আর্কাইভগল্প

গল্প : মিস ক্যাসাব্লাঙ্কা : কাজী রাফি

অরণ্য মুগ্ধ হয়ে তাকাল ক্যাসাব্লাঙ্কার সামনে দিগন্ত বিস্তৃত আটলান্টিকের দিকে। সাগরের উত্তাল আর ফেনিল ঢেউ আছড়ে পড়ছে শহর রক্ষার জন্য নির্মিত প্রশস্ত আর শক্ত পাথরের বেড়িবাঁধে। বিশ্বনাগরিক হয়ে বড় কোনও কাজ জুটিয়ে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়ানো ছিল তার অনেক বড় এক স্বপ্ন। সেজন্যই ছাত্র-ভিসায় বিদেশে একেবারেই ভিন্ন একটা বিষয় ফিল্ম এবং মডেলিং নিয়ে তার পড়াশোনা। কিন্তু পাঠ শেষ করে অনেক চেষ্টাতেও নাগরিকত্ব তার কপালে জুটল না। বরফের দেশ কানাডায় তার যে বাস করার খুব স্বপ্ন ছিল―তাও ঠিক নয়। তবু, কেন তার এত মন খারাপ তা সে জানে না। হয়তো দেশে তার ভালো কিছু সৃষ্টি করা ঝুঁকিপূর্ণ―এই অনিশ্চয়তা একটা কারণ। কিন্তু এই মন উদাস করা, আটলান্টিকের মতো হু হু করে ওঠা তার হৃদয়-প্রান্তর পার্থিব কোনও চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে এখন। পড়ন্ত বিকেলবেলার এই আটলান্টিকের প্রবল ঢেউয়ের তরঙ্গে একটাই অনুপ্রাস তার কানে খেলা করছে―নাদিয়া ফারিস… ফারিস নাদিয়া…

ফিরে আসার আগে সহপাঠী নাদিয়া ফারিসের বিষণ্ন দৃষ্টিটা ওর মানসপটে এখনও জেগে উঠে ওকে আনমনা করেই চলছে। নাদিয়া এখন মাদ্রিদ এবং ক্যাসাব্লাঙ্কার একজন নামকরা উঠতি মডেল। এই শহরের রাস্তার পাশে বিলবোর্ডে নাদিয়ার হাস্যোজ্জ্বল ছবি গত বছরের তুলনায় অনেক বেড়েছে। কিন্তু বিলবোর্ডের নাদিয়ার হাস্যোজ্জ্বল উচ্ছলতা তার মানসপটে ভেসে উঠছে তাতে এবার যেন মিশে আছে বিমানবন্দরে তাকে বিদায় জানানো নাদিয়ার নিরীহ চোখের বিষণ্নতা।

