আর্কাইভউপন্যাস

উপন্যাসিকা : একটি পোষা ভূতের গল্প : রেজানুর রহমান

সুমন ভূত পোষে। এটা সবাই জানে। কিন্তু কেউই বিশ্বাস করে না। বিশ্বাস না করার অনেক কারণ আছে। প্রথম কারণ, ভূত কি পোষার জিনিস ? ভূত তো আর হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, কবুতর নয় যে পোষ মানবে ? তাছাড়া পৃথিবীতে ভূত নামে কিছু একটা আছে এটাই তো কেউ বিশ্বাস করে না। কাজেই ভূত পোষার গল্প বিশ্বাসযোগ্য হয় কীভাবে ?

দ্বিতীয় কারণ, সুমনের অনেক বদনাম আছে। মতিঝিল সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্র সে। কিন্তু স্কুলে যায় না। প্রতিদিন স্কুলে যাবার কথা বলে বাসা থেকে বের হয়ে যেখানে খুশি সেখানে চলে যায়। একদিন হয়তো কমলাপুর রেলস্টশনে গিয়ে ট্রেনের বগির ছাদে উঠে এলাকার বস্তির ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে আড্ডা দিল। আরেক দিন হয়তো চলে গেল সদরঘাট এলাকায়। নৌকা ভাড়া করে বুড়িগঙ্গায় ভ্রমণ করল। আরেক দিন ট্রেনের ছাদে চড়ে জয়দেবপুর পর্যন্ত গিয়েছিল। সেখানেই নাকি ভূতের সঙ্গে দেখা। জয়দেবপুর রেলস্টেশনে ট্রেন থামতে না থামতেই একদল পুলিশ বাঁশি ফুঁকিয়ে ট্রেনের বগির ছাদ থেকে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার ভয়াবহ অভিযান শুরু করে। পুলিশের লাঠির ভয়ে বগির ছাদ থেকে যে যেভাবে সম্ভব লাফ দিচ্ছিল। কিন্তু সুমন লাফ দেওয়ার সাহস পাচ্ছিল না। কমলাপুর রেল স্টেশনে ট্রেনের ছাদে ওঠার সময় সালাম, মমিন ও টুকটুকি তাকে সহযোগিতা করেছিল। তিনজনই কমলাপুর রেল স্টেশনের পাশে একটা বস্তিতে থাকে। কমলাপুর রেল স্টেশনে ঘোরাঘুরি করার সময় একদিন তাদের সঙ্গে পরিচয় হয় সুমনের। তাদের পরামর্শেই অন্য একদিন ট্রেনের ছাদে উঠে জয়দেবপুর চলে যায় সুমন। জার্নিটা ভালোই ছিল। ট্রেনের ছাদে ওঠার প্রথম অভিজ্ঞতা। ট্রেনের প্রায় প্রতিটি বগির ছাদে নানা বয়সের যাত্রী উঠেছে। ছোট ছোট বাচ্চাও আছে। ট্রেনের ছাদে ওঠার সময় প্রথম প্রথম ভয় হচ্ছিল সুমনের। ছাদে ওঠার পর যখন দেখল তার সামনে একটি বাচ্চা মেয়ে ট্রেনের ছাদে ওঠার আনন্দে খিলখিল করে হাসছে তখন ভয়কে তাড়িয়ে দেয় সুমন। সালাম, মমিন আর টুকটুকি মাঝে মাঝেই এভাবে ট্রেনের ছাদে ওঠে। যেখানে সেখানে চলে যায়। ওরা অভিজ্ঞ। তিনজনই সুমনকে বার বার সাহস দিচ্ছিলো। ভয় পাইয়ো না মিয়া। ট্রেনের ছাদে টিকিট লাগে না। টিকিট ফ্রি। কিন্তু জয়দেবপুর রেল স্টেশনে পৌঁছার পর দেখা গেল পুলিশের ভয়ে ওরা তিনজনই সবার আগে ট্রেনের ছাদে থেকে টুপ করে নেমে গেছে। অথচ সুমন ধারণা করেছিল তাকে ছেড়ে ওরা কেউ ট্রেনের ছাদ থেকে নামবে না।

পুলিশের লাঠির ভয়ে নিমিষেই ট্রেনের ছাদ ফাঁকা হয়ে গেছে। সুমন ছাদ থেকে নামার পথ খুঁজছিল। নিচে রেল স্টেশনের প্লাটফরমে দাঁড়িয়ে থাকা একজন পুলিশ লাঠি উঁচিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছে―অয় ব্যাটা নাম… নাম বলতেছি… আইজকা তরে…

পুলিশের লাঠির ভয়ে হাত-পা কাঁপতে শুরু করেছে সুমনের। ট্রেনের ছাদ থেকে নামার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। হঠাৎ কারও কান্না শুনে চমকে উঠল। মনে হলো পাশেই কোনও বাচ্চা ছেলে অথবা মেয়ে পুলিশের লাঠির ভয়ে কাঁদছে। কিন্তু কান্নাটা মানুষের বাচ্চাদের মতো নয়। নাকি সুরের কান্না। সিনেমায় দেখেছে ভূতের বাচ্চা এভাবে কাঁদে।

প্লাটফরমে দাঁড়ানো কয়েকজন পুলিশ সুমনকে উদ্দেশ্য করে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছে। ভাবটা এমন ট্রেনের ছাদ থেকে নামা মাত্রই ওরা সুমনকে গিলে খেয়ে ফেলবে।

সুমন তবু ট্রেনের ছাদ থেকে নামার পথ খুঁজতে থাকল। হঠাৎ দূরে সালাম, মমিন ও টুকটুকিকে দেখতে পেল। কীভাবে ট্রেনের ছাদ থেকে নামতে হয় সেটা অভিনয় করে দেখাচ্ছে সালাম। আগে ডান পা… তারপর…

হ্যাঁ, সুমন ট্রেনের ছাদ থেকে নামার পথ খুঁজে পেয়েছে। ট্রেনের ছাদ থেকে নামার অভিজ্ঞতা তো তার আছে। কিন্তু পুলিশের লাঠির ভয়ে সব ভূলে গেছে। নিচ থেকে পুলিশের হম্বিতম্বি চলছেই। ট্রেন ছাড়ার হইসেল শোনা গেল। তার মানে এক্ষুনি ট্রেন ছেড়ে দিবে। সুমন একবার ভাবল ট্রেনের ছাদ থেকে নামবে না। অন্য স্টেশনে নিশ্চয়ই পুলিশের ভয় থাকবে না। তখন নির্ভয়ে ট্রেন থেকে নেমে যাবে। কিন্তু পরক্ষণেই ঢাকায় ফেরার কথা মনে পড়ল। জয়দেবপুর থেকে ঢাকায় ফেরার পথ তার চেনা। অন্য স্টেশনে নামলে তো একটা ঝামেলা দেখা  দেবে। ফিরতি কোনও ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে। এসব ভেবে জয়দেবপুরেই ট্রেনের ছাদ থেকে নামার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিল সুমন। প্রথমে ডান পা ঝুলিয়ে দিয়ে ট্রেনের দরজার হাতলের সাপোর্ট নিতে হবে। তারপর প্লাটফরমের খাম্বা জড়িয়ে ধরে সুপারি গাছ থেকে নামার মতো করে নিচে নামতে হবে।

ট্রেনের হুইসেল শোনা যাচ্ছে। সালাম, মমিন ও টুকটুকি সমান তালে ট্রেনের ছাদ থেকে কীভাবে নামতে হয় তা অভিনয় করে দেখাচ্ছে।

ডান পা ঝুলিয়ে দিতেই আবার সেই নাকি সুরের কান্না শুনতে পেল সুমন। এবার মনে হলো একেবারে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বাচ্চা বয়সের কেউ কাঁদছে। সুমন কিছুটা ভয় পেয়েছে। তবে বুঝতে না দিয়ে প্রশ্ন করল―কে কাঁদে ?

হঠাৎ সুমনের সামনে অদ্ভুত আকারের একটা ছোট্ট প্রাণি দৃশ্যমান হলো। দেখতে বেটে খাটো। শরীরের গঠনের তুলনায় চোখ দুটো বেশ বড়। ছোট পা। লিলিপুটের মতো দেখতে। সুমন প্রশ্ন করল―কে তুমি ?

অদ্ভুত আকারের প্রাণি জবাব দিল―আমি ভূতের বাচ্চা।

সুমন এবার সত্যি সত্যি ভয় পেয়ে গেল। সুমন ভূতে বিশ্বাস করে না। কিন্তু চোখের সামনে যা ঘটছে, যা দেখছে তা অস্বীকার করবে কীভাবে ?

ভূতের বাচ্চা কাঁদতে কাঁদতে বলল―তুমি কি আমাকে দেখে ভয় পেয়েছো ? ভয় পাবে না। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করব না। তোমার একটু সহযোগিতা চাই।

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। অজানা পথ। তার ওপর ভূতের বাচ্চা সঙ্গী হয়েছে। আসলেই কি সে ভূতের বাচ্চা ? ট্রেনের ছাদে এল কী করে ?

ট্রেন বেশ জোরে যাচ্ছে। এইমাত্র বিকট শব্দে হুইসেল দিল। ভয়ে ভূতের বাচ্চা জড়িয়ে ধরল সুমনকে। সুমনের মনে হলো ভয়ংকর টাইপের কোনও সাপ তাকে পেঁচিয়ে ধরেছে। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। অনেক কসরত করে নিজেকে ছাড়িয়ে নিল সুমন। ধমক দিল ভূতের বাচ্চাকে।

এই মিয়া তুমি কি সত্যিই ভূত ? যতদূর জানি ভূতেরা ভয় পায় না, অন্যকে ভয় দেখায়। তুমি তো মিয়া ভূত নামের কলঙ্ক…

ভূতের বাচ্চা লজ্জা পেয়েছে এমন ভঙ্গি করে বলল―স্যরি আমার ভুল হয়ে গেছে…

সুমন বলল, ভুল হয়েছে এই কথার অর্থ কী ? তুমি রেল গাড়ির ছাদে এলে কী করে ? তোমার তো এখানে থাকার কথা না। আসল ঘটনা বলো।

ভূতের বাচ্চা বলল―আমি আমার বাবা-মায়ের সঙ্গে রেল ভ্রমণে বেরিয়েছিলাম।

সুমন বলল―রেল ভ্রমণ মানে ? তোমরা ভূতেরা তো যখন তখন যেখানে খুশি উড়ে যেতে পারো। রেল গাড়িতে চড়ার দরকার কী ?

ভূতের বাচ্চা বলল―বাবা-মায়ের কাছে আমিই আবদার করেছিলাম। প্রায়ই দেখি ট্রেনের ছাদে চড়ে অনেক মানুষ ভ্রমণ করে। এখানে সেখানে যায়। আমারও এমন ইচ্ছে হয়েছিল।

সুমন বলল―তোমার বাবা-মা কোথায় ?

ওরা আমাকে ছেড়ে চলে গেছে।

চলে গেছে মানে কী ? বুঝিয়ে বলো।

ভূতের বাচ্চা মিহি সুরে কাশি দিল।

সুমন জানতে চাইল―তোমার কি শরীর খারাপ ?

ভূতের বাচ্চা বলল―না, শরীর ভালোই আছে। ভয়ে কাশতেছি।

ভূতেরা আবার ভয় পায় নাকি ? তারা তো ভয় দেখায়…

ভূতের বাচ্চা বলল―আমি এখনও ভয় দেখাতে শিখিনি। আমার ট্রেনিং পিরিয়ড চলছে।

ট্রেনিং পিরিয়ড ? সেটা আবার কী ? অবাক হয়ে প্রশ্ন করল সুমন।

ভূতের বাচ্চা বলল―ভয় দেখানোর ট্রেনিং…

তোমার কথা বুঝতে পারতেছি না। ক্লিয়ার করো। ভূতদেরকে আবার ভয় দেখানো শিখতে হয় নাকি ?

