আর্কাইভজন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

স্মরণাঞ্জলি : ভার্সাই নগরে মধুসূদনের খোঁজে : মিল্টন বিশ্বাস

২৫ জানুয়ারি ছিল আধুনিক বাংলা সাহিত্যের মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের (১৮২৪-১৮৭৩) দ্বিশত জন্মবার্ষিকী। ২৯ জুন তাঁর মৃত্যুবার্ষিকী। তিন দিন আগে ২৬ শে জুন কবির আমৃত্যু সহচর, সুখ-দুঃখের সঙ্গী হেনরিয়েটা মারা যান। ভার্সাইয়ে দারিদ্র্যপীড়িত হেনরিয়েটা ক্রমাগত দুর্ভোগময় পরিস্থিতি সামলাতে গিয়ে অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। সন্তানদের নিয়ে কলকাতায় ফিরে এলেও তাঁর অবস্থার কোনও উন্নতি হয়নি। তিন সন্তানের এই জননী অবর্ণনীয় দুঃখ ও দারিদ্র্য যাপন করেছেন, বিদেশ কিংবা স্বদেশে কপর্দকশূন্য দিন কাটিয়েছেন। তবু কখনও বিরূপ আচরণ করেননি মধুসূদনের সঙ্গে। তাঁর সান্নিধ্যের কারণেই মাত্র ৪৯ বছরের আয়ুষ্কালে মধুসূদন প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও ক্ষণজন্মা প্রতিভার অনন্য রূপকারে পরিণত হন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত ফ্রান্সের ভার্সাই নগরে বসতি গেড়েছিলেন। সময়টা ছিল নিরতিশয় অভাব-অনটন ও সংকটের। প্যারিসের কেন্দ্র স্থল থেকে ২০ কিমি দূরে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে অবস্থিত সেই ভার্সাই নগরে কবিকে খুঁজে ফেরার অভিজ্ঞতা আছে এ লেখায়।

২০১৭ সালের জুন মাসে জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনার শেষ করে অধ্যাপক ড. হান্স হার্ডারের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্যারিসের পথে সকালের ট্রেনে একাই রওনা হলাম। ভরসা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রাক্তন ছাত্র শেখ জাহিদ উর রশিদ। সে দীর্ঘদিন প্যারিসে বাস করছে। ৩৫০ কিমি বেগে চলা ট্রেনটি স্থানীয় সময় বেলা ১২টায় প্যারিস পৌঁছাল। ছাড়তে ২০ মিনিট বিলম্ব হওয়ায় সারা পথে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে করতে পৌঁছানোর নির্দিষ্ট সময় ধরে ফেলল দ্রুতযানটি। ট্রেন থেকে নেমে জাহিদের আয়োজনে হোটেলে ব্যাগ রেখে বের হয়ে পড়লাম। প্রথমে লুভর, তারপর ইফেল টাওয়ার, নটর ডেম গির্জা, প্যারিস গেট, আরেকটি ঐতিহ্যিক ক্যাথিড্রাল দেখে রাতে ফিরে আসা। কয়েক ঘণ্টায় প্যারিসের বিখ্যাত জায়গাগুলো দেখানোর কৃতিত্ব অবশ্যই জাহিদের। কিন্তু তাঁকে জানিয়ে দিয়েছি, ভার্সাই নগরে মধুসূদনের বাসস্থান দেখতে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেই হবে। সে কথা রেখেছিল।

পরদিন জাহিদ নিয়ে গেল ভার্সাই শহরে। মেট্রো যোগে ওর প্যানটিন (Pantin) এলাকা থেকে ‘গার সাঁ লেজার’ (Gare Saint-Lazare) স্টেশনে এসে টিকেট নিয়ে RER-C ট্রেনে উঠে যাত্রা শুরু করলাম। প্যারিস নগর ছেড়ে যাচ্ছি শহরতলির দিকে। দূর থেকে সুউচ্চ ইফেল টাওয়ারের চূড়ার দিকে তাকাতে তাকাতে ট্রেনের গতিপথে চোখ যায়; দেখতে পাই পাহাড় আর অরণ্যের পথ অতিক্রম করছি আমরা। মহানগরের বাইরে ছোট ছোট স্টেশনগুলো নিরিবিলি―থামলে এক-দু’জন যাত্রী যোগ হচ্ছে। আমরা হাত-পা ছড়িয়ে বসে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছি কৌতূহল নিয়ে। আবাসিক বাড়িগুলোকে মনে হচ্ছে স্নিগ্ধতায় ভরা প্রকৃতির আলিঙ্গনে ঋদ্ধ।

