আর্কাইভউপন্যাস

উপন্যাস : বহিরায়ণের কালে : আফসানা বেগম

আকাউন্টে তো কুনো ট্যাকাটুকা নাইক্কা, বুবু!

কস কী! ঠিক কইরা দ্যাখ।

নাই। কইলাম তো নাই। ইনারা কইতেছেন সব উঠায়া নিছে।

কী কইলি ?

নাজমা প্রশ্নের উত্তরটা দেবার আগেই রিতা খানমের ভারী শরীরটা ব্যাংকের চেয়ারে ঢলে পড়ে। একের সঙ্গে অন্যটা জোড়া দিয়ে রাখা প্লাস্টিকের নীল চেয়ারে পড়লে চেয়ারের পুরো সারিটা শব্দ করে নড়ে ওঠে। ব্যাংকে উপস্থিত লোকজন চমকে তাকায়। মানুষের পশ্চাতের আকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে ঢালু নকসার চেয়ারে রিতা খানমের থলথলে শরীরটা খাপে খাপ মিলে যায়। বহুদিনের ছোটাছুটি আর অনিশ্চয়তায়ও শরীর থেকে মেদ ঝরেনি যা সেই কবে কাজ থেকে অবসর নেওয়ার পরে ধীরে ধীরে গায়ে বসেছিল। তবে ভালোই হয়েছিল, ওরকম ভারিক্কি না হলে কেউ কি সর্দারনি রিতা খানমকে মানত ?

রিতা খানম অজ্ঞান হয়―ঠিক তা না। কিন্তু তার কালচে দুই ঠোঁট বিস্তৃত হয়ে কাঁপতে থাকলেও মুখে কথা জোটে না। চোখের দৃষ্টি একদিকে অর্থহীনভাবে স্থির হয়ে থাকে। নাজমা তার ঘাড় ধরে ঝাঁকায়, বুবু, ও বুবু, শুনতে পাইতেছো তো ? রিতা খানমের চোখের তারা নড়ে না কিন্তু গালের মাংসপেশি কুঁচকে আসে। গলার কাছে কিছু একটা দলা পাকিয়ে রিংয়ের মতো একটা বাড়তি ভাঁজ যোগ করে। কথা কও, বুবু, কী হইয়া গেল কও তো, ট্যাকা তো নাই! নাজমার আর্তনাদে ব্যাংকের দুজন লোক এগিয়ে আসে, কী হয়েছে ? দেখি, অ্যাকাউন্ট নম্বরটা দেখি…

নাজমার হাতে হলুদ রঙের সরু চেক বইটা ধরা ছিল। বইটার একটাই পাতা ব্যবহার করা হয়েছে আগে। আজ দ্বিতীয়টা। সপ্তাহখানেক আগে নতুন বাসা ভাড়া করার জন্য অগ্রিম এক লাখ টাকা বাড়িওলার হাতে দিতে সাইফুলকে টাকা তুলতে বলা হয়েছিল। সাইফুলের সঙ্গে তো আজকের পরিচয় নয় যে চেক লিখিয়ে নিয়ে আবার তা দেখে নিতে হবে। সাইফুলের উপরে রিতা কিংবা নাজমার ছিল অগাধ বিশ^াস। কতবার দু লাখ, তিন লাখ টাকা সাইফুলের হাতে দিলে সে ঠিকই ব্যাংকে এনে জমা করেছে। ডিপোজিট সিøপ তুলে দিয়েছে রিতার হাতে। এভাবে কয়েকজন মিলে টাকা জমিয়ে বাড়ি কেনার ব্যাপারে রিতার যে পরিকল্পনা তাতে সাইফুলও কি ঘি ঢালেনি ? সেই কৈশোরকাল থেকে সাইফুল আশা আর মাশা সিনেমা হলের টিকেট কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ব্ল্যাকে টিকেট বিক্রি করত। করতে করতে কখনও ঠোঁটে কটকটে রঙ মাখা কোনও উঠতি তরুণী তাকে হাত ধরে টেনে নিয়ে যেত টানবাজারের ভিতরের দিকে। দু’চারটা রঙের আর কেমিক্যালের দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময়ে সে আপ্রাণ চেষ্টা করত হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার। এক হাত ছাড়ালে তরুণী ধরত আরেক হাত। লজ্জায় সাইফুলের মুখটা লাল হয়ে যেত। ফরসা মানুষ সেই লাল হওয়া গাল আর গলা লুকাতে পারবে না ভেবে তাতে আরও এক প্রস্থ লাল রঙ ধরত। পা-ও এগোতে চাইত না, এই বুঝি কেমিক্যালের দোকানের চেনা লোকগুলো তাকিয়ে আছে। ওইদিকে রঙের দোকানের টিনগুলোর পিছনে বসে মিটমিট করে হাসছে হয়তো কেউ। রিতা খানম দূর থেকে দেখলে পানের রঙে লাল ঠোঁট নাচিয়ে বৃত্তাকার করে ধরত, তারপর পিক ফেলে হাসতে হাসতে বলত, পোলাডা খুব লাজুক দেহি, ওরে ভালামতোন শিখাইবি, পারবি না ? রিতা খানমের কথার জবাবে তরুণী উপর-নিচে মাথা দোলাত। তারপর দ্বিগুণ উৎসাহে সাইফুলের সরু কবজি ধরে টানাটানি শুরু করত। সামনের দিকের কোনও একটা চিটচিটে দেয়ালের স্যাঁতসেতে ঘরের দরজা পেলে উঠতি তরুণী সাইফুলকে পাঁজাকোলা করে ধরত। চৌকাঠে নিজেকে পিছিয়ে নেওয়ার শেষ চেষ্টা করে শেষে হার মেনে শরীর মুচড়ে-টুচড়ে একসময় সাইফুল ঘরে ঢুকে যেত। পিছনে দরজার ছিটকিনি উঠত ক্যারক্যার শব্দ করে। আধা ঘণ্টা নাগাদ দরজা হাট করে সাইফুল হেলেদুলে বেরিয়ে আসত আস্ত এক পুরুষের মতো। তাকে দেখলে তখন কে বলবে ষোলো বছর বয়স মাত্র!

রিতা তখন বলত, পঞ্চাশ ট্যাকা ফালাবি এইহানে, তারপর যাবি। সে লাজুক স্বরে বলত, খালা যে কী কও, টিকেট ব্ল্যাক কইরা কয় ট্যাকা পাই যে এইহানে পঞ্চাশ দিমু ?

ওরে সোনাচান্দু! টাইনা যখন আনছে এইহানে তখন মানা করবার পারিস নাই ? আইচ্ছা যা, চল্লিশ ফালা। কাইল টিকেট কাউন্টারের সামনের লাইন থেইকা কয়েকটা কাস্টমার দিবি কইলাম। এই কারণেই ডিসকাউন্ট দিলাম।

সাইফুল রিতার পায়ের কাছে চল্লিশটা টাকা রেখে লাজুক মুখে সরে পড়ত। ছেলেটা চোখের সামনে বড় হচ্ছিল। কোনওদিন কড়া রোদের মধ্যে রিতা খানমের দুপুরের আয়েশে বাগড়া বাজাত, খাওনের কিছু আছেনি, খালা ? আইজ একটু তোমার হাতের সালুন খাইতে মন চাইতেছে।

মন ভালো থাকলে রিতা খানম তার গলা শুনে উঠে বসত। ভরপেটে গড়িয়ে নেওয়ার আরাম বাদ দিয়ে ফুলকপির ঝোল দিয়ে রান্না করা কাতলা মাছের পেটি তার পাতে উঠিয়ে দিত, পাশে বসে হাতপাখা দিয়ে বাতাস করত। কখনও আবার ভেংচি কেটে বলত, আমার কুন জনমের মরদ আইছ এক্কেরে, চান্স দিলেই তাল পাখার বাতাসসুদ্ধা নলা ডুবাইয়া মাছ দিয়া ভাত খাইয়া যাও!   

সেই ভাতের দাম দিলি না তুই, সাইফুল, স্নেহের দাম দিলি না… এইডা তুই কী করলি―শেষ পর্যন্ত ডুকরে ওঠে রিতা খানম। তারপর ছুটে যায় ব্যাংকের কাউন্টারে। কাচের ওপারে বসে থাকা মিষ্টি চেহারার সরু মেয়েটাকে বলে, আপনেরা দ্যাখলেন না ? আপনেরা তো আছিলেন যখন দিনের পর দিন ট্যাকা আইনা আমি আর সাইফুল এই অ্যাকাউন্টে ভরছি, অহন সে একলা আইয়া চাইল আর আপনেরা দিয়া দিলেন ?

মেয়েটা ইতস্তত করে, দেখুন, ম্যাম, সমস্যাটা কিন্তু আমার বোঝার কথা ছিল না। মানে, একজনের সিগনেচার থাকলেই কিন্তু আমাদের টাকা দিয়ে দেবার কথা। তার পরেও আপনার নম্বরে ফোন করা হয়েছে, আপনি বলেছেন টাকা দিয়ে দিতে।                  

এগুলা কী কন ? আমারে কে ফোন করছে ? কখন কইছি আমি ট্যাকা দিতে ?

ও আচ্ছা। আপনি অপেক্ষা করলে আমরা ফোন রেকর্ড চেক করে দেখতে পারি।

করেন করেন। যা পারেন করেন। আমগো ট্যাকা আপনেরা দিয়া দিলেন, এখন… এখন…

রিতা খানম ডুকরে কেঁদে ওঠা ছাড়া আর কথা বলতে পারেন না। নাজমা রে, এইডা কী হইল আমাগো। ওই কুত্তার বাচ্চা এইডা কী করল!

রিতা খানমের কান্নাকাটিতে ব্যাংকে উপস্থিত লোকজন আর কর্মচারীরা কিছুক্ষণের জন্য থমকায় বটে। করুণাভরা চোখে তাকায়। দু-এক পা এগিয়ে এসে বিস্ময় প্রকাশ করে কেউ কেউ। আহা উঁহু করে কেউ। কিন্তু কতক্ষণইবা আর সময় নষ্ট করবে লোকে। যে যার লাইনে কি চেয়ারে ফেরত যায় খানিক বাদে। অতি উৎসাহী কেউ জানতে চায়, কত টাকা ছিল ? কাউকে সন্দেহ করেন ? এরা নাকি বলছে চেক কেটে টাকা নিয়ে গেছে ? চেকবই কার কাছে ছিল ?

উত্তর না দেয় রিতা না দেয় নাজমা। ঠকে যাওয়া মুখগুলোর মাংসপেশি কুঁচকে থাকে। বিশ্রী আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে কোঁচকাতে থাকে। নাজমার মুখ থুথুতে ভরে যায়। ব্যাংকের ঝকঝকে মেঝে, কোণের দিকে পরিপাটি সিমেন্টের টবে ঘরের ভিতরের ইলেকট্রিক বাতির আলোয় বেড়ে ওঠা গাছ, বিচিত্র লোন আর ডিপোজিট স্কিমের কথা বলা চকমকে পোস্টার, সমস্ত কিছুর মাঝখানে মুখ ফুলিয়ে নাজমা পানের পিক ফেলার মতো জায়গা খোঁজে। চোখ বুলিয়ে বোঝে এদিক ওদিক থেকে লোকজন তখনও তাকিয়ে আছে কেউ কেউ। শেষে রিতাকে চেয়ারের হাওলায় ছেড়ে দিয়ে বাইরের দিকে এগোয়। ভাগ্যিস দরজা খোলার জন্য বলতে হয় না। কাচের দরজার সামনে দাঁড়াতেই সুনির্দিষ্ট পোশাকের দারোয়ান দরজা খুলে দেয়। মুখ চেপে ধরে নাজমা কোনও একদিকে দৌড় লাগায়। লম্বা-চওড়া সিঁড়ির পাশে রাখা টবে এক দলা থুথু ফেলে হালকা হয়। মুখের ভিতরে তিতকুটে ভাব লেগে থাকে, শুয়ারের বাচ্চা এইডা করছে কী!

আমগো ট্যাকা খাইব ওই হারামি ?

নিজের মনে কথা আওড়াতে গিয়ে কথা শুনে পাশে তাকায় নাজমা। দেখে রিতা সেখানে এসে দাঁড়িয়েছে। তাকে দেখে মনে হয় হামাগুড়ি দিয়ে এসেছে ওই পর্যন্ত। ক্লান্ত আর বিমর্ষ রিতাকে জড়িয়ে ধরে নাজমা। শেষে দুজনে জড়াজড়ি করে কেঁদে ওঠে। মোটা পিলারের আড়ালে বনানীর ব্যস্ত রাস্তার কেউ তাদের লক্ষ করে না। রাস্তার একটা কুকুর শুধু খুব কাছে এসে ঘেউ ঘেউ করে ওঠে।

কুকুরের তীব্র চিৎকারে রিতার ভিতরটা কুকুরের মতো হিংস্র আর সরব হয়ে ওঠে। শরীর বা মনের দুর্বলতা কাটিয়ে ধুপধাপ করে ব্যাংকের কাউন্টারে গিয়ে আছড়ে পড়ে।

আপনেরা ফোনের কথা শুনান দেহি কখন আমি কইছি ট্যাকা দিতে ? কইলেই হইল ? ছবি দেহান যে সে ট্যাকা তুইলা নিয়া গেছে ? আপনাগো না বলে সবখানে ক্যামেরা ফিট করা থাকে ? দেহান দেহি কেডা আমগো ট্যাকা নিয়া গেছে ?

নাজমা সমানে ফোন করতে থাকে সাইফুলকে। ফোন যায় না। এই মুহূর্তে সংযোগ দেয়া সম্ভব নয়। অনুগ্রহ করে.. শুনতে শুনতে নাজমার চোখ ফেটে পানি পড়তে থাকে। পাশে এসে তারই মধ্যে অনুসন্ধানী সাংবাদিকের মতো দুএকজন জানতে চায়, কত টাকা ছিল ? সবই কি উঠায়ে নিছে ? নাজমা থুথুভরা মুখে কাঁদোকাঁদো গলায় জবাব দেয়, পয়তাল্লিশ লাক। মানুষজনের চোখ কপালে উঠে যায়, ছাপা শাড়িতে জড়ানো হতবাক মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবে, এদের কাছে পঁয়তাল্লিশ লাখ টাকা ছিল!

তা, কয়জনের টাকা ছিল ওইটা ?

বিলকিস, লিপি, শিপ্রা… নাজমা বিড়বিড় করে হাতে গুনে বলে বারো জন মিল্যা জমাইছি।

এতজনের টাকা একজনের হিল্লায় দিছেন কী বিশ^াসে ?

বিশ^াস ছিল আমাগো। বিশ^াস করা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।

মানুষেরা আর কথা বলে না। ব্যাংকের লোকেরা তৎপর হয়। দু’জন এসে নাজমা আর রিতাকে ম্যানেজারের ঘরে নিয়ে যায়। ম্যানেজারের টেবিলের চা-কফি তাদের ঠান্ডা করতে পারে না।

আমরা কিন্তু টাকা না নিয়া এইখান থেইকা যামু না।

বুঝতে চেষ্টা করেন। দেখুন আপনাদের চেক দিয়ে আপনাদের লোক সাইন করে টাকা নিয়ে গেছে। এখানে আমাদের কী করার ছিল ?

আমাদের টাকা তছরুপ হইছে আপনার ব্যাংক থেইকাই।

সেটা হতে পারে কিন্তু সেখানে আমাদের কোনও হাত তো ছিল না।

ম্যানেজারের শান্ত গলার স্বরে রিতা খানম বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। মরিয়া হয়ে বলে, পুলিশ ডাকেন।

যিনি আপনাদের টাকা উঠিয়ে নিয়ে গেছেন তিনি তো আপনাদেরই লোক। তার বিরুদ্ধে আপনারা নিশ্চয়ই পুলিশে কমপ্লেইন করতে পারেন।

করব না মানে ? করবই তো। আপনারাও তো পারতেন ঠেকাইতে।

ম্যানেজার ছোট শ^াস ফেলেন। এদের বোঝানো তার পক্ষে সম্ভব না, এরকম একটা হতাশা তার চোখেমুখে ফুটে ওঠে। শেষে তিনি ফোন হাতে নেন। টেবিলের চা ঠান্ডা হতে থাকে। রিতা চুপ থাকলেও নাজমা মাঝেমধ্যে ফোঁপায়। ম্যানেজার তাদের দুজনকে বেমালুম ভুলে গিয়ে নানা ফোনে কাজের কথা বলতে থাকেন। ফাঁকে ফাঁকে কেউ এসে কোনও না কোনও কাগজে তার স্বাক্ষর নিয়ে যায়। আড়চোখে কাগজগুলোর উপর থেকে নিচে একবার চোখ বুলিয়ে তিনি খসখস করে স্বাক্ষর করেন। রিতার ধৈর্য বাধ মানে না, আমরা তাইলে এখন কী করব ?

ম্যানেজার ফোন কানের কাছে ধরে রিতার দিকে এক পলক তাকান। তারপর পুরানো কিছু মনে করার ভঙ্গিতে বলেন, ও, ওই যে বললাম, তার বিরুদ্ধে পুলিশ রিপোর্ট তো লিখতেই পারেন। ব্যাংকের সহযোগিতা পাবেন, তিনি কখন এসেছেন আর টাকা উঠিয়েছেন সে ভিডিও আমরা পুলিশকে দিয়ে দেব।

এটাই আপনাদের সহযোগিতা ?

দেখুন, আমরা এ ক্ষেত্রে এর চেয়ে বেশি আর কী করতে পারি!

কথাটা বলেই ম্যানেজার আবার নিজের কাজে ডুবে যান। সামনের দুজন মানুষের অস্তিত্ব তখন তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায়। রিতা চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে, নাজমা চল, বলে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, শোনেন, ম্যানেজার সাব, আমরা আপনের দরজার সামনে বইসা থাকব যতক্ষণ না আমগো ট্যাকা উদ্ধারের ব্যবস্থা না করেন।

ম্যানেজার কাগজ থেকে চোখ তুলে অবাক হয়ে তাদের দিকে তকিয়ে থাকেন।

রিতা আর নাজমার গ্যাট হয়ে বসে থাকা আর মুহুর্মুহু কান্নার শব্দ কারও চোখ এড়ায় না। তাই হয়তো খানিক বাদে পুলিশ আনতে বাধ্য হন ব্যাংকের ম্যানেজার। পুলিশ এসে জিজ্ঞাসাবাদ করতে করতেই কোথা থেকে যেন সাংবাদিক আসে। হাতের মাইক্রোফোন রিতার দিকে এগিয়ে দিয়ে প্রশ্ন করে, কত টাকা ছিল আপনাদের অ্যাকাউন্টে ? আপনাদের অজান্তে কীভাবে উঠিয়ে নিলেন আরেকজন ?

পুলিশ কিছু প্রশ্ন করে আর ম্যানেজারের ঘরের দিকে যায়। ফিরে এসে আবারও প্রশ্ন করে, তারপর কাউন্টারের দিকে যায়। ফাঁকে ফাঁকে সাংবাদিক রহস্যের গন্ধ পেয়ে তার কূলকিনারা না করে ছাড়বে না, এইভাবে লেগে থাকে।

টানবাজার ছাড়ার পর থেকেই কি আপনারা টাকা জমানো শুরু করেছিলেন ?

হ, তয় টানবাজার আমরা ছাড়ি নাই। আমগো খেদাইয়া দেয়া হইছে।

ওই আর কী, এখন তাহলে টাকা উদ্ধারের জন্য এখানে কতক্ষণ অবস্থান নেবেন ভাবছেন ?

যতক্ষণ এইখান থেইকা আমগো খেদাইয়া দেয়া না হয়।

পুলিশ ম্যানেজারের ঘরে বসে চায়ে চুমুক দিচ্ছে। কাচের ঘেরাটোপের বাইরে থেকে দেখা যায়। রিতা সেদিকে দু-একবার তাকিয়েছে। সাংবাদিকটাকে জোরেশোরে উত্তর দেওয়ার পরে সে সামান্য দূরে গিয়ে চেয়ারে বসে তার ক্যামেরা ধরে থাকা লোকটার সঙ্গে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। এই ফুরসতে, নাজমা বলে, বুবু, তুমার কি মনে হয় এইহানে বইসা থাইকা কুনো ফায়দা আছে ? তার চাইতে চলো সাইফুলের খোঁজ করি। নোয়াখালীর কই জানি অর গেরামের বাড়ি না ? চলো চইলা যাই, গিয়া হালারে কানে ধইরা কয়ডা চটকোনা দিয়া…

সাংবাদিক হঠাৎ মাইক্রোফোনের তার গুছিয়ে নিতে নিতে রিতা আর নাজমার সামনে এসে দাঁড়ায়। ক্যামেরাম্যান কিছুটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে তার ফ্রেম ঠিক করে নেয়। সাংবাদিক বলে, ব্যাকগ্রাউন্ডে উনারা দুইজন আসছেন তো ?

ক্যামেরাম্যান বুড়ো আঙ্গুল তুলে সাংবাদিককে ইশারা করে। তারপর রোলিং বলতেই সাংবাদিক শুরু করে, আমরা এখন বনানী এলাকার একটি প্রাইভেট ব্যাংকে দাঁড়িয়ে আছি। এখানে কিন্তু অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করে পালিয়ে যাওয়ার একটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা ঘটেছে। এবং ঘটনাটি এজন্যে গুরুত্বপূর্ণ যে টাকার মালিক ছিলেন কয়েকজন রূপোপজীবিনী । আমরা জানি যে, টানবাজার উচ্ছেদ করার পরে কিন্তু রূপোপজীবিনী বা দেহপসারিনীরা মোটামুটি সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছিল। এবং এখন সেই রূপোপজীবিনীরাই একটি দল করে…

রিতা হুট করে পিছন থেকে উঠে লাফিয়ে সাংবাদিকের পাশে চলে আসে। তার হাত থেকে মাইক্রোফোন কেড়ে নিতে নিতে বলে, কীয়ের রূপোপজীবিনী, হুম ? এইগুলার মতলব কী ? বেশ্যা কইতারেন না ? কইতে লজ্জা লাগে ? বেশ্যা কন, বেশ্যা!

রিতা খপ করে নাজমার হাত ধরে টান দেয়। বলে, চল এইহান থেইকা। এইহানে বড় মানুষেরা আমগো নিয়া তামাশা ছাড়া আর কিছু করব না। নাজমা টান খেয়ে টাল সামলে রিতার পিছনে ছুটতে থাকে। রিতার গায়ে এখনও সেই বিশ বছর আগের শক্তি―নাজমার মনে পড়ে ঠিক এভাবেই চল্লিশ বছর বয়সের রিতা একদিন ভোর রাতে কিশোরী নাজমাকে ঘুম থেকে টেনে তুলে ধসে পড়তে থাকা দেয়ালের পাশ থেকে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল। চুন-সুরকি, আর ভাঙা ইটের টুকরো ঝুরঝুর করে নাজমার গায়ের উপরে পড়ছিল, সেসব তোয়াক্কা না করে রিতা তাকে টানছিল আর দুর্বোধ্য কিছু শব্দও তার মুখ থেকে বের হচ্ছিল যা মানুষের চিৎকার, অন্ধকারের রহস্য আর আকস্মিক ভাঙচুরের বাস্তবতায় নাজমার কানে কোনও অর্থ নিয়ে ধরা পড়েনি। টিনের বেঁকে যাওয়া জং ধরা টুকরোগুলো ছুরির ফলার মতো পড়ে ছিল চারদিকে। কাপড়, আসবাব, কত যে শখের জিনিসের চূর্ণ বিচূর্ণ স্তূপের ভিতর দিয়ে রিতা নাজমাকে নিয়ে সামনে এগোচ্ছিল, ভাবতে গেলে এখনও মাথার মধ্যে একটা ধন্দ লাগে। তারপর মাথার ভিতরেই বিদ্যুতের মতো চিনচিন করে একটা ভাবনা খেলে যায়―কী হতো রিতা তাকে তুলে নিয়ে ঘর থেকে বের না করলে ? সে কি ওই স্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকত না ?

বনানী মসজিদের সামনে স্তূপ করে রাখা ইটের খোয়া আর রডের পাশে দাঁড়িয়ে পিছনে নাজমার এলোমেলো পদক্ষেপের দিকে তাকায় রিতা, ওই তর কী হইছে ? পইড়া যাইতেছিস নাকি ? ঠিকমতো চল নাইলে রিকসা ডাক।

নাজমা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে রিতার দিকে। তার দৃষ্টিতে লেখা ছিল সে কী ভাবছে, রিতার তা বুঝতে না পারার কারণ নাই। তাই সে-ও এক মুহূর্ত বোবা চোখে তাকিয়ে থাকে নাজমার দিকে। চোখে চোখে হতভাগ্য দুজন মানুষ অদ্ভুত এক ভাষায় কথা বলে। উচ্চারণ করতে হয় না, শরীর নাড়াতে হয় না, অথচ দুজনেই দুজনের হতাশা বা প্রশ্ন শুনতে পায়, সেই যে নিরানব্বই সালের মাঝামাঝির দিকে শনির দশা শুরু হলো তাদের জীবনে, সে কি আর শেষ হবে না ?

হঠাৎ করে বেশ গরম পড়েছিল সেবারে। ঘুপচি ঘরগুলোর মধ্যে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। দিনের রোদে যেন ভিতরে শরীর সিদ্ধ হয়ে যাবার জোগাড়। আর যখন কোনও কাস্টমার আসে তখন তো কথাই নেই। দরজার খিল ভিতর থেকে লাগানো মানে আগুন একেবারে। ক্যাচক্যাচ করা চৌকির উপরে ঘটরঘটর শব্দের ফ্যান চললে লু হাওয়া শরীরে ধাক্কা দেয়। ঘেমে নেয়ে কাস্টমার চলে গেলেই কিশোরী নাজমা হাফ হাতার ফিনফিনে কমলা ফুলওলা কামিজটা গায়ে দিয়ে দরজায় ধাক্কা মেরে বেরিয়ে আসত। তারপর বুকভরে দু-চারবার শ^াস নিয়ে ছুটে যেত মাশা সিনেমা হলের পাশের গলিটার দিকে। সেদিকটায় একে তো খোলা বাতাস, তা ছাড়া খরিদ্দারের আনাগোনায় ভরপুর। পল্লীর অত ভিতরে এসে কয়জন আর খুঁজে বের করবে তাকে! প্রথম প্রথম যখন ওখানে এসেছিল তখন অবশ্য ঘরের ভিতরেই ঘাপটি মেরে বসে থাকত। দরজাটা থাকত আধভেজানো। খুলে রাখতে সাহস হতো না। দরজার আশেপাশে কারও পায়ের আওয়াজ পেলেই চৌকিতে জবুথবু বসে থাকা নাজমার বুক কাঁপত। নড়াচড়ার বা কথাবার্তার শব্দ যতক্ষণ পেত ততক্ষণ কাঠ হয়ে থাকত। তারপর একসময় পায়ের শব্দটা মিলিয়ে গেলে বুক ধড়ফড় করাটাও থামত। সরদারনি রহিমা খিস্তি করে বলত, ঘরের মইদ্দে বইসা থাকলে তুমারে দিয়া আমার চলত না কইলাম। নাক টিপলে দুধ বাইরায়, এত্ত বড় নামডাক অহনতরি তুমার হয় নাইক্কা যে মাইনষে অ্যামনেই লাইন ধইরা আইব। নিজেই গিয়া খুঁইজ্জা নিয়া আসো।

চাবুকের মতো সপাং সপাং তার কথাগুলো কানে পড়লে নাজমা মাথাটা নিচু করে থুতনি প্রায় বুকের উপরে ঠেসে ধরত। তাই দেখে রহিমা আরও গলা উঁচিয়ে বলত, এই কয়দিনে কয়জনের লগে তো ঘরের মইদ্দে হান্দাইলা, অহনতরি কি ঘোমটা খুলতে পারলা না ? এইরাম ঢংয়ের আলগা শরম আমার দুই চক্ষের বিষ।

নাজমার মুখ তখনও নিচু দেখে রহিমার মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যেত, ওই, এই কয়দিনে কত্তগুলা মাইনষে লাগায় নাই তরে ? অহনও ভাব দেখাইতেছস এক্কেরে সতী… এইহানে আইসস কিল্লাইগা তাইলে ?

আমি নিজের ইচ্ছায় আহি নাই।

নাজমার দৃঢ় কণ্ঠস্বর যে রহিমার মাথায় রক্ত চড়িয়ে দেবে তা জানা ছিল রিতার। এখনই দুমাদুম মারের আওয়াজ পাওয়া যাবে। পাশের ঘর থেকে তাই রিতা তখন ছুটে এসে আঁচল দিয়ে জড়িয়ে ধরত নাজমাকে, হইছে হইছে, রহিমা বু। নয়া ছেমরি, কয়দিনে ঠিক হয়া যাইব। নাজমার কথা শুনে রহিমা উঠে দাঁড়াতে গেছিল। রিতা যেমন ছোঁ মেরে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেছিল তাতে আর রহিমা এগোয়নি। বাজ পাখি ছোঁ মেরে উঠিয়ে নেওয়ার আগ মুহূর্তে যেন মা পাখি বাঁচিয়েছে ছোট্ট ছানাটিকে, সেইভাবে রিতার আঁচলের নিচে থরথর করে কাঁপত নাজমা। বলত, বিশ^াস কর, বুবু, আমি নিজের ইচ্ছায় আসি নাই। রিতা সে কথার উত্তর না দিয়ে নাজমার কোঁকড়া চুলে হাত বোলাত। নাজমা চাইত খরিদ্দার আসুক আবার চাইতও না। তার মনের ভিতরে সিনেমা দেখার মতো কাহিনি চলত। খরিদ্দার এলে সেই কাহিনি স্থগিত তো রাখতেই হতো, উল্টো আবোল তাবোল বিশ্রী কিছু ঘটনা সেখানে ঢুকে পড়ত। খরিদ্দার চলে যাবার পরে ঘিন ঘিন করা ক্লান্ত শরীরের ব্যথাগুলো জানান দিত। কিছু পরে তার চেয়ে বড় হয়ে উঠত মনের ব্যথা। সেসব ভুলতে নাজমা বসে বসে ভাবত, লোকটা আসার আগে কী যেন ভাবছিল সে ?

