আর্কাইভগল্প

গল্প : পড়শি : আশান উজ জামান

এপ্রিল ১২, ১৯৭১

লন্ডন

হেলাল, প্রিয় আমার!

কেবলই আবার পড়লাম তোমার চিঠি―এই নিয়ে কতবার যে হলো, হিসাব নাই! এত সুন্দর করে তুমি লেখ কী করে! সালোয়ারটাও পছন্দ হয়েছে খুব। তাকিয়ে দেখো, তোমার মন মন সুতারা, প্রেম প্রেম রঙেরা কেমন জড়িয়ে রেখেছে আমায়! আমার চাপাস্বভাবের রঙ। কেমন দেখায় না দেখায়, কোনওদিনই তাই এসব রঙ পছন্দ করতাম না। অথচ আয়নায় নিজেকে আজ নিজেই চিনতে পারলাম না! এত সুন্দর মানিয়েছে! গ্যাবি মোরেনো, আমার নতুন রুমমেট, দেখেই বলছে আমাকে পরির মতো লাগছে! একটা পুরা খালি আকাশ ভালোবাসার তারাফুলে ভরে তোমাকে পাঠিয়ে দিলাম, নাও।

তোমার মতো লিখতে পারি না। বলতে পারি না তোমার মতো লাজলজ্জার মাথা খেয়ে। কিন্তু ভেবো না যে ভালো আমি কম বাসি একটুও। টেবিলে আমার এক গোছা নার্সিসাস ফুল। জ্যাক স্নেল, আমার ছাত্র, বিকেলে দিয়ে গেল আজ। ও তো ওয়েলসের ছেলে, ওদের জাতীয় ফুল এটা। আমরা বলি ড্যাফোডিল। এত স্নিগ্ধ এত সজীব! তাকালেই তাজা হয়ে ওঠে মন। ফুলটা কখনও দেখেছো কি না জানি না। লেখার সুবিধার্থে ধরে নিলাম দেখোনি। ও মা, তাই! এত সুন্দর ফুল তুমি দেখোনি কোনওদিন ? আচ্ছা, দাঁড়াও দাঁড়াও আমিই ব্যবস্থা করছি দেখানোর। চোখ বোজো। দেখো তোমার সামনে একটা ফুল হেসে আছে অন্ধকারে। যেন অমাবস্যার আঁধারে তুমি হঠাৎ পেয়ে গেছো সর্পরাজের মণি! মণিটা জ্বলছে, আলোকচ্ছটা ঠিকরে বেরুচ্ছে আভিজাত্য। ফুলটার ছয়টা রেশমসাদা পাপড়ি ছড়িয়ে আছে ছয়দিকে পিছে হেলে, আমরা গোসলের পর ধনুকের মতো বেঁকে গিয়ে যেমন করে চুল ঝাড়ি শাড়ির আঁচলে ঠিক অমন। পেছনে হেলে আছে বটে, কিন্তু মন ওদের পড়ে আছে কোলের ওপর থাকা একটা হলুদ জবার (ছোট্ট জবার মতোই ওই অংশটা, অন্য কিছু পেলাম না বুঝিয়ে বলবার মতো) দিকে। আমি ওই ফুলটার মতোই। ছয় পাশ দিয়ে আমাকে ইতিহাস গান বিতর্ক নৃত্য এটা সেটা টেনে ধরে রাখে। কিন্তু ভেতরের ওই হলুদ জবাটুকু আমি ঠিকই জিইয়ে রাখি তোমার জন্য। তোমারই জন্য।

