আর্কাইভগল্প

গল্প : চাতালে চক্রব্যূহ : জয়দীপ দে

নদীটা দেখেই বুক ধক করে উঠল জয়নালের। ঠিক নদী নয়। নদীর পাড়। নদীও হয়তো। কিন্তু এই নদী তো তার কাছে নতুন কিছু নয়। একটা জীবন কেটে গেল এ নদীর পাড়ে। তার জন্ম হয়েছিল পৌষের রাতে। ভোর হতে না হতেই তার মাকে ছুটে যেতে হয়েছিল নদীর ঘাটে। কাপড় কাচতে। এতবার সে গল্পটা শুনেছে, মাঝে মাঝে ভ্রম হয়, মনে হয় সে মায়ের পিছু পিছু গিয়ে ঘটনাটা দেখেছে। কাপড় কাচতে কাচতে তার মা চোখ মুছছিল আর বুড়ি দাদির বাপান্ত করছিল।

তখন নদীর ঘাটে স্টিমার ভিড়ত। হয়তো মা কাপড় কাচতে কাচতে উদাস হয়ে তাকিয়েছিল স্টিমারের দিকে। পাটের গাঁইট নামাতে ব্যস্ত খালাসিদের হুলোড়। চাপা আওয়াজ। তখনই হয়তো সিটি বেজে উঠেছিল চট মিলের। বাবা মিলের লুম অপারেটর ছিল। সে নিশ্চয়ই মাকে একটা কড়া গালি দিয়ে হনহনিয়ে ছুটছিল মিল ব্যারাকের দিকে।

বুড়ি তখন বাচ্চা সামলাতে ব্যস্ত। জয়নাল চিৎকার করে প্রতিটি কাজের প্রতিবাদ জানাচ্ছিল যেন। তবে বুড়ি সবসময় তাকে শোনাত কীভাবে সে জয়নালের মায়ের যত্ন নিয়েছে। মিয়া বাড়ি থেকে কালিজিরা এনে বেটে দিয়েছিল পুত্রবধূকে। তাই তো জয়নালের মায়ের ভারী দুটো বুক ভরে ছিল ঘন দুধে। জয়নাল রাক্ষসের মতো টানত। কখনও সখনও লঞ্চের সাইরেন শুনে সচকিত হতো, আবার স্তন্যপানে মন দিত।

তখন মিলের অবস্থা জমজমাট। মালিক ছিল গাউস খান। উত্তর প্রদেশের লোক। পাকিস্তান হওয়ার পর চলে আসেন করাচি। সেখান থেকে মাঝে মাঝে ছুটে আসতেন। বেঁটে, গাট্টাগোট্টা টাইপের মানুষ। সারাক্ষণ পান খেতেন। ভীষণ ব্যবসাদার লোক ছিলেন। কোনও ভাবেই মিলে যেন কোনও গ্যাঞ্জাম না বাঁধে সে জন্য ছিল কান-খাড়া। যে বছর চটের দাম বেশি মিলত, বোনাস দিত শ্রমিকদের। শ্রমিকেরা এ নিয়ে বেশ সুখী ছিল। লোকজন ক্ষেত-কৃষি ফেলে মিলে কাজ নিত। সামান্য ক্ষেত-কৃষিতে কী আয় ? ছয় মাস খেয়ে না খেয়ে থাকতে হয়। তার চেয়ে যাও নিশ্চিত আয়ের পথে। মিলে কাজ নাও। এভাবেই জয়নালের বাবা ইউনুস মোল্লা বদলি লেবারের কাজ নিয়েছিলেন মিলে।

এ নদীর বুকে সব গল্প জমা আছে। মনটা হুহু করে ওঠে সেসব কথা ভাবলে। তখন বাড়ি থেকে আউশ ধান আসত। নদীতে বিরাট বিরাট ঘাগট বোয়াল ধরা পড়ত। এত বড় মাছ নদীতে থাকার কথা নয়। পাহাড়ি ঢলে ভেসে আসত। ঘাগট বোয়ালের সঙ্গে আসত ডায়েরিয়া ম্যালেরিয়া আর গুটিবসন্ত। মিলে এক পাঞ্জাবি ডাক্তারকে নিয়োগ দেওয়া হলো। সঙ্গে দুজন প্যারামেডিকস। তারা ধ্বস্তাধ্বস্তি করে সুঁই ফুটিয়ে দিত। এদের কল্যাণে মৃত্যু কমল। বাড়ল ঝগড়া-ঝাটি। বিহারি কলোনির ছেলেরা মাস্তানি করত লোকাল কলোনিতে এসে। প্রায় চাকু ছুরি পর্যন্ত গড়াত। গাউস খান খুব উদ্বিগ্ন হয়ে উঠলেন। সুন্দর একটা সমাধান এনে দিল বাষট্টির দাঙ্গা। দুই কলোনির গুন্ডারা মিলে স্টিমারে করে ছুটল হিন্দুবাড়ি লুট করতে। জয়নালের বাবাও কয়েকটা কাঁসার ডেচকি পাতিল এনেছিল। এখনও এসব পার্বণে কাজে লাগে। 

