অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : স্কুল শিক্ষিকার অতিথি : ইসাবেল আয়েন্দে

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

মূল : ইসাবেল আয়েন্দে

বাংলা অনুবাদ : উৎপল দাশগুপ্ত

[ইসাবেল আয়েন্দে (২ আগস্ট ১৯৪২) চিলিয়ান-আমেরিকান লেখিকা। জন্ম পেরুর লিমা শহরে। কিছুদিন চিলিতে সাংবাদিকতার কাজ করেন। চিলির রাষ্ট্রপতি সালভাদর আয়েন্দের হত্যার পরে ভেনেজুয়েলায় পালিয়ে আসতে বাধ্য হন। ওঁকে লাতিন আমেরিকার প্রথম সফল নারী ঔপন্যাসিক বলে মনে করা হয়। ওঁর প্রথম উপন্যাস দ্য হাউজ অফ স্পিরিটস। এর পরে অফ লাভ অ্যান্ড শ্যাডোজ, ইভা লুনা ইত্যাদি এবং একটি ছোটগল্প সংগ্রহ প্রকাশিত হয়। ওঁর লেখায় ম্যাজিক রিয়ালিজমের ছোঁয়া থাকে।]

ল শিক্ষিকা ইনেস দ্য পার্ল অফ দ্য ওরিয়েন্টে প্রবেশ করলেন; এ সময় লোকজন থাকে না; কাউন্টারের কাছে গিয়ে―যেখানে রিয়াদ হ্যালাবি উজ্জ্বল ফুলের নকশা করা কাপড়ের একটি থান গুটিয়ে রাখছিলেন―ঘোষণা করলেন যে উনি এই মাত্র ওঁর বোর্ডিং হাউসের একজন অতিথির মুণ্ডু কেটে ফেলেছেন। দোকানিটি ওঁর সাদা রঙের রুমালটি বের করে নিজের মুখে চেপে ধরলেন।

‘কী বললেন, ইনেস ?’

‘ঠিক যেটা আপনি শুনতে পেলেন, তুর্ক।’

‘মরে গেছে ?’

‘অবশ্যই।’

‘তা এখন কী করবেন বলে ভাবছেন ?’

‘সেটা জিজ্ঞেস করার জন্যই তো আপনার কাছে এসেছি,’ মাথার ওপর এসে পড়া একগুচ্ছ চুল সরাতে সরাতে ভদ্রমহিলা বললেন।

‘স্টোরটা বন্ধ করে নেওয়াই বোধহয় ঠিক হবে,’ রিয়াদ হ্যালাবি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন।

