আর্কাইভভ্রমণ গদ্য

ভ্রমণ : আনাবেলা, পেরু ও রৌদ্রের শহর : শাহাব আহমেদ

When I kissed her cheek, I could taste the salt of her tears. হতে পারে ওটা আমার কল্পনা অথবা অশ্রুটা ওর গালে ছিল না, ছিল অন্য গালে অথবা কে না জানে, বিপ্লবীদের অনুভূতি গিলে ফেলার প্র্যাকটিস তো করতেই হয়।

আমি তাকে মস্কোর ট্রেনে উঠিয়ে দিই।

বাইবেলে ঈশ্বরের শাস্তি হিসেবে সদোম শহর পুড়ছিল যখন, লুত তার স্ত্রী, কন্যা ও জীবন নিয়ে ছুটছিলেন। বলা হয়েছিল পেছনের দিকে তাকানো যাবে না কিন্তু লুতের স্ত্রী মানতে পারেননি। প্রিয় শহর, আঙুলের ছাপমাখা বাড়িঘর, আঙিনা ও বাগান ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, পুড়ছে প্রিয় বৃক্ষরাজি, পশু ও প্রাণি, তিনি চকিতে ফিরে তাকান শেষ দৃষ্টিক্ষেপণের জন্য। ঈশ্বর পিতা নন, তিনি অবাধ্যকে ক্ষমা করেন না, এবং মুহূর্তের মধ্যেই তার পা থেমে যায়, চোখের পাতাগুলো ভারী হয়ে আসে এবং তিনি বদলে যান একটি লবণের মূর্তিতে। পেছনে না তাকানো সন্ত্রস্ত লুত মেয়েদের নিয়ে ছুটে চলে যান, নারী দাঁড়িয়ে থাকেন তার নিজস্ব শহরে।

মূর্তি নয়, ঐ চলে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকাটুকুতে যে মমত্ব, নিজের স্থান, কাল ও পাত্রের প্রতি ভালোবাসা, তার জন্যই কি লুতের স্ত্রী আমাদের প্রিয় নন ?

সেই মমত্ব নিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম চলমান ট্রেনের দিকে তাকিয়ে।

ভেবেছিলাম… এত ‘পুদ’ লবণ খেয়েছি একসঙ্গে অথচ…

সেটা ছিল, জুনের ২১ তারিখ, ১৯৮৯ সাল।

এবং ২৮ বছর পরে সেই দিনেই আমি কুস্কো শহরে বসে মার্গারিতা খাচ্ছি। এটা কি কাকতালীয়, না মনের যে অবচেতন কক্ষটি রয়েছে তালা দেওয়া, তার অন্দর-বাহির ?

এবং ছুটছে, ছুটছে দুটি ছায়া।

ছুটছে, ত্রস্ত। পেছনে বাঘ, সিংহ, হায়েনা নয়, মানুষ। ঈশ্বর ও স্বর্ণভক্ত মানুষ এবং ওরা ক্লান্ত, একজন নারী ও একজন পুরুষ। পা চলে না, গা নেতিয়ে আসে, তারপরেও ছুটতে হচ্ছে।

থামা মানে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করা। নারীটি অন্তঃসত্ত্বা, যে কোনও মুহূর্তে প্রসব বেদনা ওঠার সময় তার। তাকে থামতে হচ্ছে। ফলে পিছিয়ে যাচ্ছে তারা এবং মৃত্যু এগিয়ে আসছে কালো রাত্রির কালো চিতাবাঘের থাবার মতো। শীতের রাত। আমাজনের অ্যানাকোন্ডা-অন্ধকার গ্রাস করেছে পৃথিবী। যে পৃথিবী বিগত ৩০০ বছর ছিল একই রকম অথচ ভীষণ অচেনা এখন। ক্লান্ত, শীতার্ত ও ক্ষুধার্ত, হাত-পা জমে গেছে। তাদের থামতেই হয় শেষ পর্যন্ত। পুরুষ আগুন জ্বালায়। উষ্ণ হওয়া দরকার। হয়তো রাত্রি কাটাতে হবে এখানেই। আকাশ দেখা যাচ্ছে না, তারাদের মুখ ঢেকে দিয়েছে আমাজনের বৃক্ষ ক্যানোপি। বাতাসে মৃত্যুর ত্বক-পোড়া গন্ধ।

কোনও লেখকের কল্পনা নয়, এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়েছে ইতিহাসে বহুবার। কখনও কখনও মিলে গেছে ঘটনাগুলোর দিন-তারিখ-ক্ষণ। এই যেমন বাংলার শেষ নবাব সিরাজের ক্ষেত্রে। মানুষ হায়েনার চেয়েও হিংস্র ও কৌশলী, হায়েনাকে ফাঁকি দেওয়া যায়, মানুষকে নয়।

সিরাজও পারেননি।

১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে পরাজিত হয়ে স্ত্রী লুৎফুন্নেছাকে নিয়ে শুরু করেছিলেন দৌড়, জীবন ও স্বাধীনতা বাঁচানোর দৌড়। মিরন ও মোহাম্মদি বেগের খুনির দলের এম্বুশ এড়িয়ে পাটনায় পৌঁছে তিনি প্রতিরোধ গড়ে তুলবেন ক্লাইভ- মিরজাফর-উমিচাঁদ-রাজবল্লভ-ঘসেটি বেগম প্রমুখ বাংলার দ্বিমুখী চরিত্রগুলোর বিরুদ্ধে।

কিন্তু দানিশ ফকির! এই দানিশ ফকিরেরা সবখানে। স্বাধীনতার প্রতীক সিরাজ-উদ-দৌলাদের ধরিয়ে দেওয়ার জন্য তাদের জন্ম। কী করে এদের চোখ এড়িয়ে বাঁচিয়ে রাখা যায় স্বাধীনতা ?

১৭৫৭ সালের জুলাই মাসের ৩ তারিখে মাত্র ২৪ বছর বয়সে হত্যা করা হয় সিরাজকে।

তারপরে কত গল্প তাকে নিয়ে, কত চরিত্রহরণের চেষ্টা! প্রতিপক্ষকে দানব হিসেবে দেখাতে ইউরোপের জুড়ি কোনও দিন ছিল না, আজও নেই। নিজেদের চরিত্রের কালিমা এরা এঁকে দেয় বিজিতের চরিত্রে।

সিরাজ-উদ-দৌলারও প্রায় ২০০ বছর আগে ১৫৭২ সালের ২৩ জুন তারিখে শেষ ইনকা সম্রাট তুপাক আমারুকে পরাজিত করা হয়েছিল। স্পেনিশ দস্যুরা স্বর্ণনগরী বিলকা বাম্বা বা এলদোরাদো দখল করে লুটপাট ও ধ্বংসসাধন করে, আগুনে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল তুপাকের বাসস্থান। তুপাক আমারু ১০০ জন বিশ্বস্ত সঙ্গী নিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিলেন। স্প্যানিশদের দৃষ্টি এড়ানোর জন্য তারা কয়েকটি ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দিকে হারিয়ে গিয়েছিলেন অন্ধকার অরণ্যের বিবরে।

কিন্তু না, তাদের গতিপথ নখদর্পণে ছিল শত্রুদের।

তুপাক আমারু ক্ষমতায় ছিলেন সিরাজের মতোই মাত্র এক বছর। অথচ স্প্যানিশরা কত অভিযোগ দাঁড় করিয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ওরা যখন সিরাজের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনে তা তুপাক আমারুর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগেরই অবিকল অনুরূপ।

বিলকা বাম্বা দখল করার পরে দুর্বৃত্তরা তিন দলে বিভক্ত হয়ে একদল যায় তুপাকের ভাই, পূর্ববর্তী সম্রাট ‘টিটু কুসি’র ছেলে ও অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে গ্রেফতার করার জন্য। দ্বিতীয় দল বন্দিদের নিয়ে কুস্কো শহরে ফিরে যায় এবং লুণ্ঠিত সোনা, রুপা, মণি-মুক্তা সৈন্য ও পুরোহিতদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়। তৃতীয় দল তুপাকের অবশিষ্ট ২ ভাইকে বন্দি করে।

কিন্তু তুপাক নিখোঁজ।

তখন বাছাই করা ৪০ জনের একটি দলকে পাঠানো হয় তাঁর অনুসন্ধানে। তারা নদীর গতিপথ ধরে ১৭০ মাইল বনের ভিতরে এগিয়ে যায়। দেখতে পায় একটি ইনকা শস্যাগার। সে সময়টা ছিল এক আদি সমাজতান্ত্রিক সমাজের মতো, সবাই মিলে শস্য উৎপাদন করত, সংরক্ষণ করা হতো রাষ্ট্রের শস্যাগারে এবং বণ্টন করা হতো জনগণের মধ্যে।

ওরা অতর্কিতে আক্রমণ করে সেই শস্যাগার। প্রহরী ইন্ডিয়ানদের গ্রেফতার করে। তাদের প্রচণ্ড অত্যাচার করে স্বীকার করতে বাধ্য করায় যে, তুপাক আমারু এই পথ দিয়েই গিয়েছে ‘মোমরি’র দিকে।

এখানে নদী খরস্রোতা ও উত্তাল। স্প্যানিশ দলের সর্দার গার্সিয়া লয়োলা পাঁচটি ভেলা তৈরি করে নদী পাড়ি দেয়। নিকটবর্তী লোকালয় ‘মোমরি’ গিয়ে পৌঁছায় কিন্তু এখানেও তারা সামান্যের জন্য তুপাককে বন্দি করতে ব্যর্থ হয়। এবার ধরা হয় ‘মোমরি’র কিছু ইন্ডিয়ানকে। ইউরোপীয় মানবতার দাওয়াই প্রয়োগ করে জেনে নেওয়া হয় তুপাকের নিষ্ক্রান্তির পথের সন্ধান। 

আরও ৫০ মাইল অতিক্রম করে রাতের ঘুটঘুটে অন্ধকারের বুক চিরে লয়োলার লোকজন দেখতে পায় স্বৈরিণী আলোর শিখা। মানুষ চিরকাল আলোর দিকে ছোটে, অথচ সেই আলোও কখনও কখনও বিশ্বাসঘাতক হয়। দানিশ ফকিরের মতো দেখিয়ে দেয় কোথায় লুকিয়ে আছে স্বাধীনতার সর্বশেষ শিখাটি।

ওরা নিঃশব্দে এগিয়ে আসে।

রাত ৯টা।

হুহু করছে শীত আর রাতের নৈঃশব্দ্য। অ্যানাকোন্ডা-অন্ধকার! আগুন পোহাচ্ছে ২ জন মানুষ, একজন নর, এক জন নারী। শেষ ইনকা সম্রাট ও সম্রাজ্ঞী।

ইনকা সাম্রাজ্য ইতোমধ্যেই স্প্যানিশদের দখলে ছিল। রাজধানী কুস্কোতে বসে তারা সাম্রাজ্য লুণ্ঠন করছিল ১৫৩২ সাল থেকে। ইতোমধ্যেই তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে ইনকাদের ঈশ্বর ভিরাকুচাকে। বহু দিন আগেই অদৃশ্য হয়ে যাবার পরেও ছিল তার মন্দির ও প্রার্থনা করার কেচোয়া জনগণ। নতুন ঈশ্বর এসেছে জাহাজে করে মহাসমুদ্র পাড়ি দিয়ে। অসম্ভব শক্তিশালী ক্রুশবিদ্ধ ঈশ্বর। সে অচেনা অদ্ভুত একটা প্রাণির কাঁধে, যার নাম ঘোড়া, চড়ে স্থান থেকে স্থানে যায়, লুণ্ঠন করে আর বারুদ বন্দুক কামানের ভাষায় কথা বলে।

যারা তাকে মানতে চায় না তাদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করে বা করায়। অথচ কী মায়াময় তাঁর অবয়ব। নাম কী আপনার ?

জসুয়া।

কেন আমাদের দেশে এসেছেন ? আমাদের হত্যা করছেন ?

আমি দুঃখিত, আমাকে ওরা ক্রুশে ঝুলিয়ে নিয়ে এসেছে। আমি মৃত, আমার আসার সাধ্য নেই।

আপনি মৃত! সত্যি ?

হ্যাঁ, মানে আমাকে ওরা বাঁচিয়ে তুলেছে কোনও এক ইস্টারে, তারপরে ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে সমস্ত ক্রুসেড, ইনকুইজিশন, পররাজ্য গ্রাসে নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছে। আমি বোবা, কোনও মতামত দিতে পারি না, সবকিছু আমার নামে করা হয়, আমার মা মারিয়ার চোখের অশ্রু শুকায় না।

২১ সেপ্টেম্বর তুপাক আমারুকে কুস্কো আনা হয়। সঙ্গে আসে সম্রাট ‘মানকো কাপাক’ ও ‘টিটু কুসি’র মমি। ইনকা রাজবংশের গৃহদেবতা ‘পুনচাও’-এর স্বর্ণমূর্তি। তুপাক যাতে পালিয়ে না যেতে পারে তাই তার গলায় একটি শিকল পরানো হয়েছে। শিকলটি সোনা দিয়ে তৈরি, ইনকারা লোহার ব্যবহার জানত না। সোনা ছিল তাদের কাছে সাধারণ একটা ধাতু, মূলত মন্দির ও ঈশ্বরের প্রার্থনার কাজে ব্যবহৃত।

তাকে ভাইসরয় ফ্রানসিস্কো টলেডোর সামনে উপস্থিত করা হয়। রবার্ট ক্লাইভের মতো ছোট, লোভী ও নীচ প্রকৃতির স্যাপিয়েন্স সে এবং এই ধরনের প্রাণিরা নিজেদের অন্যায়কে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করার জন্য সিরাজ তুপাকদের বেঁচে থাকতে দেয় না। মিথ্যা অভিযোগ এনে মৃত্যুদণ্ড দেয়। টলেডোও করে তাই, তুপাক আমারুর শিরচ্ছেদের আদেশ দেয়। সঙ্গে তার পাঁচজন জেনারেলের।

২ রাত ২ দিন ধরে তাকে খ্রিস্টান ধর্মের তালিম দেওয়া হয়। তারপরে পবিত্র শয়তানেরা তাকে বাপটাইজ করায়। তারপরে সওয়ার করে গাধার পেছনে। দেহের পেছনে দুই হাত এবং গলায় দড়ি বাঁধা তুপাক আমারুকে কুস্কোর মূল স্কোয়ারে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পূর্বপুরুষরা তৈরি করেছে পৃথিবীর নাভিপদ্ম এই সুন্দর শহর, বিগত ৩০০ বছর প্রবল প্রতাপে করেছে রাজ্যশাসন। আজ সেখানে তৈরি করা হয়েছে তার শিরচ্ছেদের মুক্তমঞ্চ। লোকে লোকারণ্য চারিদিক, ১০-১৫ হাজার মানুষ উপস্থিত হয়েছে, ৪০০ গার্ড নিয়োগ করা হয়েছে। উপস্থিত কেচোয়া জাতির লোকজন প্রভুর মৃত্যুর শোকে বিষণ্ন।

তারা আকাশের দিকে হাত তুলে বিলাপ করে ডাকছে ভিরাকুচা ঈশ্বরকে। কিন্তু ভিরাকুচা নির্বাক, দস্যুদের ক্রুশবিদ্ধ ভগবান পুত্রের মতোই নিশ্চল।

তুপাক মৃত্যুমঞ্চের দিকে এগিয়ে যান শান্তভাবে, একজন ধর্মযাজক যায় পিছু পিছু। ততক্ষণে তার হাত মুক্ত করা হয়েছে। তিনি হাত উঁচু করেন। জনতার মধ্যে নেমে আসে নিরবচ্ছিন্ন নীরবতা। তিনি বলেন―‘হে আমার জনগণ, শিশুরা দুষ্টামি করলে তাদের শাস্তি দিও কিন্তু অভিশাপ দিও না। দুষ্টামি করার কারণে মা আমাকে অভিশাপ দিয়েছিল যে, আমার অস্বাভাবিক মৃত্যু হবে। তাই হচ্ছে আজ।’

তিনি আরও কিছু বলতে চান, তার কথায় জনতার মধ্যে নির্দোষ রক্তপাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী মনোভাব গড়ে ওঠে, এমনকি স্প্যানিশ পাদ্রিদের কেউ কেউ অনুরোধ করে তাকে হত্যা না করে বিচারের জন্য স্পেনে পাঠাতে। টলেডো অবস্থা বেগতিক দেখে এক অশ্বারোহীকে পাঠায় তৎক্ষণাৎ। দ্রুতগতিতে জনতার মধ্য দিয়ে ঘোড়া চালিয়ে মঞ্চে উঠে আসে সে। জল্লাদকে আদেশ দেয় অবিলম্বে দণ্ড কার্যকর করার।

তুপাক আমারু কথা শেষ করেন, ‘ধরিত্রী মা, দেখো ওরা একজন নির্দোষ মানুষের রক্তপাত করছে।’ এই বলে তিনি নিচু হয়ে মৃত্যুবেদীতে মাথা রাখেন। ঘাতক চুলে ধরে মাথাটি উঁচু করে এক কোপে ধড় থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। তারপরে ঊর্ধ্বে তুলে ধরে উপস্থিত জনতাকে দেখায়। জনতার কান্নার রোল ঢেকে দিয়ে প্রতিটি চার্চে চার্চে, মাত্র কিছু দিন আগেও যেগুলো ছিল তাদের মন্দির, তাদের ভিরাকুচা ঈশ্বরের ঘর, কয়েদখানার পাগলা ঘণ্টির মতো বাজতে থাকে ঢং… ঢং… ঢং…

সেটা ছিল সেপ্টেম্বর মাসের ২৪ তারিখ, ১৫৭২ সাল।

তুপাকের বয়স ২৭ পূর্ণ হয়নি। সঙ্গে ইনকা আর্মির একজন বীরের শিরñেদ করা হয়। দুজন জেনারেলের হয় ফাঁসি আর তিনজনের হাত কেটে নেওয়া হয়। ইনকা সম্রাটদের মমিগুলো পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ আসে। মমি নষ্ট করা মানে, তাদের বিশ্বাসের সর্বনাশ করা। কারণ মৃতকে মমির  সংরক্ষণ এ বিশ্বাস থেকেই যে, মৃত ইনকারা আবার ফিরে আসবেন এবং রাজ্যের শাসনভার হাতে তুলে নেবেন।

এভাবেই শুরু হয় বিশ্বাসের বিলুপ্তি ঘটানোর উৎসব।

এবং এসব গল্প শোনাত সে আমাকে।

আমি ফ্রান্সিসকো পিজারো নই, যিশুও নই, পেরুতে কেন এসেছি ? সম্ভবত আনাবেলা দে লা রোসার নিভৃত সন্ধানে। ওদের লুকুমা ফল খুব মিষ্টি কিন্তু তারও চেয়ে মিষ্টি তার ঠোঁট এবং সেই ঠোঁটে যে এখন চুম্বন করে, সে কি মানকো কাপাকের মতো নম্র প্রেমিক ?

