আর্কাইভবিশেষ আয়োজন

বিশেষ রচনা : সাহিত্য-উৎসব : বাংলায় বিশ্ব, বিশ্বে বাংলা : পঞ্চম বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ : সুজয় দত্ত

ভোরে ছিল হালকা শিরশিরে বাতাস। সারাদিন মেঘ-রোদের খেলায় গরম ছিল সহনীয়। রাতে ছিল সারি সারি গগনচুম্বী অট্টালিকার নানা কোণ থেকে ঠিকরে আসা আলোয় এক রহস্যময়, অপার্থিব জৌলুস। আর পথে পথে ছিল মানুষের ঢল, গাড়িঘোড়ার ভিড়। সব মিলিয়ে ২০২৩-এ সেপ্টেম্বরের গোড়ায় তিন দিনের লম্বা সপ্তাহান্তে টরন্টো ছিল টরন্টোতেই। অন্যান্য বছরের মতোই। ব্যতিক্রমহীন।

না, ভুল লেখা হলো। ব্যতিক্রম একটি ছিল। মহানগরীর এক বিশেষ ভাষাভাষী অভিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য রীতিমতো এক মহোৎসবের আয়োজন ছিল ওই সপ্তাহান্তে, যা আগে কখনও হয়নি এখানে। আন্তর্জাতিক মহোৎসব। পৃথিবীর পাঁচটি মহাদেশের অন্তত দশটি দেশের প্রবাসী বাঙালিরা এই মহোৎসবে শামিল হয়েছিলেন কোনও না কোনওভাবে―প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ অংশগ্রহণে, সশরীরে উপস্থিত থেকে অথবা অন্তরালে কর্মযজ্ঞে শ্রম ও সময় দিয়ে। এবং এই মহোৎসব কী নিয়ে, কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে―সেটা শুনলে অবাক হতে পারে একবিংশ শতাব্দীর এই সদাব্যস্ত পৃথিবী। সাহিত্য। স্রেফ বাংলা সাহিত্য। অবশ্যি দুদিনব্যাপী সাহিত্যের এই মহাযজ্ঞের সঙ্গে ছিল সংস্কৃতির টাকনা-ও। সারাদিন প্রাণভরে সাহিত্য আলোচনার পর সন্ধ্যায় যন্ত্রসংগীত-কণ্ঠসংগীত-আবৃত্তি ইত্যাদি মিলিয়ে জমজমাট আসর। আর বাঙালিদের ব্যাপার যখন, তখন বলাই বাহুল্য যে এর কোনওটাই হয়নি রসনাতৃপ্তির ঢালাও ব্যবস্থা ছাড়া―সকালে, দুপুরে, বিকেলে এবং রাতে।

গৌরচন্দ্রিকা ছেড়ে এবার আসল কথা। প্রবাসে বাংলা সাহিত্যচর্চার এক অভূতপূর্ব মঞ্চ ‘উত্তর আমেরিকা বাংলা সাহিত্য পরিষদ’ তাদের বার্ষিক ‘বিশ্ব বাংলা সাহিত্য সমাবেশ’ এবার আয়োজন করে কানাডার অন্টারিও প্রদেশের টরন্টোতে। ২০১৯-এ শুরু হওয়া এই বার্ষিক সমাবেশ এই নিয়ে তৃতীয়বার অনুষ্ঠিত হলো সাহিত্যিক-সাহিত্যামোদীদের সশরীর উপস্থিতিতে। আগের দুবার ছিল যুক্তরাষ্ট্রের জর্জিয়া অঙ্গরাজ্যের আটলান্টা মহানগরীতে ২০১৯-এ এবং ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লেক ফরেস্ট শহরে ২০২২-এ। মাঝে দুবার করোনা অতিমারির সময়ে আন্তর্জালে বৈদ্যুতিন সমাবেশ করতে হয়েছিল। সশরীর সমাবেশের ক্ষেত্রে নির্বাচিত শহরটির তরফ থেকে একটি স্থানীয় আয়োজক দল বা সংস্থা এই কর্মযজ্ঞের মূল দায়ভার বহন করে থাকে। এবার সেই দায়িত্বে ছিল টরন্টোর ‘পাঠশালা’, যা কিনা অনেক বছর ধরে শিল্প-সাহিত্য চর্চার এক প্রবহমান প্ল্যাটফর্ম হিসেবে টরন্টো তথা বিশ্বের বঙ্গসমাজকে সমৃদ্ধ করে চলেছে। অনুবাদক, পাঠশালার কর্ণধার ও সাহিত্য পরিষদের কর্মী ফারহানা আজিম শিউলী এবারের পঞ্চম সমাবেশের আহ্বায়ক। তাঁর নেতৃত্বে এই গুরুদায়িত্ব পালনে ‘পাঠশালা’কে সর্বতোভাবে, একনিষ্ঠভাবে ও সার্বক্ষণিকভাবে সাহায্য করেছেন ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টো-নিবাসী, সাহিত্য পরিষদের কর্মী মোহাম্মদ ইরফান। আর তাঁদের পাশে থেকে সার্বিকভাবে সহায়তা করেছেন ঔকভিলের হিল্লোল ভট্টাচার্য, শিকাগোর শৈবাল তালুকদার, ক্লিভল্যান্ডের সুজয় দত্ত, ফ্লোরিডার পূরবী বসুসহ সাহিত্য পরিষদের কয়েকজন অভিজ্ঞ সদস্য।    