ক্যাসাব্লাঙ্কায় তার একদিনের ট্রানজিট। সন্ধ্যার পর শহরটার নিরাপত্তা নিয়ে তার কোনও ধারণা নেই। তবে আফ্রিকা আর ইউরোপের মিলনস্থল যে খুব নিরাপদ হবে তা সে বিশ্বাস করে না। দেয়ালের এ পাশে বিচের অংশে পর্যটক এবং মানুষের প্রাণস্পন্দনে মুখরিত। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে এক গ্লাস ডালিমের শরবত খেয়ে সে বেড়িবাঁধের দেয়ালটার উপর উঠে বসল। ডানে, একটু দূরে পৃথিবীখ্যাত হাসান-২ নামের কারুকার্যময় মসজিদ। সাগরের ফেনিল আর তরঙ্গিত ছন্দোময় ঢেউয়ের শব্দের পাশে এত মানুষের কোলাহলের গুরুত্বহীনতা কত স্পষ্ট এখানে! সাগরের গম্ভীর গর্জনের পাশে মানুষের প্রাণস্পন্দনটুকু জীবনের চিরন্তন যে অনিত্যতা তাই-ই যেন স্পষ্ট হয়ে আছে আটলান্টিকের উপর ছড়িয়ে থাকা অবারিত নীলাকাশে। এখানকার বাতাসে, শহরের রাস্তা আর পামগাছের সারিতে বিকালের ম্লান আলো আকাশ-সাগরের নীল নীল নিয়ে খেলায় মত্ত। নাদিয়া ফারিসার কথা কেন তার এত মনে পড়ছে! সাগর সাঁতরে কি তার কাছে যাওয়া সম্ভব ? একবার যেতে পারলেই সে নিশ্চিত তাকে কোনওদিন বলতে না পারা কথাটা বলেই ফেলবে এবার। কিন্তু যে ভয়ে সে কোনওদিন তার অনুভূতির কথা, ভালোবাসার কথা নাদিয়াকে সে বলতে পারেনি, তার জীবনে সেই ভয়ই আজ তো একমাত্র সত্যি। নাদিয়া ফারিসকে নিয়ে দেখা স্বপ্নটুকু কত মিথ্যা! তার সঙ্গে কোনওদিন শুটিং-মডেলিং নিয়ে প্রাণবন্ত আলোচনা অথবা মহড়া আর হবে না―ভাবতেই দীর্ঘশ্বাসে ভ’রে ওঠে অরণ্যের হৃদয়।

এই-ই বরং ভালো হয়েছে। এক পক্ষ থেকে মায়া যত বড় হোক তার ভার বহন সহজ হয়। মনে মনে ভেবেই চলে সে। নাদিয়াও যদি তাকে তার মতো করে ভালোবেসে ফেলত! ফিরে আসত কি সে তার মায়ের এই ক্যাসাব্লাঙ্কা আর বাবার মাদ্রিদ নামের শহরের বেড়ে ওঠা পিতৃ অথবা মাতৃভূমির কাছাকাছি ? মরক্কোয় নাগরিকত্ব পাওয়া হয়তো কঠিন কিছু নয়। নাদিয়ার সঙ্গে কতবার তাকে এই ক্যাসাব্লাকায় আসতে হয়েছে। অনেক বড় প্রতিষ্ঠানের কোনও অ্যাডভার্টাইজের শুটিং করার জন্য এই শহরে আসার সময় নাদিয়া ফারিস নামের বিখ্যাত মডেলকন্যাটি তাকে কি শুধু ব্যবহার করেছে ? ফিল্ম-মিডিয়া এবং ক্রিয়েটিভ মডেলিং নিয়ে দুজনের পড়াশোনার সূত্রে সে শুধু তাকে বন্ধু ভেবেছে ? বন্ধুত্বের আড়ালে তার প্রতি এত নিবিড় মনোযোগ, ধৈর্যের সর্বোচ্চ পরাকাষ্ঠায় নিজের আচরণকে তার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার সাধনা―কোনওকিছুই কি নাদিয়ার মনোযোগ আকর্ষণ করেনি ? শুধু ফিরে আসার সময়টুকুতে বিমানবন্দরে অরণ্যের চোখে তাকিয়ে নিজের চোখকে ছলছল করে তোলা―ব্যস! তাতেই সম্পর্কের সব দেনা-পাওনা চুকে গেল ? কঠোর অভিবাসনের কাছে তরুণ-তরুণীর এইসব প্রেম-প্রেমের আবেগমাখা অনুভব কত খেলো! অরণ্য মুখে স্মিত হাসি ফুটিয়ে নিজেকেই বলে, ‘নিজেকে বরং ভাগ্যবান ভাবো যে, নাদিয়া ফারিসের ক্যাসাব্লাঙ্কা আর মাদ্রিদ কাঁপানো মডেলকন্যা তোমার বন্ধু ছিল। যে মেয়েটা তোমাকে বিদায় জানানোর সময়, অভিনয় ছাড়াই তার চোখের ভাষাকে ভিজিয়ে নিয়েছিল নিজেরই অশ্রুতে। বন্ধুত্ব এমনকি জীবনের বিনিময়ে তার মতো লাস্যময়ী আর খ্যাতিমান মডেলকন্যার কাছ থেকে এর বেশি প্রত্যাশা স্রেফ মূর্খতা ছাড়া আর কী!’ 

বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষে, পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই কানাডা নাদিয়া ফারিসার মতো একজন মডেলকে আগ বাড়িয়ে নাগরিকত্ব তো দিলই, সঙ্গে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর স্বাক্ষর করা সনদে তাকে নিয়ে কানাডার গর্বের কথা জানাতেও ভুলল না। আর অরণ্য ? নাদিয়ার পাঠ-সংক্রান্ত প্রতিপাদ্য প্রস্তুত করুক অথবা তাকে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যবহারিক প্রয়োগ শেখাক এবং যতই ভালো ফলাফল সে অর্জন করুক তার মতো মূল্যবোধহীনতার আকণ্ঠ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত একটা রাষ্ট্রের একজন অরণ্যর জন্য ধনী এসব রাষ্ট্রের কোনও মনোযোগ তো নেই-ই, করুণাও নেই। এই-ই বরং ভালো হয়েছে, মেয়েটা তার মতো একজন অরণ্যকে নিয়ে কষ্ট পাচ্ছে না। মূল্য থাকলেও অর্থবহতা যার নেই তাকে এই বিশ্ব এখন পায়ের তলায় মাড়িয়ে যায়। নাদিয়ার এখন পাহাড়-অভিযাত্রার সময়। পিছনে তার না তাকানোই ভালো।

সে হাতের ব্যাগটা মাথার নিচে দিয়ে বিস্তৃত পরিসরের বেড়িবাঁধের দেয়ালটার উপর শুয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুম ঘুম ভাব আসতেই সে সচকিত হয়ে উঠল। বিদেশ বিভূঁইয়ে সব খোয়া গেলে জেলে পচতে হবে তাকে। কিন্তু ঘুম মানে না কোনও সচেতনতার ধরন। সাগরের ফেনিল আর আস্তরিত ঢেউয়ের ছন্দ ঘুমপাড়ানি গান হয়ে তাকে ঘুম-ঘুমের জগতে ডাকলেও সে জেগে থাকার সর্বোচ্চ চেষ্টা করল। একবার উঠে বসলও।

এরই ফাঁকে নাদিয়া ফারিস কখন এসে তার পাশে বসেছে। মাথায় চুলের আলতো মায়াস্পর্শে অরণ্য চমকে উঠল। মাথার নিচের ব্যাগটা শক্ত করে ধরে অবাক আর বিস্মিত কণ্ঠকে যথাসম্ভব সংযত করে বলল, নাদিয়া! তুমি ?

হুম, নাদিয়া ফারিস, মিস মরক্কো। দ্য মোস্ট গর্জিয়াস মডেল অব মাদ্রিদ অ্যান্ড ক্যাসাব্লাঙ্কা। বাট আই’ম ইয়োর নাদিয়া…

ওহ, গড! আমি… আমি আসলে ভাবতেই পারছি না… তুমি বিমানবন্দরে তাহলে কেন অমন কাঁদো কাঁদো হয়ে বিদায় দেওয়ার অভিনয় করলে ?

অভিনয় হোক আর সত্যি হোক, আমার অশ্রুসজল চোখ দেখেও তো তুমি একবারের জন্যও থেকে যাওয়ার ঝুঁকি নিলে না ? নাদিয়া ফারিসকে পাওয়ার জন্য এই বিশ্বে কতজন এখন জেল খাটার জন্য প্রস্তুত; তা কি তুমি জানো ? আর তুমি কি না পালালে… কাওয়ার্ড!

নাদিয়া!

