আর্কাইভকবিতা

কবিতা

মাকিদ হায়দার

স্মৃতি ১৯৭১

[ কবি আরিফুল হক কুমার প্রীতিভাজনেষু ]

চুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দে

হারামজাদারা

সোনার পাকিস্তান ভেঙ্গে বানাবে

বাংলাদেশ।

মাতুলের নির্দেশে চুক্তিযোদ্ধাকে

ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে দিলেন

আরিফপুরের মগরেব আলী।

ফাঁসিকাষ্ঠ থেকে নামানোর পর

আমরা সকলেই এমনকি মাতুল

প্রিয় রোকেনিলো

দেখলেন, দেখলাম

চুক্তিযোদ্ধা তখনও জীবিত।

শালা হারামির বাচ্চা তক্ষুনি বলল

ফাঁসি দিয়ে কোনও শেষ করা যাবে না।―

মুক্তিযোদ্ধাদের।

আমরা যারা মাতুলের ছায়া হয়ে

আশেপাশে থাকি দিনরাত

সকলেই দেখলাম

চুক্তিযোদ্ধারা স্টেনগান দিয়ে

হামলা চালানোর আগেই

আমি আর মাতুল লুকিয়ে পড়লাম

ঝোঁপেঝাড়ে।

সেই দিন মাঝরাতে

পঁচিশ-তিরিশ জন চুক্তিযোদ্ধারা

হত্যা করলো

আরিফপুরের শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান

মোসলেম উদ্দিনসহ জনা চল্লিশেক।

আমরা মাতুলের নিকট স্বজনদের।

ওই একই দিনে মারলো স্টেনগান দিয়ে

মাতুলের প্রিয়

      সোনার পাকিস্তানের মেজর

      ক্যাপটেনসহ জনা বাইশেক

      নাপাক বাহিনীর।

ইতিমধ্যে আলবদর আলশামস রাজাকার

সকলকেই এক সারিতে দাঁড় করিয়ে

পাঠালো ওপারে।

আমি আর প্রিয় মাতুল রোকেনিলো

সেই থেকে এখনও লুকিয়ে আছি

কুয়োর ভেতর।


জাহিদ হায়দার

অশেষ উপসংহার

১৮

মাঝেমধ্যে নৈঃশব্দ্যের এলার্ম কথা বলতে আসে।

আমি তখন মিউজিক বাজাতে থাকি।

তোমাদের বারান্দায়

               গাঁদা ফুলের হলুদ-শব্দরীতি হাওয়ায় দোদুল্যমান। 

বৃষ্টি থেমে গেলে

               কারো কারো হৃদে বিদায়-দৃশ্য বেজে ওঠে।

এলামপূর্ব যুগে

               পাখিদের সময়সততা ভোরবেলা ডেকেছে তোমাকে।

জেগে ওঠার সার্থকতা অবকাশকেন্দ্র নয়।

২৯

যৌনজীবী মেয়েটিকে আন্তরিক ধন্যবাদ।

প্রয়োজনে স্বপ্নচুক্তির বাইরে চলে যেতে পারে,

স্তম্ভের শিরদাঁড়া দেখা হয়ে গেছে।

বলেছিল,

               সব আলিঙ্গন শরীরসত্য নয়,

সব রাস্তার বাঁক কেন যায় দূরবর্তী শূন্যতার দিকে ?

থেমে পড়া রাস্তাকে কখনো থামতে দেব না।

ফিরে আসবার অর্থগুলো বোঝে কফিনের ছায়া।

৩৪

(জাহাঙ্গীর ফিরোজের জন্য) 

ব্যক্তিগত পর্যটনে

কৌম-আনন্দ আছে।

যায় না কোথাও

ঘুরিবার রূপবন্তে ঘোরে। 

গন্তব্যহীনতায়

কড়া নাড়ার ক্লান্তি নেই।

দিকের দিগন্ত

ঋতুদের চিঠি লেখে,

পাখিরা পাঠক।

আতিথ্যে পেয়েছে

শান্তির রজতদ্যুতি।

নিজস্ব তরঙ্গে করে

অনম্য পারাপার।   

৬১

সময়-পিচ্ছিলে

পড়ে যেতে যেতে

দাঁড়াতে দাঁড়াতে

উধাও পদধ্বনি।

স্বপ্ন-পিচ্ছিলে

ধ্রুপদ খুঁজে খঁুঁজে

তোমার সিঁড়িতে

ক’ধাপ যেতেই

সন্ধেবেলা।

খোলা দরজায়

ডাকো নাই তুমি

আজন্ম-পিচ্ছিলে।

১২২

কোন চলা থেকে

নেমেছ কোথায় ?