নাচতে নাচতে বই হাতে স্কুলে যেত নাজমা… সবুজ আর হলুদ ক্ষেতের পাশ দিয়ে, কোন যেন সে ক্ষেত ? কে জানে! নাজমা মনে করতে চায় না। বাড়ি ফেরার যে পথ বন্ধ হয়ে গেছে তাকে স্মৃতিতে রেখে লাভ নেই। যে দিন চলে গেছে সে দিন মনে করেইবা লাভ কী! কিন্তু কে জানে কেন ঘুরে ফিরে সেসবই মনে পড়ে। বাবা-মা কত আদর করত, আর করত বলেই ফিরে গিয়ে কোনওদিন তাদের সামনে দাঁড়ানোর মুরোদ নেই। কিন্তু যেতে চাইলেও যাবে কী করে ? নারায়ণগঞ্জের যে কোনও বাস রাস্তায় দাঁড় করিয়ে চড়ে বসলেই দালালেরা আবার ধরে এনে রহিমা সর্দারনিকে খুঁজে বের করে হাতে তুলে দেবে। বাসস্ট্যান্ডে তো যাওয়ারই উপায় নেই। সেখানে ছদ্মবেশে দালালেরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। পালানোর চেষ্টা করলে যে কী শাস্তি তা নাজমা নিজের চোখে দেখেছে। দুই বাড়ি দূরে নিলুফা নামে একটা মেয়ে একবার ওড়না দিয়ে চোখমুখ মুড়ে বাসে উঠে বসেছিল। যাওয়ার আগের রাতে নাজমাকে কানে কানে বলেছিল সে যাবে। নাজমা জানতে চেয়েছিল, বাবা-মা বা ভাইয়েরা কি তাকে বাড়িতে ঢুকতে দেবে ? নিলুফা মেয়েটার আত্মবিশ^াস দেখে নাজমা অবাক হয়েছিল, দেবে না মানে ? কেন দেবে না ? আমি কি ওই বাড়ির মেয়ে না ? নাজমাকেও নিলুফা বলেছিল ওর সঙ্গে যেতে। নাজমার সাহসে কুলায়নি। তা ছাড়া, সে জানে বাবা-মায়ের সামনে দাঁড়ানোর সাহসও নেই তার। ওদিকে নিলুফার চিন্তায় রাতভর ঘুমাতেও পারেনি সে। বেলা করে ঘুম ভাঙার পরে রহিমা সর্দারনির চেঁচামেচিতে পুরো গলিটায় একটা মেলা বসেছিল। নাজমা মনে মনে খুশি হয়েছিল, যাক, সে না পারুক, নিলুফা তো পারছে এই জায়গাটা থেকে বেরোতে। তবে ঘরের মধ্যে লুকিয়ে ছিল যেন কেউ তার মুখ দেখে বুঝে না ফেলে যে নিলুফা পালিয়ে যাওয়ার কথা সে জানত। তখনও নাজমা এতটাই বোকা ছিল যে মনে করত আশা বা মাশা সিনেমা হলের সীমানা পার হতে পারলেই মুক্তি। এদিকে ছুটে গিয়ে একটা নৌকায় উঠতে পারলে কিংবা ওদিকে বাসের একটা সিটে বসতে পারলেই হলো। নাজমা ভাবত শুধু যাওয়ার জায়গা নেই বলেই সে মধ্যরাতে কোনও নৌকায় চড়ে বসতে পারছে না। নৌকার মাঝিকে ভাড়া দেওয়ার মতো তার একটা সরু সোনার আঙটিও ছিল তার হাতে। মায়ের আঙটি, বাড়ি ছাড়ার সময়ে হাতে পরে এসেছিল। গলায় একটা প্যাঁচানো চেইনও ছিল যেটা ঈমন নিয়ে গিয়েছিল। বলেছিল নতুন বাসার ভাড়ার অ্যাডভান্স দেওয়ার জন্য টাকা লাগবে। আসলে ঈমন নিতে চায়নি চেইনটা, ইমন শুধু চিন্তায় পড়েছিল যে, বাসা ভাড়া নিতে হলে যে এক দলা টাকা একসঙ্গে লাগবে, সেটা কোত্থেকে আসবে। আর তাকে চিন্তিত হতে দেখে নাজমা নিজেই চেইনটা খুলে ইমনের হাতের মুঠির মধো পুরে দিয়েছিল। মুঠিটা শক্ত করে নিজের মুঠির মধ্যে ধরে ছিল যেন ঈমন চেইনটা ফেরত দিতে না পারে। ইমনের হাত ধরা অবস্থায় নাজমা বাসের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল। ইলেকট্রিকের পোলগুলো চিরুনির দাঁড়ের মতো পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে। নাজমার অপ্রিয় অতীত তাদের মতোই পিছনে চলে যাচ্ছে। আর সে কি দ্রুত দুর্ভাগ্য থেকে সৌভাগ্যের দিকে ছুটছে ? ভাবতেই সারা শরীরে কাঁপুনি ধরেছিল। ইমন কি হাতের স্পর্শে নাজমার সেই কাঁপুনি বা উচ্ছ্বাস ধরতে পেরেছিল ?     

বাসে নাজমা একবারই নিশ্চিন্ত মনে উঠে বসেছিল, সেই যেদিন পাড়ার ইমনের হাত ধরে স্কুল থেকে পালাল। মনে হয়েছিল কোনও বিজয় ঘটেছে। স্বাধীন দুনিয়া কত যে সুন্দর তার আগে নাজমা জানতে পারেনি। দুপুরের চড়া রোদ যেন কোমল হয়ে গায়ে বসছিল। বাসের সিটে ইমনের পাশে বসে মনে হয়েছিল, গ্রামের এবড়োখেবড়ো রাস্তায় ওরকম লক্করঝক্কর বাসে নাজমা আজীবন ইমনের পাশে বসে থাকতে পারে। বরং বাসের দুলুনিতে শান্তির ঘুম জড়িয়ে ধরেছিল। বাস যে কোথা দিয়ে কোথায় গেছে নাজমা জানে না। ইমনের কাঁধে মাথা রেখে ঘুমানোর আগমুহূর্তে মনের মধ্যে বাজছিল অদ্ভুত এক শান্তির অনুভূতি―আর কেউ তাকে ধরতে পারবে না।

বাবা আগের রাতে বলেছিল ইমনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা যাবে না, ছেলেটা ভালো না, শহরে নাকি কী সব খারাপ কাজ করে বেড়াচ্ছে। ওদিকে মা বলেছিল স্কুল পাস করলেই বিয়ে হয়ে যাবে নাজমার। বলেছিল, নাজু, খুব ভালো একটা ছেলের সম্বন্ধ আসছে রে। এই ঈদের সময়ে দেখতে আসবে তোরে। ছেলে নাকি সরকারি চাকরি পাইছে। ভাবা যায়, এত্ত ভালো একটা প্রস্তাব ? ঈদ আসতে আসতে তো তোর পরীক্ষাও শেষ হইয়া যাবে। মায়ের কথা শুনে নাজমার সারা শরীর কেঁপে উঠেছিল। পরীক্ষা বা ঈদ পর্যন্ত কিছুতেই এই বাড়িতে থাকা যাবে না। নাজমা সেটা জানত। আর তাই ইমনকে নিজে থেকেই বলতে হলো, আমারে নিয়া যাবা ?

কই যাবি তুই ?

কই আবার, তুমি যেইখানে থাকো ?

তুই যাবি ওইখানে ?

যামু না ক্যান ? তোমার সঙ্গে যামু বইলাই না বাড়ি ছাড়তে চাইতেছি। নাইলে কিন্তু আবার আইসা আর দেখবা না আমারে। একজন আইসা বিয়া কইরা নিয়া যাবে।

ইমন গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল, যা পাগলি, আমি থাকতে কে তোরে নিয়া যাবে ?

সেই কথা শুনে কী যে ভালো লেগেছিল নাজমার! এত সুন্দর করে কেউ বলতে পারে ? ইমন শহরে কী যেন কাজ করে। মাসে এক দুই দিনের জন্য দেশে আসে। তখন কী যে আনন্দ হয় নাজমার! লাফিয়ে উঠে সে বলেছিল, তাইলে কিন্তু এইবারেই নিয়া যাইতে হইব আমারে।

এইবারেই ?

কেন, ডরাও তুমি ?

ইমন ইতস্তত করেছিল বটে। তবে নাজমার সে কথা বোঝার কথা না। সে যদি নাজমাকে হাপিস করে দেয় তাহলে বহুদিন আর গ্রামে ফিরতে পারবে না। এখান থেকে ওখান থেকে বহু মেয়ে উঠিয়েছে আর জায়গামতো পৌঁছে দিয়েছে, কিন্তু নিজের গ্রাম থেকে উঠালে আর কি গ্রামে ফেরা যায় ? আবার নাজমার আহ্বান যে ফেলাও যায় না। খুব লোভ হয়। কতদিন ধরে নাজমা ইমনের সঙ্গে যাওয়ার জন্য পাগল হয়ে ছিল, আর কত বার ফেলে চলে যাবে সে ? কয়েক দিন নিজের কাছে রেখে তারপর না হয়… দেখা যাক, যা থাকে কপালে। দরকার পড়লে বছর দুয়েক গ্রামে না ফিরলেই হবে।                                 

বাস জোরে একটা ঝাঁকুনি দিলে নাজমার ঘুম ভেঙে গেছিল। নাকটা গিয়ে লেগেছিল সামনের সিটের পিছনের শক্ত লোহায়। নাকের উপরে হাত দিয়ে উহ করে উঠেছিল সে। কেন যে এত খাড়া হতে গেল নাকটা! ছোটবেলা থেকেই নাজমা শুনত তার নাকের কথা, চোখের কথা। বড় বড় চোখ আর খাড়া নাক। গ্রামে কেউ কেউ বলত তার চেহারা দেখতে বড়লোকদের মতো। ইমনের সঙ্গে শহরে যাওয়ার কথা ভাবলে নাজমার প্রায়ই এই কথাটা মনে পড়ত। শহরে গেলে সে মিশে যাবে সেখানকার মানুষের সঙ্গে, কেউ বুঝতেই পারবে না সে কোথা থেকে এসেছে। নাকের উপরে হাত বোলাতে বোলাতে নাজমা আবারো ইমনের হাত জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মাথা রাখে। বলে, কতদূর আসলাম আমরা ? ইমন বলে, এই তো চলে আসছি। সরু করে চোখ মেলে জানালা দিয়ে তাকালে অন্ধকারের মধ্যে ছায়া ছায়া নদী দেখা যায়। নাজমা বলে, কী নদী ? ইমন বলে, শীতলক্ষ্যা। নাজমা অবাক হয়, কও কী, এখনও গাজীপুরেই আছি ? ইমন হাসে, আরে না না, নারায়ণগঞ্জ আইসা পড়ছি।

নারায়ণগঞ্জ কই ?

যেইহানে আমি থাকি। এই যে এইখানে।

ইমন কোনও এক দিকে আঙুল দিয়ে ইশারা করে। নাজমা তেমন লক্ষ করে না। কী লাভ অত ভেবে, এখন থেকে ইমনই সব সিদ্ধান্ত নেবে, নাজমা শুধু তার কাছে থাকতে চায়। আর সবকিছু ইমনের যা থাকে তাতেই চলবে।

চলতে চলতে বাস কোথায় যেন এসে থামে। তখন ভোর প্রায়। আলো ফুটবে ফুটবে করে। দু-তিনটা কাপড় বয়ে আনা একটা মাত্র পুটলি হাতে নিয়ে নাজমা ইমনের সঙ্গে সরু অলিগলি পার হয়ে চলে। সামনে একটা সাদা তিন তলা বাড়ি আধো অন্ধকারে যেন একটু বেশি পরিষ্কার হয়ে সামনে দাঁড়ায়। সিঁড়ির ধাপের কোণগুলো কোথাও ভাঙা কোথাও বসে যাওয়া। পায়ের পাতা টের পায়। আন্দাজে পা ফেলতে গিয়ে স্যান্ডেল উলটে যায় দুবার। তবু নাজমার খারাপ লাগে না। দোতলার লম্বা বারান্দার শেষ প্রান্তের একটা ঘরের দরজায় চাবি ঘুরিয়ে তালা খোলে ইমন। বড়সড়ো ঘর। খাট, টেবিল, চেয়ার, সবই আছে। শেষ মাথায় একটা জানালাও। জানালার পাশের দেয়ালে বেতের ফ্রেমে একটা আয়না ঝোলানো। তার পাশে একটা পেরেকে লাল পুঁতির তসবি ঝুলছে। অন্যদিকের দেয়ালে বড় কাগজের গায়ে কেটে লাগানো নায়ক নায়িকার নানা ভঙ্গির ছবি। টিপবিহীন এক নায়িকার ছবির উপরে কে যেন লাল কলম দিয়ে টিপ এঁকে রেখেছে। ইমন ? ওর বুঝি এরকম নায়ক নায়িকার ছবি খুব পছন্দ। মনে মনে হাসে নাজমা। তার নিজেরও পছন্দ বটে। পরে হয়তো পত্রিকায় মনের মতো ছবি পেলে নাজমা নিজেও কয়েকটা কেটে আটকে দেবে ওই দেয়ালে। ঘরের ভিতরটায় ধূপের মতো গন্ধ। মনে হয় আগে ধূপ জ্বালানো হয়েছিল। নাজমাদের গ্রামে শুধু হিন্দু বাড়িতেই এই গন্ধ ছিল। পুটলি মেঝেতে রেখে বিছানায় বসে সে। ইমন বলে, বইসা পড়লা যে ? খিদা লাগে নাই ? আগে চলো হাতমুখ ধুইয়া আসি। বাথরুম এই বারান্দার ওই মাথায়। তুমি হাত-মুখ ধুইয়া ঘরে আসো আর আমি কিছু খাবার নিয়া আসি।

ওমা, এত ভোরে খাবার কই পাইবা ?

আরে, এই এলাকা কখনও ঘুমায় না।

মানে ?

মানে আর কী, মাইনষের কখন দরকার লাগে বলা যায় নাকি ?

কী দরকার লাগে ?

আরে বাবা, কাছে নদী না ? নদী দিয়া কখন মানুষ আইসা ঘাটে নামে, তখনই তো খাওয়ার দরকার লাগে। এখন গেলে দেখবা গরম গরম পুরি ভাজতেছে নাইলে পরোটা বেলতেছে। ভোর থেইকাই মানুষ আসা শুরু হইয়া যায় ঘাটে।

ও, আইচ্ছা। এই এলাকার লোকে তাইলে ঘুমায় না তেমন!

ঘুমাইয়া থাকলে পেট চলব ?

তা ঠিক তা ঠিক।

কঠিন জীবন সামনে, এই ভেবে নাজমা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকে। তারপর নাজমার যেন কী হয়, সে উঠে দাঁড়িয়ে ইমনকে জড়িয়ে ধরে আর এলোপাথাড়ি চুমু খেতে থাকে। আর ইমন তখন ভুলেও যায় নাস্তা আনার বা হাতমুখ ধোয়ার কথা। 

দুই দিন কাটে ঘরেই। কখনওবা জানালার পাশে দাঁড়িয়ে। ওদিকে দেয়ালের পাশে একদিকে এক চিলতে রাস্তা দেখা যায়। এলাকাটা যেন কেমন। ইমন যেরকম বলেছিল ঠিক সেরকম মনে হয় না নাজমার। তবে এদের ঘুমের সময়টা আলাদা হতে পারে। দুপুরের পর থেকে মধ্যরাত অবধি প্রচুর মানুষের আনাগোনা। রাত অনেক বাড়লে নিস্তব্ধ হতে থাকে। কিন্তু এটা সত্যি যে কখনওই পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয় না। কারা যেন হাঁটে, চলে। ফিসফিস করে কথা বলে। পায়ের শব্দ কখনও নাজমার ঘরের দরজার ঠিক সামনে এসে থামে। নাজমা তখন কাঠ হয়ে থাকে। পায়ের শব্দ আবারো চলা শুরু করে। কখনও জোরে দ’-একটা শব্দ শোনা গেলেও তেমন বোঝা যায় না। আবার বেশির ভাগ পরের দিন দুপুর হয়ে গেলেও মনে হয় মানুষের ঘুম ভাঙেনি। তারপর শুধু থেকে থেকে হঠাৎ চেঁচামেচি, খিস্তি কিংবা বাচ্চার কান্না কিংবা বাচ্চার নাম ধরে মায়েদের ডাক। বাথরুমে যাওয়ার জন্য নাজমা সেই সময়টাকেই বেছে নিত। অন্য সময়ে বেরিয়ে দেখেছে কেমন যেন অদ্ভুতভাবে অনেকে তাকায়। একটা লোক সিঁড়ির পাশে দাঁড়িয়ে একদিন নাজমাকে ইশারা করে আরেকজনকে বলছিল, নয়া নাকি ? অন্য লোকটা উত্তর দিয়েছিল, হুম, ইমনের মাল। নাজমার মেজাজ খারাপ হয়ে গেছিল। এটা কেমন ভাষা ? লোকগুলো ভদ্রতা জানে না। ইমন বেরিয়ে গেলে নাজমা দরজার কোণের লম্বালম্বি ফাঁক দিয়ে তাকিয়ে থাকত। একদিন দেখে বারান্দার শেষ মাথায় একটা মেয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে ইমনের গায়ে। ইমন সরিয়ে দিচ্ছে হাত দিয়ে কিন্তু মেয়েটা আবারও তার গায়ে আছড়ে পড়ছে। সে-কী! দিনে দুপুরে মেয়েটা নেশা করেছে নাকি ? করতেও পারে। বাথরুমে যাবার সময়ে নাজমা বেশ কয়েকবার বিড়ির ধোঁয়ার পাশাপাশি উৎকট গন্ধও পেয়েছে। বাড়িটা তেমন পরিষ্কারও না, আবার লোকজনও সুবিধার ঠেকে না। তাই সেদিন ইমন বাড়ি এলে নাজমা বলে, আমরা বিয়া করব কবে ?

বিয়া!

হ, তো কী ? বিয়া করব না আমরা ?

হ হ, বিয়া তো করবই।

হুম। বিয়া কইরা চলো এই বাসাটা বদলায়ে ফেলি। এই জায়গাটা সুবিধার লাগে না।

ক্যান, এই জায়গার কী হইছে ?

আরে দেখো না, লোকগুলা কেমন ? মুখের মইেদ্দে নোংরা কথা লাইগাই রইছে। আর কাইল দেখলা না একটা মাইয়া তোমার গায়ের উপরে এমনভাবে পড়তেছিল…

তুই দেখলি কেমনে ?

ওই যে দরজার ফুটা দিয়া।

আর কী দেখছস ?

ইমনের চোখ সরু হয়ে যায়। কোঁচকানো ভুরুর নিচে সন্দেহ ছাপিয়ে ভয় খেলা করে। তারপর সামনে নাজমার নিষ্পাপ চাহনি দেখে তা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে। নাজমা অবাক হয়, আর কী দেখন লাগব ? কী যে খারাপ এইহানকার মানুষের মুখের ভাষা! এইসব আর দেখার দরকার নাই, চলো বাড়ি খুঁজি। আগে একলা মানুষ ছিলা যেইহানে খুশি থাকছ। এখন পরিবার নিয়া এইরাম জায়গায় থাকা যায় ?

ক্যান, এইখানকার লোকের ভাষার আবার কী হইছে ?

আরে কাইল বাথরুমে গিয়া খাড়ায়ে আছি, আমার পিছনের জন আমারে ধাক্কা দিয়া সামনে চইলা গেল। আমি কইলাম, আমি তো আগে আছিলাম। সে জিগায়, অত তাড়া কীয়ের, ঘরে খরিদ্দার বহাইয়া রাইখা আইছনি ? আইচ্ছা কও, এইডা কুনো কতা ?

ও আইচ্ছা। বাদ দে। কাইল এক লোক আসবে, আগে তার সঙ্গে দেখা করি, তারপর বাড়ি খুঁজতে বাইর হমুনে।

আমিও যাব।

তুইও যাবি ?

আমার বাড়ি আমি দেইখা নিমু না ? বাড়ি ফাইনাল কইরা তারপর বিয়া কইরা গিয়া উঠব, বলে নাজমা ইমনের গলা জড়িয়ে ধরে। ইমন তখন তাকে পাঁজাকোলা করে ঘরের মাঝখানে ঘুরতে থাকে। তারপর নাজমার হাসাহাসি আর চেঁচামেচির চোটে তাকে বিছানায় ফেলে দেয়। 

পরদিন সকাল থেকেই নাজমা বলা শুরু করে, দেখো আমি রেডি হইতেছি। আইজ কিন্তু বিয়া করব আর তারপর বাড়ি খুঁজব। ভালো কতা, কোথায় বিয়া করব আমরা ? তুমি ঠিক করছো কিছু ?

নাজমা মুখে পাউডার মাখে। যত্ন করে একটা লাল টিপ লাগায় কপালে। আয়নার নিচে বেতের ফ্রেমের খোপে তার সাজসজ্জার সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখে। আয়নার মধ্যে দিয়ে ইমনের দিকে তাকায়। ইমন বিছানায় আধ শোয়া হয়ে তার আয়নার অবয়বের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসে। নাজমাও আয়নার ভিতর দিয়ে সে হাসির উত্তর দেয়। বেতের ফ্রেমের তাকের দিকে ইশারা করে নাজমা বলে, এই টিপ এইখানে পাইছি। কার এইটা ? ইমন বলে, আগে যারা ছিল এই ঘরে, তাদের কারও হইব। নাজমা হাসে। বলে, তাই করো। আমি আবার ভাবলাম এইখানে কে না কে… যাউ¹া, তোমার কাছে কে যেন আইব ? কখন ?

এই তো, এখনই। আমি একটু বাইরে থেইকা ঘুইরা আসি।

লোক আসবে তোমার কাছে, তা তুমি বাইরে যাবা ক্যান ?

অসুবিধা নাই। এখনই চইলা আসব। লোকটা আইলে বসতে দিস। বাসা ভাড়ার বিষয়েই আসবে লোকটা। ওই যে অ্যাডভান্সের ব্যাপারটা নিয়া কথা বলবে আর কী।

ইমনের কথা শুনে নাজমার হুট করে মনে পড়ে যায়, অ্যাডভান্সের জন্য তার সোনার চেইনটা দেওয়ার কথা ছিল। গলা থেকে যত্ন করে চেইনটা খুলে ইমনের হাতে দেয় সে। বলে, বাসার অ্যাডভান্স দিয়া যা বাঁচবে তা দিয়া একটা ড্রেসিং টেবিল কিনব। ইমন বলে, চেইনটা দিয়া দিলি ? নাজমা কপট রাগ দেখায়, দিমু না মানে ? আমগো বাড়ির জন্যই দিলাম। পরে দ্ইুজনে কোমর বাইন্ধা কামকাজ করলে কত চেইন বানাইতে পারব, দেইখো।

আচ্ছা, শোন, সিনেমা হলের পাশে যে সোনার দোকানগুলা আছে, দেখি কেমুন দাম কয়। সোনা কিনতে গেলে দেখবি অনেক দাম কিন্তু বেচতে গেলে দেখবি দাম নাই কুনো, এই এক সমস্যা। যাই, লোকটা আইলে বসায়ে রাখিস।

নাজমা জানত না, ওই যে ইমন দরজাটা ভিড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে, ওটাই ইমনের সঙ্গে শেষ দেখা। ইমন চলে যাওয়ার প্রায় পরপরই একটা লোক দরজায় টোকা দিলে নাজমা দরজা খুলে দিয়েছিল। লোকটা ঘরে ঢুকে তার হাত ধরতেই সে চিৎকারও করেছিল। লোকটা হেসে বলেছিল, ও আল্লা, চিৎকার কর ক্যান ?

আপনে ইমনের কাছে আইছেন না ? আমার গায়ে হাত দিতেছেন ক্যান ?

মর জ্বালা। গায়ে হাত না দিয়া কীভাবে করব ? ইমন কিছু বলে নাই ?

আশ্চর্য, ইমন কী বলবে ? সে যদি আইসা দেখে আপনি আমার গায়ে হাত দিতেছেন… বাড়ির অ্যডভান্সের জন্য আপনেরে ডাকা হইছে আর আপনি আইসাই…

কীয়ের বাড়ি ? কীয়ের অ্যাডভান্স ? এই মাইয়া পাগল নাকি ?

নাজমার তখন সত্যিই পাগল হওয়ার জোগাড়। সে আগের চেয়েও জোরে ইমন ইমন বলে চিৎকার করে। তাই শুনে লোকটা একটু পিছিয়ে যায়। তারপর আগের চেয়েও একটু বেশি করে হাসে।

এইহানে যে চিৎকার করলে কেউ আগাইয়া আইত না, সেইটা কি এখনও বুঝবার পারো নাই ? এক্কেরে ফ্রেশ মাল নাকি ? ইমন যে পাঠাইল আমারে এইখানে, সেও কি তোমারে খায় নাই ?

ছিঃ, আপনি এইসব কী কতা কন ? বাইর হন আমার বাড়ি থেইকা।

বাড়ি মানে ?

এইটা আমার আর ইমনের বাড়ি। আপনের বাড়িতে আমরা যাব না। যান।

বুচ্ছি আমি। পাগলী মাইয়া, শোনো, এইটা কারও বাড়ি হয় না। মানুষ এইখানে আসে আর যায়। কিন্তু বাড়ির থেইকাও বেশি সুখ আছে এইখানে। আর ইমন দালাল যে তোমারে এইখানে নিয়া আসছে সেইটা তুমি এক্কেরে বুঝবারই পারো নাই মনে হইতেছে ?  

লোকটা মিটিমিটি হাসে, শোনো মাইয়া, ওই ইমন তো আর আসবে না! লোকটার দিকে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নাজমা অচেতনের মতো বিছানায় বসে পড়তে চায়। লোকটা খপ করে তাকে ধরে ফেলে। বলে, কী যে করি, তোমারে দেইখা তো আমার খুব মায়া হইতেছে। লোকটা সেই যে তার পড়ন্ত শরীরটা ধরে ফেলে, তারপর আর ছাড়ে না। পরে রাত নাগাদ বিছানায় অচেতনের মতো পড়ে থেকে থেকেও নাজমা এসব কিছুর রহস্য ভেদ করতে পারে না। ঘরের দরজা বাইরে থেকে তালা দেয়া। ইমন সেই যে গেছে, তারপর খাবার নিয়েও আসে না আর। লোকটার কথামতো ইমন আর আসবেই না যেন! কে যেন একটা মেয়ে এসে চাবি দিয়ে তালা খুলে দাঁড়ায়, বিড়িতে টান দিয়ে বলে, বাথরুম যাইবা ? নাজমা নড়ে না অভিমানে। মেয়েটার দিকে তাকায়ও না। যেন কোনও ডাক শুনতেও পায়নি। মেয়েটা খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে তারপর নাজমার দিকে মুখ এগিয়ে ধুপ করে ধোঁয়া ছাড়ে। তারপর, থাক তাইলে, বলে দরজার দুটি কড়া একসঙ্গে করে তালাটায় চাবি ঘোরায়। মেয়েটা বেলায় বেলায় আসে। দুদিন নাজমা খায় না, কেবল পড়েই থাকে। কিন্তু তাতে তার ঘরে লোক আসা বন্ধ হয় না। সন্ধ্যা থেকেই একের পর এক আসে। নাজমা একজন গেলে নিজেকে গুছিয়ে উঠে কান্নাকাটি করতে করতেই আরেকজন চলে আসে। নতুন আসা কিশোরী মেয়ের যে অনেক কদর সেটা অবশ্য নাজমা পরে জানতে পারে। ওই লোকটা যেমন বলেছিল, ফ্রেশ মাল!

