আর্কাইভগল্প

গল্প : আপেল বাগানে : হামিম কামাল

মল রোডের হোটেল থেকে যখন বের হচ্ছি, বাঙালি ম্যানেজার বললেন, ‘যা বলেছিলাম মনে আছে তো দাদা ? বেশি ঝুঁকি নেবেন না যেন।’

আমি হাসলাম। কী করে আগে থেকে বলি ?

আজ ঠান্ডা বেশি নেই। দশ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে থাকবে আশা করেছিলাম, কিন্তু আমাকে অবাক করে দিয়ে সকাল দশটায় তাপমাত্রা প্রায় সতের ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কুয়াশা আছে।

আই সি আই সি আই ব্যাংকের একটা ছোট্ট শাখা আমার চিহ্ন। লালের ওপর সাদা রঙে লেখা। এখানে এসে উত্তর দিকে বাঁক নিলে ধীরে ধীরে জায়গাটা নির্জন হতে শুরু করে। কিছু দূর অটো নিয়ে যাওয়া যায়। এরপর আর কোনও গাড়ি চলে না। কারণ লোকালয় নেই। পাহাড় আর অরণ্যের শুরু।

সিমলায় এর আগেও এসেছি, তবে মনে মনে। বাস্তবের সঙ্গে সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো, ভেবেছিলাম এখানে এসে মন ভালো হয়ে যাবে। বিপরীত। এখানকার প্রকৃতি মন ভয়াবহ বিষণ্ন করে দেয়। মনে হয়, এই পৃথিবী একদিন থাকবে, অথচ আমি থাকব না।

আমাকে উত্তর-পশ্চিম দিকের ঢাল ধরে নামতে হবে। নামতে নামতে এক জায়গায় আড়াআড়ি একটা খাদ পাওয়ার কথা। তার ওপর একটা পাইন গাছ ফেলে সেতু তৈরি করা। সেই সেতু পার হয়ে গেলে একটা ছোট কাঠের ঘর পাব। সেখানে থাকেন সেই বাঙালি ম্যানেজারের সুহৃদ শিবাজী দেশপাণ্ডে। ভদ্রলোক একজন স্থপতি। কর্মজীবন ছাড়েননি কিন্তু শহরজীবন ছেড়েছেন। বেছে নিয়েছেন নির্জন পাহাড়বাস।

অচেনা জায়গা, অচেনা বনের ঢাল। বান্দরবান খাগড়াছড়িতে আমি কত পাহাড়ে বেড়িয়েছি। সেখানকার প্রকৃতিকে অনাত্মীয় মনে হয়নি কখনও। কিন্তু এই পাহাড়টিকে যথেষ্টই অনাত্মীয় মনে হচ্ছে। যদি ভারত ভাগ না হতো, তাহলেও কি এমন মনে হতো ?

পাহাড়ের নিচের দিকে ঠান্ডা আরও ঘন হয়ে জমে আছে। পরনে চামড়ার জ্যাকেটের নিচে একটা সাধারণ টি-শার্ট পরেছি মাত্র। ঠিক হয়নি। বুকের ভেতর কেমন বাঁশি বাজছে। পরনে আরও কিছু থাকা হয়তো উচিত ছিল।

চারপাশে অনেক পাখির শব্দ পাওয়ার কথা ছিল না ? কেউ নেই। ওরা কি ভেবেছে কোনও অনুপ্রবেশকারী আসছে ? অনুপ্রবেশকারী তো আমি বটেই। তবে শত্রু নই।

কিছুদূর নামতেই খাদটা পেয়ে গেলাম। একটা পাইন গাছ কেটে কেউ ফেলে রেখেছে খাদটার ওপর। কাটার শেষ প্রান্তটা অসমান। অর্থাৎ কোনও স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র দিয়ে কাটা হয়নি। কে কেটেছে। ম্যানেজারের সেই শিবাজীদা ভদ্রলোক ? হতেও পারে। একাকী থাকা মানুষেরা নানারকম অসাধ্য সাধন করে দ্রুত বুড়িয়ে যায়।

ঠান্ডায় গলা বোধহয় দ্রুত শুকোয়। নিঃশ^াসের সঙ্গে প্রচুর বাষ্প বের হয়ে গেছে। গলা শুকিয়ে গেল। ব্যাগে ‘কিনলে’র একটা ছোট বোতলে পানি আছে। থেমে একটু বসে অল্প চুমুক দিলাম। পানি পানের সময় আমার মায়ের কথা মনে হয়। পানি দাঁড়িয়ে খেলে মা অসম্ভব রাগ করেন। বসতে গিয়ে টের পেলাম আশপাশে ছাড়া ছাড়া কিছু রডোডেনড্রন আছে। আরও ওপরে ছিল না। এরা ‘ক্রমে আসিতেছে’। 

চারপাশে যতদূর চোখ যায় উঁচু-নিচু পাহাড়ি ঢাল। ঢাল ধরে ঝাউয়ের আধিক্য। অতি প্রাচীন সব ঝাউ। এত মোটা গুঁড়ি হতে আমি এর আগে দেখিনি। দেখেছি কক্সবাজারের ঝাউ আর মিরপুর বোটানিকাল গার্ডেনের। আমার পক্ষে বিস্মিত হওয়াই মানায়।

বনে কেবল ঝাউ নয়, আরও অনেক রকম গাছ আছে। ওক, সিডার, চেস্টনাট। যাবতীয় ‘বিদেশি’ গাছ এখানে দেশীয় মাটিতে এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছে যেন নিজ বাড়িতেই ওরা আছে। থাকবেই তো। এ হলো পৃথিবীর মাটি। এই গোটা গ্রহ কার নয় ? শুধু মানুষের নয়।

গাছগুলোর গুঁড়ি আর খেয়ালি ডালপালার বিস্তার বলছে, এখানে বহু বছর তাদের কেউ বিরক্ত করেনি। প্রকৃতি বোধহয় মানুষকে নানা রাষ্ট্রে আটকে দিয়েছে ইচ্ছেকৃত। কারণ মানুষের বিকাশের সামনে কেউ নিরাপদ নয়।

হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। মনে হচ্ছিল সময় বেশি যায়নি। অথচ এরই মাঝে দেড় ঘণ্টা চলে গেছে। বহু ওপরে শহর ফেলে এসেছি। এত দূর এসে একটু যেন ভয় ভয় করতে লাগল। কিসের ভয় জানি না। অজানার ভয়, মৃত্যুভয়।

এর মাঝে পায়ের ধমনীতে টান লেগে দু বার। আগের তুলনায় একটু দুর্বল লাগছে। থামতে ভয় লাগছে। কোথায় কোন দুর্যোগ ঘনায়!

ঢাল ধরে নামা শেষ। এবার ওঠার পালা। এদিকটায় রডোডেনড্রন আরও খানিকটা ঘন হয়েছে। এমন পুষ্পিত রক্তাভ! মনে হয় বুকে তুলে নিই অথচ হাতে নিতেও ভয় হয়। অচেনা কোনও পরিবারের অতি মিষ্টি কোনও কন্যাশিশুর মতো।

নেহাৎ এখন শীতকাল, তাই সাপ নেই। নয়ত বোধহয় আরব্যরজনীর গল্পের মতো হয়তো এতক্ষণে ডজনখানেক অজগরের পেট চিরে বের হতে হতো।

সময়ের সঙ্গে রোদ চড়ার কথা ছিল। অন্তত আবহাওয়ার পূর্বাভাস তাই বলে। কিন্তু ধীরে ধীরে দিনটা আরও কুয়াশাটে হয়ে উঠছে।

কুয়াশার ভেতর থেকে কালচে খয়েরি রঙের মজবুত কাঠে তৈরি এমন এক বাড়ি বের হবে তা আমার কল্পনার বাইরে ছিল। একটু বর্ণনা না দিলেই নয়।

এমন একটা বাড়ি সাধারণত মানুষ এমন কোনও স্বপ্নে দেখতে পায় যে স্বপ্ন সে ঘুম ভাঙার পরই ভুলে যেতে থাকে।

লোকটা আমার দিকে পেছন ফিরে কাঠ কাটছিল। পায়ের নিচে ডাল ভাঙতেই ঘুরে তাকাল। এমন উজ্জ্বল একজোড়া চোখ আমি অনেক দিন হয় দেখিনি।

বাড়িটা কিছু থামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ি পূর্ব-পশ্চিম পাশে আটটি করে থাম। থামগুলোর মাঝের ফাঁকা অংশটায় পাইরেক্সের দেয়াল, ওপরে স্বচ্ছ দেয়াল ঢেকে দেওয়ার জন্য রোল করা মাদুর-পর্দা। এ মুহূর্তে পর্দা তোলা আর ভেতরে একটা হলুদ আলো জ্বলছে।

বাড়ির দক্ষিণে ভেতরে ঢোকার দরজা, খোলা। উত্তরের অংশটা বিস্ময়কর! একটা ছোট সেতু চলে গেছে মূল বাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন আরেকটা ছোট ঘরের দিকে। বাড়ির গোটা কাঠামোর ওপর প্রাচীন তিনটি ওক তিন দিক থেকে ঝুঁকে আছে। সেগুলোকে ঘিরে থাকা শ্যামকাঞ্চন লতার ঝাড়। থেকে থেকে বুনো ফুল ধরে আছে।

বাইরে দিনের আলো হলেও ঘরের ভেতর তো কমবেশি অন্ধকার। বাতির আলোটা হলুদ নয় আসলে। চারধারে হলুদ কাগজ দিয়ে মোড়া। মনে হচ্ছে ভেতরের অন্ধকারে একটা সোনার টুকরা জ্বলজ্বল করছে।

ভদ্রলোকের মনে রঙ আছে তা অবশ্য মুখ দেখে মনে হলো না। গম্ভীর মুখে বললেন, ‘পয়মন্তর কাছ থেকে আবার অনেক দিন পর কেউ এল।’

কোনও কারণে আমি তাঁকে টাক কল্পনা করি নাই। পাহাড়ের ওপর একা থাকেন বলেই হয়তো বেদব্যাসের মতো বড় চুলদাড়ির কেউ হবেন মনে করেছিলাম।

‘আমি আপনাকে বিব্রত করিনি তো ?’

