আর্কাইভকবিতা

কবিতা : ঈদসংখ্যা ২০২৪

মাকিদ হায়দার

জানালো সেদিন

যোগ অঙ্ক ছাড়া বিয়োগ শিখব না কোনওদিন,

বলেছিল বাড়ির জায়গিরকে।

লসাগু গসাগু শিখালেও শিখতে পারি।

বলল, শিখব না ধারাপাট।

আমার আসবে না যাবে না তেমন কিছুই,

বরং আপনি খুঁজে নিতে পারেন পথ।

বললাম,

ঠিক আছে তাই হবে চললাম পথে।

সুলতানা মুখ ভার করে কাটালো সেদিন

এমনকি

তাকালো না ফিরে আমার দিকে।

ঘরে ফিরে এসে দেখি,

যাদব বাবুর পাটিগণিতের সবগুলো পাতা,

সরল অঙ্ক, শিখে ফেলার পরই

সুলতানা বসেছে আমার পাশে পড়ার টেবিলে।

জানালো সেদিন,

আমরা দুজন নিয়ে যাব সব যোগফল।


আবিদ আনোয়ার

কবির মৃৃত্যুতে

আকাশ খুবই রাগ করেছে, বাতাসে নীরবতা:

ফুল ফোটেনি আজ বাগানে,

ভ্রমরা তাই বিরত গানে,

পাখিরা বড় গোমড়ামুখো কেউ বলে না কথা।

নদীরা কেঁদে জল বাড়াল, পাহাড় হলো বোবা,

নাচ ভুলেছে কাঠবিড়ালি

গাছের পাতা দেয় না তালি,

অভ্র থেকে হঠাৎ করে হারিয়ে গেছে শোভা।

ধূলিমলিন তানপুরাটা কয় না কথা সুরে;

বাজ পড়েছে মর্ত্যলোকে

অকালমৃত কবির শোকে

প্লেটোর চেলা স্বস্তি পেলো: আপদ গেছে দূরে!  

————————-

কামাল চৌধুরী

সমর

আজ রাতে মাথার ভেতরে চিৎকার

আজ রাতে হেভি মেটালের শব্দে ডাকাতিয়া বাঁশি

আজ রাতে জমি মাপার চেইন দিয়ে

তোমার আমার দূরত্ব মাপছি

পৃথিবীটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো যে যার

ডানহাত বামহাত করে

একটা শরীর শুধু শিরায় উপশিরায়

আগুন নিয়ে খেলা করে

সে খেলায় আমি তুমি আমরাই আছি

সে খেলায় তুমি আমি জীবিত সমর

—————————-

নাসির আহমেদ

তরুণ কবিকে

যে কথা বলেনি কেউ কোনওদিন আগে

সে কথা বলার প্রতিশ্রুতি

দিতে হয় নিজেকেই নিজে

কারও কথা না ভেবে নিভৃতে।

যে ফুল ফোটেনি কোনও বনে

অথবা সজ্জিত কোনও ঐশ্বর্য-উদ্যানে

সে ফুল ফোটাতে যদি আকাক্সক্ষা তোমার

গোপন সৌরভে তার মগ্ন হতে হবে,

বাগান সাজাও সংগোপনে

নিজের ভেতরে।

সেই অকথিত কথা, সেই যে আবেগ

যদি ঘন কালো মেঘ হয়ে বৃষ্টি আনে

হৃদয় জমিতে তবে নিশ্চিত শস্যের সম্ভাবনা

এবং সে ফুল জেনো ফুটবে তোমারই মনোবনে।

নিমগ্ন সাধক তুমি ডুব দাও গভীর অতলে

যেন তীব্র অনুরাগে জ্বলে সেই অদৃশ্য আগুন

যে আগুনে দগ্ধ হয়ে মনসুর হাল্লাজ…

তুমিই তোমার স্রষ্টা নতুন কথার কারিগর।

পায়ের তলায় শুধু চাই মাটি, ঘাস আর জল

ফুল-ফল অন্যে নি’ক, গন্ধটুকু তোমার সম্বল।

—————————————-

শিহাব সরকার

তাঁবু নিয়ে আরও কিছু

বার বার ফিরে আসে তাঁবু, সমতটে

নদী বয়ে যায়, তার কূলে শান্তি অবিরাম।

কেন যে দুঃস¦প্নে তাঁবু ছারখার

ভুলে গেছিলাম ছিন্ন তাঁবুতে জন্ম  উৎসব

অরণ্য কিনারে ছেঁড়াখোঁড়া তাঁবু

মধ্যরাতে ভূমিকম্পে স্বপ্ন চুরমার

ধ্বংসস্তূপে মানুষ দিশাহারা, লাশের পরে লাশ

 দুর্যোগের স্মৃতি মুছে কত না বাগিচা করি

বালক-বালিকারা যাবে পাঠশালায়।

থাকে না কিছুই অবশেষে, সব মায়া সব ছায়া

ভুখামিছিলের দৈর্ঘ্য বাড়ে, কে কার সান্ত্বনা

মাটি চৌচির, ক্ষেত থেকে যব ঝরে

বুঝছে না কাফেলা কোন সুদূরে যাবে।

গুহার অদূরে বুনো ঝোপ, তারপর

তাঁবু কিছু জাগে এখানে ওখানে ইতি-উতি,

সবশেষে বুকের ভিতরে চাপা দীর্ঘশ্বাস  

সাধুরা বুঝে ফেলে দানবের ছদ্মবিলাপ।

কতকাল থেকে নদীতীরে কাশবন পানাফুল।


বিমল গুহ

আমরা যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি

দুঃস্বপ্নে ঘুম ভাঙে―চারদিকে যুদ্ধবিমান ঘূর্ণমান!

আমরা কি অট্টহাসি

ঘোরলাগা মন্ত্রবাণ, প্রতিহিংসা

আমরা কি কলহাস্য, আত্মধ্বংসী বারুদের ধোঁয়া

আসন্ন যুদ্ধের মাতাল নায়ক ?

―আমরা চাই না যুদ্ধ ধ্বংস কালো ধোঁয়া

আমরা চাই না যুদ্ধ বোমারুবিমান আকাশগর্জন

কান্নাভরা স্বর;

আমরা যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি।

এইমাত্র রাশিয়ার হিংস্র সমরাস্ত্র ধ্বংস করেছে ইউক্রেন

ধ্বংস করেছে গ্রন্থাগার নগরসভ্যতা,

এইমাত্র ইসরাইল মানবধ্বংসী মিসাইল ছুড়েছে সোল্লাসে

গাজা স্ট্রিপে

উড়িয়ে দিয়েছে শত যন্ত্রণাকাতর প্রাণ

ধ্বংস করেছে হাসপাতাল, লোকালয়;

এই কি উত্তরাধুনিক সমাধান ?

