আর্কাইভগল্প

গল্প : ওদিকে কিছু আছে ? : বিনোদ ঘোষাল

ড্রাইভার দিলবর আমাকে ভাঙ্গা হিন্দিতে বলল, এবার ঠান্ডা এখনও তেমন পড়ল না।

আমি বললাম, হুঁ।

গত কয়েক বছর ধরেই ঠান্ডা কমে আসছে স্যর। শিলং আর আগের মতো নাই।

আমি আবারও বললাম, হুঁ।

আমার আজ কথা বলতে ভালো লাগছে না। কারণটা…বলছি। আমি এমনিতেও কোনও কালেই খুব বেশি কথা বলতে ভালোবাসি না। আমাকে তাই মাঝেমাঝে শ্রী বলত ‘আমার মনে হয় আমি একটা মরা মানুষের সঙ্গে থাকি। মরা মানুষ!’

আমি আবার…আবার পিছন ফিরছি! আজকেও আবার! শুয়ারের বাচ্চা! নিজেকে বিড়বিড় করে গালাগাল দিলাম আমি। তারপর রাস্তার দিকে তাকালাম। দিলবর জানে না, আমার অনেক বছর শীত করে না। মানে জাস্ট করে না, আমার শুধু গরম করে, সারা বছর ধরে আমার মনে হয় আমাকে কেউ একটা ফার্নেসের ভেতর বসিয়ে রেখেছে। আমি ঘামতে থাকি। শুধু ঘামতে থাকি।

দিলবর আপন মনে বকে চলেছে। গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে বলছে ও। ট্যাক্সির পিছনে বসে আমি ওর মুখের নিঃশ্বাস থেকে মদের গন্ধ পাচ্ছি। দেশি মদের কড়া গন্ধ। কাল রাতে আমিও খেয়েছি। চারটে লার্জ। বোতলটা দিলবরই কিনে এনে দিয়েছিল। গতকাল 

ওহ, আমি নিজের সম্পর্কে এখনও কিছুই বলিনি তাই না ? সরি! আমি গৌরব। গৌরব বিশ্বাস। বয়স চুয়াল্লিশ। থাকি টালিগঞ্জের গলফ ক্লাব রোডে। এক কামরার ছোট ফ্ল্যাট। আগে থাকতাম নেতাজিনগরে। ছেড়ে দিয়েছি প্রায় বছর ছয়েক হলো। আসলে শ্রী আর বাবাই চলে যাওয়ার পরে আমার আর দুই কামরার ফ্ল্যাট দরকার ছিল না। কী হবে ? একটা মানুষের দুটো বেডরুমের কোনও প্রয়োজন নেই। তাই ওখানের ফ্ল্যাটটা ছেড়ে দিয়ে এখানে কিনলাম। আমার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে ক্রিশ্চান কবরস্থানের ভেতরটা দেখা যায়। আমার একটা অদ্ভুত স্বভাব রয়েছে জানেন। যদি কখনও দেখি কোনও কফিনে ঢাকা বডি এসেছে, আমি দৌড়ে চলে আসি ওই সিমেট্রিতে। এবং ওই শবযাত্রীদের সঙ্গে মিশে যাই। কফিনঢাকা মৃতদেহটিকে মাটিচাপা দেওয়া পর্যন্ত সবটা গোগ্রাসে চোখ দিয়ে গিলি। তারপর সকলে চলে যাওয়ার পরেও আমি বেশ কিছুক্ষণ একা বসে থাকি ওই সদ্য কবরটির সামনে। মোমবাতির শিখাটুকু শেষ অবধি জ্বলে থাকা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করি, অপেক্ষা করি। এবং তারপর খুব ব্যস্তভাবে ফিরে আসি আমার এক কামরার ফ্ল্যাটে। এই কবরস্থানের পাহারাদার আমাকে চেনে। প্রথম দিকে সে আমার এমন আচরণে আমার মতোই অবাক হতো, এখন সে বা আমি কেউই এমনটা করি বলে অবাক হই না। জগতে কোনও কিছু নিয়েই বেশিদিন অবাক হওয়া যায় না। যেমন এখন কলকাতা শহরে আর আগের মতো শীত পড়ে না বলে আমরা আর কেউ অবাক হই না। প্রথম প্রথম হতাম।

ও হ্যাঁ, আমি কিন্তু একটা কাজ করি। চাকরি নয়। ফ্রিল্যান্স। আমি একজন প্রচ্ছদ শিল্পী। বাংলা নয়, মূলত ইংরেজিসহ নানা বিদেশি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকি। মানে ইচ্ছে যখন হয় তখন আঁকি, হাতে কিছু টাকা এসে গেলে আর আঁকি না। শ্রী বলত, যখন একজন শিল্পীর ভেতরে শয়তানের আত্মা ভর করে তখন একজন গৌরব বিশ্বাসের জন্ম হয়। হা হা হা সো সুইট না!

আমি কি একটু আগে আপনাদের বললাম যে আমি শিলংয়ে এসেছি ? নাকি আপনারা দিলবরের কাছে শুনলেন ? আমার ঠিক মনে পড়ছে না। যা হোক তাহলে আমি বলি, আমি এসেছি শিলংয়ে। ঠিক বেড়াতে নয়, আবার বেড়াতেও বটে। কাজে নয়, বা বলতে পারেন একটা কাজে। কনফিউজড হচ্ছেন তো ? ভাবছেন লোকটা ফুল পাগলা তারপর ড্যাস ড্যাস হা হা হা!

আরে আমাকে নিশ্চিন্তে খিস্তি দিতে পারেন। আমি নিজেই নিজেকে উঠতে বসতে খিস্তোই। আরাম লাগে। খিস্তি দেওয়া এবং খাওয়ার মধ্যে একটা সিডেটিভ থাকে। কখনও খেয়াল করেছেন সেটা ?

