আর্কাইভগল্প

গল্প : অপূর্ণতা : রণজিৎ সরকার

দুটি আলো। একটি সূর্যের আলো। অন্যটি পূর্ণিমার আলো। সূর্যের আলো দিনকে আলোকিত করে। আর পূর্ণিমার পূর্ণ আলো রাতকে আলোকিত করে। প্রতিটি দাম্পত্যজীবনে সূর্যের আলো আর পূর্ণিমার পূর্ণ আলোর মতো সারা জীবনের প্রতিটি মূহূর্তে আনন্দ আর সুখের আলোয় আলোকিত করে দুঃখবেদনায় পাশে থাকার প্রত্যাশা নিয়ে নতুন জীবনের অধ্যায় শুরু হয়। কিন্তু অনেকেরই হয়ে ওঠে না দাম্পত্যজীবনের সুখভোগের অধ্যায়। হয়ে ওঠেনি শওকত আর সুজানার দাম্পত্যজীবনও। তাদের দাম্পত্যজীবন অমাবস্যার অন্ধকার ঘিরে ধরেছে। কেন তাদের দাম্পত্যজীবন অমাবস্যার রাতের মতো অন্ধকার ঘিরে ধরেছে ? কারণ নিশ্চয়ই আছে। তৃতীয় কোনও ব্যক্তি ?

হ্যাঁ, তৃতীয় কোনও ব্যক্তি। তার আগমন ঘটল কী করে, নিশ্চয়ই নেটদুনিয়া। এই দুনিয়া ধীরে ধীরে ভালোলাগা মন্দলাগা আলোচনা করতে করতে মায়ার জালে জড়িয়ে আটকে গেছে, ঘরের মানুষ বাদ দিয়ে দূরের পরমানুষের মনের সঙ্গে আটকে যায় মাকড়সার জালের মতো। পরিবারের বাইরে কারও সঙ্গে, সমাজ যে সম্পর্ককে বলে অবৈধ সম্পর্ক। প্রথমে সুজানা পরিবারের ভেতরের কারও সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। তবে কোন পক্ষের সঙ্গে ? জন্মদাতা পরিবার নাকি বিয়েসূত্রের নতুন পরিবারের লোকজনের সঙ্গে ? মেয়েদের বিয়ের পর জন্মদাতা পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি সাধারণত হয় না, তবে যৌতুকলোভী স্বামীর কারণে কখনও কখনও জন্মদাতা পরিবারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হতে বাধ্য হয়। কিন্তু দ্বিতীয় পরিবারের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি হয়, কেউ কেউ ভাবে পরের বাড়ির মেয়ে তাকে যা বলব, তাই করবে। যেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হবে কষ্ট হলেও বাধ্য হয়ে তা পালন করবে। সুজানাকে নিয়ে তাই ভেবেছিলেন তার শাশুড়ি।

শিক্ষিত মেয়েরা তো নিজের ভালোমন্দ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।

প্রথমে সুজানার সঙ্গে শাশুড়ির ঝগড়া শুরু হয়েছে। ঝগড়ার কারণ ? সংসারের আর্থিক কোনও অভাবের কারণে নয়। আমাদের অধিকাংশ সংসারে ঝগড়া-বিবাদ লেগেই থাকে। কিন্তু এদের অর্থ যা আছে তাতে কোনওরকমের আর্থিক কষ্ট থাকার কথা নয়। আসলে ঝগড়ার সূত্রপাত হয়েছে নাতি-নাতনির মুখ দেখা নিয়ে। সব নানা-নানি, দাদা-দাদির এমন চাওয়া থাকে, মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত হলেও নাতি-নাতনির মুখ দেখার আশা থাকে। কিন্তু সুজানা এত তাড়াতাড়ি শাশুড়ির ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে না। সে প্রথম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডার পেয়েছে। তার ইচ্ছা সামনের বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে প্রশাসন ক্যাডার পাওয়ার পর সন্তান নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে। কিন্তু তার শাশুড়ি এত কিছু বোঝেন না। মানুুষের নিঃশ^াসের বিশ^াস নেই। তিনি নাতি-নাতনির মুখ দেখে মরে যেতে চান। নাতি হোক আর নাতনি হোক তাকে আদর-সোহাগ দিয়ে লালন-পালন করে মানুষ করবেন, এটাই তার শেষ বয়সের চাওয়া। শওকতের ইচ্ছা সন্তান নেওয়ার কিন্তু সুজানা কোনওভাবেই রাজি হয় না। শওকত আর সুজানার বয়সের পার্থক্য প্রায় আট বছর। তাই শওকত বারবার চাপ দেয় কিন্তু নিজের ক্যারিয়ার গড়ার জন্য সুজানা সন্তান নিতে চায় না। এই নিয়ে তাদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ লেগে থাকে। শওকত নিজেও ইঞ্জিনিয়ার। ভালো টাকা উপার্জন করে। তার ইচ্ছা স্ত্রী চাকরি না করুক। সন্তান নিয়ে ভালোভাবে মানুষ করার জন্য সন্তানের পেছনে সময় দিক। কিন্তু সুজানার মনের ইচ্ছা, সে বিবিএস দিয়ে প্রশাসন ক্যাডার হবেই, তাকে হতেই হবে। তার আত্মবিশ^াস প্রচণ্ড।

