আর্কাইভগল্প

গল্প : গল্পের গরু : গার্গী রায়চৌধুরী

সে বার আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার মেয়াদটা বেশ একটু লম্বা হয়ে গেল। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন রেগে একশা। তাদের কাছে আমার এই নিরুদ্দেশ যাত্রা একেবারেই অর্থহীন। তবে এই সবের অর্থ তারা বুঝবে এ আমি আশাও করি না। আমার মতো তারা তো গল্প লেখে না। তাই গল্পের গরুর গুঁতাও তারা খায়নি। কোনওরকমের কোনও গুঁতা না খেলে নিরুদ্দেশে যাওয়ার প্রয়োজন হবে কেন কারও ?

আমার হাতে গোনা কড়ি, তাই ইচ্ছে থাকলেও সবসময় ট্রেনে, বাসে, প্লেনে চেপে নিরুদ্দেশ হয়ে যেতে পারি না। তবে তাতে অসুবিধা নেই, যে চায় সে বাড়ি বসেই হারিয়ে যেতে পারে। কেবল সদর দরজাটা বন্ধ রাখলেই হলো। আমার এই দু কামরার ফ্ল্যাটে বসে আমি তো বেশ ভোঁ-ভা হয়ে যেতে পারি। আর আমার পরিচিত লোকজন যেহেতু আমার এই বিটকেলে স্বভাবের কথা জানে তাই তারা আমার হদিস না পেলে একবার আমার সাহায্যকারী পরেশের থেকে জেনে নেয় আমি কোথায় আছি, আর বেঁচে আছি কিনা। মিতভাষ পরেশ আমার লাইফ লাইন। ও ঠিক মানুষের মতো না, অনেকটা ছায়ার মতো। তাই ও বাড়ি থাকলেও আমার হারিয়ে যেতে অসুবিধা হয় না।

এই খেপে কেন নিরুদ্দেশ হতে হলো এবার সেই গল্প বলি। আশা করি আপনারা এটা জানেন গল্পের গরুকে যে কেবল গরুই হতে হবে তা নয়। যেমন আমার গল্পের চরিত্র রমেশবাবু যখন রোজ গরু হয়ে আমাকে গুঁতোতে লাগল তখন নিরুপায় হয়ে তার ঠেলাতেই আমাকে সমাজ সংসার ফেলে পালাতে হলো।

গল্পটা সবে শেষ করেছি। প্রধান চরিত্র রমেশবাবু ঠিক সুবিধার লোক না। আমার মতে সে অতি ধূর্ত। কূটবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যবসায়ী মানুষ। মাখনের উপর ছুরি চালানোর মতো করে অনায়াসে সে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধরাশায়ী করে ব্যবসা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এমনকি নিজের সহোদর ভাইটিকেও যাকে বলে সাইড করে বাপের সম্পত্তির পুরোটাই প্রায় বাগিয়ে নিয়েছে। মোটামুটি শিক্ষিত একটি মেয়েকে বিয়ে করে তাকে বেঁধে রেখেছে কেবল গৃহকর্মের মধ্যে। দিনের পর দিন কর্তৃত্ব করে ভেঙ্গে দিয়েছে মেয়েটির মনোবল, সংসারে কোণঠাসা করেছে মেয়েটিকে। ইচ্ছে থাকলেও সে তার স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে পারেনি।

রমেশ ঘরে বাইরে মানুষকে কেবল ব্যবহার করেছে নিজের উচ্চাকাক্সক্ষা মেটানোর কাজে। তার নিজের আশেপাশের সবকিছুকেই নিয়ন্ত্রণ করতে চায় সে। ভালোবাসার জনদেরও ছেড়ে কথা বলেনি। এমন একজন স্বার্থপর মানুষ যে লোভী হবে এ আর এমন কি অস্বাভাবিক। রমেশের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। স্ত্রীকে ঘরের কাজ, অথর্ব মা-বাপের দেখভাল, আর সন্তান প্রতিপালনের অজুহাতে বাড়িতে আটকে রেখে বাইরে সে পরস্ত্রী-সঙ্গ করেছে। ছলে বলে কৌশলে নিজের নানা কামনা চরিতার্থতায় ব্যবহার করেছে তাদের। এমন একটি দুর্বৃত্তপ্রায় চরিত্র যদি এসে গল্পকারকে গুঁতায় আর বলে সে নাকি আসলে ভালো মানুষ, গল্পকারেরই ভুল হয়ে গেছে তার চরিত্র চিত্রণে, তবে কি সেটা মানা যায় ?

