অলংকার শব্দটা শুনলেই মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে মায়ের ব্যবহার করা নাকের নথ, কানের ঝুমকোলতা, গলার সিতা হার, হাতের বালা, কোমরের বিছা, সিঁথির টিকলি, যা নারীকে সুন্দর করে তোলে। মানুষ মাত্রই নন্দন প্রিয়। তবে আজ আমরা নারী সজ্জিতকরণের অলংকার নিয়ে আলোচনা করব না। আলোচনা করব কাব্যালংকার নিয়ে। কাব্যকে সজ্জিতকরণের ক্ষেত্রে যে অলংকার ব্যবহার করা হয় তাই কাব্যালংকার।
অলংকার :
ঈশ্বর যেমন সুন্দরের পূজারি। তেমনি মানুষও সুন্দরের পূজারি। ব্যক্তি তার সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে যেমন অলংকার ব্যবহার করে, তেমনি সাহিত্যে বিশেষ করে কবিতায় সৌন্দর্যকে তুলে ধরতে হলে অলঙ্কারের ব্যবহার আবশ্যক। যার মাধ্যমে একটি কবিতা পায় তার শিল্পিত রূপ। নান্দনিকতার ছোঁয়ায় সবার কাছে পায় গ্রহণযোগ্যতা।
অলংকার শব্দের অর্থ :
অলংকার শব্দটির অর্থ ‘ভূষণ’ বা ‘গয়না’। নারী তার দৈহিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য যে ধরনের ভূষণ ব্যবহার করে থাকে, তাকে দৈহিক অলংকার বলে। আর কবিরা কাব্যদেহের সৌন্দর্যকে বৃদ্ধি করার জন্য যে ভূষণ ব্যবহার করে থাকে, তাকে কাব্যালংকার বলে।
শ্রেণিবিভাগ :
অলংকারকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন :
১. শব্দালংকার ও
২. অর্থালংকার।
শব্দালংকার : যে অলংকার ধ্বনির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং শ্রুতি সৌকর্য-বিধায়ক তাকে শব্দালংকার বলে। শব্দালংকার একান্তভাবে শব্দের ধবনি সৌন্দর্যের ওপর নির্ভরশীল।
অর্থালংকার : যে অলংকার অর্থের ওপর নির্ভরশীল তাকে বলা হয় অর্থালংকার।
শব্দালংকার :
শব্দের ধ্বনিরূপকে আশ্রয় করে যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় শব্দালংকার। এর মূল সৌন্দর্যটুকু ফুটে ওঠে শব্দের ধ্বনিরূপে। মনে রাখতে হবে শব্দালংকারের অলংকার নির্ভর করে শব্দের ওপর, তাই ইচ্ছে মতো তাকে বদলে দেয়া যায় না।
শব্দালংকারের শ্রেণিবিভাগ :
শব্দালংকার পাঁচ প্রকার। যেমন―
ক. অনুপ্রাস
খ. যমক
গ. শ্লেষ
ঘ. বক্রোক্তি
ঙ. ধ্বনিবৃত্তি বা ধ্বন্যুক্তি
অনুপ্রাস :
অনু শব্দের অর্থ পরে বা পিছনে আর প্রাস শব্দের অর্থ বিন্যাস, প্রয়োগ বা নিক্ষেপ। একই বর্ণ বা বর্ণগুচ্ছ যুক্তভাবে হোক বা বিযুক্তভাবে হোক একাধিকবার উচ্চারিত হয়ে যদি কবিতায় ধ্বনিমাধুর্যের সৃষ্টি করে তবে তাকে অনুপ্রাস অলংকার বলে।
মূল বৈশিষ্ট্য :
ক. এতে একই ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ একাধিক বার ব্যবহৃত হবে।
খ. একাধিক বার ব্যবহৃত ধ্বনি বা ধ্বনিগুচ্ছ যুক্ত শব্দগুলো যথাসম্ভব পরপর বা কাছাকাছি বসবে।
গ. এর ফলে ধ্বনি সৌন্দর্যের সৃষ্টি হবে।
উদাহরণ :
গুরু গুরু মেঘ গুমরি গুমরি
গরজে গগনে গগনে,
গরজে গগনে। (রবীন্দ্রনাথ)
শ্রেণিবিভাগ :
অনুপ্রাস অলংকার ছয় প্রকার। যেমন―
ক. অন্ত্যানুপ্রাস
খ. শ্রুত্যনুপ্রাস
গ. সর্বানুপ্রাস
ঘ. ছেকানুপ্রাস
ঙ. বৃত্ত্যনুপ্রাস
চ. লাটানুপ্রাস
ক. অন্ত্যানুপ্রাস :