যা হোক, আগামী মাসে ছুটি, দিন পনেরোর জন্য দেশে যাওয়ার ইচ্ছে। এখানে আসতে চেয়েছো বলে বললাম। এখন এসো না, সোনা। আমি ফিরি আগে, তারপর জানাব। আর তুমি এলে আমিও তো তোমার ওখানে যাব। ফাতিমার সঙ্গে দেখা করতে উদগ্রীব হয়ে আছি। কখনও যাইনি, কিন্তু তক্ষশীলা আমার সবচেয়ে পছন্দের জায়গা। প্রাচীন ভারতের গৌরবময় জায়গাগুলো সম্পর্কে আমার আগ্রহ খুব। বললে বিশ^াস করবে না, নালন্দায় যতবার গিয়েছি আমি, বাপের ভিটায়ও যাইনি ততবার। গেলে আর ফিরতে ইচ্ছে করে না। একা একা হাঁটি আর ভাবি এখানেই বোধহয় ক্লাস হতো। এখানেই হয়তো পেট-ভরা বই নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল রত্নদধি―সে সময়ের পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। মনে হয় এই তো রত্নসাগরের দেয়াল, রত্নরঞ্জকের বারান্দা। ওখানে কারা যেন পড়ছে, আমি দেখতে পাই। গুনগুন শুনতে পাই। তারপর বখতিয়ার খিলজি এসে যেদিন মেরে ফেলল নালন্দার পণ্ডিতদের, তারপর আগুন ধরিয়ে দিল পাঠাগারে, মনে হয় নির্মম সেই আগুনের আঁচ আমিও পাই! আমারও জ্বলে-পুড়ে যায় গা। আর দ্বিগুণ যেন আঁকড়ে ধরি ঐতিহ্য আমাদের। খুব ঐতিহ্যসচেতন জাতি আমরা না, তবু যা আছে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, তাদের কাছে পৌঁছতে চাই সর্বান্তকরণে। তক্ষশীলায় গিয়েও তাই হারিয়ে যেতে চাই। কে জানে মহামতি চাণক্যের পায়ের ধুলা হয়তো জমে আছে কোনও না কোনও কোণে। দেখা গেল আমি গেলাম, আর সেটা উড়ে এসে বসল আমার মাথায়! ভাবতে পারছো, কত বড় আশীর্বাদ হবে সেটা আমার জন্য!

এখানকার এক লাইব্রেরিতে গিয়েছিলাম সেদিন। বহু পুরনো বই আছে। দ্যা এডভেঞ্চার অব পাঞ্জাব হিরো কিং রসালু বইটা পেয়ে কী যে আনন্দ হচ্ছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় বইটার অবস্থা খুব খারাপ। বাইরে আনতে দেবে না। পরীক্ষা শেষ হলে গিয়ে গিয়ে পড়ে আসব। প্রথম পাতাটা পড়েই পাগল হয়ে গেছি। পড়া শেষ হলেই তোমার ওখানে যাব। রাজা রসালুর এডভেঞ্চারের জায়গাগুলোও দেখে আসতে হবে।

আচ্ছা, অনেক বকবক করে ফেললাম। আসলে আমি এক বেরসিক, এত কিছু ভাবি, কিন্তু কিছুই লেখা হয় না। এবার ভেবেছিলাম একটা ছড়া বা কবিতা কিছু লিখব, তোমার অত সুন্দর কবিতার উত্তরে একটা কিছু না লেখা তো অন্যায়ই, না ? হা হোক, অপারগ বলেই অন্যায়টা আমাকে করতে হচ্ছে। ভয় পেয়ো না, তোমায় আমি ঠকাব না, এই অন্যায়ের শোধ আমি গান গেয়ে করব, কেমন ? তোমার কবিতার বদলে আমার নাচ আর গান, খুব কি অসম হবে কারবারটা ?

হলোই বা, ভালোবাসার মানুষের কাছে একটু আধটু ধার ঋণ থাকতেই পারে, কী বলো! 

তোমার পরবর্তী চিঠির জাদুর অপেক্ষায় থাকব। বিশেষ দ্রষ্টব্যে দুষ্টুমিষ্টি যে কথাটা লিখেছো, সেটার জন্য একটি দুটি তিন… আচ্ছা না, তিন শটি চিমটি! দূরে থাকলে এমন কথা বলে লোভ ধরাতে হয় না। আর হ্যাঁ, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা শুনছি ভালো না, এখানকার বাঙালিরা খুব তৎপর হয়ে উঠেছে দেখলাম। ব্যাপার কী ? খোঁজ নিয়ে জানিয়ো।

ইতি

লীলাবতী রায়, তোমার লীলা

মে ২, ১৯৭১

পাঞ্জাব বিশ^বিদ্যালয়, পাকিস্তান

লীলাবতী! প্রিয়তমা আমার!

আগেই বলেছি, আম্মি রাজিই হচ্ছিলেন না আমাদের সম্পর্কের ব্যাপারে। কিন্তু হাতে যখন আমি ব্লেড নিয়ে বলেছি শিরা কেটে ফেলব, তখন আর উপায়ও পাননি। তোমাকে দেখতে আসার খরচ দেওয়ার জন্যও রাজি করিয়েছি। সবকিছু গুছিয়ে নিয়েই আমি ছুটে আসব তোমার কাছে। তোমার গান গান কথা আর কথা কথা গান শুনব, পাশে বসে তোমার উড়ে আসা চুলের বনে হারিয়ে ফেলব হুঁশ, তোমার ঘ্রাণে ভরে নেবো শূন্যশুকো প্রাণ―কবে যাব কবে যাব―তর সইছে না, আর তুমি কি না বলছো, দেশে যাবে ? এরচেয়ে তুমি এক পাহাড় পাথর ছুড়ে মারতে যদি, তাও হয়তো সহ্য করে নিতাম!

