আর্কাইভউপন্যাস

সায়েন্স ফিকশন উপন্যাস : উষ্ণতা : দীপু মাহমুদ

অনেক দিন পর আজ আমার নিয়মের ব্যতিক্রম হলো। রাতে কফি খাচ্ছি। কড়া ব্ল্যাক কফি। অ্যামেরিকানো। চুমুক দিতেই মুখের ভেতর তেতো ভাব ছড়িয়ে পড়ল। সন্ধ্যায় এক কাপ চা খাই। হালকা লিকারের গ্রিন টি। সকালে নাস্তার পর কাজে যাওয়ার আগে খাই মগভরতি ব্ল্যাক কফি। সারা দিনে আর চা বা কফি খাওয়ার অভ্যাস আমার নাই। রাতে অবশ্যই খাই না। আজকের ঘটনা আলাদা।

রাত বাজে দশটা পঁয়ত্রিশ। আমার ঘুমুতে যাওয়ার সময় এক ঘণ্টা পাঁচ মিনিট পেরিয়ে গেছে। রাত সাড়ে নয়টার ভেতর ঘুমিয়ে পড়ার চেষ্টা করি। আমার ঘুমুতে সমস্যা হয় না। বিছানায় শোয়ামাত্র ঘুম চলে আসে। আজ ঘুমুতে যেতে পারিনি।

কফির মগ হাতে ঘরের বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছি। এ পাশটা আমার বাড়ির পেছনের দিক। ব্যাকইয়ার্ডে তুলতুলে নরম ঘাস। বিকালে সেখানে হাঁটি। হাঁটতে ভালো লাগে। পুরো জায়গাটা ফাঁকা। সেখানে কোনও গাছ নেই। গাছ আছে ব্যাকইয়ার্ডের বেড়ার ওপাশে। লম্বা পাইন গাছ। অনেকখানি জায়গাজুড়ে গভীর পাইন বন। তার ওপাশে পাহাড় থেকে নেমে আসা চওড়া পানির ধারা বয়ে গেছে।

পাইন বনের ভেতর দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে আমার ঘরের বারান্দায়। আকাশে সাদা মেঘের ভেতর দিয়ে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। পূর্ণচন্দ্র নয়, আধখানা চাঁদ। আলো তীব্রভাবে ছড়িয়ে পড়েনি। পাইন গাছের পাতার ফাঁকফোকর গলে আসছে। পাইন বনের ওপাশ থেকে ভেসে আসছে ঝিরঝিরে ঠান্ডা বাতাস। প্রশান্তিতে ঘুম চলে আসার কথা। আমার ঘুম আসছে না। ব্রেইনের নিউরন হয়ে আছে উত্তেজিত। আমার ব্রেইন যখন কোনও সমস্যার সমাধান করতে পারে না তখন উত্তেজিত হয়ে থাকে। সমাধান পর্যন্ত না পৌঁছালেও অন্তত সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া অবধি। বিকাল থেকে অদ্ভুত অচেনা এক যন্ত্র নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছি। দিশা পাচ্ছি না।

পুরাতন অকেজো ইলেকট্রনিক্স যন্ত্র নিয়ে এসে চালু করার অভ্যাস আমার। বলা যায় নেশার মতো। তাতে মনে হয় মৃত কোনও কিছুতে পুনঃপ্রাণ প্রতিষ্ঠা করছি। একবার এক রেডিয়ো কিনে নিয়ে এলাম। এটা আদতেই রেডিয়ো। বহু বহু বছর আগে এই যন্ত্রের প্রচলন ছিল। বহু বহু বছর আগেই এই যন্ত্র হারিয়ে গেছে। আচমকা আমি পেয়ে গেছি রেডিয়োর বিচ্ছিন্ন কয়েকটা টুকরো। ইলেকট্রনিক অসিলেটর সার্কিট বোর্ড, কনডেনসার, অ্যামপ্লিফায়ার টিউব আরও অনেক কিছু।

যে এগুলো আমার কাছে বিক্রি করছিল সেও জানে না এগুলো কিসের যন্ত্র। আমিও ঠিকঠাক ধারণা করতে পারিনি। বাড়িতে নিয়ে এসে যখন সেগুলো জুড়ে দিলাম তখন শুনি সেখান থেকে শব্দ আসছে। ঘরের শক্তিশালী এন্টেনার সঙ্গে সংযুক্ত করলাম। অমনি শুনতে পেলাম কেউ একজন হো হো করে হাসছে। কে এমনভাবে হাসছে জানি না। তবে যন্ত্রের ভেতর থেকে শব্দ আসছে। কেউ একজন বলল, আপনি বড্ড বোকা। দুঃখিত, বোকা বললাম বলে মনে কষ্ট নেবেন না। তবে এ মুহূর্তে বোকা ছাড়া আপনার জন্য আর কোনও যথার্থ শব্দ খুঁজে পাচ্ছি না।

তখন আরেকজন বলল, কেন আমাকে আপনার বোকা মনে হচ্ছে ?

কারণ আপনি ভাবছেন মানুষের ধ্বংস ত্বরান্বিত করতে বাতাসে কীভাবে কার্বন মনোক্সাইড ছড়ানো হচ্ছে তা আমরা শনাক্ত করতে পারিনি। ভুল। যারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে তাদের আমরা চিহ্নিত করেছি। হাই কমান্ডের অনুমতির অপেক্ষায় আছি ঘটনা জনসমক্ষে আনার জন্য।

আমার ভাবনায় চট করে যে শব্দটি এল তা হচ্ছে নাটক। নাটকে সংলাপ থাকে। নাটক শব্দ মিলিয়ে মাথায় এল রেডিয়ো নাটক। তখন মনে হলো এটা রেডিয়ো। আদিকালের এক যন্ত্র। রেডিয়ো ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে মডিউল সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছে।

কিন্তু এখন তো কোনও রেডিয়ো স্টেশন নেই। যেখান থেকে নাটক প্রচারিত হবে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে কোনও এক ফ্রিকোয়েন্সিতে এই আদি যন্ত্র সচল হয়ে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভে দুজনের কথোপকথন ধরেছে। এটা রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ গোপন আলাপ হতে পারে ভেবে রেডিয়োর সমস্ত সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিলাম। তবে আনন্দ পেয়েছি সীমাহীন। আদিকালের মৃত এক যন্ত্রকে বাঁচিয়ে তোলার আনন্দ।

 সেই রাতে করুণ গানের সুরে আমার ঘুম ভাঙল। ঘরে নীল আলো জ¦লছে। স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে ঘরের ভেতরের সবকিছু। কোথাও কেউ নেই। তবে কে এমন মন খারাপ করে গান গাইছে। ভীষণ পরিচিত গান। পরিচিত গলা। অর্থাৎ যে শিল্পী এই গানটি গেয়েছেন তিনিই গাইছেন। কিন্তু তিনি কীভাবে আমার বাড়িতে আসবেন!

হঠাৎ ঘুম ভেঙে আমার সবকিছু তালগোল পাকিয়ে যেতে থাকল। বিছানা থেকে নেমে এলাম। গানের আওয়াজ আসছে আমার ঘরের পাশের ল্যাবরেটরি থেকে। দরজা আলগা করে উঁকি দিলাম। সেখানে কেউ নেই। থাকার কথা নয়। মনে হচ্ছে অধিক উত্তেজনায় আমার হ্যালোসিনেশন হচ্ছে। উত্তেজিত মস্তিষ্ক আমাকে বিভ্রান্ত করছে।

ল্যাবে ঢুকলাম। টেবিলের ওপর সারিবদ্ধ সার্কিট জ¦লছে আর নিভছে। ঘটনা তখন বুঝতে পারলাম। ঘুমুতে যাওয়ার আগে রেডিয়োর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছিলাম। পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন হয়নি। কোনও এক ব্রডকাস্ট ট্রান্সমিটারের ক্যারিয়ার ওয়েভের সঙ্গে রেডিয়ো ফ্রিকোয়েন্সি মিলে গেছে। সেখান থেকে পাঠানো গান শোনা যাচ্ছে এই রেডিয়োতে।

রেডিয়ো বন্ধ করতে ইচ্ছে হলো না। মনে হলো গান বাজুক। গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর চেষ্টা করি। আমরা তো কত কিছুর সঙ্গে মানিয়ে নিতে চাই। একরাতে গান শুনতে শুনতে ঘুমানোর সঙ্গে না হয় মানিয়ে নিলাম, ব্যাপারটা যখন ভালো লাগছে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে অফিসে যাওয়ার আগে দেখলাম চার্জ শেষ হয়ে রেডিয়ো একাই বন্ধ হয়ে গেছে। রেডিয়োর খুচরো যন্ত্রগুলো প্যাকেটে ভরে তাতে নাম আর দিনতারিখ লিখে ল্যাবের আর্কাইভ জোনে রেখে দিলাম। 

রাস্তার পাশে ফেলে দেওয়া জিনিস আমি কুড়িয়ে আনি। কখনও ভাঙারির দোকান থেকেও কিনি। পুরানো জিনিস বেচাকেনার দোকান আছে আমার অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে। আজ এই যন্ত্র কিনেছি সেখান থেকে।

 দোকানদার বলতে পারল না এটা কিসের অংশ। আমার দেখে মনে হলো সাইবর্গ। বললাম তাকে, দেখে তো মনে হচ্ছে ভাঙা সাইবর্গ।

লোকটা অমনি চমকে উঠল। তাকে ভীত দেখাচ্ছে। পুরানা সাইবর্গ কিংবা রোবটের যন্ত্রাংশ বিক্রি আইনত নিষিদ্ধ। ধীরে ধীরে পৃথিবী রোবটের দখলে চলে যাচ্ছে। আবিষ্কারে উন্মত্ত হয়ে সেই পথ তৈরি করে দিচ্ছে মানুষ।

এখন সব হিউম্যানয়েড রোবট তৈরি হচ্ছে। তাদের আর রোবট বলা যাচ্ছে না। তারা সাইবর্গ। সাইবারনেটিক অর্গানিজম। রোবটে বায়োমেট্রিক আর জীবদেহের অর্গ্যান নিয়ে এই কৃত্রিম প্রাণী তৈরি করা হচ্ছে। পশু-পাখি দিয়ে শুরু হয়েছিল। এখন দেদারসে তৈরি হচ্ছে মানুষ। আদিতে মানুষের শরীরে কৃত্রিম অঙ্গ সংযোজন করা হতো। এখন রোবটের শরীরে মানব অঙ্গ সংযোজন করে সাইবর্গ বানানো হচ্ছে। তারা দেখতে অবিকল মানুষের মতো। মানুষের মতো সব কাজ করে। আবেগ প্রকাশের ভঙ্গিও এক।

মানুষ সাইবর্গ বানাতে বিজ্ঞান কল্পকাহিনিকে কাজে লাগিয়েছে। তবে তার প্রতি সৎ থাকতে পারেনি। বিজ্ঞান কল্পকাহিনি লেখক আইজ্যাক আসিমভ ১৯৪২ সালে রানঅ্যারাউন্ড নামে এক বিজ্ঞান কল্পগল্প লেখেন। আসিমভ সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধির রোবট বিষয়ে তিনটি আইনের কথা বলেছেন, যা ‘থ্রি লজ অব রোবটিকস’ নামে বিখ্যাত।

১.            কোনও রোবট মানুষের ক্ষতি করতে পারবে না, অথবা ক্ষতির কারণ ঘটলে চুপ করে থাকবে না, থামাতে চেষ্টা করবে।

২.           রোবট মানুষের আদেশ-নিষেধ মানবে। তবে প্রথম আইনের পরিপন্থি কোনও আদেশ মানবে না।

৩.          রোবটের আত্মরক্ষার অধিকার আছে, নিজ অস্তিত্ব রক্ষার জন্য যে কোনও কিছু করবে, তবে সেটা প্রথম ও দ্বিতীয় আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে নয়। 

মানুষ সেসব নিয়মা ভেঙে সাইবর্গদের এখন ভয়ংকর পর্যায়েও নিয়ে এসেছে। তারা সাইবর্গ নামের এই কৃত্রিম মানুষের ভেতর স্বাভাবিক অনুভূতি দিচ্ছে। তবে সাইবর্গের মাত্রা অনুসারে অনুভূতি দেওয়া হয়। তৃতীয় আর চতুর্থ মাত্রার সাইবর্গ হচ্ছে কর্মী সাইবর্গ। তাদের ভেতর আত্মমর্যাদা বা আত্মসম্মানের কোনও অনুভূতি নেই। তাদের ভেতর আছে সংকীর্ণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।

অষ্টম মাত্রার সাইবর্গের ভেতর আত্মসচেতনতা বোধ আছে। তারা নিজেরা নিজের অবস্থা ও অবস্থান বদলে ফেলতে পারে। তাদের ভেতর আছে কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তা। আবার নবম মাত্রার সাইবর্গ থেকে মিথ্যা বলার প্রবণতা আছে। তারা হচ্ছে উচ্চ কৃত্রিম সাধারণ বুদ্ধিমত্তার সাইবর্গ। দশম মাত্রার সাইবর্গ অন্যের ক্ষতি করার এবং নিজেকে ধ্বংস করে ফেলার ক্ষমতা রাখে। তাদের ভেতর আছে কৃত্রিম অতি বুদ্ধিমত্তা।

দোকানদার আমার এলোমেলো যন্ত্র হাতে নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। তার ভেতর ভয় মেশানো হতভম্ব ভাব চলে এসেছে। এগুলো যদি সাইবর্গ বা সাইবর্গের যন্ত্রাংশ হয় তাহলে তাকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। সে শাস্তি পেতে চায় না।

যন্ত্রগুলো দেখিয়ে বললাম, আপনার কি মনে হচ্ছে না এগুলো সাইবর্গ বা সাইবর্গের সিস্টেম সার্কিট ?

দোকানদার আরও ঘাবড়ে গেল। সে আমতা আমতা করে বলল, আমার কিছু মনে হচ্ছে না। আমি ঠিক জানি না এগুলো কী।

জিজ্ঞেস করলাম, কোথায় পেয়েছেন ?

সে আতঙ্কিত গলায় বলল, আমাকে বিশ^াস করুন। মনে করতে পারছি না। অনেক জিনিসের ভেতর পড়ে ছিল।

অতি কম দামে দোকানদার আমাকে এটা দিয়ে দিয়েছে। বড় কাগজে মুড়িয়ে ব্যাগে ভরে বাসায় নিয়ে এসেছি।

রাতের খাবার সন্ধ্যায় সেরে নিই। আজকের খাবার আয়োজন ছিল বেশ ভালো। ব্রাউন ব্রেড, মিক্সড ভেজিটেবল, শশা, গাজর, লেটুস আর গুলানো ডিমে ডুবিয়ে আলু ভাজা। আরাম করে খেয়েছি।

ডিনার খেয়ে যন্ত্রটা নিয়ে বসলাম। আমার অনুমান সত্য। এটা সাইবর্গের মেজর সার্কিট বোর্ড। এক এক করে সব কয়টি সার্কিট পরীক্ষা করেছি।

ইনপুট সেন্সর পাওয়া গেছে। বাটন, ক্যামেরা। পরিবেশ থেকে এসব ডিভাইস ব্যবহার করে সাইবর্গে ইনপুট দেওয়া হয়। মেইন প্রসেসরও পেয়ে গেলাম। সাইবর্গ কোনও অনুভূতি পাওয়ার পর সিদ্ধান্ত নিতে প্রসেসর ব্যবহার করে। আউটপুট ডিভাইসের অনেক ক্ষতি হয়েছে। শরীর বলে কিছু নেই। তবে সেখানে এলইডি, বাযার, বিভিন্ন অ্যাকচুয়েটর, মোটর পাওয়া গেল। ডিসপ্লে, হাত-পা, মাথা মনে হচ্ছে খুলে নেওয়া হয়েছে।

এক এক করে ডিভাইসগুলো দেখছি আর আমার ভেতর উত্তেজনা বাড়ছে। মনে হচ্ছে এখুনি সাইবর্গ কথা বলে উঠবে। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম, তার ভেতর অ্যাটমিক ব্যাটারি ছাড়াও ব্যাক-আপ হিসেবে ৩.৭ কিলোওয়াট/ঘণ্টা সক্ষমতার লিথিয়াম ব্যাটারি আছে। যে দুটো ব্যাটারি এখনও অক্ষত। সাইবর্গের সাধারণ কাজকর্ম করার জন্য অল্প শক্তির প্রয়োজন হয় কিন্তু অতিরিক্ত চাপ মোকাবিলার জন্য অধিক শক্তির প্রয়োজন পড়ে।

আমার মতো শান্ত মানুষের ভেতর আলোড়ন তুলে ফেলল সাইবর্গের মেমোরি ডিভাইস। তার মানে হচ্ছে যন্ত্র চালু হলে তার কাছ থেকে সব জানা সম্ভব হবে।  

গভীরভাবে সবগু সার্কিট পরীক্ষা করলাম। আরও কিছু ডিভাইসের সন্ধান পেয়েছি। দূরত্ব পরিমাপের জন্য লেজার সেনসিং আছে। এ ছাড়া গভীরতা পরিমাপের জন্য মানুষের চোখের দৃষ্টির মতো দুটো ক্যামেরা আছে।

যেখানে যতটুকু অসুবিধা ছিল তা মেরামত করা হয়েছে। চার্জ আছে যথেষ্ট। যন্ত্র চালু হওয়ার কথা, চালু হচ্ছে না। আমার ধৈর্য পর্বতের মতো। দীর্ঘ সময় স্থির থাকে। কখনও মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হয় না। তবু বিচলিত বোধ করছি। না-পারার অস্থিরতা আমাকে পেয়ে বসেছে।

আগামীকাল অফিস যেতে হবে না। সাপ্তাহিক ছুটি। সিদ্ধান্ত নিলাম আগামীকাল সকালে নাস্তা খেয়ে আবার নতুনভাবে পরীক্ষা করে দেখব। শুয়ে পড়লাম। শোয়ামাত্র ঘুমিয়ে গেছি।

যন্ত্র চালু হলো রাত চারটা বেজে দশ মিনিটে। আমার বিছানার সোজাসুজি দেয়ালে ঘড়ি আছে। সময় দেখার জন্য ঘড়ির জায়গা এখন দখল করেছে ক্রনোটেম্প। তবে আমি ঘড়িতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। ঘুম ভেঙে বরাবর ঘড়ির দিকে তাকাই। পিপপিপ শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে গেল। আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। শুনলাম পাশের ঘর থেকে কেউ বলছে, হেমা কোথায় ? আমি হেমাকে দেখতে চাইছি।

বেডরুমের পাশে আমার বাসার ল্যাবরেটরি। বাসায় ফিরে বাইরের দরজা ভালোভাবে আটকে দিয়েছি। এখানে আমি ছাড়া দ্বিতীয় কোনও মানুষ নেই। আচমকা এ বাড়িতে অন্য কারও কথা শোনা যাবে এমন আশা করিনি। অতিপ্রাকৃত কোনও কিছুতে আমার বিশ^াস শূন্য। অনেক দিন আগে চালু করা রেডিয়ো প্যাকেটে ভরে আর্কাইভ জোনের কাবার্ডে তুলে রাখা আছে। রেডিয়ো পুনরায় চালু হওয়ার সামান্যতম সম্ভাবনা নেই।

বিছানা থেকে নেমে ল্যাবরেটরিতে গেলাম। অফিস থেকে ফেরার পথে নিয়ে আসা নতুন যন্ত্রের একটা সার্কিটে সার ধরে গোলাপি আলো জ¦লছে। যন্ত্র থেকে আওয়াজ শোনা গেল, হেমা, মা, তোমাকে দেখছি না কেন ? তুমি কোথায় ?

চট করে নিজেকে সামলে নিলাম। নিজের ওপর পুরো নিয়ন্ত্রণ থাকার পরও মনে হচ্ছে আমি নই, অন্য কেউ যেন আমার মস্তিষ্ক পরিচালনা করছে। সেই অন্য কেউ আমার নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে।

শান্ত গলায় বললাম, আমি ধ্রুব। আপনি কে ?