কবিতার এক চরণের শেষে যে শব্দধ্বনি থাকে অন্য চরণের শেষে তারই পুনরাবৃত্তির যে অনুপ্রাস অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম অন্ত্যানুপ্রাস। অর্থাৎ কবিতার দু’টি চরণের শেষে যে শব্দধ্বনির মিল থাকে তাকেই অন্ত্যানুপ্রাস বলে। একে অন্ত্যমিলও বলা হয়ে থাকে।
উদাহরণ :
১. দিনের আলো নিভে এল সূর্যি ডোবে ডোবে,
আকাশ ঘিরে মেঘ টুটেছে ছাঁদের লোভে লোভে।
২. রাখাল গোরুর পাল লয়ে যায় মাঠে
শিশুগণ দেয় মন নিজ নিজ পাঠে।
৩. গগনে ছড়ায়ে এলোচুল
চরণে জড়ায়ে বনফুল।
খ. শ্রুত্যনুপ্রাস :
বাগযন্ত্রের একই স্থান থেকে উচ্চারিত শ্রুতিগ্রাহ্য, সাদৃশ্যময় ব্যঞ্জনবর্ণের অনুপ্রাসকে শ্রুত্যনুপ্রাস অলংকার বলে।
উদাহরণ :
১. বাতাস বহে বেগে
ঝিলিক মারে মেঘে।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘বেগে’ শব্দের ‘গ’ এবং ‘মেঘে’ শব্দের ‘ঘ’ যদিও একই বর্ণ নয় তবু এরা বাগযন্ত্রের একই স্থান (কণ্ঠ) থেকে উচ্চারিত হয়েছে বলে এটি শ্রুত্যনুপ্রাস অলংকার।
২. কালো চোখে আলো নাচে
আমার যেমন আছে।
গ. সর্বানুপ্রাস :
সমগ্র চরণের সঙ্গে সমগ্র চরণের যে ধ্বনি-সাম্য ঘটে তাকে সর্বানুপ্রাস অলংকার বলে।
উদাহরণ :
সন্ধ্যা মুখের সৌরভী ভাষা
বন্ধ্যা বুকের গৌরবী আশা।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে প্রথম চরণের সঙ্গে দ্বিতীয় চরণের শব্দ বা শব্দাংশগুলির ধ্বনি-সাম্য ঘটেছে বলে এটি সর্বানুপ্রাস অলংকার।
ঘ. ছেকানুপ্রাস :
দুই বা ততোধিক ব্যঞ্জনধ্বনি যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে একইক্রমে মাত্র দুবার ধ্বনিত হলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তাকে ছেকানুপ্রাস বলে।
উদাহরণ :
১. এখনি অন্ধ বন্ধ কোরও না পাখা।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘ন’ এবং ‘ধ’ এই দুটি ব্যঞ্জনবর্ণ যুক্তভাবে (ন্ধ) ক্রমানুসারে (ন, ধ) মাত্র দুবার (অন্ধ, বন্ধ) উচ্চারিত হয়েছে বলে এটি ছেকানুপ্রাস অলংকার।
২. করিয়াছ পান চুম্বন ভরা সরস বিম্বাধরে।
ব্যাখ্যা : এখানে যুক্ত ব্যঞ্জন ‘ম্ব’ একের অধিকবার ক্রমানুসারে ধ্বনিত হয়েছে চুম্বন ও বিম্বাধরে এর মধ্যে, তাই এটি ছেকানুপ্রাস অলংকার।
ঙ. বৃত্ত্যনুপ্রাস :
একটি ব্যঞ্জনধ্বনি একাধিকবার ধ্বনিত হলে, বর্ণগুচ্ছ স্বরূপ অথবা ক্রম অনুসারে যুক্ত বা বিযুক্ত ভাবে বহুবার ধ্বনিত হলে যে অনুপ্রাসের সৃষ্টি হয় তাকে বলা হয় বৃত্ত্যনুপ্রাস।
উদাহরণ :
১. সাগর জলে সিনান করি সজল এলোচুলে।
ব্যাখ্যা : এখানে একক ব্যঞ্জন ‘স’ পরপর তিনবার ও ‘ল’ পরপর চারবার পুনরাবৃত্তি হওয়ায় এটি অলঙ্কার বৃত্ত্যনুপ্রাস।
২. কেতকী কত কী কথা কহে কামিনীর কানে কানে।
চ. লাটানুপ্রাস :
যে অনুপ্রাস অলংকারে একই শব্দ দুবার বা তার বেশি একই অর্থে ব্যবহৃত হয় এবং ধ্বনি সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে, সে অনুপ্রাসকে লাটানুপ্রাস বলে।
উদাহরণ :
১. গাছে গাছে ফুল ফুলে ফুলে অলি সুন্দর ধরাতল।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে ‘গাছে’ এবং ‘ফুলে’ শব্দ দুটি দুবার একই অর্থে ব্যবহৃত হওয়ায় দুটি ক্ষেত্রেই লাটানুপ্রাস অলংকার হয়েছে ।
