অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : কুঁড়েকথা : নাগিব মাহফুজ

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

মূল : নাগিব মাহফুজ

বাংলা অনুবাদ : বিপ্লব বিশ্বাস

[খ্যাতনামা মিশরীয় লেখক নাগিব মাহফুজের জন্ম কায়রোতে ১৯১১ সালে। তাঁর অসাধারণ সৃষ্টিকর্মের স্বীকৃতি হিসেবে ১৯৮৮ সালে তিনি নোবেল সাহিত্য পুরস্কার লাভ করেন। আরবি ভাষাভাষী লেখকদের মধ্যে তিনি প্রথম নোবেল জয়ী। নাগিব মাহফুজ শতাধিক ছোটগল্প এবং ত্রিশটির মতো উপন্যাস লিখেছেন। তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস কায়রো ট্রিলজি ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত হয়। ২০০৬ সালে নাগিব মাহফুজ মৃত্যুবরণ করেন।]

গতকালের চ্যালেঞ্জ ছিল ক্ষুধা আর চরম দারিদ্র্য; আজকের চ্যালেঞ্জ, সম্পদের বাড়বাড়ন্ত। একটা পুরনো বাড়ির দাম পাওয়া গেল পাঁচ লাখ। ইসাম আল-বাকলির পুনর্জন্ম হলো যেন, সত্তর বছর বয়সে।

আদ্যিকালের চটা-ওঠা আয়নায় নিজেকে দেখে মজা পাচ্ছিল সে : সময়, ক্ষুধা আর ক্লেশের অভিঘাতে বিধ্বস্ত এক জরাজীর্ণ প্রতিচ্ছবি; বেরিয়ে আসা চোয়ালের হাড়, বিরক্তিকর তামাটে চামড়ায় মোড়া ছাতাপড়া মুখ, সরু কোটরাগত কপাল আর নিষ্প্রভ চোখের পাতায় কয়েকটি মাত্র লোম আটকে আছে; সামনের দাঁত কালচে আর মাড়ি দাঁতহীন; চামড়াসর্বস্ব কোঁচকানো ঘাড়। সত্তরের পর জীবনের কী-ই বা বাকি থাকে ? এ সব সত্ত্বেও যে সম্পদ তার কবজায় উড়ে এসেছে তার মাদকতা উবে যাওয়ার নয়। অসংখ্য সামগ্রী অর্জন করতে হবে। অভাবী, অলস, ভবঘুরে ইসাম আল-বাকলি এখন লাখপতি। বেঁচেবর্তে থাকা পুরনো বন্ধুরা নিজেদের মধ্যে অবাক বিস্ময়ে বলাবলি করছিল, ‘ইসাম আল-বাকলির ব্যাপারস্যাপার শুনেছো ?’ ‘কেন, কী হয়েছে আলসেটার ?’ ‘নতুন বড় কোম্পানিগুলোর একটা ওর বাড়িটা কিনে নিয়েছে, পাঁচ লাখে।’ ‘পাঁচ লাখ!’ ‘আমি কোরআন ছুঁয়ে বলতে পারি।’

প্রবল হ্যারিকেন ঝড়ের ঢঙে সাকাকিনি, কুবেইসি ও আব্বাসিয়ায় এই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। বাড়িটার সামনে কুশতুমুর স্ট্রিট। অনেকটা খোলামেলা উঠান। ইসাম মায়ের কাছ থেকে বাড়িটি পেয়েছে; দশ বছর আগে তার মা বয়সের ভারে জর্জরিত অবস্থায় মারা যায়। নাছোড় ঢঙে জীবনকে আঁকড়ে ছিল মহিলা যতদিন না জীবন-কাঁথার সুতা সব টুকরা টুকরা হয়ে ছিঁড়ে যায় আর সে ফুরিয়ে যায়। ইসাম মায়ের জন্য কষ্ট পায়নি―কোনও কিছুর জন্য দুঃখকষ্ট পাওয়া তার ধাতে নেই ।

