আর্কাইভগল্প

গল্প : দাঁতভাঙা হাসি : মঞ্জু সরকার

পার্কের এ দিকটা আপাতত নির্জন। সবুজ ঘাসের প্রাকৃতিক গালিচার ওপর মুখোমুখি বসে প্রেমিক-প্রেমিকা, গল্প করে। বিকেলের মিঠে রোদ গাছপালার ফাঁক গলিয়ে লুকোচুরি খেলছে। কথার ফাঁকে এবং কথা শেষ করেও  প্রেমিকা হাসিমুখ দেখাতে দু সারি দাঁত মেলে রাখে। ক্লোজআপ টুথ পেস্টের বিজ্ঞাপনের মতো ঝকঝকে দাঁত।  যুবতীর হাসির তরঙ্গে শুধু মন নয়, যেন শরীরও দোলে যুবকটির। কথার ভেলায় হাসির নদীতে ভাসতে ভাসতে, ভাললাগার আবেশে একসময় প্রেমিকাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দেওয়ার কথাও ভাবে প্রেমিকটি। এর আগের ডেটিং-এ ঝটিতি এক চুম্বন-স্মৃতি কামনাটি প্রবল করে।

যুবতী কি টের পায় ? চোর-ধরা দৃষ্টি হেনে অভিযোগ করে, ‘হ্যাংলার মতো কী দেখছো ?’

যুবকটি থলের বেড়াল আগলানো সতর্কতা নিয়ে ইতিউতি তাকায়। কিছু দূরে কয়েকটি ছেলে, দল বেঁধে কি তাদের দিকেই এগিয়ে আসছে ? সংখ্যায় ওরা চারজন, কথা বলছে নিজেদের মধ্যে। একজনের হাতে সিগারেট, অন্যজনের হাতে মোবাইল ফোন। যুবকটি ঘাসের ওপর রাখা ফোনটি হাতে তুলে নেয়। শয়তান কি ছিনতাইকারী হলে পুলিশকে জরুরি নাম্বারে কল দেবে। নির্জনতা তছনছকারী ছেলেদের দেখে বিরক্ত প্রেমিক  বলে, ‘এর চেয়ে মামার নিরিবিলি ফ্ল্যাটে গিয়ে ভালো সময় কাটাতে পারব আমরা। চলো, এখনই যাই।’

প্রেমিকা বলে, ‘প্রকাশ্য পার্কেই যেমন করছো! মামার খালি ফ্ল্যাটে নিয়ে বাঘের মতো হামলা করো যদি ?’

সম্ভাব্য বাঘ দেখার আনন্দেও প্রেমিকার হাসি উচ্ছল হয়। কিন্তু এদিকে হাঁটতে থাকা ছেলের দল আরও কাছে এগিয়ে আসছে দেখে, হাসি সংযত করে আগন্তুকদের দেখে। চাপা কণ্ঠে আলাপের সুর বদলায়।

‘এই জানো, ওই সামনের ছেলেটাকে দেখে আমার সেই উদ্ধারকারী নায়কের কথা মনে পড়ছে। নেপালিদের মতো, এরকম চেহারা ছিল তার।’

উদ্ধারকারী নায়কের চেহারা দেখতে প্রেমিকটি আগন্তুকদের দেখে। তাদের দুজনকে প্রেম করার সুযোগ দিতেই যেন ওরা ডানদিকে হাঁটছে এখন। স্বস্তি বোধ করে যুবকটি, একাগ্র দৃষ্টিতে আবার প্রেমিকার হাসিমুখ দেখে।

‘উদ্ধারকারী কোন নায়ক ? কার কথা বলছো ?’

‘ও হো, তোমাকে আমার অ্যাকসিডেন্টের কথাটা বলিনি এখনও! জানো কি, আমার এই দাঁতগুলো আসল নয়, নকল।’

‘মানে ?’

‘মানে আমার এই দাঁত পড়বে না কখনও। তার মানে বুড়ি হবো না আমি।’

যুবতীর বিজ্ঞাপনের হাসি প্রসারিত হয়। অবাঞ্ছিত ভিড় দূরে সরে যাচ্ছে। ফোন মাটিতে শুইয়ে রেখে প্রেমিকার একটি হাত নিজের হাতে তুলে নেয়, আবেগময় কণ্ঠে বলে প্রেমিক, ‘আমি তো তাই চাই গো। চিরদিন তুমি এরকম হাস্যময়ী থাকবে। জানো, তোমার এই হাসি দেখে আমি কবিতা লিখেছি ? তুমি হাসলে পূর্ণিমার জ্যোৎস্নায় ভিজি, তুমি হাসলে কলকল নদীর তরঙ্গে ভাসি, আহা কী যে তোমার মধুর হাসি তোমার―ইচ্ছে করে…,

‘কী ইচ্ছে করে ?’

