আর্কাইভবিশেষ রচনা

১১তম জন্মদিনে শব্দঘর : গুণীজন সংবর্ধনা ও শব্দঘর-নির্বাচিত সেরা বই পুরস্কার ২০২৩ এবং সাহিত্য-আড্ডা : কামরুল হাসান

বিশেষ রচনা : সাহিত্য-উৎসব

সা তটি খাঁকি রঙের কভারে মোড়ানো ভারী সোফা বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মিলনায়তনের অনুচ্চ মঞ্চটি জুড়ে ভারী হয়েই বসে আছে। দেখে মনে হয় সাত বলশালী জাপানি কুস্তিগীর গ্যাট হয়ে বসে আছে। তাদের সম্মুখে নয়টি বক্সটাইপ স্তম্ভের মতো অনুচ্চ টেবিল। নয় টেবিলে নয় ঝুড়িতে হরেক প্রকার ফুল রাখা। সাহিত্য সংস্কৃতির মাসিক পত্রিকা শব্দঘর-এর ১১তম জন্মদিন পালন, গুণীজন সংবর্ধনা ও সাহিত্য-আড্ডার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে এখানে এসেছি। সমুখের সারিতে কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনকে দেখে আমি এগুচ্ছি, এমনি সময় অচেনা একজন এসে বলল, ‘আমি সঞ্জয়।’ ইনি শব্দঘর-এর কো-অর্ডিনেটর, টেলিফোনে কয়েকবার তার সঙ্গে কথা বলেছিলাম, আজ চাক্ষুস দেখা হলো। আমি এগিয়ে গিয়ে সেলিনা আপাকে সালাম দিই। তার পাশে বসে ছিলেন কবি নাসির আহমেদ। আমার লেখা সম্পর্কে সেলিনা আপাকে নাসির ভাই বললেন, কামরুলের লেখা ভিজুয়্যাল, বর্ণনায় ছবির মতো ফুটে উঠে সব। একজন অপরূপ রূপবতী নারী, পরনে গাঢ় নীল রঙের সিল্ক শাড়ি, ডান কাঁধে  প্রিন্টেড শাল, গলায় জড়ানো রূপার মালা, বোঝাই যায় গানের শিল্পী, মঞ্চে উঠে এই তখনও দর্শক-শ্রোতায় ভরে না-ওঠা অডিটোরিয়ামে গানের মকশো করে নিচ্ছেন। তার পাশে যিনি তবলায় সহবত করছেন তার পরিধানে ফিরোজা নীল পাঞ্জাবির উপর কালো কটি। এসব বিবিধ রঙে ইতিমধ্যে বহু বর্ণের রঙিন মঞ্চটি হয়ে উঠল বর্ণিল।

আমি গিয়ে বসেছি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য মোহীত উল আলমের পাশে। ঠিক পিছনের সারিতে বসেছিলেন দুজন কবি খালেদ হোসাইন ও হাসিদা মুন। আমি তখন দ্বিতীয় সারিতে  চলে যাই। ‘তোমার অমোঘ টানে চলে এলাম’―বসতে বসতে হাসিদা মুনকে বলি। ‘দুই মাস্টারের মাঝে আমি একমাত্র ছাত্রী’―সপ্রতিভ উত্তর হাসিদা মুনের। কবি অধ্যাপক খালেদ হোসাইন আমার লেখার অন্তর্নিহিত ব্যঞ্জনা ও সামগ্রিক শৈল্পিক প্রকাশের প্রশংসা করলেন। তিনি বললেন, ‘কখনও দেখার চেয়ে পড়া ভালো। দেখাটাই পর্যবেক্ষণ আর আপনি ফুটিয়ে তোলেন পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে।’ বাংলা সাহিত্যের এই খ্যাতিমান অধ্যাপক যখন বললেন ‘আপনার  মতো কেউ নেই’ তখন আমি অভিভূত হয়ে পড়লাম। ওপাশে এক সুদর্শন যুবক, মুন বলল খালিদ হোসাইনের পুত্র। তার নাম অভীপ্সিত রৌদ্র শুনে আমি কৌতূহলী হই। জানতে পারি খালিদ হোসাইনের কন্যার নাম রোদেলা সুকৃতি। ভাবি বাংলার অধ্যাপকের পুত্র ও কন্যার নাম এমন হলেই মানায়।

হল ঘরটি ধীরে ভরে উঠছিল বিদগ্ধ দর্শক-শ্রোতায় যাদের বেশির ভাগই কবি লেখক এবং লেখালেখির সূত্রে শব্দঘর পরিবারের সদস্য। আমি মাঝে মাঝে উঠে গিয়ে তাদের ছবি তুলি আর ফিরে এসে হাসিদা মুনের পাশেই বসি। মজা করে বলি, ‘কেন যে বারবার তোমাকে ছেড়ে যাই  আর ফিরে ফিরে আসি।’ এ কথা শুনে খালেদ হোসাইন বললেন,  ‘চলে না গেলে ফিরে আসা যায় না।’ হল ঘরে পেতে রাখা আসন সারির মাঝামাঝি বসে আছেন আমেরিকা প্রবাসী কবি শামস আল মমীন, সঙ্গে কবি শফিক ইমতিয়াজ ও কবি মাহবুব শওকত। ‘কামরুল ভাই আমি বিনয়’―বিনয় সহকারে জানালেন কবি বিনয় বর্মন। পরে দেখা হলো মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের সঙ্গে। কথাসাহিত্যিক মনি হায়দার বললেন বাইরে প্রচণ্ড শীত, ভেতরে উষ্ণতা। সে উষ্ণতা প্রাণেরও। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে পাঁচটা নির্দেশ করলে মনি হায়দার মঞ্চের ডান পাশে রাখা রোস্ট্রামের পেছনে গিয়ে দাঁড়ালেন। যার কণ্ঠস্বর ভরাট, উচ্চারণ শুদ্ধ  এবং যিনি কথা বলেন স্রোতধারার মতো―তাকেই তো সেখানে মানায়।

অনুষ্ঠান শুরু হলো দেশাত্মবোধক গান দিয়ে। গাইলেন সেই নীল ময়ূরী। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার ‘সুরের ধারা’র এককালীন শিক্ষার্থী শিল্পী প্রমীলা রায়ের কণ্ঠে ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা।’ প্রমীলা রায় গাইলেন আরও দুটি গান, দুটিই রবীন্দ্র সংগীত, ‘প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে তাই হেরি তাই সকল খানে’ ও ‘আমার মল্লিকা বনে’ যখন প্রথম ধরেছে কলি’। প্রমিলা রায়ের অগ্নিপ্রভ উপস্থিতি, মাধুর্যময় সংগীত লহরী অনুষ্ঠানের শুরুতেই  দর্শক-শ্রোতাদের মন ভরিয়ে দিল। আমরা যখন সুরের সম্মোহনে সম্মোহিত তখন মনি হায়দার ঘোষণা দিলেন আজকের অনুষ্ঠান একজন সুরের জাদুকরের জন্য অপেক্ষা করছে।

