আর্কাইভবিশেষ আয়োজন

বিশেষ রচনা : সাহিত্য-উৎসব : ফ্রাঙ্কফুর্ট আন্তর্জাতিক বইমেলা : বিশ্বসাহিত্য সংস্কৃতির সংযোগ : মিলটন রহমান

বিশ্বের সবচেয়ে বড় বইমেলা (বুসমেসে) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্ট শহরে। এবার ছিল এর পঁচাত্তরতম আয়োজন। এই বইমেলা’র গল্প শুনে শুনে মনে হলো একবার দেখে আসি। গিয়েই আমি বিস্ময় মেনেছি। গত ১৮ থেকে ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত বুসমেসে কংগ্রেস হাউস, স্কাউট ভবন থেকে শুরু করে প্রায় পনেরটি বহুতল ভবনে তিল ধরার ঠাঁই ছিল না। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষার গ্রন্থ ও শিল্প-সংস্কৃতির প্রসারের জন্য এই বইমেলাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে গ্রন্থের বিশ্ববাজার তৈরিতে ফ্রাঙ্কফুর্ট বুসমেসে এক কথায় তুলনাহীন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রকাশকেরা আসে, একে অপরের গ্রন্থস্বত্ব ক্রয় করে, নিজ ভাষায় প্রকাশ করে তা তুলে দেয় নিজ দেশের পাঠকদের হাতে। পাঁচ দিনের মেলায় খুচরা কোন বই বিক্রি হয় না। তবে এবার শেষ তিনদিন খুচরা বই বিক্রির সুযোগ ছিল। ফলে শেষদিন অর্থাৎ ২২ অক্টোবর প্রায় সব স্টল ছিল শূন্য। এবারের বইমেলায় ৯৪টি দেশ থেকে চার হাজারের বেশি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। বিভিন্ন দেশ থেকে বই এবং মিডিয়া বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত এমন ব্যবসায়ী যোগ দেন প্রায় এক লক্ষ ৫ হাজার জন। ১৩০ টি দেশ থেকে আসা সাধারণ দর্শনার্থী ছিল প্রায় ১ লক্ষ ১০ হাজার জন। এই বইমেলাটি মূলত আয়োজন করা হয় প্রকাশনার স্বত্ব বিক্রির জন্য। ফলে এবার এই কাজটি সম্পাদনের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আসা প্রকাশকদের মধ্যকার আলাপ আলোচনা এবং চুক্তি সম্পাদনের জন্য বরাদ্দ ছিল ৫৪৮ টি টেবিল। যাতে কর্ম সম্পাদন করেছে বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ৩২৪ টি এজেন্সি। পাঁচ দিনে পুরো বুসমেসে’তে বিভিন্ন বিষয়ে ২৬০০ অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়। আর বইমেলার খবর সংগ্রহে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৭ হাজার সাংবাদিক অংশ নেন। তাদের মধ্যে আমিও একজন।  ভাবা যায় কত বড় আয়োজন!

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় প্রতি বছর একটি দেশকে ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে আমন্ত্রণ জানানো হয়। এবারের সম্মানিত অতিথি দেশ ছিল ‘স্লোভেনিয়া’। বিশাল দু’টো প্যাভিলিয়ন তাদের জন্য বরাদ্দ ছিল। পাঁচ দিনে নিজের এবং বহির্বিশ্বের কবি-সাহিত্যিকদের নিয়ে এই দুই প্যাভিলিয়নে প্রায় ৭০টি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। স্লোভেনিয়ার প্যাভিলিয়নে প্রতিদিন ছিল লোকে লোকারণ্য। আমি বহু কষ্টে একদিন প্রবেশ করেছিলাম। সংগ্রহ করলাম মিলান জেকোভা (Milan Dekleva)র কাব্যগ্রন্থ ব্লাইন্ড স্পট অফ টাইম। মিলান স্লোভেনিয়ার অন্যতম প্রধান কবি। তিনি শুধু কবিই নন, সাংবাদিকতা, নাটকসহ সেদেশের কথাসাহিত্যে বিপুল বৈভবে দাঁড়িয়ে আছেন। প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ বিশের অধিক। তাঁর প্রকাশিত ছোটগল্প ও উপন্যাস রয়েছে। স্লোভেনিয়াতে প্রথম মিলান জেকোভা হাইকু’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯৪৬ সালে জন্ম নেয়া মিলানের প্রথম কাব্যগ্রন্থ মোশি মোশি’ প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালে। তিনি এখনও সচল স্লোভেনিয়ায়। অসামান্য আরেকটি গ্রন্থ সংগ্রহ করি, সিক্সটিন শর্ট স্টোরিস এনথোলজি অফ দি কনটেম্পরারি স্লোভেনিয়ান শর্ট স্টোরি’। অসাধারণ সব গল্প। গ্রন্থের শুরুতে ১৯৯১ থেকে ২০২২ সালের স্লোভেনিয়ার ছোট গল্প বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধও রয়েছে। আরও বেশ কয়েকজন কবি-লেখকের গ্রন্থ সংগ্রহ করেছি।

