আর্কাইভগল্প

গল্প : মাধুরী : আসিফ কবীর

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কথা। নালক সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। প্রথম বর্ষের সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেবেন। একদিন বিভাগীয় সেমিনারে বন্ধুর সঙ্গে বসে পরীক্ষার প্রস্তুতি এগোচ্ছিল। হঠাৎ অশোভন হচ্ছে জেনেও বড় চোখ করে তাকিয়ে দেখতে হয় এমন গৌরবর্ণ সুন্দরী অচেনা তরুণী এসে ঢুকলেন সেমিনার রুমে। বসলেন সেমিনারের তত্ত্বাবধায়ক রেজা ভাইয়ের বিপরীত চেয়ারে। মুহূর্তে একটি বড় শ্রেণিকক্ষ, মানে পঞ্চাশজন ছাত্র-ছাত্রীর বসার উপযোগী কলাভবনের যে কক্ষগুলো হয়, তার সমান, মিষ্টি সুগন্ধে ভরে গেল। যিনি এলেন, তিনি দু-তিনটি বই নিয়ে গেলেন, তার আগে সে বিষয়ে অল্প আলাপ-সালাপ করলেন। নালকের বন্ধুটি তাকে বললেন, তোমার আজকে রোজা গেল। সেদিন মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল সারা দেশে। বিষয় ছিল সাধারণ গণিত। নালক তার পরীক্ষার্থী প্রেয়সীর জন্য রোজা ছিলেন। তখন অবশ্যি তাদের সম্পর্কটি প্রায় টুটেই গেছে। নালকের আপ্রাণ চেষ্টায় যাও-বা রেশ ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে।

এর দু-এক মাস পর সেদিনের বড় বড় চোখ করে দেখা তরুণী বিভাগের শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিলেন। নালক ধারণা করলেন, ওই দিন সেমিনার কক্ষে তিনি নিয়োগ পরীক্ষার প্রস্তুতির জন্য প্রয়োজনীয় পড়াশোনার কাজে রিডিং ম্যাটেরিয়াল সংগ্রহ করতে এসেছিলেন। অন্যদিকে প্রভাষক পদে যোগদান করা গ্ল্যামারাস শিক্ষিকা জানতেন, তার ত্রুটিহীন সৌন্দর্যের আকর্ষণ অমোঘ, ক্ষেত্রবিশেষে নিজের জন্য বিরক্তি কিংবা অস্বস্তি বাড়ায়। তাই প্রথম থেকেই তিনি কিছু অনুসরণীয় স্ট্র্যাটেজি নিলেন। স্ব-আরোপিত নিয়ন্ত্রণ নীতিমালার মতো। এক. তিনি সোজা তাকিয়ে বারান্দা, করিডরে হেঁটে যেতেন। কারও সঙ্গে চোখাচোখি হতে চাইতেন না। দুই. শিক্ষার্থীদের সালাম-সম্ভাষণেরও প্রত্যুত্তর করতেন না। তিন. ধেড়ে বুড়ো ছাত্র-ছাত্রীনির্বিশেষে সবাইকে বাবা সম্বোধন করতেন ইত্যাদি। এর মধ্যে বছর পার হয়ে যায় তার শিক্ষকতার। নালক তাকে কলাভবনে যখন যতবার দেখেন, সালাম বলেন। তিনিও কৌশলগত কারণে প্রত্যুত্তর করেন না। ক্রমেই ঘাবড়ে ওঠেন নালক। তার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে, মন বিষণ্ন হয়। অজানা আশঙ্কা হয়। মনে মনে ভাবেন, কী ভুল করলাম। তিনি এমন কেন করে থাকেন ? আমার দিক থেকে ত্রুটি কিছু হলো কি ? সেদিন সেমিনারে আমাদের কথা কি তিনি শুনে ফেলেছিলেন। আমার কি আলাদা করে ক্ষমা চাওয়া উচিত ? এর চেয়ে আর কী ভালো করা যায় ?

এক দশক পর কর্মজীবনে নালক একজন ডাকসাইটে আমলাকে কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে পান। তিনি ছিলেন সরকারের চিফ সেক্রেটারি। একদিন অফিসের গাড়িচালকদের সঙ্গে সভা আহ্বান করেন তিনি। সেদিনই নালক অনুধাবন করেন, কর্মবিধি, অফিস পরিচালন নীতিমালা বা ব্যবস্থাপনার বইয়ে অনেক কথাই লেখা থাকে করণীয় হিসেবে। কিন্তু সবাই জানেন, তা অনেকাংশেই অনুশীলন করা হয় না। অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে না বা অপেক্ষাকৃত কম গুরুত্বের কাজে তখনই হাত লাগানো যায়, যখন আপনি অনেক কাজ করবেন এবং কখনওই দীর্ঘসূত্রতার কর্মজটে পড়বেন না। আবুল কালাম মহোদয়ও তেমন করিতকর্মা ছিলেন। তিনিও চলার পথে সালাম নিতেন না প্রায়শই। গটগট করে আপনমনে হেঁটে যেতেন। অধীনস্থরা তটস্থ থাকতেন এই ভেবে, তিনি মনে হয় অখুশি, তার চাপিয়ে রাখা ভুলটি মনে হয় জেনে ফেলেছেন, গাফিলতির খবর বুঝি তার কানে পৌঁছে গেছে। তাই এমন হচ্ছে। তা ছাড়া আর কী কারণ হতে পারে ? এই সম্ভাবনা আর স্বতন্ত্র চিন্তাই পুরো অফিসের শৃঙ্খলা সমুন্নত করেছিল, কর্মসাফল্য ও গতি বহুলাংশে বাড়িয়ে তুলেছিল।

শিক্ষকতার বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ম্যাডাম অনেকটা সহজগম্য হয়ে যান ছাত্র-ছাত্রীদের কাছে। তার জনপ্রিয়তা ও সুনামও বৃদ্ধি পায়। অনেকের মতো ব্যবহারে কটু, মেজাজে তিরিক্ষি, ধৈর্যে অপরিমিত নন বলে তার গ্রহণযোগ্যতাও প্রথম সারির কয়েকজন সেরার মধ্যে পৌঁছে যায়। প্রথম দিকে এমনটি হয়তো ছিল না। একবার ফটোগ্রাফি বিষয়ের কোর্সে ছাত্র-ছাত্রীদের পাঠিয়েছিলেন বলধা গার্ডেনে। সেখানে তাকে নিয়ে সমালোচনা হয়েছে সন্দেহে পরের ক্লাসে অনেক রাগারাগি করেছিলেন। একজন ছাত্রী তার পড়ানোর কায়দায় অখুশি মন্তব্য করেছে জেনে ক্রোধে চড়াও হয়েছিলেন। ছাত্রী তার বকুনি খেয়ে বেহাল অবস্থায় কমনরুমে গিয়ে অতিরিক্ত কান্নাকাটি, সেদিনের প্রকৃতির দাবদাহ―সব মিলিয়ে নার্ভাস ব্রেকডাউনে অচেতন হয়ে পড়েছিলেন। এসব অবশ্য প্রথম দু-চার বছরের অনভিজ্ঞতা আর আত্মনিয়ন্ত্রণে বয়েসী অপারগতার দিনগুলোর কথা। এখন এসব দুর্বলতামুক্ত তিনি, গণমাধ্যমের পরিচিত মুখ, নিজেই যেন একটি প্রতিষ্ঠান। সামাজিক পুঁজির ব্যাপক অধিকার যেমন তার, ব্র্যান্ডভ্যালুর জন্য তার অংশগ্রহণ ইভেন্টটিকে মহিমান্বিত ও মর্যাদাশালী করে তোলে। বিখ্যাত অঙ্কনশিল্পী ও কার্টুনিস্ট রনবী (রফিকুন নবী) একবার তাঁর হোস্টিংয়ে একটি টিভি শোতে গিয়ে কোনও এক ফাঁকে শুভেচ্ছা ও কৃতজ্ঞতার স্মারকস্বরূপ একটি স্ট্রংলাইনে ছবি এঁেক দেন। টিভি স্টেশনে নিজ কক্ষে তিনি রনবীর আঁকা অমূল্য কার্টুনটি সংরক্ষিত রাখেন পরম যত্নে। কবি মাহবুবুল হক শাকিল ছিলেন নব্বইয়ের সংশপ্তক ছাত্রনেতা, কবি ও গল্পকার। রাজনৈতিক ভাষ্য, বিবৃতি, বাণী, বক্তব্যের তার কৃত ড্রাফটে হাত ছোঁয়ানো যেত না। তার বিবেচনা এতই সর্বব্যাপী ছিল যে তিনি ড্রাফট করলে এর বাইরে আর কিছু মোটামুটিভাবে ছুট থাকত না। দলীয় সভাপতির পছন্দের সবচেয়ে নৈকট্যপূর্ণ হতে পারত তার লেখনী, এমনই জনশ্রুতি ছিল। ভাষাজ্ঞান ছিল শাকিলের খুবই শানিত। বিষয় ও উপস্থাপনার রীতিভেদে বাক্যগঠন, শব্দবিন্যাস ও গতিশীল সংলাপ নির্মাণ করতে তিনি ছিলেন সেরা। রাজনীতি, ইতিহাস, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, সমসাময়িক ঘটনাবলি, দর্শন, নন্দনতত্ত্ব, সাহিত্য নিয়ে তার ছিল ব্যাপক অধীত বিদ্যা। সোশ্যাল মিডিয়ায় নালকদের সেই সর্বগুণান্বিতা শিক্ষিকা খেয়ালের বশে, খুব পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা প্রস্তুতি বিনা কবিতা পোস্ট করতেন। নিজের মনে ছবি আঁকতেন। কবি মাহবুবুল হকের এসবের আলোচনা ও মতামত প্রদান করা থেকে অনুমিত হতো যে তিনি এই খেয়ালবশে সৃষ্ট শিল্পের এক গুণমুগ্ধ ভক্ত। মাহবুবুল হকের তখনকার সামাজিক অবস্থান ও সর্বোচ্চ পর্যায়ে ওঠাবসার বাস্তবতায় শিক্ষিকার ফেসবুকে প্রকাশিত এসব শিল্পকীর্তির বিশ্লেষণ তাৎপর্যপূর্ণই ছিল বলতে হবে। একটি দূতাবাসের দাওয়াতে একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ডিনকে কেউ একজন পরিচয় করালেন ওই শিক্ষিকার সিনিয়র কলিগ হিসেবে। ডিন ভদ্রলোকও এতেই কৃতার্থ বোধ করলেন। এতে সামান্য বেজার হয়েছেন অথবা তখনও লেগে থাকা তার হাসির রেশটুকু যে অস্বস্তি ঢাকতে টেনে রাখা, তা সেদিন কারও মনে হলো না। বরং তার সহকর্মীর সঙ্গে ভালো পরিচয় ও জানাশোনার কথা তুলে আলোচনা দীর্ঘায়িত করে নিলেন। কূটনীতিকের সঙ্গে জমাতে চেষ্টা করলেন।

একবিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকে ক্রমেই প্রাইভেট টেলিভিশনের স্বর্ণযুগ শুরু হয়। প্রথম দিককার যেসব সংবাদ পাঠিকা, অ্যাঙ্কর, উপস্থাপক … নাম করে ফেলেন অল্প দিনেই, নালকের শিক্ষিকা তাদের অন্যতম। এরপর সাফল্যের সঙ্গে তার গণমাধ্যম ক্যারিয়ার এগিয়ে যায়। যা পরবর্তী দুই দশকে তাকে এক নামে পরিচিত করেছে। একের পর এক সাফল্য আর অর্জনে নিজের রেকর্ড নিজেই ভেঙেছেন তিনি। কিন্তু উত্থান-পতনেই মানুষের জীবন, এমনকি কর্মজীবনও। একদিন শিক্ষিকা নালককে ফোন করেন তার একটি প্রয়োজনে। ফোন স্ক্রিনে ম্যাডামের নামটি চাক্ষুষ করে সচকিত হন নালক। নালক কর্মজীবনে ইতোমধ্যে আট-নয় বছর পার করেছেন। তিনি সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে সিনিয়র সহকারী সচিব। শিক্ষিকার ফোন পেয়ে নালকের পূর্বজীবনের দুটি ঘটনা সহসা মনে পড়ে। এর একটি ছিল কাকতালীয়। শিক্ষিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদানের পরপরই মুক্তি পায় মাধুরী দীক্ষিত অভিনীত দেবদাস ছবিটি। মাধুরী তখন কিংবদন্তি আর শিক্ষিকা যেন তারই প্রতিভূ। সঞ্জয় লীলা বানসালি পরিচালিত দেবদাস চলচ্চিত্রে ‘অসামান্য অভিনয়শৈলী ও অপূর্ব চরিত্র পরিস্ফুটনের দক্ষতা’র জন্য ফিল্মফেয়ার শ্রেষ্ঠ [পার্শ্ব] অভিনেত্রীর পুরস্কার লাভ করেন। চলচ্চিত্রটি আন্তর্জাতিকভাবেও মনোযোগ কাড়ে। কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয়। পরের বছর একটি চলচ্চিত্র ‘ম্যায় মাধুরী দীক্ষিত বাননা চাহতি হো’ তার নামে নির্মিত হয়। তিনি বলিউডের অন্যতম সেরা অভিনেত্রী। যে সময়ের কথা মনে করতে চেষ্টা করলেন নালক, তখন মাধুরী দীক্ষিত ভারতের সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক প্রাপ্ত অভিনেত্রী। তখন ও পরে মিলিয়ে সাতবার ফোর্বস প্রণীত ভারতের শত তারকার তালিকায় তার নাম লেখা হয়। ২০০৬ সালে দেবদাস ছবির সরোজ খানের কোরিওগ্রাফিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য অনেক দিন বাদে এ ক্যাটাগরিতে ফিল্মফেয়ার পুরস্কার দেওয়া হয়। নিউইয়র্ক টাইমসে একদা লেখা হয় ‘মাধুরী এখনও প্রাসঙ্গিক’। রিপোর্টে তার অভিনয়ের ‘উচ্চ প্রশংসাসহ গভীর মূল্যায়ন করা হয়েছিল।’ ছবির মতোই ব্যাপারগুলোর ক্লিপিংস নালকের চোখের সামনে ভাসতে থাকে সে মুহূর্তে। আরও যে ঘটনাটি মনে পড়ে প্রসঙ্গক্রমে তা হলো, বিশ-বাইশ বছরে স্বাপ্নিক, কল্পনা-কাতর, অতিশয় ভাবপ্রবণ বয়সে তার মনে এমনও এসেছিল শিক্ষিকার একাধিক বোনের কাউকে তিনি বিয়ে করবেন। যদিও কোনও দিনই কারও ছবি পর্যন্ত নালক দেখেননি। এ জন্য তিনি ঠিকমতো মন দিয়ে পড়াশোনা করবেন। ভালো বৃত্তি খুঁজে নিয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত হবেন। এরপর তো অনেক বছর কেটে গেছে। পেশাগত জীবনে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে বদলি হবার পর আবার শিক্ষিকা মাধুরীর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ ও যোগাযোগ বেড়েছে। কিন্তু সেই ভাবালুতা নির্বাসিত হয়েছে। এমনকি ঘুণাক্ষরেও অপরপক্ষ তা জানার আগেই। আর এখন তো সে ভাবনার কোনও অস্তিত্বই নেই।

ফোনটি রিসিভ করলেন নালক। সালাম দিলেন।

বাবা, কেমন আছো ?

থ্যাঙ্ক য়্যু। ভালো। ম্যাডাম, আপনি ?

তোমার ম্যাডাম তো ভালো নেই বাবা!

সরি ফর ইউ। কেন ম্যাডাম ? কী হয়েছে ?

আমার পেছনে যড়যন্ত্রকারীরা কাজ করছে। আমাকে বিপদে ফেলতে চায়, স্যোশাল সায়েন্স রিভিউ জার্নালে আমার একটা জয়েন্ট আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। সেটা নিয়ে প্লেজারিজমের অভিযোগ তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে।

ম্যাডাম, আরেকটু বিস্তারিত যদি বলতেন কাইন্ডলি, বুঝতে আরও সুবিধার জন্য।

বাবা, আমি আর আমার এক স্টুডেন্ট, এখন সে-ও ঢাকা ইউনিভার্সিটির টিচার। আমাদের একটি যৌথ আর্টিকেল ছাপা হয়েছে। সেখানে রেফারেন্স উল্লেখ করার সতর্কতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। তুমি তো জানো, মধ্যে আমি একটানা দেশের বাইরে ছিলাম। ইউএসএ-তে। আমার বোনের হাসবেন্ডের আনকিওর‌্যাবল রেয়ার ডিজিজ ডিটেকটেড হয়। তখন অনেক দিন আমাদের ওখানে থাকতে হয়, ওদের পাশে…

এটুকু শোনার পর নালকের হঠাৎই বুকটা কেঁপে ওঠে। প্রথম জীবনের কল্পনা-কাতরতার কোনও অস্তিত্ব না থাকলেও, এখন তার হঠাৎই মনে হয় রুগ্্ণ ব্যক্তিটি তো সে-ও হতে পারত। ম্যাডাম বলে চলেন

… মারজুক, আই মিন আমার এক্স স্টুডেন্ট, এখনকার কলিগ, মূলত আর্টিকেলটা ডেভেলপ করে। আমাকে মাঝেমধ্যে ইনফর্মড রাখত। আমি কিছু এফোর্ড দিই। কিন্তু পারিবারিক এই বড় ক্রাইসিসের জন্য আমার খুব সময় দেওয়া, সব খুঁটিয়ে দেখা সম্ভব ছিল না। এখানে মিশেল ফুকোর কিছু রেফারেন্সের প্রপার সুপারক্রিপশন করা হয়নি। কমপ্রিহেনসিভলি বোঝা যায় যে সেগুলো কোটেশনই। রাইটারদের প্রোডিউস না। কিন্তু অ্যাপ্রোপ্রিয়েটলি সাইটেশন হয়নি।

খুবই দুঃখজনক, ম্যাডাম।

শোনো বাবা, আরেকটু বলি। এখন ইউনিভার্সিটি ম্যানেজমেন্টে পরিবর্তন আসছে। আমরা ম্যাস কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের অ্যালামনাই আর আগের ভিসি স্যারকে আউট অ্যান্ড আউট রেসপেক্ট করতাম। অউন করতাম লাইক এনিথিং। তাই আমাদের বিপদে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে, সেটা বেশ বুঝতে পারছি।