সমাবেশের প্রায় সাত-আট মাস আগে শুরু হওয়া প্রস্তুতিপর্বে প্রথমেই যে কঠিন কাজটি করতে হয়, তা হলো অনুষ্ঠানস্থল বা ভেন্যু নির্বাচন। আসনসংখ্যা, পরিসর, প্রযুক্তিগত পরিকাঠামো, অতিথিদের আবাসস্থলের নৈকট্য, যাতায়াতের সুবিধা-অসুবিধা ইত্যাদির বিচারে গ্রহণযোগ্য যে ভেন্যুটি বহু অনুসন্ধানে পাওয়া যায় শেষ অবধি, তা এই ধরনের আসরের জন্য বিশেষভাবে উপযোগী অন্য একটি কারণেও। টরন্টোর নর্থ ইয়র্কে অবস্থিত জাপানিজ কানাডিয়ান কালচারাল সেন্টারের বহিরঙ্গে, ভেতরের পরিবেশ ও সাজসজ্জায় এবং সামগ্রিক ব্যবস্থাপনায় সারাক্ষণই একটা সংস্কৃতির আবহ তৈরি হয়ে আছে―আর নতুন করে আরোপ করতে হয় না সেটা। এরপর দীর্ঘদিন ধরে চলে সম্ভাব্য অংশগ্রহণকারীদের আমন্ত্রণপর্ব ও  নিবন্ধনপর্ব, সমাবেশের তহবিলে অর্থসংগ্রহ, প্রকাশিতব্য স্যুভেনিরের জন্য বিজ্ঞাপন সংগ্রহ ও অন্য নানা আনুষঙ্গিক কাজ। স্যুভেনিরটিকে ছবিতে-লেখায় সাজিয়ে-গুছিয়ে সুন্দর ও যথাসম্ভব নির্ভুল করার দায়িত্ব পড়ে তার নিজস্ব একটি সম্পাদকমণ্ডলীর ওপর। স্যুভেনিরের প্রচ্ছদ করেন রাগীব আহসান এবং সেটি প্রকাশনার ভার নেন টরন্টোর নন্দন মিডিয়া অ্যান্ড ডিজাইনের নীল উৎপল। সমাবেশের প্রচারণায় সারথি হয় প্রথম আলো, টরন্টোর বাংলা কাগজ-সহ আরও বেশ কয়েকটি কাগজ ও নন্দন টিভি। সমাবেশের সময় যত এগিয়ে আসে, অনুষ্ঠানসূচি তৈরি করা এবং দুদিনের স্বরচিত লেখা পাঠের সেশন ও আলোচনাচক্রগুলির সঞ্চালক-আলোচক ঠিক করা কঠিন থেকে কঠিনতর হয়ে দাঁড়ায়, কারণ সীমিত সময়ের মধ্যে সব অংশগ্রহণকারীকে তাঁদের যথাযথ ভূমিকায় জায়গা করে দেওয়াটা সত্যিই দুরূহ। ঘন ঘন সাংগঠনিক সভায় এই বিষয়গুলি নিয়ে আলাপ-আলোচনা ছাড়াও অনুষ্ঠানের দিনদুটিতে স্থানীয় আয়োজন ও আতিথেয়তার খুঁটিনাটি পরিকল্পনা সেরে ফেলতে হচ্ছিল আহ্বায়ক ফারহানা আজিম শিউলী ও তাঁর মুখ্য সহায়ক মোহাম্মদ ইরফানকে। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের যে দলটি গঠন করা হয় ঐ উদ্দেশ্যে, তাদের কথায় পরে আসছি।

এসবের সঙ্গে সমান্তরালে চলছিল আরও একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ পর্ব। আমাদের বার্ষিক সমাবেশের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলো এই উপলক্ষ্যে প্রকাশিত স্মারক সাহিত্য সংকলন হৃদবাংলা। এই সমাবেশ যে শুধু  অল্পসময়ের জন্য ফুলকি ছড়িয়েই শেষ হয়ে যায় না, প্রবাসী সাহিত্যপ্রেমীদের ওপর দীর্ঘস্থায়ী ছাপ রেখে যায়, তার কারণ এই সংকলনটি। সারা বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে যত সাহিত্যমনস্ক বাঙালি অভিবাসী ছড়িয়ে আছেন, পরিষদের তরফ থেকে তাঁদের যতজনের কাছে সম্ভব পৌঁছানো এবং হৃদবাংলায় লেখা দিতে আহ্বান করা থেকে শুরু করে লেখা সংগ্রহ, সম্পাদনার জন্য সেগুলির সুষম বণ্টন, প্রতিটি লেখার সযত্ন সম্পাদনা ও ক্ষেত্রবিশেষে উন্নতিসাধন এবং সেই উদ্দেশ্যে মাসের পর মাস অসংখ্য সমন্বয়সভায় অংশগ্রহণ―সব মিলিয়ে কাজের তালিকা সুদীর্ঘ। এখানেই শেষ নয়, এরপর আছে সম্পাদিত লেখাগুলির গ্রন্থনা, কপি এডিটিং ও চূড়ান্ত পিডিএফ প্রস্তুতকরণ। এই অত্যন্ত শ্রমসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ কাজগুলি এবার করেছেন মোহাম্মদ ইরফানের সুযোগ্য নেতৃত্বে এগারো সদস্যের এক সম্পাদকমণ্ডলী। সম্পাদকমণ্ডলীতে ছিলেন―হিল্লোল ভট্টাচার্য, সুজয় দত্ত, শৈবাল তালুকদার, শীলা মোস্তাফা, রশ্মী ভৌমিক, মাকসুদা আইরীন মুকুল, ফারহানা আজিম শিউলী, পূরবী বসু, দীপেন ভট্টাচার্য, গাজী আবদুর রশীদ ও অমিতাভ রক্ষিত। প্রধান সম্পাদক হিসেবে মাথার ওপর ছিলেন জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত স্বয়ং। ২০২৩-এর হৃদবাংলায় গত চার বছরের তুলনায় লেখার সংখ্যা অনেক বেশি, সৌজন্যে আহ্বায়ক ফারহানা আজিম শিউলীর ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসা কানাডার একঝাঁক লেখক-লেখিকা যাঁরা এবারেই প্রথম লিখলেন এই সংকলনে। পাঁচটি মহাদেশের দুই শতাধিক অভিবাসী বাংলাভাষী লেখক লেখা পাঠিয়েছেন  হৃদবাংলার জন্য। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় একটির বদলে দুটি খণ্ডে ভাগ হবে সংকলনটি―কবিতা ও গল্প প্রথম পর্বে, প্রবন্ধ ও বিবিধ রচনা দ্বিতীয় পর্বে। শুধু সংখ্যা নয়, বৈচিত্র্য এবং মানসম্মত লেখারও সমাবেশ ঘটেছে দুই খণ্ডের এই সংকলনে। দুটি খণ্ডেই শোভা পাবে শিল্পী মুনিরা নকীর আঁকা একটি ব্যতিক্রমী প্রচ্ছদ এবং শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমামের আঁকা লোগো।

