আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

প্রচ্ছদ রচনা : স্বাধীনতা দিবস ২০২৪ : শেফালিকে ছেড়ে দাও : একাত্তরের রক্তাক্ত বয়ান : সেতু ইয়াসমিন

আনোয়ারা সৈয়দ হক বিচিত্রমুখী প্রতিভাসম্পন্ন কথাশিল্পী। তিনি বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে কথাসাহিত্যিক হিসেবে সমধিক পরিচিত। গল্প বা উপন্যাসেই নয় প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনি, নারীর অধিকার ও শিশুসাহিত্য রচনায় রয়েছে তাঁর জ্যোতির্ময় পদচারণা। তাঁর লেখনীতে বিশেষভাবে চরিত্রের মনস্তত্ত্ব-বিশ্লেষণ অসাধারণ ব্যঞ্জনায় পরিস্ফুটিত হয়।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের শেফালিকে ছেড়ে দাও একটি গল্প-সংকলন। সাতাশটি গল্পের সংকলনে এই গ্রন্থটি হয়ে উঠেছে সময় ও সমকালীন ঘটনাপ্রবাহের শিল্পভাষ্য। মুক্তিযুদ্ধ, ব্যক্তিমানুষের নানামাত্রিক জীবনাভিজ্ঞতার সঙ্গে করোনাকালীন ঘটনাপুঞ্জের অপূর্ব সমন্বয় এ গল্পগ্রন্থ। এই গল্পগ্রন্থের প্রধানতম বিষয় মুক্তিযুদ্ধ ও তৎকালীন দেশ-কাল পরিস্থিতির উন্মোচন। শেফালিকে ছেড়ে দাও গল্পগ্রন্থের অধিকাংশ গল্পে মুক্তিযুদ্ধকালীন বাস্তব চিত্র যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি আবার ব্যক্তি-মানুষের স্মৃতিভাষ্যে মুক্তিযুদ্ধের কঠিন দিনগুলির নির্মোহ উপস্থাপন তাঁর শ্রেষ্ঠত্বের পরিচায়ক।

শেফালিকে ছেড়ে দাও গল্পগ্রন্থের পনেরোটি গল্পে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাপুঞ্জের উপস্থাপনে গল্পকার রাজাকার, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির ভূমিকা অঙ্কন করেছেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে নিষ্পেষিত তখনকার মানুষের বক্তব্য উপস্থাপনে ভয়াল রক্তাক্ত পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠকদের। শেফালিকে ছেড়ে দাও গল্পগ্রন্থের প্রথম গল্প ‘মরণোত্তর বিলাপ’-এ জাতীয় বৃক্ষ আমগাছের ব্যক্তিরূপায়ণের মধ্য দিয়ে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অজানা শহিদদের ক্ষোভ তুলে এনেছেন রক্তগোলাপের দৃশ্যে।

‘আমি শ্রী বিমলকান্তি গুহ’ গল্পে বিমলকান্তির ভাষ্যে ’৭১ সালের ২৫শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতার হওয়া এবং পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে দালালদের অত্যাচারের বর্ণনা সংযোজিত হয়েছে দক্ষতার নিরিখে :

তো এরপর শুরু হলো পাকবাহিনীর অত্যাচার। আর তার সঙ্গে সঙ্গে দেশীয় দালাল ও রাজাকারদের তাণ্ডব। তার অল্প কয়েকদিন পরেই শুরু হলো মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ। (পৃ. ২২)

পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে স্ত্রী, সন্তান ও ভাগনি বাসন্তীকে হারানোর বেদনা প্রকাশিত হয়েছে বিমলকান্তি গুহের আর্তনাদে :

ধোঁয়া কুণ্ডলী পাকিয়ে পাকিয়ে আকাশের দিকে উঠছে, রাজাকারেরা বিকট চিৎকার করতে করতে লুটপাট করছে, মানুষের কাতরানি, আর্তনাদ খুব ক্ষীণ হয়ে কানে আসছে। সব দেখে শুনে আমার হাত-পা অবশ হয়ে গেল। এখন কোথায় খুঁজে পাবো আমার স্ত্রী, আমার সন্তান, কোথায়-বা খুঁজে পাব আমার আদরের ভাগ্নীটিকে। (পৃ. ২৪)

