অনুবাদ গল্পআর্কাইভবিশ্বসাহিত্য

অনুবাদ গল্প : না মেটার ক্ষুধা : ফণীশ্বরনাথ রেণু

বিশ্বসাহিত্য : অনুবাদ গল্প

মূল : ফণীশ্বরনাথ রেণু

মূল হিন্দি থেকে বাংলা অনুবাদ : সফিকুন্নবী সামাদী

[ফণীশ্বরনাথ রেণু (১৯২১-১৯৭৭) মুন্সি প্রেমচন্দের পর হিন্দি কথাসাহিত্যের সবচাইতে প্রভাবশালী লেখক। সতীনাথ ভাদুড়ীর সঙ্গে গভীর বন্ধুত্বের কারণে বঙ্গদেশে তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। কেউ কেউ তাঁকে সতীনাথ ভাদুড়ীর ভাবশিষ্যও বলে থাকেন। ময়লা আঁচল উপন্যাসের কারণে তাঁর পরিচিতি বাড়লেও তিনি কিছু অসাধারণ ছোটগল্প লিখেছেন, লিখেছেন স্মৃতিকথা এবং রিপোর্টাজ। গ্রামীণ ভারতের, বিশেষত বিহার অঞ্চলের হতদরিদ্র মানুষের জীবন এবং দারিদ্র্য-বঞ্চনাকে তুলে ধরবার জন্যে তিনি সমাদৃত হয়েছিলেন সাহিত্যিক সমাজে।]

আ টটা বাজছে। দিদি বিছানায় পড়ে চুপচাপ অপলক তাকিয়ে আছেন ছাদের দিকে। তার চুল বালিশের ওপর ছড়িয়ে আছে, এদিক-ওদিক ঝুলে আছে। একটা মোটা বই নিচে চপ্পলের কাছে উপুড় হয়ে না জানি কখন থেকে পড়ে আছে। বুধনীর মা পা টিপে টিপে ঘরের কাছে আসে আর উঁকি দিয়ে চুপচাপ চলে যায়। আটটা পর্যন্ত বিছানার ওপর রোগীর মতো চুপচাপ পড়ে থাকা, মৌনতাসাধন, করুণ মুদ্রা করে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ইত্যাদি ব্যাপার এমন এক আবহ সৃষ্টি করছে যে বুধনীর মায়ের কিছু জিজ্ঞাসা করবার সাহস হচ্ছে না। বেচারি হাতে ঝাড়ু নিয়ে বারবার ফিরে যাচ্ছে। শেষে ছোট দিদি মিস ফ্লোরাকে গিয়ে সে বলে, ‘দিদির কী হলো, এখনও পড়ে আছে। কিন্তু…’

‘বড় মুশকিল বুধনীর মা। কাল থেকেই তার এই অবস্থা। খাওয়াদাওয়া করে না আর কিছু বলেও না। জিজ্ঞাসা করলে বলে, কিছুই হয়নি। বেশি কিছু জিজ্ঞাসা করতে সাহসও তো হয় না।’ মিস ফ্লোরা চুলে চিরুনি চালাতে চালাতে বলে।

‘সকাল থেকে ঝাড়ু দেবার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। একটু গিয়ে…’ বুধনীর মা কথা শেষ করতেও পারে না, দিদির প্রিয় ছাত্রী চঞ্চলা কিশোরী মদালসা মুখ ভার করে এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে মিস ফ্লোরা এবং বুধনীর মায়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। বুধনীর মা প্রসন্ন হয়ে বলে, ‘এই যে! চলো তো রানি! দেখো তো তোমার দিদির কী হলো!’

মদালসা চুপচাপ দিদির ঘরে প্রবেশ করে। দিদি অপলক দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বুধনীর মা চৌকাঠের কাছেই দাঁড়িয়ে থাকে।

‘দিদি!’ মদা অনেকক্ষণ চুপ থাকবার পর ডাকে।

‘হুঁ।’

‘শরীর কেমন আছে দিদি ?’