গাড়িটা পাহাড়ের পথ দিয়ে চলেছে। নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহ চলছে। কিন্তু গাড়ির কাচ নামিয়ে সকাল সাড়ে নটার সময়ে দিলবরের মারুতি এইট হানড্রেড মডেল হলুদ-কালো পুরনো ট্যাক্সিতে চড়ে আমি শিলং থেকে যাচ্ছি চেরাপুঞ্জিতে। শিলং এ আমার এই নিয়ে দ্বিতীয়বার আসা। প্রথমবার এসেছিলাম, তখন আমি আর্ট কলেজের সেকেন্ড ইয়ার, কমার্শিয়াল ডিপার্টমেন্ট। কলেজের বন্ধুরা মিলে এসেছিলাম। শ্রীও এসেছিল। ও অবশ্য পেইন্টিইং-এর ছিল না, ক্রাফটের ছিল। তবু এসেছিল। তিনদিন ছিলাম আমরা শিলংয়ে। চেরাপুঞ্জিতে গেছিলাম। আমি শিওর নই, তবে ঝাপসা যেটুকু মনে পড়ছে ওই চেরাপুঞ্জিতেই শ্রী প্রথমবার আমার হাত ধরেছিল। বৃষ্টি…হুঁ বৃষ্টি পড়ছিল…কারণ শ্রী একটা আকাশি রঙের ফোল্ডিং ছাতা খুলে বলেছিল ভিজিস না, এই প্যাংলা শরীর। ভিজলে ঠান্ডা লেগে স্রেফ মরে যাবি। ছাতায় আয়। আমার মনে পড়ছে ওই আসমানি রঙের ছাতাটার গায়ে অসংখ্য রঙিন প্রজাপতির প্রিন্ট ছিল। শ্রীর সঙ্গে একই ছাতার নিচে আধে শুখে আধে ভিজে থাকতে থাকতে আমি বারবার ওপরের দিকে তাকাচ্ছিলাম আর আমার মনে হচ্ছিল, আকাশটা বুঝি লক্ষ লক্ষ প্রজাপতিতে ভরে গেছে!

দিলবর।

বলুন স্যর।

চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি পাব ?

বলতে পারব না স্যর। কোনও গ্যারান্টি নেই। সবই কপাল। তবে বৃষ্টি আর আগের মতো নাই। আর হয় না।

শিলংয়ে এখন খুব ট্রাফিক জ্যাম হয় দেখছি। আগে যেবার এসেছিলাম তখন এমন ছিল না। পুলিশ বাজারের কাছটা অবিকল ধর্মতলার মোড়ের মতো। আগে যেবার…ধুউউউউর আগে যেবার আগে আগে আগে…আমি শালা এই আগের হাত থেকে আর মুক্তি পেলাম না। একটা চলতি ফিরতি টাটকা জ্যান্ত মানুষ শুধু বরফ চাপা স্মৃতির ভেতর ঘুরে ফিরে বাঁচতে পারে ? বলুন ? পারে ? পারে না। আমিও আর পারছি না।…ওহ জানেন তো আমার কিন্তু রোজগার বেশি নয়। ভাববেন না ইংরেজি বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকি, দক্ষিণ কলকাতায় ফ্ল্যাটে থাকি, মানে মালকড়ি বেশ ভালোই রয়েছে। নেই, নেই। এককালে অবশ্য মোটামুটি কামাতাম। তারপর…তারপর আর ভালো লাগে না। যখন হাত একেবারে খালি হয়ে যায় তখন কয়েকটা কাজ ধরি, কিছু টাকা এসে যায়, ব্যস আবার…আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট রয়েছে দুটো। কিন্তু টাকা নেই। যেটুকু ছিল এবারে সেইটুকুও চেছেপুছে নিয়ে চলে এসেছি। কী হবে ব্যাঙ্কে টাকা রেখে ?

গাড়িতে শিলং থেকে চেরাপুঞ্জি যেতে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগে। অসামান্য রাস্তা। রাস্তার চেরিগাছগুলোয় থোকা থোকা চেরি ফুল ফুটে রয়েছে। আমার হঠাৎ মনে পড়ল চেরি ব্লসম ফেস্টিভ্যালের কথা। জিজ্ঞাসা করলাম, দিলবর, তোমাদের চেরি ব্লসম ফেস্টিভাল কবে হবে এই বছর ?

দিলবর বলল, এই গত সপ্তাহেই হয়ে গেল।

ওহ হয়ে গেল!

আমি কি হতাশ হলাম ? উঁহু মোটেই না। এই বিশ্বজগতে প্রতি মুহূর্তে অনেক উৎসব হয়ে চলেছে আমি তার কছুই দেখতে পাচ্ছি না। তাতে কী ? আমি একটি উৎসব দেখি। আমার ফ্ল্যাটের জানলা দিয়ে ওই ক্রিচান সিমেট্রিতে মৃত্যুর নিঃশব্দ উৎসব দেখা। আচ্ছা আপনার মনে হয় না জগতের প্রতিটি শবযাত্রা বড় সুন্দর, পবিত্র ? হয় না মনে ? হা হা হা হা হা আমাকে মাইরি পাগল ভাবছেন তাই না ?

এইইই দাঁড়াও দাঁড়াও দিলবর।

গাড়িটা থামাল দিলবর। আমি গাড়ি থেকে নামলাম। ঝকঝকে আকাশ। নরম রোদ। দূরের পাহাড়গুলোও স্পষ্ট। রাস্তার ধারে কত রকমের যে নামহীন ফুল ফুটে রয়েছে! ভারি সুন্দর! আমি এই দৃশ্যটা একটু বেশি সময় ধরে উপভোগ করতে চাইলাম। দুই হাত ছড়িয়ে আমি সজোরে শ্বাস নিলাম। হাল্কা আর ঠান্ডা নিশ্বাস আমার ভেতরে ঢুকল। তৃপ্তি পাবার সঙ্গে সঙ্গে আমার ভেতর থেকে কে যেন বলে উঠল গৌরব ভেবে দেখিস আরেকবার।

আমি মুচকি হাসলাম। নিজের বুড়ো আঙুলটা পাহাড়ের দিকে নাড়িয়ে মুচকি হেসে বলল নো হো ব্রো। যেন খুব জব্দ করলাম। আমি দেখলাম দিলবর আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আচ্ছা ওও কি আমাকে পাগল ভাবছে ? আই মিন ছিটিয়াল, সাইকো। ইউ নো দিলবর হু-র রিসেন্ট সমীক্ষা বলছে এই মুহূর্তে সভ্য পৃথিবীর প্রতি চারজন পিছু একজন মানুষ সাইকো। ইয়েস অ্যায়ম এ প্রাউড সাইকো হা হা হা!

