকার দিকটা আলোময় হয়ে উঠেছে!’

চমকে রাবণের মুখের দিকে তাকাল বেদবতী। রাবণের মনোভাব বুঝতে পেরেও নিরীহ কণ্ঠে নিজের পরিচয় দিল।

চোখ দিয়ে বেদবতীর দেহ লেহন করতে করতে রাবণ বলল, ‘এই কঠোর তপস্যা তোমার মতো উদ্ভিন্নযৌবনাকে মানায় না বেদবতী। কেন শুধু শুধু এরকম কঠিন তপস্যা করে যাচ্ছ তুমি ?’ রাবণের বলার ভঙ্গিতে পরিহাসের স্পর্শ।

কণ্ঠকে আরও কোমল করে চোখকে রুক্ষ করে বেগবতী বলল, ‘শুনুন রাজা, আমি আপনাকে চিনি না, তবে দেখতে আপনাকে রাজার মতো লাগছে বলে রাজা সম্বোধন করলাম। আমার বাবার উদ্দেশ্য ছিল বিষ্ণুকে জামাতা করার। দেবতা-গন্ধর্ব-যক্ষ-রাক্ষস জাতির অনেকেই আমার পাণিপ্রার্থনা করেছে। বাবা সবাইকে ফিরিয়েছে। দৈত্যরাজ শম্ভু এই প্রত্যাখ্যান মেনে নেয়নি। আমার পিতাকে হত্যা করেছে সে। মা বাবার সঙ্গে সহমৃতা হয়েছে। পিতার বাসনা পূরণের জন্য সেই থেকে আমি তপস্যায় রত। যে করেই হোক, বিষ্ণুকে তুষ্ট করে তাঁকে বিয়ে করবই আমি।’

রাবণ তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘আরে থামো থামো! এক নিশ্বাসে অনেক কথা বলে গেলে তুমি! এখন আমার কথা শোনো। এসব কৃচ্ছ্রসাধন তো বুড়োদেরই সাজে! তোমার মতো রূপসী যুবতীর পক্ষে তপস্যা শোভা পায় না। তুমি যে-বিষ্ণুর কথা বলছো, তার চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয় আমি। আমি লঙ্কার রাজা দশানন। তুমি আমার পত্নী হও। মহাসুখে রাখব আমি তোমাকে।’

রেগে গেল বেদবতী। একদলা থুতু মাটিতে থু করে ফেলে বলল, ‘তুমি যে-বিষ্ণুকে হেয় চোখে দেখছো, তিনি বহু গুণে গুণান্বিত একজন পুরুষ। একমাত্র তিনিই আমার উপযুক্ত। তুমি নও। একজন রাক্ষস কখনও আমার স্বামী হতে পারে না।’

বেদবতীর কথা শুনে রাবণ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল, ‘ঘাস-পাতা খাওয়া একজন ঋষিকন্যার এত বড় স্পর্ধা! তুমি আমাকে অপমান করছো! অবহেলা দেখাচ্ছ আমাকে! দাঁড়াও গুমর ভাঙছি আমি তোমার।’ বলে বেদবতীর দিকে ধেয়ে গেল রাবণ। বেদবতীকে ঝাপটে ধরতে গিয়ে তার দীর্ঘ খোলা চুল রাবণের নাগালে এল। মুঠি করে সেই চুল ধরে রাবণ নিজের দিকে বেদবতীকে আকর্ষণ করতে থাকল।

বজ্রকঠিন চেহারা করে এক ঝটকায় রাবণের হাত থেকে নিজের কেশ ছাড়িয়ে নিল বেদবতী। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলল, ‘আমার এই পবিত্র কেশদাম স্পর্শ করলে তুমি রাক্ষস! অপবিত্র করলে তুমি আমাকে! যে চুল তুমি স্পর্শ করেছো, সেই চুলের কী হাল করি তুমি দেখো।’ এই বলে নিজের হাতেই চুলগুলি ছিঁড়তে শুরু করল বেদবতী। বেদবতীর তখন মনে হলো, রাবণ তার কেশ স্পর্শ করেনি, তাকে ধর্ষণও করেছে। দীর্ঘ কোঁকড়ানো চুল তৎক্ষণাৎ কেটে ফেলল বেদবতী। এর পরও নিজের দেহকে বড় অপবিত্র অপবিত্র ঠেকল তার কাছে। রাবণের সামনেই প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ডে আত্মাহুতি দিল বেদবতী।

অগ্নিতে ঝাঁপ দেওয়ার আগে রাবণের উদ্দেশে বলল, ‘মরার আগে আমি তোকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছি কামাতুর রাক্ষস, আমার মতো একজন পবিত্র নারীর কারণেই তোর মৃত্যু হবে একদিন এবং নারীলিপ্সাই তোকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেবে।’

কোনও ভাবান্তর ঘটেনি সেদিন রাবণের। স্বচ্ছন্দে সে প্রাসাদে ফিরে এসেছে। কামুকতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে দশাননের। তার চাই নতুন নারী, আনকোরা রূপসী যুবতী নারী। যখনই তার রমণেচ্ছা প্রবল হয়েছে, প্রাসাদ থেকে একা বেরিয়ে গেছে। এই অবস্থায় একদিন রম্ভার ওপর চড়াও হয়েছে রাবণ।

রম্ভা এক স্বর্গসুন্দরী। দেবতাদের অঙ্কশায়িনীও সে। দেবতাদের মনোরঞ্জন ও দেহতুষ্টি প্রদান অপ্সরাদের কাজ। দেবতাদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠলে পৃথিবীতে অভিসারে আসে ওরা। রম্ভাও একদিন মর্ত্যধামে এল। কুবেরপুত্র নলকুবেরকে দেখে মুগ্ধ হলো রম্ভা।

একদিন নলকুবেরের কাছে যাওয়ার সময় রাবণের সামনে পড়ে গেল রম্ভা। আরে এত সুন্দর যুবতী! কে এ ? তাকে তো আগে দেখিনি কখনও! দ্রুত রম্ভার নিকটে এগিয়ে গেল রাবণ। রম্ভার শরীর তখন সামান্য বস্ত্রে ঢাকা। তার স্তন, তার নিতম্ব, জঘন―সবই স্পষ্ট দৃশ্যমান। রাবণ রম্ভার স্তন-জঘনের প্রশংসা করে বলল, ‘কী অপরূপ দেহলাবণ্য তোমার রমণী! তোমার বর্তুলাকার স্তন, গভীর নাভি আমার মধ্যে মাদকতার জন্ম দিয়েছে।’

রম্ভা রাবণকে চিনত। সে জানত―এই দশানন কুবেরের ছোট ভাই। দুই মা হলেও পিতা একজন তাদের। সে যে কুবেরপুত্র নলকুবেরে আসক্ত! তার সঙ্গে সম্মিলনে যাচ্ছে সে। সম্পর্কে রাবণ নলকুবেরের পিতৃব্য। সেই সুবাদে রাবণ রম্ভার খুড়শ্বশুর।

সেই কথাই বলল রম্ভা রাবণকে, ‘আপনাকে আমি চিনি দশানন। আমি আপনার ভাইপো নলকুবেরকে ভালোবাসি। তার সঙ্গলিপ্সু আমি। তাই তার কাছে যাচ্ছি।’

‘তার আগে আমার লিপ্সা মিটিয়ে যাও তুমি।’ কামান্ধ রাবণের হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত তখন।

‘এ কী বলছেন আপনি! আমি যে আপনার পুত্রবধূর সমতুল্য!’

রম্ভার সকল অনুনয়-বাধাকে অগ্রাহ্য করেছে রাবণ। জোর করে রম্ভাকে কোলে তুলে নিয়েছে।

প্রথম দিকে আছাড়ি-পিছাড়ি করলেও রম্ভা রাবণের গায়ের জোরের কাছে পরাস্ত হয়েছে।

ধর্ষিতা রম্ভা নলকুবেরের কাছে উপস্থিত হয়ে সব বৃত্তান্ত জানালে ক্ষোভে-দুঃখে উন্মত্ত হয়ে উঠেছে নলকুবের।

আকাশের দিকে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে বলেছে, ‘একদিন তুই ধ্বংস হয়ে যাবি দশানন। এই নারীর জন্যই তুই মরবি একদিন।’

পনেরো

শূর্পণখা দণ্ডকারণ্যে ঘুরতে ঘুরতে একদিন এমন একজনকে দেখতে পেল, যে তার বিধবামনের রুদ্ধ দরজা খুলে দিল।

সে-জন আর কেউ নয়, রাজা দশরথপুত্র রামচন্দ্র।

কোশলরাজ্যের রাজা দশরথ। তাঁর রাজধানীর নাম―অযোধ্যা। অযোধ্যা দুর্ভেদ্য এক নগরী। অযোধ্যারাজ দশরথ ছিলেন শত্রুমুক্ত। পার্শ্ববর্তী সকল রাজার সঙ্গে তার সুসম্পর্ক ছিল। তাঁর শাসনে সমগ্র কোশলরাজ্যের বিপুল শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছিল। প্রজাদের সুখ ও স্বস্তির অন্ত ছিল না। প্রজাদের মনে দুঃখ-বিক্ষোভ তৈরি করার মতো স্বৈরশাসক ছিলেন না রাজা দশরথ। তাঁর মন্ত্রীরা ছিলেন জ্ঞানী এবং সুপরামর্শক। প্রজারা সর্বদা তাঁর গুণকীর্তন করত।

এই রকম একজন রাজার মনে স্বস্তি ছিল না। কারণ তিনি ছিলেন অপুত্রক। একজন রাজার জন্য পুত্র যে কত প্রয়োজনীয়, তা দশরথ ভালো করেই জানতেন।

তিন তিনজন মহিষী ছিলেন তাঁর―কৌশল্যা, সুমিত্রা এবং কৈকেয়ী। তিনজনই রাজকন্যা, তিনজনই অভিজাত। যৌবনবতী এবং অপরূপ সুন্দরী তাঁরা। এছাড়া সাড়ে তিনশ উপপত্নীও ছিলেন দশরথের। এই তিনশ তিপ্পান্ন জনের কেউই দশরথকে কোনও পুত্রসন্তান উপহার দিতে পারেননি।

যত দিন গেছে, অস্থির হয়ে উঠেছেন রাজা।

রাজা দশরথের শান্তা নামের এক কন্যা ছিল। ওই সাড়ে তিনশ উপপত্নীর যে কোনো একজনের গর্ভজাত সে। এই কন্যাতে তেমন তৃপ্ত ছিলেন না অযোধ্যাধিপতি। উপপত্নীর গর্ভে জন্ম বলে শান্তার কোনও জন্ম-উৎসব করেননি রাজা। সিংহাসন রক্ষার জন্য, রঘুবংশ বিস্তৃত করবার জন্য তাঁর চাই―পুত্র।

এই কন্যাটির প্রতি তেমন যত্নবান ছিলেন না দশরথ। তাই নিঃসন্তান বন্ধু রোমপাদ যে-মুহূর্তে শান্তাকে দত্তক চাইলেন, সেই মুহূর্তেই দশরথ শান্তাকে রোমপাদের হাতে তুলে দিলেন।

রোমপাদ পরম যত্নে বড় করে তুলেছিলেন শান্তাকে। বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠলে শান্তাকে ঋষি বিভাণ্ডকের পুত্র ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন পালকপিতা রোমপাদ। হরিণীগর্ভে জন্ম ঋষ্যশৃঙ্গের। হরিণীর গর্ভজাত পুত্রটির মাথায়, জন্মানোর পর, একটি শৃঙ্গ দেখা গেল। ঋষ্যশৃঙ্গ কৌশিকী নদীর তীরে বিভাণ্ডকের আশ্রমে একবারে নিঃসঙ্গভাবে প্রতিপালিত হন। তপস্যা ও বেদপাঠে তাঁর জীবন কাটে। দেহসুখ ও নারী সম্বন্ধে একেবারেই অনভিজ্ঞ ছিলেন তিনি।

একবার রোমপাদের রাজ্য অঙ্গদেশে অনাবৃষ্টি দেখা দেয়। ফলে ফসল উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। দেশে দুর্ভিক্ষ  দেখা দিলে কুলপুরোহিতের শরণাপন্ন হন রাজা রোমপাদ। কুলপুরোহিত বলেন, ঋষ্যশৃঙ্গকে কোনওভাবে এদেশে আনতে পারলেই বৃষ্টি হবে, খরা কেটে যাবে।

বিভাণ্ডকের অনুপস্থিতিতে একদল বারাঙ্গনাকে ঋষ্যশৃঙ্গের কাছে পাঠালেন রোমপাদ। বারাঙ্গনারা মোহিত ও প্রলুব্ধ করে ঋষ্যশৃঙ্গকে তপাশ্রম থেকে অঙ্গরাজ্যে নিয়ে আসে। ঋষ্যশৃঙ্গ অঙ্গরাজ্যে প্রবেশ করামাত্র প্রচুর বৃষ্টিপাত শুরু হয়। রোমপাদ পরম যত্নে ঋষ্যশৃঙ্গকে পাদ্য-অর্ঘ্য দিয়ে সম্ভাষণ জানান। শুধু তা-ই নয়, কন্যা শান্তার সঙ্গে ঋষ্যশৃঙ্গের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। বিয়ের পর শ্বশুরদেশ অঙ্গরাজ্যে বসবাস করতে থাকেন ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গ।

রাজা দশরথের পুত্রলাভের ব্যাকুলতা দেখে সুমন্ত্র-সারথি অশ্বমেধ এবং পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করার পরামর্শ দেন রাজাকে। সুমন্ত্র রাজা দশরথের রথচালক শুধু নন, রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীও। পরম হিতৈষী সুমন্ত্রের কথা শুনে দশরথ বেশ উৎসাহিত হয়ে ওঠেন।

জিজ্ঞেস করলেন, ‘কীভাবে এ যজ্ঞ করা যায় ?’

