চিরায়ত মানবিকতা, শ্রেয়োবোধ, প্রেম, সৌন্দর্য, ঐতিহ্য চেতনাকে ভিত্তি করেই আসাদ চৌধুরীর কবি-সত্তা বিকশিত। কবিজীবনের বিকাশমান পর্যায়ে তাঁর লক্ষ্য ছিল ব্যক্তিময়তায় তার একান্ত অনুভূতিগুলোকে নান্দনিক মাত্রায় উত্তীর্ণ করা। সেজন্য যুগের নতুন আদর্শগুলোকে চিরায়ত বোধের অংশ করতে চেয়েছেন আসাদ চৌধুরী। কোনও দল বা মতাদর্শের অন্ধ আনুগত্য থেকে আসাদ চৌধুরীর কবিতা মুক্ত। যদিও মানবীয় দুঃখবোধের আত্মগত রূপটি বেদনা-করুণা-আনন্দধারায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফুটে উঠেছে আসাদ চৌধুরীর কবিতায়।
ষাটের দশকে, কবিতার নবনিরীক্ষা এবং কলাকৈবল্যবাদে তরঙ্গায়িত প্রজন্মের একজন হলেও আসাদ চৌধুরীর কবিতা আশ্চর্যজনকভাবেই ব্যতিক্রম। কুণ্ডলায়িত সামরিক শাসনের বিষাদময় যন্ত্রণার মধ্যে বসেও আসাদ চৌধুরী কবিতা লিখেছেন শ্লেষ এবং ঐতিহ্যের সংমিশ্রণে। ইন্দ্রিয় চেতনার বদলে আত্মচেতনা, রূপতৃষ্ণার বদলে প্রেমাকাক্সক্ষা আসাদ চৌধুরীর কবিতার শিল্পতত্ত্বের ভিত্তি। নৈঃসঙ্গ, ক্লান্তি, বিষাদ বেদনা, আরোপিত মতবাদ তাঁর কবিতার শিল্পসত্তাকে এতটুকু ম্লান করেনি। বরং দেশজ ঐতিহ্যের শক্তি আসাদ চৌধুরীর কবিতায় নতুন প্রাণসঞ্চার করেছে। শুরু থেকেই তিনি গ্রামীণ লোকভাষাকে কবিতায় তুলে ধরেছেন, সরল, অজটিল, কথনভঙ্গির স্বতঃস্ফূর্ততা তাঁর কবিতাকে নতুন একটা মাত্রা দিয়েছে :
ফুল ফুটেছে থোকা থোকা
তাঁতীর পুতে বড়োই বোকা
…
তাঁতীর পুত গো করি মানা
লুঙ্গি থুইয়া শাড়ি বানা
দেশ ভইরাছে মাই লোকে
শাড়ি বানা থাকবি সুখে
সোনার দেশ রে দুঃখে কই
লুঙ্গী পরার পুরুষ কই।
(ফুল ফুটেছে থোকা থোকা/তবক দেওয়া পান)
এখানে ‘পুত’ ‘মানা’ ‘থুইয়া’ ‘বানা’ ‘মাইয়া’ প্রভৃতি শব্দ আঞ্চলিক উচ্চারণের হুবহু ভঙ্গি। লোকভাষার এই সহজ, স্বচ্ছন্দ ব্যবহার আসাদ চৌধুরীর কবিতাকে সর্বসাধারণের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছে। শ্রেণিবিভক্ত সমাজে ব্যক্তিমানুষের প্রধান সঙ্কট নিজের অস্তিত্ব নিয়ে। বিদ্যমান ব্যবস্থা ও মতাদর্শের সঙ্গে প্রতিভাবান মাত্রেরই তখন দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে ওঠে। আসাদ চৌধুরী এক্ষেত্রে নৈর্ব্যক্তিক ও নিস্পৃহ ছিলেন কিন্তু আপস করেননি। তাঁর কবিতায় শব্দানুষঙ্গে আবেগীগুণের এক ধরনের সংমিশ্রণ আছে, সে আবেগ লক্ষ্যহীন নয়, শুভবোধ ও শ্রেয়োবোধ তাড়িত তাঁর কবিতার পঙ্ক্তি প্রাণবন্ত, সজীব ও আশাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্কেতরূপে প্রতিফলিত :