আমরা কি মিসাইলমানব―একবিংশ শতকের ব্যর্থ অহংকার!

―আমরা প্রতিহিংসা কলহবিরোধী;

               আমরা সর্বপ্রাণবাদী

আমাদেরও রয়েছে বাঁচার অধিকার মানুষের মতো।

আমরা যুদ্ধের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি।

————————

ফারুক মাহমুদ

রক্ষা

(উৎস : জীবনানন্দ দাশ)

ভস্মগুলো তুলে রাখো, একদিন প্রয়োজন হবে

      বিষন্ন অগ্নির ভাষা উচ্চকণ্ঠ নয়

ঝরাপাতা রুগ্ণ বটে। নৈঃসঙ্গ্যের চিহ্নছায়া

     বাতাসের স্পর্শে এসে চিরস্বপ্নময়

গ্লানির উৎকট গন্ধ, তবু কেউ টাকাকড়ি গোনে

     মাস শেষে ঘোলা চোখে উচ্ছলিত হাসি

বালিতে লুকানো মুখ―জবুথবু, উটপাখি যেন

     কেনা দাস, চিরকাল থেকে গেল দাস-ই

চেনা পথে ক্লান্তি আছে। চেনা দৃশ্যে বোবা মসৃণতা

       যেতে যেতে ছেঁড়া ঘুম, দীর্ঘ বালিয়াড়ি

আলোর স্থিরতা থেকে ফেটে পড়ে রিক্ত অন্ধকার

        বোবাপ্রাণিদের গান―অকারণে ভারী

স্বাভাবিক ধারণার অন্য পাশে কেন্দ্রবিন্দু থাকে

       সিদ্ধান্তের শুভ্র গতি, পুনঃবিশ্লেষণ

যে কোনও ধ্বনির মধ্যে প্রতি-প্রতিধ্বনি

       নতুনার্থ লেখা হয়―মনস্ক বীক্ষণ

প্রমিত শব্দের সঙ্গে দূরে-কাছে দেখাদেখি ঘটে

         ছন্দ জাগে কবিতার ধূসরিত মনে

তা না-হলে কী-যে হতো! অমূলক খ্যাতিবেড়ি

        মৃত্যুর অধিক মৃত্যু―আত্ননিষ্পেষণে।

—————————–

শামীম আজাদ

কবিতার কিস

মানুষের কত রকম প্যাশন থাকে,

আমার আছে শুধু কবিতা লিখবার।

আমি প্রতি সন্ধ্যা সুর তুলবার আগেই বেরুই

আমার সঙ্গে চলে আমার ডেট।

আমরা হাঁটতে হাঁটতেই সুরলয়তালে

একটা আনুভূমিক সম্পর্ক সৃষ্টি করি।

যেন মিষ্ট মিষ্ট জলে ভাসছি

উতলা ঐ জলখণ্ডের নিচে

মৃন্ময়ীর মসৃণ তলপেট টের পাই

দ্রুত উঠে উপরে বায়ুতে চাষাবাদ শুরু করি

আর যেখানেই যেতে চাই ঠিক পৌঁছে যাই।

আমিই হয়ে উঠি স্ফূর্তি ও ফাগুন

আমাকে অতিক্রম করার ক্ষমতা থাকে কেবল

অন্য আরেকটি উত্তম কবিতার ॥

————————–

জাহিদ হায়দার

আধুনিক মানুষের রাস্তা

বলেছিলে

               এই পথে খাদ,    

               ওই পথে যেতে।

একটা শূন্য বাড়ি। দরজা জানলা খোলা।

পায়ের অস্থির ছাপ নেমে গেছে সবুজ ঘাসের দিকে।

প্রবেশা করুণ।

গিয়েছি পরিধিপথে।

তুমি অন্যদিকে এক ঘূর্ণি,

               খুঁজছো নিঃশ^াস।

ঘুরে ঘুরে পার্কিং ওয়েতে অনেক চাকা। ক্লান্ত।

পাতাগুলি ঘড়ি না দেখেই

               গির্জার ঘণ্টাকে ছুঁয়ে ঝরে যাচ্ছে।

পাখিরও আছে ঘরে ফেরার পথ।

দুটো ডালের ক্রসিংয়ে বাসাটা শান্তি-সুন্দর। 

হাত ধরবার জন্যে 

               যে কোনও পথকে আমরা ভালোবেসেছিলাম।

নো পথে হাঁটছি দুজন।

আমি কি ‘স্টপ’-এ দাঁড়াব এখন ?

(যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের লেক জ্যাকসন শহরের রাস্তাগুলোর নাম―

‘দিস ওয়ে’, ‘দ্যাট ওয়ে’, ‘এনি ওয়ে’, ‘সার্কেল ওয়ে’, ‘পার্কিং ওয়ে’, ‘ও্যআইন্ডিং ওয়ে’, ‘নো  ওয়ে’, এমনকি গির্জার পেছনের

রাস্তাটির নাম ‘হিজ ওয়ে’।)


বাদল ঘোষ

সূর্যের মশাল হাতে

বৃষ্টি ঝরার আগেই ঝরেছিলে তুমি

ফোঁটা ফোঁটা তপ্ত ধূসর মরুতে

মেঘ জমার আগেই জমেছিলে তুমি

সূর্যের আগুন মুখ চেপে ধরে।

তুমি ঝরলে বৃষ্টি, হাসলে কমলা রঙের রোদ ওঠে

রোদবৃষ্টি তবু ভালো, শুধু মেঘ হয়ে জমতে বারণ

অমন থমথমে মেঘ আমার পছন্দ নয়।

সকাল হবার আগে হয়েছিলে মাখন সদৃশ স্নিগ্ধ সোনার সকাল 

সূর্য ওঠার আগেই তুমি জেগেছিলে সূর্যের মশাল হাতে

পৃথিবীটা তাই এত আলোকিত আজও!

তুমি জন্মেছিলে বলে এমন মানবজন্ম

সার্থক অপার।


আসাদ মান্নান

মার্চের আগুন ও অশুভের ছায়া

তেইশ বছর নয় শুধু, হাজার শতাব্দী ধরে

কী দুঃসহ শোষণে পেষণে জর্জরিত রাম-রহিমের

বাংলার মাটি ও তার জীর্ণ শীর্ণ নিরন্ন মানুষ!

সবুজ বনানী থেকে শুরু করে পাটের গুদাম

হাড্ডিসার কৃষকের কষ্টে বোনা জীবনের বীজ

নদী নালা খাল বিল হাওরের শালুক পাপিয়া

লাশ হয়ে ভেসে গেছে পচা গলা ভাসানের জলে―

যে যায় এমন করে  চলে যায় অদৃশ্য গাঙুরে! 

