আর্কাইভগল্পপ্রচ্ছদ রচনা

ফজলুল কবিরী : মগজগুলো নিদ্রাহীন

গল্পসংখ্যা ২০২৩

আপনি হয়তো সাইফুল আলমের কথা ভাবছেন। এই মুহূর্তে তাকে শীতের আর্দ্রতায় শুষ্ক হয়ে যাওয়া পরাবাস্তব চেহারা নিয়ে শরতের আকাশের দিকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখবেন। আলস্য ও ভীতিমাখা চোহারাটায় বলিরেখা জড়ো হতে দেখে অবাক হবেন হয়তো। পড়ন্ত বিকেলের গ্রামীণ জনপদের ধুলাবালিভর্তি রাস্তায় পড়ে থাকা ঝরাপাতার মতো মূল্যহীন মনে হতে পারে তার বেশভূষা।

কিন্তু আলম মতিঝিলের শাপলা চত্বরের যে-পাশে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশাল ভবনটি দাঁড়িয়ে আছে, তার উল্টাপাশের্^র ফুটপাথ ঘেঁষে বিশেষ কিছু পণ্যের পসরা সাজিয়ে বসেছে। আপনারা যারা মগজের কারবার সম্পর্কে জানেন না, তাদের জন্য এই গল্প অভিনব মনে হতে পারে। আলমকে যদি প্রশ্ন করেন, ভাই আপনি কীসের মগজ ফেরি করছেন ?

আলম নিস্পৃৃহ দৃষ্টিতে আপনাকে এক পলক দেখে উত্তর দেবে, এখানে বিভিন্ন গবাদি পশু ও পোষা পাখির কয়েক দিনের বাসি ও পচা মগজ পাওয়া যায়। 

আপনার বিস্ময়ে ফালা ফালা হয়ে যাওয়া চোখের দৃষ্টিসীমায় এমন কিছু থাকুক বা না থাকুক, আপনাকে তার কথা বিশ^াস করতে হবে।

পড়ন্ত বিকেলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ভেতর থেকে অনেক মানুষ হুমমুড় করে বের হবে একটু পরেই। সেই দৃশ্য আলমের মতো আপনারাও খেয়াল করবেন। এই লোকগুলো সারা দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন ব্যাংকে গবাদি পশু ও পোষা পাখির মগজের বিক্রিবাট্টা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

                দুপুরের কড়া রোদ যখন মতিঝিল পাড়ায় বেশ দাপট দেখায়, তখন সারা দেশের মানুষ বিভিন্ন ব্যাংকসদৃশ অফিসের কাউন্টারগুলোতে গিজগিজ করে মগজের খোঁজে।

কাউন্টারের সুবেশী ও স্বল্পবয়সী নারীকর্মীরা ব্যস্ত সময় পার করে। তাদের মুখমণ্ডলের নিদ্রার ঘাটতি নিজেদের সুদক্ষ হাতের মেকাপ যথার্থই আড়াল করে রাখে। আরেকটু গভীরভাবে লক্ষ করলে দেখা যাবে তাদের চুলে নিয়মিত ব্যবহার করা দামি বিউটি সেলুনের কালার কিংবা অন্য তেলেসমাতিগুলো তাদের সৌন্দর্যকে খানিকটা পোশাকি ও যুগোপযোগী  করে তুলেছে।

কাউন্টারে গ্রাহকরা বলে, ম্যাডাম আপনাকে আজ বেশ সুন্দর লাগছে।

কাজের তীব্র চাপ ও ধকল সত্ত্বেও নারীকর্মীটি সুন্দর একটা হাসি ক্রেতার সামনে ছড়িয়ে দিয়ে মগজের প্যাকেটটা এগিয়ে দেয়। মেয়েটি তখন দুপুরের বিস্তীর্ণ নিঃসঙ্গতা নিয়ে মায়ের জন্য অপেক্ষা করতে থাকা এক-দেড় বছর বয়সী সন্তানের কথা ভাবতে থাকে।