যখন বিষাদ এসে/ঢেকে দ্যায়/সব বিনোদন
তখন তোমার চোখে/আশ্বাসের /দীপ্রদীপ জ্বলে
যখন আনন্দ এসে/ঢেকে ফ্যালে/মলিন ভুবন
তোমার চোখের তারা/সিক্ত হয়/স্নিগ্ধ ধারাজলে।
(চোখ-২/তবক দেওয়া পান)
আত্মপ্রত্যয়ী কবি আসাদ চৌধুরী বেদনাঘন অন্তঃপীড়নে দগ্ধভূত হন তখনই, যখন দেখেন দীর্ঘ সংগ্রামের পথ পেরিয়ে, একটা রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের পরও মানুষের মুক্তি আসে না, স্বাধীনতা কেবল ভূখণ্ডগত হয়ে পড়ে, ত্রিশ লক্ষ শহিদের প্রাণ, দুই লক্ষ মা-বোনের ইজ্জত ধুলায় মিশে যায়, তিনি নিজেও একজন মুক্তিযোদ্ধা কবি,―চোখের সামনে যখন দেখেন, সাধারণ মানুষের জীবনে মুক্তি আসেনি, শোষণ, নিপীড়ন আগের মতোই বলবৎ, ভাত-কাপড়ের অভাব ঘোচেনি, দুঃখ-দারিদ্র্যের প্রক্রিয়াগুলো সমাজে রাষ্ট্রে আজও সচল, তখন নিরুপায় মনোভঙ্গি, নিজের ব্যক্তিকতাকে দুঃখপূর্ণ অন্তর্পাত্রে ধারণ করে বলেন :
নদীর জলে আগুন ছিল
আগুন ছিল বৃষ্টিতে
আগুন ছিল বীরাঙ্গনার
উদাস করা দৃষ্টিতে
* * * *
কুকুর বিড়াল থাবা হাঁকায়
ফোঁসে সাপের ফণা
শিং, কৈ মাছ রুখে দাঁড়ায়
জ্বলে বালির কণা,
এখন এসব স্বপ্ন কথা
দূরের শোনা গল্প―
তখন সত্যি মানুষ ছিলাম
এখন আছি অল্প।
(তখন সত্যি মানুষ ছিলাম/তবক দেওয়া পান)
মুক্তিযুদ্ধ যাদের জীবনের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে, তারা ছাড়া নতুন প্রজন্মের কেউ হয়তো সেই দুঃসময়ের কথা উপলব্ধি করতে পারবে না। নিরস্ত্র মানুষের ওপর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংসতা, অত্যাচার, নির্যাতন, হত্যা, প্রাণভয়ে নিজ ভিটেমাটি ছেড়ে উদ্বাস্তু হওয়া, শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানবেতর জীবন―শত্রুর আক্রমণের মুখে তখন দেশের হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান নির্বিশেষ একই সঙ্গে লড়াই করেছে, একই কম্বলের নিচে যে শুয়েছে, একই প্লেটে খেয়েছে―সত্যি তখন আমরা মানুষ ছিলাম। আর এখন ?
‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম এখন আছি অল্প।’
আসাদ চৌধুরীর এই আক্ষেপ, এই অন্তর্বেদনা, তাঁর একান্ত অনুভবগুলো অশ্রুসিক্ত। জীবনপ্রবাহের এই পরবর্তন তাঁর কবি-সত্তাকে দগ্ধ করে। স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব, সহিংসতা, মানবিক মূল্যবোধের অবক্ষয়, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ-বিপক্ষ দলের উলম্ফন, জাতির জনকের নৃশংস হত্যাকাণ্ডÑ এসবই কবির হৃৎপিণ্ডে রক্তপাত ঘটায়। কবি আসাদ চৌধুরী স্বাধীন বাংলাদেশে চোখ মেলে দেখেন, সময় কীভাবে কাটছে মানুষের :
কেটেছে সময় সন্ত্রাসে সঙ্ঘাতে
কুয়াশা কেটেছে রক্তের বন্যায়
মৃত্যু তবু হালটে ও ফুটপাতে
মাথা উঁচু করে সহস্র অন্যায়
(্স্বপ্নের সম্মোহন/বিত্ত নাই বেসাত নাই)
অনুভূমি, ব্যক্তিসত্তা ও যুগভাবনা―এই ত্রিমাত্রিক সংবেদনা রূপায়িত হয়েছে এখানে। নিষ্ক্রিয় চৈতন্য নয়, সক্রিয় মনন কবিতার শব্দকাঠামোতে অনুরণিত হয়েছে ‘হালটে, ফুটপাতে―মৃত্যু’ ‘মাথা উঁচু করে সহস্র অন্যায়’―এই যে অভিব্যক্তি, আত্মক্রন্দন, তার কোনও প্রতিকার নেই। কিন্তু কবির চেতনালোকের ধ্যান, অনুভব, বোধ প্রাঞ্জলতা নিয়েই প্রকাশিত। স্বচ্ছ মুকুরে তা তাঁর মননে প্রতিফলিত হয়―‘রক্তের বন্যা’, ‘মৃত্যু’ এবং ‘সহস্র অন্যায়’ যা স্বাধীন বাংলাদেশে এখনও ‘মাথা উঁচু করে’ দাঁড়িয়ে আছে। ক্ষুদ্রায়তনের চিত্রকল্প কিন্তু মৌলিক, সূক্ষ্ম, সংবেদনশীল চেতনা। স্বাধীন বাংলাদেশে মানবিকতার ক্ষয় ও বিমানবিক অবস্থা, মৃত্যু এবং অন্যায় মাথা তোলা―এ রকম বাংলাদেশ আমাদের কাক্সিক্ষত ছিল না।
২
বাংলাদেশের কবিতায় ‘তবক দেওয়া পান’ (১৯৭৫) নিয়েই আসাদ চৌধুরীর আবির্ভাব। ‘তবক’ আরবি শব্দ, আভিধানিক অর্থ ‘স্তবক’। ব্যবহারিক অর্থ স্বর্ণের পাতলা পাত বা নানা রকম মসলার সংশ্রিণে তৈরি সুগন্ধিযুুক্ত পান।
সোনার তবকে মুড়িয়ে দেওয়া। ‘সুগন্ধি যুক্ত পান’ শেষোক্ত অর্থটাই এখানে ধর্তব্য। লোকসংস্কৃতি এবং লোকভাষার সুগন্ধি নিয়ে আসাদ চৌধুরী বাংলাদেশের কবিতায় প্রবেশ করেন। তারপর প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থগুলো : বিত্ত নেই বেসাত নেই (১৯৭৬), প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড় (১৯৭৯), জলের মধ্যে লেখাজোখা (১৯৮২), যে পারে পারুক (১৯৮৩), মধ্যমাঠ থেকে (১৯৮৪), মেঘের জুলুম পাখির জুলুম (১৯৮৫), দুঃখীরা গল্প করে (১৯৮৭), নদীও বিবস্ত্র হয় (১৯৯২), বাতাস যেমন পরিচিত (১৯৯৮), বৃষ্টির সংসারে আমি কেউ নই (১৯৯৮), কিছু ফল আমি নিভিয়ে দিয়েছি (২০০৩), ঘরে ফেরা সোজা নয় (২০০৬), কবিতাসমগ্র (২০০০)। এ ছাড়া প্রবন্ধ গবেষণা কোন অলকার ফুল (১৯৮২), শিশুতোষ রচনা : রাজার নতুন জামা (২০০৬), রাজা বাদশার গল্প (১৯৮০), ছোট্ট রাজপুত্র (১৯৮২), গ্রামবাংলার গল্প (১৯৮০), ভিন্নদেশের মজার লোককাহিনী (১৯৯৯), তিন রসবাজোর আড্ডা (১৯৯৯), কেশবতী রাজকন্যা (২০০০), জীবনী : তোমাদের প্রিয় চার শিল্পী (২০০০), সংগ্রামী নায়ক বঙ্গবন্ধু (১৯৮৩), রজনীকান্ত সেন (১৯৮৯) এবং অনুবাদ ও সম্পাদনা মিলে আসাদ চৌধুরীর গ্রন্থসংখ্যা ৪২টি। সাহিত্যকর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ অর্জন করেছেন আবুল হাসান স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৫), অগ্রণী ব্যাংক সাহিত্যপুরস্কার (১৯৮২), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৮৭), জীবনানন্দ দাশ পদক, অতীশ দীপঙ্কর স্বর্ণপদক, জাতীয় কবিতা পরিষদ পুরস্কার (২০০৬)। আসাদ চৌধুরী পেশাজীবন শুরু করেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে (১৯৬৪-১৯৭২) অধ্যাপনা দিয়ে। তারপর সম্পাদনা ‘জয় বাংলা’ (১৯৭১), ভয়েজ অব জার্মানি (১৯৮৫-৮৮), বাংলা একাডেমির পরিচালক পদ থেকে অবসর গ্রহণ। এই বিচিত্র এবং বহুমুখী কাজের অভিজ্ঞতা ও প্রভাব তাঁর লেখায়, বিশেষ করে কবিতায় গভীরভাবে পড়েছে। তাঁর কাব্যগ্রন্থের নামকরণ থেকেই তা স্পষ্ট বোঝা যায়। যেমন, তবক দেওয়া পান-এর পর তাঁর দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম হয় বিত্ত নাই বেসাত নাই অর্থাৎ স্বাধীনতা-উত্তর সত্তর দশকে ঢাকার নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবনে যে অর্থনৈতিক টানাপড়েন, চুয়াত্তরের মন্বন্তরের পটভূমিতে নাগরিক সমাজের যে পর্যুদস্ত অবস্থা, আত্মমর্যাদা রক্ষা করে চলাই মুশকিল হয়ে পড়ে। আসাদ চৌধুরী তখন বাংলা একাডেমিতে কর্মরত, বিত্তবৈভবের মালিকরাই সমাজে সম্মান মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত, শিক্ষিত মধ্যবিত্তের বিত্ত নেই, আছে কেবল আত্মসম্মানবোধ, সেটি নিয়েও সমাজে চলা দুষ্কর হয়ে পড়ে। অর্থনৈতিক শ্রেণিবৈষম্যের শিকার এই মধ্যবিত্তের শ্রেণিরই কৌতুককর জিজ্ঞাসা :
‘এখনও ছোট মোটা আছো না কি হে, যে,
যা ভাববে তাই ঘটবে ?’
এখনও ছোট মোটা আছ নাকি হে, যে,
জানালার দিকে না তাকালেই
অন্ধ বধির ভয়গুলো চলে যাবে ?
আর অবিরাম চোখ মারবে হলুদ চাঁদ ?’