‘হুঁ…’ দিদি নড়াচড়া না করেই উত্তর দেন।

বুধনীর মা প্রথমে বারান্দায় দুয়েকবার ছপ ছপ করে ঝাড়ু চালায়, তারপর ভয়ে ভয়ে ঘরে এসে হালকা হাতে ঝাড়ু দিতে শুরু করে। মদালসা দিদির টেবিলের ওপর ছড়িয়ে থাকা বইগুলো সাজিয়ে রাখতে থাকে। ক্যালেন্ডারে তারিখ বদলে দিনও বদলে ফেলে সে, দিদি চুপচাপ দেখছে।

‘আজ কি সোমবার হয়ে গেছে নাকি ?’ দিদি বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞাসা করেন। মদালসা ভয় পায়, একবার ক্যালেন্ডারের দিকে দেখে সে বলে, ‘জী, না।’ সে দিন বদলাচ্ছিল, আবার মনে করে থেমে বলে, ‘জি আজ সোমবারই। কাল রবিবার ছিল, আজ সোমবার…’

‘সোমবার হয়ে গেছে ?’ দিদি উঠে বসে যান, বলেন, ‘তো বরযাত্রীরা চলে গেছে ?’

‘হুঁ, ভোর চারটায় চলে গেছে সবাই।’ বুধনীর মা ঝাড়ুর কাঠি সাজাতে সাজাতে বলে।

দিদি ভয়ে ভয়ে বিছানার পাশের স্কুলের দিকের জানালা খুলতে থাকেন। জানালা খুলে দেখেন, স্কুল শূন্য পড়ে আছে। দু দিন ধরে বন্ধ থাকা জানালা খুলতেই ঘরে এক তাজা হওয়া এসে খেলা করতে থাকে। সে আড়মোড়া ভেঙে ওঠে, তার চেহারার গম্ভীরতা তখনই দূর হয়ে যায়। মদালসার ঠোঁটেও হাসির একটি সরল রেখা দৌড়ে যায়, বুধনীর মায়ের কিছুটা সাহস হয়, জিজ্ঞাসা করে বসে, ‘শরীর কেমন দিদি ?’

‘ভালো, তুই শীঘ্র গিয়ে স্কুলের ঘরগুলোকে ঝেড়ে-মুছে দে। না হয় ফুলিয়াকেও ডেকে নিস। ভগেলুকে বলে দে, গাড়িতে আজ সরযু যাবে। ভগেলু ক্লাসে বেঞ্চ সাজিয়ে রাখবে। যা!’ বলতে বলতে তোয়ালে আর শাড়ি নিয়ে বাথরুমের দিকে এগোন। মদালসা বলে, ‘দিদি!’

‘কী রে ?’ দিদি থেমে মৃদু হেসে বলেন।

‘আপনি গেলেন না, ইন্দু অনেক কেঁদেছে, বলল, দিদির সঙ্গে দেখা হলো না।’ পেন্সিল কাটারে পেন্সিল ঢুকিয়ে ঘুরাতে ঘুরাতে মদালসা বলে। দিদি উত্তরে কেবল এক দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন।

‘আপনি ওকে উপহার দেবার জন্য একটা চিত্রও আঁকছিলেন না ?’

‘আঁকছিলাম তো, কিন্তু অসমাপ্ত থেকে গেছে। আচ্ছা পাঠিয়ে দেব,… আমার অনেক বড় ভুল হয়ে গেছে মদা, যাবার দিন ওর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি।’ বলতে বলতে দিদি ধীরে ধীরে চলে যান।

মদা ওখানে বসেই দিদির অ্যালবাম দেখতে থাকে।

শ্রীমতি ঊষা দেবী উপাধ্যায় ওরফে দিদিজী। শহরের গার্লস মিডল ইংলিশ স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। মাঝারি দৈর্ঘ্যের হালকা-পাতলা সুন্দরী বিধবা যুবতী। যেদিন থেকে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা হয়ে এসেছেন, স্কুলের উন্নতি হতে শুরু করেছে দ্রুত গতিতে। ছাত্রীর সংখ্যা চারগুণ হয়েছে। পরীক্ষার ফল ভালো হতে শুরু করেছে। স্কুলকে হাই স্কুলে উন্নীত করার আলোচনা শুরু হয়েছে। এই হালকা-পাতলা মৃদুভাষিণী দিদির মিঠা চাপড় যে বালিকা একবার খেয়েছে, সে তার আজ্ঞাবহ হয়ে গেছে। বালিকা এবং কিশোরী ছাত্রীদের কথা দূরে থাক, শিক্ষিকারাও তার স্নেহের কাঙাল। বুধনীর মা তার প্রাইভেট সেক্রেটারি। সদাপ্রসন্ন দিদির ঠোঁটে সর্বদা হাসি খেলতে থাকে। সে কখনও-কখনও সেতার বাজিয়ে মীরার পদাবলি গায়, আঁকাবাঁকা রেখায় শৈল্পিক চিত্রও আঁকে। বিধবা মানুষ, কাপড়চোপড় এবং খাওয়া-দাওয়ায় বিষয়ে সারল্যের কঠিন নিয়ম পালন করেন। কিন্তু অন্য শিক্ষিকা যারা সধবা, তারাও তার সারল্যের ভক্ত।