মানা না গেলেও রমেশ এসে আমাকে বিরক্ত করতে শুরু করল দিনে রাতে। ওর জ্বালায় টেকা দায় হলো আমার। হয়তো ঘুমোচ্ছি, ঘুমের মধ্যেই সে এসে হাজির।―‘আরে আমাকে ভিলেন বানিয়ে দিব্যি ঘুম লাগাচ্ছেন দেখি, উঠুন উঠুন ম্যাডাম’। যত বলি, ‘একটু বিশ্রাম করি, পরে শুনছি আপনার কথা’, সে শোনে না।―‘পাগল নাকি, অপেক্ষা করি আর আপনি গল্প ছেপে দিন কোথাও―আরে চিরকালের মতো ভিলেন হয়ে যাব আমি, না না এসব হবে না। আমার কথা আপনাকে শুনতেই হবে’। অগত্যা উঠে বসতে হয়। স্বাভাবিক ভাবেই মাথাটা গরম, গল্প লেখার ধকল কাটাতে একটু বিশ্রাম নিচ্ছিলাম, এ একেবারে কাঁচা ঘুম থেকে তুলে দিল। বেশ ঝেঝে উঠে বললাম, ‘যা সব কাণ্ড করেছেন সারা জীবন, তাতে আপনাকে ভিলেন বানাব না তো কি ? বুঝেছি আপনি অমর হতে চান, চান সকলে আপনাকে ভালোবাসুক, আপনার দুঃখে কাতর হোক, আপনার আনন্দে উৎফুল্ল হোক, আপনার বীর রসে প্রাণিত হোক―সারাজীবন জঘন্য সব কাজকর্ম করে এবার আমাকে ধরেছেন অমরত্বের আশায়―ইল্লি আর কি!’

রমেশ হার মানার লোক না, এটা তার প্রধান চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য―আমারই কলমের দোষ, কী আর বলি―শেষ পর্যন্ত সে আমাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে এতো জানা কথা। সে বলে চলল, ‘দিদিমণি, আমার গল্পটা আপনার চেয়ে অনেক বেশি ভালো বলব আমি―সেটা তো মানবেন ? তাহলে আমাকে বলতে দিন, আপনি শুনুন। তবে এও জানি আমি গল্পের চরিত্র মাত্র, যার কাঠামো তৈরি আপনার হাতে, আমি ইচ্ছে করলেই আপনার মতো যা ইচ্ছে তাই করতে পারব না, নিজের মতো করে লিখতে পারব না নিজেকে, কিন্তু আপনার তৈরি স্ট্রাকচারের মধ্যে থেকে যদি আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু কথা বলি সেটা আপনার শোনা উচিত’। আমি সায় দিলাম কি না দিলাম পরোয়া না করেই নিজের কথা বলতে শুরু করে রমেশ।

‘ম্যাডাম, আপনি লিখেছেন আমার স্বভাব নাকি আশপাশের মানুষজনকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা―এবং এদের নিজের সুবিধার্থে ব্যবহার করা। আচ্ছা বলুন তো, সেটা যদি না করতাম তাহলে তো অন্যদের হাতে নিয়ন্ত্রিত হতে হতো আমাকে এবং আমি যাকে বলে ইউসড হতাম তাদের হাতে। এই দুইয়ের মাঝখানে তো কিছু নেই, হয় মারো নয়তো মার খাও। এই যে আমার বাবা, আপনার গল্পে যে নিতান্ত একটা ভালো মানুষ―সে সারা জীবন মার খাওয়া ছাড়া আর কী করেছে বলতে পারেন ? সৎভাবে ব্যবসা করতে গিয়ে সর্বস্ব খুইয়েছে, এমনকি নিজের হাতে যে বসত বাড়িটা তৈরি করেছিল সেটাও খোয়াতে বসেছিল। তখন আমি টাকা দিয়ে না বাঁচালে পথে বসতে হতো ওদের’।―আমি এবার মুখ না খুলে পারলাম না, ‘ওদের পথে বসতে হতো তাই তুমি টাকা দিয়ে ওদের বাঁচিয়েছো এমনটা কিন্তু নয়। তোমার কাছে টাকা ছিল, তুমি সুযোগের সদ্ব্যবহার করে নামমাত্র দামে গোটা বাড়িটা নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলে। তোমার বাবা তাতে রাজি হয়েছিলেন। কারণ তিনি ভেবেছিলেন তার কষ্ট করে তৈরি করা বাড়িটা অন্যের হাতে না তার এক বংশধরের হাতে অন্তত থাকবে। তুমি তার কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিলে কোনওদিন ছোটভাইকে ওই বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করবে না। বাবার মৃত্যুর পর সেই কথাও তুমি রাখোনি।’