ভূতের বাচ্চা বলল―হ্যাঁ ভূতদেরকেও ‘ভয়’ দেখানো শিখতে হয়।

ভূতের বাচ্চার কথাবার্তা মাথা ঢুকছে না সুমনের। এমনিতেই সে ভূতে বিশ্বাস করে না। অথচ তার সামনে একজন ভূত বসে আছে। সে বলছে বাবা-মায়ের সঙ্গে রেল ভ্রমণে বেরিয়েছিল। যদি তাই হয় তাহলে বাবা-মা সন্তানকে একা ফেলে ট্রেন থেকে চলে গেল কেন ? এই প্রশ্নটা ক্লিয়ার হওয়া দরকার। তার আগে ভূতের বাচ্চার নামটা জানা জরুরি।

ট্রেনটি একটা লম্বা ব্রিজ পার হচ্ছে। বিকট শব্দ হচ্ছে। ভূতের বাচ্চা ভয় পেয়েছে। তাই আবার সুমনকে জড়িয়ে ধরল। সুমন বিরক্ত হয়ে বলল―তুমি তো মিয়া সত্যি সত্যি ভূত নামের কলঙ্ক। এতদিন জানতাম ভূতেরা ভয় দেখায়। এখন দেখতেছি ভূতেরাও ভয় পায়। অ্যাই তোমার নাম কি ?

কোনটা বলব ? বড় না ছোট নাম ?

ছোট নামই বল।

আমার নাম পুতু মিয়া।

কী বলল্যা ? পুতু মিয়া ? পুতু মিয়া আবার কারও নাম হয় নাকি ?

ভূতের বাচ্চা বলল―ভূতদের নাম এমনই হয়। আমার বাবার নাম কুতু মিয়া। আমার একটা ভাই আছে। বয়সে আমার চেয়ে বড়। তার নাম লুতু মিয়া। মায়ের নাম সুন্দরী। আমার মা দেখতে খুব সুন্দর। তাই তার নাম সুন্দরী। আমার খালার নাম বান্দরি। সে দেখতে আমার মায়ের মতো সুন্দরী না। তাই তার নাম বান্দরি।

পুতু মিয়ার কথা শুনে যারপরনাই অবাক হচ্ছে সুমন। সামনের স্টেশনে ট্রেন থামলেই নেমে যেতে হবে। তার আগে পুতু মিয়াকে তাড়াতে হবে। এমনিতেই সে একটা ঝামেলায় পড়েছে। ভূতের বাচ্চাকে নিয়ে ঝামেলা আর বাড়াতে চায় না। তবে বিষয়টা ক্লিয়ার হওয়া দরকার। পুতু মিয়ার বাবা-মা তাকে একা ট্রেনে ফেলে চলে গেছে কেন ? এরা কেমন বাবা-মা ? নিজের বাবার কথা মনে পড়ে গেল সুমনের। তার বয়স তখন কত হবে ? ৯ কি ১০ বছর। হঠাৎ একদিন বাবা-মা দুজনই ঘরের দরজা বন্ধ করে তুমুল ঝগড়া করলেন। মাকে শারীরিক ভাবে নির্যাতন করেছিলেন বাবা। মায়ের ডান কপাল রক্তে ভেজা। তবু বাবা যখন বাসা থেকে এক কাপড়ে চলে যান, মা তার পা জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলেন। তুমি আমার একটা কথা শোনো। বাসা ছেড়ে চলে যেও না। আল্লাহর দোহাই লাগে…

বাবা মায়ের কথা শোনেননি। মাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরের মেঝেতে ফেলে দেন। দরজার চৌকাঠ ধরে অসহায়ের মতো দাঁড়িয়ে ছিল সুমন। বাবা চলে যাওয়ার সময় সুমনের দিকে একবার তাকিয়েছিলেন। বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করিস। ভালো থাকিস…

বাবা আর ফেরেননি। বাবা নতুন সংসার গড়েছেন। কাজেই তার তো আর ফেরার কথা নয়। এই একটি কারণে বাবার কথা মনে রাখতে চায় না সুমন। কী স্বার্থপর একটা মানুষ। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করে ছেলেকে ফেলে রেখে চলে গেছে। ভূতের বাচ্চা পুতুর ক্ষেত্রেও কি এমন কিছু ঘটেছে ?

ট্রেন বেশ জোরেই চলছে। এইমাত্র আবারও একটা ব্রিজ পার হলো। বোধকরি সামনেই রেল স্টেশন। ট্রেন থামা মাত্রই ঝুপ করে নেমে যাবে সুমন। কিন্তু তার আগে ভূতের বাচ্চাকে সামলাতে হবে। সে যেন কোনও ভাবেই সুমনের পিছু না নিতে পারে। তাকে কথায় ভুলিয়ে রাখতে হবে। যাতে ট্রেন থামা মাত্রই সুমন ট্রেন থেকে নেমে যেতে পারে।

পুতু মিয়া ট্রেনের ছাদে বসে অবাক বিস্ময়ে চারপাশটা দেখছে। সুমন তাকে ধাক্কা দিয়ে ট্রেন থেকে ফেলে দেওয়ার কথা ভাবল। পরক্ষণেই তার মনে হলো এতে কাজ হবে না। ভূতেরা নাকি হাওয়ায়ও উড়তে পারে। কাজেই ধাক্কা দিলে হাওয়ায় উড়ে আবার ট্রেনের ছাদে চলে আসবে। তার চেয়ে ভালো হয় কথায় ভুলিয়ে রাখা।

পুতুকে প্রশ্ন করল সুমন―পুতু মিয়া, তুমি তো তোমার বাবা-মায়ের সঙ্গেই ট্রেনের ছাদে বসেছিলে ?

হ্যাঁ। জবাব দিল পুতু মিয়া।

তারপর কি হলো ?

পুতু মিয়া বলল, তারপরের ঘটনা তো তোমার জানা। স্টেশনে ট্রেন থামল। পুলিশ হৈ চৈ বাঁধিয়ে দিল। বাবা-মা আমাকে ফেলে রেখে হাওয়ায় উড়ে চলে গেলেন।

ওরা তোমার আপন বাবা মা ?

হ্যাঁ। আপন বাবা-মা।

আমার বিশ্বাস হচ্ছে না।

কেন, কেন বিশ্বাস হচ্ছে না ?

আপন বাবা-মা হলে কী সন্তানকে এভাবে একা ফেলে রেখে চলে যায় ?

পুতু মিয়া বলল―তোমার বাবাও তো তোমাকে একা ফেলে চলে গেছেন।

পুতু মিয়ার কথা শুনে সুমন যারপর নাই অবাক হয়ে বলল―তুমি আমার সম্পর্কে এত কিছু জানো ?

হ্যাঁ তোমার সম্পর্কে আমি আরও অনেক কিছু জানি। তোমাকে আমি একটা সত্য কথা বলি। একটা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমার বাবা-মা আমাকে তোমার কাছে ফেলে রেখে গেছেন…

পরিকল্পনার অংশ মানে ? অবাক কণ্ঠে জানতে চাইল সুমন।

পুতু মিয়া বলল―স্কুলে আমার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ।

পুতুমিয়াকে থামিয়ে দিয়ে সুমন জানতে চাইল―তুমি তো ভূত। ভূতেরাও পড়াশুনা করে নাকি ?

হ্যাঁ। ভূতেরাও পড়াশুনা করে।

তোমরা থাকো কোথায় ?

ভূত রাজ্যে।

সেটা কী একটা দেশ ?

হ্যাঁ একটা দেশ। তবে মাটি নাই।

মাটি নাই ? তাহলে দেশটা টিকে আছে কীভাবে ?

হাওয়ায় ভেসে টিকে আছে।

তোমাদের ভূতেদের দেশে ঘর বাড়ি আছে ?

হ্যাঁ। সবই হাওয়ায় ভেসে থাকে।

স্কুল, কলেজ…

স্কুল আছে, কলেজ নাই। স্কুলই কলেজ, স্কুলই বিশ্ববিদ্যালয়…

সুমন ভেবে নিয়ে বলল―এবার তোমার পরিকল্পনার কথা বলো।

পুতু মিয়া বলল―আমার বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। তোমাদের এখানে যেমন প্রাইমারি স্কুল, হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আছে, আমাদের ওখানে এত কিছু নাই। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত পড়তে হয়। পাঠ্যবইয়ের চেয়ে হাতে কলমে শিক্ষাটাই বেশি হয়। আমরা বাড়িতে পড়াশোনা করি না। পড়াশোনার জায়গাই হলো স্কুল। আমাদের মাস্টার মশাইরা স্কুলে পড়ান। বাড়িতে আমরা পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাই।

সব কিছু অবিশ্বাস্য লাগছে সুমনের। অবাক বিস্ময়ে সে জানতে চাইল―তোমরা পরিবারের সঙ্গে কীভাবে সময় কাটাও ? তোমাদের দেশে টেলিভিশন আছে ?

না।

ফেসবুক, ইন্টারনেট…

না। ওই সব আমাদের দেশে নাই।

তাহলে কীভাবে সময় কাটাও।

আমরা অবসর সময়ে বেশি বেশি বই পড়ি। গান শুনি, সিনেমা দেখি। আমাদের নিজেদের কাজ নিজেদেরকেই করতে হয়।

সেটা কেমন ?

পুতু মিয়া একটু ভেবে নিয়ে বলল―যেমন ধরো, আমার ঘর আমাকেই পরিষ্কার রাখতে হয়। বাথরুম পরিষ্কার করতে হয়। পরিবারের প্রত্যেক সদস্যকে সিডিউল অনুযায়ী রান্নাবান্না, বাজারঘাট, বাগান পরিষ্কার করা থেকে সব কিছুই করতে হয়। আমাদের ভূতরাজ্যে হাতেকলমে শিক্ষাটাই বড় শিক্ষা। সে কারণেই আমার বাবা-মা আমাকে তোমাদের দেশে রেখে গেছে।

এবার আরও অবাক হলো সুমন। বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না। সুমন জানতে চাইল―তার মানে তোমার বাবা-মা ইচ্ছে করেই তোমাকে আমার কাছে রেখে গেছে ?

হ্যাঁ।

এটাই তোমাদের পরিকল্পনার অংশ ?

হ্যাঁ।

আমাকে একটু বুঝিয়ে বলো। আমাদের দেশে এত মানুষ থাকতে তোমার বাবা-মা আমাকেই কেন খুঁজে নিলেন ?

তোমাকে খুঁজে নেওয়ার কারণ হলো তুমি একজন সৎ মানুষ। ভালো মানুষ। জ্ঞানী মানুষ…

সুমন যারপরনাই অবাক হয়ে বলল―আমি সৎ, জ্ঞানী মানুষ… ?

হ্যাঁ।

তুমি কি আমার সম্পর্কে ভালো করে জানো ?

হ্যাঁ জানি।

কী জানো বল।

এসব কথা ট্রেনের ছাদে বলব না। তোমার সঙ্গে বাসায় গিয়ে বলব।

বাসায় মানে ? কার বাসা ?

তোমার বাসা। তোমাদের বাসা।

তুমি আমাদের বাসায় যাবে ?

হ্যাঁ, আমার পরিকল্পনার মধ্যে এটাই আছে।

আমাদের বাসায় গিয়ে তুমি কী করবে ? তোমার পরিকল্পনা কী ?

