অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : পাথরের বালিশে : হারুকি মুরাকামি

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

মূল: হারুকি মুরাকামি

অনুবাদ: মিলটন রহমান

[প্রসঙ্গ: ২০২১ সালে প্রকাশিত হয় জাপানের কথাসাহিত্যিক হারুকি মুরাকামির (১৯৪৯) আটটি গল্পের সংকলন ফার্স্ট পারসন সিঙ্গুলার (মূল জাপানি ভাষায় গ্রন্থের শিরোনাম―ইছিবানসু তানসু)। মূল জাপানি ভাষা থেকে সব ক’টি গল্পের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল। সাম্প্রতিক বিশ্বসাহিত্যে মুরাকামির গল্পগ্রন্থটি বিস্তর আলোচনায় স্থান করে নিয়েছে। বিশ্বের প্রথম সারির প্রায় সব সাহিত্য পত্রিকা গল্পগুলো নিয়ে আলোচনা করেছে। এখনও দি নিউ ইয়র্কার, গার্ডিয়ান, দি টাইমস থেকে শুরু করে বিভিন্ন পত্রিকায় আলোচনা অব্যহত রয়েছে। সঙ্গীত, স্মৃতি এবং স্ফীত জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর মানসিক দর্শন গল্পগুলোর অবকাঠামো তৈরি করেছে। এ গ্রন্থের গল্পগুলোর বাংলা অনুবাদ আমি করছি। এর দ্বিতীয় গল্প ‘পাথরের বালিশে‘। ইংরেজি থেকে গল্পটি বাংলায় অনুবাদ করেছি। যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি মূলের ভাব এবং চিন্তার রেখা ঠিক রাখতে।]

এ মন একটি মেয়ে সম্পর্কে গল্প বলতে চাই, যার সম্পর্কে প্রায় সব ভুলে গেছি। এমনকি আমি তার নামও মনে করতে পারছি না। মনে পড়ে না তার চেহারাও। বাজি ধরে বলতে পারি সেও আমাকে মনে করতে পারবে না।

তার সঙ্গে আমার যখন দেখা হয়, তখন আমি ছিলাম কলেজে দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র, এবং অনুমান করতে পারি তখন তার বয়স ছিল মধ্য বিশে। আমাদের দুজনেরই একই প্রতিষ্ঠানে খণ্ডকালীন কাজ ছিল। কাজও করতাম একই সময়ে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, কোনও পরিকল্পনা ছাড়াই আমরা একরাত একসঙ্গে কাটিয়েছিলাম। সেই ছিল আমাদের শেষ দেখা। আর কখনও দেখা হয়নি।

আমি তখন ঊনিশ। বুঝতাম না সে সময় মনের ভেতরের অনুভূতি। মন একাই ছুটে যেত যেখানে খুশি। তারপরও ভাবতাম, সুখ এবং দুঃখ সম্পর্কে উপলব্ধি করতাম। যদিও আমি এখনও উপলব্ধি করতে পারিনি সুখ এবং দুঃখের মধ্যে থাকা সমস্ত অগণিত ঘটনা, কীভাবে এসব ঘটনা একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কের সূত্রে আবদ্ধ থাকে। ফলে আমি প্রায়ই উদ্বিগ্ন এবং অসহায় বোধ করি।

যা বলছিলাম, আমি এখনও মেয়েটি সম্পর্কে বলতে চাই।  

তার সম্পর্কে আমি যা জানতাম তা হলো, সে টংকা কবিতা লিখত। একটি কবিতার বইও প্রকাশ করেছিল। বলছি বই, যদিও সেই প্রকাশনা ছিল অনেকটা লিফলেটের মতো। নিজে নিজে বই প্রকাশ করলে যেমনটি হয় ঠিক তাই। ছাপা পাতাগুলো সুতা দিয়ে বাঁধা। তার উপরে সাধারণ একটি কভার সাঁটা। তবে গ্রন্থভুক্ত কবিতাগুলো ছিল আশ্চর্যজনকভাবে অবিস্মরণীয়।  কবিতাগুলোর বিষয় ছিল নারী-পুরুষের প্রেম অথবা মৃত্যু সম্পর্কীয়। যেন সে দেখাতে চেয়েছিল প্রেম এবং মৃত্যু দুটি একটি অপরটির সঙ্গে গভীর সম্পর্কে বাঁধা। একটা থেকে আরেকটাকে আলাদা করার কোনও উপায় নেই।

তুমি এবং আমি

আমরা কি সত্যিই, অনেক দূরে আলাদা ?

আমিই কি, হতে পারে

ট্রেন বদল করতে হবে অন্য কোনও গ্রহে ?

যখন আমি কান চেপে ধরি

একটি পাথরের বালিশের বিপরীতে

টগবগে রক্তের শব্দ

অনুপস্থিত ছিল

মেয়েটি আমাকে বলল―

যখন আমি তোমার কাছে আসব তখন চিৎকার করে অন্য ছেলের নাম বলতে বলতে আসব। তাতে কি তোমার অসুবিধা আছে ?