দিলবরের দিকে আমি তাকাতেই ও বলল, আজ ওয়েদার খুব সুন্দর স্যর।

হুঁ। আমি সংক্ষেপে উত্তর দিলাম।

স্যর চলুন, নইলে সবকটা সাইট দেখাতে পারব না। আমরা এমনতেই দেরি করে ফেলেছি। বলল দিলবর।

ওর কথা শুনে আমি আচমকা ওই নিশব্দ রাস্তায় হা হা হা করে উন্মাদের মতো হেসে উঠলাম। ভালো বলেছো দিলবর। ঠিক বলেছো, আমি অলরেডি অনেক দেরি করে ফেলেছি। আরও আগে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত ছিল। বলে আমি গাড়িতে উঠলাম।

আপনি শুরু থেকেই ভাবছেন এই গৌরব বলে লোকটা নিশ্চয়ই বেশ ইন্টারেস্টিং একটা গল্প বলবে, সাইকোদের গল্প পড়তে বা শুনতে দিব্বি মজা লাগে তাই না ? কিন্তু এতক্ষণ পরে আপনি হয়তো ইতোমধ্যেই খুব বিরক্ত এবং বোর হয়ে আমার কথা শোনা বন্ধ করে দিয়েছেন অথবা এবারে বন্ধ করবেন। কারণ আমি কেন শিলংয়ে একা এসেছি, কোথায় যাচ্ছি, কোথায় রয়েছি। মানে আমার উদ্দেশ্যটা ঠিক কী সেটা এখনও আপনি ধরতে পারেননি, আমিও বলিনি। না না স্যর, ও ম্যাডাম শুনছেন এখনই চলে যাবেন না, আর একটু পরেই আমার গল্পের ক্লাইম্যাক্স, এতটা শুনলেন যখন প্লিজ বাকিটাও জেনে যান। আমি গ্যারান্টি দিচ্ছি, চমক আছে।

সোজা কয়েকটা ইনফো দিয়ে দিচ্ছি। আমি কলকাতা থেকে ফ্লাইটে গত পরশু রাতে এসেছি গুয়াহাটিতে। সেখানে একটা থ্রিস্টার হোটেলে ছিলাম। তারপর গতকাল চলে এসেছি শিলংয়ে। গুয়াহাটির হোটেল থেকেই আমি দিলবরকে পেয়ে গেছিলাম। বছর পঞ্চাশেক বয়স। শিলং আর গুয়াহাটি ওর রুট। আমাকে নিয়ে এল শিলং। পথেই ওর সঙ্গে আলাপ জমিয়ে ফেলেছিলাম। ওকে বলেছিলাম শিলংয়ের খুব ভালো একটা হোটেলে আমাকে রাখতে। যেখানে ভিড়, চিৎকার নেই। দিলবর আমাকে বাজেট জিজ্ঞাসা করেছিল। আমি উত্তর দিয়েছিলাম বাজেট কোনও ফ্যাক্টর নয়। আসলে আমি আমার সঞ্চিত সব টাকা নিয়ে চলে এসেছি, সেটা দিলবর কী করে জানবে ?

দিলবর আমাকে নিয়ে এসেছিল হেরিটেজ ক্লাব ত্রিপুরা ক্যসেলে। অসামান্য একটি হোটেল। রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত এক প্রসাদোপম হোটেল। যেমন তার রুম তেমনই প্রবেশ। দিনপ্রতি বারো হাজার টাকায় আমি একটি স্যুট বুক করে নিয়েছি। গতকাল দুপুরে আমি পৌঁছেছি। সারাদিন হোটেলেই ছিলাম। চারপাশটা ঘুরে দেখেছি। আজ আমার চেরাপুঞ্জি যাওয়ার প্ল্যান ছিল। সকাল আটটায় দিলবর আসবে বলেছিল। কিন্তু আমার বেরোতে প্রায় সাড়ে দশটা বেজে গেল। আসলে আমার আর কোনও তাড়া নেই জীবনে। যাক গে বাকিটা পরে কেমন ? আপাতত ইচ্ছে হলে ক্লাইম্যাক্সের জন্য আমার সঙ্গে থাকতে পারেন।

দিলবর।

জি স্যর।

চেরাপুঞ্জির ওয়াটার ফলসগুলো এখনও রয়েছে ?

আমার এমন প্রশ্নে ও হাসল। বলল, ওয়াটার ফলস সব আছে স্যর। কোথায় যাবে ?

জানো দিলবর প্রায় তেইশ বছর পর আমি আবার চেরাপুঞ্জি যাচ্ছি। আর কতদূর ?

আরও ঘণ্টা খানেক লাগবে স্যর।

রাস্তা ফাঁকা এবং খুব সুন্দর। প্রতিটি পাহাড় উজ্জ্বল ও স্পষ্ট। আচ্ছা দিলবর চেরাপুঞ্জিতে কি এখনও একটু বাদে বাদেই বৃষ্টি হয় ?