জার্মান প্যাভিলিয়নে গিয়ে আমি যার পর নাই বিস্মিত হয়েছি। বিশাল বহুতল ভবনের বৃহদাকার চার চারটি ফ্লোরে লোক ধরার ঠাঁই নাই। একদিন ঠেলা সামলে প্রবেশ করেছিলাম, আর দ্বিতীয়বার প্রবেশের চেষ্টা করিনি। সেদিন ছিল বইমেলার তৃতীয় দিন। খুচরা বই বিক্রি শুরু হয়েছিল। জার্মান ভাষাভাষী পাঠকদের বইকেনার দীর্ঘ লাইন দেখে আমার ঈর্ষা হয়েছিল! অন্তর্জালের আধিপত্যের এ সময়ে ছাপার অক্ষরে বই পাঠ করার জন্য জার্মানের মানুষ দীর্ঘ সারিতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা ছিল জার্মান ভাষার লেখকদের জন্য অন্য রকম প্রাপ্তি। শিশু সাহিত্যিকদের অটোগ্রাফ নেয়ার জন্য শিশু-কিশোর এবং অভিবাভকদের লাইন ছিল দীর্ঘ। সে দেশের অন্যতম প্রধান লেখকদের পাঠক-সারি কেমন ছিল তা আর নাইবা বললাম।

সৌদি আরবের প্যাভিলিয়ন ছিল বেশ আলোকেজ্জ্বল। তাদের আতিথেয়তাও মন্দ লাগেনি। সৌদি আরব যে সব আগল ভেঙে বহির্বিশ্বের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। তারা যে আর ঘরে বন্দি থাকতে চায় না ধর্মীয় গোঁড়ামির ঘেরাকলে। তারই প্রতিফলন দেখতে পেলাম সৌদি প্যাভিলিয়নে। বিশ্বসাহিত্যের খবরা খবর নিচ্ছে তারা। নিজেদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা দিতেও চেষ্টার ত্রুটি দেখিনি।

আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দখলে ছিল বিশাল একটা এলাকা। দু‘টো ফ্লোরে ছোট-বড় মিলিয়ে পঞ্চাশের বেশি স্টল ছিল সেদেশের প্রকাশকদের। দেখলাম অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাদের গ্রন্থের স্বত্ব বেচাকেনার ব্যস্ততা। ভারতের বিভিন্ন ভাষা’র গ্রন্থ ছিল অঞ্চল ভিত্তিক স্টলগুলোতে। ইংরেজি অনুবাদে তাদের সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোও ছিল স্টলে। ইংল্যান্ডের বড় অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। পেঙ্গুইন থেকে শুরু করে ছোট-বড় বিপুল সংখ্যক প্রকাশকের উপস্থিতি এবং দর্শনার্থী ও স্বত্ব ক্রেতাদের বিরামহীন বৈঠক লেগেই ছিল। ইংল্যান্ড থেকে বেশ কয়েকটি শিশুপাঠ্য গ্রন্থের প্রকাশকের উপস্থিতি ছিল প্রাণবন্ত। 