আমরা তখন একটি কম্বলের নিচে বসনহীন ছিলাম। ভাবি, অসুবিধা কী। বললাম―

আমি পুরোপুরি নিশ্চিত না। তবে মনে হয় তাতে আমার কোনও অসুবিধা হবে না। একটা নামই তো মাত্র। একটা নামের জন্য কিছুই বদলাবে না।

সম্ভবত আমি উচ্চস্বরে সে নাম ডাকব।  

তাড়াতাড়ি বললাম, তাতে হয়তো সমস্যা হতে পারে। কাঠের তৈরি প্রাচীন ঘর আমি মাথার দিকে দেয়াল রেখে শুয়েছি। দেয়ালটি অত্যন্ত পাতলা এবং ক্ষীণকায়। খাওয়ার সময় আমি একেবারে শিশুর মতো সন্তর্পণে খাই। তার মধ্যে গভীর রাত। সত্যি সত্যি যদি মেয়েটি চিৎকার করে, পাশের বাসার মানুষ শুনতে পাবে।

‘আমি দাঁত দিয়ে টাওয়েল কামড়ে পড়ে থাকি।’ মেয়েটি বলল।

আমি বাথরুম থেকে পরিষ্কার এবং মোটা টাওয়েলটি এনে বালিশের পাশে শুয়ে পড়ি।

এখন ঠিক আছে ?

মেয়েটি টাওয়েলের ওপর কামড় দেয়। ঘোড়া কিছু খাওয়ার আগে যেভাবে স্বাদ পরীক্ষা করে দেখে, ঠিক সেরকম।

সে মাথা নাড়ল। টাওয়েল ঠোঁট ঘষে এপাশ ওপাশ করছিল।

এটা ছিল আমাদের একে অপরের কাছে আসার সুযোগ। আমি মনে করি না কখনও আমরা আবার একসঙ্গে হব। সেও সম্ভবত একই ভাবত। কয়েক সপ্তাহ আমরা একই দোকানে কাজ করলাম। তবে এ কাজটি আগের তুলনায় একটু ভিন্ন ছিল। ভালোভাবে কথা বলার সুযোগ খুব কম পেতাম। সেই শীতে আমি ইয়টসোয়া স্টেশনের কাছে একটি রেস্টুরেন্টে রান্না ঘরের কাজ এগিয়ে দেওয়ার জন্য বাসন-কোসন ধুতাম। সেখানে ওয়েট্রেসের কাজ করত মেয়েটি। সেখানে যারা পার্ট টাইম কাজ করে তারা সবাই কলেজ পড়ুয়া। কেবল ওই মেয়েটি ছাড়া। সেজন্য মেয়েটি অনেকটাই নির্লিপ্ত থাকত।

মেয়েটি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি এই কাজটি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। একদিন কাজের শেষে, কয়েকজন কর্মচারী কাছের একটি বারে যায় পান করার জন্য। আমিও তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রিত ছিলাম। এটা তেমন কোনও জাঁকজমকপূর্ণ ফেয়ারওয়েল পার্টি ছিল না। কেবল আমাদের কিছু বিয়ার পান করাবে এই যা। সঙ্গে অবশ্য কিছু জলখাবারও ছিল। খেতে খেতে আমরা নানা বিষয়ে গল্পও করলাম। এর মধ্যে বুঝতে পারলাম সে রেস্টুরেন্টে খাবার পরিবেশকের (ওয়েট্রেস) কাজে যোগ দেওয়ার আগে, ছোট একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি এবং বইয়ের দোকানে কাজ করত। বলল : সেসব কাজের জায়গায় কখনও ম্যানেজার কিংবা মালিকের সঙ্গে তার দেখা হয়নি। রেস্টুরেন্টের কাজে কখনও কারও সঙ্গে তার তর্ক-বিতর্ক হয়নি। তবে বেতন ছিল অত্যন্ত কম। ফলে সেসব কাজে তার পক্ষে দীর্ঘ সময় থাকা সম্ভব হয়নি। তাই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে নতুন কাজের সন্ধান করেছে।

‘কোন ধরনের কাজ তুমি করতে চাও’। একজন তাকে জিজ্ঞেস করল।

‘আমি পরোয়া করি না’ বলেই নাক চুলকাতে থাকে। (তার নাকের পাশে দুটো সুদৃশ্য তিল, নক্ষত্রপুঞ্জের মতো সারি বেঁধে আছে)। ‘আমি বলতে চাচ্ছি, যা-ই করি, তা কিন্তু আমি যেভাবে চাই সেভাবে হয় না।’