ক্যাম্পাসে দীর্ঘ কয়েক বছর শরীফের সঙ্গে প্রেম করেছে সুজানা। কিন্তু শরীফ বিসিএস কর বিভাগে জয়েন করেছে। ওই বছরের প্রশাসনে এক ক্যাডারের মেয়েকে পেয়ে তাকে বিয়ে করেছেন শরীফ। তাই সুজানার মনে মনে জিদ চেপেছে পড়ালেখায় সময় দিয়ে প্রশাসন ক্যাডার পেতেই হবে। তার বয়ফ্রেন্ডকে দেখিয়ে দেবে, পিছিয়ে থাকার মানুষ নয় সুজানা, সামনে এগিয়ে যাওয়ার মানুষ সুজানা। কিন্তু তার মনের কথা কাউকে বলে না। নিজের ভেতর রেখে দিয়েছে, নিয়মিত পড়ালেখা করছে দিনরাত।

শওকত তার চারপাশের মানুষের নানা কথা শুনছে। বিয়ের কয়েক বছর হয়ে গেল। তবু কেন বাচ্চা নিচ্ছে না। নাকি শারীরিক কোনও দোষ আছে। দোষ থাকলে তো উন্নত চিকিৎসা আছে। তাহলে চিকিৎসা কেন করছে না। এ রকম নানা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হচ্ছে সহকর্মী থেকে শুরু করে আত্মীয়স্বজনদের কাছে। শওকত কী করে বোঝাবে সুজানা শিক্ষিত মেয়ে। তার চাওয়া-পাওয়া ও স্বাধীনতাকে গুরুত্ব দিতে হবে। তার ইচ্ছা ভালো কিছু করবে। সে ইচ্ছাশক্তি তার আছে। সে চেষ্টা করলে পারবে। তার ইচ্ছাপূরণে বাধা দিলে হবে না। অসংখ্য মেধাবী মেয়ে বিয়ের পর পারিবারিক চাপে পড়ে ভালো কিছু করতে পারে না। তারা আসলে সরকারি জবে জয়েন করলে দেশ ও জাতির জন্য আগামী প্রজন্মের জন্য অনেক ভালো হতো। সুজানা চেষ্টা করুক না ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত। এখন জোর দিয়ে আর কিছু বলব না। জোর দিয়ে কিছু বললে নদীর তীরে গাছকে যেমন কয়েকজন মিলিয়ে ধাক্কা দিলে গাছটি নদীর পাড় থেকে পানিতে পড়ে যাবে। সুজানাকে জোর দিয়ে কিছু বললে সংসার ও সম্পর্ক দুটোই চিরতরে নষ্ট হয়ে যাবে। যদিও মনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। তবু শওকত দাম্পত্যজীবনের সম্পর্ক নষ্ট করতে চায় না। শওকত বুদ্ধি করে ঢাকার বাইরে পোস্টিং নেওয়ার চেষ্টা করে। ঢাকার বাইরে পোস্টিং নিলে সুজানার পড়ালেখার সমস্যা হবে না। তার মায়ের সঙ্গেও ঝগড়া-বিবাদ হবে না। অবশেষে তার মাকে নিয়ে ঢাকার বাইরে সিরাজগঞ্জ জেলা ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে পোস্টিং নিয়ে চলে যায়। সুজানা খুবই শান্তি পায়। নিজের পড়ালেখা করে নিজের মতো করে। এর মধ্যে ফেসবুকে একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। যখন পড়ালেখা করতে করতে ক্লান্ত লাগে তখন ওই ছেলের সঙ্গে কথা বলে। সুজানা ছেলেটাকে ধীরে ধীরে বিশ^াস করতে থাকে। বিশ^স্ত মানুষের কাছেই মানুষ সুখ-দুঃখ ও বেদনার কথা বলতে চায়। সুজানাও বিশ^াস করে ধীরে ধীরে বলে। ওই ছেলেটাও বিসিএসের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেও প্রশাসন ক্যাডার ছাড়া অন্য কোনও ক্যাডারে জয়েন করবে না। পড়ালেখায় খুবই গুরুত্ব দেয়। সুজানা জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্রী হলেও কাফিন ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের ছাত্র। তাদের মধ্যে বিসিএস প্রস্তুতির কথা নিয়েই বেশি আলোচনা হয়। সেজন্য দুজন বেশি সময় কাটায় ফোনে। তারপর একদিন দেখার করার ইচ্ছা প্রকাশ করে কাফিন। অবশেষে তারা একদিন দেখা করে। ওরা পরস্পরের আচার-ব্যবহারে মুগ্ধ হয়। তাদের বন্ধুত্বের গভীরতাটা বেড়ে যায়। একজনের আরেকজনের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ বাড়ে। সুজানা যেন ক্যাম্পাস জীবনের চেয়েও ভালো বন্ধু পেয়েছে কাফিনকে। নিজের দাম্পত্যের কথা ক্যাম্পাস লাইফের বন্ধুদের বললে সে বন্ধুরাই সুজানাকে ছোট করে দেখবে। এমনিতে তো নানারকমের কথা শুনতে হচ্ছে, মানসিকভাবে যন্ত্রণায় দিন কাটাতে হয়। সেজন্য বিসিএসের প্রস্তুতিতে পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে। তবু রাত জেগে পড়ালেখা করে। নিজের সব কথা কাফিনের সঙ্গে শেয়ারে করে।