রাশিয়া এবং ইউক্রেইনের প্যাভিলিয়নগুলো সঙ্গতকারণে ছিল সবার দৃষ্টির মধ্যে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা কেবল বিশ্বের শিল্প-সাহিত্য নয়, বৈশ্বিক রাজনৈতিক মেরুকরণেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। ফলে দুই দেশের বিবাদমান যুদ্ধ নিয়ে দর্শনার্থীদের নানা প্রশ্নের উত্তর তো তারা দিয়েছেই, সেই সঙ্গে নিজেদের পক্ষে সমর্থন আদায়ে তারা বেশ কয়েকটি সেমিনারও আয়োজন করতে দেখেছি। রাশিয়ার নির্বাসিত লেখক দিমিত্রি গ্লোকফস্কিকে দেখা গেলো মেলায়। তিনি মূলত সায়েন্স ফিকশন লেখেন। ইউক্রেইন যুদ্ধে রাশিয়ার সমালোচনা করায় তিনি গ্রেফতারী পরোয়ানা নিয়ে দেশ ছেড়েছেন। রাশিয়ান-স্যুইস লেখক মিখাইল সুশকিনকেও দেখা গেল। তিনিই একমাত্র রাশিয়ান লেখক যিনি বুকার পুরস্কার অর্জন করেছেন। তাঁর লেখা প্রায় ত্রিশটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি বই বিক্রির তালিকায়ও রয়েছে তাঁর নাম। তাঁরা প্রাসঙ্গিকভাবে রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ বিষয়ে ছিলেন উচ্চকন্ঠ।

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা হচ্ছে বিশ্বের বই বিক্রেতা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর মিলন মেলা। এ মেলায় বইয়ের বাজার তৈরির ক্ষেত্রে যত ধরনের প্রক্রিয়া অবলম্বন করা যায় তা করা হয়। অসংখ্য সেমিনার আয়োজন করা হয় মুদ্রণশিল্প ও প্রকাশনা প্রক্রিয়া নিয়ে। গ্রন্থের বিশ্ব বাজার সৃষ্টিতে করণীয় কি, সে বিষয়েও একাধিক সেমিনার হয়েছে। বৈশ্বিক জলবায়ু সংকট, রাজনৈতিক অস্থিরতা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। দৃষ্টিনন্দন আগুরা প্যাভিলিয়নে (এটি এবারের মেলায় সেরা স্থাপত্য শিল্পের গৌরব অর্জন করেছে) ‘গণতন্ত্রচর্চার বৈশ্বিক পরিস্থিতি’সহ বিভিন্ন বিষয়ে সেমিনার লেগেই ছিল। সেখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, লেখক, সাংবাদিকদের উপস্থিতি ছিল উল্লেখ করার মতো। 

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার রাজনীতি

ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে সাত অক্টোবর ফিলিস্তিন-ইসরাইল আবার যুদ্ধে মেতে উঠল। অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেনতো অস্থির আগে থেকেই। বৈশ্বিক বিরাজমান অস্থিরতা এবং একে ঘিরে যে রাজনৈতিক মেরুকরণ তার প্রকট প্রভাব অনুভব করলাম ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানেই তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মেলার গেস্ট অফ অনার পাওয়া স্লোভেনিয়ার দার্শনিক স্লাভোজ জিজেক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হামাসের হামলার সমালোচনা করেছেন, বলেছেন, ইসরাইলেরও বাঁচার অধিকার রয়েছে। সেই সঙ্গে তিনি ফিলিস্তিনের অন্ধকার দিকটিতে আলো ফেলে সে বিষয়ে সুচিন্তিত মতামত আমা করেছেন। বলেছেন, ফিলিস্তিনিদের চলমান সংকটের জন্য যেভাবে দায়ী করা হয় তা ঠিক নয়। সঠিক ইতিহাস জানার তাগিদ দিয়েছিলেন তিনি। তাঁকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হলো। দর্শকসারি থেকে কটু ভাষায় কথা শুনা গেলো। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা থেকে এবার ফিলিস্তিনী লেখিকা আদানিয়া শাবলীকে ‘লিবারাটুর পুরস্কার’ দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু যুদ্ধ শুরুর পর সে পুরস্কার বাতিল করে মেলা কর্তৃপক্ষ। শাবলী’র পুরস্কার বাতিল করার কঠোর সমালোচনা করেন স্লাভোজ জিজেক। তিনি একে ‘কলঙ্কজনক’ অধ্যায় বলে মন্তব্য করেন। শুধু তিনি নন পশ্চিমা বিশ্বের প্রধান গণমাধ্যমে এ পুরস্কার বাতিলের বিষয়টি নিয়ে ব্যপক সমালোচনা করে। ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলার একটি সেমিনারে বক্তব্যকালে সালমান রুশদীও তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, এমন আচরণ পুরোপুরি অশোভন। আদানিয়া শিবলিকে তাঁর উপন্যাস ‘এ মাইনর ম্যাটার’-এর জন্য পুরস্কার দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলা কর্তৃপক্ষ। পরে কেন বাতিল হলো সে পুরস্কার ? কি আছে সে উপন্যাসে ? ১৯৪৯ সালে ইসরাইলি সৈন্যরা এক বেদুঈন মহিলাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে, এটিই উপন্যাসের মূল বিষয়। উপন্যাসতো এমন সত্য কথাই বলবে। এটাই স্বাভাবিক। একে কেন্দ্র করে পুরস্কার বাতিল করা কতটুকু রাজনৈতিক তা বুঝতে আমাদের অসুবিধা হওয়ার কথা নয়।  

