আর্কাইভগল্প

গল্প : বাঘের বাচ্চা : অমর মিত্র

আমিনুলের বাবার রোয়াব খুব। এ তল্লাট তার হাতে। হাতে মানে তার কথায় বিডিও, বিএল এলআরও, কলেজের প্রিন্সিপাল, ইস্কুলের হেড মাস্টার সবাই ওঠে বসে। গেরস্থ থেকে পুলিশ, সবাই এক ঘাটে জল খায়। আমিনুলের বাবা সফিকুলকে সবাই ভয় করে। কয়েক বছর আগে সফিকুল দলবদল করে এমএলএ হয়েছিল। জিতেই পুরোন দলে ফিরে এসেছিল। সেই থেকে তার খুব দাপট। প্রমাণ করেছে এই এলাকায় তার বিকল্প নেই। তারপর একবার পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি। সেই থেকে এই জায়গার সব। বাবার দাপট দেখতে দেখতে আমিনুল বড় হয়েছে। তার এখন একুশ। ইস্কুলে ঢুকেছিল। ভালো লাগেনি, তাই ছেড়ে দিয়েছে। ছেড়ে দেওয়ার কারণ হলো, আমিনুলকে কেন বছর বছর ফেল করানো হয়, এর জবাবদিহি করতে বলেছিল সফিকুল। সে হেড মাস্টারের ঘরে ঢুকে তাঁকে রীতিমতো ধমকেছিল, বেতন বন্ধ করে দেবে, এই হুমকি দিয়েছিল। হেড মাস্টার চুপ করে ছিলেন। তখন আমিনুলের বাবা ক্রোধে চেয়ার টেবিল উলটে দেয়। হেড মাস্টারের গালে চড় মেরে বেরিয়ে আসে। এই ঘটনা ভিডিও করেছিল এক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি। সেই ভিডিও সেদিন সন্ধ্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে ছড়িয়ে দিতে শোরগোল ওঠে। সফিকুল আত্মগোপন করে। মানে এলাকায় থাকে, কিন্তু কোনও অফিস কাছারির ধারেকাছে কোনও কারণেই যায় না। হুমকি মারতে যায় না। থানার বড় বাবু তাকে বলেছে কদিন সমঝে চলতে। খবরের কাগজের রিপোর্টার, টেলিভিশনের বুম আর ক্যামেরা হাতে লোকজন এসে গেল এলাকায়। তারা নানা লোকের সঙ্গে কথা বলল। কেউ কিছুই বলল না। তারা দ্যাখেনি, তাই জানে না। কেউ কেউ বলল, কে সফিকুল, তারা চেনেই না। কেউ বলল, একজন সব্জি ব্যবসায়ী আছে সফিকুল, তাকে চেনে। সে খুব ভালো মানুষ। সত্যিই সেই সফিকুল বেশ লোক। তাকে দেখে টিভি-র লোক হতাশ হলো। সব্জি ব্যবসায়ী সফিকুল বলল, এ বছর আম হয়েছে খুব, সে আম থেকে লাভ করেছে অনেক। আমের ফলনের জন্য সব্জির চাহিদা একটু কম। সেটা সাময়িক মাত্র। না আলু এদিকে হয় না। কুমড়াও না। এদিকে পটল, ঝিঙে, ভেণ্ডি, কুদরি, বরবটি, লঙ্কা, বিন্স, ক্যাপসিকাম, গাজর এইসব সব্জি হয়। টিভিতে সব্জি নিয়ে কোনও রিপোর্ট হয় না। আগে রেডিওতে কৃষিকথার আসর হতো, চাষিভাইদের জন্য অনুষ্ঠান হতো, এখন শুধু মারামারি আর কোন্দলের রিপোর্ট। যা হচ্ছে আল্লার গজব। পৃথিবীর আয়ু বেশিদিন নয়। তার ভিতরে যা বেচাকেনা করে নাও। এক সফিকুলের পরিবর্তে আর এক সফিকুল এইসব বলল এক গাল হেসে। তাতে রিপোর্টার হতাশ হলো। সেই লোকটাকে জেরা করে কিছুতেই আসল সফিকুলের খোঁজ পাওয়া গেল না। সে নিজের বুকে হাত দিয়ে বারবার বলতে লাগল, ‘আমিই সফিকুল।’

