আর্কাইভগল্প

গল্প : হত্যা : সাঈদ আজাদ

বাতাসের শোঁ শোঁ গর্জনে বুক কেঁপে উঠে রেখা রানি বিশ্বাসের। শব্দটা জন্মের পর থেকে কত শত বার যে শুনেছে সে, তার ইয়ত্তা নেই। তবু প্রতিবারই বুকের ভেতরটায় কেঁপে উঠবেই তার।

পরিবারের সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে সন্ধ্যার পরপরই। তারা জানে―রেখা জেগে থাকবে, বিপদ এলে ঠিক সময়ে জাগিয়ে  দেবে। রেখা জেগেই ছিল। শব্দে বিছানায় উঠে বসে সে। ঘরের ভেতরে পচা কচুরিপানার মতো অন্ধকার। মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ চমকে সে আঁধার ফিকে হচ্ছে অবশ্য। স্বামী-সন্তানদের ডাকবে কিনা ভাবে রেখা। সবে ঘুমিয়েছে সবাই। কাঁচা ঘুম ভাঙ্গাবে ? দুুদিন ধরে মাইকিং হয়েছে বটে, যে ঝড়টা জোরেশোরেই আসবে। ঝড়টা বোধহয় সত্যিই আসছে।

শোঁওওও। শোঁওওও। বাতাসের গতি বাড়ছেই।… ক্যাঁচ-ক্যাঁচ ক্যাঁচোর। বাতাসের সঙ্গে সঙ্গে ঘরের দরজাও শব্দ করতে থাকে।

শ্যামনগরের গাবুরা এলাকাটা বেশ নিচু। সমুদ্রের প্রায় সমান্তরালেই এলাকার ভিটে-মাটি। এলাকাটা আদতে ছোট একটা দ্বীপ। মূল ভূখণ্ড থেকে দেড়শ ফুটের মতো চওড়া খাঁড়ি দ্বারা আলাদা হয়েছে দ্বীপটা। ছোটখাটো ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, কী প্রবল জোয়ার প্রায়ই গাবুরার ভিটে-মাটি-ফসলের ক্ষেত-মাছের ঘের ডুবিয়ে দিয়ে যায়। দু একদিন ঘরের বাইরে চারপাশ কাদা হয়ে থাকে। তারপর এক সময় রোদে সব শুকিয়ে গেলেই আবার সব স্বাভাবিক। বাপের বাড়ি আর শ^শুরবাড়ি পাশাপাশি বলে জন্ম থেকেই এসবে অভ্যস্ত রেখা।

দমকা বাতাস আছড়ে পড়ছে ঘরের দরজায়। বোঝা যায় বাতাসের গতি বাড়ছে। এখন বাতাসের শক্তি বাড়তেই থাকবে। একটু শংকিত হয় রেখা। ঘরের চালা না আবার উড়ে যায়! সবাইকে ডেকে তোলা দরকার। থেকে থেকে মাইকিং-এর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। যারা এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি, তাদের সেখানে যেতে বলা হচ্ছে।   

 কদিন আগে থেকেই অবশ্য মাইকিং করে সতর্ক করা হচ্ছিলো যে, বড় ধরনের ঝড় আসবে। কিন্তু ঝড় যে আসবেই, কেন জানি সে বিশ^াসটা হয়নি রেখার। এমন মাইকিং হয়েছে কতবারই। বাড়ি-ঘর সব ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে উঠেছে তারা। কিন্তু কিসের কী! ঝড় আসেনি। বড়জোর বৃষ্টি আর বাতাস হয়েছে দুদিন। এবারও তাই-ই হবে হয়তো। সে কারণে তাদের মতো আরও অনেকেই বাড়ি-ঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যায়নি এখনও। তবে, বাইরে লোকজনের চিৎকার-আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে এখন তারা ঘর থেকে বের হয়েছে।

সাতক্ষীরার শেষ প্রান্তে, সমুদ্রের কোলের ভেতরে এই জায়গাটা হয়তো বসবাসের জন্য তেমন যোগ্য ভূমি নয়। আশেপাশে দু চারটা ঘেরে মাছের চাষ, জমিগুলোতে অল্প-স্বল্প ধান ছাড়া তেমন কোনও ফসল হয় না এখানে। লোকজনের জীবিকার উৎস সমুদ্র আর সুন্দরবন। তা সেসব জীবিকায় প্রাণ যাওয়ার আশংকা মিশে থাকে। জেলে, মৌয়াল, বাওয়ালিদের এখন আর আগের মতো আয়-রোজগার নেই। সমুদ্র কৃপণ হয়ে গেছে, বনের কাঠ-মধু আহরণ প্রায় নিষেধ হয়ে গেছে।