সুমন্ত্র সারথি হলে কী হবে, তিনি রাজার সমবয়সী। তাঁর বিচক্ষণতাকে শ্রদ্ধা করেন দশরথ।

উত্তরে সুমন্ত্র বললেন, ‘উপায় একটা আছে মহারাজ। তবে তা বেশ দুঃসাধ্য।’

‘যতই দুঃসাধ্য হোক, পুত্রলাভের জন্য সে কাজ আমি করবই করব সুমন্ত্র। উপায় বল।’

‘পুত্রেষ্টি যজ্ঞ যদি বিভাণ্ডকপুত্র ঋষ্যশৃঙ্গকে দিয়ে করাতে পারেন, তাহলে আপনার পুত্রলাভ অবশ্যম্ভাবী।’

এবার রাজা হতাশ কণ্ঠে বললেন, ‘তাঁকে কী করে অযোধ্যায় আনি বলো তো! ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে যে আমার কোনও পরিচয় নেই!’

হেসে দিলেন সুমন্ত্র, ‘তিনি অঙ্গদেশেই আছেন এখন।’

‘রোমপাদের রাজ্যে ?’

‘হ্যাঁ, তাঁর জামাতা হয়েই ঋষি অঙ্গরাজ্যে বসবাস করে যাচ্ছেন।’

‘জামাতা হয়ে বসবাস করছেন। দাঁড়াও, দাঁড়াও সুমন্ত্র! আমাকে একটু ভাবতে দাও।’

‘আর ভাবাভাবির দরকার নেই মহারাজ।’ সারথি হলেও সখার মতো কথা বলেন সুমন্ত্র, রাজার সঙ্গে। ‘যে কন্যাটিকে হেলায় বন্ধু রোমপাদের হাতে তুলে দিয়েছিলেন, সেই শান্তাকে বিয়ে করেছেন ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গ। এখন তিনি আপনারও জামাতা। ঋষিকে কোনওভাবে অযোধ্যায় নিয়ে আসুন। পুত্রেষ্টি যজ্ঞের পৌরহিত্য করার জন্য অনুরোধ করুন।’

কুলপুরোহিত বশিষ্ঠের পরামর্শে একদিন রাজা দশরথ সপারিষদে অঙ্গরাজ্যে উপস্থিত হলেন। রোমপাদ বন্ধুকে আতিথেয়তা-অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রাসাদাভ্যন্তরে নিয়ে গেলেন।

দশরথ বন্ধুকে মনের দুঃখকথা খুলে বললেন এবং বললেন ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গকে সঙ্গে করে নিয়ে যেতে এসেছেন তিনি।

রোমপাদ ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে দেখা করে বললেন, ‘বাবা, আমি যেমন তোমার শ্বশুর, ইনিও তোমার শ্বশুর। রাজা দশরথ আসল শ্বশুর তোমার। আমি নিঃসন্তান ছিলাম। এই দশরথই তার একমাত্র সন্তানকে আমার হাতে তুলে দিয়েছিল। তুমি এর মনস্কামনা পূরণ করো বাবা।’

সম্মত হলেন ঋষি ঋষ্যশৃঙ্গ।

রাজা দশরথ রাজধানী অযোধ্যায় ফিরে এলেন।

একদিন সস্ত্রীক ঋষ্যশৃঙ্গ এসে পৌঁছালেন অযোধ্যায়। রাজঅন্তঃপুরে কন্যা এবং জামাতার থাকার সুব্যবস্থা করে রেখেছেন রাজা আগেই।

শান্তার সঙ্গে অযোধ্যায় বেশ কিছুদিন সুখে বসবাস করলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। তখন শীতকাল।

বসন্তকাল শুরু হতেই যজ্ঞের আয়োজন শুরু করতে বললেন ঋষি। ঋষ্যশৃঙ্গের সঙ্গে সহমত হলেন কুলপুরোহিত বশিষ্ঠ। তাঁরা দু’জনে একসঙ্গে বললেন, ‘অশ্বমেধ যজ্ঞের অশ্ব ছেড়ে দিন রাজা আর সরযূ-নদীর উত্তর তীরে যজ্ঞভূমি তৈরি করান।’

অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পন্ন হলে দশরথের পুত্রলাভের জন্য আরেকটি যজ্ঞ শুরু করলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। সেই যজ্ঞের নাম―পুত্রেষ্টি যজ্ঞ।

এই যজ্ঞানুষ্ঠানে বামদেব, জাবালি, কাশ্যপ, সুযজ্ঞের মতো বড় বড় ঋষিরা উপস্থিত থাকলেন।

যজ্ঞ আরম্ভ হলো। ঋষ্যশৃঙ্গ শ্বশুর দশরথকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘আমি কল্পসূত্রের বিধান অনুসারে অথর্ববেদের মন্ত্র দিয়ে আপনার পুত্রেষ্টি যজ্ঞ করছি। এই যজ্ঞশেষে আপনি নিশ্চিতরূপে পুত্র লাভ করবেন।’

আবেগে দশরথের কণ্ঠ বাষ্পরুদ্ধ হলো। হাত দুটি জড়ো করে মাথায় ঠেকালেন তিনি। কার উদ্দেশে প্রণাম জানালেন, বোঝা গেল না। তাঁর উদ্দিষ্ট ঈশ্বর, না ঋষ্যশৃঙ্গ―শুধু রাজা নিজেই তা বলতে পারেন। তাঁর সারা মুখমণ্ডলে তখন কৃতজ্ঞতার গাঢ় উপস্থিতি।

যজ্ঞারম্ভের মাঝামাঝিতে হাতে পায়েসের পাত্র তুলে নিলেন ঋষ্যশৃঙ্গ। সেই পায়েসের সঙ্গে গর্ভলাভের জন্য ঋষ্যশৃঙ্গ কিছু আয়ুর্বেদিক ওষুধ মেশালেন কিনা ধুন্ধুমারের মধ্যে কেউ লক্ষ করলেন না। সেই পায়েস রাজা দশরথের হাতে দিলেন। দশরথ পুত্র-বিঘ্ন দূরকারী সেই পায়েস প্রধান তিন পত্নীর কাছে নিয়ে গেলেন এবং পরম শ্রদ্ধায় ওই পায়েস কৌশল্যা, সুমিত্রা এবং কৈকেয়ীকে ভাগ-উপভাগ করে ভক্ষণ করালেন।

যথাসময়ে গর্ভবতী হলেন তিন মহিষী। কালক্রমে কৌশল্যার গর্ভে জন্মাল রাম, সুমিত্রার গর্ভে লক্ষ¥ণ ও শত্রুঘ্ন। দশরথ কৈকেয়ীর গর্ভজাত সন্তানের নাম রাখলেন―ভরত।

এত বছর পর পুত্রলাভ করে দশরথের পিতৃ-বাৎসল্য উছলে উঠল। দাম্পত্যজীবনের রোমাঞ্চ-মদিরার চেয়ে এই বাৎসল্য প্রবলতর। পুত্ররা জন্মানোর পর একে একে নানা উৎসবের আয়োজন করে গেলেন অযোধ্যাধিপতি। দান-দক্ষিণার পরিমাণও বহুগুণে বাড়িয়ে দিলেন।

শিশুবেলা অতিক্রম করার সঙ্গে সঙ্গে দশরথ রাম-লক্ষ¥ণ-ভরত-শত্রুঘ্নকে নানা শাস্ত্রীয় সংস্কারে ঋদ্ধ করা শুরু করেছেন। চার পুত্রেরই অস্ত্রশস্ত্র শিক্ষার সূচনা হয়ে গেছে। শাস্ত্রশিক্ষাও চলছে সমান্তরালভাবে। মাত্র বারো বছর বয়সের মধ্যে ছেলেরা সর্ববিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেছে। এত কম বয়সে সকল বিদ্যা রামরা অর্জন করে ফেলেছে―শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে দশরথপুত্ররা অসম্ভব মেধাবী। আর মেধাবীদের ক্ষেত্রে বয়স যে কোনও বাধা নয়, কে না জানে তা ?

চার পুত্রই দশরথের প্রিয়। কিন্তু প্রিয়তম হলো রাম। রামের জন্য দশরথের গর্বের অন্ত নেই।

দাশরথিদের অস্ত্রদক্ষতার কথা শুধু রাজপ্রাসাদে সীমাবদ্ধ থাকল না। অযোধ্যা ছাড়িয়ে তাদের অস্ত্রশিক্ষা ক্ষমতার কথা গোটা কোশলরাজ্যে ছড়িয়ে পড়ল। এই সংবাদ বন-অরণ্যের ঋষিপাড়াতেও পৌঁছাল।

ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের কানেও পৌঁছাল সংবাদটি। তিনি আর বিলম্ব করলেন না। আশ্রম ছেড়ে অযোধ্যার উদ্দেশে রওনা দিলেন। তাঁর অযোধ্যাযাত্রার পেছনে বিশেষ একটি আকাক্সক্ষা আছে।

বিশ্বামিত্র মুনিকে পরম সম্মানে রাজসভার উচ্চাসনে বসতে দিলেন দশরথ।

তারপর হাত দুটি জড়ো করে বন্দনার ভঙ্গিতে দশরথ বললেন, ‘আপনি জগদ্বিখ্যাত ঋষি। আপনার আগমনে এই রাজপুরী ধন্য হলো। আমার জন্ম সার্থক হলো। আপনার আগমনে এই রাজসভা, সমস্ত অযোধ্যা নগরী স্বর্গীয় আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে ব্রহ্মর্ষি। আপনি তপস্যাবলে রাজর্ষি থেকে যে ব্রহ্মর্ষি হয়েছেন, এই ধরিত্রীর কে না জানে ?’

বিশ্বামিত্র কিছু বলবার আগে দশরথ আবার বলে উঠলেন, ‘আপনি কি কোনও বাসনা নিয়ে আমার এখানে এসেছেন ?’ দশরথ আবেগসম্পন্ন মানুষ, অতিরিক্ত উচ্ছ্বাসপ্রবণও। ‘আদেশ করুন, আপনার কোন অভিলাষটা পূরণ করব আমি!’

দশরথের মধ্যে বাস্তবজ্ঞান কম। আবেগের বশে মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে ফেলেন তিনি। ভুল করেন তখন। যেমন ভুল করলেন এখন। মুনির অভিলাষ না শুনে প্রতিজ্ঞাই করে ফেললেন তাঁর বাসনাপূরণ করবেন বলে।

মৃদু একটু হাসলেন বিশ্বামিত্র, ‘পারবে তুমি আমার বাসনাপূরণ করতে ?’

আবেগ-শিথিল গলায় দশরথ বললেন, ‘আপনি আমার দেবতা, প্রভু। আপনি কার্যাকার্যের কথা চিন্তা করবেন না মোটেই। আমি কী পারব, কী পারব না―এসব নিয়ে ভাববেন না। শুধু বলুন আপনার চাওয়া কী ?’

