আর্কাইভগল্প

গল্প : আমি দেখতে আমার বাবার মতো : বিশ্বজিৎ চৌধুরী

ঢাকা এয়ারপোর্টের বাইরে এসে প্রথমে ভড়কে গিয়েছিলাম। প্রচণ্ড হৈ-হল্লা। আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধুদের অভ্যর্থনা জানাতে আসা লোকজন, যাত্রী পাওয়ার আশায় দাঁড়িয়ে থাকা গাড়ির চালকগণ, যাত্রীদের ব্যাগ বা ট্রলি এগিয়ে দিয়ে বখশিসের আশায় মুখের দিকে তাকিয়ে থাকা বিমানবন্দরের কর্মী―সবাই যেন উচ্চস্বরে কোরাস গাইতে শুরু করেছে। অবশ্য ধাতস্থ হতে আমার খুব বেশি সময় লাগল না। যত যা-ই হোক দীর্ঘ প্রবাসজীবন কাটিয়েও শেষ পর্যন্ত আমি এ দেশেরই তো মানুষ। আমার বরং হাসি পাচ্ছে, কিছুটা করুণাও হচ্ছে সেই বিদেশিদের জন্য যারা প্রথমবারের মতো নতুন একটি দেশে পা রাখল। ওদের কেউ যদি এই প্রচণ্ড কোলাহলে ভয় পেয়ে উল্টা দিকে ছুটে আবার বিমানবন্দরের ভেতর ঢুকে পড়ে, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।

অদিতি বলল, ‘এই হচ্ছে জীবন, বুঝলে, এটাই জীবন! এই উচ্ছ্বাস, এই প্রাণের স্পন্দন, বিশ্বাস করো এটাই আমি মিস করি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলা বিভাগের ছাত্রী, এককালে ছায়ানটে গান শিখত। কথা বলার সময় তার সুন্দর শব্দ বাছাইয়ের ব্যাপারটা আমি খুব উপভোগ করি। এই যেমন ‘প্রাণের স্পন্দন’ শব্দটা আমার ভেতর রীতিমতো সংক্রমিত হলো, একেবারে যথার্থ শব্দ বাছাই। তবে তার ভেতর আবার উন্নাসিকতাটাও নেই, খাইছি, গেছি, পাইছি শব্দগুলো নিজে ব্যবহার করে না বটে, কিন্তু কেউ বললে বিরক্ত হয় না, বরং আমার তো মনে হয় বেশ উপভোগই করে।

‘এই বিশৃঙ্খলাকে তোমার উচ্ছ্বাস… প্রাণের স্পন্দন ইত্যাদি মনে হচ্ছে ?

‘নিশ্চয়ই, এতদিন পর আত্মীয়-স্বজনকে কাছে পেয়ে কেউ উঁচু গলায় খুশি-আনন্দ প্রকাশ করছে, কেউ প্যাসেঞ্জারকে তার গাড়িতে তোলার জন্য একটু বাড়তি ভুজুং ভাজুং দিচ্ছে… খারাপটা কী দেখলে ?’

‘ভুজুং ভাজুং! এরকম কিছু শব্দও তাহলে জানা আছে তোমার ?’ ঠাট্টা আর বিস্ময় মেশানো ছিল প্রশ্নে।

‘কেন জানা থাকবে না ? কী মনে করছো মিয়া, স্টুডেন্ট লাইফে আড্ডা তো ছিল চারুকলার পুংটা পোলাপাইনের লগে।’

‘পুংটা!’ আবার ঠোঁটের কোণে হাসলাম আমি।

বোঝা গেল দারুণ এক ফুর্তির মেজাজে আছে। এতটাই ফুর্তি যে আজ অনেক দিন পর হয়তো মার্জিত রুচি ও ব্যবহারের আড়ালটাও ভাঙতে ইচ্ছে করছে। আমারও বেশ লাগছে। পরীক্ষায় বরাবর ভালো রেজাল্ট করলেও ক্লাসের চেয়ে টিএসসি ও সংলগ্ন এলাকা যে তার প্রকৃত চারণক্ষেত্র ছিল এ কথা নিজেই আমাকে বলেছিল অদিতি। ছায়ানটের সুরুচির সংস্পর্শে থেকেও চারুকলার কতিপয় উরাধুরা বন্ধুর সান্নিধ্য যে তার তুলনামূলক বেশি উপভোগ্য মনে হতো এ কথাও বলেছে।

‘আমরা কি এখানে দাঁড়িয়েই থাকব ?’ হঠাৎ আহ্লাদী কিশোরী বনে যাওয়া স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলাম আমি।

 ‘খুব ভালো লাগছে আসলে। এই যে হাওয়া, এখানে বুক ভরে শ্বাস নেওয়ার মধ্যেও ফ্রেশ একটা ব্যাপার আছে।’

এবার সশব্দে হাসলাম আমি, ‘ফর ইয়োর কাইন্ড ইনফরমেশন, এয়ার পলিউশনের দিক থেকে কিন্তু ঢাকা শহর পৃথিবীর এক বা দুই নম্বরে আছে।’

তাৎক্ষণিক এমন একটা তথ্য হাজির হওয়াতে একটু বিব্রত হলো, তারপর কিছুটা ম্লান হেসে বলল, ‘মুজতবা আলীর দেশে বিদেশে বইটির চরিত্র আবদুর রহমানের কথা মনে আছে ? সে বলেছিল, ইনহাস্ত ওয়াতানাম। আমিও বলি, ইনহাস্ত ওয়াতানাম, এই তো আমার জন্মভূমি।’

