আর্কাইভপ্রবন্ধ

প্রবন্ধ : হাসান আজিজুল হকের সাহিত্য : জীবনের অন্তর্ভেদী অবলোকন : ইয়াসমিন মাসহুদা

কোন অভিধায় তাঁকে অভিহিত করা যায়! নিরন্তর শুভব্রতি, মানবিক, স্পষ্টবাদী ও সাহসী, মহান ও বন্ধুবৎসল শিক্ষক, সমাজ সংস্কারক, বাংলা গদ্য সাহিত্যে ব্যতিক্রমী প্রাণপুরুষ―এমনি অনেক উপমায় বিশিষ্ট বাংলাদেশের এক ব্যক্তিত্বের নাম হাসান আজিজুল হক। নিতান্ত সাধারণ জীবনের পথ পাড়ি দিয়ে কী করে অসাধারণ হয়ে ওঠা যায় তারই মূর্ত প্রতীক তিনি।

হাসান আজিজুল হকের জন্ম ১৯৩৯ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার যবগ্রামে। তাঁদের পরিবার ছিল একান্নবর্তী এবং খুবই সম্ভ্রান্ত। বাবা মোহাম্মদ দোয়া বখশ্, মা জোহরা খাতুন। হাসান যবগ্রাম মহারানী কালীশ্বরী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। মাধ্যমিক শিক্ষা শেষে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায় চলে আসেন। এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তাঁর জবানি, ‘দেশ ভাগ হয় ১৯৪৭ সালে, তার ৭ বছর পর ১৯৫৪-তে আমি এখনকার বাংলাদেশে আসি, খুলনায়। কারণ খুবই আপতিক। স্কুল ফাইনাল পাস করার পর কোথাও না কোথাও তো ভর্তি হতে হবে―সেটা বর্ধমান কিংবা মাদ্রাজেও হতে পারতো। আমার বেলায় হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের খুলনায়। বাড়ি থেকে খুব যে একটা দূর তাও নয়। বৃহদায়তন উপমহাদেশ মাথায় রাখলে সত্যি খুব একটা দূরে আমার দেশান্তর ঘটেনি।’

পরবর্তী সময়ে ব্রজলাল কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক, রাজশাহী সরকারি কলেজ থেকে দর্শনে সম্মানসহ স্নাতক এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত তিনি রাজশাহী সিটি কলেজ, সিরাজগঞ্জ কলেজ, খুলনা সরকারি মহিলা কলেজ এবং সরকারি ব্রজলাল কলেজে অধ্যাপনা করেন। ১৯৭৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৪ সাল পর্যন্ত এখানে অধ্যাপনা করেছেন তিনি। ২০০৯ সালে হাসান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধু চেয়ার পদের জন্য মনোনীত হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পিইচডি করতে অস্ট্রেলিয়ায় গিয়েছিলেন। কিন্তু সেখানে মন টেকেনি। কোর্স অসমাপ্ত রেখেই তিনে ফিরে আসেন নিজ মাটি ও মানুষের কাছে।

ব্যক্তি ও কর্মজীবনে হাসান আজিজুল হক  অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ। ছিলেন প্রগতিভাবাপন্ন; শোষিতের পক্ষে সর্বদাই সোচ্চারকণ্ঠ―যা তাঁর লেখায় স্পষ্টতই প্রতীয়মান। হাসান একাধারে  লিখে গেছেন গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, আত্মজৈবনিক আলেখ্য। কলেজে পড়ার সময় ১৯৬০ সালে ‘শকুন’ নামে তাঁর লেখা একটি গল্প প্রকাশিত হয় সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত  সমকাল পত্রিকায়। এই গল্পের মাধ্যমেই তিনি সাহিত্যমহলে পরিচিতি পান। পরবর্তী সময়ে প্রকাশিত তাঁর গল্পগ্রন্থ সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য-এর প্রথম গল্পটি ছিল শকুন।