সে সময় আমি থাকতাম আসাগায়া, আর সে থাকত কোগানি। আমরা ইয়টসুয়ার বাইরে যাওয়ার জন্য একসঙ্গে দ্রুতযান রেলে উঠে বসলাম। বসেছি পাশাপাশি। তখন রাত এগারোটা পেরিয়ে গেছে, হাড় কনকনে ঠান্ডা, বাতাস যেন চামড়া ভেদ করে হাড় স্পর্শ করবে। আমার আগে জানা উচিত ছিল যে, এখন যে মৌসুমের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, এ সময় হাত মোজা এবং মাফলার না হলে চলে না। রেল যখন আসাগায়া রেল স্টেশনে প্রবেশ করছিল, তখন উঠে দাঁড়ালাম, নামার জন্য। এ সময় সে আমার দিকে তাকিয়ে নিচু স্বরে বলল, ‘যদি অসুবিধা না হয়, তুমি আমাকে আজ রাতে তোমার বাসায় থাকতে দিবে ?’

‘ঠিক আছে, কিন্তু কীভাবে সম্ভব ?’

‘কোগানি যেতে হলে অনেক দূর পেছনে যেতে হবে।’

‘এছাড়া তোমার অবগতির জন্য বলছি, আমি অগোছালো খুব ছোট একটি ঘরে থাকি।’

‘আমার জন্য তা কোনও সমস্যা নয়’―বলেই আমার ঘাড়ে হাত রাখে মেয়েটি।

সে এল আমার গিঞ্জি, নোংরা বাসায়। আমরা কয়েক ক্যান বিয়ার পান করলাম। বিয়ার পান করে আমরা কিছু সময় পার করলাম। এর পরের ঘটনা ছিল যেন অনেকটাই প্রাকৃতিক। সে আমার সম্মুখেই তার পরনের কাপড় খুলে ফেলল। পুরোপুরি উলঙ্গ হয়ে বসে পড়ল আমার মেট্রেসে। দেখাদেখি আমিও নিজের সব কাপড় খুলে বিছানায় তার সঙ্গে যোগ দিই। বাতি নিভিয়ে দিয়েছি, কিন্তু গ্যাস স্টোভ থেকে নিঃসরিত আলো ঘর মৃদু আলোয় জাগিয়ে রেখেছে। বিছানায় বিশ্রীভাবে আমরা একে অপরকে উষ্ণ করতে লাগলাম। কিছু সময়ের জন্য আমরা কোনও কথা বললাম না। এত তাড়াতাড়ি দুজন বিবস্ত্র হলাম যে, কী কথা বলব বুঝতে পারছিলাম না। বুঝতে পারলাম ক্রমান্বয়ে আমাদের শরীর উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। আক্ষরিক অর্থে আমাদের শরীরের মধ্য দিয়ে শিরশিরে একটা অনুভূতি চালান হতে শুরু করেছে। সে ছিল অদ্ভুতরকম সংবেদনশীল অন্তরঙ্গতা।

মেয়েটি বলল, ‘তোমার বাসায় যখন এসেছি, তখন আমি চিৎকার করে অন্য একটি নাম ধরে ডাকছিলাম। তুমি কিছু মনে করোনি তো ?’

‘তুমি কি তাকে ভালোবাসো ?’ তোয়ালে হাতে নিতে নিতে আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘আমি তাকে অনেক ভালোবাসি।’ মেয়েটি বলল। ‘আমি তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসি, পাগলের মতো। আমি সব সময় তাকে ভাবি, প্রতিটি মিনিট। কিন্তু সে আমাকে তেমন ভালোবাসে না। আমি বুঝাতে চাচ্ছি, তার একটা প্রেমিকা আছে।’

‘তারপরও তুমি তাকে এখনও চাও ?’

মেয়েটি বলল, ‘যখন আমার শরীরের প্রয়োজন হয় তখন সে আমাকে ডাকে। যেন ফোনে কোনও টেকওয়েতে খাবার অর্ডার করছে সেরকম।’

আমি এ অবস্থায় কী বলব বুঝতে পারছিলাম না। চুপ করে থাকলাম। তার আঙ্গুলের ডগা দিয়ে আমার পিঠে কী একটা যেন লিখল। অথবা টানা অক্ষরে কী যেন লিখেছে।

‘সে বলেছে আমার চেহারা মসৃণ, আমার শরীর অত্যন্ত আকর্ষণীয়।’

আমি মনে করি না তার চেহারা খুব একটা মসৃণ। তাকে সুন্দরী বলাও যাবে না। এখন পেছন ফিরে যদি মনে করার চেষ্টা করি, ঠিক মনে করতে পারি না আসলে সে কেমন ছিল দেখতে ? সে সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু এখন বলতে পারব না।

‘কিন্তু সে ডাকলেই কি তুমি যাও ?’

