প্রচ্ছদ রচনা : স্বাধীনতা দিবস ২০২৪ : অক্ষরস্রোতে বঙ্গবন্ধু : বঙ্গবন্ধুর অনন্যতার আরেক দিগন্ত : মফিদুল হক
‘শ্যামা পাখি দেখার তেরোটি ধরন’, এই শিরোনামে মার্কিন কবি ই. ই. কামিংসের কবিতা অনুবাদ করেছিলেন বিষ্ণু দে। সেখান থেকে উপলব্ধি ধার করে আমরা বলতে পারি বঙ্গবন্ধু, বাঙালি জাতির প্রাণপ্রিয় নেতা, তাঁকে বিচার বিবেচনা মূল্যায়নেরও রয়েছে বহু রকমফের। ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ তিনি, চলেছেন জীবনপথে উত্থান-পতনের ভেতর দিয়ে, অর্জন তাঁর আকাশচুম্বী, সেই সঙ্গে অনিশ্চয়তাও ছিল অতলস্পর্শী। দেশবাসীকে তিনি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, মুক্তির সেই স্বপ্নভাবনায় একত্র করেছেন কোটি মানুষকে, মোকাবিলা করেছেন চরম সংকটময় সময়। তিনি জনগণবন্দিত নেতা, আবার অনেক সময়ে তিনি ছিলেন নিঃসঙ্গতম মানুষ, যেমন বাস্তবিক অর্থে তেমনি চিন্তার দিগন্ত উন্মোচিত করার প্রয়াসেও। এই মানুষটিকে মূল্যায়নের যে নানা উপায়, সেখানে যখন তরল সুলুকসন্ধানী অর্থহীন স্তুতিবন্দনার পুনারাবৃত্ত তৈরি করছে বদ্ধ জলাশয় তখন অক্ষরস্রোতে বঙ্গবন্ধু-বিবেচনার ব্যতিক্রমী উদ্যোগ নিয়েছেন সম্পাদক মোহিত কামালের পৌরহিত্যে শব্দঘর সাময়িকী।
অক্ষরজালে বন্দি বঙ্গবন্ধুকে অক্ষরস্রোতে ভাসিয়ে দেয়ার এই প্রয়াস নানা দিক দিয়ে তাৎপর্যময়। প্রথমত বঙ্গবন্ধুর জীবনকৃতি ও অবদান বিবেচনা করা হয়েছে মূলত শিল্প-সাহিত্যের দৃষ্টিকোণ থেকে। লিখেছেন কৃতবিদ্য প্রাবন্ধিক চিন্তাবিদ সাহিত্যিকদের পাশাপাশি তরুণ প্রজন্মের সদস্যরা। এই গ্রন্থ তাই মূলত হয়েছে প্রবন্ধের সমাহার, যা আরেক বঙ্গবন্ধুকে পাঠকের সামনে প্রোজ্বল করে তোলে। নবীন সাহিত্যিকদের রচনাসমূহও পাঠকের জন্য হবে এক নতুন অভিজ্ঞতা। সজীব সতেজ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে একবিংশ শতকের সাহিত্যব্রতীরা তাকিয়েছেন ইতিহাসের মহানায়কের দিকে, মুগ্ধতা কিংবা প্রশস্তি-গাথা নয়, তাঁরা নিজ সময়ের নিরিখেই বুঝতে চেয়েছেন ইতিহাসের মানুষটিকে। অন্যদিকে খ্যাতিমান লেখক-গবেষকরাও নতুন বিবেচনায় শরিক হয়েছেন। কেননা সম্পাদক মোহিত কামাল সাহিত্যশিল্পের নিরিখে বঙ্গবন্ধু-অধ্যয়নে প্রণোদনা জোগাতে সচেষ্ট হয়েছেন। সম্পাদকের অভিপ্রায় যেমন এখানে প্রতিফলিত হয়েছে, তেমনি তাঁর যোগ্যতার পরিচয় পাওয়া যায় যথোপযুক্ত লেখকদের সমাবেশ ঘটানোর দক্ষতায়। শব্দঘর সাহিত্যপত্রে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত তিরিশটি প্রবন্ধ-নিবন্ধের পাশাপাশি নির্বাচিত কতক গল্প ও বহুল-পঠিত কবিতা এখানে সংযুক্ত হয়েছে। সব মিলিয়ে যেন অক্ষরমালা সাজিয়ে বঙ্গবন্ধুকে জানার আয়োজন। স্বাভাবিকভাবে আলোচ্য বিষয়াবলিতে উল্লেখ্যযোগ্য স্থান পেয়েছে শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত তিন গ্রন্থ অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রোজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীনÑযে গ্রন্থত্রয়ীর প্রকাশনা পাল্টে দিয়েছে তাঁর সম্পর্কে প্রচলিত ধারণা।
স্পষ্টতই বোঝা যায়, অনেক দিনের আয়োজনে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অক্ষরমালার এই উপাচার সাজিয়েছেন মোহিত কামাল। কাকতালীয়ভাবে এই গ্রন্থ-আয়োজন সাফল্যের উত্তুঙ্গ শিখর স্পর্শ করেছে কারাগারে প্রণীত শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রন্থত্রয়ীকে বিশেষ সার্ক সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হওয়ার ঘটনায়। দিল্লিতে আয়োজিত সাহিত্য সম্মেলনে লেখকের পক্ষে এই পুরস্কার গ্রহণ করেন রামেন্দু মজুমদার ও মফিদুল হক। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত লেখক হিসেবে উপস্থিত ছিলেন মোহিত কামাল। বঙ্গবন্ধুর মতো রাজনৈতিক নেতার রচিত গ্রন্থের ঐতিহাসিক গুরুত্বের পাশাপাশি তাঁর সাহিত্যমূল্যের এই স্বীকৃতি ছিল অনন্য। আমাদের জন্য তা উপলব্ধির নতুন দুয়ার খুলে দেয়। বঙ্গবন্ধু-বিবেচনায় মোহিত কামালের কর্মসাধনা যে এমন পরিণতি আলিঙ্গন করতে পেরেছে সেটা আনন্দমুখর উদযাপন। প্রকাশ করে বঙ্গবন্ধুর অনন্যতার আরেক দিগন্ত, সেই সাথে পরিচয় দেয় সম্পাদকের দূরদর্শিতার।
প্রতিকৃতি : আলপ্তগীন তুষার