অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : চূড়ান্ত ধ্বংসের দিন কখনও আসে না : ইউসুফ ইদ্রিস

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

মূল : ইউসুফ ইদ্রিস

ইংরেজি অনুবাদ : ওয়াদিদা ওয়াসেফ

বাংলা অনুবাদ : অমিতাভ চক্রবর্ত্তী

[চিকিৎসক, নাট্যকার, ঔপন্যাসিক এবং ছোটগল্পকার ইউসুফ ইদ্রিসের জন্ম মিশরের ফাকুস শহরে ১৯২৭-এর উনিশে মে, আর মৃত্যু ১৯৯১-র পয়লা আগস্ট। ইউনেস্কোর অনুবাদ সাহিত্য সংগ্রহশালায় ইউসুফের লেখা সংগৃহীত হয়েছিল মিশরের প্রতিনিধিত্বকারী হিসেবে। আজীবন বামপন্থি ইউসুফ মতাদর্শগত কারণে একসময় প্রেসিডেন্ট নাসেরকে সমর্থন করেছেন, আবার পরে তার বিরোধিতা করে জেলেও গিয়েছেন। কাছে থেকে দেখেছেন সাধারণ মানুষের জীবন, সেই জীবন নিয়ে লিখেছেন এবং যৌনতাকে সেখানে ব্যবহার করেছেন অস্ত্র হিসেবে। একই সঙ্গে তাঁর সময়ের এবং চিরকালীন, তাঁর এলাকার এবং সারা পৃথিবীর কাহিনি বলা বর্তমান গল্পটিতেও আমরা তাঁর লেখার এই বৈশিষ্ট্যগুলোর মুখোমুখি হই, আর আমাদের অন্তর তীব্র বেদনায় কেঁপে ওঠে।]

আরও একবার ও মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শোনার চেষ্টা করল। কারণ ওখানে যা ঘটছিল সেটা ওর জন্য গুরুত্বপূর্ণ। হয়তো ওর জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এমনিতেও, পাড়া-প্রতিবেশীদের বিনা তারের সংবাদ সংগ্রহ তো ছিলই। তাদের ঘরগুলো সব পাশাপাশি, এক দেয়াল থেকে আরেক দেয়াল, আর যা চলছিল একেবারে পুরোদমেই চলছিল। বাইরে যে বাচ্চারা তখনও জেগে আছে তারা ছুটাছুটি করে চিৎকার করে ছড়া কাটছিল―সেই ভালুক আর তার সঙ্গী শুয়োরের ছড়া যারা কুয়ার মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। ভালুকটা কি সত্যিই কুয়ায় পড়ে গিয়েছিল আর এখন কি সেটা চুপচাপ শুয়ে আছে সেখানে ? সত্যিই কি ওর বন্ধু একটা পেটমোটা গোবদা শুয়োর, ঐ আবুল শেবা ইসমাইলের মত ? সে সবকিছু পুরাপুরি শুনতে চাইছিল। কারণ বিছানায় ওর মাথার কাছে ওর মা ওর উপর প্রায় চেপে শুয়েছিল, যদিও ওর মা তেমন কিছু মোটাসোটা নয়, তবু বিছানাটা ওখানে উল্টা ঢিবির মতো নেমে এসেছে। আচ্ছা, মা তো তেমন মোটা নয় তাহলে বিছানাটা এমন ফুলে-ফেঁপে আছে কেন ? তবে এ সব তো সেই আগেকার কথা যখন সে ফিসফিস করে কিছু কথা ছাড়া আর কিছু শুনতে পেত না।

রাতের খাওয়া-দাওয়া হয়ে গেছে, মায়ের মুখে উজ্জ্বল হাসি, ভালোবাসার উষ্ণ আলোয় চারিদিক ভাসিয়ে ঘুমঘুম গলায় মা ডাকছে, ‘শুতে চলে এসো বাচ্চারা, অনেক রাত হয়ে গেছে।’ তারপর সে বিছানার চারপাশ ধরে ঝুলতে থাকা চাদরের একটা ধার তুলে ধরল আর বাচ্চারা হামাগুড়ি দিয়ে ছোট ছোট মুরগি ছানার মতন চৌকির নিচে ঢুকে পড়ল। বাড়ি বলতে তাদের ঐ একটাই ঘর। গরমকালে দেয়ালের পাশটা বেশ ঠান্ডা থাকত আর তাই ও সেখানেই শুতে চাইত, খোলা পায়ের পাতা দেয়ালে ঘষতে ভালো লাগত তার। শীত এলে আবার দেয়াল থেকে দূরে, চৌকির অন্য ধারের দিকে সরে যেত ও। এই সবের মাঝখানে সারা বছর ধরে শোনা যেত―একটা একঘেয়ে শব্দ। এটা যে কেন হতো সেটা সে কখনই ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। কারণ যতক্ষণে তার ঘুম ভেঙ্গে যেত শব্দটা তার মধ্যে থেমে গেছে, ক্যাফেটা বন্ধ হয়ে গেছে, আলোগুলো গেছে নিভে, আর পুরা রাস্তাটা ঘোর অন্ধকারে ডুবে গেছে।

