অনুবাদ গল্পআর্কাইভ

অনুবাদ গল্প : পোস্টকার্ড

মূল : অ্যালিস মুনরো

বাংলা অনুবাদ : বিনয় বর্মন

[অ্যালিস মুনরো প্রখ্যাত কানাডিয়ান কথাসাহিত্যিক, যিনি কানাডার চেখভ হিসেবে সমধিক পরিচিত। ২০১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি মূলত ছোটগল্প লেখক এবং ছোটগল্প লেখায় তাঁর রয়েছে নিজস্ব শৈলী। তার গল্পে ঘটনাবলি অকালানুক্রমিক যেখানে অতীত ও বর্তমান অহরহ স্থান বদল করে। বর্ণনার মুন্সিয়ানায় মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত ও সাম্পর্কিক টানাপোড়েনসহ মানবজীবনের নানা জটিলতা চিত্রিত হয়েছে তাঁর গল্পে। জন্ম কানাডার অন্টারিও প্রদেশে ১৯৩১ সালের ১০ জুলাই এবং স্পষ্টত তাঁর গল্পের প্রেক্ষাপটে থাকে সেই স্থানের ভূপ্রকৃতি ও জীবনাচার। ডিয়ার লাইফ (২০১২), টু মাচ হ্যাপিনেস (২০০৯), দ্য ভিউ ফ্রম ক্যাসল রক (২০০৬), রানঅ্যাওয়ে (২০০৪), দ্য লাভ অব এ গুড ওম্যান ( (১৯৯৮), ওপেন সিক্রেটস (১৯৯৪), ফ্রেন্ড অব মাই ইউথ (১৯৯০), দ্য মুন্স অব জুপিটার (১৯৮২), ডান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস (১৯৭১) তাঁর বিখ্যাত গল্পের বই। এখানে অনূদিত ‘পোস্টকার্ড’ (Postcard) গল্পে এক তরুণীর প্রেমে প্রতারিত হওয়ার কাহিনি চিত্রিত হয়েছে।]

গতকাল বিকেলে আমি রাস্তা দিয়ে হেঁটে পোস্ট অফিসে যাচ্ছিলাম। ভাবছিলাম তুষারে আমার অসুস্থতা, গলা ব্যথা ও প্রলম্বিত শীতের শেষ নিয়ে। আমার ইচ্ছে করছিল ক্লেয়ারের মতো আমিও ফ্লোরিডায় চলে যাই। এটা ছিল বুধবারের বিকাল, আধাবেলা অফিস। আমি কিংস ডিপার্টমেন্ট স্টোরে কাজ করি। নাম যাই হোক, সেখানে তৈরি পোশাক ও শুষ্ক খাবারদাবার বিক্রি হয়। এক সময় সেখানে মুদির মালামাল বিক্রি হতো, কিন্তু সেটা আমার আর মনেই পড়ে না। মা আমাকে সেখানে নিয়ে গিয়ে একটি উঁচু টুলে বসিয়ে দিতেন। বুড়ো মিস্টার কিং আমাকে এক মুঠো কিসমিস দিয়ে বলতেন, আমি এটি কেবল মিষ্টি মেয়েদের দিই। লোকটা মারা যাওয়ার পর মুদির মালামাল বিক্রি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন এটা আর কিংস ডিপার্টমেন্ট স্টোর নয়, এর মালিক এখন ক্রুবার্গ নামে এক ভদ্রলোক। তিনি নিজে কখনও এখানে আসেন না, ম্যানেজার মি. হাওয়েসকে দিয়ে এটি পরিচালনা করেন। আমি ওপরের তলাটা দেখি, যেখানে বাচ্চাদের পোশাক বিক্রি হয়, তবে ক্রিসমাসের সময় খেলনাপাতিও রাখা হয়।

বুধবার হওয়ার কারণে পোস্ট অফিসের গেইট বন্ধ, কিন্তু আমার কাছে চাবি আছে। আমি বাকশো খুলে জুবিলি পেপার, মায়ের নামে আসা ফোন বিল ও একটি পোস্টকার্ড নিই। প্রথমে আমি এর ওপরে ছবিটার দিকে তাকাই। সেখানে শোভা পাচ্ছে পাম গাছের সারি, উষ্ণ নীল আকাশ, একটি মোটেলের সম্মুখ দিক যেখানে দাঁড়িয়ে আছে একটি বিশাল আকৃতির সাদাটে প্রাণি, রাতের নিয়ন আলোয় উজ্জ্বল। তার মুখ থেকে একটি বেলুন বেরিয়ে এসেছে এবং সেখানে লেখা, আমার স্থানে ঘুমাও। আমি পোস্টকার্ডটি উলটে পড়ি, আমি তার স্থানে ঘুমাইনি, যদিও এটি খুব দামি। আবহাওয়া এর চেয়ে ভালো হবে না। মধ্য সত্তর। জুবিলিতে শীত কেমন ? খারাপ নয় আশা করি। ভালো মেয়ে হও। ক্লেয়ার। দশদিন আগের তারিখ। মাঝে মাঝে পোস্টকার্ড খুব ধীর মনে হয়, কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি এটিকে ডাকে দেওয়ার আগে সে কয়েক দিন পকেটে নিয়ে বেড়িয়েছিল। তিন সপ্তাহ আগে ফ্লোরিডা যাওয়ার পর থেকে এটাই একমাত্র কার্ড। আমি আশা করছিলাম শুক্র অথবা শনিবার সে সশরীরে এখানে আসবে। তার বোন পর্কি ও বোনজামাই উইন্ডসরের বাসিন্দা হ্যারল্ডের সঙ্গে সে প্রতি বছর এই ভ্রমণের আয়োজন করে। আমার মনে হয় তারা আমাকে পছন্দ করে না, কিন্তু ক্লেয়ার বলেছে এটি আমার কল্পনা মাত্র। যখনই আমি পর্কির সঙ্গে কথা বলি তখনই কিছু একটা ভুল হয়ে যায়, যেমন অপ্রাসঙ্গিক কিছু বলে ফেলা, পরে এটা নিয়ে আমি চিন্তা করি ও জ্বলতে থাকি। জুবিলিতে আমি সাধারণত অন্যদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলি তার সঙ্গে সেভাবে বলি না, যদিও ব্যাপারটা আমার কাছে স্বাভাবিকই মনে হয়। তার মন জয় করতে চাই, কারণ সে ম্যাককোয়ারি বংশের মেয়ে। মা বলেছেন, আমরা তাদের সমকক্ষ।

আমি ক্লেয়ারকে বলেছি, দূরে গেলে আমাকে চিঠি লিখবে। সে বলে, তোমাকে কী লিখব বলে তুমি প্রত্যাশা করো ? আমি বলেছি জায়গার বর্ণনা দিতে, যাদের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তাদের সম্পর্কে লিখতে, যা কিছু আমার শুনতে ভালো লাগবে। কারণ আমার দৌড় বাসা থেকে বাফেলো পর্যন্ত, এর বাইরে আনন্দভ্রমণে কোথাও যাইনি। (আমি সেই ভ্রমণের কথা গণ্য করব না যখন  মাকে নিয়ে আত্মীয়দের সঙ্গে দেখা করার জন্য উইনিপেগে গিয়েছিলাম।) ক্লেয়ার বলে, ফিরে এসে আমি তোমাকে সব বলব। কিন্তু সে কখনওই কিছু বলে না। বাড়ি ফিরে এলে আমি বলি, তাহলে এবার তোমার ভ্রমণের কথা বলো। সে বলবে, কী নিয়ে আমাকে বলতে হবে ? আমার মন খারাপ হয়ে যায়, সে কী নিয়ে বলবে আমি কী করে জানব ?