আজ ১৯ জুন, ইন্তি রেইমি উৎসব বা অ্যান্ডিয়ান নববর্ষের সময়ে কুস্কো শহরের ঐতিহাসিক স্কোয়ারে দাঁড়িয়ে ওকে মনে করছি। নববর্ষের রঙ ঝলমলে প্যারেড ও অনুষ্ঠান চলছে। ইনকা পোশাক পরিহিত নর-নারী। বাজনার তালে তালে চলছে গান ও নাচ। সঙ্গে বহন করছে ইনকা সভ্যতার সঙ্গে সম্পৃক্ত বিভিন্ন ধরনের মূর্তি ও মমির নকল। উৎসবমুখর চারিদিক। ভিড় করে লোকজন প্যারেড দেখছে।

সম্রাট পাচাকুতি সূর্যদেব ইন্তির নামে এই উৎসব শুরু করেন ১৪৩০ সালে। ১৫৩৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর অত্যন্ত জাঁকজমকের সঙ্গে পালন করা হতো, তারপরে দখলদার স্প্যানিশরা বেআইনি ঘোষণা করে। প্রায় ৪০০ বছর পরে আবার নতুন করে শুরু হয় ১৯৪৪ সাল থেকে, স্পেন থেকে আসা সেই সময়কার একজন, গার্সিলাসকো ডে লা ভেগার রেখে যাওয়া বর্ণনার ওপরে ভিত্তি করে।

দুই সপ্তাহব্যাপী এই উৎসবে সম্রাট তার পরিবারসহ, দেশের সমস্ত অভিজাত, ধর্মযাজক ও (তাহুয়ানতিনসুয়ো বা ইনকা সাম্রাজ্যের) অন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ জড়ো হতেন হাউ-কে-পাতা বা প্লাসা ডে আর্মাসে। কুস্কোর বিভিন্ন মন্দির ও ধর্মালয় থেকে এনে পিতৃপুরুষদের মমি জড়ো করা হতো।

২৪ জুন, খুব ভোরে ইনকা আসতেন তার পরিবার নিয়ে। সূর্যোদয়ের সময় তিনি এক গ্লাস চিচা হাতে সে বছরের শস্যফলন ও সমস্ত কিছু মঙ্গলের জন্য সূর্যদেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে পান করতেন। তারপরে পান করতে দিতেন তার পরিবারের সদস্যগণকে এবং অবশিষ্ট মাটিতে ঢেলে দেওয়া হতো। তারপরে তারা যেতেন করিকাঞ্চায়, সেখান থেকে শুরু হতো চিচা বা ইনকা বিয়ার, মিউজিক, নাচ, রং বেরংয়ের পোশাক-আশাক, মুখোশ হৈ-হুল্লোড় হাসি ও আনন্দমুখর পরিবেশে পূর্বতন ইনকা সম্রাটদের মমি নিয়ে শোভাযাত্রা। ধারণা করা হয়, ইউরোপের খ্রিস্টান ঈড়ৎঢ়ঁং ঈযৎরংঃর উৎসবটি পেরুতে এই উৎসবের  সঙ্গে মিশে গেছে।

এ বছর আমরা এই প্যারেড দেখছি ১৯ তারিখে। এটা কাকতালীয় প্রাপ্তি।

বন্ধু প্রদীপ চৌধুরী বহু দিন ধরে বলছিল, চলো মাচুপিচু ঘুরে আসি।

যাব, একটু সময় দাও―ঠেকিয়ে রাখতে হয়েছে।

অবশেষে আসা গেল। আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে দেবাশীষ মৃধা। আমি, প্রদীপ, দেবাশীষ, তিন বন্ধু, তিন ডাক্তার। প্রদীপ থাকে ক্যালিফোর্নিয়ায়, দেবাশীষ মিশিগানে। সঙ্গে আমাদের সবচেয়ে কাছের মানুষগুলো, প্রদীপের স্ত্রী বুলা, ছেলে সম্বিৎ আর মেয়ে হিয়া। দেবাশীষের স্ত্রী দীপা ও মেয়ে অমিতা। আর আমার যাকে ছাড়া এক পাও চলে না, সে, শ্বেতা।

তিন শহর থেকে উড়ে এসে প্রায় মধ্যরাতে মিলিত হয়েছি লিমা এয়ারপোর্টে। গালগল্প ঝিমুনির মধ্য দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে ভোর ৪টায় কুস্কোর প্লেন ছাড়ে। এক ঘণ্টার ফ্লাইট। সূর্য ওঠার আগেই পৌঁছে যাই। ইমিগ্রেশন পার হতে লাগে মিনিট দশেক, লাগেজ চলে আসে সঙ্গে সঙ্গে। বাইরে মাইক্রোবাস অপেক্ষা করছিল। হোটেল পর্যন্ত পৌঁছাই প্রায় মিনিট ৪০ পরে। চেক-ইন ডেস্কের ওরা যথেষ্ট ভদ্র। বলে, তোমরা ক্যাফেতে নাস্তা করো, আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তোমাদের রুম রেডি করে দিচ্ছি। ওরা কথা রাখে। নাস্তা শেষ হতে হতে রুম পেয়ে যাই। প্রথম কাজ হয় নিদ্রাদেবীর আরাধনা। বিছানায় গা এলাতেই দেবী তার দুই স্তন দিয়ে আমার দুই চোখ ঢেকে দেয়।

সমুদ্র-স্তর থেকে ১১,২০০ ফিট উঁচু কুস্কো শহর, উচ্চতা ও ‘মাউন্টেইন সিকনেস’-এর কারণে শ্বাসকষ্ট হয়, মাথায় হাল্কা একটা অস্বস্তি ঝিমঝিম করে। হোটেলের লোকজন আমাদের দেখিয়ে দেয় বিশাল পাত্রে রাখা কোকো পাতা দিয়ে কোকো চা। ওটা নিয়মিত পান করলে নাকি অস্বস্তিটা দ্রুত কাটে এবং শরীর উচ্চতার সঙ্গে অভ্যস্ত হয়ে যায়। কোকো দিয়ে তৈরি এক ধরনের ক্যান্ডিও রাখা আছে। দ্বিতীয় দিনে আমরা ভালো বোধ করতে শুরু করি। কুস্কো শহর ১৩ শতাব্দী থেকে শুরু করে ১৫৩২ সাল পর্যন্ত ছিল প্রবল প্রতাপশালী ইনকা সাম্রাজ্যের রাজধানী। ইনকা ও স্প্যানিশ স্থাপত্যের অপূর্ব নিদর্শন কতগুলো ইমারত ও মন্দির এখনও মাথা উঁচু করে আছে। করিকাঞ্চা বা সূর্যদেবের মন্দির তার মধ্যে অন্যতম। বলা হতো ভিরাকুচা ঈশ্বরের প্রাসাদ, সাম্রাজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মন্দির। 

কুস্কোর প্রথম রোমান ক্যাথলিক চার্চ, ‘কুস্কো ক্যাথেড্রাল’ ১৬৫৪ সালে তৈরি সম্পূর্ণ হয়, যদিও নির্মাণকার্য শুরু হয়েছিল ১৫৫৯ সালে। কেচোয়াদের দাস হিসেবে ব্যবহার করে, তাদেরই প্রধান মন্দির করিকাঞ্চা ধ্বংস করা হয়, তারপরে তারই ফাউন্ডেশনের ওপরে তৈরি করা হয় এই চার্চ।

পাকিস্তানিরা আমাদের লোকজন দিয়ে কবর খনন করিয়ে তারপরে সেখানেই হত্যা করেছে তাদের।

ওর কোথা থেকে শিখেছে এই হিংস্রতা ?

কে জানে কিন্তু আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়া মহাদেশসহ দেশে দেশে অমানবিকতা ও অসভ্যতার সবচেয়ে বড় শিক্ষক এবং গণতন্ত্রের গলাবাজ কারা ?

ইনকা শব্দের অর্থ রাজা বা সাম্রাজ্যের অধীশ্বর। জাতির নাম কেচোয়া কিন্তু স্প্যানিশরা ভুল অনুবাদ করে জাতিটিকেই ইনকা শব্দ দিয়ে বোঝাতে শুরু করে। তাই আমরা যাকে ইনকা সভ্যতা বলি তা আসলে কেচোয়া সভ্যতা।

করিকাঞ্চার পাশেই ছিল ‘সুন্টুর ওয়াসি’ নামে আরও একটি ইনকা বিল্ডিং। পরে, ১৫৩৬ সালে সম্রাট মানকো কাপাকের বিদ্রোহ ও আক্রমণের সময়ে স্পেনিশরা এই বিল্ডিংয়ে লুকিয়ে থেকে রক্ষা পায়, ফলে ১৫৩৮ সালে ইমারতটি ধ্বংস করে তার ফাউন্ডেশনে তৈরি করে ‘বিজয় চার্চ।’

এখন ‘চার্চ অব দি সোসাইটি অব যিসাস’ নাম তার।

বিস্তীর্ণ মাঠের দিকে তাকালে দৃষ্টি যেমন দূরে চক্রবালে গিয়ে আকাশের সঙ্গে মেশে, কুস্কো শহরের জন্মকাহিনি ঠিক তেমন, দূরে যেতে যেতে যেখানে তা হারিয়ে যায়, সেখানেই চোখে পড়ে শুরুর ঘটনাবলি।

শুরুটা ছিল অন্ধকার ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ। কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। বোঝা যাচ্ছিল না কী কোথায়। পরে দেখা গেল ভিরাকুচা ঈশ্বর দুই হাত নেড়ে নেড়ে সেই অন্ধকার দূর করে দিচ্ছেন। মুখে কী সব অবোধ্য শব্দ উচ্চারণ করে পৃথিবী, আকাশ, সমুদ্র ও গ্রহনক্ষত্র সৃষ্টি করছেন। তিনি ফুঁ দিচ্ছেন বিশাল বিশাল পাথরে আর সেখান থেকে লাফিয়ে বের হয়ে আসছে দানবাকৃতির মানুষ। তিনি তৈরি করছেন বৃক্ষ, প্রাণি ও পাখি। অ্যান্ডিজ পাহাড়ে ছুটে বেড়াচ্ছে লামা, আলপাকা ও আরও অগুনিত বিস্ময়!

প্রজাপতি উড়ছে, পাখি ঝাপটাচ্ছে ডানা।

বৃক্ষে বৃক্ষে বনানীর মর্মর।

কিন্তু ভিরাকুচার এসব পাথুরে মানুষ ভালো নয়, এরা দানবের মতো, হালাকু আত্তিলা ইয়াহিয়া হিটলারের দল। কেউ কেউ পাইপ হাতে ঘন গোঁফঅলা দেওদাসা। ওরা অন্যায় করে, অন্যকে শ্রদ্ধা করে না, হত্যা করে একে অন্যকে। নারীকে স্পর্শ করে শকুনের হৃদয় ও হিংস্রতা নিয়ে। ওদের মধ্যে আলো নেই, আছে আদি অন্ধকার। ঘুটঘুটে কালো ও গভীর! ভিরাকুচা বিরক্ত, রাগান্বিত। তার মুখের শুভ্র চামড়ায় সেই রাগের রক্তিমাভা। চোখে গনগনে আগুন। তিনি বিশাল পদক্ষেপে পায়চারি করছেন সমস্ত বিশ্ব কাঁপিয়ে। অ্যান্ডিজে লামাগুলো আর ছুটছে না, ভয়ে ছটফট করছে, সমতল ছেড়ে উঠে যাচ্ছে শুধু উঁচু থেকে উঁচুতে। ওরা জানতে পেরেছে ভিরাকুচার কঠিন সিদ্ধান্তের কথা।

আকাশের ছায়াপথে যে স্বর্গের নদী বয়, মেঘদেবতা ইয়াপুর বোন সেই নদীর জল তুলে রাখে বিশাল বিশাল কলসিতে। যখন পৃথিবীতে বৃষ্টির প্রয়োজন দেখা দেয়, মেঘদেব তার বিশাল গুলতি দিয়ে পাথর ছুড়ে মারেন কলসির দিকে। পাথরের আঘাতে গুরুগম্ভীর বজ্রের আওয়াজ হয় এবং কলসি ভেঙে চৌচির হয়ে যায়। আর তখনই ঝরঝর করে বৃষ্টি নামে মহাকাশ থেকে। ভিরাকুচা মেঘদেব ইয়াপুকে আদেশ দেন অবিরল বৃষ্টি ঝরিয়ে পৃথিবীকে মহাপ্লাবনে ভাসিয়ে দিতে। যাতে দুষ্ট মানবকুল নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ‘উনু পাচাকুতি’ সেই মহাপ্লাবনের নাম। নুহের প্লাবনের চেয়েও বড় অথবা তার সমান। সমস্ত পৃথিবী তলিয়ে যায়, অ্যান্ডিজের চূড়া ব্যতীত। সেখানেই আশ্রয় নিয়েছিল কিছু লামা ও আলপাকা। তারাই রক্ষা পায়। কিছু কিছু দুর্বৃত্তকে ভিরাকুচা নিজেই পুনরায় বিশাল বিশাল পাথরে পরিণত করে দেন। বাকি সব মারা যায়। 

কিন্তু সবাই সৃষ্টিতত্ত্বের এসব কথা মেনে নেয় না। তর্ক করে। বলে ভিরাকুচার ২ ছেলে ইমাহমানা ও তোকাপো। মহাপ্লাবন শেষ হবার পরে তিনি যখন নতুন মানুষ সৃষ্টি করেন, পুত্রদ্বয়কে পাঠান ‘উত্তর-পূর্ব’ ও ‘উত্তর-পশ্চিমে’ খোঁজ খবর নিতে যে সেখানকার লোকজন তার কথামতো চলে কিনা।

তিনি নিজে যেতে শুরু করেন উত্তর দিকে। একজন মাঝারি সাইজের শাদা মানুষের অবয়ব তার। গায়ে ধবধবে শাদা পাঞ্জাবি, কাঁধে ঝোলা, হাতে বই। পিতা ও পুত্রদ্বয় তিন পথে যেতে যেতে প্রতিটি বৃক্ষ, ফুল, ফল ও ঘাসের নামকরণ করেন। জাতিসমূহকে লতাগুল্মের কোনটি খাদ্য, কোনটি ঔষধি আর কোনটি বিষ তা শিখিয়ে দেন। শেষ পর্যন্ত তিনজনেই এসে উপস্থিত হন কুস্কো শহরে। মানুষের মধ্যে সভ্যতার আলো জ্বালিয়ে দেন। অবশেষে তারা প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে লম্বা লম্বা পা ফেলে নিরুদ্দেশ হয়ে যান। বলে যান সাবধান : ‘কোনও একদিন আমাদের বেশ ধরে প্রতারকরা আসবে, ফর্সা চুল, ফর্সা ত্বক। দাবি করবে আমরাই ফিরে এসেছি। কিন্তু বিশ্বাস করো না ওদের। আমরা শুধু যাই, আসি না।’

ভিরাকুচা শব্দের অর্থ―সমুদ্রের ফেনা। তিনি সমুদ্রে তলিয়ে গিয়েছিলেন, না ভেসে গিয়েছিলেন তা নিয়ে চূড়ান্ত সমাধান এখনও হয়নি। কিন্তু মানুষ ভুলে গিয়েছিল তার কথা। ওদের মুখেও লেখা নেই যে, প্রতারক। বরং চেহারা সুন্দর, হাতে ক্রুশ ও পবিত্র পুস্তক। ক্রুশে  ঝোলানো একজন মানুষ, আহা! বাকি সব মানুষের মতোই।

আনাবেলা দে লা রোসা বলেছিল অন্য কথা। ঈশ্বরের সীমানার বাইরে, লেনিনগ্রাদ শহরে সে ছিল আমার ক্লাসের বান্ধবী। যেহেতু সদ্য দেশ থেকে আসা, সে রুশ জানে না এবং আমিও তাই। আমরা ক্লাসের শেষে একে অন্যের কাছে ভাষা শিখতে যাই। ওর গাল আপেলের মতো মসৃণ, সুন্দর ও সাদায়-গোলাপিতে শিল্পীর পোঁচ দেওয়া। ঠোঁটগুলো আনার দানা, গাঢ় ও সতেজ। লম্বা অক্ষিপক্ষে অ্যান্ডিজ পাহাড়ের কুয়াশা। বেশ লম্বা সে, আমার মতো প্রায়, অর্থাৎ আলিঙ্গন করতে গেলে আমার মুখ ওর বুকে না ঠেকে, বুক বরং বুকেই মেশে। প্যান্ট আর শার্ট পরে, বালুঘড়ির মতো দেহের উপরাংশ ক্রমে সরু হয়ে কোমর যেখানে হারিয়ে যেতে শুরু করেছে দক্ষিণে, সেখানে সে চকচকে ও টাইট একটি বেল্ট পরে শার্ট ইন করে। ক্ষীণ কটি আরও ক্ষীণ মনে হয়। বুকের ভরাটত্ব ঠিক ততখানিই যতটুকু হলে ভিরাকুচা ঈশ্বর তার সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে তুষ্ট হতে পারতেন। গায়ে কেচোয়া ও কর্দোভার রক্ত, কুস্কোতে জন্ম, কুস্কোতেই বেড়ে ওঠা মেয়ে। শহরটি সম্পর্কে আমার কোনওই ধারণা ছিল না, এমনকি এই নামে যে একটি শহর আছে তাও জানতাম না। আনাবেলার বাপ-মা দুজনই ‘তুপাক আমারু রেভ্যুলিউশনারি মুভমেন্ট’ বা এমআরটিএর সক্রিয় সদস্য। স্বদেশে যে সমাজতন্ত্রিক সমাজ গঠনের স্বপ্নে মগ্ন তারা, মেয়েকে পাঠিয়েছে তার বাস্তব অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য। বয়স অল্প হলেও দেশপ্রেমে সে ছিল তার সৌন্দর্যের চেয়েও তীব্র এবং বিপ্লবের বিজয়ের বিশ্বাসে তীক্ষè।

It is sweet and glorious to die for oneÕs country―কবি হোরেসের মতো করে বলত সে। ধারণা করি, অত অল্প বয়সে হোরেস সে পড়েনি, আমি নিজেই পড়িনি, যদিও পড়ুয়া আমি খেলো নয়। সে নিশ্চয়ই বাবা-মায়ের কাছ থেকে শুনেছে। আর দেশের জন্য প্রাণ দিতে যে প্রস্তুত, দেহ নিয়ে মাতামাতি তার মানায় না, অন্তত অনেক দিন মানায়নি।

স্বদেশের ইতিহাস, মিথ, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিষয়গুলোর সঙ্গে ছিল সে খুব ভালোভাবে পরিচিত। কুস্কো শহরের গল্প করত ফনফনে পুঁইডগার সজীবতায় কিন্তু আমাদের শরীর ও সত্তার সবকিছু তখন টানটান, স্থির সম্মোহনের উত্তর ও দক্ষিণে ওর ঠোঁটের গল্পের চেয়ে, ঠোঁটগুলোই মনোযোগ কাড়ত বেশি। লেডি, ‘ফর গডস সেইক, হোল্ড ইউর টাঙ এন্ড লেট মি লাভ।’―মনে মনে বলতাম।

ঠোঁটে ঠোঁট লাগলে কথা থেমে গিয়ে গল্পে ছেদ পড়ত।

‘বাচ্চাদের মতো দুষ্টামি করো না তো!’ রাগ করত কিন্তু ঠিক রাগ নয়, অন্য কিছু। কে শোনে কেচোয়া সৃজনতত্ত্বের গল্প, বাচ্চাদের মতো দুষ্টামি করতেই ইচ্ছে হয় বেশি। হাত চলে যায় যেখানে যাবার নয় সে সব জায়গায় এবং বেশি বেপরোয়া হলে, ‘পড়াশুনো আছে’ বলে প্রিভিসের ভারী এনাটমি বইটি হাতে নিয়ে চলে যায়। তবে চাঁদ যেমন ফিরে ফিরে আসে, নদীতে যৌবন ও জোয়ার নিয়ে, সেও আসে নম্র ও আদুরে আলপাকার মতো।

‘ভিভা রেভুলিউৎছিয়া!’ আমি সেøাগান দিই, আর ঠোঁট উঁচিয়ে এগিয়ে যাই।

কীই না সুন্দর ছিল বিপ্লব বিপ্লব খেলার দিনগুলো!