দরজাটা আলতো করে একটু ফাঁক হলো আর ফিসফিস আওয়াজ শোনা গেল। ফিসফিসানি আর অন্ধকার। আর কিছু নাই। হ্যাঁ, আর আছে সেই একঘেয়ে শব্দ, যেন শক্ত কাঠের মেঝের উপর টপ টপ করে একটানা জল পড়ে চলেছে। ফিসফিসানি, শুনতে অনেকটা মায়ের রাত পোশাকের খসখস শব্দের মতো। অথবা এটা হয়তো মায়ের রাত পোশাকের খসখসানিই ছিল, শোনাত যেন কেউ ফিসফিস করে কথা বলছে। আর তারপর তার মা বিছানায় উঠে শুয়ে পড়ত। চৌকির উপর বিছানাটা যদিও সবার শোয়ার মতো যথেষ্ট বড় ছিল তবু মা একাই সেই বিছানায় শুতো। সে একেবারে নিয়ম বেঁধে দিয়েছিল যে বাচ্চারা সব চৌকির নিচে শোবে এমনকি আব্বা যখন বেঁচে ছিল তখনও এই নিয়মই চালু ছিল। বড় হতে হতে এক সময় যখন তারা ক্ষোভ জানাল যে চৌকির কাঠে তাদের মাথা ঠুকে যাচ্ছে, তখন মা একজন মিস্ত্রি ডেকে চৌকির পায়াগুলো উঁচু করে আরও খানিকটা জায়গা করে দিল। অবশ্য এটা ঠিক যে অন্য যে কোনও বাচ্চার মতোই এই নিরিবিলি আশ্রয়টি তার খুব পছন্দের ছিল, এখানে সে ইচ্ছেমতো লুকোচুরি খেলতে পারত। তার মনে হতো এটা যেন কোনও আরব বেদুইনের তাঁবু অথবা কোনও সন্ত মহাপুরুষের গোরস্থান। কিন্তু মায়ের কোলের একটু ছোঁয়া পাওয়ার সেই তীব্র আকাক্সক্ষাটা তার ভিতরে ভিতরে সব সময় কাজ করে যেত। নরম বিছানায় সাদা চাদরের উপর মায়ের কোলের কাছে লেপ্টে শুয়ে থাকার জন্য মনটা ভীষণ আকুলি-বিকুলি করত। কখনও কখনও মাঝরাতে শরীর খারাপের ভান করে ভালো রকম গোঙানির আওয়াজ করত সে। কিন্তু তার গোঙানির আওয়াজ সহ্যের বাইরে চলে না যাওয়া পর্যন্ত মায়ের কাছ থেকে কোনও সাড়া-শব্দ পাওয়া যেত না। তখন সে নিচু গলায় বকা লাগানোর সুরে জিজ্ঞাসা করত, ‘কী, হয়েছেটা কী, ইব্রাহিম ?’ এবং সেখানেই গোঙানির শেষ, কারণ সেটার উদ্দেশ্যই ছিল এইটুকু দেখা যে এই করে কতদূর যাওয়া যেতে পারে।