সব স্টেশনে থামতে থামতে অবশেষে এক ঘণ্টা পরে ভার্সাই শহরের ‘গার দ্য ভার্সাই শনতিয়ের’ (Gare de Versailles Chantiers) স্টেশনে এসে নামলাম। স্টেশন থেকে বের হয়েই মূল সড়কে আমরা। বিস্ময় নিয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছি। খুঁজছি প্রায় ১৫০ বছর আগের সময়গুলোকে। যখন বাংলাদেশের এক অসহায় কবি সপরিবারে এই শহরটিতে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করে চলেছেন। আজকের ভার্সাই অনেক সাজানো-গুছানো। ঊর্ধ্বমুখী বিল্ডিংগুলো একই উচ্চতায় বিন্যস্ত। সড়কগুলো পরিকল্পিতভাবে সমগ্র শহরকে আলিঙ্গন করে আছে। বড় বড় বৃক্ষরাশি দেখে সহজেই মনে হবে এটি একটি পুরোনো শহর।

উল্লেখ্য, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় মধ্যযুগেই ভার্সাই প্রথমবারের মতো ফ্রান্সের রাজার অধীনে আসে। একাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে, এই গ্রামটি দুর্গ আর সন্তদের নামে সুন্দর সুন্দর গির্জার স্থাপত্যে অপরূপ হয়ে ওঠে। এটি ছিল কৃষিকাজের জন্য বিখ্যাত। মানুষের কঠোর শ্রমে গ্রামে সমৃদ্ধি এসেছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষদিকে এটি ফ্রান্সের সমৃদ্ধিময় একটি বসতি হলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে প্লেগের মহামারি তথা ব্ল্যাক ডেথ এবং শত বছরের যুদ্ধ নিয়ে আসে এর ধ্বংস। পঞ্চদশ শতাব্দীতে শত বছরের যুদ্ধের শেষে, গ্রামটি পুনরায় জেগে ওঠে। সে সময় সেখানে কেবল ১০০ জন লোকের বসতি ছিল। ষোড়শ শতাব্দী থেকে ভার্সাই যৌবন ফিরে পেতে থাকে। মধুসূদন ১৮৬৩ সালে যখন সপরিবারে এই শহরে উপস্থিত হন তখন এর জনসংখ্যা ছিল মাত্র পঞ্চাশ হাজারের মতো। মনে রাখতে হবে বিখ্যাত ফরাসি যোদ্ধা নেপোলিয়ন বোনাপার্ট (১৭৬৯-১৮২১) এই ভার্সাই নগরে একটি রাত যাপন করেছিলেন।

ট্রেন থেকে নেমে স্টেশনের বাইরে ভার্সাই জেনেরো (সড়ক) ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যাই ‘রু দ্য লা এতা জেনেরো’তে (যার আগের নাম ছিল ‘রু দে শনতিয়ের’)। ১২ নম্বর বাড়ি খুঁজে বের করি―যেন গোলাম মুরশিদের আশার ছলনে ভুলি গ্রন্থে পড়া সেই বাড়ির বর্ণনাকে মেলানোর চেষ্টা করতে আমরা এখানে এসেছি।

১৮৬৩ থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত মাইকেল মধুসূদন দত্ত তিনতলা এই ভবনের দোতলায় থাকতেন। ভবনটির লাল দরজার উপরে লেখা ১২ নম্বর। তবে অযৌক্তিক ও সহজে নজরে না আসার মতো জায়গায় থাকা একটি নামফলক ভবনের প্রথম তলায় দুটি কক্ষের বাম দিক থেকে চতুর্থ এবং পঞ্চম জানালার মধ্যে স্থাপন করা আছে। স্মৃতিফলকটি প্যারিসের ভারতীয় দূতাবাস স্থাপন করেছিল বলেই কবিকে ‘ইন্ডিয়ান পোয়েট’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে বলে রাখা দরকার, কবির বাসস্থানের স্মৃতিফলকটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সুন্দর করে পুনরায় টাঙ্গানো দরকার। রাজপ্রাসাদের বাগানের ‘ক্যাফে বারে’ কবির একটি আলোকচিত্র রাখার ব্যবস্থাও করা যেতে পারে। বিশাল জানালার দিকে তাকিয়ে স্মরণ করলাম―দোতলার দুটি কক্ষে হেনরিয়েটা ও তাদের সন্তানদের সঙ্গে কবির নিষ্ঠুর সময় যাপন করার কথা। প্রবাস জীবন এটিই প্রথম নয়। কারণ তিনি ১৮৪৮ সালে অপরিচিত মাদ্রাজেও নিজের পরিচিত এলাকা ছেড়ে জীবন কাটিয়েছেন। ১৮৫৬ সালে সেখান থেকে কলকাতায় ফিরে যখন সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত তখন একটি সনেটে যে-ভাবের কথা ব্যক্ত করেছেন তার সঙ্গে ভার্সাই জীবনের হুবহু মিল রয়েছে। ১৮৬০ সালে লেখা যা বঙ্গভাষা নামে চতুর্দশপদী কবতিাবলীতে সংকলিত তাতে আছে :

