আর্কাইভগল্প

গল্প : যখন বেজে ওঠে : নাসরীন জাহান

আঙুল নড়ছে না, যেদিন তুমি এপ্রিলের তীব্র রৌদ্রে আমার বুক বরাবর ছুড়ে দিলে সূর্য, আমার হাত বোবা হয়ে  গেল। কণ্ঠ থেকে সুর বাষ্প হয়ে উড়ে উড়ে উড়ে গেল। ফিসফিস ফিনিক্স পাখি বলল, আমি আছি। দশতলায় উঠে ঝাঁপ দিই। কিন্তু শরীর নড়ে না।

কেউ সুন্দর স্মৃতি ফেলে চলে গেলে তাকে ভোলা কঠিন। তাকে ঘৃণা করা কঠিন, ঘৃণা ছাড়া তাকে ভুলে যাওয়া কঠিন।

দিনরাত বিপন্ন সংসারে নিশ্চল দেহমন নিয়ে অফিসে যাই, ফিরে এসে অসুস্থ তোষকে গা পেতে ময়লা সিলিং ফ্যানকে চুপ  থাকতে দেখি।

এদিকে গরমে যত ভিজে যাচ্ছি, তত পাশের ঘরে হাউকাউ, ভাই বলে, আলু আর বেগুন ভাজি আর কত ?

মা বলে, কামাই কর, পরে এইসব ক, বোন, বলে, জন্ম দিছ ক্যান ?

গুরুজি হারিয়ে যাওয়ার পরে আমার জীবনের সর্বনাশ আমাকে ছাড়ছেই না।

গির্জার পাশের ইশকুলে কী সুন্দর ছাত্রদের পিয়ানো শেখাতেন গুরুজি। আমি জানালা দিয়ে লুকিয়ে দেখতাম, আমার সমস্ত লোমকূপে অদ্ভুত শিহরণ ঘুরতে থাকত।

এরপর গুরুজি আমাকে লক্ষ্য করে নিয়ে গেলেন ক্লাসে। বিনে পয়সায় পিয়ানো শিখালেন, একদিন দেখি, আমার ঘরে গুরুজির পিয়ানো, যা আমাকে দিয়ে গুরুজি হারিয়ে গেলেন।

বাবা বলে, তোরে কে কইছিল, কেরানির ঘরে জন্ম নিতে ?

অতই যদি অসহ্য লাগে, তো যদি ধনীর পরিবারে আইতি ?

আমি চাইছি ? বোন ফুস্কে ওঠে, যোগ্যতা নাই, তো সেক্স করছ ক্যান ?

বাবা বলে, আরেকটা পোলার জন্য, তোরে আমরা চাইছি ?

তুই নিজের ইচ্ছায় আইছস।

ফ্যান ছেড়ে দিই।

ঘাম শুকানো বাস্তবতায় ফোন আসে, ভালো আছো ?

আগে হলে গা জ্বলে যেত, এবার উল্টাবাজির ঝিঁঝি লেগে যায়। জানালার ওপারে দিন নাকি রাত্রির অপরাহ্ন ঠাহর করতে পারি না।

ভালো আছি কিনা।

তুমি কেন যে নাছোড়বান্দার মতো আমার প্রেমে পড়েছিলে, কে জানে ? তোমার টানে পড়ে  বিপন্ন আমার ভেতরও শিহরণ সৃষ্টি হলো।

আমরা ক্যাফেতে, প্রকৃতিতে দেখা করতাম।

একদিন তোমার বাড়িতে ডাকলে। তাজ্জব লেগেছিল, এর মধ্যেই বাবা মার সঙ্গে দেখা করাতে চাইছো ?

বললাম, ভয় করছে, বললে, আরে ধুর, সারপ্রাইজ!

পুরা বাড়ি শূন্য। হা হা হেসে বললে, সবাই বাড়ি গেছে, তুমি নিশ্চয়ই পুরানা আমলের মতো সতীত্বে বিশ্বাস রাখো না ?

আমি তেজে বললাম, তুমি জানো, আমি ভার্জিন নই।

ওহ হো, তোমার সেই চাচার করা এক্সিডেন্ট ?