‘আমি শ্রী বিমলকান্তি গুহ’ গল্পে নারীর প্রতিবাদী সত্তার জাগরণ ঘটছে বিমলকান্তির ভাগনি বাসন্তীর মধ্য দিয়ে। নির্দ্বিধায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে তবু সে সম্ভ্রম হারাতে চায়নি :

পাকসেনা বাসন্তীর ঘরে ঢোকার অনেক আগেই বাসন্তী তার কাছে লুকিয়ে রাখা কীটনাশক বিষ পান করল। সে পাহাড়ে লুকিয়ে থাকার সময়ই তার মামি অর্থাৎ আমার স্ত্রীকে বলে রেখেছিল, মামি, আমি কিন্তু কুত্তার বাচ্চাদের হাতে নিগৃহীত হব না, একথা তোমাকে আগেই বলে রাখছি। (পৃ. ২৬)

একাত্তরের রক্তঝরা দিনে এ রকম শত-সহস্র বাসন্তী রানীর আত্মত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা বিমলকান্তি গুহের বিলাপে ফুটে উঠেছে। বাসন্তীর আত্মত্যাগেই আজকের স্বাধীনতা।

‘মা, পানি, জনপথ’ গল্পে উল্লাপাড়ার যুদ্ধকালীন বর্ণনা তুলে ধরেছেন গল্পকার। এ গল্পে নারীর প্রতি পাশবিক আচরণের জান্তব চিত্র উঠে এসেছে গল্পকারের রক্তবয়ানে।

আমাদের পাশের ঘরে যেন তাণ্ডব শুরু হয়ে গেল। নারীকণ্ঠের বুকফাটা আর্তনাদে কান দুটো যেন আমাদের বধির হয়ে গেল। সেই সঙ্গে চাবুকের সপাং সপাং আওয়াজ। মাতালের জড়ানো জড়ানো কথা। অট্টহাসি, আনন্দ, জড়ানো গলার উর্দু গান। (পৃ. ৫৬)

পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে নির্যাতিত যুবক পানি চাইলেও পায়নি। নির্যাতন, নিষ্পেষণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে যুবক। এ গল্পের শেষে এ দেশ, মাটি, আলো-বাতাসে বড় হওয়া রাজাকারেরা কীভাবে দেশবিরোধিতায় সমর্পিত হয়েছে, কেন হয়েছে সে প্রশ্ন উপস্থিত করেছেন লেখক গল্প-কথকের মাধ্যমে :

আচ্ছা, আমাদের দেশের রাজাকাররা কি মানুষ ছিল না ? তারা কি বাংলা ভাষায় কথা বলত না ? (পৃ. ৬০)

‘আমি বাঙালি, বাংলায় অনার্স পড়ি’ গল্পে খুলনার তৎকালীন ডিএসপি আখতার হোসেন চৌধুরীর স্মৃতিভাষ্যে উনিশ’শ একাত্তরের সময়পটে বাংলার প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি প্রবল দরদী এক যুবকের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের সূচনার প্রতি ইঙ্গিত লক্ষণীয়।

‘আমি উপেন্দ্রনাথ দত্ত’ গল্পে বরিশাল অঞ্চলের যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির বর্ণনা বাস্তবতার যন্ত্রণায় তুলে এনেছেন গল্পকার আনোয়ারা সৈয়দ হক। গল্পকার এখানে রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনীর অত্যাচারের বাস্তবানুগ চিত্র তুলে ধরেছেন। পিরোজপুর জেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের চিত্র উপেন্দ্রনাথের স্মৃতিকথায় এখনও মনে হয় সে নির্যাতন চলমান রয়েছে। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি অবস্থায় উর্দু ভাষায় কথা বলে কীভাবে পাকিস্তানি বাহিনীর বিশেষ স্নেহ পেয়েছিলেন এবং কীভাবে কয়েক হাজার মানুষের মুক্তির দূত হয়ে উঠেছিলেন তারই অনুপুঙ্খ বিবরণ এ গল্প। অসাম্প্রদায়িক উপেন্দ্রনাথের হাতে মুসলিম যুবক আশরাফ আলীর দাফনকার্য সম্পন্নকরণ গল্পকারের সদর্থক চিন্তার বহিঃপ্রকাশ :