ওর মুখেই শুনেছি সূর্যদেব ইন্তি এবং চন্দ্রদেবী ‘মা কিয়া’র কথা। একটি পুত্রসন্তানের জন্ম হয়েছিল তাদের, নাম ‘আইয়ার মানকো’। সূর্যদেব তার নাম পরিবর্তন করে রাখেন ‘মানকো কাপাক’। কিন্তু সন্তানকে যাতে সুন্দর পৃথিবীতে একা ও নিঃসঙ্গ থাকতে না হয়, ইন্তি যত্ন করে তার জন্য একজন নারী সৃষ্টি করেন। একজন অপূর্ব সুন্দর মানবী। তার বুকে মধু, যা দৃষ্টির ও দেহের তৃষ্ণা মিটায়। তার দেহে দেন উষ্ণতা যা শীত রাতে পৈলব বিতরণ করে। নাম তার ‘মা ওকিও’।

তাঁরা তিতিকাকা হ্রদের গহিন থেকে উঠে আসেন। পুবে বলিভিয়া এবং পশ্চিমে পেরুর সীমান্তে অবস্থিত অ্যান্ডিজ পর্বতের এই হ্রদটি দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় হ্রদ এবং সমুদ্র উপকূল থেকে সবচেয়ে উঁচু, ১২৫০৭ ফুট উচ্চতায়। তিকিনা প্রণালি দিয়ে সংযুক্ত আসলে দুটি হ্রদ মিলিয়ে একটি, ২৭টি নদী সে গ্রহণ করে, ৪১টি দ্বীপ ফেরত দেয়।

এর অন্তঃস্থল থেকেই উঠে আসেন তারা মানুষকে সভ্যতার আলো পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হাঁটতে শুরু করেন অকুমারি পৃথিবীর পথে পথে। মানকো কাপাকের হাতে ‘টোপাক ইয়াউরি’―পিতার তৈরি জাদুর স্বর্ণদণ্ড। পিতাই বলে দিয়েছেন, তাদের যেতে হবে অনেক দূরে। সেই স্থানের সন্ধানে যেখানে মাটি এতই উর্বর যে স্বর্ণদণ্ডটি গাথার সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে দেবে অদৃশ্য হয়ে যাবে। সেখানেই তারা শহর প্রতিষ্ঠা করবে এবং স্থাপন করবে ইন্তির নামে পবিত্র মন্দির।

অনেক পথ ঘুরে, অনেক পাহাড়, পর্বত, নদী ও মাঠ অতিক্রম করে তারা মনোরম এক উপত্যকার হুয়ানাকাউরি পাহাড়ে এসে পৌঁছান। স্বর্ণদণ্ডটি মাটিতে গেথে মানকো এদিক সেদিক তাকিয়ে স্থানটির সৌন্দর্য উপভোগ করেন। চারিদিকে পাহাড়েরা দাঁড়িয়ে আছে নির্বাক। দূরে রৌদ্রে ঝলমল করছে চিকুন পাহাড়ের তুষার-শুভ্র শৈলশির। একটি নদী পাহাড়েদের ভাষা মুখে নিয়ে ছুটছে যৌবনবতী। নাম তার উরুবাম্বা। কী তার আনন্দ আর পাথরে পাথরে বুকের পরশের খিলখিল। ‘মা ওকিও’র শরীরে যে মাদকতা, তারই অনিন্দ্যতার বৈভব উরুবাম্বার শরীরে। হাওয়া গড়িয়ে গড়িয়ে লুটোপুটি খায় মাঠে, আর ঘাসে, আর গাছে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় তার নম্র কোমল হাত। তিনি মুগ্ধ হন কিন্তু মুগ্ধতাই শেষ কথা নয়, যেতে হবে আরও দূরে। কতটা তিনি নিজেও জানেন না। বড় দায়িত্বের কাজ দিয়েছেন পিতা, বোঝা কিন্তু হাল্কা করে দেননি তার ভার। নতুন করে পথ শুরু করতে স্বর্ণদণ্ডটি হাতে তুলে নিতে যান। আশ্চর্য, কোথাও নেই! মাটিতে দেবে নিখোঁজ হয়ে গেছে। মাটির গহিনে চলে যাওয়া ছিদ্রটি দেখতে পান। তার বিশ্বস্ত ‘টোপাক ইয়াউরি’ যেন ফিস ফিস করে পৃথিবীর গহিন থেকে বলছে, ‘এখানে, এখানেই।’

তিনি বুঝতে পারেন এই তার পিতৃ নির্দেশিত স্থান যেখানে স্থির হতে হবে। তার স্বর্গীয় অবয়ব, ধী ও প্রজ্ঞা দিয়ে স্থানীয় লোকজনদের মন জয় করেন। তাদের নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন ইন্তির মন্দির ও একটি শহর।

কুস্কো শহর।

কুস্কো শব্দের অর্থ পৃথিবীর ‘নাভি-পদ্ম’। কারণ কুস্কোই হলো পৃথিবীর কেন্দ্র। লোকজন তখন গুহায় বাস করত। তিনি তাদের শহরে বাস করতে শেখান। লোকজন শিকার এবং ফলমূল সংগ্রহ করে জীবন ধারণ করত। তিনি তাদের চাষাবাদ করতে শেখান। শেখান আগুনের ব্যবহার, কাপড় বোনা, হাতিয়ার তৈরি, শত্রুর আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা করার কলা-কৌশল। একে অন্যের সঙ্গে ভাববিনিময় করার লক্ষ্যে সৃষ্টি করেন অনিন্দ্য কেচোয়া ভাষা। এখন এরা শুধু পাথরে আঁচড় কেটে ছবি আঁকে না এবং পরস্পরের দিকে শুধু তাকিয়ে থাকে না, মুগ্ধ দৃষ্টি নিয়ে বরং উচ্চারণ করে, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি।’ পৃথিবীর সুন্দরতম বাক্য। আর মনোজগতে সৃষ্ট অনুভূতিকে নদী, আকাশ, পাখি, মেঘ ও পাহাড়ের চিত্রকল্পে বুনে কবিতার সৃষ্টি করে। আর সংগীত। সেই কবিতায় ও সংগীতে থাকে নারীর ও পুরুষের হৃৎস্পন্দনের শব্দ প্রবাহিত নদীর ছন্দের মতো।

মানকো শেখান পশুর মতো করে নয়, প্রেমমুগ্ধ প্রকৃতির মতো নম্রতায় নারীকে ভালোবাসতে।

কী করে পুরুষকে ভালোবাসতে হয় ‘মা ওকিও’ শেখান নারীকে তার অনুভূতির তীব্রতায়।

আনাবেলা বলত, তে আমো! আমি বুঝতে পারতাম না।

যখন রুশ ভাষায় অনুবাদ করত, ইয়া তিবিয়া লুবল্যু, আমার ওকে ‘মা ওকিও’ মনে হতো।

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা।

এই মানকো কাপাকই হলেন প্রথম ‘সাপা ইনকা’ বা কেচোয়াদের প্রথম সম্রাট। তিনি আইন-বিধি সৃষ্টি করেন এবং দেবতাদের উদ্দেশ্যে মানববলি রদ করে দেন।

সারা রাত জেগে থাকার পর সৃষ্টিরহস্যের এই জটিলতায় আধা ঘুম আধা তন্দ্রায় মনে হয় আকাশের বায়ু গর্তে প্লেনে দুলছি। মগজে কোথায় যেন কে গাইছে ‘না চাহিলে যারে পাওয়া যায়…’ অঞ্জনা নদীর তীরে খঞ্জনা নামের গাঁয়ের যে প্রতিবেশী রঞ্জনার কথা বলেছিলেন কবিগুরু, সেই তারই মতো অনিন্দ্য এক প্রতিবেশীর ম্যাগনেটিক বলয়ে আমি। ইনকা সম্রাজ্ঞীর চেয়েও সুন্দর ও বিশুদ্ধ মানবী সে। তার নরম আফিম ফুলে মুঠি পূর্ণ করে ‘মা ওকিয়া’র দেহ নিস্বরিত আলোয় ঘুমিয়ে আছি।

না, ঘুমিয়ে নেই, কার হাসি মুখ দেখে বকুল ফুলের সকালে জেগে উঠেছি। কিন্তু বকুল তো ফোটে অনেক দূরে, সেই ফুলের ঘ্রাণ এল কোথা থেকে ? কোথায় আমি, আর বকুল ফোটে কই ? ভেবে ভেবে দিন গড়িয়ে যায় এবং আকাশে চন্দ্র-সূর্য যেমন, গ্রীষ্মের দুপুরে দমকা হাওয়া যেমন, জ্বর ও মাথা ব্যথায় ললাটে কোমল হাত যেমন, তেমনি সে ঘুমিয়ে আছে শুভ্র মেঘ-বালিশে মাথা রেখে। আর তার গালে ও বাদামি চুলে ইন্তিদেবীর হাসির বিচ্ছুরণ। সে পাশে না থাকলে চাঁদ উল্টোপিঠ দেখিয়ে হাঁটে, আর লামা আলপাকাগুলো দূরে পালিয়ে যায় নিরীহ আদুরে মুখ নিয়ে।

কিন্তু পাশে সে নয়, অন্য কেউ এবং আমরা মহাকাশের মহাগহ্বরে কোথায় যেন হাঁটছি। কেউ কারও সঙ্গে মুখে কথা কয় না, চোখে চোখে কয়। স্পষ্ট টের পাই চাঁদের কিরণের মতো অনপনেয় মসৃণ কোমলতা তার। উইলোর মতো সমস্ত পাতা ঝেড়ে সে কাছে আসে আর আমি বোবা বিস্ময়ে নোনা অনুভূতি হয়ে গলে যাই। নক্ষত্র নক্ষত্রে মিলতে পারে না, মহা বিস্ফোরণ ঘটে কিন্তু কী সৌভাগ্য যে, না আমি, না সে, কেউ নক্ষত্র নয়।

মা ওকিওর মতো করে সে বলে, ‘তে আমো!’

আমি ভাষা খুঁজে পাই না বরং তারই কথা ফিরিয়ে দিই, ‘তোমাকে ভালোবাসি’ এবং তাকে উরুবাম্বা নদী ভেবে অবগাহনে নামতে যাই অথবা হলুদ ধানের শীষে পূর্ণ মাঠের মতো অপার স্নেহে কাছে টেনে বলি, ‘তুমি আমার ধানখেত, প্রিয়!’

সে হাসে।

কুস্কোর বাতাস ও বুনো হাঁসের হাসির মতো সেই হাসি, চকিতে মিলিয়ে যায়।

আনাবেলা দে লা রোসা!

নিঃশব্দ চিৎকার করে জেগে উঠি। জানালা দিয়ে দেখি দূরে অ্যান্ডিজ পাহাড়ের ওপরে চাঁদের আলো খেলছে কেচোয়া শিশুদের মতো আর ছোট ছোট পায়ে দাঁড়িয়ে আছে চারটি অতি সুন্দর আলপাকা।

চোখে চোখ পড়ে।

পুরূরবা ও উর্বশীর দৃষ্টি বিনিময়ের মতো দৃষ্টি নয়। পুরূরবা সূর্যের প্রতীক আর উর্বশী ভোরের কুয়াশা। পুরূরবা তাকালে উর্বশী বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু রূপসী আলপাকারা ঠায় দাঁড়িয়ে চোয়াল আর বেণী নাড়ে। আমি মাথা চুলকাই, কী যেন মনে করতে চেষ্টা করি, মনে আসে না, তখন ফালতু একটা প্রশ্ন করি, ‘মানকো কাপাক তার স্বর্ণদণ্ডটি কোন মাটিতে গেঁথেছিলেন, জানো ?’

যেন ওটা আমার না জানলেই নয়।

ওরা কোনও ভ্রƒক্ষেপই করে না, চার সখী নিয়ে স্নানরতা হংসবেশী উর্বশী যেমন ছিল পুরূরবার আকুল আবেদনে ভ্রƒক্ষেপহীন। তাচ্ছিল্যের নিম চিবিয়ে চোয়াল নাড়তেই থাকে ওরা। আকাশে চিল উড়ছে একটা, চক্রাকারে, পাহাড়, পাইন ও পাইথনের থাবার বাইরে। বড়ই সজ্জন সে। বলে ‘উরুবাম্বা নদীর তীর ধরে হেঁটে যাও, পাবে সেই শহর, যার কেন্দ্রবিন্দুতে বাইবেল হাতে জল্লাদেরা তুপাক আমারুর শিরñেদ করেছিল।’

‘প্লাসা ডে আর্মেস’―কণ্ঠটি হঠাৎ চেনা মনে হয়, চিল নয় দূরাগত আনাবেলার কণ্ঠ!

‘প্লেইস অব টিয়ার্স!’

আমি সত্যে সন্দিহান এবং শেষ বিচারে মিথ্যায় বিশ্বাসী। একবার মিথ্যা বলে, ধরতে পারি, দুবার বলে, তাও চোখে পড়ে কিন্তু যখন বার বার মিথ্যা বলে এবং ক্ষমতার যে যেখানে আছে, সেখান থেকে সবাই মিলে বলে, তখন আর মিথ্যাকে ধরতে পারি না, বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র কী ? বেশির ভাগ যা বিশ্বাস করে।

বেশির ভাগ কী বিশ্বাস করে ? যা সমস্বরে বিশ্বাস করানো হয়।

কী বিশ্বাস করানো হয় ?

গণতন্ত্র-আইনের শাসন।

‘আইন হচ্ছে মাকড়সার জাল, দুর্বল ও দরিদ্রকে ঠিকই আটকাবে কিন্তু ধনী ও ক্ষমতাশালীরা তা ছিন্ন করে বেরিয়ে যাবে।’ সাইথিয়ান প্রাচীন দার্শনিক অ্যানাখারসিস বলতেন। আইনহীনতায় সত্য নগ্ন হয়ে হাঁটে, আমরা সহ্য করতে পারি না। আমরা তাই আইনের কাছে যাই কারণ আইন আইনহীনতার চেয়ে ভালো। কিন্তু আইন নিরপেক্ষে নয়, মিথ্যা-মুক্ত নয়।

Europe is a garden. We have built a garden. The rest of the world is not exactly a garden. Most of the rest of the world is a jungle. The jungle could invade the garden. The gardeners should take care of it… The gardeners have to go to the jungle.

এই হলো মোদ্দা কথা―পুরনো ও নতুন ইউরোপের মটো, তাদের জঙ্গলে যেতে হবে!

জঙ্গল কী ?

যেসব দেশ ইউরোপের বাইরে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্র চিফ জোসেফ বরেল কথাটিই বলেছেন ব্রাসেলসে থেকে কিছু দিন আগে।

ব্রাসেলস কী ?

ইউরোপীয়ান ইউনিয়ন এবং সভ্যদেশ বেলজিয়ামের রাজধানী। এই বেলজিয়ামেরই রাজা লিওপোল্ড-২ বেলজিয়ামের চেয়ে ৭৫ গুণ বড় কঙ্গো দেশটি তার ব্যক্তিগত জঙ্গল মনে করত এবং তার জনগণকে দাস হিসেবে বন্দি করতে, নিপীড়ন করতে, হত্যা করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করত না। লক্ষ লক্ষ মানুষের হাত কেটে নিয়েছে কোটামতো রাবার সংগ্রহ করতে পারেনি বলে। ন্যূনতম এক-দেড় কোটিও হতে পারে, মানুষ হত্যা করেছে সে। 

এই ব্রাসেলস এখন বিশ্বব্যাপী মানবতার ‘ঐশীবাণী’ পরিবেশন করে।

‘এইসব দেখিয়া শুনিয়া ক্ষেপিয়া গিয়া’ যেহেতু বিশ্বাসে আমার অবিশ্বাস, আনাবেলার ভিরাকুচা ঈশ্বরের কথাও আমি বিশ্বাস করিনি। কদিন পরে লিমার মিউজিয়ামে গিয়ে জানলাম ভিরাকুচা ঈশ্বরের জন্মের আগেও মানুষ ছিল পেরুতে। কিছু কিছু জাতি ছিল বেশ সভ্য। সুতরাং ‘মানকো কাপাক’ ও ‘মা ওকিও’র মানুষকে সভ্যতা শেখানোর ব্যাপারটা অতি সুন্দর একটি উপকথা। উপকথা আর কিছু নয়, জাতিগুলোর শিরা উপশিরা দিয়ে ঝর্নার মতো যেসব চিন্তা বয়, মগজের অরাল ও জটিল আল বেয়ে যে অনুভূতি ও বিশ্বাসগুলো হাঁটে, অজানাকে ব্যাখ্যা করার যে আকুতি বুকের ভেতর, তাই মূর্ত হয় মিথ ও উপকথায়। ওখানে বিশ্বাস অবিশ্বাসের প্রশ্ন অবান্তর।

এখন আমি আনাবেলা দে লা রোসার শহরে, তার বলা বিশাল উপকথা ও ইতিহাসের প্রান্তরে আবিষ্ট হয়ে হাঁটছি। রাস্তাগুলো সরু সরু, পরিচ্ছন্ন, পাথর বসানো, সুন্দর সুন্দর ইমারত, গায়ে তাদের বয়স, বিগত বৈভব ও গাম্ভীর্যের ছাপ। লোকজন ছুটছে, কেউ এই দিকে তো কেউ ওই দিকে।

দূরে পাহাড়গুলো নির্জন দাঁড়িয়ে সন্ধ্যার সংবাদ পাঠাচ্ছে। একটির মাথা ফুঁড়ে আসছে দিনের শেষ রশ্নি। আলো জ্বলে উঠছে ঘর-বাড়িগুলোতে।

একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকি। দোতলার ওপর, সুন্দর ছিমছিমে। আলো ম্লান করা।

শীতল বিয়ারে গলা ভিজিয়ে বসেছি।

অর্ডার নিচ্ছে মেয়েটি।

আমি তার মধ্যে আনাবেলাকে খুঁজি। কী তার নেই এবং কী আনাবেলার ছিল। মনে থাকে না যে আমার নিজেরই মাথার চুল হাল্কা হয়ে এসেছে এবং আমার কন্যার বয়েসী কোনও মেয়ের মধ্যে আমি আনাবেলাকে খুঁজে পাব না। অবচেতন মনে কাবুলিঅলার বিভ্রম কাজ করে, ঠিক আনাবেলা নয়, কুস্কো। কুস্কো নামের উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গে মুখটি ফুটে ওঠে যার, চোখ খোঁজে তাকেই, সময়ের হিসাব করে না। পুশকিনের রূপকথার ‘এক যে ছিল রাজকুমারী’র মতোই অপরিবর্তনশীল সে, দীপ্র ও তন্বী।

না, রূপের সাযুজ্য ছাড়া কিছুই খুঁজে পাই না মেয়েটির মধ্যে। সে ইতোমধ্যেই অন্য সবার অর্ডার নিয়েছে।

তুমি কী খাবে ?

আলপাকার মাংস, বেকড পটেটো আর বাটার।

আর একটা বিয়ার দেব ?

না, বরং মার্গারিতা দাও।

পানীয়টা সুস্বাদু।

স্বর্গে গিয়ে পানি খাব না, পানীয়তেই ডুবে থাকব তো, একটু আধটু অভ্যাস রাখা ভালো―রুশ বন্ধু আন্তোনভ বলত।

আমাদের ক্লাসের সবচেয়ে ভোঁতা-বুদ্ধিমান এবং একমাত্র পার্টি মেম্বার। খুব পড়াশোনো করত কিন্তু মনে রাখতে পারত না।

তুই বিদেশি, রুশভাষা ইয়েলে ইয়েলে জানিস, পড়া মনে রাখিস কেমনে, আমি তো পারি না।

তুই গাধা পার্টিতে নাম লিখিয়েছিস বলে, জানিস না ওখানে সব সুবিধাবাদী ? ফিসফিস করে বলি।

সে ঘুষি মেরে আমার ফিজিওনমি ফ্ল্যাট করে দিতে পারত কিন্তু দেয়নি।

‘না, তুই ঠিক বলিস নাই, সবাই সুবিধাবাদী না। আর কাউকে না কাউকে তো পার্টি করতেই হবে, না হলে দেশ চলবে কী করে ?’―বলত, আর হাসত। যা বলত, বিশ্বাসও করত।

বন্ধু একেই বলে।

ওরও আনাবেলাকে খুব পছন্দ।

“এই, তোদের দেশের মেয়েরা এত সুন্দর, ‘ছাড়ি’ পরে হাটে, দেখতে পরির মত লাগে, তুই আনাবেলাকে ছাড়বি কবে ?”―এক দিন ও প্রশ্ন করে।

‘বৃষ্টির পরের বৃহস্পতিবার অথবা যেদিন গলদা চিংড়ি শিস দেবে।’

‘বাহবা, তুই আমাদের প্রবাদগুলোও শিখে ফেলেছিস ?’