সাইফুল আলম তখন দুপুরের খাবার শেষে ভাতঘুমের প্রস্তুতি নিতে থাকে নিজের ঘরে। ভাতঘুম শেষে তাকে বিকেলের পড়ন্ত রোদে তড়িঘড়ি করে ছুটে যেতে হয় বিভিন্ন জায়গা থেকে আসতে থাকা অবিক্রিত ও বাসি মগজগুলো কম দামে সংগ্রহ করে নেওয়ার জন্য।

এই মগজ দিয়ে মানুষ আদতে কী করে ? খাবারের রেসিপি বানিয়ে খায় ? নাকি নিজেদের ছাদবাগানের ফুলের টবের জন্য উৎকৃষ্ট জৈবসার বানানোর কাজে ব্যবহার করে ?

আলমকে দ্বিতীয়বার জিজ্ঞাসা করা হলে হয়তো বলে বসবে, আপনাদের কি ছোদবোধ নাই ? আপনারা জানেন না মগজ দিয়া কী হয় ?

এরপর আলম আর কোনও প্রশ্নের উত্তর দিতে আগ্রহী হবে না। শরতের আকাশে শুষ্ক চেহারা নিয়ে তাকিয়ে থাকবে।

অফিসপাড়ার ব্যাংক কাউন্টারের সুশ্রী মেয়েটির তখন বিক্রিবাট্টার ব্যস্ততা ধীরে ধীরে কমে। তাকে সারা দুপুরের তুমুল বিক্রির হিসাব মিলাতে হিমশিম খেতে দেখা যায়। মাঝেমধ্যে ব্যস্ততার মধ্যেই মোবাইল ফোনটি হাতে নিয়ে বাসায় ফোন করে ছোট্ট সন্তানের খোঁজখবর নিতে দেখা যায়।

ঘণ্টার পর ঘণ্টা মায়ের বুকের দুধ বঞ্চিত একরত্তি শিশুটি চল্লিশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ঢাকা শহরের ভাড়া বাসায় কাজের বুয়া কিংবা নানির কাছে কীভাবে অফিসকর্মী মায়ের জন্য অপেক্ষা করে তা হয়তো অনেকের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।

কারণ গবাদি পশু ও পোষা পাখির মগজের অদ্ভুতুড়ে চাহিদা হু হু করে বেড়ে যাওয়ার পর থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দামও সবার সামর্থ্যের বাইরে চলে যায়। বিষয়টা শুধু তা নয়, মানুষ মনে করতে শুরু করে যে, এই লাগামহীন ঊর্ধ্বগতি আর থামানো যাবে না।

এত মগজ দিয়ে আদতেই মানুষ তবে কী করে ?

গল্পের এই দৃশ্যপটের বহুদিন পর আমরা মগজকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটনের একটা উপলক্ষ্য পেয়ে যাই। সেটি বেশ চমকপ্রদ ও শিহরণজাগানিয়া।

আলমের ফুটপাথের মগজের পসরা তখন আর দৃশ্যমান হয় না।

আলমকে এরপর দেখা যায় স্যাটেলাইটের মাধ্যমে পাওয়া আলোকচিত্রে। সাইফুল আলম তখন গভীর সমুদ্রে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলা কন্টেইনারভর্তি বিশাল জাহাজের নাবিকদের সঙ্গে সেলফি তুলে ব্যস্ত সময় পার করছে।

সামান্য ফুটপাথের ফেরিঅলা থেকে কীভাবে সে এতদূরের পথ পাড়ি দিল ? কীভাবে সম্ভব হলো এত বড় সাম্রাজ্যের অধিকারী হওয়া ?