এবার হাসিটা বিশ্বামিত্রের গলা ছেড়ে বেরিয়ে এল, ‘এরকম কথা তোমার মতো উদার রাজার মুখেই সাজে। তারপরও তুমি প্রতিজ্ঞা করো রাজা―যা চাইব, তা দেবে।’

রাজসভায় বসা মহর্ষি বশিষ্ঠ এবার মন্দ্রিত কণ্ঠে বললেন, ‘যা বলবে রাজা, ভেবেচিন্তে বলবে।’

কুলপুরোহিতের কথা কানে তুললেন না দশরথ। বললেন, ‘ব্রহ্মর্ষি, বলেন আপনি কী চান ?’

ব্রহ্মর্ষি বিশ্বামিত্রের গমগমে কণ্ঠে উচ্চারিত হলো, ‘তোমার পুত্র রামকে চাই। সে আমার সঙ্গে যাবে। যজ্ঞবিঘ্নকারী রাক্ষসদের সঙ্গে যুদ্ধ করে তাদের হত্যা করবে রাম।’

বিশ্বামিত্র তাঁর কথা আরও বিস্তৃত করলেন―তিনি যজ্ঞকর্মে দীক্ষিত হয়েছেন। তাড়কা রাক্ষসী, তার পুত্র মারীচ এবং সুবাহু নামের এক রাক্ষস যজ্ঞ ভণ্ডুল করে দিচ্ছে বারবার। ওদের হত্যা না করলে যজ্ঞ সম্পন্ন করতে পারছেন না তিনি। হত্যা করার জন্য একজন রণদক্ষ বীর চাই। তার বিবেচনায় রামই সেই বীর। তাই রামকে চাই তাঁর।

দশরথ বিশ্বামিত্রের কথা শুনে অজ্ঞান হয়ে গেলেন। হুঁশে ফিরে বললেন, ‘রাম আমার অত্যন্ত নরম একটি ছেলে। তার দেহগঠন সুদৃঢ় হয়নি এখনও! এখনও ষোলো বছরও বয়স হয়নি রামের! যুদ্ধ করার যোগ্যতাই অর্জন করতে  পারেনি এখনও রাম। তাকে বাদ দিন প্রভু। আমি যাচ্ছি আপনার সঙ্গে। এক অক্ষৌহিণী সেনা থাকবে আমার সঙ্গে। রাক্ষসজাতিকে নিশ্চিহ্ন করে ছাড়ব আমি।’

ষোলো

দশরথের কথা শুনে ক্রোধান্বিত হয়ে উঠলেন বিশ্বামিত্র, ‘তোমাকে বাহির থেকে দেখে ধার্মিক বলে মনে হচ্ছে দশরথ। এখন দেখছি―প্রকৃতপক্ষে তা তুমি নও। পুত্রস্নেহে স্বধর্ম থেকে বিচ্যুত হচ্ছ তুমি। এ তোমার জন্য মঙ্গল বয়ে আনবে না।’

অসহায় বালকের মতো দশরথ বলে উঠলেন, ‘মুনিবর, আপনি দেবতা, আপনি ভগবান। আপনি আমাকে বাঁচান। রামকে রেহাই দিন। রামকে সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন না আপনি। রাক্ষসেরা ওকে মেরে ফেলবে।’ স্থান-কাল-পাত্র ভুলে হু হু করে কেঁদে উঠলেন দশরথ। ‘আমি নিজেই যেখানে যেতে সাহস করছি না, সেখানে আমি আমার এই সুন্দর ছেলেটিকে পাঠাই কী করে! না―। আপনার সঙ্গে আমি রামকে দেব না ঋষিবর।’ চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলে গেলেন দশরথ।

এবার কুলগুরু বশিষ্ঠ রেগে গেলেন খুব, ‘এসব আবোলতাবোল কী বলছো তুমি রাজা! প্রতিজ্ঞা করেছো তুমি ব্রহ্মর্ষির কাছে। নৃপতি হয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করছো তুমি ? এরপর থেকে প্রজারা আর তোমাকে সম্মান করবে না। বলবে প্রতিজ্ঞাভঙ্গকারী রাজা তুমি।’

বশিষ্ঠের ধমকে চুপসে গেলেন দশরথ। থতমত কণ্ঠে বললেন, ‘কী করব আমি এখন ? বলে দিন আমায়।’

স্থির চোখে দশরথের দিকে তাকিয়ে বশিষ্ঠ বললেন, ‘রামকে তুমি যতই নরম অদক্ষ ভাবছো, প্রকৃতপক্ষে সে কিন্তু তা নয়। সে মস্তবড় অস্ত্রকুশলী। বড় দুঃসাহসীও সে। তার মনোবল সম্পর্কে সঠিক খবর তুমি জানো না। রামের অস্ত্রদক্ষতা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বড় বড় বীরও তার সামনে দাঁড়াতে পারবে না। সেনাপতির কাছ থেকে এসব কথা জেনেছি আমি।’

ক্রোধ কিছুটা প্রশমিত হলো কুলগুরুর। আদেশের সুরে বললেন, ‘রামকে ব্রহ্মর্ষির সঙ্গে দাও। দেখবে―রাক্ষসদের নিশ্চিহ্ন করে সে অযোধ্যায় ফিরে এসেছে।’

ব্রহ্মর্ষি বললেন, ‘কাজ শেষ হলে আমিই রামকে অযোধ্যায় পৌঁছে দিয়ে যাব।’

বশিষ্ঠ বললেন, ‘ঋষি বিশ্বামিত্র চাইলে নিজেই রাক্ষসদের ধ্বংস করতে পারেন। তিনি নিজে ভয়ংকর অস্ত্রবিদ। রামকে সঙ্গে নেওয়ার পেছনে নিশ্চয়ই কোনও গভীর উদ্দেশ্য আছে তাঁর এবং শেষ পর্যন্ত তা হয়তো তোমার অনুকূলে যাবে দশরথ।’

দশরথ আর কথা বাড়াননি।

যাত্রার দিন লক্ষ¥ণও সঙ্গ নিয়েছিল রামের। শত অনুরোধেও লক্ষ¥ণকে বিরত করতে পারেনি রাম।

অরণ্যপথে চলতে চলতে নানা কথা বলে যাচ্ছেন ব্রহ্মর্ষি। প্রাসাদের বাইরে এই প্রথম যাত্রা রামদের। খোলা আকাশের নিচে শ্বাপদসংকুল অরণ্যমাঝে ব্রহ্মর্ষির সাহচর্যে পথচলা অবিরত থাকল। বিশ্বামিত্রের নিরন্তর উপদেশ রামকে পরিপূর্ণ এক অস্ত্রযোদ্ধা করে তুলল।

পথে তাড়কা রাক্ষসী বাধা হয়ে দাঁড়াল। রামচন্দ্র তাকে হত্যা করল। বিশ্বামিত্রের আশ্রমে পৌঁছে যজ্ঞস্থলে মারীচ ও সুবাহুর মুখোমুখি হলো রাম-লক্ষ¥ণ। বিপুল এক রাক্ষসবাহিনী নিয়ে দুই ভাইকে আক্রমণ করে বসল মারীচ-সুবাহু। ঘোরতর যুদ্ধে সুবাহু নিহত হলো। মারীচ দণ্ডকারণ্যে পালিয়ে গিয়ে প্রাণ বাঁচাল।

বিশ্বামিত্র অনেক মহার্ঘ এবং মারাত্মক অস্ত্র দান করলেন রামচন্দ্রকে। অযোধ্যায় ফিরে আসার দিন নির্ধারণ করলেন ব্রহ্মর্ষি।

সেই সন্ধ্যায় এক শিষ্যের কাছ থেকে রাজর্ষি জনকের নিমন্ত্রণ-সন্দেশ পেলেন বিশ্বামিত্র। যজ্ঞ করছেন জনক, ওই যজ্ঞে বিশ্বামিত্রের উপস্থিতি কামনা করেছেন রাজা। বিশ্বামিত্র নির্দিষ্ট দিনে রাম-লক্ষ¥ণকে সঙ্গে নিয়ে জনক-রাজধানী মিথিলায় উপস্থিত হলেন। জনক দ্বারা সাদরে সম্ভাষিত হবার পর বিশ্বামিত্র হরধনুর কথা জানতে পারলেন।

রাম-লক্ষ¥ণের সামনেই হরধনুর বৃত্তান্ত জানালেন জনক। তিনি হরধনুটির পুরুষানুক্রমে হস্তান্তরের কথা বললেন। সবশেষে বললেন, ‘এই হরধনুটির সঙ্গে আমার কন্যা সীতার বিয়ের ব্যাপারটি জড়িয়ে গেছে ব্রহ্মর্ষি।’

অবাক চোখে ব্রহ্মর্ষি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সে কেমন ?’

‘মেয়ে আমার বিবাহযোগ্যা হয়ে উঠেছে। আমি ঘোষণা করেছি, যে এই হরধনুতে তির যোজনা করতে পারবে, তার সঙ্গেই সীতার বিয়ে দেব আমি।’ থামলেন জনক।

একটা শ্বাস ত্যাগ করে আবার বললেন, ‘ঘোষণার পর বিবাহার্থী অনেক রাজা, যুবরাজ হরধনুতে তির যোজনার চেষ্টা করেছে। কিন্তু কী বলব আপনাকে, যোজনা তো দূরের কথা, হরধনুটি তুলতেই পারেনি বেশির ভাগ প্রার্থী।’

‘তারপর ?’

‘হরধনুটি যথাস্থানে পড়ে আছে। এখন আর তেমন কোনও বিবাহ-প্রার্থী আসে না। সীতার বিয়েটাও আটকে গেছে ব্রহ্মর্ষি।’

এই সময় রামের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। হরধনুটা দেখবার জন্য তার বাসনা তীব্র হয়ে উঠেছে। বুঝতে পারলেন ব্রহ্মর্ষি।

জনককে উদ্দেশ করে বললেন, ‘দেখাতে পারবে আমাদের, সেই হরধনুটি ?’

‘অবশ্যই ব্রহ্মর্ষি। আগামীকাল প্রাতে হরধনুর কাছে আপনাদের নিয়ে যাব আমি।’

পরদিন হরধনুর কাছে বিশ্বামিত্র-রাম-লক্ষ¥ণকে নিয়ে গিয়েছিলেন জনক। কৌতূহলে অনায়াসে ধনুটি হাতে তুলে নিয়েছিল রাম। ওখানেই থামেনি সে। জ্যা-তে তির যোজনা করতে গিয়ে বহুদিনের পুরনো ধনুকটি মড়মড় করে ভেঙে গেল। রামের শৌর্য দেখে নির্বাক বিশ্বামিত্র, নিথর জনক।

সংবিতে ফিরে ঘোষণা দিলেন―এই রামচন্দ্রের সঙ্গেই নিজকন্যা সীতার বিয়ে দেবেন তিনি।

বিশ্বামিত্রের সম্মতিতে রাজর্ষি জনক অযোধ্যায় দূত পাঠালেন। দূত গিয়ে রাজা দশরথের হাতে একটি পত্র তুলে দিল। পত্রে লেখা―ঋষি বিশ্বামিত্রের সঙ্গে রামচন্দ্র মিথিলায় এসে বিরাট এক কাজ করেছে। সে হরধনু ভঙ্গ করে আমার কন্যা সীতাকে বিয়ে করার যোগ্যতা অর্জন করেছে। আশা করি, এই বিয়েতে আপনি দ্বিমত পোষণ করবেন না। আপনার কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ―আপনি উপাধ্যায় ঋত্বিকদের সঙ্গে নিয়ে এখানে আসুন এবং রামের বিবাহ-উৎসবের আনন্দ উপভোগ করুন।

দশরথ আনন্দে অধীর হলেন। তিনি মন্ত্রী-অমাত্য, কুলপুরোহিতকে সঙ্গে নিয়ে সৈন্যসামন্তসহ মিথিলার উদ্দেশে রওনা দিলেন।

মিথিলায় পৌঁছালে দশরথকে অতুল অভিবাদন জানালেন জনক।

রাজা জনকের দুই কন্যা―সীতা এবং ঊর্মিলা। জনকের ভাই কুশধ্বজেরও দুই মেয়ে―মাণ্ডবী ও শ্রুতকীর্তি। চারজনই বিবাহযোগ্যা।

বিশ্বামিত্রের প্রস্তাবে এই চারকন্যার সঙ্গে রাম-লক্ষ¥ণ-ভরত-শত্রুঘ্নের বিয়ে সম্পন্ন হলো।

বিবাহ-উৎসব সম্পন্ন হবার পর দশরথ পুত্র আর পুত্রবধূদের নিয়ে অযোধ্যার উদ্দেশে যাত্রা করলেন। আশ্রমে ফিরে গেলেন বিশ্বামিত্র। মিথিলাকে পেছনে ফেলে দশরথ অরণ্যপথ ধরতে না ধরতেই সেই ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটল।

জমদগ্নির পুত্র পরশুরাম, যিনি ক্ষত্রিয়কুলের হন্তারক বলে সমধিক পরিচিত, তিনি রামচন্দ্রের পথ আগলে দাঁড়ালেন। রামচন্দ্রের ওপর ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়েছেন পরশুরাম। রামের হরধনুভঙ্গ-বার্তা সহ্য করতে পারেননি তিনি। ছোট্ট একটি ছেলের এত বড় কৃতিত্ব কিছুতেই মেনে নিতে রাজি নন তিনি!