(বিত্ত নাই, বেসাত নাই)
এই যে, ‘অন্ধ, বধির ভয়’ কিং ‘হলুদ চাঁদের অবিরাম চোখ মারার’ ঘটনা কবির মননে থাকে কালজিজ্ঞাসা, থাকে অসঙ্গতির সঙ্কেত। এসব বিচূর্ণ চিত্রকল্পের দ্যুতি, অভিজ্ঞতা ব্যক্তিস্বরূপের প্রকাশকেই তাৎপর্যমণ্ডিত করে। কবির আত্মবীক্ষণ হয়ে ওঠে বিচিত্র শব্দানুষঙ্গে পরিপূর্ণ। আসাদ চৌধুরীর তৃতীয় কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম প্রশ্ন নেই উত্তরে পাহাড়-এর মধ্যে ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বৈরী পরিস্থিতির একটি বিরল দৃশ্য প্রতিফলিত :
‘বোবাদের শত্রু নাই, কখনো থাকে না।’ এ রকম
শুনে শুনে শৈশব কৈশোর গ্যালো;
চুপ চুপ, চুপ―
* * * *
কার্তিকের হিমেল সকালের শরীরের কোথায় জানি না
কাঁপন পেলাম, খুব জ্বর হয়েছিল। ভীরুদের
শরীরের ভাঁজে-ভাঁজে এ রকম দারুণ অদৃশ্য জ্বর
আজীবন লেপ্টে থাকে।
(বোবার শত্রু নাই/প্রশ্ন নেই, উত্তরে পাহাড়)
এই যে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতামঞ্চে রাজনৈতিক পালাবদল, ভয়, আতঙ্ক, শূন্যতা, কথা বলা, মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা,―এসব বৈরী পরিস্থিতি, ভয়ের সংস্কৃতি কখনও স্বাধীনদেশের কাম্য ছিল না। তবু এসব ঘটছে, হত্যা, নৃশংসতা জোরজবরদস্তি, বাকস্বাধীনতার অভাব। অনেক প্রশ্ন আসে সমাজের, বহু জিজ্ঞাসা আছে মানুষের কিন্তু উত্তর নেই, জবাব নেই। বোবার মত চুপ করে থাকা দমবন্ধ পরিবেশ। প্রতিবাদ, প্রতিরোধের আগুন বুকে জ্বলে অগ্নিগিরির মতো, কারণ চারদিকে ভয়, শীতলতা, ভয়ে কাঁপন ধরে শরীরে,―‘ভীরুদের শরীরে আজীবন লেপ্টে থাকে অদৃশ্য জ্বর।’ আসাদ চৌধুরীর পঞ্চম কাব্যগ্রন্থের শিরোনাম যে পারে পারুক। শিরোনামের কবিতাটির কয়েকটি পঙ্ক্তি :
যে পারে পারুক, আমি পারবো না মেনে নিতে।
এই রইলো রক্তমাখা রাজার মুকুট,
মানব-সভ্যতা আমি যাই, সভ্যতার নামে আমি অনেক দেখেছি
আর নয়, যাই।
* * * *
গুড বাই, যুদ্ধ, গণহত্যা।
গুড বাই, গুড বাই।
ঝকঝকে অস্ত্র, আর নয়, আর অস্ত্র নয়
আণবিক বোমা, নিউটন নো মোর এসব হাবিজাবি
জলে ও বাতাসে আর মানব বিধ্বংসী ষড়যন্ত্র নয়।
যে পারে পারুক, আমি পারবো না মেনে নিতে
এসব ক্রিয়া-কর্মে ঘেন্না ধরে গেছে।
(যে পারে পারুক, আমি পারবো না)
এই কবিতার বিষয়-ভাবনা হিউমিনিজমের গভীর প্রত্যয় থেকে উঠৈ আসা। খুব সহজ সরল, নিম্ন কণ্ঠের কিন্তু মানবিকতার হৃদয় ছোঁয়া আকুতিধ্বনিত হয়েছে।