এরপর শুরু হলো নন-কোঅপারেশন মুভমেন্ট। রেগুলার মিছিল মিটিং হতো। লিডারের নিদেশে সব বন্ধ। মিলের গেটে তালা। কিন্তু ভেতরে ভেতরে সব হতো। শুধু বন্ধ থাকত মিলের স্কুলটা। তখন মনে হতো স্কুলের মাস্টারগুলোই লিডারের কথা শুনছে। সারাদিন খালি গায়ে একটা জিপার খোলা হাফপ্যান্ট পরে ঘুরে বেড়াত জয়নাল। তার মতো দুয়েকটা বাচ্চা এক হলে ‘জয় বাংলা’ সেøাগান দিত। বিহারি শ্রমিকেরা শুনলে তেড়ে আসত। তাদের ক্ষেপাতে বেশি বেশি করে সেøাগান দিত তারা।

আদুল গায়ে ছোটাছুটির মধ্যে যুদ্ধ হয়ে গেল। সংগ্রাম কমিটির কিছু নেতা বাদে সবাই প্রতিদিনের কাজ চালিয়ে গেছে। কারও মিল ছাড়তে হয়নি। কেবল ডিসেম্বরের মাঝামাঝিতে, ক্যান্টনমেন্ট ক্র্যাক ডাউনের পর বিহারি অফিসাররা চলে গেল অন্য কোথাও। কোথায় গেল, সে খবর কেউ বলতে পারল না। ভারত থেকে ফিরে এল সংগ্রাম কমিটির নেতারা। এখন আর গাউস খান মালিক নন। সংগ্রাম কমিটিই মিলের হত্তাকত্তা হয়ে উঠল। বিহারি ফোরম্যান ইঞ্জিনম্যান নেই। নেই ম্যানেজার। এক হযবরল অবস্থা। লোকজন কাজ করতে চায় না। বেশি চাপ দিলে চাদরের ভেতর থেকে পিস্তল বের করে চোখ রাঙায়। অবস্থা খারাপ। সেবার চটের রপ্তানি কম হলো। মিলের কোষাগার শূন্য। বেতন গেল ফেঁসে। এই প্রথম তারা বুঝল ভাতের কষ্ট। ইতোমধ্যে জয়নালের তিনটে ভাইবোন হয়েছে। ইউনুস মোল্লার কণ্ঠে আফসোস ঝরে পড়ে, গাউস খানের গোলামি না করলে আইজ আমাগো ভাতের কষ্ট হইত না। কী সোন্দর জমিন, বর্গা দিয়া রাখছি।

জায়নাল অবাক হয়ে ভাবে, তবে কি এতদিনের জানাশোনা সব মিথ্যে ? বুড়ি তো বলত দাদা যখন মাঠের কাম করত সারা বছর ভাত জুটত না। কোনটা সত্য ?

এরপর এক সরকারি অফিসার এল। সঙ্গে তার পিয়ন কেরানি। সরকার ফান্ড দিল। মিল হয়ে গেল সরকারি। এবার আর চিন্তা নাই। মাসে মাসে বেতন। চাকরি শেষে পেনশন।

জয়নালের বয়স বাড়িয়ে চাকরিতে ঢুকিয়ে দিলেন ইউনুস মোল্লা। খালাসির চাকরি। কাজ পাটের গাঁইটগুলো স্টিমার থেকে লরিতে তোলা। কয়েক দিন কাজ করার পর সে বদলি হলো গুদাম শাখায়। হলো ঠিক না, করানো হলো। এরপর থেকে সে অন্য পরিচয়ে পরিচিত হতে লাগল। তরুণ সিবিএ কর্মী। ইউনুস মোল্লা ততদিনে মাঝারি সারির নেতা। মিলের খালি জায়গায় সিবিএ নেতারা মিলে একটা মার্কেট দিল। অফিসার বাধা দিয়েছিল, শেষমেষ আটকাতে পারেনি। ইউনুস মোল্লা নামমাত্র টাকায় একটা পজিশন পেল। দরমার বেড়া দিয়ে একটা দোকান তুলল। সেখানে এখন বসে থাকে ইউনুস। ছেলে জয়নাল নেতাগিরি করে বেড়ায়। তক্কে আছে ছোট ভাইকেও মিলে ঢুকাতে।