রামকে এমনি এমনি ছেড়ে দেবেন না পরশুরাম। পিতা জমদগ্নির বিখ্যাত ধনুকটি সামনে বাড়িয়ে ধরে বললেন, ‘দেখি, কেমন বীর তুমি! এটি আমার পিতার বৈষ্ণবধনু। তুমি নাকি হরধনু ভেঙেছো! এই ধনুটিতে জ্যা-আরোপণ করে দেখাও তো তুমি আমাকে! ব্যর্থ হলে উচিত শিক্ষা পাবে তুমি আমার হাতে।’

রথ থেকে নেমে এল রাম। সামনের শ্মশ্রুমণ্ডিত ঋষিটিকে চেনে না সে। কিন্তু তার অনুমান করতে অসুবিধা হচ্ছে না যে সামনে দণ্ডায়মান এই মুনি জগদ্বিখ্যাত কেউ।

দু হাত জড়ো করে পরশুরামকে প্রণাম জানাল রাম। তারপর ডান হাত বাড়িয়ে বৈষ্ণবধনুটি নিল। অল্প আয়াসে ধনুতে শরযোজনা করে পরশুরামকে তাক লাগিয়ে দিল।

পথ ছেড়ে দাঁড়ালেন পরশুরাম। রথসমষ্টি আবার চলতে শুরু করল।

চার ভাই সস্ত্রীক অযোধ্যা-প্রাসাদে ফিরে এলে কৌশল্যা, সুমিত্রা এবং কৈকেয়ী সমান আদরে পুত্র-পুত্রবধূদের গ্রহণ করলেন।

রামচন্দ্র দশরথের সর্বাধিক গুণান্বিত পুত্র। জ্যেষ্ঠপুত্র সে। তিন মাকেই সে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করে। ভালোও বাসে। জননী ও বিমাতাদের ভিন্ন চোখে দেখে না রাম। রাজার এই পুত্রটিকে মন্ত্রী-অমাত্য-সেনাপতি প্রমুখ উঁচুমানের অধিকারিকরা মর্যাদা দেন খুব।

তাঁরা জানেন―এই রামচন্দ্রই একদিন অযোধ্যার রাজা হবে। পৌর-জনপদজনেরা রামকে গভীর শ্রদ্ধার চোখে দেখে। সবার চোখে রামচন্দ্র কোশলরাজ্যের ভবিষ্য-রাজা হয়ে উঠেছে।

তিন রানির মধ্যে কৈকেয়ীর প্রতি রাজা দশরথের পক্ষপাতিত্ব বেশি। ছোটরানি কৈকেয়ী যৌবনঋদ্ধ এবং রূপসী। আর বয়স হয়ে গেলেও রাজা দশরথ এখনও যৌবনলোভী। কৌশল্যার সঙ্গে স্বাভাবিক বিয়ে হয়েছিল দশরথের। সুমিত্রার সঙ্গে বিয়েটা রাজনৈতিক। যৌবন-লোভাতুর হয়েই দশরথ কৈকেয়ীকে বিয়ে করেছিলেন। কৈকেয়ীর সঙ্গে যেদিন প্রথম সাক্ষাৎ হয় দশরথের, সেদিন তাঁর মনে হয়েছিল, কৈকেয়ীকে অঙ্কশায়িনী করবার বিনিময়ে পৃথিবীকে বাজি ধরতে পারেন। দশরথের ঘরে তখন দুই মহিষী―কৌশল্যা আর সুমিত্রা। কৌশল্যা-সুমিত্রার বয়স ততদিনে প্রৌঢ়ত্বের দিকে ঝুঁকেছে। তাই কৈকেয়ীকে মহার্ঘ বলে মনে হয়েছিল দশরথের। শ্বশুর অশ্বপতির কিছু অন্যায্য শর্ত মেনে কৈকেয়ীকে বিয়ে করে রাজপ্রাসাদে নিয়ে এসেছিলেন দশরথ।

সেই থেকে দশরথ স্ত্রৈণ হয়ে গিয়েছিলেন। কৈকেয়ীর কথায় ওঠেন, বসেন। রাম-লক্ষ¥ণের জন্মের পর কৌশল্যা-সুমিত্রার প্রতি রাজার মর্যাদা প্রদর্শন বৃদ্ধি পেয়েছে, ভালোবাসা বাড়েনি। তাঁর সকল ভালোবাসার আধার কৈকেয়ীই থেকে গেছেন। তাঁর প্রতি রাজার আনুগত্যের কথা ভালো করেই জানতেন কৈকেয়ী। কিন্তু সেই আনুগত্যকে কখনও নিজের স্বার্থের অনুকূলে ব্যবহার করেননি তিনি।

রাম তাঁর গর্ভজাত না হলেও রামকে যথেষ্ট মর্যাদা দিতেন কৈকেয়ী। সেকালের রাজতন্ত্রের প্রথানুসারে জ্যেষ্ঠপুত্র রামচন্দ্রই হবে অযোধ্যার যুবরাজ এবং রাজা―জানতেন এবং মানতেনও কৈকেয়ী। এ ব্যাপারে তাঁর মনে কোনও বিদ্বেষ ছিল না। রামের মধুর ব্যবহারে মুগ্ধ ছিলেন ছোটরানি। কিন্তু একদিন এই কৈকেয়ীর মাথা গুলিয়ে গেল।

রাজা দশরথ রামচন্দ্রকে যুবরাজ করবেন বলে মনস্থ করলেন। রাজসভায় ঘোষণাও করলেন তা।

কৈকেয়ীপুত্র ভরত তখন সস্ত্রীক মামাবাড়িতে, কৈকয়রাজ্যে। সঙ্গে নিত্যসঙ্গী শত্রুঘ্ন। কেন গেল ? মাতামহ বৃদ্ধ অশ্বপতি দীর্ঘদিন নাতিকে দেখেননি। নাতিকে দেখার বড় অভীপ্সা অশ্বপতির। তাই মামা যুধাজিতের পীড়াপীড়িতে ভরত-শত্রুঘ্ন মামাবাড়িতে গেছে।

রাজার ঘোষণায় কৈকেয়ীর মনে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়া হলো না। উপরন্তু ভীষণ খুশি হলেন তিনি। সঠিক সময়ে সঠিক কাজটিই করেছেন রাজা। পরিপূর্ণ যুবক হয়ে উঠেছে রাম। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞাও প্রশংসিত। ও-ই তো হবে অযোধ্যার যুবরাজ! কৌশল্যা-সুমিত্রার সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে থাকলেন কৈকেয়ী।

কৈকেয়ীর মতো দশরথও নির্বিঘ্ন ও আনন্দমগ্ন ছিলেন। কিন্তু অচিন্ত্যনীয়ভাবে রাজার সামনে বিঘ্ন এসে স্বয়ং উপস্থিত হলো।

সেই বিঘ্নসৃষ্টিকারীর নাম―মন্থরা। কুঁজো সে। তাই সকলের কাছে সে কুব্জা। কৈকেয়ীর বাপের বাড়ির পুরনো দাসী সে। বিয়ের পর কৈকয়রাজ্য থেকে কৈকেয়ীর ব্যক্তিগত দাসী হয়ে কুব্জা অযোধ্যার রাজপ্রাসাদে এসেছিল।

কৈকয়রাজ অশ্বপতির কাছে দশরথের বৈবাহিক প্রতিজ্ঞার কথা ওই মন্থরা জানত।

রামের যুবরাজ হওয়ার সংবাদে রাজপ্রাসাদের সবাই খুশি হলেও এই মন্থরা তা মেনে নিতে পারেনি। বিকলাঙ্গ দেহটিকে টানতে টানতে কৈকেয়ীর সামনে দাঁড় করিয়েছিল।

সতেরো

বিয়ের আগে দশরথ কৈকয়রাজ অশ্বপতির কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন―কৈকয়ীর গর্ভজাত পুত্রই দশরথের পর অযোধ্যার রাজা হবে। জানত তা মন্থরা। এই অস্ত্র সম্বল করে কৈকেয়ীর কক্ষে গিয়ে উপস্থিত হলো মন্থরা।

কৈকেয়ী তখন সুখপ্রদ শয্যায় শুয়ে আছেন। চোখ তাঁর মুদিত।

তা দেখে গা জ্বলে গেল মন্থরার।

হিসিয়ে উঠল, ‘তুমি এখনও শুয়ে আছো কী করে বুঝতে পারছি না!’

মা রাজপ্রাসাদ ছেড়ে চলে যাবার পর শিশু কৈকেয়ীকে লালনপালন করে বড় করে তুলেছে এই মন্থরা। তাই তার কথায় ‘আপনি’ সম্বোধনের সম্ভ্রম নেই।

ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন কৈকেয়ী। বললেন, ‘কী, কী হয়েছে! এরকম ভয়ের গলায় কথা বলছো কেন ?’

‘ভয় আমার নয়, ভয় তোমার বাছা। তোমার সামনে যে বিরাট ভয় উপস্থিত!’

‘আমার ভয়! কীসের ভয় ? কী এলোমেলো বকছো!’

স্বরকে এবার খাদে নামাল মন্থরা, ‘তুমি মনে কর, না না শুধু মনে করো বলছি কেন, বিশ্বাসই করো―তোমার স্বামী সর্বদা তোমার প্রিয় কাজটিই করেন ?’

মন্থরাকে থামিয়ে দিয়ে কৈকেয়ী বললেন, ‘করেন তো।’

ডান হাতের বুড়ো আঙুল কৈকেয়ীর চোখের সামনে তুলে ধরে মন্থরা বলল, ‘প্রিয় কাজ করেন, না ছাই করেন!’

‘এরকম করে কথা বলছো কেন তুমি ? তুমি কি ভুলে গেলে রাজা দশরথ কোশলরাজ্যের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ?’

‘তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী মানলাম। কিন্তু তিনি স্বেচ্ছাচারীও। শপথভঙ্গকারীও।’

এবার সটান শয্যা থেকে নেমে এলেন কৈকেয়ী। চোখ রাঙিয়ে বললেন, ‘এসব বাজে কথা বন্ধ করো মন্থরা। নইলে কঠোর শাস্তি পেতে হবে তোমায়।’

‘শাস্তিকে আমি ভয় পাই না ছোটরানি। শাস্তি পেয়েও যদি তোমার উপকারটা করতে পারি, আমার আনন্দের সীমা থাকবে না।’

কৈকেয়ী মন্থরার কথার মাথামুণ্ডু বুঝতে পারছেন না। মনে মনে একটু ভয়ও পেলেন।

‘আমার উপকার! কী উপকার আমার ?’ ভয় মিশ্রিত কণ্ঠে জানতে চাইলেন কৈকেয়ী।

এবার কথার বাঁধ ভেঙে গেল মন্থরার, ‘মহারাজ দশরথ আগামীকাল রামচন্দ্রকে যুবরাজ হিসেবে অভিষিক্ত করতে যাচ্ছেন।’

‘তো ? তাতে তোমার কী সমস্যা ?’