দুজনে দুজনকে এত বছর ধরে চেনেন যে ওঁদের কারও পক্ষেই সেটা কত বছর হিসাব করে বলা সম্ভব নয়, তবে এই বন্ধুত্বের সূত্রপাত কীভাবে হয়েছিল সেই ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ওঁদের দুজনের স্মৃতিতেই অমলিন। সেই সময় হ্যালাবি ছিলেন সেই সব ফেরিওয়ালাদের একজন, যাঁরা শহরের বিভিন্ন অলিতে গলিতে ঘুরে ঘুরে নিজের নিজের পশরা বিক্রি করতেন, যাঁদের না থাকত কোনও নির্দিষ্ট লক্ষ্য, না নির্দিষ্ট গন্তব্য। একটি জাল তুর্কি পাসপোর্ট সম্বল করে সহায়সম্বলহীন অবস্থায়, পরিশ্রান্ত মনে, আর ছায়াতে বসে একটু জিরিয়ে নেবার অবকাশ খুঁজতে খুঁজতে আরব দেশ থেকে এখানে ভেসে এলেন। তখনও ইনেস গতযৌবনা হননি, নিতম্বদেশ দৃঢ়, স্কন্ধদেশ উন্নত―শহরের একমাত্র স্কুল শিক্ষয়িত্রী এবং বারো বছরের একটি পুত্রসন্তানের জননী―ক্ষণস্থায়ী একটি প্রণয়লীলার ফসল। স্কুল শিক্ষয়িত্রীর সমস্ত আশা এবং স্বপ্ন ছিল ওই ছেলেটিকে ঘিরেই; অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গেই পুত্রের লালনপালন করতেন, তবে কোনওরকম প্রশ্রয় দেওয়া থেকে দূরে থাকতেন, ওঁর ছাত্রছাত্রীদের জন্য যে নিয়মানুবর্তিতা ধার্য করেছিলেন, নিজের ছেলের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হতে দিতেন না। শৃঙ্খলার অভাবে ওঁর পুত্র বিপথে চলে গেছে, এরকম কোনও কথা কারও কাছ থেকে শুনতে উনি প্রস্তুত ছিলেন না; একই সঙ্গে উনি চাইতেন যে ছেলে ওর বাবার বিপথগামিতার উত্তরাধিকার যেন বহন না করে, তার বদলে ওঁর পুত্র স্বচ্ছ মনের একজন হৃদয়বান মানুষ হয়ে ওঠে। যেদিন সন্ধেবেলা রিয়াদ হ্যালাবি শহরের অন্য প্রান্ত থেকে ওঁর ঠেলাগাড়ি নিয়ে অ্যাগুয়া সান্তাতে এলেন, সেদিনই একদল ছেলে জোড়াতালি দেওয়া একটি স্ট্রেচারে করে স্কুল শিক্ষিকা ইনেসয়ের ছেলের দেহ নিয়ে যাচ্ছিল। অন্য কারওর বাগানে ঢুকে গাছ থেকে একটি আম কুড়িয়ে আনতে গেছিল, বাগানের মালিক, বাইরের কেউ হবেন, কেউই ওঁকে বিশেষ চিনতেন না, রাইফেল থেকে একটি গুলি চালিয়েছিলেন, ছেলেটিকে ভয় পাওয়ানোর উদ্দেশ্যেই, কিন্তু তার বদলে গুলিটি ওর কপালে কালো একটা গর্ত তৈরি করে দিল, এবং অবিলম্বেই ও মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। সেই মুহূর্তেই ফেরিওয়ালাটি হস্তক্ষেপ করার আন্তরিক তাগিদ অনুভব করলেন, এবং নিজের অজান্তেই ঘটনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এলেন, শোকার্ত মাকে সান্ত্বনা দেওয়া, অন্ত্যেষ্টির আয়োজন করা―যেন উনি এই পরিবারেরই একজন সদস্য, আর অপরাধী ব্যক্তিকে জনরোষের বলি হওয়া থেকে রক্ষা করার জন্য উন্মত্ত জনতাকে সামলে রাখা। ইতিমধ্যে খুনি বুঝে ফেলেছিলেন যে ওখানে থাকার মানেই হলো জনতা ওঁর প্রাণের কোনও মূল্যই দেবে না, তাই উনি মানে মানে সরে পড়লেন, আর কোনওদিন ওই শহরমুখো হলেন না।

পরের দিন রিয়াদ হ্যালাবিকেই দেখা গেল নিজে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে জনতাকে নিয়ে সমাধিস্থল থেকে ছেলেটি যেখানে মৃত্যুবরণ করেছিল সেখানে নিয়ে এলেন। অ্যাগুয়া সান্তার প্রতিটি অধিবাসী সারাদিন কাটিয়ে দিল গাছ থেকে আম পেড়ে আর জানলা দিয়ে সেগুলো ঘরের ভেতর ছুড়ে ফেলে, যতক্ষণ না মেঝে থেকে ছাদ পর্যন্ত বাড়িটা আমে ভর্তি হয়ে যায়। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রোদ লেগে আমে পচন ধরে গেল আর পুতিগন্ধময় রস দেওয়াল ভেদ করে হলদে রঙের মিঠে পুঁজের মত বাইরে এসে জায়গাটিকে একটি প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসস্তূপে পরিণত করল, বিশাল এক মৃতদেহের পচন ধরে শুককীট আর মশাদের আড়ত হয়ে উঠল।