কত দিন যায় ? ছয় দিন বা সাত দিন ? নাজমা হিসাব করতে ভুলে যায়। কখন রাত কখন দিন, বন্ধ ঘরে তেমন বোঝা যায় না যদি না জানালা খোলা হয়। জানালা কে যেন বাইরে থেকে আটকে দিয়েছে। নাজমা খোলার চেষ্টা করে করে ক্ষ্যান্ত দেয়। একসময় ওই মেয়েটার বয়ে আনা খাবারও মুখে দেওয়া শুরু করে। তার পাহারায় বাথরুমে যেতে শুরু করে। তখন একজন লোক এসে তার শরীরের উপরে কিছু সময় বিচরণ করে চলে গেলে আর আগের মতো বুক ভেঙে কান্না আসে না। বরং ওরকম সময়ে সে মনে মনে তার গ্রামের সবুজ মাটিটা চিরে ভাগ করা আলের উপর দিয়ে হাঁটে।

রহিমা সর্দারনির নির্দেশ, যতদিন বশ না মানে ততদিন তালা থাকবে ঘরে। নাজমা নিজেও একদিন ঘরের ভিতর থেকে খিল তুলে রেখেছিল। খরিদ্দার ধাক্কা দিলেও খোলেনি। তখন রহিমা এসেছিল। বাইরে থেকে চিৎকার করে বলেছিল, ওই ছিনাল মাগি, এই ঘরের ভাড়া যে দিন ফুরাইবে তিনশ টাকা দিতে হইব সেইটা কি তোর ইমন নাং আইসা দিয়া যাবে ? সে যে তোরে আমার কাছে বিক্রি কইরা ভাগছে, সেইটা কি এখনও মাথার মইদ্দে ঢোকে নাই ? তাড়াতাড়ি দরজা খোল নাইলে ভাইঙ্গা ফেলব।

নাজমা ধীরে ধীরে উঠে এসে দরজা খুলেছিল। নিজের শরীর তখন আর নিজের শরীর মনে হতো না। কেন যেন চলতে গিয়ে খাটের কোণের সঙ্গে জোরে একটা বাড়ি খেলে, এমনকি এক হাত দিয়ে আরেক হাতের উপরে জোরে একটা চিমটি কাটলেও কোনও ব্যথা লাগত না। আর শুধু দিনে দিনে সবুজ ধান খেতের আল, ইমনের চেহারা, কিংবা বাবা-মায়ের ছোট্ট উঠানঅলা টিনের বাড়িটা চোখের সামনে ঝাপসা হয়ে আসত। একটা কিছু ভাবতে গেলে আরেকটা কিছু মন থেকে হুট করে হারিয়ে যেত। নাজমার মনে হতো সে দিনরাত শুধু হাতড়ে হাতড়ে তার জীবনের অতীতের কিছু একটা ধরতে চাচ্ছে আর যত চাচ্ছে ততই সেসব হাত ফসকে বের হয়ে যাচ্ছে। নাজমা রহিমা সর্দারনির বশ মেনেছিল রিতার সঙ্গে কথা হবার পরে। রিতা তখন তার পাশের ঘরে থাকে। রিতা আদর করে বসিয়ে খাওয়াত, চুলে তেল দিয়ে আঁচড়ে বেণি করে দিত। রিতাকে মনে হতো নাজমার এই জনমের মা। কদিনেই মনে হলো আগের যে নাজমা ছিল সেটা সে ছিল না যেন, সেটা অন্য কেউ। সেই অন্য এক নাজমার জীবন শেষ হয়ে গেছে। এখন যে নতুন জীবন সে যাপন করছে, এটাই তার জীবন। এখান থেকে বেরোবার কোনও উপায় নেই যা রিতা তাকে কথায় কথায় ভালোমতো বুঝিয়ে দিয়েছিল। বেরিয়ে গেলে ধরে তো আনবেই, এমনকি রহিমার চেয়েও খারাপ সর্দারনির হাতে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। জীবন চলে যাওয়াও বিচিত্র না। নাজমা বুঝত না এতকিছুর পরেও বাঁচার ইচ্ছাটা মরেনি কেন।

তবে পালানোর সুযোগ খুঁজতে থাকলেও সে ইচ্ছাটাও মরে গিয়েছিল গরম গিয়ে সেই শীতে নিলুফা যেদিন পালাল, সেদিন থেকে। নিলুফা তিন তলায় থাকত। নাজমার সঙ্গে শেষ দেখা করে সে পালিয়ে গিয়েছিল। তখন মধ্যরাত। নাজমা কান পেতে অনুভব করছিল শেষ সিঁড়ির পর নিলুফার পায়ের শব্দ ধীরে ধীরে অন্ধকারের মধ্যে মিলিয়ে গেছিল। নিলুফার বিশ^াস ছিল বাড়ি গেলে বাবা-মা তাকে আগলে রাখবে। সেই বিশ^াস থেকেই সে এত বড় সাহসের কাজ করতে পেরেছিল। আপন মায়ের মতো হওয়া সত্ত্বেও রিতাকে নিলুফার পালানোর কথা জানায়নি নাজমা। আর তারপর ভোরের পরপর ওই বাড়ির উঠোনে যেন মানুষের একটা মেলা বসল। চিৎকার-চেঁচামেচিতে কুয়াশার মধ্যে হুড়মুড় করে মানুষগুলো বেরিয়ে আসল। উপরের রেলিংয়ে ঝুঁকে নাজমা দেখল উঠোনের মাঝখানে ষণ্ডা ধরনের দুটো লোক নিলুফাকে দুই দিক থেকে ধরে আছে। আরও ফুটে কুয়াশা সরতেই দেখা গেল নিলুফার কপাল আর ঠোঁটের কোণ থেকে রক্তের ধারা। মাথাটা অনিয়ন্ত্রিত ঝুলছে যেন বুকের উপরে। খুব ব্যথা পেয়েছে নিশ্চয়ই। ওই লোকগুলোই নিলুফাকে মেরেছে নাকি জল্লাদের মতো ভাবভঙ্গিওলা ওই রহিমা সর্দারনি নিলুফার ওই অবস্থা করেছে নাজমা বুঝতে পারেনি। আবার কাউকে জিজ্ঞাসা করারও সাহস পায়নি। নাজমাকে শীতে কিংবা ভয়ে কাঁপতে দেখে রিতা ঘাড়ে হাত রেখে কানে ফিসফিস করে বলেছিল, ঘরে আয়। নাজমা এমনভাবে রেলিং ছেড়ে ঘরের দিকে রওনা দিয়েছিল যেন নিলুফাকে জল্লাদের হাতে ছেড়ে দিয়ে গেল।

ফিরে আসার পরে নিলুফাকে রহিমা সর্দারনি দুই দিন কিছুই খেতে দেয়নি। এ নিয়ে কেউ কোনও উচ্চবাচ্য করবে এরকম সাহসও কারও হয়নি। নিলুফাকে ঘরে বন্ধ করে রেখেছিল বটে কিন্তু সময় ধরে ধরে তার কাছে খরিদ্দার পাঠিয়েছিল ঠিকই। খরিদ্দার ঘরে ঢুকিয়ে রহিমা বাইরে থেকে তালা দিয়ে দিত। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলত, আর যাবি পলাইয়া ? কত্ত বড় সাহস, মাগি আমার চোখ ফাঁকি দিয়া ঢাকার বাসে চইড়া বসছে! কত্ত বড় সাহস, কুত্তার বাচ্চা,আমার এলাকা থেইকা তুই আমার অনুমতি ছাড়া বাইরাবি ? রহিমার সে চিৎকার দোতলা থেকে নাজমা আর রিতা শুনে কাঠ হয়ে থাকত। এমনকি পাশের তোড়া বাড়িওলির বাড়ির মেয়েদের কানে গেলে তারাও চলতে ফিরতে পারত না। রেলিংয়ের পাশে দাঁড়িয়ে কান পেতে থাকত। দিনের পর দিন তার বাজখাই গলা শুনতে শুনতে নাজমা মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিল, পালিয়ে যাওয়ার প্রশ্ন নেই, যাওয়ারও কোনও জায়গা নেই, মরলে সে ওখানেই মরবে।                              

বনানী মসজিদের সামনে রিকশা ডেকে রিতা উঠতে যায়। পাশে নাজমার দিকে তাকিয়ে দেখে সে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে কোনদিকে যেন তাকিয়ে আছে তো আছেই। রিতা খাকারি দিয়ে ওঠে, ওই কী হইছে তর ? মাথা আউলা হইছে নাকি ? নাজমা চমকে রিতার দিকে তাকিয়ে দেখে সে রিকসশয় বসে আছে। রিতা কখন রিকশা ডাকল আর কখন তাতে চড়ে বসল কিছুই বুঝতে পারে না। মনে হয় জোহরের আজান, পাশ দিয়ে যাওয়া গাড়ির উৎকট হর্ন, রিকসার টুংটাং সমস্ত শব্দ হঠাৎ করে সুড়ঙ্গের মতো একসঙ্গে তার কানের ভিতরে ঢুকে যায়, যার অস্তিত্ব এতক্ষণ ছিলই না। আর এই সমস্ত শব্দ ছাপিয়ে রিতার ভারী গলার ধমক কানে আসে, ওঠ রিকশায় কইলাম! রিতার ধমকে আশেপাশের কিছু মানুষ চমকায়। নাজমা চট করে উঠে পড়ে। শরীরটা সিটে ছেড়ে দিতেই রিকশাঅলা বলে, কই যাইবেন ?

আরে বাবা, যাওয়া শুরু করেন না, এইহানে খাড়ায়ে থাকার জন্য তো উঠি নাই। রিতার মেজাজমর্জি বুঝে রিকশাওলা আর কিছু জিজ্ঞাসা না করেই প্যাডেল মারে। সোজা যেতে যেতে খানিক পরে মোড় এলে বলে, কোনদিকে যাব, আপা ?

আরে ভাই, কোনদিকে যাবেন মানে ? আমগো দেইখা কি মনে হয় আমরা বনানীর এই বড় বাড়িগুলার মইদ্দে থাকি ? কড়াইল বস্তির দিকে যাব। লেকের দুর্গন্ধওলা পানির মইদ্দে যেইখানে নৌকাগুলা খাড়ায়ে থাকে, সেইখানে চলেন।

জি, আপা। তাই তো, কই আর থাকবেন ? আমার বাড়িও ওইদিকে। কপাল।

হ। আর আমগো কপালে আছে আজীবন ওইখানে আটকাইয়া থাকার।

হ, আপা, কপালে থাকলে আর কিছু করার নাই।

নাজমা ভাবে রিতা শুধু শুধু রিকশাওলার সঙ্গে এরকম ব্যবহার করে কেন! রিতার নিজেরই আসলে মাথা আউলে গেছে। আর সে কিনা খানিক আগে বলছিল নাজমার মাথা খারাপ হওয়ার কথা। তবে রিতার সত্যি সত্যি মাথা খারাপ দেখেছিল নাজমা বিশ বছর আগে। এখনও চাইলে এক একটা দিনের কথা মনে করতে পারে নাজমা।

জুন মাস থেকেই কানাঘুষা শুরু হয়েছিল―এইবার টানবাজারের উপরে নজর পড়েছে উপরের তলার লোকজনের। সইরা যাইতে হইব, রিতা প্রায়ই বলত নাজমাকে। নাজমা সে কথা উড়িয়ে দিয়ে বলত, কী যে করো না, বুবু, এত মানুষ কই যাইব ? কইলেই হইল নাকি ?

এত মানুষ কই যাইব সেইটা উনাগো চিন্তা ? তুই আমার কথা বিশ^াস যাস না ?

অনেক দিনের অভিজ্ঞতা আর বুদ্ধির জোরে যে রিতা খানম তখন সর্দারনি হয়েছে, তার কথা বিশ^াস না করেও উপায় ছিল না। রিতা বলত সে যখন মাত্র উনিশ বছর বয়সে টানবাজারে এসেছে, সে-ও তখন থেকেই শুনেছে এই পল্লী উঠে যাবে। এই ব্যবসা টিকবে না। কেউ এখানে থাকতে পারবে না। কিন্তু সেরকম কিছুই ঘটেনি। বরং দিনে দিনে রমরমা হয়েছে। আরও আরও ঘর বেড়েছে। ঘরের মধ্যে হার্ডবোর্ড বা টিন দিয়ে পার্টিশন দিয়ে একটা ঘরকে দুটি ঘর করা হয়েছে। কী যে বিশ্রী ব্যাপার মনে হতো প্রথম প্রথম, রিতা হাসতে হাসতে বলত, ওই পার্টিশানে শব্দ আটকায় ? নিশ^াসের শব্দও আটকাইত না। পার্টিশানের দুইদিকে দুই জনে… ছিঃ।

তারপর আবার দীর্ঘ একটা নিশ^াস ফেলে রিতাই বলত, কিন্তু ঘটনা কী জানস ? কয়দিন পরেই সেইটা অভ্যাস হইয়া যায়। তখন ওইসব শব্দগুলা এমন মুখস্ত হইয়া যায় যে কানে আসলেও মনে কোনও অনুভূতি জাগে না। যেমন একটা গাড়ির হর্ন। রাস্তার মাঝখানে খাড়াইয়া না থাকলে তুই কি গাড়িটার দিকে তাকাইবি ? ভাববি, ও আইচ্ছা একটা গাড়ি বুঝি যাইতেছে।                                                            

সেই বহুকাল ধরে গেড়ে বসা জায়গা থেকে তুলে দেওয়ার সম্ভাবনা জানা রিতাও কেন যেন সেবারে মুখ শুকনা করে নাজমাদের বারান্দায় এসে বলল, এইবার ক্যান জানি সন্দেহ হইতেছে। উইঠাই না যাওন লাগে!

ততদিনে রহিমা বিছানায় পড়ে থাকতে থাকতে মারা গেছে। কিশোরী বয়সে এসে টানা বছরের পর বছর কাজ করতে করতে রিতা একসময় ডগমগ তরুণী হয়েছে আর তার জন্য খরিদ্দারের লাইন পড়েছে। রিতাকে হিংসা করেনি, এদিকে পাঁচতলা আর ওদিকে তোড়া বাড়িওয়ালির বাড়ির মেয়েগুলোর মধ্যেও এমন কেউ ছিল না। রাস্তা থেকে হয়তো খরিদ্দার ধরে আনত একজন, আর দাওয়ায় আসতেই রিতাকে দেখে খরিদ্দার হাত ছেড়ে রিতার দিকে চলে যেত। চকচকে লম্বা চুল মেলে রিতা যখন পুরানো বিল্ডিংয়ের পাথরের বারান্দায় টুলে বসত, রোদ তার চুলে ঝিলিক দিয়ে যেত। ওইদিক দিয়ে যাওয়ার সময়ে কেউ যদি সেটা একবার দেখে যেত তবে পরের দু-এক সন্ধ্যার মধ্যে তাকে সেখানে আসতেই হতো। আর রিতা কখনও কাউকে নিরাশ করত না। এমনকি যে একবার তার কাছে আসত, সে বারবার আসত। অন্য মেয়েরা সেটা দেখে হিংসা তো করবেই কিন্তু হাজার চাইলেও রিতার মতো হতে পারত না। রিতাকে খরিদ্দাররাও পটানোর চেষ্টা করত। কেউ কেউ তো নিয়ে পালিয়ে যেতেও চাইত। কিন্তু রিতা জানত, সব শালা ভাঁওতাবাজ। নিয়ে যাবে না ছাই। বিনা পয়সায় তার কাছে আসার ধান্দা। টানবাজারের পাঁচিলবিহীন খাঁচায় তার জীবন বাঁধা হয়ে গেছে, সেটা বুঝতে রিতার মতো বুদ্ধিমান মেয়ের সময় লাগেনি। তবে একবার এক অদ্ভুত মানুষ এল। সে আর রিতাকে ছেড়ে নড়েই না। চলে যেতে বললে দ্বিগুণ টাকা ফেলে বিছানার উপরে। রিতা তাকে মানা করতে পারে না। সর্দারনির কাছে বলেও লাভ হয় না। এমনিতে বারবার একইজনের আসা সেখানে চলে না। তাই এ নিয়ে হাসাহাসির রোল পড়ে যায়। বিয়া বইলি নাকি ? রিতাকে মানুষ বলে। রিতাও উঠান থেকে ফিরে কখনও ঘরে পড়ে থাকা লোকটাকে বলে, আপনি যাইবেন না ? বাড়ি পাইছেন নি ?

থাকবার দ্যাও না তোমার কাছে, বলে অনুনয় করে লোকটা। রিতা খেঁকিয়ে ওঠে, আমার ঘরের মইদ্দে হান্দাইয়া থাকলে আর কেউ আইব আমার দিকে ? কন তো দেখি কী বিপদ! আমার বাজারটাই নষ্ট কইরা দিতেছেন আপনি। এইটা কিন্তু এইখানকার নিয়ম না।

লোকটা আড়মোড়া ভেঙে বলে, এক প্যাকেট সিগারেট আইনা দাও না। ফাইভ ফাইভ না থাকলে স্টার হইলেই হবে।

আমার কথা আগে শোনেন আপনি। বললাম, এইটা কিন্তু এইখানকার নিয়ম না। সর্দারনি জানতে পারলে…

এই সমস্ত কী বলো ? আমি কি তোমারে ঠকাইছি ? দাম দিই নাই তোমার ? বেশিই দিছি তুমি যা লও তার থেইকা। তাও ক্যান এইরাম করতেছো ?

আপনি বুঝতে পারতেছেন না। এইটা আপনার বাড়ি না যে এইখানে পইড়া থাকবেন। আসবেন, যাইবেন। ব্যস। আপনি এইখানে পইড়া থাকেন―এই খবর প্রচার হইলে কেউ আর আমার কাছে আইত না। আপনে ঘরের মইদ্দে পইড়া পইড়া ঘুমাইতেছেন বইলা কত বাঁধা কাস্টমার ফিরাইতে হইল, জানেন ?

তারা সক্কলে মিল্যা কত দিত তোমারে কও দেখি, আমি দিয়া দিব।

দেখেন, আপনি কিন্তু ভাবতেছেন বিষয়টা ট্যাকার। বিষয়টা কিন্তু ট্যাকার না। আমি বাজার হারাইতেছি, সেইটা বুঝবেন না আপনি। পরে একদিন যখন আপনি আর আসবেন না, তখন কী করব আমি ? আমার কাস্টমারগুলা তো ছুইটা যাইতেছে। তখন আর ডাকলেও আইব না। নতুন কোনও মাইয়া নিয়া মাইতা থাকব। তখন কী খামু আমি ? সর্দারনিরে কী জবাব দিমু ? আপনি দয়া কইরা বাইরান আমার ঘর থেইকা।

লোকটা বের হয় না। নৌকায় বোঝাই করে রঙ আর কেমিক্যাল নিয়ে টানবাজারে এসে সেই যে খুঁটি গাড়ে, কে জানে কোথাও থেকে ধাওয়া খেয়ে এসেছে নাকি! যেমনটা সে বলে, রিতার রূপের গোলাম হয়ে থাকতে চায়। রিতা পড়ে মহাফাঁপড়ে। দিনের বেলা লোকটা ভাত খেয়েটেয়ে লম্বা ঘুম দেয়। কী মুশকিল! ঘরে মেহমান থাকলে তাকে না খাইয়ে রাখাও যায় না। এমনকি দিনে এক-দেড় প্যাকেট সিগারেটও এনে দেয় রিতা লোকটাকে। লোকটা ঘুমালে নাক ডাকে। রিতাকে ঘুমানের জন্য দুই হাত বাড়িয়ে আহ্বান করে। রিতা কোনওদিন দুপুরের খাওয়া হতেই রাগের চোটে তোড়া বাড়িঅলির বাড়ির উঠানে গিয়ে বসে থাকে। ওখানে আসা নতুন মেয়েগুলোর সঙ্গে আলাপ জমায়। তারা কেউ কেউ চোখ কপালে তোলে, বাইশ দিন হইল আইছে কাস্টমার, আর বাইরায় নাই ? কন কী! তার লগে বিয়া বইছেন নাকি ? মেয়েগুলোর মুখে বিয়া শব্দটাই রিতার কানে তালা লেগে যায়। বিয়ে হলে হয়তো ঘরে এরকম স্বামী থাকে। দুপুরের খাওয়ার পরে কোলবালিশের মতো স্ত্রীকে জড়িয়ে ঘণ্টাদুয়েক গড়াগড়ি করে নাক ডেকে ঘুমায়। প্রথম প্রথম এখানে এসে কোনও কাস্টমারকে ভালো লেগে গেলে মনের দুএকটা কথা খুলে বলত। বলতে বলতে লোভ হতো বলে, আপনি আমারে বিয়া করবেন ? নিয়া যাবেন এইখান থেইকা আমারে ? কোনও কাস্টমার নিজেই বিয়ের প্রস্তাব দিত, টিনের চালাঘর, সামনে টলটলে পুকুর, পিছনে সবজির ক্ষেত, পাশে গোয়ালঘরে দুটো গরু বাঁধা… এরকম কত স্বপ্নে দিনের পর দিন যে রিতা বিভোর থেকেছে। দেখেছে সেই একই স্বপ্ন কাস্টমার কয়েক দিন পরে তোড়া বাড়িওয়ালির কোনও মেয়েকেও দেখাচ্ছে। তখন মুচকি হেসে ফুক ফুক করে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়েছে উপরের দিকে। তারপর মাথা পিছনের দিকে ঝুলিয়ে সেই ধোঁয়ার কুণ্ডলীর দিকে তাকিয়ে থেকে বুঝতে পেরেছে, ভবিষ্যতের দিকে তাকানো যায় না, এরকমই ঘোলাটে। কারও উপরে বিশ^াস করা যায় না, আস্থা রাখা যায় না। ধীরে ধীরে বিশ^াস হয়েছে ওইসব বিয়েটিয়ে তার কপালে নেই। সে কোনওদিন লোকালয়ে গিয়ে কারও স্ত্রী সেজে থাকতে পারবে না। কিন্তু মনের ভিতরে আবার কে যেন বলে, কেন পারবে না ? অন্য কোথাও চলে গেলে কেউ কি তাকে চিনবে ? ভাবনার ঘোরে চমকে উঠে রিতা নিজের দিকে তাকায়, সে এসব কী ভাবছে ? ঘরের মধ্যে উড়ে এসে জুড়ে বসে থাকা লোকটা কি ঘুণাক্ষরেও তাকে বিয়ে করতে চেয়েছে ? টাকা পকেটে আছে, ব্যস, পড়ে আছে রিতার বিছানায়। টাকা ফুরালে তারপর হয়তো যাবে। এখন দিন শেষে টাকা ফেলছে বিছানায় আর রিতা তার কোলবালিশ হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কে চায় এই ভালোবাসা-টাসা ? এসব অস্বস্তিকর আর অপ্রয়োজনীয়। কেউ দিতে চাইলেই নেওয়া যায় না। মানুষ তার কাছে একবার করে এলেই ভালো। কাজের পরে কারও সঙ্গে আর কখনও দেখা না হলে আরও ভালো। 

কী যে করবে রিতা! না পেরে শেষে বাইশ দিনের দিন যায় সর্দারনীর কাছে।

কস কী! অ্যাদ্দিন পরে কইতে আইসস ? বাইর কর ব্যাডারে। কী মতলবে এইহানে আইয়া ঢুকছে কে কইব ?

মতলব মানে ?

আরে আমাগো উঠাইয়া দিব ভদ্রলোকেরা, তাই হয়তো দেখতে আসছে। আবার মাদার চোদ কুনো আসামি-টাসামিও হইতে পারে, পুলিশের তাড়া খাইয়া এইহানে পলাইয়া আছে। কিছু কওন যায় ওইরাম কিছু হইলে কী হইতে পারে ? পুলিশ যদি আইসা ব্যাডারে খোঁজে ? তরেও ধইরা নিব কইলাম।

কোন ভদ্রলোক উঠাইয়া দিব আমগো ? আর উঠাইয়া দিব ক্যা ? আমরা উনাগো কী বিগড়াইছি ?

ওই যে উনাগো মতো ভদ্রলোকগুলা বাড়িত্তে বাইরাইয়া এইখানে পইড়া থাকলে মুশকিল না ?

আমরা উইঠা গেলে কী, কোথাও না কোথাও ঠিকই পইড়া থাকবেন ইনারা।

প্রশ্নের উত্তর দেয় ঠিকই কিন্তু রিতা চিন্তায় পড়ে। তার মানে ওই লোকটার বাড়িতে একটা বউ আছে, ছেলেমেয়েও আছে হয়তো। তারা হয়তো তাকে খুঁজছেও। সারা দেশে তন্ন তন্ন করে খুঁজলেও তারা কোথাও পাবে না তাকে। আর টানবাজারের ঘরে ঘরে গিয়ে খোঁজা পুলিশেরও কাজ না। কিন্তু লোকটার যেমন সুন্দর ব্যবহার, সে কি সত্যিই আসামি হতে পারে ? কী করেছে সে ? খুন ? রিতার হঠাৎ দমবন্ধ লাগে। সর্দারনির কাছে থেকে উলটো পায়ে দ্রুত ফেরত আসতে যায় সে। সর্দারনি পিছন থেকে ডাকে। রিতা পায়ের গতি কমায় কিন্তু থামে না। সর্দারনি চিৎকার করে বলে, ওই শোন, অরে বাইর কর, নাইলে রাইতে আমি আসব। দেখি হুমুন্দির পুত বাইরায় কি না। খালি পায়ে দ্রুত ছুটতে গিয়ে পায়ের নিচে কী যেন বিঁধে, কাচের টুকরা মনে হয়। দুই ফোঁটা রক্ত হাত দিয়ে মুছে নেয় সে। তারপর পায়ে পায়ে রিতার চোখে পানি আসে, লোকটা তাহলে চলে যাবে নিজের বাড়িতে! কারও সঙ্গে থাকাটা যেন কেমন, কয়েক দিনেই অভ্যাস হয়ে যায়। লোকটা চলে গেলে কেমন লাগবে ? রিতা মনে করতে পারে না দিনের পর দিন একলা থাকার সময়টা কেমন ছিল ? আশ্চর্য, এত বছরের অভ্যাস বিশ-বাইশ দিনেই বদলে যায় ? প্রথম দিন দুয়েকে নিঃশ^াসের শব্দ হলেও মনে হতো, কার নিঃশ^াস ? ঘুমের মধ্যে খুট করে একটা শব্দ শুনলে চমকে ভাবত, কে ঘরে ? তারপর ধীরে ধীরে আর অবাক হতো না। রিতা নিজেকে জিজ্ঞাসা করে, অভিযোগ নিয়ে সে এত দিন পরে কেন এসেছে সর্দারনির কাছে ? সে কি ইচ্ছে করেই লোকটাকে বেরিয়ে যাওয়ার জন্য সেভাবে চাপ দেয়নি ? সে কি নিজেই চেয়েছিল লোকটা থাকুক ?

এলোমেলো ভাবনার মধ্যে রিতা ঘরের চৌকাঠে এসে দাঁড়ায়। গরমের বিকেলে লোকটা মেঝের শীতল পাটির উপরে ঘুমিয়ে আছে। রিতার নিজের কাছে অবাক লাগে। লোকটা যেন ঘরেই থাকতে পারে তাই সে তিন বেলা খাবার এনে ঘরে খাইয়েছে তাকে। লোকটার পরিচয়ও তেমনভাবে জানতে চায়নি। নিজের উপরে তখন রীতিমতো সন্দেহ হয় তার, কারও সঙ্গে থাকা কি একটা ঘোর না, যে ঘোরে রিতা ভালোমন্দের বোধশক্তি পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে ? আর তখন এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে নিজের উপরে এমন রাগ লাগে যে রিতা ধুড়ুম করে শীতল পাটির উপরে পা পিছলে পড়ে। বছরের পর বছর গরমের দুপুরে তৈলাক্ত চুলে ওটার উপরে শুয়ে থাকতে থাকতে পাটিটা তেলতেলে হয়ে গেছে। ঝুপ করে পড়াতে রিতার লম্বা চুলগুলো লোকটার কোমরে বাড়ি খায়। চোখ কচলে পাশ ফেরে সে। তারপর হাত বাড়িয়ে রিতার গলা জড়িয়ে ধরে। তাকে কাছে টানে। রিতা শরীরটা শক্ত করে রাখে। লোকটা আরও বেশি করে টানে। রিতা লোকটার হাত সরাতে চায় কিন্তু লোকটা যেন সেটা জানতই, তাই লোহার মতো শক্ত বাঁধনে গলাটা জড়ায়। রিতা তখন ঝুঁকে এসে বলে, কী পাইছেন আপনে ? বিয়া করা বউ পাইছেন ? দুপুরে খায়া আয়েশ কইরা পইড়া আছেন ক্যান এইখানে ?

লোকটা কেন যেন তার পরেও রিতাকে টানে। বলে, আয় না… কোন-বারের ট্যাকা বাকি পড়ছে, ক দেহি ?

না না, তাই বইলা এইহানে থাকতে পারবেন না আপনে। আসামি নি কোনও ? কী করছেন, খুন না ডাকাতি ?

কী কস এইগুলা!

লোকটা রিতার গলা থেকে হাত সরিয়ে উঠে বসে। ঘুমের সময়ে ঠোঁটের কোণ বেয়ে থমকে থাকা লালা মোছে। তারপর রিতার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

কী করলে বিশ^াস যাবি যে তোর কাছে থাকতে মন চায় ?

৫             

লোকটা বেরিয়েছিল টানা ৩২ দিন পরে। একদিন আড়মোড়া ভেঙে বলল, ঘাটে একটা দোকান দিব, জায়গা খুঁইজা আসি। রিতা তার কথা তেমন একটা বিশ^াস করল না। বলেছে বলেই যে লোকটা চৌকাঠ পেরোবে―এমনটা তার মনে হয়নি। কুড়ের বাদশা বলে রিতা তাকে দিনরাত খোঁটা দিত। কিন্তু সে আহ্লাদ করে পিছনে দাঁড়িয়ে গলা জড়িয়ে ধরে বলত, তোরে কত্ত ভালা পাই, বুঝস না নাকি এক্কেরে ? লোকটার বাহুর বন্ধনের মধ্যে রিতার চোখে পানি আসত। তার কপালেও ভালোবাসা ছিল কখনও! তাও কিনা এই টানবাজারের এক কোণের ঘরের মধ্যে। রিতার ঘরটা অবশ্য অন্যদের চেয়ে ভালো। প্লাস্টার খসলে মেরামত করা হয়েছে, একচিলতে বারান্দার ফুটো হওয়া টিন সারানো হয়েছে। ঘরের ভিতরে অন্যদের চেয়ে খানিকটা ভালো আসবাবও আছে। আছে একটা ফুল লতাপাতাওলা লালরঙা কার্পেট। লোকটা কার্পেটের কোণে পা ঘষে আর বলে, বিয়া করবা আমারে ?

রিতা উচ্চস্বরে হাসে একবার। তারপর তার দিকে তাকিয়ে বলে, পাগল হইছেন নি কুনো ? এইসব বিয়া-টিয়ার লোভ দেখাইবেন না কইলাম।

লোকটা মুষড়ে পড়ে। ছোট নিশ^াস ছেড়ে বলে, আচ্ছা বল তো তোর কি আমারে পছন্দ হয় না ?