কৈকেয়ীর প্রশ্নের উত্তর এড়িয়ে মন্থরা বলতে থাকল, ‘সেই কথা শোনার পর থেকে গা জ্বলে যাচ্ছে আমার। দুঃখে-ভয়ে মরে যাচ্ছি আমি।’

‘এরকম একটা শুভসংবাদে তুমি কেন জ্বলেপুড়ে মরছ মন্থরা!’ হেঁয়ালি স্পষ্ট হয়ে উঠল কৈকেয়ীর কণ্ঠস্বরে।

গায়ে মাখল না তা মন্থরা। মথিত সুরে বলল, ‘শোনো বাছা, আমি তোমার ভালোর জন্য এখানে এসেছি। তুমি তো সবসময় সুখভোগে অভ্যস্ত, দুঃখের মুখ দেখোনি কখনও! এবার বুঝবে দুঃখ কাকে বলে।’

অদ্ভুত এক বিমূঢ় বিস্ময়ে মন্থরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কৈকেয়ী। ‘তোমার কথা আমি আর নিতে পারছি না মন্থরা। যা বলতে চাও, খোলাখুলি বলো।’

মন্থরা দুকদম এগিয়ে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তারপর চাপা কণ্ঠে বলল, ‘অযোধ্যার যুবরাজ হবার অধিকার তো তোমার ছেলে ভরতের! মহারাজ দশরথের পরে তারই তো অযোধ্যার সিংহাসনে বসার কথা।’

‘ভরতের রাজা হবার কথা! কী ভাবে ?’

‘তুমি ভুলে গেলেও আমি ভুলিনি ছোটরানি। বিয়ের সময় এই দশরথই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন তোমার বাবার কাছে যে তোমার গর্ভজাত সন্তানই হবে কোশলরাজ্যের রাজা।’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলল মন্থরা।

চট করে রাজা দশরথের প্রতিশ্রুতির কথা মনে পড়ে গেল কৈকেয়ীর। তাঁর ভেতরে লালসা লকলকিয়ে উঠল।

মন্থরার কথা বলা তখনও শেষ হয়নি, ‘তোমার স্বামীটিকে তুমি যতটা সহজসরল ভাবো, প্রকৃতপক্ষে তা তিনি নন। বাইরে মধুরস্বভাবী তিনি, কিন্তু তাঁর অন্তর কুটিলতায় ভরা। নইলে কেন ভরত রাজধানীতে নেই যখন, তখনই রামকে যুবরাজ করছেন ?’ ব্যঙ্গ নয় একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করল মন্থরা, ‘সারাটা জীবন মধুটা খেয়ে গেলেন তোমার, দেওয়ার বেলায় বড়রানি কৌশল্যাকে ভরিয়ে দিলেন। তোমার স্বামী মুখে খুব ধার্মিক, কিন্তু আসলে অত্যন্ত শঠ।’

হতভম্ব চোখে মন্থরার দিকে তাকিয়ে থাকলেন কৈকেয়ী। অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘এখন আমি কী করব মন্থরা! আমার যে একূল-ওকূল―দু কূলই যেতে বসল!’

মন্থরা দাসী হলে কী হবে, রাজনীতিটা ভালো করেই বোঝে। একেবারে ঠান্ডা মাথায় বলল, ‘তোমাদের এই জ্যেষ্ঠপুত্র রাম যদি রাজা হয়, তাহলে পরবর্তীকালে তার ছেলেই অযোধ্যার রাজা হবে। তোমার ছেলে ভরত চিরতরে হারিয়ে যাবে। তাকে হারিয়ে যেতে দিয়ো না ছোটরানি। তাকে তুমি পেটে ধরেছো। মা হয়ে তার সর্বনাশটা করো না তুমি। মনে রেখো, রামচন্দ্র রাজা হলে এ-রাজ্যে ভরতের পক্ষে টেকাটাই কঠিন হয়ে পড়বে। তাছাড়া এই রাজপ্রাসাদে তোমার মর্যাদা কত নিচে নেমে যাবে ভেবেছো ? রানি কৌশল্যা রাজমাতা হবেন। তুমি আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হবে তখন।’

‘আহ্ মন্থরা, আহ্! থামো তুমি!’ দুহাতে মাথার দুদিকে চেপে ধরে পালঙ্কে বসে পড়লেন কৈকেয়ী।

ওই সময় মন্থরার মোক্ষম কুপরামর্শটি কৈকেয়ীর কানে গিয়ে ধাক্কা দিল, ‘তুমি রাজাকে এখানে ডেকে পাঠাও। পূর্বের প্রতিশ্রুতির কথা মনে করিয়ে দাও তাঁকে। বলো―তোমার ছেলেই রামের পরিবর্তে এই অযোধ্যর যুবরাজ হবে। ও হ্যাঁ, আরেক দিনের কথা মনে পড়ে তোমার ? যুদ্ধে আহত হয়েছিলেন রাজা, মনপ্রাণ ঢেলে সেবা করেছিলে তাঁর। দুটি বর দিতে চেয়েছিলেন। আমার পরামর্শে বর দুটি ওই দিন তুমি নাওনি। আজ চেয়ে নাও।’

‘আজ চেয়ে নেব! কী বর চাইব ?’ কৈকেয়ীর মন পালটে গেছে ততক্ষণে। মন্থরার কথাকে সত্য বলে মনে হচ্ছে তাঁর। মনে হচ্ছে―ভবিষ্যতে রাম তাঁর মর্যাদা ক্ষুণ্ন করবে, কৌশল্যা তাঁর ওপর অত্যাচার করবেন। এই ভয় থেকে বাঁচতে চাইলে মন্থরার কথা মেনে নেওয়া উচিত তাঁর―দ্রুত ভেবে নিলেন কৈকেয়ী।

মেনেও নিলেন। লোভী চোখে মন্থরার উত্তর শোনবার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলেন কৈকেয়ী।

মন্থরার কর্কশ কণ্ঠের প্রতিটি শব্দ আলাদা আলাদা হয়ে কৈকেয়ীর কানে এসে বাজল, ‘প্রথম বরে তুমি ওই উৎসবমুখর রামচন্দ্রের চৌদ্দ বছরের বনবাস চেয়ে নেবে। দ্বিতীয় বরে রাজার কাছে চাইবে ভরতের যৌবরাজ্যের অভিষেক।’

বলা শেষ করে যেরকম দ্রুত পায়ে কৈকেয়ীর ঘরে ঢুকেছিল মন্থরা, সেরকম দ্রুততায় বেরিয়ে গেল!

পরের দিন রামচন্দ্রের অভিষেক অনুষ্ঠান যাতে নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়, সে ব্যবস্থা করে রাজসভা মুলতবি ঘোষণা করলেন দশরথ। এই সুসংবাদটা প্রথমে কৈকেয়ীকে দিতে চান তিনি। প্রিয়তমা স্ত্রী বলে কথা!

মহারাজ সরল অন্তঃকরণে কৈকেয়ীর অন্তঃপুরে প্রবেশ করলেন। কিন্তু শয়নকক্ষে কৈকেয়ীকে দেখতে পেলেন না। খুঁজতে লাগলেন কৈকেয়ীকে। কোথাও পেলেন না। উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন রাজা। হাততালি দিলে সেই মন্থরাই এসে উপস্থিত হলো। বাইরে অপেক্ষায় ছিল সে। তার মাথায় লম্বা ঘোমটা।

রাজা কৈকেয়ীর কথা জানতে চাইলে মন্থরা করুণ স্বরে বলল, ‘কী হয়েছে বুঝতে পারছি না মহারাজ। সেই সকাল থেকেই রানিকে খুব বিষণ্ন দেখেছি। ক্রুদ্ধও দেখেছি তাঁকে। তিনি ক্রোধাগারে গেলেন কিনা বুঝতে পারছি না।’

ব্যাকুল দশরথ ক্রোধাগারে ছুটে গেলেন। গিয়ে দেখলেন―কৈকেয়ী আলুথালু বেশে মাটিতে শুয়ে আছেন। দ্রুত হাতে কৈকেয়ীকে কোলে তুলে নিতে চাইলেন দশরথ। বললেন, ‘এরকম রাগ কেন তোমার ছোটরানি! আমি এমন কী অপরাধ করেছি যে রাগে-অপমানে মাটিতে শুয়ে আছো ? কে তোমার মনে ব্যথা দিল―আমি, না অন্য কেউ ? অন্য কেউ হলে নাম বল। তার মাথা কেটে নামাব আমি।’

এরকম করুণ অবস্থায় কৈকেয়ীকে স্বর্গভ্রষ্টা অপ্সরা, খাঁচাবদ্ধ হরিণী বলে মনে হলো দশরথের। তার ব্যাকুলতা শত গুণে বেড়ে গেল।

দশরথ কৈকেয়ীকে অনেক বিকল্পের কথা শোনালেন। কোনও ধনীকে নির্ধন, কোনও দরিদ্রকে ধনবান, অবধ্যকে বধ, বধ্য ব্যক্তিকে প্রাণদান করতে হবে কিনা কাকুতিভরা স্বরে কৈকেয়ীর কাছে জানতে চাইলেন মহারাজ।

শেষে দশরথ বললেন, ‘যত রাজ্য আছে পৃথিবীতে, সেখানে যা-কিছু মূল্যবান বস্তু আছে―তা সব এনে দিতে পারি তোমাকে। এর চেয়ে বড় কথা, যত পুণ্য আছে আমার, সব দিয়ে দিতে পারি তোমাকে। বলো, কী চাও প্রেয়সী ? যা চাইবে, তা-ই দেব।’

কৈকেয়ী বুঝে গেলেন, দশরথের মনে কামনার দাউ দাউ আগুন। যা করতে হবে, এখনই করতে হবে। ভূমি ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। রাজার বক্ষলগ্না হয়ে শয্যাকক্ষে এলেন।

উষ্ণ নিশ্বাস রাজার মুখে ফেলে কৈকেয়ী বললেন, ‘আমাকে কেউ নিন্দা করেনি, অপমানও করেনি। কাউকে বধও করতে হবে না তোমাকে। আমার একটা ইচ্ছা আছে রাজা। বলো―সেই ইচ্ছা তুমি পূরণ করবে ?’

রাজা কৈকেয়ীর মাথাটা নিজের বুকে টেনে নিয়ে গাঢ় কণ্ঠে বললেন, ‘একমাত্র রামচন্দ্র ছাড়া তোমার চেয়ে এই পৃথিবীতে আর কাউকে বেশি ভালোবাসি না আমি। সেই রামের নামে শপথ করে বলছি―তোমার চাওয়া পূরণ করব আমি।’

কৈকেয়ী আলতো করে রাজার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিলেন। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে বিশ্বাস করি রাজা। জানি―তুমি আমাকে ভীষণ ভালোবাসো। সেই ভালোবাসার নামে শপথ করেছো তুমি। শপথ যখন করেছো, অবশ্যই সেখান থেকে নড়বে না তুমি―দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি আমি।’ একটু থামলেন কৈকেয়ী। নিজের ভেতরটা গুছিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, ‘তোমার কি মনে আছে রাজা―একদা আমাকে দুটি বর দিতে চেয়েছিলে তুমি ?’

‘হ্যাঁ হ্যাঁ মনে আছে! মনে থাকবে না কেন ? তুমি তা নাও নি তখন।’ তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন দশরথ।

‘আজ সেই বর দুটি আমাকে দাও তুমি।’

‘ও―! সেই কথা! তাতে তো আমার কোনও আপত্তি নেই। আজ আমার বড় আনন্দের দিন। রাম আগামীকাল যুবরাজ পদে অভিষিক্ত হবে। আসলে সেই সংবাদটাই দিতে এসেছিলাম তোমাকে। বলো, তুমি তোমার ইচ্ছার কথা বলো। কী চাও তুমি ?’

