আর্কাইভগল্প

গল্প : মোপাসাঁর ইর্মা অথবা… : মোজাম্মেল হক নিয়োগী

তখন শান্তি কমিটি গঠিত হয়নি।

তবে বিভিন্ন মহল থেকে আলোচনা হচ্ছে যে ইউনিয়নে ও মহল্লায় শান্তি কমিটি গঠন করে বিদ্রোহীদের শায়েস্তা করতে হবে। ঢাকা ছাড়া যুদ্ধের উত্তাপ মফস্সল শহরগুলোতে তেমন বোঝা যায় না। তবে সারা দেশের মানুষ দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে। লক্ষ লক্ষ ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিচ্ছে। শোনা যাচ্ছে ভারতে মুক্তিফৌজ গঠিত হয়েছে এবং হাজার হাজার তরুণ-তরুণী মুক্তিফৌজে যোগ দিচ্ছে। ১৯৭১ সালের এপ্রিলে পরিস্থিতি অনেকটা এ-রকমই ছিল। 

            যোগাযোগ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত থাকায় মফস্সলে আগের মতো পত্রপত্রিকা আসে না। খবরাখবরের জন্য বিবিসি, আকাশবাণী আর মাঝে মাঝে ক্ষীণ আওয়াজে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর পাওয়া যায়। 

            এক সন্ধ্যায় হেদায়েতুল্লাহ আসকান-পাজামা ও জিন্নাহ ক্যাপ পরে, চোখে সুরমা লাগায়, গোঁফ চামড়ার সঙ্গে মিলিয়ে ছেঁটে, সম্রাট শাহজাহানের দাড়ির ছাঁট দিয়ে, গায়ে কড়া সুগন্ধি আতর লাগিয়ে পাকসেনাদের ক্যাম্পে গিয়ে দেখা করে ক্যাপ্টেন রাশেদের সঙ্গে। উর্দু ভাষা ভালোভাবে রপ্ত থাকায় রাশেদের সঙ্গে জমিয়ে কথা বলার সুযোগটা কাজে লাগায় চেহারা-সুরতে মওলানা, প্রকৃতার্থে ধূর্ত ভণ্ড হেদায়েতুল্লাহ।

            সারা দেশের কোনাকানা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের বিদ্রোহ হঠাৎ হঠাৎ চিরিক দিয়ে ওঠে; কোথাও কোথাও ব্রিজ বা রাস্তাঘাট ভেঙে ফেলার খবর এলে অভয়নগরের ক্যাম্পে পাকসেনারা শ্লেষের সঙ্গে হাসে। তারা ভাবে দু-একটা থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল, পাখি মারার বন্দুক আর লাঠিসোটা দিয়ে খুচরা হামলা করে যুদ্ধ করবে মূর্খ বাঙাল! ভেতো আর ভীতু বাঙালি করবে যুদ্ধ ?

            মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের কোনাকানায় ঠুসঠাস বন্ধ করার জন্য হানাদার বাহিনী উপর্যুপরি গণহত্যা, গ্রাম ও শহরের বিভিন্ন এলাকায় বাড়িঘরে আগুন লাগিয়ে এবং লুটপাট করে সারা দেশে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। আতঙ্ক ছড়ানো তাদের যুদ্ধকৌশল। ভীতু বাঙালিদের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়লে কোনওভাবেই স্বাধীনতার কথা ভাবতে পারবে না; এই ছিল তাদের বিশ^াস।

            কিছু দিন ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে তারপর নির্বিঘ্নে নাকে সর্ষে তেল মেখে ঘুমায়। ভাবে, বাঙালিদের কত ক্ষমতা দেখা যাবে!

