আর্কাইভগল্প

গল্প : মঙ্গলার অন্তর্ধান : মহি মুহাম্মদ

শরীরের রং শ্লেটের মতো। অন্ধকারে বোঝা যায় না। একাকার হয়ে আছে মঙ্গলা। ওকে আলাদা করে চেনার উপায় নেই। ঘাটে একগাছি নৌকাটা বাঁধা। ওটার ওপর চিত হয়ে আছে। প্রথম প্রথম দেখলে মনে হবে নিথর। মনে হবে ও মরে আছে। গাছের গুঁড়ির মতো। নিষ্প্রাণ দেহখানি। পেটানো শরীর যেন পাগাল লোহা। পাথরের মতো, নড়চড় নেই। কিন্তু একটু খেয়াল করলে বোঝা যায়, ও শ্বাস নিচ্ছে। বুকটা ওঠানামা করছে। ওকে মেরে ফেলে রাখে এমন সাহস কারও নেই। এ তল্লাটে এমন শক্তিধর কেউ জন্মায়নি। রূপনার চেহারাটা ভাসছে ওর মনে। কালো মুখে যে এত মায়া থাকে, তা রূপনাকে না দেখলে বোঝা যায় না। ও কীভাবে যেন মঙ্গলাকে সামলে নেয়। ওর মুখটা চোখে ভাসলেই সব কেমন সুনসান নীরবতায় ঢেকে যায়। মনের ব্যথাভার হালকা হয়ে যায়। গুমরে গুমরে কেঁদে ফেরা সুখপাখিটা কেমন ওর হাতের পরশে শান্ত হয়ে যায়।

মঙ্গলার ঘনিষ্ঠ সহচর তপন বলল, কিরে মংলা, এমুন কইরা শুইয়া রইলি ক্যা?

‘তর কি কোনও সমস্যা হইতাছে? তরে না যাইতে কইছি?’

‘তরে ছাড়া হাডে যাই কেম্বায়? হগলেই কইব মংলারে একলা ছাইরা থুইয়া গেছি। দোষ দিব না?’

‘এই তপইন্যা তুই বেশি প্যাট প্যাট করোছ কইলাম।’

‘আহারে, কইবি তো তো কী হইছে?’

‘জ¦ালাইস না কইলাম, যা তুই। গিয়া মহজনরে ক, আমার মনডা ভালা নাই।’

তপন ভয় পায়। এই মন ভালা নাই যেদিন মঙ্গলার গলা দিয়ে বের হবে সেদিন আসলেই মঙ্গলা আর কোনও কামকাজ করবে না। চুপচাপ শুয়ে থাকবে। এরকম কঠিন মন খারাপ সে আগে কখনও কারও মধ্যে দেখে নাই। তাই সে কিছুতেই মঙ্গলাকে ছেড়ে বাজারের ওদিকে যেতে চায় না। আর তা ছাড়া আসগর মহাজনের কড়া হুঁশিয়ারি দেওয়া আছে, তপন যেন মঙ্গলাকে একা একা ছেড়ে কোথাও না যায়। কারণ আসগরের তুরুপের তাস হলো মঙ্গলা। অন্য মহাজনরা ওত পেতে আছে মঙ্গলাকে দখল করতে। না পারলেও সুযোগ পেলে ওরা মঙ্গলার ক্ষতি করে দেবে। তাই বেগতিক দেখে নৌকা থেকে খানিক দূরে সে বালির ওপর লেপটা মেরে বসে থাকে, কখন মঙ্গলা উঠে বসে।

মঙ্গলা এদিকওদিক তাকিয়ে দেখে তপনের সাড়াশব্দ মেলে না। সে রাতের আকাশের দিকে ঠিক তেমনি থির হয়ে তাকিয়ে থাকে। এমন সময় পুবদিক থেকে ছায়ার মতো কেউ এগিয়ে আসে। বালিয়াড়ির কাছে দাঁড়ায় কিছুক্ষণ। এদিক-ওদিক তাকায়।