‘পরদেশে, ভিক্ষাবৃত্তি কুক্ষণে আচরি।

কাটাইনু বহু দিন সুখ পরিহরি।

অনিদ্রায়, নিরাহারে সঁপি কায়, মনঃ,

মজিনু বিফল তপে অবরেণ্যে বরি;’

মিলে গেল অনেক কিছু। কারণ পরদেশ ভার্সাইয়ে ভিক্ষাবৃত্তি গ্রহণের মতো অবস্থা হয়েছিল তাঁর। আর কবি পরিবারের অনাহার, অনিদ্রাময় কষ্টের দিনগুলোর কথা মনে পড়ল। এমন এক সময়ের ঘটনা ছিল যখন তাঁর ইংল্যান্ডে থাকার সামর্থ্য ছিল না বলে ভার্সাইতে চলে আসতে হয়েছিল। ফেরার পর সীমিত অর্থ দ্রুত শেষ হলে তিনি ও হেনরিয়েটা দুঃস্বপ্নে দিন কাটিয়েছিলেন। ১৮৬৫ সালে বিদ্যাসাগরের দানশীলতার কারণে পুনরায় লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়ায় ফিরতে পেরেছিলেন। ভার্সাইয়ে অবস্থানকালে আত্মসম্মানবোধ ও অতি সংবেদনশীলতা তাঁকে চাকরি খুঁজে আয় করার ইচ্ছাকে নিরস্ত করেছিল।

তবে কবির দুঃখ ও কষ্টের কথা মনে পড়লেও বাসাটি খুঁজে পেয়ে আমি উচ্ছ্বসিত হয়েছিলাম। আগেই বলেছি, বাড়িটির জানালাগুলো বিশাল বিশাল। অবশ্যি বাড়িটি সাধারণ মানের। একটি গ্যাস স্টেশনের সামনের দিকে এই তিনতলা বিল্ডিং যার উজ্জ্বল লাল দরজা সহজেই চোখে পড়ে। ভবনের গ্যারেজ স্পেসে আছে একটি গ্রাউন্ড স্টোর এবং একটি পুরানো দোকান, যার জানালাগুলোও বড় বড়। নিচতলায় একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টও দেখা গেল। বিদ্যাসাগরের সহায়তা পাবার পর কবি এই ১২ নম্বর বাসাটি বদল করেন এবং ভার্সাই রাজপ্রাসাদের কাছে একটি ভালো বাসায় ওঠেন। সেখানে ১৮৬৭ সালের ২ আগস্ট হেনরিয়েটা তাদের তৃতীয় পুত্র অ্যালবার্ট জর্জ নেপোলিয়নের জন্ম দেন। ওই বাসার ঠিকানা ৬ নম্বর রু মোপাসাঁ। ১৮৬৯ পর্যন্ত হেনরিয়েটা ওই বাসায় বাস করেছেন কলকাতায় ফিরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত।

গুগল সার্চ দিয়ে দেখতে পাই এই জায়গা থেকে বিশ্বখ্যাত ভার্সাই প্রাসাদ কয়েক কিমি দূরে। কাছেই সেন্ট লুইস এবং আরও কয়েকটি ক্যাথিড্রাল। বাড়িটির দিকে তাকিয়ে ভাবতে থাকি, এখান থেকে তিনি ট্রেনযোগে নিশ্চয়ই প্যারিসে গেছেন। কারণ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে লেখা এক পত্রে মহানুভব যে ফরাসি নারীর কথা লিখেছেন তার সঙ্গে পরিচয় ঘটে ট্রেনে। ভাবতে থাকি এই শহরের সবচেয়ে বিখ্যাত জায়গা ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে চিহ্নিত ভার্সাই প্রাসাদ। সেখানেও নিশ্চয়ই তিনি প্রায় ঘুরে বেড়িয়েছেন। কারণ ১৭৮৯ সালের ফরাসি বিপ্লবের পর ওই প্রাসাদ থেকে রাজধানী প্যারিসে স্থানান্তরিত হয়। ১০০ বছরের কেন্দ্রস্থল পাল্টে যায়। মধুসূদন যখন সেখানে বসবাস করছেন তখন সেটি জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে। আর প্রাসাদের পিছনে বিশাল বাগানের লেকের পাড়ে পুরানো ‘ক্যাফে বারে’ তাঁর পদচারণা খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।