‘ইচ্ছে করছে হাসিটাসহ তোমাকেই এখন খেয়ে ফেলি।’

এগিয়ে আসা মুখের চুম্বন ঠেকাতে প্রেমিকা হাত সরিয়ে নিয়ে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ সৃষ্টি করে, ‘সর্বনাশ এভাবে বোলো না। কারণ আমার এই হাসি বিনা নোটিশেই খেয়ে ফেলেছিল সেদিনের অ্যাকসিডেন্ট। তখনকার দাঁতভাঙা রক্তাক্ত বীভৎস মুখ দেখলে কি আমাকে ভালোবাসতে পারতে ? নেভার, কেউ পারত না। নিজের ফোলা কিম্ভুতকিমাকার চেহারা দেখে নিজেই ভয় পেতাম। ওই যে দেখালাম ছেলেটাকে, ঠিক ওর মতো দেখতে উদ্ধারকারী নায়ক যদি হঠাৎ ছুটে এসে, মুখের ভিতরের রক্ত আর ভাঙা দাঁত বের করে আমাকে কোলে তুলে হাসপাতালে না নিয়ে যেত, তোমার সঙ্গে পরিচয়ও হতো না, এভাবে নিরিবিলি পার্কে বসে প্রেম করার ভাগ্য হতো না আমার।’

প্রেমিকটি হতভম্ব। পরিচয়ের পর গত এক বছরে প্রেমিকার অতীত, বর্তমান, পারিবারিক ও বন্ধুতার জগৎ সম্পর্কে অনেক তথ্যই জেনেছে সে। বিয়ের আগে পাত্র কিংবা পাত্রীপক্ষ পরস্পরের বংশপরিচয় ও পারিবারিক-সামাজিক বিষয়ে  খুঁটিনাটি যেরকম জানতে চায়, তারচেয়েও হয়তো বেশি পরস্পরকে জেনেছে তারা। এই পার্কেই আরও তিন দিনসহ এ যাবত ডেট করেছে এগারো দিন। দেখেশুনে প্রেম এতটাই গভীর হয়েছে যে, পরস্পরকে পাকা কথা দিয়েছে তারা, চাকরির জন্য এক বছর ধরে চেষ্টারত কনে যে কোনও একটা চাকরি পেলেই প্রাইভেট কলেজের লেকচারার বর বিয়ের অনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করবে। অতঃপর এই নগরীতেই ছোট্ট এক ভাড়া বাসায় শুরু হবে নবদম্পতির যৌথজীবন যাত্রা। নিজেদের হবু স্বামী-স্ত্রী জেনে আজকের দ্বাদশতম ডেটের অংশ হিসেবে মধুচন্দ্রিমা যাপনের রিহার্সেল দিতেই একত্রে নিশিযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে তারা। যুবকটির মামা-সম্পর্কের ঘনিষ্ঠ একজন নিজের ফ্ল্যাটের চাবি বিশ্বস্ত ভাগ্নেকে দিয়ে, সপ্তাহখানেকের জন্য সপরিবার কক্সবাজার বেড়াতে গেছে। যুবকের দায়িত্ব হলো দু দিন পরে গ্রাম থেকে আসা মামার বোন-ভগ্নিপতি ঢাকায় চিকিৎসার জন্য এলে ফ্ল্যাটের চাবি বুঝিয়ে দেবে। তার আগে এ দু দিন ফ্ল্যাটের একচ্ছত্র মালিক সে। রাজার হালে থাকতে পারবে নিজেও। কিন্তু রানি ছাড়া যেখানে আসল রাজাই অসম্পূর্ণ, সেখানে পরের ফ্ল্যাটে রাজার হালে একা থেকে কী সুখ পাবে সে ? স্বভাবতই প্রেমিকার কথা মনে পড়েছিল। নিজের মেসবাড়িতে নিতে পারেনি কোনওদিন। অন্যদিকে প্রেমিকার আশ্রয় মেয়েদের হোস্টেলে ঢোকারও সুযোগ পায়নি। এই সুযোগে মামার সাজানো সংসারে পুরো একদিন না হোক, অন্তত এক রাতের জন্য ডেট করলে ক্ষতি কি ? ক্ষতির আশঙ্কা যে ১%ও নেই, নানাভাবে হবু স্ত্রীকে বোঝানোর পর ফোনে সম্মতি দিয়েছে সে। প্রেমিকার সম্মতি পাওয়ার পর থেকে প্রেমিকটি আজকের রাতটি চিরস্মরণীয় করে রাখতে সম্ভাব্য কত কী যে কল্পনায় ঘটিয়েছে! এই প্রথম দয়িতাকে নিজের নগ্ন শরীর দেখাবে ভেবে আজও আয়নায় নিজেকে দেখে নিখুঁত করার চেষ্টা করেছে। ফুলশয্যার কথা ভেবে প্রেমিকার জন্য ফুলও কিনেছে। সর্বোপরি পকেটে একটা কনডমও রেখেছে। সেজেগুজে এসেছে প্রেমিকাও। রাতের নিরাপদ গন্তব্যে পৌঁছার আগে বিকেলটাও মধুরভাবে কাটানোর জন্য উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে বসেছে দুজন। হাসি-গল্পে যখন আসন্ন মধুরাত যাপনের চূড়ান্ত প্রস্তুতি চলছে, তখন আজগুবি অ্যাকসিডেন্ট এবং উদ্ধারকারী নায়কের কথা উঠছে কেন ? প্রথমে ঠাট্টা ভেবেছিল যুবকটি। কিন্তু ঘটনা শতভাগ সত্য। দুর্ঘটনার মুখস্থ দিন-তারিখও জানায় মেয়েটি। খবরটি স্থানীয় পত্রিকাতেও বেরিয়েছিল, যার কাটিং এখনও আছে তার ফটো-অ্যালবামে।