প্রায় অর্ধশতক ধরে তাঁর লেখালেখির জীবন। সেই জীবনে তিনি চারপাশ অবলোকন করেন অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দিয়ে। আর এই অবলোকনের মধ্য দিয়ে যা আত্মস্থ করেন লেখার উপকরণ হিসেবে সেসবেরই বিস্তরণ চোখে পড়ে তাঁর রচনায়। কেবল জনপ্রিয় হবার জন্যে তিনি কখনও কলম হাতে নেননি। তাঁর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ, ভাবেন প্রচুর কিন্তু লেখেন অনেক কম। লেখক জীবনের শুরু শামুক ও এইসব দিনরাত্রি নামে দুটো উপন্যাসের মধ্য দিয়ে। কিন্তু তা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেননি। এ প্রসঙ্গে তাঁর অভিমত, ‘ওগুলোকে আমি আর ছাড়পত্র দিতে চাই না। ওগুলো পড়লে এখন মনে হয় পুরো ব্যাপারটা আবেগে খুব স্যাঁতসেঁতে। আমার ধারণা, এখন বাস্তব অনেক রূঢ় আর তাকে মোকাবিলা করা দরকার শুকনো খটখটে ডাঙায় দাঁড়িয়ে।’

হাসান আজিজুল হক সমাজ সচেতন, প্রগতিমনস্ক, জাগ্রত লেখক। তিনি মুক্ত মনের, মুক্ত চিন্তার মানুষ। পাঠকের মনোরঞ্জন করার জন্য তিনি লেখেন না। দেশ-কাল-সমাজের প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে ব্যক্তি মানুষের শেকড় অনুসন্ধানে নিবিষ্ট হন। আর এভাবেই তাঁর নিজেকে জানা―আত্মানুসন্ধান। স্বপ্নের কুহক নয়, জীবনের কঠিন সংগ্রামকে তিনি বেছে নেন। চিরায়তকাল ধরে যারা সমাজ, রাষ্ট্র ও মানুষের গড়ে তোলা ব্যবস্থার হাতে মার খেতে খেতে সংগ্রাম করে টিকে থাকে তাদের কথা তিনি বলতে চান। তিনি উঁচুতলার মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেন না। প্রান্তিক মানুষের সাথে তাঁর আত্মিক বন্ধন।

হাসান আজিজুল হকের রচনা বিষয়বৈচিত্র্যে অনন্য। বিষয়বস্তুর রূপ পরিবর্তন এবং ভাঙাগড়ায় তিনি সনিষ্ঠ এবং শক্তিশালী। উপস্থাপনা, ভাষার সুনিপুণ ব্যবহার আর বলিষ্ঠ গদ্যশৈলী তাঁর রচনাকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। তাঁর ভাষায়, ‘জোরজবরদস্তি করে কিছুই হবার নয়। ভাষা হচ্ছে নদীর তীব্র স্রোতের মতো, ভেতর থেকে বদলে যাবে। মনে রাখতে হবে, এ হচ্ছে জীবনের রসায়ন, যন্ত্রের ফ্যাক্টরি নয়।’

লেখালেখির জগতে তিনি সম্পূর্ণভাবে স্বতন্ত্র। কারও দ্বারা অনুপ্রাণিত কিংবা প্রভাবিত নন। নিজস্ব রীতিতে তিনি নির্মাণ করেন। গড়ে তোলেন স্বতন্ত্র ভুবন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, পঞ্চাশের মন্বন্তর, দেশভাগ, দাঙ্গা, খুন, মানুষের নৃশংসতা ও নিষ্ঠুরতা তাঁর মনে গভীর প্রভাব ফেলে। আর এসব নির্মম কঠিন সত্য তাঁর অভিজ্ঞতার ঝুলিতে জমা হতে থাকে। অভিজ্ঞতা সঞ্জাত এইসব বিষয়বস্তু তাঁর রচনায় প্রবলভাবে প্রতিফলিত হয়। তিনি বলেন, ভাণ্ডার শূন্য থাকলে তো কিছু বের হবে না। যদি পকেট ফাঁকা থাকে এবং আমি দান করতে চাই―সেটা কি সম্ভব হবে ?