ভাঙাচোরা বাতিঘরে কৃষ্ণপক্ষ; মুরগির খোপরে 

অন্ধকারে ঢুকে পড়ে রাতজাগা শিকারি শিয়াল―

বুকে বাজে তীব্র হাহাকার; রক্তশূন্য জনপদে

শকুন-শকুনি আর শাপগ্রস্ত পঙ্গপাল ওড়ে;

জরাগ্রস্ত জন্মভূমি, ঘরে ঘরে অভুক্ত শিশুর 

ক্ষণে ক্ষণে মর্মভেদী কী করুণ কান্নার আওয়াজ :

অন্ন নাই বস্ত্র নাই পথ্য বলে কিছুই ছিল না―

এমন বিপন্ন এক হতশ্রী দেশের সবচেয়ে

অধিক অবহেলিত এক গাঁয়ে জন্ম নেওয়া

অপূর্ব সুন্দর ওই সাহসী খোকার প্রাণে কেন

অভাগা মায়ের জন্যে জন্মে

কালজয়ী দেশপ্রেম ?

রবীন্দ্রনাথের গানে কে তাকে গোপন মন্ত্র দেয়,

দেশটাকে ভালোবেসে গেয়ে ওঠো মরণ বিজয়ী

সেই গান

ও আমার দেশের মাটি তোমার ’পরে ঠেকাই মাথা।

তারপর রক্তগামী ইতিহাসে অগ্নি জ্বেলে জ্বেলে

এ কোমল মৃত্তিকায় উঁচু মাথা ঠেকাতে ঠেকাতে,

কারাগার থেকে কারাগারে যেতে যেতে একদিন 

দীর্ঘদেহী খোকা হলো সব শোষিতের প্রিয় নেতা,

অতঃপর বঙ্গবন্ধু; এ চির উন্নত মম শির―

আকাশ বিদীর্ণ করে মুক্তিদূত স্বরূপে দাঁড়ায় :

হিমালয় নত হয় মাথা ঠুকে তার পদতলে;

বুকে তার বহে চলে শত শত দুর্বিনীত নদী;

একটা সোনার দেশ আর তার স্বাধীন নীলিমা 

আবেগবান শিল্পীর মতো স্বপ্ন দিয়ে আঁকতে আঁকতে তিনি

কাটালেন কত শত বিনিদ্র প্রহর;  

রবীন্দ্রনাথের গানে তাঁর প্রাণে মরমিয়া টানে

বেজে ওঠে জন্ম থেকে গেঁথে থাকা বাণী অপরূপ :

‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’―

এ মধুর গান যার মর্মমূলে নিত্য দিবানিশি 

বাউল বাতাস হয়ে বাজে, কে তাকে রুধিতে পারে! 

চারণের বেশে তিনি ক্লান্তিহীন উন্মত্ত নেশায় 

অন্ধ হয়ে অবিরাম ছুটেছেন দুঃখিনী বাংলার

এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে শহরে বন্দরে গ্রামে―

গণতন্ত্রে কী পরম শক্তি দেখে

দরিদ্র কাঙাল

নিরক্ষর জন্মমূর্খ মানুষের প্রতি আস্থা রেখে

দুঃসাহসিক অভিযানে নুহের কিস্তির মতো

তাঁর সেই স্বপ্নজয়ী গৌরবের  নৌকা ভাসালেন!

কী উত্তাল জনসমুদ্রের প্রমত্ত ঢেউয়ের তালে তালে  

এল অগ্নিঝরা মার্চ ১৯৭১-সংখ্যা থেকে জন্ম নেয় আমাদের স্বাধীনতা―বাঙালির  মহা ইতিহাস :

হ্যাঁ, তিনি এমন বীর সুদর্শন কবিদের কবি―

যাঁর ডাকে জেগে ওঠে বেহুলার ঘুমন্ত ঘুঙুর,

নদীর ওলান ছেড়ে জলবতী মেঘের ঔরসে 

ওই নামে মুখ ঘষে সমুদ্রের জরায়ুমণ্ডল―

তেরশ নদীর জলে ডুবে থাকা বদ্বীপের বুকে

আরও এক নদী ছিল দৃশ্যাতীত বঞ্চনার নদী,

সহস্র বছর ধরে বহে চলা সেই নদীটাকে

কে তিনি থামিয়ে দেন তাঁর ওই স্বপ্নজয়ী ডাকে:

ভাইয়েরা আমার!

রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো,

এ দেশের মানুষকে

মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ!

একটা দেশের মানুষের মুক্তি আনতে আমি জানি  

প্রথমে দরকার সে-দেশের সার্বভৌম মুক্তি―তিনি পরাধীন একটা দেশের পরিণামদর্শী

এক মুক্তিদাতা; সে-মুক্তির পথে যিনি দেশটাকে

একদিন মুক্ত করেছেন,

কিন্তু তিনি কি জানতেন জন্মদোষে অকৃতজ্ঞ এ দেশের মানুষকে মুক্ত করা যায় না ?

তিনিও তা পারেননি―মুক্ত করবার আগেই দেখা গেল

অমানুষ ঘাতকেরা বাংলার মানচিত্রের মতো

তাঁর বুকটাকে বুলেটে বুলেটে ঝাঁঝরা করে দেয়;

রক্তে ভাসে সংবিধান ডুকরে কাঁদে বাংলার আকাশ।

তারপর দেখতে দেখতে নতুন নিয়মে শুরু হলো

পুরাতন খেলা; দেশটা ভূতের পায়ে হাঁটতে থাকে―

পেছনের দিকে হাঁটতে হাঁটতে দেখা যায় ভূতের গলিতে অশ্বহীন আস্তাবলে এক সানগ্লাস পরিহিত

অমাবস্যা কালোজামা গায়ে নির্বিকার বসে আছে।

এইভাবে একদিন বেলা ডুবে যায়―আলো ছাড়া 

সূর্য ওঠে ঘড়ির কাঁটায়; চতুর্দিকে তবু রাহু

চণ্ডালের হাড় থেকে এক ভীতিকর দীর্ঘতর

ছায়া নামে;

তাকে ঘিরে অশুভের আস্ফালনে ডাকিনী উল্লাস।

২.

কবি নেই; তাঁর মহাকবিতার অমরত্বে আজও

চেষ্টা করেও হায়েনাগুলো দাঁত বসাতে পারেনি;

সারাক্ষণ কবি চোখ বন্ধ করে বাতাসের বুকে

কান পেতে শোনে;

এমন দেশের জন্য গান বাঁধে হরিনাম জপে 

জয় গুরু সকলের প্রিয় অন্ধ ফকির লালন,

আত্মভোলা দীনহীন কবি ও কাঙাল হরিনাথ;

অন্ন নাই বস্ত্র নাই হাড্ডিসাড় কলুর বলদ

নিরন্তর জীবনের ঘানি টানে; বধূ চলে গেছে―

মধুবনে মধুহীন সর্ষে ক্ষেতে মৃত প্রজাপতি;

যদিও এমন দৃশ্য আজকাল কোথাও দেখি না,

তবু বলতেই হবে, গোলাপের পাপড়িগুলো

এখনও ঠিক নিরাপদে আছে বলা তো যায় না!