মাথার ওপর ছাদ আর মায়ের সামান্য পেনশন ছাড়া পরিবারটির আর কিছু ছিল না। ইসাম স্কুলে তেমন কিছু করতে পারেনি, কোনও ব্যবসাও শেখেনি; জীবনে কখনও কোনও কাজই করেনি―এক নিষ্কর্মা ভবঘুরে। ধোঁকাবাজি করে ব্যাকগ্যামন খেলে, স্কুলে অসংখ্য বন্ধু আর পড়শি বন্ধুদের আশকারায় শৈশবে, বালকবয়সে কিংবা যৌবনকালে সে কিছু পিয়াসটার জিততে পারত। তার চরিত্রে এমন এক মনোহারিত্ব ছিল যে তার কিছু দোষ তাতে শুধরে যেত এবং তার ত্রুটি, চরম দুর্ভাগ্য আর তার অবস্থাজনিত হতাশার কারণে সবাই তাকে ক্ষমা করত ও তার প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। তার বাবা পোস্ট অফিসে চাকরি করত আর তার মা বাবার সূত্রেই কুশতুমুরের এই খোলামেলা অথচ অবহেলিত একতলা বাড়িটা পেয়েছিল। সে যে একটি ভালো পরিবারের সন্তান তা তার বলার অধিকার ছিল কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, যদিও এটা ঘটনা যে সে বোকা, অলস, অমার্জিত এবং তাকে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা খুব আগের ব্যাপার নয়। কার্যত তার পুরো জীবনটাই আইসিস ক্যাফেতে কেটে গেছে, হয় ঋণগ্রস্ত অবস্থায় নয় ঋণমুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় বন্ধুদের উদারতার সুযোগ নিয়ে তাদের ঠকানোর মাঝ দিয়ে। তার বন্ধুরা ছিল উদার। যেমন উকিল ওথমান আল-কুল্লা আর্মি স্কোয়ারে তার অফিসে বাকলিকে কাজ দিতে চেয়েছিল কিন্তু সে এক হতচ্ছাড়া কামচোর, তাই সে অস্বীকার করে।

বন্ধুরা যখন তাকে মর্জিমাফিক চলতে দিয়ে যে যার কাজে ফিরে গেল, সে অলস দিবাস্বপ্ন দেখে দেখে কাল কাটাতে লাগল। ভোট-উৎসব, বিয়েথা বা শবানুগমনের সময় নিজেকে খানিক ব্যস্ত রাখত সে। সারাটা জীবন সে কাটিয়ে গেল চরিত্রের চমৎকারিত্বে আর বন্ধুদের উদারতায় ভর করে; বিনস দিয়ে একবারের আহার, সুজির তৈরি এক টুকরো মিষ্টি বাসবুসা কেক বা দু টান হাশিশের জন্য সে মজা উসকিয়ে দিত, গাইত, নাচত আর দমফাটা মশকরা করত।

তার স্বভাবই ছিল অনাহার, উন্মত্ত আর দমিত অবস্থায় থাকা। কুশতুমুর বাড়ি বিনস ছাড়া কোনও খাবার তৈরি করা জানত না তেমন (আর সে বিনস-এরও নানা পদ); আর খেতো বেগুন ও মসুরডাল। সে স্বপ্ন দেখত রহস্যময় ভোজ―ফ্যানটাসির আর চেপে রাখা যৌনক্রিয়ার। ডিভোর্সি, বিধবা এমনকি বিবাহিত মহিলাদের সঙ্গে তাকে জড়িয়ে নানা গল্প ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল কিন্তু কেউ তার সে সব কথা বিশ্বাস করত না, যদিও তাকে কেউ মিথ্যেবাদীও বলত না। যে গল্প প্রত্যেকে বিশ্বাস করত তা হলো তার চেয়ে দশ বছরের বড় এক বিধবা চাকরানির সঙ্গে তার প্রণয়ঘটিত ব্যাপার যা দ্রুত ঝগড়াঝাটিতে গড়িয়েছিল যখন এটা পরিষ্কার হলো যে মেয়েটা তাকে বিয়ে করতে চায়। ঘটনা হলে, মেয়েটা তাকে দিয়ে কড়ার করিয়ে নিয়েছিল যে বিয়ের পর তাকে একটা কাজ জুটিয়ে নিতে হবে। কেননা কথায় আছে, অলস হাত অপরিষ্কার। প্রথমে দুজনের মধ্যে ঝগড়াঝাটি ও পরে চরম হাতাহাতির পর তাদের সম্পর্ক ভেঙে যায়। তার জীবনে এটাই ছিল প্রকৃত প্রণয়ের ঘটনা আর তার পড়শি মি. ওথমান আল-কুল্লা সেই হাতাহাতির সাক্ষী ছিল এবং ক্যাফেতে সেই ঘটনার বিবরণ দিয়েছিল। ‘সার্কাসের চাইতেও এক মজাদার দৃশ্য তোমরা দেখতে পেলে না। কয়লার বস্তার মতো মোটা এক মেয়েছেলে আমাদের প্রিয় বন্ধু আল-বাকলিকে যা তা ভাবে গালাগাল করেছে আর তারই ভদ্রসভ্য বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে লোক জড়ো করে তাকে হেনস্থা করেছে―ঠিক তার সদয় ও আতঙ্কিত মায়ের চোখ-কানের নাগালে তা ঘটেছে। কিছু দয়ালু পড়শি হস্তক্ষেপ না করা অবধি আর তার শেষ দমতক এই ন্যাকড়ানেকড়ি চলতেই থাকে―ঠিক তখনই তার মায়ের সঙ্গে নতুন লড়াই শুরু হয়।’