এমন একটা অবস্থায় পটপরিবর্তন ঘটল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। ইউনুস মোল্লার উপরের নেতারা সব গা ঢাকা দিল। ইউনুস বিনা চেষ্টায় সিবিএর সভাপতি হয়ে গেল। কী দ্রুত সব পরির্তন! কৃষক থেকে মিলের শ্রমিক। তারপর সিবিএ নেতা। কাপড়ের ব্যবসায়ী। কিন্তু রক্ত তো সেই চাষারই রয়ে গেল। বিভিন্নভাবে ইউনুসের রুটি রুজি বাড়তে লাগল। সেই কাঁচা টাকায় জমি কিনতে লাগলেন ইউনুস। বিঘাকে বিঘা জমি। আর ভাতের চিন্তা নাই। ইউনুস মোল্লার ভাগ্য ফিরলেও মিলটির সংকট আরও ঘনীভূত হলো। ধার কর্জ করে আর কতদিন। একদিন কোনও কথা ছাড়া মেশিনের গিয়ারগুলো বন্ধ হয়ে গেল। বিদ্যুৎ বিভাগ এসে কেটে দিল বিদ্যুতের লাইন। লোকজন হই হল্লা করল। স্টিমারঘাটে গিয়ে সেøাগান দিল। কে শোনে কার সেøাগান।

ছয় মাস বেতন বন্ধ থাকল। তারপর কিছু ফান্ড এল। অল্প কিছু পয়সা হাতে ধরিয়ে জানিয়ে দেওয়া হলো লে অফ। নতুন শব্দ শুনল শ্রমিকেরা। লে অফ। মানে আপাতত বন্ধ। কবে খুলবে ঠিক নাই।

দুজনের বকেয়া বেতনের টাকা দিয়ে ইউনুস ব্যবসা আরও বাড়াল। দরমা খুলে টিন লাগল। জয়নালের হাতেও অফুরান সময়। বাপ ব্যাটায় মিলে ব্যবসা বাড়াতে লাগল।

আর যাদের ব্যবসাপাতি জমি-জিরাত কিছুই ছিল না, তারা নামল রাতের আঁধারে মিলের লোহা সরানোর কাজে। ওরা যেন জেনেই গেছে এ মিলের কোনও ভবিষ্যৎ নাই। যা পাও নগদে, হাত পেতে নাও।

লুটেপুটে যখন মিলটা শূন্য খোঁড়ল, সরকার তখন সিদ্ধান্ত নিল বেচে দেবার। এদিকে উজানে পুল বসেছে। ফলে এখানকার যাতায়াত হয়েছে সহজ। হুহু করে বাড়তে লাগল জমির দাম। নয়নজুলির ইউনিয়ন বোর্ড প্রেসিডেন্ট মিয়াজান ততদিনে বিরাট নেতা। মন্ত্রী-মিনিস্টারের সঙ্গে উঠবস্। নয়নজুলিতে একটা ম্যাচ ফ্যাক্টরিও দিয়েছে। মিয়াজান ছুটে এলেন মিলটার বন্দোবস্ত নিতে। সরকার যে ভ্যালুয়েশন করল, তা দিয়ে কিনতে হলে মিয়াজানকে তিনবার জন্ম নিতে হবে। তারপরও মিয়াজান কী করে কী করে যেন মিলটার কাগজ পেয়ে যায়। সবাই আশায় বুক বাঁধল। আবার কারখানার চাকা ঘুরবে।

ঘুরল। তবে অল্প কয়টা লুমের। সবটাই ছিল লোক দেখানো। মিলের খালি জায়গায় মিয়াজান গড়ে তুললেন বিশাল বিশাল গুদাম। সে গুদামগুলো ভরে উঠল সোনালি পাটে। সবাই ধন্য ধন্য বলে উঠল। শোনা গেল মিয়াজান মোটা অংকের লোন পেয়েছেন ব্যাংক থেকে। কিন্তু আশার তাসের তুরুপ বেশি দিন দাঁড়িয়ে থাকতে পারল না। একদিন ফজরের আজানের আগেই মসজিদের মাইকে মোয়াজ্জিনের কণ্ঠ শোনা গেল। পাটের গুদামে আগুন লেগেছে। হায় হায়। মিয়াজানের এবার কী হবে ?