আই সি। রিয়েলি রিডিকুলাস।

আর মারজুকেরও দোষ আছে। বরাবরই ওর একটু অডাসিটি বেশি। চুপচাপ থাকতে পারলে, একটু সাবমিসিভ হলে হতো। না সে তা নয়। যে কারণে অনেকের টার্গেট সে। সেই সঙ্গে আমাকে জড়িয়ে নিছে।

এ পর্যন্ত বলতে বলতেই শিক্ষিকা মাধুরী উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা আর সম্মানহানির আশঙ্কায় আক্ষরিকভাবেই কেঁদে ফেলেন। তখন নালকের এক অবর্ণনীয় কাতর অবস্থা। এটা বর্ণনাতীত বলে বোঝানোর জন্য উপমা আশ্রয়ী হওয়াই সহজ। ভারতবর্ষের প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী, যিনি বেলচির মতো দুর্গম অঞ্চলে, যেখানে গাড়ি চলে না, বিকল্পে হাতির পিঠে চড়ে তার প্রৌঢ় বয়সে পৌঁছেছিলেন। সেই তিনি যদি কংগ্রেসের সাধারণ এক রাজনৈতিক কর্মীর সামনে নিজের কোনও অসহায়ত্বের কারণে হু হু করে কেঁদে দিতেন, তাহলে যেমন দাঁড়াত ব্যাপারটা, এ ক্ষেত্রেও তার চেয়ে ভিন্ন কিছু হলো না। ফোন রাখার পরও অনেকক্ষণ লাগল নালকের স্বাভাবিক বোধ করতে। এরপর সময় নষ্ট না করে কমনসেন্স থেকে তিনি তার এক বন্ধুকে ফোন করলেন, যিনি ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডে কর্মরত আছেন। তাকে মোটামুটি বিষয়টি জানিয়ে অনুরোধ করলেন গোয়েন্দা সংস্থাকে বিষয়টিতে একটু নজর রাখতে। যেহেতু, শিক্ষিকা মাধুরী বলেছিলেন ষড়যন্ত্রের চেষ্টা হচ্ছে। অনুরোধের সমর্থনে বললেন টিভি শোতে তিনি যেহেতু প্রোএস্টাবলিশমেন্ট রোলে, তাকে হয়রানি করা হেলদি প্র্যাকটিস হবে না।

ওই দিনই তিনি দেখা করলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সিনিয়র অধ্যাপকের সঙ্গে। যতই তার ব্যক্তিগত সেন্টিমেন্ট থাকুক, বিগত সাত-আট বছরে তিনি সিজনড আমলার চরিত্র পরিগ্রহ করেছেন। আমলারা জেনে, বুঝে, দেখে, যাচাই করে, পুনরায় সার্বিক বিচার করেই কাজ করেন। এতে দীর্ঘসূত্রতার সমস্যা অবশ্য হয়। তবে নগণ্য ব্যতিক্রম ছাড়া সিদ্ধান্ত বদল বা ভুল প্রমাণিত করা যায় না, অন্তত কাগজে-কলমে। তারই একজন প্রিয় শিক্ষক, এখনকার বয়োজ্যেষ্ঠ অধ্যাপক, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য তাকে যা বললেন তা এ রকমই, ইমিডিয়েট পাস্ট ভিসি স্যারকে হেয় করাটাই এখনকার নয়া প্রশাসনের কাজ। দেখো এরা দুজনই স্যারের বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী। স্যারের সঙ্গে ক্লোজ। স্যারের পক্ষে তো মারজুক খুবই ভোকাল। ওদের এ প্রবন্ধে যদি অপরাধ হয়, তাহলে তো আরও অনেক কিছু আরও বড় বড় অপরাধ। তার বিচার করতে হয় এসবেরও আগে। ব্যাপারটা আমি খুঁটিয়ে দেখেছি। ওই আপত্তির অংশগুলো একবারও বলা হয়নি ওদের প্রোডিউসড। লেখার ধরনেও বোঝা যায়, এগুলো ওদের কথা না, তবে উপস্থাপনা দুর্বল। কোথায় পেল, কার উদ্ধৃতি, আর কোন লিটারেচারের―এসব দেয়নি। এসব দিলে বরং যে উদ্দেশ্যে আর্টিকেলটা করা, তার আরও কাছাকাছি চলে যেতে সুবিধা হতো। প্রমোশন পেতে তো ওজনদার জার্নালে লেখা প্রকাশ হতে হয়, তুমি জানোই। জার্নালের এডিটর থাকেন, এডিটরিয়াল প্যানেল থাকেন। আমি বলব, দোষ বরং পিআর যারা থাকেন তাদের বেশি। তারা কি পরীক্ষা করে দেখেননি! তখনই তো একজনকে ডেকে গ্যাপটি রিপেয়ার করানো যেত। না হয় আরেকজন দেশে ছিল না। তাতে কী ? খালি তিনটা কাজ। নতুন করে সুপারক্রিপশন বা সাবক্রিপশন বসানো, পূর্বের যে ক্রনোলজি তা ভেঙে নতুন করে সঠিকভাবে পাতানো আর বিবলিওগ্রাফিতে সন্নিবেশন। এখন কী হলো ? সামান্য ব্যাপারে গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে কেউ কথা বলতে ছাড়ছে না। ব্যাপারটা তো কারও জন্য ভালো হলো বলে আমি মনে করি না।

ফুলার রোড ধরে রিকশায় ফিরে আসছিলেন নালক। এ পথটিকে তার তপোবন বলে মনে হয়। এখন গাছগাছালি একটু বেশিই কমে গেছে। ফিরতে ফিরতে মনে পড়ে নালক যখন পড়তেন রেসিডেনসিয়াল একটি স্কুলে তখনকার একটি ঘটনা। প্রসঙ্গ এলেই বারবার মনে পড়ে তার এ ব্যাপারটি। রেসিডেনসিয়াল স্কুলিংয়ে সিনিয়ররা একটু কর্তৃত্বপরায়ণই হয় কাঠামোর জন্য। নালকদের সময়ে একজন বয়োকনিষ্ঠ ছাত্র ছিল সুমন নামে। এখন পেশাজীবনে খুবই ভালো করছেন, আকর্ষণীয় ডেস্কে তার বর্তমান পোস্টিং। তারা সুমন অবাধ্যতা করছে মনে করে একবার দৈনিক পত্রিকার খেলা বা বিনোদন পাতা সংগ্রহে রাখাকে পর্নোগ্রাফি রাখার দায়ে ফাঁসিয়ে দেন। খেলার পাতায় বিদেশিনী টেনিস তারকা বা দৌড়বিদদের খেলার পোশাকই ব্যাপারটাকে পর্নোগ্রাফির দিকে নিয়ে যাওয়ার ভিত্তি ছিল। বিষয়টি মনে করে নিজেই হেসে ফেলেন। রাষ্ট্রও কখনও কখনও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে মৃত্যুদণ্ড পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে নিকট ও দূর ইতিহাসে। কর্নেল তাহেরের ফাঁসির আদেশের কথা মনে পড়ে। তার এক ভাই এই বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন শিক্ষক। ভাবতে ভাবতে দীর্ঘ নিশ্বাস নির্গত করেন হতাশাভরা বুকে।

এর কিছুদিন পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে নিয়ে যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, তাই ঘটিয়ে বসল। সাততাড়াতাড়ি সিন্ডিকেট সভা করে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হলো। তথ্যসূত্র উল্লেখ না করাকে মোটা দাগে চৌর্যবৃত্তি বলা হলো। গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়ে পড়ল বিষয়টি। মানসম্মানের জলাঞ্জলি হয়ে গেল। এখন আর চাপিয়ে রাখা নয়, আত্মপক্ষ সমর্থন আর লড়াই অনিবার্য হয়ে গেল। নালক তার মন্ত্রণালয়ের উচ্চশিক্ষা ডেস্কে বিষয়টি সামাল দিতে প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন সত্য। কিন্তু কোনও ফল এনে দিতে পারলেন না। বিষয়টি এখন পাবলিক। আলোচনা- সমালোচনায় মুখর সবাই। সোশ্যাল মিডিয়ায় নানা মুনির নানা মত নজরে এল। অধিকাংশই নেতিবাচক, সমালোচনায় মুখর; আরও দুঃখজনক ব্যাপার হলো শ্লেষাত্মকও। বিশ্ববিদ্যালয় এরই মধ্যে পদের অবনমন ও পরবর্তী পদোন্নতি বাধ্যতামূলক বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত প্রদান করল। কিন্তু শিক্ষিকা মাধুরী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ ১৯৭৩ ঘেঁটে জানলেন একটি এখতিয়ারবহির্ভূত শাস্তি সিন্ডিকেট সভায় প্রদান করা হয়েছে। তার আইনজীবীও একই কথা বললেন। অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে শিক্ষিকা মাধুরী আদালতের শরণাপন্ন হলেন, রিট করলেন। কিন্তু আইনের আশ্রয় নিতে নিতে বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত হয়ে গেল। এ সময়ে চতুর্দিকের আলাপ-আলোচনা, বক্রোক্তি, কটুকথা, কটাক্ষের বন্যা হলো। যা অসহনীয় ঠেকতে লাগল শিক্ষিকা মাধুরীর। নানাজন নানা বুদ্ধি দিতে লাগলেন। শিক্ষক-রাজনীতির বিবদমান পক্ষগুলো তাকে শিকার বানাতে চাইল নিজের নিজের মতো করে। ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের মতোই বিবদমানেরা সুযোগ নিতে চাইল। কেউ কেউ ব্যবস্থা গ্রহণকারী কর্তৃপক্ষকে আরও উসকে দিল। কেউ শিক্ষিকা মাধুরীকে নানাভাবে উত্তেজিত করল সংবাদ সম্মেলন বা সোশ্যাল মিডিয়ায় সরব-সোচ্চার হতে। কেউ মামলা দায়েরের পক্ষে বললেন, কেউ বিপক্ষে বললেন। এসব চক্রে প্রকৃত প্রতিকার খুঁজে পাওয়া দুরূহ হয়ে গেল। সিদ্ধান্ত গ্রহণ দীর্ঘায়িত হতে লাগল। সমাধান-ভাবনা অনেকটাই তিরোহিত হয়ে গেল। আদালতের আদেশে হৃত সম্মান ফিরে পাওয়ার মোক্ষম কাজটি না করে টিপ্পনীকারী অথবা তড়িঘড়ি শাস্তি প্রদানে সন্দেহভাজন মদদদাতাদের মোকাবিলায় কিছু সময় নষ্ট হলো। অপ্রয়োজনীয় প্রতি-আক্রমণে সমালোচকেরা আরও বেশি প্রস্তুতকৃত ক্ষেত্র পেয়ে গেল। সমালোচনার প্রকোপ বাড়তে লাগল দায়িত্বহীনভাবে। সৌজন্যর তোয়াক্কা করলেন না কেউই।