শিবাজী বললেন, ‘এরকম আলগা বিনয় দেখাবেন না, খুব বিরক্ত হই। ওকে যে আমাকে আবার মনে করতে হলো এটাই অবাক লাগছে।’

আলগা বিনয় তো আমি দেখাইনি। সহজাত আচরণটাই করেছি। তা তাঁকে কে বোঝাবে ?

শিবাজী বলল ‘আপনি স্নান করে নিন। আমি খাবার দিচ্ছি।’

‘আমার সঙ্গে পর্যাপ্ত খাবার আছে, আপনি চিন্তা করবেন না। আপনিই খেয়ে নিন না বরং ?’

‘পয়মন্ত আপনাকে আমার পরামর্শমতো যেতে বলেছে তো ? নাকি আমার কথায় বাধা দিতে বলেছে।’ শিবাজী ভদ্রলোকের কথায় মনে হলো না কৌতুক করছেন।

বললাম, ‘আপনার কথা অমান্য করতে নিষেধ করেছে।’

শিবাজীর ঠোঁটে হাসি ফুটল। কিছু না বলে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন ভদ্রলোক। একটা শীতলপাটি হাতে ফিরে এলেন। কাঠের মেঝেতে পাটি বিছিয়ে দিয়ে বললেন, ‘আমার রান্না খেতে সমস্যা হবে। ঝাল বেশি খাই। তা কী করা যাবে। সোনামুখ করে খেয়ে নেবেন। স্নানঘরটা পেছনে করেছি। ছাদ নেই কিন্তু স্নানঘরে।’

সংকেত পেয়ে আমি স্নানঘরে পথ দিলাম।

‘শুকনো পাতা পড়ে থাকে মেঝেতে। ঝাঁটা দিয়ে সরিয়ে নিতে হবে। জল ঢাললে যাবে না। সুতরাং আমার মূল্যবান জল ঢেলে অপচয় করবেন না। জল আনতে জীবন যায়। শহরে থেকে আপনাদের বোঝার কথা না।’

না, লোকটার মুখে জন্মের সময় মধু দেয়নি বোধহয়। ওদিকে স্নানঘরে ছাদ নেই শুনে মনে মনে একটু ভয় করতে থাকল। মনে হলো যেই না আমি চোখে-মুখে সাবানটা মাখব, খোলা আকাশ ঢাকা বন্য পাইন ওকের ডাল থেকে সবুজ সবুজ সাপ শুঁয়ো ঝরতে থাকবে।

বাড়ির পেছনে ছোট্ট সেতু ধরে আমি পায়ে পায়ে স্নানঘরের দিকে এগোতে থাকরাম। চারপাশে ঘন গাছপালা। বন চুঁইয়ে আসা কোমল সবুজ আলো শতপথে আসছে। মনে হলো অপার্থিব কোনও জগতে আমি এসেছি। অথচ শতভাগ পার্থিব! মনে হচ্ছিল কানে কোটি আলোকবর্ষ দূরের কোনও পৃথিবীর সুর বাজছে। অথচ সুরটা বাজছে এই পৃথিবীতেই, সবচেয়ে কাছে, আমার বুকের ভেতর।

ভদ্রলোকের রান্নার হাত তার ব্যবহারের বিপরীত। অমৃত। তিনি মাংস খান না। তবে মাছে না নেই। রান্না হয়েছে বাঁশপাতা মাছ। এখানে খরস্রোতা নদীতে চলার জন্যে এরচেয়ে উপযুক্ত মাছ বোধহয় হয় না। এছাড়া বাঁধাকপি, ফুলকপি আর এক ধরনের বুনোমরিচের সঙ্গে হালকা দুধ মিশিয়ে তৈরি সবজি, ভদ্রলোকের নিজস্ব রেসিপি। 

‘একা যারা থাকে, তাদের তো এই একটাই সঙ্গ, শিবাজী পাইপে তামাক ভরতে ভরতে বললেন, ‘কোনও বাজে মানুষের সঙ্গ তাকে পেতে হয় না। খাওয়ার সময় সে নিজেকে সঙ্গ দেয়। মানুষ একা খেতে পারে না। তাই যখনই একা খেতে হয় তাকে, তখন নিজেই নিজেকে ছায়াসঙ্গ দিতে থাকে।’

আমি এঁটো বাসন গোছগাছ করতে থাকলাম। নিজেই ধোব। 

ভদ্রলোক বলল, ‘কপাল ভালো হলে ফিরতে পারবেন আপনি।’ বললেন শিবাজী, ‘কৌতূহলীরা নতুন বিশ^ জয় করে। আর স্থিরচিত্তরা সেই জয়ের পর ফিরে আসতে পারে।’

আবার বাণী দিল লোকটা।

‘জানি না কতটা স্থিরচিত্ততা দেখাতে পারব,’ আমি বললাম।

শিবাজী প্রথমবারের মতো শান্ত কণ্ঠে বললেন, ‘ফেরার সময় আমার এই বাড়ি হয়েই যাবেন।’

অ্যাম্বার টোবাকোর এক বুক ধোঁয়া ছেড়ে শিবাজী বললেন, ‘কিছু মোক্ষ আছে না চাইলে পাওয়া যায়। বন এমন এক ধরনের মোক্ষ। চাইলে হারিয়ে যাবে। পৃথিবীতে এমন আটটি জিনিস আছে। এ বর তার একটা।’

‘ব্যাপারটা এতটা জটিল ভাবিনি।’

‘জলবৎ তরলং। জটিল আবার কী। বসুন, মেয়েটাকে ডাকি।’

কিছুক্ষণ পর এক নারী এলেন ঘিয়ে রঙা শাড়ি পরা, মুখে স্মিত হাসছে। তার আড়ালে উঁকি দিচ্ছে ছোট্ট একটি মেয়ে। শাড়ি পরিহিতার বয়স আমার সমান হতে পারে, বেশিও হতে পারে। শিবাজী বললেন, ‘কে সঙ্গে যাচ্ছে তা তো চিন্তাও করতে পারবেন না। মেয়েটা গাছ উজান মন্ত্রদীক্ষা পাওয়া। এ বিদ্যা ওদের বংশানুক্রমিক।’

‘গাছ উজান!’

‘ভাবটা করছেন যেন জীবনেও শোনেননি!’

‘বেশ, তিনি তাহলে আমার সঙ্গে যাচ্ছেন।’

‘শুনতেই তো পেলেন! তিনি আপনাকে পথ দেখাবেন। তাই থাকবেন পেছনে।’

‘ও আচ্ছা।’

মুখের গড়নে ছোট মেয়েটির একটু ভিন্নতা থাকলেও চোখ জোড়া হুবহু এক। মায়ের মতোই তার পরনে শাড়ি। তবে এই শাড়ি মলিন টিয়ে সবুজ।

দুজনে নীরবে আমার পেছন পেছন আসছিল। পথ চলার সময় মনে রাখছিলাম যে পথে আসতে ওদের কোনও অসুবিধা হবে না, সেই পথে আসা দরকার। কোথায় কাঁটা ঝোপে লেগে শাড়ি বা ত্বক ছড়ে যায়। বড় মেয়েটি তা বুঝতে পেরে বলল, ‘আপ হামারে বারে মে মাত সোচিয়ে।’

আমি ফিরে তাকিয়ে মেয়েটির মুখের মোহিনী হাসি দেখে চমকে গেলাম। এ নারী তার কথা ভাবতে নিষেধ করছে। কিন্তু কী করে তা সম্ভব ? এমন হাসির জন্যে কেউ চিরনের অরণ্যবাস বেছে নিতে পারে।

আমার বিহ্বল মূর্তিটি দেখে মেয়েটি ভাবল আমি পথচলা নিয়ে বিভ্রান্ত। বললেন, ‘জিস তারাহ আপ কা পাসান্দ হো যাইয়ে।’

মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলার চেষ্টা করলাম ওদের। ওরা আমার দায় নয়। ওরা আমার পথ প্রদর্শক। আমিই বরং ওদের দায়। ওদের কাজ হলো আমাকে আমার মতো চলতে দেওয়া। চলতে চলতে ভুলে যেতে হবে কেন চলছি, কোথায় চলেছি।

পথের ধারে আবার সারি সারি পাইন, ওক, রডোডেনড্রন! আমি সত্যিই ভুলে গিয়েছিলাম যে আপেল বাগানের সন্ধান চেয়েছিলাম শিবাজীর কাছে, যে বাগানের অভিভাবকের সঙ্গে আমার ভীষণ জরুরি আলাপ, একজনার জীবন-মরণ নির্ভর করছে সেই আলাপের ওপর।

যে মুহূর্তে আমি ভুলে গেলাম কোথায় যাচ্ছি কেন যাচ্ছি ঠিক তখনই আমি সেই আপেলের বনে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। যার জন্য এত পথ ভেঙে আসা।

এখন আপেল বনের প্রবেশ পথে দাঁড়িয়ে আছি, কী বিস্ময়! বাতাসে বোঁটাখসা আপেল পাতার চাপা ঘ্রাণ, আপেলের শরীরের সুগন্ধ, আর একটা অতি পুরাতন বনের সুঘ্রাণ। ঘোলাটে আকাশের নিচে অনিয়মিত বিরতিতে আপেলের কাষ্ঠল বৃক্ষ, বহু প্রাচীন। এখনও কী করে আপেল ধরছে ?