অন্ধকার, ফিসফিসানি আর তারপর তার মায়ের ঘুম না আসা, সেটার কারণ যদিও মনে হতো সেই অচেনা-অজানা শ্বাসের আওয়াজ, যেটা দরজাটা খোলা অবধি ঢুকে এসে গোটা ঘরটা ভরে ফেলেছিল। সারা রাত মা বিছানায় এপাশ-ওপাশ করত। আর, এক রাতে তো চৌকির পাটাতনের একটা কাঠ খুলে গিয়ে তার বোনের পায়ের উপর নেমে এসেছিল। ব্যথার চোটে সে চিৎকার করে উঠেছিল। ও নিজেও চেঁচাতে শুরু করেছিল এবং মায়ের দিক থেকে কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে আতঙ্কে দিশেহারার মতো হয়ে গিয়েছিল। তারপর মায়ের কাছ থেকে একটি থাপ্পড় জুটিয়ে নিয়ে সে চুপটি করে ঘুমিয়ে পড়েছিল। এতে কোনও সন্দেহ নাই যে মায়ের ঐ এপাশ-ওপাশ করা ঘুম না আসার জন্য ছিল না; অবশ্যই অন্য কোনও কারণ ছিল। ঠিক কবে থেকে ও এই অন্য কারণের সম্ভাবনা সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল ? আজকের রাতেই নিশ্চয়ই এটা প্রথম মনে এল না। প্রথমবার মনে হয় সেই উৎসবের আগের রাতে যখন মা স্নান করবে বলে ওদের সবাইকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছিল, আর তারপর তারা যখন ফিরে এসেছিল, সে দেখল মা চুল শুকাচ্ছে, পরনের পরিষ্কার রাতপোশাকটা আলগা আর তার স্তন দুটি ওর চোখের সামনে। সেই প্রথম ও খেয়াল করল, তার মায়ের স্তন আছে। সে দুটি দেখল ও, আর দেখল ওর মায়ের চোখ যা বলছে, ওর মনে হলো সেখানে কারও ছায়া পড়েছে, চারপাশের জগতে যেন অন্ধকার ঘনিয়ে আসছিল, আর তার চোখ ওকে মনে পড়িয়ে দিচ্ছিলো সেই ফিসফিসানি, আর তার স্তনদুটি। ওর আর সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে সাহস হলো না। বাইরে বাচ্চারা যেখানে কুয়ায় পড়ে যাওয়া ভালুকটার কথা বলে চিৎকার করছিল, সেই দিকে ছুটে বেরিয়ে চলে গেল ও। অনেকক্ষণ ধরে সেদিন ও খেলা চালিয়ে গেল যতক্ষণ না ওর চোখ দুটি ধুলায় ভরে গেল, শরীরটা ঝিমঝিম করতে লাগল আর ওর মনে হলো এবার ও মাথা ঘুরে পড়ে যাবে। তারপর ও ঘরে ফিরে এল। দরজায় টোকা দিল, যদিও কেউ সেটা খুলে দিল না। তার বদলে ওর মায়ের বকা শোনা গেল, ‘যেমন তুমি দেরি করে এসেছো, আজ ওই চৌকাঠেই শুয়ে থাকবে।’ এবং সেই রাতে সে আর ওকে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দিল না। ফলে বাইরে শুয়ে রাতটা কাটাতে হলো ওকে, আর ঠিক সেটা ও নিজেও চাইছিল। কিন্তু সকালে যখন ওর ঘুম ভাঙলো ও দেখল চৌকির নিচে নিজের নির্দিষ্ট জায়গাটাতে ও শুয়ে আছে আর ওর কাছে শুয়ে আছে ওর মা। ওকে জেগে উঠতে দেখে মা তাকে আদর করে কাছে টেনে নিয়ে বলল, ‘ঈদ মোবারক, ইব্রাহিম,’ আর ও দুনিয়ার সবার চেয়ে সুখী বাচ্চাটার মতো আনন্দে মাকে জড়িয়ে ধরল। যে একটামাত্র জিনিসে ওর অস্বস্তি লাগছিল সেটা হলো মায়ের গায়ের সাবানের গন্ধ। যেন সেটার মধ্যে একটা লজ্জা মিশে আছে, এমন একটা কিছু যা করা ঠিক নয়। ও মায়ের হাতটা নিজের ঘাড়ের পাশ দিয়ে টেনে নিয়ে তার আঙ্গুলগুলো নিয়ে খেলা করতে থাকে, সেগুলোর বাইরের দিকটা ভিতরের তুলনায় কম ফর্সা, প্রথমে ও মায়ের হাতের তালুতে, আর তারপর একটা একটা করে আঙ্গুলগুলোয় চুমু খেতে থাকল। কত, কতকাল বাদে যে ও এইভাবে মাকে আদর করল, কারণ দীর্ঘকাল মায়ের কাছে ও শুতে পায়নি। ও অনুভব করছিল ওর গায়ে ঠেসে থাকা ওর মায়ের বুকের উষ্ণ, জীবন্ত মাংস। তার জীবন্ত মাংস আর সাবানের ঘ্রাণ, আর তার ঘামের এক বিশেষ গন্ধ, আর অন্ধকারের ফিসফিসানি। এই সমস্ত কিছু মিলেমিশে ওকে এমন একটা স্তরে নিয়ে গেল যে ওর চোখ থেকে জল উপচে এল আর নিঃশব্দে ওর মায়ের হাতের উপর ঝরে পড়ল। মা দ্রুত হাতটা টেনে নিল যেন তাকে কিছুতে হুল বিঁধিয়ে দিয়েছে, আর যখন সে বুঝতে পারল, ছেলেটা তার কেঁদে ফেলেছে, সে ওকে আরও নিবিড় করে কোলে টেনে নিল, আর ওর ইচ্ছে হলো ও তার কাছ থেকে ছুটে পালিয়ে চলে যায়, বাইরে, ঐসব ছেলেদের মাঝে যারা ভালুক আর তার সঙ্গী শুয়োরকে নিয়ে চিৎকার করে ছড়া কাটছিল। কিন্তু যখন ও বুঝতে পারল যে, রাতটা আর নেই, এবং যে দিনটা এখন এসেছে সেটা ঈদের দিন, আর বাইরের সমস্ত বাচ্চা আজ উৎসব করবে আর নানারকম উপহার পাবে, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ও, কিছুতেই থামতে পারছিল না, যতক্ষণ না ওর মা কাঁদতে কাঁদতে ওকে শক্ত করে ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কী হয়েছে, বাবু ?’ সত্যিই ত, কী হয়েছে ? ঘটেছেটা কী ? কিছুই না। অন্তত এমন কিছু নয়, যাতে ওকে কাঁদতে হবে। তা হলে ওর এত কষ্ট হচ্ছে কেন ? সেটা কি আবুল শেবা নামের মানুষটার এই অনন্তকাল ধরে এখানে বসে থাকার জন্য ? নাকি প্রত্যেকবার লোকটা যখন আসে তখন ও মিষ্টি খেতে না চাইলেও লোকটা যে ওর হাতে কটা পয়সা গুঁজে দিয়ে ওকে জোর করে মিষ্টি কিনতে পাঠিয়ে দেয়, সেই জন্য ? এই লোকটার কাছে মাকে একা ছেড়ে যেতে ভয় করছিল ওর। যখন ও টালবাহানা করে যেতে দেরি করছিল আদেশের সুরে ওর মার গলা শোনা গেল, ‘তোমার ইসমাইল চাচার কথা শোনো, বোরহ্যাম।’১ এবং বোরহ্যাম ঘর ছেড়ে যাওয়ার আগে লোকটার চোখের ভিতর তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করল, এমন কোনও কিছুর সন্ধান যদি মেলে, যাতে ওর ভিতরের ভয়টা কেটে যায়। ব্যাপারটা এমন নয় যে লোকটার বিশাল চেহারা বা তার হাতের বিরাট থাবাগুলো আকারে যেগুলো প্রায় তার বোনের বালিশের মতো বড়, সেইসবের কারণে ও ভয় পাচ্ছিল, তবু তার চোখের দিকে ও বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারল না। লোকটার চতুর দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যা ওকে দুর্বল করে দিচ্ছিল। বিদ্রƒপের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা জড়াজড়ি করে মিশে ছিল সেই দৃষ্টিতে। একটা নোংরা মাথামোটা লোকের কর্কশ জান্তব বিদ্রƒপভরা দৃষ্টি, যে লোক এক গ্লাস জল চেয়ে খেলে তারপর ঢেকুর তুলবে আর একটানা খসখসে গলায় ঘড়ঘড় করে কথা বলে যাবে। আর যখন সে ওর মায়ের কানের উপর ঝুঁকে পড়ে ফিসফিস করে কিছু বলছিল, ওর সেই হিসহিসানি এক অশুভ কুয়াশার মতো ছড়িয়ে পড়ছিল, সারা ঘর জুড়ে, ওদের সকলের জীবন জুড়ে, একটা অস্বস্তিকর লজ্জার বোধ মিশে ছিল সেই কুয়াশায়।