তপন সেদিকে চুপচাপ তাকিয়ে থাকে। অন্ধকারে ভালো করে চিনতে না পারলেও সে বুঝতে পারে এটা রূপনা ছাড়া আর অন্য কেউ না। রূপনা এগিয়ে যায় একগাছি নৌকাটার দিকে। ওদের কথাবার্তার টুকটুক শব্দ কানে আসে কি আসে না। এর চেয়ে নদীর ফোঁস-ফোঁসানি বেশি শোনা যায়। তপন দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখ গুঁজে বসে থাকে চুপচাপ। চোখ ফেলে রাখে চারপাশে। আর কোনও ছায়া দুলে ওঠে কিনা, পাহারা দেয়। মঙ্গলাকে সে একা ছাড়তে পারে না। তাহলে আসগর মহাজন তাকে আস্ত রাখবে না। নিমকের যথার্থ প্রতিদান দিতে সে শিকারির মতো ওত পেতে থাকে।

দুই

রাইচরণ মানুষটা হারামি। অন্যের ভালো সে করতেও জানে না, দেখতেও পারে না। আসগর মহাজনের প্রতি তার ক্ষোভ কেবল বাড়েই। তার একমাত্র কারণ মঙ্গলা। আবার দ্বিতীয় কারণ হলো, আসগর মহাজনের উন্নতি। এসব রাইচরণের কাছে অসহ্য। তাই সে আড়ালে-আবডালে সব সময় চেষ্টা করে আসগর মহাজনের ক্ষতি করতে। আসগরের ভরাডুবি হলেই সে শান্তি পায়। আসগর মহাজনের কোনও ক্ষতি না করতে পারলেও মঙ্গলাকে সে কিছুতেই ছাড়বে না।

মঙ্গলার কিছু একটা করতে পারলে সে আরও বেশি উল্লসিত হয়। এমনি এমনি না হলেও সে ভাড়া করা মানুষ লাগিয়ে রাখে যাতে ওদের সমূহ ক্ষতি হয়। জলে যেমন সে চেষ্টায় থাকে, তেমনি ডাঙাতেও। তাই আসগর মহাজন তপনকে সবসময় মঙ্গলার ওপর চোখ রাখতে বলেছে, যাতে কেউ ওর  কোনও ক্ষতি করতে না পারে। রাইচরণ সুযোগ পেলেই ছোবল দেবে। বর্ষার মৌসুমে রাইচরণের ভাড়া করা লোকজন দরিয়ায় নৌকা ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু সেটা বানচাল করে দিয়েছে মঙ্গলা। কয়েকজনের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে রাইচরণের বড় দুটো নৌকা ডুবিয়েছে। রাইচরণ টুঁশব্দটি করেনি। জানে সে উচ্চবাচ্য করলে হিতে বিপরীত হবে। তাই সে পরবর্তী সুযোগের অপেক্ষায় থেকেছে। তবে যখনই সুযোগ পেয়েছে মাছ কেড়ে নিয়েছে। কখনও কখনও বাজারে অনিষ্ট করতে চেয়েছে। অবশ্য এখন মঙ্গলার জন্য এসব কাজে সে এঁটে উঠতে পারছে না। তাই বড় কোনও অনিষ্ট করার জন্য ওত পেতে আছে।

বাজারে সন্ধ্যা সরগরম। লোকজনের উপস্থিতি আর নানা গল্পে মশগুল। সকালের দিকে যেসব নৌকা এসেছে, তা খালাস হয়েছে। সন্ধ্যার দিকে আরেকটি দল দরিয়ার উদ্দেশ্যে বের হয়ে গেছে। সেগুলোকে বিদায় দিয়ে মঙ্গলা আর তপনের বাজারে আসার কথা। কিন্তু এখনও এসে পৌঁছায়নি। আসগর মহাজন অপেক্ষা করছে। মঙ্গলা আসলে তিনি অন্যদিকে ছুটবেন। মঙ্গলা এত দেরি করছে কেন, বুঝতে পারছেন না।