            পাকসেনাদের প্রধান টার্গেট হিন্দু সম্প্রদায়। এদেরকে শায়েস্তা করতে পারলেই নিশ্চিন্তে থাকা যায়। আর মুসলমান মানেই ইসলামের খেদমতগার। তারা পাকিস্তান ভাঙতে যাবে কেন ? হিন্দুদের উসকানি না থাকলে, ভারতের দালালি না করলে কি আর মুসলমানেরা এত সাহস পেত! নষ্টের গোড়া তো ওরাই। ওদেরকে শায়েস্তা করতে যেন পাকসেনারা মরিয়া। 

            ‘ওহ্ পুওর শেখ। ভারতের দালালি করো! এখন বুঝো লায়ালপুর কারাগারে একশ ডিগ্রি তাপমাত্রায় সেদ্ধ হতে কেমন লাগে!’ মনে মনে বলে ক্যাপ্টেন রাশেদ।

            কখনও ভাবান্তরে পড়ে ক্যাপ্টেন রাশেদ, ভারতে পালিয়ে যাওয়া তরুণরা যদি ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাহলে মুশকিলের অন্ত থাকবে না। ভরসা যে, আমেরিকা আর চীন যেখানে তাদের পক্ষে আছে পূর্ব পাকিস্তানে পোড়ামাটির নীতি কায়েম করতে ওয়ান-টুর ব্যাপার―পায়ে পিষে শেষ করে দিতে হবে।  

            অস্থায়ী ক্যাম্পে পায়চারি করতে করতে ক্যাপ্টেন রাশেদ আচ্ছন্ন হয়ে নানা বিষয় নিয়ে ভাবতে ছিল; তখনই লম্বা সালামের শব্দ পেয়ে পাশে ফিরে দেখে বেঁটে গাট্টগোট্টা দেহের এক লোক। বিস্ময়ের সঙ্গে তার দিকে তাকালে হেদায়েতুল্লাহ নিজেকে পাকিস্তান ও ইসলামের একজন খেদমতগার হিসেবে পরিচয় দিলে ক্যাপ্টেন রাশেদ মোলাকাত করে গভীর বক্ষবন্ধনে আবদ্ধ করে দুজনের বুকের ভালোবাসার উষ্ণতা বিনিময় করে।  

            হেদায়েতুল্লাহর পেছনে চারজন ছিল যারা একটি ভ্যানে একশ মুরগি, এক ডজন তাগড়া খাসি আর দুটি ষাঁড় বাছুর নিয়ে নত শিরে দাঁড়িয়ে আছে। তারা হতদরিদ্র যুবক শ্রমিক। ওদের পরনে জরাজীর্ণ ময়লা লুঙ্গি, ছেঁড়া শার্ট, মাথায় টুপি। ক্যাপ্টেন রাশেদ মুচকি হাসে। মুচকি হাসি মানে এসব দেখে খুশি হয়েছে এবং ক্যাম্পের খাদ্যরসদ হিসেবে গ্রহণ করার অনুমতি দিয়েছে। শ্রমিকরা বাবুর্চিখানার পাশে মুরগি ছাগল ষাঁড় রেখে বিদায় হয়। এত রসদ দেখে ক্যাপ্টেন রাশেদের মুখমণ্ডল আনন্দালোয় উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। সৌজন্যের খাতিরে হয়তো বলে, এত সবের কী দরকার ছিল! বলে রাখা ভালো যে তাদের কথাবার্তা হচ্ছিল উর্দু ভাষায়।   

            হেদায়েতুল্লাহর মুখেও প্রসন্ন হাসি, বলে, স্যার, আপনাদের খাওয়া-দাওয়ার জন্য সামান্য উপহার। আপনারা পাকিস্তান রক্ষা করার জন্য যুদ্ধের ময়দানে আসছেন, আমিও পাকিস্তান ভালোবাসি, আপনাদেরকে সামান্য খেদমত করার সুযোগ দিলে কৃতজ্ঞ থাকব। আমাদের উভয়ের লক্ষ্যই তো এক : প্রিয় পাকিস্তানের অখণ্ডতা। ইসলাম রক্ষা করা। ইসলামের বিজয় সুনিশ্চিত। আল্লাহু আকবর। পাকিস্তান জিন্দাবাদ।