সরকারের পক্ষ থেকে তাদের প্রায়ই বলা হয়, গাবুরা ছেড়ে মূল ভূখণ্ডে গিয়ে থাকতে। সরকার থাকার জায়গা দেবে তাদের। নতুন ঘর দেবে। কিন্তু গাবুরার মাটিতে যে তাদের চৌদ্দ পুরুষের নাড়ি পোঁতা। লবণাক্ত সাদা মাটি ছেড়ে, পূর্বপুরুষের ভিটা ছেড়ে তারা আসলে অন্যত্র যেতে চায় না। সমুদ্রের গর্জন, বাঘের ডাক, নোনা পানি―এসব যে তাদের রক্তে মিশে গেছে বংশ পরম্পরায়। অন্য এলাকায় মাটিতে চিরচেনা সোঁদা গন্ধটা তো নেই। বাতাসে নেই সুন্দরী, গেওয়া, গরান, কেওড়া ফুলের সুবাস। পানিতে নেই নোনা স্বাদ। গাবুরার লোকেরা একবেলা ভাত না খেয়ে থাকতে পারে, কিন্তু এসব ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারে না। অন্যরা যেমন পারে না, তেমনি পারে না রেখাও।

সব ছেড়ে চাইলেই যাওয়া যায় ? শুধু কি পেটের ভাতই সব ? চিংড়ি ভাজি দিয়ে এক গামলা পান্তা খেয়ে কেওড়া গাছের তলায় সাদা মাটিতে শুলে যে তৃপ্তিতে চোখ বুজে আসে, সেই তৃপ্তি কি অন্য কোথাও আছে ? সমুদ্র থেকে উঠে আসা নোনতা নোনতা বাতাসটা বুক ভরে না নিলে যে এখানকার মানুষরা বাঁচবে না, সে কথা কাকে বলবে তারা ?

ঝড়-জলোচ্ছ্বাস তো তাদের নিত্যদিনের সঙ্গী। বনে গেলে কাউকে বাঘে টেনে নেয়, কাউকে সাপে কামড়ায়। তারপরও এখানকার কাদামাটি শরীরে মেখে, শণের ঘরে মাটির মেঝেতে ঘুমানোর সুখ পৃথিবীর আর কোথাও নেই।  

আজকাল রাতগুলোতে একবিন্দু ঘুমও হয় না রেখার। মাথার ভেতরে আবোল তাবোল চিন্তা ঘুরতেই থাকে। ঘুরতেই থাকে। চিন্তা করতে করতে রাত ফুরিয়ে এক সময় বাইরে আলো ফোটে। পাখি ডাকে।…পাখি ডাকছে এখনও। তবে তাদের কণ্ঠে জেগে ওঠার সুর নয়। আচমকা ঘুম ভাঙ্গার আতংকের সুর। বিপদ তাহলে এবার আসবেই। পাখিরা বিপদ টের পায়।

চিন্তা যে তার আগে ছিল না, তা নয়। কিন্তু ঘুমের তাতে ব্যাঘাত ঘটেনি। মূলত স্বামীর দুর্ঘটনার পর থেকে অনিদ্রাটা যেন সঙ্গী হয়ে গেছে তার। কিছুতেই সরে না সেই সঙ্গী। মাথার ভেতরে চোরা একটা ব্যথা সারাটা দিন কেমন নিস্তেজ করে রাখে তার পুরো শরীর। ঘুমের অভাবেই এমন হয়, বুঝতে পারে রেখা। দিনে ঘুমিয়ে যে রাতের ঘুম পুষিয়ে নেবে সেই উপায়ও নেই। কাজ করতে করতে কীভাবে যেন দিন ফুরিয়ে যায় তার। সারাদিনে একবার বিছানায় গা এলানোর সুযোগও পাওয়া যায় না। সংসার তার হয়তো বড় নয়, কিন্তু কাজ সংসারের মেলাই। আসলে সমীরের কাজগুলোও এখন তাকে করতে হয় বলেই বোঝাটা বেড়েছে। সারা দিন চেঁচালেও ছেলে বা মেয়ে কোনও কাজে হাত লাগায় না। নাকি তাতে তাদের পড়ার ক্ষতি হয়। তা তারা যে মন দিয়ে পড়ে তাও কিন্তু না। তেরো বছরের মেয়ে আর পনেরো বছরের ছেলে বাইরে ঘোরা, আড্ডা, সময় পেলেই মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকা―সবই রপ্ত করে ফেলেছে। শিখতে পারেনি শুধু মা-বাবার সাহায্য হয় এমন কোনও কাজ। ঘরের দুঃখ আর কাকে বলা যায়। বাবা-মা বছরে দুটো ভালো পোশাক পরতে না পারুক, তারা ঠিকই মোবাইল কেনার টাকা আদায় করে ছেড়েছে।