নৌকা, বাস, ট্রেন

নাকি মাতৃগর্ভ থেকে ?

কোনো কোনো নেমে পড়া

জন্ম থেকে বোবা।

তখন কি ছিল রাত ?

নাকি ঝড়োদিন ?

অথবা না দেখা ভোর।

অচেনা ঘরবাড়ি

তুমি নতুন মানুষ।

নেমে পড়ার সংজ্ঞা পেলে

গন্তব্যে যাওয়া যেত।

হাঁটো, নেমেছো যখন।

১৩৫

প্রথম হাঁটার খোঁজে

জন্মের বাড়িতে গেছি।

সামান্য পতনে হেসেছিল মা।

উঠোন থেকে পাখিরা উড়ে গিয়েছিল।

পায়ের তৃষ্ণা কথা বলেছিল।

আমার পৃথিবীর প্রথম রাস্তা

ছোটো বড়ো হতে হতে 

হতে হতে…


শামীম আজাদ

জননীর অকাল জ্বরা 

এক একটি ওজনদার সন্তানের মৃত্যু হচ্ছে

আর আমাদের মা ছোট থেকে আরও ছোট হয়ে যাচ্ছেন।

শুধু উচ্চতা নয়, লক্ষ্য করছেন কি

মায়ের ওজনও কি পরিমাণ হ্রাস পেয়েছে ?

ভার-পরিমাপক যন্ত্রে উঠলে

কাঁটা তার পুরানো ঘর ছাড়ছেই না

যেন কেউ লাগিয়ে দিয়েছে সুপার গ্লু।

তপ্ত দিনে তাঁর কপালে হাত ছোঁয়াই অসম্ভব,

যেন তিনি কয়েক দশক ধরেই জ্বরগ্রস্ত। 

এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে

জননীকে কারও না কারও হাত ধরেই উঠতে হবে  

তবে যদি বৈঠকখানায় গিয়ে বসতে পারেন।  

মায়ের মুকুটের মণিগুলো

ময়লার আস্তরণে ম্লান হয়ে গেছে।

জন্মলগ্নে পাওয়া তাঁর গহনাগুলোইবা গেল কোথায় ?

চুলে তেল দেবার নাম করে কে বা কাহারা তার মাথায়  

সস্তা পরচুলা লাগিয়ে দিয়েছে!

জানি না তারাই কিনা এখন

হিজাব ও হাবিজাবি নিয়ে ওত পেতে আছে। 

মায়ের বর্তমান হতশ্রী দেখে

এমনকি ক্ষুধা-দারিদ্র্যক্লান্ত ভূমিমালিকরাও হাসাহাসি করে!

অর্বাচীনেরা জানেও না 

অন্তত ভর্তা মেখে ভাত খাবার জন্য

বাইরে থেকে আমাদের কোনও চাল কিনতে হয় না।

এখন আমরা মান্ধাতার আমলের জাহাজ ও

পাল তোলা নৌকার ধার ধারি না। 

তুড়ি মেরে পলকে পেরিয়ে যাই পদ্মার পূর্ণিমা।

মাইলকে মাইল স্থপতির পোস্টার পেতে 

তার উপর আসন পিঁড়ি করে বসে সুগন্ধি চা খাই।

সন্দেহ করি মায়ের বোধশক্তি নিয়েও।

না হলে কেন তিনি বোঝেন না যে

ঐ সব ওজনদার সন্তানরাই একদিন 

দীর্ঘ বৃক্ষ কিংবা দালাই লামা হতে পারে জেনেও

তিনিই না তাদের প্রতি বরাদ্দ স্নেহ তুলে নিয়েছিলেন!