বুনো শুয়োরের দল সুযোগেই যে কোনও সময়

তছনছ করে দেবে আমাদের মার্চের বাগান―

আশঙ্কার কথা বটে; তবে এও ঠিক আমাদের 

প্রতিবর্গ ইঞ্চি মাটির উপরে জ্বলছে চিরন্তন

ওই মহামানবের অবিনাশী গৌরবের শিখা;

আমরা করি না ভয়―আমাদের বিজয় উদ্যানে,

মহাকাব্যে আছেন দাঁড়িয়ে কবি, বাঙালির পিতা

মহামতি চিরঞ্জীব শেখ মুজিবুর রহমান―

ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল জুড়ে আজও দুঃসময়ে তিনি

মার্চের আগুন জ্বেলে তাড়াচ্ছেন অশুভের ছায়া।


সোহরাব পাশা

মন পোড়ে দূরে কোথাও

সন্ধে নামেনি তখনও

বসন্ত ফেরেনি

আলো কুড়ানো হয় না আর মেয়েটির

ফুল খোঁজে কিছু বিস্মৃতির ভুল খোঁজে

দেহে নিভৃতির অসংকোচ সরিয়ে

নিরালায় আবছায়া নিয়নের নিচে,

সে কী শবরী বালিকা―ছিঁড়ে ফেলেছে

ভালোবাসার গুঞ্জারমালা ?

গোপন ভাষার স্নিগ্ধ ফুল ফোটে চোখে

দূরে কোথাও ঝাপটা মারে

পাকুড় গাছের নিচে মাতাল দুপুর

মন পোড়ে―জোনাকির রাত

এখন সে সব দিন আর বাড়ি নেই;

অব্যবহৃত সময়

অবিশ্বাসের বিষাদ, স্বপ্নভাঙা দহনের স্মৃতি

দখল নিয়েছে দীর্ঘ মসৃণ শূন্যতা

শহরের সন্ধ্যার মলিন আলো-ছায়া,

মেয়েটি

পাতার আড়ালে খোঁজে জ্যোৎস্না

নির্জন হলুদ স্বপ্নের ভিতর খোঁজে

বসন্তের প্রিয়দিন।


মিনার মনসুর

রূপসীর মাতাল ঘুঙুর

তুমি ভাবছো, এ কেবল ট্রাম্প-বাইডেনের খেলা! খুলে গেছে প্যান্ডোরার বাক্স। গরিলার হাতে গিটার! সিল্করুটজুড়ে খুলির পতাকা ওড়ে। থাবা পেতে বসে আছেন অন্য এক চেঙ্গিজ খান। তার কামার্ত চোখ সেটে আছে চায়নার অধরা অধরে।

ইবনে বতুতা ব্যস্ত খুব মালদ্বীপের ক্রীতদাসীর বাজারে। পকেট গড়ের মাঠ। নারায়ণগঞ্জ থেকে কেনা মেয়েটিও উধাও হয়ে গেছে। তদুপরি, ঘাড়ে নিশ^াস ফেলছে অদৃশ্য তরবারি। গাধা-ঘোড়া সব একাকার! এ কেমন কাল এল―বলুন তো ভাই রফিক আজাদ!

মঙ্গলের বুক এফোঁড়-ওফোঁড় করছে মহাকাশযান। হাঁটুমুড়ে তুমি বসে আছো গুহার অন্ধকারে। বাইরে রক্ত-হিম-করা গর্জন।

ইস্পাহান থেকে উইঘুর―তবু থামে না রূপসীর মাতাল ঘুঙুর।


সরকার মাসুদ

সারা জীবন

সারা জীবন চেয়েছি সেই সব রাস্তা

যারা হৃদয়ের দিকে গেছে

ছায়াময় দূরের পথ

আর পাহাড়ের মতো হৃদয় চাই

চৌরাস্তার ধাঁধা চাই এখনও

নানারকম মানুষ আছে বলেই তো

পার হয়ে যেতে পারি জীবনের বাধা

বিপরীতধর্মী লোক এসে জোটে নিরালা মোড়ে

পথের নিরালা বাঁকে

জটিল নিয়তি এখানে এনেছে তাকে

দুর্যোগে বিব্রত মানুষও সিংহের ছবি আঁকে

অন্যমনস্কতার ভেতর বাঁধ ভেঙে পড়ে স্রোতে

দ্যাখো, কর্মজীবী মানুষও উদাসীন হয়

যখন শেষ বিকেল আকাশে ছড়ায় সিঁদুর রঙ

আত্মমগ্ন পথিক একা একা কতদূর যায়

সে নিজেই জানে না

দুঃখের শনে ছনে ছাওয়া মধুর কুঁড়েঘর      থাকে অপেক্ষায়

সারা জীবন চেয়েছি ওই টাটকা ছবি; চাই

ব্যথায় ব্যথা ঠুকে আগুন জ্বালায়

যারা তাদের আরাম


রেজাউদ্দিন স্টালিন

মহাশূন্যে প্রথম বলিদান

তার দু চোখ ঝকঝকে তারার সহোদর

মহাশূন্যের বাড়িতে যাচ্ছে সে

আকাশের ভয়ার্ত দৃশ্যরা

শরীরে আগুন লাগিয়ে দিচ্ছে

মহাকাশে তার সাথে কি দেখা হবে দেবদূতদের

জিউস কি তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেবেন

আর সে লেজ দুলিয়ে জানাবে কৃতজ্ঞতা

ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে অন্ধকার

অগ্নিভূক কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে আসে চোখ

মনে পড়ে মনিবের আদুরে ডাকে―আহ্লাদে আটখানা হবার কথা

নভোযানের জানালায় চারদিক থেকে ছুটে আসছে লক্ষ লক্ষ সিসার বর্শা

তার ঘুম জড়ানো চোখে অশ্রুর আনুগত্য

মনে পড়ছে মনিবকন্যার প্রেমময় আদল

চোখের আড়াল হলে-খুঁজতো

লা-ই-কা―লা-ই-কা―

মাথা উঁচু করে শুনছে প্রতিধ্বনি

লাইকা জানে না চান্দ্র কিংবা সৌরমাসের হিসাব

তবু ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দ-৩রা নভেম্বর গলে গলে পড়ছে উপগ্রহের চোয়ালে