তোমার কী ধারণা ? তোমার মতো একজনকে এক দেশে আশ্রয় দেওয়ার জন্য প্রভাব বিস্তারে আমি যথেষ্ট শক্তিশালী নই ? আর অমন একটা বরফস্তূপকেই কেন আমাদের বিশ্বের একমাত্র বাসযোগ্য ভূ-খণ্ড ভাবতে হবে ?

না, তা ঠিক নয়। কই, তুমি তো কখনও… আমি বরং সবসময় ভাবতাম যে, তোমার চোখ কাঁদলেও, তোমার মুখ হাসলেও জীবনের উচ্চাশার কাছে তা শুধু মডেলিংয়ের সূত্র মাত্র! পৃথিবী যাদের হাতের মুঠোয় আমার মতো সামান্য এক তরুণের আবেগ এমনকি ভালোবাসা তাদের কি আটকে রাখতে পারে!

তোমার ভাবনাটা খারাপ নয়। তবে, আজ আমি বুঝলাম বড় হওয়ার যাত্রাপথে পাশে হাজার মানুষ থাকলেও ‘খুব একা’ হয়ে যেতে হয়। তুমি আমাকে ‘একা’ করে চলে এসেছো…

আহা, নাদিয়া। কাছে, পাশে বাস করেও, একসঙ্গে পথ চলেও আমার চেতনায় তুমি কত অধরা ছিলে! আজ এই আটলান্টিকের পাড়ে তোমাকে এভাবে পাওয়ার জন্য স্রষ্টা আমাকে এত যন্ত্রণা দিলেন। মনে মনে কথাগুলো বলে অরণ্য মায়াভরে নাদিয়ার হাত ধরল। বলল, তুমিও আমার পরের কোনও ফ্লাইটে টিকেট কেটেছিলে অথচ আমাকে বলোনি। কিন্তু নাদিয়া, কী অদ্ভুত ব্যাপার, তুমি ঠিক ঠিক আমাকে এখানে খুঁজে বের করেছো।

না, আমাকে খুঁজতে হয়নি। আমি জানতাম, তুমি এখানেই আসবে। আমাদের অনেক প্রিয় এই আটলান্টিকের পাড়ে। তারপর, সাগরের ঢেউয়ের সঙ্গে নিজের হৃৎস্পন্দনকে ভাসাবে। বিমানবন্দরে আমার সঙ্গে শেষ দেখার স্মৃতি মনে করে তোমার কান্না পাবে; আমি সবই জানতাম…

নাদিয়া, আমি চাইনি আমার এই আটপৌরে জীবনের সঙ্গে তোমার জীবনকে জড়াতে। দেখো, একটা দেশে থাকার মতো সামান্য যোগ্যতাই আমার নাই। তাছাড়া, আমার এমন কিছু নাই যা তোমার বর্ণিল জীবনের উচ্ছল রংকে আকৃষ্ট করার সামর্থ্য রাখে। নাদিয়া ফাররিসের প্রতাপময় খ্যাতির পাশে অরণ্য এক লতা-গুল্মের মতো জঞ্জাল মাত্র।

রং ? তুমি রং চেনো অরণ্য ? বলে নাদিয়া তার ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে নেইল কাটারের চাকুর মতো অংশটা বের করে বলল, চিনতে চাও ?

নাদিয়া, রক্তের রংকে এই পৃথিবী আর আলাদা করে মানবসত্তার বর্ণ বলে শনাক্ত করতে চায় না। টাকার বর্ণকে এই বিশ্ব এত চিনেছে যে, হৃদয়ের রক্তের রং অথবা স্বপ্নের বর্ণময়তা এখানে মানব চোখ আর জিহ্বাকে আকৃষ্ট করার জন্য খাবারে ভেজাল হিসেবে ব্যবহার করা রঙের চেয়ে গুরুত্বহীন। 

ঠিক তাই। আমি তা জানি বলে, এই চাকু দিয়ে তোমার হৃদয়টা কেটে দেখতে চাই, সেখানে নিষ্ঠুরতা নামের কোন বর্ণ নিয়ে তুমি জন্মেছো যে, আমাকে একা এক বরফের দেশে ফেলে যাও ? এতদিন পাশে থেকেও আমাকে আপন ভাবতে পারো না! 