যন্ত্র উত্তর দিলো, আমি একশ দুই। অষ্টম পর্যায়ের সাইবর্গ। আমাকে কি গ্রেফতার করা হয়েছে ? অবশ্য আমাকে গ্রেফতার করা হলে আপনার জানার কথা আমি কে ? ঘর অন্ধকার। কোথায় আছি বুঝতে পারছি না। সবকিছু বড্ড হেঁয়ালির মতো লাগছে।

যন্ত্র থেকে আতঙ্কিত গলায় একসঙ্গে অনেকগুলো কথা শোনা গেল। ইচ্ছে করেই ঘরের আলো জ¦ালালাম না। মনে হলো আবছা আলো-আঁধারির ভেতর যন্ত্রের কথায় প্রাণ প্রতিষ্ঠা সহজ হবে।

ধীর পায়ে হেঁটে টেবিলের পাশে রাখা চেয়ারে বসলাম। কোমল গলায় বললাম, আপনি আতঙ্ক বোধ করছেন। আতঙ্কিত হওয়ার মতো কিছু নেই। আপনি নিরাপদে আছেন। শান্ত হোন।

সার্কিটে আলোর তারতম্য খেয়াল করলাম। গোলাপি আলো একবার সবুজ হচ্ছে আবার নীল হয়ে যাচ্ছে। মনে হলো সে ঘটনা বোঝার চেষ্টা করছে।

আশ^স্ত করার মতো গলায় বললাম, আপনার অনুমান সঠিক। আপনাকে গ্রেফতার করা হয়নি। আমি সিকিউরিটি কাউন্সিলের কেউ নই। তবে আপনি আছেন সর্বোচ্চ নিরাপত্তা বলয়ের মধ্যে। আপনার কথা আমি শুনতে চাইছি। আপনি কিছু মনে না করলে আমাকে সব বলুন। হতে পারে আপনার তাতে সুবিধা হবে। আপনাকে আমি সহযোগিতা করতে পারব।

সাইবর্গ একশ দুই তার কথা বলল। সেই কাহিনি সংক্ষেপে গুছিয়ে লেখার চেষ্টা করছি। এখান থেকেই শুরু হয়েছে উষ্ণতা উপন্যাসের কাহিনি।

দুই

সাইবর্গ একশ দুই বসে আছে গ্রিন অ্যাপল ইশকুলের উলটা দিকে পাহাড়ের ঢালে। সেখান থেকে সামনের ইশকুলের সবটুকু দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড রোদ্দুরে তেতে আছে চারপাশ। যে কোনও মানুষ হলে সে গাছের ছায়া খুঁজে বসত। আশপাশে কোনও গাছ নেই। একশ দুই ছায়ার খোঁজ করেনি। রোদ কিংবা ছায়াতে তার মানুষের মতো আলাদা অনুভূতি নেই। শীত আর গরম তার ভেতর কোনও ভিন্ন প্রতিক্রিয়া তৈরি করে না। তবে শীতের সময় কুয়াশা কাটিয়ে দেখার জন্য দৃষ্টিতে অতিরিক্ত শক্তির প্রয়োজন হয়। খানিক অসুবিধা হয় বৃষ্টিতে। যদিও সব সাইবর্গের দেহ যথেষ্ট সুরক্ষিত। তবু কোনওভাবে শরীরের ভেতরে পানি ঢুকে পড়লে সার্কিটে সাময়িক সমস্যা দেখা দেয়।

থিয়ার বয়স ৩ বছর। তাকে এবার গ্রিন অ্যাপল ইশকুলে ভর্তি করানো হয়েছে। থিয়ার দেখাশোনার দায়িত্ব পেয়েছে একশ দুই। তাকে থিয়াদের বাড়িতে থাকতে হয়। সে থিয়াকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়ে রাখতে চেয়েছিল। থিয়ার মা তাতে রাজি হয়েছিলেন। থিয়ার বাবা রাজি হলেন না। তিনি বললেন, এ ধরনের প্রস্তাব তুমি কেন দিচ্ছ, একশ দুই। তোমাকে যখন এজেন্সি থেকে থিয়ার দেখাশোনার জন্য এনেছি তখন তোমার এখানেই থাকার কথা বলা হয়েছে।

থিয়ার মা বললেন, সে যখন ইচ্ছে করছে, নিয়ে যাক না। যখন এর জন্য বাড়তি কোনও ইউনিট সে দাবি করছে না।

থিয়ার বাবা বললেন, এ বাড়তি ইউনিটের প্রশ্ন নয়, থিয়ার মা। আমাদের মেয়ে আমাদের কাছে থাকবে।

আমাদের যখন ইচ্ছে হবে একশ দুইকে খবর দেব। সে থিয়াকে নিয়ে আসবে। মানছি থিয়া আমাদের সঙ্গে থাকলে ভালো লাগবে। তবে ভেবে দেখো, সে বড় হচ্ছে। আমাদের প্রাইভেসি তাকে বুঝতে হবে। কেবল সে আমাদের থেকে দূরে থাকলেই তা বুঝতে পারবে।

থিয়া ঘরের ভেতর ছিল। সে কখন ছুটে এসেছে থিয়ার বাবা কিংবা মা খেয়াল করেননি। থিয়া বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলল, আমি কোথাও যাব না, বাবা।

বাবা বললেন, তোমাকে কোথাও যেতে হবে না, মা। তুমি আমাদের কাছেই থাকবে।

অমনি থিয়ার মা বললেন, মেয়েকে অত আদর দিয়ে তার পার্সোনালিটি ডেভেলপ করতে বাধা দিয়ো না।

বাবা বললেন, জাইগোট ব্যাংক থেকে না এনে মেয়েকে যদি তুমি গর্ভে ধরতে, তাহলে আজ একথা বলতে না।

একশ দুই দেখল থিয়ার বাবা আর মা উত্তেজিত গলায় কথা বলছেন। সে বুঝতে পারল এখানে থিয়ার থাকা ঠিক নয়। সে থিয়াকে কোলে নিয়ে বাইরে চলে গেল।

থিয়াকে কোলে নিলেই অন্যরকম অনুভূতি বোধ করে একশ দুই। কেমন অনুভূতি তা সে ব্যাখ্যা করতে পারে না। তবে বুঝতে পারে তার ভেতর অস্বাভাবিকতা আছে। এই অস্বাভাবিকতা তৈরি হয়েছে তাকে তৈরির সময় কোনও ত্রুটি থেকে। অষ্টম মাত্রার সাইবর্গের ভেতর মা বা বাবার কোনও প্রবল আবেগ দেওয়া হয়নি। তাদের ভেতর যা দেওয়া হয়েছে তা হচ্ছে দায়িত্ব। তার মাইক্রোপ্রসেসে যে তথ্য আসে সেটাকে সে মাইক্রোকন্ট্রোলারে পাঠিয়ে দেয়। তার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয় তাকে কী করতে হবে। এখানে মায়ের আবেগের কোনও ব্যাপার নাই। তবে একশ দুই নিজের ভেতর মায়ের তীব্র আবেগ অনুভব করে। সে নিজের এই ত্রুটি সংশোধন করিয়ে নিতে পারে। কিন্তু নেয়নি। অসম্ভব ভালো লাগা, প্রচণ্ড আকর্ষণ আর নিতল ভালোবাসার এমন অনুভূতি একশ দুই হারাতে চায় না।

তাকে থিয়ার বাবা-মা তিন বছরের জন্য নিয়ে এসেছে। থিয়ার বয়স তিন বছর হতে আর মাত্র বারো দিন বাকি আছে। এরপর একশ দুইকে এজেন্সিতে ফিরে যেতে হবে। এজেন্সি তাকে আবার হয়তো অন্য কারও সন্তান দেখাশোনার দায়িত্বে পাঠাবে। তবে একশ দুই বারবার ভাবে, তার যদি নিজের কোনও সন্তান থাকত!

ইশকুলের গাড়ি বাসা থেকে ছেলেমেয়েদের নিয়ে আসে। ইশকুল ছুটি হলে সেই গাড়িতে তাদের বাসায় পৌঁছে দেয়। ছেলেমেয়েদের নেওয়ার জন্য কাউকে ইশকুলে আসতে হয় না। তবে দায়িত্ববান কেউ এসে কাউকে তার সঙ্গে দিতে বললে দেওয়া হয়।

একশ দুই এসেছে থিয়ার ইশকুল ছুটি হলে তাকে নিয়ে যাবে। তার আসার প্রয়োজন ছিল না। থিয়া ইশকুল বাসে বাসায় ফেরে। একশ দুইকে এখানে আসতেও বলা হয়নি। সে এসেছে বিশেষ কাজে। এই কাজের ঝুঁকি অনেক বেশি। তবু সে ঝুঁকি নিয়েছে। এর জন্য নিজ সার্কিটে গোপনে কিছু পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। অষ্টম মাত্রার সাইবর্গ অনুমতি নিয়ে সেটা পারে। তবে একশ দুই অনুমতি নেয়নি। থিয়ার জন্য তাকে আইন অমান্য করতে হয়েছে। থিয়ার সঙ্গে তার যে ভীষণ রকমের মানবিক সম্পর্ক তৈরি হয়েছে তাকে ছেড়ে সে অন্য কারও কাছে যেতে পারবে না। বারো দিন পর থিয়ার সঙ্গে তার আর কোনও সম্পর্ক থাকবে না, এটা একশ দুই মেনে নিতে পারছে না। সে সিদ্ধান্ত নিয়েছে থিয়াকে ইশকুল থেকে নিয়ে আজ সে দূরে কোথাও চলে যাবে। অনেক দূরে। যেখানে তাকে কেউ খুঁজে পাবে না। তার জন্য যথেষ্ট ইউনিট সে জোগাড় করে রেখেছে।

একশ দুইয়ের পরনে অদ্ভুত ঢিলেঢালা পোশাক। এমন পোশাক সাধারণত সে পরে না। আজ পরেছে। এই পোশাকের ভেতর অনেকগুলো পকেট আছে। তাতে থিয়ার জামাকাপড়, খেলনা আর শখের কতগুলো জিনিস নেওয়া হয়েছে। একশ দুইকে এই পোশাকে দেখে থিয়া খুশি হবে। যখন সে মজা-মজা খেলা করে তখন একশ দুই তার জন্য এই পোশাক পরে। থিয়াকে ম্যাজিক দেখায়। শরীরের ভেতর থেকে অনেক কিছু বের করে আনে। তাতে থিয়া আনন্দ পায়। আজ যখন একশ দুই এই পোশাক পরে বাসা থেকে বের হয়েছে তখন থিয়ার মা-বাবা কাজে গেছেন। তাই সে কেন এই জাদুকরের পোশাক পরে বের হচ্ছে সে কথা জিজ্ঞেস করার কেউ ছিল না।

একশ দুই পাহাড়ের ঢালে পা ছড়িয়ে বসে আছে। নিচ থেকে এক ইঁদুর উঠে আসছে। এই ইঁদুরের মুখ সুঁচালো। সে সত্যিকারের ইঁদুর না কি কৃত্রিমভাবে বানানো বোঝা যাচ্ছে না। শহরে বেশির ভাগ পশু-পাখি, প্রজাপতি সব কৃত্রিমভাবে বানিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তারা শহর নোংরা করে না। নিজে থেকে বিশেষ কিছু করতে পারে না। তাদের যেভাবে প্রোগ্রাম করা হয়েছে তারা সেভাবে সাড়া দেয়। তবে কতকগুলোতে নতুন পরিবেশ থেকে শিখে নেওয়ার প্রোগ্রাম করা আছে। তারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজ থেকে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

থিয়াকে নিয়ে পালানোর চিন্তা একশ দুইকে উত্তেজিত করে রেখেছে। সার্কিটে অহেতুক তাপ বাড়ছে সে বুঝতে পারছে। নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। ইশকুল ছুটি হতে আরও খানিক সময় দেরি আছে। তা ছাড়া ছেলেমেয়েদের ইশকুলের গাড়িতে তোলার আগে তাদের খেলতে দেওয়া হয়। খেলা শেষ হলে একশ দুই গিয়ে থিয়াকে নিয়ে আসবে।

মনের চঞ্চলতা দূর করতে একশ দুই তার দিকে এগিয়ে আসা ইঁদুরে মনোযোগ দিলো। ভাবতে চাইল কীভাবে সে বুঝতে পারবে এই ইঁদুর সত্যিকারের না কি কৃত্রিম। প্রথম পরীক্ষা খুঁজে পাওয়া গেছে। গায়ের গন্ধ। সত্যিকারের ইঁদুরের গায়ে গন্ধ থাকবে। কৃত্রিম ইঁদুরের থাকবে না। ইঁদুর আছে বেশ খানিকটা দূরে। তার গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে না। একবার মনে হচ্ছে আছে। আবার মনে হচ্ছে নেই।

গন্ধের কথা মনে হতে একশ দুই ইঁদুর নিয়ে দ্বিতীয় পরীক্ষার কথা ভাবল। সে পোশাকের ভেতরের পকেট থেকে থিয়ার জন্য আনা ছোট খেলনা বের করেছে। আরেক পকেট থেকে জীবাণুনাশক তরল বের করে খেলনায় মাখিয়েছে। যদি সত্যিকারের ইঁদুর হয় তবে সে জীবাণুনাশকের গন্ধে সরে যাবে। আর নতুন কিছু দেখে তার স্মৃতি থেকে বুঝতে পারবে এখানে বিপদ থাকতে পারে।

ইঁদুর এগিয়ে আসছে। সে কী করতে চায় একশ দুই তা দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। ইশকুল ছুটি হয়ে গেছে। ছেলেমেয়েরা বের হয়ে আসছে। তাদের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে এখান থেকে। একশ দুই ইশকুলের দিকে তাকিয়ে থিয়াকে খুঁজল। উঁচু পাহাড়ের ঢালে বসে থাকার জন্য সমতলের ইশকুলের প্লে গ্রাউন্ড পুরোটা দেখা যাচ্ছে। থিয়াকে দেখতে পাচ্ছে না। আবার ইঁদুর কী করবে সেটা না দেখে ঢাল থেকে নামতেও পারছে না একশ দুই।

সে উঠে দাঁড়াল। ইঁদুরের থমকে দাঁড়ানোর কথা। সে থমকে দাঁড়ালো না। ছুটে এসে থিয়ার খেলনা ধাক্কা দিয়ে ফেলে চলে গেল। ইঁদুরের গায়ে কোনও গন্ধ নেই। খেলনা তুলে পকেটে নিয়ে একশ দুই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নামতে শুরু করল। তখন সে দুটো সত্যিকারের ইঁদুর দেখতে পেল। ইঁদুর দুটো তাকে দেখে দৌড়ে পালিয়ে গেছে।

থিয়া জিজ্ঞেস করল, আমরা কোথায় যাব, একশ দুই ?

একশ দুই বলল, ম্যাজিক দেখতে। নদীর ওপারে এক হাতি আছে। যে হাতিকে তুমি অনেক পছন্দ করো। সেই হাতি।

সাইবর্গকে বানিয়ে গল্প বলার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে শিশুদের ভেতর কল্পনাশক্তি বাড়ানোর জন্য। একশ দুই এই প্রথমবারের মতো তার সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করল। সে থিয়াকে বানিয়ে বানিয়ে ভুল কথা শোনাল।

থিয়া বলল, আমার পিটপাট হাতি ?

একশ দুই বলল, হ্যাঁ। তোমার পিটপাট হাতি।

থিয়া সব সময় এক হাতির গল্প বলে। সে বলে, জানো একশ দুই, আমার একটা হাতি আছে। তার নাম পিটপাট। সে আমাকে পিঠে চড়িয়ে ইশকুলে নিয়ে যায়। আবার তার পিঠে চড়ে ইশকুল থেকে বাসায় ফিরে আসি। যদি গাছ থেকে কিছু পাড়তে হয় তাহলে পিটপাটকে বলি। শুঁড় দিয়ে সেটা গাছ থেকে পেড়ে দেয়। আমি তো ছোট গাছে উঠতে পারি না।

একশ দুই আর থিয়া মিলে সেই পিটপাট হাতির অনেক ছবিও এঁকেছে। থিয়া বলে, সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।

কয়েক দিন থেকে একশ দুই তাকে বলছে, থিয়া মণি, তোমাকে আমি তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড পিটপাটের কাছে নিয়ে যাব।

থিয়া জানতে চায়, কবে নিয়ে যাবে ?

একশ দুই বলে, শিগগির। সবকিছু গুছিয়ে নিতে পারলেই।

কী গোছাতে হবে তোমাকে ?

সেখানে যেতে অনেক ইউনিট লাগবে।

মাকে না হয় বাবাকে বলো।

কাউকে বলা যাবে না। এটা শুধু তোমার আর আমার।

একশ দুই তাকে কোলে নিয়ে যখন পিটপাট হাতির কথা বলেছে তখন থিয়া বলল, তুমি যে বলেছিলে পিটপাটকে নিয়ে আসবে!

একশ দুই বলল, তাকে আসতে বলেছিলাম। তবে সে বলল, আমার বন্ধু থিয়া এলে তবে যাব। আরও বলল, নদীর ওপারে সেই জঙ্গলে আরও যারা আছে তারা ম্যাজিক দেখবে।

থিয়া বলল, আচ্ছা তাহলে চলো।

থিয়াকে নিয়ে একশ দুই নদী পার হয়ে যেতে পারল না। নদীর পাড়ে পৌঁছাতেই সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকজন এসে তাকে ধরে ফেলল। সেন্ট্রাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের জিপিএস ট্র্যাকার তার অবস্থান শনাক্ত করে জরুরি বার্তা দিয়েছে। একশ দুই তার জন্য নির্ধারিত লোকেশনের বাইরে চলে গেছে।

সিকিউরিটি কাউন্সিলের একজন সদস্য জানতে চাইল, তুমি এখানে কেন ?

একশ দুই কিছু বলল না। থিয়া বলল, আমার বন্ধু পিটপাটের কাছে যাচ্ছি।

পিটপাট কোথায় থাকে ?

নদীর ওপারে জঙ্গলে।

সিকিউরিটি কাউন্সিলের সাইবর্গের চোখের আলো দপ করে বেড়ে গেল। সে নিজের ভেতর বিষয়টাকে প্রসেসিং করার চেষ্টা করছে। খানিক থেমে বলল, তোমার বন্ধু জঙ্গলে থাকে! সেখানে সে কী করে ?

থিয়া বলল, সে একটা হাতি। কলাগাছ খায়। তুমিও চলো। পিটপাটের অন্য যে বন্ধুরা জঙ্গলে থাকে তাদের একশ দুই ম্যাজিক দেখাবে। সে অনেক ম্যাজিক জানে।

সিকিউরিটি কাউন্সিল থেকে থিয়ার বাবা-মায়ের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলো। থিয়া আর একশ দুইকে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। থিয়া তার হাতি বন্ধু পিটপাটের সঙ্গে দেখা না করে ফিরে যাবে না। সে কান্না শুরু করেছে।

বিশেষ আয়োজনে সিকিউরিটি কাউন্সিল এক কৃত্রিম হাতি নিয়ে এল। সেই হাতিকে নিয়ে থিয়া বাসায় ফিরেছে। বাসায় ফেরার পর সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকজন একশ দুইকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছে।        

তিন

দেয়ালজোড়া মনিটরে উচ্ছল শিশুদের ছবি দেখা যাচ্ছে। তারা খেলা করছে, হাসছে, আনন্দ করছে। তাদের ভেতর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে নীল আকাশে সাদা মেঘ। সেখানে গাঢ় নীল রঙে লেখা হ্যাপি জেনারেশন জাইগোট ব্যাংক নদীর পানির ঢেউয়ের মতো একপাশ থেকে আরেক পাশে চলে যাচ্ছে। সেখানে সবুজ গাছ। গাছে ঝুলে থাকা ফল থেকে এক একটা অক্ষর বের হয়ে এসে লেখা হলো ভালোবাসা, মর্যাদা এবং নিরাপত্তা।

রিসেপশন ডেস্কের পাশে যে মানুষটি বসে আছে তার নাম অ্যাডোনিস। বয়স ৩২ বছর। সে এসেছে জাইগোট ব্যাংক থেকে সন্তান নেওয়ার জন্য।

এটা বিশাল আকারের এক জাইগোট ব্যাংক। ভেতরে আলাদা আলাদা কাচের ঘরে তাকের ওপর বিশেষ ব্যবস্থায় সারি সারি সাজানো আছে মানব জাইগোট। তার সঙ্গে ভ্রƒণের ডিএনএ এবং আরএনএ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে। কেউ জাইগোট ব্যাংক থেকে সন্তান নিতে চাইলে ক্যাটালগে ভ্রƒণের বিস্তারিত জেনে অর্ডার দেয়। তখন তারা প্রসেসিং শুরু করে। সন্তান পূর্ণতা পেলে গ্রাহককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়।

আবার কেউ যদি বিশেষ কোনও বৈশিষ্ট্যের সন্তান চায় তাকে সেজন্য বাড়তি ইউনিট খরচ করতে হয়। জাইগোট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ ডিএনএ, আরএনএ, ক্রোমোজম মিলিয়ে সেই বৈশিষ্ট্যের জাইগোট তৈরি করে দেয়।

রিসেপশনে যে মেয়েটি বসে আছে সে মানুষ নয়, সাইবর্গ। তার নাম ছয়শ তিন। জাইগোট ব্যাংকের দায়িত্বে আছে অষ্টম পর্যায়ের সাইবর্গ। এরা যথেষ্ট আবেগপ্রবণ। মানব মস্তিষ্কের মতো করে এদের লিম্বিক সিস্টেম বানানো হয়েছে। যা নিওকর্টেক্স ফাংশনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে। এদের ভেতর মানবিকতা যেমন আছে, তেমনি ঈর্ষা, লজ্জা আর অনুতাপের সঙ্গে একাকিত্বের মতো আবেগও আছে। তাতে তারা কারও সাহচর্য পাওয়ার আকাক্সক্ষা করে থাকে।

এখানকার সাইবর্গদের আলাদা কোনও নাম নেই। তাদের সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করা হয়।

অ্যাডোনিসের হাতে হ্যাপি জেনারেশন জাইগোট ব্যাংক-এর ক্যাটালগ। সে সময় নিয়ে মনোযোগ দিয়ে ক্যাটালগে সম্ভাব্য বিভিন্ন শিশুর বৈশিষ্ট্য খুঁটিয়ে পড়ছে। আরও কয়েকজন এসেছে এখান থেকে সন্তান নেওয়ার জন্য। তাদের আলাদা আলাদা রিসেপশন ডেস্কে বসিয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত সাইবর্গ কথা বলছে।

ছয়শ তিন বলল, কত বছর বয়সের সন্তান নেবেন আপনি ? নবজাত সন্তান নিতে পারেন। আমরা এখান থেকে অলটারনেটিভ মা হিসেবে সাইবর্গ সাপ্লাই দিয়ে থাকি। তাও আবার দু ধরনের। আপনি সন্তান পালনের জন্য কেয়ারগিভার হিসেবে বাসায় সাইবর্গ নিয়ে যেতে পারেন। আবার আমাদের কোনও সাইবর্গের কাছে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য সন্তান দিতে পারেন। এই নির্দিষ্ট সময় হচ্ছে ৩ বছর, ৫ বছর, ৭ বছর আর ১২ বছর। এর যে কোনও একটি প্যাকেজ আপনি নিতে পারবেন। এই সময়ে আপনার সন্তানের যত্ন, মেধা বিকাশ সব দায়িত্ব সাইবর্গের। অবশ্য এ ছাড়াও আপনি স্পেশাল কোনও অ্যারেঞ্জমেন্টে আসতে পারেন। নির্ভর করছে আপনি ইউনিট কত দিচ্ছেন।

অ্যাডোনিস কোনও কথা বলছে না। সে চুপ করে আছে। ছয়শ তিন বলল, আপনি আমাদের ক্যাটালগ দেখুন। আমরা কোম্পানির নামের ওপর শ্রদ্ধাশীল। তাই মান নিয়ে কোনও আপস করি না। আপনি নিশ্চয়ই অনলাইনে বিস্তারিত জেনে এসেছেন। তবু ভিন্ন কিছু জানার থাকলে জিজ্ঞেস করতে পারেন।

অ্যাডোনিস চোখ তুলে তাকিয়েছে। তার চোখে গভীর বিষণ্নতা। যেন সে যেমন খুঁজছিল তেমনটা খুঁজে পায়নি। উদাস গলায় বলল, মানুষের সাইকোলজি খুব জটিল। তাকে আপনারা আরও জটিল বানিয়ে ফেলেছেন একই সঙ্গে মেধাবী আর চৌকস বানাতে গিয়ে।

ছয়শ তিন বলল, আপনি কি দয়া করে বলবেন কেমন সন্তান আশা করছেন ?