ক্রূর একটা হাসির রেখা কৈকেয়ীর মুখে দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল। বলল, ‘তুমি মনে রেখো রাজা, যে প্রতিশ্রুতি আমাকে দিয়েছো, তা ভঙ্গ করলে মহাপাতক হবে তুমি।’

এবার দশরথের বুকটা কেঁপে উঠল। কী ব্যাপার! এই শপথের কথাটা বারবার করে বলছে কেন কৈকেয়ী ? কোনও দুরভিসন্ধি, কোনও ক্ষতিকারক কিছু…। আর ভাবতে পারলেন না রাজা। ত্রস্ত চোখে কৈকেয়ীর দিকে তাকালেন।

কৈকেয়ী বললেন, তার কণ্ঠ থেকে সকল আবেগ তিরোহিত তখন, ‘তুমি রামের অভিষেকের জন্য যে আয়োজন করেছো, সেই অভিষেক-সামগ্রী দিয়ে আমার ছেলে ভরতকে যৌবরাজ্যে অভিষিক্ত করবে―এটা আমার প্রথম চাওয়া। আর দ্বিতীয় চাওয়া হলো―বল্কল বা মৃগচর্ম পরিয়ে রামকে চৌদ্দ বছরের জন্য বনে পাঠাবে।’ এক নিশ্বাসে বলে থামল কৈকেয়ী।

হঠাৎ এক বাঘকে অতি নিকটে চোখের সামনে দেখতে পেলে হরিণের যে অবস্থা হয়, দশরথেরও সেরকম অবস্থা হলো। দশরথ তখন হতভম্ব, অবশ, অচলেন্দ্রিয়। ঘটনার আকস্মিকতায় অজ্ঞান হয়ে গেলেন তিনি।

সংবিতে ফিরে অনেক তর্জন-গর্জন করলেন দশরথ। কিন্তু কৈকেয়ী তাঁর চাওয়ায় অটল থাকলেন। তিনি জানেন, রাজার এই গর্জন অসারের গর্জন। বন্ধ খাঁচায় আটকাপড়া সাপের ফোঁসফাঁসানি ছাড়া আর কিছুই নয় দশরথের হুঙ্কার-চেঁচামেচি।

দশরথ বিলাপ করে বললেন, ‘আমি নিজের বিনাশের জন্যই একদিন তোমাকে ঘরে এনেছিলাম কৈকেয়ী। জানতাম যদি, তোমার ধারেকাছেও ঘেঁষতাম না আমি।’

নির্মোহ কণ্ঠে কৈকেয়ী বললেন, ‘তুমি আমার চাওয়া পূরণ করো রাজা। মনে রেখো, তুমি আমার কাছে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।’ দশরথের শত ক্রোধ-ক্ষোভ, অনুনয়-বিনয়েও কৈকেয়ী তাঁর চাওয়া থেকে এক চুল নড়লেন না।

আঠারো

সে-রাতটা কেটে গেল।

বিনিদ্র রাত কাটল দশরথের। সুখনিদ্রায় রাত্রি যাপন করলেন কৈকেয়ী।

পরদিন রামাভিষেকের সকল প্রস্তুতি সারা হয়ে গেছে। সবাই এসেছেন, আসেননি শুধু রাজা।

কুলগুরু বশিষ্ঠ সুমন্ত্রকে পাঠালেন দশরথের কাছে। রাজা তাড়াতাড়ি না এলে অভিষেকের লগ্ন বয়ে যাবে।

সুমন্ত্র রাজ-অন্তঃপুরে কৈকেয়ীর কক্ষে ঢুকে দেখলেন, বিমর্ষ হয়ে রাজা বসে আছেন। রাতজাগা চোখমুখ তাঁর। সুমন্ত্র তো আর দাম্পত্যকলহের কথা জানেন না! রামচন্দ্রের অভিষেকের জন্য কীভাবে পৌরজনপদবাসীরা অপেক্ষা করছে, আভিষেচনিক দ্রব্যসম্ভার কীভাবে সাড়ম্বরে সাজানো হয়েছে―তার বিশদ বিবরণ দিলেন সুমন্ত্র দশরথকে।

কিন্তু সমস্ত কথা শুনেও রাজার মুখে কোনও উদ্ভাস দেখা গেল না দেখে থতমত খেলেন সুমন্ত্র।

ভাবলেশহীন মুখে দশরথ বললেন, ‘তুমি আমাকে আর বিদ্ধ করো না সুমন্ত্র।’

রাজার কথা শুনে সুমন্ত্র হাত জোড় করে দু কদম পিছিয়ে গেলেন।

এই সময় কৈকেয়ী সুকৌশলে বললেন, ‘রামের অভিষেক-উৎসবের উত্তেজনায় রাজা গত রাতে ঘুমাতে পারেননি। তুমি এক কাজ করো সুমন্ত্র, রামকে এখানে ডেকে নিয়ে এসো।’

সুমন্ত্র কৈকেয়ীর কথা শুনলেন বটে, কিন্তু সে স্থান থেকে এক পা-ও নড়লেন না। রাজরানির আদেশ তামিল করার লোক তিনি নন। তাঁর কাছে রাজার আদেশই শিরোধার্য।

বললেন, ‘রাজার কোনও আদেশ না পেলে আপনার আদেশ পালন করতে পারব না আমি।’

বিহ্বল দশরথ বললেন, ‘রামকে এখানে নিয়ে এসো সুমন্ত্র। তাকে দেখতে চাই।’ বলে মাথা নিচু করলেন রাজা।

সুমন্ত্র বুঝে গেলেন, রাজা আর রানির মধ্যে কোনও একটা ঘাপলা হয়েছে। দুজনের কেউ তাঁকে ওই কথা বলতে চান না। তারপরও নড়েন না সুমন্ত্র।

হঠাৎ মাথা তুললেন দশরথ, ‘কী, এখনও তুমি দাঁড়িয়ে কেন সুমন্ত্র ? আমি তো ঘুমের ঘোরে তোমাকে আদেশ দিইনি!’

সুমন্ত্র কৈকেয়ীর কক্ষ থেকে মন্থর পায়ে বেরিয়ে গেলেন।

রামের কাছে গিয়ে বললেন, ‘তোমার পিতা ছোটরানি কৈকেয়ীর সঙ্গে আছেন। তাঁরা তোমাকে এখুনি দেখতে চাইছেন। দেরি করো না রাম।’

সুমন্ত্রের কথা শুনে মা-কৈকেয়ী সম্বন্ধে উচ্ছ্বাসপূর্ণ কথা ভাবতে শুরু করল রাম। সে জানে তো মা-কৈকেয়ী তাকে খুবই ভালোবাসেন! নিশ্চয়ই মঙ্গলজনক কিছু করবেন বলে ছোটমা তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন! পাশে থাকা সীতাকে বলে কৈকেয়ীভবনের উদ্দেশে রওনা দিল রাম। রামচন্দ্র রথে চড়ে বসতেই লক্ষ¥ণ তার পিছু নিল।

জনতার তুমুল জয়ধ্বনির মধ্যে স্তুতি পাঠকের জয়গান শুনতে শুনতে রামচন্দ্র কৈকেয়ীভবনে উপস্থিত হলো।

রামচন্দ্র পিতাকে উচ্চাচনে উপবিষ্ট দেখল। তাঁর মুখ শুকনো, শরীর অবসন্ন।

রামকে দেখে দশরথের মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘রা-ম!’

রামকে যখন, যে অবস্থাতেই দেখেন দশরথ, মহাখুশি হয়ে ওঠেন। আজ তার বিপরীত ঘটনা ঘটল। ভয় পেয়ে গেল রাম। কী হলো ? পিতাকে এরকম বিমর্ষ, বিপন্ন দেখাচ্ছে কেন ?

কৈকেয়ীকে বলল, ‘পিতা কি কোনও কারণে আমার ওপর রাগ করেছেন ? ভরত বা শত্রুঘ্নের কোনও বিপদ হয়নি তো মা ? আপনিই বলুন না, বাবার কী হয়েছে ?’

সৌজন্য, লজ্জা―সব ত্যাগ করলেন কৈকেয়ী, ‘আসলে তেমন খারাপ কিছু ঘটেনি আর তোমার বাবা তোমার ওপর ক্রুদ্ধও হননি।’

‘তাহলে!’ বিস্মিত চোখমুখ রামের।

‘আসলে রাজার মনে একটা অভিপ্রায় জন্মেছে। চক্ষুলজ্জায় তোমার সামনে বলতে পারছেন না।’

‘কী সেটা, বাবা ?’

‘আমি বলছি রাম, তোমার বাবার কথাটি আমিই বলছি। একদিন তোমার বাবার মস্ত এক উপকার করেছিলাম আমি। বর দিতে চেয়েছিলেন আমায় তখন। নিইনি ওই সময়ে। এখন চাইছি। এতে তোমার বাবা মনঃক্ষুণ্ন হয়েছেন।’

‘আপনার চাওয়াটা কী মা ? খুলে বলুন। আমি পূরণ করব তা।’ বলল রাম।

কৈকেয়ী ভূমিকায় গেলেন এবার, ‘মানুষ যদি একবার কথা দেয়, তারপর কথা না রাখে, কেমন লাগে বলো তো রাম! ভালো লাগে না তো ? আমারও ভালো লাগছে না এখন। তোমার পিতা বর দেবেন বলে কথা দিয়েছেন আমাকে, এখন সেই বর দিতে নারাজ তিনি।’

রাম বলল, ‘বলুন না মা, আপনার চাওয়া কী ? আমায় একবার বলে দেখুন না!’

‘রাখবে তুমি আমার কথা ? পিতার মতো প্রতিজ্ঞাভঙ্গ করবে না তো ?’

রাম কিন্তু কৈকেয়ীকে প্রতিজ্ঞার কথা বলেনি, কিন্তু নিজের সুবিধার্থে প্রতিজ্ঞা শব্দটি কথার মধ্যে টেনে আনলেন কৈকেয়ী।

রাম এবার সদর্পে বলল, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করছি মা, বাবার প্রতিশ্রুতি আমি রক্ষা করব।’

কৈকেয়ী রামের কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন। তিনি বুঝলেন―রামকে এইবার কথাগুলো বলা যায়।

‘বলছি, বলছি বাবা। আমি রাজার কাছে তেমন কিছু চাইনি, চেয়েছি―তোমার পরিবর্তে ভরতের যৌবরাজ্যে অভিষেক আর চৌদ্দ বছরের জন্য তোমার বনবাস।’ লজ্জার আড়াল বলে কিছুই থাকল না কৈকেয়ীর মুখে।

এই সময় দশরথ মুমূর্ষু কণ্ঠে গর্জে উঠলেন, ‘কলঙ্কিনী! পাপীয়সী!’

কৈকেয়ীর কথা শুনে এতটুকু দুঃখিত হলো না রাম। সে স্থিতধী মানুষ। পিতার প্রতিজ্ঞার দায় অবলীলায় গ্রহণ করল সে। কৈকেয়ীকে কথা দিল―অচিরেই জটাবল্কল ধারণ করে বনে যাবে। ভরত যুবরাজ হলে তার খুশির অন্ত থাকবে না বলেও কৈকেয়ীকে জানাল রাম।

কৈকেয়ী দশরথের কথা কানে তুললেন না। বললেন, ‘আমি তাহলে ভরতকে তার মাতুলালয় থেকে আনতে পাঠাচ্ছি। আর তোমারও বেশি বিলম্ব করা উচিত হবে না রাম। তুমি তো দেখছই, রাজা দশরথ তোমার সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন! তুমি যতক্ষণ না বনে যাচ্ছ, ততক্ষণ ইনি স্নান-খাওয়া করতে পারবেন কিনা সন্দেহ।’

রাম ধীর প্রশান্ত বিচক্ষণ মানুষ। কৈকেয়ীর ওপর-চালাকি ধরতে পেরেও কিছু বলল না।

কষ্টক্লিন্ন দীর্ঘ এক শ্বাস ত্যাগ করে রাম বলল, ‘মা, আমি স্বার্থপর নই। পিতার বাক্য পালন করার মতো ধর্মবোধ আমার আছে।’

এরপর বৃদ্ধ পিতার শুশ্রƒষার ভার কৈকেয়ীর ওপর দিয়ে সংজ্ঞাহীন জনককে বারবার প্রণতি জানিয়ে কৈকেয়ীকক্ষ থেকে বেরিয়ে গেল রাম।

রামচন্দ্র বেরিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অন্তঃপুরের মহিলারা বিলাপ করতে শুরু করল। তারা যতখানি কৈকেয়ীর দোষ দিল, তার চেয়ে অধিক দুষতে থাকল রাজা দশরথকে।

রামচন্দ্র জননী কৌশল্যার কাছে এসে নির্বাসনের কথা জানাল। বিলাপে-বেদনায় অবশ হয়ে পড়লেন কৌশল্যা। স্ত্রৈণ রাজা দশরথ তাঁকে যে আগের অধিক অবহেলা দেখাবেন, কৈকেয়ী যে তাঁর ওপর অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেবেন, বিলাপে বলে গেলেন কৌশল্যা।

মায়ের বিলাপ, লক্ষ¥ণের ক্রোধোক্তি শুনে গেল রাম। পিতার সত্যরক্ষার সম্মানে কোনও কিছু গায়ে মাখল না সে। রামের সঙ্গে বনে যাবে বলে প্রতিজ্ঞা করল লক্ষ¥ণ। বহু বাদানুবাদের পর সীতাও রামকে সম্মত করাল যে বনবাসে সীতা তার অনুগামী হবে।