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন

ছয় নাম্বার ভবনের সি সারির একেবারে শেষে সিঙ্গাপুর প্যাভিলিয়নের ঠিক উল্টো দিকে বাংলাদেশ স্টল দেখে মন ভালো হয়ে যায়। ছোট্ট হলেও আমাদের উপস্থিতি নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ, এটাই তো বড় স্বস্তির কথা। সেখানে গিয়ে প্রথমেই দেখা হয় জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক ও প্রিয় কবি মিনার মনসুরের সঙ্গে। দেখা হয়ে যায় জার্মান দূতাবাসের কর্মকর্তা মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া, ফ্রাঙ্কফুর্টের অন্যতম সংগঠক, লেখক হাবিব বাবুল, ইতালি থেকে আগত লেখক আইরিন পারভীন ও ভিয়েনা থেকে আগত লেখক বুলবুল তালুকদার, অঙ্কুর প্রকাশনার মেসবা আহমেদ, বাতিঘর এর দীপঙ্কর দাশ এবং জার্মানের হ্যানোভারের বাসিন্দা সাংবাদিক ও লেখক সরাফ আহমেদসহ আরও অনেকের সঙ্গে। মুহূর্তেই মনে হলো একটা বাংলাদেশ ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে গেলো। টানা নানা বিষয় নিয়ে কথা হলো। স্টল থেকে ফেসবুকে লাইভ ব্রডকাস্ট করা হচ্ছিলো। তাতে বাংলাদেশর মেলায় অংশগ্রহণ বিষয়ে বিভিন্ন কথা হলো। সর্বশেষ ২০১৯ সালে ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বাংলাদেশের সরব অংশগ্রহণ ছিল। মাঝে তিন বছর করোনার কারণে অংশগ্রহণ ছিল সীমিত। এবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকায় সরব অংশগ্রহণ ছিল। কবি মিনার মনসুর জানালেন, বিভিন্ন দেশের পাঠক, লেখক, প্রকাশকগণ বাংলাদেশ স্টলে আসছেন। কিছু কিছু বইয়ের স্বত্ব তারা চেয়েছেন। এসব আশার কথা শুনে প্রাণিত হচ্ছিলাম। তবে, আমার মনে হলো, বিশ্বের বৃহত্তর এই বইমেলায় বাংলাদেশর অংশগ্রহণ আরও কার্যকর করা যেতে পারে। কেননা এই মেলা এমন একটি স্থান, যেখান থেকে নিজের শিল্প-সাহিত্যকে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে দেয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এই সুযোগ কিংবা সম্ভাবনা আমরা কাজে লাগাতে পারছি কিনা সে প্রশ্ন আমার মনে জেগেছে। সেখানে কথা বলার সময় পুরনো প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অঙ্কুর এর কর্ণধার শ্রদ্ধেয় মেসবা আহমেদের কথায়ও এমন প্রশ্ন ছিল। তিনি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় অংশগ্রহণ করেন ১৯৮৫ সাল থেকে। বিশ্বসাহিত্যের বহু গ্রন্থ তিনি স্বত্ব ক্রয় করে বাংলা ভাষায় প্রকাশ করেছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘হ্যারি পটার’। আমি বইমেলায় ঘুরে ঘুরে দেখলাম, বহু প্যাভিলিয়নে ছোট একটি মঞ্চ রয়েছে, সেখানে কবি-সাহিত্যিক, প্রকাশকদের সঙ্গে নানা বিষয়ে কথা হচ্ছে। তাতে করে সেসব দেশের কবি-সাহিত্যিক এবং প্রকাশকদের সঙ্গে অন্য ভাষাভাষীদের মধ্যে একটা সেতুবন্ধ তৈরি হচ্ছে। এ কাজটি আমাদের প্যাভিলিয়নে থাকলে ভালো হতো বলে আমার মনে হয়েছে। আগামীতে এমন হবে, তা আমি বুঝতে পেরেছি জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক কবি মিনার মনসুরের কথা শুনে। তিনি বারবার ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণকে আরও কিভাবে ঋদ্ধ করা যায় সেসব বিষয়ে কথা বলছিলেন। এবার সীমিত আয়োজনের মধ্য দিয়েও তিনি যতটুকু করেছেন তা কম নয়। আশা করি আগামীতে সরকার আরও বেশি সহযোগিতা করবে, বাজেট বরাদ্দ করবে, যাতে করে আন্তর্জাতিক এই বইমেলায় অংশগ্রহণ যেন কেবল নামে মাত্র না হয়, কাজেও তা প্রমাণিত হয়। আমি টানা তিন দিন বইমেলায় ছিলাম। ঘুরে ফিরে ঠিকানা ছিল বাংলাদেশ স্টল। সেখানে আরও  অনেকের সঙ্গে দেখা হয়েছে।  যাদের নাম এ মুহূর্তে মনে আসছে না। সবার কথায় বার বার একটি আশার কথা শোনা গেছে, ‘ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় একদিন বাংলাদেশ গেস্ট অফ অনার’ হবে। উপস্থিত দূতাবাসের কর্মকর্তারা জানালেন, এ অর্জনের জন্য চেষ্টা চলছে। এখন কথা হলো কিভাবে সে চেষ্টা সফল হবে ? ‘গেস্ট অফ অনার’ এর মর্যাদা পেতে হলে কমপক্ষে তিনশটি অনুবাদ গ্রন্থ থাকতে হবে। আমাদের এ বিষয়টি আগে নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে আশা আর বাস্তবায়নে রূপ লাভ করবে না। আমি মনে করি ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় বাংলাদেশের ‘গেস্ট অফ অনার’ মর্যাদা অর্জন জরুরি। তাতে করে পুরো বিশ্বের বইপ্রেমিদের কাছে দ্রুত বাংলাদেশের শিল্প-সাহিত্য সম্পর্কে আগ্রহ তৈরি হবে। আমরা যে বারবার বলি, নিজেদের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলোর অনুবাদ প্রয়োজন, তা বাস্তবায়নও সহজ হয়ে যাবে। কবি মিনার মনসুরের চোখে মুখে যে দীপ্তি দেখেছি, তাতে করে আমরা আশাবাদী। 