শব্দঘর-এর সম্পাদক কথাসাহিত্যিক মোহিত কামাল মঞ্চে এলেন সূচনা বক্তব্য দিতে। তার কথাতেই আমরা টের পেলাম মঞ্চের পেছনে ব্যাকড্রপের যে আয়তন আর শব্দঘর-এর তৈরি করা ব্যানারটির যে সাইজ সে দুটি মিলছে না। যে চারজন লেখক শব্দঘর পুরস্কার পাচ্ছেন তাদের চারটি বড় ছবি ছিল ব্যানারে। মঞ্চের উপর ভেসে আছে কেবল শাহ্নাজ মুন্নী ও মিনার মনসুরের ছবি আর ঢাকা পড়েছে মাহবুবুল হক ও এমদাদ রহমানের ছবি। আয়োজকদের জন্য এটি বিব্রতকর, বিব্রতভাব এড়াতেই প্রধান আয়োজক সকলের দৃষ্টি ফেরালেন বৃহৎ ভুলটির দিকে। ১১তম জন্মদিন পালনের এই উৎসবে চার লেখককে শব্দঘর পুরস্কার প্রদান ছাড়াও দুজন গুণী মানুষকে সম্মাননা জানানো হবে। এই দুজন গুণী মানুষ হলেন প্রাবন্ধিক মফিদুল হক ও কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকার। ব্যানারের অপর পার্শ্বে তাদের ছবি দুটি ঠিকই পোডিয়ামের বিরুদ্ধতা মেনে মঞ্চে জাগ্রত রয়েছে।

মোহিত কামাল শব্দঘর-পরিবারের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন শ্রোতাদের। কারা এর উপদেষ্টামণ্ডলীতে রয়েছেন, কারা এর কর্মীবাহিনী―তিনি তাদের পরিচয় দিলেন। প্রধানত তার একক উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত এই পত্রিকাটির ব্যানারে তিনি জড়ো করেছেন দেশের বেশ কিছু শ্রদ্ধেয় ও নামী ব্যক্তিত্বকে, যাঁরা মূলত সাহিত্যিক। উপদেষ্টা পর্ষদের শীর্ষে যার নাম আছে তিনি শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়। কলকাতায় বসবাসকারী মানুষটি আসতে পারেননি। দুজন সদস্য নাট্যব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার ও সংগীত ব্যক্তিত্ব রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা এ মুহূর্তে রয়েছেন ভারতে, হরিশংকর জলদাস রয়েছেন ঢাকার বাইরে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত রয়েছেন সেলিনা হোসেন, মোহীত উল আলম ও বিশ্বজিৎ ঘোষ।

কর্মীবাহিনীর মাঝে আছেন : সম্পাদনাকর্মী কুয়াত উল ইসলাম, সিনিয়র গ্রাফিক ডিজাইনার রেজাউল হোসেন, কো-অর্ডিনেটর সঞ্জয় গাইন, টাইপিস্ট হিমন গাইন ও মেহেদি। শব্দঘর-এর প্রচ্ছদ আঁকেন, অলংকরণ করেন একদল শিল্পী। এরা হলেন ধ্রুব এষ, আলপ্তগীন তুষার, নাজীব তারেক, রজত, শতাব্দী জাহিদ, রাজীব দত্ত প্রমুখ। রয়েছেন পত্রিকাটির প্রকাশক মাহফুজা আখতার, সম্পর্কসূত্রে যিনি সম্পাদক মোহিত কামালের সহধর্মিণী। পিতা-মাতার সঙ্গে পরিবারে যেমন, পত্রিকাতেও তেমনি জড়িয়ে আছেন তাদের দুই ছেলে মাহবুব ময়ূখ রিশাদ ও জিদনী ময়ূখ স্বচ্ছ এবং দুই পুত্রবধূ―ফাতিহা নুসরাত ও রুম্পা। এছাড়া গোপন কেউ কেউ  আছেন যাদের নাম সম্পাদক মোহিত কামাল সেই মুহূর্তে বললেন না। আমরা উপলব্ধি করলাম এই সুচারু সম্পাদিত, নান্দনিকভাবে প্রকাশিত, সমৃদ্ধ সাহিত্য সংস্কৃতির পত্রিকাটির পেছনে রয়েছেন একদল মেধাবী ও গুণী মানুষ। তাদের সম্মিলিত প্রয়াসেই শব্দঘর। সমস্যা সৃষ্টি হলে উপস্থিত বুদ্ধি ও প্রাপ্ত সম্পদ দিয়েই সমাধানের চেষ্টা করা হয়। তিনি এর নামকরণ করলেন ম্যাকগাইভার সিস্টেম। 

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক মনি হায়দার, যার কলম ও কথা সমান দ্রুতিতে চলে, তিনি যে সুরের জাদুকরের আগমনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, কিন্তু নাম বলেননি, মোহিত কামাল তাঁর নাম ঘোষণা করলেন। তিনি বিপুল জনপ্রিয় কণ্ঠশিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা। পরিচিতিমূলক বক্তৃতার শুরুতে মোহিত কামাল জানিয়েছিলেন, রবীন্দ্রনাথের গান নিয়ে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ধারাবাহিকভাবে শব্দঘরে লিখেছেন,  একইভাবে নজরুলের গান নিয়ে ধারাবাহিকভাবে শব্দঘরে লিখেছেন ফাতেমা তুজ জোহরা। এরপরে তিনি যে মন্তব্যটি করলেন তা ছিল ওই শিল্পী ও লেখকের প্রতি উচ্চ সম্মান। তিনি বললেন  ফাতেমা তুজ জোহরা শব্দঘরকে বিশ্বনন্দিত করেছেন। কীভাবে ? শব্দঘরে মুদ্রিত ওই লেখা পাঠ করেছেন দেশের ও দেশের বাইরে অসংখ্য বাঙালি পাঠক। ফাতেমা তুজ জোহরার নামের কারণে আর লেখার উৎকর্ষের শব্দঘর-এর নামটিও পৌঁছে গেছে অসংখ্য পাঠকের কাছে।

ঢাকা শহরের বিখ্যাত ট্রাফিক জ্যাম ঠেলে অবশেষে এলেন শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা। প্রধানত  হলুদরঙের পোশাকে তাকে একটি হলুদ পাখিই মনে হলো―মাথার উপরে ফালি করা কাঠের ফলস্ সিলিংয়ের মঞ্চের ডালে। হলুদ এবং বিরল। কপালে বড় লাল টিপ, মাথার চুল খোলা ময়ূরের পেখমের মতো। তিনি বললেন লেখার সময় আনন্দ পেয়েছি, পরে গ্রন্থিত হয়েছে। একবার একটি সংখ্যায় লেখা পাঠাতে পারেননি। সৈয়দ শামসুল হক দেখা হলে বলেছিলেন, ‘একটি সংখ্যায় তোমার লেখা পাইনি।’ সব্যসাচী লেখকের ওই মন্তব্য ফাতেমা তুজ জোহরাকে বিহ্বলিত ও আনন্দিত করেছিল। বিনয়ী মানুষটি এরপর বললেন, আমি লেখক নই; মোহিত কামাল আমাকে লেখক বানিয়েছেন। তিনি গান ধরলেন :