আসগর মহাজনের গদি থেকে রাইচরণের আড়ত দেখা যায় না। কিন্তু দেখা গেলেই ভালো হতো। লোকটা কখন কী যে করে বসে ঠিক নেই। তাই আসগর মহাজনকে সতর্ক হয়ে চলতে হয়। মঙ্গলার মতো এমন একজন কামলা বাগে পাওয়ার জন্য সবাই মুখিয়ে আছে। যে কোনও সময় কান ভাঙানি দেবে। বেশি টাকার লোভ দেখিয়ে নিয়ে যেতে পারে। রাইচরণ মঙ্গলার জন্যই আরও বেশি আসগর মহাজনকে শত্রু ভাবে। কিন্তু আসগর মহাজন কোনও দু নম্বরী কাজে নেই। তিনি মঙ্গলাকে পই পই করে বলে দিয়েছেন যেন অহেতুক কারও সঙ্গে লাগতে না যায়। এমন কি রাইচরণ তাকে যতই গালিগালাজ করুক সে যেন কোনও প্রতিবাদ না করে। কতদিন এমন করে রাইচরণ একাকী শত্রুতা পুষে রাখবে?

তবে আসগর মহাজন চায় না রাইচরণের সঙ্গে এমন শত্রুতা জিইয়ে রাখতে। তাই দেখা হলে সে রাইচরণকে কুশলবার্তা হাসি মুখেই জিজ্ঞেস করে। কিন্তু রাইচরণ কিছুতেই মঙ্গলাকে সহ্য করতে পারে না। এর পেছনের গূঢ় কারণ রয়েছে। বাজারের কেউ কেউ জানে বিষয়টি। আসগর মহাজনের চোখে সেই লাজুক পরিপাটি মহিলার ছবিটি ভাসে। মঙ্গলার মা। কোথায় যে হারিয়ে গেল, কেউ কোনও খোঁজ পেল না। কেউ বলছে সে দরিয়ায় ঝাঁপ দিয়েছে। আবার কেউ বলছে, দেশান্তরিত হয়েছে। কোনটা যে সঠিক, কেউ জানে না। তবে দরিয়ায় ঝাঁপ দিলে কেউ না কেউ তার লাশ পেত। লাশ যখন পাওয়া যায়নি তখন নিশ্চয়ই শুক্কুবালা বেঁচে আছে। এমনটাই ধারণা করে আসগর মহাজন। তিনি আরও মনে করেন একদিন শুক্কুবালার হাতে মঙ্গলাকে তুলে দেবেন। ওই দুখিনী নারীর তো আর কেউ নেই।

অবশেষে মঙ্গলা এল। সন্ধ্যা তখন উতরে গেছে। থমথমে হয়ে আছে মুখ। তপন পেছন পেছন আছে। আসগর মহাজন সেদিকে তাকিয়ে কোনও কথাই জিজ্ঞেস করলেন না। খালি বললেন, ‘কিরে মুখ দেহি হুকাইয়া কাডি কাডি হইয়া গেছে। কিছু খাইছস?’

মঙ্গলা থম মেরে রইল। কোনও কথা বলল না। তপনকে ইশারায় ডেকে মহাজন খাবার আনতে বললেন। তপন দৌড়ে গেল। খাবার নিয়ে এসে মহাজনের টেবিলের সামনে রাখল। মহাজন নিজের হাতে রুটি তরকারি মঙ্গলার হাতে তুলে দিল। তপনকেও বলল খেতে।

মঙ্গলা জিজ্ঞেস করল, ‘কাকা, আপনে খাইছেন?’

মহাজন হাসলেন। ‘তুই খা। আমি বাড়িত গেলাম। শরীরডা ভালা লাগতেছে না।’

মঙ্গলা তিড়িং করে লাফ দিয়ে উঠল, ‘কী কন? কী অইছে? ডাক্তারের কাছে লইয়া যাই।’

মহাজন হাসেন। ‘লাগব না। তুই খা। সব ঠিকঠাক কইরা বাইন্দা তয় আসিস।’

ঠিকাছে। এই হলো আসগর মহাজন। মঙ্গলাকে একটা স্নেহের সুতা দিয়ে বেঁধে রেখেছেন। এ সুতা কেটে কোনও প্রলোভনই মঙ্গলাকে বিচ্যুত করতে পারে না। রাইচরণ টাকা পয়সা দিয়ে মঙ্গলাকে বারবার কিনতে গিয়েও ব্যর্থ হয়েছে শুধু এই আসগর মহাজনের ভালো মানুষির জন্য। গোঁয়ারটাকে লালসে ধরে না কেন, এ নিয়েও সে কটুক্তি করেছে। কাজ হয়নি। মঙ্গলা পিতার স্নেহ পায়নি। পিতার স্নেহ কেমন তা সে জানে না। স্নেহ বলতে যা পেয়েছে, তা আসগর মহাজন আর রূপনার মায়ের কাছে থেকে। এই দুজনের ঋণ কোনওদিন শোধ করতে পারবে না সে। এই দুই জায়গায় বেঈমানি করা মঙ্গলার সাজে না বলে ধারণা করে সবাই।