পছন্দের কথা জিগান আমারে ? আমি কি করি আপনে জানেন না ? আমি কি পছন্দ কইরা কারও লগে থাকি ? এইটা আমার কাম। আমারে ঘরের বউ বানাইতে চাইয়েন না। সেইটা আমি হইতে পারব না।

লোকটা মেঝের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবে। কার্পেটে পায়ের গোড়ালিটা ঘষে। তারপর বলে, যদি তোরে কিছু করতে মানা না করি ? তুই যা চাইবি তাই করবি। খালি আমারে তোর কাছে থাকতে দিবি।

মতলব কী আপনের ? বিনা পয়সায় কাম করবার আইছে মরদ! আমার কাউরে লাগে না। আপনে যান।

নিরুপায় হয়ে লোকটা বলে, এইরকম রাইগা থাকস ক্যান ? কথাটা কইয়া গেলাম। চিন্তা কইরা দেখ।

কথাটা বলেই লোকটা সত্যি ধাপধুপ শব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। রিতা সেদিকে ফিরেও তাকায় না। মুখ ঝামটা দিয়ে বিছানার ফুল-ছাপা চাদরটা কাঠির ঝাড়ু দিয়ে ঝাড়তে থাকে। বেলা গেলে একাই ভাত খায় রিতা। এক চিলতে রান্নাঘর আর মাঝারি আকৃতির ঘরটা কেমন যেন শূন্য লাগে। লোকটা আসা পর্যন্ত ভাত নিয়ে অপেক্ষা করার দরকার ছিল ? দ্বিধায় ভোগে রিতা। আর তারপর সন্ধ্যা পর্যন্ত লোকটার কোনও খবর নাই। কী আশ্চর্য, রিতার কখনও এরকম অদ্ভুত অনুভূতি হয়নি যা তারপর শুরু হয়। প্রতি মুহূর্তে চিন্তা হয়, লোকটা হঠাৎ গেল কোথায়! এত দেরি করছে কেন ফিরতে! লোকটা আবার দূরে কোথাও চলে গেল না তো ? সন্ধ্যার হালকা আলোয় রিতা বারান্দায় বসে থাকে। ঘন ঘন তোড়া বাড়িঅলির গেটের দিকে তাকায়, লোকটা ওদিকে কোথাও হাঁটাহাঁটি করছে না তো ? কাউকে জিজ্ঞাসাও করা যায় না তার কথা। লোকটার জন্য আবেগ উৎকণ্ঠা দেখাতে লজ্জা লাগে, যার জন্যে এতদিন প্রত্যেকের কাছে অভিযোগ অনুযোগ করেছে।

অপেক্ষার ভারে সে বারান্দার এক দিকের বেঞ্চের উপরে আশ্রয় নেয়। রিতাকে বারান্দায় বসে থাকতে দেখে সন্ধ্যার দিকে দুজন খরিদ্দার খানিক অনুরোধ করে। শরীর খারাপের অজুহাত দিয়ে রিতা তাদের সঙ্গে কথাই বলতে চায় না। তাদের মধ্যে একজন সিঁড়িতে পা রাখতেই রিতা চিৎকার করে ওঠে, ওই, আর একটা পা-ও আগাইবা না কইলাম! লোকটা বিভ্রান্ত হয়, আগে তো কখনও এরকম কথা শোনেনি রিতার মুখে! নিজেকে সামলে নিয়ে লোকটা বলে, এত্ত দেমাগ দেখাইতেছ কীল্যাইগা ? ব্যবসা ছাড়ছনি ? রূপ-যৌবন তো কড়কড়া আছে, মনে দুঃখ নাকি ?

ওই গেলি! খেঁকিয়ে ওঠে রিতা। তাই দেখে লোকটা উলটো পায়ে সিঁড়ি থেকে নামে। আর কথাও বলে না। রিতা ঘরের ভিতরে চলে যায়। ছুটে গিয়ে বিছানায় পড়ে। হু হু করে কাঁদে। জানে না কী কারণে কাঁদছে। কত রকমের অনুভূতির সঙ্গে রিতার পরিচয় আছে―তার প্রায়ই খুব রাগ হয়, মানুষের ব্যবহারে ব্যথা বেদনায় তিক্ততায় মুখের ভিতরটা তিতা হয়ে থাকে। তখন করলার রসের মতো এক দলা থুথু ফেলে। কখনও মাথা ঝিমঝিম করে, তখন সে সিনেমা হলের পাশে গিয়ে তিন চামচ চিনি দেওয়া কড়া একটা দুধ চা খেয়ে বিড়িতে দুটো ফুক দেয়। কখনও সর্দারনির সঙ্গে টাকা নিয়ে বনিবনা না হলে, খরিদ্দার কম টাকায় কিনতে চাইলে, এমনকি পাশের ঘরের মেয়েরা তার বারান্দার দিকে ভেজা জামা মেলে দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা পানিতে বারান্দাটা ভিজিয়ে দিলে সে আকাশপাতাল কাঁপিয়ে খিস্তি করে। কখনও কোনও কোনও খরিদ্দার তার শরীরটা ইচ্ছাকৃত বেশিক্ষণ ধরে যথেচ্ছ ব্যবহার করলে কখনও মনে হয় হাতে কিছু একটা তুলে ব্যাটার মাথাটা ফাটিয়ে দেয়। কত রকমের অনুভূতিই না হয় তার, কিন্তু কান্না… কান্না তার কখনও আসে না। কোন দুঃখে কাঁদবে ? কার জন্য কাঁদবে ? কার কাছ থেকে দুঃখ পেয়ে কাঁদবে ? আগেপিছে কেউ আছে নাকি যে তাকে দুঃখ দিতে পারে ? মানুষগুলো হারামমি। আর মানুষগুলো যে হারামি এটা জেনেই রিতা কারও সঙ্গে মন দিয়ে মেলে না। কারও কথা মন দিয়ে শোনেও না। কারও খায় না পরে ? কাজ না করলে একটা বেলা কেউ মাথায় হাত রেখে খাওয়াবে ?  উপরে উপরে প্রত্যেকেরই বড় আমোদ-আহ্লাদের ভাব। কিন্তু লোকটার কথা আর চাহনি কেন যেন তাদের থেকে কিছু আলাদা। লোকটা কি অন্য রকম ?

মনের মধ্যে লোকটাকে নিয়ে অন্য রকম চিন্তা আসতেই রিতার মেজাজ খারাপ হয়। শালার মানুষ! কাউকে নিজের ভালোমন্দের ঠিকা দিয়ে রাখে না রিতা। অথচ একটা মানুষের জন্য তার ভিতরে হা-হুতাশ হচ্ছে। বারান্দার পাশ দিয়ে যাবার সময়ে এক খরিদ্দার সামান্য টলে উঠে বলে, শুনলাম তুমি নাকি রাজি হইতেছ না ? সর্দারনি জানছে কইলাম।

তুমি গিয়া কইছো হুমুন্দির পুত। তোমাগো রিতার পিছনে লাগন ছাড়া আর কাম নাই ?

রিতা বেঞ্চের তলা থেকে পা দিয়ে হাতড়ে স্যান্ডেল খোঁজে। তারপর পেতেই হাতে তুলে নেয়। লোকটা বারান্দার চওড়া পিলারের পিছনে লুকিয়ে দাঁড়ায়। রিতা কিছুক্ষণ স্যান্ডেল হাতে অপেক্ষা করে রাগের চোটে স্যান্ডেলটা মেঝেতে ছোড়ে। লোকটা দেয় এক দৌড়। রিতা জোরে হেসে ওঠে, শালারা খায়া না খায়া খালি রিতার পিছে লাগোস!

লোকটার পড়ি কি মরি করে দৌড়ে যাওয়া আর যেতে যেতে টাল খেয়ে পড়তে পড়তে দৌড়ে যাওয়া দেখে রিতা হাসতেই থাকে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি আসে। চোখে পানি এলে সে আবারও কাঁদতে শুরু করে―লোকটা কেন ফেরে না! সন্ধ্যার নিবুনিবু আলো চারদিক থেকে রিতার বারান্দা ঘিরে ধরে। সামনে দিয়ে কে যায় একসময় আর বোঝা যায় না। কখনও একা কেউ হেঁটে যায়, কখনও টলতে টলতে জড়াজড়ি করে হাঁটে দুটো শরীর। রিতা সেদিকে লক্ষ্যও করে না যতক্ষণ না সর্দারনির গলা শুনতে পায়―ওই রিতা মাগি, তুই বলে হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলতাছস ? ব্যাটাগো লগে যাইস না ক্যান ? নাম ডাক হইছে দেইখা মাথায় উইঠা বসছস ?

রিতা তার চিৎকার চেঁচামেচি শুনে ধড়ফড় করে ওঠে। চোখের পানি মোছার কথাও মনে থাকে না। সর্দারনি কোমরে হাত রেখে চিৎকার করে, ওই তুই পাইছস কী ? ঘরের মইদ্দে অ্যাদ্দিন মানুষ রাখলি, আর অহন এগো লগে যাইতেছস না ক্যান ? এই ঘরের দিনে তিনশ ট্যাকা ভাড়া কি তোর ওই নাগরে দিব ? গেছে না ব্যাটা ? ভালো হইছে।

রিতা চিৎকার করে ওঠে উলটো, চুপ থাকেন! রিতার ঘর ভাড়া বাকি পড়ছে কোনওদিন ? কোনওদিন পয়সা কম পাইছেন ? আমার লগে চিল্লাইতে আসবেন না। মুখ সামলাইয়া কথা বলেন। 

সর্দারনি চমকে ওঠে। দুদিক থেকে দুজন মানুষ তার পাশে এসে দাঁড়ায়। তাদের হাত নিশপিশ করে। শার্টের হাতা গোটায় তারা। শুধু সর্দারনির অনুমতির অপেক্ষায় তারা মুঠো পাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। সর্দারনি ডান হাতের পাঁচ আঙুল বিস্তৃত করে তাদের নিষেধ করে। তারা হতাশ হয়ে থেমে যায়। সর্দারনির কথার উপরে কারও গলা উঁচিয়ে কথা বলার সাহস নেই কিন্তু রিতার হয়তো সেসব খেয়াল করার মতো মন-মানসিকতা ছিল না। সর্দারনি দুই সহযোগীসহ দ্রুত পা চালায়। রিতা বেঞ্চে শরীরটা এলিয়ে দিতে গেলে আশেপাশের দুই তিন ঘর থেকে মেয়েরা বেরিয়ে এসে তার পায়ের কাছে বসে। তার কোঁকড়া চুলগুলোতে আঙুল বুলিয়ে দিয়ে একজন বলে, এক্কেরে ঠিক করছেন, বুবু। আপনে ছাড়া এগো থোতা মুখ ভোতা করতে পারব না কেউ। ঠিক হইছে। খালি প্যাঁচাল। খালি ঘর ভাড়ার খোঁটা। আরে আমরা কি কাম কম করি নাকি ?

আরেকজন রিতার মাথায় তেল দেওয়ার জন্য বাটিতে করে তেল আনে। বলে, বুবু, ওই হারামি সর্দারনিরে আমরা চাই না। আপনি হইবেন আমাদের নেতা।

রিতার তখন লোকটার জন্য মন পোড়ায়। ওদের এসব উলটাপালটা কথায় কপট রাগ দেখিয়ে বলে, যা শয়তান! আমারে বুড়া বানায় দিলি নাকি ? যদ্দিন পাবলিকে আমারে নিয়া টানাটানি করবে তদ্দিন আমারে টিক্যা থাকার জন্য সর্দারনি হইতে হবে না।

কিন্তু তারপর, বুবু ?

তারপর আবার কী ? আগে বাজার কমুক, তারপর দেখা যাবে।

আপনেরে আমরা নেতা মানি, বুবু। আপনের মনটা নরম।

পাগলের গুষ্টি। সর্দারনি হইলে মন নরম রাখলে চলব ? তখন দেখবি কেমুন ঠ্যাটা হইয়া যাই।

এই কথা শুনে মেয়েরা দমে যায়। তোড়া বাড়িওলির দিকের একটা মেয়ে বলে, আইচ্ছা, রাইত হইয়া গেল। যাই।

মেয়েরা চলে গেলে রিতা তেলমাখানো চুলগুলো আঁচড়ে খোঁপা করে। জবাকুসুম তেলের মাতাল গন্ধে আবারও লোকটার কথাই মনে পড়ে। এই তো সেদিন লোকটা দুপুরে ভাত খেয়ে বিছানায় গড়াগড়ি করছিল আর রিতা ড্রেসিং টেবিলের সামনে টুলের উপরে বসে জবাকুসুম তেল লাগিয়ে চুলগুলো আঁচড়াচ্ছিল। আয়নায় দেখা যাচ্ছিল লোকটা গড়াগড়ি করছে। সেদিকে তাকিয়ে রিতা গুনগুন করে কী যেন একটা গান ভাঁজছিল। ধুর ছাই, কিছুতেই গানটা মনে পড়ে না এখন। লোকটা গান শুনে আয়নার ভিতর দিয়ে রিতার দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসছিল। রিতা চুলের মধ্যে হাতড়ায় আর জবাকুসুম তেলের গন্ধটা তীব্রভাবে তার নাকে লাগে। যত লাগে ততই কান্না পায়। রিতা নিজের প্রতি বিরক্ত হয়। কী হলো আজ তার! এইসব ন্যাকা কান্না কাঁদলে সে কি কোনওদিনও নেতা হতে পারবে যেরকমটা আশেপাশের অল্পবয়সী মেয়েগুলো প্রায়ই তাকে নিয়ে কল্পনা করে ?

কাঁদতে কাঁদতে চোখের পানি শুকিয়ে রিতার চোখের পাশের শিরাগুলো দপদপ করে। নিজের উপরে মেজাজ খারাপ হয়। কত মানুষ এল আর গেল। কতজনের সঙ্গে কত কথা হলো। কারও জন্য এরকম কিছু কখনও হতে পারে তা বিশ^াস করাও রিতার জন্য কষ্টকর। অন্ধকারে বসে নিজের গায়ের শাড়ির ছাপা ফুলের উপরে রিতা আঙুল বোলায়। বোলায় আর ভাবে, শরীরটাকে মেলে দেওয়া মেয়েটাই কি সে ? কেউ তো কখনও তার শরীরের উপরে কোনও স্মৃতি রেখে যেতে পারেনি! এই লোকটাকে সে তা করতে দিল কেন ?

ভাবতে ভাবতে কখন যে দুই চোখে ঘুম এসে পড়ে রিতা জানে না। বারান্দায় বেঞ্চের উপরে আধ শোয়া হয়ে ঘুমিয়ে যায়। পাশ দিয়ে ভিতরের দিকের লোকেরা আসে যায়। কেউ রিতাকে সহজে ঘাঁটায় না। তারপর বেশ রাতে কে যেন এসে ঘাড় ধরে ঝাঁকায়, বলে, শরীর খারাপ করল নাকি ? চলো, ঘরে গিয়া শোও।

অন্ধকারের মধ্যে তোড়া বাড়িঅলির বাড়ির দিক থেকে পাঁচিল চুয়ে আসা একটা কম পাওয়ারের ইলেকট্রিক বাতির আবছা আলোয় রিতা দেখে লোকটা ঝুঁকে দাঁড়িয়ে আছে তার সামনে। নিজের চোখকে বিশ^াস হয় না। কেন যেন মনে হয়েছিল লোকটা আর আসবে না। কেন মনে হয়েছিল এই ভেবেও একবার হাসি পায়। নিজের ওজন জানে না সে ? তাকে কি কেউ উপেক্ষা করতে পারে ? তবে রিতা হাসে না। ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে অস্থির গলায় বলে, কই গেছিলেন আপনি ?

লোকটা হাসে, ক্যান তোমারে ক্যান কইতে হইব কই গেছিলাম ? বিয়া করা বউ নাকি আমার ?

রিতা থতমত খেয়ে যায়। মুখে উত্তর জোটে না। বলে কী এই লোক! কিন্তু রিতাইবা কেন অত উতলা হয়ে তার খবরাখবর জানতে চাইল! লজ্জা লাগে তার। তাই না শোনার ভান করে শাড়ির বিন্যস্ত আঁচল গোছাতে গোছাতে সে ঘরের দিকে এগোয়। লোকটা তার পিছনে পিছনে এসে ঘরে ঢোকে। খাইছিলা রাইতে ? বলে গায়ের ঘামে ভেজা গেঞ্জিটা খোলে। রিতা কোনও উত্তর দেয় না। লোকটা আবার বলে, আরে খাইছ নাকি না খাইয়াই ঘুমায়ে পড়ছো ? রিতা তখন মুখ ঝামটা দিয়ে বলে, আরে রান্ধিই নাই আজকে আমি। কথা নাই বার্তা নাই উনি কাপড় বদলায়া বাইরে চইলা গেলেন!

তাই তুমি না রাইন্ধা সারা দিন বেঞ্চে বইসা থাকলা ?

রিতা চুপ করে থাকে। লোকটা তার মাথায় হাত রাখে। রিতা তখন হু হু করে কান্না শুরু করে। কিছুতেই তার কান্না থামে না। যেন আর কোনওদিন থামবে না। লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, আরে আমি কী করলাম ? কান্দো ক্যান ?

চোখের পানি এক ঝটকায় মুছে রিতা গায়ের জোরে বলে, আপনে জানেন না আমার ধান্দাটা কী ? আপনে তারপরেও এইখানে আইসা পইড়া আছিলেন। বিয়া, না ? বিয়া। আমার মতো মাইয়ার বিয়া হয় ?

হইব না ক্যান ? করলেই হয়, লোকটা বলে ফেলে।

তাইলে আমার ব্যবসার কী হবে ? আপনি আসলে আমারে একটা যন্ত্রণা দিতে আসছেন। আপনার মন ভইরা গেলে চইলা যাবেন। আর আমি তখন… আমারে কি এরা এইখান থেইকা বাইরাইতে দিবে ? আমার ব্যবসাটা শেষ কইরা তারপর আপনি চইলা যাবেন। আমি আপনার কী ক্ষতি করছি ?

না না, তুমি আমারে ভুল বুঝতেছো। সেইটা আমি করব না। তুমি যেইটা খুশি সেইটা করবা। তোমার ইচ্ছা হইলে তুমি তোমার ব্যবসা করবা, না হইলে না করবা। তোমার খুশি। আমি খালি তোমার কাছে থাকব। আমারে থাকতে দাও।

রিতা তখন লোকটার বুকের মধ্যে ঢুকে যেতে চায়। এরকম হয় নাকি! রিতার বিশ^াস হয় না। কিন্তু এটা তো ঘটছে। সত্যিই ঘটছে।     

ধুমধাম করে বিয়ে হয়ে যায় রিতা আর ফারুকের। টানবাজারে এরকম সৃষ্টিছাড়া ঘটনা কেউ কোনওদিন দেখেনি। কোনও কোনও দালাল কোনও মেয়েকে পটিয়ে বিয়ে করে তারপর এখানে এনেছে বটে। তারা একসঙ্গে থাকে আবার থাকেও না। দালাল দালালি করে আর মেয়েটা থাকে খরিদ্দার নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু এ যেন একেবারে সম্বন্ধ করে বিয়ে। মানুষজন দাওয়াত পায়, উপহার নিয়ে আসে। ছোটখাটো অনুষ্ঠান হয়, গানবাজনা, খাওয়াদাওয়া কিছুই বাদ পড়ে না। রিতা বউ সেজে ঘরে বসে থাকে। পাশের বাড়ির মেয়েরা এসে লাল নীল কাগজ ত্রিভুজাকৃতি কেটে আটা জ্বাল দিয়ে আঠা বানায়। তারপর ত্রিভুজগুলো দড়িতে আটকে টানা দিয়ে খাট সাজায়, বারান্দা সাজায়। টানবাজারের দক্ষিণ দিকের এলাকাটায় এক দল মানুষের আনন্দর্তির আওয়াজে এক অদ্ভুত সন্ধ্যা নেমে আসে যা কেউ কোনওদিন দেখেনি। কেউ কেউ হাসে। দুজন সর্দারনি আর তার সঙ্গের লোকেরা এসে খেয়েও যায় আবার হাসাহাসিও করে। লোকেরা কেউ বলে, অহন থেইকা রিতার জন্য খরিদ্দার কি আমরা আনতে পারব নাকি ফারুকই আনব ? কেউ বলে, ফারুকের পারমিশন লাগব না ? ওদিকে রিতার সঙ্গে চোখাচোখি হলেই তাদের কথা বন্ধ হয়ে যায়।

ফারুক লোকটা কোথা থেকে আসে আর কী করে, তার কিছুই কেউ জানতে চায় না। এমনকি রিতাও কি তা জানে! কখনও কখনও মানুষের অতীত বা ভবিষ্যৎ জীবন তত গুরুত্ব পায় না, যতটা পায় খোদ মানুষটা। টানবাজারে কে কার খোঁজ রাখে যে, কে কোথা থেকে এল আর কোথায় গেল ? শুধু একেকজন সর্দারনির অধীনে কিছু মানুষ দাসের মতো খেটে যায়। মাঝেমধ্যে খাটতে খাটতে কখনও কখনও তারা মৃদু গলায় বা চড়া স্বরে প্রতিবাদ করে বা করতে চায়। বাতাসের বহমানতায়, আলো-অন্ধকারের আসা-যাওয়ায় সে প্রতিবাদ কখনও মিলিয়ে যায়, আবার কখনও ছোট-বড় দাগও রেখে যায়।

রিতার প্রতিবাদ দাগ রেখেছিল। আর দাগ রেখেছিল বলেই বছর দুয়েক পরে এক ঝড়-বৃষ্টির রাতে তুমুল হট্টগোলের মধ্যে রিতাকে মেয়েরা সর্দারনি মেনে নিয়েছিল। আগের রাতে কোথা থেকে যেন ধরে আনা কচিমুখের এক কিশোরীকে আটকে রাখা হয়েছিল উঠোনের আরেক দিকের ঘরে। পাখির ছানার মতো কিশোরী কাঁপতে কাঁপতে মাঝরাতে ধাক্কায় ধাক্কায় ঘরে ঢুকেছিল। মধ্যরাতে বাথরুমে যেতে গিয়ে দেখেছিল রিতা। এসব দেখলে না দেখার ভান করাই নিয়ম। রিতাও তাই করেছিল। কিন্তু কে জানে কেন কিশোরীর মুখ চেপে ঘরের ভিতরে ধাক্কা দেওয়ার দৃশ্যটা ভুলতে পারেনি। তাই হয়তো বাথরুমে যাওয়ার ছলে রিতা ওই ঘরটার পাশ দিয়ে যাতায়াত করছিল পরের দিন। এমনিতে ওখানে কে কার খবর রাখে! কেউ প্রতারণার খপ্পরে পড়ে আসে আর কেউ নিজেই এসে খোপের মধ্যে ঢোকে―এই তো পার্থক্য। কেউ ওসব বিচার করে না, কাউকে দোষেও না। কেউ সেভাবে লক্ষ্যও করে না। দুদিন কান্নাকাটি করবে, এক-দুবার পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টাও করবে, তারপর তো সেই ওই জীবনটাকেই ভালোবেসে ফেলবে―এ তো সবাই জানে। রাতভর রাস্তায় হাঁটবে, খরিদ্দার পেলে হাত জড়িয়ে ধরে হাসাহাসি করতে করতে ঘরের দিকে রওনা দেবে, কেউবা রিতার মতো নামডাকওলা হলে চড়া দামে ঘরে বসেই ব্যবসা করবে। এসবই নিয়তি। কখনও কর্মহীন নির্জন দুপুরে গোল হয়ে বসে রোদ পোহাবে তারা। অতীতের কোনও এক পরিবারের কিংবা শীতল কোনও গ্রামের কথা মনে করে দু ফোঁটা চোখের জল ফেলবে। সেই জীবনে আর কোনওদিন ফিরে যেতে পারবে না―এই দুঃখবোধে ভারাক্রান্ত হয়ে একজন আরেকজনের মাথায় তেল লাগিয়ে লম্বা বেণি পাকাবে। জীবন কত কঠিন, এই কথা আলাপ করতে করতে শেষে চাইলেই যে জীবনের বাস্তবতা থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবে।   

কিন্তু এত সব স্বাভাবিকতার মধ্যেও রিতার চোখ থেকে কিশোরীর মুখটা সরছিল না। তাই হয়তো বেশ রাতে উঠানের এক ধার থেকে একটা ইট নিয়ে সে তুলে রাখা শিকলটার মাথায় ঝুলতে থাকা সোনালি চাইনিজ তালাটা এক আঘাতেই ভেঙে ফেলেছিল। ভাঙার পরে তার মনে হয়েছিল, এই মেয়েকে এখানে থেকে ভাগাবে কীভাবে! হুজুগে নাহয় ঘর থেকে বের করে এনেছে, কোন বেদনা থেকে এনেছে তা কেবল রিতাই জানে। তারপর বুকের কাছে কাঁপতে থাকা মেয়েটাকে আঁচলে ঢেকে নিজের ঘর অবধি টেনেও এনেছে। মেয়েটার কাঁপা তবু থামেনি। ঘরের ভিতরে ফারুককে দেখে তার কাঁপুনি আরও বেড়ে গেছিল। ফারুক প্রথমে বুঝতে পারছিল না রিতা কী করতে চায়। ততদিনে মেয়েদের জন্য খরিদ্দার ধরে আনা আর রিতার ব্যবসার হাল হকিকত দেখাশোনা করা সে ভালোই শিখে গেছে। নদীর পাড়ে আর দোকান দেয়াও হয়নি তার যথেষ্ট টাকার অভাবে। তাই ভেবেছিল যেখানে থাকে সেই ব্যবসাটা ধরে ফেলাই তার জন্য সহজ। রিতাও ব্যবসার অনেক কিছুর জন্য ফারুকের উপরে চোখ বন্ধ করে বিশ^াস রাখতে পারে। তখন আর কোনও উপায় না দেখে রিতা সেটাই করেছিল, ফারুককে বলেছিল নদীর ধার পর্যন্ত মেয়েটা রিতার পুরোনো বোরকাটা পরে যাবে একাই। কিন্তু নদীর ঘাটে যেন নৌকা তৈরি থাকে। মেয়েটাকে নিয়ে যেতে হবে কোনও ঠিকানায়। কিন্তু কোথায় ? আশ্চর্য মেয়েটা নিজের ঠিকানা পরিষ্কার বলতে পারে! টাঙ্গাইল থেকে আনা হয়েছিল তাকে। নৌকার মাঝি তাকে এই ঘাট থেকে নিয়ে আরেক ঘাটে বিক্রি করে দেবে কি না সেটার দেখাশোনা করবে ফারুক। ফারুকের ইতিমধ্যেই ভালো পরিচিতি ঘটে গেছে। উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ ওই এলাকায় মানুষের পাত্তা পায় না। কিন্তু ফারুক সম্মান পেত রিতার স্বামী হিসেবে। তাকে কিছু বললে, অসম্মান করলে যে রিতা তেড়ে আসবে তা সবার জানা ছিল। একদিন ঘাটের পাশে দাঁড়ানো পানওলা ফারুককে বলেছিল, তুমি বলে রিতা মাগির পার্মানেন্ট ভাওড়া হইছ, মিয়া ? সেই দিনই সন্ধ্যানাগাদ রিতা এসে পানের ডিব্বা চুন আর খয়েরের ডিব্বাসহ তার পুরো বাক্স টেনেহিঁচড়ে নদীতে ফেলে দিয়ে গেছে। তাই কেউ ফারুককে কিছু বলার আগে কয়েকবার ভাবত। রিতা অন্তত ভাবতে পারে যে ফারুকের কথা ফেলার সাহস কোনও মাঝির হবে না। কোনও ঘাটে গিয়ে নৌকা রেখে মেয়েটাকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে আসবে নিশ্চয়ই। কিন্তু যদি কেউ দেখে ফেলে ? যদি কোনও সাক্ষী থাকে যে কিনা পরদিন পুরো টানবাজারে রাষ্ট্র করে দেয় যে, ফারুক একটা মুখের গ্রাস টেনে বের করে নিয়ে গেছে ? মেয়েটাকে পালাতে সাহায্য করেছে কিংবা পালিয়ে নিয়ে গিয়ে কাছে ধারে অন্য কোথাও বিক্রি করেছে ? যদি বলে এসব সে করেছে রিতার প্ররোচনায়, কারণ রিতা বরাবরই সর্দারনির শাসন মানে না, বেয়াদবি করে। এই দুশ্চিন্তায় রাতটা ভোরের দিকে যায়। ফারুক বলে রিতা যা ভালো মনে করে সে তা-ই করতে রাজি।                                                 

আলো ফোটে প্রায়। রিতা আর কিছু ভাবতে পারে না। মেয়েটার গায়ের উপরে বোরকা চড়ায়। বুকের মধ্যে চেপে ধরে বলে, মা রে, বাড়ি পর্যন্ত ভালোমতো যাইস। ফারুক তাকে নৌকায় উঠিয়ে দিয়ে যখন ফেরে তখন আলো ফুটবে ফুটবে করে। ভোরের শীতলতার আকাশ চিরে দূর থেকে আজানের শব্দ ভেসে আসে। আস্সালাতু খাইরুল মিনাল নাউম… শুনলে বরাবর রিতার মন হালকা হয়, আর সেই ধ্বনি শুনতে শুনতেই তাকিয়ে দেখে ফারুক দরজায় উপস্থিত। সব ঠিকমতো হইছে ? ফারুক উপর নিচে মাথা নাড়ে তার উৎকণ্ঠার জবাবে।

মেয়েটা হুট করে টানবাজারের মাঝখান থেকে উবে গেলে তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়। এমন মানুষ নাই যাকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা হয় না। তবে রিতাকে ঘাঁটাতে কেউ সাহস পায় না। ফারুককেও সে কারণে কেউ কিছু বলে না। কিন্তু মনে মনে সে চোর চোর ভাব নিয়ে ঘোরে। সমস্যা হয় মাঝিটাকে নিয়ে। মধ্যরাতে মেয়েটাকে নিয়ে হাওয়া হয়ে গেছে আর তারপর বাড়ি পর্যন্ত পায়ে হেঁটে পৌঁছে দিয়ে এসেছে সে―এই খবর জানার পরে তার আর নিস্তার থাকে না। অত্যাচারের চোটে তাকে ফারুকের কথা বলে দিতেই হয়। আর যায় কোথায়, সর্দারনির ষণ্ডারা এমনিতেই রিতার দোষ খোঁজে, কোনও ছুঁতোয় ফারুককে পাড়া-ছাড়া করতে চায়। সেই সুযোগ তখন হাতের মুঠোয়। কিন্তু কার সাহস আছে বেড়ালের গলায় ঘণ্টি বাঁধবে! আর ওদিকে মহা হট্টগোল শুরু হয় রিতার ঘরের দিকে দল বেঁধে তারা তেড়ে এলে। চারদিকে থাকা সাধারণ মেয়েরা বেরিয়ে আসে। সংখ্যায় শ তিনেক মেয়েকে রিতার পক্ষে দাঁড়াতে দেখে সর্দারনির দলের লোকেরা ভড়কে যায়। তারা যখন হাত গুটিয়ে চলে যাবে যাবে করছে তখন রিতা বেরিয়ে আসে ঘর থেকে। কোমরে হাত রেখে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। তার ভারী গলার চিৎকারে তারা পালাতে দিশা পায় না। ফারুক সেই প্রথম বাঁশের কঞ্চি হাতে নিয়ে উঠোন ছাড়া করে লোকগুলোকে। মেয়েরা পিছন থেকে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকে। দুপুর নাগাদ বিরাট এক বিপ্লব ঘটে যায় টানবাজারের দক্ষিণ দিকে। সন্ধ্যা নাগাদ সর্দারনি আর তার অনুসারীদের চিহ্ন থাকে না। ঘরগুলো খালি করে দিয়ে কে কোথায় পালায় কে জানে। যারা তারপরেও থাকতে চায়, এসে রিতার পা ধরে মাফ চেয়ে যায়। আর তখন মেয়েরা কেউ এসে রিতার পা টিপে দেয়, কেউ তার জন্য বানায় মোহিনি জর্দা আর খয়ের দিয়ে এক খিলি পান। প্রত্যেকে রিতার আস্থাভাজন হতে চায়। তার ডান হাত বাম হাত হবার জন্য হিড়িক পড়ে যায়। ফারুকের মজা লাগে। এরকম একটা পরিবর্তন কি স্বপ্নেও আশা করে সে এখানে এসে থাকা শুরু করেছিল!