ঠান্ডা বাতাস এসে আমাকে কাঁপিয়ে দিল। বনের পাতা কাঁপছে সরসর। একটা ভেজা, কুয়াশাটে পরিবেশ। ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশার মেঘ ভাসছে বনময়।

আমি ফিরে তাকাতেই মেয়েটি বলল, ‘মেরি বারি খাতাম হো গায়ি হ্যায়।’ তারপর বনের পথ দেখিয়ে বলল, ‘আব বাস, আপ কি বারি হ্যায়।’ এবার আপনার পালা।

মেয়েটির হাসি এত সুন্দর যে হেসে কিছু বলার সময় মন শুধু হাসির দিকে চলে যায়। মেয়েটি কেশে উঠল হঠাৎ। শুষ্ক কাশির একটা মালা গাঁথা চলল খানিকক্ষণ। ছোট্ট মেয়েটা কেমন উদ্বেগ নিয়ে তাকিয়ে আছে। অনেকটা পথ আমার সঙ্গে ওরা চলেছে ঠান্ডায়। গায়ে শীত নিবারণের কাপড় নেই। এটা আমার চোখেই পড়েনি। মনটা খারাপ হলো।

‘আপনি ঠিক আছেন তো ?’

‘বিলকুল!’

আবার কাশি শুরু হলো। থামার পর লজ্জিত হাসল মেয়েটা। ছোট মেয়েটা একবার মাকে আরেকবার আমাকে দেখছে। ওর চোখে লেখা, মাকে কেন এখনও ছেড়ে দিচ্ছ না ?

বেশ, ছেড়ে দিলাম। অবশ্য জানি না ধরেছিলামই বা কখন। যারা পেছনে থেকে পথ দেখায়, তাদের ধরার সাধ্য কী। এতক্ষণের পথ আবার অচেনা ছিল, এই বনও আমার অচেনা। সুতরাং সবই সমান।

‘আপ দেখেঙ্গে। মার্গ নে মার্গ কি খোঁজ দেদি হ্যায়।’ মেয়েটি আগের মতোই মিষ্টি হাসল। পথই দেবে পথের সন্ধান। মেয়েটি হয়তো অনুমান করার চেষ্টা করছিল আমি কী ভাবছি। বললাম―

‘বেশ। আমি তাহলে এগোচ্ছি। বলতে পারেন কখন দেখা হবে ভালুকের সঙ্গে ?’ 

‘কৃপেয়া!’ মেয়েটি আঁতকে উঠল। ‘ভালু মাত কাহিয়ে। উয়ো তো সাংরাকষাক হ্যায়!’

‘ওহ, ক্ষমাপ্রার্থী।’ মেয়েটির চোখের ভর্ৎসনা আমি নিতে পারছিলাম না। ‘কখন দেখা হবে তাঁর সঙ্গে ? এ বনের অভিভাবকের সঙ্গে ?’

মেয়েটি দয়াবতী। আমাকে ক্ষমা করেছে। তার ঠোঁটে আবার সেই হাসি ফিরে এল।

‘উও সামায় হি বাতায়েগা।’

বেশ, সময়ই বলে দিক না হয়।

‘শিবাজী কা বাচান ইয়াদ রাখে,’ বলল মেয়েটি।

শিবাজী দুটো কথা বলে দিয়েছেন। এক, যেন রক্ষা করি। দুই, যেন জোর না করি। এখানে এই বনে জানি না আমি কীভাবে তা পালন করব। বললাম―

‘ঠিক আছে, বিদায়। আমি চেষ্টা করব।’

মেয়েটি আর তার মেয়েটি চলে গেল। ওরা বাঁকের আড়ালে চলে যেতেই মনে হলো, আহা, ওদের নাম জানা হলো না।

বন এখানে আরও ঘন। আপেল গাছগুলো মাথার ওপর ছায়া দিয়ে রেখেছে। কোনও গাছ এমন যে, মনে হলো পাতার চেয়ে আপেল সেখানে বেশি। আমি কবোষ্ণ সমতলের বঙ্গসন্তান। আপেল সবসময় বাজার থেকে কিনে খেয়েছি। গাছে দেখার সৌভাগ্য হয়নি কখনও। বিহ্বল হয়ে তাকিয়ে থাকলাম। কিছু না ধরাই বোধহয় ভালো হবে। আমাকে ফিরতে হবে যত তাড়াতাড়ি পারি।

কোথায় পাব বনের অভিভাবক সেই ভালুকের সন্ধান ? তাঁর খোঁজে এসেছি। মহামতি রুমি বলেছেন, তুমি যাকে খুঁজছো, সেও তোমাকে খুঁজছে। এ কথা এক্ষেত্রে খাটে ? শিবাজী বলেছিলেন, পথে থেকে ভুলে যেতে হবে কেন পথে ছিলাম। তাহলে কি ভালুকের কথা আন্তরিকভাবে ভুলে যাব ?

তুমি যা খুঁজছো, তোমাকেও খুঁজছে তা-ই। ভালুকটা খুঁজছে আমাকে।

আমি বনের পথে হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত। কোথাও কোনও মধুর মৌচাক আছে ? ছোটবেলায় পড়া গল্প আমাকে বলছে, কোনও মৌচাকের কাছাকাছি ভালুক থাকতে পারে। আমি মৌচাকের খোঁজে আমার চলার পরিধি কেবলই বাড়াতে থাকলাম।

পথে অদ্ভুত কিছু দৃশ্য চোখে পড়ল। ছাড়া ছাড়া কুয়াশা আপেল গাছের ডালে ডালে আটকে আছে। কোথাও কোথাও মাকড়সার জালে জমে আছে বিন্দু বিন্দু শিশির।

আমি আকাশের দিকে তাকালাম। আজ দিন মেঘলা। বেলা কয়টা বাজে আকাশে সূর্য দেখে বোঝার উপায় নেই। আমি হাতঘড়ির দিকে তাকালাম। দুপুর দুটোর মতো বাজে। আমার হাতে আর চার ঘণ্টা হয়তো আছে। এরপর আলো যাবে নিভে। এর ভেতর যদি বনের অভিভাবককে আমি না পাই, কী করে ফিরে যাব ?

সে কথা ভাবতে চাইলাম না। আমি ভালুক মশাইকে পাওয়া ছাড়া আর কিছুর কথাই ভাবছি না।

কেমন একটা অদ্ভুত শব্দ পেতে থাকলাম হঠাৎ। শব্দটার সঙ্গে পানির বুদবুদ ওঠার শব্দের মিল আছে। কোথাও বুদবুদ উঠছে ভাঙছে উঠছে। বেশ ভারি বুদবুদ। কোথায় ? আশপাশে কি কোনও জলাশয় আছে ?

মনে হলো আমার পায়ের নিচে মাটি কেঁপে উঠল। সেই বুগবুগ শব্দ সেই মুহূর্তে গেল অনেক গুণ বেড়ে। এরপর পেলাম ঢোলকের শব্দ। দ্রিম দ্রিম দ্রিমা, দ্রিম দ্রিম দ্রিমা, দ্রিম দ্রিম দ্রিমা… কোথায় বাজছে এই ঢোলক ? আমি চারপাশে তাকালাম।

হঠাৎ পশ্চিম আকাশে চোখ পড়লে অবাক হয়ে যাই। আকাশের গায়ে, কুয়াশার পর্দায় নিজেকে আড়াল করে একটা লাল সূর্য একবার সংকুচিত, আরেকবার প্রসারিত হচ্ছে একটা হৃদপিণ্ড। দ্রিম দ্রিম দ্রিমা, দ্রিম দ্রিম দ্রিমা!

হঠাৎ বহু দূর থেকে একটা চাকা ঘোরার শব্দ ভেসে আসতে থাকলে। একটা ধাতব চাকা। অন্তত তিন লক্ষ কিলোগ্রাম ভর কাঁধে নিয়ে বহু কষ্টে ঘুরছে। ক-ট, কট কট কট, ক্ট ক্ট ক্ট ক্ট কট কট কট, ক-ট…

কোথা থেকে এই শব্দ আসছে ? আমার কি সেই শব্দ লক্ষ করে এগোনো উচিত নাকি আমার পালানো উচিত ?

আমি শব্দের উৎস লক্ষ করে হাঁটতে থাকলাম। কোথায় ভালুক ? যেন এই বনের অভিভাবক ভালুকের দেখাটাই শুধু পাচ্ছি না। এছাড়া শরীরী অশরীরী আর সমস্ত কিছু আমাকে ডেকে যাচ্ছে।

ঠিক এমন সময় আমি ভালুকের ডাকটা শুনতে পেলাম। যেন একটা লোহার ট্রাঙ্ক শেকলে বেঁধে পাকা মেঝেতে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। ভীষণ কর্কশ! কিন্তু কী ভীষণ আরাধনার!

এ সময় আবার ডেকে উঠল ভালুকটা। আমি ডাকটা লক্ষ্য করে ছুটতে শুরু করলাম। পেয়েছি, তাকে পেয়েছি! হারাতে দেবো না!