পরিকল্পনা তো অনেক বড়। সংক্ষেপে বলি। আমার পড়াশোনার অংশ হিসেবে আমি থিসিস করার জন্য তোমাদের দেশে এসেছি। ছয় মাস আমি তোমার সঙ্গে থাকব। তুমি তোমাদের দেশ এবং দেশের মানুষ সম্পর্কে আমাকে ধারণা  দেবে। সব চেয়ে বড় কথা আমি এখনও ভয় দেখানো শিখতে পারিনি। অথচ ভূতেদের অন্যতম যোগ্যতা হলো ভয় দেখানো। তোমাদের দেশে নাকি ভর দেখানোই সহজ কাজ। আমি ভয় দেখানো শিখব। তুমি আমাকে ভয় দেখানো শেখাবে…

ট্রেনটা বিকট শব্দ করে কোথায় যেন থামল। ট্রেনের শব্দ শুনে পুতু মিয়া সত্যি সত্যি ভয় পেয়েছে। ভয়ে রীতিমতো কাঁপছে সে।

হেড মাস্টারের কথা শুনে অবাক হলেন রাজিয়া বেগম। সুমন নিয়মিত স্কুলে আসে না। এলেও ক্লাস করে না। স্কুলের বাইরে বখাটে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। একদিন নাকি ব্যাগে ভরে একটা সাপ নিয়ে এসেছিল। সেই সাপ দেখার জন্য তার ক্লাসের অর্ধেক ছাত্র হাফটাইমের পর ক্লাস থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। সুমনের বিরুদ্ধে আরও অভিযোগ আছে। এক নম্বর অভিযোগ সে স্কুলের ড্রেস পরে স্কুলে আসে না। দুই নম্বর অভিযোগ  সিনিয়রদের সম্মান করে না। এই তো সেদিন ক্লাস নাইনের মিরাজের নাকে ঘুষি মেরেছিল। নাক দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়েছে। তিন নম্বর অভিযোগ সে ক্লাসের কোনও পরীক্ষায় অংশ নেয় না। বরং পরীক্ষা দেয়ার ব্যাপারে তার চরম অনীহা।

হেড মাস্টার রজনীকান্ত সেন শান্ত প্রকৃতির মানুষ। সাধারণত চড়া গলায় কথা বলেন না। অথচ রাজিয়ার সঙ্গে চড়া গলায় কথা বলছেন―

আপনি কেমন মা বলেন তো ? ছেলের ভালো-মন্দ খোঁজ রাখেন না। ও যে নিয়মিত স্কুলে আসে না এটাও জানেন না ?

না। মাথা নুয়ে অপরাধীর মতো জবাব দিলেন রাজিয়া।

সে নাকি সাপ পোষে আপনি জানেন ?      

হ্যাঁ জানি।

আপনি জানেন ? এবার বুঝতে পারতেছি ছেলেটার এত অবনতির কারণ কী ? সাপ কি পোষার জিনিস ? রাগে থর থর করে কাঁপছেন রজনীকান্ত সেন।

রাজিয়া বললেন, সুমন এক সময় সাপ পুষত, এখন পোষে না।

এখন তাহলে সে কী করে ? স্কুলে তো নিয়মিত আসে না। এলেও স্কুলের বাইরে বখাটে ছেলেদের সঙ্গে আড্ডা দেয়। আপনি কি জানেন সে সিনিয়রদেরকেও পাত্তা দেয় না। ক্লাস নাইনের একজনের নাকে ঘুষি মেরেছিল। আপনাকে তো এ ব্যাপারে চিঠি পাঠানো হয়েছিল। চিঠি পাননি ?

না। মাথা নুয়েই উত্তর দিলেন রাজিয়া। লজ্জায় মাথা তুলে তাকাতে পারছেন না। সুমন যে এতো কাণ্ড ঘটিয়েছে তার কিছুই জানেন না তিনি। হেড মাস্টার যেভাবে রেগে আছেন তাতে সুমনকে শেষ পর্যন্ত স্কুলে রাখবেন কিনা সন্দেহ। রজনীকান্ত সেনের জায়গায় রাজিয়া থাকলে এতদিনে সুমনের মতো বখাটে ছেলেকে স্কুল থেকে বের করে দিতেন।

হেড মাস্টারের মুখের দিকে তাকালেন তিনি। বিনীত কণ্ঠে বললেন―স্যার, আমি যে আপনার কাছে ক্ষমা চাইব সে পথটাও তো খোলা নাই। তবু শেষ অনুরোধ সুমনকে কি শেষ বারের মতো ক্ষমা করা যায় ?

হেড মাস্টার এবার যেন একটু শান্ত হলেন। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আপনার নামটা…

রাজিয়া বেগম।

ও হ্যাঁ রাজিয়া আপা। আপনি যদি আমার চেয়ারে থাকতেন তাহলে এরকম একটা বেয়াদব ছেলের ব্যাপারে কী করতেন ?

রাজিয়া মাথা নুয়েই বললেন, আমি তাকে স্কুল থেকে বের করে দিতাম।

আমারও তো তাই করা উচিত নাকি ?

রাজিয়া কিছু বললেন না। কেঁদে ফেললেন। হেড মাস্টার বিব্রত হয়ে বললেন, প্লিজ আপনি কাঁদবেন না। সামনে টেবিলে রাখা টিস্যু বক্স থেকে টিস্যু বের করে রাজিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, আপনি কান্না থামান। সুমনের ব্যাপারটা বেশ জটিল হয়ে উঠেছে। আমি কতুটুকু কী করতে পারব জানি না। তবে তাকে যাতে স্কুলে রাখা যায় আমি সেই চেষ্টা করব। বাই দ্য ওয়ে আমি কি আপনাকে কিছু প্রশ্ন করতে পারি ?

টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে রাজিয়া বললেন―নিশ্চয়ই। কী জানতে চান বলুন ?

প্রশ্নগুলো একান্তই আপনার ব্যক্তিগত। করব ?

রাজিয়া মুখে মৃদু হাসি ছড়িয়ে বললেন―আপনি সংকোচ করবেন না। প্রশ্ন করুন।

আপনাদের ছেলে-মেয়ের সংখ্যা কত ?

সুমন আমার একটাই ছেলে। একটাই সন্তান।

আপনি কিী করেন ?

আমি পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড অর্থাৎ পিডিবিতে চাকরি করি। একজন অফিসার।

আপনার হাজবেন্ড ?

উত্তর দিতে গিয়ে একটু থামলেন রাজিয়া।

হেড মাস্টার বিব্রত কণ্ঠে বললেন―স্যরি, তিনি কি মারা গেছেন ?

রাজিয়া বললেন―না। তিনি বেঁচে আছেন। এখন আমার সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক নাই। সুমনের যখন ৫ বছর বয়স তখনই আমাদের ‘সেপারেশন’ হয়ে যায়…

ও… একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন হেড মাস্টার। একটু ভেবে নিয়ে বললেন, আপনার হাজবেন্ডের সঙ্গে কি সুমনের যোগাযোগ আছে ? মানে বাবা আর ছেলের মধ্যে…

আমার ধারণা যোগাযোগ আছে।

ধারণা বলছেন কেন ? আপনি নিশ্চিত নন ?

আমি চাই না তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ রাখুক। কিন্তু তাদের মধ্যে যোগাযোগ আছে এটাই সত্য। বলেই চলে যাবার জন্য উঠে দাঁড়ালেন রাজিয়া। হেড মাস্টার বাধা দিয়ে মৃদু হেসে বললেন―আপনি বসুন। আমাদের কথা তো শেষ হয়নি। আপনি কি একটা কাজ করতে পারবেন ?

কী কাজ বলুন। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলেন রাজিয়া।

হেড মাস্টার বললেন, সুমন যাতে নিয়মিত স্কুলে আসে এটা নিশ্চিত করতে পারবেন ?

রাজিয়া আবারও ভেবে নিয়ে বললেন―হ্যাঁ পারব।

হেড মাস্টার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন―আপনি তাকে স্কুলে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন, এদিকটা আমি দেখছি। আর হ্যাঁ সে যেন স্কুলের ড্রেস পরে পরিপাটি হয়ে স্কুলে আসে। এতক্ষণ তো আপনার ছেলের অনেক বদনাম করলাম। আপনার ছেলের অনেক গুণও আছে। সে পরোপকারী। আপনি কি জানেন ওর নিজের ক্লাসের একটা গরিব ছাত্রের পড়াশোনার খরচ ও নিজে চালায়।

বলেন কী ? অবাক কণ্ঠে হেড মাস্টারের দিকে তাকালেন রাজিয়া। এতক্ষণ ছেলের প্রতি চরম বিরক্তি চেপে ধরেছিল। হেড মাস্টারের কথা শুনে বিরক্তিটাই আনন্দে রূপ নিয়েছে। আবারও একই প্রশ্ন করলেন হেড মাস্টারকে―সুমন নিজে অন্য একজন ছাত্রের পড়াশোনার খরচ চালায় ?

হ্যাঁ।

সেই ছেলেটিকে কি আমি এক নজর দেখতে পারি ?

হ্যাঁ পারেন। কলিং বেল টিপলেন হেড মাস্টার। পিয়ন দৌড়ে এসে বলল, জি স্যার।

ক্লাস এইটের জাহেদুলকে ডেকে নিয়ে আসো।

জি স্যার। পিয়ন চলে গেল। হেড মাস্টার সুমনের প্রশংসা করতেই থাকলেন। সত্যি আপনার ছেলের অনেক গুণও আছে। বিজ্ঞান সম্পর্কে তার অনেক আইডিয়া। ছেলেটাকে স্কুলমুখী করা গেলে একটা কাজের কাজ হতো।

অষ্টম শ্রেণির জাহেদুলকে সঙ্গে করে নিয়ে এল পিয়ন আব্দুল মালেক।

রাজিয়া সুলতানার পায়ে সালাম করল জাহেদুল। রাজিয়া অবাক হয়ে বললেন―তুমি আমাকে চেনো ?

হ্যাঁ, আপনি আমাদের সুমনের মা।

সুমনের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে ?

হ্যাঁ আছে।

সে স্কুলে কেন নিয়মিত আসে না তুমি সেটা জানো ?

না জানি না।

তোমার কি মোবাইল ফোন আছে ?

না। তবে আমার বাবার মোবাইল ফোন আছে।

নাম্বারটা কি আমি পেতে পারি ?

অবশ্যই। বাবার ফোন নম্বর বলল জাহেদুল।

ফোন নম্বরটা নিজের মোবাইল ফোনে যুক্ত করে জাহেদুলকে কাছে টেনে নিলেন রাজিয়া। কপালে চুমু দিয়ে বললেন―ভালো করে লেখাপড়া করো। তোমার সঙ্গে আমার আবার কথা হবে। অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে। আনন্দে কেঁদে ফেলল জাহেদুল। হেড মাস্টার চশমা খুলে চোখ মুছলেন। রাজিয়া বেগম কান্না লুকানোর জন্য তড়িঘড়ি হেডমাস্টারের রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।

সবচেয়ে অবাক হয়েছে টুকটুকি। এতদিন ভূতের কথা শুনেছে। কিন্তু বিশ্বাস করেনি। আজ হাতেনাতে প্রমাণ পাচ্ছে। যদিও ভূতকে দেখতে পাচ্ছে না। তবে ভূতের কথা শুনতে পাচ্ছে। ভূতের নামটা সুন্দর। পুতু মিয়া। পুতু মিয়াকে কীভাবে পাওয়া গেল সেই গল্পই সালাম, মমিন আর টুকটকিকে শোনাচ্ছিল সুমন। ওরা অনেক খুঁজে সুমনের বাসা বের করেছে। সেদিন সুমন ট্রেনের ছাদ থেকে নামতে পারল না। ট্রেনটা চলে গেল। সুমনের এখন কী হবে ? এই ভেবে টুকটুকির সে কী কান্না। মূলত টুকটুকির কারণেই সুমনের বাসা খুঁজে বের করেছে তারা।