‘শিখতেই তো এসেছি, স্পেকুলেশান করতে তো নয়।’

ও মাথা নাড়ায়, ‘ঠিক, ঠিকই বলেছিস। বিদেশি ছাত্রদের নিয়ে এ আমাদের বড় সমস্যা। পড়াশোনা করার চেয়ে চোরাচালানি বেশি করে।’

আশির দশকের শুরুর সময়টা।

আমরা ‘র’ ভদকা গিলি আর শসার পিকল খাই এবং সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির ২৬তম কংগ্রেস, বিশ্ব পুঁজিবাদের পতন ও বিভিন্ন দেশে বিপ্লবী আন্দোলনের জয়-জয়কার নিয়ে কথা বলি।

পুঁজিবাদের কুপোকাত হতে আর বেশি সময় নেই―আন্তোনভ বলে।

আমি মাথা নড়াই।

‘অত আশাবাদী হয়ো না, মরণ কামড় না দিয়ে পুঁজিবাদ যাবে না’―আনাবেলা বলে। ‘জার্মানির কথা মনে নাই, কীভাবে ওরা রোজা লুক্সেমবুর্গ ও কার্ল লিবখেনকটের মতো নেতাদের বিপ্লবকে ধ্বংস করে তাদের হত্যা করল ?’

’৬০-এর দশক থেকেই পেরুতে তুমুল গৃহযুদ্ধ চলছে, ঐ সময়ে তা ছিল খুবই তীব্র। একদিকে সরকার, অন্যদিকে শক্তিশালী মাওবাদী ‘সেন্ডেরো লুমিনোসো’ বা ‘শাইনিং পাথ’, তার মার্ক্সিস্ট-লেনিনিস্ট প্রতিদ্বন্দ্বী ‘তুপাক আমারু রেভ্যুলিউশনারি মুভমেন্ট’ এবং কমিউনিস্ট পার্টির ‘পিপলস গেরিলা আর্মি।’

আনাবেলা গল্প করে।

ওর মা-বাবা দুজনেই যুদ্ধরত এই গ্রুপগুলোর কোনও একটিতে। সে যেহেতু মস্কোতে, তাই পিপলস গেরিলা আর্মিতে হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি কিন্তু সে কখনও তা প্রকাশ করেনি। কিন্তু ওর উৎকণ্ঠা ধরা পড়ত চোখে মুখে ও কথায়। দীর্ঘ দিন মা-বাবার চিঠি আসত না। বেঁচে আছে কি নেই, তাও ছিল অনিশ্চিত। কিন্তু টেরাকোটা শক্ত ছিল সে। বাইরে টুপটুপ করে বৃষ্টি পড়ে মেপল গাছের পাতায় কিন্তু ওর আঁখি ঝুরে বুকের গহিনে।

গ্রীষ্মের ছুটিতে অনেকেই দেশে যায়, ও যেতে পারে না। আমিও যেতে পারি না, তবে যুদ্ধের কারণে নয়, টাকা নেই। বৃত্তির টাকায় খেয়ে-পরে দু-চার বোতল ভদকা কেনা যায়, এরোফ্লতের টিকেট নয়। আন্তর্জাতিক বিপ্লবী ভ্রাতৃত্ববোধ ও সহমর্মিতায় একে অন্যকে বুকে ধরে রাখি।

পেরুর মাটিতে নরক হাঁটছিল। অন্ধকারের তলকুঠুরি উঠে এসেছিল ওপরে।

‘তোমাদের বিপ্লবীরা কি সঠিক পথে আছে ?’

প্রশ্ন করি।

‘নিঃসন্দেহে’―স্পষ্ট উত্তর।

‘আমাদের দেশেও অনেক বিপ্লবী পার্টি ছিল, নকশাল, সর্বহারা, গণবাহিনী। সমাজতন্ত্রের কথা বলত, মার্কস, লেনিন, স্তালিন, মাও ছিল তাদের ঠোঁটের আগায় এবং তারাও নিশ্চিত ছিল যে, সঠিক পথে আছে। তারা খালি মানুষ মারত, ছোটখাটো জোতদার, চেয়ারম্যান, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী, পুলিশ। প্রয়োজনে মারত, অপ্রয়োজনেও মারত। কখনও কখনও মারত শুধুই একঘেয়েমি কাটাতে এবং সবচেয়ে বেশি মারত স্ব স্ব এবং প্রতিদ্বন্দ্বী পার্টির কমরেডদের।

মানুষ তুচ্ছ, হত্যাই বিপ্লব, হত্যাই সমাজতন্ত্র। আগের প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারক এবং বুদ্ধিজীবীদের মূর্তিরও গলা কাটতো প্রতিক্রিয়াশীল আখ্যা দিয়ে। অথচ ক্ষমতাসীনরা, শাসকরা, শোষকরা তাদের স্পর্শের বাইরে থেকে যেত। নির্বিচার হত্যা কি মানুষকে বিপ্লবের প্রতি বিতৃষ্ণ করে তোলে না ?

‘তোমার কথা শুনে মনে হয় তুমি বুর্জোয়া প্রোপাগান্ডা দিয়ে প্রভাবিত। এই যারা বিপ্লবের স্বপ্ন দেখে এবং বিপ্লবের লক্ষ্যে জীবনের তোয়াক্কা না করে ঘরবাড়ি ছেড়ে যায়, তোমার কী মনে হয়, তারা যায় নিজের কথা ভেবে, না অন্যের ?’

‘নিজের কথা ভাবে যারা, তারা সংসারী।’ 

‘অন্যের কথা ভাবে যারা, তারা নির্বোধ ? হয় তুমি এদের সম্পর্কে কিছুই জানো না, নয় অতিরঞ্জন করছো।’

‘না, এরা নির্বোধ নয় এবং আমি যা বলছি তাও অতিরঞ্জন নয়। এরা ঠান্ডা মাথায় খুন করাকে বিপ্লব মনে করে। এত এত মানুষ মেরে এরা নিজেদের বারুদে নিজেরাই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, বিপ্লবের চিহ্নটুকুও আমাদের দেশে নেই। ভয় পাই, তোমাদের দেশেও শেষ পর্যন্ত তা না হয়।’

১৯৮৫ সালের আগস্ট মাস।

জানালার বাইরে ঝর ঝর ঝরছে অবিরল। অপরাহ্ন। নেভা নদী দিয়ে ধীর গতিতে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে এগিয়ে যাচ্ছে ত্রিপলঢাকা একটি মালবাহী বার্জ। সেই দিকে চুপ করে চেয়ে আছে সে। চোখে মুখে তীব্র এক অভিব্যক্তি। হাতে চিঠি।

‘মন খারাপ ?’

মাথা নাড়ে।

‘কী হয়েছে ?’

‘পেরুর মিলিটারি একটি গ্রাম ঘেরাও করে নারী, পুরুষ, শিশুসহ প্রায় ৭৫ জন নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।’

আমি ওর পিঠে হাত রাখি। কিছু বলার শব্দ খুঁজে পাই না।

কিন্তু বিপ্লব নিয়ে আমার দোদুল্যমানতা এবং বিপ্লবীদের প্রতি আমার অবিশ্বাসের যেন একটি কঠিন উত্তর ছুড়ে মারে সে, ‘আমেরিকার চোয়ালের ভেতরে আমরা, তোমার দেশের মতো পাতি বুর্জোয়া বিভ্রান্তির বিলাসিতা করার সুযোগ আমাদের নেই, আমাদের জয়ী হতে হবেই।’ তার চোখে বাঘিনীর অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

পড়াশুনো শেষ হয়ে যায় ১৯৮৯ সালে, সোভিয়েত ইউনিয়ন মৃত্যুশয্যায়। সারা জীবন যেসব মানুষ সমাজতন্ত্র গড়েছে, কষ্ট করে সঞ্চয় করেছে, সুখী ভবিষ্যৎ ও মহান সোভিয়েত দেশে বিশ্বাস করেছে, তারা এখন বিভ্রান্ত, ক্ষুধার্ত।

গর্বাচভ ব্লিয়াৎ! আমাদের মহান মাতৃভূমিকে বিকিয়ে দিয়েছে। এবং পেরুতে যুদ্ধের তীব্রতা বেড়েই চলছে, দু পক্ষেই মানুষ মরছে প্রচুর।

‘দেশে তো যেতে পারবে না। চলো বাংলাদেশে চলে যাই।’

‘না, তা হয় না। বাবা-মা, পার্টি ডেকেছে। দেশে ফিরে যেতে হবে। প্রচুর আহত যোদ্ধা, তাদের চিকিৎসা করার নিজস্ব ডাক্তার নেই।’

‘এ তো মৃত্যুফাঁদ!’

‘মৃত্যুফাঁদ নয়, বিপ্লব, শোষণমুক্তির যুদ্ধ।’ সে সংশোধন করে দেয়।

‘কিন্তু এখানে, সোভিয়েত ইউনিয়নে কী হচ্ছে দেখতেই পাচ্ছ, সবকিছু ভেঙে পড়ছে, বিষয়টা এত সাদামাটা সহজ নয়, ভেতরে গলদ আছে।’

সে অনড়।

আলবের্তো ফুজিমোরির সরকার ক্ষমতায় আসে ওর চলে যাবার ঠিক ১ বছর পরে। ‘কলিনা গ্রুপ’ ও ‘রদ্রিগো ফ্রাঙ্কো কমান্ড’ নামে ডেথ স্কোয়াড তৈরি করে শুরু করে কিডন্যাপ, গুপ্তহত্যা ও মেধযজ্ঞ। রক্ত, রক্ত, রক্ত। হাজার হাজার বিদ্রোহী এবং নিরীহ মানুষ নিহত হতে থাকে। এতকাল যারা নরক নরক করে চিৎকার করেছে কিন্তু আসল নরক দেখেনি, এবার তারা দেখে রৌরব, মহারৌরব, কুম্ভীপাক―২৮টি নরক হাট করে দরজা খুলে বসে আছে। তাদের তিন মাথার পাহারাদার সেরবেরাস (Cerberus) ভয়ে পালিয়ে গেছে। যার ইচ্ছে ঢোকো। যার ইচ্ছে ফুজিমোরির নরকে নিঁখোজ হয়ে যাও।

‘আর একটা মার্গারিতা দিই ?’ মেয়েটি প্রশ্ন করে।

‘দাও।’

ভালো লাগছে। নম্র আবহে গানের দল গান গাইছে প্রাণ-ছোঁয়া কোনও লোকসংগীত এবং মেয়েটির উন্মুক্ত ঊরু এবং উন্নত বুকে বাড়ি খেয়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে করুণ সুর। কথা বলছে আমার ভ্রমণসঙ্গীরা, প্রশ্ন করছে, হাসছে, গলগল করছে আনন্দ আলাপনে। পায়ার ওপরে স্বচ্ছ ত্রিকোণ গ্লাসে চূর্ণ করা বরফে তেকিলা মেশানো পানীয়, গ্লাসের প্রান্তে চুমুক দেবার স্থানটিতে একটু লবণ ছিটানো, সেখানে মাঝে মাঝে ঠোঁট ঠেকাই স্ট্র থাকা সত্ত্বেও এবং নোনতা চুম্বনের তীব্র অনুভূতি দ্রবীভূত মগজে গরুর লেজ মুচড়িয়ে লাঙল ঠেলে কথা বলে আনাবেলা।

‘আজ তোমাকে ইতিহাসের মহত্তম ইনকা সম্রাট পাচকুতির গল্প শোনাব।’

‘বেশ শীত শীত আমেজ আজ বরং আসো নদীতে সাঁতরাই।’

সে নদীটা আমার আলিঙ্গন থেকে সরিয়ে দুলিয়ে বলে, ‘আবার বুঝি দুষ্টামি হচ্ছে ?’

‘ভালোবাসা কি দুষ্টামি ?’

‘তিনি ছিলেন নবম ইনকা।’

‘কে ?’

‘পাচাকুতি।’

‘অ…!’

তার ক্ষমতায় উত্তরণের কথা ছিল না। কিন্তু তিনি যখন কৈশোর পার করছিলেন কুস্কো রাজ্য ছিল ছোট ও দুর্বল। প্রতিবেশীরা আক্রমণ করত প্রায়শই, লণ্ডভণ্ড তছনছ করে দিত জীবন। এমনি এক আক্রমণের সময় তার পিতা ভিরাকুচা ইনকা এবং তার বড় ভাই, সিংহাসনের উত্তরাধিকারী, পালিয়ে যান। কিন্তু সদ্য কৈশোরের প্রান্তর পার হয়ে আসা পাচাকুতি বুক চিতিয়ে দাঁড়ান দেয়ালের মতো। তার সাহসে জনগণ ও সৈন্যরা সাহস ফিরে পায় এবং তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে। তার দুঃসাহস ও বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে, পিতার নামে নাম যার, সেই ভিরাকুচা ঈশ্বর মাঠের পাথরদের যোদ্ধায় পরিণত করে দেন এবং তারা জনগণের সঙ্গে পাল্টা আক্রমণে অংশগ্রহণ করে শত্রুকে নির্মূল করে দেয়।

জনগণ দাবি তোলে, অন্য কেউ নয়, পাচাকুতিই ভবিষ্যত ইনকা, ঈশ্বর তাকে নির্বাচিত করেছেন।

পিতা উত্তরসূরি বদলাতে বাধ্য হন। এই পাচাকুতির শাসনামলেই (১৪৩৮-১৪৭১ সাল) ইনকা সাম্রাজ্য বিশাল বিস্তৃতি লাভ করে। তাকে তুলনা করা হয় আলেকজান্ডার দি গ্রেটের সঙ্গে। তিনি কৃষিব্যবস্থা ও সেচ পদ্ধতির বিপুল উন্নয়ন করেন এবং নতুন নতুন রাস্তাঘাট তৈরি করে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশের মধ্যে সংযোগ সাধন করে একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রব্যবস্থার সৃষ্টি করেন। ইনকা সভ্যতার তিনিই হলেন পিতৃস্বরূপ। মাচুপিচু নামে যে জগতের বিস্ময় আজও দাঁড়িয়ে আছে তা তারই আদেশে সৃষ্ট।

লেনিনগ্রাদ অবরোধে মৃত শহিদদের স্মরণে তৈরি যে শান্ত, সুন্দর, পরিপাটি সমাধিস্থলটি রয়েছে, পিস্কারেভ গোরস্থান, সেখানে মালা হাতে দাঁড়ানো কালো পাথরে তৈরি শোকার্ত মায়ের দিকে তাকিয়ে আনাবেলা প্রায় আর্তনাদের স্বরে বলেছিল, ‘ভাবতে পারো, নয়শ দিন, নয়শ রাত অবিরল বোমা ও শেল বর্ষণ চলছে! খাদ্য নেই, ক্ষুধার্ত মানুষগুলো পড়ে পড়ে মারা যাচ্ছে। শহর ছেড়ে পালাতে পর্যন্ত পারছে না। ২০ লক্ষ মানুষ নিহত! কারা করেছিল এই হত্যাযজ্ঞ ? জার্মানরা।’

আমি বলি, ‘না, নাৎসিরা! ওদের কোনও জাত নেই।’

‘জাত নেই, জাত্যাভিমান আছে। ওই জাত্যাভিমানের কারণে জার্মানরাই নাৎসিবাদের মতো এমন পৈশাচিক একটি মতবাদের জন্ম দিতে পেরেছে। যারা একবার পারে, তোমার কি মনে হয় না, সুযোগ পেলে তারা আবারও পারবে ? পুঁজিবাদের এই কি ধর্ম নয় ?’

শিখা অনির্বাণ জ্বলছে।

করুণ সুরে হৃদয় ছিন্নভিন্ন করে বাজছে শস্তাকোভিচের সপ্তম সিম্ফোনি। বার্চ বৃক্ষের পাতায় পাতায় হাওয়া হু হু করছে, সবুজ ঘাসে হাঁটা রোদের চোখ বিষণ্ন। আমার মনও। মা দাঁড়িয়ে কাঁদছে! মা মাতৃভূমি, এত এত সন্তানের লাশ তার বুকে! কী তারা চেয়েছিল ? সুখ, সাম্য, বেঁচে থাকার নিশ্চয়তা।

তখনও সমাজতান্ত্রিক পূর্ব জার্মানি ছিল। মনে হয়েছে ইতিহাস থেকে জার্মানরা শিক্ষা নিয়েছে, ওরা নিজেরাও তো কম কষ্টের মধ্য দিয়ে যায়নি। আনাবেলার কথা সঠিক হতে পারে না।

কিন্তু এখন, এই ২০১৭ সালে, চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত। গতকালই হোটেলে নাস্তা করতে গিয়ে কফি ও কিছু খাবার নিয়ে বসেছিলাম। বহু লোক, টেবিল খালি নেই।

‘তোমার সঙ্গে বসতে পারি ?’

একটি মেয়ে। ইংরেজিতে পূর্ব ইউরোপীয় এক্সেন্ট।

‘অবশ্যই।’

গরম চা ও সামান্য কিছু খাবার নিয়েছে সে।

বসতে না বসতেই ফোন বেজে ওঠে এবং সে গর গর করে রুশ ভাষায় কথা বলে ফোন রাখে।

‘স্দ্রাস্তে!’ অভিবাদন জানাই।

‘স্দ্রাস্তে!’ আপনি রুশ জানেন ?

‘হ্যাঁ! একটু একটু।’

‘তুমি কি রাশিয়া থেকে এসেছো ?’

‘না, কিয়েভ থেকে।’

‘তোমাদের পেচোরস্কা-লাভরা মনাস্টেরি থেকে নিপার নদীর দৃশ্য কি আগের মতই হৃদয় কাড়ে ?’

‘আপনি তা দেখেছেন ?’

‘হ্যাঁ, ১৯৮৭ সালের কোনও এক রাতে সেখানে দাঁড়িয়ে ক্যাথেড্রালের স্বর্ণময় ডোম এবং নদীর জলে চাঁদের ঝলকানি দেখেছি।’

‘হ্যাঁ, খুবই সুন্দর দৃশ্য! আমার জন্মেরও ৩ বছর আগে আপনি গিয়েছেন। এখন কিয়েভ কিন্তু অনেক বদলে গেছে। অনেক রং ঝলমলে, আধুনিক শহর।’

‘বগদান খ্মেলনিৎস্কির সুন্দর মনুমেন্টটি এখনও আছে ?’

‘আছে তবে কতদিন থাকবে বলা যায় না, সে এখন এন্টিহিরো, বেইমান।’

১৬৪৮ সালে বর্তমান ইউক্রেনের পশ্চিমাংশ যখন পোলিশদের অধীনে ছিল দুঃসহ নিপীড়নে শ্বাসরুদ্ধ, তখন কসাক ও জনগণের নেতা (আতামান) রাশিয়ার জারকে অনুরোধ করেন তাদের প্রোটেকশনে নেওয়ার। ৪ বছর পরে জার অনুমোদন দেন এবং এসব এলাকা রুশ সাম্রাজ্যের অধীনে আসে ১৬৫২ সালে।

কথা জমে ওঠে। মেয়েটি কিয়েভে জন্মানো রাশিয়ান, একটি বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করে, ছুটিতে কুস্কো ঘুরতে এসেছে। আমরা যখন সোভিয়েত ইউনিয়নে ছিলাম, এটা সম্ভব হতো না, সোভিয়েত নাগরিক বিদেশে যেতে পারত না।

‘কী অবস্থা তোমাদের ওখানে ?’