মেয়েটির তখন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রীজীবন শেষের পথে। বাংলায় মাস্টার্স ডিগ্রি নিশ্চিত করতে ভাইভা পরীক্ষাটা শুধু বাকি। ক্যাম্পাস ছাড়ার আগে হলে থেকেই বিশ^বিদ্যালয়-পরবর্তী জীবনের কথা ভাবছিল সে। স্থায়ী ঠিকানা গ্রামের বাড়ি। সেখানে ফিরলেই বাবা-মা বিয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগবে। ছেলে মোটামুটি ঠিক করেছে তারা, কিন্তু মেয়েটির মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব। স্বামীনির্ভর সংসারবন্দি হওয়ার চেয়ে স্বনির্ভর ও স্বাধীন হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল তার কাছে। কিন্তু চাকরি তো গাছের গোটা নয়। মেলা ইন্টারভিউ দিতে হবে। প্রস্তুত করতে হবে নিজেকে এবং চেষ্টা-তদ্বির করতে হবে সম্ভাব্য সকল উপায়ে। এ জন্য গ্রামের বাড়ির বদলে, রাজধানী ঢাকায় থাকতে পারলেই বিশেষ সুবিধা হবে। ঢাকায় থেকে বিশেষ কোনও কোচিং কোর্সে ভর্তি হয়ে চাকরি ও পছন্দসই বরের জন্য নিজেই চেষ্টা করবে সে। বাবার মত নেয়ার জন্য ফোনে তাকে ইচ্ছের কথা জানিয়েছে। মাকে বলেছে আরও বিশদভাবে। বিষয়টি নিয়ে স্থানীয় এক বান্ধবীর সঙ্গে আলোচনা করতে পুটিয়ায় তার বাড়িতে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে হলো থেকে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিল সে। দিনটা ছিল ২০২২ সালের ৭ ডিসেম্বর, মঙ্গলবার। তার ভাইভা পরীক্ষার ঠিক দু দিন আগের ঘটনা।