এই গুমোটি অভিজ্ঞতা ছাড়াও বাকলি যখনই রাস্তায় ওই মেয়েটিকে দেখত কেমন ভীতু হয়ে পড়ত, জবুথবু ভাবে; খিদেয় যেমন পেট জ্বলে যেত, মেয়েটিকে দেখলে তার হৃদয়েও একটা আবেগী কষ্ট হতো। মা ছাড়া আর কাউকে সে খুঁজে পেত না যার ওপর রাগ আর হতাশা ঝাড়তে পারে―তার জন্য মায়ের বিপুল ভালোবাসা সত্ত্বেও যেমনটি এক বুড়ি মায়ের একমাত্র ছেলের জন্য হয়ে থাকে। যখনই মা তাকে কোনও কাজ জুটিয়ে নিজের পায়ে দাঁড়াতে বলত সে রাগে ফেটে গিয়ে মাকে ঝাড়ত, ‘তুমি মরবে কবে ?’

মৃদু হেসে মা বলত, ‘আল্লাহ তোকে ক্ষমা করুন। আমি মরার পর পেনশন বন্ধ হয়ে গেলে কী করবি তুই ?’

‘এই বাড়ি বেচে দিব।’

‘এ বাড়ির জন্য পাঁচশো পাউন্ডের বেশি কেউ দেবে না, যা তুই মাস দুয়েকের মধ্যেই ফুকে দিবি আর তারপর ভিক্ষে করে খাবি।’

সে কখনও মায়ের সঙ্গে ভালো ব্যবহার করত না। বন্ধুরা তাকে বলত স্বভাব পালটাতে যাতে করে তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা আর দুঃখ মাকে দ্রুত শেষ করে না দেয় আর তাকে সত্যি সত্যিই ভিক্ষা করে না খেতে হয়। তারা তাকে আল্লাহর কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সেই নবি হজরত মুহাম্মদ মা-বাবার প্রতি সম্মান দেখানো বিষয়ে কী নির্দেশ দিয়েছেন তা বোঝাত, কিন্তু তার চরম হতাশার বোধ ক্ষুধা ও ক্লিষ্ট হৃদয় থেকে বিশ্বাসের শেকড় উপড়ে নিয়েছিল। উপহাসপ্রবণতায় আটকে থাকে সে, চারপাশে যা ঘটছে তার প্রতি চরম তিক্ততা, যেমন রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ত খাওয়াখাওয়ি, অতিরঞ্জিত বিদ্রƒপের সঙ্গে জগতের ওপর চেপে বসা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ যা আরও বেশি ধ্বংসাত্মক―সে সবের প্রতি তার তীব্র শ্লেষ কাজ করে। তাকে নিয়ে পুরো হতাশ মা নিজেকে আল্লাহর হাতে সঁপে দিয়েছে। কখনও কখনও দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থায় মহিলা বলত, ‘কেন তুই আমার স্নেহ-ভালোবাসার এমন অপমানজনক প্রতিদান দিস ?’