আমি দেখি মা আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। বাড়ির সামনে ছোট জানালার ফাঁক দিয়ে তিনি আমাকে দেখছেন। বাড়ির কাছে পৌঁছলে তিনি দরজা খুলে দিয়ে চিৎকার করে বলবেন, ‘সাবধান, রাস্তা পিচ্ছিল। সকালে দুধওয়ালা আছাড় খেয়েছে।’

‘কোনও একদিন পা ভাঙলে খারাপ হবে না,’ আমি বলি, এবং মা বলেন, ‘এভাবে কথা বলো না, মার দেব।’

‘ক্লেয়ার তোমাকে একটি পোস্টকার্ড পাঠিয়েছে,’ আমি বলি।

‘তা হতে পারে না!’ তিনি এটি উল্টে দেখেন এবং বলেন, ‘তোমাকেই লিখেছে, যেমনটা আমি ভেবেছি।’ কিন্তু তিনি হেসে উড়িয়ে দেন। ‘সে কী ছবি বেছে নিয়েছে তাতে কিছু যায় আসে না, হয়তো সেখানে ভালো কিছু পাওয়া যায় না।’

হাঁটা শেখার সময় থেকে ক্লেয়ার সম্ভবত বৃদ্ধ মহিলাদের প্রিয়পাত্র। তাদের কাছে সে এখনও নাদুসনুদুস সুবোধ বালক, ম্যাককোয়ারি হওয়া সত্ত্বেও অহংকারী নয়। তার দুষ্টুমি তাদেরকে মাতিয়ে তুলত। মা ও ক্লেয়ার মিলে নানা রকমের খেলা খেলত যার সঙ্গে আমি তাল মেলাতে পারতাম না। যেমন একটা খেলা ছিল, ক্লেয়ার দরজায় আঘাত করে বলবে, ‘শুভসন্ধ্যা, ম্যাম, আমি ভাবছি আপনি আমার শরীর গঠনের একটি কোর্সে আগ্রহী হবেন কিনা যার আয় দিয়ে আমি কলেজে পড়ার খরচ চালাব।’ মা ঢোক গিলে চেহারায় কঠিন ভাব করে বলবেন, ‘দেখ যুবক, আমাকে দেখে কি মনে হয় আমার শরীর গঠনের কোর্স দরকার ?’ অথবা ক্লেয়ার বিষণ্ন ভাব নিয়ে বলবে, ‘আমি এখানে এসেছি, কারণ আমি আপনার আত্মা নিয়ে চিন্তিত।’ মা হেসে কুটিকুটি। ‘তুমি তোমার নিজের আত্মা নিয়ে চিন্তা করো,’ মা বলেন। মা তাকে তার প্রিয় খাবার চিকেন ডামপ্লিং ও লেমন-মেরিং পাই খাওয়ান। সে খেতে বসে মাকে কৌতুক শোনায় যা মা শোনেন বলে মনে হয় না। ‘আপনি কি শুনেছেন এই বুড়ো ভদ্রলোক এক যুবতীকে বিয়ে করে ডাক্তারের কাছে গিয়েছেন। ডাক্তার, তিনি বলেন, আমার একটু সমস্যা হচ্ছে―’ ‘থামো,’ মা বলেন, এবং তার কথা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন, ‘তুমি হেলেন লুইসকে কেবলই বিব্রত করছো।’ একমাত্র বাড়ি ছাড়া আমি আর কোথাও লুইস নামটি ব্যবহার করি না। ক্লেয়ার তার কথা চালিয়ে যায়, কিন্তু আমি তোয়াক্কা করি না। মাঝে মাঝে মনে হয় ক্লেয়ার ও মায়ের মাঝখানে আমি যেন এক শিশু। তারা হাস্যকৌতুক করছে, খাবার খাচ্ছে। আমাকে বলছে, আমি অতিরিক্ত ধূমপান করছি, এবং আমি যদি সোজা হয়ে না দাঁড়াই তাহলে কাঁধ চিরতরে গোল হয়ে যাবে। ক্লেয়ার আমার চেয়ে বারো বছরের বড়, এবং আমি তাকে বড় হয়ে ওঠা একজন মানুষ ছাড়া আর কোনওভাবে মনে করতে পারি না।

আমি রাস্তায় তাকে দেখতাম আর তখন তাকে আমার কাছে বয়স্ক মনে হতো অন্য বড়দের মতো। সে ঐ লোকগুলোর একজন যাদেরকে কম বয়সে বেশি বয়স্ক দেখায় এবং বেশি বয়সে কম বয়স্ক দেখায়। সে সবসময় কুইন্স হোটেলের আশেপাশে থাকত। ম্যাককোয়ারি হওয়ার কারণে তাকে কখনও বেশি পরিশ্রম করতে হয়নি। তার একটি ছোট অফিস ছিল এবং সেখানে বসে নোটারি পাবলিক, ইন্সুরেন্স ও রিয়েল এস্টেটের কাজ করত। সেই জায়গাটা এখনও আছে, সামনের জানালাটা ঘোলা ও ধুলোবালিমাখা, পিছনঘরে সবসময় একটা বাতি জ্বলে, তা শীত হোক বা গ্রীষ্ম হোক। সেখানে বসা প্রায় আশি বছর বয়সী এক মহিলা, মিস মেইটল্যান্ড, টাইপ করে অথবা তাকে যে কাজ দেওয়া হয় সেটা করে। যদি সে কুইন্স হোটেলে না থাকে তবে সে দু-একজন বন্ধুসহ স্পেস হিটারের ধারে বসে কার্ড খেলে, কথা বলতে বলতে একটু মদ্যপান করে। জুবিলিতে এক বিশেষ ধরনের পুরুষ আছে, বস্তুত প্রতিটি ছোট শহরেই আছে, যাদেরকে বলা হবে গণমানুষ। আমি জনগণের মানুষ বোঝাতে চাচ্ছি না, যারা সংসদ বা মেয়র নির্বাচনে দাঁড়ানোর যোগ্য (যদিও সিরিয়াস হলে ক্লেয়ার সেটা করতে পারত), এরা রাস্তায় ঘুরে বেড়ায় এবং পরিচিত মুখ হয়ে ওঠে। ক্লেয়ার আর তার বন্ধুরা সেই জাতীয় লোক।

‘সেখানে সে বোনের সঙ্গে গিয়েছে ?’ মা এমনভাবে বলেন যেন আমি তাকে জানাইনি। মায়ের সঙ্গে আমার অনেক কথাই পুনরাবৃত্ত হয়। ‘ওর নাম যেন কী ?’

‘পর্কি,’ আমি বলি।

‘হ্যাঁ, মনে পড়েছে, সেটা কোনও বয়স্ক মহিলার নাম। আমি তাকে ব্যাপ্টাইজড হতে দেখেছি, তার নাম ছিল ইসাবেল। বিবাহের আগে আমি গায়কদলে গান করতাম। তার পরনে ছিল একটি লম্বা জাঁকজমকপূর্ণ খ্রিস্টীয় পোশাক।’ মা ক্লেয়ারকে পছন্দ করে, কিন্তু ম্যাককোয়ারি পরিবারকে নয়। তিনি মনে করেন, অহংকারে তাদের মাটিতে পা পড়ে না। আমার মনে পড়ে, দু-এক বছর আগে আমরা তাদের বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। মা আমাকে সাবধান করে দেন আমি যেন তাদের রাজপ্রাসাদের সামনের ঘাসে পা না ফেলি। আমি বলি, ‘মা, কয়েক বছর পরে আমি এখানে বাস করব, এটা তখন আমার বাড়ি হবে, কাজেই এটাকে আর রাজপ্রাসাদ বলে ব্যঙ্গ করো না।’ মা আর আমি বাড়িটার দিকে তাকাই, বড় সাদা ইংরেজি এম অক্ষর দিয়ে সজ্জিত ঘনসবুজ শামিয়ানা, বারান্দা, দেয়ালের পাশে স্টেইন্ড গ্লাসের জানালা, যেন কোনও গির্জা। কোনও সাড়াশব্দ নেই, কেবল দোতলায় বৃদ্ধা ম্যাককোয়ারি শুয়ে আছেন।’ তিনি স্থির, তার একপাশ অবশ, কথা বলতে পারেন না। দিনে তার যত্ন নেয় উইলা মন্টগোমারি এবং রাতে ক্লেয়ার। যে কোনও আওয়াজে তিনি বিচলিত বোধ করেন। যখনই ক্লেয়ার আমাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেছে, আমরা ফিসফিস করে কথা বলেছি যাতে আমাদের কথা তার কানে না যায়, তা না হলে চমকে তার অবশ শরীর থরথর করে কেঁপে উঠবে। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে মা বলেন, ‘ব্যাপারটা হাস্যকর, তোমার নাম ম্যাককোয়ারি হবে আমি চিন্তা করতে পারি না।’

‘আমি মনে করেছি তুমি ক্লেয়ারকে খুব পছন্দ করো।’

‘হ্যাঁ, তা করি। কিন্তু আমি ভাবি সে তোমাকে শনিবার রাতে নিতে আসে, রবিবার রাতে ডিনার করতে আসে, কিন্তু আমি মনে করি না যে তোমাদের বিয়ে হবে।’

‘তুমি অপেক্ষা করো এবং দেখো বৃদ্ধা মহিলা মারা গেলে কী ঘটে।’

‘সে কি তোমাকে তাই বলেছে ?’