হ্যাঁ নাদিয়া, আমি নিষ্ঠুরতার বিপরীত এমন এক বর্ণহীন রক্ত নিয়ে জন্মেছি যে, এত মায়ার কুহেলিকা ধারণ করা এই হৃদয় তোমার জন্য ছটফট করলেও, তোমার জন্য মরে যেতে চাইলেও তা আর আলোর রেখা নামের রং নিয়ে ধনু আর হয় না। দুর্নীতিগ্রস্ত এক গরিব দেশের নাগরিকের রক্তে ভালোবাসার রক্তকে এই বিশ্ব রং হিসাবেই দেখে।

তুমি কোন দেশের―তাতে আমার কিছুই এসে যায় না। আমি তোমার বর্ণহীন অথচ প্রগাঢ় অনুভবটুকুকে ভালোবেসেছিলাম। ভালোবেসেছিলাম তোমার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অপার ক্ষমতা, তোমার শান্ততা আর ধৈর্যটুকু যা দিয়ে তুমি আমার জন্য অপেক্ষার নিবিড়তম সৌন্দর্যকে তোমার চরিত্রে ধারণ করতে। আর…

আর… ?

যে পুরুষ স্থান-কাল-পাত্রকে পায়ের তলায় মাড়িয়ে ভালোবাসাকে গুরুত্ব দেয়, ক্ষমতা আর অর্থের চেয়ে কাজকে গুরুত্ব দেয়―নারীর ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যতম তারা। আর আমি মডেলকন্যা হলেও এত প্রজ্ঞাহীন নই যে, আমার জন্য জুঁতসই মানুষকে আমি খুঁজে পাব না।

খুঁজে পেলে কি তাকে এভাবে কেউ ছেড়ে দেয় ?

সেজন্যই তো… তোমার পিছু পিছু ঠিক চলে এসেছি। দেখো। মা’কে সব বলেছি। তবে তোমাকে নিয়ে এই সাগরপাড়েই আজ সারারাত কাটাব। ভোরে বাসায় ফিরব আর আগামীকাল সন্ধ্যায় তোমাকে বিয়ে করব। অনাড়ম্বরভাবে। তারপর অ্যাম্বাসিতে আমার বরের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করব। জামাইকে এ দেশ জামাই আদরেই নাগরিকত্ব দেয়, জানো তো ?

আমার দেশে থাকবে না ? পাহাড়-সাগর আছে, আছে পৃথিবীর সবচেয়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ সুন্দরবন। ঢাকা নামের শহরটাকে দেখলে তোমার মনে হবে অর্থনৈতিকভাবে তা ক্যাসাব্লাঙ্কার চেয়ে শক্তিশালী।

প্রকৃতি ঠিক আছে। কিন্তু ঢাকায় কখনই নয়, প্লিজ। তোমার সঙ্গে একবার গিয়ে তো পেট ব্যথায় মরতে বসেছিলাম। তাছাড়া তোমার ঢাকার মানুষগুলোকে আমার খুব আজব লেগেছে। বিভ্রান্তির ধারণায় পুষ্ট তারা। ওখানকার ধনী লোকগুলো হাজার হাজার অপুষ্ট মানুষের উপর প্রভুত্ব চালাতে যেমন ভালোবাসে, তেমনি ভালোবাসে গোলামি করতে। তাদেরই গোলামি যারা তাদের এককালে শোষণ করেছে। ভাবতে অবাক লাগে, ভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করা এক জাতি ইংলিশ মিডিয়াম আর আরবি শেখার জন্য ভিতরে ভিতরে যত তাগাদা অনুভব করে নিজের ভাষার জন্য তা করে না!