প্রবল সৌরঝড়েও অপ্রতিহত

স্পুটনিক দুই

ভেদ করে যাচ্ছে আয়নোস্ফিয়ার

লাইকার জিজ্ঞাসু দৃষ্টি

প্রতিটি দৃশ্যকে বলছে আমি কোথায়

আমাকে কেউ ডাকছে না কেনও

তন্দ্রার ঘোরে―মহাকাশ ধমক হানছে―চুপ―বিজ্ঞানের অমর প্রাণি তুমি

ক্লান্ত অবসন্ন ধীরে ধীরে লাইকা ঘুমিয়ে পড়ে জীববিদ্যার পাতায়

আর কোনওদিন ফেরা হবে কি না প্রিয় পৃথিবীতে

জানে না সে


জুয়েল মাজহার

জেব্রাপ্রহর

আমাদের স্বল্পায়ু বিকেলগুলোর ভেতরে

জেব্রার মতন নেমে আসছে অন্ধকার

কিন্তু একটা বিকেলেরও ডোরা মেলানো যাচ্ছে না

দীর্ঘ সময় ওঁত পেতে থেকেও

শিকার জুটল না তরুণ বাঘের

খর জিভে সে এখন

নিজের বিফলতা চাটছে

অদূরে স্নানচৌকির উপর পা ফাঁক করে বসে আছে

                   বহু-ডোরাময়, অতি-বিবাহিত রাত্রি


মারুফ রায়হান

আনন্দঝরনায় সকাল-সন্ধ্যা

অজস্র ধন্যবাদ, ও আমার শস্তা ফোনসেট

হাসি তার দেখতে পাইনি বটে, শুধু

আশ্চর্য মৌলিক ধ্বনি

এক অশ্রুতপূর্ব বাজনার মতো বেজে উঠে

শ্রাবণের রক্তচক্ষু রোদ্দুরকে

অপার্থিব এক ছায়া এনে দিল

মূল্যস্ফীতির চাপে পিষ্ট মূল্যহারানো মানুষের মুখে

অকস্মাৎ যেন এক পরম প্রশান্তি

আমি কি জানতাম একটা হাসি এমন রাশিরাশি

আনন্দঝরনায় ভাসিয়ে দিতে পারে

আমার মতন মুমূর্ষুর সকাল-সন্ধ্যা, আর

তার ধ্বনিপুঞ্জে শিহরিত শহরের এক বিটোফেন

বাঁধতে বসবেন নতুন সোনাটা ?

কোন জাদুতে সংক্রমণ ঘটালো ওই হাসি যে

নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়ল তার দ্যুতি

আরোগ্যসদনের পীড়িত শয্যায়, আর

মৃতপ্রায় মহল্লার মোড়ে মোড়ে এল

অভিনব প্রাণের স্পন্দন ?

ঈষৎ হাসলো মহাকাশে অদৃশ্য তারারা

মহানগরীর সব কটি ফুলগাছে প্রস্ফুটিতারা

সুঘ্রাণ ছড়াতে ছড়াতে বলল,

কবি, তুমি আবার প্রেমে পড়েছো!