তিন

তর মায়ের নাম আছিল শুক্কুবালা। কই থাইকা তর মায়ে যে এই জাইল্যাপাড়ায় আইছিল তা কেউ কইবার পারে না। তয় তর মায়ের মইদ্যে কোনও প্যাঁচঘ্যাঁচ আছিল না। ব্যাকেই তর মায়েরে পছন্দ করত। তর মায় আইসা পরথমে রূপনার বাপের কাছেই উঠছিল। তহন রূপনার বাপ হেরে জায়গা দিছিল। কামকাইজ জোগার কইরা দিছে রূপনার বাপেই। রাইচরণের চাতালে কাম করতো তর মায়। পয়সাপাতি যা পাইত তা দিয়া হের একলা ভালাই চইলা যাইত। রূপনার বাপে হেরে বইনের মতোন আগলাইয়া রাখত। অসুখে বিসুখে হগল কামে হে রূপনার বাপের কাছেই যাইত। কিন্তু রাইচরণ এই ভালা মাইয়াডারে কী যে করলো কে জানে!

কিছুদিন পর হুনি সবাই দেহি কওয়া-বলা করে শুক্কুবালারে লইয়া। কিন্তু হেরে দেইখা আমরা কিছু বুঝি নাই। এদিকে হে রাইচরণের ডরে কাওরে কিছু কইয়াও যায় নাই। কিন্তু বেশ কিছুদিন হে লুকাইয়া আছিল ঘরের মইদ্যে। হগলে জিগায় শুক্কুবালা কামে যায় না ক্যা। রূপনার বাপে কয় হের খুব অসুক। ভালা হইলে কামে যাইব। কিন্তু একদিন কি ঠাডা পড়ার মতো বেমক্কা খবরটা হুনি। শুক্কুবালা নাহি পোলা বিয়াইছে। বেবাকে ছুটল শুক্কুবালারে দেখতে। কিন্তু হে ভোজবাজির মতো গায়েব।

 শুক্কুবালারে আর খুঁইজা পাওন গেল না। হগলের মুখে মুখে রসের কথা। পোলার বাপ কিডা এই চিন্তায় হগলের ঘুম শেষ। শুক্কুবালার খোঁজ কেউ করল না। খালি ভিতরে ভিতরে খুঁইজা মরল রূপনার বাপে। এইবার হেই পোলারে কে দেখে। শেষমেষ রূপনার বাপের কাছেই ঠাঁই হইল। রূপনার মায়ে নিজের পোলার মতো পালতে লাগল। বছরখানেক পরে একদিন রূপনার বাপ মইরা গেল। হেই পোলারে লইয়া পড়ল বিপদে। ততদিনে রূপনার জন্ম হইছে। দুইখান পোলা মাইয়া লইয়া রূপনার মায় পড়ল মহা বিপদে। আসগর মহাজনের বাড়িতে কাম কইরা রূপনার মায় দুইজনরে বড় করতে শুরু করল। আস্তে আস্তে যখন পোলায় হাঁটতে শিখল, কথা কইতে শিখল, তহন থাইকাই আসগর মহাজনের বাড়িতে রূপনার মার লগে যাইত আইত। আসগর মহাজন মানুষ ভালা। হেই পোলাডারে খাওনদাওন দিত। আস্তে আস্তে পোলা ডাঙর হয় আর মহাজনের ফাইফরমাশ খাডে। এই হইলো মঙ্গলার কাহিনি। মঙ্গল বারে হইছে দেইখা রূপনার বাপে নাম থুইছিল মঙ্গলা। এ গল্প মঙ্গলা অনেকবার শুনেছে। জেলেপাড়া, সামনে মুসলমান পাড়া সব পাড়াতেই একই গল্প। কিন্তু তাঁর মায়ের হদিস আর বাপের হদিস কেউ দেয় না। তয় ছোটবেলায় সবার ভাবভঙ্গিটা দেখে সে মনে মনে বাপের একটা প্রতিকৃতি এঁকেছে। সেখানে হারামি রাইচরণের মুখটাই বারবার ভেসে উঠেছে। তাই রাইচরণের প্রতি আক্রোশটা যেন একটু বেশি মঙ্গলার।

চার

‘তোর বাপে বোলে সব জানত।’

‘কেডায় কইলো?’