‘আমি পারবো না মেনে নিতে।’ পঙ্ক্তির মধ্যে যে না-বোধক অনুজ্ঞা ব্যক্ত হয়েছে, তা-ই কবি আসাদ চৌধুরীর আত্মতা, কবিতার শিল্পবীক্ষা। শিল্প বিপ্লবের পর পুঁজিবাদী সমাজের প্রধান নিয়ামক শক্তি হচ্ছে বিজ্ঞান। মডার্নিজমের উৎকর্ষ সাধিত হয় বিজ্ঞানের কল্যাণে কিন্তু বিজ্ঞান মানবসভ্যতাকে অনেক দূর এগিয়ে দিলেও বিজ্ঞান মানবসভ্যতা বিধ্বংসী এমন মারণাস্ত্রও তৈরি করে ফেলেছে, যা দিয়ে এরকম তিনটা পৃথিবী একসঙ্গে ধ্বংস করা যাবে। সভ্যতার এই বিমানবীকরণকে আসাদ চৌধুরী মেনে নিতে পারেন না। সে জন্যই তিনি দৃঢ় কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, যে পারে পারুক আমি মেনে নিতে পারবো না।’ ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়, ‘দুঃখীরা গল্প করে’ শিরোনামের কাব্যগ্রন্থ। এই যে মানবিক দুঃখ তাড়ানিয়া অভিব্যক্তি, তার কি কোনও তুলনা হয় ? না বিকল্প কিছু আছে ? কবির হৃদয় তাই নীরবেই অশ্রুপাত করে, তার আত্মক্রন্দন কেবল কবিতার পঙ্ক্তিতে নয়, সঞ্চারিত হয় হৃদয় থেকে হৃদয়ে :
তোমাদের দুঃখের সংবিধানে
কোনও আশার কথা নেই
আমি এমন ভরসা দিই কী করে যে
সব ঠিক হয়ে যাবে
কিভাবে বলি
তোমাদের, হে দুঃখী মানুষ
সংবিধান পাল্টে দেবো।
(তোমাদের দুঃখের সংবিধান)
কবির এই উচ্চারণের মধ্যে তার অভীপ্সা, কাম্যবিশ্ব স্পষ্ট। প্রত্যয়গুলো সঞ্জীবিত। তদুপরি ব্যক্তি আসাদ চৌধুরীর গহন জীবনটি এখানেই সঞ্চালিত। তার বিবেকী উত্থান, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পটভূমিতে খুবই তাৎপর্যময়। কবির অভিপ্রায়, মনের গহিনে লুক্কায়িত ভাবটি মূর্ত হয়ে ওঠে সহজে পাঠকের হৃদয়ে :
তখনও ক্রোধে, অন্যায়ে অবিচারে
ফেটে পড়তো মানুষ
তখনও মানুষ ছিল
ভোটার নয় মানুষ।
(মফস্বল, হায় দুয়োরানী)
আধুনিক নগর সভ্যতা, রাষ্ট্রের ব্যর্থতা করুণা সুরে আসাদ চৌধুরীর অন্তর্সরে দ্রবীভূত। তিনি আধুনিকতার ক্ষয়িত শূন্যতাকে ট্র্যাজেডি হিসেবে প্রত্যক্ষ করেন। তাঁর ভেতরে নাগরিক সমাজের ভেতরকার নৈঃসঙ্গ, ক্লান্তি, বেদনাময়, বিমানবিক ব্যবস্থা গ্রহণযোগ্য নয়। নগর রাষ্ট্রের অভ্যন্তর অসঙ্গতি, দ্বন্দ্ব-যন্ত্রণা ভোগের দ্বারা রক্তাক্ত―ফলে তিরিশি আধুনিকতা, ইয়েটস এলিয়ট মালার্মে বোদলেয়ারের অনুকৃতিতে তিনি আবদ্ধ থাকতে চাননি। আসাদ চৌধুরীর কবিতার অস্ফুট সম্ভাবনাশীল মাত্রাসমূহ, ক্রমেই গভীরতর, দেশজ, লোকজ ঐতিহ্যের দিকে প্রবাহিত হয়। নগরের গর্ভস্থিত মানবমূল্যের ভাঙন অনুধাবন করে অতীতের গ্রামীণ, সমষ্টিগত, প্রকৃত মানবিক সমাজ, নির্দ্বন্দ্ব, শান্ত সহজ-সরল জীবন তার কাছে অধিক কাম্য হয়ে ওঠে। মানবিকতা ও মরমি চেতনা ধারণ করে নতুন এক শক্তি সঞ্চয় করেছে আসাদ চৌধুরীর কবিতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ,
ডিন, কলা ও মানবিক অনুষদ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়।