‘আমি তাকে ভালোবাসি, না গিয়ে আমি কী করতে পারি ?’ অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল মেয়েটি। ‘সে কী বলেছে তা কোনও ব্যাপার নয় আমার কাছে, এমন কিছু সময় আছে, যখন আমি মরিয়া হয়ে উঠি, কোনও একজন পুরুষ যেন আমাকে ভালোবাসে।’

আমি তার এমন মনোভাব পছন্দ করেছিলাম। কিন্তু আমি যখন ভাবি এমন অনুভব কীভাবে সম্ভব, তা আমার কল্পনায়ও ধরা দেয় না―একটা মেয়ে একতরফাভাবে চাচ্ছে একটা ছেলে তাকে ভালোবাসুক। (এমনকি এখনও, বিষয়টি আমার মাথায় এলে, কিছুই বুঝতে পারি না)।

‘কাউকে ভালোবাসা এক ধরনের মানসিক অসুস্থতা, যা কোনও হেলথ ইন্স্যুরেন্স দিয়েও পূর্ণ করা যায় না।’ শীতল কণ্ঠে মেয়েটি বলল। যেন দেয়ালে লেখা কোনও কিছু দেখে সে নিজের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে।

‘আমি বুঝলাম’, বললাম, ‘তুমি যা বলেছো শুনলাম।’  

‘সুতরাং তুমি যদি আমার পরিবর্তে অন্য কোনও মেয়ের কথা ভেবে থাকো ঠিক আছে।’ মেয়েটি বলল। ‘তোমার পছন্দের কি কেউ আছে ?’

‘আছে।’

‘তাহলে তুমিও সেই মেয়ের নাম চিৎকার করে বলতে পারো, যখন আমার কাছে আসো। আমি কিছু মনে করব না। তাতে আমি একটুও বিরক্ত হব না।’

সে সময় আমার পছন্দের একটা মেয়ে ছিল, কিন্তু পরিস্থিতি আমাদের একে অপরের কাছে আসা থেকে দূরে রেখেছিল। যখন আমাদের অন্তরঙ্গ মুহূর্ত এল তখন আমি ওই মেয়ের নাম ধরে ডাকিনি। সে চিন্তা আমার মনেই আসেনি, কিন্তু মিলনের মধ্য সময়ে নিজেকে বোকা মনে হচ্ছিলো, কোনও বাক্য বিনিময় ছাড়াই একটি মেয়ের ভিতরে আমি বীর্যপাত করেছি। সে চিৎকার করে একটা ছেলের নাম প্রায় উচ্চারণ করতে যাচ্ছিল, যেমন সে বলেছিল ছেলেটির নাম ধরে ডাকবে, আমি তাড়াতাড়ি একটি টাওয়েল তার দুই পাটির দাঁতের মধ্যখানে চেপে ধরলাম। তার দাঁত ছিল বেশ শক্ত এবং শক্তিশালী। যে কোনও ডেন্টিস্ট তার দাঁত দেখে মুগ্ধ হবে। এমনকি আমি এখন মনেই করতে পারছি না সে কোনও নাম ধরে চিৎকার করে ডেকেছিল। মনে করার চেষ্টা করলে, তেমন কিছুই না, ছিল সাদামাটা একটা নাম―সেটি এমন একটি শালীন নাম ছিল, যা তার জন্য ছিল মূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ। সাধারণ কোনও নামও কোনও কোনও সময় মানুষের মনে ঝাঁকুনি দিতে পারে।

পরের দিন সকালে, আমার একটি ক্লাস ছিল, যেখানে আমার একটা বড় এসাইনমেন্ট জমা দেওয়ার কথা ছিল ছয়মাসিক পরীক্ষার বদলে। কিন্তু চিন্তা করা যায়, আমি সে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি আমলেই নিইনি। (যার ফলে আমি মহা ঝামেলায় পড়েছিলাম। সে অন্য এক কাহিনি।) আমরা একটু দেরিতে ঘুম থেকে উঠলাম। ইনস্টেন্ট কফির জন্য পানি ফুটিয়ে, সঙ্গে কিছু টোস্ট খেলাম। ফ্রিজে কয়েকটি ডিম ছিল, খাবার জন্য সেগুলো সিদ্ধ করলাম। আকাশ ছিল পরিষ্কার, মেঘহীন। ভোরের সূর্যের আলো ঝলমল করছিল, এবং আমি কিছুটা আলস্য বোধ করলাম।

মেয়েটি বাটার মাখানো টোস্টে কামড় দিয়ে জিজ্ঞেস করল কলেজে আমার প্রধান বিষয় কী। বললাম, ‘আমি সাহিত্য বিষয়ে পড়ছি।’