            ক্যাপ্টেন রাশেদ প্রসন্ন হয়। হাত ধরে টানতে টানতে নিজের কামরায় গিয়ে ঢোকে। দুটি আরামদায়ক চেয়ারে মুখোমুখি বসে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তর কথাবার্তা বলে। কিছুক্ষণ পর কাবাব রুটি আর ভ্যাট সিক্সটি নাইনের বোতল নিয়ে জনৈক সিপাই ঢোকে ক্যাপ্টেন রাশেদের রুমে। খেতে খেতে হেদায়েতুল্লাহ পকেট থেকে একটি তালিকা বের করে দিয়ে বলে, এই সব হিন্দু আর আওয়ামী লীগারকে শায়েস্তা করতে হবে স্যার। এরাই পাকিস্তানের ভয়ঙ্কর শত্রু। শত্রু নিধন খুব জরুরি। শত্রুকে কখনই বাঁচিয়ে রাখতে নেই।        

            হিন্দুরা হলো গনিমতের মাল। হিন্দু নারীদের ধরে আনলে পাপ হবে না। আপনাদের জওয়ানদের জন্য সুন্দরীদের ধরে এনে ক্যাম্পে রাখতে হবে। বাড়িঘর পোড়াতে হবে। মূল্যবান দৌলত সরিয়ে ফেলতে হবে। দেরি করলে ওরা ভারতে পাচার করে দিতে পারে। অপারেশন দ্রুত শুরু করতে হবে। 

            দুজনই ঐকমত্যে পৌঁছায়। 

            পরের সপ্তাহে শহরে দাউ দাউ করে আগুনের লেলিহান শিখা সাপের জিহ্বার মতো লিকলিক করে ভেসে ওঠে। ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় মফস্সলের ছোট্ট শহর। মানুষের আর্তনাদ বাতাসের সঙ্গে মিশে যায়। একুশ জন তরুণীকে ধরে নিয়ে আসা হয় ক্যাম্পের অন্ধকার কক্ষে। তাদের বুকফাটা চিৎকার বাতাসে তরঙ্গ তুলে মিলিয়ে যায়। চৌদ্দজন যুবককে হত্যা করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়। এক যুবক লুটের সময় প্রতিবাদ করায় তার মাথাটা কেটে রাস্তায় ফেলে দিয়ে কেবল ধরটা একটি বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখে যাতে প্রতিবাদীরা বুঝতে পারে বিদ্রোহ মানেই মৃত্যু। মৃত্যু মানেই মুণ্ডুহীন পথের ধারে পড়ে থাকা কিংবা খুঁটি বা গাছের ডালে ঝুলে থাকা। মা-বোনকে চিরতরে হারানো। পাকিস্তানি আর্মি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তার নমুনা হিসেবে তাকে এভাবে রাখা হয়। 

            বলতে গেলে হেদায়েতুল্লাহর বদান্যতায় এক প্লাটুন সৈনিকের ছোট্ট ক্যাম্পের চিত্র বদলে যায়। শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে, জনগণ নির্বাক-বিমূঢ়। পরিস্থিতি শুধু শান্ত নয়, স্তব্ধতার পাথরে চাপা গোটা শহর।

            যুদ্ধ কই ? সব পালিয়েছে ইঁদুরের গর্তে। খাও-দাও, ঘুমাও আর ফুূর্তি করো―ক্যাপ্টেন রাশেদের অলিখিত হুকুম।

            ক্যাম্পের হানাদাররা আরাম আয়েশ আর ফুর্তি করে দিন কাটাতে শুরু করে।

            হরেন্দ্রকিশোরের বাড়িটি দখল করার পর ধূর্ত হেদায়েতুল্লাহ নিজের অবস্থানকে আরও পাকাপোক্ত রাখার জন্য এবং ক্যাপ্টেনকে হাতে রাখার জন্য এক দিন লুট করা স্বর্ণালঙ্কার থেকে পঞ্চাশ ভরি স্বর্ণালঙ্কার উপহার দেয়। দামি উপহার খোশ মেজাজেই গ্রহণ করে ক্যাপ্টেন। সপ্তাহান্তে মুরগি, খাসি, কচি ষাঁড় বাছুর, চিনি, চা, আটা, ময়দা ইত্যাদি যাবতীয় দরকারি রসদ সে রীতিমতো সরবরাহ করে। প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় এসে আড্ডা দেয় আর অনেক রাতে বাসায় ফেরে মদের নেশায় টলতে টলতে। 

            একদিন ক্যাপ্টেন জানতে চায়, ‘বিবি কত জন ?’