সেদিন সন্ধ্যায় তাই যারপরনাই আনন্দ লাগে তার। মাশা সিনেমা হলের পাশে জুতমতো মদ গিলে টলতে টলতে ঘরের দিকে পা বাড়ায় সে। ভাবে ফিরে এসে আজ রিতার সঙ্গে খুব আহ্লাদ করবে। হাজার হলেও রিতা কিনা নতুন নেতা, সর্দারনি! আর সে হলো গিয়ে খোদ সর্দারনির স্বামী। রিতার কথা ভেবে গলি থেকে ফুটন্ত তেল থেকে সাতলে তোলা চারটা ধোঁয়া ওঠা সামোসা নেয় ঠোঙায় ভরে। বুক ফুলিয়ে হাঁটে সে, যে যাই বলুক, সে এখানে এসে রাজত্ব আর রাজকুমারী পেয়েছে। আগের সর্দারনির চ্যালাগুলো প্রায়ই তাকে বিদেশি ঠাওরে মেলা গ্যাঞ্জাম করত। আজ থেকে তাদের বেলুন ফুটা হয়ে গেছে। এ তল্লাটে বদমায়েশরা আর ফিরে এলে কানের নিচে চটকোনা লাগাতে হবে। ভাবনাটা এলেই চড় লাগোনোর আরাম পায় ফারুক। টলতে টলতে বারান্দার কাছে এসে খুঁটি ধরে দাঁড়ায়। মিষ্টি করে ডাকে, বউ, ও বউ ? কয়েকবার ডাকেও সাড়া না পেয়ে বলে, নেতা হইয়াই ব্যস্ত হইয়া গেলা গা নাকি রিতা ? তারপর স্পঞ্জের স্যান্ডেল খুলে সিঁড়ি থেকে ফেলে দেয়। খুঁটি ধরে দরজার কাছে গিয়ে দেখে ভিতরের ঘরের দরজা বন্ধ। এরকমটা আগেও হয়েছে বারকয়েক। তখন কিছুই মনে হয়নি। বরং মনে হয়েছে, রিতা কাজে আছে। কিন্তু আজ কেন যেন মাথায় রক্ত চড়ে গেল। সে নিজে হলো গিয়ে সর্দারনির স্বামী, টানবাজারের দক্ষিণাঞ্চলের রাজা। আর তার বউ হলো গিয়ে নেতা। তারা দুজনে আজকে থেকে আশেপাশের লোকদের বলবে কী করতে হবে আর কীভাবে চলতে হবে। নেতা হয়ে নিজের তো কারও সঙ্গে যাওয়ার দরকার নাই! এ তো রীতিমতো নিজের অবস্থানের প্রতি অবমাননা!

এরকম চিন্তা মাথায় আসতেই ফারুক হুড়মুড় করে একটা ঘর পেরিয়ে যায়। করিডোরে দাঁড়িয়ে দ্বিতীয় গেটে হাত দিয়ে দুটো ধাক্কা মেরে পা দিয়ে একের পর এক লাথি মারতে থাকে। দুই পাল্লার দরজা ধাক্কার চোটে লম্বালম্বি চিরে যায়, আবার জোড়া লাগে। চিরে যাওয়া ফাঁকের মধ্য দিয়ে রিতার চকচকে আর তেলতেলে শরীরটা পাশ থেকে দেখা যায়, পিঠের উপর দিয়ে লোমশ একটা হাত সাপের মতো পেঁচিয়ে আছে। রিতার শরীরটা কোনওদিন এরকম লাগেনি কেন যেন, সাদা পিঠটা নোংরা লাগে এক পলকে। দরজায় আরেকটা লাথি মেরে চিৎকার করে ওঠে ফারুক, ওই খানকি মাগি, দরজা ধাক্কাইতেছি গায়ে লাগে না ? বাইর হ!

ব্লাউজের হুক লাগাতে লাগাতে রিতা এসে আলসেমি করে দরজা খোলে। কপাটের উপরে কনুই ঠেঁকিয়ে কোমর বাঁকা করে দাঁড়ায় সে। তারপর অবহেলাভরে জানতে চায়, চিল্লাও ক্যা ? কী হইছে ?

কী হইছে মানে ? আমি আইসা দরজা ধাক্কাইতেছি শুনতে পাস নাই ?

ঘরের ভিতরে ফারুকের চেয়েও উঁচু লম্বা এক লোক প্যান্টটা কোমর পর্যন্ত উঠিয়ে আগে থেকে সরিয়ে মেলে রাখা ফুলহাতা শার্টটা ভিতরে গুঁজে নিচ্ছে। পাটভাঙা শার্ট দেখে মনে হচ্ছে অফিস থেকে সোজা এই পথে এসেছে, আবার অফিসের ফুলবাবুর মতো ফিটফাট হয়ে চলে যেতে চায়। ফারুকের ইচ্ছে করে ছুটে গিয়ে লোকটার শার্টটা টেনে ধরে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেয়। লোকটা উলটোদিকে দেয়ালের দিকে মুখ করা। উজ্জ্বল শ্যামলা পিঠ দেখা যায়। ফারুকের হাতে ধরা সামোসার প্যাকেটটা ভারী লাগে। রাগে মনে হয় ওটাই ছুড়ে মারে লোকটার গায়ে। অথচ মাঝখানে শুধু ব্লাউজ আর পেটিকোট গায়ে রিতা দরজায় কনুই ঠেকিয়ে মুখের মধ্যে বড় আঙুলটা রেখে নখ চাবায় আর স্বামীর দিকে আপাদমস্তক তাকিয়ে দেখে। দেখতে দেখতে আগের চেয়েও অবহেলায় ঠোঁট উলটে জানতে চায়, সমস্যা কী ? আইজই প্রথম আমারে এইভাবে দেখলা মনে হয় ? কামের সময়ে দরজা ধাক্কাইবা ক্যান তুমি ?

ওই, আমি তোর দরজা ধাক্কাইমু না ক্যান ? আমারে এই কথা জিগাস, সাহস কত মাগির!

লোকটা ততক্ষণে শার্ট ইন করে বেল্ট আটকে দেয়ালে ঝোলানো আয়নায় কলার দুটো ঠিক করে নেয়। তারপর ঘুরে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে, এসব কী, রিতা ? আগে তো এরকম কোনও উটকো ঝামেলা দেখিনি তোমার এখানে ?

বলেই লোকটা বেরিয়ে যায়। রিতার উত্তরের অপেক্ষায় থাকে না। ফারুকের উপরে রিতা যাচ্ছেতাই বিরক্ত হয়, মুখ ঘুরিয়ে রাখে। রাগ বেশি হলে রিতা কথা বলে কম। ওদিকে রিতার উপেক্ষা দেখে ফারুকের মেজাজ আরও খারাপ হয়ে যায়।

এই লোক তোরে চেনে ? এই লোক কে ? প্রায়ই আসে নাকি এইখানে ?

টানবাজারে যাতায়াত আছে এইরাম লোক আমারে চিনব না ক্যান কও তো ? উনি পুলিশের বড় অফিসার। একসময় এইখানে ছিলেন, তখন আইতেন। এখন অন্যখানে বদলি হইয়া গেছেন। তাই অনেক দিন পরে আসলেন। বেড়াইতে নাকি কী কাজে আসছেন এইখানে।

ব্যস আইসাই তোর কথা মনে পইড়া গেছে।

তা তো পড়বই। একসময় রেগুলার আইতেন না ? কিন্তু কাজের সময় তুমি যদি দরজা ধাক্কাও আর এইরাম চিৎকার চেঁচামেচি করো, তাইলে আর কাস্টমার আসব আমার কাছে ?

রিতা গলার স্বর নরম করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চায়। কিন্তু ফারুক অত সহজে মানার মানুষ নয়। 

শোন রিতা, আমি কিন্তু তোর লাইগা এই গরম গরম সামোসা নিয়া আসতেছিলাম, মানে, আজকে হইছে গিয়া আমাদের একটা খুশির দিন…

শাড়ির শেষ প্যাঁচটা পেটিকোটে গুঁজে নিয়ে রিতা বলে, কই দেখি দেও তো সামোসা, খিদা লাগছে।                                                                                

সামোসায় এক কামড় দিয়ে রিতা ফারুকের মুখে তুলে দেয়। ফারুক রাগ করে থাকলেও অন্যদিকে তাকিয়ে একটা কামড় বসায়। তারপর নিচের দিকে মুখ করে চিবাতে থাকে। রিতা বলে, কামের সময়ে ভেজাল করো ক্যা ? এইরাম করলে চলব ?

ফারুক কথা বলে না।

এইরাম করলে মানুষ আর আইব না আমার কাছে। ব্যবসা শ্যাষ।

ফারুক কথা বলে না।

এই জন্যেই মানুষ কইছিল বিয়া না করতে।

তাইলে করলি ক্যান ? করলি ক্যান বিয়া ?

করছি। করছি দেইখা এখন আমারে কাম ছাড়তে হইব ?

ছাড়তে হইলে ছাড়বি।

খবরদার! আর একবারও এই কথা যদি মুখে আনছো…

কী করবি তাইলে ?

রিতা ফারুকের কথার জবাব না দিয়ে আধা খাওয়া সামোসা জানালা দিয়ে বাইরে ছুড়ে দিয়ে উঠে চলে যায়। কোথায় যায় কে জানে। কান্না গিলতে গলার কাছে ব্যথা করে ওঠে। রিতার কাছে মনে হয় তার নিজের জীবন সত্য, তার পেশা সত্য, আর তার মধ্যে এই বিয়েটা টেনে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব এক ব্যাপার। এজন্যেই এখানকার মেয়েদের জন্য বিয়ে না, সর্দারনি হয়তো এটাই বোঝাতে চেয়েছিল। আর রিতা বিরক্ত হয় এই ভেবে যে এ কথাগুলো ভাবলেই চোখে পানি আসে। এত কিছু হয়ে যায় জীবনে, তবু চোখের পানি শুকায় না কেন!

বাইরের দিকে গিয়ে কোনও একটা দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে রিতা। আপন মনে। হঠাৎ এক পুরোনো খরিদ্দার এসে গা ঘেষে দাঁড়ায়, কী ব্যাপার, তুমি এইখানে ? তোমার আবার কবে থেইকা লাইনে দাঁড়ানির দরকার পড়ল ? আমি তো মেলা দিন হইছে আইসাও তোমারে পাই না। সবসময় তোমার ঘরের দরজা বন্ধ।

খরিদ্দারের মুখ থেকে বের হওয়া মদের গন্ধে রিতার নিশ^াস ভারী হয়। মুখ ঘুরিয়ে বলে, এখন যান তো, পরে কথা বলব।

ক্যান, পরে ক্যান ? আইজকা তোমারে সামনে পাইছি। চলো।

দেখেন, এখন ভাল্লাগতেছে না। পরে, আরেক দিন আইসেন।

ভাল্লাগতেছে না আবার কী রে ?

লোকটা বিশ্রীভাবে হাসা শুরু করে। সেই হাসির সঙ্গে তার মুখের গন্ধটা রিতার সারা গায়ে মেখে যায়। লোকটা রিতার হাত ধরে টানে। রিতা অধৈর্য হয়ে বলে, হাত টানবেন না কইলাম। বলছি না, পরে আরেক দিন আসেন।

এই কথা বলবা না, সোনাপাখি। চলো, আইজকা আসছিও অনেক দিন পরে। তোমার লাইগা দুই দিন আইসা ঘুইরা গেছি। আইজকা মানা কইরো না। ট্যাকা বাড়াইয়া দিমুনে। অন্য মাইয়ার কাছে আমারে পাঠাইয়া তোর ক্ষতি ছাড়া লাভটা কী ক ?

সত্যি সত্যি লাভ নেই। রিতা লোকটার বাহুর ভিতরে গুটিশুটি হয়ে এই কথাটাই ভাবে। ফারুক ঘরের মধ্যে ঢুকে বসে ছিল দিনের পর দিন। তখন হয়তো এই লোক দু’বার এসে ঘুরে গেছে। ঘুরে যাওয়ার পরেও এসেছে। এবারে ফিরিয়ে দিলে আর না-ও আসতে পারে। আগুপিছু ভেবে নিয়ে রিতা লোকটার হাতের মধ্যে বন্দি হয়েই নিজের মুক্ত হাতটা দিয়ে নাক-চোখ মুছে নেয়। তারপর লোকটার হাতের বন্ধনটা চেপে ধরে বলে, চলেন।           

কদিন বাদে তোড়া বাড়িওলির বাসা থেকে একটা মেয়ে আসে। যেমন প্রায়ই আসে তারা কেউ না কেউ রিতার কাছে। আয়েশ করে রিতার বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে গল্প করে। হুট করে গলা নামিয়ে বলে, তুমি কি মনে করো তোমার স্বামী শুধু তোমার কাছেই আসে ? আর কারও লগে যায় না ?

কথাটা কানে যেতেই রিতা চমকে ওঠে। কিন্তু নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, যাইব না ক্যান ? যায় বুঝি ?

হ, যাইব না ? পুরুষ মানুষ। তুমি কি মনে করো তারে ?

আমি কিছুই মনে করি না। সে সারা দিন এইটাসেইটা ধান্দায় ঘুইরা বেড়ায়। কখনও খরিদ্দার ধইরা আনে, সেইটাও তো দেখছি।

সেইসব ঠিকাছে। কিন্তু সে চ্যান্স পাইলেই ওই দিকের নাজমার ঘরে ঢুইকা পড়ে।

ওই যে ওই উঠানের নাজমা ? রিতা আঙুল তাক করে উলটোদিকের দোতলা বাড়িটাকে ইঙ্গিত করে।

তয় আর কী বলতেছি। খালি নাজমার ঘরেই ক্যান বারবার, এইটা কও দেহি ? গেলে তো অনেকের ঘরেই যাইতে পারে।

ক্যান তুই চাস নাকি ? নাজমা জোর করে মুখে হাসি টানে।

সেইটা কই না। তোমার স্বামী দেখতে শুনতে ভালা। লম্বা চওড়া ওইরকম মাইনষের সঙ্গে তো যে কেউ… কিন্তু কথা সেইটা না। খালি নাজমার ঘরেই ক্যান ? আর শুনছি নাজমা নাকি ট্যাকাও নেয় না।

এবারে রিতার মুখের সাজানো হাসিটা এক ঝটকায় উবে যায়। মুখটা কালো হয়ে ঝুলে পড়ে। উঠানের মাটির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে সে। তার ভুরুজোড়া কুঁচকে আসে আর চোখদুটো সরু হয়ে যায়। নাজমা গোসলের পরে প্রায়ই ওই উঠোন থেকে চুল ঝাড়তে ঝাড়তে এই উঠোনে আসে। কখনও রিতার বারান্দায় বসে। পশ্চিমের রোদ তির্যক রশ্মিতে রিতার বারান্দায় পড়লে বেঞ্চের উপরে বসে রিতাকে বলে, ও বু, একটা পান দ্যাও না। তোমার হাতের পান না খাইলে ভাল্লাগে না। রিতা পানওলার কাছে জোগাড় করে রাখা তবকের পাতা আর লালরঙা  কোরানো নারকেলের গুঁড়ো দিয়ে নাজমাকে পান বানিয়ে খাওয়ায়। রিতার পাতলা ঠোঁটে পানের রঙ ধরলে রিতার দেখতে ভালো লাগে। আশপাশের ঘরের মেয়েগুলোর মধ্যে নাজমার প্রতি রিতার একটু আলগা টান আছে বরাবর। এই তো কাল দুপুরেও রিতার বারান্দায় নাজমা কতক্ষণ বসে গেছে। হাসিঠাট্টায় সূর্য গড়িয়ে গেছে নাজমা বলেছে, যা দেহি অহন, আমি একটু গড়াইয়া নিই। নাজমা তখন উঠতে উঠতে বারান্দার কোণে পানের পিক ফেলে পিছন থেকে রিতাকে জড়িয়ে ধরে বলেছে, যাই বু, আইজকার পান লা জওয়াব! তারপর পান খেয়ে নেশার মতো ভঙ্গি করে টলতে টলতে পড়ে যেতে যেতে বারান্দার পিলার ধরে দাঁড়িয়ে ও চোখে চোখ পড়েছে যখনি গান গাইতে গাইতে আঙুল দিয়ে রিতার দিকে ইঙ্গিত করেছে। রিতা হাসতে হাসতে কপাট লাগিয়ে অদৃশ্য হয়েছে। এত কাছের নাজমা, কই তবু তো একদিন জড়িয়ে ধরে বলে যায়নি, ও বু, তোমার স্বামী কিন্তু আমার কাছে আসে কইয়া রাখলাম। বলতে তো পারত নাজমা। বলা উচিত ছিল। এটা এখানে কেউ কারও কাছে লুকায় না। এসব কাজের খবরাখবর। জানতে হয়, জানাতে হয়। এটাই এখানকার আলাপ। কিন্তুÍ নাজমা কী মনে করে এটা গোপন করে গেছে ?

রাগে মাথা ঝিমঝিম করে রিতার। কপালের শিরাগুলো দপদপ করে নড়ে ওঠে। আর এইসব ছাপিয়ে কেন যেন ঠকে যাওয়ার একটা অনুভূতি তৈরি হয় ভিতরে। সেই অনুভূতিটাই শেষ পর্যন্ত রিতাকে কুরে কুরে খায়। এতটাই আহত লাগে নিজেকে যে, মনে হয় পায়ের তলার মাটি সরে গেছে। হুট করে মেয়েটাকে প্রশ্ন করে ফেলে, ওই, ট্যাকা নেয় না তুই কই থেকে জানলি, হারামি ?

গাইল পাড়ো ক্যান ? ওই নাজমাই কইছে। ওই না কইলে কে জানব ? কেউ কি ওর ঘরে ঢুকছে ?

রিতার পক্ষে স্বামীর গতিবিধি লক্ষ করা সম্ভব না। আবার নাজমার মতো উঠতি বয়সের রমরমা অবস্থার কাউকে নজরে রাখাও তার সাজে না। তাই রিতা মেয়েটাকেই বলে, খালি কইলেই হইব না, বুঝলি ? প্রমাণ দেখাইতে হবে।

ও, তুমি ওগো একলগে দেখবার চাও, সেইটা কইলেই তো হয়। দেখামুনে। পুরুষমানুষ সবসময় নয়া মাইয়া খোঁজে গো বু। নিজের মাইনষের চাইতে ডগমগা মাইয়া। এইটা কি অস্বীকার করতে পারবা ? আর এইটা সত্যি বইলাই আমরা এই টানবাজারে কইরা খাইতেছি।

রিতা চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর মেয়েটার কথা গায়ে না মেখে বলে, তুই খালি আমারে দৌড় দিয়া আইসা কইয়া যাবি।                       

সেদিন বেশ রাতে বিছানায় পাশাপাশি শুয়ে রিতা ফিসফিস করে ফারুকের কাছে জানতে চায়, তুমি নাকি এইহানে অন্য ঘরে যাও ?

কে কইল তোরে ?

যে-ই বলুক। যাও নাকি তুমি ?

কিছুক্ষণ দুইজনেই চুপ। প্রায় অন্ধকার ঘরের মধ্যে ফারুকের মুখের চারদিকের রেখাটা শুধু বোঝা যায়। রিতার জ্বলজ্বলে চোখ সেদিকেই স্থির হয়ে থাকে। মুখের রেখা বদলে যায় কি না অন্ধকার বুঝতে দেয় না।

এহ্, নিজে ব্যবসা খুইলা বসছে আর স্বামী চায় সাধু!

আমি তো স্বামীই চাই নাই। তুমিই না জোর কইরা স্বামী হইলা।

তারপর আর কেউ কোনও কথা বলে না। দুজনেই হয়তো একসময় ভাবে অন্যজন ঘুমিয়ে পড়েছে।    

খবরবাহী মেয়েটা মাথা নেড়ে সেদিন চলে যায় বটে তবে সাত-আট দিন পরে ভরা সন্ধ্যায় ছুটতে ছুটতে আসে। দরজায় ধাক্কা মেরে বলে, বুবু আসেন। এখনই আসেন, হাতেনাতে ধরবেন। আসেন কইলাম।

মেয়েটার ধাক্কাধাক্কিতে রিতা শরীরে কাপড় জড়াতে জড়াতে বেরিয়ে আসে। ঘরে উপস্থিত খরিদ্দারকে সামান্য একটু বসতে অনুরোধ করে। তারপর দরজা ভিড়িয়ে দিয়ে মেয়েটাকে অনুসরণ করে। বেরোনোর আগে মুঠের মধ্যে কী যেন গুঁজে নেয়। মেয়েটা তাড়া লাগায়, আরে, চলো না তাড়াতাড়ি। ধরতে চাও না নাকি ?

দুই পাল্লার দরজাটা ভেজানো ছিল। সামান্য ঠেলাতেই নিঃশব্দে খুলে যায়। রিতা প্রথমে ঢোকে, পিছনে মেয়েটা ঢুকবে কি না ইতস্তত করে। মনে হয় একটা কোনও মারামারি লেগে যাবে। তার মধ্যে সে পড়বে কি না, এই নিয়ে কয়েকবার ভাবে। শেষ পর্যন্ত দরজাতেই দাঁড়িয়ে থাকে। রিতা ধীর পায়ে ভিতরে ঢোকে। করিডোরের মতো একটা সরু জায়গা পেরোলে ঘরটা। ফ্যানের বাতাসে গোলাপি পর্দা ওড়ে। এমনিতেই দরজার তুলনায় পর্দাটা ছোট। উড়ে সরে গেলে ভিতরটা সামনাসামনি দেখা যায়। নাজমার শরীরে কাপড় নেই। বিছানায় কোমর অবধি শোয়ানো। ফারুক সামনে দাঁড়িয়ে, গায়ে স্যান্ডো গেঞ্জি শুধু। বিছানায় নাজমার কনুই ঠেকানো দুই হাতের সব আঙুলের ভিতরে ফারুকের সব আঙুল ভাঁজ করা। ফারুক তার শরীরের উপরে হেলতে যাবে, এমন সময়ে চোখাচোখি হয় রিতার সঙ্গে। পৃথিবীর সমস্ত গতি যেন থেমে যায় এক মুহূর্তের জন্য। রিতাই আবার গতির সূচনা করে। কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে ফারুকের আঙুলের বাঁধন থেকে নাজমার একটা হাত ছাড়িয়ে তাতে পাঁচ শ টাকা গুঁজে দিয়ে বলে, ফ্রিতে কাম করবি না নাজমা। এইটাই এইখানকার শিক্ষা।

তারপর তাদের কারও মুখের দিকে না তাকিয়ে যতটা নিঃশব্দে ওখানে পৌঁছেছিল তার ঠিক বিপরীতভাবে সশব্দে ধুপধাপ করে বেরিয়ে আসে। পিছনে পিছনে মেয়েটা ছুটতে থাকে, আরে কী হইল, বু ? কিছু কইবানা ? ঠিক কইরা দেখছো তো ?           

একটা দিন টানবাজারের ভিতরে যত চেঁচামেচিই হোক না কেন, পরদিন সামান্য থমথমে মনে হলেও, বস্তুত কোথাও কোনও ঝামেলা থাকে না। মানুষ যেমন প্রিয়জনকে কবরে শুইয়ে বাড়ি ফিরে আয়েশ করে গোসল করে, ভাত খায়, রাতে মশারি টাঙিয়ে বিছানা পেতে নিরাপদে ঘুমায়, টানাবাজারও তেমনি কোনওকিছুতে থেমে থাকে না। জীবনের তাগিদ বড় তাগিদ। জীবনের তাগিদ আছে বলেই ওখানে মানুষগুলো ভরপুর জীবনের পিছনে ছুটতে ছুটতে বাঁচে। বাঁচে বলে আবারও ছোটে। হতভম্ব হয়ে কিংবা মুষড়ে পড়ে থমকে যাওয়ার কোনও সুযোগ থাকে না। ওদিকে গলির মোড়ে কেমিক্যাল আর হোশিয়ারির দোকানগুলোর সামনে স্বাভাবিক যে কোনও দিনের মতোই রিকশা এসে থামে, লোকসমাগম হয়। কাপড়ের আড়ত আর রঙের দোকানগুলোতে দিন বাড়তে বাড়তে লোকে লোকারণ্য হয়। দাম-দরের আওয়াজে বাতাস ভরে ওঠে। দামে মিললে মাল বাঁধা হয়ে পোটলা রিকশায় ওঠে। দিনের ব্যস্ততা দুপুরের পরে বিকেলে ঝিমিয়ে এলে অন্য রকম মানুষের সমাগম হয়। কখনও দলে আসে তারা। বেশির ভাগ আসে একা, কেউ স্বাভাবিক হাঁটার ভঙ্গিতে, কেউবা চুপিচুপি, শরীর-মুখে অস্বস্তি নিয়ে। মেয়েরা তখন কেমিক্যাল আর কাপড়ের দোকানের আশেপাশে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ কেউ উচ্চ স্বরে হেসে ওঠে। কেউ গরম সিঙাড়ায় কামড় বসিয়ে ব্যাগ থেকে ছোট আয়না বের করে আরেক প্রস্থ লিপস্টিক ঘষে নেয়। তখন সাধনা ঔষধালয় কিংবা টানবাজার পার্কের দিক থেকে কোনও রিকশা শর্টকাট মারতে গিয়ে হঠাৎ যদি ওই এলাকায় ঢুকে পড়ে তবে রিকশার সওয়ারি ভদ্রলোকের অস্বস্তি হয়। কেউ কেউ বুঝতে পেরে না দেখার ভান করে রিকশাওলাকে দ্রুত টানতে বলে। গন্ধওলা জায়গা পার হবার সময়ে যেমন নাক দিয়ে বাতাস না টেনে মানুষ দ্রুত পার হয়, রিকশায় বসে ভদ্রলোকেরা তখন না পারে নাকবন্ধের মতো করে চোখ বুজে রাখতে না পারে দৃশ্যগুলো সইতে। এদিক ওদিক তাকালেই দেখে যে যার মতো দাঁড়িয়ে আছে মেয়েরা। গাঢ় রঙে ঠোঁট বিস্তৃত করে রাঙানো। গালের হাড়ের পর্বতাঞ্চলে হাওয়াই মিঠাই ধরনের গোলাপি আভা। চোখে ভারী কাজল ধ্যাবড়ানো। শাড়ির আঁচল অবহেলাভরে বুকের উপরে রাখা, পেটের কাছে সরু টায়ারের মতো মাংসল চর্বি বের করা। কারও আঁটোসাটো থ্রি কোয়ার্টার হাতার কামিজে বড় কমলা বা লাল ফুল ছাপা, দুই স্তনের মাঝ বরাবর ওড়না ঝোলে। কাপড় বা সাজসজ্জা নয়, ভদ্রলোকদের বিব্রত করে তাদের ভঙ্গি। আবার ওই ভঙ্গির জোরেই কোনও কোনও দিনের ভদ্রলোক রাতের আধো আলো আধো অন্ধকারে চুপিসারে আসে।

তীব্র গরম, ঝুপ ঝুপ বৃষ্টি, আকাশের ডাক বা বিজলির আলো এসে শরীর ছুঁয়ে যাওয়া―কোনওকিছ্ইু টানবাজারের কাউকে টলাতে পারে না, তবে তারা টলে টালমাটাল হয়ে যায় যখন ভয়ানক আর চিটচিটে গরমের এক দিনে কতকগুলো মানুষ এসে হিড় হিড় করে পল্লীতে ঢুকে পড়ে। দেখলে মনে হয় যেন একটা মিছিল। তবে তাদের মুখে কোনও সেøাগান থাকে না। সামনে কতকগুলো পুলিশ আর পিছনে কয়েকজন মৌলবি আর সঙ্গে এলাকার মাস্তান ধরনের কিছু ছেলে। একরকমের মানুষের একসঙ্গে সমাগম স্থানীয় লোকদের কৌতূহলী করে। দোকানপাটে ব্যস্ত লোকেরাও ভালো করে নজর করতে থাকে। এদের উদ্দেশ্য কী! মাশা সিনেমা হলের পাশের রাস্তাটাই চওড়া বেশি। তাই সেদিক দিয়ে কিছু লোক তাদের পিছু নেয়। দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকেরা, নদীর দিকে নৌকার পাশে আর পান-সিগারেটের দোকানের পাশে ভিড় জমানো মানুষেরা কৌতূহলী হয়ে তাদের পিছনে পিছনে হাঁটে। সমস্যার গন্ধ কার না ভালো লাগে। আর টানবাজারের দিকে কোনও সমস্যা হয়েছে ভাবলে আরও ভালো লাগে।

লোকগুলো যুক্ত হতে হতে মিছিলটা বিরাট আকৃতি ধারণ করে। যে কেউ দেখলে বলবে, আজ কিছু একটা না হয়েই যায় না! তাই অসীম আগ্রহ নিয়ে মানুষের মিছিলটা পল্লীর দিকে বাড়তে থাকে। একটা কাপড়ের দোকানের সামনে মিছিলটা থমকায়। সামনের সারির একজন মাস্তান আঙুল উঁচিয়ে বলে, এই এলাকায় আপনেরা নিষিদ্ধ পল্লী চান ?