আমি ভাবছিলাম কবির জীবনের দুর্ভোগ, কষ্ট আর বেদনায় মোড়া এই বাসস্থল নিয়ে। এই নগরই তাঁকে বেঁচে থাকার জন্য নিদারুণ দুঃখের মধ্য দিয়ে চালিত করেছে, এই বাসাতে থেকেই তিনি সৃষ্টিশীল কাজ করেছেন। দুর্ভোগকে জয় করে বাংলা সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে গেছেন।

মাইকেল মধুসূদন দত্ত দু সন্তানসহ স্ত্রী হেনরিয়েটাকে মাসোহারার বন্দোবস্ত করে রেখে বিলেতে পৌঁছান ১৮৬২ সালের ৯ জুন এবং ব্যারিস্টার হওয়ার জন্য লেখাপড়ার কাজও শুরু করেন। সূচনায় তিনি চিন্তামুক্ত থাকলেও স্বজনদের প্রতারণায় হেনরিয়েটা ১৮৬৩ সালের ২ মে লন্ডনে এসে পৌঁছান। অর্থাভাবে মধুসূদনের আইন অধ্যয়ন ব্যাহত হয়। এরপর তিনি পত্তনিদার ও বন্ধুদের কাছে ৮টি পত্র লেখেন। সেসব পত্রের কোনও জবাব তিনি পাননি।

জীবনী গ্রন্থ অনুসারে আমরা জানতে পারি, প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে পড়ে ১৮৬৩ সালের মধ্যভাগে কবি সপরিবারে ফ্রান্সে উপস্থিত হন। প্রথমে প্যারিস এবং পরে ভার্সাই শহরে বাস করতে থাকেন। হাতের টাকা শেষ হলে সেখানে বাসা ভাড়া বাকি পড়ে, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ফলে পাওনাদারদের তাড়নায় এবং ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় জেলে যাবার উপক্রম হয়। স্ত্রী-সন্তানদের চ্যারিটেবল ইন্সটিটিউটে পাঠানোরও সম্ভাবনা তৈরি হয়। হেনরিয়েটার অলঙ্কার, গৃহসজ্জার উপকরণ এবং গ্রন্থাদি বন্ধক দেওয়া ও বিক্রয় করে বেঁচে থাকার রসদ জোটাতে হয়। এমনকি কালীপ্রসন্ন সিংহের নেতৃত্বে ‘বিদ্যোৎসাহিনী সভা’র সংবর্ধনায় দেওয়া উপহার কবি প্রিয় রুপোর সুদৃশ্য পানপাত্রটিও বন্ধক দিতে বাধ্য হন। এতে পুত্র-কন্যাদের কয়েক দিনের খাবারের খরচ চলেছিল। বিদ্যাসাগরের সাহায্য পাবার পর ১৮৬৫ সালের শেষ দিকে ইংল্যান্ডে এসে ‘গ্রেজ-ইন’য়ে যোগ দেন। ১৭ নভেম্বর তিনি ব্যারিস্টার হয়ে বের হন। পরিবারকে ফ্রান্সে রেখে ১৮৬৭ সালের ৫ জানুয়ারি কবি ভারত অভিমুখে যাত্রা করেন। মূল লক্ষ্য ছিল পুত্র-কন্যাদের য়ুরোপীয় শিক্ষাদান।

১৮৬৪ সালের জুন মাসের ২, ৯, ১৮; জুলাই মাসের ৪, ১১; আগস্ট মাসের ২, ১৮; সেপ্টেম্বর মাসের ২, ১৮; ডিসেম্বর মাসের ১৮ ও ২৬ এবং ১৮৬৫ সালের ২৬ এপ্রিল তিনি বিদ্যাসাগরকে পত্র লিখে সাহায্য পেয়ে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন। এর মধ্যে বন্ধু গৌরদাসকেও ১৮৬৪ সালের অক্টোবর-নভেম্বর এবং ১৮৬৫ সালের জানুয়ারিতে পত্র লিখে বিস্তৃত পরিসরে নিজের অবস্থা জানিয়েছিলেন।

লক্ষণীয়, দারিদ্র্যদশাকে গোপন না করে খোলামেলাভাবে পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করে পত্র লিখেছিলেন তিনি। ১৮৬৪ সালের ৯ জুন জানাচ্ছেন জনৈক ফরাসি নারী তাঁকে বাঁচিয়েছেন। পুরো পরিবারকে সহানুভূতি দেখিয়েছেন। বাড়িওয়ালাকে ওই সুন্দরী নারী বলেছেন, বাকি দিনগুলোতে থাকতে দেওয়ার জন্য তিনি নিজে দায়িত্ব নিচ্ছেন। অন্যদিকে জানা যাচ্ছে, উপবাস করে মরার হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য পরিচিত-অল্প পরিচিতদের কাছে হাত পেতেছেন কবি।