            ‘চার জন, স্যার। আল্লাহ পাকের ইচ্ছায় হলো আর কি।’ 

            ‘বাহ। জোয়ান বটে।’

            ‘বাচ্চাকাচ্চা ?’   

            ‘দ্বিতীয় স্ত্রীর তিনজন। তৃতীয় স্ত্রীর দুই জন। প্রথম ও চতুর্থ স্ত্রীর সন্তান নেই।’

            ‘বেশ। বেশ।’

            ‘প্রথম স্ত্রী বন্ধ্যা।’

            ‘বেশ। বেশ।’

            ‘ক্যাম্পের মেয়েরা কি আপনার দিলের বাসনা পূরণ করতে পারে স্যার ? আপনি খুশি তো ?’

            ক্যাপ্টেন হাসে, কোনও জবাব দেয়নি।

            মদের গ্লাস খালি করে মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘সেট চেঞ্জ করতে হবে।’

            ‘হবে স্যার। আপনার হুকুম পেলেই আপনার খেদমতগার বান্দা সেট চেঞ্জ করে দেবে। কয়জন লাগবে শুধু বলবেন।’

            হেদায়েতুল্লাহ ক্যাপ্টেনের মেজাজ বোঝার চেষ্টা করে। আর মনে মনে বলে, ‘হারামজাদারা কখন কী করে ঠিক নাই। শুয়োরের বাচ্চারা আবার বিবির দিকে ফিরে তাকায় কিনা কে জানে। যখন তখন গুলিও করতে পারে। যা হোক, হারামির বাচ্চাদের মেজাজ ঠিক রাখতে হবে। নইলে ইসলামি দেশ বিনাশ হয়ে যাবে।’

            কিছু দিনের মধ্যে হেদায়েতুল্লাহ শুধু ক্যাপ্টেন নয়, ক্যাম্পের সব সিপাইয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তাকে মনে হয় না যে সে ক্যাম্পের বাইরের কোনও লোক। আর এই সুযোগে সিপাই খলিল, দুর্দান্ত চেহারা, রাঙ্গা টকটকে গায়ের রং, সুন্দি বেতের মতো টাইট বডি। ছয় ফুটের কিছু বেশি লম্বা। এমন জোয়ান বাঙালের দেশে কইত্থে পাবে ? তার সঙ্গে হেদায়েতুল্লাহর সবচেয়ে বেশি বন্ধুত্ব হয়। বন্ধুত্বের খাতিরে তার বাসাতেও বেড়াতে যায় মাঝে মাঝে। পারিবারিক রান্না খেয়ে চার বিবিকে তুমুল প্রশংসা করে। বিবিরাও খুশি। সবচেয়ে বেশি খুশি চব্বিশ বছর বয়সী অপূর্ব সুন্দরী ছোট বিবি আছিয়া খাতুন। আছিয়া খাতুন কিছু কিছু উর্দু জানে বলে খলিলের সঙ্গে দ্রুত সখ্য গড়ে ওঠে এবং এক পর্যায়ে পেয়ারা পাকিস্তানের ভাইকে ধর্মভাই বানায় আছিয়া খাতুন। 

            হেদায়েতুল্লাহ যখন সন্ধ্যার সময় ক্যাম্পে আড্ডা দিতে আসে তখন খলিল হেদায়েতুল্লাহর বাড়িতে গিয়ে মজমা বসায়। খলিলের চোখ পড়ে আছিয়া খাতুনের দিকে। ধর্মভাই বলে হেদায়েতুল্লাহ খলিলের যাতায়াতে কিছু মনে করে না। নিরাপদ লোকই মনে করে। ধর্মভাই বোনের সম্পর্কটা আরও আন্তরঙ্গ হয় এবং এক সময় বিছানায় গড়ায়।