ওর চাচা আবুল শেবা ইসমাইলের ঠিক কোন ব্যাপারটা ও নিতে পারত না একদম ? ওদের বাড়িতে আরও অনেকেই আসত, যারা ওর মায়ের সঙ্গে হাতে হাত মেলাত, আর তার কানে ফিসফিস করে কথা বলত, এবং তাদের কেউ কেউ ওকে কখনও কখনও একটা দুটা পয়সা দিত, আর মা হাসত আর তাদের সবার সঙ্গে গল্প করে যেত। কিন্তু কেবল এই লোকটা যখন থাকত, ওর হঠাৎ করেই মনে হতো যেন মায়ের সঙ্গে ওর অদৃশ্য বন্ধনটা আর নেই, উবে গেছে, যেন মা আর জানেই না যে মায়ের জীবনে ওর অস্তিত্ব বলে কিছু আছে, আর তখন মাকে নিয়ে ওর নিজের সজাগ অনুভূতি এমন একটা তীব্রতায় পৌঁছে যেত যে ওর মনে হতো ও আর নিজেকে ধরে রাখতে পারছে না, গনগনে রাগে ওর ইচ্ছে করত বাবার ছড়িটা নিয়ে মায়ের চোখে বসিয়ে দেয় কি ওর নিজের সমস্ত জামাকাপড় ছিঁড়েখুঁড়ে ন্যাংটা হয়ে মায়ের চোখের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে শুধু এইটুকু জানান দিতে যে, আছে, বোরহ্যামও আছে তার জীবনে। এর আগে জীবন ছিল সহজ-সরল, মিষ্টি, কোনও জটিলতা ছিল না সেখানে, এবং সেই জীবনের সমস্ত কিছু ভালোবাসত ও। খাবার সময়ে ওদের টেবিলটার ধার ধরে ঘিরে দাঁড়াতে ভালোবাসত ও, ওর বোনের সঙ্গে আর চার বছরের ছোট ভাইটার সঙ্গে, ভাইটা তখনও আধো আধো স্বরে কথা বলত। ওদের সকলের জন্য মায়ের যে মনোযোগ, বিশেষ করে ওর নিজের জন্য, সেইটা খুব ভালো লাগত ওর। আর ভালো লাগত সকালবেলায় চা আর দুধ, নদীর ধারে বেড়াতে যাওয়া, লেটুস আর লুপিন খাওয়া, আর পার্কে গিয়ে ঘাসের উপর বসে থাকা। ওঃ! কী ভালো যে সব ছিল তখন, এমনকি যখন ওরা আব্বার কথা বলত, ওর মায়ের মুখে ছায়া ঘনিয়ে আসত আর ওর ভয় হতো এইবার বোধহয় মা কেঁদে ফেলবে। তারা সব সময় আব্বার নানারকম গুণের কথা নিয়ে গল্প করত। এমনভাবে তাকে নিয়ে কথাবার্তা বলত যেন আব্বা প্রায় কোনও সাধু-সন্ত মহাপুরুষ ছিলেন। তারা বলাবলি করত কী অসম্ভব শক্তিশালী লোক ছিলেন তিনি, বলতে গেলে ‘অন্তর ইবনে শাদাদ’২য়ের মতো। আর বলত তার অসুস্থতার কথা যেটা মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে তাকে শেষ করে দিয়েছিল। সবাই বলত, মারা গিয়েছিলেন তিনি।

হ্যাঁ। মোটামুটি এই রকমই কথাবার্তা হতো তাকে নিয়ে যেগুলোর আজ এই মুহূর্তের আগ পর্যন্ত বিশেষ কোনও তাৎপর্য ছিল না, কিন্তু এখন অর্থবহ হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ওর আব্বা মারা গিয়েছিলেন। তার মানে তিনি বরাবরের মতো চোখের পাতা বুজিয়ে ফেলেছিলেন, আর তার মুখ ফ্যাকাসে আর ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল, আর তারা তাকে কাফন পড়িয়েছিল, আর তারপর সবাই তার দাফন করেছিল। ও এর সমস্তটাই দেখেছে কিন্তু তার কোনও অর্থ বোঝেনি। ঠিক যেমন সে বোঝেনি অন্ধকারে ঐ খসখস আওয়াজ আর ফিসফিসানির অর্থ কিংবা বাবা মারা যাওয়ার পর লোকজনের বলাবলি করা―‘বোরহ্যাম ঠিক সামলে নেবে।’ এখন সেই কুয়াশাটা একটু একটু করে কাটতে শুরু করেছে, আর ও জটগুলো ছাড়াতে পারছে, খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা না গেলেও, অন্তত একটা ভয় ধরানো কিছুর আভাস টের পাচ্ছে ও যার উৎস কোনও এক অস্পষ্ট অতলান্ত, ঐ কুয়ার মুখটার মতো গভীর কিছু যার মধ্যে দোস্ত শুয়োরকে সঙ্গে নিয়ে ভালুকটা তলিয়ে গিয়েছিল। এমনকি বাইরে যে বাচ্চারা মনে হচ্ছিল জোর হুল্লোড় করছে তাদের হুটোপাটি আর গলা ছেড়ে গান গাওয়াও সেদিন ওকে ওখান থেকে নড়াতে পারেনি।

‘হুম, ভালোই তো বেড়ে উঠেছিস রে ছোঁড়া, আর গতরটাও বানিয়েছিস বড়সড় ষাঁড়ের  তো,’ ওর কান ধরে মোচড়াতে মোচড়াতে বলল ডিউকো কারখানা মানে যেখানে ও কাজ করত তার মালিক। ‘কাজেই, তুই আর বাচ্চা নেই মোটেও, বুঝেছিস রে গ্যাঁড়া ? আর শোন, তোর ঐ সারা দিন ধরে কাঁধ ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো আমার মোটেই দেখতে ভালো লাগে না, বুঝতে পারছিস ? কিসে তোর মাথাটা খাচ্ছে বলত ? বুড়া শম্বা কি তোর ঠিকমতো দেখভাল করছে না ?’

যা হবার ছিল তাই হলো। চাবুকের মতো জ্বালা ধরিয়ে দিল। ‘আর কখনও এই কথা বলবেন না, মালিক,’ বলে বসল সে, আদৌ জানা নেই, কোন সাহসে।

যদিও লাথির চোটে কালশিরা পড়ে গেল, আর তা চলতে রইল যতক্ষণ না ওর মুখ ফুলে ঢোল হয়ে উঠল, ওর কাছে যেটা সবচেয়ে আশ্চর্যের লেগেছিল তা হলো মারপিট পর্ব মিটে যাওয়ার পর মালিক যখন ইয়ার-দোস্তদের নিয়ে বসে গড়গড়ায় ধোঁয়া টানছিল, সে মালিককে বলতে শুনল, ‘তোমরা যে যাই বলো বাপু, আমার এ ছোঁড়াকে মনে ধরেছে। ও আমার মুখে মুখে তক্ক করেছে ঠিকই, কিন্তু আমার ওকে পছন্দ হয়েছে। এ ছোঁড়ার কলজের জোর আছে, আর এ শম্বার থেকে অনেক ভালো নিকলাবে।’

শম্বা ছিল মালিকের সর্দার সাগরেদ। ইব্রাহিমের থেকে বয়সে বড়, রং আরও কালচে, জটা পড়া কোঁকড়ানো চুল, বোঁচা নাক আর গলার স্বর―নিচু, ভারী, খসখসে, আদৌ ওর ভাই লোমুম্বার মতো নয়। সারা দিন ধরে ওর কাজ ছিল ইব্রাহিমকে লাথানো আর নানা নামে ডেকে বিদ্রƒপ করা।

‘তার বুড়ি মাগিকে বলিস আমার কথা,’ ও বাড়ি যাওয়ার সময় পিছন থেকে এই বলে চেঁচানোটা ওর রোজকার কাজ ছিল।