কথাটা এই যে ভিডিওটি আমিনুলের করা। সে ভিডিও করতে ভালোবাসে। তার মোবাইল ফোন খুব দামী, কিন্তু ফোকটে পাওয়া। বাবার কথায় মোবাইল শপ এমনি দিয়েছে। দিয়ে কৃতার্থ হয়েছে। আমিনুলই সেই ভিডিও একজনের মাধ্যমে ফেসবুকে পোস্ট করে। তারপর তা ভাইরাল হয়। তাতেই তার বাবার কীর্তি ছড়িয়ে পড়ে। বাবার আসন পোক্ত হয়।

এলাকার নাম পিরতলা। এখেনে এক পিরের থান আছে। উরসের সময় প্রভূত লোক সমাগম হয়। মেলা চলে এক পক্ষকাল। সেই সময় আমিনুলের বাবা সফিকুল আয় করে বিস্তর। রোজ একশো টাকা তাকে দিতে হয়, ঝালমুড়ি আর পাঁপড় ভাজাওয়ালাকেও। এক এক দিন হাজার তিরিশ হয়ে যায়। সকলে তো একশো  দেয় না। মিঠাইওয়ালা দেয় তিনশো, জামাকাপড়ের স্টল, জুতার দোকান সব দেয় পাঁচশো করে। এসব হিসেব জানে আমিনুল। আগে শাহজাদা টাকা তুলত, এখন আমিনুল তোলে। তাকে নিজের মতো করে তৈরি করছে সফিকুল। এই পিরতলা সফিকুলের সাম্রাজ্য। সেই সাম্রাজ্য আমিনুলের হাতে তুলে দিয়ে সে তীর্থ করতে  যাবে। এই এলাকার মানুষ সব চাষি। মাটি খুব সরেস। কত রকম ফসল হয়। সফিকুল চাষাদের কাছ থেকেও তার প্রাপ্য আদায় করে। সে যে এই এলাকা শান্ত রেখেছে, সকলে সুখে শান্তিতে বাস করছে, তার জন্যই এই আদায়। জমি কিনলে দিতে হবে, বাড়ি করলে দিতে হবে, ব্যবসা শুরু করলে দিতে হবে, এলাকায় থাকতে হলে দিতে হবেই। গৃহপ্রবেশ করলে দিতে হবে, মেয়ের বিয়ে দিলে দিতে হবে, ছেলের বিয়েতে বটেই। মুসলমানের ঈদে দিতে হবে, হিন্দুর দুর্গা পূজা, কালী পূজায় দিতে হবে। বছরে একবার শেতলা পূজায় দিতে হবে। দিতে হবেই। সফিকুল এসব আদায়ের ভার দিচ্ছে আমিনুলকে। তবে সব্জি ব্যবসায়ী সফিকুলের কাছে আমিনুল যায় না। সমনামী বলে হয়তো। তার কাছ থেকে যা নেওয়ার শাহজাদা নেয়।

আমিনুল বাপকে জিজ্ঞেস করে, সবাই দিতে চায় না, করব কী ?

আরে তুই কার বেটা, চমকে আদায় করবি, চেম্বার নিয়ে ঘুরবি, তুই সফিকুলের বেটা আমিনুল।