আচ্ছা যাও, ছুটি তো আর সবসময় পাবে না, ঘুরে আসো। তবে ফিরতে দেরি কোরো না। এতদিন দেখা হয়নি, কোনও সমস্যাই ছিল না। কিন্তু যেদিন থেকে দেখার কথা ভেবেছি, সেদিন থেকে আর অপেক্ষা করতে পারছি না। দম ফেটে মরেই না যাই আমি এর মধ্যে! অবশ্য, ভাবছি, তোমাকে না দেখে এ চোখ আমি বুজব কী করে!

তারপর তুমি যখন পিণ্ডি আসবে, তখন তোমার যোগ্য গাইড যেন হতে পারি সেজন্য পড়াশোনা শুরু করেছি। তক্ষশীলায় গিয়েওছি আরও একবার। তুমি বিশ^াস করবে না, যখন আমি হাঁটছিলাম, মনে হচ্ছিল তুমি আমার পাশেই আছো! মনে মনে তোমার হাত ধরে হাঁটছি―আহা, সে যে কী শান্তি, কী যে তৃপ্তির সেই চলা! এমন তৃপ্তি বুকে ভরেই সঙ্গে থাকতে চাই তোমার, সারাটা জীবন।

শুনে তুমি খুশিই হবে, ভাবিকেও বলেছি তোমার কথা। তুমি যে তাঁকে খুব শ্রদ্ধা করো বলেছি। তুমি যে কাছে পেলে তাকে জড়িয়েই থাকবে, ছাড়বে না―বলেছি। খুব খুশি হয়েছেন। তোমরা দুজন এলে পরিবারটা আমাদের পূর্ণ হয়ে উঠবে। একটু সমস্যা অবশ্য এখনও আছে। ভাইজানকে রাজি করাতে পারেননি আম্মি। তুমি লীলা বলেই তার এই গাঁইগুঁই, পাকিস্তানি কোনও মুসলিম মেয়ে হলে কবেই মেনে নিত। তবে তুমি ভেবো না, আমি ঠিক করে নেব সব। না পারলে ব্লেড থেরাপি তো আছেই! আম্মির চেয়ে ভাইজান আমাকে বেশি ভালোবাসেন, ফলে মেনে না নিয়ে নিজের বুক নিশ্চয়ই খালি করতে চাইবে না সে!

আর তক্ষশীলার কথা বলছো! ওখানেই তো ফাতিমা থাকে, তার সঙ্গে দেখা করতে আমরা তক্ষশীলায়ই যাব তো। তোমার মতো অত কিছু হয়তো আমি পাব না, কিন্তু তুমি যদি পাও, সে তো আমারও আনন্দ। তা অমন আনন্দের ভ্রমণ মনে হচ্ছে আরও করতে পারবে তুমি। মহেঞ্জোদারোর নাম শুনেছো ? আমাদের এক প্রফেসরের কাছে শুনলাম কাল। পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাস ওর। সিন্ধু সভ্যতার অনন্য সাক্ষী হয়ে সে ডুবে ছিল মাটিতে। প্রফেসর বললেন, এটা খুঁজে পাওয়াই নাকি আমাদের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আবিষ্কার। তো এর খননকাজ করতে করতে বেশ কিছু প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গিয়েছিল। নর্তকীর মূর্তি, ধ্যানরত পূজারীর মূর্তি, আরও এটা সেটা। তবে অক্ষত অবস্থায় একমাত্র একটা হারই উদ্ধার করা গিয়েছিল। সোনার সুতোয় মোড়া মহামূল্য রঙিন পাথর বুনে বানানো সেই হার দেখতেও নাকি চোখ জুড়ায়। দেশভাগের সময় আর সব ভাগাভাগি করতে গিয়ে সেই হারটাও কেটে ফেলা হয়েছে, জানো! সিন্ধু সভ্যতা আমাদের সভ্যতা। সেখান থেকে পাওয়া প্রত্নসামগ্রী তো আমাদেরই প্রাপ্য, নাকি ? অথচ সেটারও ভাগ দিতে হলো ভারতকে! যা হোক, তুমি এলে ওখানেও নিয়ে যাব তোমায়।