‘কী বলব ? জটিল।’

অনেক কথা হয়। সারমর্ম এই যে, ইউক্রেন চায় ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং ন্যাটোর সদস্য হতে কিন্তু পুতিন ইউক্রেনকে রাশিয়ার প্রভাববলয় এবং তার স্বার্থের জোনের বাইরে যেতে দিতে রাজি নয়। এই টানাপোড়েনের ফলে ২০১৪ সালে আমেরিকা একটি অভ্যুত্থান করে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচকে উৎখাত করে কট্টর রুশবিরোধী আল্ট্রা ন্যাশনালিস্ট ও নাৎসি শক্তিগুলোকে ক্ষমতায় আনে। এরা সশস্ত্র, উন্মত্ত ও হিংস্র। রাশিয়ানদের টার্গেট করে নিপীড়ন শুরু করে, দনবাসে শুরু করে হত্যাযজ্ঞ। এদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারও নেই। ওডেসায় প্রতিবাদ করা ৪০ জন মানুষকে ঘরে দরজা বন্ধ করে আগুন লাগিয়ে হত্যা করে। বিচার করার কেউ নেই, ওরাই ক্ষমতায়। স্কুলে রুশভাষা বন্ধ। আমেরিকার সঙ্গে তাদের সর্বাত্মকভাবে সমর্থন করে চলেছে জার্মানি।

‘জার্মানদের মগজপ্রসূত এই ভয়ংকর মতবাদ ওদের সহজে ছেড়ে যাবে না।’―আনাবেলা বলেছিল, আমি বিশ্বাস করিনি। ১৯৪১ সালে যুদ্ধের শুরুতে যে কিয়েভে নাৎসিদের হাতে নিহত হয়েছিল ৫ লাখ মানুষ, সেখানে আজ ওরা ক্ষমতায়! কয়েক লক্ষ ইহুদি, পোলিশ ও রাশিয়ান হত্যাকারী স্তেপান বান্দেরা এখন ইউক্রেনের জাতীয় বীর এবং স্থানে স্থানে তার মনুমেন্ট! তার নামে ডাকটিকেট এবং শহরের মেইন সড়ক!

অবিশ্বাস্য!

স্কুলের ক্লাসে ছোট ছোট ছাত্র-ছাত্রীকে পইপই করে শেখানোর মতো করে আনাবেলা বলেছে―‘মনে রেখো, পৃথিবীব্যাপী সবচাইতে বেশি গণহত্যা ও পররাজ্য গ্রাস ইউরোপিয়ানরাই করেছে। ধর্মযুদ্ধ নিয়ে প্রাচ্যে গিয়েছে ওরাই। ওরাই আফ্রিকা, এশিয়া এবং অন্যান্য দেশ থেকে নিরপরাধ মানুষ ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করেছে। হিরোশিমা, নাগাসাকিতে আণবিক বোম ফেলা ওদেরই কাজ এবং অহর্নিশ মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতার কথা বলে বলে মাথা খারাপ ওদেরই সবচেয়ে বেশি। আমাদের ভিরাকুচা বলেছিলেন, ওদের বিশ্বাস কোরো না। পেরুকে ওরা কীভাবে দখল করেছিল জানো ?’

‘না।’

‘বিশ্বাসঘাতকতা করে।’

‘রবার্ট ক্লাইভ তো আমাদের দেশে তাই-ই করেছে!’

ইতিহাস ছিল ওর নখদর্পণে। ওর চোখের দিকে তাকিয়ে আমি বোবা হয়ে যাই। কারণ আমি নিজ দেশের ইতিহাস জানি না।

গোয়ালভরা গরু, পুকুরভরা মাছ আর গোলাভরা ধান… হ্যাঁ, তা জানি।

কবে ছিল সেই সময় ?

শায়েস্তা খাঁর আমলে ? যখন বোম্বেটেরা আমাদের উপকূলে হানা দিয়ে লুণ্ঠন করত এবং সক্ষম নারী-পুরুষকে ধরে নিয়ে দাস হিসেবে বিক্রি করত এবং অসহায় মানুষ বুক চাপড়ে হাউ হাউ করে কাঁদত।

মোগল আমলে ? যখন বাংলাকে প্রতিনিয়ত লড়াই করতে হয়েছে স্বাধীন অস্তিত্বের জন্য।

হ্যাঁ, ১৭ জন তুর্কির হাঁকে বাংলার লক্ষ্মণ সেন পলায়ন করেছিলেন, সেই গৌরবের ইতিহাস আমি আনাবেলাকে বলতে লজ্জাবোধ করেছি। মীরজাফরের স্বদেশ বিক্রি, সকাল সন্ধ্যা পিতৃপূজারী মোশতাক চক্রের জনক হত্যা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের ফাঁসিতে লটকানো কোনও মেজরের স্বাধীনতা ঘোষণার ন্যাক্কারজনক উপকথার ইতিহাসও আমি তুলতে চাইনি।

আমি তার গল্প শুনেছি : আমাদের দেশে গুটিবসন্ত ছিল না তাই ইনকাদের দেহে গুটিবসন্তের বিরুদ্ধে কোনও প্রতিরোধও ছিল না। ওরা গুটিবসন্তের জীবাণু নিয়ে আসে, প্রথমে না জেনে। যখন টের পায় এ এক বিশাল অস্ত্র, যার মহামারি ছড়িয়ে পড়ে দ্রুত, কোনও যুদ্ধ ছাড়াই গ্রামকে গ্রাম উজাড় করে দেওয়া যায় এবং অদম্য উল্লাসে মৃত্যু হাঁটে কফিন কাঁধে নিয়ে, তারা তখন সংক্রমিত কম্বল সরবরাহ করতে থাকে বন্ধুর বেশে অথবা গুটিবসন্তের দেবতাকে লেলিয়ে দেবার ভয় দেখিয়ে বশ্যতা আদায় করে নেয়।

বহু দাপটের সঙ্গে রাষ্ট্র শাসন করে ১৫২৭ সালে গুটিবসন্তে দেহত্যাগ করেন সম্রাট ওয়াইনা কাপাক। তার সৎকারও হয় দাপটের সঙ্গে। প্রিয় দাস-দাসী, উপপত্নী, প্রেমিকা এবং রাষ্ট্রের কর্মকর্তাসহ প্রায় ৪ হাজার মানুষকে বলি দিয়ে সমাধিস্থ করা হয়। পুনরুত্থানের সময়ে বিশ্বস্তেরা যাতে পাশে থাকে, সে জন্যই এই ব্যবস্থা। বড় ছেলে উয়াস্কার ছিল ক্ষমতার বৈধ উত্তরাধিকারী। পিতা জীবিত থাকতেই রাজধানী কুস্কো ও সাম্রাজ্যের দক্ষিণাংশের শাসনকর্তা ছিল সে। তার সৎ ভাই, আতাউয়ালপা ছিল সাহসী, রাজনৈতিকভাবে দক্ষ এবং পিতার প্রিয়। সাম্রাজ্যের উত্তরাংশ এবং ইকোয়াডোর ছিল আতাউয়ালপার শাসনাধীন। কিটো ছিল তার রাজধানী। কিন্তু তার মা ছিল ওয়াইনা কাপাকের উপপত্নী। ইনকা ট্র্যাডিশন অনুযায়ী সম্রাটের সিংহাসন তার প্রাপ্য নয়।

সুতরাং উয়াস্কার হয় পরবর্তী ইনকা। বছর চারেক তারা শান্তিপূর্ণভাবে রাজত্ব করে কিন্তু তারপরে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হয়। উয়াস্কার কুস্কোতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে ১৫২৭ সালে আতাউয়ালপাকে গ্রেফতার করে। স্ত্রীর সহায়তায় পালিয়ে গিয়ে সে কিটোর কাছাকাছি অবস্থিত পিতার শ্রেষ্ঠ দুই জেনারেল ছলকুচিমা এবং কিজকিজের সমর্থন আদায় করতে সক্ষম হয়। শুরু হয় উয়াস্কারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ও গৃহযুদ্ধ। সাম্রাজ্য দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়। দূরবর্তী ও জোর করে দখল করা এলাকাগুলোতে শুরু হয় অস্থিরতা। প্রায় দেড় লক্ষ মানুষ নিহত হবার পর আতাউয়ালপা উয়াস্কারকে পরাজিত ও বন্দি করে। সেটা ছিল ১৫৩২ সাল। উয়াস্কার পরাজিত এবং সাম্রাজ্য দুর্বল। আঞ্চলিক অবিশ্বাস ও ঘৃণা তুঙ্গে।

স্পেনের যোদ্ধা ফ্রানসিসকো পিজারোর বীর ছিল মেক্সিকো দখলকারী হেরনান কর্তেস, নতুন রাজ্য দখলের স্বপ্নে তার ঘুম আসে না। ১৬৮ জন সৈন্য নিয়ে ১৫৩২ সালে সে জাহাজে চড়ে বসে। সঙ্গে তার ৪ ভাই, ২৭টি অশ্ব, নিরাপত্তা বর্ম, ১টি কামান, কিছু বন্দুক আর কিছু দোভাষী। এই দোভাষীদের ওরা লুট করে নিয়েছিল কোনও এক তেজারতি জাহাজ থেকে। সমুদ্রতীরের যেখানে দস্যুরা জাহাজ থেকে নেমে আসে, তারই অদূরবর্তী কাহামার্কা শহরে চলছিল ৮০ হাজার সৈন্যের বিশাল বহর নিয়ে আতাউয়ালপার বিজয়ের উৎসব। স্বজাতির রক্ত রঞ্জিত সাম্রাজ্যে ইনকা মদ ‘চিচার’ ফোয়ারা বইছিল।

এত রক্ত কেন ?

এই প্রশ্ন কাউকেও বিচলিত করেনি।

শ’খানেকের কিছু বেশি শ্বেত ইউরোপিয়ানের জাহাজ থেকে নামার খবর পেয়েছিলেন নতুন সম্রাট। কিন্তু কোনও পাত্তা দেননি। স্প্যানিশরা আসলে কী প্রজাতি, কী তাদের স্বভাব, তা জানাও ছিল না। তাদের ঘোড়সওয়ারদের কাহামার্কার মূল স্কোয়ারে লুকিয়ে রেখে দূত পাঠিয়ে আতাউয়ালপাকে দাওয়াত করা হয় পিজারোর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। তিনি সম্রাটদের সম্রাট, রোমান সাম্রাজ্যের চেয়েও বড় তার সাম্রাজ্য। ইন্তিদেবের সরাসরি বংশধর ইনকা ঈশ্বর। তিনি সম্মুখ সমরে অভ্যস্ত এবং প্রতারণা তাদের সংস্কৃতিতে নেই। তাঁকে কোথাকার কোন পিজারো ডেকে পাঠাল আর তিনি সেখানে চলে গেলেন আগ পাছ না ভেবে। এমনি ছিল সময়। মানুষ মানুষকে বিশ্বাস করত।

ট্রয়ের দেয়ালের বাইরে সমুদ্রতীরে গ্রিকরা যে কাঠের ঘোড়াটি রেখে গিয়েছিল, তাকে শহরে নিতে নিষেধ করেছিল বৃদ্ধ পুরোহিত লাকুন এবং রাজা প্রায়াম-দুহিতা কাসান্দ্রা। অতীতে বা বর্তমানে, যারাই ক্রান্তদর্শী তাদের প্রাণ হারাতে হয়, নয় উন্মাদ আখ্যা নিতে হয়। লাকুন সমুদ্র দানবের উদরস্থ হয়েছিলেন এবং কাসান্দ্রাকে উন্মাদিনী বলা হয়েছিল। কিন্তু কাহামার্কায় কোনও লাকুন বা কাসান্দ্রা ছিল না।

আমরা ডিনার সেরে বাইরে এসেছি। সুন্দর রাত, একটু শীত শীত লাগছে, আকাশে চিকন, ক্ষয়িষ্ণু, কাত করা চাঁদের ক্রিসেন্ট। শ্বেতার হাত ধরে হাঁটছি।

‘খুব চুপচাপ তুমি, ভাবছো কিছু ?’

‘ঠিক যে ভাবছি তা নয়। তবে কিছু একটা ঘুর ঘুর করছে মাথায়।’

‘আমারও তাই মনে হয়েছে। শহরটা খুব সুন্দর, বিল্ডিংগুলো সৌষ্ঠবময় অথচ তোমার মুখে রা নেই।’

‘এবং এর প্রতিটি ইটে ইতিহাস ও রক্তের গন্ধ’―নিচু স্বরে বলি।

‘তোমার তা জানার কথা, ইতিহাসে আমি ভু ডু!’

আমিও কিছুই জানি না, সময়ের চাকা ঘুরে ঘুরে যায়। ইতিহাসে সত্য, মিথ্যা এবং সত্য-মিথ্যা দলা বেঁধে থাকে, ভাবি জানি, আসলে জানি না। আবার কখনও কখনও যা জানি না, তা নিয়ে তুমুল তর্কে মেতে উঠি।

মৃতকে আমরা মৃত ভাবি কিন্তু ইনকারা ভিন্ন, ওরা নির্দিষ্ট সময়ে কবর খুলে মৃতদের খেতে দেয়, ভালোমন্দ উপহার দেয়, বা তাদের বিরক্ত না করে ছিদ্র করে কবরে সুস্বাদু পানীয় সরবরাহ করে। যারা কীর্তিমান, তাদের ভুলে যায় না, ভাস্কর্য তৈরি করে সমাজের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত রাখে। কখনও কখনও তাদের মমি করে স্পেশাল স্থানে সংরক্ষণ করে। কেচোয়ারা যখন যুদ্ধে যায়, পরাজিতদের মৃত পূর্বপুরুষের এসব মূর্তি বা মমি বন্দি করে নিয়ে আসে কুস্কোতে। যতদিন এরা বন্দি, পরাজিতরা কুস্কোর অবাধ্য হতে পারে না।

আগে বলেছি, সম্রাট বা সম্রাজ্ঞী যখন মারা যায়, নতুন বসন পরিয়ে তাদের মমি বের করে আনা হয় রেইমি ইন্তি ও অন্যান্য উৎসবের শোভাযাত্রায়। তাদের খেতে দেওয়া হয় এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ কোনও সিদ্ধান্ত নেবার সময় খাদেম যাজকদের মাধ্যমে তাদের মতামত নেওয়া হয়। অর্থাৎ মৃত মৃত নয়, ইনকা সমাজে তারা জীবিতের সহচর। দেবগণ, আত্মারা বা মৃত পূর্বপুরুষরা ফিরে আসে প্রকৃতির অংশ হয়ে, পাহাড়ের চূড়া, নগ্ন শৈলশরীর, নদী, বন, গুহা এমনকি আজব কোনও পাথরের আকৃতি ধরে। এই যে স্থানগুলো, এরা পবিত্র। এদের নাম ওয়াকা। এখানে আরাধনা হয়। হয় গ্রহ-নক্ষত্রের পর্যবেক্ষণ।

এবং গ্রহ-নক্ষত্রের ইশারা মেনে দেশ চলে।

রাস্তায় লোকজন অনেক। একজন যুবক এক যুবতীর হাত ধরে হাঁটছে গল্প করতে করতে। বেশ উঁচুগলা ছেলেটির এবং মেয়েটি হাসছে। অন্য এক জোড়া কিশোর-কিশোরী এক স্থানে দাঁড়িয়ে একে অন্যে গলে গিয়েছে। পালকিতে চড়ে সম্রাট আতাউয়ালপা যাচ্ছেন কাহামার্কা শহরের মূল চত্ব¡রে। যুদ্ধ করতে নয়, যাচ্ছেন মহাসমুদ্র অতিক্রম করে আসা অতিথিদের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে। সঙ্গে নিয়েছেন বিশাল সৈন্যবহরের সামান্য কয়েক হাজার, শুধু তার আভিজাত্যের প্রদর্শনী হিসেবে।

পালকি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গে আত্মগোপন করে থাকা ঘোড়সওয়ারের দল অতর্কিতে আক্রমণ করে। ইনকারা আগে ঘোড়া দেখেনি, তাই দ্রুতগামী এই প্রাণির সামনে ভয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ঘোড়সওয়ার দস্যুরা সুতীক্ষè তলোয়ারের আঘাতে কচুকাটা করতে থাকে সৈন্যদের, অথচ তাদের অস্ত্র বর্মাচ্ছাদিত শত্রুদের দেহ স্পর্শই করতে পারে না।

যুদ্ধ হয় সংক্ষিপ্ত।

আতাউয়ালপার প্রায় ৬০০০ সৈন্য নিহত হয়। বিশাল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর বন্দি হন মাত্র ১৬৮ জন যীশুর অনুসারীর হাতে। ওদের একজনও মারা যায়নি। ওরা যুগে যুগে এসেছে ধর্মগ্রন্থ ও তরবারি হাতে, নতুন ঈশ্বরের মুখপাত্র হয়ে। পেরুর নতুন ঈশ্বরের নবীর নাম ফ্রান্সিসকো পিজারো।

তার অস্থি সসম্মানে সমাধিস্থ আছে লিমার জাঁকজমকপূর্ণ গির্জায়।

সম্রাটকে একটি বড় কক্ষে বন্দি রাখা হয়। রাজ্য চালনার আদেশ নির্দেশ তখনও দিতে পারেন। যদিও ঈশ্বরের পুত্র কিন্তু অন্ধ ও ভবিষ্যৎ দেখায় অক্ষম। স্প্যানিশরা আদেশ দেয় বন্দি উয়াস্কারকে তাদের সামনে উপস্থিত করার।

আতাউয়ালপা ভয়ে আঁতকে ওঠেন।

যদি তার ভাই স্প্যানিশদের সঙ্গে কোনও রকম বোঝাপোড়া করে ফেলে ? যদি ক্ষমতা তার হাতে ফিরে যায় ? ক্ষমতার বৈধ দাবিদার সে-ই তো। তিনি তখনও বুঝে উঠতে পারেননি যে ক্ষমতা কর্পূর এবং তা ইতোমধ্যেই উবে গেছে। তিনি বন্দি।

তিনি উয়াস্কারকে হত্যা করার আদেশ দেন, তবে তা স্প্যানিশদের ভাষ্য, সত্য নাও হতে পারে। উয়াস্কার মৃত আর তিনি পিজারোর জেলখানায়। বিভ্রমের নিরাপত্তায় হাঁটা দিগম্বর সম্রাট। অচিরেই লক্ষ করেন যে, স্প্যানিশরা সোনা ও রুপার গৃধ্নু। সামান্য এসব ধাতু তাদের কাছে মূল্যহীন। শুধু মন্দির সাজানোর কাজে এদের ব্যবহার।

ভাবেন, এ আর কী ? অপ্রয়োজনীয় এসব ধাতু দিয়ে তুষ্ট করা যাবে ওদের।

কিনে নিতে পারবেন মুক্তি।

যে বিশাল কক্ষে তাকে বন্দি রাখা হয়েছিল তিনি প্রস্তাব দেন মুক্তির বিনিময়ে তার অর্ধেক সোনা দিয়ে ভরে দেবেন আর তার দ্বিগুণ দেবেন রুপা।

ওরা রাজি হয়।

তার আদেশে চারিদিক থেকে সোনা আর রুপা আসতে থাকে বন্যার মতো।

তার তিনজন সাহসী ও অভিজ্ঞ জেনারেল প্রস্তুতি নিচ্ছিল প্রভুকে মুক্ত করার জন্য স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে আক্রমণ করার। তারা অনুমতি চেয়ে সম্রাটের কাছে গোপনে খবর পাঠায়।

না, না, কোনও মতেই নয়! তোমরা সবকিছু নষ্ট করে দেবে!