না স্যর। ওয়েদার বদলে গেছে।

হুঁ। আচ্ছা…আমি কিছুক্ষণ চুপ রইলাম। আমার মনে পড়ল আমি আর শ্রী সেবার চেরাপুঞ্জিতে প্রথমবার জীবনে ফলস দেখেছিলাম। আহা সেই গম্ভীর শব্দের সামনে সেই অলৌকিক জলের সামনে আমরা দুজন বিহ্বল ছিলাম দীর্ঘক্ষণ। কিন্তু কোন ফলস ছিল সেটা মনে পড়ছে না আর।

আচ্ছা দিলবর চেরাপুঞ্জিতে সব থেকে ভালো ফলস কোনটা ?

এটা বলা কঠিন স্যর। এক একটা এক এক রকম। সবকটাই ভালো।

না তুমি আমাকে সব থেকে ভালোটায় নিয়ে চলো। ওটাই দেখব।

আপনার সব থেকে ভালো কোনটা লাগবে কী করে বলব স্যর ?

বেশ তোমার কোনটা সব থেকে বেশি ভালো লাগে ?

আমার ?…একটু চুপ করে ভাবল দিলবর। তারপর জিজ্ঞাসা করল, স্যর আপনি নোহকালিকাই ফলস দেখেছেন ?

নাম মনে নেই ভাই। কোথায় সেটা ?

একেবারে শেষে। ওটার একটা গল্প রয়েছে স্যর। খাসিদের পুরনো গল্প।

বাহ কী গল্প শুনি।

দিলবর বলল, অনেক দিন আগে লিকাই নামের এক যুবতী মেয়ে তার স্বামীর দ্বারা প্রতারিত হয়ে নিজের একমাত্র সন্তানকে হারিয়ে উন্মাদিনী হয়ে ওই প্রপাতে ঝাঁপ দেয়। তার দেহ হারিয়ে যায় সেই বিশাল জলরাশির মধ্যে। সেই থেকে লিকাইয়ের নামে ওই ফলসের নাম হয়েছে নোহকালিকাই ফলস। আপনি যদি খুব মন দিয়ে ওই প্রপাতের জল পড়ার শব্দ শোনেন স্যর, সত্যিই মনে হবে মেয়েলি গলায় কেউ একজন অঝোরে কাঁদছে।

আমি সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। ওকে বললাম দিলবর আমাকে ওখানেই নিয়ে চলো।

কিন্তু তার আগে আরও কয়েকটা ফসল রয়েছে স্যর।

কিছু দরকার নেই। ওখানেই চলো।

আচ্ছা স্যর।

ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছে গেলাম। একটি পাহাড়ের চূড়া। চারদিকে প্রশস্ত জায়গা। অনেকগুলি গাড়ি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সবই টুরিস্টদের। গাড়ি পার্ক করাল দিলবর। আমাকে বলল দেখে নিন স্যর।

তুমিও এসো।

আমার দেখা আছে স্যর।

তার জন্য বলছি না। অন্য দরকার আছে। আমার একটা ছবি তুলে দিতে হবে। বলে মুচকি হাসলাম। ও কি বুঝতে পারল আমি কীসের ছবি বলছি ? দিলবর এল। একটা মস্ত গেট। পাশে পাহাড়ের ধার ঘেষে রেলিং। সেখানে অনেক পর্যটক ঝুঁকে দেখছে। আর বহু দূর থেকে গুরুগম্ভীর শব্দ হচ্ছে, জলের। আমি এগিয়ে গেলাম। ঝুঁকলাম রেলিং থেকে। অনেক দূর থেকে বিশাল বিশাল চওড়া নোহকালিকাই প্রপাত। দীর্ঘযুগ পরে আমার দুই চোখ যেন সহসা জুড়িয়ে গেল। আমি আর নোহকালিকাই মুখোমুখি। চারদিকে পাহাড়ের ঘেরা আর মাঝে বিস্তীর্ণ জায়গা জুড়ে শূন্যতা। সেই শূন্যতায় যেন আকাশ থেকে আছড়ে পড়ছে এই বিপুল অনন্ত জলরাশি। কিছুক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে দেখতে দেখতে সম্মোহিত হয়ে যেতে হয়। হ্যাঁ এই সেই জায়গা যা আমি খুঁজছিলাম! 

স্যর…

উঁ…ওহ তোমাকে ডেকেছিলাম…থাক তুমি গাড়িতে গিয়েই বোসো…। আর শোনো…আমি হিপ পকেট থেকে ওয়ালেট বার করলাম। ওর হাতে একটা দুই হাজার টাকার নোট বার করে এগিয়ে দিয়ে বললাম, আজকের ভাড়টা রাখো।

স্যর পরে দেবেন।

না না রেখে দাও।

দিলবর টাকা হাতে নিয়ে আমার একদিকে একবার তাকাল। তারপর বলল একটু তাড়াতাড়ি ফিরবেন স্যর। আরও কয়েকটা সাইট রয়েছে।

বেশ।

সামনে বড় গেটটার দুই ধারে এবং ভেতরেও বেশ কিছু সার সার গুমটি দোকান। খাসিরা দারুচিনি, তেজপাতা ইত্যাদি বিক্রি করছে। আমি এমনিই ওই গেটের ভেতর দিয়ে ঢুকলাম। তখনই একটি পরিবারকে ওই দিক থেকে আমার মুখোমুখি আসতে দেখলাম। মধ্যপঞ্চাশ এক ভদ্রলোক, তার স্থুলাঙ্গি স্ত্রী, এবং দুটি ছেলে মেয়ে। প্রত্যেকের মুখেই যথেষ্ট বিরক্তি। ওর স্ত্রী খুব গজগজ করছেন। বললাম যেও না, কোনওদিন আমার কথা শুনলে না…

আমি ভদ্রলোকের মুখের দিকে তাকালাম। জিজ্ঞাসা করলাম ওদিকে কিছু আছে ?

ওদিকে কিছু নেই।

মানে ?