‘পাখি আজ কোন সুরে গায়

বকুলের ঘুম ভেঙে যায়’

গানটির একটি পঙ্ক্তি রয়েছে ‘আজ কোন কথা নয় শুধু গান আর গান’। যিনি মঞ্চে এসে বলেছিলেন আজ তিনি শুধু কথা বলবেন কোনও গান করবেন না, তিনিও কথা থেকে চলে গেলেন গানে। আর দর্শক শ্রোতার প্রত্যাশাও তাই। গানের পাখির গান না গাইলে চলে ? আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনলাম কত অনায়াসে কী সহজ ভঙ্গিতে একটি গান গাওয়া যায়।

গানের পর শুরু হলো মূল অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন, অনুষ্ঠানের সভাপতি শিল্পী রফিকুন নবী, অতিথিবর্গ : কবি কামাল চৌধুরী, অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম, কথাসাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া, বিশ্বজিৎ ঘোষ, মোহীত উল আলম, আনিসুল হক, প্রাবন্ধিক মফিদুল হক, কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকারকে মঞ্চে এসে আসন গ্রহণ করতে অনুরোধ জানালেন সঞ্চালক মনি হায়দার। মূল মঞ্চের সমুখে দু পাশে দুটি করে চারটি আসন পাতা হয়েছে পুরস্কারপ্রাপ্ত চার লেখকের আসন গ্রহণ করার জন্য। একপাশে বসলেন কবি মিনার মনসুর ও কথাসাহিত্যিক শাহ্নাজ মুন্নী; অন্যপাশে প্রাবন্ধিক মাহবুবুল হক একাই বসলেন, কেননা বিদেশে থাকার কারণে এমদাদ রহমান আসতে পারেননি। শুরু হলো শব্দঘর-নির্বাচিত সেরা বই ২০২৩ পুরস্কার প্রদান।

প্রথমেই কথাসাহিত্যের পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকের শংসাপত্র পাঠ। ২০২২ সালে চৈতন্য থেকে প্রকাশিত শাহ্নাজ মুন্নীর বই নির্বাচিত গল্প লাভ করেছে শব্দঘর নির্বাচিত কথাসাহিত্যের সেরা বই ২০২৩ পুরস্কার। শংসাপত্রে লেখা ছিল নিচের কথামালা যা পাঠ করলেন তরুণ কথাসাহিত্যিক মাঈনুল হাসান।

“একজন নির্মোহ দর্শকের মতো নিবিড় নিষ্ঠায় তিনি বয়ান করেন গল্প। চোখের সামনে অভাবনীয় সব ঘটনা ঘটতে থাকে। চরিত্রগুলোকে পাঠক দেখতে পান সচল চলচ্চিত্রের মতো। শাহ্নাজ মুন্নীর গল্পের চরিত্রগুলো তখন পাঠকের পরমাত্মীয়ে পরিণত হয়। তাঁর গল্পের অনন্য বৈশিষ্ট্য বয়নরীতি ও ভাষা। অতুলনীয় শব্দবন্ধে ঘটনাকে তিনি নিয়ে যান বোধের গভীরে।

তাঁর গল্প এ কারণে ‘হয়ে ওঠা গল্প’, বানোয়াট নয়, আরোপিত জীবন্তিকাও নয়।

২০২২ সালে শাহ্নাজ মুন্নীর নির্বাচিত গল্প প্রকাশিত হয়।  গল্পে তাঁর বৈশিষ্ট্য সমাজমনস্তাত্ত্বিক; জীবনের বিস্তৃত পটভূমি থেকে বিশেষ সংবেদনকে সমগ্রতায় রূপ দিতে উন্মুুখ; জীবনচেতনায় গূঢ় অনুভব ফুটিয়ে তুলতে প্রতীকী চিত্রকল্পের ব্যবহার; আপন অনুসন্ধিৎসাকে শিল্পরূপ দিতে সদা নিরীক্ষণ পিয়াসী। তাঁর নির্বাচিত গল্প গ্রন্থটি এ বছরের ‘সেরা বই ২০২৩’ হিসেবে নির্বাচিত করেছে শব্দঘর। তাঁকে এই সম্মাননা জানিয়ে আমরা আনন্দিত।”

পাঠের পর শংসাপত্রটি শাহ্নাজ মুন্নীর হাতে তুলে দিলেন মাঈনুল হাসান। তাকে উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন গত বছর যিনি কথাসাহিত্যে এই পুরস্কারটি পেয়েছেন সেই কথাসাহিত্যিক পারভেজ হোসেন। সম্মাননা প্রদান করলেন সেলিনা হোসেন, শব্দঘর-এর ক্রেস্ট হাতে তুলে দিলেন সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম আর পুরস্কারের অর্থমূল্য হস্তান্তর করলেন শব্দঘর-এর প্রকাশক মাহফুজা আখতার।

ওই একই বছর ২০২২ সালে কথাপ্রকাশ থেকে প্রকাশিত মিনার মনসুরের কাব্য ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম শব্দঘর-নির্বাচিত সেরা বই ২০২৩ পুরস্কার লাভ করেছে। শংসাপত্র পাঠ করলেন কবি ফারুক মাহমুদ। শংসাপত্রে লেখা ছিল নিচের কথাগুলো :

“শ্রীঈশ্বরচন্দ্র শর্ম্মা (বিদ্যাসাগর) যতিচিহ্ন যুক্ত করে বাংলা বাক্যকে অর্থবোধক আধুনিক ভাষার রূপ দিলেন। মাইকেল মধুসূদন এতকালের পয়ারের অন্ত্যমিলের বাঁধ ভেঙে দিলেন। চৌদ্দ মাত্রার পয়ারের সঙ্গে যুক্ত করলেন প্রবল প্রবহমানতা। এই ধারা ধরেই রবীন্দ্রনাথের কবিতা ভিড়ল গদ্যছন্দের ঘাটে। কলকাতা হয়ে উঠল বাংলা কাব্যের রাজধানী। সেই দিনকালের ঢাকা ছিল পদ্মা-মেঘনা-বুড়িগঙ্গা শাসিত মফস্সল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান-রাষ্ট্রের নাগপাশ ছিঁড়ে ঢাকা হয়ে উঠল বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের রাজধানী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে এই কবি এলেন নতুন রাজধানীতে। তাঁর কাব্যজলতরঙ্গের বাহন হয়ে উঠল আরও উদার দিঘল গদ্য : ‘গোটা পৃথিবীই কুরুক্ষেত্র! সর্বজ্ঞ আপনি। গৌতম বুদ্ধের আকাক্সক্ষাশূন্য হাত একবার যাকে ছুঁয়েছিল সে কীভাবে ভুলতে পারে নির্বাণের ঘ্রাণ !’