প্লিজ, চুপ।

কাউকে কেন কিছু জানাওনি পিয়ানোকন্যা ? আমাকে আমূল জড়িয়ে ধরতে ধরতে বলো, কারণ, সেদিনই চাচা স্ট্রোক করে মারা গেছিলেন।

যখন তোমার স্পর্শে আমার সমস্ত অস্তিত্ব দিশেহারা, তুমি বললে, ভাগ্যিস, ভুলে যাও পেছনের যাবতীয় অন্ধকার।

সামনের দিকে তাকাও, আমি বহুবার বহুরকম চোখ মেলে সামনের দিকে তাকিয়েছি, কেবলই ঘুলঘুলি, জীবনের আঁশটে ছায়া, আমার মা বলত ঘরেও আমি অতিথিই ছিলাম। সব ঘরই আমার ঘর, সব ঘরেই আমি অতিথি, কেবল তোমার বুকের মধ্যে মুখ গুঁজলে সব অন্ধকার নিভে যায়।

আমি বিছানা থেকে উঠে বসি, চলো, আমরা অনেক দূরের বনে যাই, যেখানে পাহাড়ের উপরে অনেক অজগর আর আর রাক্ষস মিলে আসমান থেকে রঙধনুর রস টেনে জড়াজড়ি, হুড়াহুড়ি করে আর, চুপ! মাথা থেকে  লেখার ভূত যায় না ?

হেসে উঠি, আসো, বুকে আসো, আরও আসো, আরও, দিনের পরে দিন ডুবে থাকতাম তোমার সঙ্গে কথোপকথনে, চ্যাটিং, তখন চারপাশের মাকড়সার ঝুল পেরিয়ে আমি যেন বেরিয়ে আসতাম রাজকন্যা, একদিন বললে, দারুণ শীত পড়েছে গো। সমস্ত শূন্য বাড়িতে কেমন লাগে বলো ?

আমি মজা করে লিখলাম, জানো, ছোট বেলায় এখানকার বাংলা সিনেমার একটা গান গাওয়ার চেষ্টা করতাম, নারী, আমার শীত শীত লাগেরে একা থাকা যায় না, পুরুষ, আমার কাছে আগুন আছে কাছে আয় না, চেষ্টা করতাম এজন্য বলছি, গান কিছুদূর গাইতেই আম্মা মুখ চেপে বলতেন, এসব পচা গান, গাইতে হয় না, শৈশবে কিছুতেই মাথায় আসত না, এই গান পচা কেন, বাংলাদেশের এমন শীতেই নারী পুরুষ যে যার মতো এমন গানের জিকির করছে, সেখানে তুমি তো ব্যাচেলর হয়ে আছো।

ব্যাচেলর! তাই ভেবেছি, তাই জেনে কত পথ চলেছি দুজন।

অবশেষে দুই সন্তানসহ নির্দ্বিধায় তুমি বউ নিয়ে দাঁড়ালে আমার সামনে ?

ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে গেলাম আমি।

বাবা, তুমি সৎ উপর্জন বোঝো, আমার কষ্টও বোঝো, তো ছেলে ছেলে কইরা মাথা নষ্ট ক্যান করতা ?

বুঝবি না, মানুষ মরলেও দুনিয়ায় তার চিহ্ন রাখবার চায়, ছেলেতে বংশ রক্ষা হয় ?

কী এমুন বংশ তুমার ?

তুমার বাপের কবর কই আছে, তার খবর পর্যন্ত রাখো ? জিয়ারত করবার যাও ? বরং ফুপুরা যায়, বছর বছর আয়োজন কইরা দুইটা ভালোমন্দ খাওয়ানির লাইগা তুমারে ডাকে। নিঃশ্বাস চইলা গেলে তুমার চলব পরকালের সঙ্গে জীবনের হিসাব নিকাব, সেইখানে একখান ছেলের জন্য দশখানা মেয়ে জন্ম দিয়ে দরিদ্র সংসারে যে অভাগার মতো লড়তে লড়তে নিজের জীবন শেষ করে দেয়, কতটা বুদ্ধিমান মানুষ সে ?

বাবা উত্তেজিত হয়ে বলে, যাও, দুইখানা যুক্তি জানো বইলাই খালি তর্ক আর তর্ক!