আমি এই ডাকটা শুনব বলে সেই কবে থেকে অপেক্ষা করে আছি। যেদিন থেকে তার কথা জানতে পেরেছি।

আমি এদের কথা শুনি দেশে থাকা কালে।

তখন সকাল নয়টা থেকে পাঁচটা অবধি অফিস করি। অফিস দিলকুশা। হেঁটে কমলাপুর যাই। ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করি। কালো মেঘের মতো শব্দ তুলে ট্রেন আসে। নিকুঞ্জে আমার ফ্ল্যাটে ফিরি। রাতের খাবার সেরে, আপেলের রসে গুঁড়া দুধ আর বরফকুচি ছেড়ে বারান্দায় বসি। আস্তে আস্তে চুমুক দিতে দিতে দেখি পশ্চিম আকাশে বিমানের ওঠানামা। ঘুমাতে যাই।

কোনওদিন ব্যতিক্রম হয় না।

কমলাপুরে যখন আমি ট্রেনে উঠতাম, অফিস-ফেরতা অনেকের সঙ্গে আমাকে প্রতিযোগিতা করতে হতো। তাদের ভেতর একটি চশমা পরা মেয়ে, সে অফিসে আমার সহকর্মী হলেও কখনও আলাপ হয়নি তার সঙ্গে; ছেলেদের মতো করে কাটা চুল, বরাবরই আমার সঙ্গে ট্রেনে উঠত, কিন্তু কখনও এক বগিতে উঠত না। 

প্রথম যখন তাকে দেখি, মনে হয়েছিল স্রেফ সাধারণ একজন মানুষ, রাস্তায় চলতে ফিরতে যাদের দেখা যায়। তারপর ভুলে যাওয়া যায়।

হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করি চশমার আড়ালে তার চোখ দুটো, আয়ত সুন্দর! সেই দিনের আগে কখনও মুহূর্তের জন্যেও কথাটা মনে হয়নি। নিজেকে প্রশ্ন করি, এটা কি আমার জীবনে একঘেয়েমি থেকে মুক্তির জন্যে মস্তিষ্ক সৃষ্ট কোনও বিভ্রান্তি ?

পরদিন আমার চোখে পড়ে, তার ছেলেদের মতো ছাঁটের চুলগুলোয় একটা বাদামি আলো আছে। কানের কাছে, ঘাড়ের কাছে যেখানে বাঁক দিয়েছে, সেই বাঁকগুলো বেশ শোভন, সুন্দর।

এরপর পরদিন আবিষ্কার করলাম, চুলের সেই বাঁক আমার কাছ থেকে দেখতে ইচ্ছো করছে। এই ইচ্ছেটা না করলে, পরদিনই আমি তার কানে দুটো ছোট রুপালি টব হয়তো লক্ষ্যই করতাম না। আলো পড়লে কানের নরম লতিতে দুটো হীরকবিন্দুর মতো তারা জ¦লে।

মাথার পেছনে চুলের ঘূর্ণি যেখানে থেমে গেছে, তার নিচেই মেয়েটির উজ্জ্বল গ্রীবা। চন্দ্রাকৃতির পিঠের ওপর। সেই পিঠের শাদা প্লাটফর্মের আলোয় ভেসে যাচ্ছে। কোনও আটপৌরি নীল শাড়িতে আর অতিসাধারণ ছোট হাতার সাদা ব্লাউজে যে এত আহ্বান থাকতে পারে সেটা আমি সেদিনের আগে ভাবতেই পারিনি।

আমি প্রথম কৈশোরের মতো গলার কাছে একটা জমাট কিছুর অস্তিত্ব অনুভব করি। আর ধীরে ধীরে মেয়েটির প্রতি আমার দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের জন্যে কুণ্ঠিত হয়ে থাকি।

আমার মনের চোখে চিরদিনের মতো একটা ছবি মুদ্রিত হয়ে থাকে। কলিগ মেয়েটি ট্রেনের বগির সিঁড়িতে পা রাখছে। তার নীল শাড়ি উজিয়ে সাদা গোড়ালি খানিক দেখা না যাওয়ার মতো দেখা গেল। পায়ে রুপালি স্যান্ডল, ছোট করে হিল। পরের দৃশ্য, মেয়েটি বগির ভেতর মিহিন অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে।

 পরদিনই তাকে অফিসে দেখতে পেলাম না। সঙ্গত কারণেই কমলাপুর স্টেশনেও না। এর পরদিন আমি দোতলায় উঠে দূরে ওর টেবিল যেখানে ছিল সেখানে দেখি। জায়গাটা শূন্য। কাউকে জিজ্ঞেস করতে সংকোচ হয়।

প্লাটফর্মে এত লোকের অরণ্য আমার আর কখনও এত উপেক্ষিত মনে হয়নি। মনে হলো এমন বিরান প্লাটফর্ম বুঝি আমি কোনওদিন দেখিনি।

তারপর সতেরতম দিনে মেয়েটিকে আবার প্লাটফর্মে দেখতে পেলাম। আগের চেয়ে উজ্জ¦ল লাগছে তাকে। তবে অনেক রোগা হয়ে গেছে।

সেই দিনটি এক বিশেষ দিন। আমি নিজেও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি কখন মেয়েটির এত কাছে চলে গেছি। যতটা কাছে গেলে শাড়ির সুবাস পাওয়া যায়।

‘অনেক দিন পর আজ এলেন।’

মেয়েটি ঘুরে তাকাল। একপাশে সিঁথি, ছোট চুল। চশমার ফ্রেম এত সূক্ষ্ম যে চট করে নেই মনে হয়। আমাকে অবাক করে দিয়ে মেয়েটি পরিচিত ভঙ্গিতে হাসল। বলল, ‘অসুস্থ ছিলাম যে!’

‘কী হয়েছিল ?’ নির্বোধের মতো জিজ্ঞেস করে বসলাম।

মেয়েটা চোখের ভাষ্য সাদা হয়ে আছে। আমি ডেঙ্গু ধরে নিলাম। দেশে তখন ডেঙ্গুর একরকম মহামারি চলছে।

মেয়েটি বলল, ‘ভেবেছিলাম ঢাকার বাইরে আছি, রক্ষা পাব। পেলাম না।’ মেয়েটি ম্লান হাসল। কালো মেঘের শব্দ তুলে ট্রেন এল।

মেয়েটি তার বগিতে উঠে গেল। আমার পায়ে বুঝি শেকড় গজিয়ে গিয়েছিল। নড়তে পারলাম না। কত সহজেই তার পেছন পেছন তার বগিতেই উঠে পড়া যেত।

মেয়েটি উঠে গিয়ে তখন সিট খুঁজতে লেগে গেছে। আমি পাশের বগিতে গিয়ে উঠলাম, বরাবর যেমন উঠি।

সেই দিনও মেয়েটি নীল শাড়িই পরে এসেছিল। সুতি শাড়ি। কে জানে মেয়েটির বোধহয় অন্তত কুড়িটার মতো নীল শাড়ি আছে।

পরদিন আমাকে দেখে মেয়েটি এগিয়ে না এলেও সেই মুহূর্তে অজান্তে শাড়ির কুচি ঠিক করে নিল। এটা একটা শরীরী ভাষা যে সে আমাকে লক্ষ করেছে। এরপর আমার নিজ থেকে এগিয়ে যেতে বাধা থাকল না।

‘আজ ট্রেন আসতে দেরি করছে।’ যথাসাধ্য সিরিয়াস মুখ করে বললাম যেন এ কথাই বলতে এসেছি।

মেয়েটি বলল, ‘খবরে দেখলাম পোস্তগোলার দিকে কোনও গোলমাল হয়েছে। রেল থেকে বগি সরে গেছে বা এমন। ইশ, আজকে অনেক দেরি হয়ে যাবে।’

আমি নিকুঞ্জ নেমে পড়ি, মেয়েটি এরপর আরও কিছুদূর এগোয় বলেই আমার ধারণা, কারণ আমি নেমে কখনও তাকে দেখিনি। কোথায় যাবে জিজ্ঞেস করা উচিত হবে কিনা ভেবে সংকোচ হতে থাকল।

‘ঢাকার ভেতরই তো, ক্রেন দিয়ে টেনে হয়তো সরিয়ে ফেলেছে এতক্ষণে। অত বেশি সময় লাগবে না।’

‘না লাগলেই ভালো।’

কোথায় যাবেন আপনি, এ প্রশ্ন আরেকটু হলেই করে ফেলেছিলাম।

মেয়েটি বলল, ‘আমার আবার লম্বা পথ যেতে হয় তো, তাই দুশ্চিন্তা। গাজীপুর নামতে হয়।’

‘গাজীপুর!’ ঈশ^রকে ধন্যবাদ। ‘আমি নিকুঞ্জ।’ বলে দিলাম আমারটাও।

হঠাৎ শোরগোল। এরপর কালো মেঘের মতো গর্জন করে ট্রেন উপস্থিত। আর সেই দিনই প্রথম আমরা একসঙ্গে একই বগিতে উঠলাম। প্রতিদিন মেয়েটি যে বগিতে ওঠে, সেটায় সেদিন, কোনও কারণে, বেশ ভিড়। আমি অভ্যাসবশে আমারটা পরখ করতে এগোলাম। মেয়েটি আমাকে অনুসরণ করল।

ট্রেন সেদিন আসতে পঞ্চাশ মিনিট দেরি করেছিল। আর স্টেশনে থামল আরও পনের মিনিট। লোকের ওঠা আর ফুরোয় না। আমরা কোনও সিট পাইনি।

কিন্তু নারীর কমনীয়তার একটা শক্তি আছে যে শক্তি তাদের কেউ কেউ ব্যবহার করেন, কেউ করেন না। মেয়েটি দ্বিতীয় দলে। যখন ওকে দেখে আমারই বয়েসী একটি ছেলে উঠে দাঁড়াল, ওর হাত নেড়ে প্রতিবাদ জানাল, ‘না না অসম্ভব!’