তোমার কবিতা খুব সুন্দর হয়েছে।

গ্রীষ্মের বুকফাটা মাটির আর্তনাদ বুকে ধরে তাকিয়ে ছিলাম তোমার পথে। তোমার ঝিরিঝিরি কথার সুধা আমায় ভিজিয়ে দেবে, ভাসিয়ে নেবে! সেটা যখন পিছিয়েই গেল, কী আর করা, চিঠিতেই না হয় এঁকে দিও তোমাকে। পড়তে পড়তে দেখতে দেখতে বুক নেভাব।

চিঠির ঠোঁটে জোগান দিও কথা

কথার ফাঁকে সুর বাঁধানো মধুর নীরবতা

ওর ভুরুতে তোমার টানা ভুরু

এঁকে দিও ভুরুর মাঝে টিপের দুরু দুরু।

কালির টানে ওর দু চোখে তোমার কাজল এঁকো ॥

চিঠির চুলের বাঁধন দিও খুলে

সে চুল নিয়ে বাঁধবো খোঁপা, সাজাবো হৃদফুলে

পরে যখন পাবে আমার চিঠি

দেখবে তাতে নাচছে সে-ফুল হাসছে মিটি মিটি।

সেই হাসিকে ঠোঁটে ধরেই আমার হয়ে থেকো ॥

দ্রষ্টব্য : পূর্ব পাকিস্তানে তেমন কিছু হয়নি। আমরা অন্তত কিছুই শুনিনি। ভাইয়ার ওখানেই পোস্টিং; তার চিঠি পেলাম গত সপ্তায়, তাতেও কিছু লেখা নাই। তবে তুমি বলেছো বলে খোঁজ নিলাম। কেউ কিছু জানে না, একজন শুধু বলল, মার্চ মাসের দিকে কিছু ঝামেলা হয়েছিল। ওই যে নির্বাচনের পরপরই, শেখ মুজিবের ক্ষমতায় বসা না-বসা নিয়ে। তবে চিন্তার কিছু নেই, সেনাবাহিনী সামলে নিয়েছে। এখন সব স্বাভাবিক।

দ্রষ্টব্য ২ : আম্মির একটা পাগলামো আছে। পরিবারের সবার নামে তিতির পোষেন। তোমার নামেও পুষবেন বলছেন! কিন্তু লীলাবতী নামে হবে না, তোমার পছন্দমতো একটা ইসলামি নাম নিয়ে জানিয়ো আমাকে।

দ্রষ্টব্য ৩ : পরীক্ষার খাতায় লেখার কিছু পাই না। আর তোমাকে লিখতে গেলে, শেষই হয় না। তুমি যদি আমার শিক্ষক হতে, তাহলে দেখতে আমার চেয়ে ভালো রেজাল্ট আর কেউই করতে পারত না!

ঠিক আছে রাখছি। তিন পৃথিবী ভালোবাসা, আর দেড়শো কোটি চুমু।

ইতি

হেলাল, তোমার মুগ্ধ গোলাম!

মে ২৮, ১৯৭১

কলকাতা

দাদা, জাদুর কৌটা আমার, আমি চলে যাচ্ছি। এমন একটা চাকরি নিয়েছো, বোনটাকে দেখার জন্যও আসতে পারো না। তোমার সঙ্গে দেখা হলো না। এমনিতে মনটা খুব খারাপ। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা হচ্ছে শুনেছো নিশ্চয়ই ? লাখ লাখ লোক মরতে মরতে পালিয়ে এসেছে। খুব ভালো লাগছে জেনে যে আন্তরিকভাবেই তাদের আশ্রয় দিয়েছে সরকার। এমন পরিস্থিতিতে ইন্দিরার এই অবস্থান নিশ্চয়ই লেখা থাকবে ইতিহাসে। যদিও এত মানুষকে টানা সহজ কথা না। অর্থনৈতিকভাবে বেশ ভুগতে হবে আমাদের। কিন্তু মানবিকতার ব্যাপারটাও তো দেখা লাগে, নাকি ? অবশ্য দেশে না এলে এর ভয়াবহতা আমি বুঝতে পারতাম না। যাব না যাব না করেও গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম গত সপ্তায়। আমাদের মাঠেই দুটি শরণার্থী শিবির। বিকেলে হাঁটতে বেরিয়ে ওদিকটায় গেলাম। দেখে শুনে তো আমার মাথা নষ্ট―কী যে দুরবস্থা ওদের! যাওয়ার আগে ভাবতেও পারিনি এমন কিছু দেখব।