সময় বয়ে চলল তার নিজের গতিতে। দেখতে দেখতে এসে পড়ল সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। শুক্রবার ১লা সেপ্টেম্বর থেকে টরন্টোর ডন ভ্যালি হোটেলের লবিতে, লাউঞ্জে, প্যাসেজে, লিফটে―সর্বত্র শোনা যেতে লাগল সেই ভাষা যাতে এককালে লেখা হয়েছিল গীতাঞ্জলি, যাকে ঘিরে উত্তাল হয়ে উঠেছিল বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, যাতে আমরা আজও স্বপ্ন দেখি। এবং এই সময়েই বোঝা গেল অদিতি, আজাদ, কান্তা, খসরু, ত্বিষা, তুহিন, বনাঙ্কুর, শর্মী, শাওন, শাম্মী, শাহীন, সানন্দা, হিমাদ্রীদের নিয়ে কী অসামান্য একটি স্বেচ্ছাসেবক দল তৈরি করেছেন ফারহানা আজিম শিউলী। একগুচ্ছ উৎসাহী মুখে সারাক্ষণ হাসি, হয়তোবা টুকরো রসিকতা, অচেনা অজানা বহিরাগতদের মুহূর্তে আপন করে নেওয়ার আন্তরিকতা, চমৎকার বোঝাপড়া নিজেদের মধ্যে এবং সর্বোপরি হাতে হাত মিলিয়ে পরিশ্রম। সে অনুষ্ঠানস্থলে প্রাক-উদ্বোধনী প্রস্তুতিতেই হোক বা হোটেলে নৈশভোজের ব্যবস্থাপনায়, পরবর্তী দুদিন অনুষ্ঠানের ফাঁকে ফাঁকে মঞ্চসজ্জা বা ঘোষণাতেই হোক কিংবা নিবন্ধনের টেবিল সামলানোয়। সেদিন রাতে নৈশভোজের পরে জমিয়ে আড্ডা আর নিশ্চিন্ত ঘুমের শেষে সকালে উঠতে না উঠতেই দেখা গেল অতিথিদের জন্য প্রাতঃরাশ অপেক্ষা করছে। তারপর হোটেলের অদূরে ভেন্যুতে পৌঁছতেই একের পর এক চমক।