তখনও সমীর অচল হয়নি। তবে বাপ-ঠার্কুদার পেশা মাছ ধরা ছেড়ে মানুষের ঘেরে কাজ করতে শুরু করেছে। বেশ ক বছর কাজ করার পরে কিছু অভিজ্ঞতা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতার সাহস নিয়েই রেখার নামে এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে, চার বিঘা জমি লিজ নিয়ে মাছের চাষ শুরু করেছিল তারা। সমীর বলেছিল, নাকি চিংড়ি একবার বিদেশে পাঠাতে পারলেই চার গুণ লাভ। মাস তিনেক সময়ে মাছগুলো বেড়েও উঠেছিল তরতর করে। তারপই তো একরাতে কারা যেন ঘেরের চারপাশের বাঁধ কেটে দিল। লোকজন তো বলে, যাদের ঘেরের কাজ ছেড়ে সমীর নিজের ঘেরে কাজ শুরু করেছিল, তারাই নাকি ঘেরের বাঁধ কেটে দিয়েছে। সবার নিজের ঘের হলে তাদের ঘেরে মজুর হয়ে দিন-রাত খাটবে কে ? তাই হয়তো মহাজনের রাগ হয়েছে। জানা কথাই থানা-পুলিশ করে কোনও লাভ হবে না। অপরাধী কে রেখারা সেটা কোনওভাবেই প্রমাণ করতে পারবে না। মুক্ত হয়ে মাছ সব খাঁড়ি আর সমুদ্রের পানিতে মিশে গেছে। মাছের সঙ্গে ভেসে গেছে রেখাদের স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু মাথায় থেকে গেছে ঋণের বোঝা। তখন থেকেই রেখার ঘুমহীন রাতের শুরু।

কিন্তু বিপদ তো কখনও একা আসে না। সব সময় সঙ্গী-সাথী নিয়েই আসে। এক সন্ধ্যাবেলা সমীর হাঁট থেকে ফিরছিল, ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের ভাতিজার মোটর সাইকেল ধাক্কা দিয়ে তাকে ফেলে দেয় রাস্তার পাশের খাদে। প্রাণও যেতে পারত। ভগবানের দয়া, শুধু ডান পা-টা হাঁটুর কাছে থ্যাঁতলে গেছে। চিকিৎসার বেশি দেরি হলে পায়ে পচন ধরবে। কেটে ফেলতে হবে পা। কানের সোনার দুল জোড়া বিক্রি করে সদরের হাসপাতালে গিয়ে অপারেশনটা করা গেছে কোনও মতে। বড় আশা ছিল মেয়েটার বিয়েতে দুল জোড়া দেবে রেখা। বুড়া বয়সে হাড় ভাঙলে নাকি সহজে জোড়া লাগে না। ডাক্তার তাই বলেছে। সমীরে পা কাটতে হয়নি, তবে সে এখন আর নিজের পায়ে হাঁটতে পারে না। ক্রাচে ভর করে চলে। 