কাপড়ের দোকানের কর্মচারীরা বিভ্রান্ত হয়ে একে অন্যের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।

কী মিয়ারা চান কি না বলেন না ক্যান ? আগেও তো কতবার কথা হইছিল, এই এলাকার অবক্ষয়ের জন্য দায়ী কারা ?

এক কর্মচারী বলে, কীয়ের অবক্ষয় ? এইখানে এরা না থাকলে মাইনষে আইব ব্যবসা করতে ? আমগো ব্যবসা তো লাটে উঠব।

এইটা কী কতা কইলেন মিয়া ? সারা বাংলাদেশে ব্যবসা জমানির জন্যে কি দোকানপাটের পাশে পাশে একটা কইরা টানবাজার বানাইয়া রাখছে ? মাস্তান দোকানের মালিককে খোঁজে, দেবু কই ? এই বেয়াদ্দব লোকটারে কামে রাখছে কেডা ? এইডারে আইজকাই পাছায় লাত্থি দিয়া বাইর করনের ব্যবস্থা কর। কই গে ? দেব দুলাল ?

যার দিকে তাকিয়ে কথা বলা হয় সে মাথা নেড়ে বলে, জি ভাই। আর কনুই দিয়ে নতুন কর্মচারীর গায়ে একটা ধাক্কা দেয়। কর্মচারীটা অবাক হয়ে বলে, কী হইছে ?

আ বে, তুই চুপ কর।

ক্যান, কী হইছে ? কী কয় এই লোক ? এই জায়গায় আইছে ক্যান তাইলে এতই যদি অবক্ষয় ?

তুই বুঝবি না। দেখস না সামনে পুলিশ ?

সেইটাই তো বুঝতাছি না, পুলিশ আইছে ক্যান এইহানে ?

আইছে ভালো হইছে। এমনিতে পুলিশ কি আসে না এইখানে ? দেখস নাই আগে ? অহন তুই চুপ থাক।

লোকটা চুপ করে যায় ঠিকই তবে উলটোদিকের রঙের দোকানের বয়স্ক মালিক রতন সাহা বলে, এত্তগুলা মাইনষে এই দিনে দুপুরে আইছেন কিল্যাইগা ? এইহানে তো রাইতের কাম। দিনের বেলা আছি আমরা।

… একজন মৌলবি ক্ষেপে যান, এইডা কী কন মিয়া ? আমরা আসছি একটা ভালো কাজে। এইখানকার অসামাজিক কার্যকলাপ বন্ধ হইতে হবে। শহরের এইরাম ব্যস্ত একটা এলাকায় এইরকম অরাজকতা চলতে দেয়া যায় ?

কীয়ের অরাজকতা ? রতন সাহার চোখ কপালে ওঠে।

মানে ? এই লোকে কয় কী ? মৌলবি নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করার ভঙ্গিতে কথাটা বলে নিয়ে আশপাশের অনেকের দিকে তাকায়। তারা প্রত্যেকে হাঁ করে রতন সাহার দিকে তাািকয়ে থাকে।          

দু-একজন হাসি হাসি মুখ লুকানোর চেষ্টা করে না। বলে, এইখানে অরাজকতা কোথায় দেখলেন, এইখানে তো রসের কাম হয়।

মৌলবি এমনভাবে নাক-মুখ কোঁচকায় যেন কুৎসিত কিছু শুনে ফেলেছে। শোনা কিছুতেই উচিত হয়নি কিন্তু চোখের মতো কানের সামনে পর্দা না থাকায় তার কিছু করার ছিল না। তারপর মুখ শক্ত করে বলেন, সেইটাই। সেইটাই আমরা এইখানে আর হইতে দিব না।

একজন আলেম লোকের মুখে এরকম দৃঢ় উচ্চারণ শোনার পরে উপস্থিত কারও মুখে কোনও কথা জোটে না। তারা নিজেদের মধ্যে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে। মৌলবি হাঁটা ধরলে মিছিল এগোতে থাকে। তারা এগিয়ে গেলে, একজন আরেকজনকে বলে, খবর হইব এবার!

কী হইব, বল তো ?

বুঝস না, সেই যে কবে থেইকা শুনতাছি পল্লী উঠাইয়া দিব, এইবারে সত্যিই উঠাইয়া দিব মনে কয়।

এহ্! কইলেই হইছে। উঠাইয়া দিলে এরা যাইব কই ?

মিছিলের মধ্যে একজনের কানে কথাটা যায় আর ইশারায় হাত তুলে থাপ্পড়ের ভঙ্গি দেখাতে দেখাতে সামনে হাঁটে সে। লোকদুটো তখন গলা নামিয়ে ফেলে, দেখতাছেন না, হেফাজতে ইসলামীর লোকজন আসছেন। এইবার না উঠাইয়া করব কী! আরেকজন তখন ভয়ে উত্তর দেয় না, শুধু চোখ গোল করে দাড়ি আর টুপির দিকে তাকিয়ে থাকে।

মিছিলটা পল্লীর শুরুর দিকের একটা উঠোনে পৌঁছে। সামনের সারির একজন মাস্তান চিৎকার করে ঘরগুলো থেকে সবাইকে ডাকে। উপস্থিত লোকজনকে মাস্তানরা চাপ দেয়, মানুষ এত কম ক্যান ? তোমগো তো শুনছি হাজার দুয়েক ঘরে তোমরা অন্তত সাড়ে তিন হাজার লোকে থাক। বাকিগুলা কই ? দিনে দুুপুরেও মানুষ লাগাইতে আসে নাকি তোমাগো ?

চেঁচামেচি শুনে ঘরগুলো থেকে কেউ কেউ বেরিয়ে এসে উঠোনে দাঁড়িয়ে চোখ কচলায়। তারা ভাবে, হতে পারে কোনও এনজিওর লোক। হয়তো এইডস, সিফিলিস, এই সমস্ত রোগের হিসাব নিকাশ করার জন্য রক্ত নিতে এসেছে। হতে পারে জন্ম নিরোধক বিলাবে, ব্যবহার করার জন্য অনেক অনুরোধ করবে। এই ভেবে নিয়ে এক মেয়ে আরেকজনকে কনুই দিয়ে গুঁতা দিয়ে বলে, এরা কইলেই যদি হইয়া যাইত! যারা আইব তারা যদি না মানে ? এগো কথা শুনলে আর কাস্টমার পাওয়া হইত না। কনুইয়ের গুঁতো খেয়ে মেয়েটা খিল খিল করে হাসে, কোনও এক কাস্টমারের ভঙ্গি করে। সামনে থেকে হাত দিয়ে কিছু সরিয়ে দেওয়ার মতো করে বলে, ফ্যালো তো এইসব… মজা লাগে না।

তাদের পাশে আরও দুজন এসে দাঁড়ায়, মৌলবি কী কামে আইল ক তো!

আমগো নমাজ শিখাইতে আইছে মনে কয়।

প্রথমে কিছুক্ষণ হেসে নিয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কিছু বলাবলি করে তারা। তারপর আবারও হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে উঠোনে লোক জমে। পশ্চিমের দিকে সূর্য হেলে পড়েছে বলে রিতার বারান্দায় ঝলমলে রোদ তখন। রোদের তাপে দড়িতে মেলা সামান্য মাড় দেওয়া শাড়ি কড়কড়ে হয়ে একদিকে বেঁকে আছে। সেদিকে তাকিয়ে একজন বলে, রিতা বুবুরে ডাকতে হইব না ?

পুলিশ লাঠি দুলিয়ে বলে, ডাকো। সব্বাইরে ডাকো।

উঠান প্রায় ভরে যাবার পরে কে যেন রিতাকে ঘুম থেকে ডেকে আনে। বিরক্তি নিয়ে বারান্দার সিঁড়িতে দাঁড়ায় সে। তারপর হাই তুলে নিয়ে আঁচল কোলে টেনে বাঁধে, কী চান এইহানে আপনেরা ?

তোমাগে লগে কথা কইতে চাই।

কীয়ের কথা ?

দেখো, আগেও টুকটাক বলা হইছে, এই পল্লী কিন্তু থাকব না।

থাকব না, মানে ? কই যাইব ? আপনেরা একসঙ্গে আইলেন ক্যান ?

এই জন্যেই আমরা একসঙ্গে আইছি। যেন তোমাগো লগে কথা কইতে পারি।

একলা আইতে ভয় পান সেইটা কন না ক্যান ? একলা আইলে কি এই মাইয়াগুলান আপনাগোরে খাইয়া ফালাইব ?

রিতার কথা শুনে লোকজনের মধ্যে হাসির রোল ওঠে। মৌলবি বিব্রত বোধ করে। তার মুখে কথা জোটে না। একজন মাস্তান এগিয়ে আসে, ওই, হুজুরের লগে এইরাম বেয়াদবি করলে… ছেলেটার ডান হাতটা হয়তো নিজের অজান্তেই মাথার উপরে উঠে যায়।

রিতা এগিয়ে এসে সেই হাতের কবজিটা ধরে ফেলে। তার ঠিক পিছনে আসে তিন-চারজন দালাল বা দেখভালকারী লোকজন। তাদের মধ্যে সাইফুল একটু বেশিই এগোয়। ছোটখাট মানুষ হলে কী হবে, তার মারদাঙ্গা ভঙ্গি দেখে ভয় পেয়ে যায় মাস্তানেরা। সাইফুল তার ভরাট গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলে, আমগো উঠানে খাড়াইয়া আমগো গায়ে হাত তোলার কায়দা করতেছিলেন ? এইহানে আপনাগো কাউরো নিয়ম চলে না। এইটা আমগো জায়গা।

তার কথার দৃঢ়তায় মৌলবি আগেই পিছিয়ে গেছে, মাস্তানরাও চুপসে যায় পাশে রিতার অগ্নিমূর্তি দেখে। একজন পুলিশ এগিয়ে আসে, একদম চুপ। কথা বন্ধ। আমরা যেইটা কইতে আসছি, সেইটা আগে শোনো তোমরা।

রিতা কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়ায়। সাইফুল কয়েকজনসহ রিতার পাশে এসে দাঁড়ায়।

অনেক দিন থেইকাই আপনেরা শুনছেন যে, এই পল্লী উঠাইয়া দিতে হবে। আপনারা এইটা জাইনাও কোনও পদক্ষেপ নেন নাই। এইবারে তাই আপনাগো উঠাইয়া দেওয়া হবে।

কেমনে উঠাইবেন শুনি ? রিতার মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে থাকে।   

মিছিলে আসা কেউ কেউ রিতাকে চেনে। তাই ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে খানিকটা পিছিয়ে যায়। রিতা বলতেই থাকে, তা, আমগো উঠাইয়া আপনাগো ফায়দাটা কী, সেইটা একটু খুইলা কইবেন ?    

এত কথা বলা যাবে না। তবে আগেও যেটা বলছি, তোমরা এই এলাকার জন্য হুমকি। তোমরা রং তামাশা কইরা, অসামাজিক কার্যকলাপ চালু রাইখা মানুষরে বিপথে পাঠাইতেছ। মানুষরে নেশার মইধ্যে টাইনা আনো তোমরা। তোমগো লাইগা দ্যাশটা…

আমাগো লাইগা দ্যাশটা শ্যাষ হইয়া গেল, বলেই রিতা হো হো করে হাসতে থাকে। তারপর নিজের চারপাশে দুই পাক ঘুরে বলে, শুনছো সবাই ? আমগো লাইগা দ্যাশটা এক্কেওে শ্যাষ হইয়া গেল। তাই আমাগো কী করতে হবে ? আমাগো উইঠা যাইতে হবে, বলে নিয়ে রিতা আবারও মিটি মিটি হাসতে থাকে। চারদিকে দাঁড়ানো মেয়েরাও মুচকি হাসে। কেউ কেউ নিজের ঘরের দিকে যেতে উদ্যত হয়।

শোনো, তোমরা ভাইবো না এইটা খামোখা একটা কথা কইতে আসছি আমরা। আমরা যা কওয়ার কইয়া গেলাম। আগামী জুলাই মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত তোমাগো টাইম দেওয়া হইল। আমরা টানবাজারের মাটি শুদ্ধ করতে চাই। হুজুরের নেতৃত্বে আমরা এই এলাকার মানুষেরা তোমাগো নষ্টামি বন্ধ কইরা এই জায়গা উদ্ধার করব কইলাম।

ওই, তোরা উদ্ধার কইরা কী করবি জায়গা ? কীয়ের লোভ এত ? এইগুলা তোগো জায়গা ? আমরা বছরের পর বছর এইহানে থাকি, ভাড়া দিই, তোগো সমস্যা কী ?

ওই মাতারি, চুপ এক্কেরে! আর একবার যদি গলা উঁচাইয়া কথা বলছস।

পুলিশের কথায় রিতা চুপ করে থাকে বটে তবে চোখ কটমট করে তাকিয়ে থাকে। চোখ যেন ঠিকরে বের হয়ে আসবে। ওখানে উপস্থিত যারা রিতার মেজাজ আর শক্তির কথা জানত, তারা বলে দিতে পারত যে রিতা চাইলে এগিয়ে গিয়ে পুলিশটাকে ধাক্কা দিতে দিতে মাশা সিনেমা হল পর্যন্ত রেখে আসতে পারে। কিন্তু রিতা কেন যেন কিছুই করে না। বিস্ফোরিত কিংবা রাগত চোখের আড়ালে কেন যেন তার মন বলে এটা চেঁচামেচির সময় না। তাই সে গলা স্বাভাবিক করতে চেষ্টা করে, বলে, আপনেরা সত্যি সত্যি কী বলতে আসছেন ?

আমরা বলি যে, তোমাগো এই ব্যবসা এইখানে চলব না। এলাকাটা রং, কাপড়, হোশিয়ারি আর কেমিক্যালের জন্য বিখ্যাত। দূর দূরান্ত থেইকা মানুষ এইখানে আসতেছে এইসমস্ত জিনিসগুলির জন্য। কিন্তু তোমরা মধ্যখানে একটা পল্লী বানাইয়া রাখছো। তোমরা না উঠলে এইখানকার পরিবেশ এক্কেরে নষ্ট হইয়া গেছে। দুই দিন পর তোমাদের যন্ত্রণায় এইখানে আর মানুষ আইব না। তাই এই জায়গাটায় ব্যবসাপাতি ঠিকঠাক হওয়ার জন্য, তরুণদের ভালো ভবিষ্যতের জন্য তোমরা এইখান থেইকা উইঠা যাও।

আশ্চর্য, এই পল্লী আমরা বানাইছি নাকি ? এইটা তো চাইরশ বছর ধইরা এইখানেই আছে। তখন আপনেরা কই আছিলেন ? আর আমরা না থাকলে এইখানে ব্যবসা হইত না কইলাম। আমরা মানুষগুলারে আনন্দ দেই দেইখাই না…

রিতার গলা আবারও চড়ে যায় আর পিছন থেকে হুজুর এগিয়ে এসে বলে, অ্যায় জেনানা, খুবই আপত্তিকর কথা বলতেছেন। আনন্দ মানে কী ? যে কাজ সমাজ নষ্ট করে তাকে তিনি মানুষের আনন্দ বলতেছেন ?

পিছনের দুইজন এগিয়ে সামনে আসে, বলে, হুজুর এইদিকে আসেন। এই মহিলার সঙ্গে কথা বললে আপনার মান-সম্মান থাকবে না।

তগো মান-সম্মান নিয়া এতই যখন চিন্তা, তোরা এইহানে আইসস ক্যান ? কুত্তার বাচ্চারা, যা গিয়া তগো ভদ্র সমাজে মুখোশ পইরা বইসা থাক। আমগো এইখান থেইকা যা।

রিতার কথায় এমন আহ্বান ছিল যে আশপাশের লোকেরা ঘিরে আসে। প্রায় তিন-চারশ মেয়েরা যখন ঘিরে আসে মিছিলটা একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায়। পুলিশের হাতের লাঠি নুয়ে পড়ে। অতগুলো উদ্ধত মানুষের সামনে লাঠি তুলে ধরার প্রশ্ন নেই। হঠাৎ করে তাই এক মাস্তান বলে বসে, শোনেন, মেয়র সাহেবের অর্ডার নিয়া আসব আমরা। তখন আর কইতে পারবেন না, চইলা যা। আপনাগোরই চইলা যাইতে হইব। এই জায়গায় থাইকা আপনারা আমাদের শহরের পরিবেশ ধ্বংস করতে পারবেন না।

ও, মেয়র! তাই কও। আমগো এই জায়গার উপরে নজর পড়ছে, তাই না ? বিল্ডিং বানাইবা আমগো খেদাইয়া ?

রিতার কথায় ঘিরে আসা মেয়েদের মধ্যে একরকমের বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে। তারা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রতিরোধের জন্য এগোয়। বেগতিক অবস্থা দেখে মৌলবি আর এলাকার মাস্তানেরা পুলিশসহ টানবাজার মসজিদের দিকে এগোতে থাকে। তারা হাঁটা ধরলে পিছনে পিছনে কিছু মেয়ে ছুটতে থাকে। তারা হাঁটার গতি বাড়ায়। মেয়েরা দৌড়ায়। বলতে গেলে ধাওয়া করতে করতে পল্লীর সীমা পার করে মসজিদের সামনে রেখে আসে তাদের। মসজিদের সামনে গিয়ে মিছিলটা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেলে মিছিলের কেউ কেউ মেয়েদের হাতে দু-চারটা চড়থাপ্পড়ও খায়। উপায় না দেখে যে যেদিকে পারে দৌড় লাগায়।

আপাতত আবারো পল্লীতে শান্তি নেমে এলেও থমথমে একটা ভাব সবখানে। উঠে যেতে হবে শোনা গেলেও কখনও এরকম ঘটনা ঘটেনি যে একদল লোক এতটা সাহস করে পল্লীর মাঝখানে উঠানে দাঁড়িয়ে কথা বলবে, তাদেরই জায়গায় দাঁড়িয়ে তাদেরকেই চলে যেতে আদেশ দেবে। রিতা সকাল সকাল বারান্দায় বসে থাকলে তাকে ঘিরে থাকে রক্ষাকারী বাহিনীর মতো কতকগুলো ছেলে আর আশেপাশের মেয়েরা। প্রত্যেকের এক প্রশ্ন, এবার কি সত্যিই আমাগো উইঠা যাইতে হবে ?

পাগল নাকি! রিতা চোখ কপালে তোলে। এই জায়গা আমাদের। আমরা যখন বাঁইচা থাকব না, আমাদের সঙ্গে থাকা পোলাপাইনরা এই জায়গায় বসবাস করবে। চইলা যাইতে বললেই হবে নাকি ?

সত্যিই চলে যেতে হবে কি না―এই নিয়ে সারাদিন পল্লীর আনাচে কানাচে জল্পনাকল্পনা চলে। কেউ বলে এইবার আর রক্ষা নাই। কেউ বলে, মামার বাড়ির আব্দার আর কী! হ্যারা কইল আর আমরা রওনা দিলাম। তা এতগুলা মানুষ চট কইরা যামু কই, শুনি ?

কেউ আলোচনা এগিয়ে নেবার খাতিরে পাল্টা যুক্তি দেখায়, তা আমরা কই যাব, কী খামু সেইটা অগো চিন্তা নাকি ?

অগো চিন্তা না মানে ? এতগুলা লোকরে পথে নামাইতে পারে কেউ ? জোর কইরা কেউ সমাজের কোনও পেশারে বন্ধ ঘোষণা করতে পারে ?

না না, পারে না, অনেকের গলা শোনা যায়।

রিতা বারান্দায় বসে শোরগোলটা চুপচাপ শোনে। তাদের কথা শুনে মনে হয় না কেউ বিশ^াস করছে সত্যি সত্যি এই জায়গা ছেড়ে চলে যেতে হতে পারে। কিন্তু কে জানে কেন রিতার বুকের ভিতরটা কেঁপে ওঠে। এসব তো ভালো আলামত না, এই যে লোকগুলো সাহস করে তাদের উঠানের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে শাসিয়ে গেল। রিতা ধীরে ধীরে বারান্দা থেকে উঠে ভিতরে যায়। ফারুক ঘুমিয়ে ছিল। তাকে ধাক্কা মেরে উঠায়। বলে, এত কিছুর পরে পইড়া ঘুমাইতেছ কেমনে ? কই যাব আমরা ?

কই যাব মানে ? তোর কি মাথা খারাপ হইছে ? আমাগো উঠাইব এত হ্যাডম কার দেখি ?

শোনো, বিছানায় আরাম কইরা শুইয়া এইসব ভাবলে বিপদ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে না। তুমি যাও, লোকজনের সঙ্গে দেখা করো। খবর আনো। কেন এইটা হইতেছে। এইটার পিছনে কারা।

কই যাব ?

কই যাবা মানে ? আমি কী জানি কই যাবা ? পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করো, মেয়রের অফিসে কী আলাপ চলতেছে সেইটা জানার চেষ্টা করো। আর এই মৌলবিগো স্বার্থ কী সেইটাও জানতে হবে।

এত জাইনা কী হবে ? আমরা কি তাদের সঙ্গে পারব ?

রিতা চুপ হয়ে যায়। এই কথার উত্তর তার জানা নাই। গায়ের জোরে একটা উত্তর দিয়ে লাভও নাই। বরং ভাবা যেতে পারে। রিতা নিজেই টানবাজারের দোতলা বা একতলা বাড়িগুলোর বাড়িঅলাদের সঙ্গে দেখা করবে। দেখা যাক তারা কী বলে। মনটা বেশি অস্থির বলে রিতা মা ফাতিমা মন্দিরের দিকে যাবে বলে কাপড় বদলাতে থাকে। ফারুক বলে, তুমি কই যাও ?

মন্দিরের দিকে যাই। ওইখানে কিছুক্ষণ বইসা থাকব। তারপর দেখি কিছু খবরাখবর পাই কি না। আমাগো উঠতে কইলেই তো হইব না। বাড়িঅলাগো কিছু কইছে কি না, সেইটা দেখার বিষয়।

ফারুক মাথা নেড়ে একমত হয়। তারপর বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে রিতাকে জড়িয়ে ধরে। রিতা, যদি সত্যিই যাইতে হয় চইলা, আমার সঙ্গে যাবি ?

কোথায় ?

আমার গ্রামে।

না। আমি তোমারে বিশ^াস করি না।

কী কস এইগুলা!

রিতার পাথর-চোখ টলটল করে তবে গড়িয়ে পড়ে না। সে একভাবে ঝাপসা দৃষ্টিতে ফারুকের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফারুক এটা শোনার জন্য প্রস্তুত ছিল না। আর রিতা সবসময় প্রস্তুত ছিল সময়মতো তাকে আঘাত করার জন্য। মন্দিরের দিকে যেতে ধরলে রিতা পাটভাঙা শাড়ির আঁচল ঘুরিয়ে টানে। যেন ফারুককে পিছনে ফেলে নিজের জীবন নিয়ে রওনা দেয়। যেন পিছনের মানুষটা কোথায় যায় না-যায়, থাকে কি না থাকে তাতে তার কিছু যায় আসে না। ফারুক একটা শেষ চেষ্টা করে, তুই একা কোথায় যাবি ?  তোর তো কেউ নাই।

রিতা দরজা পর্যন্ত গিয়েও থমকে যায়। পিছনে ফিরে দৃঢ় গলায় বলে, ঠিক বলছো। আমার কেউ নাই।

বলতে গিয়ে চোখ থেকে শেষ পর্যন্ত জলটা গড়িয়েই পড়ে।

মা ফাতিমা মন্দিরেও একই আলাপ। মানুষে বলাবলি করে, শোনা যাচ্ছে নোটিস আসবে। উঠে যাওয়ার নোটিস। আর সেখান সময় বেঁধে দেয়া থাকবে। যে তারিখ নোটিসে দেওয়া থাকবে, তার পর আর থাকা যাবে না এখানে। রিতার মাথায় ঢোকে না, থাকা যাবে না মানে ? তারা হলো গিয়ে ভাড়াটিয়া। বাড়িওলা না চাইলে তারা উঠবে কেন! বাড়িওলা কি তাদের নোটিস দিয়েছে ? তাহলে কে দেবে নোটিস ?

মন্দিরে কয়েকজন ভক্তিভরে ভেট চড়াচ্ছে। রিতা সেদিকে একভাবে তাকিয়ে থাকে। তাদের কাজ শেষ হলে তারা রিতার দিকে আসে, বুবু, কী করবা ঠিক করলা ?

চল তো বাড়িঅলাগো কাছে শুইনা আসি তাগো কী মতামত ?

দলটা হাঁটতে থাকে। পূর্ব দিকের উঠোনে শহর বানুর তিনটা বাড়ি। ছেলেরা ঢাকায় থাকে। শহর বানু থাকে টানবাজার মসজিদের উলটোদিকের একটা এপার্টমেন্টে। নিজের জায়গার উপরে অ্যাপার্টমেন্ট বানিয়ে তার পাঁচতলায় নিজে থাকে। সেখান থেকে টানবাজারের বাড়িগুলোর উপরে নজর রাখে বুড়ি। ছেলেরা শহরে বড় বড় বাড়িতে থাকে, বিশাল দামি গাড়ি হাঁকায়, কিন্তু টানবাজারে শহর বানুর এটাই জীবন―দিন শেষে ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে থাকে। তার ম্যানেজার মিজান নামের ছেলেটা বাড়িগুলোর ঘরে ঘরে যাচ্ছে কি না। সিঙ্গেল ঘর হলে তিন-চার শ আর ডাবল হলে পাঁচ-ছয় শ টাকা করে ভাড়া উঠিয়ে বাসের কন্ডাক্টরের মতো ঘাড়ে ঝোলানো ব্যাগে করে টাকা নিয়ে মিজান ফিরবে। মিজান যতক্ষণ না ফোলানো ব্যাগের উপরে হাত রেখে পূর্ব দিকের উঠোন থেকে হেঁটে তার বাড়ির সিঁড়ি ঘরের মধ্যে ঢুকে যাবে, ততক্ষণ শহর বানু বারান্দায় বসে থাকবে। তারপর ধীরে ধীরে ফিরবে বসার ঘরের দিকে। কোণের দিকের আলিশান একটা কাঠের চেয়ারে বসবে। চেয়ারটা না চেয়ার না সোফা। পিঠের পিছনের দিকটা অস্বাভাবিক উঁচু আর ফোমে ঠাসা। ছোটখটো শহর বানু চেয়ারটাতে বসলে যেন ডুবে যায়। সামনের টেবিলে মিজান এসে টাকাগুলো ঢালবে ব্যাগ থেকে। তারপর পাঁচ শ, এক শ, বিশ, আর দশ টাকার নোটগুলো আলাদা বান্ডিল করে হিসাব বুঝিয়ে দিলে মিজানের ছুটি। দিন শেষে তেষট্টি হাজার তিনশ টাকা ভাড়া। তার মধ্যে কোনওদিন পাঁচ-ছয় শ টাকা কম এলে শহর বানু চিৎকার-চেঁচামেচি করে মিজানের মাথা খারাপ করে দেবেন। মিজান হয়তো মিনমিন করে বলার চেষ্টা করবে, ওরা আইজকা কাম পায় নাই, মালকিন। শহর বানু তখন ততোধিক চিৎকার করে বলবে, কাম পায় নাই বইলা ভাড়া দিবে না এইরাম চুক্তি আছেনি ? ওগো কাছে মাইনষে আহে নাই, এইডা কি আমার দোষ ? শোন, ভাড়া না তুইলা যদি এইসব ফালতু কথা তুই কইতে আসোস, তোর বেতন থেইকা কাইটা নিমু কইলাম। তখন বুঝবি। তোরে কি আমি ওগো লগে পিরিত করতে রাখছি ? আর একদিনও যেন এমুন না দেহি। তাইলে আর তোর আসার দরকার নাই। 

এরকম একবার ঝারিঝুরি খেলে মিজান পরের সপ্তাহ দুয়েক ঠিকঠাক থাকে। যে কোনওভাবে পারে মেয়েদের থেকে টাকা বের করে আনে। কোনও কোনও ঘরে আধা ঘণ্টাও বসে থাকে। কোনও কোনও মেয়ে তাকে আদর আহ্লাদ করে বলে, ট্যাকা নাই আইজ। আসো তোমার শরীরডা ঠান্ডা কইরা দিই। শহর বানুর চিৎকারের কথা মনে পড়লে মিজান তখন সটান দাঁড়িয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে আর টাকার জন্য আদেশ নির্দেশ দিতে থাকে।           

শহর বানু যেরকম গলা টিপে ভাড়া আদায় করে, তাতে করে তার কাছে গিয়ে যে তেমন কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে তা মনে হয় না। কিন্তু পল্লী উঠে গেলে বুড়ির ভাড়া বন্ধ হয়ে যাবে, তারপর তার চলবে কী করে! কৌতূহল থেকেই হয়তো রিতাদের দলটা প্রথমে শহর বানুর বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হয়। শহর বানু এতগুলো মানুষকে একসঙ্গে আসতে দেখে অবাক হবার কথা, কিন্তু কেন যেন তার ব্যবহারে মনে হয় তাদের আসার কথাই ছিল, তিনি শুধু অপেক্ষা করছিলেন এলে কী বলবেন এজন্যে। তাই তিনি বলা শুরু করেন, দেখো, আমি বুঝলাম বাড়ি আমার। কিন্তু এখন যদি সরকার বলে আমাকে যে, তোমাদের কাছে বাড়ি ভাড়া দিতে পারবা না, তাহলে আমার এখানে কী করার আছে ? আমি কি জোর কইরা তোমাদেরকে বাড়িতে বসায়ে রাখতে পারব ? এইটা তো সরকারি সিদ্ধান্ত।

কে বলল এইটা সরকারি সিদ্ধান্ত ? আপনেরে কে জানাইছে ?