ওদের জন্য কিছু করতে খুব ইচ্ছে করছিল। আমার কাছে তো টাকা পয়সা তেমন নাই। শুনে আবির বলল মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য টাকা লাগে না, মানুষ হওয়া লাগে! কিন্তু কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সবাই মিলে তখন ঠিক করলাম শিশু এবং বৃদ্ধদের সঙ্গে সময় কাটাব। যে ট্রমার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, একটু হাসিখুশি রাখতে পারলেও অনেক। যে যতটা পারে টাকা দিয়ে কিছু ফলমূল আর খেলনা কিনলাম ওদের জন্য। ওই সুবাদে ঘোরা হলো বিভিন্ন শিবির।

কোনও হাসি নেই কোথাও, সবখানে মেঘ। ভেসে বেড়াচ্ছে ফেলে আসা ঘরবাড়ির জন্য বেদনা আর হারিয়ে ফেলা বা মৃত স্বজনের জন্য বিলাপ। রোগ শোক দুঃখ কষ্টের আহাজারিতে বাতাসও যেন ভারী। কী যে অসহায় লাগে ওদের দেখে।

সকাল বিকাল মিলিয়ে চারদিন ছিলাম। আসতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু কী করব বলো, যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। তাই চলে আসতে হলো। মানুষ এভাবে মরছে, বলতে গেলে কিছুই করা হলো না… আচ্ছা দাদা, তোমাদের কিছু করার নেই ? ধরো, তোমরা গিয়ে যুদ্ধ করে ওদের স্বাধীন করে দিলে! তা করতে গিয়ে আবার দখল করে বোসো না যেন! দেশে দেশে আর্মিদের দিয়ে তো আবার বিশ^াস নাই! এত আরাম আয়েশে থাকো তোমরা, তারপরও সুযোগ পেলেই ক্ষমতার জন্য লেগে পড়ো.., দেখা হলে এই কথার জন্য আবার কানমলা দিও না, যা সত্যি সেটাই বললাম, হিহি…!

আর একটা কথা―বৌদিকে তুমি চিঠি লেখো না কেন ? খোঁজ খবর নাও না কেন ? ওঁর এমন একটা সময় যাচ্ছে, তুমি কাছে নেই। জানো, এ সময়ে মেয়েরা কত অসহায় কত হতাশ কত সন্ত্রস্ত বোধ করে ? আমাকে বলতে বলতে তো কেঁদেই ফেললো কাল। পারলে একবার দেখা করে যাও। অন্তত চিঠি লিখো হাবা দাদা আমার! আর ভালো থেকো। সাবধানে থেকো।

ইতি

তোমার পিচ্চি, তোমার লিলু

জুন ০৮, ১৯৭১

লন্ডন

প্রিয় হেলাল, ধ্রুবতারা আমার!

এসেই দেখি তোমার চিঠি! কিন্তু উত্তর দিতে দেরি হলো। আসলে ছুটি কাটিয়ে এসে যে একটু দম নেব, তারও উপায় নেই, খুব ব্যস্ততা। ক্লাস শুরু হয়ে গেছে, কিছু স্বেচ্ছাসেবার কাজও করতে হচ্ছে। এবং দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে তুমি যা জেনেছো তা ভুল। মোটেও ‘মার্চে কিছু ঝামেলা হয়েছে’ বলার মতো নিরীহ না সেখানকার পরিস্থিতি। রাতের আঁধারে হাজার হাজার মানুষকে মেরে ফেলেছে আর্মি। সামরিক বেসামরিক মানামানি নেই, হিন্দু-মুসলমান মানামানি নেই, বাঙালি পেলেই মেরে ফেলছে তারা। গ্রামের পর গ্রাম উজাড় হয়ে যাচ্ছে। লাখ লাখ মানুষ তাই পার্লিয়ে এসেছে প্রাণভয়ে। আশ্রয় নিয়েছে আমাদের মাটিতে। আরও লাখ লাখ আসছে। সীমান্তে গড়ে উঠছে একের পর এক শরণার্থী শিবির। সেখানে ওদের মানবেতর জীবন। পর্যাপ্ত খাদ্য নেই। ওষুধ নেই। অশেষ দুর্ভোগ। আর অন্তহীন অভাব। বৈধ নির্বাচনে জেতা একটা দলের নেতার হাতে ক্ষমতা তুলে না দিয়ে ওখানে অত্যাচারের স্টিমরোলার চালাচ্ছে তোমার সরকার। নির্বিচারে গণহত্যা করছে তোমাদের আর্মি। এই নৃশংসতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে ওদের ফ্রিডম ফাইটাররা। তাদের সমর্থনে সোচ্চার হয়ে উঠেছে ব্রিটেনবাসী বাঙালিরাও। সারা ইংল্যান্ড চষে বেড়াচ্ছে তারা। এম্বেসিতে এম্বেসিতে স্মারকলিপি দিচ্ছে। জাতীয় পতাকা পোড়াচ্ছে। ইয়াহিয়ার ছবি পোড়াচ্ছে। মিটিং মিছিল সভা চলছে। আর তুমি বলছো, তেমন কিছুই হয়নি, হচ্ছে না!