কিন্তু সে তো আমার নিজের দেশ!

খাবারেও যেখানে এত ভেজাল বুঝতে হবে সেখানে মানুষ লোভের পাপে আবিষ্ট। লোভের পাপ বেশি হলে পুণ্য খোঁজার ভণ্ডামিতে সেই জাতি জরাজীর্ণ হয়ে যায়। সেখানে বাস করতে হয় না। নিজের দেশ হলেও না। ওসব অর্থনৈতিক উন্নয়ন এক ধোঁয়াশা মাত্র। ভোট পাওয়ার জন্য রাষ্ট্র এখন রাজনীতির পোস্টারমাত্র।  

তার মানে ? তুমি ক্যাসাব্লাঙ্কায় থাকবে ?

সারা পৃথিবীকেই আমাদের ‘ঘর’ বানাব। আমার খ্যাতিতে ঐ পাওনাটুকু বোনে। আজ পাহাড়ে তো কাল সাগরপাড়ে। একদিন পাহাড়ে তো অন্যদিন মরুপ্রান্তর অথবা বুনো প্রকৃতির কোনও কোলে…

আহা, আমাকে এত স্বপ্ন দেখিয়ো না; নাদিয়া ফারিস, ফারিস নাদিয়া…। তোমার নামের অনুপ্রাস নিয়ে আটলান্টিকের ঢেউও এখন বন্দনা করে। তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখতেই আমার ভয় লাগে…

‘কোনও ভয় নেই। আমার চোখের দিকে তাকাও। তাকাও এই ছবির দিকে। নাদিয়া ফারিসের মতো সুন্দরী মেয়ে আমাদের মোটেলে আছে। ঠিক তার মতো চুল, ত্বক, শরীরের উচ্চতা।’

চোখের দৃষ্টিসীমায় দুটি ছবি অরণ্য ঝুলতে দেখল। ঝাপসা ঝাপসা অবয়ব দুটি একটু স্পষ্ট হতেই ছবি দুটিকে কয়েকটা আঙুলে ধরে থাকা একটা হাত দেখল। এবং সেই হাতটা এক নারীর। দ্রুত চোখ ঘষল অরণ্য। কালো টি শার্ট, সাদা জিন্সের ছোট করে কাটা চুলের নারীকে দেখে মাথার নিচে বালিশ বানানো নিজের হাত-ব্যাগটি হাতড়ে তার অস্তিত্ব বোঝার চেষ্টা করল সে। না, তা খোয়া যায়নি। পাথরের দেয়াল থেকে বালির সৈকতের দিকে পা ঝুলিয়ে অরণ্যের কোমর ছুঁয়ে তারই দিকে মুখ করা মহিলাটি এবার স্মিত হেসে বললেন, এভাবে এখানে শুয়ে আছো দেখে বড্ড মায়া হলো। দেখলাম তোমার বাহুর নিচে আলতো পড়ে আছে আমাদের মডেলকন্যা নাদিয়া ফারিসের ছবি। ক্যাসাব্লাঙ্কায় ফারিসের মতো সুন্দরীর অভাব নেই। বলে তিনি ছবি দুটি আবার তার চোখের সামনে এমনভাবে ঝুলিয়ে দিলেন যেমন বিখ্যাত কোনও রেস্তোরাঁ আস্ত এক খাসি ল্যাম্ব-রোস্ট বানিয়ে ঝুলিয়ে রাখে। চোখ ঘুরিয়ে ছবি দুটি মনোযোগ দিয়ে সে দেখল। মনে হচ্ছে জমজ দুই বোনের ছবি সে দেখছে। নাদিয়ার একজন যমজ বোন আছে তা সে কোনওদিনই জানেনি! মহিলা তার ঘোর কাটাতে বললেন, তুমি কোথায় যাচ্ছ, বলো তো ? কয়েক দিন থাকছ তো ক্যাসাব্লাঙ্কায় ?