দেশি-বিদেশি এনজিও সহায়তা করার নামে যে ঋণ দেয়, তাতে আসলে ফেঁসেই যায় তার মতো গরিবেরা। একবার লোকসানে পড়লে আর কোমর সোজা করে উঠে দাঁড়াতে পারে না সহজে। ঋণ নেওয়ার আগে এনজিও কর্মীদের কী মিষ্টি মিষ্টি কথা! একবার ঋণ নিয়েই দেখুন না দিদি। সপ্তাহে কত টাকা আর কিস্তি! আটশ এক হাজারের বেশি তো নয়। ঋণ শোধ করতে আপনার সময় লাগবে না। আপনি যে পরিশ্রমী! ঘেরে মাছ ছাড়বেন। পাড়ে সবজি করবেন। কিস্তির টাকা পরিশোধ করেও হাতে সমান টাকা থাকবে। সেই টাকায় আবার মাছের পোনা ছাড়বেন। ছাগল কিনবেন। আয় তো বাড়তেই থাকবে।

কিন্তু যে-ই মাছ সব ভেসে গেল, জোয়ারে সবজির গাছ পচে গেল, তখনই কিস্তি নিতে আসা লোকগুলোর চেহারা পাল্টে গেল। সপ্তাহ ঘুরতেই সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি ঘরের দরজায় বসে থাকে। যতই তাদের অনুরোধ করে রেখা, কটা মাস সময় দেওয়ার জন্য, কিন্তু তারা একদিনও বাড়তি সময় দিতে চায় না। একটা ধাড়ি ছাগল ছিল, বড় পয়া। তিনটা করে বাচ্চা দিত। তার পেছনে তেমন খরচও হতো না। আশেপাশেই চড়ে খেত। সেই ছাগল বেচে কিছুদিন কিস্তির টাকা শোধ করা গেছে। কিন্তু বাকি টাকা কী করে শোধ হবে ? শেষে একজনের পরামর্শে ফের আরেক এনজিও থেকে ভিটে জামানত রেখে পঁয়ত্রিশ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছে। সেই ঋণের কথা স্বামী-ছেলে-মেয়ে কেউ জানে না। নতুন ঋণের টাকায় পুরনো ঋণ শোধ হয়েছে। বাকি কিছু টাকা ছিল হাতে। দু মাস ভালো-মন্দ বাজার করেছে সেই টাকায়। নতুন ঋণ কী করে যে শোধ করবে, তা জানে না রেখা। শুধু রাতে যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়ে, তখন সে ঋণ শোধের উপায় ভাবে। ভেবে ভেবে রাত কাবার হয়ে সকাল হয়। উপায় আর মেলে না।

এবারের ঝড়ের নাম নাকি ফণি। সে ফণিই হোক আর মনিই হোক, তাতে কী যায় আসে। নামের কারণে তো আর তাণ্ডবের হেরফের হয় না। বাতাসের গতি বেড়েই চলছে। মানুষজনের চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে গাছপালা ভাঙ্গার শব্দও শোনা যাচ্ছে। ঝড় বোধহয় এবার তাদের যতটুকু আছে সবটুকুই উড়িয়ে নিয়ে যাবে। চিন্তা করে মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠে রেখার। সে মৃদু স্বরে স্বামীকে ডাকে। ও বৈশাখির বাপ, তাড়াতাড়ি উঠো দিনি। তুফান তো আসলেই আসতিছি। দেরি করলি জল পার হতি পারবো না মনে কয়। ছেলে-মেয়ে নিয়্যি ভেসে যেতি হবে।

সমীরের ঘুম ভাঙ্গে না। মানুষ এমন সময়ও মরার মতো ঘুমায় কীভাবে ? ছেলে-মেয়েরা অবশ্য উঠে পড়েছে। মেয়ে তাড়া লাগায়, মা ঝড় তো আইসেই গেল। জলদি বের হও ঘর থেইকে। আর দেরি করলে জল ভাসিয়ে নিয়ে যাবে সবাইরে। কত কইরে কাল বলিলাম, আশ্রয়কেন্দ্রে চলো। শুনলে না আমার কথা। কতবার মাইকিং করে বলিল, ঝড় আসবে। কানে তুললা সে কথা ?… বাবা, ও বাবা উঠো তো। এখনও ঘুমাচ্ছো তুমি!

সমীরের ঘুম ভাঙ্গে। সে বিছানায় বসে বলে, সব ছাইড়ে আবার অইপাড় যাতি হবে নাকি ?

না গিয়ে এখানে থেইকে মরব নাকি ? রেখা বলে।

আমাগে আর মরা বাঁচা!