আমি বললাম, ‘পরে ভিড় আরও বাড়বে। অন্য বগি থেকেও আরও লোক আসতে থাকবে, প্লিজ আপনি বসুন।’ আমার কথায় এমন একটা আকুতি ছিল যে সে বসল। আমি সেই ছেলেটির দিকে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে থাকলাম। মেয়েটি বলল, ‘তাহলে আপনার ব্যাগটা দিন।’

মানুষের এত ভিড়, এবং স্রোত তখনও চলছে যে আমি ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছি না। এর ভেতর ব্যাগটা রাখতে সত্যিই খুব অসুবিধা হচ্ছিল। এর ভেতর ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। যারা উঠতে পারেনি বগির পাশে পাশে দৌড়াতে শুরু করেছে।

মেয়েটি আবার বলল, ‘কই, দিন ?’

চারদিকে মানুষের ভিড়, স্বেদসিক্ততার একটা মিলিত গন্ধ, যাতে অভ্যাস হয়ে উঠতে প্রতিবার একটু দেরি হয়। ওটুকু সময় আমি কথা বলতে পারি না। কোনওক্রমে বললাম, ‘ব্যাগটা অনেক ভারী।’

‘তাহলে আমিও উঠে যাচ্ছি,’ মেয়েটি বলল।

আমি হাসলাম। মাঝে মাঝে মানুষের জীবনে আসে এমন একেকটা দিন। তাই না ? চলেও যায়। আমি ব্যাগটা তার হাতে তুলে দিতে দিতে ভাবছিলাম, প্রকৃতি এই সুমধুরতা কী দিয়ে সমীকৃত করবে ? খুব বেশি কি কষ্ট অপেক্ষা করছে ?

সেদিন আমি গাজীপুর পর্যন্ত তার সঙ্গে গেলাম। অন্ধকার পথ পেরিয়ে অবশেষে আলোর নিচে কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের বিরাট তোরণ যেখানে, সেখানে তাকে ছেড়ে আসার সময় বললাম, ‘আমাদের দুজনের ডিপার্টমেন্ট তো স্বাধীন। যদি নির্ভরশীল হতো, হয়তো আরও আগে পরিচিত হতাম আমরা।’

মেয়েটি হেসে তার জড়তাহীন হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘বিদায় সলিল।’

আমিও বললাম, ‘বিদায়, পূর্ণা।’

সেদিন আমি অনেকটা পথ ঘুরে, রাত গভীরে যখন নিকুঞ্জের পথে, আমার বাড়ির কলাপসিবল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ব্যাগ হাতড়ে চাবি বার করছি, আমার অন্তর অদ্ভুত এক প্রশান্তিতে ভরে রয়েছে।

বারবার ঘুরে ফিরে নানা স্মৃতি মনে পড়ছিল। আমরা পরস্পরের সঙ্গে কী করে এমন আচরণ করছিলাম যেন কতদিনের চেনা ? হয়তো আমরা সহকর্মী, জানি সে কথা, তাই।

অথবা হয়তো দুজনেরই দুজনকে ভালো লেগেছিল। মানুষের মন বিচিত্র। এমন ভালো লাগাও আছে, প্রতারিত হবে জেনেও ফেরা যায় না।

যৌবনবয়েসের মনস্তত্ত্ব দিয়ে হয়তো এসব ব্যাখ্যা করা যায়।

সেদিনের পর স্টেশনের অপরিচ্ছন্ন মেঝে, ক্লান্ত ঘর্মাক্ত পরাজিত মানুষের দীর্ঘ সারি, গুমোট গরম সব কিছুর ভাষা আমার কাছে বদলে গেল।

এর ভেতর বহুবার আমি তাকে সন্ধ্যায় কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তোরণের কাছে দিয়ে এসেছি। আর ভেতরের গল্প শুনেছি। ভেতরে নাকি দেশি-বিদেশি সহস্র রকমের গাছ, ঝোপঝাড়, জলাশয় আর কৃষি পরীক্ষাগার। ভেতরটা নাকি মস্ত এক গ্রাম, এক বিপুলা উপনিবেশ, শহর থেকে বিচ্ছিন্ন এক লজ্জাহীন স্বর্গ।

‘স্বর্গে তো সাপ থাকে। এখানে কি আছে ?’

‘ইশ! সাপ ছাড়া তো স্বর্গই অসম্পূর্ণ।’

এরপর গরম কেটে শীতকাল এল। পূর্ণা বলল, ‘আমাদের কলোনিতে একদিন আপনাকে না নিলেই না।’

আমার ভেতর এর অপেক্ষায় প্রহর গোনা শুরু হয়ে গিয়েছিল তো আরও আগে থেকে।

কিন্তু পৌষের সাত তারিখ থেকে হঠাৎ একদিন পূর্ণা অফিসে এল না। এভাবে এল পরপর তিন দিন। আমি একাকী অফিস, একাকী প্লাটফর্ম করছি, আর ভাবছি, হঠাৎ কী হলো। ফোনটাও বন্ধ। অফিসের রিসেপশনে জিজ্ঞেস করলাম। রিসেপশনের হুজুর ভদ্রলোক বললেন, ‘ফোন তো বন্ধ আইজ কয়দিন।’

সপ্তম দিন শুক্রবার আমি সরাসরি উপস্থিত হলাম কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের তোরণে। আমাকে আটকালে বললাম, ‘পূর্ণাদের বাসায় যাব।’

দরজার লোকগুলোকে বিভ্রান্ত মনে হলো। বলল, ‘বাসার নম্বর জানেন না ? ফুন দেন।’

‘জি ফোন বন্ধ। বাসার নম্বর জানি না। তবে তাদের বাসার উল্টো দিকে একটা দোতলা মসজিদ আছে।’

প্রহরী দুজন পরস্পরের দিকে একবার তাকিয়ে আমাকে ছেড়ে দিল।

আমি সারা সন্ধ্যা, রাত কেবল পূর্ণাকে খুঁজে বেড়ালাম। কোথাও কেউ পূর্ণা নামে কাউকে চেনে না!

আমি সেই মসজিদটা ঠিক পেয়ে গেলাম। কিন্তু উল্টো দিকের কোনও ফ্ল্যাটের কেউ পূর্ণা নামের কোনও বছর ত্রিশের তরুণীকে চেনে না। না, সেসব বাড়ির কেউ কাজও করে না দিলকুশার কোনও প্রতিষ্ঠানে।

আমি নিজেও ঠিক বুঝতে পারছিলাম না যে আমার জগৎ তখন ভেঙে পড়ছে।

আমি ভালুকের ডাক লক্ষ করে ছুটে যাচ্ছি। পথে আবার সেই গাছটা পেলাম, কোনও সবল থাবার আঘাতে যার বাকল, গুঁড়ির কাষ্ঠল টুকরাংশ উড়ে গেছে। সেই মুহূর্তে মনে হলো, ভালুক ছাড়া আর কিছু হতে পারে না এর হোতা। পেলে সবার আগে জিজ্ঞেস করব, ‘আপনি না রক্ষক ? রক্ষকের এ কেমন আচরণ ?’

সেই জান্তব চিৎকার হঠাৎ কান ফাটানো তীব্রতায় শোনা গেল। চারপাশের ঘোলাটে আকাশ আগের চেয়ে ফর্সা। কোথা থেকে উষ্ণ বাতাস আসছে। কুয়াশার যে ছোট ছোট দল উপদল চরে বেড়াচ্ছিল বনময়, তারা সব কোথায় চলে গেছে। হঠাৎ সবকিছুকে কেমন ভীত মনে হলো।

পথে হঠাৎ একটা গাছ দেখতে পেলাম। আপেল গাছই, বেশ বয়স্ক, তার গুঁড়ির এক খোঁড়ল মাংস কেউ থাবা দিয়ে তুলে ফেলেছে মনে হলো। কাঠটার ভেতরকার কাঁচা কাষ্ঠ বেরিয়ে আছে, খুব করুণ লাগছে। আহারে। কী করতে পারি আমি গাছটার জন্য ? এ ক্ষতচিহ্ন খোলা থাকবে ? আমি সত্যিই জানি না। আমি কি কিছু মাটি নিয়ে লাগিয়ে দেব গাছের ক্ষতে ?

আশপাশে তাকালাম। টুকরা টুকরা ফাঁকা জায়গা আছে, কিন্তু নিখাদ মাটি কোথাও নেই। ঝোপঝাড়, ঘাস, বুনো ফুলে ভরা। আমি যদি কিছু মাটি তুলি, কিছু ঘাস, কিছু বুনোফুল মারা পড়ে। শিবাজী বলেছেন রক্ষা করতে। আমি কাকে রাখব, কাকে মারব ? গাছের গুরুত্ব কি বেশি ? গাছ বড় প্রাণ, তাই ? কে বড়, কে ছোট তা কি আমি ঠিক করে দিচ্ছি ? গাছের গায়ে মাটি সঁপে দিলে গাছটা কি বাঁচবে ? জানি না। তবে এই বুনোফুলগুলো মরবে নিশ্চিত। এখানে হয়তো মাটির নিচে ছিল কেঁচো। সে মরবে।

মানুষের বিবেক খুব জটিল উপায়ে কাজ করে। এই বিবেক গড়ে ওঠার পেছনে হয়তো লাখো বছরের কাজ ও ফলাফলের স্মৃতি কাজ করেছে। মানুষের বুকের ভেতর থেকে যারা কথা বলে, তারা তো সবাই মানুষ নয়।

আমি এক দলা মাটি জড়ো করলাম। আমার নখ বিক্ষত হয়ে গেল। সেই মাটি নিয়ে আমি  সেই গাছের কাঁচা ক্ষতে চাপ চাপ করে লাগিয়ে দিতে থাকলাম। কিছু মাটি ঝরে পড়ে গেল। দেখতে দেখতে সব মাটিই ঝরে পড়ে যাচ্ছে। এ কী কাণ্ড।

আমি আশপাশে তাকালাম, কোথাও কি জল আছে ?