শাহজাদা রেগে গেছে। আমিনুল বলে, তারা বলে, শাহজাদাকে দেবে।  

শাহজাদা এতদিন সাফল্যের সঙ্গে এই কাজ করত। নিজে নিত পাঁচ ভাগের এক ভাগ। পাঁচশো টাকায় একশো টাকা। কতদিন নেবে, সে এখন নিজের পথ দেখুক। আমিনুল লায়েক হয়ে গেছে। শাহজাদাকে এরিয়া ভাগ করে দেবে সফিকুল। শাহজাদার জন্য যে এলাকা পড়ল, সেখানে আদায় নাই। ধু ধু চাষের জমি। শাহজাদাকে সেখানে কাজ করতে হবে। বুড়া চাষাদের পেট ফাঁসিয়ে দিতে হবে, যদি না লোকাল পিস (শান্তি) ট্যাক্স দেয়। খাজনা না দিলে জমি দখল করে বেচে দাও। একবার কেন, কয়েকবার তা করেছে সফিকুল। এমন করে দিয়েছে, জমি পড়ে আছে, ক্রেতা আর আসল জমির মালিক মামলা করে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। এই লাইনটা তো খোলাই আছে শাহজাদার জন্য।

সফিকুল বলল, শাহজাদাকে ফোন কর।

শাহজাদাকে ফোন করল আমিনুল। শাহজাদা ফোন ধরল না। আবার করল। বেজেই গেল। তখন সফিকুল নিজের ফোন এগিয়ে দিল ছেলেকে। সেই ফোন থেকে শাহজাদার কাছে ফোন গেল। একই ফল। ফোন ধরল না শাহজাদা। এখন বেলা দশটা। শাহজাদা কি এখনও ঘুমচ্ছে ? বাড়ি আছে না মস্তি করতে গেছে কোথাও। আমিনুল জানে না। জানে না শুনে রেগে যায় সফিকুল, গর্জন করে উঠল, বানচোত, কিছুই জানো না, কেন জানিস না ?

আমিনুল রুখে গেল। সে সফিকুলের বেটা। তার রোষ কম নয়। গরগর করতে লাগল। দাঁতে দাঁত ঘষে গেল তার। কিন্তু সে বাপের সমান হয়নি এখনও, বাপের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো তার পক্ষে সম্ভব নয়। বিশ্বাস নেই সফিকুল ইসলামকে। দরকারে ছেলেকে হাজতবাস করাতে পারে থানার বড় বাবুকে বলে। এতে তার বাপের খ্যাতি বাড়বে। বাপ বলবে, অন্যায় করেছে, তাই পুলিশ অ্যাকশন নিয়েছে, আইন আইনের পথে চলবে। আমিনুলের নিজস্ব ফলোয়ার আছে, তারা যে তার পিছনে ঘোরে, তার কারণ সে সফিকুলের বেটা। পিরতলায় সফিকুল শের। মন্ত্রী, এমপি যদি আসেন এদিকে, সফিকুলের ডাক পড়বেই। সফিকুলের সঙ্গে তাঁরা বৈঠক করেন। আমিনুল এতদিন সেই সব সাক্ষাৎকারের সময় পৌঁছে দিয়েছে খাদ্যাদি, ঠান্ডা পানীয়। বাবার চেয়ারের পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থেকেছে। এদিকে টেলিভিশনের লোক এলে সব সময় তার বাবার বাইট নেয়। সে বাবার পাশে থাকে। তাতে তার ছবিও দেখা যায়। এইটা কম কথা নয়। টিভির লোকেরা সফিকুলের বেটা আমিনুলকে চিনে গেছে। তাকে আমল দেয়। তার কাছেও এক-দুবার কিছু জিজ্ঞেস করেছে। সে সব কথা নিরামিষ। তার বাবা গরম গরম কথা বলে। সে ক্রমশ গরম কথা বলতে শিখছে। আমিনুল বলল, শাহজাদা ভাই মনে হয় নিজের রাস্তা খুঁজছে।

সেইটা কী ? সফিকুল জিজ্ঞেস করে।

মনে হয় ফুলচাঁদ ভাইয়ের সঙ্গে মিটিং করেছে।

তুই জানিস ? সফিকুল নিজের লুঙ্গি টেনে দাবনার কাছে তুলে নিল। লম্বা সিগারেট ধরাল। মাথায় কম চিন্তা নেই। সামনে পঞ্চায়েত ভোট। আন কন্টেস্টেড সব সিটে জিতে জুলুস লাগাতে হবে। বোম্বাই ডান্স।