না হলে ওরাই হতে পারতেন

ঝাঁকড়া চুলের বাবড়ি দোলানো মহান পুরুষ,

জাহানারা-জ্যোতি কিংবা মহান মুজিবরের মতো

যিনি কোলে তুলে নিয়ে মাকে বসাতেন বিশ্ব বৈঠকে।

কিন্তু একে একে একাত্তর হাত বেধ নিয়ে জন্ম নেওয়া

সন্তানগুলো কেবলি মরে যাচ্ছে…

                             মরে যাচ্ছে…

                                    না, মেরে ফেলা হচ্ছে।

এখন আমার মায়ের উঠোনে উটের বাস,

কুয়াশা ঢেকেছে আম্রকানন,

পুরানো মাঝিরা তাঁর ঘাটে আর নৌকা ভিড়ায় না 

কদাচিৎ কোনও তিরন্দাজ এলেও

সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য খুঁজে পায় না।

জননী এখন কার কাঁধে হাত রাখেন সেটাই কথা। 

১৩.৮.২৩ ক্যাফে বেথনাল গ্রীন 


মেহেদী ইকবাল

ভুট্টা

ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ভুট্টার ক্ষেত দেখে জুড়িয়ে যাচ্ছে চোখ

এত ভুট্টা এত ভুট্টা

কাঁঠালের রোয়ার মতো কাঁধে কাঁধ সোনালি রঙের ভুট্টা

বুঝি আসছে দিন সোনালি বিস্কুটের!

মনে পড়ে থরে থরে সাজানো কেক আর বিস্কুট বেকারির দোকানে

একটা বিস্কুট পেয়ে কতদিন থামিয়েছি কান্না

কত সকাল আর কত দুপুর করেছি পার একটা বিস্কুট খেয়ে!

ব্রহ্মপুত্র পাড়ে ভুট্টার ক্ষেত দেখে জুড়িয়ে যাচ্ছে চোখ

এত ভুট্টা এত ভুট্টা

হাসছে ভুট্টার চোখ

মনে হয় ভুট্টা নয় যেন ঝুলে আছে লোভনীয় বিস্কুট সোনালি রঙের!

আহা, আসুক না দিন বিস্কুটের

ভাঙ্গারির দোকান নয় বিস্কুট নিয়ে হাতে হাতে

কবে হাসবে প্রাণখুলে নিরন্ন শিশুরা?

বইখাতা নিয়ে তারা কবে যাবে

কবে যাবে অভিন্ন পাঠশালায়?


গোলাম কিবরিয়া পিনু

আত্মত্যাগ 

কারও কারও আত্মত্যাগ

       আত্মহত্যার সামিল!

           জলহীন হয়ে যায় খালবিল!

আকাশে উড়ত যে চিল 

         সে-ও আর ওড়ে না,

খাঁখাঁ করে অজপাড়াগাঁ!

দান ও সামর্থ্যরে মধ্যে ভারসাম্য না থাকলে

               তুমিও হেলে পড়বে,

নিজে যদি পুরোটা হেলে পড়ো

উঠে দাঁড়িয়ে না নড়ো,

তোমাকে তখন কেউ আর টেনে তুুলবে না

হয়ে পড়বে অকেজো!

     ভাই ছিল যে মেজো?

সে-ও উল্টোপথে উল্টোরথে

সাভার থেকে যাত্রা শুরু করবে আবার!

অন্য দাঁতের সাথে আক্কেলদাঁতও করো পরিষ্কার

গাছের সব ডাল কেটে কাউকে খড়ি করতে দিও না,

             গাছ আর তখন বাঁচবে না!

তোমার মাটির ছোট ঘরটা

এত ঝড় ও জলবৃষ্টি সহ্য করতে পারবে না!

মহত্ত্বের মৃত্যু না ঘটিয়ে

          কলমিগাছ পুকুরের জলে রাখো,

সব জল অন্যের জমিতে টেনে নিতে দিও না!

নিজেকে বেশিমাত্রায় দমনপীড়ন ক’রো নাÑ

অন্যরা দলাইমলাই করে ফেলে দেবে ময়লার ঝুড়িতে!

আঘাত পাও―কষ্ট সহ্য করো

      কিন্তু ক্ষতকে গ্যাংগ্রিন হতে দিও না!


শিকদার নূরুল মোমেন

জীবন ও প্রণয়ের কবিতা

ঘর ছিল না,

ঘর পাইলামও না!

পাখির জীবন, ঝড়ে উড়ে গ্যাছে

আমার আবার কীসের হিসাব!

        অনেক কথা

        কয়টা কইতে পারি?

        ভিতরে পাক খাইয়া বেড়ায়

        মাতাল প্রলাপে কী যায়-আসে?