প্রথমবার যখন শম্বা এই কথাগুলো বলেছিল, ইব্রাহিম উড়ে গিয়ে ওর উপর পড়ে ওর মুখের উপর ঘুষি বসিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু তার ফলে ওর যে পিটুনিটা জুটেছিল তা ও জিন্দেগিতে ভুলবে না। এতে কোনও সন্দেহ নেই যে বড় হয়ে ওর প্রথম কাজ হবে শম্বাকে খুন করে ফেলা। সেটা করতে গিয়ে প্রথমে যদি একটা ভালুকের মুখোমুখি হতে হয় ওকে, তবে ঐ ভালুকটাকেও মেরে ফেলবে ও। অন্যান্য বাচ্চার সঙ্গে সুর মিলিয়ে ঐ ছেলেমানুষি ছড়াটা বার বার আউড়ে যেতে ওর এখন খুব বোকা বোকা লাগে। ওটা এখন আর ওকে টানে না তেমন। আর বিছানার নিচে গুঁড়ি মেরে ঢুকে যেতে আজকাল অনেক বেশি চেষ্টা করতে লাগে। কাঠের তক্তার মতো শক্ত হয়ে যাওয়া লম্বা বালিশটায় একসময় মাথা ঠেকানো মাত্র সেই যে চটপট ঘুমিয়ে পড়ত ও, সেইটা এখন বেশ কঠিন হয়ে গেছে। এখন ও খসখসানি আওয়াজের থেকে ফিসফিস শব্দকে আলাদা করতে পারে। এখন আর খটখট আওয়াজে ঘুম ভাঙ্গে না ওর, বরং সেই আওয়াজ কাছে আসার অনেক আগে, অন্ধকার রাস্তায় পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলেই সজাগ হয়ে ওঠে ও, এবং ও জানে, ঐ আওয়াজ আসছে আবুল শেবা ইসমাইলের পা থেকে, আর এও জানে যে সেই রাতের মতো ক্যাফে বন্ধ হয়ে যাবে এবার। আর, একমাত্র ও-ই যে সজাগ হয়ে ওঠেনি সেটা বোঝা যেত যখন চৌকিটা ক্যাঁচক্যাঁচ আওয়াজ করত আর তার উপরে মায়ের পায়ের নড়াচড়া থেমে যেত আর তার হাতের চুড়িগুলো ঠুনঠুন করে বেজে উঠত। তারপর সেই খসখস আওয়াজ। দরজাটা ফাঁক হওয়া, আর তার মায়ের ঘুম-জড়ানো গলার ফিসফিস করে ডেকে নেওয়া ‘মাসা আল-খায়ের (শুভ সন্ধ্যা)।’ ঘটনা এটাই যে প্রথম অভ্যর্থনাটা মায়ের দিক থেকেই আসত। আর ঐ ব্যাঙের মতো আওয়াজ, সেটাকে শত চেষ্টাতেও ফিসফিসানি বলার কোনও মানে হয় না। লোকটার চোখদুটি এমন জ্বলজ্বল করে উঠত যে মনে হতো সেখান থেকে আলো ছড়িয়ে পড়ে ঐ অন্ধকার ঘরের সমস্ত কিছু উজ্জ্বল করে তুলেছে, এমনকি ওর নিজের তামাটে কুৎসিত মুখ, মায়ের খোলা পা, সেই পায়ের আঙ্গুলগুলো, চৌকির চারদিক থেকে ঝোলা চাদরের ঘেরাটোপে ইব্রাহিমকে রেখে দিয়ে গুঁড়ি মেরে বিছানায় উঠে যাওয়ার সময় যেগুলো মায়ের নিজেরই শরীরের চাপে কুঁকড়ে রয়েছে। আর ইয়াসমিন, আপনমনে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকা, দ্রুত গভীর ঘুমে তলিয়ে যাওয়া, ঘুমন্ত মুখের থেকে কী নিষ্পাপভাবে লালা ঝরে যাচ্ছে তার। আর তাদের ছোট ভাইটা, বোনের পায়ের কাছে লম্বা হয়ে পড়ে আছে, একজন বড় মানুষের মতো নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ওরা সবাই এখন কুয়াটার তলায় শুয়ে আছে, আর উপরে স্বর্গে রয়েছেন ফেরেস্তারা, আর সেই স্বর্গের ছাদ বানানো হয়েছে কাঠের তক্তা দিয়ে, যেগুলোর ফাঁক দিয়ে এখানে ওখানে বিছানার তোষক নেমে এসেছে, আর চৌকির নিচে সমস্ত কিছু তছনছ হয়ে যাচ্ছে। আর কাঠের আকাশটা এবার ছেৎরে যাবে বলে ভয় ধরাচ্ছে। আর এরপর নেমে আসবে সেই শেষ বিচারের, কেয়ামতের দিন। স্বর্গ আর নরক এক কাতারে এসে দাঁড়াবে। সেই কেয়ামতের দিনে ইব্রাহিম তার মাথাটা নিচু করে দাঁড়াবে। আর শম্বা যখন তার মাথায় বাড়ি মারার জন্য এগিয়ে আসবে উপর থেকে ঈশ্বরের বজ্রকণ্ঠের হুকুম শোনা যাবে, ‘হাত সরিয়ে নে হতচ্ছারা!’ এবং হাতটা তখন গুটিয়ে যাবে। চূড়ান্ত ধ্বংসের দিন, কেয়ামত এখনও আসছে না কেন ? শোনা যাচ্ছে না কেন সেই আকাশ ফাটানো হুংকার ‘হাত সরিয়ে নে হতচ্ছারা!’ যাতে শুয়োরটা বাড়ি খেয়ে স্তব্ধ হয়ে পড়ে থাকে আর ওর মায়ের কথাগুলো চিরকালের মতো তার গলার ভিতরেই আটকে থাকে, আর কোনওদিন ওকে আর ঐ ফিসফিসানি শুনতে না হয় ? ঐ ফিসফিসানি যা ওর মাকে একটা সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ বানিয়ে  দেয়, যার মুখ ও চেনে না, এমন একজন মহিলা যাকে নিয়ে ওর লজ্জার শেষ নেই। আর যখন ঐ ফিসফিসানির আওয়াজ চাপা আর সন্দেহজনক হয়ে ওঠে, তখন তার সত্তার লুকোনো রূপ, যাকে তার নিজের শরীরের গোপন অংশের মতো ঢেকে রাখা উচিত ছিল, ঐ ফিসফিসানির সঙ্গে সেটাও বেআব্রু হয়ে বেরিয়ে আসে। আর যত সে ঐ ফিসফিসানিকে চেপে দিতে চেষ্টা করে, ততই তা এত জোরে জোরে ওর কানের উপর বাজতে থাকে যে ওদের সমস্ত ঢাকনা, সমস্ত চাদর মিলেও সেই আওয়াজ চাপা দিতে পারে না। শোনো, শোনো। কোনওভাবেই কি সেই মহিলার থেকে এইসব আওয়াজ আসতে পারে যে ওর জন্ম দিয়েছিল ? যে ওর মা ?