স্নানাহার করে দিদি অন্য শিক্ষিকাদের সঙ্গে যখন স্কুলে প্রবেশ করেন, বুধনীর মা ফুলিয়াকে নিয়ে ঘর ঝাড়ু দিচ্ছিল আর বিড়বিড় করছিল। ভগেলু চুপচাপ বেঞ্চ তুলে-তুলে ঘরে নিচ্ছিল। দিদিকে দেখতেই বুধনীর মা জোরে জোরে চিৎকার করে বলতে থাকে, ‘ছি ছি! একদিনে শুয়োরের খোঁয়াড় করে দিল সব… রাম রাম…!

দিদি ঘরের ভেতর গিয়ে দেখে, দেয়ালের জায়গায় জায়গায় পানের পিক লেগে আছে। নিচে মেঝেতে আধজ্বলা সিগারেটের টুকরো, সিগারেটের খালি কৌটো, দেশলাইয়ের পোড়া কাঠি ছড়িয়ে আছে। দিদি কিঞ্চিৎ নাক কুঁচকে বলে, ‘নে, শীঘ্র পরিষ্কার কর।’ বলে অফিস খুলতে যায়। সে অফিস খুলছিল, এমন সময় তার চোখ দেয়ালের ওপর সুন্দর অক্ষরে আটকে যায়।

‘ওঠ সজনী খোল কেওয়াড়, তোমার প্রেমিক আসে দুয়ার।’

অন্য জায়গায় ‘তোমার জানালা বন্ধ ছিল কিন্তু আমি তোমায় দেখে নিয়েছি।’

লাল অক্ষরে ‘রানি এবার শিক্ষকতা ছাড়ো, আমার হৃদয়ের রাজত্ব সামলাও।’

নীল পেন্সিলে ‘প্রেমের ভাষা সজনী, আমাকেও পড়িয়ে দাও।’

পড়তে পড়তে দিদি পীড়ায় অধীর হয়ে ওঠেন। অফিস খুলে ধম করে চেয়ারে বসেন। তার ঠোঁটে কয়েক ঘণ্টা আগে যে স্বাভাবিক হাসি ফিরে এসেছিল তা বিলীন হয়ে যায়। তিনি ওঠেন, আবার বসে পড়েন। একটা কাগজ বের করে লিখতে শুরু করে, ‘বরাবর চেয়ারম্যান’। তারপর না জানি কী ভেবে কাগজ ছিঁড়ে  উঠে দাঁড়িয়ে যান।

‘ফ্লোরা!’ দিদি ডাকেন।

ফ্লোরা আর উর্দু শিক্ষিকা সালমা আসে, দিদির গম্ভীর মুদ্রা দেখে অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।

‘কী দিদি ?’ ফ্লোরা মৌনতা ভঙ্গ করে জিজ্ঞাসা করে।

দিদি বাইরে এসে দুজনকেই দেয়াল দেখান। দুজনেই পড়ে ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে ফেলে। সালমা বলে, ‘এসব বরযাত্রীদের কাজ!’