উপহাস করে সে বলত, ‘এ জগতে দুর্ভাগ্যের অন্যতম কারণ হলো যে কিছু মানুষ প্রয়োজনের অতিরিক্ত বাঁচে।’

দিন গুজরানের খরচ বেড়েই চলেছে। আরও হানিকর কিছু হবে নাকি ? তাই সে মায়ের কাছে প্রস্তাব রাখল কোনও ব্যক্তি বা পরিবারকে শোওয়ার ঘরটা ভাড়া দিতে আর সে মায়ের ঘরের গদিওয়ালা সোফায় শোবে। মা তা শুনে অবিশ্বাসের ঢঙে চেঁচিয়ে বলল, ‘আর অচেনা লোকেদের কাছে বাড়িটা হাট করে খুলে দিই!’

‘না খেয়ে মরার চেয়ে তো ভালো হতো’, সেও চিৎকার করে বলে। তারপরে উঠোনের দিকে তাকিয়ে বিড়বিড়িয়ে বলত, ‘এটা একটা ফুটবল মাঠের মতো, কোনও কামের নয়।’

এরপর এক দালাল গ্রামাঞ্চল থেকে এক ছাত্র ধরে আনল; এক পাউন্ড ভাড়ায় একটা ঘর নিল সে। বন্ধুরা সব তা নিয়ে ঠাট্টা করে বলতে লাগল, কুশতুমুর বাড়িটা বোর্ডিং হয়ে গেল। তারা বাকলির মাকে ‘ম্যাডাম আল-বাকলি’ নামে ডাকতে লাগল। কিন্তু সে তাদের এই উপহাস এড়ানোর চেষ্টা করল না এবং সুর করে গাইতে লাগল, ‘দিন এসেছে যখন বনেদি মানুষকেও অপমানিত হতে হয়।’

অন্যদের মতো না হয়ে সে আকাশপথে বিমান হানাকে হালকা ভাবে নিত। সাইরেন বাজলে গা করত না―ক্যাফেতে বসেই থাকত, নড়ত না সেখান থেকে; এবং কোথায় আশ্রয় নিতে হবে তাও জানত না। এতে তার কোনও হেলদোলও ছিল না। যা নিয়ে ভাবত তা হলো, তার জীবন বয়ে যাচ্ছে আর সে পৌঁছে যাচ্ছে চল্লিশের কোঠায়―মনমতো খানাপিনা না করেই বা কোনও সুন্দরীর সঙ্গলাভ না করেই। এমনকি দেশের বিপ্লব তাকে কখনই ছুঁতে পারেনি। সে ব্যঙ্গ করে বলত, ‘মনে হয় এই বিপ্লব আমাদের মতো জোতদারদের বিরুদ্ধে।’

জীবনে কখনও খবরকাগজ পড়েনি সে, বন্ধুদের জটলার মাঝ থেকেই এলোমেলোভাবে খবর জোগাড় করত। এভাবেই বয়স বাড়িয়ে সে পঞ্চাশ পেরোল। মায়ের বয়স আরও অনেকটাই বেড়ে গেছে; দুর্বল হয়েছে শরীর, কোনও কিছুতেই যেন আর আগ্রহ বোধ করে না। এভাবে সেও একদিন সঙ্কটাপন্ন হলো। বাকলির এক ডাক্তার বন্ধু মাকে দেখে হার্টের দুর্বল অবস্থার কথা জানাল। ওষুধ দিল, বিশ্রাম নিতে পরামর্শ দিল। যাই হোক, বিশ্রামের তো প্রশ্নই নেই আর ওষুধও পাওয়া সম্ভব নয়। এর মধ্যে বাকলির মাথায় ঢোকে, মায়ের পেনশন বন্ধ হয়ে গেলে তার চলবে কীভাবে! ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরোয়, মা মৃত্যুর দিকে এগোতে থাকে। এক সকালে সে ঘুম ভেঙে দেখে, মা মরে গেছে। মুখে কাফন দেবার আগে দীর্ঘক্ষণ মরা মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। মনে পড়ে দূর অতীতের আবছা স্মৃতি সব এবং এভাবেই সে বাধ্য হয় বিদ্রƒপ করা থেকে বিরত হতে। বুঝতে পারে, সকালের সেই মুহূর্তটা তার কাছে দুঃখ-বিষাদময়।