তারপর রাত যখন গভীর হলো কয়েকজন লোক ডেকে তাদের সাহায্যে আমি আশরাফকে কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে কবর দিয়ে দিলাম। (পৃ. ৮৫)

উপেন্দ্রনাথের বক্তব্যে স্পষ্টতই প্রতীয়মান যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি বাহিনীর চেয়ে দেশীয় দোসরদের অত্যাচার বেশি ছিল :

তারপরও সত্য রক্ষা করতে বলব, পাক হানাদার বাহিনী আমাদের ওপরে যত না অত্যাচার করেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি অত্যাচার করেছে বাংলাদেশের বাঙালি রাজাকার ও শান্তি কমিটির লোকেরা। (পৃ. ৮৮)

বাঙালিকে সতর্ক থাকতে অনুরোধ করেছেন উপেন্দ্রনাথ দত্ত। কারণ তার মতে বাঙালির মধ্যে রাজাকারসহ এ দেশীয় দালালেরা সুযোগের অপেক্ষায় আছে।

‘কুমারখালির রাজাকার’ গল্পে কুষ্টিয়া জেলায় সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র উপস্থাপিত করেছেন গল্পকার। এ গল্পে বিকৃত মানসিকতার রাজাকারের সমাজ-বিরুদ্ধ কর্মকাণ্ডের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। পাকবাহিনীর সহায়তাকারী রাজাকারের নিজের মা পাকবাহিনীর দ্বারা ধর্ষিত হলে সে সম্বিত ফিরে পায় এবং এরপরই গ্রাম ছেড়ে চলে যায় :

রাজাকারের ক্যাম্প ছিল কুমারখালি রেল স্টেশনে। কিন্তু রাজাকার সেখানে ফেরার আগেই তার মায়ের খবর ছড়িয়ে পড়ল সবখানে। রাজাকার আর ক্যাম্পে ফিরল না। (পৃ. ১০২)

বিকৃত মানসিকতার রাজাকারের জীবনের চরম উপলব্ধির ফলে ঘরহীন হয়ে ভবঘুরে জীবনে পদার্পণ যেন শাস্তির প্রতীক।

‘আমার একটা প্রশ্ন আছে’ গল্পে রাবেয়া খাতুন রাজারবাগ পুলিশ লাইনে থাকার সময়ে তার চোখে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনের যে দৃশ্য সে দেখেছে সেই বর্ণনা যেমন রক্তাক্ত, বেদনাদায়ক, একই সঙ্গে যুদ্ধের বিভীষিকায় দগ্ধ। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর যৌন নিপীড়নে নারীদের জীবন-যন্ত্রণার যে চিত্র সুইপার রাবেয়া খাতুনের স্মৃতিভাষ্যে উপস্থাপিত হয়েছে তা ইতিহাসের জঘন্যতম অধ্যায়। পাকিস্তানি বাহিনীরা যে নারীদের ধর্ষণ করেছে বিজয়ের পরে তাদের শিশ্ন কেন কেটে ছিঁড়ে ফেলা হলো না সে প্রশ্ন প্রত্যক্ষদর্শী রাবেয়ার। রাবেয়ার প্রশ্ন :

আমার মুক্তিযোদ্ধা ভাইদের কাছে আমার এই অনুযোগ, কেন তারা পাকিস্তানি পাঞ্জাবি কুকুরদের শিশ্নহীন করে তাদের দেশে ফেরত পাঠালো না ? (পৃ. ১১০)