———————

জাফর সাদেক

শবনম

বিষের সুখ বলে

যে-যমুনা উন্মোচিত ছিলো তোমার

ইচ্ছে করলে সমুদ্রকে পাঁজাকোলায় এনে

ওখানে গুটিয়ে রাখতে পারতাম

এতে যে ঢেউয়ের বিলাসিতা বিঘ্নিত হতো শবনম

সবকিছুতে পূর্ণতা পেতে

মেঘেদের দেখিয়ে দিলে ত্রিবেণী সঙ্গম

এতে ঋতুকালে বৃষ্টিহীন হয়ে রুদ্ধ হলো দুয়ার

প্রবল বর্ষার রাতে তোমার ঘুম ভাঙাতে চেয়েছি শবনম

নিঃসঙ্গতা কী জেনে গেছি এখন

শরতে খুব সন্তর্পণে এসে

হেমন্তের নদীতে দেখ শীতের অসুখ

শীতের কম্পন প্রবল জড়িয়ে ধরিনি শবনম

যদি ছাড়িয়ে দাও তোমার পাহাড়ি বাগানে মালির কাজ

ওখানে বন-মহুয়ার পথ―আছে শিউলি ঝরার কাল

ওই নিঃসঙ্গ প্রহরার অস্থিরতায়

জোছনার পত্রমদে চেয়ে এখনও তুমি হারানো শবনম


মারুফুল ইসলাম

বোধ

তোর নিরানব্বইটা আমি মেনে নিতে পারি না

তবু শুধু একটার জন্য

আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারি না

আকাশে আতজবাজির কারসাজি

জমিনে তোর ফাঁকিবাজি

বাজিকর আমি নই

তবু তোর জন্যই ধরি জীবনবাজি

সঙ্গীতে উত্তাল সময়

জানি জীবন কোনো ধর্ম মানে না

অধর্মের অন্তরে তোর চাষবাস

লাঙলের ফলায় আমি ফালি ফালি হয়ে যাই

জানি না তোকে ভুলে যাওয়ায় রক্তক্ষরণ বেশি

নাকি তোকে মনে রাখায়

কিন্তু তোকে ছাড়া আমি আমাকেই ভাবতে ভুলে গেছি

বিদেশি ঢেউ এসে টেনে নিয়ে যেতে চায় তোকে

আমার কী সাধ্য বল তোকে ধরে রাখি এই বুকে

অনাত্মীয় সমুদ্রসৈকতে রেখে আসি যুগল পায়ের ছাপ

চোখের পলকে বদলে যায় বছর

কেউ কেউ কাতর শীতে

কেউ কেউ গরমে

অথচ আমি বহুদিন তাপ উত্তাপ কিছুই বুঝতে পারি না

আমার সকল বোধ গ্রাস করে আছে সেই এক বোধ

যে বোধের জন্য আমি তোকে ছাড়া বাঁচতে পারি না


শিহাব শাহরিয়ার

অস্তলগ্নে

বৃক্ষছায়া মাপো

নির্জনতার সংজ্ঞা পাবে

অন্ধকারে যাও

কবরের নিঃসীম ঘ্রাণ পাবে

সন্ধ্যা কত প্রকার

তা পাঠ্যবই গণিতে নেই

সূর্যোদয় কেবল

পুবাকাশকেই ফর্সা করে

নিশিকান্ত বাবু অস্তলগ্নে

ধুতির রং চোখে নিতে চেয়েছিলেন

অবশেষে

অনন্তলোক সবাইকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে


শাহীন রেজা

চোখ

চোখের নীচে আরও একটা চোখ

একটু ভাসা-ভাসা ঘননীল লোবানগন্ধী

সেই চোখ ঈশ্বরের

তুমি যা দেখো না

তোমার দৃষ্টি যেখানে থমকে যায়

তাঁর শুরু সেখান থেকে

জলে একটা মরাল খাবি খাচ্ছে

তার ঠিক নীচে কানকো নাড়ছে বোয়াল

তুমি মরাল দেখছো

কিন্তু বোয়াল ঢেকে আছে ধুসরে

ঈশ্বর আছেন বলেই তীব্রতর এই

দেখা না-দেখা

চোখের আড়ালে আরেকটি চোখের

নিঃসঙ্কোচ বেড়ে ওঠা ।


গোপাল দাশ

অহংকার

পৃথিবীর সব রঙ হয় অন্ধকার

পাপ আর অহংকার সব একাকার।

সাড়ে তিন হাত মাটির নিকষ গহ্ববর 

পাপাচারী মানুষ তবু আজ নির্বিকার।

তোমার শরীর আজ দেহ নয় মাটি

উড়েছে যেখানে আজ, মেঠো ঘাসফড়িং।

গলিত দেহ লক্ষীন্দর বেহুলার সাথে

ভেলায় ভেসে বেড়ায় যমের দুয়ারে। 

সন্ধ্যার আকাশ আজ কফিন দেখায়

তবুও মানুষের মন পাপাচারী হয়।

কালো কাক যম হয়ে ঘুরে বেড়ায়

স্বপ্ন পড়ে থাকে হলুদ সরিষার ক্ষেতে।

অসংখ্য পোকা আজ তবু কিলবিল করে

ভাগাড়ের গরুর দেহে ও মানুষের মনে।

লক্ষীন্দর দেহ পায় যম রাজের বরে

মনসার দংশন কৃপা নাহি করে। 


মেঘ অদিতি

ক্ষরণ

জলের নহর কেন ভেবে দেখ সারা দিন বয়

কেন এত রং মাখে অবিরাম শোকের পাথর

কপিশ ছায়ায় মিশে নিভে যায় যাপনের মায়া

তুমি সেই দিগ্ভ্রান্ত, এসবের কিছু যে জানলে না

যে হাতে ভাসালে শব, সব সুর সব তান মুছে

সরে গিয়ে, ফিরে ফের, এখন বাজাও যত তাকে

বৃক্ষ্মগুল্মলতা মাঝে অবসাদ গাঢ়তর হয়

নিধুবন তোলপাড়, ভরে ওঠে বারুদের ঘ্রাণে

করপুটে অন্ধকার, ঝড়ে ভাঙে পাখিদের ঘর

অখণ্ড পুঁথির পাতা উড়ে তবে চলেছে কোথায়…


মতিন রায়হান

এই বসন্তে যা যা হতে পারে

ভোরের অধিবেশনে পাঠ করি রোজ পাখিকাব্য

বসন্ত মানেই পুষ্পে পুষ্পে পাখি-সম্মিলন

বসন্ত-বাতাসে তাই পাতারাও হয়ে ওঠে পাখি;

ও বসন্ত, দরোজা খোলো তো আজ, ঢুকে পড়ি

তোমার অন্দরে! খুলে ফেলো যত সব পোশাকি

বাঁধন; নন্দনকাননের অভিষেকে নাচে চোখের

বিভূতি; সভ্যতার সময়কাঁটা কিছুটা পিছিয়ে

পড়ুক; গুহাজীবন থেকে যদি শুরু করি তবে

সম্ভাব্য তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেমে যায়, যাক; আবারও

গুহামানবেরা পশুশিকারের খোঁজে পৃথিবীতে

ছড়িয়ে পড়ুক; পাথরে পাথরে অগ্নি-প্রজ্বলন;

পোড়া মাংসের গন্ধে কী মোহন নৈশভোজ!

অতঃপর জলস্রোতে ছোটে এক নদী―নাব্য!

ভোরের অধিবেশনে পাঠ করি রোজ পাখিকাব্য


সৌমনা দাশগুপ্ত

আতশকাচের বাড়ি

ঈষৎ কালচে জল, কিছুটা লালাভ স্রোত

নিচু স্রোতে পা-ডুবিয়ে বসে আছে মেঘ

যেন এক চায়ের দোকান

সে আসে। ধুলো জমা হয়। বৃষ্টিক্ষত

কেউ যেন এক টুকরো বেদনা সেলাই করে দিচ্ছে রৌদ্রবেসিনে

এসো, তুলে ধরো এই রোদ্দুর, অন্তর্বাস খুলে চিনে নাও তাকে

রোগা ও খয়েরি এই ছোটগল্প আমার। শুরু নেই, শেষ নেই

কত রাত জেগে জেগে কাটিয়েছে ঝরনা কলম

আর নীরবতা, আর সান্নাটা―পোয়াতি হয়ে উঠছে ভাতঘুম

আতশকাচের বাড়ি, সূর্য ছানতে গিয়ে নিজেই আগুন

আকাশ কোথায় থাকে! ঠিকানা কী, সাকিন, নিবাস

শ্বেত পারাবত মেঘ নেমে আসে দিন ও রাত্রির সন্ধিকালে

হননের ছলে তার নাম দিই মহাকাশ

ফুটন্ত সে-ঘিলুর কড়ায় রান্না হোক আমাদের ঘরবাড়ি

আমাদের মুঠো মুঠো ছাই ও অঙ্গার-কথা

তার গায়ে লিখে দিয়ে মৃদু বাতাসের দিকে চলে যাব

চলে যাব অতিজাগতিক সেই ঘোড়ার কেশর থেকে

                                       যেইখানে স্বেদ জমা হয়

আকাশের ফ্রেমে, সিপিয়া টোনে আঁকা দিকচক্রবালে 


ভাগ্যধন বড়ুয়া

এই মাটি আমার পরিচয়পত্র

এই মাটি পাটাতন, শক্ত

এই মাটি পলিময়, আর্দ্র

এই ভূমি বহন করে আমার শরীর

এই ভূমি অপমানে কম্পিত হলে ডুবে যাই জল তলে…

এই মাটি আমার বিছানা

এই ভূমি বানায় ঠিকানা

এই মাটি জানায় মানচিত্র মুখ

এই মাটি আমি বুকে করে খুঁজি আদিবাস নিজঘর

মাটির মানুষ মাটি খুঁজে পায় জীবন বাঁচাতে

মাথা ঠেকে নিই মাটির মায়ায় নিয়েছি যেখানে ঠাঁই

এই মাটি আমার পিতার কায়া এই মাটিতে চাষবাস

এই মাটি আমার পরিচয়পত্র যতদিন আছে শ্বাস…

এই মাটি মন বুঝে গান বুঝে, মিশে থাকে কোষে কোষে

এই মাটি যদি পর হয়ে যায় পরিযায়ী হবো পরদেশে…

এই মাটি ছেড়ে যতদূরে যাই তত বাড়ে মনোটান

এই মাটিতেই একদিন বিলীন হবে জমা স্মৃতি অভিমান


সৈকত হাবিব

ভাষাশহীদেরা বলছেন

এই সুনীল পৃথিবী তো আমাদেরও ছিল

এই বাংলা, এই সবুজ ঘাস লতা প্রান্তর

আমাদের হৃদয়েও প্রেম ছিল

ছিল মায়ের সুকোমল স্নেহ

কখনও ভেবেছি ন্যায্য দাবিতেও দিতে হবে রক্ত ও জীবন ?