‘এটা বোঝা যায়।’

‘আচ্ছা কল্পনা করতে থাকো,’ মা বলেন।

‘তোমার এটা মনে করার কারণ নেই যে সে আমাকে আনুকূল্য দেখাচ্ছে, আমি বলতে পারি এমন অনেক মানুষ আছে যারা এর বিপরীতটাই ভাববে।’

‘তোমাকে না রাগিয়ে কি আমি মুখ খুলতে পারি না ?’ মা মৃদুভাবে বলেন।

শনিবার রাতে ক্লেয়ার ও আমি সাইড ডোর দিয়ে ঢুকে যেতাম এবং বনেদি উঁচু রান্নাঘরে কফি বা অন্য কোনও খাবার বানাতাম। আমরা স্কুল বাচ্চাদের মতো নীরবে লুকিয়ে কাজ করতাম। তারপর আলতো পায়ে হেঁটে ক্লেয়ারের ঘরে যেতাম। টেলিভিশন চালিয়ে দিতাম যাতে মহিলার মনে হয় ক্লেয়ার একা তার ঘরে আছে। যদি ক্লেয়ারকে তিনি ডেকে নিতেন তবে বিশাল বিছানায় আমি একা হয়ে যেতাম, অনুষ্ঠান দেখতাম অথবা পুরনো ছবি দেখতাম, ক্লেয়ার হাই স্কুল হকি টিমে গোলি হিসেবে খেলছে, পর্কি তার সমাবর্তন পোশাক পরে আছে, ছুটির দিনে ক্লেয়ার, পর্কি ও বন্ধুবান্ধব যাদেরকে আমি চিনি না। যদি সে আমাকে দীর্ঘক্ষণ আটকে রাখত এবং আমি বিরক্ত বোধ করতাম, তখন টেলিভিশনের শব্দের আড়ালে নিচে চলে যেতাম ও কফি খেতাম। (আমি কখনও কড়া কিছু পান করতাম না, ওটা ক্লেয়ার করত।) রান্নাঘরের আলোয় আমি ডাইনিং রুমে গিয়ে ড্রয়ার টেনে লিনেনগুলো দেখতাম। চায়না কেবিনেট ও সিলভার চেস্ট খুলতাম। নিজেকে চোর মনে হতো। কিন্তু আমি ভাবতাম, কেন আমি এটা উপভোগ করব না ? ম্যাককোয়ারি নামে আমাকে কিছু করতে হবে না বলে কি আমি কিছু করব না ? আমরা যখন একত্রে ঘুরে বেড়াতাম, ক্লেয়ার বলত, ‘আমাকে বিয়ে করো।’ আমি বলতাম, ‘আমাকে বিরক্ত করো না, আমি বিয়ের কথা ভাবছি না।’ তারপর সে চলে যেত। পরের বছরগুলোতে আমি যখন নিজেই তাকে এ কথা বলি, সে খুশি হয়। সে বলে, ‘বেশ, আমার মতো বুড়ো ষাঁড় খুব বেশি নেই যারা তোমার মতো সুন্দরী মেয়ের কাছ থেকে শুনবে সে তাকে বিয়ে করতে চায়।’ আমি ভাবি বিয়ে পর্যন্ত অপেক্ষা করি এবং কিংস ডিপার্টমেন্ট স্টোরে যাই, হাওয়েস আমার সেবাযত্নে তড়িঘড়ি করবে। তার সময়টা কি খারাপ করে  দেব না ? কিন্তু রুচিশীলতার কারণে আমি সেটা করা থেকে বিরত থাকি।

‘এখন আমি এই পোস্টকার্ডটি নিয়ে বাকশে রাখব,’ আমি নিজেকে বলি। ‘আমাদের দুজনের জন্য হালকা ঘুম দেওয়া ছাড়া এই বিকেলটা কাটানোর আর ভালো কোনও উপায় নেই।’ আমি উপরে গিয়ে ড্রেসিং গাউন পরি (চায়নিজ-এমব্রয়ডারিযুক্ত, ক্লেয়ারের উপহার)। আমি মুখে ক্রিম মাখি এবং পোস্টকার্ড, চিঠি ও অন্যান্য স্মারক রাখার বাকশোটি নিই। অন্য পোস্টকার্ডের সঙ্গে এটিকে রাখি, বিভিন্ন সালের পোস্টকার্ড সেখানে আছে, ব্যানফ, জেসপার, গ্রান্ড ক্যানিয়ন ও ইয়েলো স্টোন পার্কের ছবিযুক্ত। অলস সময় কাটানোর ফাঁকে আমি স্কুলের ছবি ও রিপোর্ট কার্ডগুলো দেখি। হাই স্কুলের এইচ.এম.এস. পিনাফোর অনুষ্ঠান, যেখানে আমি নায়িকা হয়েছিলাম, কী যেন নাম, ক্যাপ্টেনের মেয়ে। আমার মনে আছে ক্লেয়ার রাস্তায় আমার সঙ্গে দেখা করেছিল এবং গানের জন্য আমাকে অভিনন্দন জানিয়েছিল। আমাকে নাকি খুব সুন্দর লাগছিল। আমার সঙ্গে আড্ডা মারার সময় খেয়াল করেছি তাকে বুড়োটে দেখাচ্ছে। এরপর আমি তার সঙ্গে কতো আড্ডা দিয়েছি। আমি আমাকে নিয়ে সন্তুষ্ট  ছিলাম। এরপর যা ঘটলো তা কি আশ্চর্যের নয় ? টেড ফোর্গির সঙ্গে তখনও আমার পরিচয় হয়নি।

তার চিঠির দিকে তাকিয়েই আমি বুঝে ফেলি এতে কী আছে, ফলে আমার না পড়লেও হয়। কিন্তু কৌতূহলবশত আমি এটা খুলে পড়া শুরু করি। আমি সচরাচর টাইপরাইটারে লেখা চিঠি পছন্দ করি না কারণ এতে ব্যক্তিগত স্পর্শ থাকে না। নানা ঝুটঝামেলায় আজ আমি এতো বিধ্বস্ত যে আশা করি তুমি আমাকে ক্ষমা করবে। টাইপরাইটারে লেখা হোক বা না হোক, চিঠির দিকে তাকিয়েই আমি ভালোবাসার স্পর্শ পেতাম, যদি সেভাবে বলা যায়, আমাকে একেবারে আকুল করে ফেলত। টেড ফোর্গি জুবিলি রেডিও স্টেশনে ছয় মাস ধরে কাজ করছে, সে সময় আমার হাই স্কুলের পড়াশোনা শেষের দিকে। মা বলেছিলেন, সে তোমার জন্য একটু বেশি বয়স্ক―মা ক্লেয়ার সম্পর্কে এরকম কখনও বলেননি―অথচ তার বয়স ছিল মাত্র চব্বিশ। যক্ষ¥ার চিকিৎসার জন্য তাকে দু বছর শুশ্রƒষালয়ে থাকতে হয়েছে, এবং এটাই তার বয়স বাড়িয়ে দিয়েছে। আমরা সালিভান পাহাড়, রেডিও স্টেশন এবং কুইন্স হোটেলের কফি শপে যেতাম, আমি মনে মনে আমাদের কথোপকথনগুলো আওড়াতাম, মনশ্চক্ষে তার মুখচ্ছবি দেখতাম, তখনও বুঝিনি যে সবকিছু আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ঘটে না। তখন ক্লেয়ারের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সে বলতো আমার উৎফুল্ল থাকা উচিত, এবং সে তার গল্প শোনাত। আমি আমার সমস্যার কথা তাকে বুঝতে দিইনি, কিন্তু আমরা যখন একত্রে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম তখন তাকে জানিয়ে দিই যে আমাদের সম্পর্ক বন্ধুত্বের বাইরে যাবে না। সে আমার খোলাখুলি কথার প্রশংসা করে এবং চুপচাপ অপেক্ষা করতে থাকে।