ছেলেটির মৃত্যু, সেটিকে ঘিরে ওঁর ভূমিকা আর অ্যাগুয়া সান্তার অধিবাসীদের সাদর অভ্যর্থনা, রিয়াদ হ্যালাবির জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। যাযাবরবৃত্তি ভুলে গিয়ে উনি সেই গ্রামেই থেকে গেলেন। ওখানে উনি একটি দোকান খুলে বসলেন। দ্য পার্ল অফ দ্য ওরিয়েন্ট। বিবাহ করলেন, স্ত্রীবিয়োগ হলো, দ্বিতীয়বার দার পরিগ্রহ করলেন, ব্যবসা চালিয়ে গেলেন, এবং একজন ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি হিসেবে ওঁর সুনাম বেড়েই চলল। অপর দিকে, ইনেস, যে অসীম মমতায় নিজের ছেলেকে মানুষ করার স্বপ্ন দেখেছিলেন, সেই একই মমতা দিয়ে, যতদিন সামর্থ্য ছিল, প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান করে গেলেন; তারপর যে সব শিক্ষিকা শহর থেকে নতুন পাঠক্রম নিয়ে এখানে এলেন, তাঁদের জায়গা ছেড়ে দিয়ে অবসর গ্রহণ করলেন। বিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসার পর ওঁর মনে হলো উনি যেন সহসা বুড়িয়ে গেছেন, যেন সময় এত দ্রুত এগিয়ে চলেছে যে দিনগুলো কীভাবে কেটে যাচ্ছে সেটা উনি মনেই রাখতে পারছেন না।

‘আমি কেমন যেন হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছি, তুর্ক। হয়তো মরতে বসেছি, আর সেটাও বুঝতে পারছি না,’ উনি মন্তব্য করলেন।

‘আপনি ঠিক আগের মতোই বহাল তবিয়তে আছেন, ইনেস,’ জবাবে রিয়াদ হ্যালাবি বললেন। ‘আসলে আপনার খুব একঘেয়ে লাগছে। অলস হয়ে বসে থাকা ঠিক হচ্ছে না আপনার।’ তারপর উনি পরামর্শ দিলেন বাড়িতে কয়েকটা ঘর বাড়িয়ে অতিথিদের রাখার বন্দোবস্ত করতে। ‘আমাদের এই শহরে একটাও হোটেল নেই।’

‘এখানে বেড়াতেও কেউ আসেন না,’ ইনেস যোগ করলেন।

‘পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন একটা বিছানা, সকালে গরম গরম ব্রেকফাস্ট ভ্রমণকারীদের কাছে আশীর্বাদের মতো।’

অবশেষে সেটাই সত্যি হলো, মূলত ন্যাশনাল পেট্রোলিয়ামের ট্রাকচালকদের জন্য―পথশ্রম আর একঘেয়েমি থেকে ওদের যখন অলীক দর্শন হতে আরম্ভ করত, তখন ওরা ওঁর বোর্ডিং হাউসে রাতটা কাটিয়ে যেত।