সবাইকে একসঙ্গে দেখে সুমনও বেশ খুশি। সুমনের মা রাজিয়া বেগম বাসায় থাকলে হয়তো এভাবে সবাইেেক বাসায় এলাউ করা যেত না। মা কত যে প্রশ্ন করতেন। মা বাসায় আসার আগেই সালাম, মমিন ও টুকটুকি যেন বাসা থেকে চলে যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। বাসায় একটা ভূত আছে। ওরা যদি সেটা জেনে যায় তাহলে সহজেই যাবে না। যদিও সালাম, মমিন আর টুকটুকির মধ্যে চলে যাবার কোনও লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। বরং তারা আয়েশি ভঙ্গিতে সুমনদের বাসা ঘুরে ঘুরে দেখছে। সবচেয়ে খুশি টুকটুকি। সুমন বলল, ভাইজান আপনারা এত বড় লোক ? রেল ইস্টিশনে, যেখানে সেখানে এইভাবে বাদাইম্যার মতো ঘুইর‌্যা বেড়ান ক্যান ? আপনের বাবা-মা আপনারে বকে না ? টুকটুকির কথা বলার ভঙ্গিটা বেশ আন্তরিক। সুমনের মনে হলো তার আপন বোন থাকলে তার সঙ্গে হয়তো এভাবেই  কথা বলত। টুকটুকির প্রশ্নের দিকে সে গেল না। বরং তাড়া দেখিয়ে বলল, আমার বাসা তো তোমরা দেখল্যা। আমার একটু কাজ আছে। কাল অথবা পরশু তোমাদের সঙ্গে দেখা হবে। আজকের মতো বিদায়।

সালাম, মমিন চলে যাচ্ছে। টুকটুকি যাবার জন্য পা বাড়িয়েও থেমে গেল। ঘরের ভেতর অপরিচিত কারও কণ্ঠ শুনতে পেয়েছে সে। কণ্ঠটা মানুষের বলে মনে হচ্ছে না। কেমন যেন মিহি সুরের কণ্ঠ। একবার মনে হয় মানুষের কণ্ঠ আবার পরক্ষণেই মনে হয় মানুষের কণ্ঠ না। মানুষের কণ্ঠ হলে তো তাকে দেখা যাবার কথা। মানুষ কোথায় ? মানুষ বলতে সুমন, সালাম, মমিন আর টুকটুকি। ঘরে আর তো কেউ নাই। কথা বলল কে ? আবার সেই অপরিচিত কণ্ঠটা শোনা গেল। সবাইকে শুভ বিকেল। সবার মঙ্গল হোক।

এবার সবাই কণ্ঠটা শুনল। সুমন বাদে সবাই ভয় পেল। ভয় পাবারই কথা। মানুষ নেই অথচ মানুষের কণ্ঠই শোনা যাচ্ছে। টুকটুকি কাঁদো কাঁদো হয়ে সুমনের দিকে তাকাল―ভাইজান এভাবে কথা বলতেছে কে ?

সুমন সত্যটাই বলল। কারণ পুতু মিয়া শর্ত দিয়েছে সুমন যদি কখনও মিথ্যা কথা বলে তাহলে সে সুমনের সঙ্গে থাকবে না। সঙ্গে সঙ্গেই সুমনের সঙ্গ ত্যাগ করবে। শর্ত শুনে সুমন বেশ খুশি হয়েছিল। ভালোই হয়েছে। পুতু মিয়াকে তাড়ানোর একটা টেকনিক জানা গেল। এখন থেকে সুমন শুধুই মিথ্যা কথা বলবে। ব্যস পুতু মিয়া চলে যাবে। উটকো ঝামেলা বিদায় হবে। কিন্তু স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই পুতু মিয়ার প্রতি একটা মায়া জন্মেছে। আগে যেমন সহজেই মিথ্যা বলতে পারত, এখন মিথ্যা কথা বলতে গেলেই কেউ যেন তাকে টেনে ধরে। সুমন, মিথ্যা বলা মহাপাপ। খবরদার, মিথ্যা বলা যাবে না। সুমন বুঝতে পারছে পুতু মিয়ার সঙ্গে পরিচিত হওয়ার মাত্র একদিনের ব্যবধানে তার মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। আগে যেমন কেউ তাকে কিছু বললে কিছু না ভেবেই সত্য মিথ্যা যা মনে আসতো তাই বলে দিত, অথচ এখন সেটা পারছে না। ভেতর থেকে মিথ্যাটা আর আসছে না।

গতকাল বাসায় ফিরতে অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধু সেতুর আগে একটা রেল স্টেশনে পুতু মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ট্রেন থেকে নেমে যায় সুমন। কীভাবে ঢাকায় ফিরতে হবে সেটা পুতু মিয়াই বলে দেয়। যেন পুতু মিয়া ট্রেনের এই লাইনে নিয়মিত যাতায়াত করে। সব কিছু তার জানা। বঙ্গবন্ধু সেতুর দিক থেকে একটা ট্রেন আসছে। স্টেশনের মাইকে ঘোষণা শোনা গেল। সুমনকে তাড়া দিল পুতু মিয়া। যাও টিকিট কিনে আনো।

টিকিট ? কিসের টিকিট ? অবাক কণ্ঠে জানতে চায় সুমন। পুতু মিয়াও অবাক কণ্ঠে বলে, ট্রেনে চড়ে যাবে। টিকিট কিনতে হবে না। যাও টিকিট কিনে আনো। ঐ যে দেখো টিকিট কাউন্টার। ওখানে ট্রেনের টিকিট পাওয়া যায়।

পুতু মিয়ার কথায় গুরুত্ব না দিয়ে সুমন বলল, আমার টিকিট লাগবে না। ছাদে উঠে যাব। ছাদে টিকিট লাগে না।

পুতু মিয়া বলল, ট্রেনের ছাদ কি বসার জায়গা ? আমাদের দেশে কেউ ট্রেনের ছাদে ওঠে না। উঠলেই তাকে ধরে নিয়ে জেলে পুরে দেয়।

তোমাদের দেশেও ট্রেন আছে ?

হ্যাঁ। আছে ?

মাটি ছাড়া ট্রেন চলে ?

হ্যাঁ, হাওয়ার মধ্যে ভেসে ভেসে চলে।

পাখির মতো ?

হ্যাঁ পাখির মতো।

তোমাদের দেশে পাখি আছে।

হ্যাঁ পাখি আছে। অনেক পাখি।

ওরা থাকে কোথায় ? তোমাদের দেশে গাছও আছে ?

হ্যাঁ আছে।

পাখিরা কি গাছেই থাকে ?

গাছেও থাকে। বাড়িতেও থাকে। পাখিরা আমাদের সবচেয়ে ভালো বন্ধু। ওদেরকে আমরা কখনও আঘাত করি না। ভয় দেখাই না। আমাদের দেশে পাখিকে হত্যা করা অন্যায়। কেউ যদি পাখিকে হত্যা করে তাহলে কোনও বিচার ছাড়াই তাকে জেলে যেতে হয়।

তোমাদের দেশে জেলখানাও আছে ?

হ্যাঁ আছে। তবে সেখানে ভূত পাওয়া যায় না।

কেন ?

ভূত পাবে কোথায় ? কেউ তো অন্যায় করে না। অন্যায় করলে না জেলে যাবে। তাই আমাদের দেশের সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশ থেকে জেলখানা তুলে দেবে।

পুতু মিয়ার কথা শুনে সুমন যারপরনাই অবাক হচ্ছিলো। এতদিন শুনে এসেছে পৃথিবীর শয়তান মানুষেরাই নাকি মরে গিয়ে ভূত হয়। অথচ ভূতের দেশ এতো ভালো।

মাইকে আবারও ট্রেন আসার ঘোষণা শোনা গেল। পুতু মিয়া সুমনকে তাড়া দিল, যাও টিকিট কিনে আনো।

পুতু মিয়ার চাপাচাপিতে শেষ পর্যন্ত ট্রেনের টিকিট কিনেছিল সুমন। একটা নয় দুইটা। একটা সুমনের জন্য। আরেকটা পুতু মিয়ার জন্য। পুতু মিয়া শুনে বলেছিল, আমার টিকিট না কিনলেও পারতে। আমাদের দেশে ট্রেন, বাস, লঞ্চ, স্টিমার, উড়োজাহাজসহ সব যানবাহনে যাতায়াত ফ্রি…

পুতু মিয়ার কথা বিশ্বাস হচ্ছিলো না সুমনের। ভূতটা কি সত্যি কথা বলছে ? নাকি গুল মারছে ? একটা দেশে সব ফ্রি হয় কী করে ? তাহলে দেশটা চলে কী করে ? আমাদের দেশটা যদি এমন হতো। পুতু মিয়া লঞ্চ, স্টিমারের কথা বলল। উড়োজাহাজের কথাও বলল। তার মানে ভূতরাজ্যে নদী, সাগরও আছে ? সেটা কী করে সম্ভব ?

পুতু মিয়ার কাছে জানতে চাইল, তোমাদের ভূত রাজ্যে নদীও আছে ?

হ্যাঁ। নদী সাগর সবই আছে।

কী করে সম্ভব ? মাটি ছাড়া নদী সাগর… তুমি মিথ্যা বলছো ?

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল পুতু মিয়া। শোনো ভূতেরা মিথ্যা বলে না। তোমাকে তো আগেও বলেছি ভূত রাজ্যে মিথ্যা বলা মহাপাপ। তবে তোমাদের পৃথিবীতে বেড়াতে এসে আমাদের কিছু কিছু ভূত মিথ্যা বলা শিখেছে। তারা ধরাও পড়েছে। তাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে।

সুমন যেন ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেল। মানুষের মৃত্যুর পর সে নাকি ভূত হয়। যদিও সুমন সেটা বিশ্বাস করে না। তবু ধরা যাক মৃত্যুর পর মানুষ ভূত হয়। মৃত্যুর পর আবার মৃত্যু ? মৃত্যুদণ্ড মানেই তো মৃত্যু।

পুতু মিয়া বলল, আমি একটা দারুন রিস্কের মধ্যে আছি ?

রিস্কের মধ্যে আছো মানে ? বুঝিয়ে বলো।

পুতু মিয়া বলল, আমি যখন তোমাদের মানুষ রাজ্যে থিসিস করার জন্য ইচ্ছে প্রকাশ করলাম তখন আমাকে অনেকেই নিরুৎসাহিত করেছিল। বলেছিল পৃথিবীতে যেও না। বর্তমানের পৃথিবীটা মিথ্যায় ভরা। যে দেশে যাচ্ছো সেখানে তো আরও বেশি মিথ্যা। মানুষকে মানুষ খুন করে, কিছুই হয় না। কী সাংঘাতিক। সবাই জোর দিয়ে বলেছে আমি তোমাদের বাংলাদেশে থাকলে নাকি সহজেই মিথ্যা বলা শিখে যাব। আমি চ্যালেঞ্জ দিয়ে এসেছি যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজে মিথ্যা বলব না। যাদের সঙ্গে থাকব তারাও যাতে মিথ্যা না বলে সেই চেষ্টাই করব। তোমার বায়োডাটা আমার কাছে আছে। তুমি মাঝে মাঝে মিথ্যা বলো। এটা করা যাবে না।

পুতু মিয়াকে থামিয়ে দিল সুমন―বায়োডাটা কীভাবে পেলে ?

পুতু মিয়া বলল, আমি পৃথিবীতে আসব জানার পর আমাদের গোয়েন্দা শাখার লোকজন পৃথিবীতে এসে আরও অনেকের সঙ্গে তোমার খোঁজখবরও নিয়ে যায়। তোমার বায়োডাটাই আমার পছন্দ হয়। তুমি ভালো মানুষ। তবে একরোখা। সবচেয়ে বড় কথা তুমি তোমার মাকে অনেক ভালোবাসো। বাবাকেও ভালোবাসো। তবে মায়ের দিকে ভালোবাসার পাল্টাটা ভারী। এটাই স্বাভাবিক। বাবা হঠাৎ একদিন তোমাকে ছেড়ে চলে যায়। মা-ই তোমাকে আদরযত্ন দিয়ে মানুষ করেছে। কাজেই মায়ের প্রতি বেশি ভালোবাসা থাকাটাই স্বাভাবিক।

জয়দেবপুর থেকে কখন যে ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে টের পায়নি সুমন। হঠাৎ পাশের যাত্রীর কথা শুনে চমকে উঠে। বয়স্ক লোক। সুমনের কাছে জানতে চাইল, বাবা তুমি কার সঙ্গে কথা বলতেছো ?