‘আহ’―চেঁচিয়ে উঠে রমেশ, ‘আপনি তো জানেন বাবার টাকার প্রয়োজন ছিল না। ছোটভাইটা কুপথে গিয়ে ধার দেনা করেছিল আর সেই টাকা মেটাতে বাড়ি বিক্রি করতে হয়েছিল বাবাকে। আপনি এই ভাবে লিখুন―আমি তখন উদ্ধার করেছিলাম ছোটভাইকে, বাড়িটা কিনে নিয়ে, নইলে তো ওকে জেলে যেতে হতো। বাবা তো আমাদের দুই ভাইকেই ব্যবসা করে দিয়েছিল। ও সেটা রাখতে পারেনি, আড্ডা মেরে, জুয়া খেলে, মদ খেয়ে নষ্ট করেছে সব আর আমি দিনরাত এক করে কঠোর পরিশ্রমে ব্যবসাটা বড় করেছি―এখন দোষ কি আমার ?’

‘রমেশ, ছোট ভাইটা তোমাকে ঈশ্বরের মতো মানত, আমি যদি বলি তুমি ইচ্ছে করে ওকে বয়ে যেতে দিয়েছো, ও বদ সঙ্গে পড়ছে দেখেও ওকে সরাওনি ওখান থেকে, জুয়া খেলে জেনেও শয়তানি করে বাবার নিষেধ সত্ত্বেও টাকা গুঁজে দিয়েছো ওর হাতে যাতে ও সহজেই নষ্ট হয়ে যায়। বড় ভাই হয়ে ওর কোনও খেয়াল রেখেছো তুমি ?’

‘আপনি বড় বেশি উল্টো বোঝেন। এরকম করে ভাবছেন না কেন ছোট ভাইটা আবদার করত তাই বড় হয়ে ওকে টাকা দিয়েছি যখন চেয়েছে। আর আমার পক্ষে নিজের কাজ ছেড়ে ওর পিছন পিছন ঘোরা সম্ভব ছিল না, কার সঙ্গে মিশছে, কী করছে সেটা আমি অত জানতামও না। ভেবেছিলাম ভদ্রবাড়ির ছেলে যৌবনে দুষ্টুমি করলেও সব ঠিক হয়ে যাবে বয়েস হলে। এ সব কিছুর মধ্যে আপনি অসহায় এক বড় ভাইয়ের ছবিটা দেখতে পাচ্ছেন না, যে ছোটভাইকে স্নেহের বশে টাকা দিত, তারপর তার বিপদে তাকে বাঁচাতে এবং অন্যের হাত থেকে বাড়িটা বাঁচাতে টাকা জোগাড় করে বাড়িটা কিনে নিয়ে স্বস্তি দিল বৃদ্ধ বাবাকে ? এসব চোখে পড়ছে না আপনার ?’

‘তাহলে বাবা চোখ বুজতেই ছোট ভাইটাকে বাড়ি থেকে তাড়ালে কেন ?’

‘আপনি জানতেন না ততদিনে পাওনাদারেরা ওকে ছেঁকে ধরেছে, রোজ মদ না হলে এক মুহূর্ত চলে না ওর ? নেশার জন্য বাড়ির টুকটাক জিনিসপত্র সরাতে শুরু করেছে ততদিনে। আমার সন্তান বড় হচ্ছে, এই পরিবেশে কেমন করে সন্তান মানুষ করতাম আমি ?’