অবিলম্বে সে তার সবচেয়ে ধনী বন্ধু মি. নুহকে খুঁজে বের করে যে সম্পত্তিবিষয়ক ব্যবসায়ী এবং যে তার মায়ের দাফনের দরকারি ব্যবস্থা করে দিল। শুধু তাই নয়, সে তাকে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে সতর্ক করে বলল যে হুট করে এটা করলে পথে বসতে হতে পারে। এ কথায় ইসাম আল-বাকলি বিস্মিত, যদিও তার মনে হলো ব্যাকগ্যামন খেলায় ধাপ্পাবাজি করে আর একটি ঘর ভাড়া দিয়ে কদ্দিন চালাবে! আবার বন্ধুদের উদারতারও তো একটা সীমা আছে! সে সাহস করে শহরের প্রান্তে ভিক্ষে শুরু করল এবং তাতে কাজ হলো বেশ।

দিনের পর দিন যায়, এক নেতা মারা গেলে আর একজন তার জায়গায় বসে আর তারপর ‘খোলা-দরজা’ নীতি চালু হলো যখন, সে সত্তরের কাছাকাছি; এসে গেল জীবনের চরম হতাশা আর অপব্যয়ের বয়স। জীবনযাপনের খরচ সত্যসত্যই বেড়ে যাচ্ছিল আর তার মান বিপজ্জনকভাবে ওঠানামা করছিল। ভিক্ষাবৃত্তির আর তেমন সুযোগ রইল না, বন্ধুদের উদারতাতেও হঠাৎই ছেদ পড়ে গেল (তার জনাকয় বন্ধু, দুর্ভাগ্যই বটে, জগতের মায়া ত্যাগ করে চলে গেল যখন বাকিরা বুড়ো বয়সের প্রশান্তি অবলম্বন করে একত্রে বসে খোশগল্পে মশগুল হয়েই কাটাত); এবং সে গভীর ধ্বংসের অতলে হঠকারীর মতো ঝাঁপ দিল। কী হতভাগ্য, বেপরোয়া বৃদ্ধ সে!

তারপর একদিন তার অস্তিত্বের অন্ধকার ঘুচে গেল, দেখা পেল এক দালালের যে তাকে স্বর্গ থেকে নেমে আসা দেবদূতীয় পাখনার ওপর বসতে সাহায্য করল। তার দুই বন্ধুর উপস্থিতিতে, একজন উকিল আর অন্যজন সম্পত্তি বেচাকেনার দালাল, চুক্তি সম্পাদিত হলো আর একটি মোটা অঙ্কের অর্থ তার ব্যাঙ্কবইতে জমা পড়ল। তারপর তিনজন মিলে আল- আজহার স্ট্রিটে এক নিম্নমানের ক্যাফেতে বসল যার ভড়ংহীন চেহারার সঙ্গে লাখপতি বেচারা বাকলির বেশ মিল ছিল। সে আত্মতৃপ্তির গভীর শ্বাস ফেলল, কোনওরূপ শব্দ না করেই। এই প্রথম সে জীবনে পুরো খুশি হলো। তবু হতবাক হয়ে সে বলল, ‘তোমরা দুজন কি আমাকে একটু একা থাকতে দেবে না ?’