সারা পৃথিবী জেনে গেছে এই ঘৃণ্য গণহত্যার কথা, আর তুমি জানো না, বিশ^াস করতে কষ্ট হচ্ছে। সত্যিই কি তোমরা কিছু জানো না ? নাকি অস্বস্তি ঢাকতে না-জানার ভান করছো ? তোমার সরকার হয়তো সংবাদ নিয়ন্ত্রণ করছে। তা হলেও, সচেতন নাগরিক হিসেবে তোমাদের চোখ-কান খোলা উচিত। একটু খোঁজ খবর নাও। তোমরা বন্ধুরা মিলেও তো মানুষকে জানাতে পারো। মানুষ দাঁড়িয়ে গেলে সরকার হয়তো পিছপা হবে। নইলে এই নৃশংসতার শেষ কোথায় ?

পাকিস্তান-ইংল্যান্ড টেস্ট খেলা ছিল এখানে। তোমাকে বলেছিলাম দেখতে যাব। কিন্তু দেশে যাওয়ায় আর দেখা হলো না। ফিরে এসে শুনি ওই খেলার মাঠেও প্রতিবাদ করেছে বাঙালিরা। দলে দলে ভাগ হয়ে তারা চাঁদা তুলছে। চলচ্চিত্র প্রদর্শনী করছে। এটা সেটা বিক্রি করছে। শরণার্থীদের জন্য ওষুধ খাবার এটা সেটা প্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনে পাঠাবে। ফ্রিডম ফাইটারদের জন্য টাকা পাঠাবে। সামনেই একটা চ্যারিটি শো হবে। বাঙলাদেশিদের আয়োজন। আমিও নাম লিখিয়েছি। গাইব এবং নাচব। ভার্সিটির ছাত্রছাত্রীরা দেখবে। কত টাকাই বা উঠবে। যা-ই উঠুক, তা দিয়ে খাবার কিনে পাঠানো হবে।

আচ্ছা, থাক ও প্রসঙ্গ। আশা করি তুমি ভালো আছো।

আমিও আমাদের কথা বাড়িতে বলেছি। বোঝোই তো, বুড়ো মানুষ সব, ধর্মের নামে মরতেও পারে। তাছাড়া রাজনৈতিক দিক বিবেচনায় নিলে ওরা আমাদের মেনে নেবে না এটাই স্বাভাবিক। তবে চিন্তা কোরো না, দাদা নিশ্চয়ই আমার পক্ষে দাঁড়াবে। নইলে কী আর করা, আমি বড় হয়েছি না ? আমার পৃথিবী আমিই গড়ে নেব। মাসিমা আর বৌদির সঙ্গে দেখা করার জন্য মুখিয়ে আছি। কিন্তু সেটা বোধহয় খুব শিগগির হচ্ছে না। ওহ! তোমার এবারের কবিতাটা আমার সবচেয়ে ভালো লাগল! কতবার যে পড়েছি, আর পড়ে শুনিয়েছি গ্যাবিকে, তার গোনা গাঁথা নেই! ভাবছি অনুবাদ করে ভার্সিটির সাহিত্যপত্রিকায় দিয়ে দিব। তোমার কবিতা ব্রিটিশরা পড়বে, ভাবতেই ভালো লাগছে!

আর একটা কথা, দেশভাগ হলো এই সেদিন। গোঁয়ার আর অশিক্ষিত মাথামোটা নেতারা বসে দাঁড়িয়ে ভাগ করল চেয়ার টেবিল সুই সুতা। জন্তু জানোয়ার পর্যন্তও নাকি ভাগ হয়েছে শুনেছি। সেখানেই ঠিক হলো কার অধিকারে কোন অঞ্চল থাকবে। তাহলে পাঁচ হাজার বছর আগের সিন্ধু সভ্যতা ‘তোমাদের’ হয়ে গেল কী করে! এটা তো পুরো ভারতেরই ঐতিহ্য। আমাদের সবারই গর্ব। আমার সঙ্গে এমন তর্ক কোরো না সোনা। আমি বরং লজ্জা পাই ভাবলে, এত শতাব্দী ধরে যে হারটা সামলে রাখল নিজেকে, অক্ষত থাকল আমাদের গৌরবের সাক্ষী হয়ে, তাকে ছিঁড়ে ফেলা হলো, নিজেদের হীন স্বার্থে! কত বড় নিচুতা এটা, ভাবো! এমন একটা জঘন্য কাজ হয়তো পৃথিবীর কোনও দেশের নেতাই করতেন না। আমাদের ভাগের অংশটা দিল্লির জাতীয় সংগ্রহশালায় আছে, দেখেছি। ভালোই হলো তুমি কথাটা তুলেছো। তোমাদের অংশটা কোথায় আছে খোঁজ নিও তো। ওটাও দেখার চেষ্টা করতে হবে।