‘ও―তাই ভাইটাকে বাড়ি থেকে বার করে একটা বস্তির ঘরে পাঠিয়ে দিলে।’

‘হ্যাঁ দিয়েছি, কারণ কোনও ভদ্র পাড়ায় থাকার উপযুক্ত আর ছিল না ও। তবে বস্তির ঘরের টাকা, ওর রোজের খাওয়ার টাকাও যে আমি দিই সেটা একলাইনে সেরেছেন আপনি। কিন্তু যদি চাইতেন সেটা হাইলাইট করে একটা চ্যাপ্টার লিখতে পারতেন। বখে যাওয়া ভাইকে নিরাশ্রয় না করে এই শহরের মধ্যেই তার ভরণপোষণের ব্যবস্থা করেছি আমি। পাওনাদারদের দেনা মিটিয়েছি, এমনকি তার নেশার জোগানও দিতে হয়েছে আমাকে। এই স্বার্থপর সময়ে এ তো এক দারুণ স্বার্থত্যাগের নিদর্শন। লোকে ধন্য ধন্য করবে যদি আপনি একটু অন্যভাবে ব্যাপারটা দেখান। বৃদ্ধ বাবা মাকে আমৃত্যু সেবা করেছি আমি, নিজেদের বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হতে হয়নি তাদের―সেও তো আমারই জন্য।’

রাগে আমার শরীর কাঁপতে থাকে, ‘বৃদ্ধ মা-বাবার দেখভাল―ভালো বললে, ওদের দেখভাল করেছে তোমার বউ আর কাজের লোকজন। একটা অন্ধকার ঘরে দুটো পাশাপাশি খাটে জীবনের শেষ বছরগুলো অনেক কষ্টে অনেক আফসোসে কেটেছিল ওদের। তুমি সেই ঘরে উঁকি দিয়েও দেখতে না, মনে পড়ছে ?’

‘কাজের চাপ, ব্যবসার চাপ, সর্বোপরি একা রোজগেরে মানুষ আমি―আমার ব্যাবস্থাপনায়, আমার দেওয়া টাকাতেই ওদের শেষ জীবনটা চলেছিল। আমি তো একমাত্র সন্তান ছিলাম না, ভাই তো কিছুই করেনি ওদের জন্য। শুধু যন্ত্রণা দিয়েছে। আমিও তো ওদের না দেখতে পারতাম।’

কথোপকথনের মাঝখানে কখন যেন ছায়ার মতো রমেশের একপাশে এসে দাঁড়িয়েছে রাধা। রমেশের বউ।

‘আর আমার সঙ্গে ? আমার সঙ্গে তুমি কী করেছো বলবে না ?’

রমেশ ধমকে ওঠে―‘যা করেছি তোমার ভালোর জন্যই করেছি।’

আমি রমেশকে না বলে পারি না, ‘ওকে বলতে দাও ওর কথা। ও তো তোমারি মতো একটা চরিত্র এই গল্পের। আমি শুনতে চাই ও কী বলছে গল্পটা নিয়ে। রাধা তুমি বলো, কোথাও কি বুঝতে ভুল হয়ে গেছে আমার ? সত্যি কি আমি রমেশকে বুঝতে ভুল করেছি’ ?

‘আপনি ওকে বুঝতেই পারেননি দিদি।’ রাধার উত্তরে আমি থমকে যাই। ও কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে বলে―‘আপনারা শিল্প দিয়ে বাস্তবের কত সামান্যই যে ফুটিয়ে তুলতে পারেন তা যদি নিজেরা জানতেন তবে হয়তো আর এই―’

‘আর এই কি ? বলো রাধা’ ?

‘বলছি দিদি―যদি জানতেন তাহলে হয়তো আর কোনওদিন লেখার চেষ্টাই করতেন না। নিজেকে এতটাই ব্যর্থ মনে হতো আপনার, আপনাদের―যারা নিজেদের শিল্পী মনে করেন, শিল্প সৃষ্টি করছেন বলে মনে করেন।’

রাধার গলায় তীব্র রাগ আর শ্লেষ। রমেশ ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বলে ওঠে,―‘জানে না বোঝে না কথা বলছে, ম্যাডাম আসলে ও এতটাই সহজ, এতটাই বোকা যে ওর কথা শোনা মানে সময় নষ্ট করা―এই এই তুমি ভিতরে যাও তো।’

‘না ও ভিতরে যাবে না, বলো তুমি কী বলবে রাধা।’

আপনি জানেন না রমেশ কতটা নীচ―আর আমার মতো পরাধীন জীবন, দিনের পর দিন অপমানিত হয়ে কাটানো জীবন, বলিপ্রদত্ত এক জন্তুর মতো একটা জীবন কি কখনও কাটায়েছেন আপনি ? কাটাননি। তাহলে আপনি আমাকে বুঝবেন কী করে। আপনার কাছে সেটা আশা করাই ভুল হবে।’