সুজানার স্বামী শওকত স্কলারশিপ পেয়ে যায়। দুই বছরের জন্য। আমেরিকায় চলে যাবে। এবার তার পরিবারের সবাই মিলে সুজানাকে চাপ প্রয়োগ করেছে। শওকত দুই বছরের জন্য দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। এবার বাচ্চা নিতেই হবে। কিন্তু সুজানা রাজি হয় না। সুজানা তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয় দুই বছর পর দেশে ফিরলে বাচ্চা নেব। এমন সিদ্ধান্তের কথা শুনে তার শাশুড়ি আর আত্মীয়স্বজন সবাই চাপ প্রয়োগ করে। সুজানা চিন্তা করে এই অবস্থায় কনসিভ করলে আমি তো বিসিএস পরীক্ষার ভালো করে প্রস্তুতি নিতে পারব না। আমার স্বপ্ন পূরণ হবে না। আবার সংসার ভেঙে গেলে বাবা-মা প্রচণ্ড কষ্ট পাবেন। তা কল্পনাও করা যাবে না। এমনকি মেয়ের কষ্টের কথা শুনে স্ট্রোক করতে পারেন। তাই বুদ্ধি করে সিদ্ধান্ত নিল, বাচ্চা নেবে। কিন্তু শওকত দেশের বাইরে চলে গেলে। সুজানার মত জানাল। সুজানার এমন সিদ্ধান্ত শুনে তেলে-বেগুনে জ¦লে উঠে শওকত বললো, ‘আমি চলে গেলে কার মাধ্যমে বাচ্চা নেবে ?’