‘আমি ছোটন ডোম’ ও ‘আমি একাত্তরের নূরজাহান সুইপার’ গল্পদ্বয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড, যৌন নির্যাতন ও অত্যাচার পাকিস্তানি বাহিনী করেছে তারই চিত্র তুলে ধরেছেন। পাকিস্তানি বাহিনীর জান্তব অত্যাচারের প্রত্যক্ষদর্শী এসব নিম্নবর্গীয় মানুষের সত্যনিষ্ঠ উপস্থাপনে বিভীষিকাময় সময়ের চিত্র এ গল্প দুটির মূল অনুষঙ্গ। ২৫শে মার্চে লাশের পর লাশ রাস্তা-ঘাটে পড়ে ছিল। সেসব লাশ সরানোর জন্য ছোটন ডোমের ডাক পড়েছিল ঢাকা পৌরসভা থেকে। ছোটনের বর্ণনায় সারা ঢাকা শহরে লাশের স্তূপের চিত্র পাঠকের হৃদয়ে করুণ রসের সৃষ্টি করেছে। নিজেদের শ্রেণিসচেতনতার পরিচয়ও আছে এখানে।

আমরা ডোম। ক্ষমতাশালী লোকেরা যত নোংরামি করবে, আমরা শুধু সেগুলো পরিষ্কার করব! ভগবান আমাদের ঘাড়ে এই দায়িত্ব দিয়েছেন। (পৃ. ১৩২)

অন্যদিকে ‘আমি একাত্তরের নূরজাহান সুইপার’ গল্পে লেখক যশোর ক্যান্টনমেন্টে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের সুইপার নূরজাহানের বর্ণনায় যশোর অঞ্চলের যুদ্ধকালীন সময়ের বাস্তব চিত্র এঁকেছেন বলিষ্ঠ শব্দ প্রয়োগে; বাক্যের তূর্যবাদনে―জীবন্ত সত্তায়। এ গল্পের আখ্যানে তরুণদের আত্মত্যাগে অর্জিত স্বাধীনতার মর্মবাণী গল্পকার এঁকেছেন―প্রয়োগ সাহসের বর্ণতিলকে।

তোমরা আজ যেখানেই থাকো তোমাদের এই গরিব মায়ের মুখে তো স্বাধীনতার হাসি ফুটিয়ে দিয়ে গিয়েছ, শহিদ সন্তানেরা আমার! (পৃ. ১৯৫)

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনালেখ্য উপস্থাপিত হয়েছে ‘জলতরঙ্গ’ গল্পে। এ গল্পে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুননেছার সাংসারিক জীবন, বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি, পরোপকারিতা, উদার নৈতিকতা সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। বাঙালি স্বামীভক্ত আদর্শ নারীর প্রতিভূ রেণু, যিনি বঙ্গবন্ধুর উৎসাহদাতা। রেণুর কথায় তারই প্রতিচ্ছবি প্রতিফলিত হয়।

কাছে এগিয়ে এসে রেণু মুজিবের বুকে হাত রেখে বলল, আর মাথা গরম করবেন না। কেউ যদি এই মিটিং-এ না আসে আপনি মাথা গরম করবেন না। আপনি এ ক’দিন কী যে কষ্ট করেছেন আমি দেখেছি, কিন্তু তবু মন খারাপ করবেন না, আর মাথা গরম করবেন না, তাহলে কিন্তু আমি খুব কষ্ট পাব। (পৃ. ১৭৭)

‘জলতরঙ্গ’ গল্পে বঙ্গবন্ধুর পিতা শেখ লুৎফর রহমানের দৃঢ়চেতা মানসিকতার পরিচয় মেলে :

লুৎফর রহমান ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলেন পাটাতনের দিকে। খোকার পিঠে হাত রাখলেন, দেখলেন খোকার গায়ে জ্বর। আর তার শরীর যেন উত্তেজনায় থিরথির করে কাঁপছে। জ্বর, খোকার গায়ে জ্বর। সন্তানের কষ্ট যেন পিতার বুকের ভেতরে ঝাউ পাতার মতো দোলা দিতে শুরু করল। তাঁর বুক চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইল। কিন্তু না, তিনি শেখ লুৎফর রহমান। এত সহজে ভেঙে পড়ার মানুষ তিনি নন। (পৃ. ১৮৪-১৮৫)