            মাসখানেক পর আছিয়া খাতুন ও খলিলের সম্পর্কের বিষয়টি হেদায়েতুল্লাহর কানে গেলে সে প্রথমে উদ্বিগ্ন ও বিচলিত হলেও পরে নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য চুপ মেরে যায়। মনে হয় সে অন্ধ, কিছুই দেখেনি। সে বধির, কোনও কিছুই শোনেনি। ধর্ম ভাই-বোনের মধ্যে খারাপ কিছু ঘটতে পারে তা সে বিশ^াস করে না। এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ক্ষতি করতে পারে না। 

মাস দু-একের মধ্যেই দেশের আনাচে-কানাচে গেরিলা আক্রমণ শুরু যায়। দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে ওয়ারলেসে ক্যাপ্টেনের কাছে ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর খবর আসতে শুরু করে। রেডিও ট্রানজিস্টারেও দেশের অভ্যন্তরে গেরিলাদের হামলা, পাকসেনাদের হতাহতের খবর প্রচার হতে শুরু হলে এই ক্যাম্পের সেনারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। কিন্তু যুদ্ধের ময়দানে দুশ্চিন্তার কোনও স্থান নেই। হয় মরো, না-হয় মারো। এই দুইয়ের মাঝখানে কোনও স্থান নেই। আবেগ মায়াদয়া ভালোবাসা অসুখ-বিসুখ সুখ-দুঃখের কোনও স্থান নেই। ক্যাপ্টেন রাশেদ হুকুম দেয় শহর ছেড়ে গ্রামেও অপারেশন চালিয়ে প্রতি সপ্তাহে কমপক্ষে দুটি গ্রামে আগুন লাগাতে হবে। যুবকদের পেলে নির্বিচারে হত্যা। যত নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয় তত বীরত্বের গাথা। ইয়াহিয়া খানের পোড়া মাটির ঘোষণা আগেই দেওয়া ছিল―পূর্ব পাকিস্তানে মানুষ চাই না, কেবল মাটি চাই। ক্যাপ্টেন রাশেদ সে দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে শুরু করে। 

            ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নির্দেশে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য শহরে ও গ্রামে শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির সদস্যরা মুক্তিফৌজের সন্ধান দিলে, কাউকে সন্দেহ করলে ধরে এনে প্রথমে নির্যাতন এবং পরে হত্যা করে নদীতে বা পথে ঘাটে ফেলে রাখা হয়। সারা দেশে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। এই ক্যাম্পের আরাম-আয়েশ আর ফুর্তির দিনগুলো ফিকে হয়ে আসে। এত দিন দেশের সাধারণ মানুষের মধ্যে যে আতঙ্ক বিরাজ করেছিল সেই আতঙ্ক এখন মফস্সলের এই হানাদারদের ক্যাম্পেও ছড়িয়ে পড়ে। কখন কোন দিক থেকে আক্রমণ হয় বলার উপায় নেই। প্রতিটি ক্যাম্পে বাংকার তৈরি করা হয়েছে। রাতে সৈনিকরা বাংকারে ঘুমায়। প্রতিটি ক্যাম্পে কড়া পাহারা বসানো হয়েছে এবং বালির বস্তা দিয়ে ক্যাম্পের চারপাশে প্রাচীর নির্মাণ করে নিজেদের সুরক্ষিত করা হয়েছে।

            শহরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হলো হেদায়েতুল্লাহ।  

            ক্যাম্পের অপহৃত মেয়েদের মধ্যে তিনজন আত্মহত্যা করেছে। আত্মহত্যা করেছে পরনের শাড়ি পেঁচিয়ে ঘরের ধর্নার সঙ্গে ফাঁসি লাগিয়ে। পাঁচজন অকথ্য ও নৃশংস নির্যাতনের ফলে মারা গেছে। অনাহার, অর্ধাহার, চিকিৎসার অভাব, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের ফলে সব মেয়েই রোগা হয়ে গেছে। 

            এই সেটটা পরিবর্তন করতে হবে, ভাবে ক্যাপ্টেন রাশেদ। মেয়েরা তার কাছে সেট।  

            বন্দি ও নির্যাতিত মেয়েরা যাতে শরীরের পোশাক পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করতে না পারে সেজন্য তাদেরকে চব্বিশ ঘণ্টা বস্ত্রহীন রাখা হয়।