‘কেডায় কইলো হেই প্রশ্ন জিগাস ক্যান? সত্য না মিথ্যা হেইডা ক।’

‘বাপে জানলে জানল, আমি জানমু কেম্বায়?

‘ক্যান কোনওদিন কিছু কয় নাই কাহা?’

‘না কয় নাই।’

‘তুই মিছা কইতাছস মনে লয়।’

‘কি কও, মিছা কমু ক্যা?’

‘হ আমার মনে লয়, তুইও মেলা কিছুই জানোস, আমারে কছ না।’

‘আমি জানলে তো কবেই তুমি হুনতা।’

‘হ, আমিও হেইডা কই। তুই জানলে তো আমারে কইতি। আইচ্ছা, কাহি  জানে কি ব্যাপারডা?’

‘কেমনে জিগাই মায়েরে?’

‘আইচ্ছা, তুই না পারলে আমি জিগাই।’

‘না জিগাইলেই ভালা।’

‘ক্যান, ক্যান ভালা?’

‘এইসব জাইন্যা আর লাভ কী? তোমার কি জাউরা বাপরে খুঁইজা আদর করন লাগব? তুমি এহন তোমার জীবন লইয়া ভাব। তুমি এহন কর্মক্ষম হইছো, এহন তোমার নিজের জীবন সাজাও। হেইডা না কইরা অহন তুমি কার পোলা, কার কী, এইসব খুঁইজ্যা লাভ কী?’

‘হ ঠিকই কইছস। কিন্তুক রাইতে তো দুই চোক্ষের পাতা এক করতে পারি না। আমারে শান্তি দেয় না। খালি জ্বালায়। হেই জ্বালায় যে জ্বলে নাই হে জানব কেমনে!’

‘তাইলে একখান কাম করো, বাপরে খুঁইজা বাইর করনের আগে মারে খুঁইজা বাইর করো। তইলে বাপরে এমনেই পাইয়া যাবা।’

‘মায়রে কেমনে চিনুম? মার যে কোনও কিছুই আমার মনে নাই। মায় সাদা না কালা কেমনে কমু। তয় দোষ কিন্তুক তাগো দুইজনেরি। পৃথিবীতে আনছে কিন্তু নিজে গো কাছে রাহে নাই। হিয়াল-কুত্তার লাহান ফেলাইয়া থুইয়া চইলা গেছে। একবারও আমার অসহায় অবস্থা বুঝে নাই। এমন পাষাণ মা ক্যামনে হয়, কইতে পারোস?’

‘মায়রে দোষ দিও না। তার কষ্ট তুমি ক্যামনে বুঝবা? তোমার বাপ যদি তারে জায়গা দিত, হে তো এমুন কাম করত না। তোমার মার তো আর করনের কিছু আছিল না।’

‘তার পরেও। মায়রে  কোনওদিন পাইলে আমি ছাড়ুম না।’

মঙ্গলা কী যেন ভাবল। তারপর হনহন করে হেঁটে চলে গেল।

রূপনার মা এসে ছেলেটার জন্য আফসোস করতে লাগল। রূপনাকে ওর সঙ্গে আরও নমনীয়ভাবে কথা বলতে অনুরোধ করল।

পাঁচ

‘ওই কুলাঙ্গারের পুত আমার নাওডারে ইচ্ছা কইরা ডুবাইছে। এইডা ওর কাম ছাড়া অন্য কেউ করতে পারে না। আসগর মহজন যতই ভালা মানুষ হোক না ক্যান ওই কুলাঙ্গারটার জোরেই তো বাহাদুরি করে। অরে আমি জনমের শিক্ষা দিয়া ছাড়মু।’