এভাবেই বাংলা কবিতা পৃথিবীর নতুন নতুন দ্রাঘিমা ছুঁয়ে যায়। ব্রাসেলসের সন্ধ্যাটি ছিল মনোরম―তাঁর কাব্যগ্রন্থটিকে ‘সেরা বই ২০২৩’ হিসেবে নির্বাচিত করেছে শব্দঘর। তাঁকে সম্মাননা জানিয়ে আমরা আনন্দিত।”

পাঠের পর শংসাপত্রটি মিনার মনসুরের হাতে তুলে দিলেন ফারুক মাহমুদ। কবিকে উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন গত বছর যিনি কবিতায় পুরস্কারটি পেয়েছিলেন সেই কবি খালেদ হোসাইন। সম্মাননা প্রদান করলেন প্রধান অতিথি সেলিনা হোসেন, শব্দঘর-এর ক্রেস্ট হাতে তুলে দিলেন কবি কামাল চৌধুরী আর পুরস্কারের অর্থমূল্য হস্তান্তর করলেন প্রকাশক মাহফুজা আখতার।

এরপরে প্রবন্ধ ও লোক গবেষণায় পুরস্কার প্রদানের পালা। পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রাবন্ধিক মাহবুবুল হকের শংসাপত্র পাঠ করলেন ইফফাত আরা রুম্পা। মাহবুবুল হকের শংসাপত্রে লেখা ছিল,

“আবহমানকাল ধরে বাংলাদেশ ধানের দেশ গানের দেশ, সংস্কৃতি ও সম্পদে বিশ্বসেরা দেশ। ঐশ্বর্যের লোভে যুগে যুগে এ দেশ মৌর্য, গুপ্ত, পাল, সেন, তুর্কি, বর্গি, আফগান, মোগল, ইংরেজ, পাকিস্তানিদের দ্বারা সম্পদ-লুটের কবলে পড়েছে। আমাদের লোকসংস্কৃতিই বাঙালি-সত্তার আঁতুড়ঘর। বার বার বহিরাগত শাসকগোষ্ঠী তাদের শাসন টিকিয়ে রাখার জন্য আমাদের ভাষা-সংস্কৃতির ওপর ছোবল হেনেছে। এমনতর জাতীয় পটভূমিতে বাঙালি তার জাতিসত্তাকে টিকিয়ে রাখতেই ১৯৭১ সালে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়।

মুক্তিযোদ্ধা, কৃতী গবেষক ও অধ্যাপক মাহবুবুল হক তাঁর লোকসংস্কৃতি চর্চা গ্রন্থটিতে বাঙালির ইতিহাস ও সংস্কৃতিরই বস্তুনিষ্ঠ প্রামাণ্য বয়ান হাজির করেছেন। এ বইটিকে ‘সেরা বই ২০২৩’ হিসেবে নির্বাচিত করেছে শব্দঘর। তাঁকে সম্মাননা জানিয়ে আমরা আনন্দিত।”

ইফফাত আরা রুম্পার হাত থেকে শংসাপত্রটি নেবার পর মাহবুবুল হক অন্যান্য সম্মাননা গ্রহণ করলেন। তাকে উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন কথাসাহিত্যিক ঝর্না রহমান। সম্মাননা যথারীতি প্রদান করলেন প্রধান অতিথি সেলিনা হোসেন, ক্রেস্ট হাতে তুলে দিলেন মোহীত উল আলম আর পুরস্কারের অর্থমূল্য হস্তান্তর করলেন প্রকাশক মাহফুজা আখতার।

শব্দঘর নির্বাচিত সেরা বই ২০২৩য়ের চতুর্থ লেখক হলেন এমদাদ রহমান। ২০২১ সালে জলধি থেকে প্রকাশিত নৈঃশব্দ্যের সংলাপ এ পুরস্কার লাভ করেছে। শংসাপত্র পাঠ করলেন এলহাম হোসেন। শংসাপত্রে লেখা ছিল নিচের কথাগুলো :

“বিশ ও একুশ শতকের প্রারম্ভে আধুনিক বিশ্বসাহিত্যের ভাণ্ডার থেকে বিশেষ এক সাহিত্যসম্ভার ছেঁকে তুলেছেন এমদাদ রহমান। বিশ্বসাহিত্যের নির্বাচিত লেখকদের সাক্ষাৎকার-সন্নিবিষ্ট নৈঃশব্দ্যের সংলাপ গ্রন্থের ভাষান্তর ও সম্পাদনাকর্ম, তাঁকে সমকালিক এক ধীশক্তিসম্পন্ন সাহিত্যবিদ হিসেবে স্বীকৃতি এনে দিয়েছে।

আধুনিক ভাষাসাহিত্যের ভূমণ্ডলীয় ভাণ্ডারীগণ তাঁদের কালোত্তীর্ণ সৃষ্টিসম্ভার নিয়ে কেন মুগ্ধ-পাঠকসমাজের কাছে হাজির হয়েছেন? এ প্রশ্নের জবাবে ২২ জন সাহিত্যশিল্পী মুখোমুখি দাঁড়িয়েছেন আমাদের সমুখে। কোটি কোটি পাঠকের প্রিয় কথাশিল্পের স্রষ্টারা কোন্ শিল্পসত্যের গূঢ় তাড়নায় তাঁদের মহৎ সৃষ্টি হাজির করেছেন, সে-প্রশ্নের জবাব এ গ্রন্থ।

প্রবীণ-তরুণ নির্বিশেষ লেখক- পাঠকসাধারণের জন্য এ আগ্রহোদ্দীপক গ্রন্থটিকে বছরের ‘সেরা বই ২০২৩’ হিসেবে নির্বাচিত করেছে শব্দঘর। তাঁকে এই সম্মাননা জানিয়ে আমরা আনন্দিত।” 

পুরস্কারপ্রাপ্ত অনুবাদক এবাদুর রহমান বাস করেন যুক্তরাজ্যে। তিনি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে পারেননি। ফলে তার পক্ষ থেকে সম্মাননাগুলো গ্রহণ করলেন প্রকাশক কথাসাহিত্যিক নাহিদা আশরাফী। উত্তরীয় প্রদান করলেন মোহীত উল আলম। সম্মাননা যথারীতি সেলিনা হোসেন, ক্রেস্ট তুলে দিলেন সুব্রত বড়ুয়া; পুরস্কারের অর্থমূল্য হস্তান্তর করলেন প্রকাশক মাহফুজা আখতার। বারংবার অর্থ তুলে দেবার জন্য সকলে তাকে অর্থমন্ত্রী হিসেবে অভিহিত করলেন।

এরপরে পুরস্কারের ক্রেস্ট হাতে তিন উপস্থিত পুরস্কারজয়ী ছবির জন্য পোজ দিলেন। তাদের দিকে তাক করল এক টিভি চ্যানেলের টিভি ক্যামেরা, তিন ডিএসএলআর যারা প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চায় টিভি ক্যামেরার। আর রয়েছে কয়েকটি মোবাইল ক্যামেরা, যারা হয়ে উঠতে চায় ডিএসএলআরের প্রতিদ্বন্দ্বী।

পুরস্কার প্রাপ্তির পর প্রতিক্রিয়া জানাতে এসে শাহ্নাজ মুন্নী বললেন : গত ৩০ বছরে লেখা গল্পসমূহ থেকে ৫২টি গল্প নিয়ে তার এ সংকলন, যা শব্দঘর পুরস্কার পেল। শাহ্নাজ মুন্নী শব্দঘর-পরিবার এবং এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সকলকে, বিশেষ করে বিচারকদের ধন্যবাদ জানালেন। তিনি জানালেন নিজের মনের আনন্দেই লেখেন, ভেতরে তাড়না থেকেই লেখা। ৩০ বছর কম কথা নয়। এত দীর্ঘ সময় ধরে তিনি নিজেকে যে লেখার সঙ্গে যুক্ত রাখতে পেরেছেন সেটা আনন্দের। শাহ্নাজ মুন্নী একটি শঙ্কার কথাও বললেন। এখন আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই কবিতা লিখে দিচ্ছে গল্প লিখে দিচ্ছে। সাহিত্যের ভবিষ্যৎ যে কী চেহারা নিয়ে দাঁড়াবে তা নিয়ে  শঙ্কিত তিনি। এখন এআইয়ে আবেগ নেই এটা সত্যি, কিন্তু যদি এআইয়ে আবেগ ঢুকিয়ে দেওয়া হয়  তখন কী হবে ? 