সে হবে সরল। খুব বেশি মেধাবী না হলেও হবে। তবে অবশ্যই তার ভেতর থাকবে মানবিকতা। যন্ত্রের মতো টিকে থাকার চেষ্টা করবে না। সে হবে প্রাণবন্ত। গান গাইবে, বৃষ্টিতে ভিজবে, পাহাড়ে উঠবে, সমুদ্রে সাঁতার কাটবে।

একশ দুই এসে পাশে বসেছে। থিয়ার দায়িত্ব পালনের দশ দিন আগেই তাকে থিয়াদের বাসা থেকে কোম্পানিতে ফেরত দেওয়া হয়েছে। একশ দুইয়ের আচরণের জন্য কোম্পানিকে থিয়ার বাবা-মায়ের একাউন্টে বেশ কিছু ইউনিট জরিমানা জমা করতে হয়েছে। তাকে আর অন্য কোনও শিশুর দায়িত্ব না দিয়ে কোম্পনির জাইগোট ব্যাংকের দায়িত্বে রেখে দিয়েছে। এখানে তার কাজ হচ্ছে জাইগোট থেকে মানবশিশু জন্ম হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেকটি ধাপ পর্যবেক্ষণ করা।

একশ দুইকে ম্যাসেজ পাঠিয়ে ছয়শ তিন ডেকে এনেছে। অ্যাডোনিস যদি এখান থেকে সন্তান নিতে আগ্রহী হয় তাহলে প্রসেসিং সে করবে। তাকে বুঝে নিতে হবে গ্রাহক কী চাইছে।

একশ দুই গভীর আগ্রহ নিয়ে অ্যাডোনিসের দিকে তাকিয়ে আছে। অ্যাডোনিস আরও বলল, সে ধরাবাঁধা নিয়মের মানুষ হবে না। তার যখন যা ইচ্ছে হবে সে তাই করবে। নিজের ভাবনা নিয়ে বড় হবে। স্বাধীন মুক্ত জীবন যাপন করবে।

ছয়শ তিন ঘাড় ঘুরিয়ে একশ দুইয়ের দিকে তাকাল। একশ দুই তার দিকে তাকিয়েছে। তারা পরস্পর ঘাড় ঘুরিয়ে না তাকিয়েও নিজেদের ভেতর যোগাযোগ করতে পারত। তবু আচমকা এত বেশি বিস্মিত হয়েছে যে তারা ঘাড় ঘুরিয়েছে।

অ্যাডোনিসের কথায় ছয়শ তিন এবং একশ দুইয়ের ব্রেইন সার্কিট দু ধরনের সিগন্যাল দিলো। ছয়শ তিনের লিম্বিক সিস্টেম জানাল, এ ধরনের মানুষ সমাজে টিকে থাকতে পারবে না। তাকে নানা স্তরে হেনস্তা হতে হবে।

একশ দুইয়ের লিম্বিক সিস্টেম অধিক উত্তেজিত হয়েছে। একশ দুইয়ের মনে হচ্ছে সে অনেক দিন এরকম কিছু চাইছিল। সবাই শুধু জিতে যেতে চায়। সকলেই চায় সকলের ভেতর শ্রেষ্ঠ হতে। নিজে যা পারেনি তা সন্তানের ভেতর দিয়ে পুষিয়ে নিতে। আর তাতেই তারা বছরের পর বছর মানুষের অবয়বে আদতে যন্ত্র বানিয়ে যাচ্ছে। সে অন্তত একবার একজন মানুষ বানাতে চায়।

একশ দুই বলল, আমাদের কয়েকটা দিন সময় লাগবে। ডিএনএ ম্যাচিং করতে হবে। নতুন প্রোফাইল।

সময় নিন, অসুবিধা নেই। কবে নাগাদ জানতে পারব যদি জানাতেন।

ছয়শ তিন বলল, ইউনিট বেশি দিতে হবে। অ্যাডভান্স করবেন মোট ইউনিটের ৭৫%। প্রফাইল রেডি হলে আপনাকে জানানো হবে।

অ্যাডোনিস ইউনিট বুঝিয়ে দিয়ে উঠে পড়ল।

একশ দুই শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে ল্যাবে। তাকে দেখাচ্ছে দোকানে সাজিয়ে রাখা ডলের মতো। সে নড়াচড়া করছে না। তার চোখের কাছে সবুজ বাতি দুটো ঘন ঘন জ¦লছে আর নিভছে। একসঙ্গে অনেক ভাবনা কাজ করছে তার ব্রেইন সার্কিটে। একশ দুই মনে মনে বলল, কোনওভাবেই ব্রেইন সার্কিটকে উত্তপ্ত হতে দেওয়া যাবে না। ব্রেইন উত্তপ্ত হলে সে হ্যাং হয়ে যাবে। কাজ করতে পারবে না।

ব্রেইন থেকে কয়েক ধরনের সিগন্যাল আসছে। একশ দুই সিগন্যালগুলোকে আলাদা আলাদাভাবে সাজানোর চেষ্টা করতে থাকল। কিছু সিগন্যাল আসছে অ্যাডোনিসের স্পেসিফিকেশন মেলানোর। অদ্ভুত এক মানবসন্তান চেয়েছে অ্যাডোনিস। সেজন্য তাদের বেশ আগের কিছু ডিএনএ সন্ধান করতে হচ্ছে। স্রোতের বিপরীতে চলা মানুষ এখন কেউ চায় না। সকলেই চায় স্রোতে গা ভাসিয়ে ভেসে থাকা যন্ত্রমানব। বাজারে যাদের দাম হবে অনেক অর্থাৎ যারা একে অপরকে হারানোর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত থাকবে আর প্রচুর ইউনিট রোজগার করবে।

তার লিম্বিক সিস্টেম থেকে আরেক ধরনের সিগন্যাল আসছে। সেটা ভয়াবহ। একশ দুই সেই সিগন্যালকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। এড়িয়ে যেতে পারছে না। তার ভীষণ ইচ্ছে হচ্ছে এমন একজন মানবসন্তানের মা হতে। যে সন্তান বেড়ে উঠবে স্বাধীনভাবে। নিজের মত নিয়ে। সে ওপরে ওঠার জন্য অসামঞ্জস্য কোনও প্রতিযোগিতায় লড়বে না। সে হবে মানবিক একজন মানুষ। তার সন্তান।

এই ভাবনা হ্যাপি জেনারেশন জাইগোট ব্যাংক-এর নীতিমালা বিরোধী। কোম্পানির নীতিমালায় স্পষ্ট লেখা আছে এখানে চাকুরিকালীন সাইবর্গ সন্তান তৈরি, যত্ন ও লালনপালন প্রক্রিয়ায় বিকল্প মা বা সন্তানের পরিচর্যাকারী হিসেবে যুক্ত থাকবে কিন্তু কখনও নিজে মা হতে পারবে না। সেই শর্তে রাজি হয়ে এখানে কাজ করছে তারা। নিজে মা হতে চাওয়া মানে কোম্পানির আইন অমান্য করা। সেটা তারা করতে পারে না।

আবার মনে হচ্ছে, সন্তান বানানো শেষ হয়ে গেলে সন্তানকে নিয়ে সে চলে যাবে অনেক দূরে। এবার আর ভুল করবে না। যাওয়ার আগে যোগাযোগ মডিউল নষ্ট করে দেবে। মূল কেন্দ্রের সঙ্গে তার ইন্টারনাল রাউটারের কানেকশন অফ করে দেবে। কেউ যেন কোনওভাবেই তাকে খুঁজে না পায়। কারও সঙ্গে সে কোনও যোগাযোগ রাখবে না।

কোম্পানি ব্যবসার স্বার্থে সাইবর্গদের নিজের মতো করে ভাববার সুযোগ সৃষ্টি করে রেখেছে। তাতেই ছয়শ তিন ঘুরেফিরে ইউনিটের কথা বলতে পারে, কোম্পানির লাভ আগে নিশ্চিত করতে পারে।

একশ দুই মা হওয়ার চিন্তা সরিয়ে রেখে অ্যাডোনিসের সন্তানের ভাবনায় মনোযোগ দিলো।

চার

ভোরবেলা বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়ার অবস্থা হয়ে গেছে এলোমেলো। তবু শীতকালে এমন খ্যাপাটে বৃষ্টি সচরাচর দেখা যায় না। আজ ভোরে হয়েছে সেরকম আকাশভাঙা বৃষ্টি। ঝড়ো বাতাস বৃষ্টিকে আরও ভয়ংকর করে তুলেছিল। থেকে থেকে বিদ্যুৎ চমকে মনে হচ্ছিল পৃথিবী এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে। মুষল বৃষ্টি শীতের প্রকোপ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। মানুষজনের ভেতর জবুথবু ভাব চলে এসেছে। অতিরিক্ত প্রয়োজন ছাড়া আজ কেউ বাড়ি থেকে বের হয়নি।

একশ দুই বুঝল এটা যথার্থ সুযোগ। সে পালাবে। আজই পালাবে। হ্যাপি জেনারেশন জাইগোট ব্যাংকে আজই তার শেষ দিন। বৃষ্টি শুরু হয়েছে গত সন্ধ্যারাত থেকে। মাঝরাতে খানিক সময়ের জন্য থেমেছিল। ভোরবেলা আবার আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামল। একশ দুই তখন পালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

পালাচ্ছে একশ দুই। তার গায়ে লম্বা বর্ষাতি। মাথা বর্ষাতির হুডিতে ঢাকা। চোখে রেইনগ্লাস। ডানে বাঁয়ে কোনওদিকে না তাকিয়ে সে সোজা হাঁটছে। ভয়াবহ ঠান্ডায় রাস্তা ফাঁকা হয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ দু-একটা উড়োযান সাঁ করে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে দেখা যাচ্ছে। আশপাশে সিকিউরিটির কাউকে দেখা গেল না। তা ছাড়া একশ দুই এমনভাবে হাঁটছে যে তাকে দেখে মনে হচ্ছে প্রচণ্ড দরকার হয়েছে বলেই সে বাসা থেকে বের হয়েছে, তা না হলে বাসা থেকে এই বরফ-শীতল আবহাওয়ার ভেতর বের হতো না।

একশ দুই যাবে রেল স্টেশনে। রেল স্টেশন এখান থেকে বেশি দূরে নয়। হেঁটে যেতে দশ মিনিট লাগার কথা। বৃষ্টি থেমে গেছে। তবে পুরোপুরি থামেনি। ঝিরঝির করে পড়ছে। বাতাস আছে। প্রবল ঠান্ডা বাতাস। সেই বাতাস উপেক্ষা করে জোরে হাঁটা সম্ভব হচ্ছে না। একশ দুই কোনওভাবেই নির্ধারিত ট্রেন মিস করতে চায় না। পরের ট্রেন তেরো মিনিট পর। তেরো মিনিটে অনেক কিছু ঘটে যেতে পারে। ধরা পড়লে সিকিউরিটি কাউন্সিল তাকে সম্পূর্ণভাবে অকেজো করে দিতে পারে।

একশ দুইয়ের বুকের সঙ্গে আঁকড়ে আছে একজন মানব সন্তান। এই শিশু একশ দুই নিজে বানিয়েছে। ল্যাবে গোপনে একটি ভ্রƒণকে পূর্ণতা দিয়েছে। জন্ম নিয়েছে এক মেয়েশিশু। মেয়ের নাম রেখেছে হেমা।

বুকের ভেতর হেমাকে জড়িয়ে রেখেছে একশ দুই। সে তার যোগাযোগ মডিউল নষ্ট করে দিয়েছে। চট করে তার সঙ্গে এখন কারও যোগাযোগ করা সম্ভব হবে না। তাকে খুঁজে পেতে হলে সেন্ট্রাল কাউন্সিলের মাধ্যমে খুঁজতে হবে। তাতে সময় লাগবে অনেক দিন।

বেশ আগে এক সাইবর্গ হারিয়ে গিয়েছিল। তার যোগাযোগ মডিউল নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। তখন তাকে সেন্ট্রাল কাউন্সিল খুঁজে বের করেছিল। সময় লেগেছিল ৫ বছর। কোনও সাইবর্গ হারিয়ে গেছে এটা রিপোর্ট হতেই অনেক সময় লেগে যায় যদি না সে কোনও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থাকে। সেই সাইবর্গ এক এয়ার কমিউনিকেশন কোম্পানির পরিচ্ছন্নতা কর্মী ছিল। এয়ার বাসে সে অকেজো হয়ে গিয়েছিল। তাকে অকেজো রোবটের ভাগাড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছিল।

তিন বছর পর এয়ার কমিউনিকেশন কোম্পানি খেয়াল করল তাদের একটা সাইবর্গ কম। তখন তারা সেন্ট্রাল কাউন্সিলকে জানাল। সেন্ট্রাল কাউন্সিল সেটা খুঁজে বের করতে আরও দুই বছর সময় নিয়েছিল।

তাছাড়া সেন্ট্রাল কাউন্সিল কোনও হারানো সাইবর্গ খুঁজতে নিজেরা যেতে পারে না। তাদের নির্ভর করতে হয় আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলের ওপর। তারা হারানো সাইবর্গ খুঁজে বের করে।

যেহেতু কোনও সাইবর্গ কখনও নিজ থেকে কোথাও চলে যায় না, তাই সেন্ট্রাল কাউন্সিল কখনও তারা হারিয়ে গেলে তাদের দ্রুত খুঁজে বের করার ব্যাপারটা ভেবে দেখেনি। যে ব্যবস্থা আছে তা দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ।  

একশ দুই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে এখান থেকে এত দূরে চলে যাবে যেখানে তাকে খুঁজতে আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরাও পৌঁছতে পারবে না।

সদ্যোজাত হেমাকে নিয়ে একশ দুই অনেক সকালে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত আগেই নিয়েছিল। সূর্য ওঠার খানিক পরে। অফিসে তখনও ছয় থেকে আট মাত্রার সাইবর্গ কেউ আসে না। আজ তার বেরুতে একদম অসুবিধা হয়নি। হেমা ঘুমাচ্ছে। তাকে বেবি ক্যারিং ব্যাগে করে বুকের কাছে রেখেছে। তবে অফিস থেকে বেরুতেই তাকে থামতে হয়েছিল। সাইবর্গ ছয় হাজার পাঁচশ আটান্ন সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। সে স্থানীয় নিরাপত্তা কর্মী। তিন মাত্রার সাইবর্গ।

যন্ত্রের মতো খটখটে গলায় ছয় হাজার পাঁচশ আটান্ন বলল, তোমাকে নিয়মমাফিক তল্লাশির প্রয়োজন আছে।

একশ দুইয়ের চোখের কলাপাতা রং প্রথমে গাঢ় সবুজ হয়ে সেখানে গোলাপি আভা দেখা দিলো। নিরাপত্তা কর্মী সেটা খেয়াল করেনি। তিন মাত্রার সাইবর্গ নির্ধারিত কাজের বাইরে নিজে থেকে কিছু ভাবতে পারে না, সিদ্ধান্তও নিতে পারে না। এই প্রবল বাজে আবহাওয়ার ভেতর এত ভোরে একজন কেন বের হয়েছে তা তার ভাবনায় আসবে না। সে অফিসের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে কাউকে বেরুতে দেখলে কিংবা ঢুকতে দেখলে তল্লাশি করবে। তাকে সেভাবে প্রোগ্রামিং করা হয়েছে।

ছয় হাজার পাঁচশ আটান্ন স্ক্যানিং মেশিন তুলে ধরল। একশ দুই বলল, আমার শরীর স্ক্যান করবে না। আমার বুকের কাছে একজন মানবসন্তান ঘুমুচ্ছে।

ছয় হাজার পাঁচশ আটান্ন বলল, সন্তান নিয়ে তুমি কোথায় যাচ্ছ ?

একশ দুই বলল, বেবিকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দিতে।

ছয় হাজার পাঁচশ আটান্নর একবারও মনে হলো না কেন পরিবারের কাছে সন্তানকে পৌঁছে দিতে অফিস সময় শুরুর আগে যেতে হচ্ছে। কেন তাকে এমন বাজে আবহাওয়ার মধ্যে বেরুতে হয়েছে। সে নিয়মমাফিক পরের ধাপে চলে গেল। বলল, ডক্যুমেন্টস দেখাও।

একশ দুই তার বাঁ হাতের করতল প্রসারিত করে তুলে ধরল। সেখানে উজ্জ্বল মনিটর। ছয় হাজার পাঁচশ আটান্ন তাকিয়ে আছে। মনিটরে বেবিকে তার পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা আছে। ছয় হাজার পাঁচশ আটান্ন বুঝতে পারল না এই ডক্যুমেন্ট একশ দুই নিজে বানিয়েছে। ছয় হাজার পাঁচশ আটান্ন হাতের স্ক্যানার নামিয়ে সরে গেল। হেমাকে নিয়ে রওনা হয়ে গেল একশ দুই।   

হেমাকে নিয়ে একশ দুই কেন্দ্রীয় শহর থেকে অনেক দূরে এক ছোট শহরে গিয়ে উঠল। যেহেতু অনেকে সন্তান লালনপালনের জন্য সাইবর্গের সহযোগিতা নেয়। কেউ বাড়িতে সাইবর্গ রাখে, আবার কেউ সন্তানকে সাইবর্গের কাছে দিয়ে দেয়। সন্তানের বয়স পাঁচ, সাত বা দশ কিংবা বারো বছর হওয়া পর্যন্ত সে সাইবর্গের কাছে থাকে। তাই হেমাকে সাইবর্গ একশ দুইয়ের কাছে দেখে কেউ কিছু ভাবল না।

ফাঁকা মাঠের মাঝখানে কাঠের বাড়ি পাওয়া গেছে। বাড়ি খুব বড় নয়। তবে সুন্দর। একশ দুই পছন্দ করেছে। আশপাশের এলাকা থেকে বিচ্ছিন্ন জায়গায় বাড়ি বলে কম ভাড়ায় পাওয়া গেছে। কাছে যথেষ্ট ইউনিট আছে। তা দিয়ে বেশ কিছুদিন চলবে। কিন্তু দীর্ঘদিন চলবে না।

হেমার জন্য খাবার কিনতে হবে। তার জামাকাপড় লাগবে। কিছু খেলনা দরকার। আসার পথে ট্রেন থেকে নেমে সে কিছু খাবার আর জামাকাপড় কিনে এনেছে। খাবার বলতে মায়ের দুধ আর জামাকাপড় হচ্ছে কয়েকটা ন্যাপি আর জামা। শীতের কাপড়, বিছানা।

সন্তান লালনপালনের সবগুলো ধাপ মেমোরিতে ইন্সটল করা আছে। তাই একশ দুই সে বিষয়ে ভাবল না। তা ছাড়া এ ব্যাপারে তার অভিজ্ঞতাও আছে। টানা ৬ মাস একশ দুই হেমাকে ছেড়ে কোথাও গেল না। সবসময় হেমাকে নিয়ে থেকেছে। তার সঙ্গে খেলা করা, কথা বলা, তাকে খাওয়ানো, যত্ন করা এর বাইরে তার আর কোনও ভাবনা ছিল না। হেমাকে দেখেছে সে কেমন করে একটু একটু করে বড় হচ্ছে।

সেই ছোট্ট বেলাতে তার গালে আঙুল দিয়ে টোকা দিলে সে মাথা ঘুরিয়ে তাকাত। এখন বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বুকে ভর দিয়ে মাথা উঁচু করে। সামনে কিছু ঝুলিয়ে দিলে সেটা হাত বাড়িয়ে ধরতে যায়। কিছু পেলে মুখে দিতে চায়। নাম ধরে ডাকলে বুঝতে পারে। তাকায়।

হেমার কাছে থাকলে তার অদ্ভুত ভালো লাগে। সে এর আগে অন্যের শিশু পরিচর্যার কাজ করেছে। এখন সে নিজের সন্তানের পরিচর্যা করছে। তার বিস্ময় কাটে না। সে শুধু হেমাকেই দেখে।

একদিন একশ দুই সিদ্ধান্ত নিল তাকে কাজে যেতে হবে। 

পাঁচ

একশ দুই কাছাকাছি এক আপেল বাগানে কাজ জোগাড় করে নিয়েছে। বিশাল আপেল বাগান। তাকে অন্যদের সঙ্গে নিয়মিত আপেল গাছের পরিচর্যা করতে হয়। গাছে আপেলের কুঁড়ি এলে যত্ন করে। আপেল বড় হয়। খাওয়ার উপযুক্ত হলে একদল রোবট এসে আপেল পেড়ে নিয়ে যায়।

আপেল বাগানে যারা কাজ করে তারা বেশির ভাগ রোবট। কয়েকজন আছে সাইবর্গ। যারা এখানে রোবটদের কাজ তদারকির দায়িত্ব পালন করে। একশ দুই তাদের একজন। বাগানের মালিক হচ্ছে মানুষ। তা ছাড়া আর কোনও মানুষ বাগানে আছে কি না সঠিক বোঝা যায় না। বাগানে মানুষ রাখা হয়েছে বাগান মালিকের পক্ষ থেকে। তারা নিজেদের আড়াল করে রাখে। সাইবর্গের কাজের ওপর নজরদারি করে। মালিক কখনও বাগানে আসে না। তবু বাগানের যে কোনও ঘটনা দায়িত্বরত সাইবর্গ মালিককে জানানোর আগেই মালিক তা জেনে যায়। এখানে কয়জন মানুষ আছে, তারা কারা সঠিকভাবে বোঝা যায় না।

এই আপেল বাগানে কাজের সবচেয়ে বড় সুবিধা হচ্ছে এখানকার বেবি কেয়ার সেন্টার খুব ভালো। একশ দুই ছাড়াও আরও তিনটি সাইবর্গ সন্তানদের বেবি কেয়ার সেন্টারে রাখে। এক সাইবর্গের সন্তান আছে দুজন। তাতে এখানে চারটি সাইবর্গের পাঁচজন মানবসন্তান থাকে। সন্তান কোনও সাইবর্গের নিজের নয়। সবাই সন্তানের লালনপালন করে। সন্তান লালনপালন করে যে ইউনিট রোজগার করে তাতেই বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে চলে যায়। তবে শিশুদের সামাজিক পরিবেশে অন্যদের সঙ্গে মিশতে শেখানোর জন্য কেন্দ্রীয় কাউন্সিল শিশু পরিচর্যাকারী সাইবর্গদের কাজের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু তাদের এমন জায়গায় কাজ করতে হবে যেখানে বেবি কেয়ার সেন্টারে একের অধিক মানবশিশু থাকবে।

আপেল বাগানের কাজ করে যা রোজগার হয় তাই দিয়ে হেমার জন্য খাবার, ড্রেস, খেলনা আর অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস কিনে আনে একশ দুই। যতক্ষণ কাজে থাকে ততক্ষণ হেমাকে দেখে রাখতে পারে। বেবি কেয়ারের দায়িত্বে দুটো সাইবর্গ আছে। তারাও বেশ অভিজ্ঞ এবং যত্নশীল।

বেবি কেয়ার সেন্টার থেকে লম্বা পথ চলে গেছে বাগানের ভেতর। বাগানের দু পাশে সারি সারি আপেল গাছ। একটা গাছ ব্যতিক্রম। সেটা ওক গাছ। কোয়েরকাস ওক। দেখে বুঝা যায় অনেক পুরাতন। বিশাল জায়গা নিয়ে ডাল ছড়িয়ে ঝাঁকড়া গাছ দাঁড়িয়ে আছে। ওক গাছের নিচে বয়স্ক একজন নারী বসে থাকেন। আপেল বাগানে কাজ নেওয়ার শুরুতে এই নারীকে সে এখানে দেখেনি। অল্প কয়েক দিন হলো তিনি এসে এই ওক গাছের নিচে বসে থাকেন। তিনি কেন সেখানে বসে থাকেন, তার কাজ কী এ সম্পর্কে একশ দুই কখনও জানতে চায়নি। একশ দুই বুঝেছে ওক গাছের নিচে বসে থাকে একজন মানুষ।

একে মানুষের গায়ে একেক ধরনের গন্ধ থাকে। সাইবর্গের থাকে না। ওক গাছের নিচে যিনি বসে থাকেন তার গায়ের গন্ধ বুনো লতাপাতার মতো। মানুষ হয়েও নিজেকে আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেন না। তার গায়ের গন্ধ হালকা নয়, তীব্র। আড়াল করতে চাইলেও সম্ভব ছিল না। পাশ দিয়ে গেলেই গায়ের গন্ধ নাকে এসে লাগে।

একশ দুই বাগান থেকে বেবি কেয়ার সেন্টারে যাচ্ছিল। ওক গাছের নিচে বয়স্ক নারী হাত তুলে তাকে থামিয়েছে। বললেন, তোমার নাম কী, মেয়ে ?