একই বিভাগের অধ্যাপক রেফাঈ আবিদ। তার সঙ্গে ছাত্রজীবনে ভালোই ঘনিষ্ঠতা ছিল। পরে অবশ্য কাটাকাটি হয়ে গেছে। বিয়ে পর্যন্ত যায়নি। বর্ষার নতুন পানিতে গা ভেজাতে খুবই আনন্দ হতো ছাত্রজীবনে শিক্ষিকা মাধুরীর। কলাভবন এলাকায় বৃষ্টিস্নাত হতে এ যুগলকে দেখা তাই খুবই নৈমিত্তিক ঘটনা ছিল। অধ্যাপক রেফাঈ আবিদ তার ঘনিষ্ঠদের নিকট খুবই কড়া অভিমত ব্যক্ত করলেন। ‘বহুদিন থেকেই আমি ওকে চিনি। এক নম্বরের পল্টিবাজ। মারজুককে বিপদে ফেলে ঠিক কেটে পড়বে ও। নিজের গায়ে দাগ লাগতেই দেবে না। নানারকম নাটক চলবে। তারপর ধুলা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াবে। নতুন প্রশাসনের সঙ্গে হাত মেলাতে ওর মুহূর্ত লাগবে না। ও ঠিক সব ম্যানেজ করে বেরিয়ে যেতে পারবে। মারজুকটাই বিপদে পড়ে থাকবে, তোমরা দেখো।’ আরও বললেন, ‘ও হলো বেড়ালের মতো ধূর্ত। চৌর্যবৃত্তি করে গৃহস্থের ঘরে বেড়াল যেমন বাঁ হাত দিয়ে মুখটা সুন্দরভাবে মুছে নেয়, ও তা-ই করতে পারে।’ এর মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় বহু কটু কথা লেখা হলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় যারা জীবনে একসময় কৃতকার্য হয়নি, তাদের অবচেতনে জমে থাকা ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটে গেল এই ঘটনায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেও শিক্ষকতার সুযোগ বা ভালো ফল হয়নি এমন অনেকেই কুশ্রী মতামত লিখলেন নিজ নিজ অ্যাকাউন্ট থেকে, তোমার মন কী বলে, ফেসবুকের এমন অপশনে। ছাত্রছাত্রীদের যাদের সঙ্গে প্রথম জীবনে অনিয়ন্ত্রিত আচরণ করেছিলেন, তারাও উগরে দিলেন পুরানো রাগ। অ্যালামনাইয়ের সক্রিয় সদস্য হলেও শিক্ষিকা মাধুরীর এমন সংকটাপন্ন অবস্থায় তখনই কিছু না বলার চিরায়ত সিদ্ধান্তে সকলে অটল থাকলেন। শিক্ষক লাউঞ্জে নির্দয় আলোচনা হলো, শিক্ষক ক্লাবে তুমুল সমালোচনা হতে লাগল। যাও-বা সহানুভূতিমূলক আলোচনা হলো, তাতে কটাক্ষ থেকেই গেল। কেউ কেউ আপাতসহমর্মী হয়ে বললেন, একবার শিক্ষক হওয়ার পর অধিকাংশই আর পড়াশোনা, গবেষণা, জ্ঞানচর্চার ধার ধারেন না। অনেকের ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী দুজনই শিক্ষকতায় বা গবেষণাকর্মে যুক্ত হলে একজনের শ্রমে অপরজন উতরে যেতেই পারেন। শিক্ষিকা মাধুরীর সেই পথ বন্ধ হওয়ায় বিপদটা বেশিই হয়ে গেল। এমন সব কথা।

এরই মধ্যে একটি প্রেস কনফারেন্স ডেকে শিক্ষিকা মাধুরী তার অবস্থান ব্যাখ্যা করলেন। টিভি ক্যামেরার সামনে একপর্যায়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। কান্নাজড়িত কণ্ঠেই বলে গেলেন―‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার আগে নিজেদের দিকটা আরও ভালো করে দেখতে হতো। আমার প্রবন্ধ প্লেজারিজমের দায়ে সমালোচিত হলে অনেকের কাজই (লেখনী) প্রশ্নমুক্ত হতে পারে না।’ এ প্রেস কনফারেন্সের খবর প্রচারিত হতেই নানা কদর্য মন্তব্যে ভেসে গেল সোশ্যাল মিডিয়া। কুম্ভীরাশ্রু দেখে মন গলল না তাও, ব্যাঙের সর্দি হয় নাকি, এক বুড়ি অপর বুড়িকে বলছেন নানি কিংবা ছিদ্রান্বেষণ নিয়ে সুচ ও ঝাঁঝরের অতিপরিচিত প্রবাদটি ভাইরাল মতো হয়ে গেল। একই সময়ে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনার জেরে একজন মানী সাংবাদিক একটি হেঁয়ালি লিখলেন তাঁর স্ট্যাটাসে। এটি চোখে পড়তেই শিক্ষিকা মাধুরী রাগে-ক্ষোভে ফেটে প্রতি-উত্তর করে পাল্টা স্ট্যাটাস দিলেন। কিছুদিন ধরেই তিনি শিক্ষকতার প্রথম জীবনের মতো আত্মনিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছেন। যদিও সংকটেই আমাদের চিত্তের প্রকৃত পরিচয় মেলে। অধিকাংশই আমরা সংকটমুখে বেসামাল, দিশাহারা হয়ে পড়ি। শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আবার ছিলেন এর সম্পূর্ণ বিপরীত। তিনি যত বেশি সংকটে থাকতেন, তত ভালো নেতৃত্ব, সিদ্ধান্ত এবং রাজনৈতিক পারদর্শিতা দেখাতে পারতেন। তেমন তুলনাবিরল ব্যক্তিত্ব ছিলেন না শিক্ষিকা মাধুরী। তিনি আটপৌরে মানুষের মতোই হাসেন, কাঁদেন কিংবা ভালোবাসেন―তেমন প্রকৃতির। এসব টিকা-টিপ্পনী সইতে না পেরে আত্মহননের চেষ্টা করে বসলেন। এমন ত্রিশঙ্কু অবস্থা তার গোটা পরিবারকেই বিপদাপন্ন করে তুলল। সকলের সহায়তা কামনা করে পরিবারের পক্ষ থেকে নেটিজেনদের কাছে সহানুভূতি ও সুবিবেচনা কামনা করা হলো। তার বাবার একটি আবেগমথিত সম্বোধন তখন মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। তিনি তার সকলের সহযোগিতা চেয়ে দেওয়া স্ট্যাটাসে লিখলেন, আমার ‘দুর্গেশনন্দিনী’কে আপনারা স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে দিন। জীবনে ফিরতে দিন। দুর্গেশনন্দিনী মানে রাজকন্যা। সকল কন্যাই তো পিতার কাছে রাজকন্যা। এই সর্বজনীন উপলব্ধি থেকে প্রকাশ্য সমালোচনার তোড় কমে এল সেদিন থেকেই।