আমি চিঠিটি আগাগোড়া পড়ি এবং ভাবি, যদিও প্রথমবার নয়, আমি কতই না বোকামি করেছি। আমি তোমাকে এটা বলতে চাই যে তোমার মিষ্টতা ও সদ্ভাবের জন্য আমি তোমার প্রতি যারপরনাই কৃতজ্ঞ। তখন মিষ্টতা শব্দটি আমার মাথায় গেঁথে গিয়েছিল, আমাকে আশা দিয়েছিল। আমি ভাবি, ক্লেয়ারের সঙ্গে যখন আমার বিয়ে হবে, তখন এই চিঠি আমি ছুড়ে ফেলে দিব। এখনই সেটা করি না কেন ? আমি এটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরা করে ফেলি যেমনভাবে স্কুল শেষে অনায়াসে নোটখাতা ছিঁড়ে ফেলতাম। আমি চাই না মা জানুক ময়লায় ঝুড়িতে কী আছে। তাই এটাকে দলা করে আমি আমার পার্সে রেখে দিই। এরপর  অন্য কয়েকটি জিনিস নিয়ে ভাবতে শুরু করি। যেমন, টেড ফোর্গির সঙ্গে সম্পর্ক না হলে কি ক্লেয়ার সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন হতো ? সম্ভবত না, টেড ফোর্গিকে নিয়ে যে ঘোরের মধ্যে ছিলাম, তা না হলে ক্লেয়ারকে নিয়ে ভাবতামই না। আমার জীবন তখন অন্যদিকে চলে যেত, কিন্তু এসব নিয়ে এখন চিন্তাভাবনা করে লাভ নেই। সে প্রথমে যেভাবে আমাকে আন্দোলিত করেছে তার জন্য দুঃখ হয়। আমি তার গোলগাল টাক মাথার দিকে তাকাতাম এবং তার ছটফটানি দেখতাম। আর ভাবতাম, ভদ্র হওয়া ব্যতীত এখন আমি আর কী করতে পারি ? সে আমার নিকট বেশি কিছু প্রত্যাশা করেনি, চেয়েছে শুধু শুয়ে থাকতে, আমিও অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি পিছনে তাকাই এবং ভাবি, আমি কি হৃদয়হীন ? সে আমাকে ধরেছে, আদর করেছে, কানের কাছে ফিসফিস করে প্রেমের কথা বলেছে, অথচ প্রত্যুত্তরে আমি একটি কথাও বলিনি। আমি কখনও হৃদয়হীন হতে চাইনি, ক্লেয়ারকে দিতে আমি কখনও কার্পণ্য করিনি, দিয়েছি দশবারের মধ্যে নয়বার, তাই না ?

আমি মায়ের নিদ্রা থেকে জেগে ওঠার শব্দ শুনি, তিনি কেটলিতে চা বসান এবং পেপার পড়েন। একটু পর হঠাৎ তিনি চিৎকার দিয়ে ওঠেন। আমি ভাবি কেউ হয়তো মারা গেছে। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে হলরুমের দিকে দৌড়ে যাই। তিনি বলেন, ‘যাও গিয়ে ঘুমাও। আমি দুঃখিত তোমাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছি। আমার ভুল হয়েছে।’ আমি আমার ঘরে ফিরে যাই এবং শুনতে পাই তার ফোন করার শব্দ। তিনি সম্ভবত তার পুরনো কোনও বন্ধুকে ফোন করেছেন পত্রিকায় প্রকাশিত কোনও সংবাদ জানানোর জন্য। তারপর আমি আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ি।

একটি গাড়ি থামার শব্দে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায়। কেউ একজন গাড়ি থেকে নেমে সম্মুখের পথ দিয়ে হেঁটে আসছে। আমি ভাবি, ক্লেয়ার কি এতো তাড়াতাড়ি ফিরে এল ? তারপর আধো তন্দ্রাঘোরে আমি ভাবি, আমি চিঠিটা ছিঁড়ে ফেলেছি, ভালোই হয়েছে। কিন্তু এটা সে নয়। বেল বাজার আগেই মা দরজা খুলে দেন। আমি আলমা স্টোনহাউসের কণ্ঠ শুনি, যে জুবিলি পাবলিক স্কুলে শিক্ষকতা করে এবং যে আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আমি হলরুমে গিয়ে হেলান দিয়ে বসি এবং বলি, ‘হে আলমা, তুমি কি আজ এখানে খাবে ?’ সে বেইলি বোর্ডিংয়ে থাকে যেখানে খাবারদাবার প্রায়শ বাজে হয়। এরকম ঘটলে মাঝে মাঝে সে আমন্ত্রণ ছাড়াই আমাদের এখানে চলে আসে।

গায়ের কোট না খুলেই আলমা ওপরের তলায় ওঠা শুরু করে। উত্তেজনায় তার শ্যামলা মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। বোঝা যাচ্ছে কিছু একটা ঘটেছে। তার স্বামীর ব্যাপার হতে পারে। তারা আলাদা হয়ে গেছে, তবু লোকটা তাকে ভয়ঙ্কর চিঠি লেখে। সে বলল, ‘হাই হেলেন, কেমন আছো ? মাত্র ঘুম ভাঙলো!’

‘আমি তোমার গাড়ির শব্দ শুনেছি,’ বললাম। প্রথমে ভেবেছিলাম ক্লেয়ার এসেছে, কিন্তু আগামী দু এক দিনে সে আসবে বলে মনে হয় না।’

‘হেলেন, বসো। চলো তোমার রুমে গিয়ে বসি। তুমি কি চমকে দেওয়ার মতো কিছু শুনতে প্রস্তুত ? আমাকেই ব্যাপারটা বলতে হবে বলে খারাপ লাগছে। স্থির থাকো।’

মা তার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছেন। আমি বলি, ‘মা, এটা কি কোনও কৌতুক ?’

আলমা বলল, ‘ক্লেয়ার ম্যাককোয়ারি বিয়ে করেছে।’

‘কী বলছো!,’ আমি বলি। ‘ক্লেয়ার ম্যাককোয়ারি এখন ফ্লোরিডায় এবং আজকেই তার কাছ থেকে একটি পোস্টকার্ড পেয়েছি, মাও ভালো করে জানেন।’

‘সে ফ্লোরিডাতেই বিয়ে করেছে। হেলেন, শান্ত হও।’

‘কীভাবে সে ফ্লোরিডাতে বিয়ে করতে পারে ? সে তো ছুটি কাটাচ্ছে।’

‘তারা এখন জুবিলিতে ফিরছে এবং তারা এখানে থাকবে।’

‘আলমা, তুমি যার কাছ থেকেই শুনে থাকো, এটা বাজে কথা। আজই আমি তার কাছ থেকে একটি পোস্টকার্ড পেয়েছি, মা―’

লক্ষ করলাম মা আমার দিকে এমনভাবে তাকাচ্ছেন যেন আমি আট বছরের বাচ্চা, আমার হাম হয়েছে এবং গায়ে তাপমাত্রা একশো পাঁচ ডিগ্রি। তার হাতে পত্রিকা এবং সেটি তিনি আমার সামনে মেলে ধরলেন। ‘এই যে এখানে,’ তিনি আস্তে করে বললেন, ‘এটা বিউগল-হেরাল্ডে ছাপা হয়েছে।’