‘তুমি এত কম বুঝ কেন ? উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছ কেন ? তুমি চলে যাওয়ার আগে স্পার্ম রেখে যাবে। আমার পরীক্ষা শেষ হলে আইভিএফ পদ্ধতির মাধ্যমে বাচ্চা নেব।’

‘ও আচ্ছা, তাই! বুঝতে পেরেছি।’

‘হ্যাঁ। চলো আমরা চেন্নাই চলে যাই।’

‘ঠিক আছে তাই হবে। ভিসা জমা দিতে হবে।’

‘ভারতে যাওয়ার কাজগুলো দ্রুত শেষ করে ফেলব।’

‘ঠিক আছে।’

শওকত খুবই খুশি হলো। ভিসা জমা দিলো। কিছুদিন পর চেন্নাইয়ে চলে গেল শওকত আর সুজানা। চেন্নাই গিয়ে সুজানার ইউটেরাসে হালকা একটা সমস্যা ধরা পড়ল। এটার চিকিৎসা করলে ঠিক হয়ে যাবে, ডাক্তার বলেছেন। আর শওকতের স্পার্ম নিয়ে রাখলেন। কারণ তার যাওয়ার আর বেশিদিন বাকি নেই।  এক মাস পর আবার যেতে হবে সুজানার। এ অবস্থায় চিকিৎসা করে বাংলাদেশে চলে এল ওরা।

সুজানা বাংলাদেশে এসে শাশুড়িকে বলল, ‘আমার ইউটেরাসে সমস্যা হয়েছে। এই অবস্থায় বাচ্চা নেওয়া যাবে না। এখন বাচ্চা নিলে প্রতিবন্ধী হওয়ার আশঙ্কা থাকতে পারে। আপনি কি চান না আপনার নাতি-নাতনি সুস্থভাবে পৃথিবীতে আসুক ? তাই এক মাস পর আমাকে আবার যেতে হবে। তখন চিকিৎসার পর ডাক্তার বিস্তারিত জানাবেন।’

‘শওকত বিদেশে চলে যাবে। বাচ্চা হবে কীভাবে ?’ সুজানার শাশুড়ির আইবিএফ পদ্ধতি সম্পর্কে হয়তো কোনও ধারণা নেই। তাই তিনি এমন প্রশ্ন করেছেন।

সুজানা কৌশলে আবার বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আপনার ছেলে এ যাত্রা না গেলেও চলবে। কারণ স্পার্ম রেখে এসেছি। আমি গেলেই হবে। বিজ্ঞান দিন দিন আমাদের অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আপনার নাতি না নাতনি যে আসুক তাকে কিন্তু বিজ্ঞানী বানাতে হবে।’

‘তাই! সত্যি বলছো।’

‘হ্যাঁ, সত্যি বলছি। শুধু অপেক্ষা করেন। আমি যেন সুস্থ থাকি।’

‘আচ্ছা’ বলেই শওকতের মা চিন্তা করতে লাগলেন। আমাকে কি সাতপাঁচ ঘোড়া বুঝ দিয়ে দিল নাকি বউমা। বউমার উদ্দেশ্য কিছুই বুঝতে পারছি না। তবে আমার ছেলেও তো সঙ্গে গিয়েছিল। তার কাছ থেকে সঠিক তথ্য বের করতে হবে। ছেলেকে পরদিন চিকিৎসার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলেন। মায়ের কথা শুনে শওকত বলল, ‘তোমার বউমা যা বলেছেন, তা ঠিক বলেছেন। তুমি টেনশন করো না। সুজানাকে তার মতো করে থাকতে দাও। দোয়া করো। আর অপেক্ষা করো।’

‘তাহলে অপেক্ষা করতে হবে। আচ্ছা, নাতি-নাতনির মুখ দেখার জন্য অপেক্ষা করাও আনন্দের।’

মায়ের মন ভালো করার জন্য বুদ্ধি করে শওকত বলল, ‘তোমার নাতিপুতি হলে কী নাম রাখবে চিন্তা করেছো। এখন থেকে দুটি নাম ভেবে রাখো।’

‘যমজ সন্তান হবে নাকি ?’

‘মা আইবিএফ করলে সাধারণত যমজ সন্তান হয়। ধরো যমজ সন্তান হলো। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।’

‘না না, যদি দুটি ছেলে বা দুটি মেয়ে হয়। যেমন আমার এক বান্ধবীর মেয়ের দুটি সন্তান হয়েছে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে।’

‘তা হলে তুমি একটা ছেলে আর একটা মেয়ে এবং এক জোড়া মেয়ে আর এক জোড়া ছেলের নাম বের করার চেষ্টা করো। আর আল্লাহ আল্লাহ করো।’