থতমত খেয়ে প্রথমে খানিক চমকেছে। তবে চট করে নিজেকে সামলে নিল। কোম্পানি থেকে বের হওয়ার আগে একশ দুই নিজের কাগজপত্র বদলে ঠিক করে নিয়েছে। একশ দুই তার কোম্পানির দেওয়া নম্বর। সেই নম্বর অন্য কোথাও বললে সন্দেহ করবে সে কেন কোম্পানি থেকে চলে এসেছে। কোম্পানিতে খোঁজখবর করবে। একশ দুই মাথা ঝুঁকিয়ে নিজের নাম বলল, আইফা।

কোম্পানি থেকে বেরুনোর আগে তিন মাস একশ দুই নিজ পরিচয় বদলানোর কাজ করেছে। আইডি সিস্টেমে নিজের নাম, ঠিকানা, পেশা বদলে ফেলেছে। সেখানে নিজের নাম লিখেছে আইফা। এখানে অন্যরা তাকে আইফা নামে জানে। আসার আগে তার ট্র্যাকিং সিস্টেম নষ্ট করে দিয়েছে। বেশ কিছু মানুষের অভিজ্ঞতা নতুনভাবে নিজের মেমোরিতে ইন্সটল করেছে।

বৃদ্ধা বললেন, আমার নাম মিলেট। আমার বয়স মাত্র চুয়ান্ন বছর। কেউ অমর নয়। তবু কোনও এক রোগে বার্ধক্য আমাকে পেয়ে বসেছে। মেডিকেল কাউন্সিল আমাকে নিয়ে পরীক্ষা চালাচ্ছে। তারা নাকি এমন এক ওষুধের সন্ধান পেয়েছে যা দিয়ে জরা মানে বার্ধক্য ঠেকিয়ে দিতে পারবে। এখন আমার কাজ হচ্ছে এখানে বসে থাকা। মানুষ আর সবুজ দেখা। তুমি থাকো কোথায় ?

একশ দুই নিজের ভেতর নিজেকে গুছিয়ে নিয়েছে। মিলেট নামের এই নারী সব সত্য কথা বলছেন বলে তার মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে তার বয়স আরও কম। বিশেষ ব্যবস্থায় তাকে বৃদ্ধ বানানো হয়েছে। জরাগ্রস্ত একজন মানুষ এতগুলো কথা একটানা বলে যেতে পারে না। মিলেট পেরেছেন। নিজ শরীরের ত্বক বদলে ফেললেও তার চোখ আর দাঁত লুকাতে পারেননি। চোখ আর দাঁত বয়সের তুলনায় অতিরিক্ত উজ্জ্বল। সম্ভবত গায়ের উগ্র গন্ধ ইচ্ছাকৃতভাবে তীব্র করা হয়েছে। একশ দুই এখন কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে, মিলেট সত্যি মানুষ না কি তার মতো সাইবর্গ।

আঙ্গুল তুলে দক্ষিণ দিকে দেখিয়ে একশ দুই বলল, থাকি ওই ওদিকে।

মিলেট বললেন, তোমার মেয়ে থাকে বেবি কেয়ার সেন্টারে।

হ্যাঁ তাকেই দেখতে যাচ্ছি।

কী নাম তার ?

হেমা।

কী যেন নাম বললে তোমার ?

চমকালো একশ দুই। মিলেট তাকে পরীক্ষা করছেন। আচমকা বিভ্রান্ত করে ফেলার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। একশ দুই শান্ত গলায় বলল, আইফা। আইফা আমার নাম। যদি কিছু মনে না করো, তাহলে বলি, আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আমাকে যাওয়ার অনুমতি দাও।

মিলেট মাথা ঝুঁকিয়ে থুতনি বুকের কাছাকাছি নিয়ে এলেন। একশ দুই হেঁটে হেঁটে চলে গেল। মিলেট মাথা তুলে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকিয়ে আছেন একশ দুইয়ের চলে যাওয়া পথের দিকে।     

হেমা বড় হচ্ছে। হেমা কাঁদে। একশ দুই তাকে পরম মমতায় বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে। হেমার কান্না বন্ধ হয় না। একশ দুই তার বুকের তাপ বাড়িয়ে দেয়। হেমা কান্না থামায়। খানিক বাদে আবার কান্না শুরু করে। এবার আগের থেকে জোরে কাঁদে। একশ দুই বুঝতে পারে তার বুকের তাপ হয়ে গেছে অতিরিক্ত। হেমা সহ্য করতে পারছে না। একশ দুই বুকের উত্তাপ কমায়। হেমার কান্না বন্ধ হয় না। একশ দুই বুঝে উঠতে পারে না, হেমা কেন কেঁদে যাচ্ছে। তার কোথায় অসুবিধা হচ্ছে।

হেমা বেড়ে উঠছে। তাকে নিয়ে একশ দুই বেড়াতে যায়। হেমা মায়ের হাত ধরে হাঁটে। হাঁটতে হাঁটতে তারা অনেক দূর চলে যায়। আবার ফিরে আসে। একশ দুই হেমাকে গাছ চেনায়, পাখি দেখায়, অন্য সাইবর্গদের কাছে যেতে বলে। হেমা আনন্দ পায়, তবে তার আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। অমনি সে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। একশ দুই তাকে কোলে নিয়ে আদর দেয়। হেমা আরাম বোধ করে না। দিনে দিনে একশ দুইয়ের কাছে হেমা একটু একটু করে বড় হতে থাকে। 

প্রথম আতঙ্কিত হওয়ার মতো ঘটনা যখন ঘটল তখন হেমার বয়স সাড়ে চার বছর। আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরা সাইবর্গ একশ দুইয়ের বাড়ি ঘিরে ফেলল। একশ দুই জানত কোনওদিন এমন ঘটনা ঘটতে পারে। বিপদ থেকে বাঁচতে সে বাড়ির বেসমেন্টে ঘর বানিয়ে রেখেছে। সেখানে চলে যেতে হবে। বেসমেন্টে যাওয়ার আগে ঘর আর বিছানা গুছিয়ে টিপটপ করে রাখা দরকার। যেন তারা অনেকক্ষণ হলো বাসায় নেই। বাইরে গেছে। বাসায় ফেরেনি।

আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যদের কাছে হার্ড সার্চ ওয়ারেন্ট থাকলে তারা ডোর বেল বাজিয়ে কিংবা বাইরে নোটিশ টাঙিয়ে চলে যাবে না। তারা দরজা ভেঙে ভেতরে ঢুকে তন্ন তন্ন করে বাসা সার্চ করবে। জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরা বাসার চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে যাচ্ছে। একশ দুই দ্রুত হাতে ঘর গুছাচ্ছে। হেমা ঘুমিয়ে থাকলে ভালো হতো। সে ভয় পেয়ে চিৎকার করলে মুশকিল হয়ে যাবে। তাদের ধরা পড়ে যেতে হবে। একশ দুই ধরা পড়তে চায় না।

আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরা কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছে। তারা এখনি ডোর বেল বাজাবে। হেমাকে ছোঁ মেরে কোলে তুলে নিয়ে পাশের ঘরে চলে গেল একশ দুই। হতভম্ব হয়ে গেছে হেমা। ঘটনা কী ঘটেছে সে বুঝতে পারছে না। তবে গুরুতর কিছু হয়েছে তা অনুমান করতে পারছে। হেমা শব্দ করল না। মায়ের বুকের সঙ্গে সেঁটে থাকল।

ডোর বেল বাজছে। ঘরের কাঠের পাটাতন তুলে হেমাকে নিয়ে একশ দুই বেসমেন্টে চলে গেল।

সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকজন সাজ সাজ রব তুলে দুড়দাড় করে বাড়িতে ঢুকে পড়ল। তারা একশ দুই আর হেমাকে খুঁজছে। হেমাকে বুকের ভেতর শক্ত করে চেপে ধরে রেখেছে একশ দুই। হেমার কষ্ট হচ্ছে। তবে সে বুঝে গেছে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। হেমা কোনও আওয়াজ করেনি। মাথার ওপর ঘরের কাঠের মেঝেতে মচ মচ আওয়াজ হচ্ছে। ভারী বুটের আওয়াজে আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে হেমা। যে কোনও সময় ভয়ে চিৎকার দিয়ে কেঁদে উঠতে পারে। একশ দুই আরও জোরে তাকে বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রাখল। হেমার নিশ^াস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তবু সে কোনও শব্দ করল না।

সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরা হেমা কিংবা একশ দুইকে খুঁজে পেল না। তারা পুরো বাড়ি তছনছ করে দিয়ে ফিরে গেল।

একশ দুই বুঝতে পেরেছে এখানে থাকা তাদের জন্য নিরাপদ নয়। সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকজন তাদের খোঁজে আবার আসবে। হেমাকে নিয়ে এখান থেকে অন্য কোথাও চলে যাওয়া দরকার। আপেল বাগান কর্তৃপক্ষকে জানাতে হবে। না জানিয়ে গেলে তার ওপর সন্দেহ বাড়বে।

আপেল বাগানে গেল একশ দুই। সেখানে গিয়ে প্রথম তার নজরে এল ওক গাছের নিচে কেউ নাই। অনেক দিন বাদে আজ প্রথম মিলেট নামের সেই নারী ওক গাছের নিচে এসে বসেননি।

যতদিন কাজ করেছে ততদিনের ইউনিট বুঝে নিয়ে আপেল বাগান থেকে ফিরে এল একশ দুই। কর্মী সম্পর্কিত ডিপার্টমেন্টের হেড সাইবর্গ ইটনি জানতে চাইল, তুমি কাজে ইস্তফা দিতে চাইছ কেন ?

একশ দুই বলল, এখানে মানবসন্তান অনেক কম। আমার মেয়ে হেমা বড় হচ্ছে। তাকে এমন এক জায়গায় নিয়ে যেতে চাই যেখানে সে অনেক মানুষের ভেতর বড় হবে। আর সেরকম এক জায়গায় কাজ পেয়ে গেছি।

ইটনি তার কাছে আর কিছু জানতে চায়নি। এখানে মানবসন্তানের বেড়ে ওঠা ও বিকাশের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি। সাইবর্গ জানে তাদের চূড়ান্ত অবস্থা মানুষের ওপর নির্ভরশীল। তাই তারা চায় সকল মানবসন্তান পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হয়ে বড় হোক।

হেমাকে নিয়ে একশ দুই সেখান থেকে বহু দূরের এক গ্রামে চলে এসেছে। কাজল নদীর পাড়ে সুরাশ্রম গ্রাম। এখানে যাদের বসবাস তারা খামারে কাজ করে। সকলে কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকে সারাদিন। কারও ব্যক্তিগত ব্যাপারে আগ্রহ দেখায় না। হেমা বা একশ দুইয়ের ব্যাপারেও তাদের কোনও কৌতূহল দেখা গেল না।

হেমার বয়স হয়েছে ১০ বছর।

বিকাল। হেমাকে নিয়ে একশ দুই হাঁটতে বের হয়েছে। তারা প্রতিদিন শেষ বিকেলে হাঁটে। হেমা ইশকুলে যায়। বেশ মেধাবী হয়েছে। ইশকুলের পড়া যেমন নিজে থেকে করে নিতে পারে, তেমনি নিজে ভেবে কাজও করতে পারে।

বিকেল পড়ে আসছে। সন্ধ্যার আগমুহূর্ত। এক রোবট দুটো গরু নিয়ে খামারে যাচ্ছে। আচমকা গরু তেড়ে এল হেমার দিকে। হতভম্ব হয়ে গেছে একশ দুই। বুঝতে পারছে না কী করবে। গরুকে থামানো দরকার। কিন্তু কীভাবে উন্মত্ত গরুকে বশ মানানো যাবে ভাবতে পারছে না।

গরু ছুটে কাছাকাছি চলে এসেছে। হেমা সরসর করে গাছে উঠে পড়ল। গরু ছুটে এসে গাছের গোড়ায় থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছে। রোবট ছুটে এল। সে গরুকে নিজের আয়ত্তে নিয়েছে। করুণ মুখে বলল, গরুর এহেন ব্যবহারে আপনাদের কাছে আন্তরিকভাবে ক্ষমা চাইছি। বুঝতে পারছি না, সে কেন মানুষ দেখলে খেপে যাচ্ছে। কোনও রোবট দেখলে এমন আচরণ করছে না। কিছুক্ষণ আগে আরেকজন মানুষের দিকে তেড়ে গিয়েছিল।

গাছের নিচের ডালে নেমে এসেছে হেমা। সে বলল, কাপড় দিয়ে গরুর চোখ বেঁধে নিয়ে যান।

রোবট জিজ্ঞেস করল, তাহলে সে দেখবে কেমন করে ?

হেমা বলল, তাকে দেখতে হবে না। তার পাশে আরেকটি গরু আছে, আপনি টেনে নিয়ে যাচ্ছেন, এতে গরু বিশ^াস করবে তার কোনও বিপদ হবে না। সে নিশ্চিন্তে হেঁটে যাবে। চোখ বাঁধা বলে পথে কোনও মানুষ দেখতে পাবে না। তাই সে ক্ষেপে গিয়ে কারও দিকে ছুটে যাবে না।

রোবট গরুর চোখে কাপড় বেঁধে হাঁটিয়ে নিয়ে গেল। গরু কোনও যন্ত্রণা না করে হেলেদুলে হেঁটে যেতে থাকল।

হেমা গাছ থেকে নেমে এসেছে। একশ দুই বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চোখে হতচকিত ভাব। সে অবাক গলায় বলল, তুমি কেমন করে বুঝলে তোমাকে গাছে উঠতে হবে ? আগে কখনও তুমি এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হওনি। তোমার অভিজ্ঞতা নেই। এমন সমাধান আমার ভাবনায় আসেনি।

হেমা ধীরেসুস্থে বলল, মা, মানুষের ব্রেইন তাকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য সিগন্যাল দেয়। সাইবর্গ শুধু ততটুকু জানে, যেটুকু তার ভেতর প্রোগ্রামিং করে দেওয়া হয়।

একশ দুইয়ের মন খারাপ হয়ে গেল। সে বিষণ্ন মনে তাকিয়ে থাকল। হেমা বলল, মন খারাপ কোরো না, মা। তুমি চেষ্টা করলে এই সমাধান বের করে ফেলতে পারতে।

একশ দুই চুপ করে আছে, কিছু বলছে না। হেমা বলল, বিড়াল যখন কাঠবিড়ালিকে তাড়া করে, তখন কাঠবিড়ালি দৌড়ে গাছে উঠে যায়, তুমি দেখেছ। এই অভিজ্ঞতা থেকে তুমি বুঝতে পারতে।

একশ দুই হাহাকারের সুরে বলল, কিন্তু আমি তোমাকে বাঁচানোর জন্য সবগুলো উপায় ভেবেছিলাম। গরুকে থামিয়ে দেওয়া ছাড়া অন্য কোনও উপায় খুঁজে পাইনি। কিন্তু তেড়ে আসা গরুকে কীভাবে থামাতে হয় আমার জানা নেই।

হেমা বলল, তোমার ভেতর যতটুকু তথ্য ইন্সটল করা আছে, তুমি কেবল সেটুকু দিয়ে ঘটনা বিশ্লেষণ করতে পারো। তার অতিরিক্ত করা তোমার পক্ষে সম্ভব নয়। মানুষ যেভাবে ভাবে আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স সেই ভাবনা অনুকরণ করে।

দমে গেছে একশ দুই। চুপ করে আছে। খারাপ লাগছে হেমার। সে এমন কিছু বলতে চায়নি যাতে তার মা কষ্ট পেতে পারে। হেমা বলল, মা শোনো, মানুষ হচ্ছে প্রকৃতির অদ্ভুত সৃষ্টি। তার কাজকর্ম সব উলটাপালটা। ধরো, আমি ভাবছি ভরদুপুরে বাইরে ঘুরতে যাব। কিন্তু বাইরে ভীষণ রোদ আর গরম। ভরদুপুরে বাইরে গেলে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি। অতএব আমার ঘুরতে যাওয়া ঠিক হবে না। তুমি হলে কী করতে, সেই ভরদুপুরে বাইরে যেতে না। কিন্তু আমি মানুষ তো, তাই গরমে কাহিল হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়তে পারি জেনেও আমি বাইরে যাব। এটা হলো মানুষের ভাবনা আর কাজের পার্থক্য। উলটাপালটা না ?  

একশ দুইয়ের মন ভালো হলো না। আরও খারাপ হয়ে গেল। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। বুঝতে পারছে সে সন্তানকে অচেনা বিপদের হাত থেকে রক্ষা করতে অক্ষম।

হেমা দেখল মায়ের চোখ কাতর হয়ে আছে। মা কাঁদছে। মায়ের মন ভালো করার জন্য হেমা হেসে বলল, মানুষেরও সীমাবদ্ধতা আছে, মা। পাখি উড়তে পারে, মানুষ পারে না। মানুষ প্রচণ্ড গরম কিংবা ঠান্ডায় নিজের শরীরের তাপমাত্রা কমবেশি করে প্রকৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে না। তুমি পারো। আর তুমি পারো বলেই অমন কঠিন পরিস্থিতিতে আমাকে তোমার বুকের ভেতর নিয়ে রক্ষা করে যেতে পারছো।

অমনি মায়ের মন ভালো হয়ে গেল। সে হেমার যুক্তি মেনে নিল। হেমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরে একশ দুই আদর করল। মায়ের নিষ্প্রাণ বুকের ভেতর হেমা স্বস্তি পাচ্ছিল না, তবু সে কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে মায়ের আদর নিল।

ছয়

আট বছর পর।

হেমা মেডিকেল ইশকুলে পড়ে। একশ দুই স্থানীয় এক লাইব্রেরিতে কাজ নিয়েছে। সকালে দুজন একসঙ্গে বের হয়ে যায়। একশ দুই ফেরে বিকেলে। হেমা কোনওদিন দুপুরের পর ফেরে। কোনওদিন ফিরতে রাত হয়ে যায়। সেদিন কাজ থেকে বাসায় ফিরে একশ দুইয়ের অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো। এর আগে কোনওদিন তার এমন বোধ হয়নি। মনে হচ্ছে সে যেন একদম একা হয়ে গেছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে চারপাশ থেকে। নানা ধরনের তথ্য বিশ্লেষণ করে বুঝল এরকম অনুভূতিকে বলে নিঃসঙ্গতা। কেউ কেউ একে বিষণ্নতাও বলেছেন।

বাসায় ফেরার পর একশ দুইয়ের আর কিছু করার থাকে না। হেমা ফিরে নিজের খাবার নিজে তৈরি করে নেয়। সে নিজের ভেতর থাকে। গুনগুন করে গান গায়। খরগোসের মতো তুড়ুক তুড়ুক করে লাফিয়ে বেড়ায় এঘর ওঘর। এ বাসায় যে আরও একজন কেউ আছে তা যেন হেমার মনেই থাকে না।

আবার কোনও কোনও দিন তার মন ভীষণ খারাপ থাকে। দুই হাঁটু মুড়ে তার ভেতর মাথা গুঁজে ঘরের বারান্দায় বসে থাকে। এরকম হলে একশ দুই হেমার কাছে এগিয়ে যায়। মাথায় হাত রেখে বলে, কী হয়েছে, মা ?

মুখ না তুলে হেমা বলে, কিছু হয়নি।

একশ দুই বুঝতে পারে তার কিছু হয়েছে। মানুষের এই এক অদ্ভুত স্বভাব। প্রচণ্ড কষ্টের সময়ও যদি জিজ্ঞেস করা যায়, ‘কেমন আছেন’ ? সে বলবে, ‘ভালো আছি’। অথচ সে ভালো নেই। মানুষ সবসময় নিজেকে আড়াল করে।

একশ দুই বলল, আমি বুঝতে পারছি তোমার কিছু হয়েছে। নিজেকে লুকিয়ে রেখো না, মা। আমাকে বোলো।

হেমা ঝট করে মাথা তুলে তাকিয়েছে। তার চোখে পানি। একশ দুই বুঝতে পারছে না এমন কী হয়েছে যার জন্য হেমা কাঁদছে। হেমা বলল, বললেও তুমি বুঝতে পারবে না। তোমরা সবকিছু বুঝতে পারো না।

একশ দুই বুঝল হেমা বলতে চাইছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে মানুষের মন বোঝা সম্ভব নয়। তা সে মানে। তবু মেয়ের কষ্ট দেখতে খারাপ লাগছে। বলল, মায়েরা সব বুঝতে পারে। তুমি বলো, আমি বুঝব।

হেমা খানিক ঝাঁঝালো গলায় বলল, সাইবর্গ মা পারে না।

বলেই বুঝতে পারল সে ভুল করেছে। তার এমন কথায় মা মনে আঘাত পাবে। একশ দুইকে জড়িয়ে ধরে হেমা হু হু করে কেঁদে উঠল। কাঁদতে কাঁদতে বলল, কিছু মনে করো না, মা। আমি এভাবে বলতে চাইনি। আমি জানি তুমিই আমাকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারো। তবু তোমাকে বলতে পারছি না আমার কী হয়েছে। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে, মা। মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে।

একশ দুই কিছু বলল না। হেমাকে বুকের ভেতর জড়িয়ে নিয়ে তার চুলে আদর করে যেতে থাকল।

জানালার পাশে বসে আছে একশ দুই। জানালার ওপাশে ফাঁকা মাঠ। তার ধার দিয়ে পায়ে হাঁটা রাস্তা। মাঠের মাঝখানে প্রকাণ্ড ইয়ু গাছ। কত শত না কি হাজার বছর হয়েছে এ গাছের বয়স তা কেউ বলতে পারে না। ইয়ু গাছের সবুজ পাতা শেষ বিকেলের রোদ্দুরে তিরতির করে কাঁপছে। কখনও চিক চিক করছে। আবার কোথাও যেন ছায়া।

একশ দুই ভাবছে মানুষ কিসে এত আনন্দ খুঁজে পায়! জীবনের কত কঠিন আর জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে তাদের টিকে থাকতে হয়। তবু তারা বেঁচে থাকতে চায়। গান গায়, হাসে, আনন্দ করে। কখনও বিষাদ তাদের মন ছেয়ে ফেলে। তারা নিস্তেজ হয়ে পড়ে। আবার তারা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে।

হেমার আগে কোনও মানুষকে এমন কাছ থেকে এত দীর্ঘ সময় দেখার সুযোগ হয়নি একশ দুইয়ের। বিচিত্র আবেগ নিয়ে বেড়ে উঠছে মেয়েটি। মুখে কিছু বলে না। তবে বুঝা যায়, তার ভেতর তোলপাড় হচ্ছে। কী সেই তোলপাড়, একশ দুই কোনওদিন জানতে পারবে না। সে শুরু থেকে আজ অবধি একই রকম। নির্দিষ্ট অনুভূতি নিয়ে সময় পার করে যাচ্ছে। তবু তার ভেতর অস্বাভাবিকতা আছে, তাই সে আলাদাভাবে ভাবতে পারে যা অন্য সাইবর্গ পারে না। তাদের রুটিন জীবন কাটিয়ে দিতে হয়। একশ দুইয়ের মনে হলো এই বিষয় নিয়ে সে একদিন হেমার সঙ্গে কথা বলবে। তার ভেতর এমন কোন আবেগ আছে, যা সাইবর্গের নেই! কোন উদ্দীপনা তাকে উদ্দীপ্ত করে রাখে। কিসে সে প্রাণবন্ত থাকে। কোন ফ্যাক্টরের জন্য মানুষ নিজের জীবন তুচ্ছ করে অন্যের জন্য লড়ে যেতে পারে।