‘আমি এটা মোটেও বিশ্বাস করি না,’ আমি বলি। আমি পড়া শুরু করি, পড়তে পড়তে মনে হয় এই নামগুলো এর আগে আমি কখনও শুনিনি। কতগুলো নাম আসলেই অপরিচিত। ফ্লোরিডার কোরাল গ্যাবলসে ছিমছাম অনুষ্ঠান। ক্লেয়ার আলেক্সান্ডার ম্যাককোয়ারি এবং মার্গারেট থোরা লিসন বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন। পাত্রের মাতা জুবিলির অধিবাসী মিসেস জেমস ম্যাককোয়ারি এবং পিতা বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও সংসদ সদস্য মিস্টার জেমস ম্যাককোয়ারি। পাত্রীর পিতামাতা নেব্রাস্কার লিঙ্কনের অধিবাসী মিস্টার ও মিসেস ক্লাইভ টিবাট। বিবাহের অনুষ্ঠানে পাত্রের বোন ও বোনজামাই মিস্টার ও মিসেস হ্যারল্ড জনসন উপস্থিত ছিলেন। পাত্রী পরেছিলেন পাতা-সবুজ ড্রেসমেকার সুট, তামারঙের ব্রোঞ্জের কাঁচুলি ও ঘনবাদামি রঙের আনুষঙ্গিক বস্ত্র। মিসেস জনসন পরেছিলেন হালকা বাদামি সুট, সবুজ অর্কিড ও কালো রঙের আনুষঙ্গিক বস্ত্র। দম্পতি এখন মোটরগাড়িতে করে তাদের জুবিলির গৃহে ফিরছেন।

‘এখনও কি তুমি একে উড়িয়ে দেবে ?’ আলমা ঝাঁজ নিয়ে বলে।

আমি বললাম, ‘জানি না।’

‘তুমি ঠিক আছো তো ?’

‘ঠিক আছি।’

মা বললেন, এইখানে এই ছোট রুমে আবদ্ধ না থেকে নিচে গিয়ে সকলে মিলে চা-নাস্তা খেলে একটু ভালো লাগবে। রাতের খাবারের সময় হয়ে গেছে। কাজেই সবাই মিলে নিচে নেমে গেলাম। আমার গায়ে এখনও ড্রেসিং গাউন। মা আর আলমা মিলে কিছু খাবার তৈরি করল, বাসায় কেউ অসুস্থ থাকলে শক্তি যোগানোর জন্য যে-রকম খাবার হয়। খাবার নিয়ে বেশি চিন্তা করার দরকার নেই। ঠান্ডা মাংসের স্যান্ডউইচ, নানা রকমের আচার, টুকরা মাখন ও খেজুরের বরফি। ‘মন চাইলে একটি সিগারেট খেয়ে নাও,’ মা আমাকে বললেন, জীবনে প্রথমবার তিনি আমাকে এভাবে বললেন। আমি সিগারেট খেলাম, আলমাও খেলো। মা বললেন, ‘আমার ব্যাগে কিছু ট্রাঙ্কুইলাইজার আছে, খুব কড়া নয়, চাইলে একটি দুটি খেতে পারো।’ আমি বললাম, না, লাগবে না। আমার এখনও এসব খাওয়ার মতো অবস্থা হয়নি।

‘প্রতি বছর সে ফ্লোরিডায় যায়, তাই না ?’

আমি বললাম, হ্যাঁ।

‘আমার মনে হয়, সে ঐ মহিলার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচিত, বিধবা অথবা ডিভোর্সি। তারা অনেক দিন যোগাযোগের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা ঠিক করেছে।’

মা বললেন, ক্লেয়ার সম্পর্কে এরকম ভাবাটা নিতান্তই কঠিন।

‘আমার কাছে যে-রকম মনে হয়েছে তাই বললাম। আমি বাজি ধরে বলতে পারি, মহিলা তার বোনের বান্ধবী। তার বোনই ঘটনার হোতা। তারা বিবাহ অনুষ্ঠানে যোগদান করেছে, বোন ও বোনের জামাই। সে তোমার বন্ধু ছিল না, হেলেন, এমনটাই তুমি আমাকে বলেছিলে।’

‘আমি তাকে ভালো করে চিনিনি।’

‘হেলেন লুইস, তুমি আমাকে বলেছিলে তোমরা দুজন বৃদ্ধার মরণের জন্য অপেক্ষা করছিলে’, মা বললেন, ‘ক্লেয়ার কি তোমাকে তাই বলেনি ?’

‘তার জন্য অজুহাত দাঁড় করানো,’ আলমা তড়িঘড়ি করে বলে।

‘সে এরকম করতে পারে না,’ মা বলেন, ‘ক্লেয়ার কেন এটা করল বোঝা কঠিন।’

‘পুরুষেরা সবসময় পাওয়ার জন্য লালায়িত থাকে,’ আলমা বলে। একটু বিরতি, উভয়েই আমার দিকে তাকায়। আমি তাদের কিছু বলতে পারি না। বলতে পারি না আমি কী ভাবছি। গত শনিবার রাতে তাদের বাসায়, সে বেড়াতে যাওয়ার আগে, উলঙ্গ সে, আমার চুল তার মুখের ওপর নিয়েছিল, দাঁতের ভেতর নিয়ে এমন ভাব করেছিল যেন কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবে। আমার চুলে কারও লালা ঝরবে এটা আমার পছন্দ নয়, তবু তাকে সুযোগ দিলাম। তাকে সাবধান করে দিয়েছিলাম যে সে যদি চুল ছিঁড়ে ফেলে তাহলে হেয়ারড্রেসারে চুল ঠিক করার খরচ তাকে বহন করতে হবে। সে রাতে সে বিবাহের ভাব দেখায়নি।

মা ও আলমা জল্পনাকল্পনা ও কথা চালিয়ে যায়। আমার ঘুম এসে যায়। আমি আলমাকে বলতে শুনি, ‘এর চেয়ে খারাপ কিছুও ঘটতে পারতো। আমি চার বছর জীবন্ত নরকে বাস করেছি।’ মা বলেন, ‘সর্বদা তার ছিল দয়ার আত্মা এবং ঐ মেয়েটার প্রতি ছিল তার তীব্র টান।’ বিকেলে ঘুমানোর পরেও আজ সন্ধ্যায় আবার কেন যে আমার এভাবে ঘুম পেলো ভেবে পাচ্ছি না। আলমা বলে, ‘ঘুম তোমার জন্য ভালো, এটা স্বাভাবিক। প্রকৃতির এক প্রকার চেতনানিবারণের উপায়।’ তারা দুজন আমাকে ওপরে নিয়ে গিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল এবং আমি আর তাদের নিচে যাওয়ার শব্দ শুনিনি।

খুব তাড়াতাড়িও আমি ঘুম থেকে উঠিনি। নির্দিষ্ট সময় আমি ঘুম থেকে উঠে নাস্তা খাই। আমি মাকে খুব নড়াচড়া করতে শুনি, আমি চিৎকার করে বললাম শব্দ না করতে, যেভাবে অন্যদিন সকালে বলি। মা বললেন, ‘তুমি কি নিশ্চিত যে কাজে যেতে চাও ? আমি মিস্টার হাওয়েসকে ফোন করে জানাতে পারি যে তুমি অসুস্থ।’ আমি বললাম, ‘আমি কেন তাদের কাউকে সন্তুষ্টি দিব ?’ আমি লাইট না জ্বেলে হলের আয়নায় মেকআপ সেরে নিই এবং তারপর বেরিয়ে পড়ি। আড়াই ব্লক হেঁটে কিংসের এখানে পৌঁছি। আমি খেয়াল করি না আজ কী ধরনের সকাল, তবে এটা বুঝি যে রাতারাতি বসন্ত আসেনি। স্টোরের ভিতরে তারা অপেক্ষা করছিল। বাহ, কী সুন্দর, সুপ্রভাত, হেলেন, সুপ্রভাত! তারা দেখার জন্য অপেক্ষা করছিল আমার মতো শান্ত স্বভাবের মেয়েটি মাথা ঘুরে পড়ে যায় কিনা এবং খিঁচুনি শুরু হয় কিনা। সেখানে আছে মিসেস ম্যাককুল, বেরিল এলেন যার আঙুলে বাগদানের আংটি, মিসেস ক্রেস যে পঁচিশ বছর আগে একজনকে ছেড়ে আরেকজনের কাছে চলে গিয়েছিল কিন্তু সেই পুরুষটিও আবার ভেগেছে। সে আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কি জন্য ? বৃদ্ধ হাওয়েস হাসে এবং জিভ নাড়ে। আমি উৎফুল্লভাবে বলি, সুপ্রভাত। আমি ওপরে যাই এবং ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই যে আমার নিজের ওয়াশরুম আছে। আমি ভাবি আজ বাচ্চাদের পোশাকের জন্য একটি বিশাল দিন হবে। হলোও তাই। এর আগে আমি কখনও সকালে একসঙ্গে এত মাকে বাচ্চাদের চুলের ফিতা ও মোজা কেনার জন্য ভেতরে আসতে ও সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখিনি। 