সুমন বিপাকে পড়ে গেল। সে কি এখন সত্য কথা বলবে ? সত্য বললে এই বুড়ো বিশ্বাস করবে ? চাচা আমি ভূতের সঙ্গে কথা বলছি… শোনো মাত্রই বুড়ো হয়তো ভয়ে অজ্ঞান হয়ে যাবে। ট্রেনের এই কামরায় ভূতের ভয়ে হৈচৈও শুরু হয়ে যেতে পারে। নিচু স্বরে পুতু মিয়ার কাছে জানতে চাইল সুমন, এখন তো মিথ্যা বলা ছাড়া উপায় নাই। কী করব বলো।

পুতু মিয়া বলল, চুপ করে থাকো।

চুপ করে থাকাও তো মিথ্যা ?

হ্যাঁ, চুপ করে থাকাও এক অর্থে মিথ্যা… এটা একটা পয়েন্ট। নোট করে রাখলাম। তুমি চুপ করেই থাকো। কেন চুপ থাকতে বললাম তার পিছনে একটা যুক্তি আছে। সেটা হলো একটা মিথ্যা হাজারটা মিথ্যার জন্ম দেয়। কাজেই চুপ করে থাকাই ভালো।

পুতু মিয়ার কথা পছন্দ হলো। বুড়োর কথার জবাব দিল না সুমন। বুড়ো আনমনে কী যেন বলল। বোঝা গেল না। তবে বুড়ো একই সঙ্গে অবাক ও বিরক্ত হয়েছে। তার চেহারায় তা ফুটে উঠেছে।

রাতে বাসায় ফিরে সুমন দেখল মা অন্যদিনের তুলনায় বেশ বিরক্ত। বাসার দরজা খুলে দিয়ে রাজিয়া বিরক্ত কণ্ঠে বললেন, দাঁড়াও তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে। সুমনও তার স্বভাব সুলভ ভঙ্গিতে বিরক্ত কণ্ঠেই বলল, আমি ক্লান্ত। পরে তোমার কথা শুনব।

নিজের ঘরের দিকে চলে যাচ্ছিল সুমন। রাজিয়া রেগে বললেন, আমি তোমাকে দাঁড়াতে বলেছি…

সুমন প্রতিবাদ করতে যাচ্ছিল। পুতু মিয়া বলল, কুল সুমন কুল। মায়ের সঙ্গে এইভাবে ব্যবহার করা ঠিক না। স্যরি বলো।

পুতু মিয়ার প্রতিও বিরক্ত হলো সুমন। কোথাকার কোন ভূত তো দেখি তার ওপর খবরদারি করছে। সুমনের উপর কেউ খবরদারি করুক এটা তার পছন্দ নয়। যে করেই হোক পুতু মিয়াকে তাড়াতে হবে। পুতু মিয়া সেটা বুঝতে পেরে বলল, সুমন তুমি ভুল করছো। তুমি আমাকে শত চেষ্টা করলেও তাড়াতে পারবে না। আমি তোমার কোনও ক্ষতি করতে আসিনি। মায়ের কাছে স্যরি বলো।

রাজিয়া বেগম অবাক হয়ে সুমনের দিকে তাকিয়ে আছেন। সুমনের কাছে জানতে চাইলেন, তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস ?

সুমন এবার আরও বিপাকে পড়ে গেল। ট্রেনের বুড়োটাকে উপেক্ষা করা গেছে। কিন্তু মাকে তো উপেক্ষা করা যাবে না। পুতু মিয়া বুঝতে পেরে বলল, সত্যিটাই বলো।

সত্যি মানে ? রাতদুপুরে আমি ভূতের সঙ্গে কথা বলছি মা বিশ্বাস করবেন ?

হয়তো করবেন, হয়তো করবেন না। তুমি সত্যটা বলো।

সুমন বিড়বিড় করে কথা বলছে দেখে রাজিয়া বেগম এবার ভীত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, সুমন তোর কী হয়েছে ? তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস ? সুমন… বলেই রাজিয়া বেগম হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে মেঝেতে পড়ে গেলেন। সুমন ভয়ে অস্থির হয়ে উঠল। পুতু মিয়াও ভয় পেয়েছে। তবে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, সুমন এক কাজ করো মায়ের মুখে পানির ছিটা দাও। মায়ের জ্ঞান ফিরে যাবে। আমি বরং যাই…

যাই মানে। কোথায় যাবে ?

কোথাও যাব না। আশেপাশেই থাকব। কাল সকালে তোমার সঙ্গে দেখা হবে।

পুতু মিয়ার উপর বেশ বিরক্ত হলো সুমন। এই না হলে ভূত। সুমন এখন একটা কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। পুতু মিয়ার উচিত তাকে সাহায্য করা। অথচ সে চলে যাচ্ছে। যদিও সুমনই চাইছিল পুতু মিয়া চলে যাক। পুতু মিয়াকে উটকো ঝামেলা মনে হয়েছিল। এখন পুতু মিয়াকেই তার দরকার বলে মনে হলো। মায়ের যদি জ্ঞান না ফেরে তাহলে… পুতু মিয়া রাজিয়া বেগমের মুখে পানির ছিটা দিচ্ছে। রাজিয়া চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলেন খাটের উপর বসে আছেন। সুমন তার পা জড়িয়ে ধরে মেঝের উপর বসে আছে।

রাজিয়া ছেলেকে কাছে টেনে নিয়ে বললেন, ওঠ।

সুমন বিছানায় মায়ের পাশে বসতে বসতে বলল, মা, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এখন থেকে আর মিথ্যা বলব না।

রাজিয়া খুশি হয়ে বললেন, তুই সত্যি বলছিস ? আর মিথ্যা বলবি না।

হ্যাঁ। আর কোনও দিন মিথ্যা বলব না।

সুমনকে জড়িয়ে ধরলেন রাজিয়া বেগম। কপালে চুমো দিয়ে বললেন, লক্ষ্মী বাপ আমার…

পুতু মিয়া পাশে দাঁড়িয়ে সুমনের দিকে ইশারা করছে। আমার কথা বলো…

সুমন ইশারায় জানতে চাইল, তোমার কথা বললে মা কি বিশ্বাস করবেন ? আবার যদি অজ্ঞান হয়ে যান ?

আর অজ্ঞান হবেন না। আমার কথা বলো।

মা কি তোমাকে দেখতে পাবেন ?

হ্যাঁ পাবেন।

রাজিয়া বেগম আগের চেয়ে আরও বেশি অবাক হয়েছেন ? সুমন কার সঙ্গে কথা বলছে ? লক্ষণ তো ভালো না। ভীত কণ্ঠে জানতে চাইলেন, বাবা তুই কার সঙ্গে কথা বলছিস ?

সুমন বলল, ওই যে বললাম আমি আর কোনও দিন মিথ্যা বলব না…

হ্যাঁ। বলেছিস তো…

তাহলে সত্যটা শোনো।

বল।

আমি একজন ভূতের সঙ্গে কথা বলছি ?

ভূতের সঙ্গে কথা বলছিস মানে ? পৃথিবীতে ভূত বলে কিছু আছে নাকি ? তুই তো ভূতে বিশ্বাস করিস না। বাবা তোর কী হয়েছে ? হায় আল্লাহ আমি এখন কী করি… রাজিয়া অস্থির হয়ে উঠলেন। হঠাৎ দেখলেন তার সামনে ফুটফুটে একটা বেটে খাটো প্রাণি দৃশ্যমান হলো। দেখতে সিনেমায় দেখা এলিয়েনদের মতো। মাথা বড়। হাত-পা সেই তুলনায় ছোট। চোখে গোল চশমা। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না রাজিয়া বেগম। যা দেখছেন তা কি সত্যি। শরীরে চিমটি কেটে দেখলেন হ্যাঁ সত্যিই দেখছেন। বেটে খাটো এলিয়েনটা মানুষের মতোই কথা বলল, মা আমার নাম পুতু মিয়া…

নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না রাজিয়া বেগম। ভূত কথাও বলে দেখছি। রাজিয়া বেগমকে মা বলে সম্বোধন করল। ভূতে বিশ্বাস নেই রাজিয়ার। তবে ছোটবেলায় দাদি, নানির কাছে ভূতের গল্প শুনেছেন। ভূতের গল্প মানেই গা ছম ছম করা ভয়ের গল্প। রাজিয়া ভয় পেতেন। তবু ভূতের গল্প শুনতে চাইতেন। দাদিই বেশি ভূতের গল্প বলতেন। তার গল্পের ভূতেরা ছিল ভয়ঙ্কর টাইপের। মানুষকে তারা পছন্দ করত না। ঘাড় মটকে দিত। মানুষকে ভয় দেখানোই ছিল একমাত্র দায়িত্ব। দাদির বর্ণনায় ভূতদের চোখ দুটো ছিল সব চেয়ে ভয়ঙ্কর। নামগুলো ছিল আরও ভয়ঙ্কর। গেছো ভূত, শয়তান ভূত, ডাইনি বুড়ি, শ্মশানের রাজা আরও কত নাম। কিন্তু রাজিয়ার সামনে যে ভূতটি দাঁড়িয়ে আছে তার চোখ দুটো বেশ সুন্দর। নামটাও সুন্দর। পুতু মিয়া। সে কেন সুমনের সঙ্গে এসেছে জানা দরকার। তার মতলব কী জানা দরকার। তার আগে নিশ্চিত হওয়া দরকার রাজিয়া যা দেখছেন সত্যি দেখছেন কিনা। বাম হাতে চিমটি কাটলেন রাজিয়া। যা দেখছেন সত্যি দেখছেন। সুমনের পাশে বেটে খাটো পুতু মিয়াই দাঁড়িয়ে আছে।

পুতু মিয়াকে প্রশ্ন করলেন, তুমি তো ভূত ?

হ্যাঁ।

সুমনের সঙ্গে তোমার কীভাবে পরিচয় ?

সেটা অনেক বড় ইতিহাস। বড় করে বলব না ছোট করে বলব ?

ছোট করে বলো। ঠিক আছে ইতিহাস বলতে হবে না। তুমি আমাকে একটা প্রশ্নের জবাব দাও ?

বলেন।

ভূতেরা ভয়ংকর হয়। মানুষের ক্ষতি করে। তুমি কি সুমনের ক্ষতি করতে এসেছো ?

পুতু মিয়া একটু সময় নিয়ে বলল, ভূত নিয়ে মানুষের মধ্যে অনেক খারাপ ধারণা আছে। আমি সেই তর্কে যাব না। আপনাকে আর সুমনকে আমাদের ভূত রাজ্যে নিয়ে যাব। ভূত সম্পর্কে আপনাদের ধারণা বদলে যাবে।

রাজিয়া বেগম ধমক দিলেন, তোমার নাম যেন কী ?

পুতু মিয়া।

নামটা সুন্দর।

ধন্যবাদ।

তুমি সুমনের নাম ধরে ডাকছো কেন ? বয়সে তুমি তো সুমনের ছোটই হবে।

পুতু মিয়া মৃদু হেসে বলল, আমি কিন্তু আপনার চেয়েও বয়সে বড়।

মানে ? অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন রাজিয়া।

পুতু মিয়া বলল, আমার বয়স কত হবে আন্দাজ করেন তো ?

কত আর হবে ? বড় জোর তেরো, চৌদ্দ বছর ?

পুতু মিয়া বলল, আপনার ধারণা ভুল। এই ফেব্রুয়ারিতে আমার বয়স হবে ৮১ বছর।

বলো কী ? যার পর নাই বিস্মিত হলেন রাজিয়া বেগম।

পুতু মিয়া বলল, আপনাদের পৃথিবীতে ২৪ ঘণ্টায় রাত দিন। আমাদের ভূত রাজ্যে রাত বড়। দিন ছোট। ৪৮ ঘণ্টায় রাত দিন।

ভূত রাজ্য মানে ? এটা কি কোনও দেশ ?