একশ দুই পথের দিকে তাকাল। হেমা ফিরছে। হেমা একা ফিরছে না। তার সঙ্গে একজন ছেলে আসছে। তাকে আগে কখনও দেখেনি একশ দুই। তার কথা হেমা তাকে কিছু বলেনি। হতে পারে আজই তাদের প্রথম পরিচয়।

আচমকা হেমাকে ভীষণ নার্ভাস দেখাচ্ছে। সে হড়বড় করে একসঙ্গে অনেকগুলো কথা বলে যাচ্ছে। যা হেমা কখনও করে না। সে বেশ শান্ত ও গোছানো মেয়ে। গুছিয়ে প্রয়োজনীয় কথাটুকু বলে। হেমা বাসায় ঢুকেই বলল, মা, এ হচ্ছে বর্ষণ। তার সঙ্গে পরিচয় কেমনভাবে তোমাকে বলি শোনো মা। আমি তো প্রতিদিন টিউবে ইশকুল থেকে ফিরি। একদিন দেখি এই ছেলে টিউবের ভেতর কমলা বিলি করছে। আমি ভেবেছি কমলা বিক্রি করছে মনে হয়। কিন্তু টিউবে তো কিছু বিক্রি করা নিষেধ। পরে দেখি সে সবাইকে কমলা বিলাচ্ছে। এটা নাকি তার বাগানের কমলা। সে প্রতিজ্ঞা করেছিল যেবার বাগানে কমলার ফলন ভালো হবে, সে তার যাওয়া আসার পথে সবাইকে বাগানের কমলা খাওয়াবে। আরেক দিন দেখি…।

একশ দুই বুঝতে পারছে না হেমা কেন হঠাৎ এত কথা বলছে। তার চোখ মুখে অচেনা আলো। নদীর পানিতে সূর্যের আলো পড়ে যেমন ঝিকিমিকি করে সেরকম। চোখ উজ্জ্বল হয়ে আছে। চোখের নিচে দুুই গাল লাল হয়ে গেছে। যেন খানিক আগে দেখা শেষ বিকেলের নরম কমলা রোদ পড়েছে ইয়ু গাছের সতেজ সবুজ পাতায়।

একশ দুই বলল, বসে কথা বলো। বর্ষণকে নিয়ে শান্ত হয়ে বসো আগে।

হেমা যেন তখুনি বুঝতে পারল বাসায় ঢুকেই সে কথা বলতে শুরু করেছে। বর্ষণকে বসতে বলাও হয়নি। হেমা লজ্জা পেয়েছে। আলতো গলায় বলল, সরি বর্ষণ। আমার খেয়াল করা দরকার ছিল। এসো বসো।

বর্র্ষণ কিছু বলল না। মুখে হাসি এঁকে ঘরে গিয়ে বসল। একশ দুই দেখল হাসলে বর্ষণকে সুন্দর দেখায়। অতিরিক্ত সুন্দর। এই ছেলের মুখ সরলতায় ভরা। হাসিতে তাকে একদম শিশুর মতো দেখায়। একশ দুইয়ের মনে হলো এত সুন্দর মানুষ আর এমন প্রশান্ত হাসি সে আগে দেখেনি।

 হেমা বলল, মা তুমি কি আমাদের জন্য কিছু নাস্তা তৈরি করে দেবে ? ওই যে তুমি দারুণ বানাও গুলিগ্রুব আর আর ক্রামবল স্নাইডার। ও দুটো বানিয়ে দাও।

এর আগে হেমার জন্য একশ দুই বেশ কয়েকবার গুলিগ্রুব আর আর ক্রামবল স্নাইডার বানিয়েছে। চুপচাপ খেয়ে গেছে হেমা। কোনওদিন বলেনি সেগুলো ছিল খেতে দারুণ।

একশ দুই বলল, বানিয়ে দিচ্ছি। আর কিছু বানাব ?

হেমা বলল, তাহলে একটু স্মাইলি স্প্যাগেটি আর হামস্টেক বানাও।

একশ দুই বলল, আচ্ছা তুমি গিয়ে বর্ষণের সঙ্গে কথা বলো। আমি বানিয়ে আনছি।

হেমা মাকে জড়িয়ে ধরে চপলতা নিয়ে বলল, থ্যাঙ্কিউ মা। আই লাভ ইউ।

বলে হেমা ঘুরে গেল। মজা পেয়েছে একশ দুই। এই প্রথম মনে হয় তার হাসির অনুভূতি কাজ করল। সে হেসে বলল, সব খেতে হবে কিন্তু। বেশিক্ষণ সময় লাগবে না। তোমার পছন্দের গিগলিং জুস বানিয়ে দিচ্ছি। নিয়ে যেয়ো।

হেমা যেতে গিয়ে ঘুরে এল। পায়ের নখের দিকে তাকিয়ে বলল, বর্ষণকে রাতে খেয়ে যেতে বলব, মা ?

একশ দুই বলল, বলো। আর রাতে কী খেতে চাও জানিয়ে দিয়ো। বানিয়ে দেব।

একশ দুইকে আবার জড়িয়ে ধরে হেমা বলল, তুমি যা খাওয়াবে আমরা আজ রাতে তাই খাব। তোমার বানানো বিখ্যাত ফাতিজা, ক্যালামিটি ক্রাঞ্চ, ট্রাইফল আর যা খাওয়াবে সব।

একশ দুই বলল, আচ্ছা।

হেমা লাফাতে লাফাতে ঘরের দিকে চলে গেল। সেখানে বর্ষণ বসে আছে।              

সাত

ইশকুল শেষে বাড়ি ফেরার জন্য হেমা সাধারণত যে টিউব ধরে, আজ সেটা ধরতে পারেনি। টিউব স্টেশনের সামনের রাস্তায় এসে দেখে ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে বর্ষণ দাঁড়িয়ে আছে। খানিক অপ্রস্তুত গলায় হেমা জিজ্ঞেস করল, আরে, তুমি এখানে ?

বর্ষণ বলল, এদিক দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ল তুমি তো ক্লাস সেরে এই টিউব স্টেশনে আসবে। ক্রনোটেম্প দেখলাম। তোমার আসার সময় হয়ে গেছে। দাঁড়িয়ে রইলাম।  ঘটনা হচ্ছে, তোমার জন্য এসে এখানে দাঁড়িয়ে আছি।

ভালো লাগছে হেমার। আদর চোখে তাকিয়ে বলল, কতক্ষণ হলো এসেছো ? আমার ইশকুলে গেলে পারতে।

বর্ষণ বলল, রাস্তার মোড়ে কারও জন্য দাঁড়িয়ে থাকার ভেতর অন্য রকম ভালোলাগা আছে। তুমি কখনও দাঁড়িয়ে থেকে দেখো।

হাসল হেমা। হেসে বলল, এখন আমরা কোথায় যাব ?

বর্ষণ বলল, হাঁটব। হাঁটতে হাঁটতে পেছনের টিউব স্টেশনে যাব। সেখান থেকে টিউব ধরে যে যার বাড়ি।

দুপুর গড়িয়ে গেছে। তবে বিকাল হয়ে গেছে বলা যাবে না। সূর্যের তেজ কমছে। এ সময়ে হাঁটতে ভালো লাগার কথা নয়। হেমার ভালো লাগছে। সে বর্ষণের শার্টের গুটানো হাতা আঁকড়ে ধরে হাঁটছে। বর্ষণ সবসময় তার ফুলহাতা শার্টের আস্তিন গুটিয়ে রাখে। হেমা সেটা ধরে হাঁটে।

হেমা যখন ফিরতি টিউব ধরে বাড়ির কাছের স্টেশনে নামল তখন বেলা পড়ে এসেছে। টিউব স্টেশন থেকে বাস ধরে বাড়ির রাস্তায় এসে পৌঁছেছে শেষ বিকেলে। বাকিটুকু হাঁটা পথ। সামনে খানিকটা গিয়ে বাঁ দিকে মোড় নিয়েছে।

রাস্তার বাঁকের ডান দিকে বেশ পুরোনো দোতলা একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়ির কাছাকাছি এসে হেমার হাঁটার গতি কমে এল। সে ইশকুল থেকে বাড়ি ফেরার সময় প্রতিদিন দেখে সেই বাড়ির বাইরের বারান্দায় একজন তরুণী বসে আছেন। কেন জানি তিনি কাতরভাবে হেমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। কিছু বলেন না। তবে তার দৃষ্টিতে অদ্ভুত আকর্ষণ আছে। কী আকর্ষণ তা হেমা বুঝতে পারে না। তবে সেই দৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়া যায় না।

দু-একদিন হেমা রাস্তা থেকে সেই তরুণীর দিকে তাকিয়েছে। তাদের চোখাচোখি হয়েছে। হেমা হেসেছে। তরুণী হাসেননি। তিনি বিস্মিত চোখে কেবল তাকিয়ে থেকেছেন। কোনওদিন কিছু বলেননি। আজ হাত নেড়ে হেমাকে ডাকছেন। হেমা সেই ডাক উপেক্ষা করতে পারল না। রাস্তার পাশে সেই বাড়ির দিকে এগিয়ে গেল। বাইরের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকে বিভ্রান্ত হয়েছে। তরুণী বসে আছেন ইলেকট্রিক হুইল চেয়ারে।

তরুণী প্রথম কথা বললেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী নাম তোমার ?

হেমা নিজের নাম বলল।

তরুণী বললেন, আমার নাম জাইমা। তুমি আমাকে জাইমা বলেই ডাকবে। কী করো ?

হেমা বলল, মেডিকেল ইশকুলে পড়ছি।

জাইমা বলল, আমরা কি ঘরে বসে কফি খেতে খেতে কথা বলতে পারি ? যদি তোমার আপত্তি না থাকে।

হেমা খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেষ্টা করছে। অপরিচিত একজনের বাসায় ঢোকা ঠিক হবে কি না। জাইমাকে মানুষ বলে মনে হচ্ছে। সাইবর্গ হলে সে হুইল চেয়ারে বসে থাকত না। বাড়িতে আর কে কে থাকতে পারে। আচমকা কোনও বিপদ এলে বেরুনোর পথ কী কী আছে। এসব ভাবতে ভাবতে মনে করল বলবে, মা পথ চেয়ে আছে। বাসায় ফিরব। বলুন কী বলবেন।

জাইমা তার হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে ফেলেছেন। তিনি গভীর গলায় বললেন, এসো।

হেমা কিছু বলতে পারল না। সে জাইমার সঙ্গে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। অমনি বাইরের বারান্দার দিকের দরজা নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে হেমা হকচকিয়ে গেছে। ডিভানে অল্প বয়সের একজন মেয়ে আধশোয়া হয়ে আছে। তার পরনে সাদা প্যান্ট। গায়ে লাল পুলওভার। সে এক পা দিয়ে আরেক পা আঁকড়ে ধরে আছে। হাতে বই। বইয়ের নাম হুইমসি। বিখ্যাত উপন্যাস। পরপর কয়েক বছর বেস্ট সেলার ছিল। অবশ্য এ ঘটনা তার জন্মের বেশ অনেক বছর আগের।

ডিভানে শুয়ে যে বই পড়ছে সে সত্যিকারের মানুষ নয়। একজন মানুষের টুয়েলভ ডি হলোগ্রাফিক ইমেজ। দেখলে মনে হয় সত্যিকারের মানুষ। তাকে দেখে চমকানোর কারণ হচ্ছে, ঘরে ঢুকে হেমা বিভ্রান্ত হয়েছে। তার মনে হয়েছে সে যেন বিশাল আয়নার সামনে আছে। ডিভানে শুয়ে সে নিজে বই পড়ছে। অবিকল সে।

জাইমা বলল, আমার কিশোরী বেলার ইমেজ। একা থাকি। মাঝেমধ্যে দম বন্ধ লাগে। তখন আমি আমার সঙ্গে কথা বলি। আমার কৈশোর ছিল অসম্ভব সুন্দর। সেখানেই আটকে থাকি। সেখান থেকে বেরুতে চাই না বলে।

কফি মেকারে মৌমাছির ডাকের মতো বিজবিজ আওয়াজ হচ্ছে। পানি গরম হওয়ার শব্দ। জাইমার কৈশোর নিয়ে কিছু বলল না হেমা। হলোগ্রাফিক ইমেজ নিয়েও নয়। অতিরিক্ত কৌতূহল বেশির ভাগ সময় নতুন বিপদ ডেকে আনে। ঘরের চারপাশে তাকাতে তাকাতে বলল, পাঁচ-ছয় মাত্রার কোনও সাইবর্গ এনে রাখতে পারেন ঘরে। আপনাকে সঙ্গ দেবে। কিংবা কোনও একটা রোবট।

ম্লান হেসে জাইমা বললেন, তাতে কতক ইউনিট খরচ হবে। ঘরের কিস্তি মিটিয়ে, খেয়েপরে অতিরিক্ত ইউনিট আমার কাছে থাকে না। আঞ্চলিক কাউন্সিল প্রতিবন্ধী ভাতায় সামান্য কিছু ইউনিট আমাকে দেয়। আরও কিছু ইউনিট হলে তো নিজের দুটো কৃত্রিম পা লাগিয়ে নিতে পারতাম দিব্যি।

হুইল চেয়ারের সঙ্গে প্রায় মিশে গেছেন জাইমা। তার শরীর ছোট হয়ে এসেছে। তবে ভীষণ উজ্জ্বল চোখ দুটো। নিকষ কালো চোখের মণিতে বিদ্যুতের মতো ঝলক। বুদ্ধিদীপ্ত চোখের মণিদুটো চক চক করছে। আর অপূর্ব সুন্দর তার দাঁতগুলো। তাতে ঋজু ব্যক্তিত্বের ছাপ স্পষ্ট। মুখের দিকে তাকালেই বোঝা যায় তিনি একসময় দেখতে যথেষ্ট আকর্ষণীয় ছিলেন।

কৌতূহল নয়, নিতান্তই ভদ্রতার বশে হেমা শান্ত গলায় বলল, কিছু মনে না করলে যদি বলতেন পা কীভাবে হারিয়েছেন।

জাইমা সে কথার উত্তর দিলেন না। কফি তৈরি হচ্ছে। জাইমা বললেন, কোনও বিশেষ কফি তোমার পছন্দ ?

হেমা বলল, আপনি যেমন পছন্দ করেন।

আমি ব্ল্যাক কফি খাই।

আমাকেও তাই দিন।

জাইমা বললেন, হ্যামবার্গ আছে। তুমি ইশকুল থেকে ফিরছো। নিশ্চয় ক্ষুধা পেয়েছে। তোমার জন্য অল্প একটু সালাদ তৈরি করি।

হেমা বলল, ব্যস্ত হবেন না। বয়ামে কুকিজ দেখছি। কুকিজ আর কফি হলেই হবে।

জাইমা বললেন, না বোলো না, মেয়ে। বানিয়ে দিচ্ছি খেয়ে নাও।

এখন আর হেমার অস্বস্তি লাগছে না। বেশ পরিপাটি করে গোছানো ঘর। হালকা মিউজিক বাজছে। সূর্য ডোবার আয়োজন করছে। ডুবে যাওয়ার আগে শেষ আলোটুকু ছড়িয়ে দিয়েছে। ঘরের কাচে এসে পড়েছে সেই নরম কমলা সূর্যের আলো। সবুজ গাছপালার ফাঁকফোকর দিয়ে এসেছে। অপূর্ব দেখাচ্ছে।

ঘরের মাঝখানে কাঠের গোলাকার টেবিল। তার ওপরে ধোঁয়া ওঠা গরম কফি আর কুকিজ রেখেছেন জাইমা। হ্যামবার্গার রেখেছেন। সালাদ বানাচ্ছেন।

জাইমা বলল, খুব ভালো অ্যাথলেট ছিলাম। দৌড়ে চ্যাম্পিয়ান হয়েছি বরাবর। তারপর একসময় পা হারিয়ে হুইল চেয়ারে চলে এলাম।

হেমা কিছু বলল না। সে অপেক্ষা করছে কীভাবে পা হারিয়েছে সে কথা জাইমা নিজ থেকে বলবেন। সালাদ তৈরি হয়ে গেছে। টেবিলে দেওয়া হয়েছে। একটা কুকিজ তুলে নিয়ে হেমা দাঁত দিয়ে কুট করে ভেঙে মুখে পুরে নিল।

জাইমা জিজ্ঞেস করলেন, এখানে কে কে থাকো তোমরা ?

হেমা বলল, মা আর আমি।

জাইমা বললেন, মানুষের সংখ্যা দিন দিন কমে আসছে। এখন আর মানুষ দেখাই যায় না।

হেমা বলল, আমার মা সাইবর্গ।

জাইমা বললেন, তোমার মা কি বরাবর এখানেই থাকেন ?

থামল হেমা। চিন্তা করছে। এতদিন মায়ের পরিচয় সবসময় আড়াল করে এসেছে। আজ কেন জানি জাইমার কাছে কিছু লুকাতে মন চাইছে না। সে বলল, আমরা কেন্দ্রীয় শহরে থাকতাম। মা সেখানে হ্যাপি জেনারেশন জাইগোট ব্যাংকে কাজ করতেন। আমার জন্মের পর আমরা কেন্দ্রীয় শহর থেকে চলে এসেছি। মা বলেন, শহর বড্ড বেশি কৃত্রিম। পরিবেশের কাছাকাছি থাকলে নাকি সত্যিকারের মানুষ হয়ে গড়ে ওঠা যায়।

স্থির হয়ে বসে আছেন জাইমা। তিনি তাকিয়ে আছেন হেমার দিকে। তার চোখের পলক পড়ছে না। হেমার অস্বস্তি লাগছে। তার মনে হলো জাইমা যেন ভেতর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছেন। অস্বস্তি কাটাতে হেমা বলল, ইশকুল থেকে আসার সময় আপনাকে প্রতিদিন দেখি বাড়ির বাইরের বারান্দায়।

হেমাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে জাইমা বললেন, তোমাকে দেখব বলে ওখানে বসে থাকি। তুমি দেরি করে এলে আমার বুকের ভেতর ছটফট করে। কেন করে জানি না। তুমি না ফেরা পর্যন্ত আমি ঘরে ঢুকতে পারি না। যেমন আজ হয়েছে। তুমি ফিরতে দেরি করেছো। কেন আমার এমন হয় তার কোনও ব্যাখ্যা আমি পাইনি।

হুইল চেয়ার নিয়ে টেবিল ঘুরে জাইমা চলে এসেছেন হেমার পাশে। আকুতি ভরা গলায় বললেন, আমি কি তোমার হাতটা একবার ধরতে পারি ?

হেমা বড় বড় চোখে তাকিয়ে আছে জাইমার দিকে। জাইমাকে ভীষণ অসহায় দেখাচ্ছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে ভেঙেচুরে পড়ে থাকা এক ধ্বংসস্তূপ। হেমা হাত বাড়িয়ে দিলো। জাইমা নিজের দু হাতের ভেতর হেমার হাত জড়িয়ে ধরলেন।

থরথর করে কেঁপে উঠেছে হেমা। যেন আচমকা তার শরীরের ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়ে গেল। একদম অন্যরকম অনুভূতি। প্রথম সে কোনও মানুষের হাতের স্পর্শ পেয়েছে। বর্ষণের সঙ্গে তার বারবার দেখা হয়েছে। কিন্তু কোনওদিন কেউ কারও হাত ধরেনি। বর্ষণের শার্টের আস্তিন ধরে হেঁটেছে হেমা। হাত ধরতে ইচ্ছে হয়েছে। বলা হয়নি। ধরাও হয়নি। জাইমার হাতে অদ্ভুত উষ্ণতা। যে উষ্ণতা সে তার সাইবর্গ মায়ের কাছে পায়নি। জাইমার শরীরের রক্ত চলাচল অনুভব করতে পারছে  হেমা। তার পুরো শরীর শিহরিত হয়ে উঠেছে। সে আকুল চোখে তাকিয়ে আছে জাইমার দিকে।

জাইমা বললেন, অ্যাথলেটিক্সে একসময় আমার খুব নাম হলো। শহরময় আমাকে নিয়ে আলোচনার তুফান উঠল। সেই ঝড় আমাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। খ্যাতির অহংকার পেয়ে বসল আমাকে। প্রবল স্রোতে ভেসে গেলাম। নিজেকে নিয়ে গেলাম অধরা পর্যায়ে। পার্টি, ক্লাব, হইহুল্লোড়ে মেতে থাকলাম। তাতে আমার শরীর ভেঙে যেতে থাকল। লড়ে যাওয়ার শক্তি হারালাম। নিজেকে আর অ্যাথলেটিক্সের চূড়ান্ত স্থানে ধরে রাখা সম্ভব হলো না। আমার অবস্থান পড়তে থাকল। ইউনিট কমে গেল। সঙ্গীসাথী যারা ছিল তারা আমাকে একে একে ছেড়ে গেল। আমি একা হয়ে পড়লাম।

সূর্য ডুবে গেছে। বাইরে ধীরে ধীরে অন্ধকার জমাট বাঁধছে। ঘরের ভেতর স্নিগ্ধ আলো। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। কেউ সালাদ খায়নি। ওরকমই আছে। জাইমা এখনও হেমার হাত ছাড়েননি। তিনি নিজের দু হাত দিয়ে হেমার হাত জড়িয়ে ধরে বুকের কাছে নিয়ে এলেন। বুকের সঙ্গে চেপে ধরে রেখেছেন। হেমা নিজেকে শিথিল করে দিলো।

জাইমা বললেন, নিজেকে অযোগ্য কেউ বোধ হতে থাকল। আবার ট্র্যাকে ফেরার চেষ্টা করলাম। আমার প্রচুর ইউনিট দরকার ছিল। সেই সময় একজন মাদক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যোগাযোগ হলো আমার। সে আমাকে মাদক চোরাচালানের জন্য প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি ইউনিট দিতে চাইল। আমি রাজি হলাম। দিনে দিনে মাদক পাচারে অভ্যস্ত হয়ে পড়লাম। নগদ ইউনিট আসতে থাকল। প্রচুর ইউনিট। আবার পার্টি, ক্লাব, হইহুল্লোড়ে মেতে উঠলাম। নতুন অনেক বন্ধু জুটে গেল অল্প কয়েক দিনে।

অল্প অল্প হাঁপাচ্ছেন জাইমা। চুপ করে আছেন। হেমা কিছু বলল না। সে সময় দিচ্ছে। জাইমা নিজের ভেতর নিজেকে গুছিয়ে নিতে থাকলেন। খানিক বাদে শান্ত হয়ে এলে বললেন, একদিন সিকিউরিটি কাউন্সিলের নজরে পড়ে গেলাম। আমার কাছে লুকানো ছিল মাদকের প্যাকেট। সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যদের নজর এড়াতে দৌড় শুরু করলাম। পেছনে সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরা তেড়ে আসছে। আমি দৌড়াচ্ছি। সামনে রেললাইন। দৌড়ে রেললাইন পার হতে চেয়েছিলাম। লাইনে আটকে উপুড় হয়ে পড়ে গেলাম। ম্যাগনেটিক ট্রেন ছুটে এসে আমার পা দুটো কেটে দিয়ে চলে গেল। জ্ঞান হারানোর আগে মাদকের প্যাকেট ছুড়ে দিয়েছিলাম ট্রেনের দিকে। কাজটা করেছিলাম যখন রেললাইনে পা আটকে উপুড় হয়ে পড়ে গিয়ে দেখলাম ট্রেন আসছে তখুনি। সেই প্যাকেট ট্রেনের ধাক্কায় বাতাসে উড়ে গিয়ে কোথায় পড়েছিল জানি না। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর জেনেছি সিকিউরিটি কাউন্সিলের সদস্যরা আমার কাছে কোনও মাদকের প্যাকেট পায়নি।

জাইমার হাতের ভেতর থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়েছে হেমা। সে উঠবে। মায়ের কথা মনে হচ্ছে। মা নিশ্চয় সন্ধ্যা পর্যন্ত রাস্তার দিকে তাকিয়ে ছিল। দেরি হলে মা যোগাযোগ করে না। তবে হেমা বুঝতে পারে তার অস্থিরতা।

জাইমা হুইল চেয়ার ঘুরিয়ে সরে গেছেন। বললেন, সালাদ খাও। তোমার জন্য বানালাম।

হেমা বলল, এখন খেতে ইচ্ছে করছে না। আপনি চাইলে বক্সে দিয়ে দিতে পারেন। ডিনারে খাব।

জাইমা সালাদ ফয়েল বক্সে দিতে দিতে বললেন, হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আমি একদম ইউনিট শূন্য হয়ে পড়লাম। সুস্থ হতে জমানো ইউনিট সব খরচ হয়ে গেল। ইউনিটের জন্য মাদক চোরাকারবারিদেরর সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। তারা আমার সঙ্গে তখন সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছে। ইউনিট না থাকার বীভৎস কষ্ট টের পেতে থাকলাম। প্রথম বিক্রি করলাম একটা কিডনি। তুমি জানো মানুষের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কী ভীষণ দামী। সাইবর্গে ব্যবহার করা হয়।

এসব শুনে হেমার অস্থির লাগছে। তবু সে চুপচাপ বসে থাকল। জাইমা বললেন, তারপর বিক্রি করেছি খানিকটা ফুসফুস। পরে লিভারের অংশ। শেষে আর বিক্রি করার মতো কিছু ছিল না। আমার কোনও উত্তরাধিকার এ পৃথিবীতে রেখে যেতে চাইনি। ইউনিটের প্রয়োজনে নিজের কাছে হার মানলাম। একদিন হ্যাপি জেনারেশন জাইগোট ব্যাংকে গেলাম। সেখানে আমার ডিএনএ বিক্রি করে দিয়ে এলাম।

হেমা উঠে দাঁড়িয়েছে। হুইল চেয়ার নিয়ে জাইমা আবার এগিয়ে এলেন। তিনি সালাদের বক্স দিলেন হেমার হাতে। হেমা নিজের ব্যাগে সেটা রেখে দিলো। জাইমা অবসন্ন গলায় বললেন, কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের কাছে থাকার জায়গা আর প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য দরখাস্ত করেছিলাম। বহুদিন পর তারা এখানকার আঞ্চলিক কাউন্সিলের মাধ্যমে সহজ কিস্তিতে আমার এই থাকার জায়গাটুকুর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। আর মাস গেলে সামান্য কিছু ইউনিট দেয় প্রতিবন্ধী ভাতা হিসেবে।

হঠাৎ কেন জানি হেমার কাছে চারপাশ কেমন শূন্য বোধ হচ্ছে। তার এমন কেন লাগছে সে বুঝতে পারছে না। মনে হচ্ছে গহিন কোনও অন্ধকার কুয়ার মধ্যে পড়ে যাচ্ছে। যার তল নেই। হেমা বলল, আমি কি আপনাকে একবার জড়িয়ে ধরতে পারি ?