আছে, আমার ব্যাগে কিনলের বোতলে জল আছে। আসার পথে গলা ভেজাতে মনে ছিল না। হায়, মেয়েটিকেও বা ছোট মেয়েটিকেও তো জিজ্ঞেস করা হয়নি একবারও, তারা জল পান করবে কি না ?

বোতলটা বের করে মাটিতে কিছু পানি ঢাললাম। পর্যাপ্তর চেয়ে কিছু কম পানি ছিল, কিন্তু কাজ চলে গেল। এবার খানিকটা কাদা কাদা হতেই আবার নিয়ে গিয়ে গাছের বিশ্লিষ্ট বাকলে চাপালাম। চেপে ধরে থাকলাম।

‘কে আপনার এ দশা করল ?’    

আকাশে একটা চাকার দাগ ফুটে উঠেছে। পরে মনে হলো চাকার দাগ না। বিমান থেকে দেখা শৈলশিরার মতো ছাপ। আকাশে এই চিহ্ন আর দেখিনি।

ভালুকের ডাক আবার শোনা গেল। ইচ্ছে হলো চিৎকার করে বলি, প্লিজ সামনে আসুন। একজন আপনার আশীর্বাদ চাইছে তার ভীষণ প্রয়োজন। আপনার একটু আশীর্বাদ, একটু সাহায্য, একটু অনুমোদন তার জীবন বাঁচাতে পারে। শুনছেন ? না আপনি শুনছেন না। আপনি তো অকারণেই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন, শুনবেন কী করে।

আবার ভালুকটার ডাক শোনা গেল, এ বনের রক্ষক। এবার অনেকটা স্তিমিত। লক্ষ করলাম ডাক শুনে এগোতে এগোতে আমি পূর্বদিকে চলেছি।

আমি এগোচ্ছি দিগন্তের দিকে, পূর্বদিকে। পুবের আকাশ ক্রমশ দিগন্তে মিশে গেছে।

দু’পাশে আপেলের বন। আমি যেখান থেকে যাত্রা শুরু করেছিলাম সেই জায়গাটা কোথাও পেলাম না।

বহুক্ষণ একটানা চলায় আমার গোড়ালি ব্যথায় টনটন করে উঠল হঠাৎ। প্রকৃত অবস্থা নিশ্চয়ই আরও খারাপ। জুতো খুলে একবার নখ দেখা দরকার। আর বুকে, নাকে, মুখে কেমন ঠান্ডা বসে গেছে। মনে হচ্ছে নাকের ভেতর একটা বড়শি গাঁথা। ফুসফুসে একটা ভেজা কম্বল জড়ানো।

পুবদিকে যেতে যেতে হঠাৎ দেখি, যেখানে আকাশ আর মাটি মিশেছে মনে করেছিলাম, সেখানে একটা চিড় ধরেছে। প্রায় দিগন্তজোড়া চিড়। সেই চিড়ের  ফাঁক গলে একটা নতুন জগৎ দেখা যাচ্ছে। চিড়টা আবার বন্ধ হয়ে গেল। আকাশ মাটি আবার এক হয়ে গেল।

আমি এসব কী দেখছি ?

এমন সময় ভালুক গর্জন উঠল আবার। আকাশ আর দিগন্তে আবার ফাঁক সৃষ্টি হলো! সেই ফাঁক দিয়ে বাইরের বাতাস আসছে। বাতাসে আমার চুল মাথার সঙ্গে লেপ্টে গেল। কোনওক্রমে চোখ খোলা রেখে আমি এগোতে থাকি। সেই ফাঁকের ভেতর দিয়ে আমি কিছু একটা দেখতে পাচ্ছি। অন্য কোনও জগৎ ?

আমার মাথা ফাঁকা হয়ে গেল। দাঁড়িয়ে থাকলাম। স্থাণু। কারণ, আমার ঝুঁকি নেওয়া নিষেধ, আমার রক্ষা করার দায়, আমার জোর খাটানো বারণ।

এমন সময় দিগন্ত আর আকাশের সেই ফোকরে আমি দুটো অবয়ব দেখতে পেলাম। একটি দীর্ঘ চুলের কোনও নারী। তার পাশে কোনও মেয়ে শিশু। তারও দীর্ঘ চুল। ওরা ওখানে কী করছে ? ওরা কি আমার এ জগতের বাইরের ওই জগতের মানুষ ?

এমন সময় আকাশ আর দিগন্ত আবার এক হয়ে গেল। এই যেন চিরকালের সেই জগৎ, আকাশকে যেখানে দিগন্তে মিশে যেতে দেখি।

এরপর বহুক্ষণ কোনও সাড়া নেই। কোনও ভালুকের গর্জন নেই। হঠাৎ সেই বুগবুগ শব্দটা আবার শুনতে পেলাম। কোথাও কিছু ফুটছে। কার খোঁজে বৃথাই ঘুরে বেড়ালাম। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে সেই শব্দটা সবচেয়ে বেশি শুনতে পাচ্ছিলাম। সেখানে মাটি কাঁপছে। আমি মাটিতে কান পেতে শুনি, বহু নিচ থেকে আসছে সেই শব্দ।

আমি আবারও আকাশে দেখতে পেলাম একটা লাল পিণ্ড, পিণ্ডটা জীবন্ত। প্রতিবার দ্রিম, দ্রিম, দ্রুক―দ্রিম, দ্রিম, দ্রুক শব্দ আসছে। আচ্ছা। আকাশের এই কোণটায়, একে বলা যায় ঈষাণ কোণ, এই পিণ্ডটা ঝুলে আছে একটা স্বচ্ছ পর্দার আড়ালে। পর্দাটা কি মেঘের ?

আমি আবার এগোতে থাকলাম পূর্ব দিকে। সেদিকেই আকাশ আর দিগন্ত হঠাৎ আলাদা হয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ আবারও একটা শব্দে আমি সতর্ক হয়ে গেলাম। কোথাও যেন কোটি টন ভরসহ বিরাট কোনও চাকা কট কট ক্ট ক্ট ক্ট ক্ট কট কট শব্দ করে ঘুরছে আর থামছে। আগের বার ঠিক এই শব্দের পরই আমি ভালুকের ভয়াল ডাকটা শুনেছিলাম। এবারও কি তাই হবে ?

যেন একই নকশা দেখে সব ঘটছে। হুবহু প্রতিলিপি। আবারও ভালুকের ভয়াল গর্জনটা উঠল। আর পূর্ব দিকের দৃশ্য যা ভেবেছিলাম তাই।

এবার আগের বারের সঙ্গে পার্থক্যটা হলো, আগের বার সেই নারী আর ছোট্ট মেয়েটি দিগন্ত আর আকাশের সংযোগস্থলের শূন্যস্থানে দাঁড়িয়ে ছিল। এবার আর তা নয়। এবার তারা দুজনেই ভেতরে ছুটে আসছে।

সেই দিগন্তে কী ধরনের বাধা আমি জানি না। সেই নারী আটকে গেল। আমি বহুদূর থেকে কেবল কালো অবয়ব দেখে কিছুটা আঁচ করতে পারছি কী ঘটছে। সেই নারী হাত আকাশে তুলে কী যেন ঠেকাতে চাইছে। তার ভারে বসে পড়ল। তাকে ধরে রেখেছিল মেয়েটি। সে ভয়ার্ত চোখে একবার মা ডেকে উঠল! তারপরই ছুটে আসতে থাকল আমার দিকে।

আমিও ছোট্ট মেয়েটির দিকে ছুটতে থাকলাম।

কেউ এ সময় আমাকে ডেকে উঠল পাশ থেকে, ‘সলিল, সলিল!’ আমি থামিনি। ছুটছি। হঠাৎ আমার অপর পাশ থেকে আবারও একই কণ্ঠে বলল, ‘সলিল, তুমি শুনছো না ? শুনতে পাওয়ার তো কথা। আমি তোমার চিন্তায় আমাদের ছাপ দেখতে পাচ্ছি। আগেই কেউ ছাপ রেখে গেছে। তোমার কিন্তু আমার কথা শুনতে পাওয়ার কথা সলিল ? সলিল, শুনতে পাচ্ছ ?’

আমি ছুটছি প্রাণপণে। এরই মাঝে কোনওক্রমে বললাম, ‘কে ?’

‘আমি সে। একটু আগে তুমি যার যত্ন করেছো। আমার ক্ষতে তুমি মাটি লাগিয়ে দিলে। ভালো থেকো তুমি, সলিল, ভালো মানুষ!’

‘তুমি কী করে কথা বলছো ?’

‘আমি তো কথা বলছি না। শুধু তুমি শুনছো।’

‘তুমি কথা না বললে আমি শুনছি কেন ?’