অনুপ্রাস অলংকারের আরও কিছু উদাহরণ :
১. ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসি
২. একটি ধানের শিষের উপরে একটি শিশিরবিন্দু
৩. কহিলাম তবে বক্ষে জুড়িয়া সজল চক্ষে, করুন রক্ষে গরিবের ভিটাখানি।
৪. নন্দপুর চন্দ্র বিনা বৃন্দাবন অন্ধকার।
৫. কত না ছিন্ন চরণচিহ্ন ছড়ানো সে ঠাঁই ঘিরে।
৬. ঐ দিকে দিকে বেজেছে ডঙ্কা শঙ্কা নাহিক আর।
৭. আবাদ করে বিবাদ করে সুবাদ করে তারা।
৮. এত ভঙ্গ বঙ্গ দেশ তবু রঙ্গে ভরা।
৯. ছুটির সঙ্গে রুটির ব্যবস্থা হলে দুটিই পরিপাটী হয়।
শ্লেষ :
একটি শব্দ একাধিক অর্থে একবার মাত্র ব্যবহারের ফলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম শ্লেষ। এতে একবার মাত্রই শব্দটি ব্যবহৃত হয় কিন্তু তাতে ভিন্ন অর্থের ব্যঞ্জনা থাকে। এই শ্লেষ শব্দকেন্দ্রিক বলে কেউ কেউ একে শব্দ-শ্লেষ বলেন।
উদাহরণ :
১. আছিলাম একাকিনী বসিয়া কাননে
আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে। (মুকুন্দরাম)
ব্যাখ্যা : এখানে ‘গুণে’ শব্দে শ্লেষ অলংকার ব্যবহৃত হয়েছে। এর একটি অর্থ ধনুকের ছিলায় আর অন্য অর্থ সুন্দর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য বা গুণ।
২. মাথার উপরে জ্বলিছেন রবি, রয়েছে সোনার শত ছেলে (নজরুল)
এখানে কবি ‘রবি’ বলতে সূর্য ও রবীন্দ্রনাথকে বুঝিয়েছেন।
শ্রেণিবিভাগ :
শ্লেষ অলংকারকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়।
যেমন―অভঙ্গ শ্লেষ ও সভঙ্গ শ্লেষ।
অভঙ্গ শ্লেষ :
শব্দকে না ভেঙ্গে অখণ্ড অবস্থায় রেখেই যে শ্লেষ প্রকাশ পায় তা-ই অভঙ্গ শ্লেষ।
উদাহরণ :
১. আনিলা তোমার স্বামী বান্ধি নিজ গুণে।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে শ্লেষাত্মক শব্দ হল ‘গুণে’। ‘গুণে’ শব্দের প্রথম অর্থ ধনুকের ছিলা এবং দ্বিতীয় অর্থ উৎকর্ষতা। শ্লেষাত্মক শব্দটিকে না ভেঙে একাধিক অর্থ পাওয়া যাচ্ছে বলে এটি অভঙ্গ শ্লেষ অলংকার।
সভঙ্গ শ্লেষ:
অখণ্ড অবস্থায় শব্দের শ্লেষ প্রকাশ না পেয়ে শব্দকে ভাঙলে যে শ্লেষ প্রকাশ পায় তাকে সভঙ্গ শ্লেষ বলে। একাধিক অর্থ পাওয়ার জন্য শ্লেষাত্মক শব্দটিকে ভাঙতে হয়।
উদাহরণ :
১. আমার দিনের শেষ ছায়াটুকু মিলাইলে
মূলতানে গুঞ্জন তার রবে চিরদিন।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে শ্লেষাত্মক শব্দ হল ‘মূলতান’। মূলতান কথাটির প্রথম অর্থ একটি রাগিনীর নাম। দ্বিতীয় অর্থ মূল+তান অর্থাৎ প্রধান সুর। একাধিক অর্থ পাওয়ার জন্য শ্লেষাত্মক শব্দটিকে ভাঙতে হচ্ছে বলে এটি সভঙ্গ শ্লেষ অলংকার।
যমক :
একই শব্দ একই স্বরধ্বনিসমেত একই ক্রমে ভিন্ন ভিন্ন অর্থে একাধিক বার ব্যবহারের ফলে যে অলংকারের সৃষ্টি হয় তার নাম যমক। যমক শব্দের অর্থ হল যুগ্ম বা দুই। লক্ষণীয় যে, একই শব্দ দুই বা ততোধিক বার ব্যবহৃত হওয়া এবং ভিন্ন অর্থ প্রকাশ করা এর বৈশিষ্ট্য।
উদাহরণ :
১. মাটির ভয়ে রাজ্য হবে মাটি
দিবসরাতি রহিলে আমি বন্ধ। (রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
ব্যাখ্যা : এখানে ‘মাটি’ একটি শব্দ যা দুইবার ব্যবহৃত কিন্তু অর্থ ভিন্ন। প্রথম মাটি ধুলা অর্থে এবং দ্বিতীয় মাটি বিনষ্ট অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