‘হুঁ’, দিদি বলেন, ‘সভ্য বরযাত্রীগণ লিখেছেন।’

মেয়েরা দল বেঁধে হাসতে হাসতে আসছে। সরযুও স্কুলের গাড়িতে মেয়েদের নিয়ে চলে এসেছে।

‘প্রণাম দিদিজী, দিদিজী প্রণাম, প্রণাম…’ বলে হাসতে হাসতে মেয়েদের দল যেই স্কুলের সিঁড়িতে পা রাখতে শুরু করে, দিদির গম্ভীর বাণী শুনে সকলে একসঙ্গে থেমে যায়।

‘কিছুক্ষণ বাইরে মাঠে দাঁড়িয়ে থাকো।’

দিদি এবং শিক্ষিকাদের চেহারা দেখে মেয়েরা নিজেদের মধ্যে কানাকানি করতে থাকে, ‘দেখো দেখো! দিদির চোখ লাল!’

‘এমন তো কখনও…’

‘বুঝেছি, বুঝেছি…’ মঞ্জু খুশি হয়ে বলে, ‘কোনও বড় মানুষ মারা গেছেন, তারপর ওই পাঁচ মিনিট চুপ…’

‘ফ্লোরা! রোলকল করে ছুটি দিয়ে দাও।’ বলতে বলতে দিদি পুনরায় অফিসে গিয়ে বসেন।

ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়। ছাত্রীরা বুধনীর মাকে জিজ্ঞাসা করে, মদালসার নিকট অনুসন্ধান করে, কিন্তু কিছুই জানতে পারে না।

দিদি নিজের ঘরে ফিরে আসেন এবং বিছানায় শুয়ে পড়েন। তার ভেতর যেন এক আগুন জ্বলছে, মাথা ফেটে যাচ্ছে আর থেকে থেকে পিপাসা লাগছে।

শনিবার শহরের প্রতিষ্ঠিত অভিজাত শ্রী আনন্দী প্রসাদজীর ওখানে বরযাত্রী এসেছিল। তাঁর একমাত্র কন্যা ইন্দুর শুভ বিবাহ উপলক্ষে স্থানীয় ধর্মশালায় বরযাত্রীদের থাকবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু সভ্য-অসভ্য, সাধারণ-অসাধারণ এবং ধনী-গরিবের বর্গীকরণের দিকে ব্যবস্থাপকেরা খেয়াল করেনি। সভ্য এবং সুসংস্কৃত বরযাত্রীগণ যখন ‘জেনারেল বরযাত্রী’দের সঙ্গে থাকতে অস্বীকৃতি জানান তখন চেয়ারম্যান সাহেবের অনুমতি নিয়ে গার্লস স্কুলেই থাকবার ব্যবস্থা করে দেয়া হয়―সভ্য, শিক্ষিত এবং সুসংস্কৃত বরযাত্রীগণের জন্য।

স্কুলের কম্পাউন্ডেই শিক্ষিকাগণের কোয়ার্টার। রবিবার সন্ধ্যায় অন্য শিক্ষিকাগণ বিয়েবাড়ির সমারোহে যোগ দিতে চলে গিয়েছিলেন, স্কুলের দিকের জানালা বন্ধ করে দিদি নিজের ঘরে বসে অর্ধসমাপ্ত চিত্রটি সমাপ্ত করছিলেন। জানালার ওপাশে স্কুলে সভ্য বরযাত্রীগণের পান-ভোজন শেষ হয়ে গিয়েছিল। এঁটো খাবার নিয়ে কুকুরদের লড়াই, ভিখারি আর ভিখারিনীদের করুণ কান্না শুনে দিদির ধ্যানভঙ্গ হয়। চিত্র অসমাপ্ত রেখেই তিনি না জানি কী ভাবতে থাকেন। ধীরে ধীরে কুকুরের ঘেউ ঘেউ বন্ধ হয়, ভিক্ষুকেরা নিজেদের মধ্যে লড়াই শুরু করে দেয়। লড়াই যখন শান্ত হয়, একটা ছোট্ট শিশুর কান্নার আওয়াজ শোনা যায়। দিদি চিনে ফেলেন অভাগিনী মৃণালের ছেলের কোমল কণ্ঠস্বরকে। ‘ও বাবা এত ঝাল, তাই তো বলি, ছেলে আমার কাঁদছে কেন ?’ মৃণাল খেতে খেতে বলে ওঠে। ‘মৃণালের ছোট শিশু এঁটোর স্বাদ নিতে শুরু করে দিয়েছে।’… দিদি কিছুটা বিস্মিত হন। দিদি মৃণালকে চিনতো, তাকে ভালোবাসতেন, কখনও কখনও ডেকে ভরপেট ভোজন করাতেন আর তার মিষ্টি ছেলেকে কোলে নিয়ে আদর করতো। বাংলার ভুখাদের দলে মৃণাল যখন এই শহরে আসে তখন তার কোলে অথবা দেহে এই শিশু ছিল না। রোজ সন্ধ্যায় কিছু বাসি রুটি পেয়ে তার বদলে মৃণাল দিয়েছে এই শহরকে ওই ভোলাভালা শিশু… যে ঝাল তরকারি খেয়ে কেঁদে উঠেছে। মৃণাল বাংলার এক গ্রামের সুখী কৃষকের কন্যা ছিল।