‘তুমি বলো রাধা, তোমার নিজের কথা―আমাকে জানাও। আমি তো  লিখেছি, তোমার স্বামী সর্বতোভাবে ক্ষমতা প্রয়োগ করেছে তোমার উপর, কোণঠাসা করেছে তোমাকে, এমনকি তোমার নিজের সন্তানও তোমাকে ব্যক্তিত্বহীন মনে করে মানুষের মর্যাদা দেয় না। কারণ তোমার প্রতি তার বাবার আচরণ দেখে দেখে সে এটাই শিখেছে। রমেশের রেজাল্টের থেকে তোমার রেজাল্ট বরাবর ভালো, সেটা তুমি একদিন বলার পর থেকে রমেশের হিংসা তোমার প্রতি আরও বেড়ে যায়, কারণ ও তোমার যোগ্যতাকে ভয় পেয়েছিল, বুঝতে পেরেছিল সুযোগ পেলে তুমি ওকে ছাপিয়ে যাবে। আর সেই জন্যই দমিয়ে রেখেছে তোমাকে প্রথম থেকে।’

‘তোমার উপস্থিতি সত্ত্বেও বিভিন্ন মহিলার সঙ্গে মিশেছে, তুমি প্রতিবাদ করলে ওই মহিলাদের সঙ্গে তুলনা টেনে তোমাকে হেয় করেছে তোমার সন্তানের সামনে। এমনকি অনেক সময় ওই মহিলাদের সামনেও। দিন দিন নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছো তুমি, মেনে নিয়েছ নিজের নিয়তি।’

‘না মেনে নিইনি, প্রতিবাদ করেছিলাম, আর রমেশের মতো লোকের কথা না শুনলে কী হতে পারে তা আপনি জানেন না ? লিখতে পেরেছেন দিনের পর দিন আমার উপর চলতে থাকা যৌন অত্যাচারের বিবরণ ? রেখে ঢেকে লিখেছেন, আপনার লেখা ‘শারীরিক নির্যাতনের’ চড়-থাপ্পড়ের আড়ালে যে ঢাকা পড়ে আছে কত ঘৃণ্য বমন উদ্রেককারী কুকীর্তি তা আপনি জানতেও চাননি লিখতেও চাননি। হাজার হোক মেয়ে লেখক তো, কলমের মাথায় বোরখা পরানো না থাক ঘোমটা পরানো তো আছে।’

রমেশ চিৎকার করে ওঠে, ‘থামুন তো আপনারা, আপনাদের এই ঘ্যানঘ্যানানি অনেকক্ষণ থেকে শুনছি। রাধার না হয় বুদ্ধিসুদ্ধি ধারালো নয় কিন্তু আপনি কী করে সায় দিয়ে যাচ্ছেন ওর কথায়, অবশ্য লিখেছেন ও তো ওই ধাঁচেরই―কী আর বলি। আচ্ছা দেখুন তো এইভাবে ভাবা যায় কিনা, স্বামীর কাজ হলো স্ত্রী কে প্রতিপালন করা। আমি তো সেই কাজে কোনওদিন কোনও গাফিলতি করিনি। এই কাক, চিল, শকুনের পৃথিবীতে ওকে বাইরে রোজগারের জন্য পাঠালে ও কি খুব আরামে থাকত। আপনি নিজের বুকে হাত দিয়ে বলুন তো মেয়েদের কত রকম অসম্মানের মধ্যে পড়তে হয় ঘরের বাইরে কাজে বেরিয়ে ? আমি ওর স্বামী আমার অসম্মানই সহ্য হচ্ছে না ওর―বাইরের লোকের অসম্মান সহ্য হতো তো ? আজকের মতো কোমল হৃদয় নিয়ে ও বেঁচে থাকতে পারত তো ? উত্তর আপনি জানেন, পারত না। আর আমি যেসব মহিলাসঙ্গ করেছি তাদের কাউকেই আমি স্ত্রীর সম্মান দিইনি। সেই সব সম্পর্কই ছিল গিভ অ্যান্ড টেকের। একথা আমি ওকে কতবার বুঝিয়ে বলেছি জিজ্ঞেস করুন। সে সব ওর মোটা মাথায় ঢুকলে তো। আর সন্তানকে আমি শেখাব কি, সে তো দেখতেই পাচ্ছে বাইরের জগৎ সম্পর্কে কোনও ধারণাই নেই ওর মায়ের। ভুলভাল মন্তব্য করে ফেলে, ছেলে বড় হয়েছে তার কাছে ধমক খায়―এও কি আমার দোষ ? খাচ্ছে, দাচ্ছে, বাড়িতে দশটা কাজের লোক, বছরে এক মাসের ফরেন ট্রিপ―এই দুঃখবিলাসের কোনও মানে নেই।’