‘ঠিক আছে। আমার নাতিপুতির জন্য দোয়া করি আগে।’ তিনি দোয়া করতে বসলেন।

শওকত ঠিক বুঝে উঠতে পারছে না, তাদের দাম্পত্যজীবনের ভবিষ্যৎ আসলে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। তিনি আসলে বিদেশে যে যাচ্ছেন। গেলে কোন দিক দিয়ে লাভবান হবেন। শওকত এটা জেনে গেছে সুজানার ভালো বন্ধু হয়েছে কাফিন নামের একজন। তার হোয়াটসঅ্যাপ একদিন পরীক্ষা করে দেখে তার সঙ্গে সম্পর্কের গভীরতা। শওকত সেদিন থেকে বুঝতে পারে জোর করে হয়তো অনেক কিছুই রক্ষা করা যায়। কিন্তু মানুষের সম্পর্ক জোর করে ধরে রাখা যায় না। সম্পর্ক হলো লোহা আর চুম্বকের মতো। যদিও ওদের আবেগ নেই তবু যে টান থাকে পরস্পরের প্রতি। মানুষের সম্পর্ক হলে প্রকৃত আবেগের টানেই টিকে থাকে সম্পর্ক। আর মাঝে শ্রদ্ধাবোধের জায়গা থাকা দরকার। কিন্তু এইটা এখনও শওকত আর সুজানার প্রতি নেই। কিন্তু কাফিনের সঙ্গে আত্মার একটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। শওকতের সঙ্গে মনের দূরত্ব তৈরি হলেও সংসারের দায়িত্ববোধ সঠিকভাবেই পালন করছে। তারা শিক্ষিত বলে তাদের আচার-ব্যবহারে কাউকে কিছু বুঝতে দেয় না।

মনের অশান্তি নিয়ে শওকত বিদেশে চলে যায়। পড়ালেখা নিয়ে আরও বেশি ব্যস্ত থাকে সুজানা। বিদেশ থেকে শওকত চাপ দেয় চেন্নাই যাওয়ার জন্য। কিন্তু সুজানা যায় না। পরীক্ষার ফলাফল না দেওয়া পর্যন্ত কিছুই করবে না। টেনশনে থাকে খুবই। কিছুদিন যাওয়ার পর রেজাল্ট দেয়। তাতে সুজানার মনের ইচ্ছা পূরণ হয়। সে বিসিএস প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়। এবার তার স্বামী আর শাশুড়ি সবাই সুজানাকে নিয়ে চাপ দেওয়া শুরু করে। তবু সুজানা সময় নিতে চায়। তার সাবেক প্রেমিক যদি তাকে চায় তাহলে এ সংসার ত্যাগ করে চলে যাবে। এমন মানসিকতা নিয়ে আশায় থাকে সে। একদিন তার মনের কথা তার বর্তমান বন্ধু কাফিনকে বলে। শরীফ যদি আমাকে এখনও চায় তাহলে আমি কি তাকে বিয়ে করব কাফিন তখন সুন্দর করে বুঝিয়ে বলে, তোমার কি মাথা খারাপ। এখন তুমি তার ঘরের ঘরণী হয়ে গেলে দুটি সংসার ভেঙে যাবে। পরিবারের সবার কী অবস্থা হবে সামাজিকভাবে। আমার কথা চিন্তা করো। আমার গার্লফেন্ড চলে গেছে তাতে কিছুই মনে করিনি। তবে হ্যাঁ, তাকে ভোলা যায় না। দিনের কোনও এক সময় দিনের আলোর মতো এসে স্মৃতিগুলো মনে ধাক্কা দেয়। তবে তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে আমি অনেকটা তার কথা ভুলতে পেরেছি। আগামীতে আরও ভুলতে পারব। হৃদয়ের স্মৃতিগুলো অমাবস্যার অন্ধকারে কবর দেব। তুমি শুধু বন্ধু হয়ে পাশে থাকো সুজানা।

সুজানা মনে মনে ভাবে, পুরুষ মানুষ এমনই মনে হয়, অন্যকে ছেড়ে দিয়ে বা কেউ চলে গেলে খুব দ্রুতই ভুলে যায় আবার অন্যকে আপন করে নেয়। কাফিনকে কথাগুলো বলতে চাইল। কিন্তু সাহস করে বলতে পারল না। যদি কাফিন মন খারাপ করে।