হ্যাঁ দেশ তো বটেই। আপনাদেরকে আমাদের ভূত রাজ্যে একদিন নিয়ে যাব। এটা আমার অ্যাসাইনমেন্টের মধ্যে আছে।

অ্যাসাইনমেন্ট মানে ? বুঝিয়ে বলো। তুমি কেন সুমনের সঙ্গে এসেছো ? ওর ক্ষতি করার জন্য ?

না। সুমনের ভালো করার জন্য এসেছি। সুমন আমাকে ভয় দেখানো শেখাবে। আমি ওকে ভালো হতে শেখাব।

পুতু মিয়ার কথা মগজের ভেতর ঢুকছে না রাজিয়ার। যা দেখছেন, যা শুনছেন তা মোটেই বিশ্বাস হচ্ছে না। পুতু মিয়ার কথার মধ্যে রহস্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। ভয় দেখানো শিখবে। আবার বলছে সুমনকে ভালো হতে শেখাবে। ভয় আর ভালো হওয়া একটার সঙ্গে অন্যটার দা-কুড়াল সম্পর্ক। যে মানুষ ভয় দেখানো শেখাবে সে তো খারাপ মানুষ। তাকে ভালো করা কি সম্ভব ?

পুতু মিয়া বলল, আম্মা আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করতে পারছেন না ?

না। সত্যিটাই বললেন রাজিয়া বেগম।

পুতু মিয়া জানতে চাইল―আমার কোন কথা বিশ্বাস হচ্ছে না ?

তোমাকেই আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। ভূত বলতে কিছু আছে নাকি ? ভালোয় ভালোয় চলে যাও। তা না হলে ভূত তাড়ানোর ব্যবস্থা করব। তখন কিন্তু পালানোর পথ খুঁজে পাবে না।

পুতু মিয়া সঙ্গে সঙ্গেই কিছু বলল না। রাজিয়া বেগমের চোখের দিকে তাকাল।

আপনি কি সত্যিই চাচ্ছেন আমি চলে যাই ?

হ্যাঁ। ছোট্ট উত্তর দিলেন রাজিয়া।

পুতু মিয়া বলল, ঠিক আছে আমি চলে যাব। তবে যাবার আগে আপনাকে কিছু কথা বলে যাই। সুমন সত্যিকার অর্থে খুউব মেধাবী ছেলে। কিন্তু আপনারা ওর মেধাকে কাজে লাগাতে পারছেন না। সুমন যেমন আপনাকে চায়, তেমনই ওর বাবাকেও চায়। আমাদের ভূত রাজ্যে সন্তানের মঙ্গলের জন্য স্বামী-স্ত্রী কখনও আলাদা হয় না। আর আপনাদের পৃথিবীতে এটা খুব সহজ, স্বাভাবিক ঘটনা। সন্তান তার বাবা-মায়ের মধ্যে কখনই বিচ্ছেদ দেখতে চায় না। মা যেমন তার আপন, বাবাও তেমনই আপন। আপনি কি জানেন সুমন তার বাবার জন্য প্রায় প্রতিদিনই কাঁদে। আপনি যাতে বুঝতে না পারেন সেজন্য বাইরে স্কুলের মাঠে, বটগাছের তলায়, রাতে ওর রুমে একা কাঁদে। ওর কান্নার ভিডিও আমার কাছে আছে। আপনি চাইলে এখনই দেখাতে পারি। দেখবেন ?

রাজিয়া বেগম যারপরনাই অবাক। পুতু মিয়া এত সত্যি কথা জানলো কী করে ? সুমন মাথা নিচু করে মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। কাঁদছে সুমন। রাজিয়া বেগম আরও অবাক হলেন। চরম বিপদে ও কষ্টেও সুমন সাধারণত কাঁদে না। আজ বাচ্চাদের মতো হু হু করে কাঁদছে। ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন রাজিয়া। সুমনও মাকে জড়িয়ে ধরল। রাজিয়ার মনে হলো কতদিন পর যেন ছেলেকে এভাবে জড়িয়ে ধরেছেন। পুতু মিয়া তার চোখ খুলে দিয়েছে। হোক সে ভূত। থাকুক সুমনের সঙ্গে। ভূত মিয়াকেও কাছে টেনে নিলেন। কী তুলতুলে নরম শরীর তার। পুতু মিয়া জানতে চাইল, আম্মা আমি কি চলে যাব ?

না। বলেই সুমন ও পুতু মিয়াকে আরও বেশি করে জড়িয়ে ধরলেন রাজিয়া বেগম।

টুকটুকির ডাকে চমক ভাঙ্গল সুমনের। নতুন কিছু জানার ব্যাপারে টুকটুকির বেশ আগ্রহ। নতুন যা দেখে চিনতে না পারলে বুঝতে না পারলে সুমনকে প্রশ্ন করে। যেমন একদিন কমলাপুর রেল স্টেশনের বেঞ্চিতে বসে সুমনের সঙ্গে আড্ডা দিচ্ছিলো সবাই। একটা ট্রেন এসে থামে। যাত্রীরা নামে। যাত্রীরা ওঠে। টুকটুকি দূর থেকে দাঁড়িয়ে মানুষের যাওয়া-আসা দেখে। হঠাৎ সুমনকে প্রশ্ন করে―ভাইজান এত্ত বড় একটা টেরেন। ওই ইঞ্জিনটা টানে কী কইর‌্যা। ইঞ্জিনের অনেক শক্তি। হ্যায় শক্তিটা পায় কেমনে ? বাপরে বাপ এত্তগুলো বগি একলা টাইন্যা আনে… আরেক দিন টুকটুকি হঠাৎ প্রশ্ন করল, ভাইজান আল্লায় রাইত আর দিন বানাইছে ক্যান ? পুরাটাই দিন থাকলে কী ক্ষতি হইত ? রাত খুব কষ্টের টুকটুকির জন্য। কমলাপুর রেলস্টেশনের পাশে একটা বস্তিতে থাকে। টুকটুকির বাবা-মা নেই। বেঁচে আছে না মারা গেছে টুকটুকি জানে না। মাকে একটু মনে পড়ে। ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দিয়ে মারা গেছে। তারপর মায়ের এক বান্ধবী হাফেজা খালা টুকটুকিকে মানুষ করেছে। হাফেজা খালাও বেঁচে নেই। এখন সালাম আর মনিরই টুকটুকির অভিভাবক। সালাম এবং মনিরও নিজেরা জানে না তাদের বাবা-মা কে ? মূলত এই গল্পটা শোনার পর থেকে সালাম, মনির ও টুকটুকির সঙ্গে গভীর বন্ধুত্ব হয় সুমনের। টুকটুকি, সালাম, মনির তাদের বাবা-মা সম্পর্কে কিছুই জানে না। সুমন তার বাবা সম্পর্কে জানে। শহরের নামকরা ব্যবসায়ী। সাইকেল বানানোর কারখানা আছে। বিদেশে চিংড়ি মাছ রপ্তানি করে। বাবার সঙ্গে থাকে না সুমন। বাবা-মা নিজেরা ঝগড়া করেছেন। তাদের কি কোনও ক্ষতি হয়েছে ? ক্ষতি হয়েছে সুমনের। টুকটুকি তার বাবা সম্পর্কে কিছুই জানে না। আর সুমন তার বাবা সম্পর্কে সব কিছুই জানে। কিন্তু বাবা তার সঙ্গে থাকে না। এক অর্থে টুকটুকির মতো সুমনেরও বাবা নেই। সুমনের মা আছেন। টুকটুকি, সালাম আর মনিরের সঙ্গে সুমনের এটাই পার্থক্য।

সালাম, মনির যাবার জন্য তাড়া দেখাচ্ছে। কিন্তু টুকটুকি যেতে রাজি হচ্ছে না। সুমনকে প্রশ্ন করল, ভাইজান রহস্যটা তো বুঝলাম না।

রহস্য ? কী ?

আপনি কি ভূত পোষেন ?

সুমন সত্যিটাই বলল, ভূত পোষা যায় না। তবে হ্যাঁ আমার সঙ্গে একজন ভূত আছে।

টুকটুকির পাশাপাশি সালাম, মনিরও ভয়ে আঁতকে উঠল। সালাম বলল, আপনার সঙ্গে ভূত আছে ?

হ্যাঁ।

আপনি তাকে দেখতে পান ?

হ্যাঁ পাই।

মনির জানতে চাইল―ভূতের সঙ্গে আপনার কথা হয় ?

হ্যাঁ কথা হয়।

টুকটুকির চোখে-মুখে বিস্ময়ের ঘোর যেন কাটছেই না। ভূত মানে ভয়ের ব্যাপার। অথচ সুমন ভূতের সঙ্গে কথা বলে এটা কী করে সম্ভব।

টুকটুকি সুমনকে বলল, ভাইজান আমরা ভূতটাকে দেখতে চাই। পাশে দাঁড়িয়ে সবার কথা শুনছিল পুতু মিয়া। টুকটুকির কথা শুনে সুমন কী করবে ভেবে পাচ্ছিল না। পুতু মিয়াই তাকে উদ্ধার করল। টুকটুকিকে প্রশ্ন করল―তোমরা কি সত্যি সত্যি আমাকে দেখতে চাও ?

ভূতের কণ্ঠে শুনে সালাম, মনির, টুকটুকি তিনজনই ভয় পেলো। পরক্ষণেই নিজেদের সামলে নিয়ে বলল, হ্যাঁ আমরা তোমাকে দেখতে চাই।

তাহলে একটা কাজ করতে হবে ?

কী কাজ ? তিনজনই একসঙ্গে জানতে চাইল।

পুতু বলল, মিথ্যা বলা বন্ধ করতে হবে। এখন থেকে ২৪ ঘণ্টা যদি তোমরা মিথ্যা না বলো তাহলে আমাকে দেখতে পাবে।

ভূতের কথা শুনে তিনজনই প্রথমে একটু অবাক হলো। কারণ মিথ্যা বলতে না পারার চেষ্টা তো তারা কোনওদিন করে নাই। কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা সেটাই তো ভালো করে জানে না। পুতুকে দেখতে চায় তারা। তাই পুতুর কথায় রাজি হয়ে গেল। পুতু মিয়া বলল, এখন থেকে ২৪ ঘণ্টা পর তোমাদের সঙ্গে আমার দেখা হবে। তবে শর্ত একটাই মিথ্যা বলা যাবে না। তোমরা যদি মিথ্যা বলো তাহলে আমি বুঝতে পারব। কাজেই আমার সঙ্গে চালাকি করবে না।

