আর্কাইভগল্প

গল্প : অন্দরে বাহিরে অন্তঃপুর : মিলু শামস

ঘটনার সূক্ষ্মতা এতই যে, কেউ সেভাবে আঁচ করারও সুযোগ পায়নি। বয়স্কদের মধ্যে জ্ঞানপ্রাপ্ত যারা তাদের কেউ কেউ ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ-বিন-বখতিয়ার খলজিকে স্বপ্ন দেখার কথা বলেন। কেউ শামসুদ্দীন-শাহ-ই বাঙ্গালিয়ার কথা বলেন। তারা আরও বলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তার সভার ভাঁড় গোপাল এবং তার ব্যঙ্গ-বিদ্রƒপের কথা। কিন্তু এ কথা কেউই স্পষ্ট করে বলতে পারেন না, ভাঁড়সহ পারিষদ এবং খোদ কৃষ্ণচন্দ্র মসনদ নিয়ে পাখির মতো ডানা মেলে উড়ে এসেছিলেন, নাকি সর্বতোভাবে জনগণের ইচ্ছায় মসনদে বসেছিলেন। তবে পূর্বপুরুষের কাছ থেকে শোনা কিছু আনন্দময় গল্পগাছা তারা হুবহু বলে যেতে পারেন। যেমন ঘটা করে মহিষাসুর মর্দিনীর অর্চনার গাথা তারা এমনভাবে উল্লেখ করেন যেন নিজেরাই চাক্ষুষ করেছেন সেসব।

‘পুরো বাংলা নেচে উঠত, বুঝলে, ইংরেজ সাহেবদের সে কি তারিফ! দশভুজার দশটি হাত দেখে, ফুল, বেল পাতা, অষ্টব্যঞ্জনসহ তাঁকে পূজিত হতে দেখে তারা শুধু মুগ্ধ আর মুগ্ধ!’

ওই মুগ্ধতা কোনও পাপেট শোয়ের প্রসেনিয়াম ছিল কি নাÑতা নিয়ে তাদের মাথাব্যথা নেই। এ প্রসঙ্গ তাদের মনেই আসেনি কখনও।

তাদের কয়েক প্রজন্ম পরের কিছু অনুসন্ধানীর দৃষ্টি সেদিকে নিবদ্ধ হলে তারা খবরের কাগজে বিবৃতি দেওয়ার মতো করে ঘটনা বর্ণনা করেন। একদল গবেষক একেই ভিত্তি করে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন শুরু করে এবং দেখতে পায় মাটির কয়েক স্তর নিচে চকমকে স্যান্ডউডস পাথরের নিদর্শন রয়েছে। রয়েছে কিছুু নরমুণ্ডু, দেবী ভবানীকে তুষ্ট করার নিমিত্তে উৎসর্গীকৃত। তাঁর প্রভাব-প্রতিপত্তি তখন আকাশচুম্বী। এসবে গোপন সংকেতের ইঙ্গিত রয়েছে কিনা তা যাচাই করার উদ্যোগ নেন তারা এবং সূত্রবদ্ধ করেন বিচিত্র তথ্যÑযেমন, চূড়ার শীর্ষে বহু দূরবর্তী ভবিষ্যৎ মোহগ্রস্ত দিনের পূর্বাভাষ লুক্কায়িত ছিল কিনা অথবা ঘটনা প্রবাহের শাখা-প্রশাখার যে বিস্তৃতি তার মূলটি ওখানে প্রোথিত ছিল কিনা ইত্যাদি। তাদের মতে, চূড়া বা আকাশচুম্বী কনসেপ্ট প্রতিষ্ঠিতই হয়েছিল সুদূর ভবিষ্যতে এমন পরিস্থিতি উদ্ভবের জন্য, যাতে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন আবহ সৃষ্টি হয়ে সম্মিলিত অন্ধত্ব নেমে আসে জনপদে। এবং জন্ম নেয় আরেকটি বিপরীতমুখী চূড়া। যার নির্দশন এখন প্রকটভাবে পষ্ট। তাদের ধারণা ওখান থেকে ঝরনার মতো নামে কিছু গায়েবি আওয়াজ আর আপাদমস্তক আলখাল্লা মোড়া অন্তঃপুর। বহু কাল ধরে কুলকুল শব্দে ধীর গতিতে বয়ে যেতে যেতে সম্প্রতি দ্রুত হয় গতি। বন্যার মতো জনপদ ভাসিয়ে গিয়ে  মেশে দক্ষিণের বঙ্গোপসাগরে।