কবি মিনার মনসুর বললেন, ৪০ বছরের  ব্যবধানে যা কিছু আমি রচনা করেছি কোন স্বীকৃতি পুরস্কার বা নিন্দা আমাকে উল্লসিত বা বেদনার্ত করতে পারেনি। ভূমিকায় লিখেছি এগুলো আমি রচনা করিনি আমাকে দিয়ে কেউ লিখিয়ে নিয়েছে।’ কবি মিনার মনসুর ৭০ দশকে লেখালেখি শুরু করলেও তার প্রথম কাব্য এই অবরুদ্ধ মানচিত্র প্রকাশিত হয় ১৯৮৩ সালে। স্বৈরাচারী সামরিক সরকার বাজেয়াপ্ত করেছিল বইটি। কবিতা লেখার প্রধানতম অনুপ্রেরণা অতৃপ্তি’। কবির কোনও আত্মতৃপ্তি বা সন্তুষ্টি থাকা উচিত নয়। কবি একজন পর্যটক, প্রতিদিন নতুন পথে হাঁটেন। তিনি ঝর্নার মতো পেছন ফিরে তাকান না। নিজেকে নিরন্তর প্রকাশ করেন। সর্বশেষ যে কবিতাটি তিনি লিখেছেন তা পাঠ করে হতাশা তার বেড়ে যায়। কেননা এতকাল ধরে যে কবিতাটি তিনি লিখতে চেয়েছেন তা এখনও লিখতে পারেননি। মিনার মনসুর সভাকে জানালেন তিনি মাসউদ আহমাদের উপন্যাস পড়ছেন। যখন কারও কবিতাই ভালো লাগে না তখন জীবনানন্দ পড়তে ভালো লাগে । কী সাদামাটা, নির্জন এক মানুষ জীবনানন্দ, জীবিতকালে উপেক্ষিত, ব্যর্থ, বঞ্চিত। জীবনানন্দ দাশই  আমাদের আধুনিকতম কবি।

প্রাবন্ধিক মাহবুবুল হক লিখতে যতটা স্বচ্ছন্দ কথা বলতে ততখানি নন। তার বক্তৃতা হলো খুবই সংক্ষিপ্ত। তিনি বললেন আমি দৈনন্দিন জীবনকে পাঠ করে চলেছি। এই সন্ধ্যায় অনেক কিছুই মুছে ফেলেছি। তার ওই কথায় যা ফুটে উঠল তা হলো অনেক দিনের অপ্রাপ্তির আক্ষেপ, উপেক্ষার বেদনা আজকের স্বীকৃতি, আজকের আনন্দ এসে মুছে দিয়েছে।

পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রতিক্রিয়া প্রকাশের পর আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করা হলো শব্দঘর-এর এবারের সংখ্যা। মঞ্চের অতিথিরা সকলে নতুন সংখ্যাটি সমুখে তুলে ধরে দাঁড়ালে চিত্রগ্রাহকেরা মোটামুটি ঝাঁপিয়ে পড়ল সে ছবি ধারণ করার জন্য। তারা ঢেকে দিল দর্শকদের দেখার বাতাবরণটুকু।

শব্দঘর-এর ১১তম জন্মদিনে দু’জন গুণী মানুষকে সম্মাননা জানানো হলো। এরা হলেন প্রাবন্ধিক, গবেষক মফিদুল হক ও কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকার। শব্দঘর-এর বর্তমান সংখ্যাটি তাদের উদ্দেশ্যে  নিবেদিত। প্রচ্ছদে এই দুই গুণীর মুখাবয়ব এঁকেছেন নিউ ইয়র্কে বসবাসরত শিল্পী তাজুল ইমাম। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।  মফিদুল হককে উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ। মঞ্জু সরকারকে উত্তরীয় পরিয়ে দিলেন সাহিত্যিক সুব্রত বড়ুয়া। ফুলের তোড়া ও প্রবাসী শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামের আঁকা দুটি বাঁধাই করা পোর্ট্রেট দুই গুণীর হাতে তুলে দেওয়া হলো।

একাত্তরের গণহত্যার বিচারের দাবি তোলা, বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি মফিদুল হকের জীবনী পাঠ করলেন স্বপন নাথ। তা থেকে আমরা জানলাম দেশ বিভাগের ঠিক পরের বছর অর্থাৎ ১৯৪৮ সালে মফিদুল হক জন্মগ্রহণ করেছিলেন নোয়াখালীতে। কিন্তু তার পিতা চলে এসেছিলেন বিক্রমপুর। সেই  সূত্রে তাঁর শৈশব কেটেছে বিক্রমপুরে। তিনি সমাজবিজ্ঞানে মাস্টার্স করেছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন একজন সিরিয়াস গবেষক ও প্রাবন্ধিক হিসেবে। তিনি সরাসরি মুক্তিযুদ্ধ না করলেও সাংগঠনিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তার কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেকগুলো জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার লাভ করেছেন। ২০১৩ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার, ২০১৬ সালে একুশে পদক। এছাড়া লাভ করেছেন শহিদ আলতাফ মাহমুদ পুরস্কার।

কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকারের জীবনী পাঠ করলেন ইফফাত আরা রুম্পা। মঞ্জু সরকার জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৩ সালে, রংপুরে। তাঁর উপন্যাসে সমাজবাস্তবতা ফুটে ওঠে। প্রান্তিক জীবনের তিনি এক দক্ষ রূপকার।  ১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় অবিনাশী আয়োজন। ৫ দশকের সাহিত্য সাধনার পুরস্কারস্বরূপ তিনি যে শুধু প্রবল পাঠকপ্রিয়তা পেয়েছেন তাই নয়, ১৯৯৮ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। তাঁর অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে ফিলিপস পুরস্কার, সমকাল-ব্র্যাক ব্যাংক পুরস্কার, অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্য পুরস্কার উল্লেখযোগ্য। ২০০৬ সালে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত লিটারারি ওয়ার্কশপে একজন সম্মানিত ফেলো হিসেবে যোগদান করেছিলেন।