প্রথম চমক বিশালাকার সমাবেশকক্ষের বিস্তৃত পরিসরকে ভাগ-ভাগ করে যেভাবে মূল অনুষ্ঠানমঞ্চ ও দর্শকাসন, খাওয়াদাওয়া ও আলাপচারিতার ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত সহায়তার যন্ত্রপাতি, স্বেচ্ছাসেবকদের টেবিল―সব এক ছাদের তলায় নিয়ে আসা হয়েছে। দ্বিতীয় চমক সমাবেশকক্ষের একপাশে সংরক্ষিত টেবিলে অতিথি-লেখকদের নিয়ে আসা বই প্রদর্শনীর ব্যবস্থা। তৃতীয় চমক (এটি অবশ্যি যাঁরা হোটেলে ছিলেন তাঁরা আগের রাতেই পেয়েছেন) শতাধিক নিবন্ধনকারীর জন্য শান্তিনিকেতন থেকে নিয়ে আসা সমাবেশ, সাহিত্য পরিষদ ও পাঠশালার লোগো সাঁটানো সুদৃশ্য হাতে-তৈরি কাপড়ের ঝোলাব্যাগ। এবং চতুর্থ চমক উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মঞ্চে সাহিত্য পরিষদের পুরোধা ব্যক্তিত্ব প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত), কথাসাহিত্যিক পূরবী বসু (বাংলা একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত), বাংলা অভিধান প্রণেতা জামিল চৌধুরী (একুশে পদকপ্রাপ্ত), কানাডিয়ান পার্লামেন্টারি পোয়েট লরিয়েট জর্জ এলিয়ট ক্লার্ক, গত সমাবেশের আহ্বায়ক দীপেন ভট্টাচার্যের উপস্থিতি। চমৎকার মঞ্চসজ্জা (সৌজন্যে শাহীন) আর নিখুঁত শব্দসমন্বয় (সৌজন্যে স্থানীয় শব্দযন্ত্রী মাহবুব) ছিল অনুষ্ঠানের বাড়তি আকর্ষণ। স্বনামধন্য নৃত্যশিল্পী সুলতানা হায়দার ও অরুণা হায়দারের নেতৃত্বে স্থানীয় নৃত্যগোষ্ঠী সুকন্যা নৃত্যাঙ্গনের শিল্পীদের অপূর্ব নৃত্যপরিবেশনার পর মঞ্চে প্রদীপ জ্বালিয়ে সমাবেশের উদ্বোধন, উপস্থিত বিশিষ্ট অভ্যাগতদের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য, প্রধান সম্পাদক ও সম্পাদকের হাতে সদ্যপ্রকাশিত হৃদবাংলার মোড়ক উন্মোচন এবং স্বেচ্ছাসেবকদের পরিচিতি দিয়ে শেষ হয় সকালের অনুষ্ঠানের প্রথম পর্ব। বাংলা ভাষার অন্যতম কবি আসাদ চৌধুরীরও (একুশে পদক ও বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত) থাকবার কথা ছিল এই মঞ্চে। শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি আসতে না পারলেও তাঁকে স্মরণ করা হয় এবং তাঁর রোগমুক্তির জন্য শুভকামনা জানানো হয়। এ পর্বটি পরিচালনা ও স্বাগত বক্তব্য রাখেন এবারের সমাবেশের আহ্বায়ক ফারহানা আজিম শিউলী। 

দ্বিতীয় পর্বে একটি বহুপ্রতীক্ষিত প্যানেল আলোচনা। নাম ‘রবীন্দ্রনাথ: জ্ঞান ও শিল্পের আনন্দতীর্থে।’ দীপেন ভট্টাচার্যের সঞ্চালনায় এই প্যানেলে তিনজন আলোচক রবীন্দ্রনাথের এমন তিনটি দিক নিয়ে আলোচনা করেন যার ওপর সচরাচর আলোকপাত করা হয় না। রবীন্দ্রগবেষক শক্তি দাস (ক্যালিফোর্নিয়া) বলেন কবির আংশিক বর্ণান্ধতা ও তাঁর চিত্রকলার ওপর এই প্রতিবন্ধকতার প্রভাব নিয়ে। অধ্যাপক, সুলেখক সেলিম জাহান (লন্ডন) বক্তব্য রাখেন কবির অর্থনীতি-দর্শন নিয়ে। আর মৌসুমী দত্তরায় (নিউ ইয়র্ক) উপস্থিত শ্রোতা-দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেন একটি অভিনব ও অতিগুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের সঙ্গে যা তিনি ও তাঁর স্বামী কাজল মুখোপাধ্যায় সম্প্রতি শুরু করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় অঙ্গরাজ্যের আরবানা-শ্যাম্পেনে। ‘টেগোর হাউস ইনিশিয়েটিভ’ নামক এই প্রকল্পের উদ্দেশ্য হলো কবিপুত্র রথীন্দ্রনাথের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষিবিদ্যা-অধ্যয়নের সময় কবি তাঁর যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে আর্বানা-শ্যাম্পেনের যে বাড়িটিতে বেশ কিছুদিন ছিলেন, সেটি কিনে নিয়ে তাকে ভগ্নদশা থেকে উদ্ধার করে তার যথোপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে কবির স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানো।

এদিন মধ্যাহ্নভোজের আগে শেষ আকর্ষণ ছিল স্বরচিত গল্পপাঠ। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যাক্রামেন্টোর মাকসুদা আইরীন মুকুলের সঞ্চালনায় একে একে ছজন গল্পকার―খায়রুল আনাম (শিকাগো), শবনম সায়েমা (টরন্টো), রুমা বসু (অটোয়া), শাহাব আহমেদ (ফ্লোরিডা), রাশেদা নাসরীন (ক্যালিফোর্নিয়া), রুমানা চৌধুরী (টরন্টো) পড়েন তাঁদের লেখা। প্রতিটি গল্প নিয়ে অল্প কয়েক মিনিটে মতামত জানান ভার্জিনিয়ার দুই আলোচক আনোয়ার ইকবাল ও মোস্তফা তানিম, যাঁরা নিজেরাও সুলেখক হিসেবে পরিচিত। সব মিলিয়ে সেশনটি যে যথেষ্ট উপভোগ্য হয়েছিল, তা দর্শক-প্রতিক্রিয়া থেকেই স্পষ্ট।

