অনুবাদ গল্প : পোশাক : ডিলান টমাস
বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প
মূল : ডিলান টমাস
বাংলা অনুবাদ : বিকাশ গণ চৌধুরী
[ডিলান টমাস, জন্ম : ২৭ অক্টোবর, ১৯১৪; মৃত্যু : ৯ নভেম্বর, ১৯৫৩। নাটক, গল্প লিখলেও মূলত কবি। জন্মেছিলেন ওয়েলস্-এর সোয়ানসিতে। বায়রনীয় মেজাজে কাটিয়েছেন জীবন, শুরু থেকে শেষ; আর আমাদের মধু-কবির মতোই ছিল সুরা পানে আসক্তি জীবনভর। বলতেন : ‘জীবন খুব সুন্দর, এটা বুঝি’। বিশ্বাস করতেন : ‘যদিও প্রেমিকারা হারায়, তবু থেকে যায় ভালোবাসা, এবং মৃত্যুর কোনও ক্ষমতা থাকে না’। কবির গদ্য আমাদের সবসময়ই এক রহস্যবিতানের অন্দরে নিয়ে যায়। হে পাঠক আসুন, এ গল্প পড়তে পড়তে শতবর্ষে পৌঁছানো কবির সঙ্গে আমরা পথ হাঁটি…]দুদিন ধরে তারা ওকে অনুসরণ করছে দেশের এমাথা থেকে ওমাথা, কিন্তু ছোট পাহাড়টার কাছে এসে ও ওদের হারিয়ে দিল, আর একটা সোনালি ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে শুনতে পেল কিছু একটা হারাবার বিরক্তিতে চিৎকার করতে করতে ওরা উপত্যকা বেয়ে নিচে নেমে যাচ্ছে। পাহাড়শিরার একটা গাছের পেছন থেকে উঁকি মেরে ও দেখল নিচে মাঠে, যেখানে ওরা কুত্তার মতো ছোটাছুটি করছে, তাদের লাঠিগুলো দিয়ে খোঁচাচ্ছে সব ঝোপঝাড় আর ছড়িয়ে দিচ্ছে রাগের একটা হালকা ঘড়ঘড়ানি, আর ঠিক তখনই হঠাৎ বসন্তের আকাশ থেকে নেমে আসা একটা কুয়াশা তার দৃষ্টি থেকে তাদের লুকিয়ে ফেলল। কিন্তু কুয়াশাটা তার কাছে ছিল মায়ের মতো, তার কাঁধের ওপর যেন একটা কোট রেখেছিল যেখানে তার শার্টটা ছেঁড়া ছিল আর তার ধারের দিকে লেগে ছিল শুকনো রক্ত। কুয়াশাটা তাকে উষ্ণতা দিচ্ছিল; ঠোঁটে কুয়াশার ছোঁয়ায় ও খাবার আর পানীয়ের স্বাদ পাচ্ছিল, আর ঐ ঘেরাটোপের মাঝখান থেকে ও বিড়ালের মতো হাসল। উপত্যকার দিক থেকে ও চলতে শুরু করল ঘন গাছপালাদের দিকে যা হয়তো ওকে নিয়ে যাবে আলো আর আগুনের দিকে, সুরুয়ার গামলার দিকে। ও ভাবছিল সেইসব কয়লার কথা যারা হাঁপরের ঝাঁঝরির মধ্যে হিস্হিস্ করছিল, ভাবছিল তার একলা দাঁড়িয়ে থাকা তরুণী মায়ের কথা, তাঁর চুলের কথা, ওর হাতের মাপের এক পাখির নীড়ের কথা যা ঐ চুল দিয়ে গড়া যাবে। গাছপালার মধ্য দিয়ে ও দৌড়ে গেল আর নিজেকে আবিষ্কার করল সরু একটা রাস্তায়। কোন দিকে ওর যাওয়া উচিত; চাঁদের আলোর দিকে না চাঁদ থেকে দূরে ? কুয়াশা গোপন ক’রে রেখেছে চাঁদের অবস্থান, কিন্তু আকাশের এক কোণে, যেখানে কুয়াশা একটু সরে গিয়েছে সেখানে ও দেখতে পেল নক্ষত্রের দেবদূতদের। উত্তরে, যেখানে সেই নক্ষত্ররা ছিল, ও চলতে শুরু করল, বিড়বিড় করতে থাকল সুর ছাড়া একটা গান, শুনতে থাকল নরম মাটিতে তার পায়ের ঢুকে যাওয়া আর বেরিয়ে আসার শব্দ।