আরে মশাই কিছুই নেই। স্রেফ ফাঁকা… ফালতু গেলাম। সময় নষ্ট। যাবেন না যাবেন না। বলতে বলতে  চোখমুখে একরাশ ক্ষোভ আর হতাশা মেখে ভদ্রলোক ও তার পরিবার এগিয়ে গেলেন।

আর আমি এমনিই নিছক কৌতূহলে ওই কিছু নেই দিকটার দিকে এগিয়ে গেলাম।

এক পা, দুই পা, দশ পা, কুড়ি পা…পঞ্চাশ পা…একশো কিংবা দুশো পা কখন পেরিয়ে গেলাম আমার খেয়াল থাকল না। আমার আজকাল এমন মাঝেমাঝেই হয়। পুরো জগৎসংসার থেকে আউট হয়ে যাই। সহসাই আবিষ্কার করলাম আমি এমন একটা জায়গায় এসে পৌছেছি যার ত্রিসীমানায় কোনও মানুষ তো ছাড় একটা গাছও নেই, শুধু শুকনো ঘাস জমি, যতদূর চোখ যায়, শুধুই ফাঁকা আর ফাঁকা। দিগন্তের পর দিগন্ত অনন্তের পর অনন্ত শুধুই ফাঁকা চারদিক। আমি আমার চল্লিশ বছরের জীবনে এমন সমতল ফাঁকা আর নিঃশব্দ জমি কোনওদিন দেখিনি। এখানে কোলাহল তো দূরের কথা, শুধুই একটা পাখির ডানা মেলার শব্দও নেই। নোহকালিকাইয়ের বিপুল শব্দও এখানে চুপ।

বিশ্বাস করুন, আমি বাপের জন্মে এমন কান ফাটানো নৈঃশব্দ্য টের পাইনি। মনে হচ্ছে আমার কানের পর্দাদুটো আচমকা কেউ নষ্ট করে দিয়েছে, অথবা আমি জন্মবধির কিংবা এমন একটা স্বপ্ন দেখছি যা নির্বাক!

এই…এইই সেই জায়গা যা আমি খুঁজছিলাম। হ্যাঁ এবার ক্লাইম্যাক্স। আমি হাঁটতে থাকলাম। আচমকা টের পেলাম আমার ছায়ার পাশে  আরেকটি ছোট ছায়া আমার সঙ্গেই হাঁটছে।

তুই আবার এসেছিস! আমি মুখ না তুলে ওই ছায়ার দিকেই চোখ রেখে বিরক্ত হয়ে বললাম!

হ্যাঁ আজ তো আমাকে থাকতেই হবে। উত্তর দিল সেই ছায়া।

আপনারা ভাবছেন এই অসম্ভব নির্জনতায় আচমকা একটি বাচ্চা ছায়ার উদ্ভব হলো কী করে ? অ্যাকচুয়ালি হি ইজ মাই পাস্ট, মাই চাইল্ডহুড। ব্যস অমনি আবার আপনি ভেবে নিলেন আমি আবার পাগলামো করতে শুরু করেছি, তাই তো ? দেখুন আগেও বলেছি আমি একজন গর্বিত মানসিক রোগী। এক সময় নিয়মিত ওষুধ খেতে হয়েছে। বছরের পর বছর। কিন্তু যেদিন আমি সিদ্ধান্তটা নিলাম, মানে আজ যেটার ক্লাইম্যাক্স সেদিন থেকে সব ওষুধ সরিয়ে দিয়েছি। নো মোর ওষুধ। আচ্ছা আমি মানুষটা তো এখনও বেঁচে রয়েছি, তাহলে আমার ছেলেবেলাও বেঁচে রয়েছে। সে পিছিয়ে যায় বাট মরে তো যায় না। আমার শৈশব আমাকে ফেলে যায়নি। সে থেকে গেছে।

ছায়াটি আবার বলে উঠল, আচ্ছা তোমার মনে রয়েছে সেই তুমি যেবার ক্লাস এইটে ফেল করলে…ক্লাসের একমাত্র ফেলটু ছেলে…সকলে তোমাকে নিয়ে খুব হাসাহাসি করেছিল…মনে আছে তোমার ? পাড়ার বন্ধুরা তোমার সঙ্গে মেলামেশা বন্ধ করে দিয়েছিল। মনে আছে ?

আমি এই কথাগুলো এতবার এর কাছ থেকে নিয়মিত শুনি যে আর উত্তর দিই না। আমি হাঁটতে থাকলাম। আচমকা থমকে গেলাম। আবার তাকালাম চারদিকে। মাইরি বিশ্বাস করুন এই মস্ত ফাঁকা জমিটাকে দেখে আচমকা আমার মনে হলো এই পৃথিবীটার সব জায়গায় গাছ-পালা, নদী, পাহাড়, পাখি না থাকলেও সুন্দর! সত্যি সুন্দর।

আর তখনই টের পেলাম আমার পাশে আরও একটি ছায়া এসে হাজির হয়েছে। হ্যাঁ এও আসে, আমার কাছে। এর উচ্চতা আমার বুক পর্যন্ত। সে বলল, বাই দ্য ওয়ে, পাড়ার এবং স্কুলের প্রতিটা স্পোর্টসে তুমি ছিলে সব থেকে অপদার্থ। তোমাকে সেই জন্য কোনও খেলায় নেওয়া হতো না, কোনও কালচারাল অ্যাকটিভিটিজেও তুমি যোগ দিতে ভয় পেতে, মনে আছে ?