অ্যাগুয়া সান্তায় স্কুল শিক্ষয়িত্রী ইনেস ছিলেন অতি সম্মানীয় একজন প্রবীণা। বহু দশক ধরে উনি শহরের ছেলেমেয়েদের শিক্ষাদান করেছেন, ফলে ওদের জীবনের যে কোনও ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার এবং প্রয়োজন হলে ওদের কান ধরে উঠবোস করানোর অধিকারও উনি অর্জন করেছিলেন। সম্মতি লাভের জন্য মেয়েরা তাদের ছেলেবন্ধুদের ওঁর কাছে এনে হাজির করত, স্বামী এবং স্ত্রীরা নিজেদের মতবিরোধের ফয়সালা করার জন্য ওঁর কাছেই আসতেন; উনি ছিলেন একাধারে পরামর্শদাত্রী, সালিশ এবং বিচারক―শহরের সমস্ত সমস্যায়। সত্যি বলতে কী, উনি যাজক, ডাক্তার, এমনকি পুলিশের চেয়েও বেশি কর্তৃত্বশালিনী ছিলেন। আর এই কর্তৃত্বের প্রতিপালনে ওঁকে কেউই বাধা দেবার সাহস করতেন না। একবার উনি জেলখানায় হাজির হয়ে, লেফটেন্যান্টকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, দেয়ালের পেরেক থেকে ঝোলা চাবির গোছা ছিনিয়ে নিয়ে কারাকক্ষ থেকে ওঁরই এক ছাত্রকে―মদ্যপ অবস্থায় হাঙ্গামা করার অপরাধে যাকে জেলে পোরা হয়েছিল―বের করে নিয়ে এসেছিলেন। অফিসার ওঁকে বাধা দেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু উনি তাঁকে একপাশে ঠেলে সরিয়ে ছাত্রটির কলার ধরে হিড়হিড় করে টেনে বাইরে নিয়ে এলেন। রাস্তায় এসে উনি ছাত্রটিকে বেশ কিছু উত্তমমধ্যম দিয়ে জানালেন যে ফের যদি এরকম কিছু ঘটে তাহলে ওর প্যান্ট খুলে এমন চাবুক লাগাবেন যে ও জীবনে ভুলবে না। ইনেস যেদিন রিয়াদ হ্যালাবিকে বলতে এলেন যে উনি অতিথিদের একজনকে খুন করেছেন, রিয়াদ হ্যালাবির মনে ক্ষণেকের তরেও এই সন্দেহ হয়নি যে উনি তামাশা করছেন, কারণ ইনেসকে উনি খুব ভালো করেই জানতেন। দ্য পার্ল অফ দ্য ওরিয়েন্ট থেকে দুটো ব্লক পরে যেখানে ইনেস থাকেন, হ্যালাবি ওঁর বাহু ধরে সেদিকেই চললেন। শহরের অন্যতম বিশাল অট্টালিকা সেটি, পাকা ইট আর কাঠের তৈরি, প্রশস্ত বারান্দা যেখানে তীব্র গরমে দোলনা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়, আর প্রত্যেক ঘরেই একটি করে সিলিং ফ্যান। এই সময় বাড়িটা ফাঁকা বলেই মনে হচ্ছে; কেবল একজন অতিথি বসার ঘরে বসে বিয়ার পান করছেন আর নিবিষ্ট মনে টিভি দেখছেন।