এসব প্রশ্নের উত্তর খোঁজার মধ্যেই আমাদের সামনে হাজির হয় বাংলাদেশ ব্যাংকের মগজ তদারকি বিভাগের ছোট্ট ব্রিফিং। তারা জানায় যে, মগজ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন পৃথিবীর প্রথম স্থান অধিকারী দেশ। এটি খুব সামান্য কোনও ঘটনা নয়।

এই ফাঁকে আলমের যে ছবিটি ফাঁস হয়েছে সে বিষয়ে অধিকতর তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্রিফিং পরবর্তী পর্যায়ে দেওয়া হবে। কর্তৃপক্ষ এসব বিষয়ে আগ বাড়িয়ে কিছু বলতে অপাগরতা প্রকাশ করে।

এসব ঘটনার পর সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে ছাপোষা কেরানি কিংবা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বড় কর্মকর্তাদের মধ্যেও আতঙ্ক তৈরি হয়। সবার বদ্ধমূল ধারণা হয় যে, তাদের রুটিরুজি আর নিশ্চিত নয়। যে কোনও মুহূর্তে তাদেরকে নিজ-নিজ পেশা ছেড়ে দিয়ে পথে বসতে হবে। কারণ সমগ্র বাংলাদেশের মানুষ সব ব্যবসা-বাণিজ্য ছেড়ে দিয়ে লাভজনক মগজের কারবারে নেমে পড়তে শুরু করেছে।  

অফিস কাউন্টারের সুশ্রী ও সুবেশী নারী অফিসারটির চেহারায় আগের চেয়ে খানিকটা বেশি ক্লান্তি ভর করতে দেখা যায়। কিন্তু তখনও আগের মতোই মগজের গ্রাহককে হাসিমুখে সম্ভাষণ জানাতে ভুল করে না।

কিন্তু যে কথা সে গ্রাহককে শেয়ার করে না, তা হচ্ছে ইতোমধ্যে বাসার পুরনো কাজের সাহায্যকর্মী বুয়াটি বিদায় নিয়েছে। শুধু তাই নয়, অবুঝ শিশুটিকে কাজের মেয়ের ওপর ছেড়ে না দিয়ে পরম আদরে চোখে চোখে রাখতেন যে বৃদ্ধ নানি, তারও অন্তর্ধান ঘটেছে পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে।

আরও একটি ভয়াবহ ঘটনা নারীটির জীবনে ঘটে যায়। তাদের প্রায় বিশ^বিদ্যালয় জীবনের প্রথম বর্ষ থেকে শুরু হওয়া যে মধুর সম্পর্কটি বাস্তবে বৈবাহিক জীবনে রূপ লাভ করেছিল, তারও সমাপ্তি ঘটে।

একদিন আচমকা মেয়েটির সামনে হাজির হয়ে তারই সহপাঠীটি হাতের মধ্যে গুঁজে রাখা একটি গোলাপ বাড়িয়ে দিয়ে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে বসেছিল। সেদিন শুধু নয়, আরও কয়েকটি পূর্ণিমা ছেলেটিকে নানাভাবে বোঝানোর পরও যখন কোনওভাবেই কাজ হচ্ছিল না, তখন মনের গভীরে তৈরি হওয়া এক ভালোলাগা বোধের কাছে পরাস্ত হয়ে মেয়েটি সায় দিয়েছিল। এভাবেই তাদের দীর্ঘদিনের পথচলা শুরু।

তারপর থেকে যৌবনের উত্তুঙ্গ সময়টি নিজেদের করে নিয়েছিল দুজন। দীর্ঘ বিশ^বিদ্যালয় জীবনে ছোটখাটো মনোমালিন্য কিংবা ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার জায়গাগুলো বেশ ভালোভাবে সামলে নিয়ে কীভাবে যে দুজন পরস্পরকে নির্ভরতা দিয়েছিল, তা এখন ভাবা তার কাছে অনর্থক মনে হয়। বিচ্ছেদ তাকে এসব স্মৃতি রোমন্থনের দায় থেকে মুক্তি দিয়েছে।

তার জন্য এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজটি হচ্ছে অফিস থেকে সময়ের একটু আগে বের হওয়ার কোনও সুযোগ থাকলে সেটিকে কাজে লাগানো আর মায়ের জন্য প্রতীক্ষারত সন্তানের কাছে এক দৌড়ে ছুটে যাওয়া।

ততক্ষণে আমরা হয়তো গল্পের মূল চরিত্র সাইফুল আলমকে স্যাটেলাইটসূত্রে পাওয়া অন্য কোনও ছবিতে আরও অনেক বেশি রোমাঞ্চকর দৃশ্যে আবিষ্কার করব।