এতক্ষণে ওর সময় হলো ভাবনাগুলোকে একটু গুছিয়ে নেওয়ার, কিন্তু যেই ও সেগুলোকে গুছিয়ে তুলতে যাবে, রাস্তার ওপর ঝুলে থাকা একটা গাছের মধ্যে থেকে একটা প্যাঁচা ডেকে উঠল, আর ও ঐ আওয়াজের ভিতর একটা পারস্পরিক বিষাদ খুঁজে পেয়ে থেমে গিয়ে চোখ পিট্পিট্ করে প্যাঁচাটার দিকে এগিয়ে গেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছোঁ মেরে একটা ইঁদুর ধরল প্যাঁচাটা। এক মুহূর্তের জন্য ও প্যাঁচাটাকে দেখল, তখন ওটা ডালে বসে কর্কশ শব্দ করছে; তারপর ভয় পেয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগল, আর অন্ধকারে আরও কয়েক গজ যেতেই আরেকটা চিৎকার দিয়ে প্যাঁচাটা উড়ে গেল। বেচারা খরগোস, ও ভাবল, বেজিটা ওকে গিলে ফেলবে। রাস্তাটা নিচু হয়ে নক্ষত্রদের দিকে চলেছে আর ফিকে হয়ে আসছে পিছনে ফেলে আসা গাছপালা, উপত্যকা আর বন্দুকের স্মৃতি।
ও পায়ের আওয়াজ শুনতে পেল। বৃষ্টিতে উজ্জ্বল এক বৃদ্ধ যেন কুয়াশা ফুঁড়ে বেরিয়ে এল।
বৃদ্ধ বলল, ‘শুভ রাত্রি’।
পাগলটা বলল, ‘ভদ্রলোকদের জন্য এটা কোনও রাতই নয়’।
বৃদ্ধ শিস দিল, তারপর আধা দৌড়ে রাস্তার ধারের গাছগুলোর দিকে দ্রুত মিলিয়ে গেল।
শিকারি কুকুররাই জানতে পারুক, সেই পাগল লোকটা পাহাড়ে চড়ার সময় মনে মনে হাসছিল, শিকারি কুকুররাই জানতে পারুক, আর শেয়ালের দক্ষতায় ও দ্রুত সেখানে পৌঁছল যেখানে সেই কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তাটা তিনদিকে তিনটে রাস্তা হয়ে চলে গেছে। চুলোয় যাক নক্ষত্ররা―এই বলে ও অন্ধকারের দিকে হাঁটা লাগাল।
ওর পায়ের নিচে অবিকল বলের মতো একটা পৃথিবী; ও দৌড়ালে ওতে লাথি পড়ে, ওটা ওঠাপড়া করতে থাকে, গাছেরা সামনে এসে দাঁড়ায়। দূরে চোরা শিকারিদের একটা কুকুর তার পায়ের সামনে একটা ফাঁদ দেখে তীব্র চিৎকার করছে, আর তা শুনে ও জোরে দৌড়তে লাগল এই ভেবে যে, ওর পেছনেই আছে শত্রুরা। ‘মাথা নিচু করে দৌড়াও, হে বালক, মাথা নিচু করে দৌড়াও’, ও বলতে থাকল, আর বলতে থাকল এমন এক গলায় যেন খসে পড়া একটি নক্ষত্রকে ও কথাটা বলছে।