বাংলাদেশি কমিউনিটি আয়োজিত বইমেলা

একুশ অক্টোবর ফ্রাঙ্কফুর্টে বসবাসরত বাংলাদেশি কমিউনিটি প্রথম বারের মতো বাংলা বইমেলার আয়োজন করে। এই ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে পেরে আমারও কম তৃপ্তি হয়নি। প্রথমবারের বইমেলায় বাংলাদেশের বাতিঘর, অঙ্কুর প্রকাশনী, আগামী প্রকাশনী, পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্সসহ বেশ কয়েকটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশগ্রহণ করে। ছিলেন, জার্মান তথা ইউরোপের বিভিন্ন শহর থেকে আসা কবি, সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ। মূল অনুষ্ঠানে বই নিয়ে কথা হয়েছে। আয়োজকদের অন্যতম প্রধান লেখক হাবিব বাবুল ভবিষ্যতে এই বইমেলার সঙ্গে কিভাবে পুরো ইউরোপের বাঙালিদের যুক্ত করা যায় সেসব পরিকল্পনার কথা বলেছেন। ছিল কবিতা পাঠ, আবৃত্তি ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। অনুষ্ঠানের শুরুতে কথা বলেছেন রাষ্ট্রদূত মোশারফ হোসেন ভূঁইয়া, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক কবি মিনার মনসুর, সরাফ আহমেদ, লেখক আইরিন পারভীন, লেখক বুলবুল তালুকদার। আমিও নিজের লেখালেখি নিয়ে কথা বলেছি। সেখানে দেখা হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অন্যতম সংগঠক আব্দুল্লাহ আল ফারুকের সঙ্গে। প্রথম বারের আয়োজন হিসেবে আয়োজকরা উৎরে গেছেন বলা যায়। আগামীতে এই বইমেলা আরও সমৃদ্ধ হবে তা সবার স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ দেখেই বুঝেছি। লন্ডন ছাড়া ইউরোপের অন্য কোনও শহরে বা দেশে বাংলা বইমেলা হয় না। প্রথমবারের মতো ফ্রাঙ্কফুর্টে শুরু হলো।

 লেখক : কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button