অদিতির এই আবেগ না বোঝার কথা নয় আমার। বরং তারচেয়ে হয়তো একটু বেশিই বুঝি, কারণ অদিতির জার্মানপ্রবাস পর্ব বছর চারেকের, তার মধ্যে দুবার ঘুরেও গেছে দেশে। আর আমি দেশে ফিরলাম প্রকৃত অর্থেই এক যুগ অর্থাৎ বারো বছর পর।

 এই যে এতগুলো বছর যে আমার দেশে আসা হলো না, তার প্রধান কারণ আমার বাবা। আমি দেশে ফেরার প্রস্তুতি নিলে তিনি নিজেই চলে গেছেন জার্মানি। এ এক অদ্ভুত মানুষ। চিরকাল আমার শিক্ষা, আমার উন্নতি নিয়ে ভাবতে ভাবতে তাঁর নিজেরই একটা জীবন পেরিয়ে গেল। দার্জিলিংয়ের বোর্ডিং স্কুলে যখন পড়াশোনা করেছি, তখনও সেই কম বয়সে ছুটির সময়ে কবার যে দেশে ফিরতে পেরেছি তা হাতে গুনে বলতে পারব। স্কুলের ছুটির সময়ে, প্যারেন্টস ডেতে যেমন, তেমনি টেকনিক্যাল স্কুল অব বার্লিনের ছোটখাটো অনুষ্ঠান থেকে কনভোকেশন পর্যন্ত সবকিছুতেই আমার বাবা হাজির। শুধু বিত্তবান হলে তো হয় না, তাঁর মতো চৌকস সপ্রতিভ মানুষ জীবনে কম দেখেছি আমি। সহপাঠীদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে গৌরব বোধ করতাম, বাবাও খুব সহজে মিশে যেতে পারতেন আমার বন্ধু-সহপাঠীদের সঙ্গে। সত্যি কথা বলতে কী, আমার অন্তত বাঙালি সহপাঠী বন্ধুদের মধ্যে কারও এমন পিতৃভাগ্য ছিল না। এই স্মার্ট লোকটার কথা ছাত্র-শিক্ষক অনেকেই নানা সময়ে বলেছে। বন্ধুরা বলত, তুমি হুবহু তোমার বাবার চেহারা-ফিগারটা পেয়েছ। এটা যে আমার জন্য কত বড় কমপ্লিমেন্ট! কারণ সেখানে সেই দীর্ঘদেহী জার্মানদের ভিড়ে অমার বাবা হারিয়ে যেতেন না, আলাদা করে চেনা যেত তাঁকে। অদিতির সঙ্গে আমার সম্পর্কের পেছনেও লোকটার হাত ছিল। বার্লিনে বাঙালিদের একটি অনুষ্ঠানে পরিচয় হয়েছিল আমাদের। বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা বর্ষবরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করেছিল। সে সময় বার্লিনে আমার বাবাও উপস্থিত ছিলেন অনুষ্ঠানে।

নানা বয়সের মানুষ জড়ো হয়েছিল। শাড়ি ও পাঞ্জাবির ছড়াছড়ি। প্রবাসে এসব ব্যাপারে আদিখ্যেতার সীমা নাই। অদিতি সেখানকার সাংস্কৃতিক দলের একজন। ফলে সাদা শাড়ি লাল পাড়, চুলে সাদা ফুল ইত্যাদি পরিহিতা মেয়েটিকে দেখে আমার মধ্যে ‘বাঙলার রূপ আমি দেখিয়াছি…’ ধরনের কিঞ্চিত আবেগও উথলে উঠেছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই, এই একটি জায়গায় আমার বাবার ঠিক উল্টো স্বভাবের, অত্যন্ত মুখচোরা। আমি আমার পক্ষে নানা স্তুতি গেয়ে একটি বাঙালি মেয়ের কাছে ঘেঁষা বা প্রেম নিবেদন করা দূরে থাক, কথা বলাও সম্ভব হতো কিনা জানি না। কিন্তু ওই যে সপ্রতিভ মানুষটা, আমার বাবা, আমার খুব কাছে ঘেঁষে নিচু গলায় বলেছিলেন, ‘ওই মেয়েটা… ওই যে আঁচল ঠিক করছে, তিনজনের মাঝখানে দাঁড়ানো, সাদা ফুল…।’

‘হ্যাঁ।’

‘কার কথা বলছি বুঝতে পারছিস ?’

‘হ্যাঁ, মাঝখানে ওই সুন্দর মেয়েটা ?’

‘অ্যাকজাক্টলি, ওই সুন্দর মেয়েটা…। ওর সঙ্গে তোর আলাপ-পরিচয় হয়েছে ?

‘না। এমনিতে নানা সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখাটেখা হয়েছে।’

‘কী আশ্চর্য, আজকালকার দিনের একটা ছেলে, নিজেই বলছে মেয়েটা সুন্দর… তার সঙ্গে আলাপ-পরিচয়টা করতে পারে না ?’

‘না, মানে যেচে পড়ে আলাপ করতে যাওয়াটা…।’

‘আরে, যেচে পড়ে মানে ? তুমি যেচে আলাপ না করলে সে কেন যেচে তোমার সঙ্গে আলাপ করতে আসবে ?’