‘আজ থেকে তোমার আর কাউকে দরকার হবে না ’, উকিলবন্ধু ওথমান আল-কুল্লা হেসে বলল।

কিন্তু মি. নুহ বলল, ‘ও পাগল আর ওর প্রতি পদক্ষেপেই ওকে চালনা করার জন্য কাউকে দরকার।’

কৃতজ্ঞচিত্তে বাকলি বলল, ‘আমার জানা মোতাবেক তোমরা দুজনেই এ ব্যাপারে শ্রেষ্ঠ মানুষ।’

‘কিছু বিষয়কে অগ্রাধিকার দিতে হবে’, মি. নুহ বলল, ‘কোনও কাজে নামার আগে―যা ফেলে রাখা যাবে না।’ সব আগে তুমি বিশেষ তুর্কি স্নান সেরে এতদিনের জমা ময়লা সব তুলে এসো যাতে করে তোমার আসল চেহারাটি দেখা যায়।

‘তাতে ভয় হয়, ব্যাঙ্কে আমাকে চিনতে পারবে না…।’

‘এরপর চুল-দাড়ি কেটে এসো, আজ তোমার জন্য একটি রেডিমেড স্যুট আর কিছু জামাকাপড় কিনে দিব যাতে করে একটি ভদ্রগোছের হোটেলে কারও কোনও সন্দেহ ছাড়াই থাকতে পারো।’

‘আমাকে কি স্থায়ীভাবে হোটেলে থাকতে হবে ? ’

‘তা যদি তুমি মনে করো’, উকিলবাবু বলল, ‘সেখানে তুমি পুরো পরিষেবাসহ সব পাবে…।’

‘ফ্ল্যাট নিলেও তার সুবিধাটুবিধা আছে’, মি. নুহ বলল।

‘কিন্তু বিবি ছাড়া ফ্ল্যাট পরিপূর্ণ নয়!’ বিস্ময় প্রকাশ করে বাকলি বলল―

‘বিবি ?’

‘কেন নয় ? সত্তর বছর বয়সে আমিই প্রথম বা শেষ সাদির পাত্র নই!’

‘এটা একটা সমস্যা।’

‘ভুলে যেয়ো না পাত্র কিন্তু লাখপতি।’

‘সেটা জোর উৎসাহের বিষয় বটে, কিন্তু তা কেবল অবিবেচকদের জন্য’, উকিলবাবু হেসে বলল।

‘বিবেচক আর অবিবেচক আখেরে সব এক!’, বিদ্রƒপের সুরে আল-বাকলি বলল।

‘না, এতে তোমাকে হয়তো হিসেবের অনেক আগেই ভিক্ষেকাজে ফিরতে হতে পারে।’ নুহ বলল।

‘এখনকার মতো এ আলোচনা থাক’, উকিল বলল।

‘মেয়েদের বিষয়ে আলোচনা থামিয়ে রাখা যায় না’, ইসাম আল-বাকলি বলল। ‘রেডিমেড স্যুটের চাইতে এটি বেশি গুরুত্ববহ।’

‘সেখানে অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে, আর আছে রাতের ক্লাবগুলোর হই-হুল্লোড়।’

‘এ ব্যাপারে তোমাদের দুজনকে আমার জরুরি প্রয়োজন।’

‘কিন্তু আমরা বহু যুগ আগেই এই উচ্ছৃঙ্খল যাপনকে বিদায় দিয়েছি।’

‘তাহলে আমি একা কীভাবে চলব ?’

‘টাকাকড়ি কারও সঙ্গী হলে সে আর নিঃসঙ্গ বোধ করে না।’

‘আমাদের আর একটি আলোচনায় বসতে হবে’, মি. নুহ বলল, ‘এই বিপুল অর্থ বিনিয়োগের বিষয়টি ভাবার পর। মূলধন খরচ না করে উপার্জন থেকেই ব্যয়নির্বাহ করাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে।’

‘একটা কথা স্মরণ করো’, প্রতিবাদ করে আল-বাকলি বলল, ‘আমি এখন সত্তরের কোঠায় আর আমার কোনও উত্তরাধিকার নেই।’

‘তথাপি!’