মিয়াজান সে বছরই জাপানি গাড়ি কিনলেন। ঢাকা না চট্টগ্রাম না খুলনায়―ঠিক করে বলা গেল না, একটা পেল্লাই দালান তুলেছেন বলে গুঞ্জন শোনা গেল না। লোকসানে জর্জরিত মিয়াজান বন্ধ করে দিলেন মিলের শেষ লুমটি। মিয়াজানের আর কী বা করার আছে ?

চায়ের দোকানে লোকজন আফসোস করে।

কিন্তু সিবিএর পান্ডা মকবুল খেকিয়ে ওঠে, কুত্তার বাচ্চা একটা হারামি। ও-ই তো পয়সা দিয়ে গোডাউনে আগুন লাগাইছে। ব্যাংকের টাকা মাইরা দিতে…

কী সর্বনাশের কথা!

তবে সব খারাপের পর ভালো কিছু আসে। পোড়া গুদামগুলো কিছুদিনের মাথায় ভরে উঠল তেল আর চিনিতে। মিয়াজান হয়ে উঠলেন দেশের সবচেয়ে বড় তেল-চিনির ব্যবসায়ী।

আর মিল ব্যারাকগুলো ভরে উঠল ধুলো কালি আর বাদুড়ে। এদিকে কলোনির বেকার ছেলেরা মেতে উঠল অন্য ব্যবসায়। জাহাজ থেকে চোরাই মাল এনে ভর্তি করল ব্যারাকের গলি-ঘুপচি। শহর থেকে লোকজন আসত লাগল সস্তা টিভি ফ্রিজের খোঁজে। মাঝে মাঝে পুলিশ রেইড দেয়। মাসোয়ারা ঠিকমতো গেলে অবশ্যি কোনও উৎপাত করে না।

মিয়াজান আর কলোনির ছেলেরা সমান্তরালে এগিয়ে যেতে লাগল। ইউনুস মোল্লার কাপড়ের ব্যবসায়ও জমজমাট হয়ে উঠল। কাঁচা পয়সার প্রবাহে মিলের আশেপাশের চেহারা পাল্টে গেলো। স্টিমারঘাটটা উঠে গেল। শহর থেকে মোটরগাড়িগুলো একদমে চলে আসতে পারে মিলের গেটে। কী আনন্দ কী আনন্দ। মিল এলাকার উন্নয়ন দেখে বৃদ্ধ ইউনুসের চোখে জল এসে যায়।

অবশ্য বেশিদিন এই জমাটি ভাব থাকল না। চোরাই মালের ব্যবসায় ধস নামল। মিয়াজান অন্য কোথাও আরও বড় কারখানা দিল। ফলে গোডাউনগুলো দিন দিন খালি হতে লাগল।

মিয়াজানের যুগ শেষ হলো। সিঙ্গাপুর না সিংড়াইতে তিনি শেষ নিঃশ^াস ফেললেন। বিরাট করে তার কুলখানি হলো মিল ব্যারাকে।

এবার হেমায়েত-নিয়ামতের যুগ। মিয়াজানের দুই পুত্র।

নদীর ওপারে উঁচু উঁচু চিমনি উঠতে দেখা গেল। সবুজ প্রান্তরেখা জুড়ে কাঁটাতারের মতো উঁকি দিতে লাগল ছাইরঙা কারখানাগুলোর চালা।

হেমায়েত-নিয়ামত ভূমির নেশায় পাগল হয়ে উঠল। নদীর দু পাড়ের সব ভূমি তারা কিনে নিতে চায়। মিল ভরে গেল দালালে। দালালিই সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসা হয়ে উঠল। যারা এতদিন চোরাচালানে ব্যস্ত ছিল, তারা হয়ে উঠল দুঁদে দালাল। এক শতক কিনে দিতে পারলে শতে ৫ টাকা কমিশন। বিশাল লাভ।

অল্পদিনে নদীর পাড়গুলো বিক্রি হয়ে গেল। হেমায়েত-নিয়ামত এলাকায় এলে সবাই ঘিরে ধরে। আমাদের শেষ সম্পদটাও তো আপনি নিয়ে গেলেন। আমাদের কী হবে ?

হেমায়েত-নিয়ামত মুচকি মুচকি হাসে।

দেখো না কী হয়…

দালালি শেষ। চোরাই ব্যবসা তো অনেক আগেই সাঙ্গ হয়েছে। মিলও বন্ধ। চাষ করে খাবে, এমন ভূমিও নাই। কী হবে মিল-কলোনির ছেলেদের ?