হঠাৎ ওর মনে পড়ল যে পালাবার পর থেকে ও ঘুমায়নি, আর এ কথা মনে পড়তেই ও দৌড়ানো বন্ধ করল। এখন বৃষ্টির জলের ফোঁটাগুলো, মাটিকে আঘাত করতে করতে যারা ক্লান্ত, পড়েই যারা ভেঙ্গে যাচ্ছে, উড়ে যাচ্ছে হাওয়ায়, বালুমানুষের অণুকণার মতো। যদি ও ঘুমের দেখা পেত তাহলে ঘুম হতো এক মেয়ে। গত দু’রাত্রি ধরে ধু-ধু ন্যাড়া দেশের মধ্য দিয়ে হাঁটবার বা দৌড়াবার সময় ও স্বপ্ন দেখেছিল তাদের মিলনের। তার জামাটা বিছিয়ে দিয়ে মেয়েটা হয়তো বলতে পারে, ‘শুয়ে পড়ো’, আর টানটান হয়ে শুয়ে পড়তে পারে তার পাশে। যদিও ও স্বপ্ন দেখছিল আর অনুভব করছিল ওর পায়ের নিচে একটা খচর-মচর শব্দ, অনেকটা সেই মেয়েটার জামার খসখসানির মতোই। শত্রুরা মাঠে চিৎকার করছে। ঘুমকে অনেক পেছনে ফেলে ও এক নাগাড়ে দৌড়াতে লাগল। দমছুট হয়ে পড়ার আগে, কখনও সূর্য, কখনও চাঁদ আর কখনও বা কালো আকাশের নিচে বাতাসকে নিয়ে লোফালুফি খেলছিল ও।
জ্যাক কোথায় ? ও যেখান থেকে পালিয়েছিল সেই বাড়ির বাগানে দাঁড়িয়ে ওরা প্রশ্ন করছিল। ‘একটা কসাইয়ের ছুরি নিয়ে ওই পাহাড়ের ওপরে’, মৃদু হেসে ওরা বলল। কিন্তু ছুরিটা আর নেই, একটা গাছে ওটা ছোড়া হয়েছিল আর সেটা এখনও ওখানেই কাঁপছে। ওর মাথায় কোনও বায়ু চড়ে নাই। ও কেবলই দৌড়াচ্ছে, আর দৌড়াচ্ছে, ঘুমের জন্য চিৎকার করছে।
আর মেয়েটা, বাড়িতে একদম একা, ও তার নতুন পোশাক সেলাই করছিল, একটা উজ্জ্বল দেশি পোশাক, যার সারা গায়ে ফুল আর ফুল। পরবার আগে আর কয়েকটামাত্র সেলাই বাকি। ওর কাঁধের ওপর সুন্দরভাবে থাকবে এই জামা, আর জামাটার ফুলদুটো যেন বেড়ে উঠবে ওর স্তনদুটি থেকে।
রবিবারের সকালগুলোয় ও যখন ওর বরের সঙ্গে গ্রামের ভিতর মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটবে, তখন ছেলেরা ওর দিকে তাকিয়ে হাত দিয়ে মুখ ঢেকে হাসবে আর বিধবারা কথা বলবে ওর পেটের ওপরের পোশাকের কাঁট-ছাট নিয়ে। ওর নতুন পোশাকটা পরে ও ফায়ারপ্লেসের ওপর রাখা আয়নার দিকে তাকাল, দেখল, ও যেরকমটা ভেবেছিল তার থেকেও সুন্দর হয়েছে পোশাকটা। পোশাকটা ওর মুখটাকে আরও ফ্যাকাশে আর লম্বা চুলগুলোকে আরও মেঘাচ্ছন্ন করে তুলেছে। ও ওটাকে কেটে আরও একটু ছোট করে ফেলল।
রাতে বাইরে একটা কুকুর মুখ তুলে ডাকছিল। ও ঝট্ করে নিজের প্রতিবিম্ব থেকে মুখ ফিরিয়ে নিল, আর পর্দাগুলোকে টানটান করে টেনে দিল।