আমি এবারও এই কথার উত্তর দিলাম না। এরা অবশ্য আমার উত্তরের প্রত্যাশাও করে না, শুধু ক্রমাগত বলে যায়, শুধু বলে যায়।

এমনকি ছবি আঁকতে ভালোবাসতে বলে তোমাকে তোমার বাবা-মা অনেক আঁকার কম্পিটিশনে পাঠাতেন, সেখান থেকেও কখনও কোনও প্রাইজ আনতে পারোনি। ডু ইউ রিমেম্বার ? তারপর কোনওমতে এইচ এস পাস করলে। ভর্তি হলে আর্ট স্কুলে। সেখানেও পিছিয়ে থাকা। তোমার কোনও বন্ধু ছিল না, তুমি মিশতে পারতে না, স্যরেরাও তোমার ছবি পছন্দ করতেন না, অ্যানুয়াল এক্সিবিশনে ছবি সিলেক্ট হতো না তোমার।

আমি এই পর্যন্ত শুনে আবার থামলাম। আবারও দেখলাম চোখ ঘুরিয়ে। আমি এই প্রথম এত বড় শূন্যতাকে নিজের চোখে দেখছি…। শনশন করে শুধু হাওয়া দিচ্ছে। আমি কোন দিক দিয়ে এতটা রাস্তা চলে এসেছি জানি না, কিন্তু মনে হচ্ছে এই আকাশটা যে সত্যিই এতখানি বড় তা এখানে না এলে আমি কোনওদিন বুঝতে পারতাম না।

যাওবা দয়া করে শ্রীতমা মানে শ্রী তোমার প্রেমে পড়ল, বিয়ে করল তোমাকে, তুমি ওকেও রাখতে পারলে না। এবার দশ বছর আগের গৌরব বিশ্বাস আমার মুখের সামনে এসে দাঁড়াল। তার গালে বিজিবিজি দাড়ি, রোগা চেহারা, ব্যাকব্রাশ করা ঘাড় ছাপানো চুল, গায়ে খয়েরি রঙের খদ্দরের পাঞ্জাবি আর জিন্স। কাঁধে ক্যাম্বিসের ব্যাগ। তার ভেতরের রয়েছে, ছবি আঁকার সকল সরঞ্জাম। আর এই গৌরব বিশ্বাসের চোখে তখনও কালির ছাপ পড়েনি, চোখের মণিদুটো মরা মাছের মতো হয়ে ওঠেনি।

একটা সংসার পর্যন্ত ঠিক করে করতে পারলে না তুমি। শ্রী যে নতুন করে প্রেমে পড়েছে ঋতমের তা তুমি বোঝনি বলছো ?

আমি এতকাল একে বলে এসেছি না বুঝিনি, আজ প্রথমবার বলে দিলাম, হ্যাঁ বুঝেছি, শ্রী আমাকে আর ভালোবাসতে পারছিল না, কিন্তু আমি জানতাম শ্রী ভালোবাসা ছাড়া বাঁচবে না, তাই আমি চাইছিলাম ও আবার প্রেমে পড়ুক। ঋতমের সঙ্গে ওর সম্পর্ক হয়েছে তা আমাকে জানিয়েছিল আমার পুরনো বন্ধুরা। ওদের দুইজনকে নানা জায়গায় নানাভাবে দেখা গেছে, সেই খবর দিয়ে ওরা আমাকে সাবধান করার চেষ্টা করত বাট আমি মনে মনে খুশি হয়ে উঠতাম। ভালো লাগত, মনে হতো শ্রী বেঁচে গেল।

আমার সামনের গৌরব হেসে উঠল, তারপর বলল ছিঃ ছি ছি ছি তুমি শুধু হেরো কাপুরুষই নয়, একটা নপুংসক। নিজের বউকে অন্য ছেলের সঙ্গে প্রেম করতে দেখে যে কোনও স্বামী খুশি হয় তা এই প্রথম শুনলাম। তা বাবাই তোমারই ছেলে তো ? নাকি সেটাও অন্য কারও।

আমি সোজা তাকালাম আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা গৌরবের দিকে। কিছু বলতাম হয়তো কিন্তু দেখলাম ওর ঘাড়ের পিছন থেকে আমি বেশ খানিকটা দূরে এই নিঃসঙ্গ ভূমির শেষ দেখতে পাচ্ছি। আমার ওখানে যেতে ইচ্ছে হলো। আমি শুধু বললাম হ্যাঁ, বাবাই আমারই ছেলে। আর যদি আমার ঔরসজাত সন্তান নাও হতো, তাতেও কিছু এসে যেত না, বাবাই আমারই ছেলে।

আমার সামনের গৌরব পথ ছেড়ে দিয়ে বলল, তুই সত্যিই একটা অপদার্থ! জীবনে কিস্যু করতে পারলি না।

আমি থমকে গেলাম। কিছু একটা বলতে গেলাম, বললাম না। হাঁটতে থাকলাম। এসে পৌছলাম খাদের ধারে। নিচটা দেখে একবার মনে হলো আমি মহাকাশ থেকে পৃথিবীর দিকে দেখছি, এতই দূরত্ব। কী গভীর!

জীবনে একটা সিদ্ধান্ত তুমি ঠিক নিয়েছো। বলল আমার ছোট ছায়াটি।

আর আমার অন্য ছায়াটিও সায় দিল সেই কথায়। আরেকজনও। 

হ্যাঁ ওরা জানে, আমি চেরাপুঞ্জিতে কেন এসেছি। নিজেকে বরাবরের মতো থামিয়ে দেওয়ার জন্য। কারণ আমার মনে হয়েছে বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত কারণ আমার আর নেই। হ্যাঁ, আপনি এই কথা শুনে হয়তো হাঁ হাঁ করে উঠলেন, আমাকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন আত্মহত্যা মহাপাপ। আমি ওষুধগুলো খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি বলেই আমার এমন হঠকারী সিদ্ধান্ত ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার আবার উচিত কাউন্সেলিং করানো। কিন্তু একটা কথা বলুন, আপনারা যারা আমার সঙ্গে এতক্ষণ রয়েছেন তাদের মধ্যে অনেকেই কি বেঁচে থেকেও প্রতি মুহূর্তে সুইসাইড করছেন না ? বলুন ? নিঃশ্বাস নেওয়াটাই কি একমাত্র বেঁচে থাকা ? ওই যে দেখুন আমার অতীতের গৌরবেরা কেমন খুশিখুশি মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। আজ ওরা সত্যিই খুশি, কারণ আমার সঙ্গে ওদের কলঙ্কময় ব্যর্থ অধ্যায়ও শেষ হবে যে।

এখন আপনার মনে শেষ প্রশ্ন আসতেই পারে মরার জন্য এত কষ্ট করে আমি এত দূরে কেন এলাম ? যে ঘরটায় আমি থাকি সেখানেও তো মরতে পারতাম ?