‘কোথায় সে ?’ ফিসফিস করে আরব বণিক জিজ্ঞেস করলেন।

‘পেছন দিকের একটা ঘরে,’ ইনেস বললেন, গলা নামানোর চেষ্টা না করেই।

ইনেস ওঁকে সারি সারি যেসব কক্ষ ভাড়ায় দেন, সেদিকে নিয়ে চললেন―প্রতিটি কক্ষের লাগোয়া তোরণ থেকে বেগুনি রঙের মর্নিং গ্লোরি লতিয়ে উঠেছে আর কড়িকাঠ থেকে ফার্নের টব ঝোলানো―বারান্দার ধার ঘেঁষে কিছু মেডলার আর কলাগাছের সারি। ইনেস সর্বশেষ কক্ষটির দ্বার খুললেন, রিয়াদ হ্যাবিলি অন্ধকারাচ্ছন্ন একটি ঘরে প্রবেশ করলেন। ঝাঁপ ফেলা রয়েছে, হ্যালাবির একটু সময় লাগল বিছানার ওপর নিরীহ চেহারার একটি বৃদ্ধের মৃতদেহ দেখতে পেতে, জীর্ণ চেহারার অপরিচিত একজন মানুষ নিজেরই মৃত্যুর পাঁকে ডুবে রয়েছেন, ওঁর ট্রাউজার বিষ্ঠায় মাখামাখি, এক ফালি পাংশুবর্ণের মাংসপিণ্ডের সঙ্গে লেগে থেকে মাথাটা ঝুলে আছে, ভয়াবহ যন্ত্রণার অভিব্যক্তি, যেন সমস্ত ঝামেলা আর রক্তের জন্য, সর্বোপরি নিজেকে খুন হতে দিয়ে যে অস্বাভাবিক বিরক্তির কারণ ঘটিয়েছেন, তার জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। ঘরে থাকা একটি মাত্র চেয়ারে রিয়াদ হ্যালাবি বসে পড়লেন, গা গুলিয়ে ওঠা ভাবটা কোনও মতে সামলে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বুকের ওপর দু হাত জড়ো করে ইনেস দাঁড়িয়েই রইলেন, মনে মনে হিসেব করলেন, দাগ ওঠাতে অন্তত দিন দুয়েক লেগে যাবে ওঁর, তারপর আরও দুদিন মলের দুর্গন্ধ দূর করতে আর ভয় কাটিয়ে উঠতে।

‘কীভাবে করলেন কাজটা ?’ কপাল থেকে ঘাম মুছে নিয়ে শেষমেষ প্রশ্নটা করলেন রিয়াদ হ্যালাবি।

‘নারকেল পাড়ার কাটারি দিয়ে। ওঁর পেছনে দাঁড়িয়ে এক কোপে মাথাটা নামিয়ে দিয়েছি। বুঝতেও পারেননি কিসে লাগল, বেচারা।’

‘কেন এমন করলেন ?’

‘এটা আমাকে করতেই হতো। অদৃষ্টের লিখন। কপাল মন্দ ছিল এই বুড়া লোকটার। অ্যাগুয়া সান্তায় থামার ইচ্ছাই ওঁর ছিল না; শহরের মধ্য দিয়ে গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, একটা পাথর লেগে গাড়ির উইন্ডশিল্ডটা ভেঙ্গে গেল। এখানে কয়েক ঘণ্টা কাটানোর জন্য এলেন, যখন গ্যারেজের ওই ইতালীয় লোকটা অন্য একটা উইন্ডশিল্ড লাগাচ্ছিল। অনেকটাই বদলে গেছেন―বোধহয় সকলেই আমরা বুড়া হয়ে গেছি―তবে আমি দেখেই ওঁকে চিনতে পেরেছিলাম। এত বছর ধরে আমি অপেক্ষা করেছিলাম; আজ না হয় কাল উনি যে আসবেনই, এ আমি জানতাম। ওই যে আমওয়ালা লোকটা।’

‘আল্লাহ্ আমাদের রক্ষা করুন,’ বিড়বিড় করে রিয়াদ হ্যালাবি বললেন।

‘লেফটেন্যান্টকে খবর দেব নাকি―আপনি কী বলেন ?’

‘খবরদার না; একথা বললেন কেন ?’

‘আমি তো ঠিক কাজই করেছি। উনি আমার ছেলেকে মেরে ফেলেছিলেন।’

‘লেফটেন্যান্ট এ কথা বুঝবেন না, ইনেস।’

‘একটা চোখের বদলে একটা চোখ আর একটা দাঁতের বদলে একটা দাঁত, তর্ক। আপনার ধর্মে এটাই শেখানো হয় কিনা ?’

‘কিন্তু আইন তো ঠিক সেইভাবে চলে না, ইনেস।’

‘বেশ, তাহলে ওঁকে একটু ঠিকঠাক করে নিই, বলে দেব যে আত্মহত্যা করেছেন।’

‘ওঁকে ছোঁবেন না যেন। বাড়িতে কজন অতিথি আছেন ?’