আজ আর না। তোমার চিঠির আশায় থাকব। আর হ্যাঁ, আমার তিতিরগুলোর যত্ন নিও ঠিকঠাক। ওদেরকে আমার আদর।

ইতি

তোমার লীলা

জুন ২৫, ১৯৭১

৬৬ মাউন্টেন ব্রিগেড, বালুরঘাট

লীলা, পিচ্চিসোনা আমার,

তোর চিঠি পাওয়ার কদিন পর বাবার চিঠি পেলাম। রূপকথার দেশের এক অপ্সরা এসেছে আমাদের ঘরে। বাবা লিখেছেন, ‘তুমি তো জানো না, পরিটা একেবারেই তোমার মতো হয়েছে। দেখলেই তোমাকে আর আয়না দেখার দরকার হবে না!’ অথচ আমাকে আয়না দেখে দেখেই মেয়েটার চেহারা কল্পনা করতে হচ্ছে, দেখতে যেতে পারলাম না। এতদিন পরে এলি, তোর সঙ্গেও দেখা হলো না! মন খুব খারাপ হয়ে আছে। কী করি বল, চাইলেই তো ছুটি মেলে না। তোরা শুধু আমাদের আরামটুকুই দেখিস, কষ্ট যন্ত্রণা তো দেখাতে পারি না! যা হোক, অভিযোগ নেই কোনও, চাকরিটা এমন, জেনে বুঝেই তো ঢুকেছি। যা-ই হোক মেনে নিই তাই।

ঠিকঠাক পৌঁছে গেছিস আশা করি। শরীর ভালো ? পড়াশোনা কেমন চলছে ?

শরণার্থী শিবিরে তোর অভিজ্ঞতার কথা জেনে আমি শিউরে উঠেছি। পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা জঘন্য বর্বরতা। কিন্তু করার কিছু নেই। সরকার চেষ্টা করছে সাধ্যমতো। জানিস কি না জানি না―বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার আমাদের মাটিতে বসেই পরিচালিত হচ্ছে। এতে ইন্দিরা সরকারের সর্বাত্মক সহায়তা রয়েছে। ওদের ফ্রিডম ফাইটারদের ট্রেনিং দেওয়া অস্ত্রসংস্থান সব আমাদের আর্মিই করছে। আমাদের তত্ত্বাবধানেই চলছে ওদের অপারেশন। এর বাইরে একটা স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে আরেকটা স্বাধীন দেশের আর্মি গিয়ে নাক গলাতে পারে না। তাছাড়া আমাদের স্বার্থটাও তো গুরুত্বপূর্ণ। সব দিক বিবেচনায় যদি সরাসরি কিছু করাই যুক্তিযুক্ত হয়, তেমন সময় এবং নির্দেশই আসে, আমরা অবশ্যই যাব। নইলে এত মানুষের বোঝা তো আর অনন্তকাল টেনে যাওয়া যাবে না। যত তাড়াতাড়ি ওরা দেশে ফিরে যাবে ততই মঙ্গল। কোটি মুখের খাবার জোগাতে কম ক্ষতি তো আর হচ্ছে না আমাদের!

ভালো থাকিস, খেয়াল রাখিস নিজের। বাবা বলেছেন তোর জন্য ছেলে দেখতে। দেখব, নাকি তোরটা তুইই ঠিক করবি ? কাউকে পছন্দ থাকলে বলিস, আমাকে তাহলে আর কষ্ট করে ছেলে খুঁজতে হবে না।

আদর। ভালোবাসা।

ইতি

দাদা

জুলাই ০৪, ১৯৭১

পাঞ্জাব বিশ^বিদ্যালয়, পাকিস্তান

লীলাবতী! প্রিয়তমা আমার!