সালাম, মনির, টুকটুকি খুশি মনে সুমনের বাসা থেকে চলে গেল।

ঘরের ভেতর সুমন এবং পুতু ছাড়া আর কেউ নাই। ট্রেনের ছাদে পুতুর সঙ্গে পরিচয় হবার পর সুমন যতটা বিরক্ত হয়েছিল এখন সেই বিরক্ত ভাবটা নেই। মায়ের কাছে একটা সত্য কথা বলেছে পুতু। বাবার ব্যাপারে যা বলেছে পুরোটাই সত্য। সুমনের পরিচিত বন্ধুদের মধ্যে সবারই বাবা-মা আছেন। সুমনের থাকবে না কেন ? এমন যদি হতো যে সুমনের বাবা বেঁচে নেই তাহলে না হয় একটা কথা ছিল। মানুষটা বেঁচে আছে। আগে বাবার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করতো সুমন। এখন সেটা করে না। আপন পিতার সঙ্গে লুকিয়ে লুকিয়ে কেউ দেখা করে ? সুমন কি অপরাধী যে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখা করবে ? বাবা মাঝে মাঝে সুমনকে ফোন দেয়। মায়ের তা পছন্দ নয়। সুমনের ধারণা মায়ের মধ্যে একটা ভয় ঢুকে গেছে। ভয়টা হলো সুমন হয়তো একদিন মাকে ছেড়ে তার বাবার কাছে চলে যাবে। অথচ সুমন এটা কোনও দিনই করবে না। এত অকৃতজ্ঞ হতে পারবে না। বাবা যখন সুমনকে ফেলে চলে গেলেন তখন মা-ই তাকে বুকে টেনে নিয়েছে। মা-ও তো বাবার মতো সুমনকে ছেড়ে চলে যেতে পারতেন। তিনি তা করেননি। বাবা নেই, মা-ও নেই, সুমনের তখন কী দশা হতো ? সালাম, মনির, টুকটুকির মতোই হতো তার জীবনটা। মায়ের প্রতি অনেক কৃতজ্ঞ সুমন। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। মা-ও সেটা করতে পারতেন। তিনি তা করেননি। সুমনের জন্য সেক্রিফাইজ করেছেন। তবু কেন যেন বাবার প্রতি মাঝে মাঝে বেশি টান অনুভব করে সুমন। আজ যদি বাবা-মা একসঙ্গে থাকতেন তাহলে সুমনের জীবনটা অনেক সুন্দর হতো। ডানে বাবা বামে মা। সুমন মাঝখানে। সুখী পরিবার। কী যে শান্তি লাগত।

পুতু বিছানার উপর চুপ করে বসে আছে। তাকে একটা ধন্যবাদ দিতে হবে। মায়ের কাছে বাবা সম্পর্কে সত্যটা বলেছে। তার আগে পুতুর মূল পরিকল্পনাটা জানা দরকার। আসলে কী করতে চায় সে। এটা ঠিক স্বল্প সময়ের মধ্যে পুতুকে অনেক পছন্দ হয়েছে সুমনের। পুতু যেন তাকে একটা নতুন শক্তি দিয়েছে। আগে যে কাজটা কঠিন মনে হতো এখন সেটা সহজ মনে হচ্ছে। তবে পুতুকে মাতব্বরি করতে দেওয়া যাবে না। অতিরিক্ত মাতব্বরি সুমনের পছন্দ নয়।

পুতুকে ধন্যবাদ বলল সুমন।

পুতু চোখ তুলে তাকিয়ে বলল, ধন্যবাদ কেন ?

মাকে বাবার ব্যাপারে সত্যটা বলার জন্য। ও হ্যাঁ, তোমার আসল উদ্দেশ্যটা কী বলোতো ? তুমি কী করতে চাও।

কিছুই না। তোমার সঙ্গে পৃথিবীতে কিছুদিন থাকতে চাই। তুমি তোমাদের পৃথিবীটা আমাকে দেখাবে। আমিও একদিন তোমাকে আমাদের পৃথিবীতে নিয়ে যাব। আমাদের পৃথিবী দেখাব। তুমি চাইলে দুই-একজনকে সঙ্গে নিতে পারবে।

সুমন বলল, সেটা না হয় হলো। এই মুহূর্তে তুমি কী করতে চাও ? দেখলাম মা-ও তোমাকে বিশ্বাস করে ফেলেছে। ধারণা হচ্ছে মা তোমাকে বেশ গুরুত্ব দেবেন। তুমি আসলে কী করতে চাও বলো ?

পুতু বিছানা থেকে নেমে বলল, আমি তোমার জীবনটা বদলে দিতে চাই।

মানে ? আমার জীবন বদলে দেওয়ার তুমি কে ? অবাক হয়ে জানতে চাইল সুমন।

পুতুও একটুও বিরক্ত হলো না। বরং খুশি মনে বলল, ধরো আমি তোমার বন্ধু। নাকি তুমি আমাকে বন্ধু ভাবতে চাও না ? তোমার বন্ধু সার্কেলের অবস্থা খুব ভালো না। টুকটুকিদের সঙ্গে তোমার মানায় না। কিন্তু আমি ব্যাপারটা পছন্দ করেছি। টুকটুকি মেয়েটার বেশ বুদ্ধিমতী। আমি ওদের জন্যও কিছু করতে চাই।

তোমাকে ধন্যবাদ।

আবার ধন্যবাদ কেন ?

টুকটুকিদের কথা ভাবার জন্য। আমিও ওদের জন্য কিছু করতে চাই।

কী করতে চাও বলো ?

এখনও ভাবিনি।

তোমার নিজের ব্যাপারে কী ভাবছ বলো ?

আমার ব্যাপারে ?

হ্যাঁ।

কিছুই ভাবিনি। আগে যেমন চলেছে, আগামীতেও তেমনটাই চলবে।

তার মানে তুমি স্কুলে যাবে না ?

হঠাৎ স্কুলের প্রসঙ্গ আসছে কেন ? দেখো আমার ওপর অযথা খবরদারি করবে না। স্কুল আমার ভালো লাগে না। স্কুলে কোনও আনন্দ নাই।

তাহলে তুমি কী করতে চাও ?

ঐ যে বললাম যেমন চলছিল তেমনই চলবে।

তার মানে তুমি স্কুলে যাবে না ? যখন যেখানে খুশি চলে যাবে। বন্ধুদের সঙ্গে অহেতুক মারামারি করবে…

অবজেকশন। বলেই পুতুকে থামিয়ে দিল সুমন।

পুতু জানতে চাইল, অবজেকশন কেন ?

আমি বন্ধুদের সঙ্গে মারামারি করি না।

মারামারি করো না ?

না।

সত্য বলছো ?

হ্যাঁ… বলতে গিয়ে থেমে গেল সুমন। হঠাৎ তার মনে হলো মিথ্যা বললে পুতু তার সঙ্গে থাকবে না বলেছে। সুমনকে ইতঃস্তত করতে দেখে পুতু বলল, কী ভাবছো ? তোমার মনের কথা আমি বুঝতে পেরেছি। তুমি আর মিথ্যা বলতে চাও না। এটা ভালো লক্ষণ। এবার কাজের কথায় আসি। আজ এই মুহূর্ত থেকে তোমাকে নিয়ম মানতে হবে। প্রথম কথা হলো মিথ্যা বলা যাবে না। ঘরে সাপ পোষো সেটাও করা যাবে না। কাউকে খাঁচায় অথবা বাক্সে বন্দি করে রাখা ঠিক নয়। ধরো তুমি যে সাপটা পোষো সেটা একদিন মানুষ হয়ে গেল। তুমি হয়ে গেলে সাপ। তোমাকে বাক্সের ভেতর বন্দি করে রাখা হলো। কেমন লাগবে ? কাজেই শুধু সাপ নয়, কোনও প্রাণিই পোষা যাবে না। তুমি সাপের সঙ্গে বন্ধুত্ব করতে চাও সেটাও সম্ভব। আমি তোমাকে সহযোগিতা করব। তার আগে কথা দাও কাল থেকে স্কুলে যাবে। তোমার নতুন জীবন শুরু হবে।

অসম্ভব বলেই রীতিমতো চিৎকার দিয়ে উঠল সুমন। পুতু একটু অবাক হলো। কিন্তু বুঝতে দিল না। কারণ সে পরিকল্পনামাফিক এগোচ্ছে…

টুকটুকি মহা ঝামেলায় পড়েছে। সত্য বলাটা যে কত কঠিন আগে বুঝতে পারেনি। সত্য বললে পুতু মিয়াকে দেখতে পারবে এই আশায় মিথ্যা বলা ছেড়ে দিয়েছে। সালাম এবং মনিরেরও একই অবস্থা। সত্য বলাটা খুবই কঠিন। পুলিশ বস্তি ভেঙ্গে দিয়েছে। স্টেশনের একটু দূরে ভাঙ্গা রেলবগির ভেতরে শুয়েছিল টুকটুকি। বলতে গেলে এটাই এখন তার বাড়ি। সালাম এবং মনির আপন ভাইয়ের মতো তাকে আগলে রাখে। ওরা দুইজন অন্য গাড়িতে শুয়ে ঘুমাচ্ছে। ফজরের আজানের সময় হঠাৎ একটি লোক দৌড়ে এসে লাফ দিয়ে ভাঙ্গা রেলবগিতে ওঠে। একটা ছোট প্যাকেট টুকটুকির বালিশের কাছে রেখে আবার টুক করে রেল বগি থেকে নেমে যায়। প্যাকেটটাতে কী আছে বুঝে ফেলে টুকটুকি। পুলিশ যাতে এই প্যাকেটের ব্যাপারে টের না পায়, বুঝতে না পেরে টুকটুকির কাছে প্যাকেট আছে, সেই চেষ্টা করতে হবে টুকটুকিকে। বিনিময়ে যে ব্যক্তি তার কাছে প্যাকেট রেখে গেল সে তাকে বখশিস দিবে। টুকটুকি ভাবল আজ দিনটা মনে হয় ভালোই যাবে। কম করে হলেও ৫০০ টাকা বখশিস পাবে সে। একটা লাল জামা কেনার ইচ্ছে। কিন্তু হঠাৎ চমকে উঠল টুকটুকি। একটু পরে নিশ্চয়ই পুলিশ আসবে। প্যাকেটের কথা জিজ্ঞেস করবে। টুকটুকি তো আজ মিথ্যা বলতে পারবে না। মিথ্যা বললে সুন্দর ভূতটাকে চোখের দেখা সম্ভব হবে না। টুকটুকি সিদ্ধান্ত নিল পুলিশকে সত্য কথা বলবে সে। এরপর যা হয় হবে। মিথ্যা বলতে পারবে না সে। কখনও না।

যা ঘটার তাই ঘটলো। দুজন পুলিশ এল। রেল বগিতে লাঠির আঘাত দিয়ে ঠক ঠক আওয়াজ তুলে টুকটুকিকে ডাক দিল―এই মেয়ে এই দিকে কাউকে দৌড়ে আসতে দেখেছো ? টুকটুকি দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেল। অন্যদিন হলে ফস করে বলে দিত, না কোনও মানুষ তো দেহি নাই। আমি তো ঘুমায়া আছিলাম। আজও কথাটা বলতে গিয়ে জিভে আটকে গেল। টুকটুকির মনে হলো কেউ তাকে সাবধান করে দিচ্ছে―মিথ্যা বলা মহাপাপ। মিথ্যা বোলো না।

পুলিশ ধমক দিল টুকটুকিকে। অ্যাই মেয়ে আমার কথা কানে যাচ্ছে না ? কোনও লোককে দৌড়ে আসতে দেখেছো…

হ্যাঁ।

কোথায় সে ? কোন দিকে গেছে ?

ওই তো… ওই দিকে ?

তোমার কাছে কিছু রেখে গেছে ?

এবার ভয় পেয়ে গেল টুকটুকি। ভয়ে ভয়েই বলল―হ্যাঁ রাইখ্যা গেছে ?