বড় রাস্তায় একটি খালি অটো তাকে প্যাসেঞ্জার ভেবে দাঁড়ায়। আরও প্যাসেঞ্জার তুলতে দেরি করবে ভেবে সে ওটাতে ওঠে না। প্যাসেঞ্জারসহ আধাখালি একটা অটোকে থামিয়ে গন্তব্য বলে উঠে বসে। বড়জোর পাঁচ কি ছয় মিনিট চলার পর, মেয়েটি যখন ঢাকা যাওয়ার বিষয়ে বাবার সিদ্ধান্ত জানার জন্য মাকে আজ রাতেও ফোন করার কথা ভাবছিল, ঠিক সে সময়ে ভাবনাটা সম্পূর্ণ না হতেই একটা দ্রুতগতি-বাসের ধাক্কায় উল্টো যায় তিন চাকার অটোটি। ‘ও মাগো!’ বলে আত্মরক্ষার জন্য চিৎকার দিয়ে সে অটোর মাঝখানের লোহার রডটি আঁকড়ে ধরেছিল, তারপর তার আর কিছু মনে নেই। বাকিটা লোকমুখে শুনেছে, স্থানীয় একটি খবরের কাগজেও পড়েছে, যার কাটিং এক বান্ধবী যত্নের সঙ্গে তার জন্য রেখে দিয়েছিল।

অটো ও বাসের মুখোমুখি ধাক্কায় অটোটি উল্টে গেলেও বাসের কোনও ক্ষতি হয়নি। একই গতিতে ছুটে পালিয়েছে। অন্যদিকে অটো উল্টে গেলেও ছয়জন যাত্রীর কেউই মারা যায়নি। শুধু চালক ও একমাত্র মহিলা যাত্রী সে, মারাত্মক আহত হয়েছিল। বাকি চারজনই উল্টানো অটো থেকে অক্ষত শরীর নিয়ে বেরিয়ে আসতে পেরেছে। কিন্তু লোহার রডের আঘাতে তার মুখ রক্তাক্ত ও দাঁতগুলি ভেঙে যাওয়ার কতক্ষণ পর সে জ্ঞান হারিয়েছিল বলতে পারবে না। লোকজন তাকে রক্তাক্ত অবস্থায় অটো থেকে টেনে বের করেছিল। রাস্তার ধারে তাকে শুইয়ে দিলে  অ্যাকসিডেন্ট দেখতে কৌতূহলী মানুষের ভিড় জমেছিল। সবার মুখে একই প্রশ্ন―‘মরছে না বাঁইচা আছে ? নাকে হাত দিয়া দেখেন। হায় নাক দিয়াও গলগল রক্ত বারাইতেছে! মরছে, ধড়ে জান আছে অহনো ?’ এসব প্রশ্নের সঠিক জবাব দেয়ার জন্য নীরবে শ্বাসপ্রশ্বাসও ফেলতে পারছিল কি না, কেউ বুঝতে পারেনি। রক্তাক্ত মুখমণ্ডলের নিচে তার অক্ষত নারী শরীর। ওড়নাটি অটোতে আটকে যাওয়ায় বুকের অবয়ব যুবতী শরীরকে এতটাই পষ্ট করে তুলেছিল যে, শরীরে হাত দিয়ে, এমনকি রক্তাক্ত নাকের কাছে হাত নিয়েও তার বাঁচা-মরা পরীক্ষা করতে সাহসী হচ্ছিল না কেউ। ঠিক এ সময়ে ভিড় ঠেলে উদ্ধারকারী নায়কই তার রক্তাক্ত শরীরের পাশে বসে হাতখানা নিজের হাতে তুলে পালস পরীক্ষা করেছে। প্রথম নাকে হাত দিয়েছে, দাঁত-ভাঙা রক্তাক্ত হা-মুখ দেখে ভয় পায়নি, বরং তাকে কাত করে দিয়ে মুখের ভিতরে রক্ত ও ভাঙা দাঁতের টুকরা ঢোকা বন্ধ করেছে। মুখ বাঁধার জন্য শুকনো কাপড় চেয়েছে ভিড়ের কাছে। ভিড়ের একজন কাঁধের গামছা এবং আরেকজন বিধ্বস্ত অটো থেকে তার ওড়নাটি এগিয়ে দিলে ওড়না দিয়েই মুখমণ্ডল বেঁধেছে যুবকটি। একই সঙ্গে আদেশ দিয়েছিল ভিড়কে, হাসপাতালে নেওয়ার জন্য খালি অটো ডাকেন একটা। উদ্ধারকারী নায়ক ভিড়ের দুজনের সাহায্যে অটোতে তুলে নিয়ে ছুটে গেছে। রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমার্জেন্সি বিভাগে তাকে ভর্তি করানোর পর ডাক্তারও ডেকে আনতে দেরি হয়নি উদ্ধারকারীর। কারণ ছেলেটি ছিল আসলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের শেষ বর্ষের ছাত্র। এশিয়া ও আফ্রিকার দরিদ্র দেশ থেকে যারা এ দেশেও উচ্চ শিক্ষা নিতে আসে, নেপালি যুবকটি ছিল তাদের একজন, নাম মহীন্দর কৈরালা। অ্যাকসিডেন্টে মেয়েটি মারাত্মক আহত হলেও, তার মোবাইল ফোনটি অক্ষত ছিল। সেই ফোন থেকে ছেলেটি আহত মেয়েটির বাবা, ডিপার্টমেন্টের এক ম্যাডাম ও দুই বান্ধবীকেও ফোন করে  জানিয়েছিল খবরটি।