‘কেবল সেই ট্রাকচালকটাই। রোদ একটু পড়লেই রওনা হয়ে যাবেন; রাজধানী পর্যন্ত যেতে হবে ওঁকে।’

‘উত্তম। আজ আর নতুন কোনও অতিথি ঢোকাবেন না। এই ঘরের দরজায় তালা লাগিয়ে দিন, আর আমার জন্য অপেক্ষা করুন। আমি রাতেই ফিরব।’

‘কী করতে চলেছেন আপনি ?’

‘আমি নিজের মতো করে কিছু একটা বন্দোবস্ত করব।’

রিয়াদ হ্যালাবির বয়স এখন পঁয়ষট্টি, কিন্তু অ্যাগুয়া সান্তায় পদার্পণ করার দিনই তরুণ বয়সের যে তেজ আর উদ্যম ওঁকে জনতার নেতৃত্ব দেবার শক্তি দিয়েছিল, আজও সেই তেজ আর উদ্যম উনি বজায় রাখতে পেরেছেন। সেদিন বিকেলের মধ্যেই যাদের যাদের সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বলে ভেবে নিয়েছিলেন, তাদেরই প্রথম জনের কাছে এলেন স্কুলশিক্ষিকার বাড়ি থেকে বেরিয়ে দ্রুত পা চালিয়ে। অল্পক্ষণের মধ্যেই শহর জুড়ে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। অবিশ্বাস্য খবরটা জানতে পেরে অ্যাগুয়া স্যান্তার অধিবাসীরা বহু বছরের দীর্ঘ আলসেমি কাটিয়ে সজাগ হয়ে উঠল, ঘরে ঘরে কানাকানি চলতে লাগল, চাপা দেওয়া যায় না এরকম একটা গুঞ্জন, আবার জোর গলায় চেঁচিয়ে বলার মতোও নয়, আর গুজবটাও যেন কেবল গুঞ্জনেই সীমিত রাখা যায় এই বোধ থেকে সেটিকে একটি বিশিষ্ট অবস্থান প্রদান করা হলো। সূর্য ডোবার আগে থেকেই আকাশে বাতাসে এক অস্থির উচ্ছ্বাস অনুভব করা যাচ্ছিল, যেটি বহু বছর ধরে এই শহরের বৈশিষ্ট্য হয়ে থেকে যাবে, তবে বহিরাগতরা সমুদ্রের নিস্তরঙ্গ উপকূলে পড়ে থাকা গুরুত্বহীন এই শহরের মধ্যে কোনও অসাধারণত্ব খুঁজে পাবে না, অরণ্যের ধার ঘেঁষে থাকা আর পাঁচটা শহরের মতোই। সন্ধ্যা হতে না হতেই সরাইখানায় জনসমাগম হতে লাগল; মহিলারা রান্নাঘরের চেয়ার ফুটপাথে এনে মুক্ত হাওয়ায় বসে পড়লেন; তরুণ-তরুণীরা ভিড় করে নগরচত্বরে ঘোরাঘুরি করতে লাগল, যেন রবিবারের ছুটির দিন। লেফটেন্যান্ট দলবল নিয়ে একবার উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে গেলেন, তারপর পতিতালয় থেকে আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, যেখানে একটি জন্মদিন উদযাপন হচ্ছে বলে ওরা জানাল। রাত বাড়তেই রাস্তায় লোকজনের ভিড় আরও বেড়ে গেল, অল সেন্টস’ ডে-তে যেরকম জমায়েত হয় ভিড়টা তার চেয়েও বেশি; প্রত্যেকেই নিজের নিজের কাজে এমন মগ্ন হয়ে রইলেন যেন ওঁরা সবাই সিনেমার কোনও না কোনও একটা চরিত্রের মহড়া দিচ্ছেন; কেউ কেউ আবার ডোমিনো খেলতে লাগলেন; অন্যেরা রাস্তার এক কোণে দাঁড়িয়ে রাম পান করতে আর সিগারেট খেতে লাগলেন; কয়েকজন দম্পতি হাতে হাত ধরে পায়চারি করতে বেরিয়ে পড়লেন, মায়েরা নিজের নিজের বাচ্চার পেছনে দৌড়াচ্ছেন, দিদিমা ঠাকুমারা কৌতূহলী হয়ে খোলা দরজা থেকে উঁকি মারছেন। প্যারিস চার্চে যাজক মোমবাতি জ্বালিয়ে, ঘণ্টি বাজিয়ে শহিদ সেন্ট ইসিদ্রোর জন্য প্রার্থনাসভায় অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছেন, কিন্তু কারও তখন ওই ধরনের ভক্তি প্রদর্শনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নাই।