তবু তো দিয়েছি―

আর তোমরা জেগে উঠেছিলে

আরও কত রক্ত, জীবন, স্বপ্নের শস্যে

আজ এই বিশ্বভূগোলে

              পেয়েছ স্বাধীন স্বদেশ

এই রক্ত ও আগুনের দেশ

এই মৃত্তিকাপললের দেশ

এই প্রবাহিত নদীর দেশ

আমরা কি কেবল হারতে ও হারাতে এসেছি

জন্মে-জন্মান্তরে দাসচিহ্ন বয়ে বয়ে

আমরা কি চাইনি মুক্তি

আত্মার হৃদয়ের শরীরের ?

তাই বারবার, বারবার মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়েছি।

তবু তোমাদের কেন এত ক্ষমাহীন বিস্মৃতি ?

আমরা কি চেয়েছি পূজা, ফুল, নগ্নপদ-হাঁটা

এই সব নিশ্চয়ই ভালো লাগে

ভালো লাগে প্রজন্মে প্রজন্মে

                  এই ক্রম সঞ্চরণ…

মনে রেখো, চাইছি তোমার হৃদয়ের তলদেশ

যেখানে ফুলের মতো প্রস্ফুটিত মা-ভাষা

চেয়েছি আমাদের অশ্রুবিন্দু হোক বাংলার বর্ণমালা

আমাদের রক্তস্রোত হোক অবিনাশী বাক্যরাশি

তোমার হৃদয়ে ফোটাও মাতৃভাষাপুষ্প

পৃথিবীতে বয়ে নিয়ে যাও নিজের বাংলাহৃদয়

কিন্তু আজও কি গেল তোমাদের দ্বিধা, শঙ্কা, ভয়

চাই তোমাদের ভাষাচেতনা হোক সুদৃঢ় ও অক্ষয়


সুমিতা মুখোপাধ্যায়

দুর্ভিক্ষের গণতন্ত্র

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো

আমার ভেতরে কোথায় নেমেছে ধস,

কোথায় নেমেছে ঘোর-কালো!

দেখো আমার ভেতরে এখন প্রবল গ্রীষ্মকাল

খরা আর খাদ্যের অভাব; ভালো করে চেয়ে দেখো

আমার ভেতরে সমস্ত কেমন তন্দ্রাচ্ছন্ন, ভগ্ন ও ব্যথিত

ঠিক যে আঁধার তাও নয়

মনে হয় মধ্যাহ্নের অকালসন্ধ্যা 

অস্তমিত সকল আলোর উৎস;

ভালো আছি বলি কিন্তু ভেতরে যে লেগেছে হতাশা

লেগেছে কোথাও জং আর এই মরচে-পড়া লোহার নিঃশ্বাস

গোলাপ ফুটতে গিয়ে তাই দেখ হয়েছে ক্রন্দন,

হয়েছে কুয়াশা! 

আমি অনন্তকাল বসে আছি কেন

তাও তো জানি না

চোখে মুখে উদ্বেগের কালি, থেকে থেকে ধূলিঝড়

আতঙ্কের অন্তহীন থাবা; ভেতরে ভীষণ গোলোযোগ

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো

ভেতরে কেমন কোলাহল উদ্যত মিছিল

ঘন ঘন বিক্ষুব্ধ স্লোগান, ডাক-তার-ব্যাঙ্ক ধর্মঘট

হরতাল প্লাবিত দেখ আমার ভেতরে

এই এভেনিউ, পাড়া-মহল্লা,

হঠাৎ থমকে আছে ব্যস্ত পথচারী

যেন কারফিউ তাড়িত 

আমার ভেতরে এই ভাঙাচোরা, দ্বন্দ্ব ও দুর্যোগ;

দেখো অনাহারপীড়িত শিশু 

দেখো দলে দলে দুর্ভিক্ষের মুখ

ভালো আছি বলি কিন্তু ভালো নেই চেয়ে দেখো

ভেতরে কী অস্থির উন্মাদ,

ভেতরে কী নগ্ন ছেঁড়া ফাড়া!

অসুস্থ আকাশ রক্তাক্ত মেঘ

রক্তাভ রাজপথ, হাস্যের গণতন্ত্র।


ওবায়েদ আকাশ

বলতে চেয়েছি

কতবার তোমাকে বলতে চেয়েছি

আছো যে―তার সব কিছুই গূঢ়ার্থে মালিন্যে আবৃত

একবার বলেই ফেলেছি―এ যাত্রায় চলো

অনাহূত অন্ধকার বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি সৈকতে

স্তব্ধ হবার আগেই পরস্পর হাত ধরে বুঝি

সমুদ্র থাকলেই তাতে অনিবার্য নয় বালুকাবেলা

বলতে চেয়েছি―অরণ্যের অধিকার ছেড়ে

আমার সমস্ত শরীরে হামলে পড়েছে প্রতিরোধ

পৃথিবীর ঝুলে থাকা সৌন্দর্যের দিকে তাকিয়ে আছ

আর একটি একটি ফল এসে ঢুকে পড়ছে মৃত্যুর

বাকলের ভেতর

তোমার নামে লেখা নেই পিচরাস্তা, খেজুরবাগান


তুষার কবির

ছাতিমতলায়

ছাতিমতলায় আজ

শ্রীমতী রাধিকা নেই;

আমার চিঠিরা সব উড়ে গেছে

প্রত্ন বসন্তের হাওয়ায়!

শ্রীমতী রাধিকা

আমাকে আগে চিঠি লিখতেন।

চিঠির ভেতর তিনি গুঁজে দিতেন

ব্লাউজের ঘ্রাণ, হালকা পালক,

ভুলে যাওয়া গোধূলি গীতিকা!

ছাতিমতলার পাশ ঘেঁষে চামেলি অপেরা।

প্রত্ন বসন্তের হাওয়ায়

অপেরার নায়িকারা সব

শ্রীমতী রাধিকা হয়ে নাচে!