বাইরে রাতের অন্ধকারে ওরা ওই পাগল লোকটাকে খুঁজছিল। বলাবলি করছিল, লোকটার চোখদুটি সবুজ আর ও একটা বিয়েও করেছিল। ওরা বলছিল, লোকটা নাকি ওর বউয়ের ঠোঁট দুটি কেটে নিয়েছিল। কারণ ওর বউ লোকজনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি মিষ্টি হাসত। ওরা ওকে দূরে নিয়ে রেখেছিল, কিন্তু ও রান্নাঘর থেকে একটা ছুরি চুরি করে ওর দেখাশোনা করত যে লোকটা তাকে ছুরি মেরে জঙ্গুলে উপত্যকাটায় বেরিয়ে পড়ে।
দূর থেকে ও বাড়িটার ভিতর আলো দেখতে পেল আর টলতে টলতে বাগানটার ধারে এসে দাঁড়াল। ওর মনে হলো বাগানঘেরা ছোট্ট বেড়াটা ও দেখতেই পাচ্ছে না। মরচে পরা তারে ঘসে যেতে লাগল ওর হাত আর ভেজা, বীভৎস সব ঘাস গুঁড়ি মেরে ওর হাঁটু বেয়ে উঠছিল। আর একসময় ও যখন ঐ বেড়া ভেঙ্গে বাগানের মধ্যে, তখন মাথাভরা ফুল আর তুষার শরীরের বাগানরক্ষকরা ওর সঙ্গে দেখা করতে এল। ও ছিঁড়ে ফেলতে লাগল ওর আঙুল, তখনও ওর পুরোনো ক্ষতগুলো শুকোয়নি। একটা রক্তের মানুষের মতো পায়ে পায়ে ও শত্রুদের অন্ধকার থেকে বেরিয়ে এল। ফিসফিস করে বলল : ‘ওরা আমাকে যেন গুলি না করে’। তারপর দরজাটা খুলল।
ঘরের মাঝখানে ছিল মেয়েটা। ওর চুল আলুথালু আর গলার কাছে তিনটে বোতাম খোলা। কী কারণে ডাকছিল কুকুরটা ? কুকুরের ডাক শুনে ভয়ে, আর যেসব গল্প ও শুনেছিল সেগুলো ভাবতে ভাবতে মেয়েটা ওর চেয়ারে বসে দুলছিল। কী হয়েছিল সেই মহিলার? দোল খেতে খেতে ও অবাক হয়ে যাচ্ছিল। ঠোঁটহীন কোনও মহিলার কথা ও ভাবতেও পারে না। ঠোঁটছাড়া মহিলাদের কী হয় ? ভেবে ভেবে ক্রমশ অবাক হয়ে যাচ্ছিল ও।
দরজাটা কোনও আওয়াজ করল না। লোকটা ঘরের মধ্যে এসে দাঁড়াল, মৃদু হাসবার চেষ্টা করল, আর বাড়িয়ে ধরল তার দুটি হাত।
‘ওহ্, তুমি ফিরে এসেছো’, মেয়েটা বলল।
তারপর চেয়ারে ঘুরে বসে ও লোকটাকে দেখল। লোকটার সারা শরীরে রক্ত, এমনকী ওর সবুজ চোখেও। মেয়েটা নিজের মুখের মধ্যে আঙুল ঢুকিয়ে দিল। লোকটা বলল : ‘গুলি করো না’।
কিন্তু হাত নাড়ানোয় মেয়েটার গলার কাছ থেকে ওর পোশাকটা সরে গেল, আর এক বিস্ময়চাউনিতে লোকটা দেখতে থাকল মেয়েটার চওড়া কপাল, তার ভীত-সন্ত্রস্ত দুটি চোখ আর মুখ, আর তার ঠিক নিচেই পোশাকের সব কটা ফুল। মেয়েটার হাতের নাড়া খেয়ে ওর পোশাকটা আলোয় নেচে উঠল। আর সামনে এসে বসল মেয়েটা, ফুলে ফুলে ঢাকা। ‘ঘুমোও’, পাগলটা বলল। আর নতজানু হয়ে বিহ্বল হয়ে মাথাটা নামিয়ে মেয়েটার কোলের ওপর রাখল।
সচিত্রকরণ : কাব্য কারিম