আমি ফের বিছানায় শুয়ে হাসতে হাসতে কাঁদতে শুরু করি।

ফিনিক্স ফের বলে ওঠে, আমি আছি।

শুনতে পাইনি শব্দ। ফলে হাসপাতালে। রাজ্যির চিকিৎসা।

কিন্তু হাসি ফুরিয়ে যাওয়া আমার অনুভব থেকে সমস্ত বাজনের বিষয় আধমরা বাদুড়ের মতো আমার রাত্রির গ্রন্থিতে ঝুলতে শুরু করল।

মিডিয়ায় তোলপাড়, ফুরিয়ে গেছেন সুরস্রষ্টা। আর আমি নিথর বিছানায় হয়ে নিশ্চল পড়ে থাকি, চারপাশে ঘুরতে থাকে, খচ্চরের পিঠে চড়া বৃষ্টি আর আঁধার ফেরিওয়ালা।

এইভাবে দিনরাত যাচ্ছিল।

মা বলেন,আর পারতাছি না, হয় তুই চাকরি ঠিক রাখ, নয় বিয়া কর। একটা সংসারে তিনজন পোলা মাইয়া নিয়া আমি আর পারতাছি না।

মার কোলে পিচ্চি পোলাকে দোল খেতে দেখে আমার মাথা গরম হয়ে যায়, বলি, লজ্জা লাগে না ? সামর্থ্য নাই, একটার পরে একটা বাচ্চা পয়দা দেয়ার ? আমারে আমার মতো থাকতে দেও, নইলে আরও খারাপ কথা কমু।

মনোচিকিৎসক বলেন, জোরে চিৎকার করুন, ঘৃণা করুন তাকে, যাকে ভালোবেসেছিলেন, ছাদে উঠে গালি দিন, যা ভেতর থেকে আসে, উগড়ে দিন।

নিজেকে সামলে আমার মা ভাবলেশহীন।

এরপর আমার কেনা পুরনো হারমোনিয়ামে, গিটার আর সমস্ত বাজনের সামনে নিয়ে যান, যেসব ছাড়া আমার কোন জীবন ছিল না।

মেঘহীন ধু-ধু খরা আসমানের মতো।

ফের ফিনিক্সের ফিসফিস, আছি…

এক এক করে এসব বাজন বিক্রি হতে থাকে।

আর আমি একদিন সমস্ত কাপড় খুলে পুরো বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে যখন অনুভব করছিলাম, জগতের কোনও প্রাণি নিজেকে ঢাকতে কোনও কাপড় পরে না, আমি অসুস্থ, তাই পরছি।

আমি তন্দ্রা থেকে জেগে সব কাপড় খুলে সারা বাড়ি চক্কর খেয়ে গেট খুলে রাস্তায় বেরোই।

তক্ষুনি টের পাই পেছনে আম্মার হাউমাউ, আর আরশি দিয়ে পেছন দিকে টানছে কেউ।

এরপর নিজেকে দেখতে পাই, একটা মনোহাসপাতালে।

বাড়ি যেন ছিল আমার কারাগারের মতো।

এখানে একটার পরে একটা ছিমছাম বিছানা পাতা।

কিন্তু বেশির ভাগ বিছানায় কেউ নেই। রাত বাড়তে থাকে আর আমি হাঁটতে শুরু করি। দেখি, একেকটা কক্ষে একেকটা নানা রকম অঙ্গভঙ্গি করছে। কেউ বিছানায় উপুড় হয়ে কাঁদছে।

আসলে মনোসমস্যা হলেও আমি একেবারে চুপ হয়ে গেছিলাম। ফলে, ওরা আমাকে নিজের মতো ছেড়ে দিয়েছিল।

একেবারে জাতে মাতাল তালের মতো, সব মনে ছিল।

সেখানে একজন জানি না কী কারণে যে উপুড় হয়ে কাঁদছিল, তাকে মনের সব শক্তি দিয়ে জড়িয়ে ধরলাম। সে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে এল। এরপর প্রতিটি কক্ষে গিয়ে বাজনহীন গান গেয়ে, আমূল ভালোবেসে বেসে যখন বিছানায় ফিরে আসি, তখন ভোর হয়ে গেছে।

শুনতে পাই, মার কন্ঠ, তারা বলছে, আপনার কন্যা একেবারেই অসুস্থ নয়, সে এক রাতে আমাদের অনেক পেশেন্টদের পজেটিভলি বদলে দিয়েছে।

বাড়ি ফিরে আসি।

বাড়িতে অনেক দিন পরে মাংস রান্না হয়, বহুদিন পরে বাবা এসে আমার পাশে বসেন।

আমি সহসা কথা বলতে পারি না।

বাবা বলেন, যে যত অসৎ উপার্জন করে, লাখ কোটি টাকা ঘুষ নিয়ে সন্তান মানুষ করে, আসলে তারাই ভালো।

কী মনে হয় তোমার ?