বনগমনের জন্য একেবারে প্রস্তুত হয়ে রাম দশরথের কাছে শেষ বিদায়ের জন্য এল। সঙ্গে সীতা ও লক্ষ¥ণ। দশরথ আরেকটা রাত অযোধ্যায় থেকে যাবার জন্য রামকে অনুরোধ করলে রাম অসম্মতি জানাল।

প্রাসাদনারীরা কাঁদতে থাকল, কৌশল্যা-সুমিত্রা কেঁদে কেঁদে মাটিতে লুটাতে থাকলেন, মন্ত্রী-অমাত্যরা ক্রুদ্ধচোখে কৈকেয়ীর দিকে তাকাতে লাগলেন। সুমন্ত্রও নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না।

শুধু অবিচল থাকলেন ছোটরানি কৈকেয়ী। তাঁর চোখে একফোঁটা জল নেই, মুখে কোনও বিকার নেই।

সুমন্ত্র থাকতে পারলেন না আর, ‘তুমি স্বামীকে খেলে কৈকেয়ী! ইক্ষ¡াকুবংশকে ধ্বংস করলে! তুমি তোমার ছেলে ভরতকে নিয়ে রাজ্যশাসন কর। আমি আর এ দেশে থাকব না। রামের সঙ্গে বনবাসে যাব।’ দাঁত কড়মড় করতে লাগলেন সুমন্ত্র, হাতে হাত ঘষতে লাগলেন, মাথা ঝাঁকাতে থাকলেন।

সুমন্ত্রের কথাতে কৈকেয়ীর মধ্যে কোনও ভাব-বিচার দেখা গেল না।

রাজা দশরথ বুঝে গেলেন―রামচন্দ্রকে কিছুতেই আটকানো যাবে না। কাতর কণ্ঠে বললেন, ‘রামদের সঙ্গে যাবে তুমি সুমন্ত্র। রথ নিয়ে যাবে।’

সেদিনেই রামরা বনে যাত্রা করল।

দশরথ কৈকেয়ীর ঘর থেকে কৌশল্যার ঘরে চলে এলেন। এরপর রাজা মাত্র পাঁচদিন বেঁচেছিলেন। কৌশল্যার কোলে মাথা রেখেই দশরথ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন।

কৈকেয়ীর ডাকে কৈকয়রাজ্য থেকে ভরত অযোধ্যানগরীতে এলে পরিস্থিতি একেবারে পালটে গেল।

পিতার খোঁজে ভরত প্রথমে জননী কৈকেয়ীর ঘরে ঢুকল। সে জানে―তার পিতার অধিকাংশ সময় কাটে তার জননীর কক্ষে। কিন্তু সেখানে বাবাকে না পেয়ে বেশ অবাক হলো ভরত। সেই অবাক হওয়ার কথা মাকে বললও সে, ‘কী ব্যাপার মা! বাবা তো বেশির ভাগ সময় তোমার এই ঘরেই থাকেন, এখন নেই কেন ? তিনি কোথায় এখন ? আমি তাঁকে পা ছুঁয়ে প্রণাম করতে চাই। তিনি কি এখন মা-কৌশল্যার ঘরে ?’

মনে মনে পুত্রের প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বেড়ালেন কৈকেয়ী। শেষে দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন, ‘জীবনের শেষে সমস্ত মানুষের যে গতি হয়, তোমার পিতাও সেই গতি লাভ করেছেন বাছা।’

চিৎকার করে উঠল ভরত, ‘দার্শনিক কথা রাখো মা। সহজ ভাষায় বল, বাবা এখন কোথায় ?’

অসামান্য বাক্য কৌশল কৈকেয়ীর, ‘দেখো, তোমার পিতা হা রাম, লক্ষ¥ণ কোথায়, সীতা কোথায়―এই হাহাকার করতে করতে মারা গেছেন। জটা-চীর ধারণ করে রাম-লক্ষ¥ণ-সীতা বনে চলে গেছে।’

এর পর সেই চরম বাসনার কথাটি উচ্চারণ করলেন কৈকেয়ী, ‘রাম পিতৃসত্য রক্ষার জন্য বনে গেছে। তোমার পিতা মারা গেছেন। অযোধ্যার সিংহাসন এখন নৃপতিশূন্য। তুমি আমার ধর্মজ্ঞ পুত্র। তুমি এবার অযোধ্যার রাজা হও। যা যা করেছি আমি, তোমার ভালোর জন্যই করেছি পুত্র।’

কৈকেয়ীর কথায় গলল না ভরত। উপরন্তু রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে পুত্র হয়ে মাকে যে যে তিরস্কার করা যায় না, তা-ই করল ভরত। মায়ের সঙ্গে জীবনে আর কোনওদিন বাক্যালাপ করবে না বলে প্রতিজ্ঞা করল। রাজজননী কৌশল্যার সঙ্গে দেখা করে কৈকেয়ীর অপরাধকর্মের জন্য ক্ষমা চাইল।

ভরত-শত্রুঘ্নের হাতে মন্থরা চরমভাবে লাঞ্ছিত হলো। কৈকেয়ীর কক্ষে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে রক্ষা পেল মন্থরা।

পিতার শ্রাদ্ধশান্তি হয়ে যাবার পর ভরত ঘোষণা করল― যে-করেই হোক, অরণ্য থেকে দাদাদের ফিরিয়ে আনবে।

রামচন্দ্রকে ফিরিয়ে আনবার জন্য বনযাত্রা শুরু করল ভরত। সঙ্গে বিশাল এক সৈন্যবাহিনী। সমস্ত অযোধ্যাবাসী ভরতের সঙ্গে চলল। কৌশল্যা আর সুমিত্রাও রথে চড়ে বসলেন। মুখটা কালোকাপড়ে ঢেকে কৈকেয়ীও রথারোহণ করলেন।

ভরতের শত কাকুতি-বিনতি, মা-দের আর্তনাদ-আহাজারিতেও রাম কিন্তু অযোধ্যায় ফিরে এল না। সে যে পিতৃসত্য রক্ষা করার প্রতিজ্ঞায় আবদ্ধ!

ভরত ফিরে এসেছে রামের পাদুকা নিয়ে। সেই পাদুকা সিংহাসনে স্থাপন করে অযোধ্যা থেকে দূরের নন্দীগ্রামে রামচন্দ্র ফিরে না আসা পর্যন্ত অযোধ্যা রক্ষণাবেক্ষণ করে যাবে বলে ঘোষণা করল। আর প্রতিজ্ঞা করল―সে আর কোনও সুখশয্যায় শয়ন করবে না, মাথায় জটা বাঁধবে, বল্কল পরবে এবং ফলমূল আহার করে কালাতিপাত করবে।

উনিশ

সুমন্ত্র রথে করে রাম-লক্ষ¥ণ-সীতাকে অরণ্যে নিয়ে এসেছিলেন।

রথের পেছন পেছন সমগ্র অযোধ্যানগরীর সাধারণ মানুষ ছুটতে শুরু করেছিল। বনবাসের প্রথম রাতে তমসানদীর তীরে খুব তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল রামচন্দ্র। অনুগামী পুরবাসীকে দেখে ভীত হয়ে অতি প্রত্যুষে সে স্থান থেকে পালিয়ে গিয়েছিল রামচন্দ্ররা।

অনেক জনপদ-নদী অতিক্রম করে রামরা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকল। একদিন গঙ্গার কাছাকাছি চলে এল তারা। সেখানে নিষাদরাজ গুহের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটল তাদের। এই অঞ্চলের রাজা গুহ।

নিষাদরাজ রামচন্দ্রদের সাদর অভ্যর্থনা জানাল। চব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয়―নানারকম খাবার রামদের জন্য রাজপ্রাসাদ থেকে নিয়ে এসেছিল গুহ। পিতৃসত্য পালনের কথা বলে সেই খাবার গ্রহণ করল না রাম। রামের ইচ্ছা―লোকালয় ছেড়ে আরও আরও দক্ষিণে যাওয়া।

পরের দিন গঙ্গা পার হবার জন্য বড় একটি নৌকার ব্যবস্থার করল নিষাদরাজ। সেখান থেকে সুমন্ত্র রামচন্দ্রের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।

ফিরে যাবার আগে সুমন্ত্রকে রামচন্দ্র অদ্ভুত এক কথা বললেন, ‘বাবা বৃদ্ধ হয়েছেন। শোকে যেমন তিনি অবসন্ন, আবার কামভাবেও জর্জরিত। মা-কৈকেয়ীর প্রতি ভীষণভাবে কামনাসক্ত তিনি। আপনারা বাবার বিরোধিতা করবেন না। বেশি বিরোধিতা করলে বিচলিত হবেন তিনি। তাতে রাজকার্য বিঘ্নিত হবে। দেশের ক্ষতি হবে খুব তখন। পিতাকে দেখবেন আপনি। আপনি শুধু মন্ত্রী বা সারথি নন, ইক্ষ¡াকুবংশের মস্ত বড় এক সুহৃদও।’

চোখের জলে বুক ভাসিয়ে সীতা-লক্ষ¥ণকে নিয়ে নৌকায় উঠেছিল রামচন্দ্র।

গঙ্গা পার হয়ে কিছুদূর যেতেই জনপদচিহ্ন শেষ হয়ে গেল। শুরু হলো শ্বাপদসংকুল অরণ্য। সীতার নিরাপত্তার কথা ভেবে রাম খুব বিচলিত হয়ে পড়ল।

সন্ধ্যা হলে তিনজনেই মাটিতে শুয়ে পড়ল। এই প্রথম অরণ্যরাত্রি, যেখানে নিষাদরাজ গুহ, সুমন্ত্র সারথি―কেউই নেই।

সীতা-লক্ষ¥ণ ঘুমিয়ে গেলেও রামের চোখে ঘুম এল না। নানা কথা মনে পড়তে লাগল তার, নানা স্মৃতি চোখে ভেসে বেড়াতে লাগল। এই প্রথম তার মনে হলো―মহারাজ দশরথের দুর্দশা, তার নির্বাসন এবং ভরতের রাজ্যলাভ―এসবের জন্য কৈকেয়ীই প্রধানত দায়ী। পিতা দশরথের সত্যি কোনও বুদ্ধি-বিবেচনা নেই। তাঁর বুদ্ধিহীনতার জন্য তার পরিবর্তে ভরত অযোধ্যার রাজা হলো।

ঘুমন্ত সীতার দিকে তাকিয়েছিল রাম। অপরাধবোধে মনটা হঠাৎ বিচলিত হয়ে উঠল রামের―এই সীতাকে নিয়ে একদিন মিথিলা থেকে অযোধ্যায় ফিরেছিল সে। প্রাসাদীয় কর্মব্যস্ততায় সুন্দরী স্ত্রীটির দিকে তেমন করে তাকায়নি পর্যন্ত। প্রকৃতপক্ষে সীতাকে তার যথাযোগ্য মর্যাদাই দেয়নি সে অযোধ্যার প্রাসাদে। আজ সেই সীতা তারই অনুগামী হয়ে অরণ্যভূমিতে শুয়ে আছে।

পরদিন ভরদ্বাজ মুনির আশ্রমে উপস্থিত হলো রামরা। ঋষি ভরদ্বাজ তাঁর আশ্রমে বনবাসের কালটা কাটিয়ে দেবার জন্য বললেন। রামচন্দ্র রাজি হলো না।

বলল, ‘আপনার আশ্রম এক পবিত্রভূমি মহর্ষি। আমরা যতই জটা-চীরধারী হই না কেন, অন্তরে তো আমাদের গার্হস্থ্যবোধ বিরাজমান। দাম্পত্যজীবনের প্রভাব এই আশ্রমের ওপর পড়বে একদিন না একদিন। তাতে আশ্রমিকধর্ম বিঘ্নিত হবে। তাই আমরা এখানে থাকতে চাই না মুনিবর।’

চমৎকৃত হয়ে রামের দিকে তাকিয়ে থাকলেন ঋষি ভরদ্বাজ। মনে মনে ভাবতে থাকলেন―এ তো অল্পবয়সী কোনও যুবকের কথা নয়! এ তো বুদ্ধি বিবেচনাসম্পন্ন একজন সমৃদ্ধ মানুষের কথা!