শিক্ষিকা মাধুরী গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, মিডিয়ায় অতি পরিচিত মুখ। গণমাধ্যমসংশ্লিষ্টরাও নানা রকম টিপ্পনী কাটলেন। আড্ডায়, আলাপে, ঘরোয়া কি অনানুষ্ঠানিক আলাপে কটাক্ষ করলেন তার অনুপস্থিতিতেই। জাতীয় প্রেসক্লাবের সবুজ পরিচর্যাকৃত ঘাসাবৃত লনে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে নানখাতাই বিস্কুটে কামড় বসিয়ে চিবানোর ফাঁকে ফাঁকে আলাপ চলল তার বিষয়ে ওঠা অভিযোগটি নিয়ে। তিনি গত প্রেসক্লাব নির্বাচনে এক প্রার্থীর জোর প্রচারে নেমেছিলেন। ভোটের দিনেও অনেক তৎপর ছিলেন। তার সমর্থিত প্রার্থী প্রথম মহিলা সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছেন কিন্তু প্রতিপক্ষের রাগ ছিল। তারা ছাড়বেন কেন এবার ? সৌন্দর্যের সঙ্গে মেধার দ্বন্দ¦ নেই, বিত্তের সঙ্গে পাণ্ডিত্যের বিরোধ কিছু নেই, সৃজনশীলতার সঙ্গে বিলাসী জীবনের সংঘাত নেই, গ্ল্যামারের সঙ্গে জ্ঞানচর্চার বৈপরীত্য নেই। তবু সেসব ইঙ্গিত করেই শিক্ষিকা মাধুরীকে ধুয়ে দেওয়া হলো। সেফোরার প্রসাধনী, পেনহালিগনের সুগন্ধি, লুই ভুঁইটন বা এইনারের ব্যাগ, প্ল্যাটিনামের অলঙ্কার, বহুমূল্য সিফনের গজ কাপড় কিনে শাড়ি হিসেবে পরিধান, লুব্রিডার্মের লোশন, ইউসেরিয়নের ফেসওয়াশ, র‌্যাডোর ঘড়ি কেন তিনি ব্যবহার করেন, তা নিয়ে অনেকেই আপত্তি তুললেন। এসব করলে পড়ানো, গবেষণা, শিক্ষা কার্যক্রমে মন থাকবে কেন―থাকার কথাই না―এমনই মত দিলেন প্রায় সবাই। তার কেশবিন্যাস করেন একজন ফিলিপিনো বিউটিশিয়ান। কার্লি হেয়ার করায় ঢাকায় এক নম্বর হাত, সে বিদেশিনীরই। এ কথা যারা জানতেন, তারা এ সমালোচনা অনায়াসেই আরও উসকে দিলেন। শিক্ষিকা মাধুরী হৃষ্টচিত্তে একদিন কোনও এক গণমাধ্যমের মহিলা সহকর্মীকে বলেছিলেন, নীতা আম্বানি যে ‘অ্যাকোয়া ডি ক্রিস্টালো ট্রিবিউটো আ সদিগ্লিয়ানি’ বহুমূল্য (অর্ধকোটি টাকা মূল্যের বোতল) পানি পান করেন, তা অত্যন্ত স্বাস্থ্যকর। খনিজ উপাদান সমৃদ্ধ। শিক্ষিকার সুপ্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি স্পাউজ তাকে কোনও এক সুবিধাজনক সময়ে এ পানি একবারের জন্য হলেও পান করাতে চান। এ ব্র্যান্ডের সবচেয়ে স্বল্প মূল্য বোতলের দাম বাইশ হাজার টাকা। খুশি খুশি মনে এমন গল্প অসতীর্থদের সঙ্গে করাটা তার কালই হয়েছিল। তিনি এ সংকটের আগে সে কথা ঘুণাক্ষরে বোঝেননি। তার বলা সরলোক্তি আজ তারই বিরুদ্ধে সবচেয়ে শানিত মুখাস্ত্র হয়ে এল।

কেউ কেউ কটাক্ষ করে বললেন, ‘ওরা সরকারি কলোনিতে থাকত। কলোনির জীবন কেমন তো জানোই।’ এসব ছিল অকারণ ও যুক্তিবিবর্জিত বিষোদ্গার। এর অন্যচিত্রও আছে। যারা অপরাপর কেতাদুরস্তদের পছন্দ করতেন না, তারা শিক্ষিকা মাধুরীর পক্ষ নিলেন। তাদের হিসাব হলো, এই সংকট শিক্ষিকা মাধুরী কাটিয়ে উঠতে পারলেই অপছন্দনীয়রা মুষড়ে পড়বে। এতেই আপনাআপনি কঠিন শিক্ষা পাবে। আবার একটি ধারণা ছিল, শিক্ষিকা মাধুরী একাগ্র মনোযোগ লাভের জন্য আকাক্সক্ষী। অন্যদের সঙ্গে অনুষ্ঠানে মনোযোগ বা মুখ্য আতিথ্য ভাগ করতে হলে, সেসব দাওয়াতে যোগদানে উৎসাহ পান না তিনি। বলা যায় […] রুশদি সিন্ড্র্রম আছে তার। সবের বেলায়ই তিনি এক নম্বরই থাকতে চান। মনোযোগ লাভ কখনও ভাগ করতে চান না। একজন আইন পেশার নারী লক্ষ করলেন, তার স্বামী শিক্ষিকা মাধুরীকে নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত। কিন্তু তার স্বামী অপরাপর সুপ্রতিষ্ঠিত নারীদেরও কৃতিত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। আইনজীবী ভদ্রমহিলার মনে হলো, শিক্ষিকা মাধুরী এই বিপদ কাটিয়ে উঠতে পারলে তার উইমেন এমপাওয়ারমেন্টের একনিষ্ঠ সমর্থক স্বামীর আরও অনেক মহিলাকে প্রশংসা করার ‘বদ্গুণ’ কাটিয়ে দিতে পারবেন। কারণ, একসঙ্গে অনেককে অ্যাডমায়ার করা শিক্ষিকা মাধুরী টলারেট করবেন না নিশ্চয়। তিনি কায়মনোভাবে শিক্ষিকা মাধুরীর উদ্ধার চাইলেন। একজন শিক্ষার্থী শিক্ষিকা মাধুরীর কাছ থেকে ইনকোর্স পরীক্ষার প্রয়োজনে একটি বই ধার নিয়েছিলেন সাংবাদিক সায়মন্ড ড্রিংয়ের। সায়মন ড্রিং তার দীর্ঘ সাংবাদিকতা জীবনে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ২২টির মতো যুদ্ধ ও বিপ্লবের সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। একসময়ে সাংবাদিকতায় সহকর্মী থাকা অবস্থায় নিজের লেখা বইটি সায়মন ড্রিং উপহার দিয়েছিলেন শিক্ষিকাকে। বইটির নাম অন দ্য রোড অ্যাগেইন। পুস্তানিতে যে কথা লেখা ছিল, তার মোটামুটি বাংলা করলে দাঁড়ায়―‘যন্ত্রের মতো নিখুঁত, দেবীর মতো পারঙ্গম, অশরীরীর মতো রহস্যময় আমার সহকর্মীকে।’ উপহারপত্রের এ লেখা ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই দেখেছিল। তারা এ নিয়ে আলোচনাও করেছিল কয়েকবার। তাদের জানার সঙ্গে তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষের বক্তব্য মেলে না একদমই। এটা অনেক শিক্ষার্থীকেই ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা ভাবে, আজ ভারতবর্ষে মাধুরী দীক্ষিতের অসম্মান হলে কত তীব্রই না প্রতিবাদ হতো। কোভিড-১৯ এ শিক্ষা কার্যক্রম স্থগিত থাকায় তারা সোশ্যাল মিডিয়া ছাড়া কোথাও তাদের মনের কথা জানাতে পারছে না। প্রয়োজনীয় প্রতিবাদে সরব হতে পারছে না। একজন ছাত্র স্ট্যাটাসে লিখলেন :

‘আজ দুপুরে ঘুমাইয়া পড়ছিলাম। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাকেরে স্বপ্নে দেখলাম। স্যারে কইলেন, প্রশাসন অন্য হাতে থাকলে আপনের শিক্ষকের এমন নাজেহাল হইতে হয় না। যে অন্যায় রিলেটিভ তা পুরোপুরি অন্যায় না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে অনেকগুলান মামলা লড়ছি ব্রোহীর [এ. কে ব্রোহী, তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রখ্যাত আইনজীবী] মতো ল’ইয়ার লইয়া। সারা জীবন লেকচারার থেইক্যা উপরে উঠি নাই। কি হইছে তাতে ? তারে আপনেরা বুঝাইয়া কন।’ এক চির দুষ্টুমতি সাবেক ছাত্র তার রাজু আহমেদ আইডি থেকে তৎক্ষণাৎ কমেন্ট করেন, ‘রাজ্জাক স্যার মারজুক নিয়া কিছু কন নাই ?’

সিনিয়র সাংবাদিকেরা অবশ্যি শিক্ষিকা মাধুরীর প্রশংসাই করেন। তারা তার কাজেও সন্তুষ্ট বলেই মনে হয়। তাকে কাজ বোঝালে সহজে এঙ্গেলটি বুঝতে পারেন। খুব দ্রুত কাজ ম্যানেজ করার সক্ষমতা রাখেন। একটি রিপোর্ট মোটামুটি সময়ের মধ্যে প্রস্তুত করতে পারেন। যতই খটমট বিষয়ে হোক না কেন। টাইম ম্যানেজমেন্ট তার ভালো। অধিকন্তু ভালোই সময়ানুগভাবে চলেন তিনি। সিনিয়রদের যা না, তা সমালোচনা করতে বয়স, অবস্থা ও আত্মসম্মানের কারণে বাধে। তা ছাড়া তারা হরে-দরে দায়িত্বহীন সুইপিং কমেন্ট করবেন না। কাজেই কদর্য সমালোচনায় তারা নেই। বরং তাদের অভিজ্ঞতার সঙ্গে শিক্ষিকা মাধুরীর বিরুদ্ধে রজ্জু বিভাগীয় মামলার বয়ান অসামঞ্জস্যই ঠেকে। আবার ইতোমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের দেওয়া শাস্তির ব্যাপারে অভিযুক্ত আদালতের দ্বারস্থ হওয়ায় বিষয়টি এখন সাবজুডিস। এই কারণে বা অজুহাতে সিনিয়র সাংবাদিকেরা প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানাতে বিরত থেকে গেলেন। তারা অবশ্য আরও একটি কৌণিক মূল্যায়ন নিয়ে নিজেরা আলাপ করলেন। নারী বলেই এত হয়রানি হচ্ছে তার। একই কারণে পক্ষ নিতেও অনেকে কুণ্ঠা করছেন। নালকের আরও মনে হলো, শিক্ষিকা মাধুরী সাংবাদিক হিসেবে সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। শিক্ষিকা মাধুরীর এ বিপর্যয়ে তারা কী ভাবছেন ? নালকের মনে হয় সমরেশ মজুমদারের যে লেখাজোখা তিনি পড়েছেন, তা থেকে তাকে প্রথাবিরোধী, প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি নতজানু নন একদমই এবং বিপ্লব-অন্তঃপ্রাণ বলে জেনেছেন। এই কর্তৃত্বপরায়ণতা, এখতিয়ারবহির্ভূত শাস্তি প্রদান, ব্যক্তিগত আক্রোশপ্রসূত অতিকঠোরতা তিনি কখনওই সমর্থন করবেন না বলে নালকের বিশ্বাস।