কথা ঠিক। অদিতির মতো মেয়েকে দেখে আমার বোঝা উচিত ছিল। সে তার চারপাশে রঙ ছড়িয়ে প্রজাপতির মতো উড়ে বেড়াবে, কিন্তু যেচে আলাপ করতে আসবে না। কিন্তু বুঝেও বা কী হবে, আমি তো আমার বাবার মতো সেই অর্থে চৌকস ব্যক্তি নই। এত বছর দেশ-বিদেশ ঘুরেও আমাকে বরং আমার গ্রাম্য… না গ্রাম্য নয়, অদিতির ভাষায় বরং গ্রামীণ বলা ভালো, আমার গ্রামীণ স্বভাবের মায়ের মতো একটু লাজুক বা মুখচোরা।

‘তোমার মা না হয় গ্রামের মেয়ে, বেশি দূর লেখাপড়ার সুযোগ পাননি, কিন্তু তুমি কেন ?’

‘আরে বাবা আমি সেই ছোটবেলায় ঢুকে পড়েছি ছেলেদের বোর্ডিং স্কুলে, মেয়েদের সঙ্গে মেশার সুযোগ কোথায় ? আমাদের সঙ্গে কিছু ফাজিল টাইপের ছেলে ছিল মেয়েদের স্কুল ছুটি হলে সার বেঁধে হেঁটে যাওয়া মেয়েদের দিকে তাকিয়ে নানা অঙ্গভঙ্গি করত, নানা মন্তব্য ছুড়ে দিত। আমি এসব করতাম না।’

‘তুমি কী করতে ? হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে ?’

‘না, ঠিক হাঁ করে নয়, তবে তাকিয়ে থাকতাম। একটা কৌতূহল ছিল। আগ্রহ ছিল, তাকিয়ে থাকতাম…।’

হেসে ফেলেছিল অদিতি, ‘থ্যাংক ইউ ফর অনেস্ট কনফেশন।’

‘কী করি, স্টুডেন্ট লাইফটা তো ঘরের বাইরেই কেটেছে, স্টুডেন্ট লাইফ কেন, এই বয়স পর্যন্ত পরিবারের সঙ্গে ছিলামই বা কদিন ? কাজিনদের সঙ্গেই তো মেলামেশার সুযোগ পেলাম না।’

‘সেটা একটা সমস্যা তো বটেই। তবে মেলামেশার বা সম্পর্ক তৈরির আরও কিছু সুযোগ ইদানীং আছে।’

‘তা আছে। এই যেমন সোশ্যাল মিডিয়া, কিন্তু এটা নট মাই কাপ অফ টি।’

তো, শেষ পর্যন্ত আমার সপ্রতিভ পিতাই তাঁর মুখচোরা ছেলের গতি করেছিলেন। যেচে পড়ে বেশ আলাপ জমিয়ে ফেলেছিলেন অদিতির সঙ্গে। বাংলাদেশে তার কোথায় বাড়ি, বাবা-মা কী করেন ইত্যাদি নানা ঠিকুজি সংগ্রহ করে একদিন আমাকে বললেন, ‘বাঙালি হিন্দু পরিবারের মেয়ে, বাবা ডাক্তার, সব দিক দিয়েই আমাদের সঙ্গে একটা সম্পর্ক করার জন্য উপযুক্ত।’

‘কিন্তু আমাকে সে উপযুক্ত মনে করে কিনা ?’

আমার এ প্রশ্ন শুনে প্রচণ্ড বিরক্ত হয়েছিলেন মনে আছে, বলেছিলেন, ‘তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে তুমি নিজেকে উপযুক্ত মনে করো কি না।’

ভ্যাবাচেকা খেয়েছিলাম। কঠিন প্রশ্ন, আমি কি নিজেকে উপযুক্ত মনে করি ? কেন নয়, বুয়েট থেকে স্থাপত্যকলায় গ্র্যাজুয়েশন করে বার্লিনে উচ্চতর সনদ নিয়েছি। বেশ ভালো একটি অবস্থান তৈরি হয়েছে, সে দেশে আমার মতো মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে আছে খুব কমসংখ্যক বাঙালি। অর্থকড়ি যথেষ্ট। সুতরাং আমি নিজেকে উপযুক্ত মনে না করার কোনও কারণই তো নেই। কিন্তু অনেক কিছু থাকলেই তো হলো না, ছোট একটা কিছুর অভাবে সব থেকেও নেই হয়ে যেতে পারে। সেটাই ছিল না আমার, আপনারা যাকে বলেন, স্মার্টনেস। অদিতির মতো একটি মেয়ের সামনে দাঁড়িয়ে আমি বলতে পারব না তাকে আমার খুব পছন্দ, এমনকি আমি তাকে বিয়ে করতে চাই। না, এটা আমাকে দিয়ে কিছুতেই হবে না।

আমার বাবা বিদেশ-বিভুঁয়ে কয়েক দিনের জন্য বেড়াতে এসে দিব্যি পাকড়াও করে আমার সামনে এনে দাঁড় করিয়েছিলেন অদিতিকে। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলেছিলেন, ‘এই আমার ছেলে শান্তনু, আর্কিটেক্ট… অনেক বছর ধরে বার্লিনে আছে।’

আমি কথা খুঁজে পাচ্ছিলাম না, সম্ভবত প্রথম প্রশ্নটা করেছিলাম, ‘আপনি কোথায় থাকেন ?’