চারপাশে যেন ঝিঁঝি ডাকে। বদ্ধ চারদেয়ালের স্তব্ধতার বাতাস আমাকে বিমূঢ় করে তোলে।

আমরা যারা পারি না, ঘুষ নিতে, আমাদের লাত্থি দিয়ে চলে কোটি টাকা কামাই করা পিওনরা পর্যন্ত, তোমার কী মনে হয়, এরা ধর্মে বিশ্বাস করে ? পরকালে বিশ্বাস করে ?

আমি বাবাকে আঁকড়ে ধরি, এইসব তো আমাদের মতো মানুষের টাকাতেই হয়। শ্রমিকদের ঘাম রক্তের টাকায় হয়, সরকারি পিওনের কাছে কোনও হেল্প চাইলে এরা ধনী হয়াও ফকিন্নির মতো হাত পাতে, ঘুষ যেন তার সাত জনমের অধিকার।

বাবা বলেন, এখন ঘুষ খারাপ, এমন কথা বলতেও শরম লাগে। মনে হয়, যুগের সঙ্গে পাও মিলাইতে পারতেছি না।

সেদিন মন খুলে আমাদের জাগতিক অসহ্য বাস্তবতা নিয়ে বাবার সঙ্গে অনেক কথা হয়েছিল, বলেছিলাম, অবশ্যই, আমাদের টেক্সের টাকায় একজন পিওনও রাজার দাপটে চলে, আর সরকারি কর্মকর্তাদের কথা ভাবেন ? একশো কোটি হাজার কোটি টাকা যেন নস্যি, বাইরে পাচার করে, এত এত টাকা দিয়া তারা তো বয়স কিনতে পারে না, জীবন কিনতে পারে না। তাইলে ? কেন এমন বেহুঁশ রাক্ষসের মতো করে এরা ?

বাবা, চুপ হয়ে যান, চারপাশে প্রচ্ছায়া ঘুরতে থাকে, আর প্রচণ্ড গরমের ভাপে একটা ভ্যাপসা ঘরে আমরা সেদ্ধ হতে থাকি, বাবার মুখে অপরাধ বোধ, তোর শিল্পটা হইল না, আমাদের জীবনটা পুড়তে পুড়তেই শেষ হয়া গেল।

প্লিজ বাবা, এ নিয়ে কষ্ট পায়ো না, আমি নিজেই ব্যর্থ, পিয়ানোর নেশায় ঠিকঠাক পড়াশোনা শেষ করতে পারি নাই, বলে একটা লম্বা নিশ্বাস নিই, চিন্তা কইরো না, আমি এইবার অনার্স ফাইনাল দিয়া তোমাদের দেখায়া দেব, আমি অকম্মার ধাড়ি নই।

ফের ছায়া, রোদ নিভতে থাকে, বাবা বলে, টাকা ?

টাকা পাইবি কই ?

আমি দুটো টুইশনি নিয়েছি।

নিজের জীবন লাগায়া দেব।

কিন্তু সব যত ঠিক চলে তত তোমার তাচ্ছিল্য মনে পড়ে। 

মনে পড়ে তোমার উচ্চারিত বাক্য, ভাগ্যিস তোমাকে বিয়ে করিনি, করলে অন্যের বাসি করে যাওয়া শরীরের সঙ্গে আমার বাসর রাত হতো।

এসব কথার আগে, তুমি যখন হঠাৎ আমার সঙ্গে তুচ্ছ কারণে তর্ক করে করে আমাকে বললে, আমি মোটেই মানুষ চিনি না, তোমাকে বুঝি না, শিল্পী হওয়ার যোগ্যতা আমার নাই, আমি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছিলাম, পুরুষবাদী সমাজের প্রথাগত পুরুষ তুমি। মেয়েদের অনুভব করার ভান করো। তোমার মধ্যে কোনও সংবেদনশীলতা নেই।