রাধা পাগলের মতো চিৎকার করে ওঠে, ‘আমাকে মানুষের মর্যাদা দাও না তুমি। একটা মনুষ্যেতর পশুর মতো ব্যবহার কর আমার সঙ্গে―বন্ধ দরজার ভিতর কী করো তুমি আমার সঙ্গে সেই কথা কি লিখতে পেরেছেন দিদি ? দিতে পেরেছেন বিশদ বিবরণ ? উনি জানেন তবু লিখতে পারেননি, কারণ তাতে শিল্পের সৌন্দর্য নষ্ট হয়।’ ককিয়ে কেঁদে ওঠে রাধা, কাঁদতেই থাকে।

আমার মাথা নিচু হয়ে যায় সেই কান্নার সামনে। রাধা ধীরে ধীরে সরে যায়।

রমেশ দাঁড়িয়ে থাকে, আমার চোখে চোখ রেখে বলে চলে, ‘ম্যাডাম শেষবারের জন্য অনুরোধ করছি গল্পটা পাল্টে ফেলুন। প্রথমে আমার স্ট্রাগলের কথা লিখুন, তারপর আমার উত্তরণের কথা লিখুন―আমার জীবনে কামরসের উপাদান প্রচুর, সেগুলো একটু সিম্প্যাথি রসে ভিজিয়ে পরিবেশন করুন―একজন মানুষ তার জড়ভরত সঙ্গিনীর কাছ থেকে কিছু পেল না, জীবন তাকে একদিকে বঞ্চিত করল, তবে সে পূর্ণতা পাবে কী করে ? আউটলেট তো তাকে খুঁজতেই হবে। সব নায়ক চরিত্র সব মহাপুরুষরাই তাই করেছেন। লক্ষ করুন আজকাল বায়োপিকগুলো ঠিক এই ফরমুলাতেই হিট করছে, ভিলেনই সেখানে হিরো। আপনার ভালোর জন্য বলছি গল্পটা এই ভাবে দিলে কিন্তু বাজার ধরতে পারবে না।’

আমি ওর বকবকানি থামাতে বলি, ‘আচ্ছা তুমি এখন এসো, একটু ভাবি আমি।’

গল্পটা না ছাপা হওয়া পর্যন্ত রমেশ আমাকে ছাড়বে না সেটা বেশ বুঝতে পারছিলাম। তাই এক বন্ধু সম্পাদককে ফোন করলাম। সে আমার কাছে কয়েক মাস আগে একটা গল্প চেয়েছিল। বললাম, ‘একটা গল্প পাঠাচ্ছি’। সে সানন্দে রাজি হয়ে গেল। আমি সেই রাতেই গল্পটা ইমেল করে দিলাম। এবার স্বস্তি। আরাম করে পিঠ টান করলাম।

পরদিন সকালে সম্পাদক বন্ধু ফোন করল, ‘তোমার গল্পটা ভালই, তবে প্রধান চরিত্র রমেশের মধ্যে একটু টুইস্ট আনলে গল্পটা বেশ অন্যরকম দাঁড়াবে, আরও ভালো হবে, মানে রমেশ যত বাজে কাজই করুন মানুষের মনে তার জন্য একটা সিম্প্যাথি জাগিয়ে তুলতে হবে। মানে অন্তত একটা অভিশপ্ত নায়ক ইমেজ আর কি―’ ও কথা বলে যাচ্ছিল আর আমার মনে হচ্ছিল রমেশ কথা বলছে ওর গলায়, নাছোড়বান্দা চরিত্রটি এখনও আমার পিছু ছাড়েনি। আমি কোনওরকমে, ‘আচ্ছা দেখছি কী করা যায়’ বলে ফোন ছেড়ে দিলাম।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button