নালক শিক্ষাজীবনে জিতেন্দ্রনাথ বৈরাগী নামের শিক্ষকের কাছে সাধারণ গণিত প্রাইভেট পড়তেন। তিনি ছিলেন সৎসঙ্গ সভ্য ও ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অনুসারী। তিনি সাদা পোশাকের অনুরাগী ছিলেন। ব্যসনের শুভ্রতার মতো জীবনযাপনেও যতটা শুদ্ধাচার বজায় রাখা যায়, সে চেষ্টাই করতেন। লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ও ঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের অনুসারী। প্রতি বছরই বাংলাদেশের পাবনা জেলায় ঠাকুরের আশ্রমে বাৎসরিকে তিনি অংশ নিতে আসেন। ধর্মপ্রাণ মানুষ লেখক শীর্ষেন্দু। শুদ্ধতা আশ্রয়ী, শাস্ত্রমতে জীবনযাপন তার নিশ্চয়ই। পাপাচার, পরের অনিষ্ট বা অমঙ্গল ভাবনা কোনওক্রমেই মনে প্রশ্রয় পায় না, সে-ই স্বাভাবিক। তিনি শিক্ষিকা মাধুরীর প্রতি অন্যায় হলে খুবই ব্যথিত হবেন।

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, সাত পাকে বাঁধা চলচ্চিত্রে সুচিত্রা সেনের বিপরীতে আত্মসম্মান ও আদর্শিক জীবনযাপনের প্রকৃষ্টরূপে অভিনয় করেছিলেন। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরের চরিত্রই সিনেমাটিতে করেছিলেন সৌমিত্র। খবরটি জানলে তার হয়তো, সেই সাদাকালো সেলুলয়েড চিত্রিত চলচ্চিত্রটির কথা মনে পড়বে। তিনি সেখানে যেমন অনঢ়, অটল, অনাপোস থেকেছেন, মনে মনে হয়তো চাইবেন শিক্ষিকা মাধুরীও তার প্রতি কর্তৃপক্ষ অন্যায় করে থাকলে একই রকম ঋজুভাবে প্রোটেস্ট করবেন। নির্বিবাদে সব মেনে নেবেন না। আদালতে যাবেন। নিজের প্রতি হওয়া অন্যায়ের প্রতিবাদ জানাবেন। আত্মসম্মানের প্রশ্নে নতজানু হবেন না কোনওমতেই। অন্য বিড়ম্বনায়ও পড়তে হলো শিক্ষিকা মাধুরীকে। সরকারের প্রচার বিভাগে কর্মরত আসিফ কবীরকে একটি টিভি টক শোতে আমন্ত্রণ জানানো হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দশটি উদ্যোগ, যুগন্বয়ী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, মেগা প্রজেক্টগুলো নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেতে আবদার করলেন। তিনি সহ-আলোচক হিসেবে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক ও স্কাইপেতে লন্ডনপ্রবাসী সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংবাদিক ও বিখ্যাত গীতিকার আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানোর পরামর্শ দিলেন। টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ সরকারের যুগপূর্তির আলোচনা অনুষ্ঠানে এ প্রস্তাব সানন্দে গ্রহণ করলেন। কিন্তু অনুষ্ঠান বিভাগের প্রধান শিক্ষিকা মাধুরী চট করে সম্মতি দিলেন না। তিনি পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় নিলেন। তার সাংবাদিকতার মন তাৎক্ষণিক অনুমোদনে বাদ সাধল। তার মনে হলো, কিছু প্রতিবক্তব্যও থাকা উচিত। চিন্তা-ভাবনা করে দেখলেন, আলোচকদের দুজন খুব বস্তুনিষ্ঠতাবিবর্জিত বক্তব্য দেবেন না। অতএব অনুষ্ঠান প্রস্তাবনা অনুমোদন দিয়ে দিলেন। এই বিবেচনার জন্য সময় নেওয়ায় নিন্দুকেরা তাকে সরকারবিরোধী বলে প্রতিপন্ন করে এখানে-সেখানে কথা রটিয়ে দিতে কুণ্ঠা করল না। এই অপপ্রচার তার বস্তুনিষ্ঠতা ও নিরপেক্ষ সংবাদচিন্তার অহংকে তীব্রভাবে আহত করল।

একদিন শিক্ষিকা মাধুরীর এক সাবেক ছাত্রী মধুবন্তী হাজরা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে এলেন। তারই একটি কাজে। বিভাগের সাবেক হিসেবে নালকের কাছে সরাসরি গিয়ে হাজির হলেন। তার প্রয়োজনটি জানালেন। নিজের কাজ নিয়ে আলোচনার ফাঁকে ফাঁকে শিক্ষিকা মাধুরীর কথা উঠল। মধুবন্তীই প্রসঙ্গ তুললেন।

ম্যাডাম কিন্তু অন্য অনেকের চেয়ে অনেক ভালো। অন্যরা অনেকেই আছেন লেকচার টেকনিকে অত ভালো না, আবার স্টুডেন্ট-বান্ধবও নন। ম্যাডাম কিন্তু তেমন নন। তিনি স্টুডেন্টদের সঙ্গে চমৎকার ব্যবহার করেন।

তুমি লেকচার টেকনিক ভালো না বলে ঘুরিয়ে বলছো কেন ? আমাদের সময় তো আমরা বলতাম, স্যার পড়াইতে পারেন না।

ধরেন, তাই-ই বলছি।

কিন্তু জানো, এখন মনে হয় ব্যাপারটা পুরোপুরি সে রকম নয়। একটা তো দুর্ভাগ্য দু-একজনের বিষয়ে প্রিকনসেপ্ট দিয়ে দেওয়াই হয় অমুক জানেন-শোনেন কম। এতে করে শিক্ষার্থীরা ফিফটি অ্যাভোব মনোযোগ লস করে ক্লাসে ঢোকে। অনেকে আছেন ভাস্ট লেকচার দেন। অনেক শিক্ষকের ভয়েস লো হওয়ায় শোনা-বোঝাই মুশকিল হয়ে যায়। আমাদের একজন স্যার ছিলেন, খণ্ডকালীন। তিনি আফটার রিটায়ারমেন্ট আমাদের ১০৪ কোর্স নিতেন। আন্তর্জাতিক ও সাম্প্রতিক ঘটনাবলি। মূলত ছিলেন আইআর, ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনের ফ্যাকাল্টি। স্যার ক্লাসে বলতেন, এই সবাই শোনো, খুবই ইমপরটেন্ট। আমরা তো প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছি। স্যারের মুখের দিকে তাকিয়ে আছি চুপচাপ বসে। স্যার বললেন, যাক ভুলে গেছি এখন শোনো…।

[উভয়ের হাসি]

তাহলে ভাইয়া, রেমিডি কী ?

আমার তো মনে হয় লেকচারটা ছাত্রদের দিয়ে দিলেন রিটেন ফর্মে এক ক্লাস আগে। সবাই পড়ে আসবে। খটকা বিষয়ে ক্লাসে প্রশ্নোত্তর হবে। এরপর সম্ভাব্য প্রশ্নের একটা আইডিয়া শিক্ষক দিয়ে দেবেন। এই তো। আরও বেশি জনপ্রিয় হতে চাইলে ওই টপিকে পুরোনো বছরগুলোয় কত সালে কী প্রশ্ন এসেছে, সেটাও রিলেট করে বলে দিলেন।

আইডিয়াটা ভালো অবশ্যই। উঠি আজকে ভাইয়া। আমার ব্যাপারটা একটু দেখেন। আমি আগামী সপ্তাহে ফোন করব।