‘ব্র্যান্ডেনবার্গ, খুব একটা দূরে না।’ অদিতি বলেছিল।

ব্যস, পরিচয়ের সূত্রটা ধরিয়ে দেওয়ার পর আর কিছুই করতে হয়নি বাবাকে। অদিতি আমার চেহারায় একটা গদগদ ভাব দেখতে পেয়েছিল। বুঝতে পেরেছে বাদবাকি দায়িত্ব পালন করতে হবে তাকেই। সে-ই শেষ পর্যন্ত পথঘাট চিনিয়ে আমাকে লাভ লেনে এনে তুলেছিল।

‘কী হলো একদম চুপচাপ হয়ে গেলে ? কী ভাবছো ?’

অদিতির প্রশ্নে আবার ঢাকা বিমানবন্দরে ফিরে এলাম আমি। বললাম, ‘না, বাবার কথা মনে পড়ল।’

অদিতির চোখে একটু সহানুভূতি দেখতে পেলাম। আমার বাবা মারা গেছেন এক সপ্তাহ আগে। শেষ দেখাটা হয়নি। আমার তো আর কোনও ভাই-বোন নেই, এক কাকা আছেন, তিনি ফোনে জানতে চেয়েছিলেন আমি দেশে কখন আসব, না আসা পর্যন্ত মৃতদেহ ফ্রিজারে রাখবেন কিনা।

আমার জন্য অপেক্ষা না করে সৎকার করে ফেলতে বলেছিলাম আমি। কারণ দু-তিন দিনের মধ্যে সব কাজকর্ম গুছিয়ে দেশে আসা সম্ভব ছিল না আমার পক্ষে। এতদিনে সময় হলো।

একটা ভাড়া গাড়িতে উঠলাম আমরা। আমি একটা উবার ডাকতে চেয়েছিলাম। কারণ আমার দু-একজন বন্ধু পরামর্শ দিয়েছিল কিছুতেই যেন অপরিচিত ড্রাইভারের পাল্লায় না পড়ি। তারা বিদেশ থেকে আসা যাত্রী পেলে বেপথে নিয়ে গিয়ে সর্বস্ব হাতিয়ে নিতে পারে, এমনকি শারীরিকভাবে আক্রমণও করতে পারে। আমার এ কথা কিছুতেই মানতে পারেনি অদিতি। তার মতে, এসব হচ্ছে অপপ্রচার। ঢাকা শহরে এক বছর আগেও ঘুরে গেছে সে, এই শহর মোটেও এরকম বিপজ্জনক হয়ে ওঠেনি। নিজের কথা যে সত্য তা প্রমাণ করার জন্যই বোধকরি উবার ডাকার পরিবর্তে ড্রাইভারের সঙ্গে দরদাম করে একটা গাড়ি ভাড়া করেছে সে। ঢাকা এখনও পৃথিবীর অনেক বড় শহরের চেয়ে নিরাপদ এটা হাতেনাতে আমাকে বুঝিয়েই ছাড়বে।

বেশ খুশি চেহারার একজন যুবাবয়েসী চালক। আমাদের প্রায় সাহায্য ছাড়া একাই বড় দুটো লাগেজ টেনে তুলল ক্যারিয়ারে। গাড়িতে বসে হাসিমুখে জানতে চাইল, আমরা গান শুনতে চাই কিনা, আমি ইশারায় না করলাম। একটু হতাশা প্রকাশ পেল তার অভিব্যক্তিতে। গাড়ি চলতে শুরু করল ঢাকার রাস্তায়। এক যুগ পর আমার দেশকে দেখছি আমি কাচের জানালা দিয়ে। এতটা পাল্টে গেছে ভাবতে পারিনি। বিশেষ করে এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পূর্ণগতিতে গাড়ি ছুটে যাওয়ার সময় মনেই হচ্ছিল না ঢাকায় আছি। চালক হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনারা কি স্যার হাজব্যান্ড ওয়াইফ ?’

প্রশ্নটা আমার উদ্দেশে, কিন্তু আগ বাড়িয়ে অদিতি উত্তর দিল, ‘হ্যাঁ।’

‘দ্যাশের বাড়ি কোথায় ?’ আবার জানতে চাইল।

আমার ভ্রƒকুঞ্চন উপেক্ষা করে অদিতি উত্তর দিল, ‘ওর বাড়ি চট্টগ্রামে, আর আমার দিনাজপুর।’

‘দিনাজপুর।’

এত জোরে ও বিস্ময়ের সঙ্গে জেলাটির নাম উচ্চারণ করল, আমার মনে হলো যেন গাড়িটাই কয়েক ইঞ্চি লাফ দিয়ে উঠেছে সড়ক থেকে। পরমুহূর্তেই কারণটা জানতে পারলাম। চালক যুবকটির বাড়িও দিনাজপুরে। এবার দুজনের মধ্যে আরও নানাবিধ ‘দেশোয়ালী’ আলাপ-আলোচনা শুরু হলো। অদিতি অনায়াসে চালকের কাছে জানতে চাইল, সে বিবাহিত কিনা এবং তার সন্তানাদি আছে কিনা। হাসিখুশি চেহারার কমবেশি ত্রিশ বয়েসী চালক উত্তর দিল, সে বিবাহিত তো বটেই তার দুটি কন্যা ও একটি পুত্র রয়েছে। আমরা এখনও নিঃসন্তান জেনে চালক অনায়াসে পরামর্শ দিল আমাদের দ্রুত সন্তান নেওয়া উচিত, এসব ব্যাপারে দেরি করা ঠিক নয় ইত্যাদি।