মনে হয়। আমিনুল উদ্বিগ্ন গলায় বলল।

আবে মনে হয় মানে কী, বিকাশকে ডাক।

বিকাশ পাল উঠতি কর্মী। বিকাশ আবার পুলিশের খোঁচড়ের কাজও করে। জানে সফিকুল। কিন্তু বিকাশ এসবও করে। তারও খোঁচড়। বিকাশ এল। বিকাশ এসে এক গণ্ডা রসগোল্লা খায়। তারপর বলে, ফুলচাঁদের সঙ্গে মিটিং করছে শাহজাদা, দাদা তুমি সাবধান।

কী করবে ? সফিকুল জিজ্ঞেস করে। 

বলবে এরিয়া আলাদা করে নিতে, তারাও নেবে।

আমি তো আর নেই, আমিনুল করছে।

আমিনুল করা আর তোমার করা কি আলাদা দাদা, আমিনুলের মাথায় তোমার হাত, কে কী বলবে ?

গুম হয়ে থাকে সফিকুল। শাহজাদা তার হাতেই তৈরি। শাহজাদার বাপ জগন্নাথ সিং তার হাতে মরেছিল। সেও এমনি নিজের এরিয়া ভাগ করে নিতে চেয়েছিল। জগন্নাথ মরেছিল রোড অ্যাকসিডেন্টে। লোকে বলত সফিকুলের কাজ। কিন্তু প্রমাণ কই। সফিকুল বরং জগন্নাথের মৃত্যুর প্রতিবাদে একদিন বন্ধ ডেকেছিল। চারটি গাড়িতে আগুন লাগায়। আর বিপক্ষ পার্টি অফিস পুড়িয়ে দেয়। তারপর শাহজাদার মায়ের কাছে গিয়ে বলে, আমি আছি, চিন্তা নেই ভাবি তোমার।

বিকাশ বলল, ভোটে দাঁড়াবে ও।

কে দাঁড়াবে না বসবে, তা আমি ঠিক করব, ভোটে দাঁড়াবে বললেই হয়ে যাবে ?

না দিলে বিরোধীর হয়ে দাঁড়াবে।

ফুলচাঁদের পার্টি দেবে নমিনেশন ?

দাদা পার্টির কি অভাব আছে, ও নিজের পথ নিজে তৈরি করছে।

সফিকুল নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে রইল। আকাটটা কিছুই খোঁজ রাখে না। কতদূর এগোবে ? ছেলের যা আছে তা হলো রোষ। রোখ। গুলিগোলা চলছে, টিয়ার গ্যাস চলছে, সে লাঠি হাতে তার ভিতরে ঢুকে যাবে বিপক্ষ পেটাতে। বিচার বিবেচনা কম। এখন টু শটার নিয়ে ঘোরে সফিকুলের বেটা। সে আমিনুলকে বলল, তুমি বুঝে নাও, শাহজাদার সঙ্গে লড়তে হবে তোমাকে।

আমিনুল বলল, ওকে নমিনেশন দিলে কী হবে ?

ও পঞ্চায়েত মেম্বার হলে, তোর ভবিষ্যৎ কী হবে ?

কী হবে আমার ? আমিনুল ভ্যাবলার মতো জিজ্ঞেস করে।

বানচোত, তোর গুয়া মারা যাবে, তুই হবি মেম্বার, তোর নাম আমি পাঠিয়েছি নমিনেশনের জন্য।

চুপ করে থাকল আমিনুল। সে হবে প্রধান ? না পঞ্চায়েত সমিতির মেম্বার ? বাবা তাহলে করবে কী ? বাবা কিং মেকার। বাবা তাকে তৈরি করছে। বাবা এবার তীর্থ করতে যাবে খাজা মৈনুদ্দিন চিস্তির মাজারে। তখন যা করার আমিনুলকে করতে হবে। বাবা দেশ ঘুরতে গেলে তাকে একা থাকতে হবে পিরতলায়। তার চেয়ে সে-ও যাবে বাবার সঙ্গে। কিন্তু তাহলে পিরতলা অরক্ষিত হয়ে থাকবে। শাহজাদা আর ফুলচাঁদ শেখের  কবলে সব চলে যাবে।

দুই

শাহজাদা বলল, তোমার বেটা তোমার জায়গায় বসবে, তা হবে না সফিকুলভাই, জমানা বদলে যাচ্ছে, এসব তোমার নিজস্ব সম্পত্তি না।

সফিকুল বলে, কেন ইন্দিরা গান্ধীর ছেলে রাজীব গান্ধী হয়নি ?