হাসপাতালের ও.টিতে জ্ঞান ফিরে পাওয়ার পর ডাক্তার-নার্স ছাড়া প্রথম বাবাকে দেখেছিল সে। তারপর ক্লাসের সহপাঠী দুই বান্ধবীকে, প্রিয় প্রফেসর ম্যাডামও দেখতে এসেছিল তাকে, অভয় দিয়েছিল, ‘ভাইভা নিয়ে তুমি ভেবো না। আমি সব ম্যানেজ করে নেব।’ তখন মুখজুড়ে বাঁধা ব্যান্ডেজ, নাকে নল, দাঁতভাঙা মুখের সাদা ব্যান্ডেজেও দুঃখের কালো ছায়া দেখে ওদের চোখে-মুখে বিস্ময়-বেদনা টলমল করেছিল। হাত চেপে উষ্ণ ভালোবাসা সহানুভূতি প্রকাশ করছিল সবাই।

উদ্ধারকারী যুবকটির সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল আরও পরে, দুর্ঘটনার এক সপ্তাহ পর। নার্স পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। ভাঙা বাংলায় বলেছিল সে, ‘আমি স্যারের সঙ্গে কথা বলেছি। একদম ঠিক হোয়ে যাবেন। আর টিথ নো প্রোব্লেম, নয়া দন্ত ব্রিজ করাবেন। এখানে সেটা হোবে নাই।’ মেয়েটি জিহ্বা দিয়ে মুখগহ্বরে যে ভয়ঙ্কর অস্বাভাবিকতা অনুভব করছিল, মুখগহ্বর দেখে ব্লাকহোলের সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণ উড়ে-যাওয়ার যে আতঙ্ক বোধ সারা শরীর কাঁপিয়েছে, অচেনা উদ্ধারকারীর কথা শুনে তা অনেকটাই কেটে গিয়েছিল যেন। কৃতজ্ঞতায় চোখে পানি এসেছিল তার।

টানা সাতাশ দিন ছিল সে রাজশাহীর হাসপাতালে। মুখের ব্যান্ডেজ খোলার পরও মুখখানা ফোলাই ছিল অনেকটা, আয়নায় প্রথম নিজেকে দেখেও আঁতকে উঠেছে সে। দুর্ঘটনা তার সহজাত হাসিটাও মুছে দিয়েছিল। হাসপাতালের ডাক্তাররা কয়েকটি ভাঙা দাঁত মাড়ি থেকে তুলতে বাধ্য হয়েছিল, কিন্তু দাঁতের উপযুক্ত চিকিৎসা তারা দিতে পারেনি। রেফার করেছিল ঢাকার ডেন্টাল হাসপাতালে।

বাবা মেয়ের বিয়ে দিয়ে দায়িত্বমুক্ত হওয়ার জন্য যে টাকা জোগাড় করেছিল, সেই টাকায় দাঁতের চিকিৎসার জন্য মেয়েকে ঢাকা পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল। যে বর ঠিক করেছিল বিয়ের জন্য, দুর্ঘটনার পর সে পিছিয়ে গেছে। ঢাকায় আসার পর এক দফায় পারেনি, ছয় মাসের মধ্যে তিন দফায় বাবার সাড়ে তিন লক্ষ টাকা ব্যয় করে এই নকল দাঁত লাগিয়েছে। হাসি দেখে কেউ টের পায় না। নকল দাঁতেই বরং হাসিটা খোলতাই হয়েছে। আসলগুলি একটু বাঁকাতেরা ছিল, কিন্তু নকলগুলি সব সমান।