কবি কামাল চৌধুরীর আরেকটি অনুষ্ঠানে যোগদানের ব্যস্ততা ছিল, তাই তিনি প্রথম বক্তা হিসেবে মাইক্রোফোনের সম্মুখে এলেন। বাংলা ভাষার এই গুরুত্বপূর্ণ কবি সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। এতে কবি-লেখক-শিল্পীরা উল্লসিত। কামাল চৌধুরীকে সংস্কৃতির পতাকাবাহী’ বলে উল্লেখ করলেন মনি হায়দার। কামাল চৌধুরী প্রথমেই পুরস্কৃতজনদের অভিনন্দন জানালেন। বললেন পুরস্কারপ্রাপ্তরা যখন আমার সম্মুখে আছে তখন একটি গল্প মনে পড়ে গেল। মেক্সিকোর নোবেলজয়ী কবি অক্টাভিও পাজ তার In Light of India গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। একবার অক্টাভিও পাজ একটি পুরস্কার পেলেন। তিনি সেটি গ্রহণ করবেন কি করবেন না তা নিয়ে দ্বিধাগ্রস্ত ছিলেন। তিনি মা আনন্দময়ীর কাছে গেলেন পরামর্শ নিতে। গিয়ে দেখলেন মা আনন্দময়ী একটি কমলা নিয়ে লোফালুফি করছেন। পাজকে দেখে তিনি কমলাটি পাজের দিকে ছুড়ে দিলেন। এর অর্থ হলো পুরস্কার গ্রহণ করো। কেননা স্বীকৃতির মূল্য রয়েছে। অনেকে মহাকালের গল্প করেন। কামাল চৌধুরী বললেন তিনি মহাকালে বিশ্বাস করেন না। তিনি বিশ্বাস করেন যারা সমকালে বিখ্যাত হন  তারা মহাকালেও বিখ্যাত হন। সমকালে যারা আদৃত হয়েছেন, তারা মহাকালেও সমাদৃত হয়েছেন। কামাল চৌধুরী শব্দঘর সম্পাদক মোহিত কামাল সম্পর্কে বললেন একজন প্রথিতযশা মনোচিকিৎসক হয়েও ১১ বছর ধরে একটি অসামান্য পত্রিকা বের করছেন। তিনি শুধু একা নন, তার পুরো পরিবারই শব্দঘরকে ঘিরে রয়েছে। আমরা জানলাম কামাল চৌধুরী ও মোহিত কামাল প্রতিবেশী। একজন খ্যাতিমান মনোচিকিৎসক কী করে একটি পত্রিকার পেছনে এতটা সময় দেন, কী করে এতটা অভিনিবেশ সহকারে কাজ করেন তা এক বিস্ময়! শব্দঘর পশ্চিমবঙ্গেও সমাদৃত। শব্দঘর-এর উপদেষ্টামণ্ডলীতে তাঁর নাম থাকলেও কামাল চৌধুরী সরল সত্য কথাটি কৌতুক করে বললেন, শব্দঘরকে উপদেশ দেবার সময় আমি পাইনি।’ তিনি যে কৌতুকপ্রবণ তা তাঁর  কথায় ফুটে ওঠে। মোহিত কামালের প্রতি তার মুগ্ধতা তিনি প্রকাশ করেন এভাবে : মোহিত কামাল আমাদের মোহিত করে রেখেছেন। কবি কামাল চৌধুরী তাঁর বক্তৃতায় আমাদের মোহিত করে রাখলেন।

অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম তাঁর ভাষণে বললেন যাদের আজ পুরস্কৃত করা হলো তাদের সঙ্গে তার দীর্ঘ পরিচয়। প্রথম কাব্যগ্রন্থ থেকেই তিনি মিনার মনসুরের কবিতার গুণগ্রাহী। শাহ্নাজ মুন্নীর গল্প মাটির ট্রানজিস্টর প্রসঙ্গে বললেন বাংলা ভাষায় এমন গল্প কমই লেখা হয়েছে। প্রাবন্ধিক মাহবুবুল হক সম্পর্কে বললেন তিনি চমৎকার লেখেন। প্রবাসী এমদাদ রহমান সম্পর্কে বলতে গিয়ে তার মনে পড়ল দুই প্রবাসী লেখকের কথা। এরা হলেন দীপেন ভট্টাচার্য ও শামস আল মমীন। তিনি শামস আল মমীনকে বাংলা ভাষার শক্তিমান কবি বলে উল্লেখ করলেন। তিনি এই বলে শেষ করলেন, নিজের অর্থবিত্ত বিলিয়ে দিয়ে কী করে সাহিত্যের সেবা করা যায় মোহিত কামাল তার একটি উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। এই মনোচিকিৎসক জানেন মানসিক চাপ দিয়ে কী করে লেখা আদায় করা যায়।

চিত্রকলায় অসামান্য অবদান রেখেছেন রফিকুন নবী। তিনি সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখলেন। স্মরণ করলেন সেই দিনটির কথা যেদিন মোহিত কামাল কয়েকজন সমমনা সতীর্থকে নিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে চেয়েছিলেন শব্দঘর ছাপবেন কী ছাপবেন না। বললেন নিজে লেখক না হলেও এর সঙ্গে তিনি সংশ্লিষ্ট ছিলেন। একটা সময় ছিল যখন লেখক ও শিল্পীদের মাঝে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। তারা পরস্পরের কাছাকাছি ছিলেন। এখন সবাই সরে গেছে দূরে। তিনি স্মরণ করলেন সমকাল পত্রিকার কিংবদন্তি সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফরের অফিসে লেখক-শিল্পীদের জমজমাট আড্ডা বসত। তার জিজ্ঞাসা শিল্প-সাহিত্যের জগৎ বিশাল নয় তবু আমরা কেন  একসঙ্গে  নেই ? এ কথা বলেই তিনি অবশ্য স্বীকার করলেন সংগীতে একটি collective ব্যাপার রয়েছে, লেখালিখিতে লেখক যেমন একা, আঁকাআঁকিতে চিত্রকরও একা। তিনি মোহিত কামালকে বলেছিলেন সাহিত্য  পত্রিকা চলবে না। এ কথা বলার কারণ  তিনি সমকাল, পূর্বলেখ প্রভৃতি পত্রিকা বন্ধ হয়ে যেতে দেখেছেন। ওই নেতিবাচক কথার মধ্য দিয়ে তিনি মোহিত কামালের মনে জেদটা জাগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

তা তিনি পেরেছেনও।

বিশ্বজিৎ ঘোষ তার বক্তৃতায় শব্দঘর প্রকাশের প্রশংসা করে বললেন, ১১ বছর ধরে এমন একটি মানসম্পন্ন পত্রিকা প্রকাশ করা দুরূহ। এর পেছনে শুধু যে মোহিত কামাল রয়েছেন তাই নয়, তার গোটা পরিবারই রয়েছে। যারা পুরস্কৃত সংবর্ধিত  হলেন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বললেন যে ভবিষ্যতে তাদের কর্মময় জীবন আরও বিস্তৃত হবে, তারা আরও পুরস্কার লাভ করবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের এই অধ্যাপক জানালেন তিনি মোহিত কামালের প্রতিবেশী। তার বাড়ির জানালা দিয়ে মোহিত কামালের বাড়ি দেখা যায়। তিনি দেখেন আর বিস্মিত হয়ে ভাবেন ওই বাড়ি থেকে প্রতি মাসে একটি দুর্দান্ত পত্রিকা বের হয়।