সেঁজুতি বড়ুয়া

অক্টোবরের পঙ্ক্তিমালা

আমরা তখন অক্টোবরের নিঃসঙ্গতায় হাঁটছি

যদিও কনসার্টের ভেতর ঢুকে গেছে সন্দিগ্ধ রাত

কেউ হাত-পা ছড়িয়ে মাটিতে বসতে বলছে

কেউ ইশারা করছে―বেগুনি আলোর নিচে ডুবে যেতে

আমরা হাঁটছি যতটুকু পাশাপাশি হাঁটা যায়

লুপ্ত আকাক্সক্ষার নিচে আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে যাচ্ছি

আমাদের অমূলক ভয়―যদি থেমে যায় সূর্যাস্তের গান

ফিরে যেতে হবে, পাখিরা যেমন নির্বাসনে নীড়ে ফেরে

আড়ষ্টতা ভেঙে আবারও নিজেদের অসন্তোষ লুকিয়ে রাখি

ঠোঁটের নরম উপত্যকার খাঁজে গাজার বসন্তকাল খুঁজি

আমাদের চুম্বনের এপাশে দ্রুত ফুরিয়ে আসে গানের উল্লাস

ভাবনায় জড়ো হতে থাকে জেরুজালেমের অবধারিত ক্ষত

হঠাৎই তোমার অপাপবিদ্ধ চোখে জ্বলে ওঠে স্ফুলিঙ্গের ছায়া

কে জানত―একদল স্বাধীনতাকামী গোপনে সমুদ্র পেরিয়ে

আমাদের দুই পৃথিবীকে ভালোবাসার স্বীকারোক্তিতে আলাদা করবে

আমার ফিলিস্তিনি পরিচয়টুকুও ঢেকে দেবে জলপাই পাতার প্রগলভতায়!    


স্নিগ্ধা বাউল

প্রতিচ্ছবি

মাটি নিয়ে যায় আকাশ অবধি মৃত্যুর মতো করে

মৃত্যু জানে না মাটির কবর আকাশেই যায় উড়ে

স্পষ্ট হয়ে এলে অন্ধকার দেখি যেন অদেখারে

যে নাই এমন তারেই ডাকছি কেন এই অভিসারে

তাতানো লোহার গরম নামে সোনার শরীরজুড়ে

ছাপার টাকায় একটা শহর দালান ঘরেই মরে

মুঠোভর্তি জোনাক পুষি কানের লতায় ফুল

হাতের নখে আলতা দিলাম আয়না ভর্তি ভুল।


মাসুদ পথিক

ভুবনডাঙার মেমোরি

যদি চলতে চলতে খুঁজে না-পাও ঠিকানার শেষ বিন্দু

যদি দেখা যায় ছাইয়ের ভেতর ভুবনডাঙার আয়না

থামো, ধীরে ধীরে দেখো, লেখা আছে সমূহ সব

ইতিপূর্বে যারা এসেছিল তাদের পায়ের ছাপ

গুনে গুনে পায়ের ছাপ, তুমি, ঢুকে পড়ো আয়নার গুহায়

প্রতিবিম্ব হয়ে আছে সব স্মৃতি, ডাইলেক, রতিদানবের ছায়ামূর্তিগুলি

খোঁজো ক্ষুধার্তের মুখ, আউশ আমন, চাষের বিস্মৃত গ্লানি

খুঁজে খুঁজে চোখ ক্ষয়ে যায় ক্ষয়ে যায় তার নুন

আরও স্থিরতর আর নিবিড় তাকালে, দেখা যায় ভাতের হারিকিরি;

শোষকের অতীত আয়নার গোপন গৃহে

শোষিতের রচিত বঞ্চনাসমূহ―জারুল পাতায় পাতায়

বাতাসের খাতায় নিভৃতে লিপিবদ্ধ হাহাকার

যদি পতনের পর, স্বর্গের বেহেশতের কলা নিয়ে হাজির হয় গন্তব্য

যদি আশ্রম বালিকাদের সঙ্গে খেলো তুমি আয়না হয়ে

ছায়া-মুখর দিনলিপি

তবে পাবেই ঠিকানার ধূপগন্ধ পরিসর―পাঠে পাঠে,

এই মাঠে―অবর্ণিত ভুবনডাঙার মেমোরি।


হাসনাত শোয়েব

ইসরাফিলের শিঙ্গা

দূরে দাঁড়িয়েই সব দেখি। পাখিদের পায়ের বিস্তার, হলুদ বংশোদ্ভূত একটি আর্তচিৎকার আর নীল নদের অবিস্মরণ। জানি এসবে তোমার কিছুই আসে যায় না। যেমন আসে যায় না ফিসফিসের মধ্যে উড়তে থাকা শ্বেত ভাল্লুকের। তারা শুধু আপন মনে উড়েছিল, আর হুটহাট গেয়ে উঠেছিল ‘ফেয়ার ওয়েল এঞ্জেলিনা’র শেষ অন্তরাটুকু। যাওয়ার সময় তুমিও বলে গিয়েছিল, ‘এসব গানেই শেষ পর্যন্ত তোমার মুক্তি।’ মুক্তির লোভে আমি সেই থেকে গান গেয়ে যাচ্ছি। গীতবিতান, মালকোষ, রক অ্যান্ড রোল পেরিয়ে এখন এসেছি ডেথ মেটালে। ওই দেখো, শিঙ্গা হাতে দাঁড়িয়ে আছে খোদ ইসরাফিলও।


অচিন্ত্য চয়ন

নিদ্রাহীন চোখ মুখস্থ করে চুলের ঢেউ

দূরে যাও, দূরের আকাশে তুলে রাখো কালো টিপ!

শূন্য হও, তবে শূন্য কপালে তোমাকে মানায় না,

জেগে ওঠে ভীষণ মায়া―

                             জেগে থাকা মায়ায় দূরত্ব বাড়ে;

বালিকার অভিমানে গণিত ভুলে যাওয়ার অভ্যাস

করছি নীরবে, নীরবে মেনে নেওয়া ‘নীরব’ নয়।

নীরবতা অন্তিম মায়ার চাদর; তবু সহজ করে

বিকেল মাড়িয়ে যাও তোমার গন্তব্যে―

                                                 নিজের সিদ্ধান্তে!

বেদনা হও, ভুল করে ভুলে যেও না―

দুঃখ হও, অবহেলার নিশানে চোখ রেখো না!

ভিড় পেরিয়ে প্রতিদিন ‘ঠিকানা’য় গন্তব্যে যাও

তোমার গন্তব্য বালকের নিঃশ্বাস, গন্তব্যহীন

ঠিকানার অপেক্ষায় আলোরা ঘুমিয়ে যায়!

গণিতে কাঁচা হলেও মায়ায় পাকা, বেদনার আড়ৎ

ছুটি হয় ঘুমের―নিদ্রাহীন চোখ মুখস্থ করে চুলের ঢেউ।

সচিত্রকরণ : নাজিব তারেক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button