যুবতীর নকল দাঁতে আবার আগের মতোই হাসি ফোটে।

প্রেমিক আগের মতো মুগ্ধ হতে পারে না। কারণ চেতনায় তখনও দাঁতভাঙা দুর্ঘটনার রেশ। প্রতিদিনই খবরের কাগজ ও টেলিভিশনে সড়ক দুর্ঘটনার খবর থাকে। আহত ও নিহত হয় কত যে মানুষ! এসব খবর দেখে দুর্ঘটনার শিকারদের প্রতি বিন্দুমাত্র সহানুভূতি জাগে না, একটি দীর্ঘশ^াসও পড়ে না। কিন্তু নিজের হবু-স্ত্রীর জীবনসংশয়ী এমন মর্মান্তিক  ঘটনা সহজে ভুলতে পারে না সে।

‘আশ্চর্য, তোমার জীবনে এমন মারাত্মক দুঃখজনক একটি অ্যাকসিডেন্ট ঘটেছে, অথচ আমাকে আগে বলোনি!’ ‘মারাত্মক দুঃখের ঘটনাগুলি ভুলে থাকতে চাই। হাইওয়েতে গাড়িগুলিকে সাবধানে চলার জন্য অনেক সতর্কবার্তা লেখা থাকে। এক জায়গায় লেখা দেখেছি, একটি দুর্ঘটনা সারা জীবনের কান্না। কিন্তু এ কথাটা বোধ হয় ঠিক না। কোনও মানুষই সারাজীবন কাঁদতে চায় না। দুর্ঘটনায় যার হাত-পা ভাঙা, সেও কৃত্রিম পা লাগিয়ে খুঁড়িয়ে চলে, এমনকি চিরশয্যাশায়ী মানুষকেও হাসতে দেখেছি আমি। অন্যদিকে আমার অ্যাকসিডেন্ট তো আমার বড় সৌভাগ্যেরও কারণ হয়ে উঠেছে।’

‘কী রকম ?’

‘বাড়ি থেকে বিয়ের জন্য যে ছেলে ঠিক করেছিল, আমার অ্যাকসিডেন্টে সেই বিয়ে ভেঙে দিয়েছে। বাবা ঢাকা পাঠাতে চায়নি। বিয়ের জন্য যে টাকা জোগাড় করেছিল, সেই টাকায় ঢাকা পাঠিয়ে দাঁতের চিকিৎসা করিয়েছে। চাকরির জন্য নিজেকে প্রস্তুত করতে বিএড পড়াচ্ছে। সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য, ঢাকায় এসেছি বলে তোমাকেও পেয়েছি। আর কথায় আছে না, সবার জীবনে তিনটি বড় ফাঁড়া থাকে। আমার কিন্তু তিনটাই ঘটে গেছে।’

‘তার মানে এই অ্যাকসিডেন্টের আগেও অ্যাকসিডেন্ট ঘটেছিল ?’

‘অ্যাকসিডেন্ট ঠিক নয়, ছোটবেলায় অ্যাপেনডিসাইটিস অপারেশন হয়েছে। ডাক্তার বলেছিল, হাসপাতালে নিতে আর এক ঘণ্টা দেরি হলেই মরে যেতাম। মরিনি। আর করোনার সময় আমারও করোনা মারাত্মক হয়েছিল, সেটা তোমাকে বলেছি বোধহয়।’

‘আচ্ছা, তোমার সেই উদ্ধারকারী নেপালি নায়ক এখন কোথায় ?’

‘জানি না। হাসপাতালে কয়েক দিন দেখা হয়েছিল, কথাও হয়েছে। তখন শুনেছিলাম, পাস করার পর দেশে চলে যাবে, সেখানকার হাসপাতালে চাকরি করবে, প্রাকটিস করবে।’

‘ঠিক আছে, বিয়ের পর আমরা হানিমুনে প্রথম নেপালে যাব। তখন খুঁজব তোমার জীবন রক্ষাকারী নায়ককে, শুধু তোমার না, আমার ধন্যবাদ-কৃতজ্ঞতাও তার পাওনা।’

‘আশ্চর্য, আমার গোপন চিন্তাটি তুমিই আগে প্রকাশ করলে! জানো, নেপাল কি হিমালয়ের কথা উঠলে আমার সেই নেপালি যুবকটির কথা মনে পড়ে। আর মনে মনে ভাবি, আহা ওই দেশে গিয়ে যদি আবার কোনও ঘটনাচক্রে তার সঙ্গে দেখা হতো।’