তো, সেই সন্ধ্যায় বসে বসে দিদি অনেক কথা ভাবছিলেন―কুকুর, মনুষ্য, মৃণাল এবং তার সুন্দর পুত্রের বিষয়ে না জানি কী-কী ভাবতে ভাবতে আরাম-কুরসির ওপর ক্লান্ত হয়ে শুয়ে পড়েছিলেন। স্কুলের বারান্দায় কেউ একজন কোনও সরোজ নামের ব্যক্তিকে ডেকে বলে, ‘সরোজজী! ও! সরোজজী, একটু এদিকে আসুন।’

‘কী ?’ সরোজ কিংবা অন্য কেউ জিজ্ঞাসা করে।

‘দেখুন! এখানকার ভিখারিনীদের চোখেও এক আশ্চর্য জাদু!’ যে ব্যক্তি ডেকেছিল সে দেখায়। দিদির ভ্রƒ একটু টান হয়ে যায় আর কান সতর্ক হয়ে যায়।। দর্শক ব্যক্তি দেখে বলে, ‘ওহো!… ‘জাদু’ বলবেন না, ‘মদ’ বলুন ‘মদ’।’

‘আরে আপনি তো দেখছি কবি।’ প্রথম ব্যক্তি সংশোধনকে স্বীকার করে নেয়। তৃতীয় একটি কণ্ঠ শোনা যায়, ‘আচ্ছা কবিজী! কল্পনা করুন তো, যেখানে সড়কের ওপর এমন ‘পরি’ ঘুরে বেড়ায়, সেখানে জানালা বন্ধ করে বসে থাকা সুন্দরীরা কেমন হবে ?’

এই কথায় জোরে অট্টহাসি ওঠে আর এই ব্যঙ্গ অট্টহাসির সঙ্গে জানালার কাঠ ভেদ করে দিদির অন্তঃস্থলে ঢুকে যায়।

সে রাতেই তিনটা পর্যন্ত স্কুলের বারান্দায় আঙ্গুরীবাঈ নাচতে থাকে। নূপুরের ছমছম, বেদনাভরা আওয়াজ আর ‘বাহ! বাহ! কি চমৎকার!’ শুনতে শুনতে দিদি বালিশে মুখ লুকিয়ে কেঁদেছেনও। পরদিনও তিনি বিছানার ওপর নিশ্চেষ্ট পড়ে ছিলেন। বিছানা থেকে উঠতেই তার মাথা ঘুরছিল। এক রাতেই না জানি কত দুর্বল হয়ে যান। রবিবার সন্ধ্যাতেই আঙ্গুরীবাঈ গেয়ে উঠেছিল, ‘অন্ধেরিয়া হ্যায় রাত সজন…।’ (অন্ধকার রাত, প্রিয়তম…।)

‘আরে ভাই! ভালো কাজে জিজ্ঞাসা করবার কী আছে…’ প্রেমিকদের মধ্যে একজন বলে, অন্য প্রেমিকেরা জবরদস্ত অট্টহাসি তোলে।

‘চুন চুন কলিয়াঁ সেজ বিছাঈ…’ (ফুলকলিদের একত্র করে শয্যা বিছিয়েছি…)

‘মজাদার…’

অট্টহাসির ঘূর্ণিবাত্যায় দিদি জ্ঞানশূন্য হয়ে যান, আঙ্গুরীবাঈ গাইতেই থাকে।

…সোমবার রোলকলের পর ছুটি দিয়ে যখন তিনি ফেরেন, তার ভেতর যেন এক আগুন জ্বলছে, মাথা ফেটে যাচ্ছে আর থেকে থেকে পিপাসা লাগছে।