রাম আবার বলল, ‘বরং আপনি আমাদের এমন একটা স্থানের সন্ধান দিন, যেখানে নিরাপদে এবং স্বস্তিতে বনবাসের চৌদ্দটি বছর কাটিয়ে দিতে পারব।’

ভরদ্বাজ রামচন্দ্রকে চিত্রকুটের ঠিকানা দিলেন।

বললেন, ‘ওই স্থানটি তোমাদের জন্য সুখকর হবে।’

ঋষি ভরদ্বাজের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে একদিন রামচন্দ্ররা চিত্রকুট অঞ্চলে উপস্থিত হলো।

এখানেই ভরত সসৈন্যে এসে রামের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিল।

এই সুরম্য চিত্রকুটেও শেষ পর্যন্ত রামচন্দ্র থাকেনি। ভরতের সহাগত হস্তি-অশ্বের মলমূত্রে চিত্রকুটের আবাসস্থলও বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। তাই একদিন চিত্রকুট ছাড়ল রাম। আরও দক্ষিণে অগ্রসর হতে থাকল। দক্ষিণমুখী যাত্রাপথে খানিক পর পরই মুনিদের আশ্রম পাওয়া যাচ্ছে। এইভাবে তারা অত্রি ঋষির আশ্রম, শরভঙ্গ মুনির আশ্রম, সুতীক্ষè তপস্বীর আশ্রম পেল।

এই আশ্রমগুলির মাঝখানে মাঝখানে অনার্যজনগোষ্ঠীর বসবাস। দৈত্য, অসুর, নাগ, পক্ষী, রাক্ষস―এসব জনজাতির মানুষেরা আর্য ঋষিদের কার্যকলাপ মোটেই পছন্দ করত না। তারা মাঝে সাঝে ঋষিদের যজ্ঞানুষ্ঠান ভণ্ডুল করে দিত। রামকে পেয়ে মুনিঋষিদের অনেকেই অনার্যজনজাতির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন।

তাঁরা বলেছেন, ‘তুমি এখানে আসার পর ওদের উপদ্রব অনেক গুণ বেড়ে গেছে রাম। ওদের মোকাবিবলা করার শক্তি আমাদের নেই। রাম, তুমি ওই দুর্বৃত্তদের হাত থেকে আমাদের রক্ষা করো।’

আরেক ঋষি বললেন, ‘তুমি এখানে থেনো না রাম। যে কোনো সময় ওরা তোমাদের বড় ধরনের ক্ষতি করবে।’

ওই ঋষিস্থান ত্যাগ করে রাম-সীতা-লক্ষ¥ণ দণ্ডকারণ্যের সুতীক্ষè ঋষির আশ্রমে উপস্থিত হয়েছে।

ঋষি সুতীক্ষè রামকে বলেছেন, ‘এই আশ্রমে কোনও উপদ্রব নেই বৎস। অনার্যদের তেমন উৎপাতও নেই। একমাত্র হরিণ ছাড়া তোমাদের আর কেউ বিরক্ত করবে না। তোমরা থাক আমার আশ্রমে, নিশ্চিন্তে বাস কর।’

‘আমার যে এক স্থানে বেশিদিন বাস করতে ভালো লাগে না মহাত্মন!’ বিনীত কণ্ঠ রামের।

‘তাহলে তুমি এক কাজ করো রাম, এই দণ্ডকারণ্যে আরও বহু মুনিঋষির আশ্রম আছে। সেই সব আশ্রম তুমি ঘুরে ঘুরে দেখো। ভালো লাগলে দু-একটা জায়গায় থাকো কিছুদিন করে। কিন্তু আবার ফিরে এসো এই আশ্রমে।’

সুতীক্ষè মুনির কথা মান্য করে রাম-লক্ষ¥ণ-সীতা বেরিয়ে পড়ল। দণ্ডকারণ্যের বিভিন্ন স্থানের কোথাও ছয় মাস, কোথাও চার মাস, কোথাও-বা পাঁচ মাস থাকল তারা।

এইভাবে বনবাসের চৌদ্দ বছরের দশ বছর কেটে গেল।

নানা স্থান ঘুরে তারা পুনরায় সুতীক্ষè ঋষির আশ্রমে ফিরে এল।

পূর্বে রামের কাছে আর্যঋষিরা রাক্ষসদের অত্যাচারের যে অভিযোগ করেছিলেন, রামরা ফিরে আসার পর সেই অভিযোগ আবার করতে শুরু করলেন তাঁরা। ক্ষিপ্ত হয়ে রাম রাক্ষসদের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলবেন বলে ঋষিদের সামনে অভিপ্রায় প্রকাশ করল। এতে সীতা খুব ভয় পেয়ে গেল। এই দূর বনে পিতৃসত্য রক্ষা করতে এসে জটা-চীরধারী রামের ক্ষত্রিয়সুলভ যুদ্ধে জড়ানো মোটেই পছন্দ হলো না সীতার। সীতা অনুরোধ-উপরোধ করে রামকে রাক্ষসনিধন থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করল। ব্রাহ্মণ তপস্বীদের সুরক্ষা দেওয়া আর্যরাজার কর্তব্য―এই অজুহাত দেখিয়ে সীতার অনুরোধকে অগ্রাহ্য করল রাম।

সীতা বিক্ষুব্ধ হয়ে বলল, ‘দণ্ডকারণ্যবাসী ঋষিদের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে তুমি যে রাক্ষসনিধনে উদ্যোগী হচ্ছ, তাতে আমার কোনও সমর্থন নেই। আমি মনে করি―তুমি নিরপরাধী কিছু মানুষকে হত্যার উদ্যোগ নিচ্ছ।’

রাম আপাতত চুপ করে থাকলেও তার চোখমুখ দেখে বোঝা গেল―সে নিজ সিদ্ধান্ত থেকে এক চুলও নড়েনি।

সুতীক্ষè মুনির আশ্রম থেকে আবারও বেরিয়ে পড়ল রাম। তাকে যেন অরণ্য পেয়ে বসেছে! যতই দক্ষিণে অগ্রসর হয়েছে রাম, অরণ্যানী আরও ঘন, সবুজ, আকর্ষণীয় হয়েছে। এই অরণ্যঘোরে পড়ে রাম সস্ত্রীক, সভ্রাতা দক্ষিণ থেকে আরও দক্ষিণে এগিয়ে গেছে।

হাঁটতে হাঁটতে একদিন অগস্ত্য মুনির আশ্রমে এসে পৌঁছাল রামরা। পরিচয় পেয়ে ঋষি অগস্ত্য রামদের বড় আদর-যত্ন করলেন। বেশি অবাক হলেন সীতাকে দেখে। স্বামীর জন্য রাজসুখ বিসর্জন দিয়ে প্রাণান্তকর অরণ্যে বছরের পর বছর কাটিয়ে দেওয়া নারীটি ঋষির মনে গভীর রেখাপাত করল। সীতার দিকে বাৎসল্যভরা চোখে তাকিয়ে থাকলেন অগস্ত্য।

অগস্ত্য-আশ্রমেও বেশিদিন ভালো লাগল না রামের।

বসবাসের জন্য আরও সুন্দর কোনও স্থান আছে কিনা রাম ঋষি অগস্ত্যের কাছে জানতে চাইল।

অগস্ত্য বললেন, ‘আছে একটা জায়গা। অত্যন্ত মনোরম। বৃক্ষবহুল। পাশেই গোদাবরী নদী। যাবে তুমি সেখানে, রাম ?’

ঋষির কথায় রাম উৎফুল্ল হয়ে উঠল, ‘তাহলে তো খুব ভালো হয় ঋষিবর! চৌদ্দ বছর পূর্ণ হতে আর বেশিদিন বাকি নেই। সেই সময়টুকু সীতাকে নিয়ে আমি ওই স্থানে কাটিয়ে দিতে চাই। আপনি দয়া করে সেই স্থানের নাম বলুন এবং কী করে আমরা সেখানে পৌঁছাব তারও নির্দেশনা দিন।’

রামের কথা শুনে প্রীত হলেন অগস্ত্য। বললেন, ‘সেই স্থানের নাম পঞ্চবটী। আমার আশ্রম থেকে কয়েক যোজন দক্ষিণে এগিয়ে গেলে পঞ্চবটীতে পৌঁছে যাবে তুমি। আমার বিশ্বাস―ওই স্থানটি তোমার পছন্দ হবে নিশ্চিত।’

এক প্রত্যুষে মুনি অগস্ত্যকে প্রণিপাত করে আবার পথচলা শুরু করল রামরা।

পঞ্চবটীতে প্রবেশের মুখে জটায়ু নামের এক অনার্য মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল দশরথপুত্রদের। জটায়ু বয়োবৃদ্ধ। শকুন জনজাতির মানুষ তিনি। একসময় এই জনজাতির রাজা ছিলেন তিনি। এখন অলস জীবন কাটছে তাঁর।

তাঁকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে যাবার সময় জটায়ু বললেন, ‘কে তোমরা ? কোথায় যাও ?’

থমকে গিয়েছিল রামরা। লক্ষ¥ণ বাধা দিলেও রাম জটায়ুর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

বলেছিল, ‘আমরা দুজন দশরথপুত্র। আমি রাম, ও লক্ষ¥ণ। আর ওই যে দাঁড়িয়ে আছে যে-নারীটি, সে আমার পত্নী। সীতা তার নাম।’

বসা থেকে তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াতে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে গেলেন জটায়ু। রাম তাঁকে ধরে দাঁড় করালেন।

বলিরেখাময় জীর্ণ মুখে যত আদরের চিহ্ন প্রকাশ করা যায়, ততটুকু প্রকাশ করে জটায়ু বললেন, ‘তোমরা রাজা দশরথের পুত্র! ও পুত্রবধূ! আহা, আহা! তোমাদের দেখে বড় আনন্দ লাগছে আমার!’

দীর্ঘ একটা শ্বাস ত্যাগ করে জটায়ু আবার বললেন, ‘তোমার বাবা আমার বন্ধু ছিল। আমাকে একবার নিমন্ত্রণ করে অযোধ্যাতে নিয়েও গিয়েছিল দশরথ। তা বাবা, রাজপুত্র হয়ে তোমরা এখানে কেন ?’

পিতৃবন্ধুর পরিচয় পেয়ে বিগলিত হলো রাম। সংক্ষেপে তাদের বনে আসার বৃত্তান্ত জানাল এবং শেষে বলল, পিতা আমাদের ছেড়ে স্বর্গলোকে চলে গেছেন।’

কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে জটায়ু বললেন, ‘যদি কোনও সাহায্যের দরকার হয় কোনওদিন, আমাকে বলো বাছা। আর যা-ই পারি না-পারি, সীতাকে দেখাশোনা করতে পারব আমি।’

জটায়ুকে ছাড়িয়ে সামান্য পথ যাওয়ার পর একটা স্থান রামের পছন্দ হয়ে গেল। দেখল―জায়গাটি ঘিরে পাঁচ ধরনের বটবৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে। তাদের ছায়ায় স্থানটি সুশীতল। আশপাশটায় দ্রুত চোখ বোলাল রাম।

মুগ্ধ চোখে বলে উঠল, ‘এই স্থানটি আমার বড় পছন্দ হয়ে গেছে লক্ষ¥ণ। সীতা, তোমার পছন্দ হয়নি ? লক্ষ¥ণ, তোমার কি ভালো লাগছে এই জায়গাটা ? ঋষি অগস্ত্য যে পঞ্চবটীর কথা বলেছিলেন, এটাই সেই পঞ্চবটী। এই, এই যে পাঁচ রকমের পাঁচটি বটগাছ দেখছো না ?’ শিশুসুলভ কণ্ঠে একনাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল রাম।

লক্ষ¥ণ-সীতারও বেশ পছন্দ হলো স্থানটি। রামের আদেশে কয়েক দিনের চেষ্টায় সেখানে একটা পর্ণকুটির দাঁড় করিয়ে ফেলল লক্ষ¥ণ। বাকি সময়টুকু এখানে কাটিয়ে দিয়ে অযোধ্যায় ফিরে যাবে বলে মনস্থ করল রাম।

রাম ভাবল বটে অযোধ্যার ফিরে যাবার কথা, কিন্তু নিয়তি আড়ালে বসে মুচকি হাসলেন। হয়তো বললেন, তোমার জীবনে আরও যে কত বিড়ম্বনা আছে, জানো না তুমি রাম! আর ওই যে সীতা, তার দুঃখকথায় গাছের পাতা পর্যন্ত অকালে ঝরে পড়বে একদিন।

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button