            সৈনিকরা আগে ক্যাম্পের বাইরে অবাধে ঘোরাফেরা করতে বের হলেও এখন সতর্কতার সঙ্গে চলাফেরা করে। কোন সময় কোন দিক থেকে গেরিলা বিচ্ছু বাহিনী আক্রমণ করে বলা তো যায় না।

            এক দিন খলিল অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে জেলা শহরে পাক আর্মিদের অস্থায়ী হাসপাতালে পাঠানো হয় চিকিৎসার জন্য। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে জানা গেল সে সিফিলিসে আক্রান্ত। ক্যাপ্টেন রাশেদকে জানানো হলো সিপাই খলিলের অসুস্থতার কথা। ক্যাপ্টেন রাশেদ দুশ্চিন্তায় পড়ে যায়। তাহলে কি ক্যাম্পের মেয়েদের কারও শরীরে সিফিলিসের জার্ম আছে ? ভাবে ক্যাপ্টেন রাশেদ। সেটটা বদলাতে হবে। সবগুলোকে নিকেশ করে দিতে হবে।

            পরদিন ক্যাপ্টেন রাশেদকে পাকসেনাদের অস্থায়ী ক্যাম্পের ডাক্তার ইয়াদ খান জানাল যে, খলিল ক্যাম্পের বন্দি মেয়েদের ছাড়াও হেদায়েতুল্লাহর চতুর্থ বিবির সঙ্গে মেলামেশা করেছে। এখন কার শরীর থেকে জার্ম ছড়িয়েছে বলা মুশকিল। বিষয়টি খতিয়ে দেখা দরকার।

            গভীর রাত। আকাশ কালো মেঘে ছেয়ে আছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। ঝড়ো ও ঠান্ডা বাতাস বইছে। চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। ক্যাপ্টেন বিছানায় শুয়ে ভাবছে এই ভয়াবহ রোগে আর কে কে আক্রান্ত হয়েছে কে জানে। দুর্ভাবনায় তার মাথা ক্রমে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে। রুম থেকে বাইরে এসে দাঁড়ায়। গাঢ় রহস্যময় অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ। সে ভাবছে, তবে কি ক্যাম্পের সবাই সিফিলিসে আক্রান্ত ? হঠাৎ ক্রোধে সে যেন অন্ধ হয়ে যায়। তার মাথা কাজ করছে না। মাথাটাকে মনে হয় একটা জড়পিণ্ড। রুমের ভেতরে ঢুকে একটা ভ্যাট সিক্সটি নাইন বোতলের ছিপি খুলে ঢক ঢক করে মুখের ভেতরে ঢেলে দেয়। তারপর একজন সিপাইকে ডেকে হুকুম দেয় ক্যাম্পের মেয়েগুলোকে নিকেশ করে নদীতে ভাসিয়ে দিতে।

            ভারী বর্ষণ শুরু হয়।

            সৈনিকরা ক্যাপ্টেনের হুকুম পালন করে নির্দ্বিধায়। একদিন নির্যাতিতা রুগ্ণ, কাহিল মেয়েদের জিপে উঠিয়ে নদীর পাড়ে দাঁড় করিয়ে গুলি ক’রে লাশগুলো নদীতে ফেলে দিয়ে ওরা ফিরে আসে। তরুণীদের লাশ ভাসতে ভাসতে ভাটির দিকে যেতে থাকে।