স্কুল শিক্ষয়িত্রী ইনেসের বাড়িতে সাড়ে নটার সময় একটি সভা ডাকা হয়েছিল―তুর্ক, শহরের ডাক্তারবাবু আর চারজন কমবয়সী ছেলে যাদের উনি প্রথম শ্রেণি থেকেই পড়িয়েছেন এবং বর্তমানে সামরিক বাহিনীতে চাকরি করে ফেরা অভিজ্ঞ তাগড়াই ব্যক্তিত্ব। রিয়াদ হ্যালাবি ওঁদের পেছনের ঘরটিতে নিয়ে গেলেন, ওখানে ওঁরা পোকা ধরে যাওয়া মৃতদেহটি দেখতে পেলেন; জানলাটা খুলে রাখা হয়েছে আর এটি মশার উৎপাতের সময়। একটি ক্যাম্বিসের থলিতে ওঁরা মৃতদেহটি ভরে নিলেন, তারপর টানতে টানতে রাস্তায় এনে রিয়াদ হ্যালাবির ট্রাকের পেছনে তাচ্ছিল্যের সঙ্গে ছুঁড়ে দিলেন। তারপর বড় রাস্তা ধরে ওঁরা এগিয়ে চললেন, যাঁদের সঙ্গেই চোখাচোখি হলো যথারীতি তাঁদের দিকে হাত নেড়ে অভিবাদন জানাতে জানাতে। অভিবাদনের জবাবে কেউ কেউ অত্যন্ত উৎসাহ দেখিয়ে হাত নেড়ে প্রত্যাভিবাদন জানালেন, কেউ কেউ ভান করলেন যেন নজরেই পড়েনি আর দুষ্টুমি চাপা দিতে গিয়ে বাচ্চারা যেরকম বোকার মতো হেসে ফেলে, ঠিক সেভাবে হেসে। চাঁদের উজ্জ্বল আলোর ভেতর দিয়ে ওঁরা গাড়ি নিয়ে অকুস্থলের দিকে এগিয়ে গেলেন, যেখানে অনেক বছর আগে স্কুল শিক্ষয়িত্রী ইনেসের পুত্র শেষবারের মতো আম কুড়ানোর জন্য নিচু হয়েছিল। অযত্নবর্ধিত আগাছার ঘন জঙ্গলের মাঝখানে সময় আর দুঃস্বপ্নের ভারে জর্জরিত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সম্পত্তি। গাছ থেকে আম খসে পড়তে পড়তে নতুন গাছ গজিয়ে উঠে দুর্ভেদ্য জঙ্গল তৈরি হয়ে গেছে। চারদিকের বেড়া, পায়ে চলার পথ, এমনকি বাড়ির ধ্বংসাবশেষটিও দখল করে ফেলেছে। বাতাসে শুধু আমের মোরব্বার মতো মৃদু সুবাস ছড়িয়ে আছে। ওঁরা কেরোসিনের বাতি জ্বালিয়ে নিয়ে, কাটারি দিয়ে আগাছা সাফ করতে করতে এগিয়ে চললেন। যখন ওঁদের মনে হলো যথেষ্ট এগোনো হয়েছে, একজন আঙ্গুল দিয়ে ফলের ভারে নত বিশাল গাছটির তলায় একটি জায়গা নির্দেশ করলেন। গভীর একটি গর্ত খুঁড়ে সেই ক্যাম্বিসের ঝোলাটি নামিয়ে দেওয়া হলো। মাটি দিয়ে গর্তটি ভরিয়ে দেবার আগে রিয়াদ হ্যালাবি ছোট্ট একটি মুসলিম প্রার্থনা উচ্চারণ করলেন, অন্য কোনও প্রার্থনা ওঁর জানা ছিল না। মধ্যরাত্রে ওঁরা যখন শহরে ফিরলেন, দেখলেন তখনও কেউ ঘুমোতে চলে যাননি; প্রতিটি জানলা থেকেই আলো দেখা যাচ্ছে, লোকজন রাস্তায় ঘোরাঘুরি করছ্নে।