কাফিন সুজানার চেহারা দেখে বুঝতে পারল কিছু একটা ভাবছে। তাই বলল, ‘সুজানা টেনশন করো না। আমি তো কর ক্যাডার পেয়েছি। দেখি তুমি আর আমি এক এলাকায় পোস্টিং নেওয়ার চেষ্টা করি। তাহলে তো দূরে থাকব না। মনের দিকে দিয়ে কাছে থাকব, সশরীরেও পাশাপাশি থাকব।’

‘তোমার মতো বন্ধু পাশে থাকলে জীবনে অনেক অপূর্ণতা পূর্ণ করা যাবে কাফিন।’

‘তোমার মনের সব কথা নির্দ্বিধায় বলে যাবে, আমি ভালো পরামর্শ দেওয়ার চেষ্টা করব সব সময়।’

‘পরিচয়ের শুরু থেকেই তো তাই করে আসছো। অবশ্যই বলব।’

‘জয়েন করার ছয় মাস পর বাচ্চা নিতে চেন্নাই যাবে। আমিও যাব তোমার সঙ্গে।’

‘ঠিক আছে।’

ওরা চাকরিতে জয়েন করে। সুজানা আর কাফিনের বন্ধুত্বের গভীরতা আরও গভীর হয়। তারা দুজন শারীরিক চাহিদা নিজেদের অজান্তেই যেন পূরণ করতে জড়িয়ে যায়। সুজানার স্বামীও বিদেশ। আর কাফিন এখনও অবিবাহিত। সুসম্পর্কের কারণে প্রকৃতির নিয়মে তাদের শরীরিক প্রয়োজনে এমন সম্পর্ক জড়িয়ে যায়।

ছয় মাস পর ছুটি নিয়ে চেন্নাই যায় সুজানা আর কাফিন। সুজানা ভবিষ্যতের কথা ভেবে কাফিনকে বলে তোমার স্পার্ম দিয়ে আমার গর্ভে বাচ্চা নেব। আমার স্বামীর স্পার্ম যে রাখা আছে, সে স্পার্মে আমি গর্ভবতী হব না।’

কাফিন শুনে অবাক হয়। কোনও হিসাব মেলাতে পারে না। বুঝতে পারে ভবিষ্যতে কিছু একটা ঘটনা ঘটবে। তাই হয়তো এমন সাহস নিয়ে স্পার্ম বদল করে বাচ্চা নিতে চাচ্ছে সুজানা।

সুজানা বলল, ‘কাফিন, তুমি কি সাহস পাচ্ছ না।’

‘সাহস পাব না কেন ? তোমার জন্য তো আমি সব করতে প্রস্তুত আছি। তবে ভবিষ্যতে যদি কিছু হয়।’

‘হ্যাঁ, ভবিষ্যতে কী হবে। সেটা জেনেই তোমাকে এমন প্রস্তাব দিচ্ছি।’

‘তুমি ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নাও।’

‘আমার ভাবা শেষ। আমি যা বলব তুমি তা শুনবে তো।’

‘হ্যাঁ। শুনব।’

‘তাহলে আর কোনও কথা বলবে না। আমি যা বলব তাই শুনবে।’

‘আচ্ছা, তবে এখন দুজন শুক্রাণুদাতার কথা মনে পড়ল। একজন হলো চিকিৎসক জান কারবাট। তিনি নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগ শহরে একটি আইভিএফ ক্লিনিক চালাতেন। তিনি যখন ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন বা আইভিএফ পদ্ধতিতে নিষেক ঘটাতেন তখন দাতার শুক্রাণুর বদলে নিজের শুক্রাণু ব্যবহার করতেন। এভাবেই বিগত বেশ কয়েক বছরে ৪৯টি শিশু জন্ম নিয়েছে তার শুক্রাণু থেকে।’

‘বলো কী! অন্যজন কী করেছিলেন ?’

‘বলছি শোনো, যুবকের নাম জেকব মেইজার। তিনি শুক্রাণু দান করে ৫৫০ জনেরও বেশি শিশুর জন্ম দিয়েছেন। বিষয়টা জানাজানি হয়ে গেলে নেদারল্যান্ডসের আদালত অবিলম্বে ওই যুবককে তার শুক্রাণু দান করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেন। তবে আমার ক্ষেত্রে তোমার বিবেকের আদালত আর জানাজানি হয়ে গেলে কি শাস্তি হবে তা ঠিক বুঝতে পারছি না।’