একদিনেই জ্বর ভীষণ রূপ ধারণ করে। লেডি ডক্টর আসে, প্রেসক্রিপশন দিয়ে চলে যায় আর ওষুধ চলতে থাকে। মঙ্গলবার সকাল থেকেই প্রলাপের লক্ষণ দেখা দিতে শুরু করে। বিছানার ওপর চঞ্চল হচ্ছেন আর থেকে থেকে বিড়বিড় করে কিছু বলছেন। কখনও কখনও চমকে উঠে বসে পাশে বসে থাকা মদালসাকে জড়িয়ে ধরছেন আর কেঁদে ফেলছে। ‘মদা! লুকিয়ে যাও আমার বেটি… ওই বিড়িওয়ালা… বিড়িওয়ালা!’… বলতে বলতে অজ্ঞান হয়ে বিছানার ওপর লুটিয়ে পড়ছেন।

হ্যাঁ, এক বিড়িওয়ালার প্রায়ই ‘মিস্ট্রেস কোয়াটার’-এর কাছে এসে হৃদয়ে বেদনার উদয় হতো আর সে এই বেদনা দূর না করবার জন্য ঈশ্বরের নিকট প্রার্থনা করে চলে যেত।

দিদি চোখ মেলে এদিক-ওদিক তাকান―মদা, ফ্লোরা, সালমা আর বুধনীর মা করুণ চোখ নিয়ে বসে আছে,… ‘না, ও দাঁড়িয়ে আছে, মৃণাল; ওর কোলে কোমল শিশু! ওই বিড়িওয়ালা!…উঁহ-হুঁ-হুঁ!’

‘দিদি!’ সালমা ডাকে।

দিদি চক্ষু বিস্ফারিত করে দেয়ালের দিকে তাকিয়েই থাকেন―‘মজাদার… হলুদ আঙ্গুরী আর সেই বোবা পাগলী…গর্ভবতী পাগলী হাসছে, হেঁহ-হেঁহ উঁহু হেঁহ উঐঁ…!’

‘হেঁহ-হেঁহ উঁহু হেঁহ উঐঁ’ বোবার মতো দিদিও হেসে ওঠেন।

‘দিদি’ প্রায় কাঁদতে কাঁদতে ফ্লোরা ডাকে। সালমা মাথায় আইসব্যাগ রাখে আর মদালসা পাখা দিয়ে বাতাস করতে থাকে। দিদি চোখ বন্ধ করে ভাবতে থাকেন, ওই পাগলী গর্ভবতী। তাকেও বলাৎকার করা হয়েছে। ছি ছি! ওয়ার, ওয়াইন অ্যান্ড উইম্যান―শরাব, যুদ্ধ এবং নারী… সর্বনাশী জিনিস সব।…‘ওঠ সজনী খোল কেওয়াড় ?’… তিনি আবার চমকে উঠে বসে, বিড়বিড় করে ওঠেন, ‘খুলে দাও সব জানালা…আ…আ…।’ বুধনীর মা ধরে তাকে শুইয়ে দেয়।

‘জানালা তো সব খোলাই আছে।’ সালমা বলে।

দিদি চুপচাপ চোখ বন্ধ করে থাকেন…‘ভরা সভায় দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ… তার করুণ চিৎকার, তাকে উলঙ্গ দেখবার বাসনা…ওহ!’ চোখ বন্ধ করেই নিজের শাড়ির আঁচল ধরে নেয় আর চিৎকার করে ওঠেন, ‘আমি উলঙ্গ হয়ে যাব…আমি উলঙ্গ হয়ে যাব-অ-অ!’

‘দিদি!’ ফ্লোরা, মদা আর সালমা তিনজন প্রায় একই সঙ্গে ডেকে ওঠে। দিদি ঘৃণায় মুখ বিকৃত করে ফেলেন।

ভগেলু লেডি ডক্টরের কাছে গিয়েছিল, ফিরে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। অনেক জিজ্ঞাসা করবার পর ভগেলু বলে, ‘ডক্টরনী সাহেবা রাজা রঘুবীর সিংহের ওখানে যাচ্ছিলেন। আমি গিয়ে দিদির কথা বললে ডক্টরনী সাহেবা বলে…’

