ইশতিয়াক আলমের কাব্যিক নামের ভ্রমণগদ্য মেঘ পাহাড়ের দেশে পড়ছি। মেঘালয়, আসাম, দার্জিলিং ও সিকিমসহ ভারতের সেভেন সিস্টারস নামে পরিচিত এলাকাগুলো ভ্রমণের অনুভূতি, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, মিথ, ইতিহাস ও লোকাচার নিয়ে লেখা বইটি সাবলীল ও সুখপাঠ্য। আকাশে যেমন মেঘ ওড়ে আয়েশহীন, নদীতে জল যেমন বয় অবিরল, বইটির ভাষা-সৌন্দর্য আমার তেমন মনে হয়েছে। ‘নদীর পানি হয় এতই স্বচ্ছ যে আরোহীসহ নৌকার ছায়া পড়ে নদীর তলদেশে। উমগট নদী নেয় এক মোহনীয় রূপ। এই সময়ে তোলা ছবিতে নৌকা এবং নিচে এর ছায়া দেখে মনে হয় শূন্যে ভাসছে নৌকা ও যাত্রী।’
পরিচিত দৃশ্য?
হ্যাঁ।
শৈল্পিক বর্ণনা? আবারও হ্যাঁ।
মনে হয় না উমগট নদীতে ভাসছি? অবশ্যই, নদীটি দেখিনি কিন্তু ইশতিয়াক আলম দেখালেন।
‘সুউচ্চ এক পাহাড় থেকে বাস যেন ঝাঁপ দিয়েছে আরেক পাহাড়ে। আরেকটা ছোট পাহাড়ের শিরদাঁড়ায় সরুপথ। দুই পাশেই খাদ, গভীর অতলস্পর্শী। এতই গভীর যে সূর্যের আলো পর্যন্ত বুঝি পৌঁছায় না নিচে।’
একটি পাহাড়ি পথের বর্ণনা, ভয় যেখানে শিঁড়দাড়া বেয়ে ওঠে উত্তরে, তারপরে মগজের হেমিস্ফেয়ারগুলোতে বিস্ফোরিত হয়ে সারা শরীরে কাঁপন ধরায়।
বড় বড় অনেক পাহাড় ঘুরেছি আমি, যৌবনে উত্তর ককেশিয়ার ‘মুসা আচাতিরার’ ১১,০০০ ফুট চূড়ায় বিনির্মাণ দলে অস্বাভাবিক কায়িক পরিশ্রম সেরে মধ্যদুপুরে যখন ক্লান্ত, শ্রান্ত, ঘাসে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলাম আমি আর তাতিয়ানা, ও বলেছিল পাহাড়কে অত ভয় পাবার কী আছে?
ও ছিল আলপিনিস্ট, তার ওপরে যৌবতী এবং তারও ওপরে সুন্দর, জানতাম ওকে পাহাড় গিলবে না কিন্তু আমি সমতলের ভেতো ভেড়ুয়া, উল্টা পাল্টা পা ফেললে পাহাড় যে আমার হাড়ও বাদ দেবে না, আমি নিশ্চিত ছিলাম। ইশতিয়াক আলমের ওই বর্ণনায় এবং শুধু ওইটুকুতেই নয়, আরও অসংখ্য শব্দমালায় আমি সেই পাহাড়ি ভয়টা টের পেয়েছি।
‘হেলা ফেলা নয়, পাহাড়কে শ্রদ্ধা করতে হয়’ ককেশিয়ানরা বলে, ধারণা করি বইয়ের লেখক এমন কথা ওখানেও শুনেছেন একাধিকবার।
‘মেঘের পর মেঘের মতোই পাহাড়ের পর শুধুই পাহাড়। দূরের পাহাড়ের ঘুম এই দুপুরেও বুঝি ভাঙেনি। কুয়াশার চাদর গায়ে জড়িয়ে পাহাড় যেন ধ্যানমগ্ন মৌনী বৃদ্ধ, নিরাকার-নিরাসক্ত।’
কী অসামান্য সৌন্দর্য এই বর্ণনায়। মৌন নিরাসক্ত পাহাড়! কিন্তু নিরাকার কেন?