এক প্রকার বাধ্য হয়েই আমি চালকের জন্য অবোধ্য জার্মান ভাষায় অদিতিকে বললাম, সদ্য পরিচিত একজন লোকের সঙ্গে এতটা ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে আলাপ চালিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। অদিতিও জার্মান ভাষাতেই আমাকে উত্তর দিল, এই জিনিসটাই দীর্ঘদিন ধরে প্রবাসজীবনে মিস করে আসছে সে। নতুন পরিচিত একটা লোকের সঙ্গে অনায়াসে ভাব জমিয়ে ফেলা, দুটি সুখ-দুঃখের কথা বলা―এসব ব্যাপার ওখানে কল্পনাই করা যায় না। ‘পাথরমুখা’ জার্মানগুলো প্রাণ খুলে কথা বলতে জানে না, ভালো করে হাসতে পর্যন্ত জানে না… ইত্যাদি।

অগত্যা বিনা বাক্যব্যয়ে আমি আবার কাচের জানালা দিয়ে বদলে যাওয়া ঢাকা শহর দেখতে থাকি। আর দুই ‘দেশোয়ালী’ মহাউৎসাহে অভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে থাকে। গাড়ি আমাদের হোটেলের সামনে এসে দাঁড়ালে চালক ও যাত্রীর মধ্যে অন্তরঙ্গ বিদায়পর্ব দেখে অবশ্য আমারও একবার মনে হলো এত কম সময়ের মধ্যে এমন আত্মীয়তার সম্পর্ক গড়ে ওঠা পৃথিবীর আর কোন দেশেইবা সম্ভব!

হোটেলের কামরায় বসে একের পর এক ফোন করতে শুরু করল অদিতি। ওর মা-বাবা আছেন দিনাজপুরে, তাঁদের সঙ্গে কথা হলো। বন্ধু-বান্ধবী যারা ঢাকা শহরে আছে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করে সন্ধ্যার মধ্যে অদ্ভুত দক্ষতায় আমাদের হোটেলের লবিতেই একটি পুনর্মিলনীর আয়োজন করে ফেলল।

কী আশ্চর্য, আমার ফোন করার কেউ নেই। একটাই লোক ছিলেন, তিনি সম্প্রতি ইহজগত ছেড়ে গেছেন।

আমার বাবার কারণেই এই দেশে আমার কোনও বন্ধু-বান্ধব নেই। সেই স্কুলবেলাতে দেশের বাইরে পড়তে পাঠিয়েছিলেন। ফেরা আর হয়নি, এক দেশ থেকে অন্য দেশে শুধু ছুটেছি। নিজের দেশকে জানা তো হলোই না, নিজের মাকেও চিনলাম না। মা বলতে আবছা তার কোলের ওম, গভীর আলিঙ্গন, আলিঙ্গন না বলে আঁকড়ে ধরা বললে যর্থার্থ হয়, মুখের কাছে নাক ঠেকিয়ে হুমহাম শব্দ আর একটু অদ্ভুত গন্ধের কথা মনে আসে। এর মধ্যে কতটা সত্য, আর কতটা আমার কল্পনা ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। কেননা কোলের বয়সের স্মৃতি তো মানুষের মনে থাকার কথা নয়।

প্রবাসে থাকার সময় মায়ের সঙ্গে তেমন কথা হতো না আমার। কী আশ্চর্য, এই জমানায় আমার মায়ের একটা ফোন নাই। এ নিয়ে অদিতিও বিস্ময় প্রকাশ করেছে কবার। কখনও বাবার সঙ্গে কথোপকথনের সময় মার হাতে ফোন তুলে দিতেন তিনি। আমার মা তার নিজের ছেলের সঙ্গে আড়ষ্ট কণ্ঠে, কেমন আছো, শরীর ভালো কিনা বা বউমা কেমন আছে ধরনের দু একটি কথা বলে ফোন ছাড়ত।

    আমাদের বাপ-ছেলের মধ্যে আমার মায়ের প্রসঙ্গ উঠতই না বলতে গেলে। মা কেমন আছে জানতে চাইলে, ‘আছে, ভালোই আছে…’ এরকম দু-এক শব্দে প্রসঙ্গটা শেষ করতে চাইতেন। কিছুদিন আগে একবারই শুধু বলেছিলেন, ‘আজকাল তোমার মাকে একটু মেন্টালি ডিস্টার্বড মনে হয়।’

‘কেন ?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

দীর্ঘশ্বাস চাপা রেখে বলেছিলেন, ‘জানি না। ডাক্তার দেখাচ্ছি।’

সন্ধ্যা নেমে গেছে। এ দেশে বসন্ত ঋতুতে দ্রুত নামে সন্ধ্যার অন্ধকার। বসন্ত যে বুঝলাম কী করে ? কোকিলের ডাক শুনে। একটু অবাকই হলাম। এখনও ঢাকা শহরের ইট-কাঠের ভেতর থেকে কোকিল ডাকে! এই ডাক খুব ছোটবেলায় শুনেছি, দেশেই শুনেছিলাম, বিস্মৃত হইনি। মাঝখানে যত কাল গড়িয়ে যাক, কিছু কিছু জিনিস সারা জীবনে ভোলা যায় না। মায়ের গায়ের গন্ধ, কোকিলের ডাক এসব বোধহয় সে রকমই অবিস্মরণীয়।