অদূরদর্শী সম্রাট উত্তর পাঠান।

তার ধারণা স্বর্ণ ও রৌপ্য দিয়ে তিনি এদের কিনতে সক্ষম হয়েছেন। কিন্তু অপরিমেয় সোনা-রুপা দেখে দস্যুদের চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে হায়েনার মতো। তারা সম্রাটকে মুক্তি দেয় না।

অবশেষে কুস্কো থেকে তার জেনারেলরা বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে রওনা হয়। তারা তাকে ছিনিয়ে নিয়ে বিশাল মাত্রার যুদ্ধে লিপ্ত হতে পারে এই আশঙ্কায়, উয়াস্কারকে হত্যা করার অভিযোগ এনে দ্রুত বিচার সম্পন্ন করে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেয় এবং ১৫৩৩ সালের ২৬ জুলাই কাহামার্কায় তার শিরñেদ সম্পন্ন করে। সেদিন আকাশ কেঁদেছিল কি না উল্লেখ নেই। ফুঁসে উঠেছিল কি না সমুদ্র, কেউ জানে না।

দুই ভাই ইকোয়াডোর, পেরু, পশ্চিম দক্ষিণ ও সেন্ট্রাল বলিভিয়া, উত্তর পশ্চিম আর্জেন্টিনা, উত্তর ও সেন্ট্রাল চিলি, দক্ষিণ কলম্বিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত এত বড় সাম্রাজ্যকে ভাগাভাগি করে নিতে পারেননি কিন্তু মৃত্যুকে সমবণ্টন করে নেন কত সহজে।

তুপাক আমারুর দেশে।

পরের দিনের অনেকটা সময় কাটে কুস্কোর প্রাচীন ধর্মসদন করিকাঞ্চাতে। কয়েকটি মন্দির নিয়ে তৈরি এটি ইনকা ধর্মের শুধু পবিত্রতম স্থানই নয়, বরং তাওয়াতিনসুয়ো বা সারা ইনকা সাম্রাজ্যের কেন্দ্রবিন্দু বা স্বর্ণবেষ্টনী বলে পরিচিত। সর্বোচ্চ ঈশ্বর ভিরাকুচা, সূর্যদেব ইন্তি এবং চন্দ্রদেবী কিয়াকে নিবেদিত মন্দিরগুলো ছিল এখানে। জৌলুশ ও জাঁকজমকের কোনও কমতি ছিল না, স্বর্ণ সূর্যদেবের দেহের ঘাম এবং তা ছিল প্রচুর, চন্দ্রদেবীর অশ্রু হল রুপা, তাও অজচ্ছল। পুরুষ ঘামে আর নারী কাঁদে, এভাবেই গড়ে ওঠে সভ্যতা। সময়ে তাও বিলুপ্ত হয়ে যায় এবং মিথ ছাড়া কিছুই থাকে না।

১৪৩৮ সালে সম্রাট পাচাকুতি করিকাঞ্চা তৈরি করেন আদি পিতা মানকো কাপাকের তৈরি পুরানো এক মন্দিরের ভিত্তির ওপর। সেই সময়ের দুই প্রখর নদী, উয়ানতানে ও তুয়ামায়োর মিলনস্থলে এর অবস্থান এবং ওপর থেকে দেখলে চূড়াটি চারিদিকে রশ্মি বিকিরণকারী সূর্য বলেই মনে হয়। ৪১টি রশ্মি, যাদের বলা হয় পবিত্র জ্যাক লাইন, ৩২৮টি পবিত্র স্থানের দিক নির্দেশ করে।

কুস্কো শহর দেখতে একটি জাগুয়ারের মতো এবং করিকাঞ্চা বসে আছে তার লেজে। আর মাথায় অবস্থান করছে স্যাক্সায়ুম্যান রয়্যাল ইগল দুর্গ। অসংখ্য ১০০ টন বা তারও বেশি ওজনের ব্লক ব্যবহার করে প্রায় ২০,০০০ মানুষের বিরামহীন পরিশ্রমে তৈরি ১৮ মিটার উঁচু দেয়ালের এই স্থাপনায় প্রায় ১০০০ সৈন্য অবস্থান করতে পারত। কিন্তু এর প্রয়োজন ছিল না, ইনকা সাম্রাজ্য কেউ কখনও আক্রমণ করেনি। মূলত অস্ত্র, যন্ত্রপাতি, খাদ্য, টেক্সটাইল এবং অন্যান্য মহার্ঘ বস্তুর গুদাম হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। তবে যুদ্ধ সে দেখেছে, অন্য যুদ্ধ আসল যুদ্ধের পরে, কুস্কো তখন আর তাদের ছিল না। সে গল্প পরে।

করিকাঞ্চার নিখুঁতভাবে কাটা বিশাল বিশাল পাথরের ব্লক দিয়ে তৈরি পুরো দেয়াল, চতুষ্কোণ দরজা জানালা। দরজার ফ্রেমগুলো নাকি সোনা দিয়ে মোড়ানো, দেয়ালগুলোতে পান্নার সাজ সৌষ্ঠব। উত্তর প্রান্তে সূর্যদেবকে নিবেদিত অংশে ভেতর এবং বাইরের দেয়ালগুলোতে চকচক করে ৭০০ সোনার পাত, প্রতিটির ওজন ২ কেজি করে। পুনচাও (দুপুরের সূর্য বা মার্তণ্ড) নামের একজন বালকের বেশে বসা ইন্তির স্বর্ণমূর্তি, যার মাথা ও কাঁধ থেকে বিকীর্ণ হতো সূর্যরশ্মি, মাথায় ছিল রাজকীয় বিড়া আর দেহ থেকে নির্গত অসংখ্য সাপ ও সিংহ। উদর পূর্ণ করে রাখা হতো পূর্ববর্তী ইনকা সম্রাটের দেহভস্ম দিয়ে এবং পুনচাওকে প্রতিদিন মন্দিরের বাইরে আনা হতো হাওয়া বাতাস সূর্য ও সন্ধ্যার সংস্পর্শ পাবার জন্য এবং রাতে ফিরিয়ে নেওয়া হতো। অন্যত্র আলাদা কক্ষে দেয়ালে ঝোলানো ছিল বিশাল স্বর্ণমুখোশ, যার মাথা থেকে বিচ্ছুরিত হতো সোনালি সূর্যের কিরণ।

চারিদিক দিয়ে ইমারত-ঘেরা করিকাঞ্চার বাগানে ভুট্টার খেত ভরা ছিল সোনা বা রুপা দিয়ে তৈরি মেষচালক, লামা, জাগুয়ার, গিনিপিগ, বানর, পাখি এমনকি প্রজাপতি বা পোকামাকড়ের পূর্ণাকার মূর্তি। সবই দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য এবং তাও যথেষ্ট নয় ভেবে রাখা ছিল মণি-মাণিক্য খোদিত সোনা-রুপাভর্তি বড় বড় বয়াম। ছিল কিন্তু এখন আর নেই। গলিয়ে, সোনা বা রুপার পাত বানিয়ে স্পেনে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।

১৪০০ কিলোগ্রাম সোনা!

ইন্তির স্বর্ণমূর্তিটি লুকিয়ে রেখেছিল মন্দিরের যাজকরা কিন্তু ১৫৭২ সালে ওরা ঠিকই খুঁজে বের করে নিয়ে যায়।

তারপর ?

তার আর পর নেই, সেই মূর্তি হারিয়ে যায় চিরতরে। ধারণা করা হয়, তাও গলিয়ে উদরপূর্তি করেছে স্পেনের রাজা ও রানির।

করিকাঞ্চার বাগানে আরও ছিল দেবী ভেনাস, বজ্রদেব ইয়াপা ও রংধনু-দেব কুইচুর মন্দির। যে রংধনু আমাদের মনকে পবিত্র অনুভূতি-পূর্ণ করে, তাকেই ইনকারা অমঙ্গলের ইঙ্গিত মনে করত তাই কুইচু পূজা পেতেন।

১৫৩৪ সালে স্পেনিশরা করিকাঞ্চা ধ্বংস করে তার ফাউন্ডেশনের ওপরে তৈরি করে বর্তমানের সান্তো ডমিঙ্গো মনাস্টেরি। এখনও দাঁড়িয়ে আছে সে। না থাকার কারণ নেই, ঈশ্বর সে ইনকা হোক বা স্প্যানিশ হোক, মন্দিরে তার কী আসে যায় ? পৃথিবীর অসংখ্য অন্যায়, অসুন্দরতা, যৌনাচার ও পাপের কলঙ্ক নিয়ে ভ্যাটিকান দাঁড়িয়ে আছে পবিত্র সন্ন্যাসীর মতো, যেমন দাঁড়িয়ে আছে অন্যান্য ধর্মমন্দির।

ক্ষমতার ইগোর মূর্তরূপ!

পেছনে গিয়ে অনুভব করি যে, মন্দিরটি অনেক উঁচুতে। নিচে উন্মুক্ত হয়েছে কুস্কো ভ্যালির সৌন্দর্য এবং দূরে ঘিরে থাকা পাহাড়ের দেয়াল।

এখান থেকে বের হয়ে আমরা যাই কুস্কো ও মাচুপিচুর মাঝামাঝি পবিত্র উপত্যকা বা স্যাক্রেড ভ্যালিতে। চার-চাকার যানে (ATV) করে বিশাল ভ্যালি পার হয়ে যাই পাহাড়ের সারির পাশ কেটে অন্য উপত্যকায়। স্বল্পগতির উন্মুক্ত যান, আমি সামনে শ্বেতা পেছনে। পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাবার সময় উঁচুতে আমার মাথা ঘোরে, বুকে মুরগি ডানা ঝাপটে ছটফট করে। মনে হয় ওখানেই ঝাঁপ দেব অসাবধানে। যত সাবধান হই ততই উদ্বেগ বাড়ে।

খাদের দিকে তাকিও না সামনে চোখ রাখো।

বলা সহজ, চোখ তো অবশ নয়।

জুনে এখানে শীতকাল এবং আমরা গ্রীষ্মের দেশ থেকে এসেছি। কনকনে শীত, হাত-পা জমে যাচ্ছে, আদিগন্ত রোদে চিকচিক করা কখনও সোনালি শস্যময়, কখনও শস্যহীন প্রান্তর দূরে উঠে গেছে পাহাড়ে এবং পাহাড় মিশে গেছে কখনও সাদা, কখনও সোনালি মেঘে। রোদে একটুও তাপ নেই, আছে হিমশীতল অপ্রীতি।

অবশেষে যেখানে পৌঁছাই নাম তার ‘মোরে’ (Moray), বিস্ময়কর একটি জায়গা। পাহাড়ের ওপরে প্রায় ৫০০ ফিট গভীর একটি বিশাল গর্ত নেমে গেছে ধাপে ধাপে। ১২টি বৃত্তাকার ধাপ কাটিয়ে নিচে যাওয়া যায় কিন্তু যাওয়া নিষেধ। সবচেয়ে বড় বৃত্তটির ব্যাস ৬০০ ফিট। ধারণা হয়, কোনও প্রাচীন থিয়েটার, হয়তো ইনকাদের উৎসব বা অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন হতো।

কিন্তু তা নয়।

কী এটা ?

কেউ জানে না।

থিওরি অনেক। প্রথম ও সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য থিওরি এখন, ইনকাদের কৃষিকাজের রিসার্চ এলাকা। প্রতিটি বৃত্তে রয়েছে তাপমাত্রার তারতম্য, উচ্চতম ধাপ থেকে নিম্নতম ধাপে তফাৎ ২৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট। ওরা সেটা নির্ণয় করেছিল। প্রতিটি ধাপে এক ধরনের চ্যানেলের মাধ্যমে জল সেচনের ব্যবস্থা আবিষ্কার করা গেছে, যাদের মধ্য দিয়ে পাহাড়ে উচ্চতর কোনও জল সংরক্ষণাগার থেকে জল সেচন করা সম্ভব। এভাবে প্রতিটি ধাপের রয়েছে নিজস্ব মাইক্রো ক্লাইমেট এবং ইনকা সাম্রাজের বিভিন্ন এলাকার শস্য ফলানো সম্ভব। বিভিন্ন ধরনের আলু, কিনোয়া দানা এবং ভুট্টা ছিল এই এলাকার গুরুত্বপূর্ণ শস্য।

আরও প্রায় ৪ মাইল দূরে মারাস লবণখনি, ইনকাদের কালেরও আগে থেকে এখানে লবণ আহরণ করা হতো।

ÔEat Your Highness.Õ

ÔEverything tastes like doomÕ, he whispered.

ÔThen add saltÕ.

Doom বা বিলয়ের সঙ্গে লবণ খুব যায়। বহু দেশ ও সাম্রাজ্যের সৃষ্টি ও ধংসের কারণ হয়েছে সে, বহু যুদ্ধ, বিদ্রোহ, মৃত্যু ও কদাচার এর খাতায়। সাহারা অতিক্রম করে হাজার হাজার উটের ক্যারাভান যেত সাহেলে, দাস ব্যবসার কেনাবেচা হতো লবণের বিনিময়ে। খনিজ লবণের কারণে পোল্যান্ডের যে বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল ১৬ শতকে, তার বিলয় ডেকে আনে জার্মানদের সামুদ্রিক লবণ। লিভারপুল বিশাল বন্দরে পরিণত হয় চেশায়ারের লবণ আমদানি রপ্তানি করে এবং ফ্রান্সের ঘৃণ্য লবণ-কর ‘গ্যাবেল’ টিকে ছিল মধ্য চৌদ্দ শতক থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর পর্যন্ত।

পাহাড়ের ওপরে দাঁড়িয়ে দেখি নিচে অসংখ্য চতুষ্কোণাকার লবণের প্যান, লবণ তৈরি প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপ, কারও মধ্যে কেলাসিত সাদা লবণ, কারও মধ্যে লবণ-পানির মিশ্রণ এবং কোথাও শুধুই পানি। ইনকারা নেই কিন্তু তাদের জীবন ধারণের আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দেখে চার-চাকার যানে শহরের দিকে যাত্রা শুরু করি। আবারও কষ্টকর, শীতে কাঁপানো জার্নি। কিন্তু স্যাক্রেড ভ্যালির অল্লানটেয়টাম্বো শহরে আমাদের যাওয়া হয়নি, তবে তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে ইতিহাস জড়িত।

সম্রাট আতাউয়ালপাকে হত্যা করার পরে পিজারো তার সৎ ভাই ‘মানকো ইউপানিক’কে সঙ্গে নিয়ে কুস্কোর দিকে এগিয়ে যায় বাধাহীনভাবে। মানকো ইউপানিক পিজারোর পুতুল ইনকা হিসেবে অপমান ও অত্যাচার সহ্য করেন কিছু দিন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না, তাকে জেলে ঢোকানো হয়। তিনি জেল থেকে পালাতে সক্ষম হন এবং দখলদার দস্যুদের প্রতি ঘৃণায় জ্বলে ওঠেন। জনগণের এক বিশাল আর্মি তৈরি করে ১৫৩৬ সালে কুস্কো আক্রমণ করেন। গুলতি ব্যবহার করে লাল গরম পাথর ছুড়ে কুস্কো শহরে আগুন ধরিয়ে দেন। স্প্যানিশরা শহরে ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়। তারা ‘স্যাক্সায়ুম্যান’ দুর্গে আশ্রয় নেয়। কিন্তু মাত্র ২০০ জনের বাহিনী উত্তম আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে মানকো ইউপানিকের ৪০-৫০ হাজারের বাহিনীকে ঠেকাতে সক্ষম হয়। ইনকারা আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে অসহায়। কিছু আগ্নেয়াস্ত্র দখল করতে সক্ষম হলেও তাদের ব্যবহার তারা জানত না।

অবরোধ চলতে থাকে। কিন্তু শস্য বপনের সময় এগিয়ে আসে। ফলে বিদ্রোহী জনগণ দুর্গ অবরোধ ছেড়ে চলে যেতে থাকে এবং মানকো ইউপানিকের প্রতিরোধ ব্যর্থ হয়ে যায়। তিনি তখন তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে অল্লানটেয়টাম্বো শহরে আশ্রয় নেন। সেখানেও সুবিধা করতে না পেরে দুস্তর অ্যান্ডিজ পর্বতমালা ও আমাজন বনের গহিনে বিলকাবাম্বায় (যা এলদোরাদো নামে পরিচিত) চলে যান এবং সেখান থেকে চোরাগোপ্তা আক্রমণ করে স্প্যানিশদের দক্ষিণমুখী অগ্রসর ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হন।

কুস্কোতে একজন পাপেট ইনকা নিয়োগ করা হয়। লুণ্ঠিত সম্পদের ভাগাভাগিতে পিজারো ও তার ভাইদের দ্বারা প্রতারিত হয়ে ১৫৩৭-১৫৪১ সালে তাদেরই সঙ্গী দিয়েগো দি আলমাগরো গৃহযুদ্ধ শুরু করে। মানকো ইউপানিক তার পক্ষ নিয়ে যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু আলমাগরো পরাজিত হয়ে বিলকাবাম্বায় পালিয়ে যাবার পথে ধরা পড়ে পিজারোর লোকজনের হাতে নিহত হয়। ইউপানিক পরাজিতের ৭ জন সঙ্গীকে বিলকাবাম্বায় আশ্রয় দেন। বাসস্থান, খাদ্য ও নারী সবকিছু দিয়ে আতিথেয়তা করা সত্ত্বেও ২ বছর পরে, ১৫৪৪ সালে এই সাত দস্যু মানকো ইউপানিককে কোনও এক ঘোড়দৌড় প্রতিযোগিতার সময় পেছন থেকে পুনঃপুন ছুরির আঘাত করে হত্যা করে। পালিয়ে যাবার পথে তারা ধৃত ও নিহত হয়।

ইউপানিকের পুত্র সায়রি তুপাকের বয়স তখন ৫ বছর। সে নিজ চোখে পিতার হত্যাকাণ্ড দেখে। সে-ই তার পিতার স্থলাভিষিক্ত হয়। যুদ্ধ চলতে থাকে।

১৫৫২ সালে স্পেনের প্রিন্স ফিলিপ তাকে চিঠি লিখে জানান যে, তার কানে এসেছে যে তার পিতা মানকো ইউপানিক ছিল স্পেনের মিত্র। স্থানীয় ক্ষমতাধর পিজারো গোষ্ঠী তার প্রতি অন্যায় করে তাকে বাধ্য করেছে স্প্যানিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যেতে। বর্তমান যুদ্ধের অধিনায়ক সায়রি তুপাক যদি যুদ্ধের পথ ত্যাগ করে ভাইসরয়ের সঙ্গে শান্তি স্থাপন করে, তবে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয় তার সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করে দেওয়া হবে এবং কুস্কোতে তাকে ইনকার মর্যাদা দেয়া হবে। ১৫৫৭ সালে সায়রি তুপাক পিতার শুরু করা যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটিয়ে কুস্কোতে ফিরে যান।

তার পূর্বপুরুষের পবিত্র শহরে জাঁকজমকপূর্ণভাবে পোপ তৃতীয় জুলিয়াসের বিশেষ আশীর্বাদ নিয়ে নিজের বোনকে খ্রিস্টান মতে বিয়ে করেন। তার খ্রিস্টান ধর্মগ্রহণ ও যুদ্ধবিরতির কারণে স্প্যানিশরা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। বিলকা বাম্বা একই সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। কিন্তু শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করেও প্রতিশ্রুতির প্রাপ্তি আসে না। তাকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয় ১৫৬০ সালে ।

সৎ ভাই টিটু কুসি পরবর্তী ইনকা হিসেবে অভিষিক্ত হন। বিলকাবাম্বা আবার আলাদা হয়ে যায়। সিংহাসন পাবার কথা ছিল সায়রির আপন ভাই তুপাক আমারুর। তাকে ধর্মযাজক করে তাদের পিতা মানকো ইউপানিকের মমি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তুপাক তাই চেয়েছিলেন। ক্ষমতার থেকে দূরে এক স্বপ্নচারী জীবন।

গাছের পাতার শব্দ, নদীর কুলুকুলু, পাখির গান, রাতের আকাশে পতনশীল নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে থাকা আর তার পিতার পবিত্র দেহের সংরক্ষণ করা—এই ছিল তার দৈনন্দিন দিনের অংশ। যতদিন পূর্ববর্তী ইনকাদের পবিত্র মমি রক্ষা হবে ততদিনই আশা বেঁচে থাকবে যে তারা আবার জেগে উঠবেন এবং স্বহাতে তুলে নেবেন রাজ্যশাসন। ফিরে আসবে বিগত হয়ে যাওয়া স্বর্ণযুগ।

কুস্কো থেকে বহু চেষ্টা করা হয় ক্ষমতাসীন টিটু কুসিকে কেনার। তাকে উপঢৌকন পাঠানো হয়। তিনি কুস্কো যাবার নিমন্ত্রণ এড়িয়ে চলেন। যদিও পিতা-পিতামহের অতিথিপরায়ণতায় শ্রদ্ধা রেখে বিলকা বাম্বায় স্প্যানিশ দূতদের থাকতে দেন। তিনি ছিলেন তার সৎভাই সায়রির চেয়ে সাবধান। তার পরিণতির কথা জানেন। জানেন পিতার পরিণতির কথা। স্প্যানিশদের সাপের স্বভাব তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে চেনা।

ওদের সঙ্গে মৈত্রী মানে নিজের এবং নিজের জাতির জন্য সর্বনাশ। তিনি যুদ্ধ ও চোরা-গোপ্তা আক্রমণের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়ে স্পেনিশদের নিরবচ্ছিন্ন লুণ্ঠন, হত্যা, ধর্ষণ ও এক স্থান থেকে অন্যস্থানে চলাচল ব্যহত করতে থাকেন।

কুস্কোর ভাইসরয় ফ্রানসিসকো টলেডো বহুবার তাকে দামি কাপড় ও মদ দিয়ে কেনার চেষ্টা করে। তিনি অনড় থাকেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দস্যুদের চারুবাকে সম্মোহিত হয়ে ১৫৬৮ সালে গ্রহণ করেন মানব সভ্যতার সবচেয়ে দামি মদ—খ্রিস্টধর্ম।

১৫৭১ সালে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একজন স্প্যানিশ ধর্মযাজক ছিল বিলকা বাম্বায়। লোকজন তাকে অনুরোধ করে সমুদ্রের ওপারে বসবাস যে ঈশ্বরের, তার ক্ষমতাবলে তাদের সম্রাটকে সুস্থ করে তুলতে।

সে চেষ্টা করে। কিন্তু ১৪৯২ সালে মুসলমান মুরদের বিতাড়িত ও ধর্মান্তরিত করে যে ঈশ্বরকে জাগ্রত করা গিয়েছিল স্পেনে এবং যার পুরস্কার হিসেবে কলম্বাসের হাত দিয়ে তিনি স্পেনকে আমেরিকা উপহার দিয়েছেন, তিনি তখন ‘অশ্বিনীদ্বয় পরিবেশিত সোমরসে’ চুর হয়ে গহিন নিদ্রায়।

টিটু কুসিকে বাঁচানো যায় না।

শালা বাটপার! পুন্দি মারি তোর!