হাসান আজিজুল হকের লেখা গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে―উপন্যাস : বৃত্তায়ন (১৯৯১), শিউলি (২০০৬), আগুনপাখি (২০০৬), বিধবাদের কথা (২০০৭), সাবিত্রী উপাখ্যান (২০১৩); ছোটগল্প : সমুদ্রের স্বপ্ন শীতের অরণ্য (১৯৬৪), আত্মজা ও একটি করবী গাছ (১৯৬৭), জীবন ঘষে আগুন (১৯৭৩), নামহীন গোত্রহীন (১৯৭৫), পাতালে হাসপাতালে (১৯৮১), আমরা অপেক্ষা করছি (১৯৮৮), রোদে যাবো (১৯৯৫), মা-মেয়ের সংসার (১৯৯৭), রাঢ়বঙ্গের গল্প (১৯৯১), মুক্তিযুদ্ধের গল্প (২০০০); নাটক : চন্দর কোথায় (ভাষান্তরিত); গবেষণা প্রবন্ধ : কথাসাহিত্যের কথকতা (১৯৮১), অপ্রকাশের ভার (১৯৮৮), অতলের আঁধি (১৯৯৮), বাংলা কথাশিল্পের কয়েকজন : মগ্ন অবলোকন ও সামান্য বিচার (২০০৫); মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক : একাত্তর : করতলে ছিন্নমাথা প্রভৃতি। স্মৃতিকথা বা আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : ফিরে যাই ফিরে আসি (প্রথম অংশ ২০০৯), উঁকি দিয়ে দিগন্ত (দ্বিতীয় অংশ ২০১১), টান (২০১২), লন্ডনের ডায়েরি (২০১৩), এই পুরাতন আখরগুলি (তৃতীয় অংশ ২০১৪), স্মৃতিকহন (২০১৯) ইত্যাদি। এছাড়া সম্পাদিত গ্রন্থ ও কিশোর সাহিত্য রচনায়ও তিনি বিশেষ অবদান রাখেন।

হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্পের প্রত্যেকটিই শিল্পসফল। শিল্পের নান্দনিক স্পর্শে হয়েছে সর্বকালীন ও সর্বজনীন। বারবার তিনি প্রেক্ষাপটের পরিবর্তন ঘটান। প্রথম গল্প শকুন থেকে আত্মজা ও একটি করবী গাছ কিংবা অচিন পাখি, জীবন ঘষে আগুন, সাক্ষাৎকার, আমৃত্যু আজীবন―বিরতি দিয়ে লেখা গল্পগুলো পাঠের পর হাসান পাঠকের কাছে নব নব রূপে আবিষ্কৃত হন। তাঁর গদ্য কখনও কবিতার মতো মনে হয়। আত্মজা ও একটি করবী গাছ গল্পের শুরুটা হয়েছে এভাবে, ‘এমন নিদয় শীতকাল, ঠান্ডা নামছে হিম, চাঁদ ফুটে আছে নারকেল গাছের মাথায়। অল্প বাতাসে একটা বড় কলার পাতা একবার বুক দেখায় একবার পিঠ দেখায়। ওদিকে বড় গঞ্জের রাস্তার মোড়ে রাহাত খানের বাড়ির টিনের চাল হিম-ঝকঝক করে। একসময় কানুর মায়ের কুঁড়েঘরের পইঠায় সামনের পা তুলে দিয়ে শিয়াল ডেকে ওঠে।’

এমন নান্দনিক, সুখপাঠ্য ভাষা―পাঠকের চোখের সামনে যেন সবটা দৃশ্যমান ও শ্রাব্য হয়ে ওঠে। পাঠক শুনতে পান, ‘হঠাৎ তখন স্কুলের খোয়ার রাস্তার দুপাশের বনবাদাড় আর ভাঙা বাড়ির ইটের স্তূপ থেকে হু-উ-উ চিৎকার ওঠে। ঈশান কোণ থেকে ধর ধর লে লে শব্দ আসে, অন্ধকারে―ভূত অন্ধকার কেঁপে কেঁপে ওঠে, চাঁদের আলো আবার ঝিলিক দেয় টিনের চালে।’

হাসান আজিজুল হক সত্তরটির মতো গল্প, দুটি পূর্ণাঙ্গ উপন্যাস ও দুটি ছোট উপন্যাস রচনা করেছেন। যদিও তাঁর লেখক জীবন পঞ্চাশ বছরের অধিক। তথাপি তিনি নিজেকে ‘সার্বক্ষণিক লেখক-ক্লান্তিহীন লেখক’ মনে করেন। হাসান একজন দায়বদ্ধ লেখক। মানুষ হিসেবে সমাজের কাছে তাঁর যে ঋণ, লেখার মাধ্যমে সমাজচিত্র উপস্থাপন করে তিনি সেই দায় মেটাতে প্রত্যয়ী। তিনি মনে করেন, লেখকের দায় তাই বড় অর্থে মানবজাতির কাছে―সুনির্দিষ্ট অর্থে আপন দেশ ও কালের কাছে। বিকারগ্রস্ত মানব-অস্তিত্বকে ঠিক জায়গায় আনার যে-কর্মযজ্ঞ তাতে অংশ নেওয়াই লেখকের কাজ।’ তাঁর লেখার মূল লক্ষ্য মানুষের জীবনকে স্পর্শ করা, সবকিছুর ওপরে মানুষকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়া।