‘প্রথম কি সংগীত কারও কণ্ঠে বেজেছিল ? তাহলে মানুষ কেন সংগীত শুনেছিল ? সলিল, সলিল। আরও দ্রুত ছোট। সেই মেয়েটির মাকে গিয়ে বাঁচাও।’

‘আমার যে আরও জোরে ছোটা দরকার! আমি পারছি না।’ ঠান্ডা বাতাসে মনে হচ্ছে আমার ফুসফুস আর গলার মধ্যপথে কেউ একজন শিরিষ কাগজ ঘষে দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমার মাথার ভেতর বঁড়শিটা ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে গোটা মগজ দখল করে নিয়েছে, খুলির ভেতর টক্কর লাগিয়ে দিয়েছে।

‘ওর মাকে বাঁচাও!’

‘আমি তো বাঁচাতেই চাই!’

‘তার আর সুযোগ নেই। ও নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পেরেছে, দেখো ?’

আমি দেখলাম, সেই মহিলা উঠে দাঁড়িয়েছে। আমার দৌড়ের গতি একটু শ্লথ হয়ে গেল। সেই ছোট মেয়েটি কেমন পেট ফুলিয়ে আমার দিকে দৌড়াচ্ছিল। আমার শিথিল হয়ে ওঠা সেও লক্ষ করে পেছনে তাকাল। মাকে দাঁড়িয়ে যেতে দেখে আবার ঘুরে উল্টো দিকে দৌড়। এই ছোট্ট দেড় ব্যাটারি এত দৌড়াচ্ছে কী করে ?

শুভ্র হয়ে উঠেছে ছবিটা। যেন বরফ ঝরেছে।

মাথার ভেতর একটু আগের কণ্ঠটা, আমি তাকে আপেল গাছ বলে স্বীকার করছি না এখনও, বলল ‘তুমি বোধহয় বুঝতে পারোনি এখনও। যে ভালুককে খুঁজছো, তুমি তার ভেতরেই রয়েছো।’

আমি তখন গাজীপুর কৃষি গবেষণা কেন্দ্রে বিরান সব জমির ভেতর, প্রায় বিজন সব অফিসার্স কোয়ার্টারের ভেতর, ঘন সঘন অঘন গাছের সারি, ঝোপের ল্যান্টানায়, শিয়ালকাঁটায়, ভাঁটফুলে কী যে খুঁজছি, আমি জানি না। আমি সেই মসজিদের সামনে দিয়ে চুয়াল্লিশবার হেঁটে গেছি। বাঁদিকে একটা বাড়ি আছে। কিন্তু সেখানে পূর্ণা নামে কেউ থাকে না। এমনকি দিলকুশার কোনও সরকারি অফিসে কাজ করে এমনও কেউ থাকে না।

কিন্তু আমি বের হচ্ছিলাম না। কারণ পূর্ণাকে আমি এই তোরণের ভেতর দিয়ে অগণিতবার ঢুকতে দেখেছি। ও মিথ্যা বলতে পারে না। পূর্ণা মিথ্যা বলার মানুষ নয়।

খুঁজতে খুঁজতে সন্ধ্যা নামিয়ে ফেলেছি, একটা বাবলা গাছের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম, পাশে স্বচ্ছ একটা খাল। মনে আছে, সেই শেষ সন্ধ্যায় সেই খালটার টলটলে জল দেখে আমার খুব তাতে মুখ দেখতে ইচ্ছা হয়েছিল। অথচ আলো ছিল না। মখমলের মতো সবুজ ঘাস। একটা বাবলা গাছ, মিশকালো কাণ্ড আর টিয়ে সবুজ পাতার ঝালর বাতাসে কাঁপিয়ে সে কি আমার মন ভালো করে দিতে চাইছিল না ?

আমিও তাই দাঁড়িয়েছিলাম। এমন সময় আমার বুকের ভেতর কেমন ব্যাখ্যার অতীত একটা অস্বস্তির অনুভবে ছেয়ে গেল। আমার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল, কিন্তু আমি তো কান্নার কথা ভাবছিলাম না ? মনে হচ্ছিল আমি যেন অন্য কারও অনুভব বহন করছি।

আমি জানি না কেন, অজান্তেই পেছনে তাকালাম। দূরে একটা দীর্ঘ বৃক্ষ। পার্পল-সবুজ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আছে। দূরে দূরে আরও অনেক গাছ আছে ছোটবড়, তাদের আমি চিনি। তারা কেউ শিরিষ, কেউ শ্যাওড়া, কেউ কামিনি, কেউ বাগানবিলাস, কেউ জাম। শুধু সেই গাছটাকে চিনি না।

আমি নিজেকে থামাকে চাইলাম। আমি কোথায় চলেছি ? কে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে ?

আমার বুকের ভেতর কেমন একটা কান্না। মনে হচ্ছিল মন যেভাবে যার কাছে যেতে বলে, তার কাছে গেলে হয়তো বা আমার কান্নার উপশম হবে। আমি তাই চলেছিলাম।

সেই গাছের কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। তার গুঁড়িতে হাত রাখলাম। এই গাছটাকে আমি চিনি না। কী গাছ ও ? কোনও ধরনের শ্যাওড়া গাছ ? বা কোনও ধরনের রেইনট্রি ? না তো। ওকে আমি চিনতে পারছি না। এরকম গাছ, এমন পাতা আমি কি কখনও দেখেছি ?

সন্ধ্যার সেই অন্ধকারে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবু আমার মনে কেমন জানা হয়ে গেল, এমন গাছ এখানে আর একটিও নেই। এমন আর একজনও নয়।

আমার মনের ভেতর যেন আপনাতেই কত কথা আসছে। যে কথা গুলো আমার নয়। যেন কেউ ফুঁকে দিচ্ছে। সত্যিই এভাবে কেউ ফুঁকে দিতে পারে ?

গাছটিকে স্পর্শমাত্র আমার মনে হলো, এই গাছটি একটি আপেল গাছ। আমি এর আগে কোনওদিন আপেল গাছ দেখিনি। তাহলে আমি কী করে জানলাম এটি একটি আপেল গাছ ? আমি জানি না। হয়তো মনের খেয়াল। আসলে এ গাছটা হয়তো একটা―আপেল গাছ।

বারংবার একই উত্তর আমার মনে আসছে।

এবং মানুষ হওয়ার পরও যেমন আমাদের প্রত্যেকের আলাদা নাম আছে, তেমন এই গাছেরও আছে। গাছটির নাম পূর্ণা।

আমি গাছটিকে স্পর্শ করে মৃদু স্বরে বললাম, ‘পূর্ণা, তুমি ?’

‘হ্যাঁ আমি।’ উত্তর এল।

‘তুমি এখানে কেন পূর্ণা ? এই রূপে কেন ?’

‘সলিল। আমার ভীষণ কষ্ট।’

‘বলো, কীভাবে তোমার কষ্ট একটু কমাতে পারি ?’

‘তুমি কি পারবে আমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে ?’

‘কোথায় ?’

‘যেখানে সব আপেল গাছের স্বর্গ ? আজ আটচল্লিশটি বছর আমি কী দুর্বিষহ একা, যদি জানতে!’

‘আটচল্লিশ বছর! কেন ?’

সে অনেক কথা। কৃষি গবেষণা কেন্দ্রটি স্থাপনের সময় এখানে কিছুকালের জন্যে একজন জাপানি স্থপতি এসেছিলেন। তিনি এখানে দুটি কাজাখ আপেলের গাছ লাগান। জগতে মরাল মরালি যেমন জোড় বেঁধে চলে, মানব মানবী যেমন হাতে হাত রাখে, তেমনই পরাগে পরাগ রাখে আপেল গাছেরা। হৃদয়ে হৃদয় রাখে। দুটো আপেল গাছ পাশাপাশি না থাকলে, একটি আপেল গাছ একা ফল ধরিয়েছে এটা দুর্লভ। এটা ঘটে না। আপেলরা বলে, ‘ঘটতে নেই’। ঘটে না বলেই আপেল গাছ বিশেষ। পূর্ণা তার জোড়াকে পেয়েছিল চোখ মেলেই, নাম জল।

জল ? নামে নামে পূর্ণাকে টানে। এখানেও প্রকৃতি একটা কৌতুক রেখে গেল কি আমার জন্যে ?

দুজনে একসঙ্গে বেড়েছে, আলো শুনেছে, শব্দ দেখেছে। মানুষ যেখানে আলো দেখে, শব্দ শোনে, গাছ তার বিপরীত। পূর্ণা আর জল বাতাসের হাত হয়ে একে অপরকে স্পর্শ করেছে, প্রায়ই। পৃথিবীর সঙ্গে ভালোবাসার সেতুটি দুজনের একসঙ্গে গড়া।

তারপর এক খর গ্রীষ্মকালে জল শুকিয়ে গেল, কিন্তু পূর্ণা বেঁচে থাকল। জল আয়ুর অনেকটা মৃত্যুকালে তাকে দিয়ে গেল। পূর্ণা তার মান রক্ষার্থে সেই আয়ু ক্ষয় করে বেঁচে ছিল।

আপেলের মিলিত আয়ু শেষ হয়ে এলে, শেষের কটি দিন তারা কিছুকালের জন্যে এই অভিজ্ঞতাটুকু পেতে পারে, যা এতকাল শুনে এসেছে, তা দেখার; যা এতকাল দেখে এসেছে, তা শোনার। একজন মানুষের মাধ্যমে। পূর্ণার জন্যে সেই মানুষটি ছিল সলিল।

পূর্ণা নামের কেউ কোনওদিন দিলকুশার সেই সরকারি দপ্তরে কাজ করেনি, যেখানে কাজ করে সলিল। যে টেবিলে সলিল পূর্ণাকে দেখে এসেছে, সেই টেবিলে বহুদিন কেউ বসে না। একসময় একজন টাইপিস্ট বসতেন। একজন নারী। তিনি নীল শাড়ি পরতেন। তাঁর চুল ছিল ছেলেদের মতো কাটা। টেবিলে জমা অজস্র কাগজের নিচে সেই টাইপ রাইটার আজো আবিষ্কার করা যাবে।

সলিল শুধু একটি সপ্তাহের জন্যে তাঁকে দেখেছিল। যখন সে নতুন এসেছিল কাজে। সেই মেয়েটিকে দেখে সলিলের ভালো লেগেছিল।

‘তার মানে কোনওদিন তুমি দিলকুশায় আমারই অফিসে কাজ করোনি পূর্ণা ?’