এভাবেই এ গল্পে পারিবারিক স্নেহময় পরিচর্যায় বেড়ে ওঠা খোকা একদিন এ জাতির কর্ণধার হয়ে উঠেছেন। এ গল্প যেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জীবন-সংগ্রামের জীবনালেখ্য।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের শেফালিকে ছেড়ে দাও গল্পগ্রন্থের গল্পগুলোতে প্রবল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ সমাজের নানাস্তরের মানুষ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকবাহিনী এবং বিশেষ করে পাকবাহিনীর এ দেশীয় দোসর রাজাকার ও শান্তি কমিটির সদস্যদের হাতে  যে অমানুষিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সেই নির্যাতনের অনুপুঙ্খ বিবরণ উপস্থিত করেছেন আখ্যানে আখ্যানে, বাক্যে বাক্যে, বাঙালি চেতনার ভাস্বর অঙ্গীকারে। প্রবল প্রতিবাদী সত্তায় উপনীত দেশপ্রেমিক এসব গল্পকথক সজাগ থাকার যে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন তা যেন লেখকের ভাবনারই প্রতিফলন।

আনোয়ারা সৈয়দ হকের শেফালিকে ছেড়ে দাও গল্পগ্রন্থে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গল্প ছাড়াও ‘একাকিত্ব’, ‘রা’, ‘কাজকর্ম ঠিক অথবা ভুল’, ‘জটিল জীবন’, ‘পাপ না পুণ্য’, ‘রুকসানার ঈদ’, ‘শেফালিকে ছেড়ে দাও’ প্রভৃতি গল্পে মানুুষের অন্তর্জাগতিক উপলব্ধি, নৈঃসঙ্গ্য, মনস্তত্ত্বের জটিল অন্তর্বাস্তবতা-সহযোগে মানব মনস্তত্ত্বের স্বরূপ উন্মোচনে লেখকের দক্ষতা প্রশংসাবাহী। এছাড়া ‘এখন করোনার সময়’, ‘শাশ্বত অভিযান’, ‘সময়ের সিঁড়ি ভেঙে’, ‘এভাবেই তবে হোক’ গল্পগুলোতে করোনাকালীন বাস্তবধর্মী রূপায়ণ লক্ষ করা যায়। এ গল্পগুলো পাঠ করলে পাঠক মানুষের মনের অন্তর্গূঢ় যন্ত্রণা উপলব্ধি করতে পারবেন সহজেই।

সর্বোপরি শেফালিকে ছেড়ে দাও গ্রন্থের গল্পগুলোতে প্রধানভাবে উপস্থাপিত হয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালীন মুক্তিযোদ্ধাদের কর্মযজ্ঞ এবং এরই বিপরীতে রাজাকার, দেশবিরোধী অপশক্তির ধ্বংসযজ্ঞের জান্তব রূপ। এ গ্রন্থের গল্পগুলো কুশলী গল্পকার আনোয়ারা সৈয়দ হক নিটোল ঝরঝরে গদ্যে উপস্থাপন করেছেন যা শিল্পমানের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে বাংলার সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মধ্যে গুটিকয়েক কুলাঙ্গার ছাড়া সবাই বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন। কোটি কোটি ঘটনার জন্ম হয়েছিল বাংলার জলমাটিতে। সেইসব রক্তাক্ত ঘটনার নির্যাস থেকে ছেঁকে ছেঁকে গল্পকার আনোয়ারা সৈয়দ হক, যিনি ছিলেন নিজ বাসভূমে রক্তাক্ত বধ্যভূমির মধ্যিখানে, সংবেদী বাঙালি হিসেবে অপমানের কাঁটায় বিদ্ধ হতে হতে যা দেখেছেন, শুনেছেন―তারই আলেখ্য শেফালিকে ছেড়ে দাও গ্রন্থের গল্পগুলোতে বয়ান করেছেন।

 লেখক : প্রাবন্ধিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button