আলীবর্দী খাঁ, সিরাজদ্দৌলা, পলাশী প্রসঙ্গেরও অবতারণা করেন তারা। প্রহসনের যুদ্ধের আগে কিশোর নবাবের মাতামহ ভিনদেশী বণিকের শাসনের কাছে আনুগত্য স্বীকার না করার সিদ্ধান্ত জানিয়ে যে তেজোদীপ্ত পত্র পাঠিয়েছিলেন সেই ঘটনাকে তারা ইতিহাসের একটি অমোচনীয় মাইলস্টোন হিসেবে তুলে আনেন। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার ইংরেজ কেতার প্রসঙ্গ তোলেন এবং পরের ঘটনাগুলো যে ছক কেটে পর পর সাজানো তার সপক্ষে তথ্য-প্রমাণ হাজির করেন। তারা এও বলেন, দেশীয় কিছু বিভীষণ উঠে এসেছিল তখন সবংশে, শাখা-প্রশাখাসহ। নবাবি চরিতনামা, বাংলার ইতিহাস ইত্যাদি নাকি তাদের হাতেই রচিত যার সত্যায়ন হয়েছে বণিকের ছদ্মবেশ খোলা রাজদণ্ডের মুদ্রণালয়ে। সত্যকে কীভাবে ধামাচাপা দিতে হয় তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন বোঝাতে তারা রেফারেন্স হিসেবে ওই সময়ের উল্লেখ করেন। নবাবের রোমহর্ষক ব্যাভিচার, গর্ভবতী নারীর পেট চিরে সন্তান বের করার উল্লাস, শত নারী সম্ভোগের মনোহর বর্ণনা ইত্যাদি। গা ঘিনঘিনে অনুভূতি নিয়ে সেসব যখন ইতিহাসের ছলে গেড়ে বসছে জনস্রোতের ঢেউয়ে ঢেউয়ে তখনই নাকি আদ্যাশক্তি মহামায়ার চূড়ায় আরোহণ। বৈদিক যুগ থেকে তিনি সিংহাসনারূঢ় হলেও হঠাৎ করে এই চূড়ায় ওঠানো আর নবাবী অধঃপাতের যুগান্তকারী মেলবন্ধনের খোঁজ এ জনপদের আপামর মানুষ কোনওদিন পায়নি। ফ্যাল ফ্যাল করে তারা তাকিয়ে থেকেছে শুধু। গায়ত্রী সন্ধ্যায় মন্ত্র জপেছে, কেবলামুখী হয়েছে মুয়াজ্জিনের ডাকে। ইতিহাস এগিয়েছে নাটকের গ্রিনরুমে নটবরের পোশাক পাল্টানোর মতো একের পর এক পরিপাটি সাজে। ঘটনার সুললিত অনুকৃতিতে।

এ পর্যন্ত বিশ্লেষণ করে গবেষক দল একটু থামে। গবেষণার ডেটা, কাগজপত্র ঘাঁটে, তারপর এক ঝটকায় অনেকখানি এগিয়ে যায়।

আগের তথ্যের ধারাবাহিকতায় পরের তথ্য যুক্ত করে জানায়, তখন থেকেই একটি গুমোট বাতাস মৃদু লয়ে বইতে শুরু করেছিল। পাটখেত, ধানখেত, আম-কাঁঠালের বনে তা তেমন দৃশ্যমান না হলেও সাহেবি বৈঠকখানায় ছিল বেশ ভালো রকম উষ্ণ প্রবাহ। ওক কাঠের আরাম কেদারা, বেলজিয়াম কাচ আর ভারতবর্ষীয় তামা-পিতলের কারুকাজে সজ্জিত ঘরে ঘূর্ণির মতো ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে তা নিরবচ্ছিন্ন। প্রাচ্যদেশীয় চণ্ডাল ঝঞ্ঝার মতো নয়, ইংরেজ কেতায় মৃদু পেলব ভঙ্গিতে। ইরানি ফরাসে সন্তর্পণে নরম কোমল শরীর আকণ্ঠ ডোবানোর আবেশে। প্রেমভাব, পরকীয়া, কূটচাল, পলিটিক্সের পাঁচমেশালি হাওয়ায় মাখামাখি হয়ে শেষতক রন্ধনশালা থেকে বেরিয়েছিল যে উপাদেয় খাবার তা গলাধঃকরণের পরই সবিস্ময়ে শনাক্ত হয় রোগ এবং বাড়তে থাকে উপসর্গের তীব্রতা।

জ্ঞানপ্রাপ্ত বয়স্করা কেউ কেউ এর সঙ্গে একমত পোষণ করেন, কেউ মতভিন্নতার কথা জানিয়ে অন্য প্রসঙ্গের অবতারণা করেন। এ অঞ্চলে ঝনঝনে লাঙ্গলের ফলায় উঠে আসা স্বর্ণলতা হাওয়ায় দুলত, ঝলক তুলে বয়ে যেত ভাটিয়ালি সুরে। সেই নির্মল বায়ুর খবর তাদের নখদর্পণে থাকা সত্ত্বেও একমত পোষণকারীরা জানান, সুজলা সুফলা ভূমি এক সময় কুয়াশার চাদরে ঢেকে যাবেÑএ তাদের অনুমানে ছিল। তাদের বদ্ধমূল ধারণা, রন্ধনশালার ইংরেজ পাচক এমন ভাব নিয়েই খাবার পরিবেশন করেছিল দু’পক্ষের ভিআইপি অতিথির সামনে। ভবিষ্যতে তারা যে আর এক টেবিলে বসে অন্ন গ্রহণ করবেন নাÑএ তারা দিব্যদৃষ্টিতে পরিষ্কার দেখতে পেয়েছিল। তাই সমাদরের বাহুল্যে অমন চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া।