তাকে দেখা যেতে পারে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ কিংবা মরিশাসে অবকাশযাপন করতে কিংবা কানাডার নিউ ফাউনল্যান্ড উপকূল থেকে শত শত মাইল দূরে সমুদ্রের গভীর তলদেশে টাইটানিকের ধ্বংসাবশেষ দেখার মতো লোমহর্ষক অভিযানে অংশ নিতে।

ইতোপূর্বে এত বড় ধনকুবের বাংলাদেশের ঔরসে জন্মায়নি। কী এক আলাদিনের চেরাগ আলমের ফুটপাথের পশুপাখির মগজের দোকানে ভর করেছে তার হদিস কেউ দিতে পারে না।

কিন্তু সংবাদপত্রের নাছোড়বান্দা সাংবাদিকরা বিষয়গুলোর সঙ্গে নানারকম রঙ মাখিয়ে উদ্ভট সব সংবাদ ঠিকই প্রচার করতে থাকে।

তার গ্রামের লোকজনের বরাত দিয়ে কেউ কেউ জানায় যে, এসব মূলত আলমের পিরভক্তির নজরানা। বহু বছর ধরে যে পিরের কাছে বাইয়াত হয়েছে আলম, সেই পির-বাবার কুদরতি ও উছিলায় একজন সাধারণ ফুটপাথের আলম থেকে তার জনাব সাইফুল আলমে রূপান্তর ঘটেছে।

অতঃপর মানুষের মুখের লাগাম টানা না গেলেও সত্য ও বাস্তবতার যে বিবিধ রূপ ও রঙ ক্ষণে ক্ষণে বাতাসে ভেসে বেড়ায়, তাতে একটা কথা ধীরে ধীরে চাউর হতে থাকে।

আলমের ফুটপাথের গবাদি পশু কিংবা পোষা পাখির মগজের যে কারবার ছিল, তা ছিল একটা ছদ্মবেশ। তাছাড়া শরতের আকাশের দিকে শীতের শুষ্ক চেহারা নিয়ে তার তাকিয়ে থাকার ব্যাপারটাও ছিল একটা গোপন চালাকি।

এসবের আড়ালে ছিল তার মানুষের মগজ আমদানি-রপ্তানির রগরগে ব্যবসা। এত মানুষের মগজের সংস্থান কীভাবে করত কিংবা সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কীভাবে বিভিন্ন মহাদেশে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছে, তারও সহজ কোনও উত্তর কারও কাছে পাওয়া যায় না।

এর মধ্যেই আরেকটি গরম খবর পত্রিকায় ফলাও করে প্রচার হতে থাকে। বলা হয় যে, বাংলাদেশ ব্যাংক নামক মগজ তদারকির দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যাংকটি তাদের ভল্টের গোপন কোড কারিগরি ত্রুটির কারণে হারিয়ে ফেলে। ফলে তাদের পক্ষে এটা বের করা অসম্ভব হয় যে, সাইফুল আলম আদতে কী উপায়ে এমন অভেদ্য নিরাপত্তা বলয় ভেদ করে পশুপাখির মগজের আড়ালে মানুষের মগজের ব্যবসা চালিয়ে গেছে। কীভাবেই বা তার এই নেটওয়ার্ক দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছে।

অনেক দিন পর আলমের পিরের এক খাদেম পির-বাবার ইশারা মারফত সবকিছু খোলাসা করার কথা বলে আচমকা শোরগোল তুললেও নিরাপত্তাজনিত কারণ দেখিয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে বিষয়টি নিয়ে গোপনীয়তা বজায় রাখার কথা বলা হয়।

ফলে আলমের মগজ-বাণিজ্যের রহস্য উদঘাটন সম্ভব না হলেও মতিঝিল পাড়ার শাপলা চত্বরের আশেপাশে মেট্রোরেলের উন্নয়নযজ্ঞের ক্রমশ দৃশ্যমান হওয়ার ঘটনা কারও নজর এড়ায় না।

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button