আসলে ভার্সাই জীবনের শুরুতে অসুখী ও দুশ্চিন্তায় দিনাতিপাত করেছেন মধুসূদন। এরই মধ্যে তিনি জানাচ্ছেন, ফরাসি, ইতালি, জার্মান এবং স্প্যানিশ ও পর্তুগিজ ভাষা শিক্ষার কথা। দুঃসময়ের ভেতর তিনি বিদ্যাসাগরকে আরও জানিয়েছেন, মহাকাব্যের কবি ট্যাসো হচ্ছেন ইউরোপের কালিদাস। তিনি কয়েকটি ভাষা শিক্ষায় নিরন্তর চর্চা অব্যাহত রাখতে উৎসাহী ছিলেন দুঃখ কষ্টের মধ্যেও। শৈশব-কৈশোরে কবির স্মৃতিময় পারিবারিক জীবন, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা অপূর্ব সাগরদাঁড়ি গ্রাম আর স্রোতস্বিনী কপোতাক্ষ নদের কুলকুল তান প্রবাসী জীবনে মনে পড়ত। বাংলার প্রকৃতি আর ইতিহাস-ঐতিহ্য তাঁর জীবনকে ভিন্নতর রসে উজ্জীবিত করত। মধুসূদনের বাল্যকালে দেখা জীবন নিংড়ানো স্মৃতিকাতরতা আর মুগ্ধতার বিন্যাস রয়েছে তাঁর এ সময়ের সনেট ও অন্যান্য কবিতায়।

১৮ জুন (১৮৬৪) কবি লিখেছেন, জনৈক ইংরেজ পাদ্রি বরাবর দরিদ্র তহবিল থেকে সাহায্য পাবার জন্য আবেদন করেন। সেখান থেকে ২৫ ফ্রাঁ সাহায্য পান, যার ফলে সপরিবারে উপবাস করতে হয়নি। তবে ওই সামান্য অর্থ শেষে তাঁদের না খেয়ে থাকতে হবে সে কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। একসময় তাঁদের প্রাণ বাঁচানোও অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে শঙ্কিত হন।

সীমাহীন দুঃখ, অনাহার, দারিদ্র্য আর আত্মসম্মান বিসর্জনের কষ্ট থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যার কথা ভেবেছেন কবি। স্ত্রী-সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে তিনি সেই চিন্তাও পরিহার করেন। কিন্তু তাঁর মন তিক্ততায় ভরে গিয়েছিল। হতাশায় স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল অন্তরের সব উৎসাহ। এমনকি দেশে ফিরে কয়েকজনকে গোপনে হত্যা করে ফাঁসিতে ঝুলতে চেয়েছিলেন তিনি। ভার্সাই থেকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘আমার সব আশা আপনার উপরে, আমি নিশ্চিত আপনি আমাকে হতাশ করবেন না। আর যদি করেন, তবে ভারতে ফিরে দু-এক জন লোককে সুকৌশলে পরিকল্পিতভাবে খুন করে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।’ ১২ নম্বর বাসা থেকেই তিনি ১৮৬৪ সালের ১৮ আগস্ট বিদ্যাসাগরকে জানাচ্ছেন, তাঁর স্ত্রী মৃত সন্তান প্রসব করেছেন। হাতে একটিও মুদ্রা নেই। অর্থাভাবে মানুষের কাছে দয়া ভিক্ষা করতে গিয়ে অপমানিত হয়েছেন। দুর্ভাগ্যের জন্য অন্যেরা লজ্জা দিয়েছে।

কবির দাম্পত্যজীবনে হেনরিয়েটার কষ্টসহিষ্ণুতা ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ১৮৫৬ সাল থেকে কবি কলকাতাবাসী, সঙ্গে হেনরিয়েটাও। ভার্সাইয়ে এক রবিবারে ছুটির দিনে যখন তিনি নিজে লেখাপড়া নিয়ে ব্যস্ত তখন হেনরিয়েটা নিকটস্থ মেলাতে সন্তানেরা যেতে ইচ্ছুক জানান। কিন্তু তার হাতে মাত্র ৩ ফ্রাঁ। মধুসূদন ভাগ্যের কাছে নিজেকে সমর্পণ করার মানুষ নন। কিন্তু সেদিন স্ত্রীকে বলেছিলেন অপেক্ষা করো আজ ডাকে টাকা আসতে পারে। আর ঠিকই সেদিন বিদ্যাসাগরের পাঠানো ১৫০০ টাকা পৌঁছেছিল। সে কথা তিনি সেপ্টেম্বরের ২ তারিখের চিঠিতে জানিয়েছিলেন।