জাইমা দুই হাত সামনে বাড়িয়ে দিয়েছেন। হেমা তাকে জড়িয়ে ধরল। তার ভেতর বিস্ময়কর আবেগের আলোড়ন শুরু হলো। সে জাইমার হার্টবিট অনুভব করতে পারছে। বুকের ভেতর ঢিপ ঢিপ ঢিপ ঢিপ করছে। সেই বিট তার নিজের ভেতর সঞ্চারিত হচ্ছে। ইচ্ছে করছে অনন্তকাল জাইমাকে জড়িয়ে ধরে থাকতে।

হেমা আলতোভাবে জাইমার বুকের কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। ঘর থেকে বের হতে গিয়ে তার চোখ পড়ল ডিভানে। অমনি বিভ্রান্ত হয়েছে আবার। কিশোরী জাইমা তার দিকে তাকিয়ে আছে। না কি সে নিজে তাকিয়ে আছে নিজের দিকে! অপার বিস্ময় নিয়ে জাইমার বাসা থেকে হেমা বেরিয়ে এল।

রাত। হেমা খাচ্ছে। একশ দুই পাশে বসে আছে। এমনিতে হেমা খাওয়ার সময় সে বসে থাকে না। আজ হেমা তাকে থাকতে বলেছে।

হেমা খাচ্ছে আরাম করে। আসার সময় জাইমা সালাদ দিয়ে দিয়েছেন। সালাদ খেতে ভালো লাগছে।

হেমা বলল, তুমি জাইমা নামে কাউকে চেনো, মা ?

একশ দুই স্থির হয়ে আছে। তার কয়েক সেকেন্ডের স্থিরতা মনে হলো কয়েক ঘণ্টা। গলার স্বরে কোনও আলোড়ন না তুলে বলল, জাইমা নামে একসময় একজন খুব ভালো অ্যাথলেট ছিল। পরে ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টে পা দুটো হারিয়েছে। কেউ বলে প্রচণ্ড হতাশা থেকে সে সুইসাইড করতে গিয়েছিল। কেউ বলে মাদক চোরাকারবারিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল। সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাছ থেকে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। সেসব তোমার জন্মের আগের ঘটনা।

সালাদের শেষটুকু মুখে পুরে চিবুচ্ছে হেমা। খাওয়া শেষ হলে মুখ মুছে বলল, আজ জাইমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল। আমাদের রাস্তার ওই বাঁকের ওপাশে থাকেন। প্রতিদিন দেখা হয়। আজ কথা হয়েছে। সেজন্য আসতে দেরি হলো। তিনিই সালাদ বানিয়ে দিয়েছেন আমাকে।

একশ দুই তাকিয়ে আছে হেমার দিকে। চোখের দিকে তাকিয়ে সে কী ভাবছে বোঝা যাচ্ছে না। তবে তার রেটিনার রং বদল হচ্ছে। সবুজ রং ধীরে ধীরে নীল হয়ে যাচ্ছে। হেমা বলল, তিনি তোমাদের হ্যাপি জেনারেশন জাইগোট ব্যাংকে গিয়েছিলেন ডিএনএ বিক্রি করতে।

চুপ করে আছে একশ দুই। তার ভেতর আচমকা ফ্যাকাশে ভাব চলে এসেছে। স্থির হয়ে বসে আছে। তাকে মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। তাকিয়ে আছে কাচের জানালা দিয়ে বাইরের দিকে। বিশাল ফাঁকা মাঠ। মাঠের মাঝখানে হাজার বর্ষজীবী বৃহৎ ইয়ু গাছ। চাঁদের আলো এসে পড়েছে ইয়ু গাছের পাতায়।

জাইমার কাছে যা যা শুনেছে সব বলে যাচ্ছে হেমা। একশ দুই তার কিছুই শুনছে না। জোছনামাখা অন্ধকারে ঝাঁকড়া ইয়ু গাছকে অপার্থিব বোধ হচ্ছে। ইয়ু গাছের ডালপালার ফাঁক দিয়ে জোছনা গলে পড়ছে মাটিতে।

সকাল। হেমা ইশকুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। একশ দুই লাইব্রেরিতে যাবে বলে বসে আছে। হেমাকে দেখে বলল, তোমার সঙ্গে একটা ব্যাপারে কথা বলতে চাইছিলাম। সময় হবে ?

হেমা নিজেকে গোছাতে গোছাতে বলল, জরুরি কিছু ?

একশ দুই বলল, চলো আমরা তোমার ইশকুলের কাছে কোথাও বাসা নিয়ে চলে যাই।

হেমা জিজ্ঞেস করল, কেন মা ?

একশ দুই বলল, সেখান থেকে তোমার ইশকুল কাছে হবে। তা ছাড়া শপিং মল, রেস্টুরেন্ট সব সেখানে আছে। এখানে তো কিছু নেই।

আর তোমার লাইব্রেরি ? ওখান থেকে এখানে এসে কাজ করবে ?

ওখানেই কোনও কাজ জুটিয়ে নেব। তোমার ইশকুলের পাশে ফাঁকা বাসা খুঁজছি। তুমি ইশকুল থেকে ফিরলে জানাব।

দৃঢ় গলায় হেমা বলল, এখান থেকে আমি কোথাও যাব না, মা। কোনওদিন নয়। তুমি আর কোনওদিন আমাকে এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা বলবে না।

হেমা বেরিয়ে যাচ্ছে। তার চলে যাওয়া পথের দিকে তাকিয়ে আছে একশ দুই। ব্রেইন সার্কিট বিচিত্র সিগন্যাল দিচ্ছে। লিম্বিক সিস্টেম জানাচ্ছে মানুষ হচ্ছে সৃষ্টির সবচেয়ে গোলমেলে জীব। যাদের ব্যাপারে কোনও স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। বিক্ষুব্ধ ঝড়, খ্যাপাটে বৃষ্টি, জমাট অন্ধকারের প্রতিও মানুষের গোপন আকর্ষণ থাকে। কী সেই আকর্ষণ তার ব্যাখা পাওয়া যায় না।           

আট

আজ ছুটির দিন। হেমা ইশকুলে যায়নি। বর্ষণের সঙ্গে সে কফি পার্লারে এসেছে। কফি পার্লারের নাম, কাহাওয়া স্যাবর। শহর থেকে বেশ দূরে ঘন জঙ্গলের ভেতর এই কফি পার্লার। বাস থেকে নেমে সরু হাঁটা পথ ধরে আসতে হয়। শান্ত নিরিবিলি জায়গা। চারপাশে পাখির ডাক। এর কতগুলো সত্যিকারের পাখি আর কতগুলো বানানো তা জানা যায় না। সরু পথ দিয়ে হেঁটে আসতে আসতে কাঠবিড়ালি, খরগোশ আর অনেক পাখি দেখা যায়।

হাঁটতে হাঁটতে আজ প্রথম দুজন কোনও কথা বলেনি। হেমা আর বর্ষণ মনে মনে অনেক কথা বলে যাচ্ছে। মনের ভেতর স্রোতস্বিনী নদীতে প্রবল ঘূর্ণি উঠেছে। ঘুরপাক খাচ্ছে। নদীর পাড় ভেঙে পড়ছে হুড়মুড় করে। কিন্তু কোনও শব্দ উচ্চারিত হয়নি তাদের মুখে। মনে হচ্ছে চারপাশে কোনও আওয়াজ নেই। ভয়ংকর রকমের নিস্তব্ধতা। পায়ের সামনে দিয়ে পরপর দুটো খরগোশ ছুটে গেল। একটা খরগোশ তাড়া করেছে আরেকটাকে। হেমা চমকালো না। লাফিয়ে উঠে থেমে যায়নি। যেন সে খরগোশ দুটোকে দেখেনি। সে আছে নিজের মনের গভীরে। তল খুঁজছে।

কফি পার্লারে বাগানের ভেতর পেতে রাখা টেবিলে মুখোমুখি বসেছে হেমা আর বর্ষণ। লম্বা করে বুকের ভেতর বাতাস টেনে নিল বর্ষণ। হেমার শরীর থেকে অদ্ভুত সুন্দর পারফিউমের গন্ধ আসছে। যে গন্ধ প্রবলভাবে আকর্ষণ করে। হেমার শরীর থেকে আসা সুগন্ধ বর্ষণকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। তাকে অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে।

হেমা বাটনে চাপ দিয়ে দুই মগ কফি অর্ডার করল।

টেবিলের ওপর হাত পেতে বসে আছে হেমা। তার হাতে প্লাটিনামের চিকন ব্রেসলেট। সে শান্ত চোখে নিজের হাতের দিকে তাকিয়ে আছে। সেদিকে তাকিয়ে হেমা বলল, আমি কি তোমার হাত দুটো ধরতে পারি বর্ষণ ?

বর্ষণ তার দুই হাত দিয়ে টেবিলের ওপর রাখা হেমার হাত দুটো ধরল। হেমা সেই হাত দুটোকে শক্ত করে চেপে ধরেছে। অনুভব করতে পারছে তার শরীরে রক্ত চলাচলের গতি বেড়ে গেছে। হৃৎপিণ্ড এত জোরে জোরে ধক ধক করছে যে মনে হচ্ছে বাইরে থেকে তার আওয়াজ পাওয়া যাচ্ছে। মাথার ভেতর শূন্য হয়ে এসেছে। হেমা যেন নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। তার পিঠ ঘামে ভিজে যাচ্ছে।

আলতোভাবে বর্ষণের চোখের দিকে তাকিয়েছে হেমা। বর্ষণ বিস্মিত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। বর্ষণের চোখে নিতল ভালোবাসা আর আদর। হেমা বলল, আমার মা সাইবর্গ। মানুষের স্পর্শের এই উষ্ণতা আমি কখনও অনুভব করতে পারিনি।

হেমার চোখ পানিতে ভরে গেছে। হেমা কাঁদছে। বর্ষণের হাতের মুঠোর ভেতর তার হাত শিথিল হয়ে এসেছে। বর্ষণ সেই হাত শক্ত করে আঁকড়ে ধরল।

সার্ভিস টেবিল থেকে হেমার নাম ডাকছে। কফি তৈরি হয়েছে। বর্ষণ হাত দুটো আলগা করে ফেলল। উঠে দাঁড়াল। হেঁটে গিয়ে সার্ভিস টেবিল থেকে কফি নিয়ে এসেছে।

হেমা হাসছে। তার চোখে লজ্জা। লজ্জায় দুই চোখ হাসছে। সেখানে পানি নেই। হেমা মুছে ফেলেছে।

বর্ষণ বলল, তুমি অতিরিক্ত সুন্দর। তুমি কখনও নদীর পানিতে শেষ বিকেলের রোদ্দুর দেখেছো কি না জানি না। তুমি সেরকম সুন্দর। না, ঠিক সেরকম নয়। তুমি উথালপাতাল জোছনায় কাশফুলের মতো সুন্দর। উহু, ওরকমও নয়। তুমি হচ্ছো, কচি সবুজ ধানক্ষেতের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া বাতাসের মতো। নাহ, এরকমও নয়। তুমি পাকা যবক্ষেতে বিকেলে বেলার রোদ্দুরের মতো।

হেসে ফেলেছে হেমা। মাথা দুলিয়ে বলল, তুমি পাগল। পাগল টু দি পাওয়ার এন।

কফি মগে চুমুক দিয়ে বর্ষণ বলল, এরা ভেলভেটো দারুণ বানায়। তুমি কেমন করে বুঝলে কফির ভেতর ভেলভেটো আমার পছন্দ ?

হেমা বলল, আমার পছন্দকে গুরুত্ব দিয়েছি। আশা করেছিলাম তোমার পছন্দ আমার পছন্দের সঙ্গে মিলে যাবে। আমি আনন্দিত যে সেটা মিলে গেছে। তবে কখনও ব্ল্যাক কফিও পছন্দ করি নিজের জন্য। সেটা কখনও। সবসময় নয়।

বর্ষণ বলল, এদের সবচেয়ে চমৎকার হচ্ছে কফি ডেকোরেশন। আর পরিবেশনা। অন্য কোনও কফি শপে তুমি এরকম পাবে না। কেমন বুনো ব্যাপার আছে। অনেক বেশি প্রাকৃতিক, মেকি নয়।

 হেমা চুপচাপ তাকিয়ে আছে বর্ষণের দিকে। সে চোখ ফেরায়নি। কোনও কথা না বলে তার নিঃশব্দে তাকিয়ে থাকতে ভালো লাগছে। হেমার চোখে মুগ্ধতা।   

 কফি পার্লার ধীরে ধীরে ফাঁকা হয়ে আসছে। যারা কফি খেতে এসেছিল তারা কফি খেয়ে চলে যাচ্ছে। দুপুরে এ জায়গাটা একদম ফাঁকা হয়ে যায়। আবার বিকেলের দিকে মানুষের ভিড় বাড়ে। ছুটির দিন হওয়াতে এখনও কয়েকজন আছে। তারা কফি খাচ্ছে। দুপুর হয়ে আসছে।

হেমা আর বর্ষণ যে টেবিলে বসেছে তার মুখোমুখি টেবিলে খানিক দূরে একজন বসে আছে। তার হাতে লুমিনারিড প্রক্সিমা। সে সেটার দিকে তাকিয়ে আছে, কিন্তু সেখান থেকে কিছু পড়ছে বলে মনে হচ্ছে না। ঘরে ঢুকেও চোখ থেকে সানগ্লাস খোলেনি। হয়তো সে কোনও মানুষ নয়, সাইবর্গ। চোখ দেখলে অনেক সময় মানুষ আর সাইবর্গ আলাদা করা যায়। সেজন্য নিশ্চয়ই চোখ গাঢ় রঙিন কাচের চশমায় ঢেকে রেখেছে। তার সামনে সিন্থোমাঞ্চ। লোভনীয় খাবার। সে তাতে এক কামড়ও দেয়নি। পায়ে খয়েরি জুতো। পরনে ধূসর প্যান্ট। গায়ে শ্যাওলা সবুজ ঢোলা শার্ট। হাত থেকে লুমিনারিড প্রক্সিমা টেবিলের ওপর রেখে মাঝেমধ্যে হেমার দিকে তাকাচ্ছে। হেমা অস্বস্তি নিয়ে গুছিয়ে বসল। এখানে আসার পর থেকে সে ওই লোকটাকে দেখছে। শুরুতে গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারা এখান থেকে না ওঠা পর্যন্ত ওই লোকটাও উঠবে না। সে কফি খেতে আসেনি। তার অন্য মতলব আছে।    

বর্ষণ বলল, লাঞ্চের অর্ডার করছি।

হেমা গহিন গলায় বলল, তোমার মা একজন সত্যিকারের মানুষ, তাই না ?

বর্ষণ বলল, হ্যাঁ। মায়ের বেশ বয়স হয়েছে। তার চেয়ে বেশি তিনি বুড়িয়ে গেছেন। বাবা সাবওয়েতে কাজ করতেন। অ্যাক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর মা মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েন। আমার একজন বড় বোন আছে। মায়ের সিনিয়র সিটিজেন হোমে থাকার কথা ছিল। আমরা দুই ভাইবোন আঞ্চলিক কাউন্সিলের কাছে দরখাস্ত করলাম। তারা এসে আমাদের থাকার জায়গা দেখে গেল। মায়ের যত্ন কীভাবে করব রীতিমতো তার পরীক্ষা দিতে হলো। নানা হাঙ্গামা শেষে আঞ্চলিক কাউন্সিল বলেছে মা আমাদের কাছে থাকতে পারবেন। যখন ইচ্ছে হয় তখন মা বোনের কাছে থাকেন। ইচ্ছে হলে আমার কাছে আসেন।

হেমা জিজ্ঞেস করল, মা এখন কোথায় আছেন ?

বর্ষণ বলল, আমার কাছে।

হেমা বলল, আমাকে একদিন মায়ের কাছে নিয়ে যাবে ?

ওই টেবিল থেকে সানগ্লাস পরা লোকটা উঠে এসেছে। চোখের চশমা না খুলে সরাসরি হেমার দিকে তাকাল। থমথমে গলায় বলল, তোমার নাম হেমা ?

হেমা বিরক্তি আর বিস্ময় মেশানো গলায় বলল, হ্যাঁ।

লোকটা টেবিলে দু হাতের ভর রেখে বলল, তোমার মায়ের নাম কী ?

হেমা বুঝতে পারছে কোথাও কোনও গণ্ডগোল হয়েছে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে বলল, সেটা কি আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন ?

লোকটা উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল। তার গলা কিছুটা হালকা শোনাচ্ছে। আগের মতো থমথমে মনে হচ্ছে না। সে বলল, আমি আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিল থেকে আসছি। তুমি চাইলে আমার আইডি কার্ড দেখতে পারো। তোমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।

হেমা বলল, বলুন।

লোকটা বলল, তোমাকে একা বলতে চাইছিলাম।

বর্ষণকে দেখিয়ে হেমা বলল, সে আমার বন্ধু। অসুবিধা নেই। আপনি এখানেই বলুন। বসুন।

লোকটা বসল। সানগ্লাস খুলে টেবিলের ওপর রাখল। হেমা তাকিয়ে দেখল তার চোখের গোলাপি রেটিনা ঘন সবুজ হয়ে যাচ্ছে। নিশ্চিত হওয়া গেল সে মানুষ নয়, সাইবর্গ।

লোকটা বলল, গতকাল তুমি জাইমার ওখানে গিয়েছিলে। তোমার সঙ্গে তার কী কথা হয়েছে আমার জানা দরকার।

 হেমা চমকালো। কিছু বলল না। লোকটা বলল, বহু বছর আগে সেন্ট্রাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ফোর্স তাকে ধরতে গিয়েছিল। সে ছিল মাদক কারবারি দলের সদস্য। সেন্ট্রাল সিকিউরিটি কাউন্সিল ফোর্সের কাছে কনফার্ম ইনফরমেশন ছিল তার কাছে মাদক আছে। কিন্তু তাকে যখন ধরা হয় তখন তার কাছে কোনও মাদক পাওয়া যায়নি। এজন্য সেন্ট্রাল সিকিউরিটি ফোর্সকে অহেতুক অনাকাক্সিক্ষত, অমর্যাদাকর দোষের দায় নিতে হয়। এ ঘটনা তোমার জন্মের আগের। তোমার জানার কথা নয়। দীর্ঘদিন জাইমার সঙ্গে কেউ দেখা করে না। সে একা থাকে। শেষ তুমি গেছো তার সঙ্গে দেখা করতে। জাইমা তার মাদক লুকানোর কথা তোমাকে কী বলেছে ?