‘কী বলেছে ?’ ফ্লোরা ধমক দিয়ে জিজ্ঞাসা করে।

‘বলে যে গিয়ে তোমাদের দিদিকে আরেকটা বিয়ে দিয়ে দাও, সব ঠিক হয়ে যাবে।’

এদিকে বিছানায় পড়ে পড়ে তিনি দেয়ালের দিকে এক দৃষ্টিতে দেখছে, স্কুল কম্পাউন্ডে সেই মৃণাল, উলঙ্গ আঙ্গুরী আর বোবা পাগলী দাঁড়িয়ে। চার দেয়ালের চারিদিকে পুরো শহরের মানুষ―সভ্য-অসভ্য, শিক্ষিত-অশিক্ষিত আর গরিব-ধনী, নিজের নিজের ভাষায় হল্লা করছে―

‘খানিক আমাকে দেখাও আজ সুরত তোমার চিকন কোমরওয়ালী…’

‘তোমার দ্বারে দাঁড়িয়ে কবে থেকে…।’

‘ওঠ সজনী খোল কেওয়াড়…’

‘তিরছি নজরওয়ালী রে!…’

‘ওরে পাগলী…’

‘আরে বাচ্চাওয়ালী ছুড়ি…’

‘ঘোমটা সরিয়ে চাঁদমুখ…’

লোকের ভিড় ক্রমশ উত্তেজিত হচ্ছে। সবাই ফাটকে ধাক্কা দিচ্ছে। আঙ্গুরীবাঈ আঁচল দিয়ে নিজেকে ঢেকে নেয়। মৃণাল কেঁদে ফেলে, তার কোলের বাচ্চা বুকে মুখ লুকিয়ে তার সঙ্গে মিশে যায়। পাগলী হাসছে, হেঁহ-ঐঁ-উঁ অহ-অহ হে-হে…, ফাটক ভেঙে যাবে যেন। ওহ! দিদি চমকে উঠে বসেন। এবার তাকে দেখে মদা, ফ্লোরা আর অন্যরা ভয় পেয়ে যায়! দিদি হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে দৌড়ান।

‘দিদি! দিদি!! দিদি…আরে থামাও, ধরো…’ সকলে পেছনে পেছনে দৌড়ায়। তিনি ‘হেঁহ উঁহ ওয় অহ-অহ’ করে হাসেন আর দৌড়াতে থাকেন। ফাটকের কাছে যেতে যেতে দেয়ালে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যান। জমিনে রক্তের ধারা বয়ে চলে।

দিদি হাসপাতালে শেষ মুহূর্ত গুনছেন। এভারগ্রিন রেস্তোরাঁয় চা খাওয়া নবযুবকেরা নতুন এক মসলা পেয়ে গেছে। চায়ে চুমুক দিতে দিতে এক যুবক বলে, ‘অরুণ! তুমি কিছু শুনেছো… ওর অবস্থা খুব নাজুক দোস্ত!’

‘কিন্তু এমন কেন হলো, কিছু জানা গেছে ?’

‘ভাই, তার বুকেও তো হৃদয় আছে, কেউ তা ছিনিয়ে নিয়ে নিষ্ঠুরভাবে ভেঙে দিয়েছে হয়তো, আর কী ?’

‘শুনলাম বরযাত্রীদের মধ্যে তার কোনও পুরানো প্রেমিক এসেছিল।’

‘তাহলে তো ঠিকই আছে’ একজন গল্প-লেখক যে এতক্ষণ চুপচাপ বসে ছিল, বলে ওঠে, ‘আমিও এরকমই কল্পনা করেছিলাম।’

‘হিঁ-হিঁ ঐহ হে-হে ওয়…’ রেস্তোরাঁর সামনের সড়কে বোবা পাগলী, যে খুব নিকট ভবিষ্যতে মা হবে, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে হাসছে, ‘ঐহ হেঁহ হোঁ…’ হাসতে হাসতে পেটে চাপ পড়ার মুদ্রা করছে।

‘আরে ভাগ, যা শয়তান!’

‘হেঁহ ঐঁ…’ সে প্রত্যেক পদক্ষেপে ভূমির ওপর এক বিশেষ জোর লাগিয়ে হাসতে হাসতে চলে যায়।

সচিত্রকরণ : রাজীব দত্ত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button