শাহজাদা বলল, ওসব জানিনে, তুমি যদি রিটায়ার করো, আমি বসব তোমার জায়গায়।

সফিকুল বলল, পলিটিক্সে রিটায়ার হয় না, কিন্তু আমিনুল তার ভাগ তো বুঝে নেবে।

ভাগ আবার কী, আমার বাপ জগন্নাথ সিঙের ভাগ আমরা পেয়েছিলাম ?

সফিকুলের মনে হচ্ছিল শাহজাদাকে শেষ করে দেয়। কিন্তু রাগ সংবরণ করল। আমিনুল চুপ করে আছে। আমিনুল তার জায়গা বুঝে নিক। যা বলার সে বলুক। সফিকুলের পঞ্চাশ পার হয়ে গেছে। ষাট ছুঁতে যাচ্ছে। আমিনুল তার তৃতীয় সন্তান। তার আগের দুটি মেয়ে। জামাইরা কেউ রাজনীতি করে না। ব্যবসাপাতি নিয়ে ব্যস্ত। বেশি বয়সের পুত্রকে দাঁড় করাবেই সফিকুল। সেইভাবে তৈরি করেছে। এখন খুব দরকার না পড়লে সে সরাসরি ফিল্ডে নামবে না। কিন্তু ঘরে বসে রণনীতি ঠিক করবে। সে শাহজাদাকে বলল, আচ্ছা, তুই আমিনুলকে দেখবি তো।

আঁজ্ঞে, আমিনুলকে আমি দেখব কেন ?

বাহ আমিনুল যদি তোর আন্ডারে কাজ করে ?

শাহজাদা বলল, আমি পঞ্চায়েতের সব নমিনেশন ঠিক করব, এখেনে আর মতের বাইরে আর কাউকে দাঁড়াতে দেব না।

তুই করবি, তা সবাই মেনে নেবে ?

না নিলে ফাইট হবে সফিকুলভাই।

সফিকুল বলল, তাহলে ফাইট হোক।

আমি ফুলচাঁদের গ্রুপে জয়েন করছি, তুমি মহাসেয়ানা, আমার বাপকে তুমিই মেরেছিলে।

তখন আমিনুল এক মনে ভিডিও করে যাচ্ছিল। তা ছাড়া তার কাজ কী ? ভিডিও করতে সে খুব ভালোবাসে। যখন কাজ থাকে না, এইটা করে। বাবার ভিডিও করেছিল সে কৌতূহলে। কিন্তু তা হয়ে গেল  ভাইরাল। সে বুঝেছিল হেড মাস্টারের গালে চড় মারায় বাবার খ্যাতি বেড়ে গিয়েছিল। বাবাকে এক দিনেই সারা বাংলা চিনে গিয়েছিল। হিন্দি, ইংরেজি চ্যানেলেও বাবাকে দেখিয়েছিল। ভিডিওটা তার কাছে ধরা আছে। সেই হেড মাস্টার তারপরেই এখান থেকে ডুয়ারস, কালচিনি হাইস্কুলে বদলি হয়ে গেছে। তার বাড়ি  শ্যামবাজার। এক্কে চড়ে ভুটান সীমান্তে। এখন শাহজাদা আর বাবার ভিতরে গোলমাল হলে, সেই ভিডিও তার কাছে থেকে যাবে। তারপর শাহজাদার কিছু একটা হবে। তার বাবার সেই ক্ষমতা আছে। শাহজাদার নেই। শাহজাদা এমন ঘটনা ঘটাতে পারবে না। এক চড়ে দেশের সীমান্তে।

সফিকুল বলল, তোর বাবার কথা কি ফুলচাঁদ বলেছে ?