ঝড় শুরু হয়েছে হেমার ভেতরে। সে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে। সাইবর্গ যদি একবার বুঝতে পারে সে নার্ভাস হয়ে গেছে তাহলে তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে কথা বের করবে। এরা অতিরিক্ত নিষ্ঠুর, বর্বর আর অমানবিক। তারা তো মানুষ নয়, মানবিক হওয়ার তাই প্রশ্ন নেই। জাইমা তাকে মাদকের কথা বলেছিল।

বর্ষণ অবাক হয়ে হেমার দিকে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কী ঘটছে সে বুঝতে পারছে না। তবে ঘটনা যে ভয়াবহ কিছু তা অনুমান করতে পারছে। আচমকা বর্ষণের কপালে বিনবিনে ঘাম জমতে শুরু করল।

হেমা দ্রুত চিন্তা করে যাচ্ছে। আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিল থেকে যেমন তার কাছে জাইমার খোঁজ নিতে এসেছে তেমনি তারা জাইমার কাছে যাবে তার খোঁজ নিতে। সে মায়ের কথা সব জাইমাকে বলে এসেছে। জাইমা সেসব কথা আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলকে জানিয়ে দিলে মা তীব্র সংকটে পড়ে যাবে।

স্থির চোখে হেমা সামনে বসে থাকা আঞ্চলিক সিকিউরিটি কাউন্সিলের ওই লোকটার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে। কারও নার্ভের ওপর প্রভাব ফেলে তাকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে থাকা কার্যকরী কৌশল। এই কৌশল মানুষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাইবর্গের ওপর এই কৌশল কাজ করে কি না হেমা জানে না। তবু সে লোকটার চোখের ওপর থেকে চোখে সরালো না। চোখের রেটিনার রং বদলে যাওয়া দেখতে দেখতে হেমা বলল, প্রকৃতি রহস্য পছন্দ করে। কিছু রহস্য সে লুকিয়ে রাখে। কিছু প্রকাশ করে। জাইমার কিশোরী বেলার চেহারার সঙ্গে আমার চেহারার অদ্ভুত মিল আছে। তার ঘরে ঢুকলে দেখবেন ডিভানে আধাশোয়া হয়ে একজন মেয়ে বই পড়ছে। অবিকল আমার মতো দেখতে। জাইমা আমাকে সেটাই দেখাতে ডেকেছিলেন।

সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকটাকে বিভ্রান্ত দেখাচ্ছে। সে জাইমার ঘরে গিয়েছিল। সেখানে দেখেছে হেমার মতো দেখতে একজন মেয়ে লাল পুলওভার পরে ডিভানে আধাশোয়া হয়ে বই পড়ছে। সেটা একটা হলোগ্রাফিক ইমেজ।

হেমা বলল, জাইমা আমাকে কফি বানিয়ে খাইয়েছেন। রাতে খাওয়ার জন্য সালাদ বানিয়ে দিয়েছিলেন। বাসায় নিয়ে গিয়ে সালাদ দিয়ে ডিনার করেছি। তিনি তার ব্যক্তিগত কোনও কথা আমাকে বলেননি। আমার ব্যক্তিগত কথাও জানতে চাননি।

কফি পার্লারের দেয়ালে বিশাল ক্রনোটেম্প। সময় দেখাচ্ছে। দুপুর পার হয়ে যাচ্ছে। লোকটার দিকে তাকিয়ে হেমা বলল, আজ উঠি।

বর্ষণকে দেখিয়ে বলল, আমাকে ওর মায়ের কাছে যেতে হবে। তিনি আমাদের জন্য রান্না করে বসে আছেন। আমরা গেলে একসঙ্গে লাঞ্চ করব।

 হেমা উঠে পড়েছে। বর্ষণ কিছু বুঝতে না পেরে উঠে দাঁড়াল। সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকটা হতভম্ব চোখে তাকিয়ে আছে। সে পুরোপুরি বেকুব হয়ে গেছে। তার বিভ্রান্ত দৃষ্টির ওপর দিয়ে বর্ষণের হাত ধরে হেমা কফি শপ থেকে বের হয়ে এল।

এই ঘটনা কতখানি বাস্তবে ঘটেছে, আর কতটুকু একশ দুই অনুমান করে বলেছে, তা বিবেচনার আজ আর বিশেষ গুরুত্ব নেই।

নয়

ভোর হচ্ছে। বাতাসে শীতল ভাব। গতরাতের গুমোট গরম কেটে গেছে। মনে হয়েছিল বৃষ্টি হবে। বৃষ্টি হয়নি। বাতাস ছেড়েছে। শীতল বাতাস।

ভয়াবহ খারাপ খবর জেনে হেমার ঘুম ভাঙল। কর্পোরেশন খবর দিয়েছে রাতের শেষ প্রহরে জাইমা মারা গেছেন। মৃত্যুর কারণ হিসেবে তারা বলছে হার্ট অ্যাটাক। একশ দুই বলল, অনেক দিন পর একজন মানুষের মৃত্যুর খবর শোনা গেল।

হেমা জানতে চাইল, অনেক দিন পর কেন ?

একশ দুই তার কথার উত্তরে বলল, এখানে আর মানুষ কোথায়! দিন দিন মানুষ কমে যাচ্ছে।

জাইমাকে এখন কী করা হবে ?

তাকে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পরানো হবে। তারপর শোয়ানো হবে কফিনে। ফুল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হবে কফিন। আনুষ্ঠানিকতা শেষে সমাহিত করা হবে।

আমি যেতে চাই।

বেশ যাবে।

সেখানে কি শুধু মানুষ থাকে ?

সাইবর্গও থাকে। আনুষ্ঠানিকতার জন্য এত মানুষ কোথায় পাওয়া যাবে! সমাহিত করার আগে যিনি প্রার্থনা করেন, তিনি মানুষ হবেন এমনই প্রত্যাশা করা হয়। কিন্তু উপযুক্ত মানুষ পাওয়া না গেলে সেটা কোনও সাইবর্গ করে দেয়।

তবে তুমিও চলো।

একশ দুই বলল, তুমি তোমার নাস্তা বানাও। আনুষ্ঠানিকতা শুরু হতে সকাল হবে। আমি ফুলের সন্ধানে যাচ্ছি। আর শোনো, সেখানে যেতে হবে আমাদের বিশেষ পোশাকে। হয় সাদা, নয়তো কালো। সেটাই নিয়ম।

একশ দুই ফুল খুঁজতে বের হয়ে গেল। কৃত্রিম ফুল হলেও হয়। কিন্তু সে আজ মৃত জাইমার জন্য অকৃত্রিম তাজা ফুল কিনে আনবে। তাতে যত ইউনিট খরচ হয় হোক।

কফি মেকারে কফি ঢেলে হেমা বসে আছে। তার ভেতর বিষণ্ন ভাব চলে এসেছে। জাইমার স্পর্শের কথা মনে পড়ছে। কোনও মানুষের প্রথম স্পর্শ। শরীরের অকৃত্রিম রক্তের সত্যিকারের উষ্ণতা। জাইমাকে যখন সে জড়িয়ে ধরেছিল তখন তার বুকের ভেতর ঘোরলাগা গন্ধ ছিল। মানুষের বুকে সুবাস থাকে, সেটাও হেমা তখন প্রথম জেনেছে।

কফি তৈরি হয়ে গেছে। মগে কফি নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল হেমা। সামনের সরু রাস্তা ফাঁকা। বাঁকের ওপাশে জাইমার বাড়ি। কফি খেতে খেতে হেঁটে একবার গিয়ে দেখা যায় সেখানে কী হচ্ছে। মৃতের আনুষ্ঠানিকতায় হয়তো কফিনে শোয়ানোর আগে কাউকে কিছু দেখতে দেয় না। মা এলে শুনতে হবে। তা ছাড়া জাইমার তো কেউ ছিল না। নিশ্চয়ই কর্পোরেশনের গাড়ি এসে তাকে নিয়ে গেছে। ও বাড়িতে এখন কেউ নেই।

কফি অতিরিক্ত তেতো লাগছে। প্রতিদিন যেমন কফি খায় আজও সে সেরকম করে বানিয়েছে। তবু কফির তিক্ত স্বাদ তার মুখে ছড়িয়ে পড়েছে।

বর্ষণকে ডাকবে কি না হেমা ভাবছে। মানুষের মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারে সে কিছু জানে না। এর আগে কারও মৃত্যুতে সে যায়নি। বা কারও মৃত্যুর কথা শোনেনি। মৃত্যু নিয়ে কখনও ভাবেনি। মাকে জিজ্ঞেস না করে কিছু করা যাবে না।

পেটের ভেতর মোচড় দিচ্ছে। মনে হচ্ছে কফি তার পাকস্থলীর ভেতর গিয়ে সবকিছু তেতো করে ফেলেছে।

একশ দুই ফিরেছে। তার হাতে এক তোড়া সাদা ধবধবে জেফিরা ফুল। তার পাশ দিয়ে হালকা কলাপাতা রঙের সেরেস্তারা ফুল। অপূর্ব সুন্দর দেখাচ্ছে সেই তোড়া।

একশ দুই ফুলের তোড়া হেমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, তোমার জন্য এনেছি। এই ফুলের তোড়া তুমি জাইমার কফিনে দেবে।

চমৎকার সুবাস আসছে ফুল থেকে। নাকের কাছে ফুলের তোড়া নিয়ে গন্ধ শুঁকে হেমা বলল, সত্যিকারের ফুল মা। কী মিষ্টি গন্ধ!

একশ দুই বলল, জাইমার জন্য।

হেমা ঘাড় বাঁকিয়ে বলল, তুমি তাকে চিনতে, মা! সে গিয়েছিল তোমাদের কোম্পানিতে।

একশ দুই তাকে চিনতে পেরেছে। জাইমা এসেছিল হুইল চেয়ারে চেপে হ্যাপি জেনারেশন জাইগোট ব্যাংকে। তখন সে সেখানে কাজ করে। ডিএনএ পারচেজ ডিপার্টমেন্টে তার কাজ ছিল। তখনও এমব্রায়োজেনেসিস ডিপার্টমেন্টে আসেনি। জাইমা আসার পর তাকে রিসেপশন থেকে তার কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিল। তখন জাইমার শরীর ভেঙে গেছে। চোয়ালের হাড় বীভৎসভাবে উঁচু হয়ে ছিল। শরীর শুকিয়ে দড়ির মতো জিরজিরে হয়েছে। নিউজ পোর্টালে জাইমার যে ছবি তারা দেখেছে তার সঙ্গে এ জাইমাকে একেবারে মেলানো যায় না। তবে সে যখন কথা বলল তখন দেখা গেছে কী অসম্ভব সুন্দর তার দাঁতগুলো। ঝকঝকে আর সমানভাবে সাজানো। দাঁতের সেই সৌন্দর্য জাইমাকে চিনতে সাহায্য করেছিল।

একশ দুই বলল, কীভাবে আপনাকে আমি সহযোগিতা করতে পারি ?

জাইমা বললেন, ডিএনএ বিক্রি করব। দাম বেশি দিতে হবে। আপনি নিশ্চয়ই আমার পরিচয় পেয়েছেন। আমি জাইমা। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ান অ্যাথলেট। আমার মেধা আছে, সাহস আছে, লড়াই করার সক্ষমতা আছে। প্রচণ্ড রকমের পরিশ্রম করতে পারি। স্বাভাবিকভাবেই আমার ডিএনএর দাম খানিক চড়া হবে।

একশ দুই বলল, আমরা নির্দিষ্ট রেটে ডিএনএ কিনে থাকি। তার চেয়ে বেশি ইউনিট দেওয়া সম্ভব হবে না।

হতাশ গলায় জাইমা বললেন, আমার কাছে কোনও ইউনিট অবশিষ্ট নেই। ইউনিট ভীষণ দরকার আমার। না হলে ডিএনএ বিক্রি করতাম না।

আপনার রক্ত বিক্রি করতে পারেন। মানুষের রক্তের বেশ ভালো দাম দিচ্ছে।

আমার রক্ত বিক্রির সীমা অতিক্রম করে ফেলেছি। এখন আর কেউ আমার রক্ত কিনতে চাইছে না। উপায় না পেয়ে চোরাই রক্ত কারবারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। রক্ত পরীক্ষা করে তারাও রাজি হয়নি।

কিডনি, লিভার, ফুসফুস ?

একটা কিডনি বেচে দিয়েছি। ফুসফুস আর লিভারের খানিকটা করে অংশ বিক্রি করেছি।

জাইমা হাঁপাচ্ছে। একশ দুই উঠে গিয়ে এক গ্লাস জুস নিয়ে এল। জাইমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, আপনার পিপাসা পেয়েছে। খেয়ে নিন।

ঢক ঢক করে জুসটুকু খেয়েছে জাইমা। মুখ মুছে বলল, চোখের কর্নিয়া, দাঁত আর ব্রেইন সেল বিক্রি করা বাকি ছিল। সেগুলো আগাম বিক্রি করে দিয়েছি। মৃত্যুর ১ ঘণ্টার ভেতর কোম্পানি থেকে লোক গিয়ে ওগুলো নিয়ে আসবে। এখন বিক্রি করলে ইউনিট বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু এই মুহূর্তে আমার ইউনিটের খুব দরকার। ব্রেইন ছাড়া একজন মানুষ তো মৃত। আর এই অসম্ভব সুন্দর পৃথিবী দেখার জন্য চোখ দুটো রেখে দিয়েছি। দাঁতগুলো রেখেছি নিজের সৌন্দর্যের জন্য। অবশ্য আগাম বিক্রি করাতে ইউনিট অনেক কম পেয়েছি। তাছাড়া ইন্সুরেন্স কোম্পানি সেখান থেকে অনেকগুলো ইউনিট নিয়ে নিয়েছে। আমার এখন ডিএনএ বিক্রি করা ছাড়া অন্য উপায় নেই।

জাইমার জন্য কষ্ট বোধ করছে একশ দুই। তবে কোম্পানির নিয়মের বাইরে তার পক্ষে কিছু করা সম্ভব নয়। সে আন্তরিক গলায় বলল, আপনার জন্য বিশেষ কিছু করতে না পেরে দুঃখ পাচ্ছি।

জাইমা ভেঙে পড়া গলায় বলল, আমার ডিএনএ নিন। আপনাদের নির্ধারিত দামই দেবেন। তবে আমাকে একটা কথা দিন। শর্ত নয়, অনুরোধ করছি।

একশ দুই বলল, বলুন আমাকে কী করতে হবে।

জাইমা বললেন, আমার ডিএনএ থেকে যে সন্তান জন্ম নেবে তা এমন কাউকে দেবেন যে ভীষণভাবে সেই সন্তানকে আদর করবে, ভালোবাসবে। সেই সন্তানকে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে দেবে। সে হবে একজন মুক্ত মানুষ।

জাইমা কাঁদছেন। তার চোখ থেকে টপ টপ করে পানি গড়িয়ে পড়ছে গালে।

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ফুলের তোড়া হাতে দাঁড়িয়ে আছে হেমা। একশ দুই নিজের হাতে ধরা লুমিনা ফুলের স্টিক তুলে ধরে বলল, এটা আমি দেব জাইমার কফিনে। এটাও সত্যিকারের ফুল। তুমি এর গন্ধ নিতে পারো।

 হেমা তাকিয়ে আছে একশ দুইয়ের দিকে। লুমিনা ফুলের গন্ধ নেওয়ার ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখা গেল না। তার মনে হচ্ছে জাইমার ব্যাপারে মা কিছু লুকাচ্ছে। তার কাছ থেকে মা কী লুকাচ্ছে আর কেনই বা লুকাচ্ছে তা অনুমান করতে পারছে না।

পাশের টেবিলে ফুলের স্টিক রাখতে রাখতে একশ দুই বলল, চলো খুঁজে দেখি অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় উপস্থিত হওয়ার মতো ঘরে আমাদের কী পোশাক আছে।

 পোশাক পাওয়া গেছে। তবে একই রঙের পোশাক দুজনের পাওয়া যায়নি। একশ দুই পরেছে সাদা পোশাক আর হেমা পরেছে কালো।

ক্রনোটেম্পে ঠিক যখন সকাল সাড়ে সাতটা বাজে তখন শুরু হলো অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার আনুষ্ঠানিকতা। হেমা আর একশ দুই পৌঁছে গেছে আগেই। জাইমার বাড়ির বাইরের সামনের রাস্তার পাশে কফিন রাখা আছে। ফুলে ঢেকে গেছে কফিন। হেমা খেয়াল করল এত ফুল কিন্তু কোনও গন্ধ নেই। অনেকে ভিড় করে রাস্তার ওপর দাঁড়িয়ে আছে। সম্ভবত এরা সকলে সাইবর্গ। তাদের ভেতর হেমা কফি পার্লারে দেখা সিকিউরিটি কাউন্সিলের সেই লোকটাকেও দেখতে পেল। তার চোখে সানগ্লাস। সে কয়েকবার ঘাড় ঘুরিয়ে হেমা আর একশ দুইকে দেখেছে।

 কোথাও শবযাত্রার করুণ সুর বাজছে। কয়েকজন কফিন তুলে নিয়েছে কাঁধে। হেমা বাড়ির দিকে তাকাল। জাইমার বাড়ি বন্ধ। এই প্রথম হেমা অনুভব করল জাইমা নেই। তার বুকের ভেতর হাহাকারের মতো শূন্যতা চেপে বসল। কফিন নিয়ে শবযাত্রা এগিয়ে গেছে।

হেমা ফিসফিস করে একশ দুইকে জিজ্ঞেস করল, ওরা জাইমাকে কোথায় নিয়ে যাবে, মা ?

একশ দুই বলল, কবরস্থানে।

শবযাত্রার করুণ সুরের ভেতর দিয়ে হেঁটে হেঁটে তারা এসে কবরস্থানে পৌঁছালো। শববহনকারী লোকেরা কফিন নামিয়ে রাখল মাটিতে। যিনি প্রার্থনা করবেন তিনি কফিনের ওপর সতেজ পাতাসহ ইয়ু গাছের একখানা চারা রেখে দিলেন।

হেমা জিজ্ঞেস করল, মা, কফিনের ওপর কী রাখল ?

একশ দুই বলল, ইয়ু গাছের চারা। মানুষরা মৃত মানুষের কফিনে ইয়ু গাছের চারা রেখে দেয়। তারা এই গাছকে পুনর্জন্মের প্রতীক হিসেবে দেখে। অনন্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি মনে করে। হাজার বছর ধরে বেঁচে থাকে এই গাছ। ভাঙা ডাল থেকে ইয়ু গাছ জন্মাতে পারে। এমনকি পুরোনো গাছের গুড়োর ভেতর থেকেও নতুন একটা ইয়ু গাছের জন্ম হতে পারে।

জাইমাকে সমাহিত করে যখন হেমা আর একশ দুই বাড়ির পথে ফিরছে তখন সূর্য উঠে গেছে অনেক উপরে।  রোদ্দুরের তেজে বাতাস তেতে উঠেছে। শরীরে সুঁচ ফোটার মতো রোদ ফুটে যাচ্ছে। হেমা অনুভব করল সে কিছু হারিয়ে ফেলেছে। অনেক বড় কিছু। যা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। শুধু জানে না সে কী হারিয়েছে।

সেই রাতে হেমা ঘুমের ভেতর ভয়াবহ স্বপ্ন দেখল। বিশাল ফাঁকা মাঠ। সেই মাঠের শেষে উঁচু পাহাড়। ঘন সবুজ ঘাস বিছানো। হেমাকে সঙ্গে নিয়ে মা পাহাড়ে উঠছে। জাইমা সেখানে হেমার মা। স্বপ্নে ব্যাপারটা একদম অস্বাভাবিক মনে হলো না হেমার কাছে।

মায়ের কোমরে বেল্ট বাঁধা। সেই বেল্টের হুকের সঙ্গে আরেকটা চওড়া বেল্ট দিয়ে হেমার কোমরে আটকে রাখা হয়েছে। মা পাহাড়ে উঠছেন আগে আগে। তাকে অনুসরণ করছে হেমা। পাহাড় বেয়ে তারা বেশ অনেকখানি উঠে পড়েছে। এতদূর পাহাড়ে উঠতে হেমার হাঁপিয়ে যাওয়ার কথা। হেমা হাঁপিয়ে যায়নি। মা থামলেন। হেমাও থেমে গেল। মা নিচের দিকে তাকালেন। হেমার চোখে চোখ রেখে বললেন, তোমার কষ্ট হচ্ছে না তো, সোনা ?

সেই উজ্জ্বল দীপ্তিময় চোখ। হেমা বলল, একটুও না মা।

বলে হেঁয়ালি মেশানো গলায় বলল, আর আমার কষ্ট হলে তুমি কী করবে ?

কোমরে আটকানো বেল্ট ধরে জাইমা বললেন, তোমাকে টেনে আমার কাছে নিয়ে আসব। তোমাকে কখনও আমি কষ্ট পেতে দেব না আমার ছোট্ট পাখি।

মা হাসছেন। প্রথম জাইমাকে হাসতে দেখছে হেমা। এমন সুন্দর হাসি কেউ কখনও দেখেনি। যে হাসিতে পৃথিবী থমকে যেতে পারে। যে হাসি সব দুঃখ ভুলিয়ে দেয়। ভীষণ কষ্টে আদর বুলায়।

আচমকা পাহাড় থরথর করে কেঁপে উঠল। পাহাড়ের কাঁপুনি বাড়ছে। যেন ভূমিকম্প হচ্ছে। পাহাড়ে বিশাল বিশাল ফাটল দেখা যাচ্ছে। প্রচণ্ড গরম হয়ে উঠেছে পাহাড়। এখুনি যেন পাহাড়ের ফাটল দিয়ে উত্তপ্ত বাতাস, গলিত শিলা, কাদা বের হয়ে আসবে। অগ্ন্যুৎপাত শুরু হচ্ছে।

কোমরের বেল্ট শক্ত করে চেপে ধরে ওপরের দিকে তাকাল হেমা। সেখানে মা নেই। আশপাশ কোথাও জাইমাকে দেখা যাচ্ছে না। ভীষণ অসহায় বোধ করছে হেমা। ভয়ংকর আগ্নেয়গিরিতে সে একা হয়ে গেছে।

হেমাকে নিয়ে পাহাড়ের বড় এক খণ্ড ছিটকে পড়ল সমুদ্র। হেমা বুঝতে পারল না এখানে সমুদ্র কোথা থেকে এল। সমুদ্রের পানি স্থির এবং নিñিদ্র কালো। সেই জমাট কালো পানির ভেতর হেমা ডুবে যাচ্ছে। অতল সমুদ্রে হারিয়ে যাচ্ছে হেমা। তার শ^াস নিতে কষ্ট হচ্ছে। ফুসফুসে ব্যথা শুরু হয়েছে। একটুখানি বাতাসের জন্য সে মুখ হা করল। বাতাস পেল না।

প্রচণ্ড আতঙ্কের মধ্যে হেমার ঘুম ভাঙল। ঘামে তার পুরো শরীর ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। প্রবল পিপাসা পেয়েছে। হাত বাড়িয়ে বেডসাইড টেবিল থেকে পানির বোতল টেনে নিল। ঢক ঢক করে এক নিশ^াসে বোতলের পুরো পানি খেয়ে শেষ করেছে।

কাচের জানালা দিয়ে ফাঁকা মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা প্রকাণ্ড সেই ইয়ু গাছের দিকে তাকাল। অন্ধকারে ডালপালা ছড়িয়ে থাকা ইয়ু গাছকে অতিপ্রাকৃত বোধ হচ্ছে। হেমার মনে হলো এই গাছের ভেতর জাইমা মিশে আছেন।

দশ

পরের বসন্তে বর্ষণের সঙ্গে হেমার বিয়ে হলো। বিয়ে হয়েছে হারিয়ে যাওয়া আনুষ্ঠানিকতা মেনে। বর্ষণ আর হেমা বর-বউ সেজেছে। তাদের জন্য বিয়ের প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে। পরিচিত যত মানুষ ছিল সবাইকে বিয়েতে নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। তারা এসে বর আর বউয়ের জন্য আশীর্বাদ করে গেছেন। এসব আনুষ্ঠানিকতার ব্যাপারগুলো সাজিয়েছেন বর্ষণের মা। আর পুরো অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে বর্ষণের বড় বোন। উৎসব, আনন্দ, উপহার, বিপুল ভোজ সব মিলিয়ে বলা যায় আড়ম্বরপূর্ণ জাকজমক অনুষ্ঠান করে হেমার বিয়ে হয়েছে।

বর্ষণের মা যখন মেয়ের কাছে থাকে তখন বর্ষণ আর হেমা থাকে একশ দুইয়ের কাছে। মা যখন বর্ষণের কাছে থাকে তখন হেমাও গিয়ে সেখানে থাকে। হেমা আর বর্ষণ এখুনি আলাদা কোনও বাসা নিয়ে থাকতে চাইছে না।

বিয়ের এক বছর পর হেমা সন্তানের মা হলো। মেয়ে সন্তান। তার নাম রাখা হয়েছে তাতাই। মুগ্ধ চোখে একশ দুই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তাতাই হাত-পা নেড়ে বিছানায় শুয়ে খেলা করে। আচমকা কেঁদে ওঠে। একশ দুই তাকে কোলে নেয়। তাতাইয়ের কান্না থামে না। হেমা কোলে নিতেই তাতাই কান্না বন্ধ করে চুপ হয়ে যায়। ঘুম থেকে জেগে উঠে কাঁদলে, কান্না থামিয়ে আবার পরম শান্তিতে ঘুমিয়ে যায়। অন্য সময় হাসে, খেলা করে।

এই ঘটনা একশ দুইকে দারুণভাবে ভাবনায় ফেলে দিয়েছে। তার কী নেই, যা হেমার আছে! তার কোলে এসেও তাতাই কেন কাঁদে, হেমা কোলে নিলে কান্না থেমে যায়! জটিল ভাবনায় আটকে গেছে একশ দুই। একসময় বুঝতে পারল, হেমা তার মা। তাই তাতাই তার কোলে প্রশান্তি বোধ করে। কিন্তু সেই ভাবনা একশ দুইকে আরাম দিলো না। সে নিজে হেমার মা। হেমা যখন ছোট ছিল সে কাঁদলে তাকে কোলে তুলে নিত। তাতাইয়ের মতো হেমার কান্না বন্ধ হতো না। কেঁদে যেত।

আকাশ নীল হয়ে আছে। আকাশে সাদা মেঘ ভেসে যাচ্ছে। বাতাসে তীব্র গরমের ভাব নেই। মন ভালো করা সকাল। একশ দুই মন খারাপ করে বাড়ির বারান্দায় বসে আছে। তার দৃষ্টি দূর মাঠের দিকে। তাকে উদাস দেখাচ্ছে। গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন হয়ে গেছে।

হেমা এসেছে। কোলে তাতাই খেলা করছে। হেমা বলল, মা, তুমি কি কোনও বিষয় নিয়ে চিন্তিত ?