‘নিশ্চয়ই খুঁজে বের করতে পারব, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে গিয়ে খোঁজ নিলে তার নেপালি ঠিকানা পাব। আর আমাদের হানিমুনের প্রোগ্রাম নেপালেই করব অবশ্যই। টাকা জমাচ্ছি। তোমার উদ্ধারকারী নায়ককে খুঁজে বের করে বলব, আপনি সেদিন আমার ডার্লিংকে না বাঁচালে তাকে নিয়ে হানিমুনে আসা হতো না।’

‘কিন্তু তার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর যদি জানতে পারো, হাসপাতালে ঠিকভাবে চিকিৎসা দিয়ে আমাকে ভালো করার পর আমাকে সে ভালোবেসেছিল, নেপালে আমাকে দেখে যদি তার কাছেই থেকে যেতে বলে, তবে নিজের জীবনবাঁচানো নায়ককে না করতে পারব আমি ?’

কল্পনায় প্রেমিকার অ্যাকসিডেন্টের ছবি দেখে প্রেমিক যতটা চমকে উঠেছিল, তার চেয়েও বেশি চমকে ওঠে। অপলক তীক্ষè দৃষ্টিতে তাকিয়ে জানতে চায়, ‘তার মানে হাসপাতালে সেরকম সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল ? তোমাকে ভালোবাসার কথাও বলেছিল সে ?’

যুবতী এবার ভালোবাসা পাওয়ার আনন্দেই যেনবা  হাসিতে উচ্ছল হয়। বলে, ‘তুমি আসলে খুব হিংসুটে। এমনি বললাম। তবে ধরো, বিয়ের আগে আমরা যদি হানিমুনে নেপালে যাই, আর উদ্ধারকারী নায়ক আমাকে ভালোবাসার কথা বলে, তাকে চট করে ফিরিয়ে দিতে পারব না। কিন্তু বিয়ের পর গেলে বিয়ে-করা নতুন স্বামীকে ত্যাগের চিন্তাও করতে পারব না। ঠিক না ?’

কী এক রহস্যের ধূসর বোরখায় নিজেকে আবৃত করে। কী লুকাতে চায় ? বোঝার জন্য যুবকটি তাকিয়েই থাকে। মনে হয়, প্রেমিকার মনের রহস্য ভেদের চেয়েও নির্জন ফ্ল্যাটে গিয়ে তার অনাবৃত শরীরের রূপসুধা পানও অনেক আনন্দের হবে, নেপালি যুবকের ছায়াও সেখানে থাকবে না।

‘এই কী হলো ? কী দেখছো এমন করে ?’

‘বিয়ে রেজিস্ট্রি হওয়ার পরই আইনসঙ্গত স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই আমরা নেপালে হানিমুনে যাব। তখন যদি নেপালি নায়ক তোমাকে ভালবাসার কথা বলতে আসে, তার পাছায় অবশ্যই লাথি মারব।’

যুবতী হাসির তরঙ্গে নিজেই গড়িয়ে পড়ে প্রেমিকের গায়ে আদুরে চাপড় দিয়ে বলে, ‘বলেছি না তুমি আসলে খুব হিংসুক। ঠিক আছে, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, চলো কোনও নিরিবিলি রেস্তোঁরায় বসে চা-কফি খাই। বাবা টাকা পাঠিয়েছে, আমি খাওয়াব আজ তোমাকে।’

‘তারচেয়ে মামার ফাঁকা ফ্ল্যাটে গিয়ে আমার হবুস্ত্রী নিজ হাতে যদি চা বানিয়ে খাওয়ায়, অনেক বেশি ভালো লাগবে আমার। চলো, এখন রওয়ানা দিলে পৌঁছতে সন্ধ্যা পেরুবে। রাতের খাওয়ার ব্যবস্থাও সেখানে করে রেখেছি আমি।’

‘পরের সাজানো সংসারে আমাদের আজ চোরের মতো ঢুকতে হবে। যতই বলো একটু ভয়-অস্বস্তি তো হবেই। কিন্তু বিয়ের পর যদি নিজেদের ঘরে টানা কয়েক দিন হানিমুন করি, কারও কিছু বলার থাকবে, ভয়-ডর থাকবে ?’