ইতিমধ্যে স্কুল শিক্ষয়িত্রী ইনেস সাবান আর জল দিয়ে ঘষে ঘষে পেছনের ঘরটির দেওয়াল আর আসবাবপত্র সাফ করে ফেলেছেন; বিছানার চাদর এবং অন্যান্য জিনিস পুড়িয়ে ফেলেছেন, বাড়িতে হাওয়া চলাচল করিয়েছেন, আর সুন্দর একটি ডিনারের আয়োজন করে, আর এক জার বিয়ার আর আনারসের রস সহ বন্ধুদের জন্য অপেক্ষা করছেন। সকলেই সর্বশেষ মোরগের লড়াই নিয়ে খোশমেজাজে গল্প করতে করতে ডিনার করলেন―স্কুল শিক্ষিকার মতে ওই খেলাটি নাকি খুবই বর্বর, কিন্তু অন্যরা বললেন যে ষাঁড়ের লড়াইয়ের থেকে নাকি সেটি কম বর্বর, যেখানে এই সেদিন একজন কলম্বিয়ান ম্যাটাডরকে তার যকৃত খোয়াতে হয়েছিল। রিয়াদ হ্যালাবি সবার শেষে বিদায় নিলেন। সেদিন রাত্রে জীবনে প্রথমবার ওঁর মনে হলো যে উনি বুড়ো হয়ে গেছেন। দরজার কাছে স্কুল শিক্ষয়িত্রী ইনেস ওঁর হাতটি নিজের হাতে তুলে নিয়ে কিছুক্ষণ ধরে রইলেন।

‘ধন্যবাদ, তুর্ক,’ বলে উঠলেন।

‘আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন কেন, ইনেস ?’

‘কারণ, যে মানুষটিকে আমি পৃথিবীতে সব চেয়ে ভালোবাসি, সেই মানুষটি হলেন আপনি। এবং এই জন্যও যে আমার সন্তানের সত্যিকারের পিতা আপনারই হওয়া উচিত ছিল।’

পরের দিন অ্যাগুয়া স্যান্তার অধিবাসীরা আবার নিজের নিজের কাজে ডুবে গেলেন। একটি মহৎ দুষ্কর্মের মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে, ভালো প্রতিবেশীদের মতো একটি কথা বুকে গোপন রেখে―যে কথাটি ওঁরা যে কোনও মূল্যে গোপন রাখবেন, আর এই ন্যায়বিচার কিংবদন্তির মতো অনেক বছর ধরে ওঁদের মনের মধ্যে ঘুরবে, একমাত্র সেই স্কুল শিক্ষয়িত্রী ইনেসের মৃত্যুর পরেই এই গোপনীয়তার বাধা আর থাকবে না। আজ সেই বাধা কেটে গেছে, তাই গল্পটি আপনাদের বললাম।

 লেখক : অনুবাদক, ফটোগ্রাফার

কলকাতা থেকে

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ 

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button