            গভীর রাত। ভয়ানক উৎকণ্ঠায় ক্যাপ্টেন রাশেদের ঘুম আসছে না। একবার রুমের বাইরে এসে পায়চারি শুরু করে। মদের নেশাটা কাটছে না। মাথাটা ভীষণ ভারী ভারী লাগছে। হঠাৎ তার মনে পড়ে মোপাসাঁর ‘বেড নম্বর ২৯’ গল্পটির কথা। সেই গল্পের নায়িকা ইর্মা নিজের সিফিলিস রোগ আছে জেনেই ইচ্ছাকৃতভাবে প্রুশিয়ার সৈনিকদের হত্যা করার জন্য সঙ্গমে লিপ্ত হতো। সে সৈনিকদের ওপর প্রতিশোধের আগুন ছড়াত সিফিলিসের জার্ম ছড়িয়ে দিয়ে। অনেক সৈনিক সিফিলিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এখানে কি ইর্মার মতো কেউ আছে ? কীভাবে খলিলের দেহে সিফিলিস জার্ম ছড়ালো ? কে এই গুপ্তচর ? যদি এই ক্যাম্পে কারও সিফিলিস থাকত তাহলে অন্য সৈনিকরাও আক্রান্ত হতে পারত। কিন্তু অন্য কেউ তো আক্রান্ত হয়নি। আমিও আক্রান্ত হইনি। তাহলে কি হেদায়েতুল্লাহর চতুর্থ বিবিই ইর্মার ভূমিকায় নেমেছে। ব্লাডি বাঙালিকে কোনওভাবে বিশ^াস করা যায় না। যদি চতুর্থ বিবিই জার্ম ছড়ায় তাহলে সে কীভাবে আক্রান্ত হলো ? এত প্রশ্নের ফাঁদে আটকে যায় ক্যাপ্টেন কিন্তু কোনও প্রশ্নেরই উত্তর পায় না।

            ক্যাপ্টেন সিগারেট জ¦ালায়। রাত নিঃশেষের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। উপরে তাকিয়ে দেখে কালচে বরফ শীতল আকাশে সাদা বুটিকের মতো রহস্যময় তারা ফুটে আছে। কী বিচিত্র! কী রহস্যময় এই বিশ^ব্রহ্মাণ্ড! আকাশের দিকে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ক্যাপ্টেন রাশেদ ভাবে, বন্দি মেয়েদের লাশগুলো হয়তো ভেসে ভেসে অনন্তের পানে ছুটছে। অন্তহীন সীমানার দিকে ছুটছে। ওদের আত্মা কি ওই অন্তহীন আকাশের পানে ছুটে যাচ্ছে ? কোথায় স্থির হবে ওদের আত্মা ? ওদের আত্মা কি নক্ষত্র হয়ে আকাশে আলো ছড়াবে। সেই যে ছোটবেলায় মা বলত, মানুষ মরে আকাশের তারা হয়ে যায়। ওরা কি তাহলে তারা হবে ? মৃত্যুভয় কিংবা একুশটি মেয়ের জীবননাশের জন্য তো আমরাই দায়ী। আতঙ্কে তার অন্তরাত্মায় দহন শুরু হয় এবং এক সময় হু হু করে কাঁদতে শুরু করে। 

            এই কান্না বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। 

            আমি সৈনিক। যুদ্ধের মাঠে আবেগ নয়। পাথরের মতো হৃৎপিণ্ড থাকতে হবে। ইস্পাতের মতো শরীরের পেশি। আবার সে ভীষণ ক্রুদ্ধ হয় এবং ক্রোধের সংবরণ অথবা নিজের উত্তেজনা প্রশমনের জন্য রুমে ঢুকে পিস্তলটি এনে শূন্যে গুলি ছুড়ে ম্যাগাজিনটি বুলেটশূন্য করে। পাহারারত সৈনিকরা দৌড়ে আসে ক্যাপ্টেনকে দেখতে―স্যার কী হয়েছে ?

            প্লিজ লেট মি লিভ এলোন। প্লিজ। ইউ গো। উই অল আর বাস্টার্ড। ইউ গো ফ্রম হেয়ার। উই আর বাস্টার্ড। উই অল আর বাস্টার্ড। 

            পর দিন দুপুরে হেদায়েতুল্লাহকে ডেকে পাঠানো হয় ক্যাপ্টেনের রুমে।

            ক্যাপ্টেন খোশ মেজাজে হাসতে হাসতে বলে, গত রাতে রোগাসোগা মেয়েগুলোকে নিকেশ করে দিলাম। নতুন সেট দরকার।

            হেদায়েতুল্লাহও হাসতে হাসতে বলল, স্যার কোনও চিন্তা করবেন না। ওয়ান-টুর ব্যাপার। কয়জন লাগবে ?