আলতো ভঙ্গিতে অরণ্য উঠে বসল। বেলা প্রায় ডুববে ডুববে। কিন্তু শেষ বিকেলের রক্তিমাভা ছড়িয়ে আছে আটলান্টিকের নীলের তেপান্তরে, শহরের বড় বড় দালান আর ছোট ছোট গাছ দিয়ে সাজানো রেস্তোরাঁ অথবা কফি শপের আড্ডায়। ঊর্ধ্বে অবারিত নীলাকাশের সবটুকু নীল ঘনায়মান আঁধারে হারিয়ে যাওয়ার আগে ফিকে হয়ে যাচ্ছে। ফিকে হয়ে যাচ্ছে অরণ্যের ভিতরের ডানামেলা স্বপ্নের ঘোর। আনমনা ভঙ্গিতে সে বিশ্বের এই এক টুকরা অনিন্দ্যসুন্দর জগৎটার দিকে আবার তাকাল। মগ্নচোখে কিছু একটা খুঁজল অথবা নিজের হৃদয়টুকু হাতড়ে তার শূন্যতার অস্তিত্ব অনুভব করল। কিন্তু রাত-দিন তার শূন্য হৃদয় উজাড় করে ডেকে যাওয়া আটলান্টিকের ঢেউছন্দ আছে। নাদিয়া ফারিস কোথাও নেই। কিন্তু অরণ্যর হৃৎস্পন্দনে তার যে দ্যোতনাময় অনুপ্রাস তাকে ভালো করেই জানে সে। সে ঠিক এই মুহূর্তেই একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। আটলান্টিক হয়ে সে আকাশের নীল হৃদয়ে একা বয়ে বেড়াবে না। নাদিয়া ফারিসকেও সে আর কারও হতে দেবে না। কিন্তু তার জন্য তার ভয়ংকর সাহসী এক পুরুষ হয়ে ওঠা প্রয়োজন। তার জন্য নাদিয়া ফারিসের অনুরূপ এক প্রতিমূর্তির সঙ্গে সে প্রেমের মহড়াটুকু আজ রাতে করে নিতে চায়। মহিলার দিকে সে তার জোরালো তবু মায়াবী দৃষ্টি ফেলতেই মহিলা জানালেন, হুবহ একজন ফারিসকে চাইলে আমার মোটেলকেই তোমার বেছে নিতে হবে। তবে, স্বাভাবিক কারণেই মেয়েটার বুক-নিতম্ব ফারিসের চেয়ে একটু ভারী। সে তোমার বরং ভালোই লাগবে। তুমি চাইলে সারারাত সে তোমার সেবা করবে। আর একটু যদি বেশি ডলার ঢালো…

অরণ্য তার ব্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে প্রশ্ন করল, তোমার মোটেল কতদূর ?

ঐ যে ঘাস-ফুলের চত্বরের উপর যে পামগাছটা দেখছ, ওটাই আমার মোটেল। মোটেলের সামনে ড্যান্স বারটা তোমাকে যা আনন্দ দেবে…

অনেক দিনের চেনা মানুষের মতো অরণ্য হেঁটে চলছে মহিলার পাশে। কিন্তু অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখে থমকে দাঁড়াল অরণ্য। মহিলা চলার সময় বাম পায়ের প্রতি পদক্ষেপ সংক্ষিপ্ত করে ফেলছেন। একবার পড়ে গিয়ে নাদিয়াও কিছুদিন ঠিক এভাবেই হাঁটত। তার হঠাৎ মনে পড়ল, গ্রামের বাড়িতে টিউবওয়েলের জল আনতে গিয়ে তার মা একবার পড়ে গিয়ে বাম পায়ে ব্যথা পেয়েছিলেন। মনে হলো, বাংলাদেশটার কোথাও এমন ব্যথা যে, তার প্রিয় মাতৃভূমি প্রতি পদক্ষেপকে সংক্ষিপ্ত করে তবেই সামনে পা ফেলে। হাতের মুঠি তার শক্ত হয়ে গেল। মনে মনে সে দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে উঠল, লোভের পাপে আবিষ্ট মানুষদের অন্তরে সে আলো ফেলবে নিজের সব অর্জন দিয়ে। অরণ্য থমকেই থামল দেখে মহিলাও থামলেন, কী খোকা! থামলে যে ?