‘তুমি কি ঔপন্যাসিক হতে চাও ?’ মেয়েটি জিজ্ঞেস করল। 

কোনও ভনিতা না করে বললাম, ‘আমার সে রকম কোনও পরিকল্পনা নাই। সত্যিই সে সময় ঔপন্যাসিক হওয়ার মতো আমার কোনও পরিকল্পনা ছিল না। এমনকি এ বিষয়টি আমি কখনও আমলেও নিইনি (যদিও সে সময় আমার ক্লাসে অনেকে ছিল, যারা ঘোষণা করেছিল যে, তারা ঔপন্যাসিক হতে চায়)। এর ফলে সম্ভবত মেয়েটি আমার প্রতি কিছুটা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। তবে এমনও না যে শুরু থেকেই আমার প্রতি তার আগ্রহ ছিল। এখনও তাই।

দিনের আলোয় দেখতে পেলাম, টাওয়েলে তার দাঁতের চিহ্ন ছাপার মতো দৃশ্যমান হয়ে আছে। যা দেখে আমি কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। মেয়েটির কামড় বেশ জোরালো ছিল। এটা বিশ্বাস করতে কষ্ট হয় যে―ছোটখাটো-অস্থির-সুন্দরী এই মেয়েটি কাল রাতে শীতের চাঁদের আলোতে আমার বাহুর উপরে আবেগে চিৎকার করেছিল। 

‘আমি তন্কা কবিতা লিখি’ মেয়েটি বলল।

‘তন্কা ?’

‘তুমি তো তন্কা সম্পর্কে জানো, ঠিক না ?’

‘অবশ্যই’। আমি বললাম। আমার মতো এমন সাদাসিধা মানুষও এ সম্পর্কে জানে। ‘তবে এ প্রথম আমি একজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম যে তন্কা কবিতা লেখে।’

মেয়েটি আনন্দের হাসি দিল। ‘কিন্তু পৃথিবীতে এমন আরও অনেকে আছে, যারা তন্কা লেখে, নিশ্চয়ই তুমি জানো।’

‘তুমি কি কোনও পোয়েট্রি ক্লাব বা তেমন কিছুর সঙ্গে যুক্ত আছো ?’

‘না, আমি কোনও ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত নই।’ মেয়েটি বলল। একটু মাথা ঝাঁকালো।

‘তন্কা হচ্ছে এমন এক ধরনের কবিতা যা তুমি নিজে লিখছো। ঠিক আছে ? এটা বাস্কেট বল খেলার মতো কিছু না।’

‘কোন ধরনের তন্কা ?’

‘তুমি কয়েকটি শুনতে চাও ?’

আমি হাঁ সূচক মাথা নাড়লাম।

‘সত্যি ? তুমি ঠিক তাই বলোনি মনে হয়।’

‘সত্যি তাই বলেছি’। আমি বললাম।

এবং সেটাই ছিল সত্য। আমি খুব আগ্রহী ছিলাম। কোন ধরনের কবিতা সে লেখে, যে মেয়েটি, কয়েক ঘণ্টা আগে যে আমার বাহুর ওপর হাহাকার করেছিল এবং চিৎকার করে এক ছেলের নাম ধরে ডেকেছিল।

মেয়েটি কিছুটা সংকোচ বোধ করছিল। ‘আমি এখানে কোন কবিতা আবৃত্তি করব তা মনে ছিল না। যা আমার জন্য অস্বস্তিকরও বটে। তাছাড়া মাত্র সকাল হলো। আমি আমার কবিতার একটি সংকলনও প্রকাশ করেছি। তুমি যদি সত্যিই আমার কবিতা পাঠ করতে চাও, আমি তোমাকে পাঠাব। তুমি কি আমাকে তোমার পুরো নাম এবং ঠিকানাটা বলতে পারবে ?’

আমি তাড়াতাড়ি করে একটি কাগজে আমার নাম-ঠিকানা লিখে তার হাতে ধরিয়ে দিলাম। সে এক নজর দেখে, কাগজটিকে চার ভাঁজ করে, তার ওভারকোটের পকেটে রেখে দিলো। হালকা সবুজ রঙের কোট। গোলাকার কলারের ওপর গ্রামের লিলি ফুলের মতো সিলভারের কারুকাজ। আমার মনে আছে দক্ষিণের জানালা ভেদ করে ছুটে আসা সূর্যের আলোয় জ্বলজ্বল করছিল। ফুল সম্পর্কে আমার তেমন কোনও ধারণা নাই, কিন্তু গ্রাম্য লিলি ফুলের প্রতি আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে।

‘আমাকে থাকতে দেওয়ার জন্য ধন্যবাদ। সত্যি বলতে আমি একা একা কোগানিতে ফেরত যেতে চাই না।’ আমার বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়ার সময় বলেছিল মেয়েটি।

আমরা দুজনেই জানতাম যে, এরপর আমাদের আর কখনও দেখা হবে না। সে রাতে মেয়েটি একা রেলে চেপে কোগানি যেতে চায়নি। এটাই ছিল আমার সঙ্গে রাত কাটানোর কারণ, আর কিছু না।  