‘বুঝেছি। আমার বিবেকের আদালত আর দেশের আদালত কী শাস্তি তোমাকে দেবে তা তখন ঠিক বুঝতে পারবে। তুমি তো মেধাবী, ভয় না পেয়ে বুঝে নাও।’

কাফিন বুঝতে পারে সুজানা আমাকে এত গভীরভাবে ভালোবেসেছে, অথচ ক্যাম্পাসের বয়ফ্রেন্ডকে পাওয়ার জন্য বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার হলো। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে সংসার করছে। অবশেষে তাদের দুজনকে বাদ দিয়ে আমার সঙ্গে বাকি জীবন পার করার জন্য এতকিছু হচ্ছে। বুঝতে পারছি না। তাদের দুজনের মতো কী আমাকেও আবার কখনও বাদ দিয়ে অন্যের ঘরে চলে যাবে না তো! সুজানার কথায় কী সিদ্ধান্ত  দিব ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে হ্যাঁ, একজন নারী তো। দুজনকে বাদ দিয়ে আমাকে নিয়ে যেহেতু সংসার করতে চাচ্ছে, তাকে গ্রহণ করে নেব।

ওরা ডাক্তারের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করে দিল। সুজানা তার স্বামীর স্পার্ম বাদ দিয়ে কাফিনের স্পার্ম নিয়ে গর্ভধারণ করল। চেন্নাই থেকে সফলভাবে কাজ সম্পন্ন করে দেশে এসেই কাউকে তেমন না বলে শওকত ও তার আত্মীয়স্বজনকে জানিয়ে দিল তার শাশুড়ি। সবাই খুশি পরিবারে নতুন অতিথি আসছে জানতে পেরে। দশ দিনের মাথায় আমেরিকা থেকে খবর এল শওকত স্ট্রোক করে মারা গেছে।

সুজানার দুর্দিন। কাফিন আছে তার পাশে সব সময়। ছয় মাসের মাথায় সুজানা আর কাফিন বিয়ে করে ফেলল। সুজানার গর্ভের বাচ্চাটা শওকতের পরিবারের লোকজন নিজেদের মনে করে। এটা ভাবাই স্বাভাবিক।

কাফিন সন্তানের বিষয়ে কিছু বলে না। মনে মনে ভাবে, শওকতের বৃদ্ধ মা ভেবে যেটুকু শান্তি পায় পাক। ওরা তো জানে আসল রহস্য। আর আমার পরিবারকে বোঝাব তখন, যখন শওকতের মা জীবিত থাকবে না। এমনকি আইভিএফের কাগজপত্র দেখাব। এমনকি ডিএনএ পরীক্ষা করে দেখাব। যাতে কেউ আর কোনওদিন প্রশ্ন না তুলতে পারে। পুত্রশোকে আর বেশিদিন বাঁচতে পারলেন না শওকতের মা।

কাফিনকে যারা ভুল বুঝে দূরে রেখেছিল তাদের ডিএনএ ও স্পার্ম রাখার কাগজগুলো দেখাল। তখন পরিবারের লোকজন আর কিছু বন্ধুদের দেখিয়ে ভুল ভাঙাল। নয় মাসের মাথায় ফুটফুটে ছেলেসন্তান এল সুজানার কোলজুড়ে। সন্তান নিয়ে সুজানা আর কাফিনের সুখের সংসার।

কয়েক মাস যাওয়ার পর সুজানার ক্যাম্পাস লাইফের বয়ফ্রেন্ড শরীফ যোগাযোগ করার চেষ্টা করল। কিন্তু ফোন ধরেনি সুজানা। শরীফের মোবাইল ফোন নম্বরটা সুজানা ছদ্মনামে সেভ করে রেখেছে। শরীফ বুদ্ধি করে তার দুঃখের কথা হোয়াটসঅ্যাপে  লিখল, ‘আমার স্ত্রী শাহনাজ আমাকে ডিভোর্স দিয়ে একজন এডিসির সঙ্গে সংসার শুরু করেছে। তোমাকে কষ্ট দেওয়ার ফল এখন সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হবে। আমাকে মাফ করে দিও সুজানা। আর তুমি যদি বর্তমান সংসারে অশান্তিতে থাকো তাহলে আমাকে জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করতে পারো। আমি তোমাকে গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত আছি।’