ঠিক, এখন মনে পড়ছে ওর। কী করে ও ভুলে যেতে পারে সেইসব দিনগুলোর কথা যখন ও ইয়াসমিনের বয়সী ছিল, হয়ত আরও ছোট ? একরাতে ওর ঘুম ভেঙ্গে গেছে, এবং ও প্রায় চিৎকার করে কেঁদে উঠতে যাচ্ছিল, কিন্তু ওর কানে ঢুকে আসা কথাগুলো ওর মন পাল্টে দিল। ও তার আব্বার গলা শুনতে পাচ্ছিল। আব্বা ফিসফিস করে কিছু বলছিল। কাঠের আকাশের উপরে আব্বা তখন মায়ের সঙ্গে শুয়ে ছিল, আর তাদের ফিসফিস কথা হাসির টুকরোয় ভেঙ্গে যাচ্ছিল, সেই শুনে ওর হৃদয় খুশিতে ভরে উঠেছিল আর ও ভুলে গিয়েছিল যে ওর হিসি পেয়েছে, এবং মাত্র এক মুহূর্ত আগেও ও চিৎকার করে কেঁদে উঠতে যাচ্ছিল। উপরের বিছানায় খেলা-খেলা জড়ামড়ির পরে একটা হাল্কা চাপড়ের শব্দ শোনা গেল। তারপরে একটা চাপা ব্যথা পাওয়া চিৎকার, তারপরে আবার সেই জড়ামড়ি, যেন আর শেষ হচ্ছে না। ও ভাবতেই পারে না, ওর আব্বা, যাকে সে এত ভালোবাসে আর শ্রদ্ধা করে তিনি এমন কোনও খেলায় অংশ নিতে পারেন, আর যখন ওর খেয়াল হলো যে ওর মাও এতে যোগ দিয়েছে, কোনও এক অজানা কারণে ও এমন ক্ষেপে গিয়েছিল যে অনায়াসেই কেঁদে উঠতে পারত। কিন্তু সেটা অত্যন্ত বোকা বোকা হয়ে যাবে ভেবে ও চেপে গিয়েছিল। তা ছাড়া, সমস্ত বিরক্তি সত্ত্বেও এটা তো ঠিক যে তাদের কাছাকাছি থাকায় ও নিজেকে নিয়ে বেশ নিশ্চিন্ত আর নিরাপদ বোধ করছিল, যেন ও নিজেও এই খেলাটার একটা অংশ। আর এই অনুভূতিটাই অন্য সমস্ত কিছুকে ছাপিয়ে গিয়েছিল। ওর ইচ্ছে হলো ও জানিয়ে দেয় যে তাদের মতো ও নিজেও সেখানে হাজির আছে, আর তাই ও মুখটা হাঁ করে একটা ফোঁপানির আওয়াজ করে উঠল। অবাক হয়ে ও শুনল যে ওর ফোঁপানির উত্তরে উপরের হাসির আওয়াজ আরও বেড়ে গেল, মজা-পাওয়া আর লাগামছাড়া, আর তাতে বিছানাটা আরও ভীষণভাবে নড়তে থাকল। সেই একই বিছানা যেখানে এখন ওর মা শুয়ে আছে, কিরকম যেন সব-মেনে-নেওয়া ভাব, কোথায় গেছে দিনের বেলার সেই প্রবল দাপুটে চেহারা, বা কথা বলার সময়ের সেই ভয় ধরানো গলা! নম্র আর সবকিছু মেনে নেওয়া, পুরোপুরি নিজেকে সমর্পণ করে রাখা, শুয়োরটাকে আরও অত্যাচারী হতে আমন্ত্রণ করা। সেটার দম-চাপা ব্যাঙের ডাক এখন জবাই হতে থাকা ষাঁড়ের ঘড়ঘড়ানি। এখন আর ও শিশুটি নেই। এখন ও জানে। কিন্তু সবটা জানা নেই ওর। কারণ ওর মাথার উপরের আকাশটায়, একেবারে কুয়ার মুখটার কাছাকাছি আজব সব কাণ্ড ঘটে চলেছে যা ওর বোধের বাইরে। ঐ মানুষগুলোকে পিটিয়ে সত্যিটা ও বার করে নিতে পারে, কিন্তু ও যে চায় সব কিছু যেমন আছে তেমনই থাকুক, শুধু ওদের থেকে কথাগুলো সরিয়ে নাও, অবান্তর করে দাও সেগুলোকে। এই যে সবকিছু মেনে-নেওয়া আর পাশবিক অত্যাচার, আর ফিসফিস, আর বিছানার স্প্রিং খুলে গিয়ে গায়ের উপর নেমে আসার ভয়। কিন্তু তবু বরাবরের মত এখনও ওর রক্ত টগবগ করে ফুটতে থাকে আর ওর সারা শরীর ঘামে ভিজে যায়। মাথাটার কাজ করে যাওয়া, সমস্ত কিছু বুঝে ফেলা, এসব ও কিছুতেই থামাতে পারছে না। আর তারপর সেই ভীষণ ভয়, যেন ওর মাথার উপরে ঐখানে এক জোড়া জিন শুয়ে আছে, খোলাখুলি বেপরোয়া, সন্ধ্যাবেলায় যারা একসঙ্গে ভালোবাসাবাসি করেছে, উদ্দামভাবে এবং কোনওরকম ভয়ডর ছাড়া। লোকটা গর্জন করে একটা নরখাদকের মতো, আর ওর মা যেন এক বাঘিনী যার কিছুতেই তৃপ্তি হয় না, যার মুখের কষে এখনও ওর ছোট ভাইটাকে ছিঁড়ে খাওয়ার রক্তের দাগ লেগে আছে এবং এখনও যার অনেক খাওয়া বাকি আছে। বর্বরতা একেবারে পাগলামির পর্যায়ে পৌঁছে গেছে, কোনও রাখঢাক নেই আর, যেন দুটো খ্যাপা কুকুর কামড়াকামড়ি করছে। আর তাদের চাপে বিছানার স্প্রিংগুলো ওর প্রায় বুকের উপর চেপে এসেছে। আর তারা, এবং এই পৃথিবী আর আকাশ, আর এই দুনিয়ার যা কিছু মায়া-মমতা, ওর ঠিক উপরে শুয়ে আছে, একটু একটু করে ওকে গুঁড়া গুঁড়া করে ফেলছে, পিষে দিচ্ছে ওকে, দম বন্ধ করে দিচ্ছে ওর। আর নিতে পারছে না ও। পাগল হয়ে মরে যাবে এবার। ভোর হয়ে আসার ভয় এমনভাবে চেপে ধরেছে ওকে যে ও আর চিৎকারটুকুও করতে পারছে না। ভয়ই ওকে সামলে রেখেছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলা থেকে, সমস্ত কিছু তছনছ করে ফেলা থেকে, ভয়ংকর রাগে ওর পুরনো বাদামি জুতাটা নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার থেকে, আর একটা হাতুড়ি দিয়ে তাদের খুলিগুলো ফাটিয়ে দেওয়ার থেকে। কিন্তু ও জানে যে যত রাগই হোক না কেন ওর, সেরকম কোনও কিছুই ও করবে না। বড় হয়ে গেছো তুমি, বোরহ্যাম―একটা গোব্দা ভালুকের মতো বড় হয়ে গেছো তুমি। তোমার কান সব শুনতে পায়, তোমার চোখদুটো গরম শলার মতো বিছানার স্প্রিং ভেদ করে দৃষ্টি চালিয়ে দেয়, আর দেখে নেয় উপরে যা রয়েছে। যখন ছোট ছিলে, এত কিছু তুমি জানতে না। তুমি শুধু দেখতে পেতে। এখন তুমি দেখছো আর সেই সঙ্গে জানছো। শুধু ও যদি সব একবার মুছে দিতে পারত―আগে যা যা ঘটে গেছে, আর আবার প্রথম থেকে শুরু করতে পারত। এই যেমন ধরো আজকের থেকেই, কিংবা আগামীকাল থেকে, যেন এর আগে ও আর কিচ্ছু দেখেনি, কিচ্ছু শোনেনি। যেন ওর সমস্ত জ্ঞান এই প্রথম ওর কাছে এসে পৌঁছাচ্ছে আর এইবার সেই জ্ঞান অনুসারে ও ঠিক করবে কী করা উচিত ওর। কিন্তু ও জানে এমনটি কখনই ঘটবে না। কারণ ও জানে এই বারই প্রথম নয়। এমনকি প্রথমবারেরও আগে থেকে ছায়া ছায়া ধূসর কিছু উপলব্ধি ছিল যারা এখন একটু একটু করে নিজে থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠছে, যার ফলটা এই দাঁড়াচ্ছে যে পুরো খবরটা যখন শেষ পর্যন্ত ওর কাছে এসে পৌঁছচ্ছে, সেটা ইতিমধ্যেই বাসি হয়ে গেছে; যেন বহু যুগের ওপারের একটা ছায়ামূর্তি যা ও দেখার আগেই চিনে নিতে পেরেছিল।