‘কালে কালে দ্যাখো, ফলে গেল পাচকের মনোভাব। তাই হলো, সীমানা হলো, স্বত্ব হলো, আহার বিহারে ফিটফাট কিন্তু মগজ ও মনন ঠিক বন্ধক রইল তাদের কাছে, বিশ্বহাটে কুৎসিতভাবে বিকিয়ে গেল!’

বিশ্রম্ভালাপের মতো এ কথা বলে সেই জ্ঞানপ্রাপ্ত বয়স্করা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পাচক প্রসঙ্গে বলেন,

‘খাবার পরিবেশনের কী কৌশল দ্যাখো, পাচকের মনে এই ভাব ছিল যে, লাঙ্গলের ফলা যতটা তীক্ষè, পুবের কৃষকের মস্তিষ্কের ধার কখনও তত তীক্ষè হবে না। একদিন তারা লাঙ্গল আর ফসলের স্বত্বাধিকার পেলেও প্রকৃত মালিকানা প্রতিষ্ঠা করার দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না। অথবা করলেও ধরে রাখতে পারবে না। এ বিষয়ে তাদের প্রত্যয় দৃঢ় ছিল বলেই চতুর পাচক অমন খাবার পরিবেশন করেছিল।’

তখনও সীমানা নির্ধারণ না হলেও পুবের জমিতে আবাদি ফলনের রমরমা বলে লাঙ্গল চড়ে বারো মাস। সেই সঙ্গে কৃষকের উত্থিত অঙ্গের উর্বর তরল গড়ায়, ছড়ায় জনপদে। কিলবিল করে বাড়ে তাদের বীজ, সবুজ ঘাস, গুল্ম লতার আড়ালে।

‘কী সবুজ! কী সবুজ মাঠ, ঘাট ভাসা জল, জলবতী নারী! শুধু ফসল আর ফসল! পাটই তো হরেক প্রকার। এ মুলুকে মাঠভরা পাট আর ও মুলুকে ফ্যাক্টরির সাইরেন। তামাম দুনিয়া বদলে গেল সে আওয়াজে। শুধু এ মুলুকে কারও কান অবধি পৌঁছাল না।’

ম্লান মুখে কথা শেষ করেন বয়স্করা। খসখসে সন্দেহ দূর করতে এ ওকে জিজ্ঞেস করেন সাইরেনের আওয়াজ শুনেছে কি না। না সূচক মাথা নাড়েন একযোগে সবাই এবং বলেনÑসাইরেন নয়, তারা শুনেছেন আজানের ধ্বনি। সেই ধ্বনির তীব্রতা কৃষকের লাঙ্গলের ফলা ভেদ করে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মেশে তাদের উত্থিত অঙ্গের সমবেত তরলের সঙ্গে। সমুদ্রের জলে ছায়া ফেলে মায়াবী মসি। দেহাতীত কালের এক গায়েবি আওয়াজ ‘আলহামদুলিল্লাহ্’। বঙ্গোপসাগর, আরব সাগর, ভূমধ্যসাগর সর্বত্র এই আওয়াজে মাতোয়ারা বঙ্গ সন্তান। তারা সমবেত হয় প্রার্থনালয়ে, মাঠে-ময়দানে, তাঁবুর তলায়, অন্তঃপুরে বেগমালয়ে। নিশ্ছিদ্র চাদরে ঢেকে দেয় অন্তঃপুর। গভীর গাঢ় মসি, অমাবস্যা রাতের মতো ভারী আর গম্ভীর। ক্রমে তাদের মহোৎসব জমে ওঠে। অফিস, পাড়া, বিদ্যাপীঠ, হাসপাতাল, শপিংমল সর্বত্র মসিমাখা অন্তঃপুর। সীমানায় বাঁধা ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলে সাফল্যমাখা গাঢ় গভীর সমবেত আওয়াজÑ‘আলহামদুলিল্লাহ্’।

সুপারসনিক গতিতে এই আওয়াজ এবং অন্দরে বাহিরে ছড়িয়ে পড়া অন্তঃপুর কখন যে গেঁথে গেছে সমবেত মন ও মগজেÑসেই সূক্ষ্ম ঘটনাটি কেউই সেভাবে টের পায়নি।

 সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button