বিদ্যাসাগরের কাছে ১৮/৯/১৮৬৪ তারিখে লেখা চিঠিতে তিনি জানাচ্ছেন লন্ডনের চেয়ে ভার্সাইয়ে খরচ কম। বাসা ভাড়াও কম। এজন্য অর্থের সংস্থান হবার পর তিনি লন্ডনে গ্রেজ-ইনয়ে ফিরে যাচ্ছেন পরিবারকে এখানে রেখে। বিদায় নেবার সময় রেলস্টেশনে কি হেনরিয়েটা গিয়েছিলেন। শিশুরা খুব চঞ্চল হয়ে উঠেছিল। কবি কি ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে লন্ডনে পৌঁছান ?

মধুসূদন নিদারুণ দারিদ্র্য, অর্থাভাব, কষ্ট ও একাকিত্ব অবস্থার মধ্যে ভাষা ও সাহিত্যচর্চা করেছেন। ১৮৬৫ সালে তিনি ভার্সাই বাসকালে সনেটগুলি লেখেন এবং প্রকাশের জন্য কলকাতায় পাঠিয়ে দেন। কয়েকটি নীতিগর্ভ কবিতাও ওই সময়ে লেখা হয়। সেই আর্থিক সংকটের দিনগুলিতে কয়েকটি কাহিনিকাব্যও লিখতে আরম্ভ করেছিলেন, কিন্তু শেষ করতে পারেননি।

১২ নম্বর বাসা ছেড়ে রাজপ্রাসাদের দিকে হাঁটতে থাকি। ইউরোপের সবচেয়ে বড় রাজপ্রাসাদের আঙ্গিনার দিকে জাহিদ নিয়ে চলে। প্রাসাদটি এখন একটি ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ এবং ইউনেস্কোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট। লুভর জাদুঘর ও ইফেল টাওয়ারের পরে ভার্সাই রাজপ্রাসাদ সর্বাধিক পরিদর্শনকৃত স্মৃতিস্তম্ভ। এখানে প্রতি বছর প্রায় কোটির ওপরে দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে। স্থাপত্যকলার অনন্য নিদর্শন হিসেবে সগৌরবে দাঁড়িয়ে থাকা প্রাসাদের কক্ষ ও সাজ-সজ্জা দেখার আমার আগ্রহ ছিল না; কেবল ওকে বলেছিলাম খুঁজে বের করো মধুসূদনের পদচিহ্নের জায়গাগুলো। অবশ্য প্রাসাদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব আছে। ১৭৮৩ সালে ‘পিস অব প্যারিস’ চুক্তি এখানে সম্পাদিত হয়, ১৯১৯ সালের ‘ভার্সাই চুক্তি’ দিয়ে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্ত হয় এই রাজপ্রাসাদ থেকেই।

রাজা চতুর্দশ লুই ১৬৫১ সাল থেকে ভার্সাইয়ে যাতায়াত শুরু করেন যখন তার বয়স ১২। শহরতলির এই জায়গায় প্রথম দিকে শিকারের উদ্দেশ্যে এলেও পরে রাজপ্রাসাদের পুনর্নির্মাণ ও সড়ক প্রশস্ত করতে মনোযোগী হন তিনি। ফলে বিশ্রাম ও বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত হয় নিজের বাসস্থান। সপ্তদশ শতকে রাজ-স্থপতিকে রাজা ইউরোপের সর্বাধিক সুন্দর, দৃষ্টিনন্দন ও বৃহৎ পরিসরে উদ্যান তৈরি করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১৬৮২ সাল থেকে চতুর্দশ লুইয়ের প্রাসাদটি ফ্রান্সের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয় যা ফরাসি বিপ্লবের মধ্য দিয়ে অবলুপ্তি ঘটে। তবে প্রাসাদের পিছনে ১৬৬০ সাল থেকে বৃহৎ বাগানটি গড়ে উঠতে থাকে। ১৭৭০ সালে উত্তর দিকে পঞ্চদশ লুইয়ের সময় নির্মিত অপেরা হাউজটি চারিদিকের বৃক্ষবেষ্টনীতে অপরূপ হয়ে আছে। রাজপ্রাসাদের পিছনে এলে দেখা যাবে মনোরম লেক, ঝরণা, বিচিত্র ভাস্কর্য, জ্যামিতিক ফুলের বিছানা এবং গাছের খাঁজে সজ্জিত বাগান। ফলের গাছগুলিতে প্রচুর কমলা ধরে আছে, বিচিত্র রঙের বিভিন্ন পাখির হৈচৈ তো আছেই। বৃহৎ লেকটি চলে গেছে দক্ষিণের প্রান্ত পর্যন্ত। বাগানে ঢুকে কিছু দূর এগিয়ে গেলে লেকের শুরুতে পুরোনো দিনের একটি ছোট ‘ক্যাফে বার’ আছে। প্যারিসের বাঙালি মাত্রই জানেন, এই ক্যাফেতে মধুসূদন এসে বসতেন। সময় কাটত প্রকৃতির অপরূপ শোভা দেখে। মনে পড়ত বাংলার পথ-প্রান্তরের কথা। দেখলাম বৃহৎ বাগানের বিন্যাসটি অনন্য। ভেতরে ওভিডের মেটামোরফোসিস কাব্য অবলম্বনে ১৬৭০ সালে নির্মিত ল্যাটোনা ঝরনার অপরূপ শোভা, সূর্যদেবতা অ্যাপোলোকে নিয়ে রথারোহী ভাস্কর্যটি এমনভাবে তৈরি হয়েছে যেন সূর্য উদিত হচ্ছে। এছাড়া আছে নানা স্থাপত্য। একসময় রাজপ্রাসাদকে কেন্দ্র করেই কয়েক হাজার মানুষের বসতি গড়ে ওঠে ভার্সাইয়ে।