তাঁর রচনায় একজন শক্তিমান  লেখকের সংহত দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাওয়া যায়। বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে মহত্তম ঘটনা মহান মুক্তিযুদ্ধের নির্মম বাস্তবতার অভিজ্ঞতা নিয়ে রচিত তাঁর গ্রন্থ একাত্তর করতলে ছিন্নমাথা। এর শুরুটা এমন : ‘আমার জানা ছিল না যে, পানিতে ভাসিয়ে দিলে পুরুষের লাশ চিৎ হয়ে ভাসে আর নারীর লাশ ভাসে উপুড় হয়ে। এই জ্ঞান আমি পাই ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের একেবারে শেষে।’ এভাবেই সাবলীল রচনাশৈলী দিয়ে শুরু হয়ে উন্মোচিত হয়েছে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস হত্যাযজ্ঞ―মানুষের চূর্ণ-বিচূর্ণ হাড়, পোড়া মাংসের গন্ধে ভরা শ্যামল বাংলার করুণ চিত্র। লেখক তখন খুলনায় অবস্থান করছিলেন। শহরের প্রতিবেশী উকিলবাবুর তিন সন্তানকে হত্যা করে পাকিস্তানিরা। তার বর্ণনায় হাসান লেখেন :

রক্ত শুকিয়ে কালচে হয়ে গেছে, ফেনা তুলে মৃদু কলকল শব্দে গড়িয়ে গিয়েছিল নিশ্চয়, এখন শুকিয়ে চটকা উঠে গেছে এখানে-সেখানে। কার কোথায় বুলেটের আঘাত দেখতে পাই না। রাজপথে এই চারজনের শুয়ে থাকা দেখতে দেখতে কেমন অদ্ভুত সম্মোহনের মধ্যে পড়ে যাই আমি। ওদের তিনজনকেই আমি চিনতাম। দোতলা বাড়িটা পাশেই, শেকসপিয়র আর মিল্টন পড়া উকিলবাবুর বাড়িতে আমি একসময় খুবই যেতাম। মাথা তুলে তাকিয়ে দেখি, দোতলার বারান্দায় উকিলবাবু আকাশের দিকে মুখ তুলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর হালকা রুপোলি চুলগুলো এলোমেলো বাতাসে উড়ছে। আমি একদৃষ্টে তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকি এই ভেবে যে তিনি এবার নামবেন, হয়তো আবার, আবার দেখে নিতে চাইবেন তাঁর তিন আত্মজের মুখ। কিন্তু আমার অপেক্ষা বৃথা হলো, আকাশের দিকে চেয়ে রইলেন, তাঁর মৃত সন্তানেরা শুয়ে রইলো মার্চের তীব্র রোদে পিচ গলে-যাওয়া রাজপথে।