মধ্যাহ্নভোজের একটি ঘণ্টা নির্ভেজাল আড্ডায় কাটার পর শাহীন ইসলামের (ভার্জিনিয়া) সঞ্চালনায় স্বরচিত কবিতাপাঠের পালা। এই পর্বে অংশ নেন―আতোয়ার রহমান (টরন্টো), আইনুন আফরোজা (টরন্টো), কাজী হেলাল (টরন্টো), শীলা মোস্তাফা (ক্যালিফোর্নিয়া), রেজা অনিরুদ্ধ (টরন্টো), দেবাশীষ মৃধা (মিশিগান), দিলারা হাফিজ (টরন্টো), মোস্তফা তানিম (ভার্জিনিয়া) ও তাজুল ইমাম (নিউ ইয়র্ক)। পঠিত কবিতা নিয়ে আলোচনা করেন সুদূর ইংল্যান্ড থেকে আসা কবি শামীম আজাদ (বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত) ও দক্ষিণ ক্যালিফোর্নিয়ার জনপ্রিয় সাহিত্যিক দীপেন ভট্টাচার্য। নানা স্বাদের ও ধরনের একঝাঁক কবিতা এবং তা নিয়ে মনোজ্ঞ আলোচনা শ্রোতাদের মধ্যে যে আমেজ সৃষ্টি করে দিয়ে যায়, তারই রেশ ধরে পরবর্তী আলোচনাচক্রটিও কবিতা নিয়ে। এবার বিষয় ‘রবীন্দ্রোত্তর কবিতা: কল্লোল থেকে কাদরী―বাসে ও প্রবাসে।’ এই প্যানেলের নির্ধারিত সঞ্চালক শিকাগোর শৈবাল তালুকদার শেষ মুহূর্তে করোনা-আক্রান্ত হয়ে আসতে না পারায় আসর পরিচালনার দায়িত্ব পড়ে মোহাম্মদ ইরফানের ওপর এবং তিনি তা যথেষ্ট মুন্সিয়ানার সঙ্গে পালন করেন। ফ্লোরিডা থেকে আগত আলোচক কথাসাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, নিউ ইয়র্ক থেকে আসা সাহিত্যতাত্ত্বিক-প্রাবন্ধিক আবেদীন কাদের ও টরন্টো নিবাসী কবি দেলোয়ার এলাহী নিজ-নিজ ক্ষেত্রে স্বীয় কৃতিত্বে উজ্জ্বল। আলোচ্য বিষয়টির বিস্তীর্ণ গভীরতায় তাঁরা স্বচ্ছন্দে সাঁতার কাটেন ও শ্রোতাদের আবিষ্ট করে রাখেন। এ পর্যায়ে আলোচনার সূত্র ধরেই দেখানো হয় বাংলা ভাষার অন্যতম কবি শহীদ কাদরীকে নিয়ে নজরুল কবীর-নির্মিত ও তাজুল ইমাম-সুরারোপিত ‘রূপালী ডানা’ তথ্যচিত্র। আলোচকত্রয়ীর  জ্ঞানগর্ভ ও তথ্যপূর্ণ আলোচনায় ঋদ্ধ হয়ে ও তথ্যচিত্র দেখে আবিষ্ট হয়ে শ্রোতারা যখন ভাবছেন এর পরে কী, তখনই ঘোষণা করা হয়, সেদিনের সাহিত্য সেশনগুলির শেষে সমাবেশকক্ষে প্রদর্শিত হবে একটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের কাহিনিচিত্র।

সাহিত্যের একটি সেশন অবশ্যি তখনও বাকি। স্বরচিত প্রবন্ধ ও বিবিধ রচনার এই সেশনটিতে গল্পকার সুজয় দত্তের সঞ্চালনায় পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে  লেখা পাঠ করেন―ফারাহ্ নাজ (লন্ডন), আলমগীর ফরিদুল হক স্বপন (ইংল্যান্ড), সুলতানা শিরিন সাজি (অটোয়া), শ্রুতি দে (নিউ ইয়র্ক) ও শামীম আমিনুর রহমান (টরন্টো)। লেখাগুলির বিষয়বস্তু ও লেখনভঙ্গির বৈচিত্র্য সেই পড়ন্ত বেলায়ও শ্রোতাদের মনোযোগ অটুট রাখতে পেরেছিল, যথেষ্ট প্রশংসাও পেয়েছিল। লোকসাহিত্য, রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ- সচেতনতা ও ঢাকা শহরকে নিয়ে দু-আড়াইশো বছরের পুরোনো চিত্রশিল্পের ওপর তিনটি চিত্তাকর্ষক প্রবন্ধের সঙ্গে ছিল দুটি চমৎকার স্মৃতিকথা। লেখাগুলি নিয়ে সুলেখক আবেদীন কাদের ও রেজা অনিরুদ্ধর সংক্ষিপ্ত মন্তব্য থেকেও শ্রোতারা অনেক কিছু পান।  

সারাদিনের সাহিত্য-অবগাহনের সুখস্মৃতি মনে নিয়ে সবাই বৈকালিক চা-জলখাবারের পাট তাড়াতাড়ি চুকিয়ে ফেলেন। কারণ এরপরই প্রদর্শিত হয় অভিবাসী কথাসাহিত্যিক পূরবী বসুর ‘ঘরে ফেরা’ গল্প অবলম্বনে সরকারি অনুদানে কামরুল হাসান লেনিনের  নির্মিত একই নামের পুরস্কারপ্রাপ্ত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।