কিছু বলার জন্য সুব্রত বড়ুয়াকে আমন্ত্রণ জানানোর সময় মনি হায়দার বললেন, আমাদের সময়ে এমন একজন মানুষ যে বেঁচে আছেন সেটা দেখা আমাদের জন্য একটা সৌভাগ্য। সর্বজন শ্রদ্ধেয় ও অগ্রজ এই কথাসাহিত্যিক মঞ্চে এসে বললেন প্রতিদিন বেঁচে থাকা একটা প্রাপ্তি। এমন একটি সাহিত্য-আড্ডায় থাকাটা আরেক প্রাপ্তি। এতে নতুন করে উদ্বুদ্ধ হই। তিনি পুরস্কারপ্রাপ্তদের তার শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানালেন।

সবাই যখন সংক্ষিপ্ত কথা বলেই সমাপ্তি টানছিলেন তখন অধ্যাপক মোহিত-উল-আলম অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ বক্তৃতা দিয়ে সে ঘাটতি পুষিয়ে দিলেন। তিনি একবার চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে করে ঢাকা আসছিলেন। ট্রেনে তার সঙ্গে দেখা হলো দুজন চিকিৎসকের। একজন মনোচিকিৎসক, অন্যজন চর্মচিকিৎসক। একদিন গভীর রাতে এক নারীকণ্ঠ তাকে টেলিফোনে বলল আপনি আমাকে যে ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলেন,  তা এতদিন কাজ করেছে, এখন করছে না। প্রথমে অবাক হলেও তিনি পরে বুঝলেন কোথাও একটা ভুল হয়েছে। বললেন আমি নই, আপনি বোধকরি মোহিত কামালকে খুঁজছেন। এখন প্রায় প্রত্যেক রাতেই মোহিত কামালের টেলিফোন পান তিনি। ‘অমুক লাইনটা শেক্সপিয়র তার কোন নাটকে যেন লিখেছেন’―এমনি সব জিজ্ঞাসা। ১১ বছর আগে একটি চীনা রেস্তোরাঁয় কয়েকজন সাহিত্যপিপাসুকে সঙ্গে নিয়ে মোহিত কামাল একটি পত্রিকা প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নিলেন। পত্রিকার নাম রাখা হলো মন। পরে নাম পাল্টে শব্দঘর রাখা হলো, কারণ লোকেরা ভাববে এটি মনোরোগের চিকিৎসার পত্রিকা। বেশির ভাগ পত্রিকাই তো ১/২ সংখ্যা পর আর বের হয় না, অথচ শব্দঘর বের হয়েই চলেছে। ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে এর নৈকট্য; চলছেই। ‘আমি আত্মশ্লাঘা অনুভব করি যে এর সঙ্গে আমার নামটি রয়েছে।’ কথা বলেই সংশয় প্রকাশ করলেন, ‘নাকি বাদ পড়ে গেছে ?’ তাঁর মন্তব্য শ্রোতৃমহলে কৌতুক ছড়াল।

বললেন, এই মাসিক পত্রিকাটি প্রতি বছর ১২টি সংখ্যা করে ১০ বছরে একশো কুড়িটি সংখ্যা প্রকাশ করেছে। সঙ্গে আছে ঈদসংখ্যা। কোনও কোনওটি ঢাউস, ৫০০ পৃষ্ঠার বেশি। তিনি মোহিত কামালের এই পরিশ্রমকে দশটি হিমালয় পর্বতের সঙ্গে তুলনা করলেন। পত্রিকাটিকে দুই বাংলার মধ্যে একটি সেতুবন্ধ বলে উল্লেখ করে পত্রিকাটির প্রশংসা করতে গিয়ে তিনি অতিশয়োক্তি করলেন। বললেন : শব্দঘর পদ্মা সেতুকে হার মানিয়ে দিয়ে এমন একটি মহাসড়কের দিকে নিয়ে যাচ্ছে যে মহাসড়কে অন্য পত্রিকাগুলো যেতে পারবে না। পত্রিকাটির একটি অংশ দ্বিভাষিক। এর কাগজের মান উঁচু, ছাপার অক্ষর চমৎকার। অথচ পত্রিকাটি তেমন বিজ্ঞাপন পাচ্ছে না, অর্থাৎ প্রতি সংখ্যাতেই মোহিত কামাল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন।

তিনি শব্দঘরের জন্য কয়েকটি পরামর্শ রাখলেন,

১. শব্দঘর যেন কোনও গোষ্ঠীর পত্রিকা না হয়;

২. ছবিকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত নয়। লেখার চেয়ে পাঠকের মনোযোগ ছবির দিকে চলে যাচ্ছে। ছবি থাকবে, তবে লেখাকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। চরিত্রগুলো হবে লেখানির্ভর। শব্দঘর কোনও pictorial পত্রিকা নয়। ফেসবুকে যেমন মানুষ কিছু পড়ে না, কেবল ছবি দেখে। ছবি দেখে লাইক দেয়। পড়ার ধৈর্য মানুষের আর নেই। শব্দঘর-এর দৃষ্টিভঙ্গি হবে ক্লাসিকাল।

শব্দঘর পুরস্কার প্রসঙ্গে তিনি বললেন কারা পুরস্কৃত হবে তার একটি মানদণ্ড রয়েছে। কয়েকটি স্তরে রিভিউ হয়। একটি স্তরে পুরস্কার দেওয়া হয় না। তাড়াহুড়া বাদ দিয়ে স্থিত হতে হবে।

শুভেচ্ছা বক্তব্য দিতে এসে কবি নাসির আহমেদ বললেন তার কর্মময় জীবনের ৩৫ বছর তিনি তিনটি পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সে অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বললেন শব্দঘর কোটারি প্রথা থেকে মুক্ত। নাসির আহমেদ একজন কবি। তার বক্তব্য―‘কবি হওয়া এত সহজ নয়।’ ফেসবুকে তিনি এমন সব কবিতা দেখেন তাদের লেখকরা যে কোনও দিন কবি হতে পারবে না সে ব্যাপারে তিনি নিঃসংশয়। ফেসবুকের মাধ্যমে তারা জনপ্রিয় হতে চায়। নাসির আহমেদ জানালেন মুদ্রিত পত্রিকার সার্কুলেশন মারাত্মকভাবে কমে গেছে। মোহিত কামাল নিজের গাঁটের পয়সা খরচ করে পত্রিকাটি প্রকাশ করে যাচ্ছেন। তার আত্মত্যাগ উদাহরণযোগ্য। তার দুদিকেই ক্ষতি, কেননা পত্রিকার জন্য তিনি যে সময় দেন সে সময়ে তিনি চিকিৎসাসেবা দিয়ে প্রভূত অর্থ অর্জন করতে পারতেন। 