‘ওয়েস্টার্ন দেশগুলোতে বয়ফ্রেন্ড-গার্লফ্রেন্ড এক বাসায় থাকছে, লুকাবার কিছু নেই। আমাদের দেশেও কিন্তু অনেক প্রেমিক-প্রেমিকা বিয়ে করতে দেরি হচ্ছে বলে অভিভাবকদের না জানিয়ে স্বামী-স্ত্রী পরিচয়ে এক বাসায় থাকছে। ভার্সিটিতে পড়ার সময়েও অনেকে থাকছে। আমরা তো থাকব শুধু এক রাত, কেউ কোনওদিন জানতেও পারবে না। তবু তোমার এত ভয় দ্বিধা কেন ? তোমার ওই শরীর নিয়ে খেলার অধিকার আমি ছাড়া আর কাকে দেবে বলো ?’

‘ছি, কী যে বলো। আসলে শরীর কি শুধু খেলাধুলার জন্য ? আমি বিয়ের পর তোমার সন্তানের মা হওয়ার সময়ও ভেবে রেখেছি। আমাদের মতো টানাপোড়েনের মধ্যবিত্ত পরিবারে মেয়েদের মা হওয়া ছাড়াও বাবা-মা ভাই-বোনের উপর কত রকম দায়িত্ব পালনের কথা ভাবতে হয়। এ জন্যই তো বিয়ের আগে চাকরিটাকে এত গুরুত্ব দিচ্ছি।’

‘ঠিক আছে বাবা, তোমার চাকরিটার জন্য তো মিলনের স্বর্গীয় আনন্দ থেকে নিজেকে বঞ্চিত রেখেই যাচ্ছি। শুধু একটা রাতের ডেটে তোমার শরীর-মন কোনওটাই অপবিত্র হবে না।’

‘কিন্তু অপবিত্র যে হয়ে গেছি! তুমি শুনলে হতাশ হবে, এ জন্য ফোনে বলিনি। কাল রাতেই মাসিক শুরু হয়েছে আমার। এ সময়টায় আমার শরীরও বেশ খারাপ থাকে। কাজেই তোমার আজকের মামার ফ্ল্যাটের প্রোগ্রামটা বাদ দাও। তার বদলে চলো, এখন কোনও নিরিবিলি রেস্টুরেন্টে। আমি আজ খাওয়াব তোমাকে।’

পার্কে বিকেলের আলো-ছায়ার খেলা বন্ধ হয়েছে। বাতাসের স্পর্শ না পেয়ে গাছগুলো বিষণ্ন গম্ভীর হয়ে উঠেছে যেন। যুবকের মুখের হাসি মিলিয়ে যায়। দৃষ্টির তরবারি এত ধারালো নয় যে, অন্তর্বাস কেটেছিঁড়ে প্রকৃত প্রাকৃতিক সত্যমিথ্যে বুঝতে পারবে। যুবতী উঠে দাঁড়িয়েছে। হাত থেকে অমূল্য কিছু ছিটকে পড়ার ভয় নিয়ে উঠে দাঁড়ায় যুবকটিও।

‘তোমার শরীর খারাপ থাকলে জোর করে আমি কিছু করব ? তুমি আসলে আমাকে বিশ্বাস করতে পারছো না!’

‘নিজেকেই বিশ^াস করতে পারি না অনেক সময়। চলো, সন্ধ্যা হয়ে আসছে, তোমাকে কফি খাওয়াব।’

চুপচাপ, পাশাপাশি হাঁটে ওরা। পার্ক থেকে বেরিয়ে, প্রশস্ত রাস্তার ফুটপাথ ধরে। জ্যামে যানবাহনের স্রোত থমকে গেলেও, রুদ্ধ স্রোতধারা থেকে বিকট যান্ত্রিক আওয়াজ উঠছে যেন। ফুটপাথের লাইটপোস্ট ও রাস্তার যানহানের চটকানো ছিন্নভিন্ন আলোয় ছেলেটি তার প্রেমিকার মুখের সেই উচ্ছল হাসি দেখতে পায় না। সহসা সচল হয়ে ওঠা জ্যামের একটি বড় বাসের জ্যান্ত হয়ে ওঠার গর্জনে মেয়েটার সেই দাঁতভাঙা দুর্ঘটনার দৃশ্য চোখের সামনে লাফায় যেন। প্রকাশ্য রাস্তাতেও মেয়েটির হাত চেপে ধরা ছেলেটা। এভাবে জোড় বেঁধে চলতে থাকলে, আজকের রাতের হানিমুন প্রোগ্রামটি মাটি করে দেওয়ার মতো আরও কত রকম দুর্ঘটনা যে সামনে ঘটবে কে জানে!

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button