অত কতা কওয়ার সুমায় এখন নাই। মরতে চাইলে পরেও মরতে পারবা। ছেলে মেইয়্যি দুটোকে নিয়্যি চল দিনি। অই বোধহয় ট্রলার ছাইড়ে দিল।

ঘর থেকে বের হতেই ঠান্ডা বাতাস আর পানি যেন ঝাঁপিয়ে পড়ে ওদের উপর। ইতোমধ্যে পানি বেড়েছে অনেক। ঘরের ভিটায়ও ঢুকতে শুরু করেছে পানি। বাতাসের গর্জন কলিজা কাঁপিয়ে দেয়। গাছের পাতা-ডাল সব ঘুরে ঘুরে উড়ছে বাতাসের সঙ্গে। কার যেন ঘরের চালাও উড়ে গেলো। রেখা বোঝে, ভীষণ বোকামি হয়েছে দিনের বেলায় আশ্রয়কেন্দ্রে না গিয়ে। দুপুরের দিকে যখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো তখনই চলে যাওয়া উচিত ছিল। 

বাতাসের ঝাপটায় দাঁড়িয়ে থাকতে বেশ কষ্ট হচ্ছে। আর ঠান্ডা তো আছেই। সবাই হিহি করে কাঁপছিল।

জল পার করার ট্রলার তাদের ইশারায় ডাকছে। খোঁয়ারে কয়েকটা ডিমপাড়া হাঁস আছে। গোয়ালে ছাগল ছানাটা ছিল। ধাড়িটা বেচার পর বাচ্চাটাকে রেখে দিয়েছে রেখা। সময় গেলে সেটা বড় হবে সেই আশায়। সেটা সঙ্গেই নিয়েই বের হয়েছে সে। হাঁস তো অনেক, একা নেওয়া সম্ভব না। ছেলেকে বলেছিল, সে নিতে রাজি হয়নি। ছেলে আর মেয়ে নিয়ে নিয়েছে নিজেদের বইপত্র। হাঁসের খোঁয়ারের দরজা অবশ্য তালা দিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে এসেছে। মানুষ চুরি না করলে আশা করা যায় ঠিকই থাকবে ওরা। ভিটার পশ্চিমে কয়েকটা সাগরকলার চাড়া লাগিয়েছিল। সেগুলোতে কাঁদি এসেছে মেলা দিনই হবে। পাকার সময় হয়ে এসেছে। সেসব ফেলে যেতে মন চাচ্ছিলো না রেখার। অন্তত পাকা একটা কাঁদি নিয়ে গেলেও রাতে খাওয়া যাবে। আশ্রয়কেন্দ্রে কখন খাবার পাওয়া যাবে তার কি কোন ঠিক ঠিকানা আছে। হাতে তো নগদ টাকাও নেই যে কিছু কিনে  নেবে। তাই সে মেয়েকে বলে―বৈশাখি, তুই আর ভাই মিলে বাপকে নিয়ে ট্রলারে উঠ। আমি পরের বার আসছি। 

মাথাডা কি তোমার খারাপ হইয়ে গেছে ? সমীর বউকে ধমক লাগায়। কী সম্পদ আছে যে তুমি সেসব আগলানোর জন্যি এই তুফানের মধ্যি বইসে থাকবা ? ট্রলার যদি আর না আসে ? আর কোলে করে ছাগল নিয়্যি এসেছ কোন আক্কেলে ? মানুষের জায়গা হয় না ট্রলারে, তোমার ছাগল তুলবি তারা ?

আমি থাকি। আমারে নিয়ে অত ভেব না তোমরা। জীবনই তো পার করলাম এই গাবুরায়। সমুদ্র, জল, ঝড় এসব নতুন দেখতিছি নাকি। সিডর, আইলা কত কিছু পার করিলাম। আর ফণি কী করবে আমার ? সবাই চলে গেলে হাঁস, গাছের ফল কিছু থাকবি ? মনে নেই, গতবার আশ্রয়কেন্দ্রে গেইলাম। ফিরে পুরো বাড়ি ফাঁকা পেয়্যিছি। জল খাওয়ার পিতলের গ্লাসটা পর্যন্ত ছিল না। বলি কী, আমি না হয় থাকি। তুমি ছেলে-মেইয়্যিদের নিয়ে অইপার যাও। কোনও বড় গাছে উইঠে বইসে থাকব না হয়।