কী রাইখ্যা গেছে ? কই দেখি। টুকটুকির বালিশের নিচ থেকে একটা প্যাকেট খুঁজে পেয়ে আনন্দে চিৎকার দিল পুলিশটি। স্যার পাইয়া গেছি। পাইয়া গেছি… ভিকটিম কট।

পুলিশটির চিৎকার শুনে একজন অফিসারসহ আরও কয়েকজন পুলিশ দৌড়ে এল। রহস্যজনক সেই প্যাকেটসহ টুকটুকিকেও নিয়ে গেল থানার দিকে।

থানায় বেশ ভিড়। সালাম ও মনিরও গ্রেফতার হয়েছে। লোকজন টুকটুকি, মনির আর সালামকে নিয়ে নানা কথা বলছে। কী জামানা আসলো বাচ্চা বয়সেই মাদক ব্যবসা শিইখ্যা ফালাইছে… টুকটুকি হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল।

ধানমন্ডির এই বাড়িতে বহুবার এসেছে সুমন। আগে ঘন ঘনই আসতো। বাবার কথা মনে হলেই দৌড়ে ছুটে আসতো। বাবাও ফোন করে ডেকে নিতেন। পরে সুমন যখন বুঝতে পারল রাজিয়া বেগম চান না সে এই বাড়িতে যাতায়াত করুক তখন আসা-যাওয়া বন্ধ করে দেয়। আজ পুতু মিয়ার পীড়াপীড়িতে এসেছে। টুকটুকি, সালাম, মনিরকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। থানায় গিয়েছিল সুমন। কর্তব্যরত পুলিশ অফিসার তার কথা শুনতে চায়নি। বরং তাকে এক ধরনের অপমান করেছে। তোমাকে দেখে তো ভদ্রঘরের ছেলে বলেই মনে হচ্ছে। তুমি বাবা এই ধরনের কেস নিয়ে দৌড়াচ্ছ কেন ? মাদক পাচারের মামলা। বয়স কম। কঠিন শাস্তি হবে না। তবে গাজীপুরে কিশোর অপরাধ সংশোধনী কেন্দ্রে চালান করে দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তুমি যাও। থানা পুলিশ তোমার কাজ নয়… কী বললাম বুঝতে পারো নাই ? নাকি তোমাকেও লকাপে ভরাব… পুলিশ অফিসারের কথা শুনে খুব কষ্ট পেয়েছে সুমন। পুতু সঙ্গে ছিল। সব কিছু দেখে শুনে সে তো অবাক। শুধু বলল, আমাদের দেশে কোনও পুলিশ বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে এভাবে ধমক দিয়ে কথা বলে না। চলো তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। সামনের দিকে যাবার জন্য ইশারা করল পুতু।

সুমন জানতে চাইল, কোথায় যাব ?

চলই না। তোমার একটা পরিচিত জায়গায়, একজন আপন মানুষের কাছে নিয়ে যাব।

আপন মানুষ ? কে ? নাম বলো।

নাম বলা যাবে না।

আমাকে যার কাছে নিয়ে যেতে চাচ্ছ তাকে তুমি চেনো ?

হ্যাঁ চিনি।

তার নাম বলো।

তার নাম আগে বলতে চাই না। তার কাছে গেলে তোমার বেশ ভালো লাগবে।

সুমন দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, টুকটুকিদের থানা থেকে না ছাড়ানো পর্যন্ত আমি থানা থেকে কোথাও যাব না।

পুতু বলল, আমরা যার কাছে যাচ্ছি তিনি নিশ্চয়ই আমাদেরকে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করবেন।

সুমন আবারও নামটা জানতে চাইল। পুতু যার কাছে যাচ্ছি তার নাম বলো। নাম না বললে আমি যাব না।

পুতু এবার কোনও রহস্য না করে বলল, সুমন আমরা তোমার বাবার কাছে যাচ্ছি ?

আমার বাবার কাছে ?

হ্যাঁ। কেন ?

এটা আমার অ্যাসাইনমেন্টের অংশ।

তুমি যাও। আমাকে টানছো কেন ?

তুমি সঙ্গে চলো। তিনি তো আমাকে দেখতে পাবেন না। তুমি কথা বলবে আমি শুনব।

স্যরি, আমি যেতে পারব না।

তোমার মায়ের কথা ভাবছো ?

সুমন কোনও উত্তর দিল না।

পুতু বলল, মায়ের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে।

কোন বিষয়ে ?

তোমার আর তোমার বাবার ব্যাপারে। বলেছেন, তুমি যদি মাঝে মাঝে বাবার সঙ্গে দেখা করতে চাও তাহলে তার কোনও আপত্তি নাই।

মা বলেছেন ?

হ্যাঁ। শোনো, আমি মিথ্যা বলি না।

স্যরি।

স্যরি কেন বলছো ?

ওই যে সত্য-মিথ্যা…

তাহলে তুমি আমাকে তোমার বাবার কাছে নিয়ে যাচ্ছো ?

চলো। পুতুকে সঙ্গে নিয়ে থানা থেকে বেরিয়ে গেল সুমন।

ধানমন্ডির বাড়ির গেটের বুড়ো দারোয়ান সুমনকে দেখে পড়িমড়ি করে ছুটে এল। সুমন বাবা তুমি কেমন আছো ? কতদিন পর তোমার সঙ্গে দেখা। তুমি আসো না কেন ?

সুমন কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। পুতু বলল, বুড়ো মানুষ। তার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলতে হয়। হেসে হেসে কথা বলো।

হঠাৎ দূর থেকে সুমনের বাবা আজাহার উদ্দিনের গলা শোনা গেল। বুড়ো দারোয়ানকে উদ্দেশ্য করে বললেন―কে এসেছে রে ?

দারোয়ান বলল, সুমন বাবা।

আজাহার উদ্দিন অফিসে যাচ্ছিলেন। সুমনের নাম শুনে দৌড়ে এলেন। সুমনকে কাছে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দিয়ে বললেন, বাবা ভালো আছিস ?

হ্যাঁ ভালো আছি। ছোট্ট উত্তর দিল সুমন। আজাহার উদ্দিন ছেলের হাত ধরে বাড়ির ভিতরে যেতে যেতে চিৎকার দিয়ে বললেন, ড্রাইভার… ড্রাইভার এখন গাড়ি বের করতে হবে না। সুমনের জন্য নাস্তা দিতে বল। ও আজ আমার সঙ্গে দুপুরে খাবে।

সারা বাড়িতে একটা হইচই পড়ে গেল। সুমনকে এই বাড়ির লোকজন খুবই পছন্দ করে। সুমনের সৎমা ফরিদা আখতারও সুমনকে ভালোবাসেন। সুমন বাসায় এলে ফরিদা হইচই ফেলে দেন। তবু ফরিদাকে পছন্দ নয় সুমনের। তবে ফরিদার একমাত্র ছেলে ফরহাদকে খুব পছন্দ সুমনের। ফরহাদ বোধকরি বাসায় নাই। বাসায় থাকলে এতক্ষণে আনন্দে সারা বাড়ি মাথায় তুলত। নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে কম্পিউটারের জগৎ দেখাত।

সুমনের দিকে আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে আছেন আজাহার উদ্দিন।

বাবা, তুই কেমন আছিস ?

ভালো।

শুনলাম নিয়মিত স্কুলে যাস না।

হ্যাঁ।

কেন ?

স্কুল ভালো লাগে না।

তাহলে এক কাজ কর বিদেশে চলে যা। বিদেশে পড়।

সুমন দৃঢ়তার সঙ্গে বলল, তোমাকে তো আগেই বলেছি আমি বিদেশে পড়তে যাব না। বিদেশে গেলে আমার মাকে কে দেখবে ? তুমি তো আমার মাকে ছেড়ে এসেছো…

আজাহার উদ্দিন ভাবতে পারেননি সুমন তার সঙ্গে এভাবে কথা বলবে। বিব্রত চোখে এদিকে-ওদিক তাকাতে থাকলেন। পুতু দুজনের কথা শুনছিল।

সুমনকে বলল, সুমন, বাবার সঙ্গে তর্কে যেও না। তুমি কেন এসেছো সেটা বলো। সুমন বলল, তাকে আমি কিছুই বলব না। চলো, আমরা বরং যাই।

যাবার জন্য উঠে দাঁড়াল সুমন। আজাহার উদ্দিন অবাক হয়ে বললেন, বাবা তুমি কি চলে যাচ্ছো ?

হ্যাঁ।

কেন এসেছিলে ? আমাকে দেখতে ?

না। একটা কাজে এসেছিলাম।

আজহার উদ্দিন মৃদু হেসে বললেন, কাজটা কী ? বলো আমাকে।                  

আমি জানি তুমি কাজটা পারবে। না বলবে না।

আজাহার উদ্দিন ভরসা দিয়ে বললেন, আগে কাজটা কী আমাকে বল ? চেষ্টা করে দেখব।

চেষ্টা নয়। তোমাকে কাজটা করে দিতে হবে।

সুমনকে আশ্বস্ত করলেন আজাহার উদ্দিন―কাজটা কী আগে বল।

তিনটা ছেলে-মেয়েকে থানা থেকে ছাড়িয়ে আনতে হবে।

সুমনের কথা শুনে আজাহার উদ্দিন যারপরনাই অবাক হয়ে বললেন―থানা থেকে ছাড়িয়ে আনব মানে ? কী করেছে তারা ?

মাদক পাচার করেছে।

আজাহার উদ্দিন ভয় পেয়ে বললেন, মাদক পাচার। তাদের সঙ্গে তুইও জড়িত ?

সুমন বলল, তুমি ভুল করছো বাবা। আমি মাদক পাচারকারী নই। ওই ছেলে-মেয়ে তিনজনও মাদক পাচারে জড়িত নয়। ওদেরকে ফাঁসানো হয়েছে। আমি চাই তুমি তাদেরকে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করবে।

ওদের সঙ্গে তোর সম্পর্ক ? জানতে চাইলেন আজাহার উদ্দিন। সুমন কোনও প্রকার দ্বিধা না করেই বলল, ওরা আমার বন্ধু।

আজহার উদ্দিন এবার কিছু বললেন না। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। পুতু সব কিছুই দেখছিল। আজাহার উদ্দিন হঠাৎ ঘর থেকে চলে যাবেন এমনটা আশা করেনি। পুতু ভেবেছিল অনেক দিন পর বাবা-ছেলের দেখা হবে। একটা মধুর মিলন ঘটবে। কিন্তু সেটা বোধকরি হচ্ছে না। কিছুক্ষণ পর আজাহার উদ্দিন আবার ঘরে ঢুকলেন। সুমনের মুখোমুখি বসে বললেন, আমি তোর কাজটা করব। কিন্তু তোকেও আমার একটা কাজ করে দিতে হবে।

সুমন বলল―কী কাজ ?

কথা দে কাজটা করবি ?

কাজটা কী সেটা তো জানতে হবে।

ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন আজাহার উদ্দিন। কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমি একটা ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করে দে। তুই নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু কর। মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা কর। তুই যদি চাস আমি তোর মায়ের কাছে গিয়ে স্যরি বলে আসব। প্লিজ বাবা…

বাবা-ছেলে পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। দৃশ্যটা দেখে পুতুর চোখেও পানি এসে গেছে।

কয়েক মাস পরের ঘটনা। সুমন নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু করেছে। এতে বাবা-মা দুজনই খুশি। টুকটুকিদের জন্য একটা প্রজেক্ট খুলেছেন সুমনের বাবা আজাহার উদ্দিন। সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের একটি তালিকা তৈরি করে তাদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছেন। টুকটুকিরা এখন স্কুলে যায়। তাদের জন্য থাকার একটা ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকটা হোস্টেলের মতো। নাম দেওয়া হয়েছে সুমন শিশুকেন্দ্র। সুমন আর পুতু মিলে শিশু কেন্দ্রের উন্নয়ন ভাবনায় অনেক কর্মসূচি নিয়েছে। এই কাজে সুমনের ক্লাসের বন্ধু জাহেদুলকে যুক্ত করা হয়েছে। সুমনদের স্কুলের হেড মাস্টারও এই কাজে যুক্ত হয়েছেন। সব চেয়ে আনন্দের খবর, ভূতরাজ্যে যাবার পরিকল্পনা নিয়েছে সুমন। সুমন যদি বার্ষিক পরীক্ষায় প্রথম হয় তাহলে ভূতরাজ্যে যাবার পারমিশন মিলবে। পুতু মিয়া সেই ব্যবস্থা করবে। সুমন মনে প্রাণে সেই চেষ্টাই করছে। ভূতরাজ্যে যেতে চায় সে। যে দেশে মাটি নাই, সেই দেশে পাহাড় পর্বত, সমুদ্র, নদী নালা আছে কী করে। ওই দেশে নাকি কেউই মিথ্যা বলে না। অপরাধ করে না। পশুপাখিকে হত্যা করে না। ফুল ছেঁড়ে না। এও কী সম্ভব ? এই গল্পটা আরেক দিন বলব…

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button