যেদিন থেকে শুনেছি, আমি তোমার বিপক্ষে হয়ে গেছি সফিকুলভাই।

সফিকুল বলে, সব ঝুটা, আরে শাহজাদা, তোর বাপ একসিডেন্টে মারা গেলে কে তোদের পাশে দাঁড়িয়েছিল ?

তুমিই মার্ডার করিয়েছিলে, অ্যাকসিডেন্ট ফালতু কথা, আমি উঠি, সফিকুল ভাই, সব সিট আমি ঠিক করব  আর কেউ দাঁড়াতে পারবে না।

সফিকুলকে এখন মাথা ঠান্ডা করে কাজ করতে হবে। শাহজাদা চলে গেল। আমিনুল তার পিছু পিছু গেল। বাড়ির বাইরে শাহজাদার জন্য অপেক্ষা করছিল তিন মোটর বাইকে ছজন। সব কাশিপুর এলাকার লোক। শাহজাদা তার বাইকে উঠল। সামনে দুই মোটর বাইক, পিছনে আর এক। চলল শাহজাদার কনভয়। আমিনুল ভিতরে এলে সফিকুল বলল, তোকে শাহজাদার সঙ্গে লড়তে হবে।

যা বলল শাহজাদা, তা সত্যি ?

কী বলল ? সফিকুল জিজ্ঞেস করল।

শাহজাদার বাপকে তুমিই মেরেছিলে ?

পথের কাঁটা উপড়ে ফেলতে হয়।

আমিনুল বলল, শাহজাদা তা জেনে গেছে।

তুই সাবধান হ। সফিকুল চিন্তিত গলায় বলল, তোকে আমার এরিয়া রাখতে হবেই।

এরপর এলাকায় মুহুর্মুহু বোমাবাজি হতে লাগল। শাহজাদার দল মানে বিপক্ষ পার্টি এসে বোমাবাজি করে নিজেদের অস্তিত্ব জারি করতে লাগল। সফিকুল মাঠে নামল। লড়াই চলতে লাগল। দু একটা লাশ হেথা হোথা পড়ল। সফিকুল সহজে ছাড়বার পাত্র নয়। তার ছেলে আমিনুল ভিডিও করতে লাগল। সেই ভিডিও  ভাইরাল হতে লাগল কোনও কোনওটা। সফিকুল তার ছেলেকে তার জায়গায় প্রতিষ্ঠা করবেই। জওহরলালের মেয়ে ইন্দিরা, ইন্দিরার ছেলে রাজীব, তাহলে তার ছেলে কেন তার আসনে বসবে না ? আরও উদাহরণ আছে। রাজার ছেলে রাজাই হয়। কিন্তু ইন্দিরা, রাজীব, দুজনেই নিহত হয়েছিল, তা মনে রাখতে হবে।  আমিনুল তা জানে। সফিকুল তা মনে মনে ভাবে। শাহজাদার বাপকে সে মেরেছিল, তাও তো ঠিক।

সফিকুল শুনতে পাচ্ছে অঙ্ক বদল হয়ে যাচ্ছে। পার্টির হাইকম্যান্ড এখন শাহজাদার পাশে চলে এসেছে। শাহজাদা প্রত্যেক দিন প্রমাণ করছে তার অস্তিত্ব। এলাকায় মন্ত্রী এসে শাহজাদার সঙ্গে মিটিং করে গেল। এমপি এসে শাহজাদার সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করল। সে যখন খবর পেল খোঁচড় বিকাশ মারফত, মন্ত্রী চলে গেছেন বাসন্তীর দিকে। আমিনুল একটা গবেট। খবরই রাখেনি। সফিকুল ভাবছিল কী করা যায় ? ঝড় তুলতে হবে। আমিনুলকেই ঝড় তুলতে হবে। আমিনুল তুই একবার যদি জায়গা ছেড়ে দিস, উদ্ধার করা কঠিন হবে। তাহলে ? সফিকুল বলল, এমন কিছু করতে হবে, যাতে লোকে ভয় করতে আরম্ভ করে। আমিনুল বলল, আমি ছাড়ব না, তুমিও ছাড়নি।