এক সপ্তাহ পরে ডাকযোগে তার কবিতা সংকলন আমার বাসায় পৌঁছুলো। আমি আসলে ভাবিইনি যে সে মনে করে আমার জন্য কবিতার বইটি পাঠাবে। ভেবেছিলাম কোগানি গিয়ে সে আমাকে পুরোপুরি ভুলে যাবে (অথবা সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করবে), কখনও ভাবিনি যে সময় নষ্ট করে আমার জন্য তার বই খামে পুরবে, খামের ওপর আমার নাম-ঠিকানা লিখবে, টিকেট লাগাবে, এবং মেইলবক্সে তা ফেলবে―আর এ কাজ করার জন্য পুরো পথ হেঁটে পোস্ট অফিসে যাবে, এমনটাই আমার মনে ছিল। যখন প্যাকেটটি আমার বাসার মেইলবক্সে দেখলাম, তখন আমার বিস্ময়ের অন্ত ছিল না। 

কবিতাগ্রন্থটির শিরোনাম ছিল, ‘পাথরের বালিশে’। লেখকের নাম ছিহু। আমি ঠিক বুঝতে পারিনি এটা কি তার আসল নাম নাকি ছদ্মনাম। রেস্টুরেন্টে যখন একসঙ্গে কাজ করতাম তখন তার নাম অনেক শুনেছি। এখন সে নাম কোনও মতেই স্মরণ করতে পারছি না। তবে তাকে যে কেউ কখনও ছিহু নামে ডাকেনি সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। বইটি একটি খাকি বাণিজ্যিক খামের ভিতরে ছিল। তবে খামের ওপরে প্রেরকের নাম কিংবা ঠিকানা ছিল না। এমনকি কোনও কার্ড বা চিঠিও ছিল না। শুধু একটা মোটা কবিতার বই, সাদা সুতা দিয়ে বাঁধা। তবে তা হাতে লেখা সস্তা কোনওকিছুও নয়, দামি মানসম্মত মোটা কাগজে ছাপা। আমার ধারণা বইটির পৃষ্ঠাবিন্যাস লেখক নিজেই করেছেন, যুক্ত করেছেন কার্ড বোর্ডের প্রচ্ছদ। আর খরচ বাঁচানোর জন্য সুঁই সুতা দিয়ে বইটি বাঁধাই করা হয়েছে। সে এই কাজগুলো কীভাবে করেছে তা ভাবার চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু অনুমানে কিছুই বুঝতে পারিনি। প্রথম পৃষ্ঠার উপরে লেখা ২৮। এটা সম্ভবত গ্রন্থের সংখ্যার প্রকাশ। তাহলে মোট কটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে ? বইয়ের কোথাও দাম উল্লেখ করা নেই। সম্ভবত দাম লেখা হয়নি।

আমি সঙ্গে সঙ্গে গ্রন্থটি খুলে দেখিনি। আমার টেবিলের ওপর রেখে দিলাম, মাঝে মাঝে কভারের দিকে তাকাই। বিষয়টি এমন ছিল না যে, গ্রন্থটির প্রতি আমার আগ্রহ ছিল না। কেবল ভাবছিলাম, যার কবিতা পাঠ করব―সে এক সপ্তাহ আগে আমার বাহুর ওপরে নগ্ন শুয়েছিল―তার কবিতা পাঠ করতে হলে আমার কিছুটা মানসিক প্রস্তুতি দরকার। আমি মনে করি গ্রন্থটির প্রতি আমার সম্মান দেখানো উচিত। অবশেষে সাপ্তাহিক বন্ধের দিন বিকালে আমি বইটি খুললাম। জানালার পাশে দেয়ালে হেলান দিয়ে শীতের গোধূলিতে বইটি পাঠ করতে থাকলাম। পুরো গ্রন্থে বিয়াল্লিশটি কবিতা রয়েছে। প্রতি পৃষ্ঠায় একটি করে তন্কা কবিতা। সংখ্যার বিচারে অনেক নয়। গ্রন্থের কোথাও কোনও ভূমিকা নেই, এমনকি প্রকাশের কোনও তারিখও নেই। শুধু সাদা কাগজের ওপর কালো অক্ষরে ছাপা তন্কা।

আমি আশা করিনি যে কবিতা-সাহিত্যের সেরা কবিতাগুলো আমার কাছে এসেছে। গ্রন্থটির প্রতি আমার আগ্রহ আছে, এই যা। কয়েক দিন আগে যে মেয়েটি আমার কানের কাছে কয়েকজন যুবকের নাম আওড়েছিল, কামড়ে ধরেছিল টাওয়েল, তার কাছ থেকে কোনও ধরনের কবিতা এসেছে। তবে পাঠের পর কয়েকটি কবিতা আমার ভালো লেগেছে।