লেখক-জীবনের সিংহভাগ জুড়ে হাসান নিবিষ্ট ছিলেন ছোটগল্প রচনায়। পরিণত বয়সে এসে লিখেছেন উপন্যাস। তাতে নিজস্ব ভাবনার স্বরূপ উন্মোচন করেন সচেতনভাবে। উপন্যাসের বিষয়ও বাংলা ও বাঙালি। লেখকের সবচেয়ে পাঠক-নন্দিত উপন্যাস আগুনপাখি। গ্রামের ত্রিকালদর্শী এক প্রৌঢ়ার বয়ানে উপন্যাসটি রচিত। তিনিই উপন্যাসের কথক-চরিত্র―একদিকে রক্ষণশীল মুসলমান পরিবরের মেয়ে এবং বিরাট একান্নবর্তী পরিবারের গৃহবধূ। স্বামী, সন্তান আর পরিবারের অন্য সকলকে নিয়ে সুখেই কাটছিল সংসার। এরপর একে এক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, কলেরা-বসন্তের প্রাদুর্ভাব, দুর্ভিক্ষ প্রভৃতি দুর্দৈবর ফলে স্বার্থের নগ্নরূপ উন্মোচিত হয়ে একান্নবর্তী পরিবারে ভাঙন ধরে। দুর্ভিক্ষের রেশ কাটতে না কাটতে দেখা দেয় সাম্প্রদায়িক সংঘাত―হিন্দু- মুসলমান যারা এতদিন সুখেদুখে প্রাণে প্রাণ মিলিয়ে বসবাস করেছে তারাও হয়ে ওঠে একে অপরের শত্রু। কেবল দাঙ্গা আর রক্ত। ভেঙে দু টুকরা হয় ভারতভূমি। বাড়ির কর্তা সপরিবারে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে শ্বশুরবাড়ির ভিটেতেই থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন কথক। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এ যেন তাঁর প্রতিবাদ। নিজের অস্তিত্বের জন্যেই তিনি দেশ ভাগের এই ভ্রান্ত সিদ্ধান্ত মেনে নেন না। সমগ্র জীবন নিতান্ত সাদামাটাভাবে যাপন করে আসা নারী চরিত্রটি এই ক্রান্তিকালে এসে হয়ে ওঠেন প্রজ্ঞাবান, বলিষ্ঠ। এই উপন্যাসে একটি পরিবারের উত্থান- পতনের মধ্য দিয়ে পুরো সমাজচিত্র তুলে ধরেন হাসান। দেশভাগের ফলে কত মানুষকে নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হতে হয়েছে, বিধ্বস্ত হয়েছে অভাবে, বিপর্যস্ত হতে হয়েছে মানসিকভাবে আগুনপাখি তারই চিত্ররূপ। একটু খতিয়ে দেখলেই বোঝা যায়, কথক হাসানের অতি নিকটজন। কেননা তিনি যাপিত জীবন থেকেই উপন্যাসের জীবনরস সংগ্রহ করেন। আগুনপাখি প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের স্বীকৃতি পায়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে উপন্যাসটির জন্য দেওয়া হয় আনন্দ সাহিত্য পুরস্কার।

সাবিত্রী উপাখ্যান একটি চাঞ্চল্যকর নারী নিগ্রহের সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। ১৯৩৮ সালে পশ্চিমবঙ্গে একটি ধর্ষণ মামলা হয়। সেই মামলার কিছু নথিপত্র অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে লেখক তাঁর রচনায় ফাঁক ফোকরে ঢুকিয়ে দেন। তবে কোনও প্রমাণ উপস্থাপনের জন্যে নয়, আইন-আদালত-সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রভৃতির অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণ করতে।  উপন্যাসে দেখা যায় এক অপরূপ জোৎস্না রাতে সাবিত্রী নামের এক কিশোরী ধর্ষণের শিকার হয়। এরপর থেকে একের পর এক তার জীবনে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে থাকে। এই উপন্যাসে সাবিত্রী অসহায়, প্রতিবাদহীন। কিন্তু সমাজ আর মানুষের প্রতি তাঁর তীব্র ঘৃণা। ঈশ্বরের কাছে সাবিত্রীর প্রশ্ন, ‘হায় ভগোমান পিথিমিতে মেয়ে মানুষ কেন জন্মায়!’ উপন্যাসে প্রায় তিন দশকের সামাজিক অবস্থা, নিগৃহীত নারীর অসহায়ত্ব এবং হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কের চিত্রও উঠে আসে। উৎসর্গপত্রে লেখা আছে―‘সাবিত্রী দেবী ক্ষমা করো’। এ যেনো ধর্ষণের শিকার সকল নারীর কাছে তাঁর ক্ষমা চাওয়া। শ্বাসরুদ্ধকর, মর্মস্পর্শী এ উপন্যাসটির মাধ্যমে লেখক তথাকথিত সমাজ-সভ্যতার মর্মে যেন আঘাত করেন। এই উপন্যাসের অন্যতম আকর্ষণ ভাষার কারুকার্য।