কথাসাহিত্যিক আনিসুল হক অনুষ্ঠানে এসেছিলেন কিছুটা পরে। তাকে মঞ্চে আহ্বান করা হলো শুভেচ্ছা বক্তব্য দেওয়ার জন্য। এটি শব্দঘর-এর ১১তম নাকি দশম জন্মবার্ষিকী তা নিয়ে তার একটু সংশয় তৈরি হলো। এরপরই চলে গেলেন শব্দঘর দম্পতির সঙ্গে তার পরিচয়ের কথা বলতে। একবার আনিসুল হকের মাথার চুল পড়ে যাচ্ছিল। তিনি শরণাপন্ন হয়েছিলেন চিকিৎসক মাহফুজা আখতারের। এরপর পরিহাসচ্ছলে বললেন মাহফুজা আখতার দুজন লেখকের মাথায় চুল ফিরিয়ে দিয়েছে। তারা হলেন আনিসুল হক ও মোহিত কামাল। পুরস্কারপ্রাপ্তদের প্রসঙ্গে তিনি বললেন তার প্রিয় লেখকদের একজন শাহ্নাজ মুন্নী। জানালেন মঞ্জু সরকার ও তিনি একই শহর রংপুরের বাসিন্দা। এরপরই তার প্রশসাসূচক মন্তব্য―এত বড় একজন লেখক রংপুরে জন্ম নিয়েছেন ভাবতেই ভালো লাগে।

মঞ্চের সম্মুখ সারিতে বসে থাকা জনপ্রিয় কার্টুনিস্ট অনুষ্ঠানের সভাপতি রফিকুন নবী, যাকে সকলেই  রনবী নামে চেনে, তার উদ্দেশ্যে আনিসুল হক বললেন, রনবী পৃথিবীর সম্পদ। তার আঁকা নতুন ছবিগুলো দেখে আনিসুল হক বিস্মিত হয়ে গেছেন। কামরুল হাসান, কাইয়ুম চৌধুরী, রফিকুন নবী আমাদের জাতীয় সম্পদ। আনিসুল হক তাকে এই বলে অনুরোধ করলেন, স্যার আপনি সব জায়গায় যাবেন না। হয়তো রনবীর অগ্রগামী বয়সকে লক্ষ করে এ কথা বলা। পুরস্কারপ্রাপ্ত কবি মিনার মনসুরকে লক্ষ করে বললেন মিনার ভাই একজন নেতা। আনিসুল হক স্মরণ করলেন তার প্রথম কাব্য খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে কবি মিনার মনসুর সম্পাদনা করে দিয়েছিলেন।

মফিদুল হক প্রসঙ্গে বললেন, তিনি খুবই ভালো লেখেন। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে খুব কমই নতুন তথ্য পাওয়া যায়, মফিদুল হকের গবেষণায় নতুন তথ্য উঠে আসে। অজানা লেখকের ডায়েরি প্রকাশ করে তিনি আমাদের ঋণী করে রাখলেন। সাহিত্যপ্রকাশ প্রকাশ করেছে উঁচুদরের সাহিত্য, প্রয়োজনীয় গ্রন্থসকল। মফিদুল হককে একজন সাত্ত্বিক মানুষ, নির্লোভ  মানুষ  আখ্যায়িত করে  আনিসুল হক বললেন তিনি একজন রোল মডেল।

পুরস্কারপ্রাপ্তদের একজন প্রাবন্ধিক মাহবুবুল হক মাইক নিয়ে কথা বলতে চাচ্ছিলেন না। জানালেন তার দীর্ঘ বক্তৃতা দেবার অভ্যাস কম। আজ পুরস্কার পেয়ে তিনি আনন্দিত হলেও কিছুটা  বিব্রতবোধ করছেন। শব্দঘরে বাংলা সাহিত্যের রূপরেখা ফুটে উঠেছে। তিনি তরুণ লেখকদের লেখার বিষয়বৈচিত্র্যের প্রশংসা করলেন।

যে দুজন গুণীকে শব্দঘর সম্বর্ধনা দেওয়া হলো তাদের একজন কথাসাহিত্যিক মঞ্জু সরকার লেখায় যত স্বাচ্ছন্দ, কথা বলায় তত স্বাচ্ছন্দ নন। সংবর্ধনা উল্লেখে কিছুটা কুণ্ঠিত মানুষটি মাইক্রোফোনের সম্মুখে এসে বললেন, ‘আজ আমি ও মফিদুল হক যেন দুটি ছক্কা মেরেছি। শব্দঘর-এর একটি আস্ত সংখ্যা উৎসর্গ করাটা আনন্দের। এ সংখ্যা যারা আমাদের উদ্দেশ্য করে লিখেছেন তাদের সকলকে ধন্যবাদ।’

মফিদুল হককে মঞ্চে আহ্বান করার সময় সঞ্চালক মনি হায়দার বললেন, মফিদুল হক যখন হেঁটে যান, তখন অজস্র শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি নিয়ে হেঁটে যান। তিনি মেধাবী ও মননশীল মানুষ, তার ভিতরে প্রজ্ঞা ও পরিশ্রমের সমন্বয় ঘটেছে। মফিদুল হক তার বক্তৃতায় শব্দঘর-এর প্রতি তার মুগ্ধতা জানালেন। বললেন এমন একটি পত্রিকা প্রকাশের জন্য যে পরিমাণ কাঠখড় পোড়াতে হয়, সে পরিমাণ প্রাপ্তি মেলে না। ধারাবাহিকভাবে পত্রিকা প্রকাশের জন্য প্রচুর শ্রম ও মেধা প্রয়োজন। শব্দঘর-এর সম্পাদক মোহিত কামাল মনোচিকিৎসাবিদ্যার একজন অধ্যাপক। মনোচিকিৎসকদের লোকেরা এক সময় ‘পাগলের ডাক্তার’ বলত। মোহিত কামাল যে ‘পাগল’ তাতে সন্দেহ নেই, নজরুলের মতো ক্ষ্যাপাটে। এই ক্ষ্যাপাটেরাই সমাজকে নতুন কিছু দিয়ে যায়।

অনুষ্ঠান চলে এল তার শেষ পর্বে। অতিথিদের ধন্যবাদ জ্ঞাপন করলেন মাহবুব ময়ূখ রিশাদ। রিশাদ একজন গল্পকার। জন্মদিন যেহেতু, হোক তা পত্রিকার, কেক কাটা হলো সাড়ম্বরে। ঈষৎ হলুদাভ, তাকে অফ হোয়াইট বলাই সঙ্গত, বড় ও আয়তকার ভ্যানিলা কেকটি কেবল দেখতেই পরিপাটি নয়, স্বাদেও অপূর্ব। কেক কাটা ঘিরে জড়ো হলেন শব্দঘর-পরিবার ও উপস্থিত অতিথিরা। অনেকক্ষণ ধরে চলল ফটোসেশন। প্রথমে বড় দল, পরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে। বিখ্যাত মানুষদের কাছে পেয়ে দর্শকরা অনেকেই ছবি তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। আনন্দঘন পরিবেশে শেষ হলো শব্দঘর-এর ১১তম জন্মদিন পালন ও শব্দঘর-নির্বাচিত সেরা বই ২০২৩ পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠান।

 লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button