ও এমনকি ওর অস্তিত্বটা পর্যন্ত বুঝতে দিতে চায়নি। বাবা আর মায়ের সময় ব্যাপারটা অন্যরকম ছিল কারণ তাদের কাছাকাছি ও নিরাপদ ছিল। কিন্তু এই দুজন তো সম্পূর্ণ অচেনা। একটা শুয়োর আর একটা ভালুক, উপরে ঐ আকাশে, দুনিয়ার ছাদের উপরে, এদিকে ও আর ওর ভাই, আর ওর বোন নিচে এইখানে কবরের ভিতর আটকা পড়ে আছে, ঠিক যেমনটা রয়েছে তাদের বাবা, চারধার দিয়ে ঝুলে থাকা সাদা চাদরে ঢাকা, তার কবরের ভিতর। ওর কি কেঁদে ফেলা উচিত হবে, কিন্তু সেটা করলে ও কি ওর নিজের কাছেই মালিক ওকে যা বলে ডাকে সেই শম্বার ‘খেলার জিনিষ’-এর মতো ছোট হয়ে যাবে না ? ওর কি চিৎকার-চেঁচামেচি করে একটা কাণ্ড বাধিয়ে তোলা ঠিক হবে ? অচেনা লোকটা চলে যাওয়ার পর মাকে ও মেরে ফেলতেই পারে, কিন্তু তাতে তো মাকে ও এখনও যতটুকু কাছে পায় সেটুকুও শেষ হয়ে যাবে। কারণ, যত যা-ই হোক সে এখনও ওর মা আর ও নিজে যে এখনও বেঁচে আছে তার একমাত্র কারণ ওর একটা মা আছে। মাকে মেরে ফেলে মায়ের জীবন শেষ করে দেওয়ার কোনও প্রশ্নই আসে না। অন্য কোনও মা নয়, একমাত্র এই মা আছে বলেই ও বেঁচে আছে। তাদের দুজনের জীবনকে যা জুড়ে রেখেছে, যত পলকাই সেটা মনে হোক না কেন, সেটাকে হারিয়ে ফেলা মানে ওর নিজের জীবনটাও হারিয়ে যাওয়া। এখন এই মুহূর্তে বুকের ভিতর মৃত্যু চেপে বসা ওকে এই ঠান্ডায় এইখানে ফেলে রেখে উপরে ওর মা ঐ অচেনা লোকটার সঙ্গে ওর থেকে একেবারে আলাদা হয়ে আছে। দুনিয়ায় কেউ নেই যে ওকে নিজের ভাবে, কেউ নেই যাকে ও নিজের ভাবে। ও বেঁচে আছে শুধু একটাই আশায় ভর করে যে, এই মাঝখানের সময়টা একদিন কেটে যাবে, ওর মা আবার ওর কাছেই ফিরে আসবে। ও যদি কেঁদে ওঠে, একবার যদি ওর মা জেনে যায় যে ও সব জানে, তাহলে তো সে ওকে বরাবরের মতো দূর করে দেবে, আর যেই ঝরনার থেকে জল নিয়ে ওর জীবনটা বয়ে চলেছে, সেটা শুকিয়ে যাবে, আর ওর মা, সেও আর থাকবে না। সিল্কের স্বচ্ছ একঢালা পোশাকের উপর দিয়ে একটা কালো আচ্ছাদন জড়িয়ে নেওয়া ঐ অন্য মহিলাটাই শুধু থাকবে, যে কখনও রাস্তায় রাস্তায় জিনিস  ফেরি করে, আবার কখনও স্রেফ মুটেগিরি করে ওদের জন্য দুটো খাবারের জোগাড় করতে প্রাণপাত করে। খাবার পেয়ে ও যে এত খুশি হয় সেটা ঐ বস্তুটা খাদ্য বলে নয়, ওটা ওর মায়ের পরিশ্রম আর ভালোবাসার ফলে পাওয়া গেছে বলে। মায়ের কোনও কাজে বাধা দেওয়া কি লোকের কাছে তার কথা বলে দেওয়ার চাইতে ও বরং নিজে মরে যেতে রাজি আছে, কারণ ওদের মায়ের ওদেরকে যতটা দরকার, তার চেয়ে ওর নিজের হাজার গুণ বেশি দরকার ওর মাকে।