এর দুটো উত্তর হতে পারে। এক, আমি চাইনি যে আমার মৃত শরীরটা আমার পরিচিতরা কেউ দেখুক, মানে মরে যাওয়ার পরেও আমাকে দেখে যেন কেউ হেরো না ভাবে, মৃত-র থেকে নিরুদ্দেশ হওয়ার মধ্যে একটা সম্মান রয়েছে, আমি এই অন্তিম সুযোগের মোহ কাটাতে পারিনি, আর দুই…আমি যখন এই সিদ্ধান্তটা নিলাম তখন আচমকা আমার মনে পড়েছিল আমি আর শ্রী…একটা প্রজাপতি ছাতা। ছাতার চারধারে বৃষ্টি, কুয়াশা…ব্যস এইটুকু…স্রেফ এইটুকুই…

ছোট ছায়াটি বলল, আর দেরী কেন ? ফালতু ছেলে একটা, সবেতেই লেট। নাও এবার অন্তত আমাদের মুক্তি দাও। কিচ্ছু দাওনি আমাকে। কিচ্ছু না। পড়াশোনা, খেলাধুলো, কিচ্ছু না…

আমি তাকালাম আমার ছোটটির দিকে। আর কয়েকটা দৃশ্য আমার চোখে ছায়াছবির মতো ভেসে উঠল, প্রায় ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে মফস্সলের একটি পুরনো বাড়ির ছাদ, একটি হাফপ্যান্ট ছেলে মাথা উঁচু করে হাঁ হয়ে দেখছে ঘন কালো আকাশের মধ্যে লক্ষ লক্ষ জোনাকির মতো জ্বলতে থাকা নক্ষত্ররাজিকে। সেই প্রথমবার তার ইচ্ছে হলো এই মুহূর্তটাকে সাদা কাগজে রঙ দিয়ে ধরে রাখতে…তারপর আরেকদিন পাড়ার মস্ত পুকুরে বর্ষার বিকেলে একা চুপ করে বসে জলের ওপর বৃষ্টির সহস্র ফোঁটা আর মাছেদের ভেসে থাকা দেখে তার আচমকা প্রথমবার মনে হয় বৃষ্টির থেকে সুন্দর আর কিছু নেই!

এই দুটো ছবি…হ্যাঁ আমার জীবনে প্রথম আঁকা ছিল সেই দুটো ছবি। আমি ঠিক করেছিলাম আমি ছবি আঁকব। এই কথা মনে পড়তে আমার মনটা অদ্ভুত রকমের হয়ে উঠল, দীর্ঘ দীর্ঘদিন পর…

আরে আজও ভ্যাবলার মতো দাঁড়িয়ে রইবে নাকি ? দেখছো তো সামনে অতল খাদ। এটাই তো চেয়েছিলে তুমি। নাও এবার অন্তত আমার মুখ পুড়িও না, পুরো স্কুলের জীবনটা, তোমার জন্য আমাকে একা একা কাটাতে হয়েছে। বলল অন্যজন। 

একা একা শব্দটা আমাকে এক লহমায় নিয়ে গেল একটা বসন্তের শেষ বিকেলে। তখন ক্লাস টেন কিংবা ইলেভেন। বাড়ির পিছনে বেশ কিছুটা সাইকেল চালিয়ে যাওয়ার পর ধু ধু ধানক্ষেত। সন্ধে নেমে আসছে, আমি ফাঁকা ধানক্ষেতের মাঝখানে একা চুপচাপ বসে রয়েছি। দূরের গাছগুলোর আড়াল থেকে কোকিল ডাকছে, মিষ্টি হাওয়া আর এক অজানা আনন্দে আমি কাঁদছি,…আমার দুই চোখ আর মন ভরে উঠছে অশ্রুতে… সেই অশ্রুর প্রতিটি দানা কোহিনূরের চেয়েও দামী, নক্ষত্রের চেয়েও উজ্জ্বল…

সেই দাঁড়িয়ে রইলে! আজও ঝোলাবে নাকি ? না হতে পেরেছ আর্টিস্ট, না হতে পেরেছো একজন ভালো স্বামী, না পেরেছো ভালো বাবা হতে, তুমিও জানো শুধু শ্রী নয় বাবাইও তোমাকে বাবা বলে ডাকতে ঘৃণা বোধ করে…

আর্টিস্ট…শব্দটা আমাকে আবার ভাবিয়ে তুলল, হ্যাঁ সত্যিই আমাকে কেউ কখনও কোনও এক্সিবিশনে ছবি দিতে বলত না, কলেজ লাইফেও না, কলেজের পরেও না। আমার কোনও আর্টিস্টস গ্রুপ ছিল না, আমি মিশতে পারতাম না, আমার মুদ্রাদোষে আমি চিরকাল একা। কিন্তু আমার মনে পড়ল, একটা ছোট দৃশ্য, অনেক দিন আগে, তখন আমি কলেজে ফাইনাল ইয়ার, একটা শীতের দুপুরে আউটডোর করার জন্য গেছিলাম ধর্মতলার শহিদ মিনারের কাছে। ওখানে একটি মেয়ে, আমাকে তার ঘরে যাওয়ার কথা বলেছিল, খুব কম টাকা নেবে বলেছিল, আমি যাইনি, উলটে তার কাছে একটু সময় চেয়েছিলাম, তার একটি পোর্ট্রটে করতে চেয়েছিলাম, মেয়েটি আমাকে প্রথমে গালাগাল দিয়ে তারপর কী যেন ভেবে আমার থেকে একটু দূরে বসে পড়ে বলেছিল তাড়াতাড়ি করতে…

আমি দ্রুত হাতে সেই রুগ্ণ গরিব বেশ্যাটিকে স্কেচ করছিলাম। কাজটা করতে আমার ভালো লাগছিল। সবে আর্ধেক হয়েছে এমন সময়ে একটা ফিরিঙ্গে লোক এসে দাঁড়িয়েছিল আমার পাশে, আমার ছবিটাকে মন দিয়ে দেখতে শুরু করেছিল। আমি মেয়েটার চোখের মণিদুটো অস্থির আর ভীত হয়ে উঠতে দেখেছিলাম। কাজ থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনি কি চলে যাবেন ?