আত্মজৈবনিক আলেখ্য অর্থাৎ স্মৃতিকথা রচনায়ও তাঁর ভূমিকা অনন্য। ব্যক্তিগত স্মৃতিকে এমন সুনিপুণ ও শৈল্পিকভাবে তিনি উপস্থাপন করেন যে, পাঠক বিস্ময়ে অভিভূত হন। স্মৃতিকথায় রাঢ়বঙ্গের রুখোমাটির শৈশবের হাসানের সাথে পরিণত বয়সের হাসানের বারবার দেখা হয়। দুই প্রেক্ষাপটে দুটো চরিত্র সমসাময়িক হয়ে ওঠে। স্মৃতিকথার প্রথম পর্ব ফিরে যাই ফিরে আসি-র সূচনায় তিনি বলেন, ‘স্মৃতিকে কতটা পেছনে নেওয়া যায়, নিশ্চয় চেতনার পেছনে নয়। আমার ধারণা শুধুমাত্র চেতনাতেও স্মৃতি নেই, যদি থাকে তা আধো অন্ধকারেই ডুবে থাকে। আত্মচেতনা থেকেই স্মৃতির শুরু। জন্মের পর থেকে চেতনা আছে, গূঢ় রহস্যময় চেতনা, কিন্তু স্মৃতি নেই। চেতনা-আত্মচেতনার মাঝখানের সান্ধ্য জায়গাটায় অনেকবার ফিরে ফিরে যেতে চেয়েছি। তাই ফিরে যাই, ফিরে আসি।’

কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে হাসান আজিজুল হক ৪৪ বছর শিক্ষকতা করেছেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন খুব জনপ্রিয়। ছাত্রদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল বন্ধুবৎসল। শ্রেণিকক্ষে পাঠদানের বাইরেও তিনি ছাত্রদের প্রচুর সময় দিতেন। যুক্ত ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সাথে। ব্যক্তিজীবনে ছিলেন অত্যন্ত বড়মাপের মানুষ। উচ্চ শিক্ষিত, পড়াতেন বিশ্ববিদ্যালয়ে, কিন্তু নিজেকে মাপতেন একদম সাধারণের কাতারে। ছিলেন নিতান্তই সাদাসিদে। ছাত্রজীবনে জড়িয়েছিলেন প্রগতিশীল রাজনৈতিক সংস্কৃতি চর্চায়। শিক্ষকতা করতে এসেও হেঁটেছেন একই পথে।

সাহিত্যচর্চার স্বীকৃতি হিসবে বাংলাদেশ সরকার অসামান্য এই গদ্যশিল্পীকে ১৯৯৯ সালে একুশে পদক ও ২০১৯ সালে স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত করে। ২০১৮ সালে তাঁকে ‘সাহিত্যরত্ন’ উপাধি দেওয়া হয়। আগুনপাখি উপন্যাসের জন্য ২০০৮ সালে কলকাতা থেকে ‘আনন্দ পুরস্কার’ লাভ করেন। ১৯৭০ সালে পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। তাঁর গল্প ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, রুশ ও চেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তাঁর রচনার কাহিনি অবলম্বনে বাংলাদেশে তৈরি হয়েছে একাধিক চলচ্চিত্র।

বাংলা কথাসাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক হাসান আজিজুল হক। তাঁর লেখার মধ্যেই তিনি বলে গেছেন মানুষের জয়গানের কথা, অস্তিত্বের কথা। নিজের শৈশব তিনি কখনওই ভুলতে পারেননি। কাটোয়া, নিগন স্টেশন, মাটির লাইনের পুরোনো আমলের ট্রেন―এই নিগন স্টেশন থেকেই পায়ে হেঁটে যেতে হত যবগ্রামে―যেখানে তাঁর জন্ম। অবিভক্ত বাংলায় নিজের জন্মস্থানের কথা কতভাবেই না তুলে এনেছেন স্মৃতির আকর থেকে। দেশভাগের দগদগে ক্ষত তাঁকে বারবার বিক্ষত করেছে। আর তার শুরুটা এই যবগ্রামে―তাঁর জন্মস্থানে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়ার পর তিনি রাজধানীমুখো হননি। রাজশাহীতেই ‘উজান’ নামে একটি বাড়ি করেন। এখানের সপরিবারে বসবাস করছিলেন―কোলাহল থেকে দূরে। অবশেষে সব কোলাহল থেকে ছুটি নিয়ে ২০২১ সালের ১৫ নভেম্বর অসীমের পানে যাত্রা করেন এই শিল্পী।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button