ওদের জীবনে ঐ লোকটা এসে হাজির হওয়া অবধি ওর মনে হয় যে মায়ের কাছে ওদের দরকার ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু মা ওদের মা বলেই তো তাকে কেন্দ্র করে ওদের জীবনগুলো দাঁড়িয়ে আছে। তাই ওর মাকে বেঁচে থাকতেই হবে আর ওকেও চুপ করেই থাকতে হবে। ওদের টিকিয়ে রাখতে, বেঁচে থাকার রসদ যোগাড় করতে শয়ে শয়ে মানুষকে সামলাতে হলে তাই করুক ওদের মা। ওর মা যদি ওকে বকাবকি করে তো করুক। সমস্ত লোকের মধ্যে ঐ অচেনা লোকটাকেই যদি ওর মার মনে ধরে, ধরুক, এমনকি আগ বাড়িয়ে সে নিজেই তার খসখসে আদুরে গলায় লোকটাকে ডেকে নেয়, নিক। ও কোনও ঝামেলা করবে না। কাঠের শামিয়ানা থেকে আসা শব্দগুলো শুনতে শুনতে লম্বা রাত জেগে কাটিয়ে দেবে ও। সে সব শব্দে কোনও হাসি নেই, আনন্দ নেই, তার আব্বার গলার প্রিয় নরম স্বর নেই। শুধু কুয়ায় পড়ে যাওয়া শুয়োরের ঘোঁতঘোঁত আর ভালুকের হাঁপানি। এক বিশাল আদরে মহিলাটি নিজের ইচ্ছায় ঐ থলথলে হোঁৎকাটাকে জড়িয়ে নিয়েছে। তাদের নারকীয় পাশবিক জড়াজড়িতে চৌকির নিচে ওর কিশোর অস্তিত্ব গভীর থেকে ক্রমাগত আরও গভীরে তলিয়ে যায়। এখন তো ও বড় হয়ে গেছে। তবে, সেই যখন ও শিশু ছিল, সেই তখন থেকেই ও সব শুনে এসেছে, কিন্তু এখন এগুলো ওকে উন্মাদ করে দিচ্ছে, এবং আর একটাই পথ এখন পড়ে আছে, সেটাই সবচেয়ে বুদ্ধিমানের আর তা হচ্ছে, কিচ্ছুটি না বলা। আর এত কিছুর পরেও চূড়ান্ত ধ্বংসের দিনটি আর এসে পৌঁছায় না, এবং আকাশ থেকে কোনও বজ্রকণ্ঠের দৈববাণী শোনা যায় না ‘হাত সরিয়ে নে হতচ্ছাড়া!’ এবং ভিনদেশি শুয়োরটার মাথায় কেউ বাড়ি কষায় না, আর খসখসে আদুরে গলার মেয়েলোকটা মরে গিয়ে ওর মায়ের ফিরে আসা হয় না। কাঠের শামিয়ানার নিচ থেকে উঠে আসা কান্নার আওয়াজ ঘুমন্ত শহরের আনাচে কানাচে, সারা পৃথিবী জুড়ে আর তারও ওপারে অনন্ত স্বর্গের কুঠুরিতে পৌঁছে যায়। আর চূড়ান্ত ধ্বংসের দিনটি যেহেতু আসবে না, প্রতিদিন সকালে এক বুক হতাশা নিয়ে ও জেগে ওঠে, বাড়ি থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় চুরি করে একবার ও মায়ের দিকে তাকিয়ে নেয়, আর ওর মনে হয় ওদের দুজনের মাঝের নড়বড়ে সেতুটা আরও দুর্বল হয়ে গেছে, আর ওর মা আরও একটু দূরে সরে গেছে। আব্বা চলে যাওয়ার পর অজস্র বছর পার হয়ে গেছে, আর ফিসফিস করা মেয়েলোকটা জাঁকিয়ে বসেছে। একটা নিতান্ত অভাগার মতো সে তার কাজে গিয়ে যোগ দেয়, আর শম্বার কিলগুলো পড়তে থাকে তার মাথার পিছনে। একটা ছোট কালো ছেলের মাথার পিছনে।

‘তা হলে, তুই তো এখন বড় হয়ে গেছিস, গায়ে-গতরেও বেড়েছিস ভালোই,’ বলে শম্বা, ‘একটা পেল্লায় হোঁৎকা ভালুকের মতো বড়… আর ভালুকটা কুয়ার মধ্যে পড়ে গেছে।’

পাদটীকা

১ ইব্রাহিমের সংক্ষিপ্ত রূপ―বোরহ্যাম

২ প্রাক ইসলাম যুগের শক্তিশালী বীর

 লেখক : কবি, গল্পকার, অনুবাদক

টেনেসি, যুক্তরাষ্ট্রে থেকে

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button