অদিতি যখন বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে হোটেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরের লবিতে কলকলাচ্ছে, আমি তখন আমাদের চারতলার কামরার পেছনের বারান্দায় একা সময় কাটাচ্ছি। অদিতি খুব চেয়েছিল তার বন্ধুদের আড্ডায় আমিও যোগ দিই। আমি বলে-কয়ে তাকে আপাতত নিরস্ত করেছি। ‘সময় কাটাচ্ছি’ বলাটা যথার্থ হলো না, বরং সিমিলি ব্যবহার করে বলা যায়, একটা নিঃসঙ্গ পাখি ডানা ঝাপটাচ্ছে দেহ-মনের খাঁচায়, নানা ভাবনা, নানা স্মৃতি-বিস্মৃতির অবিরাম ঝাপটানি।

আমার বাবা নিজের মনের মতো করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন আমাকে। বলা যায়, সেটা তিনি পেরেছেন এবং নিশ্চয়ই সেই পরম তৃপ্তি নিয়েই শেষবার নিশ্বাস ফেলেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, দেখতে শুনতেও আমি হয়েছি  বাবার সাক্ষাৎ প্রতিমূর্তি। এই বিস্ময়কর সাদৃশ্যের কথা সকলেই বলেন। বাবার বিত্ত-চিত্ত আভিজাত্য কোনও কিছুর সঙ্গে আমার মায়ের সামঞ্জস্য যে ছিল না, সেটা খুব ছোটবেলাতেই বুঝতে পারতাম আমি। দৈহিক গড়নের কথা যদি ধরি সুঠাম দীর্ঘদেহী পুরুষটির তুলনায় আমার মা প্রায় বেমানান রকমের ছোটোখোটো। তবে আমার মায়ের মুখশ্রী সত্যি দেবী প্রতিমার মতো। দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। ‘মধুর আমার মায়ের হাসি চাঁদের মতো ঝরে’ গানটি শুনে ছোটবেলায় বিদেশ-বিভুঁয়ে অনেক সময়ই অশ্রুসিক্ত হয়েছিলাম, কিন্তু আমার মাকে তো খুব একটা হাসতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। বড় গলায় কথাও  তেমন শুনেছি বলে মনে পড়ে না। তাকে সব সময় স্বামীর করুণাপ্রার্থী বলে মনে হতো আমার।

এই বিসদৃশ বৈবাহিক সম্পর্কটি কীভাবে গড়ে উঠেছিল আমার পক্ষে জানা বা বোঝার সুযোগ ছিল না সেই বালক বয়সে। তবে ঘনিষ্ঠজনদের নানা আকার-ইঙ্গিতের কথা থেকে অনেক পরে, যুবা বয়সে আমি অনুমানের একটি লম্বা সুতা জোড়া লাগাতে পেরেছিলাম। বোয়ালখালী গ্রামে আমার মামাবাড়ির কাছাকাছি কোনও একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়ে দু দিন কাটিয়ে এসেছিলেন আমার বাবা। সেখানে গ্রাম্য কিশোরীটিকে হয় তাঁর মনে ধরেছিল, নয় আদিম প্রবৃত্তি তাঁকে প্ররোচিত  করেছিল। সেই অসংযমের খেসারতই অনিচ্ছাসত্ত্বেও তাঁকে দিতে হয়েছে পরে। ধারণা করি, অনাকাক্সিক্ষত গর্ভসঞ্চার হওয়ার দরিদ্র নিরক্ষর কিশোরীর পিতা-মাতা বা আত্মীয়স্বজনের চাপে পড়ে বিত্তবান পরিবারের ছেলেটিকে মেনে নিতে হয়েছিল এই অসম সম্পর্ক। কেউ আমাকে এ ঘটনা ধারাবাহিকতা মিলিয়ে বলেনি, এমনকি কোনও দুর্বল মুহূর্তে পুত্রের কাছেও বাবার এ ব্যাপারে গাম্ভীর্য বিন্দুমাত্র টলেনি। কিন্তু এত বছর দেশের বাইরে আত্মীয় পরিজন বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকার পরও, প্রচণ্ড নিষ্ঠায় বিদ্যার্জন ও পেশাগত জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভের ব্যাপারে স্থিরচিত্র থাকা সত্ত্বেও কোনও এক সময় আত্মপরিচয় উদ্ঘাটনের আপাত-অপ্রয়োজনীয় বিষয়েও হয়তো আমি তাগিদ বোধ করেছিলাম। আমি সহানুভূতি বোধ করেছিলাম বাবার প্রতি, জীবনের একটি সাময়িক অসংযত আচরণের জন্য বাকি জীবনভর দায় বহনের জন্য তাঁর প্রতি করুণাও বোধ করেছিলাম। মাত্র দিন সাতেক আগে লোকান্তরিত মানুষটির প্রতি সেই করুণা বোধ এখনও অক্ষুণ্ন আমার মনে। এসব বিষয় আমি কখনওই অদিতির সঙ্গে আলোচনা করিনি।

 ‘কী ব্যাপার, তুমি এখনও বারান্দাতেই বসে আছো ? এত করে ডাকলাম একবার নিচে নামলে না, আমার সুন্দরী বান্ধবীরা তোমাকে মিস করল।’ অদিতির কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, আনন্দে ছলছল করছে চেহারা।