লুই ষোড়শ (১৭৫৪-১৭৯৩) ছিলেন এই প্রাসাদের শেষ বাসিন্দা। যাকে গিলোটিনে দণ্ড দেবার পর ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটে। বাস্তিল দুর্গের পতন হয় ১৭৮৯ সালের ১৪ জুলাই। ৫ অক্টোবর জনগণের ক্ষোভের মুখে রাজ পরিবার প্যারিসে যেতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ ফরাসি বিপ্লবের পর ভার্সাই ফ্রান্সের রাজধানী না থাকলেও সমৃদ্ধ শহরতলির মূল কেন্দ্র হয়ে উঠতে থাকে। আর সেই উনিশ শতকেই মধুসূদন ভার্সাই নগরে বাস করতে আসেন জীবন যাত্রার ব্যয় কম বলে।

১২ নম্বর বাসা থেকে রাজপ্রাসাদের বাগানে হেঁটে আসতে ১৫ মিনিট সময় লাগে। দুর্দশা ও হতাশার মধ্যে মধুসূদন যে এই বাগানে চলে আসতেন এটাই স্বাভাবিক। কেউ কেউ লিখেছেন, পাওনাদারদের ভয়ে মধুসূদন প্রায় সময়ই গৃহের মধ্যে লুকিয়ে থাকতেন, বাইরে বের হতেন না। কিন্তু বিদ্যাসাগরের সহায়তায় সাংসারিক অনটন কিছুটা সামলে উঠে আবার পড়াশুনোর কথা ভেবেছেন, ব্যারিস্টারি পাস না করে দেশে ফিরবেন না―তাও জানিয়ে ছিলেন। সেই সংকল্প সত্য করে তুলেছিলেন তিনি। এজন্য পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এই বাগানে এসে বসা তাঁর সৌন্দর্য পিপাসিত মনের জন্য অনিবার্য ছিল।

আমি ঘুরছিলাম ‘ক্যাফে বার’কে কেন্দ্র করে। লেকের পাশে ছোট এই কফি শপের ভেতরটাও বেশ গুছানো। সামনে লেকের দিকে মুখ রেখে বসে বসে কফি পানের কথা কল্পনা করলাম। এখন রাজপ্রাসাদের সামনে দিয়ে ঢুকে পিছনের এই বাগানে আসতে হয়। কিন্তু মধুসূদনের সময় কফিশপের উল্টো দিক দিয়েও বাগানে প্রবেশের পথ ছিল। এখন যতটা পরিপাটি এবং সযত্নে লালিত বাগানের গাছ-গাছালি ঠিক দেড়শ বছর আগে এরকমটা ছিল না। কিন্তু পরিকল্পিত উদ্যানের বৈশিষ্ট্য যে তখন থেকে তৈরি হয়েছিল এটা ইতিহাসের তথ্য সমর্থন করে। অনন্য সব বৃক্ষের সমারোহ এই বাগানে। পুষ্পিত বর্ণের সমাহার চারিদিকে, সবুজের মলাটে আবৃত পুরো এলাকাটি। ভালো লাগছিল এক বাঙালি কবি এই রাজপ্রাসাদের আঙিনায় চরম কষ্টের মধ্যেও ঘুরে বেড়িয়েছেন। হয়তো সন্তানদের নিয়ে এসেছেন। লেকের পাশে বসে গল্প শুনিয়েছেন তাঁর নিজের বাংলা প্রকৃতির। হয়তো হেনরিয়েটা তখন কবিকে মনোবল হারাতে নিষেধ করেছেন। উৎসাহ দিয়েছেন কাব্য রচনায়। তখনকার প্রকৃতি আর দেড়শ বছর পরের এই প্রকৃতি জীবনের গান গেয়ে চলেছে। মধুসূদন সেই প্রকৃতির চিরকালীন সংগীতের মূর্ছনায় জেগে ওঠা প্রাণ। যিনি সহজেই পরাজয় মেনে নেননি। সংগ্রাম করে জয়ী হয়েছেন। তাই আজও স্মরণীয় হয়ে আছেন বিশ্ববাসীর কাছে।  