চলচ্চিত্র প্রদর্শনীর পরই টরন্টোর প্রিয় মুখ বনাঙ্কুর মোস্তফা ও নাজমা কাজীর সাবলীল ও মনোগ্রাহী সঞ্চালনায় সান্ধ্য সাংস্কৃতিক পর্বে স্বনামধন্য বর্ষীয়ান শিল্পী এনামুল কবীরের অনবদ্য ইলেকট্রিক গিটার বাদন ও কয়েকটি মনোমুগ্ধকর আবৃত্তির (সৌজন্যে মাকসুদা আইরীন মুকুল, রেজা অনিরুদ্ধ, শীলা মোস্তাফা, ম্যাক আজাদ, রওশন জাহান ঊর্মি) পাশাপাশি সংগীতশিল্পী মণিকা মুনা ও অনন্যা শিলার সুললিত কণ্ঠে অনেকগুলি গান শোনেন শ্রোতারা। এরপর গাইলেন এ পর্বের মুখ্য আকর্ষণ টরন্টোর প্রথিতযশা সঙ্গীতশিল্পী, বাংলা সঙ্গীতের প্রাণপুরুষ কলিম শরাফী-তনয়া আলিয়া শরাফী। তাঁর সম্মোহনী কণ্ঠের জাদু দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আবিষ্ট করে রাখলেন সবাইকে। তাঁকে এই অনুষ্ঠানে এভাবে পাওয়াটা সকলের কাছেই এক বিরাট প্রাপ্তি। তার সঙ্গে উপরি পাওনা মঞ্চে একসঙ্গে তিনজন কৃতী যন্ত্রানুসঙ্গীর উপস্থিতি―তবলায় পণ্ডিত অশোক দত্ত, সারেঙ্গিতে পণ্ডিত পঙ্কজ মিশ্র ও হারমোনিয়ামে অমিত শুভ্র রায়। সবশেষে সংগীতশিল্পী  ও চিত্রশিল্পী, শ্রদ্ধেয় মুক্তিযোদ্ধা তাজুল ইমাম তাঁর উদাত্ত গলায় মন-ছুঁয়ে-যাওয়া কয়েকটি গানে মুগ্ধ করেন শ্রোতাদের। সেই সুরেলা মাধুর্যের রেশ কাটার আগেই অবশেষে জিভে-জল-আনা নৈশভোজ দিয়ে দাঁড়ি টানা হয় সমাবেশের প্রথম দিনের।

প্রথম দিনের ভুরিভোজ ভালো করে হজম হতে না হতেই চলে এল দ্বিতীয় দিনের সকাল। সারাদিন ধরে ঠাসা অনুষ্ঠানসূচি, দম ফেলার ফুরসত নেই―সে কথা ভেবেই বোধহয় শ্রোতারা সকালে ধীরেসুস্থে একটু দেরি করে আসেন অনুষ্ঠানস্থলে। কিন্তু শুরুটা কিছুটা দেরিতে হলেও আয়োজকদের তৎপরতায় ও প্রত্যুৎপন্নমতিত্বে দিনের বাকি অনুষ্ঠানগুলির ওপর তার প্রভাব তেমন পড়েনি। সেদিনের সাহিত্যপর্ব শুরু হয় স্বরচিত গল্পপাঠের আসর দিয়ে। নির্ধারিত সঞ্চালক আঞ্জুমান রোজীর অনুপস্থিতিতে মোহাম্মদ ইরফান সঞ্চালকের আসনে বসে একটি সুন্দর সেশন উপহার দেন। পাঠে অংশ নেন―কামাল উদ্দিন (টরন্টো), তপতী রায় (স্যাক্রামেন্টো), ফাতমা সুমাইয়া খান (টরন্টো), সুজয় দত্ত, আনোয়ার ইকবাল ও লিজি রহমান (নিউ ইয়র্ক)। ছটি গল্পই স্বীয় বৈশিষ্ট্যে শ্রোতাদের মনে অল্পবিস্তর দাগ কাটতে পেরেছিল। আলোচক শাহাব আহমেদ ও হিল্লোল ভট্টাচার্য যে নিজেরা শক্তিশালী গল্পকার, তা তাঁদের সংক্ষিপ্ত মন্তব্য বা বিশ্লেষণের ভঙ্গি থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি কারও।

এই বার্ষিক সমাবেশের পরিচিত স্লোগানটি হলো ‘বাংলায় বিশ্ব, বিশ্বে বাংলা।’ স্বরচিত গল্পপাঠের সেশনটি শেষ হতে না হতেই যে প্যানেল আলোচনার তোড়জোড় দেখা যায় মঞ্চে, তার শিরোনামও ওই একই শব্দবন্ধ। সমগ্র অনুষ্ঠানে এই প্রথম কোনও একটি আলোচনাচক্রে আন্তর্জালের মাধ্যমে কেউ অংশগ্রহণ করলেন অন্য মহাদেশ থেকে―ইংল্যান্ড-নিবাসী অধ্যাপক, সুপরিচিত কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জমান। তিনি ছাড়াও আলোচক ছিলেন পূরবী বসু, শাহাব আহমেদ, শামীম আজাদ ও আরিফ আনোয়ার। সুজয় দত্তের সঞ্চালনা ছিল সুপরিকল্পিত, তাই শেষদিকে আয়োজকদের কিঞ্চিৎ সময়াভাব সত্ত্বেও আলোচনা ভালোই হয়েছে। পূরবী বসু অভিবাসী সাহিত্যের শুরুর ও বিবর্তনের ইতিহাস নিয়ে বলার পর সুদূর সাগরপাড় থেকে শাহাদুজ্জমান ‘বাংলা কি বিশ্বের কাছে স্বাগত ? কেন, অথবা কেন নয় ?’ এই প্রশ্নের উত্তর দেন রাজনীতি ও অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে, যার সঙ্গে পূরবী বসু যোগ করেন আরও কিছু প্রয়োজনীয় কথা। শাহাব আহমেদ ও টরন্টো থেকে যোগ দেওয়া আরিফ আনোয়ার বাংলা ও বিশ্বের মধ্যে এই আদানপ্রদানের মূল সরণীগুলির ওপর বক্তব্য রাখেন। প্রথমজন বলেন অনুবাদ সাহিত্যের গুরুত্ব ও এই প্রসঙ্গে তাঁর নিজের সংস্থা ’ট্রান্সলেশন ফাউন্ডেশন’-এর কাজকর্ম নিয়ে, আর দ্বিতীয়জন ইংরেজিতে বা অন্য বিদেশি ভাষায় বাংলা-কেন্দ্রিক গল্প বা উপন্যাস লেখার অভিজ্ঞতা নিয়ে। সবশেষে শামীম আজাদ তাঁর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে অপূর্ব একটি বক্তব্য রাখেন যুক্তরাজ্যে তাঁর দীর্ঘ প্রবাসকালে বাংলার ওপর বিশ্বায়নের কী কী প্রভাব লক্ষ করেছেন, সেই বিষয়ে।