পাহাড়ের পাদদেশের জটাজাল, শরীরের সৌষ্ঠব, কোমরের মেখলা, বুকের বৈভব এবং শীর্ষের গর্বিত মাথা উঁচু করে থাকা, সবটাই তো দেখা যায়, সবটাই আকারে সাকার।
এখানেই লেখকের চোখ, বিশালের সংস্পর্শে এসে লেখক নিরাকার বিশালে বিদ্রুত হয়ে যান, পাহাড় তখন পাহাড় থাকে না, সমুদ্র থাকে না সমুদ্র এবং গহিনে অনুভব করেন :
‘You are not in the mountains. The mountains are in you’
এই বইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর অসংখ্য মিথ। শিলং শহরের নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে পাহাড়ের এক কুমারিমাতা লি’র গল্প, যে অলৌকিকভাবে গর্ভধারণ করে এক পুত্রের জন্ম দেয় কিন্তু লোকলজ্জার ভয়ে শিশুকে ত্যাগ করে বাগানের ঝোঁপে। কিন্তু সেই শিশু, নাম যার শুলং, বড় হয়ে খুঁজে বের করে মাকে, বলে, সে পৃথিবীতে এসেছে ধর্মপ্রচার ও সকল মানুষকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে। পরিচিত মিথ, মাতা লি’কে মাতা মেরি বললেই সবকিছু স্ব স্ব স্থানে দাঁড়ায়। কিন্তু মিথটির বয়েস যদি দু’হাজার বছর পুরনো হয়, তাহলে জটিলতার জট বাঁধে। তাই আমরা অতদূরে না গিয়ে আপাতত বরং যাই শিলং দেবতার ‘ক্রেইম মেরাই’ গুহার কাছে যেখান থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে আসে ‘পরীর মত অপূর্ব সুন্দরী এক তরুণী’, শিলং পিকের নিচে বড় জলপ্রপাতের কাছে রোদ পোহায়। এবং বসন্তের কোনও এক দিনে, যখন সারা প্রকৃতি ছেয়ে গেছে ফুলে ফুলে, গুহা থেকে বের হয়ে এসে ফুলের দ্বারা প্রলোভিত হয়ে ধরা পড়ে যুবক মাইলিয়েঙ্গাপের হাতে। এমনি এক যুবকের হাতে বাইকাল হ্রদের তীরে ধরা পড়েছিল গোত্রপ্রধান আসাজে মালোনের কনিষ্ঠ কন্যা, যে পরে হয় সাইবেরিয়ার বুরিয়াত জাতির আদিমাতা। এই গল্পের পরী, পাহসেনতিউ (অনুবাদে―ফুলের দ্বারা প্রলোভিত যে) শিলং রাজবংশের আদি রানি।
দেশ-জাতি ভেদে উপকথাগুলোর যে আশ্চর্য সাযুজ্য দেখা যায় তা মন ও মননকে বিহ্বল না করে পারে না।
এই মুগ্ধতা ছাপিয়ে দোহালিয়াদের বাঁশি, ঢাকঢোল ও ঘণ্টা বাজিয়ে উত্তাল নাচের তালে তালে নেচে ওঠে খাসিয়া যুবক ও মাথায় হাল্কা হলুদ, মিষ্টিগন্ধের ‘তিউর্লসাবুন’ ফুলের মুকুটপরা যুবতীরা। যৌবন সুন্দর এবং অপূর্ব সেই যৌবনের ঝর্নাধারা।
তন্ময়তার তাল কাটার আগেই আমরা পৌঁছে যাই, ‘উ শেহ পেটবং’ পাহাড়ে। পেরুর কুস্কো শহর দেখে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে ওদের দাবি সত্য, কুস্কোই ‘পৃথিবীর নাভিপদ্ম’, কিন্তু গোল বাঁধলো ‘ঘরের থেকে দু পা ফেলিয়া’ এখানে এসে। জানা গেল ‘শেহ পেটবেং’ শব্দের অর্থও পৃথিবীর নাভিপদ্ম। পুরানের এইসব ভেল্কির খেলায় মাথা বন বন করলেও এটা আমরা জানি যে, ঈশ্বরপুত্র মানকো কাপাকের সোনার দণ্ড ‘ইয়াউরি’ কুস্কোর মাটিতে দেবে গেলেও, কুস্কো থেকে কোনও স্বর্ণের সিঁড়ি স্বর্গের সঙ্গে পৃথিবীর সংযোগ স্থাপন করেনি, যা করা হয়েছিল অতীতে, এই পাহাড়ের ওপর থেকে, যখন আকাশ নীচু ছিল এবং স্বর্গ থেকে দেবতারা নেমে আসতেন। স্বর্গে দেবতা ছিলেন মাত্র ষোল পরিবার, তাদের মধ্যে সাত পরিবারের পৃথিবী এত ভালো লেগে গেল যে তারা আর স্বর্গে ফিরে যেতে চাইলেন না। ঈশ্বর দেখলেন এমন exodus চলতে থাকলে তার স্বর্গে ঝাড়ু দেওয়ার জন্যও কেউ থাকবে না। তিনি তখন ডিনামাইট মেরে নর্ডস্ট্রিম পাইপ লাইনের মতো স্বর্ণের সিঁড়িটিও উড়িয়ে দিলেন।