তুমি এই ঝড়ের মধ্যে গাছে উইঠে বসে থাকবা মা ? ছেলে বলে। পাগল টাগল হইয়্যি গেলে নাকি ?  আমাগের কী এমন রাজার ধন আছে যে তার জন্যি তুমি জীবন হাতে কইরে এইখানে থাকবা ? চল আমাগের সঙ্গে। ট্রলার কিন্তু আর দাঁড়াবে না। আমি বাবারে ধরছি, তুমি বৈশাখিরে নিয়ে পিছে পিছে আসো। সাবধানে হাঁটবা। বাতাস কিন্তু জোর ধাক্কা দিচ্ছে।

ছাগলটারে ছাড়ো। সমীর ফের বলে। ওটারে নিয়্যি তুমি ট্রলারে উঠতি পারবা না। সবাই যদি তাগের ছাগল-গরু নিয়ে ট্রলারে উঠে, মানুষ দাঁড়াবে কই।

ছোট একটা জীব। না হয় আমার কোলেই রাখব।

কেউ আর কোনও কথা বলে না। সামনে পা বাড়ায়। স্বামী-সন্তানের পিছে পিছে কাদায় পা ফেলে ফেলে হাঁটতে থাকে রেখা। তার যতটুকুই সম্পদ ছিল―সব পড়ে থাকে পেছনে। সে একবার ঘাড় ফিরিয়ে সেসব দেখে। কে জানে ঝড় থেমে যাওয়ার পর যখন তারা ফিরবে, তখন হয়তো সব ভেসে যাবে জলের তোড়ে। আর যদি জলের তেমন জোর না হয় মানুষেরাই সব চুরি করে নিয়ে যাবে।

তারা যখন পৌঁছছে তখন প্রায় মাঝরাত। বিদ্যুৎ ছিল না। মোম জ্বালিয়ে রাখা যাচ্ছিল না। আশ্রয়কেন্দ্রের সোলার বাতিগুলোও জ্বলছিল না। জ্বলবে কী করে! সূর্যের আলো ছিল না দু দিন ধরে। বাতিগুলোতে চার্জ হয়নি। বাচ্চাদের চিৎকার, বড়দের আহাজারি। আশ্রয়কেন্দ্র না যেন নরক!

রাতের শেষ প্রহরগুলো কী যে দীর্ঘ হয়ে গিয়েছিল। শেষই হচ্ছিল না অইটুকু সময়। ঝড় তার শক্তি দেখিয়েছে অতটুকু সময়েই। কী শব্দ ঝড়ের! কী গতি বাতাসের! পৃথিবীর প্রলয়ের দিনটা বুুঝি এমনই হবে। ঝড়ের তাণ্ডবলীলা লণ্ডভণ্ড করেছে চারপাশ। গাছ ভেঙ্গেছে, কাঁচা-পাকা ঘর মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে। বৈদ্যুতিক খুঁটি উপড়ে পড়েছে। ঘেরের মাছ ভেসে গেছে পানির তোড়ে।

যেন রাত নয়, দীর্ঘ একটা জীবন পার হয়ে সকাল হয়। এখনও ঝড় থামেনি পুরোপুরি। বৃষ্টিও পড়ছে প্রবলভাবে। অনেক অনেক দুর্ভাবনার মধ্যে একটা ভাবনা রেখাকে অদ্ভুত এক ধরনের স্বস্তি দেয়। আজকে অন্তত ঋণের কিস্তি নিতে লোক আসবে না। ওরা প্রতি শনিবারই আসে। আজ শনিবার। ঝড়ের কারণে একটা সপ্তাহ অন্তত ওদের মুখ দেখতে হবে না। কিস্তির টাকা পরে দেবে বলে অনুনয় করতে হবে না। ধারের টাকা শোধ করতে না পারার যে কী গ্লানি, তা শুধু রেখাই মতো উপায়হীন ঋণগ্রস্তরাই অনুভব করতে পারবে।

পুরোপুরি সকাল না হতেই আশ্রয়কেন্দ্রে চিৎকার-কান্নাকাটি শুরু হয়ে গেছে। রেখা তার দুপাশে তাকায়। নাহ, শোয়ার জায়গা না পেলেও স্বামী, সন্তানেরা তার দু পাশে অন্তত বসার জায়গা পেয়েছে। ক্লান্তিতে সবার মুখ কেমন কালো হয়ে গিয়েছে। আহা, নিশ্চয়ই ক্ষুধাও পেয়েছে সবার। আশ্রয়কেন্দ্রে খিঁচুরি কী চিঁড়া-মুড়ি দেওয়ার কথা। বৈশাখি, তুই বাপ-ভাইয়ের খেয়াল রাখিস, রেখা মেয়েকে বলে। আমি গিয়ে দেখি খাবার দিচ্ছে কিনা।