‘বড় কথা হলো আমাদের শুরু করা দরকার।’ উকিলবন্ধু বলল।

সন্ধ্যায় তারা যখন জড়ো হলো, ইসাম আল-বাকলির পরনে নতুন স্যুট আর চেহারাতেও নতুন জেল্লা। কিন্তু ময়লা-টয়লা যখন সব উঠে গেছে বুড়ো বয়সের দুর্দশা আর আগেকার ছতিচ্ছন্ন অবস্থা রয়েই গেল।

‘কাবা শরিফের নবির নামে দিব্যি কেটে বলছি, একদম ভ্যালেন্টিনোর মতো সুস্থ, সফল লাগছে তোমাকে!’ হেসে বলল উকিল।

যেহেতু নাইল হোটেলের ম্যানেজারের সঙ্গে ওথমান আল-কুল্লার বন্ধুত্বপূর্ণ ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিল, সে আল-বাকলির জন্য সেখানে একটি সুন্দর ঘর ভাড়ায় নিয়ে দিল আর বাকলি তৎক্ষণাৎ তার দুই বন্ধুকে সেখানে ডিনারে নিমন্ত্রণ করল। খাবারের আগে তারা কয়েক পেগ মদ্যপান করল, তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে পরের দিনের মিটিংয়ের পরিকল্পনা করল। এরপর আল-বাকলি মি. নুহর গাড়িতে তাদের সঙ্গে গেল কিন্তু হোটেলে ফিরল না। পরিবর্তে সে একটা ট্যাক্সি নিয়ে মহম্মদ আলি স্ট্রিটে গেল এবং সোজা মিশরীয় রান্নার জন্য বিখ্যাত একটি রেস্তরাঁয় ঢুকল। কিছুক্ষণ আগে ডিনারে কী খেয়েছে তা ভুলে গিয়ে খিদেতে শান দেওয়ার কথা ভাবল। গরমাগরম ঝোলসহ ভেড়ার মাথার মাংস আর টুকরা করা রুটির অর্ডার দিল; খেলোও পেটপুরে। সেখান থেকে বেরিয়ে এমন একটা দোকানে ঢুকল যেখানে বাসিমা, কুনাফা, বাসবুসা জাতীয় মিশরীয় মিষ্টি কেক পেস্ট্রি পাওয়া যায় তাকে যেন খাবারের বাতিকে পেয়েছে। মাঝরাতের খানিক আগে সে হোটেলে ফিরল। এতই খেয়ে ফেলেছে যে অচেতন হবার জোগাড়। ঘরের দরজা বন্ধ করার পর তার গোটা দেহজুড়ে অস্বাভাবিক কুঁড়েমি ভর করল। পরনের কাপড়চোপড় এমনকি জুতাশুদ্ধ শরীরটাকে বিছানায় ছুড়ে দিল আলো না নিভিয়েই। তার পাকস্থলী, বুক ও হার্টজুড়ে কী একটা যেন গুটিসুটি মেরে বসে আছে ? কীসে তার শ্বাস আটকে আসছে ? কে তার গলায় চেপে বসেছে ? সে সাহায্য চাওয়ার কথা ভাবল, টেলিফোন ব্যবহারের কথা ভাবল, কিন্তু তার নড়বার ক্ষমতা নেই। হাত-পায়ে যেন বেড়ি পরানো, গলা দিয়ে আওয়াজ সরছে না। হোটেলে সহায়তার ব্যবস্থা থাকলেও কীভাবে সে সব হাতের নাগালে পাবে ? এ কী অদ্ভুত পরিস্থিতিতে পড়ল সে যা একজন মানুষের কাছ থেকে ইচ্ছা, ক্ষমতা সব ছিনিয়ে নেয়, তাকে পুরো অস্তিত্বহীন, তুচ্ছ করে দেয় ? তাহলে এটাই মৃত্যু, সেই এগিয়ে আসা মৃত্যুর হাতছানি যাকে কেউ হটাতে পারে না, বাধা দিতে পারে না কেউ। জ্বোরো অচেতন অবস্থায় সে ম্যানেজারের কাছে, নুহর কাছে, ওথমানের কাছে, তার বৈভবের কাছে, সাদির কনের কাছে, সেই মেয়েটির কাছে, তার স্বপ্নের কাছে কাকুতিমিনতি করতে লাগল। কেউই কোনও উত্তর দিল না। তাহলে কেন এই অলৌকিক ঘটনা ঘটল ? কিছুই বুঝতে পারল না সে। কিছুই বোঝা গেল না। হায় আল্লাহ।

 লেখক : গল্পকার, অনুবাদক, প্রাবন্ধিক

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : কাব্য কারিম

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button