স্বপ্নঘোরে নাদিয়া তাকে বলেছিল, ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি কারণ তুমি থামতে জানো। আটলান্টিকের প্রবল ঢেউও নির্দিষ্ট দূরত্বে থেমে যায় বলে তার আস্তরে এত জাদুছন্দ! থামতে জানার চেয়ে বড় শিল্প মডেলিং জগতে আর নেই, অরণ্য। আর এখানে একবার থামলে আমি খোঁড়া হয়ে যাব। কিন্তু আমি জানি, একজন খোঁড়া নাদিয়াকে বহনের জন্য এক সিংহ-হৃদয় প্রস্তুত হয়ে আছে। আই’ম সো লাকি।’

কিন্তু এখন নাদিয়ার জন্য নয়। মায়ের জন্য এক সন্তানের হৃদয় হাহাকার করে উঠল। থেমে যাওয়া মহিলাকে সে বলল, মেয়েটার রেট কত ?

ওহ, তুমি খুব ভাগ্যবান যে, আজ সারারাত ওকে তুমি পাবে। ভাগ্য কি ডলারে কেনা যায় ?

তবু…

ষাট ডলার প্রতি ঘণ্টা। তবে সারারাতের জন্য তিনশ ডলার…

অরণ্যের হাতে আছে মাত্র দুইশ নব্বই ডলার। সে দুইশ পঞ্চাশ ডলার তার হাতে দিয়ে বলল, মেয়েটাকে দিয়ে দিয়ো।

তুমি যাচ্ছ না ?

না, আমি জানি মেয়েটার এক পায়ে অনেক ব্যথা। অভিনয় করে ব্যথাটুকু সে লুকিয়ে রাখে।

বলো কী খোকা ? কী আজব মানুষ তুমি! এই তথ্য তুমি জানো কীভাবে ? কিন্তু, পা নয় ওর আসলে… অরণ্য তার কথা শেষ করতে দিল না, জানি, কারণ সবাই থামতে জানে না বলে অন্য কোনও জীবনকে তাদের বেছে নিতে হয়।

মহিলা ডলারগুলো হাতে নিয়ে ফিরে যাওয়া অরণ্যের দিকে হতভম্ব আর বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থেকে মহিলার চোখ ছলছল করে উঠল। নিজেকে শুনিয়ে তিনি বললেন, নাদিয়া বড় হতভাগিনী। ডলারের চেয়ে ছেলেটাকে পেলেই মনে হয় বেশি খুশি হতো সে! এমন নায়কোচিত ভঙ্গিমায় কোনও তরুণকে সে এই ক্যাসাব্লাঙ্কায় কোনওদিন হাঁটতে দেখেনি।

মহিলা ঝাপসা আর মুগ্ধ দৃষ্টিতে যার দিকে তাকিয়ে আছেন সেই অরণ্যকে আটলান্টিক আজ তার জাদুছন্দ দিয়ে ভালোবাসা শিখিয়ে দিয়েছে―ভালোবাসা মানেই পাওয়া নয়। ভালোবাসা ত্যাগও নয়। ভালোবাসা নতুন কিছুকে ধারণ করতে শেখায়। আটলান্টিক হয়ে আকাশের অবারিত নীল হৃদয়ে একা বয়ে বেড়ানোর জন্য যে অরণ্য এখন প্রস্তুত। প্রস্তুত নিজেকে উজাড় করে মরে যাওয়ার জন্য।

দেশের জন্য, মায়ের জন্য, প্রেমিকার জন্য!

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button