লোকজন ধর্মযাজককে বোগাস ধর্মের বিক্রেতা মনে করে হত্যা করে।

তুপাক আমারুর বয়েস তখন ২৫-২৬। মন্দিরের নির্জন জীবন থেকে উৎপাটন করে জনগণ তাকে সিংহাসনে বসায়। পাখির ডাক যার শ্রবণে, যে গাছের ছায়া, পাতার মর্মর, নদীর তরঙ্গে তন্ময়, সে রাজা নয়, কবি। কবির শাসক হতে নেই। একজন স্প্যানিশ দূতকে পাঠানো হয় কুস্কো থেকে। তুপাকের অজ্ঞাতে পথেই কে বা কারা তাকে হত্যা করে। আমারুকে দোষারোপ করা হয়। অথচ ঘটনার সঙ্গে তার সম্পৃক্তির কোনই প্রমাণ ছিল না। কিন্তু যুদ্ধ করার জন্য ইচ্ছাই যথেষ্ট। শাদা মানুষের মুখের কথাই প্রমাণ।

বিলকা বাম্বা ধ্বংস করা না গেলে দস্যুবৃত্তি নির্ঝঞ্ঝাট হবে না।

তারা যুদ্ধের ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়।

ইনকাদের শেষ সম্রাট তুপাক আমারু পরাজিত হন ২৩ জুন, বাংলার পলাশির যুদ্ধের দিন।

তাকে হত্যা করা হয় ৪ মাস পরে, ২৪ সেপ্টেম্বর ১৫৭২ সালে।

পরের দিন সকালে নাস্তা শেষ করার পরে ট্যুর বাস এসে থামে হোটেলের সামনে। ট্রেন স্টেশনে নামিয়ে দেওয়া হয়। পেরু রেলের ঝকঝকে সুন্দর ট্রেন। প্লেনের মতো দুই সারি সিট, মাঝখান দিয়ে চলাচল। দুই দিকেই শুধু বড় বড় জানালা নয়, ছাদেও কাচের জানালা, ফলে দিনের আলোয় ঝলমলে ট্রেন। শুধু পার্শ্ব নয়, ছাদ জানলা দিয়ে অপূর্ব সব পাহাড় দেখা যায় এবং মাচুপিচু যাবার এই ট্রেন জার্নি স্মরণে রাখার মতো।

ট্রেন ছেড়ে দেবার পরে পরিচারিকা নাস্তা নিয়ে আসে, গরম স্যান্ডউইচ, চা ও কফি। সদ্য তৈরি কফির ঘ্রাণ কামরায় ভুরভুর করে।

উরুবাম্বা নদীর তীর ধরে ট্রেন চলছে মাঠ, শস্যের খেত, পাহাড় গিরি ও গিরিখাতের মধ্য দিয়ে। উরুবাম্বা নদী নয়, বরং বারো বা তেরোর সদ্য রজঃস্বলা কিশোরী। নদী বলতে আমরা যা বুঝি মোটেও তা নয়, এর তলা জলে ডোবা নয় বরং বড় বড় পাথরে ভাসা, যে পাথর থেকে ভিরাকুচা তার প্রথম মানুষ সৃষ্টি করেছিলেন এবং পরে বিরক্ত হয়ে সেই মানুষের অনেককেই আবার পাথরে পরিণত করেছিলেন। এরা সেসব সত্তা অর্থাৎ এদের সবারই প্রাণ আছে এবং এরা কেউ ছোট, কেউ বড়, কেউ বিশাল। স্রোতধারা তন্বী, পাথরে বাড়ি খেয়ে খেয়ে বিরক্ত, রাগান্বিত এবং উচ্চস্বরা অথবা এসব কিছু নয়, আনন্দে উচ্ছল, চপলা, পায়ে তার নূপুর ও নৃত্য, কণ্ঠে গান ও তনুতে নাচের মুদ্রা। কোথাও আবার জলে তলা ঢাকা এবং রঙিন লাইফ জ্যাকেট পরা ট্যুরিস্টরা ‘কান্যু’ বা ‘কাইয়াকে’ চড়ে বৈঠা বাইছে। কোথাও জল থেকে খাড়া আকাশে উঠে গেছে গিরি দেয়াল এবং সবুজ ছত্রাক গজিয়ে পাথরে জীবনের প্রলেপ দিয়েছে। পাখা মেলে দিয়ে আকাশে নীরবে রোদ পোহাচ্ছে অ্যান্ডিজ চিল। হুট করে ছুটে যায় ‘চিরিমইয়া’ বা কাস্টার আপেল বৃক্ষ, ওর ফল নাকি খুব মিষ্টি। কখনও দেখা যায় মিষ্টি ফলের ‘লুকমা’ গাছ। কখনও প্রসূনে অপ্রসূনে পাহাড়ে বা গাছে ঝুলে আছে অর্কিড। পাতাগুলো সবুজ ও সতেজ।

দেখো দেখো কত সুন্দর সুন্দর ফুল! শ্বেতা উচ্ছ্বাসে গমগম করে।

ওই দেখো আরও একটা ফ্যালানোপসিস। আমার বিশ্বাস এটার গন্ধ সুন্দর।

৪০০ ভ্যারাইটির অর্কিড হয় মাচুপিচুর উঁচু পাহাড়ে। কয়টি আর দেখা যায়, চেনা তো দূরের কথা। শ্বেতা কিছু চেনে, কারণ সে ওই জগতে বিচরণ করে। আমার কাছে কোনটা ফ্যালানোপসিস, কোনটা ভান্দা, দিন শেষের আঁধার কক্ষে সবই কালো বেড়াল।

প্রায় ৪ ঘণ্টা সময় লাগে কুস্কো থেকে মাচুপিচু পৌঁছাতে। ১০৬ মাইল দূরত্বের সবটাই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সমৃদ্ধ। বাসে চড়ে বসি। বাস আমাদের নিয়ে যায় অনেক উঁচু পাহাড়ের চূড়ায় গড়া শহরে। পাহাড়ের পাশ ঘেঁষে ঘেঁষে মেখলার মতো পথ, পথ ঊর্ধ্ব বা অতলমুখী। বাস চলছে বড় বড় পাইনগাছের শির বা শিকড় ছুঁয়ে। এখন অনেক নিচুতে, গিরিখাদে উরুবাম্বা বয়ে যাচ্ছে সর্বশেষ ইনকা শহর বিলকা বাম্বা বা এলদোরাদোর দিকে। নদীর অন্য তীরে উঁচু পাহাড়। পাহাড় কি পাহাড়কে স্পর্শ করতে পারে, নাকি কোটি কোটি বছর তারা চেয়ে থাকে একে অন্যের দিকে ?

তারা কথা কয় ?

‘এক পাহাড়ের চূড়া থেকে অন্য পাহাড়ের চূড়ায় যাবার সবচেয়ে কম দূরত্ব হলো সরল রেখায় কিন্তু তোমার তাতে লম্বা পা লাগে’―নিৎসের জরথস্ত্রু বলেন। আমার পা ছোট এবং তারও চেয়ে ছোট সাহস।

বাস যখন ক্লিফের খুব কাছে চলে আসে, মনে হয় এই বুঝি শুরু হবে ইকারুস-উড়াল। শরীর কাঁপে এবং ওই রাস্তাটুকু পার হলে গায়ে ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মতো লাগে। গাইড চুপ করে নেই। সে বলেই যাচ্ছে এবং মোদ্দা কথা হলো অঢেল প্রাচুর্যের শহর ছিল বিলকা বাম্বা এবং তা এখনও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

যখন পেরু আসবে, আমি তোমাকে মাচুপিচু নিয়ে যাব―আনাবেলা বলেছিল।

মাচুপিচু কী ?

সে আমাকে পরিচিত করেছিল মানুষের শ্রমে ও ঘামে তৈরি বিস্ময়কর এক শহরের কথা।

ছোট পা নিয়ে আমি সেখানে যাচ্ছি। আনাবেলা নয়, শ্বেতা আমার পাশে এবং গাইড বলেই চলেছে, মাচুপিচুকে সারা বিশ্বের সামনে পরিচিত করেন হাইরাম বিংগহাম। তিনি ১৯১১ সালে পাহাড়ের ওপর দিয়ে নদীর সমান্তরালে চলা এক হাঁটাপথ ধরে এসে মাচুপিচু খুঁজে পান। যদিও তার আগে ফ্রেঞ্চ, জার্মান, ইতালিয়ান কিছু লোকজন এখানে ঘুরে গেছে। হাইরাম বিংগহামের গাইড হয় যে, পরিবার নিয়ে সে বাস করত মাচুপিচুর ধ্বংসাবশেষে, চাষবাস করত। সেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখায়। বহু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে তিনি আমেরিকায় ফেরেন, রাতারাতি খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। তারপরে ফিরে আসেন বার বার।

এখানে কোনও স্বর্ণ পাওয়া যায়নি―তিনি উল্লেখ করেছেন। যদিও পরে পেরুর লোকজন একটি ভারী সোনার ব্রেসলেট খুঁজে পায় এবং তাদের সন্দেহ হয় নগ্ন পুঁজির দেশের মহাপুরুষ হাইরাম বিংগহাম সত্য কথা নাও বলে থাকতে পারেন, সে কথাটি ডিপ্লোমাটিকভাবে পরিবেশন করে।

ইনকাদের দাস ছিল না। প্রতিটি নাগরিককে কাজ করতে হতো। জনসাধারণ শুধু একজনই স্ত্রী রাখতে পারত। তবে বিয়ের আগে কয়েক বছর তারা একসঙ্গে বসবাস করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে পারত তারা একে অন্যের উপযুক্ত কি না।

সম্রাটরা বৈধভাবে একাধিক উপস্ত্রী রাখতে পারত কিন্তু বিয়ে করতে পারত শুধু নিজের বোনকেই। বোনই ছিল বিশুদ্ধতম ব্লাড লাইন। সে-ই শুধু সম্মান পেত রাজরানির। রাজরানির পুত্রই হতো ভবিষ্যৎ বংশধর এবং সিংহাসনের উত্তরাধিকারী।

রোড, হাইওয়ে, বড় বড় স্থাপনা ইত্যাদি তৈরি করার জন্য ইনকা সাম্রাজ্যে ‘মিতা সিস্টেম’ ব্যবহার হতো। যে কোনও মানুষ ১৫ বছর বয়েস থেকে ৫০ বছর বয়েস পর্যন্ত সরকারের জন্য বছরের একটা নির্দিষ্ট সময় কাজ করত বিনা পারিশ্রমিকে। তার বিনিময়ে তার অবর্তমানে সরকার তার পরিবারের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিত। এই সিস্টেম ব্যবহার করেই ১৪৫০ সালের দিকে মাচুপিচু তৈরি হয়। এই দেশে ভারবাহী উট, অশ্ব ও গর্দভ কিছুই ছিল না। ভার বইতো লামা ও আলপাকা। ওরা এত উঁচু পাহাড়ের ওপর একটি আস্ত শহর তৈরি করল কীভাবে, কীভাবে এত বড় বড় পাথর তুলে নিল সেখানে, তা আজও বিস্ময়ের বিষয়।

বাস এসে থামে পার্কিং লটে। সেখান থেকে হেঁটে আরও ওপরে যেতে হয়। শ্বাস নিতে কষ্ট। থেমে থেমে হাঁটি। দেখি পাহাড়ের অধিত্যকায়, দুই পাহাড়ের মাঝখানে একটি শহরের ভগ্নাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে। শহরের পেছনে বা উত্তর দিকে, অর্থাৎ আমাদের দৃষ্টি বরাবর সরু চূড়ার যে পাহাড়টি দাঁড়ানো, তার নাম ওয়াইনা পিচু বা তরুণ পর্বত। মাচুপিচুর ছবিতে আমরা পাহাড়টিই দেখতে পাই। ইনকারা তার চূড়া পর্যন্ত সিঁড়ি, হাঁটা পথ, কক্ষ ও বেদি তৈরি করেছে। আর আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে আছি বা শহরটি যেখানে, তার নাম মাচুপিচু বা বৃদ্ধ পর্বত। অ্যান্ডিজ পর্বতমালার বিলকা বাম্বা মাউন্টেইন রেঞ্জের পূর্ব ঢালুতে প্রতিষ্ঠিত শহরটি সমুদ্রস্তরের থেকে প্রায় ৮ হাজার ফিট ওপরে।

শহরের নাম কী, কেউ জানে না। দুই ভাগ তার―কৃষিশহর ও পৌরশহর। পাহাড়ের দক্ষিণে কৃষিশহর, যেখানে কর্মজীবী সাধারণ জনগণ বাস করত। কৃষিশহরে ছিল পয়ঃনিষ্কাশনের খন্দ। দেয়াল ও মুখ্য ফটক দিয়ে এই শহর পৃথক। পৌরশহরেরও দুই ভাগ―পশ্চিম দিকে উচ্চ শহর বা হানান, পুবদিকে নিচু শহর বা হিউরিন। তাদের মাঝে সেন্ট্রাল প্লাজা বা চওপি পাটা, যা পৌরশহরের নাগরিকদের মিটিংস্থল। ৮০০-১০০০ মানুষের বাসস্থান ছিল মাচুপিচু শহরে।

উরুবাম্বা নদীর তীর থেকে পাহাড়ে শীর্ষ পর্যন্ত উঠে যাওয়া হাঁটাপথ দিয়ে শহরে প্রবেশ করতে হতো দক্ষিণ ফটক দিয়ে, যার নাম ‘সান গেইট’ বা ইন্টিপুঙ্কু। শহরের উঁচুতম এ স্থানেই রয়েছে দ্বাররক্ষীর কুঁড়ে, দ্বিতল সংরক্ষণাগার ও অনুষ্ঠানাদি সম্পন্ন করার বিশাল প্রহেলিকা প্রস্তর। এখান থেকেই প্রথম উন্মুক্ত হয় সর্বজন পরিচিত মাচুপিচুর দৃশ্য এবং এখান থেকে শহরটি উত্তর প্রান্ত পর্যন্ত ২ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ।

ধারণা করা হয়ে থাকে মাচুপিচু ছিল একটি রাজপ্রাসাদ এবং শহরের বিভাজন ছিল মূলত সেই প্রাসাদের সার্ভিসে নিযুক্ত লোকজনের রেঙ্ক অনুযায়ী। হয়তো কিছু সম্ভ্রান্তও সেখানে বাস করত। ইনকা সাম্রাজ্যে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় শক্তির বিভাজন ছিল না। সম্রাটই ছিলেন দুই শক্তির মূলাধার।

স্থাপনাগুলো গ্রানাইট স্টোন দিয়ে তৈরি। বড় বড় পাথর কাটা হতো এক বিশেষ পদ্ধতি অবলম্বন করে। তাদের মধ্যে প্রাকৃতিকভাবে যে ফাটল তৈরি হয় তার ভেতরে হেমাটাইট স্টোনের হাতুড়ি ব্যবহার করে ছোট ছোট কাঠের টুকরা ঢুকানো হতো। বৃষ্টিতে ভিজে সেই কাঠ ফুলে উঠলে তাতে পাথরের ফাটল আরও একটু বড় ও দীর্ঘ হতো। তখন হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে কাঠের টুকরোটি আরও কিছুটা ভেতরে ঢুকানো যেত। এই পদ্ধতি ছিল অতি ধীর, বছরের পর বছর লেগে যেত। ব্যাসাল্ট স্টোন ব্যবহার করা হতো পাথর কাটার পরে কার্ভিং করার জন্য।

সিমেন্টের ব্যবহার তারা জানত না। কাদা মাটি বা মাড মর্টার বা পাথরে পাথরে ইন্টারলকিং সিস্টেম ব্যবহার করা হতো। এই সিস্টেম ছিল ভূমিকম্পে স্থায়ী। দেখা গেছে যেসব ইনকা মন্দির বা স্থাপনা ধ্বংস করে তাদের ভিত্তির ওপর স্প্যানিশ বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছিল, ভূমিকম্পে সেই ওপরাংশ ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু ইনকা অংশটুকু রয়ে গেছে ক্ষতিহীন।

সবচেয়ে বড় ইনকা ঈশ্বর হলেন―সূর্যদেব বা সান গড। কিন্তু ব্যাপারটি সোজাসাপ্টা নয়। খ্রিস্টান ধর্মে যেমন একজন সর্বশক্তিমান, নিরাকার এবং অদৃশ্য ঈশ্বর আছেন এবং যীশুকে মনে করা হয় তার দৃশ্যমান অবতার হিসেবে, খ্রিস্টধর্ম এখানে আসার বহু আগেই, ইনকারা তৈরি করে নিয়েছে তাদের ‘অমনিপটেন্ট, সুপেরিয়র ও ইনভিজিবল গড’কে। তিনি ‘ভিরাকুচা’, তার দৃশ্যমান রূপ হলেন সূর্যদেব। ভিরাকুচাকে প্রকাশ করা হয় ডিম্বাকৃতি বা ওভাল শেইপের মাধ্যমে এবং আঁকা হয় একজন শাদা দাঁড়িওয়ালা বৃদ্ধ হিসেবে। খ্রিস্টান ধর্মেও ঈশ্বর বৃদ্ধ এবং শাদা শ্মশ্রুমণ্ডিত। মহাসমুদ্র দিয়ে বিযুক্ত মহাদেশ, একে অন্যের অস্তিত্বের খবর রাখে না, অথচ দুইয়ের চিন্তার সাযুজ্য বিস্ময়কর।

এখানকার মূল মন্দির ‘সান টেম্পল’। ‘নুস্তা প্রাসাদ’ও বলা হয় তাকে। পাথরের তৈরি অর্ধবৃত্তাকার একটি দ্বিতল দালান, তিনটি জানালাসহ, তাই এর আর এক নাম ‘তিন জানালার মন্দির।’ এই মন্দিরের নিচে আছে ৩২টি পাথর দিয়ে তৈরি গুহা, ধারণা করা হয় ওটা ছিল রাজকীয় সমাধিস্থল বা মুসোলিয়াম।