মানসিকভাবে ক্রমেই বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় শিক্ষিকা মাধুরী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুটির আবেদন করলেন। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট রুলসহ আদেশ দেন। প্রয়োজনীয় কিছু নথি ও প্রামাণিক দলিল তলব করেন। শিক্ষিকা মাধুরী দেশত্যাগ করার পর সামাজিক আলোচনা অনেকটাই ঝিমিয়ে আসে। উচ্চ আদালত লম্বা লম্বা বিরতি দিয়ে মামলা শুনানির তারিখ দিতে থাকে। সবার অলক্ষেই চলে যায় প্রায় ঘটনাটি। একমাত্র নালকের মাথায়ই থেকে যায় ব্যাপারটি। নালক প্রায়ই ভাবেন তার শিক্ষিকার অসম্মান, বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ে নানা রকম অসন্তুষ্টির আলোচনা, দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থা, শিক্ষণ পদ্ধতির ঘোরতর ত্রুটিসমূহ, শিক্ষা কার্যক্রমের নানা অসারতা আর দুর্বলতার কথা। শিশুবেলা থেকেই পর্যবেক্ষণে আসা নানা অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও প্রসঙ্গক্রমে মনে চলে আসে। নামকরা সরকারি স্কুলের শিক্ষকের ক্লাসে ঝিমানো, ছাত্রদের অবলীলায় তুই-তোকারি করা, প্রাইভেট না পড়লে অকারণে নম্বর কাটা …। মনে পড়ে প্রাথমিক শিক্ষাকালে গৃহশিক্ষক কিংবা অভিভাবক সকলেই বলতেন, অধিকাংশই যেটি লিখবে না, তুমি সেটি লিখলে ভালো নম্বর পাবে। কিন্তু কেন বেশি নম্বর পাব, বৈচিত্র্যের জন্যই তো, বিরল কাজ করে দেখাতে পারাই তো, সেটা বলতেন না। আফসোস হয় ইতিহাসের মতো একটি মজার ও প্রয়োজনীয় বিষয় পাঠদানের একঘেয়েমি আর তাগিদ তৈরির গাফিলতিতে কোনওদিনই অধিকাংশ ছাত্রছাত্রী ঠিকমতো পড়ল না। এসএসসি পর্যন্ত শিক্ষকেরা ক্লাসে ছাত্রের পিতৃপরিচয় বা পরিবারের প্রতিপত্তি ভরা ক্লাসে ডেকে ডেকে শুনে আচরণে তুমুল বৈষম্য করতেন। চরম পক্ষপাতিত্বমূলক আচরণ করে অন্যদের মন ছোট করে দিতেন। বুঝে বা না বুঝেই।

নালক ছাত্রজীবনে দেখেছে তার মেয়ে শিক্ষার্থী বন্ধুরা খেলাধুলা, রাজনীতি ও সাধারণ জ্ঞানচর্চায় অধিকাংশই খুব আগ্রহী নয়। এসব বিষয়ে খবর রাখতে বা পড়তে কোনও উৎসাহ দেখায় না বেশির ভাগই। খুবই খটোমটো মনে করে এড়িয়েই চলে তারা সাধ্যমতো। সৃজনশীল পাঠ্যক্রম বলতে যা বোঝায়, তা নিয়েও অকারণ ভীতি থাকে অনেকের। একটি বই পড়ে নিজের মতো সেটির মূল্যায়ন বা সমালোচনা লিখতে গেলে খুবই ঘাবড়ে থাকে। যদিও ব্যাপারটা এমন কিছু নয়, সেই-ই হয়তো পারবে সহজেই এবং সফলভাবেই একটু সাহস করলে আর কৌশলটা শিখতে পারলেই, তা-ও সে জানে না। অপারগতাটিই বরং সযত্নে লালন করে। আর কৌশলটাও এমন কিছু না। এই ধরা যাক, ছোট ছোট ভাগ করা, বইয়ে তো অনুচ্ছেদ বিভাজিত থাকেই। লেখক তো অনেকটাই সেরে দেন কাজটা। ছাঁচ বা ছকে ফেলা, লেখনীর তো কিছু স্তরবিন্যাস থাকেই, শুরু থেকে শেষ, সেভাবেই করা আর কি। নালকের আজকাল মনে হয়, ফাঁকিবাজ ছাত্রছাত্রীরা বানিয়ে লেখার নামে যে আপাত ফাঁকিবাজির কাজটি করত, নোট মুখস্থ না করে, সেটাই বরং বিরল প্রতিভা। বানিয়ে লেখার নামে নিজের বুঝ থেকে, নিজের ভাষায়, নিজের ভেতর থেকে উৎসারিত লেখাটিই বেশি সমাদৃত হওয়া উচিত।

খুব সাধারণ একটি কাজ হেডমাস্টার বরাবর আবেদন লেখা। নানা প্রয়োজনে সেটা লিখতেই হয়। অনেক বন্ধুকে নালক দেখেছে, যারা এ কাজ অজানা ভীতিতে অপরাপর বন্ধুকে ধরে করিয়ে নেয়। কাজটা যে জলের মতো সোজা, সেটা না জেনেই ছাত্রজীবন তারা শেষ করে। যারা বেশি নম্বর পেয়ে থাকে পরীক্ষায় তাদের অনেকেই সৃজনশীলতার ধার ধারে না। তৈরিকৃত বা সংগৃহীত অপরের হাতের নোট অনেক ত্যাগ স্বীকার করে মুখস্থ করে। এতে পরীক্ষায় ভালো প্রস্তুতির জন্য অনেকটা বেশি, গুছিয়ে ও বাছাইকৃত শব্দচয়নে লিখে আসতে পারে, সংগতভাবেই তারা ভালো করে। কিন্তু আড়ষ্টতা একটা রয়েই যায়। সেই দুর্বলতাই তাকে ভোগায়। নালক পরিদর্শনে গিয়ে এ-ও দেখেছে, মফস্সলের দুর্গম বা প্রান্তিক কোনও বেসরকারি কলেজে, যেখানে পাকা ভবন নেই, তেমনই সুবিধাবঞ্চিত এলাকায় এক-দুজন খুবই জানাশোনা, মার্জিত, পরিশীলিত ও সর্বোপরি তুলনাবিরল সংস্কৃতিমান শিক্ষক। যাদের ওরকম স্থানে থাকাটা বেমানান, থাকার কথাই নয়। পদ্ধতির ফেরে অন্য আর কোথাও কর্মসংস্থান হয়নি। নালক নিজেকে নিজে প্রশ্ন করেছেন, এটা কেন হয় ? অনেক ভেবে দেখেছেন, ওই শিক্ষকই প্রতিষ্ঠানটির প্রাণ, স্তম্ভ, বুনিয়াদ। আর এটাই বাংলাদেশের শক্তি। তাকে কেন্দ্র করেই যাবতীয় সাংগঠনিক, সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ড আবর্তিত হয়। তিনিই শহর বা মহানগরের সঙ্গে যোগসূত্র। তার সুবাদেই কোনও বইয়ের সর্বশেষ সংস্করণ, লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা, ভালো পত্রপত্রিকা, গবেষণাগারের যন্ত্র কিংবা গবেষণা সামগ্রী, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে কোনও এক সন্ধ্যায় সময়ের আলোচিত চলচ্চিত্রটি দেখানোর ব্যবস্থা হয়।

আবার পরক্ষণেই মনে হয় এ মূল্যায়ন সর্বাংশে সঠিক নয়। এর মূল্যও কেউ দেয় বলে মনে হয় না। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মহান শিক্ষক হাসান আজিজুল হকের কথা মনে পড়ে যখন। তাকে ভেবে কি কারও রাজধানীমুখিনতায় ভাটা পড়বে ? মেধার দৌড়ে তিনি কি অগ্রগামী নন ? আবার নালকের নিপুণ বাস্তবজ্ঞান বলে : হাসান আজিজুল হক তো একজন বিরল উদাহরণ মাত্র। তাহলে কি বিষয়টি এমন : প্রকৃতিই নিজ দায়িত্ব ও প্রয়োজনে এই বিকেন্দ্রীকরণ করে। সবাই এক বৃত্তি গ্রহণ করবেন না, সবাই একইভাবে ভাববেন না, সবাই একই অভিগম্যতা পাবেন না …।

তার মনে পড়ে, ছাত্রজীবনে সামাজিক গবেষণা পদ্ধতির পাঠ গ্রহণে মনোযোগী করতে তাদের শিক্ষক একটি কৌশলের আশ্রয় নেন। নম্বরের দায় না থাকলে শিক্ষার্থীরা যে অপেক্ষাকৃত খটোমটো, এ বিষয়টির নাম শুনেই এড়িয়ে যাবে, তিনি ভালোই জানতেন। তাই বললেন, তোমাদের টিউটরিয়াল হবে এ বিষয়ের ওপরে। ছোট ছোট দলে ভাগ করে একেকজন শিক্ষককে টিউটরিয়ালের দায়িত্ব দেওয়া হতো। এখানটাতে শিক্ষকের নিবিড় সান্নিধ্য পেত কলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা। সামাজিক গবেষণা পদ্ধতির শিক্ষক কোনও টিউটরিয়াল গ্রুপের শিক্ষকের সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনা করেননি। প্রয়োজন না থাকায়। তার উদ্দেশ্য ছিল শুধু একটা পদ্ধতির আওতায় পাঠবিমুখ শিক্ষার্থীদের মন ফেরানো। নম্বরের আকাক্সক্ষায় যদি তারা একটু মন দেয়। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষক-শিক্ষিকাই সামাজিক গবেষণা-পদ্ধতির পাঠ টিউটরিয়াল কাজে অধিভুক্ত করায় আপত্তি করলেন। এর গহিন কারণ ছিল, তাদেরও বিষয়টিতে অত দখল ছিল না। আজ ভাবতে ভাবতে নালকের মনে হলো, এসব ঘাটতির একটা বড় কারণ সাহসে ভর করে সচেষ্ট না হওয়া। ট্যাক্স নির্ধারণ, ট্যাক্স কর্তন, ব্যাংকিং, শেয়ার, বিট কয়েন, মাল্টি লেভেল মার্কেটিং, জিও পলিটিকস ইত্যাদিও যে সব তিনি খুব ভালো বোঝেন না। ব্যাপারগুলো কি এতই জটিল-কঠিন ? ওই-ই তো এক ব্যাপার। ভয়টা তুচ্ছ করে একটু মনোসংযোগ।