তুমি ফোন কেটে দিলে।

দিনরাত্রি আমার শূন্য হয়ে গেল। প্রতি মুহূর্তে যখনই তোমার কথা ভাবতাম, তোমার ছোট ছোট কেয়ারিং দীর্ঘ হয়ে উঠত। আমি কী জানতাম, তুমি আমার কাছ থেকে সরে যাওয়ার একটা পথ একেবারে একটানে বানিয়ে ফেলেছো ?

তুমি ফোন ধরো না। আমি কাজ করি একেবারে মরে যেতে থাকা মানুষের মতো।

আমি তোমায় লিখতে থাকি, মানুষ যদি মূলত ভালো মানুষ হয়, যে কারও ক্ষতি চায় না, অন্যের সুখে সুখী হয়, সে প্রথমত আত্মীয়তার ভালোমন্দ মিলিয়ে টিকিয়ে রাখতে চায় নিজেদের জীবনের সঙ্গে।

প্রেমও।

কিন্তু হঠাৎ তৈরি হওয়া সম্পর্কের মধ্যে সব মায়া, সব স্মৃতি এসব যে কেউ তিক্তভাবে নিতে পারে, যখন জানে, সে মানসিক অসুস্থতায় ভুগছিল তখন।

তখনও ত্যাগ করে চলে যেতে পারে, এমন জীবন আমি আগে দেখিনি।

তুমি খুব ভালো করে জানো, আমার মানসিক ভারসাম্য হারানোর প্রবণতা আছে। তাই যুক্তিহীনভাবে তোমাকে বিয়ের জন্য বলতে গিয়ে নিজের অজান্তেই তোমাকে প্রেসার দিয়ে ফেলেছি, অভিনয় করছো বলেছি, এটাকে এত মারাত্মক করে দেখার কী আছে যে তুমি একেবারে সম্পর্ক ছিন্ন করতে উঠেপড়ে লেগেছো ?

অন্ধকার ঘরে ভাইবোনের সঙ্গে বিছানায় ল্যাপালেপ্টি পড়ে থাকি। জীর্ণ ফোনের মৃদু শব্দের সঙ্গে আমার হৃৎপিণ্ড উঠানামা করে।

তুমি একেবারে স্তব্ধ হয়ে গেলে যেন।

আসলেই হঠাৎ করেই পরিচয় তোমার সঙ্গে। ফেসবুকে আমার লেখা পড়ে দারুণ সব মন্তব্য করতে!

আমার পিয়ানো তুমি বুঁদ হয়ে শুনতে।

এরপর দেখা হলো। তোমার পুরো অবয়বে, চলনে তুমি একজন সিঙ্গেল এমনই মনে হতো। ফলে আমি আর কারও কাছ থেকে তোমার খোঁজ নেওয়ার প্রয়োজন বোধ করিনি।

আমি উ™£ান্তের মতো তোমাকে কোথাও খুঁজে পাই না।

কিন্তু তুমি আমাকে আনফ্রেন্ড করোনি, ব্লক করনি, এই ভরসায় জলের ওপর ভাসতে থাকি, পাগলের মতো লিখতে থাকি, বুনো, যখন জলের কাছে যাই, জল হয়ে যাই রোদের কাছে রোদ, বলতে বলতে চলে গেলে, অথচ দিনরাত বলতে, তুমি বলতে পারো না।

যখন মেঘ এসে জানালায় শব্দ করে, বৃষ্টির সঙ্গে কথা বলার ভয়ে ভাঙ্গা ফ্যানের দিকে তাকিয়ে থাকো।

গরমে বাষ্প হয়ে ঘুরো শীতে বরফ হয়ে ওড়ো।

বাড়ি ভাড়া একমাস দেরি হলে, বাড়িওয়ালার দূর হ, শুনে হাঁ করে তাকিয়ে থাকো, চারপাশে শব্দ খুঁজে না পেয়ে উদভ্রান্ত দিন পার করো।

অথচ, কিচ্ছু ঠিকঠাক না বুঝে আমাকে নষ্ট বলতে, সস্তা আর শকুন বলতে, হাজার শব্দ তোমার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল।

সেকি তীব্র গতি তোমার কথার!