মা আমিও সঙ্গে আসব ? ছেলে জিজ্ঞেস করে।

আচ্ছা আয়। দুজন গেলে ভালোই হবে।

সারারাত নির্ঘুম কেটেছে বলেই হয়তো খিঁচুড়ি পেটে পড়াতে ঘুমে চোখ বুঝে আসে ওদের। শোয়ার মতো পর্যাপ্ত জায়গা নেই। কোন রকমে পা দুটো ভাঁজ করেই চারজন জড়াজড়ি করে শুয়ে পড়ে। 

ঘুম ভাঙ্গে বেশ বেলা করেই। দুপুর গড়িয়ে গেছে। খাবার টাবার বা কোনও সাহায্য কিছু পাওয়া যায় কিনা সেই খোঁজ নেওয়ার জন্য উঠে দাঁড়াতেই লোকগুলোকে চোখে পড়ে রেখার।

কিস্তির লোকেরা আশ্রয়কেন্দ্রে কেন ? তার কাছেই এসেছে নাকি ? না বোধহয়। হয়তো ওরাও রাতে আশ্রয়কেন্দ্রে ছিল।

লোকগুলোর পাশেরই একজনকে জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা, এখানে গাবুরার রেখা রানি বিশ^াস এসেছে না ?

লোকটা জবাব দেয়, চিনি না তাগের। ক্যান আপনারা ত্রাণ নিয়্যি আসিছেন নাকি ? বেশি থাকলে আমাগেরও কিছু দেন।

ত্রাণ না, আমরা উনার কাছে অন্য কাজে এসেছি।

মা, ওরা তোমারে খুঁজতিছি ক্যান ? বৈশাখি নিচু স্বরে জিজ্ঞেস করে।

স্তম্ভিত রেখা নির্বাক হয়ে যায়। মেয়ের প্রশ্নের জবাব দেয় না। মানুষ এতটা অমানুষ হয় কী করে! কটা টাকা নিয়ে কি রেখা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবে ? হঠাৎ মেঝেতে শুয়ে পড়ে সে। শুয়ে থেকে যেন মাটিতে মিশে যেতে চায়। পারলে মাটির নিচেই চলে যেত।

শুয়ে থেকে লাভ হয় না। এত এত মানুষের ভিড়েও ঠিক রেখাকে বের করে ফেলে ওরা।

আমাদের রিজিক এখান থেকেই হয়। কী করব দিদি। সব তো দেখতেই পাচ্ছি। বাড়ি-ঘর ছেড়ে এখানে এসেছেন। কিন্তু আমরাও নিরুপায়। আপনিসহ আরও চারজনের কিস্তি পুরোপুরি বন্ধ। কিস্তি আদায় না করতে পারলে আমাদের বেতন থেকে কেটে নেবে। আর ম্যানেজার স্যার বলেছে, কিস্তির টাকা দিতে না পারলে মামলা করবে। পুলিশ হয়তো ধরে নিয়ে যাবে আপনাকে। তাই যেভাবে পারেন অন্তত দুটো কিস্তির টাকা দেন দিদি।

ও বৈশাখির মা, তুমি কবে আবার ঋণ নিলা ? একটাবার তো জানালেও না ? সমীর জিজ্ঞেস করে।

জানালে কী করতা তুমি ? তোমার পা ঠিক করতিই তো ঋণ নিতি হলো।

তা জামানত কী রাখলা ? ভিটে নাকি ?