আবার এটাও ঠিক নয় যে সবাই সব জানবেন বা জানতে হবে। কিন্তু সংকটটা অন্যখানে। ছাত্রছাত্রীরা মনে করে, শিক্ষক সব জানবেন। অনেকে ওপরের ক্লাসে শিক্ষককে নানা হয়রানি ও উদ্দেশ্যমূলক প্রশ্ন করে। শিক্ষকেরাও অনেক সময়ই এত অনমনীয় হন যে কোনও ভালো বিকল্প বা তার শেখানো কাঠামোর বাইরে কিছু মানতেই চান না। ভুল না হলেও শূন্য ধরিয়ে দেন। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্য সেই স্বেচ্ছাচারিতা চলে না। সেখানে শিক্ষক-শিক্ষার্থী পরস্পরকে অ্যাসেসমেন্ট দেয়। কাজী স্যার তো এত দিনে স্ট্যামফোর্ডে সিধা হয়ে গেছেন, ভেবে নিজের মনেই হাসেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা নালক।

তবে যতই শিক্ষিকা মাধুরীকে নিষ্কলুষ ভাবুন, নালক ভালোই জানেন ঘটনাটি অনাকাক্সিক্ষত। কেউ আঙুল তুলতে মুহূর্তও-বা সামান্য দ্বিধান্বিত হবেন না। সমাজে এর প্রতিক্রিয়া ও কুপ্রভাব সুদূরপ্রসারী। ফাঁকতালে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল্যায়ন ও পরীক্ষা পদ্ধতি নিয়ে অনেক কথা হবে। সামনে চলে আসবে সূক্ষ্ম থেকে স্থূল পক্ষপাতিত্বের নানা পর্যায়ের আলোচনা। নম্বর বৈষম্য বা বঞ্চনার বেদনা বুক ফুঁড়ে উঠবে অনেকের। আবার এ-ও ঠিক যে ছাত্রজীবনে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রীই নানা বাস্তবতায় জড়িয়ে একইভাবে সারা জীবন নিজেকে শানিত রাখতে পারেন না। আবার পরীক্ষায় যা আসবে, মানে যা তোমায় প্রশ্ন করা হলো, তার ঠিকঠাক জবাব দিতে পারলেই তো হলো। এখন জবাবদাতা আর কী জানেন না, সেটা তো বোঝার তেমন কোনও গ্রাহ্য উপায় নেই। যিনি পরীক্ষার্থী, সিলেবাস দেখে প্রস্তুত হচ্ছেন, তার কর্তব্য তো কেবল পরীক্ষার প্রস্তুতিই অগ্রাধিকারে রাখা। কাজেই এসব নিয়ে অন্তহীন তর্কে জড়ানোর ফলাফল দিন শেষে শূন্য। নালক নিজেকে প্রবোধ দেন। তবে শিক্ষকদের একটি বিবেচনা জ্ঞান সচকিত রাখা দরকার সার্বক্ষণিক। তা হলো তারা যেমন শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন করেন, শিক্ষার্থীরাও কিন্তু তাদের শিক্ষকের কার্যক্রম দেখে। আজ তারা নম্বর আর শেখার জন্য শিক্ষকের মুখাপেক্ষী বলে চরম উদাসীনতা, হেলাফেলা কিংবা অন্যায্য অবিচার করবেন শিক্ষার্থীদের প্রতি, সেটা বড় দাগে অন্যায়। শিক্ষার্থীরা পরিস্থিতির মুখে নানা অবিচার মানলেও, বাকি জীবনব্যাপী যখন ছাত্রজীবনকে ফিরে দেখবে, তখন নিরুপায় হয়ে নতজানু থাকবে না। নালকও যেমন কাজী স্যারকে অন্যায্য অবিচারের জন্য মনের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে রেখেছেন আজ অবধি। তিনি তার পছন্দের শিক্ষার্থীদের আনসিন প্রশ্নের উত্তর পর্যন্ত পরীক্ষার হলে বলে দিয়েছেন, এমন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীও আছে ভূরি ভূরি। আর কাজী স্যারের কোর্সে আনসিন প্রশ্নের উত্তরের মানদণ্ড হলো তার সঠিক মনে হয় কি হয় না। ভদ্রতা আর বিনয়ের বরপুত্র নালক এ জন্য তার নাম দিয়েছিলেন দ্রোণাচার্য। এতটুকু ভেবে নালক ঠিক করেন, এ নিয়ে আর প্রাণান্ত হয়ে লাভ কি ?

পৃথিবীর উচ্চশিক্ষার পুণ্যভূমি বোস্টনে প্রায় স্থায়ীভাবে থাকছেন শিক্ষিকা মাধুরী। বিদ্যার্জনের পীঠস্থান এ শহরে ক্রমেই স্থায়ী হয়ে ব্যক্তিগতভাবে হয়তো লাভবান হবেন শিক্ষিকা মাধুরী। কিন্তু নালকের মাথায় আসা শিক্ষণ সংকটে তিনি আর প্রত্যক্ষ কোনও অবদান রাখতে পারবেন না। এ জন্য দায়ী কে ? শিক্ষাব্যবস্থার দুষ্টচক্র না শিক্ষিকা মাধুরীর নিজের মতো ভালো থাকতে চাওয়া। রেফাঈ আবিদ যে ক্ষুদ্রস্বার্থবাদিতার দায় দেন, তাই কি সর্বৈব সত্য ? তা নিরূপণ করা একদম সহজ নয়। শিক্ষার শহর বোস্টনে থাকতে থাকতেই বিশ্ববিদ্যালয় চাকরিতে ইস্তফা দিলেন ইমেইল পাঠিয়ে শিক্ষিকা মাধুরী। খবরটি একসময়ে পত্রিকায়ও ছাপা হলো। সাংবাদিকেরা তারে মন্তব্য চেয়ে বার্তা লিখলে অনেক কথাবার্তার মাঝে তিনি বলে ফেললেন, আর নিতে পারছিলাম না … শেষে বীতশ্রদ্ধ হয়ে ছেড়েই দিলাম … আমি আপনাদের সহযোগিতা চাই, ইত্যাদি। সবাই ভাবল, এ তার পলায়নপর মনোবৃত্তিরই প্রকাশ।

এর কয়েক মাস পর নালককে প্রবাস থেকেই টেক্সট করলেন একটি বাক্য, উই ঔন দ্য ব্যাটেল, ফাইনালি। সঙ্গে মামলার রায়ের কপির ছবি। উচ্চ আদালত কর্তৃত্ববহির্ভূত অন্যায্যতা করায় প্রদত্ত শাস্তি অবৈধ ঘোষণা করেছেন। এ বার্তা নালকের ধাঁধায় ফেলে দিল। পদত্যাগ গৃহীত হওয়ার পর এ রায় তো ইনফ্রাকচুয়স [অর্থহীন]। একই ঘটনা প্রসঙ্গে তার দ্বিতীয়বার কর্নেল আবু তাহেরের ফাঁসির কথাটি মনে এল। ১৯৭৬ সালে ফাঁসি কার্যকরের বহু বছর পর ২০১১ সালে আদালত রায় দিলেন, সামরিক আদালত গঠন এবং ওই বিচার কার্যক্রমের সবকিছুই অবৈধ এবং সংবিধান পরিপন্থি।

দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার কর্নেল তাহেরকে এ রায় জীবন ফিরিয়ে দিতে পারবে না কোনও দিনই, তা সত্য। কিন্তু একজন দেশপ্রেমিকের পরিচয় কোনও বিবেচনায়ই দেশদ্রোহী হতে পারে না। আদালতের রায়ে তার হৃত সম্মান সর্বাংশেই ফিরে পেলেন, পরিবার দীর্ঘ আইনি লড়াই শেষে চাপিয়ে দেওয়া অন্যায় অপবাদ থেকে মুক্তি পেল। কিন্তু শিক্ষিকা মাধুরী তো কর্নেল তাহেরের মতো বিপ্লবী নন, প্রাতিষ্ঠানিকতাবিরোধী নন। তাহলে তাদের অন্ত্যমিলটি কোথায় ? নাকি তাদের ঘটনা দুটি স্বতন্ত্র। নালকই কেবল জবরদস্তি করে নিজ মস্তিষ্কে তার প্রিয় দুই ব্যক্তিত্বকে মিলিয়ে ফেলেছেন। এমনটি মনে আসছে কেবলই তার ব্যক্তিগত অনুরাগের আতিশয্যে। কর্নেল তাহেরের নামে পাসওয়ার্ড রেখেছেন নিজের একটি সোশ্যাল মাধ্যমের অ্যাকাউন্টের। এ তারই ভ্রম। এ বাস্তবতাকে মানতে চান না নালক। আবার বাস্তবতা অলংঘনীয় এ বোধ তার আছে। তাই তীব্র মর্মপীড়া হয়। তিনি পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান করেন প্রাণপণে। সেই মুহূর্তে বিদ্যুৎ-ঝলকের মতো তাদের সাদৃশ্যের দিকটি মনে ধরা দেয় নালকের। নির্বিশেষে মজলুম মন বিচার চায়। বিচারে প্রাপ্তির বিষয়টি বস্তুগত কিছু না হলেও মনের যাতনা নির্বাসিত করে। অন্যায়ের শিকার হয়ে বয়ে বেড়ানো দীর্ঘ গ্লানি থেকে মুক্তির একমাত্র উপায়ই বিচার প্রাপ্তি।

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button