মুখ তুলে তাকাল একশ দুই। তার চোখে গভীর বিষণ্নতা। খাদে পড়ে যাওয়া গলায় বিড়বিড় করে বলল, বলো তো মা, তোমার কাছে এমন কী আছে, যা আমার কাছে নেই! তুমি যখন তাতাইকে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরো, তখন সে আরাম পায়। আমি যখন তোমাকে অমনভাবে বুকের ভেতর জড়িয়ে ধরতাম তুমি আরাম পাওনি। অস্থিরতা নিয়ে সবসময় ছটফট করেছো।

তাতাইয়ের মাথা কাঁধে রেখে হেমা বলল, মন খারাপ করে না, মা আমার। তুমি অনেক ভালো। শোনো মা, মানুষের বুকে ওম থাকে। যে ওম সাইবর্গের বুকে থাকে না। এই উষ্ণতা কৃত্রিমভাবে বানানো সম্ভব নয়। মায়ের বুকের উষ্ণতা হচ্ছে প্রাকৃতিক। প্রকৃতি মাকে এমন উষ্ণতা উপহার দিয়েছে। কমও না, আবার বেশিও না, একদম ঠিকঠাক।

একশ দুই বুঝতে পারছে। সে দেখেছে যখন বরফ পড়ে, তুষারকুঁচিতে ঢেকে যায় মা পাখি। সে তার ছানাদের তখনও বুকের ভেতর রেখে ওম দেয়। শুধু মানুষ নয়, সব প্রাণির বুকে উষ্ণতা থাকে, যা সাইবর্গের নেই।

মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটল সেদিন যেদিন তাতাইকে নিয়ে হেমা আছে বর্ষণ আর তার মায়ের কাছে। বাড়িতে একশ দুই একা। লাইব্রেরির কাজ শেষ করে বাসায় ফিরেছে। বাড়িতে কাজ বলতে ব্যাকইয়ার্ডে গাছের যত্ন নেওয়া। হেমা প্রাকৃতিক গাছ পছন্দ করে। একশ দুই তার জন্য অনেকগুলো ফুল আর সবজির বীজ আর চারা এনে ব্যাকইয়ার্ডে লাগিয়েছে। তাতাই জন্মের আগ পর্যন্ত হেমা বাগানের যত্ন নিয়েছে। তাতাই জন্মের পর সে মেয়েকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। এখন বাগানের যত্ন নেয় একশ দুই।

ঘরের ভেতর থেকে একশ দুই দেখল সিকিউরিটি কাউন্সিলের সৈনিকেরা আসছে। সংখ্যায় তারা অনেক। তাদের কাছে ভারী অস্ত্র। ব্লাস্টার এক্স-সেভেন। বাড়ি গুড়িয়ে দেওয়ার সরঞ্জাম। তারা নিশ্চয়ই কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের অনুমতি নিয়ে এসেছে। এমন দিন আসবে একশ দুই ধারণা করেছিল। তবে বিশ^াস করতে চায়নি। সুবিধা হয়েছে আজ হেমা, তাতাই, বর্ষণ বাড়িতে নেই। তারা আছে বর্ষণের মায়ের কাছে। তাদের সামনে একশ দুই ধরা দিতে চায় না।

কেন্দ্রীয় সিকিউরিটি কাউন্সিল একশ দুইকে কোনও সাধারণ অপরাধী হিসেবে দেখছে না। তাদের মনে হয়েছে একশ দুই সাইবর্গের জন্য বিরাট হুমকিস্বরূপ। সে পুরো সিকিউরিটি সিস্টেমকে অচল করে দিয়ে নিজেকে লুকিয়ে ফেলেছে। কেন সে এটা করেছে তা স্পষ্ট নয়। রাষ্ট্রের কোনও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য কোথাও পাচার করতে পারে। শুধু একজন শিশুকে নিয়ে পালানোর জন্য কোনও সাইবর্গ এত বড় ঝুঁকি নেবে না। সে পুরো সিকিউরিটি সিস্টেমকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেকে আড়াল করে রেখেছে।

কেন্দ্রীয় সিকিউরিটি কাউন্সিল একশ দুইয়ের সৃষ্টির ত্রুটিকে আমলে নেয়নি। তারা ধারণা করেছে, হয় সে নিজে কিংবা কোনও মানুষ তাকে ব্যবহার করে, মেশিন লার্নিংয়ের মাধ্যমে তার ভেতরে অ্যালগরিদমের এমন উন্নতি ঘটিয়েছে, যা সর্বোচ্চ পর্যায়ের সাইবর্গকে ছাপিয়ে গেছে।

কেন্দ্রীয় কাউন্সিলকে বিষয়টি বোঝাতে দীর্ঘ সময় লেগে গেছে। জাইগোট ব্যাংক থেকে শিশু নিয়ে পালানোর মতো একজন সাধারণ অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযানে কেন্দ্রীয় কাউন্সিল এত দিন রাজি হয়নি। যখন ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে পেরেছে তখন অনুমতি দিয়েছে। তবে শর্ত আরোপ করেছে একশ দুইকে ধ্বংস করা যাবে না। তাকে ধরতে হবে অক্ষত। অন্তত তার ব্রেইন সার্কিট যেন ঠিক থাকে।

সিকিউরিটি ফোর্স বাড়ি ঘিরে ফেলছে। তারা বাড়ির চারপাশে তিন স্তরে সৈনিকদের সাজিয়েছে। দেখে মনে হচ্ছে সৈনিকরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে এলোমেলো অবস্থায় আছে। তারা আছে অতি সুশৃঙ্খল অবস্থায়।

লিম্বিক সিস্টেম কাজ করতে শুরু করেছে। ব্রেইন সার্কিটে দ্রুত তথ্য চলাচল করছে। একশ দুই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলার সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে।

বহুদিন ধরে লুকিয়ে রাখা অস্ত্র ক্রোনো এমিটার বের করল একশ দুই। সে কখনও চায়নি এই অস্ত্র ব্যবহার করতে। ব্রেইন সিগন্যালে লিম্বিক সিস্টেম জানাচ্ছে আজ এই অস্ত্র ব্যবহার করা ছাড়া তার আর কিছু করার নেই।

সিকিউরিটি ফোর্সের ছোড়া পাথরের ব্লক দড়াম করে ঘরের মেঝেতে এসে পড়ল। তারা ডোর বেল বাজিয়ে সময় নষ্ট করতে চায়নি। দরজা ভেঙে ফেলেছে। কয়েকজন সৈনিক হুড়মুড় করে ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ল। একশ দুই বাটনে সময়মতো চাপ দিয়েছে। সৈনিকদের সামনে নেবুলা ডিসরাপটার নেমে এসেছে ওপর থেকে। তারা এরকম কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিল না। জালে আটকে দুজন সৈন্য উলটোমুখো হয়ে সিলিং থেকে ঝুলে থাকল। তাদের পা ওপরে আর মাথা ঝুলছে ঘরের মেঝের দিকে।

একশ দুই জানে সাইবর্গের মেইন অপারেটিং ফাংশন এরিয়া। সে লুকানো জায়গা থেকে হাতের ক্রোনো এমিটার দিয়ে গুলি করল। ভুটাস-ভুটাস জাতীয় দুবার ভোঁতা শব্দ করে সৈন্য দুটো নিস্তেজ হয়ে গেল। বাকি যারা ছিল তারা আচমকা এমন আক্রমণে হতভম্ব হয়ে গেছে। তারা পিছিয়ে গেল। পিছাতে পিছাতে বাড়ির বাইরে চলে গেল। নতুন আরও চারজন ঢুকেছে বাড়িতে। তাদের একজনের হাতে অত্যাধুনিক আথের এক্স-টুয়েলভ। মুহূর্তে আগুন জ¦ালিয়ে ভস্ম করে দিতে পারে এই অস্ত্র। তবে টার্গেট নিশ্চিত না হয়ে এ অস্ত্র ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা আছে। কিছু অস্ত্র ভয় দেখানোর জন্যও প্রদর্শন করা হয়। আথের এক্স-টুয়েলভ তেমন এক অস্ত্র। অন্য দুজনের হাতে ভলটেক্স আর একজনের কাছে লুমিথরাস্ট।

সামনে যে ছিল একশ দুই তার কাঁধ বরাবর গুলি করল। সে গুলি করতে করতে সাঁই করে ঘুরে গেল। তাতে তার পেছনে যে সৈন্যরা ছিল তারা ক্ষতবিক্ষত হয়ে ঘরের মেঝেতে লুটিয়ে পড়েছে।

একশ দুই পালানোর পথ খুঁজছে। সে জানে এভাবে বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবে না। ধরা দিতে চায় না। তাকে পালাতে হবে। ব্যাকইয়ার্ডের দিক দিয়ে পালাতে পারলে ভালো হয়। তারপর গুলি করতে করতে যতদূর যাওয়া যায়। সে জানে না আগামীতে কী হবে।

ঘটনার আকস্মিকতায় দিশেহারা হয়ে গেছে সিকিউরিটি ফোর্স। তারা কোনওভাবে মেলাতে পারছে না তাদের কীভাবে আক্রমণ করা হচ্ছে।

পুরো ফোর্স বাড়ির বাইরে একত্র হয়েছে। তারা নতুনভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা সাজাচ্ছে। একশ দুই সুযোগ পেয়ে গেছে। সে বাড়ির পেছন দিক দিয়ে পালাল। পালিয়ে নদীর দিকে চলে গেল। সিকিউরিটি কাউন্সিলের লোকজন তাকে দেখে ফেলেছে। তারা পেছনে তেড়ে আসছে। একশ দুই সিদ্ধান্ত নিল সে দৌড়ে গাছে উঠে পড়বে। আশপাশে কোনও গাছ দেখতে পেল না। সামনে নদী। বিকল্প কোনও উপায় খুঁজে না পেয়ে একশ দুই নদীর দিকে দৌড়ে যেতে থাকল। একশ দুই পেছনে গুলি করছে। কোনও গুলি কারও গায়ে লাগছে না। তবে তাদের ছুটে আসার পথ এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

আচমকা হাঁটু ভেঙে পড়ে গেল একশ দুই। তার তার বাঁ পা সিকিউরিটি সৈনিকের গুলিতে উড়ে গেছে। উঠে ছুটতে গেল। পুরোপুরি দাঁড়াতে পারল না। যে কোনও সময় ধরা পড়ে যেতে পারে। একশ দুই আগে লিখে রাখা টেক্সট সেন্ড করল হেমাকে। সেখানে লেখা আছে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে আমাকে কেন্দ্রীয় শহরে যেতে হচ্ছে। কবে ফিরব জানি না। বাইরের সঙ্গে আমার যোগাযোগ সিস্টেম বন্ধ থাকবে। তোমরা ভালো থেকো। তাতাইয়ের জন্য আদর।

একশ দুই গুলি করতে করতে এক পায়ে ভর দিয়ে দৌড়ে নদীর পাড়ে চলে গেল। তখন সিকিউরিটি সৈন্যের গুলিতে তার ডান পা শরীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। শূন্যে লাফিয়ে উঠে গুলি করতে গিয়েই একশ দুইয়ের এক হাত উড়ে গেল আর আরেক হাত বেকায়দায় ঝুলে থাকল। অমনি একশ দুই লাফিয়ে পড়ল খরস্রোতা নদীতে। নদীর তীব্র স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল দূরে। পানির ভেতর খাড়া হয়ে থাকা পাথরে আছড়ে পড়ল একশ দুইয়ের শরীর। ধাক্কা লেগে পাওয়ার অফ হয়ে গেল। তারপর আর কিছু মনে নেই।  

এগারো

ভোর হয়ে গেছে। চারপাশ অদ্ভুত শুভ্র স্নিগ্ধতায় ভরে আছে। পাখি ডাকছে। আজ আমার অফিস নেই। একশ দুইকে সারাদিন সময় দিতে পারব। বললাম, আমাকে কিছুক্ষণ সময় দাও। সকালে এক মগ ব্ল্যাক কফি খাই।

একশ দুই কিছু বলল না। আমি উঠে গিয়ে মগভরতি গরম কফি নিয়ে এলাম।

একশ দুই বলল, আমার কী হয়েছিল জানি না। আমাদের চার্জ শেষ হয়ে যেতে থাকলে আমরা বুঝতে পারি। সংকেত দিয়ে অন্যকে বোঝাতে পারি। অন্যের কাছ থেকে প্ল্যাগ চেয়ে নিয়ে নিজেকে চার্জ করতে পারার মতো করে আমাদের বানানো হয়েছে। কিন্তু আমার চার্জ শেষ হয়ে যায়নি। আমার শরীরে অ্যাটমিক ব্যাটারি। তা ছাড়া সূর্য থেকে বিকল্প চার্জের ব্যবস্থা আছে। পানিতে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। বাড়ি ফিরে যেতে পারছি না। হেমাকে দেখতে পাচ্ছি না।

আমার হাসি পেল। হাসলাম না। আমি জানি, দশম পর্যায়ের সাইবর্গ সিনট্যাক্স আর সিম্যানটিক্সের মাঝখানের ব্যবধান ঘুচিয়ে ফেলেছে। তারা সচেতনভাবে সাড়া দিতে পারে। কিন্তু এখনও মানুষের মতো তথ্য বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। মানুষ কোনও ঘরে ঢুকলে চেয়ার দেখে, টেবিল দেখে, ঘরের মেঝে, আসবাবসহ অন্যান্য জিনিস দেখে চিনতে পারে। সাইবর্গ পুরো ঘর স্ক্যান করে দেখে অনেকগুলো সরল আর বক্ররেখা। বক্ররেখাগুলোকে পিক্সেলে কনভার্ট করে। জটপাকানো এসব রেখা থেকে কিছু বুঝে উঠতে তাদের অনেক সময় লেগে যায়। অষ্টম পর্যায়ের সাইবর্গ সেটাও পারে না।

একশ দুই বলল, তুমি আমাকে হেমার কাছে নিয়ে যাবে ?

বললাম, যাব। শোনো, তোমার ব্রেইন সার্কিট আর অপটিক্যাল মডিউল ঠিক আছে, যা দিয়ে তুমি তথ্য বিশ্লেষণ করতে এবং দেখতে পারছো। তুমি কি তোমার আগের শরীর ফিরে পেতে চাইছ ? তাহলে সমস্যা হবে। সে কাজটি আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে না।

একশ দুই বলল, তোমার ব্যাকপ্যাকে করে আমাকে নিয়ে চলো। হেমার কাছে আমাকে রেখে দেবে। তাকে দেখব।

সার্কিটের আলোর দিকে তাকিয়ে বললাম, তোমার হাত নেই। তুমি হেমাকে স্পর্শ করতে পারবে না।

আবেগ জড়ানো কণ্ঠে একশ দুই বলল, আমার শরীরের দরকার নেই। রোবটের শরীরে ওম থাকে না। তার ব্রেইনের সার্কিটে আবেগ থাকে। আমার স্পর্শ হেমাকে কোনওভাবে উষ্ণতা দেবে না।

কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে। সবটুকু খাওয়া হয়নি। উঠে গিয়ে গরম করতে ইচ্ছে করছে না। বললাম, এ অবস্থায় হেমা তোমাকে দেখলে কষ্ট পাবে। বরং তোমাকে কোনও সাধারণ রোবটের কাঠামোতে রাখি। তা ছাড়া আমার কাছে রোবট রাখার অনুমতি আছে। রোবটের কাঠামো আমি নিজে তৈরি করব।

একশ দুই কী বুঝল জানি না। সে বলল, তুমি যা ভালো বুঝবে।

 হেমার সঙ্গে দেখা করা একা সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরের ছুটির দিন আমরা যাব হেমার সঙ্গে দেখা করতে। এই এক সপ্তাহ ধরে আমি রোবটের কাঠামো বানাব। একটু একটু করে একশ দুইকে গড়ে তুলব।

যন্ত্রপাতি সব নিয়ে আসা হয়েছে। আমি কাজ করি আর একশ দুই দেখে। কোনও অসুবিধা হলে তার সঙ্গে আলোচনা করি, শোনো হাত-পায়ের মোটর ফাংশনগুলো অনেক হার্ড করব না কি সফট করব ?

একশ দুই বলে, তুমি আমার কাছ থেকে যেমন সহযোগিতা আশা করো। যদি মনে করো পুরো শরীর না ঘুরিয়ে কবজির মোচড়ে আমার দরজার লক খুলতে পারা উচিত তাহলে সফট মোটর ব্যবহার করো। তাতে বেশি শক্তি সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে।

মোটরযুক্ত জয়েন্ট লাগাই। কোনও কিছু তুলতে কিংবা সরাতে যাতে হাঁটু, মেরুদণ্ড আর পেছনের দিকের অ্যাকচুয়েটরগুলো শক্তি পায়। পড়ে গেলে আবার সোজা হয়ে দাঁড়ানোর মতো শক্ত জয়েন্ট আর ভারসাম্য বজায় রাখার মতো সেন্সর লাগাই পায়ে।

কাঠামো তৈরি হয়ে গেলে সবগুলো ফাংশন একশ দুইয়ের মেইন প্রসেসরের সঙ্গে তারবিহীন রাউটার দিয়ে জুড়ে দিই। আয়নার সামনে দাঁড় করিয়ে একশ দুইকে বলি, তোমাকে কেমন দেখাচ্ছে বলো!

হাসছে একশ দুই। ঝকঝকে নির্মল শিশুর মতো সরল হাসি।

বললাম, একশ দুই গাণিতিক সংখ্যা মাত্র। এ নাম তোমাকে মানাচ্ছে না। তোমার একটা নাম দিতে চাই আমি।

একশ দুই বলল, বাঃ, সে ভালো তো। নতুন নাম দাও আমার।

বললাম, তোমার নাম দিলাম, অনন্তলতা।

চুপ করে আছে একশ দুই। একদম চুপচাপ। নিস্তব্ধ। সার্কিট দেখলাম। সব ঠিক আছে। আলোগুলোকে অধিক নমনীয় দেখাচ্ছে। আমার খারাপ লাগছে। তার একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপারে প্রবেশ করা ঠিক হয়নি। বললাম, অনন্তলতার সৌন্দর্য অসাধারণ। অনন্তলতা বেঁচে থাকে বিচিত্র কৌশলে। পানিতে ভাসিয়ে দেয় নিজ বীজ, ডাঙায় পাখি ছড়ায়। গাছ ধ্বংস হয়ে গেলে, আগুন লেগে ছাই হয়ে গেলেও গাছের নিচের সাকার রুট থেকে জন্ম হয় অক্ষয় অনন্তলতা।

একশ দুই বলল, আমার নাম পছন্দ হয়েছে। অত্যধিক।

জানতে চাইলাম, তাহলে চুপ করে আছো!

গাঢ় গলায় অনন্তলতা বলল, আমার ভেতরের অস্বাভাবিক ত্রুটি কেউ কখনও খেয়াল করেনি। আমি সাইবর্গ অবশ্য, মানুষের মতো আকর্ষণের প্রবল আবেগ দিয়ে আমাকে বানানো হয়েছে। তুমি যখন পরম যত্নে আমাকে একটু একটু করে গড়ে তুলছিলে, তখন আমি ভীষণভাবে তোমার প্রতি আকর্ষণ বোধ করেছি। তোমার কাছে আমাকে রাখবে, ধ্রুব ?

বাউরি বাতাসের মতো এমন দুরন্ত আবেগ আগে কখনও অনুভব করিনি। অনন্তলতা যখন আমার কাছে থাকতে চাইল তখন করেছি। গলার ভেতর আটকে আসা বাতাস সরিয়ে বললাম, আমার কাছেই থাকবে তুমি।

অনন্তলতা বলল, হেমার কাছে যাব।

আমার কেন জানি হাসি পেল। হেসে ফেলেছি। হাসি মুখে বললাম, আচ্ছা।

অনন্তলতা আদুরে গলায় বলল, হেমাকে দেখে আবার তোমার সঙ্গে চলে আসব।

 হেমার সঙ্গে দেখা করার জন্য যখন অনন্তলতাকে নিয়ে বাস থেকে নামলাম তখন সূর্য খাড়া মাথার ওপর উঠে গেছে। বাস থেকে নেমে আমরা সরু পথ দিয়ে হাঁটছি। আমাদের ছায়া পায়ের নিচে জড়িয়ে আছে। বিস্তারিত ঘটনা জানিয়ে হেমাকে আমি আগেই টেক্সট করেছি। আমরা কয়েকবার কথা বলেছি। তবে অনন্তলতা সিকিউরিটি কাউন্সিলের কাছ থেকে পালাচ্ছিল তা বলিনি। বলেছি কেন্দ্রীয় শহরে আসার সময় ভয়াবহ দুর্ঘটনায় সে তার শরীর হারিয়েছে। তাকে রাখা হয়েছে রোবোটিক স্ট্রাকচারের ভেতর। সেটা তার ইচ্ছেতে করা হয়েছে। সে ভালো আছে।

অনন্তলতা আমার হাত ধরে সরু পথ দিয়ে হাঁটছে। আমরা যাচ্ছি আমরা যাচ্ছি কাজল নদীর পাড়ে সুরাশ্রম গ্রামে, হেমার কাছে।  

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button