                লেখা চিঠিটি

                কুটি কুটি করে উড়িয়ে দিই―

                আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নামে

                ভেসে যায় খড়কুটো জীবন―


সাইয়্যিদ মঞ্জু

সমুদয় অন্ধকার

কবিতার নাকি বন্ধ্যাকাল চলছে এখন

দূষিত নগর ছেড়ে বিশুদ্ধ বাতাস আমি

হরিৎ উদ্যানে। চেয়ে থাকি পৃথিবীর দিক

অদ্ভুত ব্যাপার যেনো

পৃথিবী ও কবিতার কী যে নিবিড় সম্পর্ক।

আটশো বছর আগে, ফিরে যায় কেউ

আরেঠারে বলে দুঃসময়। জানি এই নিয়ে

শাহবাগের আড্ডায় কত যুক্তিতর্ক হয়।

জীবন্ত দুপুর হেলে পড়ে বালখিল্য রোদে

সমুদয় অন্ধকার

কবিতার ক বুঝাই বুঝেছি দুর্ভেদ্য কিছু

তাই

উপকূল, নদী, মৈনাক, সমুদ্র পাঠ করি শুধু

পৈতৃক ভিটায়…


মেহনাজ মুস্তারিন

বন্ধনে

জানি নক্ষত্র নই, তবু গভীর এক দুঃখ

গ্রহের মতো

রাত-দিন জেগে আছে! অতি ক্ষুদ্র প্রাণ আমি, বেহুলার ভেলায়

লখিন্দরের মতো ভেসে চলেছি! শুনেছি, ভালোবাসায়

মৃতজনে জাগে প্রাণ! তবু ইন্দ্রের সভায় নৃত্য নয়,

জেগে আছি আলো হাতে―

অপেক্ষা কোনও এক শব্দের!  যাকে ঠিক অনুভব করা যায়! স্পর্শে!

ফিরে এসো যদি ইচ্ছে হয়! যদি ইচ্ছে হয় আঙ্গুল

ছুঁয়ে দিতে! মধ্যগগনে যে হাত ছুঁয়েছিল মুখখানি একবার!

জ্যোৎস্নাও করেনি বারণ! সেই ক্ষণে

ঝরে পড়েছিল আলো, ভিজেছিলাম

ধুয়ে নিয়ে যত দুঃখছায়া, প্রেমের স্রোতে!

যদি আসো আলোর বন্যায়

ঢেকে যাবে চারপাশ! শুধু একবার

ফিরে দেখো! শুধু একবার আগলে নাও তোমার

স্বপ্ন আকাশ! দেখো, মাটি বৃক্ষ কীট পতঙ্গ সবুজবীথি,

চেয়ে আছে  তুমি আসবে বলে! চেয়ে আছে চন্দ্রতিথি! 

ঝড়ো বৃষ্টি? তারাও চেয়ে আছে,

তুমি আসবে বলে! ওরা ঝরবে! ওরা গাইবে! সেই গানে

দোদুল দোলায় দুলবে ওরা! ঝড়ো হাওয়ায় কম্পন! যেন সুরের ধারায়

নামবে বৃষ্টি! জেগে ওঠব চোখের তারায়!

তোমার স্পর্শে; দেখো আবারও ভিজে যাব তোমার উষ্ণতায়! 


বিবিকা দেব

দেয়ালঘড়ি

মিশমিশে কালো রঙের সাথে সোনালি রঙের সম্প্রীতির বসবাস। বেশ মানিয়েছে দু’জনকে,  একে অন্যের প্রিয়জন। বাবা রোজ সকালে সময় নিয়ে দেখতেন। হালদার পাড় থেকে ভোরের এক ফালি রোদ আসে সোনালি রঙের সাথে। আগুনরঙা হয়ে বাবার চোখ করে জ¦লজ¦ল। সেই আগুনে পুড়ছে যাপিত জীবনের রসদ। হঠাৎ একদিন বাবা চলে গেলেন মহাকালের অবসরে। কালো রঙের সাথে সোনালি রঙের দেয়ালঘড়িটা এখনও পড়ে আছে দমহীন। ঝুল মাকড়সা বেঁধেছে নিজের মতো বাসা। রঙটা আগের মতো আগুনরঙা নাই। এখন দেয়াল ঘড়িটা মায়ের সংরক্ষণে। মায়ের চোখ বাবার চোখের মতো নয়। তবু মা সকাল-বিকাল দেখে ঝাপসা চোখে। হাতড়ে খোঁজে বাবার চোখ আর মুঠো মুঠো সোনালি সুখ কিংবা দুঃখের নীরবতা।

—————

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button