            বিশটা কচি মেয়ে চাই। একেবারে ষোলো বছরের।

            স্যার চিন্তা করবেন না। আপনি কয়েকজন সিপাই দেবেন আমার সঙ্গে। গ্রাম থেকে নিয়ে আসব।

            এবার ক্যাপ্টেন পাতলা পিরিতের ফাঁদ পেতে হাসতে হাসতে বলল, আপনি তো আচ্ছা জোয়ান আছেন। চার বিবিতেই কি চলে ? নাকি আরও খেপটেপ মারেন ?

            ক্যাপ্টেন রাশেদের পাতলা পিরিতের ফাঁদে পা দেয় হেদায়েতুল্লাহ। হাসতে হাসতে বলে, স্যার তা কি আর চলে! মাঝে মাঝে বিভিন্ন জায়গায় খেপ মারি। আর এখন তো আমাদের ক্ষমতার দাপটে চাইলেই হুর হুর করে চলে আসে।

            ব্রথেলেও যান না কি বন্ধু ?

            হা হা হা। স্যার লুচ্চাদের কোনও বাছবিছার আছে ? শরীর তো নারীর। রক্তমাংসের গন্ধ তো নারীর। ঠিক না ? যেখানেই থাকুক তারা… প্রাসাদে কিংবা ব্রথেলে। হা হা হা।

            হো হো হো। আপনি বড্ড বড়ো খেলুড়ে। হো হো হো।

            এই হাসির রেশ কাটতে না কাটতেই ক্যাপ্টেন রাশেদ হুঙ্কার দিয়ে ওঠে, শুয়ারের বাচ্চা। বাস্টার্ড কুত্তির বাচ্চা। কোমর থেকে পিস্তল থেকে বের করে মুহূর্তকাল দেরি না করে গুলি করে ম্যাগাজিন খালি করে।

            লুটিয়ে পড়ে হেদায়েতুল্লাহ। তার শরীর থেকে তাজা রক্ত টগবগ বের হয়ে আঙিনা রক্তাক্ত হয়ে যায়। ক্যাপ্টেন রাশেদ ক্রোধান্ধ হয়ে পড়ে এবং কিছুক্ষণ স্তিমিত থাকার পর পাশে তাকিয়ে দেখে ক্যাম্পের সব সৈনিক দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাপ্টেন রাশেদ শান্তভাবে ধীরে ধীরে বলে, ডিসপোজ দ্য ডেডবডি।  

            ক্যাপ্টেন রাশেদের দ্বিতীয় হুকুম অনুযায়ী হেতায়েতুল্লাহর চতুর্থ বিবিকে উঠিয়ে এনে ক্যাপ্টেনের সামনে রাখা হয়। ক্যাপ্টেন ক্রূর দৃষ্টিতে তাকে দেখে। ক্যাপ্টেনের চোখ থেকে আগুন ঠিকরে পড়ছে। সে দাঁতে দাঁত চেপে বলে, একাত্তরের ইর্মা। ব্লাডি বিচ। হারামি কুত্তি। তারপর মনে মনে বলে, হয়তো তুমি জেনে-বুঝে খলিলের শরীরে সিফিসিলিসের জার্ম ছড়িয়েছো। অথবা তুমি জানোই না যে ভয়ঙ্কর রোগের জার্ম তুমি বহন করছো। কিন্তু তুমি জেনে ছড়াও অথবা না জেনে ছড়াও, আমি সৈনিক। আমার হৃৎপিণ্ড লোহার তৈরি। সন্দেহভাজন যে-কাউকে হত্যা করা আমার ফরজ কাজ। সন্দেহভাজন গুপ্তচর হিসেবে তোমাকে হত্যা করতে হবে। করতেই হবে। কোমর থেকে পিস্তলটি বের করে পরপর তিনটি গুলি করলে হেদায়েতুল্লাহর চতুর্থ বিবি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তার শরীর থেকে তপ্ত টকটকে লাল রক্তের স্রোতে আঙিনা ভেসে যায়।

            ক্যাপ্টেনের পাশে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকজন সৈনিক। ক্যাপ্টেন আগের মতোই শান্তভাবে বলে, ডিসপোজ দ্য ডেডবডি। 

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button