২. ওরে ও তরুণ ঈশান
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচী’র প্রাচীর ভেদি। (নজরুল)
যমকের শ্রেণিবিভাগ : দুই প্রকার
১. সাধারণ শ্রেণিবিভাগ ও
২. প্রধান শ্রেণিবিভাগ
সাধারণভাবে যমক চার প্রকার। যেমন―
ক. আদ্য যমক
খ. মধ্য যমক
গ. অন্ত্য যমক
ঘ. সর্বযমক
ক. আদ্য যমক :
যে যমক অলংকারে যমক শব্দগুলি চরণের শুরুতে থাকে তাকে আদ্য যমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :
১. ঘন ঘনাকারে ধুলা উঠিল আকাশে।
(মাইকেল মধুসূদন দত্ত)
২. ভারত ভারত খ্যাত আপনার গুণে।
খ. মধ্য যমক :
যে যমক অলংকারে যমক শব্দগুলি চরণের মধ্যে অবস্থান করে তাকে মধ্য যমক বলে।
উদাহরণ :
নামজাদা লেখকদেরও বই বাজারে কাটে,
কাটে বেশি পোকায়। (প্রমথ চৌধুরী)
গ. অন্ত্য যমক :
যে যমক অলংকারে চরণের শেষে যমক শব্দগুলি থাকে তাকে অন্ত্যযমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :
১. দুহিতা আনিয়া যদি না দেহ
নিশ্চয় আমি ত্যাজিব দেহ। (ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত)
ঘ. সর্বযমক :
যে যমক অলংকারে যমক শব্দগুলি চরণের সমগ্র চরণজুড়ে থাকে তাকে সর্বযমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :
কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত-সহকারে।
কান্তার আমোদপূর্ণ কান্ত-সহকারে।।
যমকের প্রধান শ্রেণিবিভাগ : দুই প্রকার
ক. সার্থক যমক ও
খ. নিরর্থক যমক অলংকার
ক. সার্থক যমক অলংকার :
যে যমক অলংকারে যমক শব্দ দুটির প্রতিটিই অর্থপূর্ণ তাকে সার্থক যমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :
১. রক্ত মাখা অস্ত্র হাতে যত রক্ত আঁখি
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে যমক শব্দ হল ‘রক্ত’। প্রথম রক্ত শব্দের অর্থ শোণিত (নষড়ড়ফ) এবং দ্বিতীয় রক্ত শব্দের অর্থ রাগান্বিত। এখানে যমক শব্দ দুটির প্রতিটি অর্থপূর্ণ।
২. ঘন বন তলে এসো ঘন নীল বসনা।
খ. নিরর্থক যমক অলংকার :
যে যমক অলংকারে যমক শব্দ দুটির একটি অর্থপূর্ণ ও অন্যটি অর্থহীন তাকে নিরর্থক যমক অলংকার বলে।
উদাহরণ :
১. শেফালি রায়ের সঙ্গে আমার
একফালিও পরিচয় নেই।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে যমক শব্দ বা শব্দাংশ হল ‘ফালি’। এখানে প্রথম ফালি শব্দের কোনও অর্থ নেই। কারণ তা শেফালি শব্দের অন্তর্গত একটি শব্দাংশ মাত্র। কিন্তু দ্বিতীয় ফালি শব্দটি অর্থপূর্ণ যার অর্থ টুকরো। কাজেই যমক শব্দ দুটির একটি অর্থহীন এবং একটি অর্থপূর্ণ বলে এটি নিরর্থক যমক অলংকার।
২. মাসীমার সীমাতেও আমি আসিনি।
বক্রোক্তি :
বক্রোক্তি কথার অর্থ বাঁকা কথা।
সোজাসুজি কোন কথা না বলে প্রশ্ন বা স্বরবিকৃতির দ্বারা বাঁকা ভাবে বলায় যে অলঙ্কারের সৃষ্টি হয় তার নাম বক্রোক্তি। বক্তা তাঁর বক্তব্যে কী কথা কী ভাবে বলতে চান তা সঠিক ভাবে জেনেও শ্রোতা অনেক সময় ইচ্ছে করে তাকে একটু বাঁকিয়ে ও ভিন্ন অর্থে গ্রহণ করলে তা বক্রোক্তি অলঙ্কার হয়।
উদাহরণ :
আপনার কি পানাভ্যাস আছে ?