‘ইশ, যদি সেই সৌভাগ্য হতো!’

‘তার মানে কোনওদিন তুমি আমার জন্য দাঁড়াওনি কমলাপুর স্টেশনে।’

‘যদি তা পারতাম সলিল!’

‘একেকদিন গাজীপুর আসতাম যখন, তোমাকে এই গবেষণা কেন্দ্রের তোরণে বিদায় জানাতাম যখন, তখন একদিন, তোমার চোখ আমি ভেজা দেখেছি। আমি ভেবেছি তুমি আমাকে ভালো বাসছো। কিন্তু তা তো মিথ্যা ছিল। তাই না ?’

বাতাস এসে পূর্ণার পাতা দুলিয়ে গেল। কোথাও কোনও উত্তর বাজল না।

‘আলো দেখতে কেমন পূর্ণা ? শব্দ শুনতে কেমন ?’

‘আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ সলিল! শব্দ শুনতে আলোর মতোন। আলো দেখতে যেন রঙবেরঙের সব শব্দ।’

আমিও তোমার কাছে কৃতজ্ঞ পূর্ণা। তুমি না বললে আমি জানতে পারি না কিছু, কিন্তু আমি না বললেও তুমি তা ঠিক জানো। আমার নিঃস্ব, একাকী, পুনরাবৃত্তিময়, ক্লিষ্ট জীবনে কিছুদিনের জন্যে ভালোবাসার একটা ছদ্ম অনুভূতি হলেও তুমি দিয়েছিলে।

‘সলিল। আমি কীভাবে তোমার মন একটু হলেও হালকা করতে পারি ?’

‘কে বলল আমার মন ভারী হয়ে আছে ?’

‘আমি কি তোমার মন জানি না ?’

‘তাহলে নিশ্চয়ই এও জানো, তোমাকে আপেল গাছের স্বর্গে নিয়ে যাব আমি। যেমনটা তুমি চাও। আটচল্লিশটি বছর তুমি একা। আমি আমার সাতত্রিশ বছরের একাকিত্ব বহন করতে পারছিলাম না। আরও এগারটা বছরের কথা তো আমি ভাবতেই পারি না!’

‘আমি আর চাই না সেখানে যেতে। ওখানে আমাকে নিতে পারবে না তুমি। যদি পেরেও থাকো, অমানুষিক কষ্ট হবে।’

‘আমি জানি, এর মতো সেই কষ্টের ভেতরও আনন্দ থাকবে।’

পূর্ণার কাছ থেকে জানলাম তারপর বনের ঠিকানা। সিমলার সেই আপেল বন, যা এমন এক মোক্ষ, তাকে কেবল না চাইলে পাওয়া যায়। সেই স্বর্গে যদি যেতে পারি তো আমিই প্রথম মানুষ হবো না। আগেও সেখানে প্রেমিকরা গেছে।

আপেলের সেই পবিত্র বনভূমি পাহারা দিয়ে রাখেন এক ভালুক। জীবিত আর মৃতের মাঝামাঝি তার প্রাণ। কোনও এক কালে সেই আপেলের বনে ঘুরতে ঘুরতে সুখে তার মৃত্যু হয়েছিল। কোনও এক কালে অপরূপ আপেলের বনে মারা যাওয়ার তীব্র আনন্দে সে বেঁচে উঠেছিল।

এমন প্রাণিকে কি ব্যাখ্যা করা যায় ? ভাষার আর কতটুকুই বা শক্তি।

কাছে গিয়ে দেখি সেই নারী তার হাতের রক্ত শাড়ির আঁচলে মুছে ফেলেছেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাঁর, শাড়িটা ঘিয়া রঙের, সুতরাং রক্তের কালচে মেহেদি দাগ স্পষ্ট ধরা পড়ে যাচ্ছে। ঠোঁটের কোণেও তাঁর রক্তের রেখা। তীব্র ব্যথায় দাঁতের চাপে তাঁর ঠোঁট কেটে গেছে। টের পেয়ে হাতের উল্টো পিঠে দ্রুত মুছে নিলেন।  

‘কেন আসতে গেলেন আপনি ?’

‘ইসসে ভি দার্দ হুয়া হ্যায় মুঝে, কায়ি বার।’

‘আরও একটা বার এখন আমার কারণে যোগ হলো। কেমন হলো ব্যাপারটা ? দেখুন, আপনার মেয়েটা কী ভয়ই না পেয়েছে। ও কীভাবে আমার দিকে দৌড়ে আসছিল আপনি দেখেছেন ?’

সেই ছবিটা চিরকাল আমার চোখে মুদ্রিত হয়ে থাকবে। ভদ্রমহিলা হাসলেন।

‘বহুত তেজ হ্যায়, অরুন্ধতী কা দিমাগ। কোই বাত নেহি।’

‘অরুন্ধতী! কী অপূর্ব নাম। আর আপনার ?’

‘তারা।’

তারা পূর্ব দিকে ফিরে দুহাতের তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি এক করে চোখ বুজলেন। আর ভালুকের সেই কণ্ঠস্বরটা শোনা গেল। যেটা শুনতে বিপুলা ধাতব চাকা ঘোরার কথা মনে পড়ে। আমরা ঢাল ধরে পূর্বদিকে হাঁটতে থাকলাম।

এবার আমার সচেতন চোখের সামনেই বনটা হঠাৎ সেই আপেল বন থেকে বদলে আবার ঝাউ, ওকম সিডার আর রডোডেনড্রনের বন হয়ে উঠল। আমি পেছনে তাকিয়ে কোথাও সেই আপেলের বন দেখতে পেলাম না।

শিবাজী আমার মুখ দেখামাত্র বললেন, ‘আপেলের বন আপনাকে গ্রহণ করেছে দেখছি।’

তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলাম। বিদায় নিলাম মল রোডে আমার হোটেলের ম্যানেজারের কাছ থেকে। পয়মন্ত।

‘পয়মন্ত বাবু। আপনার উপদেশ আমার কাজে এসেছে। আমাকে শিবাজীর কাছে পাঠানোর ঋণ কেনোদিন শুধতে পারব না।’

আর সবাইকে আমি খুঁজে বের করলেও এই পয়মন্তর সঙ্গে তা ব্যতিক্রম। মল রোডে পা রাখার পর পয়মন্তই আমাকে খুঁজে বের করেছিল।

‘এরপর আপনার পালা দাদা,’ বললেন পয়মন্ত। ‘ঋণ যে তার নিজের নিয়মে কাঁধ থেকে কাঁধে বর্তায়! আমার দিকেই দেখুন ? আজ থেকে দায়মুক্ত হলাম। এই মেয়েটি কিন্তু অমূল্য রতন। গাছ উজানিয়া ডাকিনি এখন আর দেখা যায় না।’

তারা আমার দিকে তাকিয়ে নমস্কার জানাল। আমি প্রতিনমস্কারে হাত তুললাম।

‘তিনি মায়ের মতো, বোনের মতো, বন্ধুর মতো আমাকে আগলেছেন।’

তারা হাসিমুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল। সেখানে একটা হলদে বেনেবৌ দোল খাচ্ছে। এ যে একেবারে বাংলার বেনেবৌ! শীত কমে আসছে বোধ হয়। 

তারা হাসি মুখে বললেন, ‘যাব জরুরত হো গি, মে যাউঙ্গি।’

তারা এর আগে অনেক আঘাতের ভর নিলেও, যেমনটা তখন বলেছে, এবার আর পারল না। আমার চলে আসার এক পক্ষকালের ভেতর তারার মৃত্যু হলো। মায়ের পরিবর্তে আমার সঙ্গে এল অরুন্ধতী।

ছোট্ট অরুন্ধতী এত শক্তি ধরে আমি জানতাম না। পূর্ণার আয়―শেষের কুড়ি দিন আগে, শুক্লপক্ষের প্রথম পূর্ণিমা রাতে মায়ের কাছ থেকে পাওয়া গাছ উজানিয়া মন্ত্রে তাকে উড়িয়ে আপেলের স্বর্গে নিয়ে গেল অরুন্ধতী।

পূর্ণার শেষ কটা দিন আমি তার সঙ্গে ছিলাম।

সেই আপেল বাগানে পূর্ণা আবার পুরনো দিনের মতোন সেই নারীরূপে আমার চোখে ধরা দিয়েছিল। আমার প্রতি উপহার ?

আমি প্রথম ও শেষবারের মতো পূর্ণার হাত ধরেছি। গালে, গ্রীবায় চুমু খেয়েছি।

পূর্ণা আমার ঘুমের ভেতর চলে গেল। মাঝ-সকালে, ভালুকের ক্লান্ত গর্জনে যখন আমার ঘুম ভাঙল, দেখি আমি এক নিষ্প্রাণ আপেল গাছের শরীরে হেলান দিয়ে বসে আছি।

হ্যাঁ, নিষ্পত্র সেই আপেল গাছটায় প্রাণ ছিল না। তবে তা নিঃসঙ্গও ছিল না। 

সচিত্রকরণ : ধ্রুব এষ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button