লোকটা মুখ থেকে খৈনির পিক ফেলে আমাকে বলেছিল, না না, আপনি তসবির বানিয়ে নিন, ভালো হচ্ছে, ও আমার মেয়ে। আমি না বললে ও কোথাও যাবে না।

ওই কথা শোনার পর আমি সেই মেয়েটির চোখে ওই পড়ন্ত বিকেলে যে অপরূপ আলো দেখেছিলাম তা বিশ্বাস করুন আর কোনওদিন কারও মুখে দেখিনি, আর স্কেচটা শেষ হয়ে যাওয়ার পর ওই সস্তার বেশ্যাটা যখন নিজের তসবিরকে বারবার ঘুরিয়ে দেখছিল আর ওর দালালকে সেটা দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করছিল কী সুন্দর হয়েছে বল! মাইরি বলছি আমার সেইদিন মনে হয়েছিল এই তো এই তো আমার শিল্পীজন্ম সার্থক…আর কী চাই! আর কীসের স্বীকৃতি ?

আর তোমার স্ত্রী-পুত্রের এই যে তোমাকে মাঝবয়েসে এইভাবে ছেড়ে চলে যাওয়া, তোমারই বন্ধুর সঙ্গে নতুন করে ঘর বাঁধা, এটাকে কীভাবে জাস্টিফাই করবে তুমি ? এবারের প্রশ্নটা এল আমার থেকে। হ্যাঁ এই চোখের তলায় কালি, মাথায় রুক্ষ চুল, রোগা রোগা কাঠি আঙুলওলা গৌরব বিশ্বাস নিজেকেই এই প্রশ্ন করল, আপনারাও শুনতে পেলেন নিশ্চয়ই এই প্রশ্নটা ?

আসলে দেখুন একটা সম্পর্ক শেষ হয়ে যাওয়া মানেই কি সেটা ব্যর্থতা ? জগতে লক্ষ লক্ষ মানুষ যে কত মৃত সম্পর্ক লাশের মতো বয়ে নিয়ে চলেছে সেটাকে ব্যর্থতা বলবেন না! আমি তো বলব এটা পারস্পরিক মুক্তি। যে সম্পর্ক আমি শ্রী একসঙ্গে দাম্পত্যের নাটক করে প্রতিদিন মেরে ফেলছিলাম এখন বরং দুইজনে নিজেদের সরিয়ে ফেলে সেই সম্পর্ককে আজীবনের জন্য বাঁচিয়ে দিয়েছি…

আমার আচমকাই ঘোর কাটল। এইসব কথা আমি কার সঙ্গে, কাদের সঙ্গে বলে চলেছি ? আপনারা যারা এতক্ষণ ধরে আমার প্রলাপ শুনছেন আপনারা কি কেউ দেখতে পেয়েছেন আমি কাদের সঙ্গে কথা বলছিলাম ? নাহ অনেক কথা হল, এবার বিদায়। আমি খাদের সামনে এসে দাঁড়ালাম। আর মাত্র এক ফুট দূরত্ব। শরীরটা জাস্ট ছেড়ে দেব। তারপর কিছু একটা ভাবতে ভাবতে ভাসতে ভাসতে…আমি আরও এক পা এগোলাম। কিন্তু ভয় নয়, মনের ভেতরটায় আজ এতকাল পর এত ভর্তি লাগছে… আমি আবার পিছন ফিরে এই অসীম শূন্য প্রান্তরকে, এই মস্ত আকাশকে আর এই নৈঃশব্দ্যকে দেখলাম, তার গন্ধ নিলাম, তাকে দুই হাতে ছুঁলাম আর আমার মনে হল আরেকটা অন্তত ছবি আঁকা দরকার। হোটেল ফেরার পথে পুলিশ বাজার থেকে কিনে নেব। আর …আর শিলং ফেরার পথে বাকি ফলস কটাও দেখে নেব।

আমি হন হন করে হাঁটতে থাকলাম ঐ নিঃসীম শূন্যতার মধ্য দিয়ে। আমার আশপাশে কোনও বাড়তি মানুষের উপস্থিতি টের পাচ্ছিলাম না। আমি হন হন করে হাঁটছি। আমি উত্তেজিত বোধ করছি, তীব্র উত্তেজিত!

ওই যে সেই গেটটা দেখা যাচ্ছে। গেটের ওই পাড়ে রয়েছে অনেক মানুষ, অনেক গাড়ি, দোকান, জলপ্রপাতের দৃশ্য।

গেটের ঠিক সামনেটায় আসতেই আচমকা আমার মুখোমুখি একটা লোক।

লোকটা আমার দিকে তাকাল, তারপর খুব নীচু গলায় পরম কুণ্ঠিতভাবে জিজ্ঞাসা করল, ওদিকে কিছু আছে ?

আমি লোকটার মুখের দিকে তাকালাম। চমকে উঠলাম। লালচে পাতলা চোখ, ভাঙা গাল, গালে বিজিবিজি দাড়ি, কোটরে ভরা চোখদুটো মর্গের মৃতদেহের চোখের মতো। উত্তর দিতে গিয়ে টের পেলাম আমার কেমন যেন শীতশীত করছে!

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button