…যা হোক, আমাদের মধ্যে এসব ফালতু ব্যাপার টেনো না তো। দেশভাগ টেশভাগ যা হয়েছে, হয়েছে; তুমি আমি ভাগ না হলেই হলো। আর, পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাপারে তুমি যেমন বলেছো, তেমন কিছুই ঘটছে না। আমি আমার পরিচিত নেতাদের কাছেও জিজ্ঞেস করেছি। ওঁরা যা বলেছেন, তা শুনলে তুমি লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবে না―উল্টো ভারতই নাকি বাঙালি হিন্দুদের সঙ্গে মিলে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্র করছে। আর সেনাবাহিনী সেই অপচেষ্টা রুখে দেওয়ার চেষ্টা করছে। চিন্তা করো, একটা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ, সুখে শান্তিতে আছে, তাতে সহ্য হচ্ছে না তোমার সরকারের। তাছাড়া লাখ লাখ লোক ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে, এ কথা তুমি বিশ^াস করলে কী করে! তুমিও কি অন্যদের মতো হয়ে যাচ্ছো নাকি, কিছু শুনেই বিশ^াস করে ফেলছো, তলিয়ে দেখছো না আসল ঘটনা কী!

বাদ দাও, এসব ব্যাপার টেনে আমি মুড নষ্ট করতে চাই না।

… তোমার তিতিরেরা বড় হচ্ছে। ভালো থাকো। তিন পৃথিবী ভালোবাসা। আর দেড়শো কোটি চুমু।

ইতি

হেলাল, তোমার মুগ্ধ গোলাম!

জুলাই ২১,

লন্ডন

প্রিয় হেলাল,

তোমার কাছ থেকে এমন আচরণ আশা করিনি। শরণার্থীর কথা কারও কাছে শুনে তোমাকে বলেছি নাকি, আমার গ্রামের বাড়ি ত্রিপুরার সাব্রুমে, সেখানে বেশ কয়েকটা শরণার্থী শিবির, সেগুলোতে আমি নিজেই গিয়ে ছিলাম সপ্তাখানেক! দেশের এমন পরিস্থিতিকে এড়িয়ে হাসিমুখে সুখ খুঁজে বেড়ানো ছেলে তুমি, ভাবতেও অবাক লাগছে। অন্য কেউ হলে পাত্তাই দিতাম না ব্যাপারটা, কিন্তু তোমাকে তো আমি অন্যরকম ভেবেছিলাম। অথচ তুমি তোমার দেশের আর সবারই মতো। এবং এখানকার পাকিস্তানিরাও দেখছি তোমারই মতো। ব্যক্তিপর্যায়ে একে তাকে চড় থাপ্পড় দেওয়া কিল ঘুষি মারার মতো গুন্ডামি তো করেই আগে থেকে, বাঙালিদের শান্তিপূর্ণ একটা সমাবেশে ওরা হামলাও করেছে কাল! এমন দূর দেশে শুধু গায়ের জোর দেখাতে যারা এটা করতে পারে, অস্ত্র হাতে পেলে নিরীহ মানুষদের তারা কী হাল করবে তা চোখ বুজেও দেখতে পাওয়ার কথা।

পাচ্ছো না কেন ?

কাবিল ঠিকই পেয়েছে। তোমার কবিতাগুলো অনুবাদ করে দেয়ালিকায় দিয়েছিলাম, তার সূত্র ধরেই ওর সঙ্গে পরিচয়। একেবারেই অন্য রকম ছেলেটা, তোমাদের অন্য পাকিস্তানিদের মতো না। উল্টা ও দেখলাম সরকারের আচরণে লজ্জিত। বলল, সুযোগ থাকলে এখুনি ও এই গণহত্যা বন্ধ করত, আর এর সঙ্গে জড়িতদের বিচার করত। আর তুমি বলছো কিছু হচ্ছে না! একই মাটির মানুষ তোমরা দুজন―বিশ^াস হয় না। তোমরা নাকি আবার বাল্যবন্ধুও! তা বন্ধু হয়ে ওর কবিতাগুলোকে তুমি নিজের নামে আমাকে লিখতে পারলে কী করে! ভাগ্যিস ওর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল, নইলে এভাবেই বোকা বানিয়ে যেতে তুমি আমায়, না ? যেমন ভেবেছি, তেমন সুবিধার লোক তো তুমি না। আমাকে যখন ইসলামি নাম নিতে বলেছিলে, তখনই অবশ্য আমার বোঝা উচিত ছিল তুমি কত নীচ।

যা হোক, এখনও সময় আছে, চোখ খোলো। নিজের দেশের মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করছে যারা, তাদের দোষ চাপা দেওয়ার মতো অন্ধ ঢাল হয়ো না। যাদের হত্যা করা হচ্ছে তাদেরকেই দোষী সাব্যস্ত করার মতো নির্বিবেক নির্মম হয়ো না।

ইতি

লীলাবতী রায়

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button