সেই থেকে পৃথিবীর মানুষের সঙ্গে ঈশ্বরের যোগাযোগ তাই ‘তুমি কানা তাই আমি কানা’, অথবা ‘আমি কানা তাই তুমি কানা’ গোছের উভমুখী।
কিন্তু পৃথিবীতে থেকে যাওয়া দেবতাদের বংশধর ছিল ‘হাইনিউ’ বা ‘সাত পরিবার’ গোত্র, যাদের থেকে খাসিয়াদের উৎপত্তি। ওরা কেন সরল, সৎ ও প্রকৃতির সন্তান, তার ব্যখ্যা এতক্ষণে পাওয়া গেল।
লেখক আমাদের নিয়ে গেছেন জিৎভূমে, যেখানে একটি বাড়িতে কবিগুরু ছিলেন ৪০ দিন, সঙ্গে ছিল রানু। রানুর কথা অনেকেই জানেন, না জানলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রানু ও ভানু পড়ে নেওয়া যায়। কবিদের অনেক দীর্ঘশ্বাস থাকে, বুক থেকে জন্ম হয়ে কিছু বুকেই মরে যায়, আর কিছু বের হয়ে আসে নিঃশব্দে বা শব্দ করে। তার হিসাব কেউ রাখে না। সপ্তদশী রানু কবির হাত ধরে গল্প করতে করতে পাহাড়ি রাস্তায় হাঁটেন। কখনও শুয়ে থাকেন কবির শূন্য বিছানায়। নতুন কিছু নয়, রানু এমনি ছিলেন, এতদূরে বসে আমরাও তা জানি কিন্তু মীরা দেবীর কাছে এটা মনে হয়েছিল, ‘একটু বেশি বেশি বেহায়াপনা’ এবং তিনি তাকে তিরস্কার করেন। রানু কষ্ট পান। কিন্তু কষ্টই জীবন, সেটা বয়েস অল্প হলেও রানু জানতেন।
‘আমায় পরশ করে প্রাণ সুধায় ভরে
তুমি যাও যে সরে
বুঝি আমার ব্যথার আড়ালেতে
দাঁড়িয়ে থাকো…
ও গো দুঃখ জাগানিয়া…’
কবিগুরু এখানে বসেই লেখেন বুকে চমক দিয়ে ডাকার আখ্যান, রক্তকরবী নাটক।
লেখেন উপন্যাস যোগাযোগ। তার ভবিষ্যতের শেষের কবিতা উপন্যাসের স্থান কাল পাত্র নির্বাচিত হয়।
কবিগুরুর স্মৃতি যেখানে, বয়েসভেদে যে কোনও লেখক, বাংলায় যার জন্ম, সেখানে গিয়ে দু’দণ্ড দাঁড়াবে, তাই স্বাভাবিক। ইশতিয়াক আলম তার ব্যতিক্রম নন।
লেখকের শব্দসেঁতু বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমরা চলে এসেছি গারোদের ওয়াঙ্গালা উৎসবে, যেখানে মাথায় পাখির পালক গুঁজে নমনীয় গ্রীবার ‘দখমান্দা’ মেয়েরা কোমর দুলিয়ে নাচছে পুরুষদের সঙ্গে জোড়বেঁধে, আর ঢোলের তালে তালে দুলছে চরাচর।
মনোমাদকতার এই যে আবহ তা আরও তীব্র হয়ে ওঠে লিয়েং ম্যাকাউ নামের রূপসী তরুণী রানির হৃদয় হরণ করা এক বাঁশিসুরে। আমরা জানি, বিষণ্ণ জাপানি সম্রাট তাকাকুরার হৃদয় হরণ করেছিল লেডি কোগোর বেহালা (কটো) এবং তার পরিণতি ভালো হয়নি, ‘My tears are like a string of white jewels’, বিপর্যস্ত লেডি কোগোকে স্বীকার করতে হয়েছিল। লিয়েং-এর প্রেমে জ্বলন্ত চিতায় গিয়েছিল মানিক রাইভুং এবং তাকে হারানোর ব্যথা লিয়েং সহ্য করতে পারেনি। ইনিয়াসকে হারিয়ে কার্থেজের রানি দিদোনার মতো সেও ঝাঁপ দিয়েছিল চিতায়। ভালোবাসার গল্প হলো হৃদয় বিচলিত করার গল্প, ভালোবাসার আগুন হলো অস্তিত্ব থেকে মানুষকে অনস্তিত্বে নিয়ে যাবার সিঁড়ি।
এমন অসংখ্য আবহে ইশতিয়াক আলমের বই পাঠককে সম্মোহনের তরলতায় হাঁটায়। যতই এগোই ততই মুগ্ধতা নেমে আসে, যেমন মেঘ নেমে আসে পাহাড়ে এবং অদৃশ্য ও অচেনা কোনও কণ্ঠ ফিসফিস করে, ‘If you need me, you can find me in the mountains..’
সত্যিই পাহাড়কে পেতে পাহাড়েই যেতে হয়। পাহাড়ের গল্প পাওয়া যায় মেঘ পাহাড়ের দেশে বইতে। আমি পাঠককে শেষতক এই বইয়ের কাহিনি না বলে আহ্বান করব বইটি পড়ার জন্য। কারণ একটাই : You’re never alone when you’re reading a book.
কথাটি আমার নয়, তবে কথাটি সত্য, এবং এই বইটি একাকীত্ব দূর করার সঠিক সহচর।
লেখক : ভ্রমণসাহিত্যিক