‘তিন’ হলো ইনকাদের পবিত্র সংখ্যা। তাদের ক্রুশে আছে, যেখানে তিনটি স্তর:

আকাশ―যার প্রতীক শকুন।

পৃথিবী বা ‘পাচা মামা’, তার প্রতীক পুমা। পুমা শক্তি ও ক্ষমতার প্রতিনিধিত্ব করে।

পাতাল জগতের প্রতীক হলো সাপ।

ইনকা সমাজে আইনও ছিল মাত্র তিনটি :

মিথ্যা বলো না।

চুরি করো না।

আলসেমি করো না।

সহজ, সুন্দর ও মেনে চলা কষ্টসাধ্য নয়।

একস্থানে রয়েছে জল দর্পণ বা ওয়াটার মিরর, যার উপযোগিতা এখনও অজ্ঞাত। ধারণা করা হয় এটা হয়তো এস্ট্রোনমিকাল কোনও যন্ত্র। বিশাল দুই পাখার পাথরের শকুনও রয়েছে। তার পাখায় আছে মানুষের আত্মা স্বর্গে বহন করার কুলুঙ্গি বা অগভীর খাঁজ।

ইন্তিওয়াতানা নামে পিরামিডের ধ্বংসাবশেষ দেখতে পাই। শব্দটির অর্থ ‘যেখানে সূর্যকে বেঁধে রাখা হয়’। এছাড়া রয়েছে ছেলেদের আবাসিক শিক্ষালয়―‘ইয়াকাই ওয়াচি’ বা জ্ঞানগৃহ―যেখানে ছেলেরা শিখত রাজ্যচালনার কলাকৌশল। অভিজাত ঘরের মেয়েদের স্কুলের নাম ছিল ‘আকিয়া ওয়াচি’―যেখানে তাদের শেখানো হতো কাপড় বুনন, রন্ধন ও অভিজাতদের জন্য চিচা তৈরির বিদ্যা। চিচা হল ভুট্টা থেকে তৈরি স্থানীয় সোমরস।

আকিয়া ওয়াচির বিশুদ্ধ নারীদের জীবন কাটতো চিরকুমারী হিসেবে। পছন্দ হলে একমাত্র ইনকা সম্রাট এদের কাউকে প্রেমিকা বা উপপত্নী হিসেবে গ্রহণ করতে পারতেন। অন্যথায় পুরুষের সংস্পর্শ, প্রেম বা যৌন সঙ্গম ছিল তাদের জন্য নিষিদ্ধ। তবে সমাজে তাদের স্থান ছিল খুবই সম্মানের। কখনও কখনও প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ ও অন্যান্য দুঃসময়ের সময় দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য এদের মধ্য থেকে ১২-১৩ বছর বয়েসী কুমারীদের বলি দেওয়া হতো। মানুষের যেমন দেবতাদেরও তেমনি সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে সতেজ, যে কোনও রকমের ত্রুটিমুক্ত মেয়েরাই পছন্দের। বলিদানের আগে তাদের উত্তম খাদ্য পরিবেশন করা হতো যাতে তারা ক্ষুধার্ত ও ক্রন্দনশীল অবস্থায় দেবতাদের কাছে উপস্থিত না হয়। উৎসর্গীকৃত মেয়েদের দেহ ফিটাল পজিশনে মমিতে রূপান্তর করা হতো।

মেয়েরা নাকি সানন্দে ও স্বেচ্ছায় গ্রহণ করত সম্মানের মৃত্যু, আমাদের গাইড বলে। সতীদাহের সতীদের সম্পর্কে সমাজপতিদের মুখেও অবশ্য আমরা এ কথাই শুনেছি। স্প্যানিশরা কখনই  মাচুপিচু আসেনি কিন্তু ‘আসছে’ এই ভয়ে তারা এই শহর ছেড়ে চলে যায় মোটামুটি ১৫৩৫ সালের দিকে। জনমানবহীন শহর আস্তে আস্তে হারিয়ে যায় মানবজাতির ইতিহাস থেকে ১৯১১ সাল পর্যন্ত।

৩০০ বছর স্থায়ী হয় স্প্যানিশ শাসন। এই সময়ে স্প্যানিশ রক্ত ও অ্যান্ডিয়ান রক্ত মেলামেশা করে এবং স্পেন ও মাগরেবের মুসলমান ও পশ্চিম আফ্রিকার যে দাসেদের নিয়ে আসা হয়েছিল, তাদের রক্তও মিশে যায় অভিন্ন জিনের নদীতে এবং তৈরি হয় পেরুর জনগোষ্ঠী। পুরাতন ইনকা সভ্যতার সঙ্গে বাইরে থেকে আসা সভ্যতাগুলো মিলেমিশে তৈরি করে এর অতুল্য সংস্কৃতি। এবং তাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন আর্জেন্টিনার হোসে ডে সান মার্টিন এবং ভেনেজুয়েলার সাইমন বলিভার। সান মার্টিন ১৮২১ সালের ২৮ জুলাই পেরুকে স্পেনের শাসন থেকে স্বাধীন ঘোষণা করেন। ১৮২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে ভেনেজুয়েলার জেনারেল আন্তোনিও হোসে ডে সুক্রে ‘আইয়াকুচো ব্যাটেলে’ স্পেনিশদের পরাজিত করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন।

তারপরে যা হয়, বিশৃঙ্খলা, বিপর্যয়, ষড়যন্ত্র, কূটচাল, যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দুর্নীতি, ক্ষমতার লড়াই। এরই মধ্যে চিনা শ্রমিকরা আসে ক্যান্টন এবং ম্যাকাও থেকে, আসে ওকিনাওয়ার জাপানিরা, তিরলের জার্মান ও অস্ট্রিয়ানরা। লিগুরিয়ার ইতালিয়ানরাও ঝাঁপ দেয় নতুন জাতিগঠনের ফুটন্ত কড়াইয়ে। প্রেসিডেন্ট রামোন কাস্তিয়া এবং হোসে বালাতা কালো ও আদিবাসীদের দাসত্বমুক্ত করেন, এশিয়া ও ইউরোপ থেকে পেরুতে ইমিগ্রেশন উৎসাহিত করেন। কিন্তু এগিয়ে আসে বিপর্যয়। ১৮৭৯-১৮৮৩ সালে পেরু-চিলি যুদ্ধে পেরু পরাজিত হয়।

পেরু এবং ইকোয়াডোরের মধ্যেও নিয়মিত বর্ডার বিতর্ক ও গোলাগুলি চলতে থাকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। তারপরে শান্তি চুক্তির মাধ্যমে বিরোধের অবসান হয়। কিন্তু চিলি-পেরু দ্বন্দ্ব শেষ পর্যন্ত ২০১৪ সালে হেগের আন্তর্জাতিক আদালতে সমাধান হয়।

১৯৬৮ সালে জেনারেল ভেলাস্কো একটি বামপন্থি ক্যুয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। কৃষি রিফর্ম, শিল্পের রাষ্ট্রীয় মালিকানা, পেট্রোলিয়াম, খনি ও কয়েকটি ব্যাংকের রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়। সেই সঙ্গে প্রচার মাধ্যমগুলোর স্বাধীনতা অপহৃত হয়।

১৯৭৫ সালে জেনারেল ভেলাস্কোকে সরিয়ে জেনারেল মোরালেস বেরমুডেজ ক্ষমতা দখল করেন। ক্ষমতার অপব্যবহার, দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় শিল্পের অপপরিচালনা ইত্যাদি কারণে পেরু অর্থনৈতিক চোরাবালিতে পতিত হয়। তীব্র আন্দোলনের ফলে মিলিটারি শাসকরা ১৯৮০ সালে নির্বাচন দিতে বাধ্য হন এবং ১৯৬৮ সালে নির্বাচিত যে প্রেসিডেন্ট ফেরনান্দো বেলাউন্দে টেরিকে উৎখাত করা হয়েছিল, তিনি পুনঃনির্বাচিত হয়ে ফিরে আসেন। কিন্তু শান্তি আসে না, দেশে গৃহযুদ্ধ চলতেই থাকে।

কুস্কো ত্যাগ করে আমরা লিমা এসে পৌঁছাই ২৩ জুন।

মহাসাগর উপকূলবর্তী লিমার মিরাফ্লোরেস জেলায় হোটেল। পায়ে হেঁটে বিচে চলে যাওয়া যায়। বেশ সুন্দর। মিরাফ্লোরেস পমেনেড নামে সমুদ্র তীরবর্তী কিন্তু অনেক উঁচুতে অবস্থিত একটি বিশাল পার্কে বিশাল এক ভাস্কর্যে যৌবনবতী এক নারী আধশোয়া অবস্থায় নিবিড় চুম্বন ও আলিঙ্গনে আবদ্ধ রয়েছে তার প্রেমিকের সঙ্গে। ডেলফিন নামে এক ভাস্করের কাজ এটি, নাম চুম্বন। তাদের দিকে তাকিয়ে আছে উন্মুক্ত মহাসমুদ্র, ঢেউ আর মহাকালের ফেনা।

The sunlight claps the earth, and the moonbeams kiss the sea:

what are all these kissings worth, if thou kiss not me ?*

শহর ঘুরে দেখি ট্যুর গাইড নিয়ে। 

গভর্নমেন্ট প্যালেস গড়া হয়েছিল লিমা ভ্যালির অধীশ্বরের প্রাচীন তাওলিচুস্কো প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষের ওপর। ফ্রান্সিসকো পিজারোর প্রথম গভর্নমেন্ট ভবন এটি। এখানে বসেই সে নদীপথের নিয়ন্ত্রণ করত। এর স্থাপত্যে মুর সভ্যতার বহু এলিমেন্ট ব্যবহার করা হয়েছে এবং গাইড তার অনুপুঙ্খ বর্ণনা দেয়। পাশেই পেরুর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভবনটিও একইভাবে মুর স্থাপত্যে সমৃদ্ধ। ‘অ্যানেজল ডে লা ফামা’ নামে ব্রোঞ্জের বিশাল একটি ফাউন্টেন রয়েছে প্রাসাদ চত্বরে।

লিমা ক্যাথেড্রাল প্রি-হিস্পানিক পুমা ইন্তি মন্দিরের ওপরে কেচোয়া ধর্মের ওপরে ক্যাথোলিক ধর্মের বিজয়ের প্রতীক হিসেবে পিজারো এর ভিত্তি প্রস্তর করে। সে নিজে সমাহিত আছে এখানেই। ১৯৭৩ সাল থেকে এটি একটি ধর্মবিষয়ক মিউজিয়াম।

বারোক ও মুরিশ স্টাইলে ১৫৪৬ সালে তৈরি সান ফ্রানসিসকো মনাস্টেরি, একসময়ে ছিল লিমার সবচেয়ে বড় ইমারত। এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ কালচারাল সেন্টার, সেখানে অতি প্রাচীন লাইব্রেরি আছে প্রায় ২৫০০০ বইসহ। এর দেয়ালগুলো সজ্জিত সিডর কাঠে খোদাই করা বিভিন্ন সন্তের মূর্তি দিয়ে। এর নিচতলায় ভূগর্ভস্থ একটি কক্ষে এই চার্চের সদস্য, শহরের গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমাহিত করা হতো। সেখানে গোল ডিজাইন করে সাজিয়ে রাখা আছে প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড়।

দেখি ওয়াকা পুকিয়ানা নামের বিশাল পিরামিড। পাথর নয় মাটি দিয়ে তৈরি। প্রায় ১০ একর এলাকাজুড়ে, ৫০০ মিটার লম্বা, ১০০ মিটার প্রশস্ত এবং ২২ মিটার উঁচু। ষষ্ঠ শতাব্দীতে তৈরি। এই পিরামিডের মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন কক্ষ, বারান্দা এবং ভেতরে ঢোকার রাস্তা। খনন করে পাওয়া গেছে নানা ধরনের টেক্সটাইল, লাল, শাদা, কালো, ধূসর ও কমলালেবুর রঙের সিরামিক। এছাড়া ভুট্টা, শিম বিচি, বিভিন্ন ফল (চিরিময়া, পাকাই, লুকুমা, পেয়ারা) বিভিন্ন গৃহপালিত প্রাণি―আলপাকা, লামা, গিনিপিগ, হাঁস ইত্যাদির আকৃতির নানা জিনিস। ধারণা করা হয় এটি হয়তো কোনও প্রি-ইনকা এডমিনিস্ট্রিটিভ বিল্ডিং ছিল। লিমার উপকূলে নাকি এমন পিরামিড ছিল শত শত। স্প্যানিশরা যখন আসে তারা ইক্ষু প্লানটেশন করার জন্য পিড়ামিডগুলো কেটে কেটে সমতল জমি তৈরি করে।

বাগানবিলাস ফুলে ফুলে ঢাকা, বড় বড় গাছে রংবেরঙের ধুতুরা ফুল বা এনেজল ট্রাম্পেট ও নানা রকমের সুন্দর সুন্দর ফুল ও গাছপালা দিয়ে সজ্জিত ন্যাশনাল মিউজিয়াম অব আর্কিওলোজি ও এনথ্রোপলোজি আমাদের অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান দেয়। পেরুর সভ্যতা যে প্রায় ৫ হাজার বছরের প্রাচীন, আমার জানা ছিল না। এখানে সময় কাটিয়ে আবারও উপলব্ধি করি, কোনও দেশে গিয়ে তার ন্যাশনাল মিউজিয়াম না দেখলে সেই দেশ সম্পর্কে জানায় খামতি থেকে যায়।

একটি রেস্টুরেন্টে সান্ধ্যভোজন সেরে হাঁটতে বের হই অসংখ্য রঙিন ফোয়ারার এক পার্কে। এরা বলে ‘দি ম্যাজিক ওয়াটার সার্কিট’, রঙিন আলো ঝলমলে, বৈচিত্র্যময় ১৩টি ফোয়ারার, গিনেস বইয়ের নাকি পৃথিবীর সর্ববৃহৎ কমপ্লেক্স। বহু লোকজন, প্রেম-পিরিত, বহু যুবক যুবতী, রাত, মিউজিক ও লেজার লাইটে চোখ ধাঁধানো রাষ্ট্রীয় অর্থ অপচয়ের পুঁজিবাদী তৃতীয় দুনিয়ার ফ্যাশন পার্ক।

‘পুঁজিবাদ তোমার চোখ ধাঁধিয়ে, অনুভূতিকে থেঁতলে দেবে, তুমি শুধু তোমার কথা ভাববে, তোমার লাভ-ক্ষতি, তোমার সুখ, তোমার অনুভূতির কথা কিন্তু বিপ্লবীরা কিছু করতে চায়, চুপ করে বসে থাকে না, বর্তমানকে বদলাতে চায়, চায় নিজের জন্য নয়, সবার জন্য। তারা ভুল করতে পারে, ভ্রান্ত বা বিভ্রান্ত হতে পারে কিন্তু তাদের মহৎ উদ্দেশ্যকে তুমি খাটো করে দেখতে পারো না।’

আনাবেলার কণ্ঠ বাজে।

অনুভব করি সাম্রাজ্যবাদী শোষণের নাগপাশে নিষ্পেষিত পেরুর সাধারণ জনগণ আমার দেশের জনসাধারণের মতোই, সন্তানের মুখে অন্ন তুলে দেওয়ার সংগ্রামে সদা ব্যস্ত।

এই পার্ক তাদের না হলেও চলে কিন্তু পুঁজিবাদী প্রভু ?

হোক তারা মুষ্টিমেয়, নগণ্য সংখ্যার, তাদের কথাও তো ভাবতে হয়, না কি ? 

শেষের দিনটি, ২৪ জুন, কাটে Legends park গার্ডেনে। বিশাল একটি ন্যাশনাল পার্ক, অসংখ্য পশুপাখি গাছপালা নিয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা। লাল লাল ফুলে শোভিত বহু আফ্রিকান টিউলিপ গাছ।

কী যে সুন্দর!

মাটির পিরামিড বেশ কয়েকটি।

চুপ করে মাটিতে বসে আছে টাপির। সরু ছুঁচো নাকমুখ। আলপাকা চেয়ে আছে, লামা হাঁটছে, বানর লাফিয়ে যাচ্ছে গাছের এক ডালা থেকে অন্য ডালায়। আরও কত কত প্রাণি, ফুল। অলস, শান্তিময় একটি দিন। হিয়া, অমিতা, বুলা, চিনু, শ্বেতা, সম্বিত, প্রদীপ ও দেবাশীষের উষ্ণ, হাস্যোজ্জ্বল সান্নিধ্যের শেষ দিন।

রাতে খেতে আসি এক রেস্টুরেন্টে। মেন্যু হাতে এগিয়ে আসে মেয়েটি।

মুখে হাসি, মিমিকে সৌষ্ঠব এবং ওর চোখ নাচে যার মতো, সে আমার হৃদয়ের খুব কাছের। চিনতে একটুও কষ্ট হয় না।

ইয়ো সয় ইসাবেলা! (আমি ইসাবেলা)

দে লা রোসা ? প্রশ্ন করি।

সে বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে।

সি! কোমো সাবেজ। (ই-য়ে-স, তুমি কী করে জানো ?)

আনাবেলা ডে লা রোসার মেয়ে ?

শুভ্র পাথরের গালাতেয়া সে, চোখে স্থির স্ফটিক!

মাকে তুমি কীভাবে চেনো ?

রাশিয়ায় পড়াশোনা করেছে ? লেনিনগ্রাদে ?

সি!

আমি লাফ দিয়ে দাঁড়াই, আমি তোমার মায়ের বন্ধু।

তুমি, তুমি… ? তার মুখে খুব স্পষ্ট আমার নামটা প্রশ্নবোধক চিহ্নে থামে।

হ্যাঁ, তোমাকে একটু আলিঙ্গন করতে পারি ?

নিজের মেয়ের মতো, চুপ করে সে আমার বুকে ধরা দিয়ে মিশে থাকে। আমার সঙ্গীরা, আমার স্ত্রী বিস্মিত ও বোবা এবং আমিও।

ব্যগ্র হয়ে প্রশ্ন করি―‘আনাবেলা কোথায় ? কেমন আছে ?’

ইসাবেলা চুপ করে থাকে।

তারপরে ধীর, শান্ত গলায় বলে, ১৯৯৬ সালে মাকে কিডন্যাপ করে হত্যা করেছে ফুজিমোরির হায়েনারা। আমার বয়েস তখন ৫। আমার নানা-নানি দুজনেই যুদ্ধ করতে করতে নিহত হন, তারও আগে ১৯৯০ সালে, ফুজিমোরির ক্ষমতারোহণ এবং আমার মায়ের ফিরে আসার কয়েক মাস পরেই।

It is sweet and glorious to die for oneÕs country! সত্যি তাই নয় কি ?

কানে রিনরিন করে আনাবেলার কণ্ঠ। হোরেসের কবিতা পড়ে বিপ্লব জ্বলজ্বলে চোখে সে আমাকে প্রশ্ন করেছিল।

অবশ্যই! শিরা ও ধমনিতে বলকানো লোহিত নিয়ে আমি সায় দিয়েছিলাম।

আজ সে মৃত এবং আমি আমার দেশকে বদল করে নিয়েছি ইয়াংকি দেশের সঙ্গে!

পাদটীকা

               *George R. R. Martin―A Feast for Crows

৯ই মে ২০২৩

               *Percy Bysshe Shelley

               *Leigh Bardugo, King of Scars

               ১. পেরুবিষয়ক প্রবন্ধ―মার্ক কার্টরাইট (Mark Cartwright)

               ২. Hemming John: The conquest of the Inca. London : Pan Books , 2004

               ৩. Peru land of the Incas: Luis Felipe Villacorta Ostolaza

               ৪. Omnilogos.com Civil War Peru (1980-1996) Kathleen Gallagher Cunningham

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button