আজ্ঞে না, পকেটের পজিশন খারাপ কিনা―তাই এখনও রপ্ত করে উঠতে পারি নাই।
ব্যাখ্যা : এখানে লক্ষ করলে দেখা যায় বক্তার জিজ্ঞাসার জবাবে শ্রোতা একটু ঘুরিয়ে বাঁকাভাবে তার উত্তর দিয়েছেন, যে কারণে এখানে অলঙ্কার বক্রোক্তি ঘটেছে।
শ্রেণিবিভাগ :
বক্রোক্তি দুই প্রকার। যেমন―
ক. শ্লেষবক্রোক্তি ও
খ. কাকু-বক্রোক্তি
শ্লেষ বক্রোক্তি :
একই শব্দে নানা অর্থ গ্রহণ করে উক্তি-প্রত্যুক্তির মাধ্যমে যে বক্রোক্তি অলংকার হয় তাকে শ্লেষ বক্রোক্তি অলংকার বলে।
উদাহরণ :
বক্তা : আপনার কপালে রাজদণ্ড আছে।
শ্রোতা : নিশ্চয়, আইন অমান্য করে ছ’মাস খেটেছি এখন সশস্ত্র বিপ্লবে না হয় বছর কত খাটবো।
ব্যাখ্যা : আলোচ্য উদাহরণে বক্তার উক্তির মধ্যে ‘রাজদণ্ড’ কথাটি শ্লেষাত্মক। যার দুটি অর্থ হলো―
ক. রাজার শাসনদণ্ড হাতে পাওয়া বা রাজা হওয়া।
খ. রাজশাস্তি বা গুরুতর শাস্তি।
বক্তা এখানে প্রথমটির অর্থ ধরে নিয়ে বক্তব্য রাখলেও শ্রোতা দ্বিতীয় অর্থটি ধরে নিয়ে উত্তর দিয়েছে। তাই এটি শ্লেষ বক্রোক্তি অলংকার।
কাকু বক্রোক্তি :
কাকু মানে স্বরভঙ্গি। কন্ঠধ্বনির বিশেষ ভঙ্গির ফলে বিধিমূলক বাক্য নিষেধমূলক বাক্যে কিংবা নিষেধমূলক বাক্য বিধিমূলক বাক্যে যদি পর্যবসিত হয় তবে কাকু বক্রোক্তি অলংকার বলে।
উদাহরণ :
স্বাধীনতা হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে
কে বাঁচিতে চায়।
সমাপ্তি কথা :
শুরুর দিকে নিজের কাছেই ব্যাকরণিক ‘অলংকার’ একটি জটিল বিষয় বলে মনে হতো। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের অনেক শিক্ষার্থী ক্লাস শেষে বলে থাকেন বিষয়টা অনেক গোলমেলে। কিছুই বুঝলাম না। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি―স্থির মনে, ধীরে সুস্থে, বুঝে বুঝে সময় দিলে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন। আমি অনেক বইপত্র ঘেটে ছেটে সহজ করে বিষয়টা তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। কতটুকু পেরেছি জানিনা। ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন প্রত্যাশা। আর যদি কারও এতটুকু উপকার হয় তাহলে নিজেকে সার্থক মনে হবে।
সব শেষে বলব অলংকার দিয়ে সাজালে রমণীকে যেমন সুন্দর লাগে তেমনি ভেতর পটে লুকিয়ে থাকা সুন্দর বোধ জাগ্রত করে নিজেকে অলংকৃত করুন। তাহলে দেখবেন নিজেকে সুন্দর লাগবে, পরিবার সুন্দর লাগবে, সমাজ সুন্দর লাগবে, দেশ সুন্দর লাগবে, সুন্দর লাগবে গোটা পৃথিবী। আর তখন আপনি যে সাহিত্য বা কাব্য চয়ন করবেন তা অনায়াসেই হয়ে উঠবে অলংকারময়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, সংগঠক
সচিত্রকরণ : রজত