আমিনুলের সাগরেদ আছে কম না। তারা ভিডিও করে। আমিনুল যখন লোককে চমকায়, তারা মোবাইল ক্যামেরা অন করে তুলে ধরে। আমিনুল গেল ইস্কুলে। এমনিই গেল। মাস্টাররা মাইনে নেবে অং বং চং পড়িয়ে, তাকে ভাগ দেবে না ? তা কি হতে পারে ? ফাইভ পারসেন্ট করে আমিনুলের গরিব ত্রাণ সমিতিতে দিতে হবে। তা কী করে হয় ? টিচাররা বলল, সরকারি ত্রাণ তহবিলে আমরা আম্ফান, ইয়াসের ঝড়ের সময় দিয়েছি।

দিতেই হবে, এই ভিডিও কর, এই যে মাস্টার, মিড ডে মিলের খাতা বের কর, দেখব।

এক মাস্টার বলল, হবে না, আপনি কে, খাতা দেখাব কেন, বেরিয়ে যান।

কেন বে, তোর বাপের ইস্কুল, আমি এই ইস্কুলের এক্স-স্টুডেন্ট, আমার রাইট আছে, সব্বাই ফাইভ হান্ড্রেড করে দে, মাসে মাসে তাই দিবি, খাতা বের কর, মিড ডে মিলে কত চুরি হচ্ছে আমি চেক করব। 

না। একজন মোবাইল ফোনে ডায়াল করে থানায়। তা দেখে আমিনুল সেই তার বাবার মতো, বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে চড় চাপড় মারে সেই শিক্ষককে। আর বলে ভিডিও কর, ভিডিও কর।

সেই ভিডিও ভাইরাল হলো কথাবার্তা সমেত। ফেসবুক মারফত ছড়িয়ে পড়ল দেশের সর্বত্র। সফিকুলের স্মৃতি ফিরে এল। আমিনুল লুকোল। থানা তাকে সেই জায়গা থেকে তুলে নিল। সফিকুল যা করেছিল, যে প্রতিদান পেয়েছিল, তা আমিনুল পাবে কেন ? থানা এখন শাহজাদার পিছনে আছে। সফিকুলের এখন অজ্ঞাতবাসে যাওয়ার সময় হয়েছে। বিছানায় শুয়ে থাকুক, যেমন আছে অবনী মুখুজ্জ্যে। দিন ফুরিয়েছে পাশের ব্লক জামতলার সেই দাপুটে নেতার। কটা খুন করেছে তার হিশেব নেই।

স্কুলের হয়ে শাহজাদার দল ঝাঁপিয়েছে। শিক্ষক জাতির মেরুদণ্ড, তার গায়ে হাত! সফিকুল শুনল  আমিনুলকে হাজতে পিটাই করছে হেড কনস্টবল। সফিকুল থানায় গেল না। তার ছেলে একদিন না একদিন বেরোবে। তারপর ? সফিকুল অপেক্ষা করতে লাগল। শাহজাদার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিল। ছেলে যদি তার পক্ষে আসে, সফিকুল যদি তার কর্তৃত্ব মেনে নেয়, আশীর্বাদ করে তাকে, তবে আমিনুল জেল থেকে ছাড়া পাবে জামিনে। জামিনে পুলিশ সায় দেবে। সফিকুল হুঙ্কার দিল, ছেলে জেল খাটুক। মহাত্মা গান্ধী, নেতাজি সুভাষও  জেল খেটেছে। জেল থেকে গলায় মালা নিয়ে বেরোবে নেতা আমিনুল। তারপর শাহজাদা কেমন লড়ে দেখা যাবে। কারওর দয়ায় কেউ শের হয় না। শের হতে হয় নিজে নিজে। আমিনুল এক বাঘের বাচ্চা।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button