এইটা কি তোমরা বহুদিন ধইরাই শুনতেছো না ? আমিও তো শুনতেছি।

রিতা বলে, খালাম্মা বাড়িভাড়ার টাকা না উঠলে চলবেন কেমনে ?

রিতার সরাসরি প্রশ্নে শহর বানু থতমত খেয়ে যায়। তারপর গুছিয়ে বলে, আমার ভাড়াটিয়া যাইব, বাড়ি তো যাইব না। দেখা যাক তারপর কী করি।

রিতা তখন নিরুপায় হয়ে বলে, আপনে খালাম্মা কইতে পারেন না যে আপনে আমাগোই ভাড়া দিতে চান ? আপনেরা বাড়িঅলারা যদি একলগে বলেন তাইলে কার কী করার আছে ? আপনাগো জমি আপনাগো ইচ্ছা কারে ভাড়া দিবেন কারে না দিবেন।

বিষয়টা এত সোজা না, রিতা। তোমরা বুঝবা না।

আচ্ছা, খালাম্মা, কথা হইল, আপনেরা নোটিস না দিলে আমরা উঠব ক্যান ? আর আমাগো বাইর কইরা দিলে আমরা কোথায় যাব ?

যে শহর বানুর কাছে কেউ একটা কথা বলেও পার পায় না, যাকে বলে, একটা কথাও মাটিতে পড়ে না, সেই শহর বানু প্রশ্ন শুনে কেমন যেন চুপ হয়ে যায় আর উত্তর না দিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে। তার উদাস ভাব দেখে রিতাও চুপ হয়ে যায়। শেষে শহর বানু বলে, তোমরা এখন যাও, আমি নামাজে বসব।

মেয়েরা একে একে বেরিয়ে যায় সে কথা শুনে। রিতাও একসময় উঠে পড়ে। এই বাড়িঅলারা কি তাহলে তাদেরকে কোনওরকম সাহায্য করবে না ? আশ্চর্য, এতদিন তাদেরকে ভাড়া দিয়ে রেখেছে, তারা টাকা থাকুক না থাকুক ভাড়ার টাকাটা গুনে দিয়েছে দিন শেষে, অথচ এখন বিপদের সময়ে তারা সাহায্য করবে না। এটা কেমন ব্যাপার ? বিস্ময় বা বিভ্রান্তির কারণে রিতা মেয়েদের নিয়ে আরও কয়েকজন বাড়িওলার কাছে ঘুরে আসে। কোথাও তেমন কোনও আশার কথা শোনা যায় না। বরং রিতার অবাক লাগে এই ভেবে যে, বাড়িঅলারা কেউ অবাক নয় কেন! ভাড়াটিয়ারা চলে গেলে রাতারাতি তাদের দৈনন্দিন আয় বন্ধ হয়ে যাবে, এই নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা নেই কেন ? প্রচুর বিভ্রান্তি নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে রিতারা এসে পৌঁছে তোড়া বাড়িঅলির পাশের বাড়িতে। পল্লীতে ঢুকতেই তোড়া বাড়িঅলির কবর। তার একদিকে রঙের দোকানগুলো, আরেকদিকে দোতলা বিল্ডিংয়ে সারি সারি ঘরে মেয়েরা থাকে। সেখানে রঙের দোকানের ম্যানেজার ঠোঁট উলটে বলে, এই দিনে দুপুরে রইদের মইদ্দে তোমরা এইসব নিয়া হয়রান হইয়া ঘুরতাছ ক্যান ? আসল বিষয় কি কিছুই বুঝতে পারতেছো না ?

রিতা কৌতূহলী হয়, কী বিষয় বলেন তো, কাকা ?

বিষয় তো খুব সোজা। আমি কইছি এইটা আবার কাউরে বলবা না তো ?

আপনারে কেন বিপদে ফেলব, কাকা!

শোনো, তোমাগো উঠাইয়া দিতে পারলে কি আর এই বাড়িঘর থাকবে ? এইখানে দেখবা কত্ত বড় বড় ইমারত উইঠা যাবে রাতারাতি।

কে তুলবে ইমারত! রিতার চোখ কপালে উঠে যায়।

কে আবার ? আছে অনেক মানুষ যারা সেই ইমারতের এক একটা ঘর বহু দামে বিক্রি করবে। লাভ আর লাভ। তোমরা বাড়িঅলাদের পিছে ঘুরতে আছো, তাগো স্বার্থ বুঝ না ? তারা কত্ত দামে এই জায়গা বিক্রি কইরা চইলা যাবে জানো না। কেউ কেউ আবার বিক্রি না কইরা জীবনভর ভাড়া তুলবে। যারা বানাবে তাগো লাভ, যাদের জমি তাদেরও লাভ। ওইদিকে মৌলবি সাহেবগো লাভ হইল তারা বিরাট একটা কাজ করল সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার জন্য। আর পুলিশ-মেয়র-এমপিগো লাভ আছে―এইগুলা আমারে জিগাইও না। মনে করো, ওই মৌলবি-মুন্সিগো তেনারাই এই কামে ডাইকা আনছে।

সরল চোখে তাকিয়ে থাকে রিতা, এইসব কী বলেন, কাকা ? আমি তো কিছুই বুঝতেছি না। আমরা কাম করি, ট্যাকা পাই, ভাড়া দিয়া যা থাকে তাই দিয়া চলি। আমরা কি এত কিছু বুঝি ? আমাগো উপরে এই অত্যাচার ক্যান, কাকা ?

আম্মাজান কয় কী! পৃথিবীর সবখানে তো এইরাম মানুষের উপরেই অত্যাচার হইব আর হইতেছে, যারা কিচ্ছু বোঝে না, কারও আগেপিছে নাই, নিজেরটা কইরা খায়। তাগো জীবনে শান্তি নাই। মাইনষে তারে নাড়াইবই।

রিতা চুপ করে থাকে। চোখ কুঁচকে চিন্তায় ডুবে যায়। এত কিছু তো তাদের চিন্তায় নেই। তারা কি সত্যিই কোনও ষড়যন্ত্রের মধ্যে পড়ে গেছে ? দোকানের তোলা শাটারের উপর দিয়ে রিতা সরু গলিপথে পল্লীর দিকে তাকিয়ে থাকে। এই পল্লী ছেড়ে কে যাবে কোথায়! বাড়ি বলে কিছু নেই। আবার বাড়ি আছে কিন্তু ফিরে যাবার পথ বন্ধ। একবার একজন বড় মুখ করে বাড়ি ফিরে গেছিল। বয়স হয়ে গেছে, খরিদ্দার তেমন আসে না। তারও থাকতে ভালো লাগে না। ভেবেছিল বাড়ি ফিরে ভাইবোনদের সঙ্গে থাকবে নতুন পরিচয়ে। ভাইবোনেরা খুশি হবে তাকে পেয়ে। কিন্তু যখন সে বাড়ি পৌঁছল তখন ঘটল উলটো ঘটনা। শুরুতেই অন্যেরা ধরে নিল এত বছর পরে জমি আর বাড়ির ভাগ নিতে এসেছে। একে তো কেউ ভালো করে কথা বলে না তার উপরে এতদিন কোথায় ছিল জানতে চাওয়ায় সে বলল নারায়ণগঞ্জে। কী করত জানতে চাইলে বলল, গার্মেন্টসে কাজ করত। গ্রামের লোকেরা তাকে দেখতে এসেছিল। এত বছর পরে কেউ ফিরে এসেছে, তাদের দৈনন্দিন জীবনে বিশেষ ঘটনা বটে। একজন এগিয়ে এসে জানতে চাইল, নারায়ণগঞ্জের কোন গার্মেন্টসে কাজ করতা ? মেয়েটা দ্রুত বলে ফেলল, টানবাজার পার্কের পাশে শিলা গার্মেন্টসে। মেয়েটা অবাক হয়ে বলল, কোন সেকশনে ? সেকশনের ব্যাপারে বেচারার ধারণা ছিল না। চট করে বলে ফেলল, তি… তিন তলায়, তিন তলায় কাজ করি। সামনের জন অবাক হলো, তিন তলায়! ওই গার্মেন্টসের তিন তলায় তো আমি পাঁচ বছর ধইরা কাজ করতেছি। তোমারে তো কোনওদিন দেখি নাই! গ্রামের উপস্থিত লোকেরা বিষয়টা ভালোমতো বোঝার জন্য আরেকটু এগিয়ে এল। তাইলে ? তুমি কি ওইখানে কাম করতা নাকি বানাইয়া কইতেছ ? হ্যায় তোমারে এত্তগুলা দিনের মইদ্দে একবারও দ্যাখল না যে ? নানা প্রশ্নর মাঝখানে গার্মেন্টসে কাজ করা মেয়েটা গম্ভীর হয়ে বলল, সত্যি কইরা কও তো, তুমি কি টানবাজারে আছিলা ? এয়ানে, ওই পল্লীতে ? তোমার সাজসজ্জা দেইখা তো সেইরকমই মনে হয়!

কাজের ক্ষেত্রে বয়সী হয়ে গেলেও মেয়েটি বহু বছর পরে বাড়ি ফিরবে বলে যত্ন করে সেজেছিল। মোটা কাজল, কড়া লিপস্টিক, বড় টিপ―কিছুই বাদ ছিল না। জরিচুমকির কাজ করা ওড়না দিয়ে সে চোখ মুছছিল তখন। তাকে যে এত প্রশ্নের সামনে পড়তে হবে, এভাবে ধরা পড়বে, তা সে স্বপ্নেও ভাবেনি। মেয়েটার কথা ভাবতে গেলে যাদের বাড়ি আছে সেখানে ফিরতে চাওয়ার চিন্তার মাঝখানে ছেদ পড়ে। বরং রিতার সারা শরীর শিউরে ওঠে। সাধারণ মেয়েরাও একবার বাপের বাড়ি থেকে বেরোলে তাদের আর নিজের বাড়ি থাকে না। তারা বাপের বাড়িও ফিরতে পারে না, আর স্বামীর বাড়ি তো স্বামীর বাড়ি। পরে সেটা হয় ছেলের বাড়ি। তাদের নিজের কোনও বাড়ি থাকে না। আর রিতা ভাবে, তাদের মতো মেয়েদের তো বাড়ি থাকার প্রশ্নই নেই। ভাই-বোন বেঁচে থাকলেও তাদের দেখলে দূর দূর করবে। বাবা থাকলে লজ্জায়-ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নেবে। মা বুকে টেনে নিতে চাইলেও লোকলজ্জার ভয়ে পারবে না। আর স্বামী তো তাদের থাকেই না। যাদের থাকে তাদের ওই রিতার মতো থাকে―আছে, আবার নাই।

কী ভাবো, আম্মাজান ?

কী আর, কাকা। ভাবি কত মানুষের ফায়দা হইতে পারে আমগো সরায়ে দিলে, কিন্তু আমগো জীবন কি জীবন না, কাকা ?

দোকানের ম্যানেজারের মুখে কথা জোটে না। ওরকম চারটা বড় দোকান ওই রঙের কোম্পানির, সবগুলোই ওই এলাকায়। ম্যানেজার বলে, আমার আরেক দোকানের একটা ছেলে বলতেছিল, এইসব রাজনৈতিক ব্যাপার। আমরা যেরকম সাদা চোখে দেখতেছি, বিষয় নাকি সেইরকম না।

তাইলে কীরকম, কাকা ?

এই মনে করো, বড় রাজনীতি আছে এইসবের মইদ্দে। ধরো, বড় লাভ।

আমি অত বড় কিছু বুইঝা উঠতে পারি না, কাকা। আমি খালি আমার নিজের ধান্দাটা বুঝি। কারও ক্ষতি করি না। নিজের খাই, নিজের পরি। কখনও সম্ভব হইলে আমার মতো কোনও অভাগীরে সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্য করি। আমরা তো রাজনীতির প্যাঁচগোছ বুঝি না গো, কাকা।

হুম। আমাদের মতো সাধারণ মানুষের কী-বা যায় আসে, কে পাইল ক্ষমতা আর কে হারাইল। তয় ওই ছেলেটা কইতেছে এক দলের লোকের জায়গাজমি আর বাড়ি আছে এই পল্লীতে। লাখ লাখ টাকা দিনে ভাড়া উঠায়। এখন তাগো যারা বিপক্ষে তারা কি চাইব যে শত্রুর ব্যবসা চলুক, ভালো আয় হউক ? চাইব না। পারলে ব্যবসা আগাগোড়া ধ্বংস করব। কথা হইল, তোমার শত্রুর ইনকাম বন্ধ করলে তার কোমর ভাইঙা যাবে, তোমার বিরুদ্ধে আর লড়তে পারব না।

একটু একটু বুঝতেছি, কাকা। কিন্তু আমরা এতগুলা মানুষ, কই যাব, কী খাব―এইটা কি কারওরই ভাবার দরকার নাই ?

দোকানের কাকা চুপ করে থাকেন কিছুক্ষণ। তারপর বলেন, তুমি তো কঠিন মানুষ, মা। তুমি চিন্তা কইরা কিছু একটা বাইর করো। একটা কিছু পথ বাইর হবেই।

রিতা জানে এটা সান্ত্বনার কথা। তাই সে আর কথা বাড়ায় না। দুপুরে খাওয়ার সময় হয়ে যাচ্ছে। আজ অনেকের বাড়িতেই রান্না চড়েনি। রিতার বাড়িতেও না। তাই বাজার থেকে যাবার সময়ে কয়েকটা পুরি কিনে সে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। গিয়ে দেখে বারান্দায় নাজমা বসে আছে। দরজায় তালা দেখে অপেক্ষা করছে। রিতা যেতেই উৎকণ্ঠিত গলায় বলে, এগুলা কী শুনতেছি, বুবু ? আমগো নাকি চইলা যাইতে হবে ? আমি তো আছিলাম না এইদিকে। মানুষজন আইসা নাকি হুলুস্থুল কইরা গেছে ?

রিতা জবাব না দিয়ে তালা খোলে। ভিতরে গিয়ে বিছানায় বসে নাজমার দিকে পুরি এগিয়ে দেয়। তারপর দুটি কামড় বসিয়ে বলে, শালারা! যেই কুত্তার বাচ্চাগো আমরা অ্যাদ্দিন ফাও ফাও শুইতে দিছি, সেইগুলা মিল্যাই আমাগো কপাল পুড়াইতেছে।

নাজমা অবাক হয়ে দেখে যে রিতার মতো সাহসী একটা মেয়ে, যাকে পল্লীতে আসার পর থেকেই সে আঁকড়ে ধরেছিল, সে কিনা রাগে-ভয়ে কেমন যেন কুঁকড়ে আছে। পুরির মধ্যে কামড় বসিয়ে রিতা মুখ নাড়ায় না। তার বাম চোখ দিয়ে দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে। নাজমা রিতার কাছে এসে বসে। হাত বাড়িয়ে রিতার গালটা মুছে বলে, কোনওই কি উপায় নাই, বুবু ?

রিতা কথা বলে না। কেন যেন তার মন বলে, এটা অনেক বড় খেলা, তার ছোট মাথায় এর উত্তর নেই। তারপর নাজমা আরেকটু এগিয়ে আসে। হাতে পুরি ধরে রেখেই রিতাকে জড়িয়ে ধরে। আবেগের ছোঁয়া পেয়ে দুজনেই ডুকরে কেঁদে ওঠে। দুজনেই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের জন্য দুজনের কাছে সান্ত্বনা পায়। কবে যেন ফারুক নাজমার ঘরে গেছিল বলে রিতার মনে একটা গাঢ় কষ্ট ছিল। নাজমাকে টাকা ধরে দিয়ে সে কষ্টের প্রতিশোধ কিছুটা নিয়েছিল কিন্তু ওই মুহূর্তে যেন মনে হলো সেসব কষ্ট বা প্রতিশোধের জিঘাংসা খুবই সাধারণ ব্যাপার। সত্য হলো নিজেদের এই একই নৌকার সওয়ারি ভাবা, যে নৌকাটা খানিক পরে ডুবে যাবে। যে নৌকায় যতক্ষণ তারা আছে ততক্ষণ হাত ধরাধরি করে চলবে। টালমাটাল হলে কোনওরকমে ভেসে থাকার চেষ্টা করবে।                                                     

১০

কয়েক দিন প্রত্যেকের বুক ধুকধুক করে―এই বুঝি বাহিনী আসে। এই বুঝি কথা নেই বার্তা নেই এসে বলে দেয়, চলে যেতে হবে সবাইকে। পল্লীতে যারা আসে তারাও আসে ভয়ে ভয়ে।

শুনতেছি তোমরা নাকি উইঠা যাইবা গা ?

আমরাও তো তাই শুনতেছি। কিন্তু যাইমু কই, কন ?

সেইটাই তো। আমিইবা আইমু কই। এই জায়গাটা থাকলে ভালো আছিল।

তো এইটা আপনেরা কন না ক্যান ? যখন পুলিশ, মাস্তান আর মৌলবিরা দল বাইন্দা আসে তখন আমগো লাইগা কথা বলব কে ?

কী বলো, আমরা যদি সামনে আসি তাইলে আর রক্ষা আছে ? আমাগো মতো কেউ চাইলেও ওগো মিছিলের বিরুদ্ধে কিছু কইতে পারবে না। কারণ, তাইলেই তারে নিয়মিত খরিদ্দার ধইরা নেওয়া হবে। বুঝতে পারছো ?

হ হ, আপনাদের এইসব বিষয় আমরা না বুঝলে বুঝব কেডা ?

থমথমে পরিস্থিতির মধ্যে বিশ দিন কেটে যায়। যেমনটা টানবাজারে কেউ মনে রাখে না আগের দিনে কী হলো, কে কার বন্ধু হলো, কে কার শত্রু―তেমনি সব যেন মিটে যায়। মানুষ মোটামুটি নিশ্চিন্ত হয়ে আবারও নিজ নিজ কাজে মনোযোগ দেয়। নতুন মেয়ে আসে, লাজুক চোখে ভীতু পাখির মতো, বদ্ধ ঘরে জানালার শিক ধরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ আবার লাজুক চোখে সেজেগুজে এসে সিনেমা হলের পাশের গলিতে গিয়ে দাঁড়ায়, একা। অভ্যাস হয়ে গেলে এক দল মেয়ের সঙ্গে সিনেমা হলের দেয়ালে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কেউ কেউ। তাদের হাসিঠাট্টায় সেখানকার বাতাস মুখরিত হয়। কোনও খরিদ্দার পাশাপাশি বসে সিনেমা দেখতে চাইলে তারা আকাশের চাঁদ হাতে পায়। তবে সেটা কম। এখানে বেশির ভাগ মানুষ আসে অল্প সময় হাতে নিয়ে। এসেই ঘরে ঢোকে। আর তারপর অতিরিক্ত দ্রুত কেউ কেউ প্যান্টের জিপার লাগায়। ছুটে বেরিয়ে যায়। কে জানে কে দেখে ফেলে… কে দেখে ফেলে… মাশা সিনেমা হলের সামনে দিয়ে গিয়ে টানবাজার পার্কটা পার হতে পারলে বিপদমুক্ত।

দিনগুলো কীভাবে যেন আবারও একটু খাওয়ার বা মাথার উপরের ছাদের দুশ্চিন্তা থেকে মানুষগুলোকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনে। তারপর যখন তারা দুশ্চিন্তার কথা প্রায় ভুলেই গেছে তখন একদিন বিকেল নাগাদ আবারও খুব গরম পড়ে। খুপরিমতো ছোট ঘরগুলোতে প্রাণ টেকে না বলে কেউ কেউ এমনিতেই বারান্দায় আর উঠানে বসে থাকে। গলিতে হাঁটাহাঁটি করে। উঠানের শিউলি গাছের মগডালের পাতাটাও নড়ে না। কেউ রিতার বারান্দায় এসে পা ছড়িয়ে বসে, বলে, পানি খাইতাম একটু, বু। তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলে আইজ মনে হয় ঝড় আসব।

ঝড়-বৃষ্টি হচ্ছিলই কিছুদিন আগে। তখন কয়েক দিন বৃষ্টির খবর নাই। খরার মতো গুমোট। সবসময় ঝড়ের আতঙ্ক―ঠিক ওই এলাকার মানুষের মনের মতো। কেউ কি নিজের বাড়ি ছাড়ার প্রস্তুতি নিতে পারে! হয়তো জানে ছাড়তে হতে পারে। কিন্তু ঠিক যখন জানবে সত্যি সত্যি ছাড়তে হবে, তার আগ-পর্যন্ত কী করে প্রস্তুতি নেয়া যায় ? যেমন জীবনের মধ্যে থেকে অবধারিত মরণের কথা কে না জানে! তবু কীভাবে প্রস্তুতি নেবে প্রতিদিন মৃত্যু নামের সমাপ্তির জন্য ?

বিকেল পড়তেই আবারও হঠাৎ সেদিন সেই মিছিল আসে। আগের দিনের চেয়ে অনেক বড়। সামনে ব্যানার, ‘যৌনপল্লী উচ্ছেদ চাই’। নিচে আরেক লাইন, ‘অসামাজিক কার্যকলাপ প্রতিরোধ কমিটি’। সবাই অবাক হয়ে দেখে, এর মানে কী! কমিটির মিছিলের শুরুর ভাগে আলেম ও মোল্লারা কয়েক সারিতে হেঁটে চলেছে। পবিত্র সাদা টুপি, সাদা আলখাল্লা তাদের পরনে। কারও কারও গলায় চেক রুমাল। পিছনে সাধারণ পোশাকের মানুষের দীর্ঘ সারি। সামনে পবিত্র পোশাককে তুলে ধরা নিশ্চয়ই জরুরি। মানুষ ওটুকুই জানুক, এদের কার্যকলাপ অসামাজিক আর পবিত্রতাবিরোধী। তাই সেটা প্রতিষ্ঠিত করতে জেলার আমির স্বয়ং উপস্থিত। এছাড়া আশেপাশের মসজিদ মাদ্রাসার আলেম, মৌলবি। তাঁরাই তো বলে দেবেন ইহজীবনে কার কী করতে হবে। তাদের কথার উপরে কথা বলবে কে ? কে চায় দোজখে যেতে আর সামাজিকভাবে বেয়াদব প্রমাণিত হতে ? তাদের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য করতে পারে পল্লীর সাধারণ কেউ আর দালাল। কোনও ভদ্রলোক, যে চায়ের দোকান শত শত কাপ চা বিক্রি করে টানবাজারের পল্লীর লোকদের কাছে, পল্লীতে আসে বলে রঙ, কেমিক্যাল, চামড়া আর কাপড়ের ব্যবসার ফায়দা লোটে যারা, তারা কি কেউ প্রতিবাদ করবে ? এলে তাদেরকেও খরিদ্দার বলা হবে প্রকাশ্যে। হেয় করা হবে। সামাজিক অপমানের ভয় কার নেই! আয় হোক আর না হোক, যে বাড়িঅলারা বাড়ি ভাড়া দিয়ে যে কোনওভাবে দিন শেষে সন্ত্রাসীর মতো মানুষকে দিয়ে টাকা উঠিয়ে নিয়ে যায়, করবে তারা উচ্চবাচ্য ? রঙের দোকানের কাকা যেরকম বলে, তারা তাদের জমি আরও বেশি দামে বিক্রি করবে। এককালীন টাকা পেলে কার আপত্তি থাকবে ?

শুধু যে লোকগুলো বছরের পর বছর নিশ্চিন্তে ছিল সেখানে, যাদের সমাজ ছিল পল্লীর ওই গণ্ডি, তাদের কী হবে―তা কেবল তাদেরই ভাবতে হবে। এই নাও নোটিস, আর রাস্তা মাপো―মিছিলের পক্ষ থেকে রিতা আর আরও কয়েকজন সর্দারের হাতে তুলে দেওয়া হয় উকিল নোটিস। মওলানা বলেন, আজ জুলাইয়ের এক তারিখ। বিশ দিন সময় দেয়া হইছে। ঠিক বিশ দিন পরে সব ঘর খালি চাই।

রিতা সামনে এসে হাসে। হাতের মধ্যে নোটিসটা উলটে পালটে জানতে চায়, বাড়িঅলারা আমগো নোটিস না দিলে আমরা উঠমু ক্যান ?

ঠিক আছে তাইলে, বাড়িঅলাগো দিয়াই নোটিশ পাঠামু তোমাগো। তাইলে উঠবা তো ?

উত্তর শুনে রিতা বিভ্রান্ত হয়। টাকা আর ক্ষমতার কোনও মা-বাপ নাই। বাড়িঅলারা তো বললে পাঠাবেই নোটিস। টাকা পাবে, নতুন ব্যবসা পাবে, কেন পাঠাবে না ? এতদিন যাদের কাছে টাকা আদায় করে শান-শওকত বজায় রেখেছে, তাদেরকে ফেলে দিতে বাড়িঅলাদের এক মুহূর্তও সময় লাগবে না। রিতা তাই ধাক্কাটা সামলে নেয়, হাসে আর বলে, কী করবেন খালি ঘরগুলা ? নামাজ পড়বেন ? হা হা হা…

এই মহিলা তো পাগল হইয়া গেছে।

হমু না পাগল ? হমু না ?

রিতাকে উত্তেজিত হতে দেখে লাঠি হাতে একজন পুলিশ আসে।

আপনাগো সময় দেওয়া হইছে। নিজেগো লাইগা জায়গা কইরা নেন, সমস্যা কী ? সময়টা কিন্তু বিশ তারিখ, মনে রইখেন।

এত্ত সোজা ? আমরা যামু না। দেখি কী করবার পারেন, করেন।

আগের দিন উঠানে যত মানুষ জমা হয়েছিল, সেদিন জমা হয় তার চেয়েও বেশি। তবে কেউ এগোয় না। পুলিশ এগোয় রিতার দিকে। চারদিকে সবাই দাঁড়িয়ে দেখে, পুলিশ কি সর্দারনিকে একটা লাঠির বাড়ি দেবে ? এটাও সম্ভব! পুলিশ যখন রিতার একেবারে কাছে চলে আসে, রিতা ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এক চুল নড়ে না। তারপর কানে কানে বলার মতো ভঙ্গিতে বলে, স্যার, যহনই আইতেন, ফ্রি ফ্রি কইরা চইলা যাইতেন। খালি আপনে না, আপনাগো থানার কত লোকে আইত, স্যার। ফ্রিতে কাম করাইত আবার চান্দাও তুইলা নিত, স্যার। আমরা যেমন প্রতিদিন বাড়িভাড়া দিছি, সেইরকম প্রতিদিন আপনাদের লোকেরা আমাগো কাছে চান্দা নিয়া চইলা গেছে। কত কত চান্দা যে নিছে তার কোনও হিসাব নাই। আবার সরকারি অফিসের লোকও আইত এইখানে। প্রতিদিন আইত। কাউর কাছে পয়সা নিছি আমরা ? কেউ কইতে পারবে ? আর আইজকা আপনেরাই একলগে হইয়া আমগো নোটিস দেখাইতে আইছেন ?

রিতার রক্তচক্ষুর সামনে পুলিশ মানুষটাকে দেখতে লাগে হুস করে বাতাস বেরিয়ে যাওয়া বেলুনের মতো। তার হাতের লাঠিটা কেঁপে উঠে থেমে যায়। মুখের পেশিগুলো নড়ে ওঠে কিন্তু কোনও কথা শোনা যায় না তার। সে কি রিতার কানের কানে কিছু বলে ? কে জানে! উপস্থিত লোকেরা উৎসাহিত হয়, শোনার জন্য এগোয়। পুলিশ তখনই নিজেকে সামলে নিয়ে নোটিসটা হাতে তুলে সবাইকে দেখিয়ে দেয়। চিৎকার করে বলে, সব ঘরে নোটিস যাবে, সব ঘরে। বিশ তারিখ আইসা যেন দেখি পুরা মাঠ ফাঁকা। যেন দেখি একটা মাইয়াও নাই এইখানে। একটা দালালও নাই। একটা আজেবাজে লোকও নাই। কিচ্ছু নাই। মনে থাকে যেন… বলতে বলতে পুলিশ মিছিলের ভিতরে ঢুকে যায়। তখন একজন মওলানা বক্তৃতা শুরু করেন। হাত তুলে তিনি বলতে থাকেন, এই যৌনপল্লীর জন্য টানবাজারের মসজিদে কারও নামাজ হয় না। এই পল্লীর আশেপাশে কোনও ইবাদত হয় না। এইখানে এত পাপের সৃষ্টি হয় যে আশপাশের মানুষের ভাগ্যে কোনওদিন ভালো কিছু হয় না। এই পল্লীর কারণে এলাকার তরুণেরা নেশাগ্রস্ত হয়। কারণ এইখানে প্রচুর নেশার জিনিস কেনাবেচা চলে। লোভে পড়ে ভদ্রলোকেরা এইখানে এসে তাদের চরিত্র নষ্ট করে। এই নষ্ট মেয়েমানুষগুলাই তাদের চরিত্র নষ্টের জন্য দায়ী। তাহলে মিয়ারা, এই ক্ষতিকর ব্যবসা কি আমরা চলতে দিতে পারি ?

মিছিলের লোকেরা সমস্বরে ‘না না’ বলে ওঠে।

মৌলবি বলেন, বিশ দিন সময় কি যথেষ্ট হয় নাই উইঠা যাওনের লাইগা ?