আমি মাকে ফোন করে জানালাম যে আজ দুপুরে বাড়ি আসব না। আমি ভেবেছি কুইন্স হোটেলে গিয়ে একটি হ্যামবার্গার খাব, প্রায় অপরিচিত রেডিওর লোকজনদের সঙ্গে বসে। কিন্তু পৌনে বারোটার দিকে আলমা আসে। ‘এই দিনে আমি তোমাকে একা খেতে দিব না!’ কাজেই আমাদের একসঙ্গে কুইন্স হোটেলে যেতে হবে। সে আমাকে হ্যামবার্গার নয়, ডিমের স্যান্ডউইচ খাওয়াবে, কোক নয়, এক গ্লাস দুধ খাওয়াবে। তার ধারণা আমার হজমে সমস্যা হয়েছে, কিন্তু আমি জানালাম সেরকম কিছু হয়নি। আমরা খাবারের জন্য অপেক্ষা করলাম। খাওয়া শুরুর আগে সে বলল, ‘ওরা ফিরেছে।’

ওরা কারা বুঝতে আমার মিনিটখানেক সময় লাগল। ‘কখন,’ আমি বলি।

‘গত রাতে নৈশভোজের সময়। আমি যখন সংবাদটা জানানোর জন্য তোমাদের বাসার দিকে যাচ্ছিলাম, অল্পের জন্য ওরা আমার গাড়ির নিচে পড়েনি।’

‘তোমাকে কে বলেছে ?’

‘দেখো, বিচাররা ম্যাককোয়ারিদের পরের বাড়িটাতেই থাকে।’ মিসেস বিচার চতুর্থ শ্রেণিতে পড়ায় এবং আলমা তৃতীয় শ্রেণিতে। ‘গ্রেস তাদেরকে দেখেছে। সে এর মধ্যে পত্রিকায় খবরটা পড়েছে, কাজেই বুঝে ফেলেছে নতুন মহিলাটি কে।’

‘সে দেখতে কেমন ?’ অকারণেই আমি জিজ্ঞেস করলাম।

‘সে চঞ্চল নয়, গ্রেস বলেছে। তার বয়স, কী জানি। আমি তোমাকে বলেছিলাম না সে ক্লেয়ারের বোনের বান্ধবী। সে সৌন্দর্যের ব্যাপারে কোনও বাহবা পাবে না। মনে করো সে ঠিক আছে।’

‘সে কি লম্বা না খাটো ?’ আমি আর থামতে পারছি না। ‘কালো না ফর্সা ?’

‘কনের মাথায় হ্যাট ছিল বলে গ্রেস তার মুখ ঠিকমতো দেখতে পায়নি, তবে তার কাছে কালো বলে মনে হয়েছে। বিশালদেহী। গ্রেস বলেছে তার পিছন দিকটা দেখতে গ্র্যান্ড পিয়ানোর মতো। হয়তো তার টাকা আছে।’

‘গ্রেস কি সেই কথাও বলেছে ?’

‘না, এটা আমার কথা, অনুমান মাত্র।’

‘ক্লেয়ারের টাকাওয়ালা কাউকে বিয়ে করার দরকার নেই। তার নিজের টাকা আছে।’

‘সেটা হয়তো আমাদের বিচারে, কিন্তু তার বিচারে নয়।’

আমি সারা বিকেল ধরে ভাবতে থাকলাম ক্লেয়ারের চেতনা হবে এবং আমাকে ফোন দেবে। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে পারব সে সেটা কী চিন্তা করে করল। আমার মনে হয়েছে সে আমাকে কোনও উদ্ভট ব্যাখ্যা দেবে, যেমন এই দরিদ্র মহিলার ক্যান্সার হয়েছে এবং আর মাত্র ছয় মাস বাঁচবে, সে অত্যন্ত গরিব (তার মোটেলের পরিচ্ছন্নতাকর্মী) এবং ক্লেয়ার তাকে একটু স্বস্তি দিতে চেয়েছে। মহিলা ক্লেয়ারের বোনজামাইকে ভজিয়েছে এবং ক্লেয়ার তাকে বিয়ে করে ফেলেছে। কিন্তু এ ধরনের কাহিনি নিয়ে চিন্তা করার বেশি সময় নেই কারণ দোকানে খরিদ্দার ভিড় করে আছে। বৃদ্ধ মহিলারা সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে গল্প করছে তারা নাতিনাতনিকে জন্মদিনে কী উপহার দেবে। জুবিলির প্রতিটি নাতিনাতনির জন্ম মার্চ মাসে। আমার কাছে তাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত, আমি ভাবি, আমি তাদের দিনটিকে কি উত্তেজনায় ভরে দেইনি ? এমনকি আলমাকেও শীতের তুলনায় ভালো দেখাচ্ছে। আমি তাকে দোষ দিচ্ছি না, আমার মতে, এটা সত্য। কে জানে আমারও হয়তো তার মতো দশা হতো, ডন স্টোনহাউস মেয়েটিকে ধর্ষণ করে চলে যায়, পা থেকে মাথা পর্যন্ত তার সারা শরীরে রক্তমাখা আঘাতের চিহ্ন, ক্লেয়ারের কথা, আমি দুঃখিত, মেয়েটার জন্য আমি যা পারি করব। কী যে ভাবছি, বাজে ঘটনা ঘটে গেছে, দীর্ঘ শীত।

রাতের খাবারের জন্য বাড়ি না যাওয়ার কথা ভাবাও যায় না, তাহলে মা একেবারে শেষ হয়ে যাবে। আমার পছন্দ করা কত খাবার নিয়ে তিনি অপেক্ষা করছেন- স্যামন রুটি, কিসমিস দেওয়া বাঁধাকপি ও গাজরের সালাদ, ব্রাউন বেটি। তার গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। ‘কাউকে যদি একরাত কাঁদতে হয় তবে আমিই কাঁদব,’ আমি বলি। ‘তোমার জীবনে কী এমন মারাত্মক কিছু ঘটেছে ?’

‘আমি তাকে পছন্দ করতাম,’ তিনি বলেন। ‘খুব পছন্দ করতাম। আজকালকার জমানায় এমন লোক খুঁজে পাওয়া ভার যে তোমাকে সপ্তাহে প্রতিদিন দেখতে আসবে।’

‘আমি দুঃখিত,’ আমি বলি।

‘কোনও পুরুষ যখন কোনও মহিলার প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে, তখন বুঝতে হবে তার বিরক্তি এসে গেছে।’

‘মা, তুমি কী বোঝাতে চাচ্ছো ?’