সুজানা এসএমএসটা পড়ে কষ্ট পেল। মনে মনে ভাবল―মানুষ মন থেকে কিছু চাইলে মনে হয় একদিন না একদিন বাস্তবে পেয়ে যায়। দুর্দিনে অমাবস্যার মতো কষ্ট দিয়ে অন্যের জীবনকে অন্ধকার করে দিলে নিজের জীবনেও সেই অমাবস্যার রাত ফিরে আসে। আর তখন ওই অন্যের ঘরে হয়তো পূর্ণিমার পূর্ণ জোছনার আলো আলোকিত করে।

এসএমএসটা আনন্দের সঙ্গে সুজানা কাফিনকে পড়িয়ে শোনায়। পড়া শেষে বলে ‘আমি অবশেষে জয়ী হয়েছি।’

কাফিন বলে, ‘তাহলে কি আমি এখন হেরে যাব ?’

‘তুমি হেরে যাবে মানে ?’

‘তুমি কি এখন শরীফের সঙ্গে সংসার করতে চাও। যেতে চাও তার কাছে ?’

‘আমি এই দিনের অপেক্ষায় ছিলাম।’

‘তার মানে গাছের ফল ওপর থেকে এসে এখন গাছের গোড়ায় পড়েছে। তোমার সুখের জন্য আমার সুখ ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছি। সমস্যা নেই। তবে আমার বিশ^াস আমি কাউকে ঠকাইনি। আমাকে কেউ ঠকাতে পারবে না।’

‘তুমি কী ভাবছো, আমি শরীফের সঙ্গে চলে যাব, সেজন্য অপেক্ষায় ছিলাম ? হ্যাঁ, একটা আবেগ পর্যন্ত অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু এখন আর না। তোমার ধারণা ভুল। আমি আসলে চেয়েছিলাম শরীফ কোনও না কোনওদিন আমার কাছে এসে পড়বেই। আজ এসএমএস দিয়ে উপস্থিত হলো। তোমার মতো ভালো মানুষ রেখে তার কাছে চলে যাব, কোনওদিন না। সে থাক তার মতো করে। সময়ের মূল্য সময়েই দিতে হয়।’

‘আমি রক্তে-মাংসে গড়া একজন মানুষ। আমারও এমন চিন্তাভাবনা আসা স্বাভাবিক। তবে তোমার প্রতি আমার বিশ^াস আছে। তবে শরীফের দুর্দিনে তুমি তার পাশে দাঁড়াতে পারো। এমন কিছু করবে না যাতে আমার ভীষণ কষ্ট পেতে হয়। সেজন্য বলছি, সম্পর্কের কিছু সীমা থাকে, সে সীমা অতিক্রম করবে না।’

‘কাফিন, এই যে কথাগুলো বলে বড় মনের পরিচয় দিলে, সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ। আর এজন্যই তোমাকে আমার ভালো লাগে। কিন্তু তুমি এটাও যেন মনে রাখো আমি তার সঙ্গে আর কোনও প্রকার যোগাযোগ করে আমাদের সংসারের অশান্তি ও আমার মনের ওপর চাপ নিতে চাই না। এখন যে ম্যাজিস্ট্রেটের দায়িত্বে আছি। দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়েই দেশকে ভালো কিছু দিতে হবে। সন্তানের মা হয়েছি, তোমার মতো স্বামী পেয়েছি। আমার অনেক দায়িত্ব কাফিন। বর্তমানের দায়িত্বগুলো সঠিকভাবে পালন করতে পারলেই মানবজনম সার্থক হবে। অন্য কারও দায়িত্ব নিতে চাই না। তুমি শুধু সুখে-দুঃখে চিরদিন পাশে থেকো কাফিন।’

‘সূর্য, চাঁদ যেমন আলো দিয়ে যায়, আমিও তোমার জীবনে সব সময় আলোকিত করার জন্য পাশে থাকব। কখনও অমাবস্যার অন্ধকার আসতে দেব না।’

হঠাৎ ওদের সন্তান অভি কান্না করে উঠল। দেখে শরীরে অনেক জ¦র। রাতেই ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। ডেঙ্গু পরীক্ষা করল। পরদিন জানতে পারল ডেঙ্গু পজিটিভ। অনেক চেষ্টা করেও অভিকে বাঁচানো গেল না! সুজানার ভাগ্যে কেন এত অপূর্ণতার ঘটনা ?

সচিত্রকরণ : রজত

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button