‘জি জি।’

আপনেরা সব ঘরে নোটিস পৌঁছাইয়া দেন। কোনও ঘর যেন বাদ না পড়ে। 

‘জি, হুজুর, কেউ বাদ পড়ব না,’ বলে ছেলেরা একে একে নোটিসের কপি নিয়ে ছোটে। ঘর ছেড়ে দিতে হবে। জিনিসপত্র নিয়ে যেতে হবে। বিশ দিন সময়। বিশ দিন পার হলে কেউ যদি এখানে থাকে, অর্থাৎ জুলাই বিশ তারিখের পরে, তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কী ব্যবস্থা সে ব্যাপারে অবশ্য কিছু বলা হয়নি। নোটিস বিলি করতে ঘণ্টাখানেক লাগে। তারপর জোরে জোরে হুঁশিয়ারি দেয় ছেলেরা, বিশ দিন কিন্তু। মনে রাইখেন।

পিছনে দাঁড়িয়ে রিতা চিৎকার করে বলে, মওলানা সাব, এই উঠানে আইলেন, ইবাদত হইব না কইলাম আপনের… বুইঝেন! মওলানা পিছনে ফিরে তাকায়, গলার কাছের আলখাল্লার কলার ধরে টেনে নিয়ে বুকের উপরে থু থু ছিটায়। মুখে কেবল বলতে থাকে, আস্তাগফেরুল্লাহ্ আস্তাগফেরুল্লাহ!

কী করা যায়, কী করা যায়―এই ভেবে কয়েকটা দিন কাটিয়ে দেয় পল্লীর মানুষেরা। কেউ কেউ বেশি ভিতু বলে আগেই বাকসোপেটরা বাঁধা শুরু করে। ভালো একটা দিন দেখে চলে যাবে কোথাও। রিতা দেখে অনেকের মনোবল শুরুতেই ভেঙে গেছে। অনেকে দ্বিধায় আছে, চলেই কি যেতে হবে! খুব কম মানুষ আছে রিতার মতো, যারা মনে মনে ভাবে, যাব না। মরতে হলে এইখানেই মরব। মানুষগুলো রিতার বারান্দায় পড়ে থাকে। দিনরাত বলাবলি করে, কী করা যায় ? শেষে কে যেন বলে, আইচ্ছা, আমাগো নোটিশ দিছে পৌরসভা, তাইলে আমরা সেইখানে যাই না ক্যান ? গিয়া আমগো সমস্যার কথা কইলেই হয়। যেই ভাবা সেই কাজ, পরের দিন রিতার নেতৃত্বে ছোটখাটো একটা দল পৌরসভায় গিয়ে হাজির। তারা মেয়রের সঙ্গে দেখা করবে। সেখান থেকে বেরিয়ে তারা জেলা প্রশাসকের সঙ্গে দেখা করবে। একটা চিঠি লেখা দরকার। তাদের সমস্যাগুলো তুলে ধরে লম্বা করে লিখে ফেললে হয়। মেয়েরা কাজে লেগে যায়। যারা পড়াশোনা জানে, নিজ দায়িত্বে এগিয়ে আসে। সবাই মিলে সমস্যাগুলো নিয়ে লিখে ফেলে এক স্মারকলিপি। পরদিন তৈরি হয়ে পৌরসভার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। সেখানকার পান-বিড়িওলা থেকে শুরু করে অফিসের লোকেরা এমনভাবে তাদের দিকে তাকিয়ে থাকে যেন চিড়িয়াখানার কোনও চিড়িয়া দেখছে। তাদের সেসব তোয়াক্কা করার সময় থাকে না।

মেয়র অফিসে নেই। তার ঘনিষ্ঠ লোকেরা এগিয়ে আসে, সমস্যা কী ? স্মারকলিপি পড়েন তারা। আকাশ থেকে পড়েন, তাই নাাকি! আপনাদেরকে নোটিস দেয়া হয়েছে ? ঘনিষ্ঠ লোকগুলোর মধ্যে কেউ কেউ বেশ হম্বিতম্বি করেন, হ্যাঁ, নোটিস দিলে তো সরে যেতেই হবে।

আমরা তাইলে কই যাব, স্যার। এখন এইটাই তো আমাদের বাড়িঘর। আমাদের পেশাও আপনেরা জানেন। এখন এই পেশা নিয়া যদি সারা দেশে ছড়াইয়া পড়ি, তাইলে কি ভালা হইব, স্যার ?

রিতা যখন কথাগুলো বলতে থাকে, নাজমা আর সাইফুল পিছনে এসে দাঁড়ায়, বলে এই লোকটা কিন্তু আমাদের উঠানে গেছিল মৌলবি আর পুলিশের লগে। তাদের ফিসফিসানি শুনে রিতা ভালোমতো তাকায়। হ্যাঁ, যার সঙ্গে কথা বলছে, তার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে এক লোক, দেখেই চেনা চেনা মনে হচ্ছে। রিতার মনে হয়, মায়ের কাছে মাসির বিরুদ্ধে বলছে। এখানে দাঁড়িয়ে এসব কথা বলার অর্থ নেই। যারা তাদের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তাদের কাছেই তাদের নিজেদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে বলার মানে আছে ? এ তো হলো গিয়ে সরিষার ভিতরে ভূত, আর রিতা সেই ভূতের পিছনে লেগেছে যা কিনা অনেক গভীরে চলে গেছে। ভাবতে গিয়ে নিজেকে কেমন বোকা বোকা লাগে রিতার নিজের কাছে। ওখানকার লোকেরা বলে, আচ্ছা, আপনাদের চিঠি আমরা মেয়র সাহেবের কাছে পৌঁছে দিব। শুনে রিতার মনে হয় না যে, এ নিয়ে আর আশা করার কিছু আছে। তাই সেখান থেকে বেরিয়ে তারা ডিসি অফিসে যায়। ডিসি সাহেবের কাছেও একই স্মারকলিপি দেবে। তিনিও একই রকম নোটিস দেখে বিস্ময় প্রকাশ করেন। রিতা যখন বলে, স্যার, আমরা তাহলে এখন কোথায় যাব ? আমাদেরকে আগে একটা জায়গা দেখায়ে দেন, তাইলে আমরা সরে যাই। ডিসি সাহেব বলেন, আপনারা পুনর্বাসনের কথা বলছেন তো ? ঠিক আছে, আমি সেই বিষয়টা দেখব।                 

রিতার তখন হুট করে মনে হয়, তাহলে কি পল্লী ছেড়ে চলে যাওয়া মেনেই নিয়েছে তারা ? হেফাজতের মওলানা, পুলিশ, আর মেয়রের লোকজনের কাছে কি তাহলে তারা হেরেই গেল ? চোখ ফেটে পানি আসে। যে কথা মুখ উচ্চারণ করতে পারে না, সে কথা মন কেন মেনে নেয় ? রিতার স্বভাবসুলভ মাথা গরমও হয়ে ওঠে। বলে, দেখেন, স্যার পুকুর ভরাট করলে কিন্তু পানি আকাশে উইঠ্যা যায় না। চাইরদিকে ছড়াইয়া পড়ে। স্যার, আমরা যে একলগে একটা ছোট্ট জায়গার মইদ্দে ঠাসাঠাসি কইরা আছিলাম, এইটাই কি ভালো আছিল না, স্যার ?

ডিসি সাহেব চুপচাপ রিতার দিকে তাকিয়ে থাকেন। ধীরে ধীরে কনুই টেবিলে ঠেকিয়ে গালে হাত দেন। তারপর চিন্তিত চোখে তাকান। রিতা বলে যায়, স্যার আপনারা তো বাড়ি বানাইতে গেলে ড্রেন রাখেন, রাখেন না, স্যার ? এই পতিতালয় হইল গিয়া সমাজের ড্রেন। ড্রেন বন্ধ কইরা দিলে আপনাগো বাড়িতে ময়লা উপচাইয়া পড়বে, স্যার।

আচ্ছা, ঠিক আছে ঠিক আছে, আমি দেখছি ব্যাপারটা।

তাইলে কি স্যার আমরা থাকতে পারব নিজেদের জায়গায় ?

সেটা আলাপ-আলোচনা না করে কী করে বলি ? দেখছি আমি বিষয়টা। আপনারা তাহলে আসেন।

আমরা কি তাইলে স্যার কিছুটা নিশ্চিন্ত হইতে পারি এখন ?

এটা বলা আসলে আমার জন্য কঠিন।

এরপর আর রিতা কথা বাড়ায় না। সালাম দিয়ে চলে আসে। বুকের ভিতরটা হুহু করে। এ সংসারে এমন কেউ নেই যিনি বলতে পারেন যে, রিতাসহ সবাই বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন। এমনটা হয়নি। কয়েক দিনের মধ্যে রিতার কাছে মনে হয়, এমনটা হবেও না। ডিসি বা মেয়র যখন সামান্য সান্ত্বনাটুকুও দেন না, কিংবা বিষয়টা খতিয়ে দেখবেন বলে এতটুকু উচ্চারণ করেন না, তার মানে, এটা অনেক উপরের সিদ্ধান্ত। এই সমস্ত লোকেরা এখানে কেবল পুতুলের মতো দায়িত্ব পালন করছে। রিতার হতাশ লাগে। কিন্তু যতটা হতাশ লাগে, সঙ্গের মেয়েদের সামনে সেটা প্রকাশ করে না। সত্যিই কি এটা প্রধান দুই দলের বিবাদের জের, যেমনটা কাকা বলেছিল ?

রিতার মন বলে, সেটাই। শুধু আগুনটা লেগে যাওয়ায় যার যেভাবে সুবিধা আলু পুড়িয়ে খাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।        

১১

পৌরসভা আর ডিসি অফিসে টহল দিয়ে আসায় ভালো হয় যে, টানবাজারে সাংবাদিকরা আসে। তারা এসে সরেজমিনে খোঁজখবর করে। নোটিসের একটা কপিও নেয় তারা। অনেকের কাছে মনে হয়, এসব খবর পেপারে ছাপলে হয়তো অনেক সাড়া পড়ে যাবে। মানুষ জানবে কত অরাজকতা ঘটছে এই টানবাজারে আর তাতে ক্ষমতা বা জায়গাজমিলোভী মানুষগুলোর একটা শিক্ষা হবে। কিন্তু এটাই হয়তো মুখচোরা লোকদের জন্য স্বাভাবিক যে, সাংবাদিকরা যখন আসে, কথা বলে প্রায় অনেকের সঙ্গে, সেসব পেপারে ছাপলে মানুষ আরও বেশি শত্রু হয়ে ওঠে টানবাজারের লোকদের। স্রোতের মতো মানুষ তাদের বিরুদ্ধেই অবস্থান নেয়। মুখে মুখে শুধু টানবাজার কেন, দুনিয়ার তাবৎ যৌনপল্লী তুলে দেওয়ার ব্যাপারেই তাদের আগ্রহ আছে―এমনটাই বলে। এরকম কাজের পক্ষে অবস্থান সাধারণ মানুষদের জন্য আরামদায়ক।

মানুষজনের অসহযোগিতা আর জীবনের আসন্ন অনিশ্চয়তা―দুইয়ে মিলে টানবাজারের পল্লীতে এক আতঙ্ক। যেখানে কোনওকিছুই জীবনের গতি থামাতে পারে না, সেখানে শেষ পর্যন্ত হাসিঠাট্টায় ছেদ পড়ে। মেয়েরা কেমন যেন অসুস্থ বোধ করে। ভরা সন্ধ্যায় অনেকে সাজগোজ করে গলির মুখের দিকে না গিয়ে ঘর বন্ধ করে শুয়ে থাকে। বাচ্চাকাচ্চারাও জেনে যায় তাদের চলে যেতে হবে। তবে বয়সের কারণে জীবনের তীব্র অনিশ্চয়তা তাদের গ্রাস করে না। পুরো পল্লীতে এক তাদেরই চিৎকার ভাসে যখন তারা দল বেঁধে পূর্ব বা দক্ষিণ দিক থেকে হৈ হৈ করতে করতে টানবাজার মসজিদের দিকে ছুটে যায়। সেখান থেকে মিলাদ শেষে হাতে হাতে একটা করে গরম জিলাপি নিয়ে আবারো হৈ হৈ করতে করতে যার যার ঘরে ফিরে আসে।

যখন বিষণ্নতায় বা আতঙ্কে পাড়াময় কেমন যেন গুমোট নিস্তব্ধতা তখনই একদিন পূর্ব দিকের উঠানের কাছে কয়েকটা ঘরে এক দল লোক আক্রমণ করে। তারা এসে এসে দরজায় ধাক্কা দেয়। মেয়েরা ভীত মুখে বের হয়ে এলে বলে অহনও যাও নাই তোমরা ? ছেলেরা এই ঘর থেকে ওই ঘরে দরজায় কিল ঘুষি মারতে থাকে। মেয়েরা ঘর থেকে বের হয়ে প্রথমে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়, তারপর ধাতস্থ হয়ে জানতে চায়, অহনই ক্যান যাব ? আইজ তো বারো তারিখ, আপনেরা না বিশ তারিখ পর্যন্ত সময় দিয়া গেলেন ?

বারো তারিখ তো কী হইছে ? বারো তারিখ আইলে বিশ তারিখও আইব। তোমরা যাইতেছো কি না সেইটা বলো।

মেয়েদের মধ্যে কে যেন সাহস করে বলে, ক্যান যাব ? ক্যান যাব আমগো জায়গা ছাইড়া ? আমগো ঘরের ভাড়া কি বাকি পড়ছে ?

আর তখনই সেখানে একটা তুমুল শোরগোল বেঁধে যায়। কয়েকটা ছেলে এসে সামনে সারি করে দাঁড়ায়। একজন আরেকজনকে চিৎকার করে বলে, ওই, এক গ্যালন পেট্রোল আন দেহি বড় রাস্তার পেট্রোল পাম্প থেইকা, আইজকা এই ঘরগুলাতে আগুন লাগাইয়া দিয়া যাব। দেখি তারপরে এরা ঘর থেইকা বাইর হয় কি না। শুনছস তোরা ? দাউ দাউ কইরা আগুন জ্বললে বুঝতে পারবি অবস্থা। বাইরাবি না তখন ?

বিকৃত মুখে কথাগুলো বলতে বলতে ছেলেটা পকেট থেকে ম্যাচ বের করে কাঠি হাতে নেয়। যে মেয়েটা কথা বলছিল, তার এবং বাকিদের শরীরে বিদ্যুৎ খেলে যায়। তারা ছোটাছুটি শুরু করে। কেউ বাচ্চার হাত ধরে, কেউ তোষক গোল করে প্যাচায়। কেউ রান্নাঘরের দিকে ছুটে যায় দরকারি হাঁড়িপাতিল নিয়ে আসতে। তাদের ছোটাছুটি আর চেঁচামেচিতে পূর্বদিকে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। অসময়ে আসা কিছু খরিদ্দারকে ধরে লাথি কিল ঘুষি দিতে থাকে ছেলেরা। তারা ছুটে পালিয়ে যায়। উঠানে মেলে রাখা কাপড় গোটাতে গোটাতে দুজন মেয়ে বলে, ভাই, একটু সময় দেন, চইলা যাইতেছি। ছেলেটা তখন চিৎকার করে বলে, ওই, গেলি না এখনও ? ঠিক দুই ঘণ্টা সময় দিলাম। তারপর কইলাম এই ঘরগুলাতে দাউ দাউ কইরা আগুন জ্বলবে।

যারা যারা তাদের হুংকার শুনতে পায়, তারা বাকসোপেটরা গুছিয়ে ফেলে। সামান্য দূরে কেউ শুনলেও নড়ে না। ভাবে, দেখা যাক কী করে। ছেলেগুলো সেখানে থাকতে থাকতেই আরেক দিক থেকে কয়েকজন সাংবাদিক আসে। ছেলেগুলো কী বোঝে কে জানে, ছুটে পালিয়ে যায়। তারপর সেদিকটায় একটু শান্তি আসে। এমন শান্তি যে কেউ কথা বলতেও ভুলে যায়। সাংবাদিকরা এসে থম মেরে বসে থাকা মেয়েগুলোকে বলে, কী হইছে ? জিনিসপত্র গোছাইছেন ক্যান ? যাইতেছেন আপনারা ?

একজন হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে, আচ্ছা, ভাই, কন তো কী করব আমরা ? আমরা কি এখনই চইলা যাব ? নাকি ঘরে আগুন দিলে পুইড়া মরব ?

আগুন ? কে দেবে আগুন ?

ক্যান, তাগো দেখলেন না আপনেরা ? ওই যে পলাইয়া গেল ?

সাংবাদিকদের মধ্যে একজন বলে, আরে অত ভয় পাইলে চলে ? ওরা কইল আর আপনেরা যাওয়ার লাইগা রেডি হইলেন!

ভাই, ম্যাচ বাইর করছে। বাচ্চা-কাচ্চা লইয়া পুইড়া মরুম নাকি ?

সাংবাদিকরা একজন আরেকজনকে বলে, সাংঘাতিক ব্যাপার। যে লাগালাগি ঘর, এইখানকার একটা ঘরে আগুন ধরাইলে আর অস্তিত্ব থাকব ? পুরা পল্লী পুড়তে লাগব ঘণ্টাখানেক। কিন্তু এই পোলাপান কোনখানকার ? কারা এরা ?

এরা যে কে সেই হদিস বোঝা যাবে না। এরা এলাকার মাস্তান হইতে পারে, দোকানপাটের এজেন্ট হইতে পারে, মেয়র বা এমপির লোক হইতে পারে, আবার খালিখালিই সরকারি ছাত্রদলের লোক হইতে পারে, তারপর ধরো,  তালেবেলেমও হইতে পারে। কতজনের যে কত রকমের ধান্দা আছে এই জায়গা নিয়া, যার যেরকম খুশি চাপ প্রয়োগ করতেছে। একজন বিশ তারিখ পর্যন্ত সময় দিল, আরেকজনে দেয় দুই ঘণ্টা।

স্যার, কী কন, সইরা কি আমগো যাইতেই হইব ?

সাংবাদিক নিজের দুই ঠোঁট চেপে বলে, কী বলব আমরা ? যা দেখতেছি আইজ কাইল, থাকতে মনে হয় পারবেন না আপনেরা।

তারপর আর কথা আগায় না। আরেকজন উৎসাহী সাংবাদিক আসে, যারা জিনিসপত্র প্রায় গুছিয়ে এসেছিল, তাদের  জিজ্ঞাসাবাদ করে, আপনারা কোথায় যাচ্ছিলেন ?

জানি না।

এরপর কী কাজ করবেন বলে ভেবেছেন ?

জানি না।

সংসারের খরচ চালাবেন কীভাবে ?

জানি না।

নতুন করে জীবন শুরু করতে পারবেন ?

জানি না।

সাংবাদিক হয়তো উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। তাই মেয়েগুলোও বেঁচে যায়। তারা নতুন করে চৌকির উপরে তোশক বিছায়, হাতের তালু দিয়ে উপরের চেক প্রিন্টের চাদরটা টান টান করে। বাচ্চাদেরকে কোলে নিয়ে আদর করে। উঠানে ছড়ানো হাঁড়িপাতিল নিয়ে রান্নাঘরের দিকে হাঁটা দেয়। মানুষ মূলত গুছিয়ে থাকতে চায়―সাংবাদিকেরা তাকিয়ে থাকে মেয়েগুলোর দিকে। একজন সাংবাদিক হঠাৎ তুলনামূলক অল্পবয়সী একটা মেয়ের কাছে জানতে চায়, যখন এখানে এসেছিলেন, আপনার কি পরিবার ছিল ? বাবা-মা ? মেয়েটার কেন যেন হুট করে চোখে পানি এসে পড়ে। ওড়নায় চোখ মুছে মেয়েটা বলে. এইগুলা কী কন ? বাপ-মা-পরিবার থাকলে কোনও মাইয়ার এই দশা হয় ?

রিতার নেতৃত্বে মেয়েগুলো একসঙ্গে হয়। কাগজে, ব্যানারে কতকিছু লেখে―যৌনপল্লী উচ্ছেদ মানি না, আমরা কোথায় যাব প্রশাসন বলে দিন, পুনর্বাসন ছাড়া উচ্ছেদ নয়―কত কিছু! মেয়েরা চিৎকার করে করে রিতার সঙ্গে গলা মেলায়। টানবাজার এলাকার আশেপাশে মিছিলটা ঘোরে। একজন পুরুষও সেই মিছিলে যোগ দেয় না, সমর্থন দেয় না। দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে বা না দেখার ভান করে। আর এভাবেই কী করে যেন অনাকাক্সিক্ষত বিশ তারিখ চলে আসে। দুপুর নাগাদ টানবাজার পল্লীতে আর ফ্যান ঘোরে না। গরমের চোটে মানুষগুলো বাইরে বেরিয়ে হাঁসফাঁস করে। পিপাসায় ট্যাপ খোলে, দেখে পানি নেই। চুলায় আগুন জ্বলে না। কে যেন কখন সমস্ত লাইন বন্ধ করে দিয়ে গেছে। মানুষগুলো তখন ওখানে থাকার শেষ আশাটুকুও ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। কেউ কেউ বাকসোপেটরা বাঁধে। কেউ কেউ ছুটে যায় বাড়িঅলার বাড়িতে। বেশির ভাগ বাড়িঅলারা দরজাই খোলে না। তাই মেয়েরা ফিরে আসে রিতার মতো সর্দারনিদের কাছে, বুবু, কী করব ? কই যাব এখন ?

রিতা বারান্দায় বোবার মতো বসে থাকে। তার দুই চোখ দিয়ে জলের ধারা গাল বেয়ে পড়ে। সে যেন অনুভূতিবিহীন, হাতও ওঠে না অশ্রু মোছার জন্য। মেয়েরা জানতে চাইতে চাইতে হতাশ হয়ে ফিরে যায়। মাথার উপরে গাট্টি বোঁচকা বেঁধে কেউ কেউ সন্ধ্যা নাগাদ ক্ষুধা-পিপাসায় গলিগুলো ধরে চিরকালের মতো বেরিয়ে যায় পিছনের অনেক মিষ্টি এবং দুঃসহ স্মৃতি ফেলে।

রিতার পায়ের কাছে বসে থাকে নাজমা। রিতা বহুক্ষণ পরে প্রথম কথা বলে, নাজমা, আমরা কি হাইরা গেলাম রে ?

নাজমা উত্তর না দিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। সাইফুল আর ফারুক পানি আর খাবার বয়ে আনে। কোনওরকম রাতটা কাটে। পরদিন রিতারা জানতে পারে তাদেরকে পুনর্বাসন করা হবে। সাইফুল দৌড়াতে দৌড়াতে এসে রিতার ঘুম ভাঙায়, বুবু, শুনছো খবর ? এমপি বলছেন আমাগো নাকি পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হইছে!

শুনব কী রে, আমি তো ঘুমাইতেছিলাম।

উঠো উঠো। তাই তো কই, সরকার কি আমাগো উপরে এতটা অন্যায় করতে পারে, বুবু ?

পুনর্বাসন মানে কী রে, আমাগো থাকার নতুন জায়গা হইব ? আর খাওন ?

সব হবে, বুবু।

রিতা তৃপ্তির নিঃশ^াস ফেলে উঠে বসে। তারপর ধীরে ধীরে বিছানা থেকে পা নিচে ফেলে। তাকে দেখে মনে হয় না সরকারের প্রতিশ্রুতিতে তার কোনও বিশ^াস আছে। সাইফুল বলে যেতে থাকে, আর এই পুনর্বাসনে সরকার কত টাকা দিতেছে, জানো বুবু ? আট কোটি টাকা। আ…ট কোটি!

আট কোটি টাকা কত টাকা রে, সাইফুল ?

উত্তর না শুনেই রিতা কেন যেন ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সাইফুলও ভাবতে থাকে, কোটি কোটি টাকা আসলে কত টাকা হতে পারে। তবে খোদ এমপি যখন বলেছেন তখন টাকা তো সরকার বলতে গেলে দিয়েই ফেলেছে। কিন্তু এই পুনর্বাসনের কথাও কেন যেন রিতা-নাজমাদের সান্ত্বনা দিতে পারে না। তারা কেমন মনমরা হয়ে পানিবিহীন মরুভূমির মতো ঘরে সন্ধ্যা হলে মোমবাতি জ্বালিয়ে বসে থাকে। কাইরের সিঙ্গাড়া-পুরির উপরে জীবন চলে। তাও তো চলে যতক্ষণ না তেইশ তারিখ ভোর বেলা আজরাইলের শিঙ্গার মতো তীব্র স্বরে বাঁশি বাজতে থাকে। যে যার ঘরের বিছানায় ধড়ফড় করে জেগে ওঠে শব্দ শুনে। বাইরে বেরোলে দেখা যায় তিনটা বুল্ডোজার এলোপাথাড়ি ঘরগুলোর ছাদে আঘাত করছে। আঘাতের সঙ্গে সঙ্গে ভিতর থেকে মেয়েরা বেরিয়ে আসছে। বাচ্চাদের কাইমাই আর মেয়েদের আর্তনাদে জায়গাটার বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। কে যে কোনদিকে দৌড়াবে দিশা পায় না। দেয়াল আর ছাদ ভাঙার ধুলায় সিমেন্টের গুঁড়োয় জায়গাটায় একটা দুর্বোধ্য রহস্যময় ব্যাপার ঘটে। যেখানে বোঝা যায় না কে টানবাজারের বাসিন্দা আর কে বাইরে থেকে এসেছে টানবাজার ভাঙতে। মেয়েরা এলাপাথারি দৌড়াদৌড়ি করে নিজের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিতে থাকে। ঘুম থেকে হুট করে জেগে ঘুমের ঘোরটাও কাটেনি তখনও। কোথায় যেন জমানো কয়েকটা টাকা… প্রিয় জামা বা হাঁড়ি… দুচারটা সাজগোজের জিনিস, তেল-সাবান, নিজের ছোট বাচ্চাটা কোথায়… কেউ চায় ছোট স্যুটকেসে জিনিস ভরে বেরোতে, কিন্তু ভরতে ভরতেই ছাদের সুরকি ঝরা শুরু হয়। মাথার উপরে ছাদ ভেঙে পড়ার আশঙ্কায় সে স্যুটকেস ফেলেই দেয় দৌড়…

কেউ কেউ ছুটে যায় আশেপাশের দোকানপাটের দিকে। চেনা দোকানের শাটার পড়ে যায়। কেউ যায় বাড়িঅলাদের বাড়িতে। দরজা বহুক্ষণ ধাক্কা দিলে তারা কেউ খোলে কিন্তু ঢুকতে দেয় না। বলে, আশ্রয় দিলে বিপদ আছে। কেউ বাচ্চাকাচ্চা বোচকা-পাতি নিয়ে ছোটে টানবাজার পার্কের দিকে। সেখানে গিয়ে জোরে জোরে শ^াস নেয় খানিক। আশেপাশে দু’টি এনজিওতে আশ্রয় পায় কেউ কেউ। বিকেল পর্যন্ত তাণ্ডব চলে পল্লীতে। কোথাও কি আর ভাঙার কিছু বাকি আছে ? বুল্ডোজারে বসে থাকা জল্লাদ খুঁজতে থাকে। কিন্তু কেমন করে যেন নারকেল গাছের নিচে একতলা বাড়ির একটা ঘর বাকি থাকে, নারকেলের বড় কয়েকটা পাতায় ঢাকা। বিকেল নাগাদ সেই ঘরের একমাত্র দরজাটা খুলে অল্পবয়সী একটা মেয়ে বেরিয়ে আসে। দুর্বল শরীরে আলুথালু পা ফেলে বাইরে তাকায় মেয়েটা। এটা কোথায়! কোনওদিকে একটা ঘর নেই। ভাঙাচোরা দেয়াল আর ছাদ উলটেপালটে পড়ে আছে। তারই ফাঁকে ফোকরে একটা সিনেমার পোস্টার, একটা ওড়না, ছোট বাচ্চার প্যান্ট, ধুলোয় ঢাকা বাসন কয়েকটা, একটা চিরুনি… মেয়েটার মাখা ঘুরে ওঠে। নিজের ঘরের আস্ত দেয়াল আঁকড়ে ধরে দাঁড়ায় সে। গত রাত থেকে জ্বরে বেহুঁশের মতো পড়ে ছিল। তার জ্বরের কথা হয়তো কেউ জানত না। কেউ তার ঘরে আসেওনি। ঘুম ঘুম তন্দ্রায় সে অনেক চেঁচামেচির শব্দ শুনেছে বটে―তবে সেসব স্বপ্ন নাকি সত্যি সে সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। বিস্ফোরিত চোখে সে এদিক ওদিকে তাকায়। সিমেন্টের গুঁড়া নাকে ঢুকলে তীব্রভাবে কাশে। তার কাশির শব্দে দুজন মানুষ তার দিকে তাকায়। নারকেলের পাতা সরিয়ে আবিষ্কার করে ফিটিং ফুল ছাপা লাল কামিজ আর নীল পাজামা পরে বোকা বোকা চোখে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে। তারাও মেয়েটির মতোই বিস্মিত চোখে তাকায়, কই আছিল এ ? ওই মাইয়া, অহনতরি যাও নাই ?

১২

রিকসা থামলেও নাজমা যেন কোনদিকে তাকিয়ে থাকে। রিতা নেমে যায়। তারপর ভাড়া দিয়ে হাঁটা শুরুর আগে দেখে নাজমা জানেও না রিকসা থেমেছে।

ওই, কী হইল, তুই কই যাবি এখন ?

কই যাব, বুবু ?

আরে, মাইয়া পাগল হইল নাকি ?

বুবু, কেউ তো আমাগো দিকটা দেখল না। কত্ত গল্প শুনছিলাম পুনর্বাসনের… আমাগোটা কেউ দেখল না, বুবু।

আমগো নিজের লোক সব্বার টাকা মাইরা খাইল, আর তুই আছিস অন্য মানুষ নিয়া।

এখন আমরা কই যাব, বুবু ? ওই টাকা দিয়া যে ঘর বানাইতে চাইছিলাম ?

রিতা নাজমার কথার জবাব দেয় না।

সচিত্রকরণ : রজত    

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button