তন্কা ছিল আমার কাছে রহস্যময় (তখনও ছিল, এখনও)। ফলে, কোনও তন্কা সবচেয়ে ভালো সে সম্পর্কে মতামত দেওয়া আমার পক্ষে কঠিন। এমনকি কোনটা নিম্ন মানের সেটা বলাও সম্ভব নয়। তবে শিল্পমূল্য বিচারে সে যে কটি তন্কা কবিতা লিখেছে তার মধ্যে অন্তত আটটি কবিতা আছে যেগুলো আমার মন ছুঁয়ে গেছে।

উদাহারণস্বরূপ এই কবিতাটার কথা বলা যায় :

এই মুহূর্ত

যদি এটা বর্তমান মুহূর্ত হয়

শুধুমাত্র নেওয়া যেতে পারে

অক্ষম হিসেবে

পাহাড়ি বাতাসে

কাটা হলো একটা মাথা

কোনও বাক্য ছাড়াই

হাইড্রেঞ্জার ফুলের শেকড়ে

ঢালা হলো জুনের পানি

আশ্চর্যের বিষয় হলো, যখন আমি কবিতার বইটির পাতা খুলে, বড় বড় কালো অক্ষরে ছাপা কবিতা উচ্চস্বরে পাঠ করছিলাম, সেই রাতের মেয়েটির শারীরিক অবয়ব আবার আমার কাছে ফেরত এসেছে। ঠিক সেই সময় যেমন দেখেছিলাম। ভোরের আলোয় আমি তাকে দেখেছিলাম, অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক। আমি তার শরীর যেভাবে বাহুতে ধরেছিলাম, সেই চাঁদনি রাতে, মসৃণ ত্বকে আবৃত মেয়েটিকে। গোলাকৃতির স্তন, ছোট-শক্ত বোটা, যৌনাঙ্গ আবৃত পাতলা গুপ্ত লোম। সে কাম ক্রোধে অস্থির, চোখ বন্ধ করে ফেলে, টাওয়েলে ভীষণ কামড় বসিয়ে দেয়, এবং আমার কানের কাছে বার বার  ডাকতে থাকে আরেকটি ছেলের নাম ধরে। কোন মানুষের নাম আমি ঠিক স্মরণ করতে পারি না।

আমি মনে করি

আমরা আর কখনও দেখা করব না।

আবার আমি এও মনে করি

আমরা পারি না এমন তো কিছু নাই।

আমরা কি আর দেখা করব

নাকি এভাবেই এর শেষ হয়ে যাবে

আলো দিয়ে আঁকা

পদদলিত ছায়ায়।

সে এখন তন্কা লেখে কিনা আমার কোনও ধারণা নাই। আমি আগেও বলেছি, মেয়েটির নামও আমি জানি না। হঠাৎ কোনও এক সময় অনেক কষ্টে তাঁর চেহারাটা মনে করার চেষ্টা করি। আমি কেবল মনে করতে পারি ছাপার অক্ষরে প্রচ্ছদে লেখা ছিল গ্রন্থের নাম ‘ছিহু’। শীতের ফ্যাকাশে আলোয় জানালা দিয়ে জ্বলজ্বল করা তার অরক্ষিত কোমল মাংস, এবং  নাকের পাশে দু’টি ছোট তিলের নক্ষত্রমণ্ডল। 

কোনও কোনও সময় আমার মনে হয় সে বেঁচে নেই। মনে হয় সে নিজের জীবন নিজেই বিসর্জন দিয়েছে। আমি এ কথা বলছি কারণ, তার বেশির ভাগ তন্কা―এমনকি তার গ্রন্থের অনেক তন্কায় মৃত্যুর দৃশ্য চিত্রায়ন করেছে। যার ফলে আমার মনে হয় যে কোনও কারণে সে ব্লেড দিয়ে নিজের মাথা কেটে ফেলেছে। তার নিজের মৃত্যুর জন্য এটাই একটা উপায় হতে পারে।

অবিরাম মুষলধারের

বৃষ্টি হারিয়ে

একটি নামহীন কুঠার

গোধূলির শিরñেদ করে

তবে মনের কোনও এক কোণে, মেয়েটি এখনও এই পৃথিবীর কোথাও বেঁচে আছে এমন আশা পোষণ করি। কখনও কখনও আমি আচম্বিতে নিজেকে এমন প্রবোধ দিই। মনে করি মেয়েটি এখনও কোথাও কবিতা লিখছে। কেন ? কেন আমি এই ধরনের অস্থির একটা চিন্তা ধারণ করছি ? এমন কোনও নিয়ামক নেই যে যা আমাদেরকে আবার এক জায়গায় মিলিয়ে দিবে। এমনকি, যদি মনে করো আমি আর সেই মেয়েটি এখন একই রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাই, কিংবা কোনও রেস্টুরেন্টে যদি আমরা পাশাপাশি টেবিলেও বসি, আমার মনে হয় না আমরা একে অপরকে চিনতে পারব। যেন দুটি সরল রেখা একটি অপরটিকে অতিক্রম করে চলে গেল, এর পর দুজনের পথ বেঁকে গেছে দুদিকে।  