এরপর যে প্যানেল আলোচনাটি মঞ্চস্থ হবার কথা তার বিষয়বস্তু এমনই চিত্তাকর্ষক যে তাকে ঘিরে আগ্রহ আর ঔৎসুক্যের বাতাবরণ তৈরি হয়েই ছিল। ‘কাগজ, ক্যানভাস, সেলুলয়েড: চিত্রকলা ও চলচ্চিত্রে সাহিত্য’ শীর্ষক এই আলোচনাচক্রে ফারহানা আজিম শিউলীর সুন্দর ও সপ্রতিভ সঞ্চালনায় এই প্যানেলে  উপস্থিত থেকে আলোচনায় অংশ নেন টরন্টোর গল্পকার-চিত্রশিল্পী সৈয়দ ইকবাল (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরস্কারপ্রাপ্ত), ইংল্যান্ড থেকে আগত শিল্প সমালোচক আলমগীর ফরিদুল হক স্বপন, যুক্তরাষ্ট্রের মেইন থেকে মিনিমালিস্ট চিত্রশিল্পী মুনিরা নকী ও ফ্রান্স থেকে আগত চলচ্চিত্রকার আমীরুল আরহাম, আর আন্তর্জালের মাধ্যমে নিউইয়র্ক থেকে যোগ দেন কথাসাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকার আনোয়ার শাহাদাত। আমীরুল আরহাম বলেন চলচ্চিত্রের সাহিত্যের সঙ্গে পথপরিক্রমা ও চলচ্চিত্রে সাহিত্যিক বিষয়ে। মিনিমালিস্ট শিল্পী ও তাঁর চিত্রশিল্পে সাহিত্য কীভাবে প্রচ্ছন্ন থেকেও ব্যাপ্ত থাকে, তা উঠে আসে মুনিরা নকীর আলোচনায়। চিত্রকলা ও সাহিত্য এই দুই শিল্পমাধ্যমে যাতায়াতের অভিজ্ঞতা উঠে আসে সৈয়দ ইকবালের আলোচনায়। বাংলায় সাহিত্যাশ্রিত চলচ্চিত্র কতটা উত্তীর্ণ বিষয়ে বলেন আনোয়ার শাহাদাত। সাহিত্য-চলচ্চিত্র-চিত্রকলা এই ত্রয়ী মাধ্যমের সংযোগ নিয়ে বলেন আলমগীর হক স্বপন। স্ব স্ব ক্ষেত্রে অত্যন্ত যোগ্য পাঁচজন আলোচকের, চলচ্চিত্র-সাহিত্য-চিত্রকলা―এই ত্রয়ী শিল্পমাধ্যমের আন্তঃসংযোগ, বিনিময়, মিথস্ক্রিয়া, স্বাতন্ত্র্য নিয়ে আলোচনায় ঋদ্ধ হন শ্রোতারা।

স্বরচিত কবিতাপাঠের দ্বিতীয় আসরটি ছিল মধ্যাহ্নভোজের ঠিক আগেই। এদিন পাঠ করেন―সুস্মিতা দেবনাথ (নিউ ইয়র্ক), সৈকত রুশদী (টরন্টো), পপি চৌধুরী (কানেকটিকাট), মুস্তাফা মাহমুদ (টরন্টো), মেহরাব রহমান (টরন্টো), তসলিমা হাসান (টরন্টো), উম্মে সালমা আবদুল্লাহ (ব্র্যাম্পটন), নয়ন হাফিজ (টরন্টো), হিল্লোল ভট্টাচার্য (ঔকভিল), আমীরুল আরহাম (ফ্রান্স), সৈয়দা রোখসানা বেগম (টরন্টো), হোসনে আরা জেমী (টরন্টো) ও বেনজির শিকদার (নিউ ইয়র্ক)। তাঁদের পঠিত কবিতাগুলির মধ্যে পাওয়া গেল বেশ কিছু মণিমুক্তো। সেসব কবিতা নিয়ে টরন্টো থেকে যোগ দেওয়া দুইজন আলোচক কবি দিলারা হাফিজ ও দেলওয়ার এলাহীর সংক্ষিপ্ত অথচ মনোগ্রাহী বিশ্লেষণ এই সেশনটিকে একটি আলাদা মাত্রা দেয়। সঞ্চালক শীলা মোস্তাফাও ছিলেন সাবলীল।