২০২৪ সালে কলকাতার বইমেলা পরিদর্শন এবং ২৬ জানুয়ারি সেখানে একটি সেমিনারে অংশগ্রহণ করার পর কোনও এক সকালে হাঁটতে বের হয়ে রিপন স্ট্রিটের কাছে লোয়ার সার্কুলার রোডের খ্রিস্টান কবরস্থানে প্রবেশ করি মধুসূদনের সমাধি সৌধ দেখার জন্য। 

কবরস্থানটি বিশাল ক্যাম্পাসে সবুজের গালিচায় অপরূপ। প্রবেশ ক’রে মন ভালো হয়ে গেল। বেথুন সাহেবসহ ইতিহাসের কীর্তিমানদের কবরের সামনে দাঁড়িয়ে মনে সম্মান এল। দেখতে পাই টালি-ফেলা পথের ধারে বড় ফলকের গায়ে লেখা ‘মধু-বিশ্রাম পথ’, ‘বাংলার গৌরব কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের সমাধিস্থলে যাবার রাস্তা’। পৌঁছালাম পিএইচডি গবেষক ছাইফুল আযিমসহ। সমাধি সৌধ লোহার রেলিং দিয়ে ঘেরা এক টুকরো জমিতে; পাশাপাশি দুটি কবর। গেট দিয়ে ঢুকতেই আবক্ষ মর্মরমূর্তি, নিচে সেই বিখ্যাত এপিটাফ:

‘দাঁড়াও পথিকবর, জন্ম যদি তব/ বঙ্গে! তিষ্ঠ ক্ষণকাল।’

দুপাশে নানা রঙের পাতাবাহারি গাছ আর বিচিত্র ফুলের মাঝে পাশাপাশি সমাধিতে শুয়ে আছেন মধুসূদন- হেনরিয়েটা। স্মৃতিফলকে হেনরিয়েটার অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে কবির প্রকৃত সহচরী হিসেবে।

দেশ থেকে ছয় হাজার মাইল দূরের ভার্সাই নগরে পৌঁছেছিলাম সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে মহাকবি মধুসূদনের প্রতি অন্তরের টান থেকে। ১৮৬৩-৬৫ সালে ভার্সাই নগর বাঙালিদের কাছে সে অর্থে পরিচিত ছিল না। অথচ মধুসূদন সাহস নিয়ে সেই নগরে বসতির জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন। তারপর দুর্যোগ, অনাহার, অনিদ্রা আর কষ্ট কবির মনে গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল। ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় তিনি লিখেছেন―‘প্রবাসে, দৈবের বশে, জীব-তারা যদি খসে/এ দেহ-আকাশ হতে,―নাহি খেদ তাহে।’ খেদ হবে না কারণ তিনি ‘দত্ত কুলোদ্ভব কবি শ্রীমধুসূদন’। আসলে ভার্সাইয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে আমার হৃদয়ের ভেতর গন্তব্যের সন্ধান ছিল পরিষ্কার। আমরা পৌঁছাতে চেয়েছিলাম এমন এক গন্তব্যে যেখানে একসময় মাইকেল মধুসূদন দত্ত নামে আমাদের একজন বাঙালি কবি, নাট্যকার এবং একজন বিদ্রোহী বাস করেছিলেন। বহু ঘটনা ভার্সাইকে বিশ্বের সর্বাধিক প্রশংসনীয় স্থানে পরিণত করেছে; এক উজ্জ্বল, অবিস্মরণীয় স্থানও এটি। তবে মাইকেল মধুসূদন দত্তের কারণে আমাদের কাছেও ভার্সাই আকর্ষণীয় স্থান। প্রতি বছর ভার্সাইয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে কোটি পর্যটকের সমাগম ঘটে; সেই মানুষদের তা জানানোর সময় এসেছে আজ।

 লেখক : কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, কবি। অধ্যাপক, চেয়ারম্যান বাংলা বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button