রেখা জবাব দেয় না।

পাশে বসা একজন কিস্তি নিতে আসা লোকদের বলে, ও বাবুরা মেয়েটারে এট্টু দয়া করো। এই অবস্থায় সে কিস্তির টাকা দিবানি কোত্থেকে।

লোকগুলো কোনও কথা বলে না।

ও বাবুরা, সমীর অনুনয় করে। কিস্তি মাফ হওয়ার কোনও উপায় নেই ? আমাগের তো সম্পদ কিছু নেই। ক্যামন কইরে কিস্তির টাকা দিব।

শুনুন, ঝড়ের দোহাই দিয়ে না হয় কিস্তি দুই সপ্তাহ পরে দিলেন। কিন্তু ঋণগ্রহীতা মারা না গেলে ঋণ শোধ করতেই হবে। তেমন হলে জামনাত হিসেবে যে ভিটে রেখেছেন―তাই বিক্রি করে আমরা টাকা নিব।  

ভিটে গেলে আমরা থাকব কই ? সমীরের কণ্ঠে হাহাকার।

একজন বলে, দেখেন না দিদি, যদি সোনার কানের দুল, হার টার থাকে আপনার কাছে। মেয়েদের কাছে তো অমন থাকে। বিপদের সময়ই যদি সেসব কাজে না লাগে… কথা শেষ না করেই রেখার কানের দিকে, গলার দিকে চোখ পড়াতে সে থেমে যায়। একটু পরে বলে, আচ্ছা আজকে আমরা যাই। কাল সকালে আসব না হয়। যেভাবেই পারেন, কিছু টাকা ম্যানেজ করে রাখবেন দিদি। না হলে আমরা থানা পুলিশ করতে বাধ্য হব।

থানা-পুলিশ! আপনিরা কি মানুষ দাদা ? কত সোন্দর সোন্দর কথা বইলে ঋণ দিয়িলেন। এখন বিপদে পড়িছি বইলে ঋণ আদায় করতে পুলিশ ডাকবেন ? রেখা রাগ ধরে রাখতে পারে না।

দেখুন দিদি, আমরা তো আর দানসত্র করতে বসিনি। ঋণ নেওয়ার সময় তো বলেছিলেন প্রতি সপ্তাহে ঠিকঠাক কিস্তি দিবেন।

সে তো বলিলামই।… আচ্ছা যান আপনারা। কাল সোকালে কিস্তির টাকা পেইয়্যি যাবেন।

এই ছাগলটা আপনার নাকি দিদি ? এটাকে নিয়ে গেলাম। এক কিস্তির টাকা তো শোধ হবে বেচলে। লোকগুলো ছাগলের রশি ধরে টানতে টানতে চলে যায়।

সমীর বলে, আগের ঋণ শোধ না হতিই কোন আক্কেলে তুমি আবার ঋণ নিইলা ?

আগের ঋণ শোধ হয়িছে। রেখা বলে। এবারও হবে। অত চিন্তা করো না। তুমি ছেলে মেয়্যিদের কাছে বসো। আমি দেখি খাবার টাবার কিছু দিতিছে কিনা ? শব্দ শুনে তো মনে হচ্ছে খাবার দেওয়া শুরু হয়িছি। ত্রাণ ট্রাণও দিতিছে মনে হয়। কিছু ত্রাণ পালি পরে বৃষ্টিটা ধরে এলে বাড়ি চলে যাব। সব কিছু কেমন আছে কিডা জানে! হারামিরা ছাগল ছানাটারে নিয়্যি গেল।

ও তুমি যাই বলো, কাল সকালের আগে আর ভিটেয় ফিরা হচ্ছে না। সমীর বলে। বৃষ্টি কী, ঝড়ই তো থামার নাম নেই।

রেখা দীর্ঘ একটা শ^াস ফেলে বলে, জীবনটাই গেল ঝড়ে-জলে। আর বাঁচতে ইচ্ছে করে না। …আমি যাই। দেরি করলে কিছু পাব নানে।

একটু এগিয়ে গিয়েই রেখা পেছনে ফিরে ছেলে-মেয়ে-স্বামীর দিকে তাকায়। আহা, ঠান্ডায় তিনজনে কেমন জড়াজড়ি করে আছে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকেও তার আশ মেটে না। চোখ ফেরাতে ইচ্ছেই করে না।

একসময় চোখ কড়কড় করে উঠে রেখার। জলে ঝাপসা হয়ে যায় দৃষ্টি। তবু সে চোখ সরায় না। এই জনমে তো এটাই শেষ দেখা। কাল সকালেই হয়তো ঝড় থামবে। রোদ উঠবে। কিন্তু তার আর সেই সকাল দেখা হবে না। আজ রাতেই যে সে রওয়ানা হবে অন্য দেশে।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button