‘তুমি যদি না জানো তবে বলছি।’

‘তোমার লজ্জিত হওয়া উচিত,’ বলে আমি নিজেও কাঁদতে শুরু করি। ‘তুমি তোমার নিজের মেয়ের সঙ্গে এভাবে কথা বলছো।’ হ্যাঁ, আমি ভেবেছি মা জানতেন না, ক্লেয়ারকে দোষ দিও না, আমাকে দাও।

‘না, আমি লজ্জিত হওয়ার মতো মানুষ নই,’ তিনি কথা চালিয়ে যান। কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি একজন বৃদ্ধ মহিলা কিন্তু আমি জানি। পুরুষ যদি কোনও মেয়ের প্রতি শ্রদ্ধা হারিয়ে ফেলে তবে সে তাকে বিয়ে করে না।’

‘যদি সেটাই সত্য হতো তবে এই শহরে একটাও বিয়ে হতো না।’

‘তোমার ভাগ্য তুমি নিজেই নষ্ট করেছো।’

‘যতদিন সে এখানে এসেছে ততদিন তুমি এ ব্যাপারে একটি কথাও বলনি এবং আমি এখন তা শুনব না,’ বলে আমি ওপরে চলে যাই। তিনি আমার পেছনে আসেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমি বসে ধূমপান করি। পোশাক খুলি না। আমি তার ওপরে আসার শব্দ শুনি, তিনি ঘুমাতে চলে যান। তারপর আমি নিচে গিয়ে কিছুক্ষণ টেলিভিশন দেখি, গাড়ি দুর্ঘটনার খবর। আমি কোট পরে বাইরে বের হই।

আমার একটি ছোট গাড়ি আছে, একটি ছোট মরিসান, যা এক বছর আগে ক্লেয়ার ক্রিসমাসে আমাকে দিয়েছিল। আমি এটা ব্যবহার করে চাকরিতে যাই না, কারণ আড়াই ব্লক ড্রাইভ করে যাওয়া বোকামি, লোকদেখানো ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়, যদিও আমি জানি অনেকেই এটা করে। আমি গ্যারেজ থেকে গাড়িটি বের করে আনি। রবিবার মাকে নিয়ে টাপারটাউনে নার্সিং হোমে কে আন্টিকে দেখতে যাওয়ার পর এই প্রথম আমি গাড়িটি বের করলাম। আমি গ্রীষ্মে এটি বেশি ব্যবহার করি।

আমি ঘড়ির দিকে তাকাই, সময় দেখে বিস্মিত হই। বারোটা বেজে কুড়ি মিনিট। দীর্ঘক্ষণ বসে থেকে দুর্বল লাগছে। আমার এখন আলমার সেই বড়িটা খেতে ইচ্ছে করছে। আমার মাথায় শুধু ড্রাইভ করে ঘুরে বেড়ানো, কিন্তু কোনদিকে যেতে হবে জানি না। আমি জুবিলির রাস্তায় ঘুরে বেড়ালাম, রাস্তায় আমার গাড়ি ছাড়া অন্য কোনও গাড়ি চোখে পড়ল না। ঘরবাড়ি সব অন্ধকারে ঢাকা, রাস্তাগুলো কালো, শেষ তুষারে আঙিনা মলিন। আমার মনে হলো এই বাড়িগুলোতে যারা বাস করে তারা প্রত্যেকে সেই কথাটা জানে যা আমি জানি না। তারা জানে কী ঘটেছে, হয়তো জানত কী ঘটতে যাচ্ছে, আর আমিই কেবল জানতাম না।

আমি গ্লোব স্ট্রিট থেকে বেড়িয়ে মিনি স্ট্রিটে যাই এবং তার বাড়িটাকে পিছন থেকে দেখি। সেখানেও কোনও বাতি নেই। আমি ঘুরে সামনের দিকে গেলাম। তারা কি টেলিভিশন চালু রেখে চুপি চুপি ওপরের তলায় উঠছে ? জানতে ইচ্ছে করছে। গ্র্যান্ড পিয়ানোর মতো পিঠওয়ালা কোনও মহিলা এটা মেনে নেবে না। আমি যদি তাকে ধরে ওপরে নিয়ে গিয়ে বৃদ্ধাকে বলতে পারতাম, ‘এই হলো নতুন মিসেস ম্যাককোয়ারি!’ যদি এমনটা হতো।

আমি গাড়ি পার্ক করে জানালা নামাই। তারপর কোনও কিছু না ভেবে একটু ঝুঁকে জোরে হর্ন বাজাতে শুরু করি, যে পর্যন্ত আমি সহ্য করতে পারি।

হর্ন বাজানো থামিয়ে আমি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি, ‘হেই, ক্লেয়ার ম্যাককোয়ারি, আমি তোমার সঙ্গে কথা বলতে চাই!’

কোনও উত্তর নেই। ‘ক্লেয়ার ম্যাককোয়ারি!’ আমি তার অন্ধকার গৃহের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করি। ‘ক্লেয়ার, বেরিয়ে এসো!’ আমি আবার হর্ন বাজাই, দুইবার, তিনবার, জানি না আরও কতবার। হর্ন বাজানোর মাঝখানে চিৎকার করেছি। আমি আমার নিজেকে দেখেছি বিরামহীনভাবে কেবল হর্ন বাজাতে আর চিৎকার করতে। এটা ছিল এক প্রকার উপভোগ্য। আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম কী জন্য আমি এমন করছি। আমি এবার ছন্দময়ভাবে হর্ন বাজাতে ও চেঁচাতে শুরু করি। ‘ক্লেয়ার, তুমি কি কখনও বেরিয়ে আসবে না ? ক্লেয়ার ম্যাককোয়ারি, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আসো, নইলে কিন্তু খবর আছে― ’আমি চিৎকার করছিলাম ও কাঁদছিলাম, রাস্তার মধ্যে, তাতে কিছু যায় আসে না।

‘হেলেন, তুমি কি শহরের সবাইকে জাগিয়ে তুলতে চাও ?’ বাডি শিল্ডস বলল, জানালা দিয়ে তার মাথা বের করে। সে নাইট কনস্টেবল, আমি তাকে সানডে স্কুলে পড়িয়েছি।

‘আমি নবদম্পতির জন্য বিয়ের বাদ্য বাজাচ্ছি। এতে কী হয়েছে ?’

‘আমি বলছি এই আওয়াজ থামাও।’

‘থামানোর কোনও ইচ্ছা আমার নেই।’

‘তোমাকে থামাতে হবে, হেলেন, তোমার একটু মন খারাপ হয়েছে।’

‘আমি তাকে বারবার ডাকছি, কিন্তু সে আসছে না,’ আমি বলি, ‘আমি চাই সে বেরিয়ে আসুক।’

‘আচ্ছা, ভদ্রমহিলার মতো এখন হর্ন বাজানো থামাও।’

‘আমি চাই সে বেরিয়ে আসুক।’

‘আস্তে। ঐ হর্ন আর একবারও বাজাবে না।’

‘তুমি কি ওকে বের করে আনবে ?’

‘হেলেন, আমি কোনও মানুষকে তার বাড়ি থেকে বের করে আনতে পারি না, যদি সে নিজে বের হয়ে না আসে।’

‘আমি ভেবেছিলাম তুমি আইনের লোক, বাডি শিল্ডস।’

‘হ্যাঁ আমি আইনের লোক, কিন্তু আইনের কিছু সীমা আছে। যদি তুমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাও তবে দিনের বেলা আসো না কেন ? যে কোনও ভদ্রমহিলার মতো দরজায় টোকা দেবে।’

‘যদি না জানো তবে বলছি, সে বিবাহিত।’

‘হ্যাঁ হেলেন, সে বিবাহিত হয়ে থাকলে দিনে যেমন রাতেও তেমন।’

‘মজা করা হচ্ছে ?’

‘না, মজা করছি না, যা সত্য তাই বলছি। এখন তোমাকে আমি বাড়ি পৌঁছে দেব। দেখো এই রাস্তার আলো জ্বলছে আর নিভছে। গ্রেস বিচার আমাদের লক্ষ করছে, এবং আমি দেখতে পাচ্ছি হোমসরা তাদের জানালা খুলেছে। তুমি কি চাও তারা তোমাকে নিয়ে কথা বলুক ?’