বেশ্যা, পর্যন্ত এসে হাঁপ ছেড়েছিলে।

আমার বিশ্বাস হারিয়ে গেছে, বুক পুড়ে অগ্নিচুল্লা আর মরুভূমি হয়ে গেছে।

আমি এখনও জলের কাছে যাই, রোদ হয়ে যাই, রোদের কাছে জল।

আমার শব্দ উল্টেপাল্টে অশরীরী হয়ে গেছে, ভূত হয়ে গেছে।

অথচ এতসব শব্দ কান থেকে মুছতে কবিরাজ খুঁজি, দরগার দরজায় মাথা ঠেকাই।

কিন্তু যত এসব শব্দ নিয়ে এদিক ওদিক দিগ্ভ্রান্ত হই, তত সেই শব্দ অন্য এক অনুভবে আমার শব্দ হয়ে যায়।

তাই আমি প্রতিদিন রাতে জলের সুতা দিয়ে চক্ষু সেলাই করি।

বুনো, ক্রোধ যেসব জঘন্য শব্দ আমাদের মুখ থেকে টেনে বের করেছিল, চলো তাকে ধিক্কার জানাই।

মরে যাচ্ছি বুনো, একবার হাত বাড়াও, এসব যত মনে পড়ে, তত অদ্ভুত এক শক্তি রঙিন বুদবুদ হয়ে আমাকে তোমার বিরুদ্ধে খাড়া করায়।

কিন্তু ভেতর বেদনা আমার জীবন অসহ্য করে তোলে।

এইভাবে দিন যাচ্ছিল, ধীরে ধীরে অনুভব করেছি, তোমার সঙ্গে বিচ্ছেদেও আমি তোমার কাছে যত সুন্দর থাকতে চাইব, তত তোমার তাচ্ছিল্য ভুলতে পারব না, ফলে হঠাৎ তোমাকে ফোন দিই, যেই তুমি বিরক্তিভরা কণ্ঠে হ্যালো বলেছ, তক্ষুনি চিৎকার করে বলতে শুরু করলাম, এই ফকিন্নীর পুত, কুত্তার বাচ্চা নিজেকে কী মনে করেছিস তুই, হারামি, এরপর অনেকদিন কেটে যায়। আমার ভেতরটা যত হালকা হতে থাকে, তত আমার সামনে পিয়ানো এসে দাঁড়ায়। আমি হুহু করে কাঁদতে থাকি। আঙুল নড়ছে না। সামনে শত দর্শক, শ্রোতা।

অবশ্য তখন তুমি লাত্থি খেয়ে আমার পায়ের কাছে এসে বসেছো। এবার খচ্চর তোমার পিঠে চড়ে আমি মাফলার উড়াই, ধীরে ধীরে তুমি গড়িয়ে পড়ো, কিন্তু সুর আসে না।

এইভাবে ভালোবাসাহীন আমি রিহার্সালহীন নিজেকে পুরো শেষ ক’রে দিতে জনারণ্যের সামনে  আলোকিত মঞ্চে পিয়ানোর সামনে দাঁড়াই।

কিন্তু চারপাশে যত কোলাহল তত অনুভব করি স্থবির হয়ে যাচ্ছি আমি, আঙুল নড়ছে না।

মার চোখ গড়িয়ে জল সীমাহীন।

যেন প্রাণ উড়ে উড়ে উড়ে যায়, ফের ফিনিক্স পাখির শব্দ।

এবার শুনতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পিয়ানোহীন মঞ্চে অনুভব করি, অপুর্ব সুর আর করতালির মূর্ছনায় কেউ এসে চারপাশ মুখরিত করে কেউ একজন বাজিয়ে উঠল।

অথচ কী দারুণ পিয়ানো বাজাত। ধীরে ধীরে টের পাই, পেছন থেকে জড়িয়ে ধরেছে কেউ। অনুভব করি, গুরুজি! আমার দশ আঙুল যেন বা একশো আঙুল হয়ে যায়। পুরা হল অদ্ভুত সুন্দর কোলাহল মুখর হয়ে ওঠে।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button