এরপর অনেক বছর কেটে গেল। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো (সম্ভবত খুব বেশি আশ্চর্যেরও নয়) মানুষের বয়স চোখের পলকে কেটে যায়। প্রতিটি মুহূর্ত আমাদের দেহ এগিয়ে চলে একটি পথে জীবনের পরিসমাপ্তি কিংবা ধ্বংসের দিকে, সেখান থেকে ফিরে আসার কিংবা ঘড়ির সময় ঘুরিয়ে দেওয়ার কোনও সুযোগ নেই। আমার চোখ বন্ধ করলাম, আবার চোখ খুললাম, এই সময়ের মধ্যে আমি অনুভব করলাম অনেক কিছুই চোখের সামনে থেকে মিলিয়ে গেছে। মধ্যরাতে তীব্র বাতাসের তোড়ে সেই জিনিসগুলো―কিছু নাম কোনও চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে যায়। কেবল রেখে যায় কিছু ক্ষীণ স্মৃতি। তা এমনই স্মৃতি যার ওপর তেমন নির্ভর করা যায় না। কেউ কি নিশ্চিত করে বলতে পারবে অতীতে আমাদের জীবনে কী কী ঘটেছিল ?

আমরা যদি কলুষমুক্ত হই, তাহলে কিছু কথা আমাদের পাশে জেগে রইবে। তারা রাতের অন্ধকারে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে, হামাগুড়ি দিয়ে চিকন সুড়ঙ্গে তাদের শারীরিক অবয়ব ঠিক করে নেয়, স্থির নীরবতায় বসে থাকে, এবং ঝড়ো হাওয়ায় অতীতের ঘা মোছার সময় নেয়। অবশেষে ভোর নামে, থেমে যায় বুনো ঝড়, এবং বেঁচে থাকা শব্দগুলো ভূপৃষ্ঠ থেকে উঁকি দেয়। বেশির ভাগ সময় তাদের কণ্ঠস্বর থাকে ক্ষীণ―তারা নাজুক প্রকৃতির, নিজেকে প্রকাশে তাদের অবস্থান অস্পষ্ট। তারপরও তারা সাক্ষী হওয়ার জন্য প্রস্তুত। সৎ এবং নিষ্ঠাবান সাক্ষী। কিন্তু যাতে সহিষ্ণুতা তৈরি করা যায়, তৈরি করা যায় দীর্ঘস্থায়ী শব্দ, অন্যথায় তাদের খুঁজে বের করতে, এবং তাদের পিছনে রেখে যেতে, তোমাকে অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে, কোনও শর্ত ছাড়াই, তোমার নিজস্ব অবয়ব কিংবা তোমার নিজের হৃদয়। তোমার নিজের ঘাড়ে শুয়ে থাকতে হবে শীতার্ত চাঁদের আলোয় ঠান্ডা পাথরের বালিশে।

আমি ছাড়া, এই নশ্বর পৃথিবীতে আর কোনও মনের মানুষ নেই, যে মেয়েটির কবিতার কথা মনে রাখবে, কিংবা একা একা কবিতাগুলো পাঠ করবে। প্রচ্ছদে ব্যতিক্রমী ২৮ নম্বর দেওয়া, পাতলা ছোট স্ব-প্রকাশিত সুতা দিয়ে বাঁধানো গ্রন্থটি, এখন বিস্মৃত, বৃহস্পতি এবং শনি গ্রহের মধ্যবর্তী রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেল, অদৃশ্য হয়ে গেল চিরতরে। সম্ভবত মেয়েটি নিজেও (অনুমান করি মেয়েটি এখনও বেঁচে আছে) সেই তরুণ বয়সে লেখা কবিতাগুলোর কথা মনে করতে পারবে না। হয়তো আমি এখনও তার কিছু কবিতা মনে করতে পারব, এর কারণ, টাওয়েলে তার তীক্ষè দাঁতের কামড়। এটাই প্রধান কারণ। আমি জানি না সেই সব স্মৃতি মনে করার মধ্যে কতটুকু অর্থ ও মূল্য রয়েছে। কখনও কখনও আমি ড্রয়ার থেকে পুরনো ফ্যাকাশে কবিতা সংগ্রহটি বের করে বারবার পাঠ করতে থাকি। সত্য বলতে কি, আমি কেন পাঠ করি কিছুই জানি না।

যে কোনও মূল্যে, যেসব অবশিষ্ট ছিল, যখন অন্য শব্দ এবং স্মৃতিরা ধূলিকণায় পরিণত হয়ে, অদৃশ্য হয়ে যায়।

যদি তুমি এটা কাটো

কিংবা অন্য কেউ কাটে

তুমি যদি ঘাড় রাখো পাথরের বালিশে

বিশ্বাস করো―তুমি ধুলো হয়ে যাবে।

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত    

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button