‘তাদের কথা বলা ছাড়া আর কোনও কাজ নেই, তারা আমাকে নিয়েও কথা বলতে পারে।’

বাডি শিল্ডস সোজা হয়ে দাঁড়ায় এবং গাড়ির জানালা থেকে একটু সরে যায়। আমি কালো কাপড় পরা কাউকে ম্যাককোয়ারি লন দিয়ে আসতে দেখি, সে ক্লেয়ার। সে ড্রেসিং গাউন বা ঐ জাতীয় কোনও পোশাক পরেনি, তার পরনে শার্ট, জ্যাকেট ও ট্রাউজার। সে গাড়ির দিকে এগিয়ে আসে, আমি অপেক্ষা করি তাকে আমার কথা বলার জন্য। তার কোনও পরিবর্তন হয়নি। সে মোটাসোটা, আরামপ্রদ, ঘুমঘুম চেহারার লোক। তার ভাবসাব, নিত্যদিনের সহজস্বাভাবিক ভাবসাব, আমার কান্না ও চিৎকারের ইচ্ছা রুদ্ধ করে দিল। আমার চেহারা নীল হয়ে আসা পর্যন্ত আমি আমি কাঁদতে ও চিৎকার করতে পারতাম, কিন্তু এতে তার ভাবসাবে কোনও পরিবর্তন আসতো না কিংবা তাকে বিছানা থেকে নামাতে পারত না। আঙিনায় তার দ্রুত পদচারণা।

‘হেলেন, বাড়ি ফিরে যাও,’ সে কথাটা এমনভাবে বলল যেন আমরা দুজন সারা সন্ধ্যা টেলিভিশন দেখেছি এবং এখন বাড়ি ফিরে ঠিকমতো ঘুমানোর সময় হয়েছে। ‘তোমার মাকে আমার ভালোবাসা দিও,’ সে বলল। ‘বাড়ি চলে যাও।’

সে এটুকুই বলতে চেয়েছে। বাডির দিকে তাকিয়ে সে বলল, ‘তুমি কি তাকে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে যাবে ?’ বাডি হ্যাঁ-সূচক জবাব দিল। আমি ক্লেয়ার ম্যাককোয়ারির দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম, এই লোকটা তার নিজের মতো চলে। আমার সঙ্গে সে যা করেছে এবং আমার কেমন লাগছে তা নিয়ে সে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত নয়। তার বিয়ে নিয়ে আমি রাস্তায় যে গোলমাল বাঁধিয়েছি তাতেও সে উদ্বিগ্ন নয়। সে এমন লোক যে কোনও ব্যাখ্যা দেবে না, হয়তো তার কাছে কোনও ব্যখ্যাও নেই। তার কাছে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো যদি কিছু থেকে থাকে তা হয়তো সে ভুলেই গেছে। এখানে তার সমস্ত প্রতিবেশী আমাদের লক্ষ করছে, কিন্তু কাল সকালে যদি রাস্তায় তাদের সঙ্গে তার দেখা হয়, সে কোনও উদ্ভট কাহিনি বলবে। আর এখন আমার সঙ্গে রাস্তায় তার দেখা হলে সে কী বলবে ? হয়তো সে বলবে, ‘কেমন চলছে, হেলেন ?’ তারপর একটি কৌতুক বলবে। আমি যদি সত্যি ক্লেয়ার ম্যাককোয়ারির স্বভাবচরিত্র সম্পর্কে ভাবতাম, যদি আমি মনোযোগ দিতাম, তবে হয়তো তার সঙ্গে সম্পর্কটা সম্পূর্ণ ভিন্ন হতো, অনুভূতি ভিন্ন হতো, যদিও নিয়তিই জানে তাতে শেষ পর্যন্ত কী দাঁড়াত।

‘তুমি যে এতো হাঙ্গামা করলে তার জন্য কি তুমি এখন দুঃখিত নও ?’ বাডি বলল। আমি গাড়ির সিটে বসলাম এবং দেখলাম ক্লেয়ার বাড়ির দিকে ফিরে যাচ্ছে। আমি ভাবছি, হ্যাঁ, আমার মনোযোগ দেওয়া উচিত ছিল। বাডি বলল, ‘তাকে ও তার বৌকে তোমার এখন আর বিরক্ত করা উচিত নয়, তাই না, হেলেন ?’

‘কী ?’ আমি বললাম।

‘ক্লেয়ার ও তার বৌকে আর বিরক্ত করবে না। সে এখন বিবাহিত এবং এখানেই সবকিছু সমাপ্ত। কাল সকালে ঘুম থেকে উঠলে আজ রাতে যা করলে তার জন্য তোমার খারাপ লাগবে। তুমি জীবন চালাতে পারবে না এবং মানুষকে মুখ দেখাতে পারবে না। আমি তোমাকে একটা কথা বলে রাখি, ঘটনা ঘটতেই থাকবে এবং জীবন চালিয়ে যেতে হবে। মনে রাখবে, তুমিই এরকম একমাত্র ব্যক্তি নও।’ লোকটা আমাকে লেকচার শুনিয়ে যাচ্ছে, একটুও ভাবছে না এটা কতটুকু সঙ্গত। এই লোক বাইবেল পড়ত আবার লুকিয়ে-চুরিয়ে লেভিটিকাস পড়তে গিয়ে ধরা খেয়েছিল।

‘এই যেমন গত সপ্তাহে, বলছি শোনো,’ সে বলে, গ্লোব স্ট্রিট দিয়ে ধীরেসুস্থে গাড়ি চালাতে চালাতে। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার তাড়া নেই, সে তার লেকচার চালিয়ে যায়, ‘গত সপ্তাহে ফোনকল পেয়ে আমাদের ডানক সোয়াম্পে যেতে হয় যেখানে একটি গাড়ি আটকে ছিল। বুড়ো কৃষক তার গুলিভরা বন্দুক উঁচিয়ে বলছিল তার সম্পত্তিতে যে দুই লোক বিনা অনুমতিতে ঢুকে পড়েছে তারা যদি সরে না যায় তাহলে গুলি করবে। অন্ধকারে তারা ওয়াগন ট্র্যাক দিয়ে যাচ্ছিলো কিন্তু ঐ দুই বোকার হদ্দ আন্দাজ করতে পারেনি যে তারা আটকে যাবে। যদি আমি নাম বলি তবে তুমি তাদের দুজনকেই চিনবে। এবং তুমি সহজেই বুঝে যাবে, তাদের গাড়িতে একত্রে থাকার কথা নয়। একজন বিবাহিত মহিলা। তার স্বামী বেচারা হয়তো ভেবেই পাচ্ছে না তার স্ত্রী গানের অনুশীলন শেষ করে এখনও ফিরছে না কেন। দুজনই গায়ক দলের সদস্য, আমি গায়ক দলের নাম বলবো না। তার স্ত্রী হারানোর ব্যাপারে ভদ্রলোক রিপোর্ট করেছে। আমরা একটি ট্রাক্টর দিয়ে গাড়িটিকে টেনে তুলি। স্বামী বেচারা তখন ঘামছিল। বুড়ো কৃষক শান্ত হয়। আমরা মহিলাকে ছাড়িয়ে নিয়ে আসি, সারা রাস্তায় সে শুধু কাঁদছিল। এই হলো ঘটনা, এসব ঘটতেই থাকে। আমি ভদ্রলোক ও তার স্ত্রীকে গতকাল ডাউনস্ট্রিটে মুদির মালামাল কিনতে দেখেছি। তাদেরকে দেখে খুব সুখী মনে হয়নি, কিন্তু তারা চালিয়ে যাচ্ছে। কাজেই ভালো মেয়ে হও, হেলেন, এবং বাকি লোকদের মতো জীবন চালিয়ে যাও। খুব শীঘ্রই আমরা বসন্তের আগমন দেখতে পাব।’

আচ্ছা, বাডি শিল্ডস, তুমি বকবক করে যেতে পারো, আর ক্লেয়ার তোমাকে কৌতুক শোনাবে। মা বেদনা থেকে মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত কাঁদতেই থাকবে। কিন্তু আমি কখনওই বুঝতে পারব না, কেন, এই মুহূর্তে, ব্যাখ্যাহীন ম্যাককোয়ারিকে দেখে আমি প্রথমবার অনুভব করলাম যে হাত দুটো প্রসারিত করে আমি তাকে স্পর্শ করতে চাই।

সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button