‘আমি বাবার কথা ভাবছিলাম।’

তৎক্ষণাৎ নিজেকে সংযত করল অদিতি, ‘স্যরি শান্ত, আমার ভুলে যাওয়া ঠিক হয়নি, এখন তো তোমার শোকের সময়। আইম রিয়েলি স্যরি।’

‘ইটস অলরাইট।’

পরদিন সকালে চট্টগ্রামে রওনা হয়ে গেলাম আমরা। বিমানবন্দরে আমার কাকা এসেছিলেন গাড়ি নিয়ে, বলাবাহুল্য আমার বাবার গাড়ি। এক যুগ পর নিজের শহরটাকে বড় অচেনা মনে হলো। কাকা জানালেন, নতুন একটা রাস্তা হয়েছে, সমুদ্রের ধার ঘেঁষে, ওই পথ দিয়েই যাব আমরা। কর্ণফুলী নদী যেখানে এসে সমুদ্রে পড়েছে, সেই মোহনা থেকে যাত্রা শুরু, তারপর অবারিত সমুদ্র একদিকে, অন্যদিকে পাহাড়, টিলা, কোথাও বা সমতল। অদিতি বলল, ‘শহরটা সত্যিই সুন্দর।’

‘একই শহরে পাহাড়, নদী,  হ্রদ ও সমুদ্র… এটা তো পৃথিবী জুড়েই বিরল।’

‘হুম।’ সায় দিল আমার স্ত্রী।

‘আমার মা এখন কেমন আছেন ?’ কাকার কাছে জানতে চাইলাম আমি।

‘আছে, ভালোই আছে, তবে মাঝে মাঝে লোকজন চিনতে গোলমাল করে ফেলে, আর কেমন সব অদ্ভুত আচরণ করে।’

‘কেমন ?’

‘নিজে নিজে কাঁদে-হাসে, বিড়বিড় করে কী সব কথা বলে।’

‘এটা কি বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে ?’

‘না, আগেও ছিল।’

হাঁটাচলা করতে পারে তো ?’

‘হ্যাঁ, হাঁটাচলা করতে পারে, নিজে বাথরুমে যেতে পারে। রান্নাবান্নাও তো নিজেই করে। কী এমন আর বয়স। তবে ওই মাঝে মাঝে…।’

‘দেখাশোনা করার কেউ নাই ?’

‘আছে, নার্স আছে একজন। তার সঙ্গে খুব ভাব।’

‘হুম, এখন বাড়িতে আর কে আছে ?’

‘কেউ নাই। তোমার বাবার সৎকার হয়ে যাওয়ার দু-একদিন পর আত্মীয়-স্বজন যারা এসেছিল, তারা ফিরে গেছে। আর জানোই তো তোমার মামাবাড়ির লোকজনের সঙ্গে সম্পর্কটা তেমন ছিল না তোমার বাবার। তারা নেহায়েত দায় সেরে চলে গেছে।’

‘জানোই তো’ বলল বটে আমার কাকা, আমি কিন্তু সেভাবে কিছু জানি না। শুধু অনুমান করি, ঘটনার চাপে বিয়ে করতে হয়েছিল বলে শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে তিক্ত সম্পর্ক ছিল বাবার।

গাড়ি ঢুকল বাড়ির আঙিনায়। চেনা যাচ্ছিল না। পুরনো বাড়িটা সংস্কার করে প্রায় নতুন একটা চেহারা দিয়েছেন বাবা। অবশ্য মাঝখানে তো অনেকগুলো বছর কাটল। চারপাশে এত বদলের মধ্যে বাড়িটাইবা অবিকল থাকবে কী করে!

রেলিংঘেরা বারান্দা পেরিয়ে গোছানো ড্রইংরুমটা দেখে মন ভালো হয়ে গেল। দেয়ালে দু-একটা পেইন্টিং আর আমার বাবার কাচবাঁধাই একটা আবক্ষ ফটোগ্রাফ রাখা হয়েছে। আমার এখন যে বয়স, সেই বয়সেরই বাবার ছবি। ছবিটার দিকে তাকিয়ে রীতিমতো চমকে উঠলাম আমি। এটা যে আমার ছবি নয়, এ কথা প্রমাণ করতে গলদঘর্ম হতে হবে যে-কাউকে। আমি দেখতে এতটাই বাবার মতো ছিলাম। একই রকম বিভ্রমে পড়ল খোদ অদিতিও, ‘এটা তোমার ছবি না ?’

আমার কাকা হাসলেন, ‘এটা তো আমার সবসময় বলি, দুজনের হুবহু এক চেহারা।’

      নার্স ভদ্রমহিলা এলেন, মধ্যবয়েসী খ্রিস্টান মহিলা, তাঁর নাম মিলি গনজালবেস। তিনিও বারবার তাকাচ্ছেন আমার দিকে। আমি হাসলাম।

    ‘মা কোথায় ?’