কলেজ ভার্সিটি থেকে পড়াশোনা শেষে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় ছেলে-ছোকরারা।

এর মধ্যে ইউনুস মোল্লা শুয়ে পড়েছেন নদীর পাড়ের গোরস্থানে। ঢেউ ধাক্কা মারে ঘাটে। যেন ইউনুসকে জাগিয়ে তুলতে চায়। ইউনুস নির্বিকার।

ইউনুসের অবর্তমানে তার জায়গায় প্রতিস্থাপিত হয় জয়নাল। সিবিএর সভাপতি এখন সে। সবাই এসে জয়নালকে ঘিরে ধরে। আমাদের কী হবে ? সব তো গেল…

মুরুব্বি সবাই দলবেঁধে গেল হেমায়েত-নিয়ামতের কাছে।

হেমায়েত-নিয়ামত এখন অনেকগুলো ব্যাংক-বিমার মালিক। হাজার হাজার মানুষের চাকরি দেয় তারা। তাই ওরা মুচকি হেসে বলে, চাচারা এত ক্ষেপেন কেন ? আপনাদের পোলাপাইনের নাম দেন।

হেমায়েত-নিয়ামত সত্যি সত্যি ভাগ্য বিধাতা হিসেবে অবতীর্ণ হলো মিল এলাকায়।

ছেলে-ছোকরাদের চাকরি বাকরি হতে লাগল। সাদা শার্ট কালো প্যান্ট পরে ছেলেরা এলাকা ছাড়তে শুরু করল। এক একজনের পোস্টিং হলো এক এক জেলায়। দূর দূরান্তে। ছুটি-ছাটার সময় ছাড়া পুরুষ-শূন্য থাকে এলাকাটা।

জয়নালের মতো বৃদ্ধরা একা একা ঘুরে বেড়ায় হাটে মাঠে। দোকানের বিকিকিনিও কমে এল দ্রুত। কেউ আর বাজারের দোকান থেকে কাপড় কিনতে চায় না। শহর থেকে সস্তায় ভালো কাপড় নিয়ে আসে।

এতকাল পরে জয়নালের যেন নদী দেখার সুযোগ হলো। ওপার থেকে নদী দীর্ঘশ^াস ছাড়ে, এপার থেকে জয়নাল। রাতদিন দু পক্ষের দীর্ঘশ^াস বিনিময় হয়।

নদী সেই প্রমত্তা রূপে নেই। ক্ষীণকায় এক খাল যেন। ঘাগট বোয়াল ধরার গল্পগুলো মধুর স্মৃতি হয়ে রয়ে গেছে।

নদীর দু পার জুড়ে ছিল সবুজ মাঠ। এখন ওপারে মিলের সারি। এপারে উর্বর ভূমির উপর ফেলা হচ্ছে বালু। রাতদিন ড্রেজারের ঘর্ঘর আওয়াজ। কৃষিভূমি হয়ে যাচ্ছে নালভূমি। যাতে সহজেই কারখানা তোলা যায়।

দেখতে দেখতে একটা জনপদ হয়ে যাচ্ছে অনুর্বরা। অনুৎপাদনশীল। জনমানুষশূন্য। জয়নালের বুকটা ধক করে ওঠে। ইতিহাসে অনেক জনপদ নাকি এভাবে হারিয়ে গেছে।

সকালে গিয়েছিল বাজারে। চিনির কেজি ১৭০ টাকা। তেল ১৭৫। মাসের বাজার করতে হিমশিম খায় জয়নাল।

চায়ের দোকানে বসে লোকজন গল্প করে। আবার হেমায়েত-নিয়ামতের কাছে যেতে হবে। তারা যদি গোডাউন থেকে তেল চিনি ছাড়ে বাজারে দাম কিছুটা কমবে।

মকবুলের দু পাটির একটাও দাঁত নেই অবশিষ্ট। বাংলা মদের ঝাঁজে ঝাঁজে পড়ে গেছে। তাই তার খেঁকিয়ে ওঠাটা ঠিক বোঝা যায় না।

হ্যাগোরে পাইবা কই ? ব্যাংক বেইচা সুইটকেস ভাইরা টাকা নিয়া তারা পলাইছে―

‘ব্যাংক বেইচা’ শব্দটাই শুধু ঘুরপাক খায় জয়নালের মাথায়। তার দুটি ছেলেই কাজ করে হেমায়েত-নিয়ামতের ব্যাংকে। এদের চাকরি চলে গেলে তারা করবে কী ? না আছে চাষের জমি, না মিল না গঞ্জের দোকান। যে কটা টাকা দালালি করে পেয়েছিল তাও ফিক্সড করে রাখা আছে হেমায়েত-নিয়ামতের ব্যাংকে। সে টাকাও যদি যায়… কোথায় যাবে তারা ?

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button