মধ্যাহ্নভোজের অব্যবহিত পরে যে পর্বটি শুরু হয় তা বিগত প্রত্যেক সমাবেশেরই একটি বিশেষ আকর্ষণ। বই পরিচিতি। নিবন্ধিত লেখকদের মধ্যে যাঁরা নিজেদের সম্প্রতি প্রকাশিত বইয়ের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিতে চান, তাঁদের একে একে মঞ্চে আহ্বান করে স্বল্প সময়ে বইটি সম্বন্ধে কিছু কথা বলতে অনুরোধ করেন সঞ্চালক। এবারেও এই পর্বটি নিয়ে লেখকদের ও শ্রোতাদের উৎসাহের কমতি ছিল না। ফারাহ্ নাজ, সানন্দা চক্রবর্তী ও নাজমা কাজীর সঞ্চালনায় বই পরিচিতিতে অংশ নেন―সুজয় দত্ত, মেহরাব রহমান, সুলতানা শিরিন সাজি, দিলারা হাফিজ, মুস্তাফা মাহমুদ, হোসনে আরা জেমী, রুমা বসু, শাহাব আহমেদ, আইনুন আফরোজা, শীলা মোস্তাফা, মোস্তফা তানিম, রুমানা চৌধুরী, কাজী হেলাল, ফারাহ্ নাজ ও বেনজির শিকদার। বেশ কিছু নতুন বইয়ের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয় জানা গেল এ পর্বে।

আগের দিন যেমন রবীন্দ্রোত্তর কবিতা নিয়ে একটি প্যানেল আলোচনা ছিল, এদিন তেমনি ছিল গল্প নিয়ে। আর এই প্যানেল আলোচনা ঘিরে ছিল সবার প্রত্যাশা ও ঔৎসুক্য। মোহাম্মদ ইরফানের সঞ্চালনায় ‘বাংলা গদ্যের নানা ধারা’ নামে এই প্যানেলের আলোচক ছিলেন সুলেখক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, দীপেন ভট্টাচার্য,  খসরু চৌধুরী (টরন্টো), সেরীন ফেরদৌস (টরন্টো) ও সাগুফতা শারমীন তানিয়া। সাগুফতা (সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ পুরষ্কারপ্রাপ্ত) লন্ডন থেকে আন্তর্জালে যোগ দেন। এই প্যনেলে আলোচকগণ বাংলা গল্প, উপন্যাস ছাড়াও সংবাদপত্র, বিজ্ঞান ও পরিবেশ ইত্যাকার নানা ধারার গদ্যের গতিপ্রকৃতি, সামাজিক অনুষঙ্গ, সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করেন। আলোচনা শুনে ঋদ্ধ হন শ্রোতারা।

এদিনের স্বরচিত প্রবন্ধ ও বিবিধ রচনা পাঠের সংক্ষিপ্ত সেশনটিতে শিকাগো নিবাসী খায়রুল আনামের  সঞ্চালনায় ও টরন্টোর শওগাত আলী সাগরের আলোচনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে প্রবন্ধ পড়েন নীনা হাসেল (ব্রিটিশ কলম্বিয়া)। বিষয়টি ছিল মাতৃতন্ত্রের অবসান ও পিতৃতন্ত্রের উত্থান। 

দেখতে দেখতে ঘনিয়ে আসে মিলনমেলায় যবনিকা পড়ার সময়। শেষের ঠিক আগে প্রথা অনুযায়ী ঘোষণা করা হয় আগামীবারের আয়োজক শহরের নাম, সর্বসমক্ষে আনা হয় সেখানকার আহ্বায়কদের আন্তর্জালের মাধ্যমে। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, পূরবী বসু, দীপেন ভট্টাচার্য ও মোহাম্মদ ইরফানের উজ্জ্বল উপস্থিতিতে এবারের আহ্বায়ক ফারহানা আজিম শিউলীর হাত থেকে দায়িত্বের ‘ব্যাটন’ অর্পিত হয় তাঁর উত্তরসূরিদের হাতে। এরপরেও অবশ্যি উপস্থিত শ্রোতৃমণ্ডলীর পাওনার খাতায় আরও কিছু বাকি ছিল। সেই সন্ধ্যায় শারমিন শর্মীর সঞ্চালনায় টরন্টোর ‘পাঠশালা’-কে নিয়ে একটি সুনির্মিত তথ্যচিত্র প্রদর্শনের পরে সরোদের মূর্ছনায় অনুষ্ঠানকক্ষ অনুরণিত হয়। শিল্পী সেই শ্রুতি দে যিনি আগের দিন স্বরচিত প্রবন্ধপাঠ পর্বে রবীন্দ্রনাথের পরিবেশ- সচেতনতা নিয়ে বলেছিলেন। সরোদ বাদনের পর ছিল পথিকৃৎ আবৃত্তিশিল্পী খসরু চৌধুরীর আবৃত্তি পরিবেশনা ও পণ্ডিত অশোক দত্তের তবলার সঙ্গে গুণী কণ্ঠশিল্পী অমিত শুভ্র রায়ের সুরের মূর্ছনা। এরপর এই দুদিনব্যাপী মহোৎসবের ‘মধুরেণ সমাপয়েৎ’ হলো যাঁর গান দিয়ে, সেই স্বনামধন্য, প্রতিষ্ঠানসম ইফ্ফাত আরা দেওয়ানকে শিল্পী হিসেবে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার আর কিছু নেই।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button