‘ভেতরের ঘরে। আপনারা আসুন।’

আমি বললাম, ‘আগে আপনি ওকে (অদিতি) নিয়ে যান। পরিচয় করিয়ে দেন। দেখি কীভাবে নেন, আমি একটু পরে যাব।’

মিলি গনজালবেস অদিতিকে নিয়ে মায়ের ঘরে গেলেন। আমি পাশের ঘর থেকে জানালার ফাঁকে চোখ রাখলাম। ছেলের বউকে এই প্রথম দেখবে আমার মা।

অদিতি সোজা গিয়ে প্রণাম করলেন মাকে। তাঁর বিস্মিত দৃষ্টির সামনে মিলি বললেন, ‘আপনার ছেলের বউ।’

মুহূর্তে কী উজ্জ্বল ও আনন্দময় হয়ে উঠল মার চেহারা! থুতনি ধরে মুখটা তুলে ধরল, ‘আমার শান্তর বউ! ওমা কী মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার বউমা… বলে বুকে টেনে নিল অদিতিকে। নিজের হাত থেকে দুটি সোনার চুড়ি খুলে পরিয়ে দিল অদিতির হাতে। আমার মায়ের চোখ-মুখ-নাক-ঠোঁট সবই যেন হাসছে। এত হাসি মার চেহারায় কোনওদিন দেখিনি। ‘মধুর আমার মায়ের হাসি’… আমার দু চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আসে।

একটু নাটকীয়তা করতে চেয়েছিলাম। মিলি আর অদিতি বেরিয়ে আসার পর আমি ঢুকলাম ঘরে। ‘মা…’ ছোট্ট করে ডাকলাম। আমি তাঁর প্রচণ্ড খুশির অভিব্যক্তি দেখার অপেক্ষা করছি। বারো বছরের অপেক্ষা। কিন্তু আমার দিকে তাকিয়ে আপদমস্তক কেঁপে উঠল আমার মা। মুখ ফিরিয়ে নিল, মুখ ঢেকে ফেলল দু’হাত দিয়ে। আমি আরও একটু সামনে এগোলাম, এবার কাতরে উঠল আমার মা, খাট থেকে নেমে আমার পায়ের কাছে বসে পড়ল, ‘আর কখনও হবে না, ভুল হয়ে গেছে…, প্লিজ আমাকে মেরো না।’

আমি লাফ দিয়ে পিছিয়ে যাই, অবাক তাকিয়ে থাকি। দু’হাতে মুখ ঢেকে আছে মা। ধীরে ধীরে উঠে বসল খাটে, ভয়ে কুঁকড়ে আছে এখনও। সন্তর্পণে বসলাম পাশে। তখনও থিরথির একটা কাঁপুনি আছে শরীরে।

‘আমি তো আছি, ভয় পেয়ো না।’ বলে আমি একটা হাত রাখলাম তার কাঁধে।

প্রায় অস্ফুট গলায় বলল, ‘আমার শরীরটা আজ ভালো নেই।’

আমি দু’হাতে জড়িয়ে ধরলাম তাকে, ছোট্ট শরীরটাকে বুকের ভেতর টেনে নিতে চাইলাম। হঠাৎ ‘না…’ বলে প্রচণ্ড চিৎকার করে এক ঝটকায় নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। তার পরপরই নিস্তেজ হয়ে গেল, বাঁকা হয়ে পড়ে গেল খাটের ওপর। আমি চিৎকার করে মিলিকে ডাকলাম। অদিতিও ছুটে এল।

মিলি অভয় দিলেন, ‘ভয় পাবেন না, চোখে-মুখে পানির ছিটা দিলে জ্ঞান ফিরবে।’

‘এরকম কি প্রায়ই হয় ?’

‘সাহেব বেঁচে থাকার সময় মাঝে মাঝে হতো। আপনাকে সাহেব মনে করছে, একই রকম চেহারা তো…।’

আমি নির্বাক তাকিয়ে থাকি মিলি গনজালবেসের দিকে। তিনি বললেন, ‘আপনি ওই ঘরে যান প্লিজ, আমি দেখছি।’

আমি আর অদিতি বেরিয়ে এলাম মার ঘর থেকে। অদিতি খুব অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘আচ্ছা ব্যাপারটা কী বলতো ?’

আমি উত্তর দিই না। কিন্তু ব্যাপারটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে আমার কাছে। চোয়াল শক্ত হয়ে উঠছে, মাথায় রক্ত উঠে গেছে আমার। আমি ছুটে গিয়ে ড্রইংরুমে বাবার ছবিটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আশ্চর্য এত মিল! যেন আয়নায় নিজের ছবি দেখছি আমি। রাগে-ক্ষোভে বর্তমান-বিস্মৃত হয়ে পড়েছি। প্রচণ্ড জোরে একটা ঘুষি হাঁকালাম ছবিতে। ঝনঝন করে ভেঙে পড়ল কাচ। কিন্তু কাচভাঙা ফ্রেমের মধ্যে বাবার ছবিটি তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি আরও একবার হাত মুষ্টিবদ্ধ করেছি। ঠিক এ সময় ছুটে এসে অদিতি ধরল আমাকে। ‘কী করছো, কী করছো শান্তনু ? কেন ?’

‘মরে গিয়ে বেঁচে গেল লোকটা!’ গজরাতে থাকলাম আমি।

মিলি গনজালবেস এসে আমার হাতটা টেনে নিলেন, ‘অনেকটা কেটে গেছে, মাই গড, কীভাবে রক্ত ঝরছে!’

‘কোনও অসুবিধা নেই, ঝরুক, এই রক্তে পাপ আছে, ওই লোকটারই তো রক্ত।’ হিসহিস করে উচ্চারণ করলাম আমি।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button