‘রাইচরণবাবু তুমি হুদাই ফাল পারো। কামডা কে করছে, হেইডা তুমি দেহ নাই। দইরায় জলদস্যু আছে, আছে কত মতলববাজ, তোমার নাও কেম্বায় ডুবছে হেইডার কোনও প্রমাণ নাই। তুমি হুদা ওরে গালাগালি কইরা নতুন হাঙ্গামা লাগাইও না। কারণ এই বাজারে আসগর মহাজনের মতো ভালা মানুষ আর কেউ হয় না। হে কারওরডা ধরেও না, ছোঁয়ও না। পারলে আমারে তোমারে হগলতেরেই হে সাহায্য করে। আর তা ছাড়া রক্তডা কিন্তু তোমারই। এই কথা অনেকেই জানে। খালি তোমার ডরে কেউ মুখ খোলে না। একবার যদি জাইন্যা যায় মঙ্গলা, তুমিই অকামের মহাজন, তাইলে কিন্তু নিস্তার নাই। পাপ কিন্তু বাপরেও ছাড়ে না।’

হলধরের কথাগুলো কেমন ভয় ধরানো। রাইচরণ গাঁইগুঁই করে। তার চোখে ভাসে সেই ছিপছিপে অষ্টাদশীর যৌবন। কোন অসময়েই সে এই  আড়তে কাজ করতে এসেছিল আর কেনই বা সে এমন করে তাকে মুগ্ধ করেছিল, রাইচরণ তা জানে না। হলধরের কথা শুনে সে ঠান্ডা হয়ে যায়।

হলধর আবার বলে, ‘একদিন না একদিন মঙ্গলা ঠিকই বাইর কইরা ফেলাইব তোমারে। হেইদিনের কথা ভাইবা হইলেও ওর লগে একটা ভাব রাখ। না হয় বাজারের হগল মাইনষের সামনে তুমি নাকাল হইবা।’

‘ওর এত্ত বড় সাহস হইব আমার লগে লাগার?’

‘কর্তা কয় কি, অর কি ন্যাংটা হওনের ডর আছেনি? ডর তো সব তোমার।’

‘ক্যান ক্যান, আমার ডর হইব ক্যান?’

সে কথাই বোঝায় হলধর রাইচরণের কানে কানে। ওদের কথায় যে মুখ্য বিষয়টি উঠে আসে সেটা হলো যেভাবেই হোক মঙ্গলাকে গ্রামছাড়া করার কোনও উপায় যদি খুঁজে বের করা যায়। এমন ভাবনাতেই ওরা মশগুল থাকে।

ছয়

বাজারে তখন আড়ত বন্ধ করার সময়। আসগর মহাজন বাড়িতে ফিরেছে। মঙ্গলা আর তপন আড়ত বন্ধ করে ফিরবে। ঠিক তখন পাড়ার একজন এসে খবর দিল রূপনার মার অবস্থা খারাপ। যায় যায় অবস্থা। চোখমুখ টানা দিয়েছে। শুনে তো মঙ্গলা আর তপন হায় হায় করে উঠল। দ্রুত ওরা বন্ধ করে আড়ত। ভ্যান নিয়ে মঙ্গলা বের হয়। তপন ভ্যানে বসে পড়ে। গ্রামে এসে রূপনাদের বাড়িতে রূপনার কান্নার শব্দ পায়। কী হয়েছে জানতে চায় মঙ্গলা। রূপনা বলে দুদিন যাবৎ ডায়রিয়ায় রূপনার মার এই অবস্থা। আর দেরি নয়। হাসপাতালে নিতে হবে। ভ্যানে ধরাধরি করে তোলা হয় রূপনার মাকে। ভ্যান ছুটে চলে হাসপাতালের দিকে। গভীর রাতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয় রূপনার মাকে।

স্যালাইন চলতে থাকে। আর নির্ঘুম বসে থাকে মঙ্গলা, তপন আর রূপনা। স্যালাইন শেষ হতেই রূপনার মা চাঙা হয়ে ওঠে। সকালে মঙ্গলা বলে, ‘এইবার আর চিন্তা নাই। তুই থাক, আমরা কামে গেলাম।’

রূপনা মাথা ঝাঁকায়। চোখে মুখে কৃতজ্ঞতা। কিছুদূর চলে যাবার পরেই রূপনা আবার মঙ্গলাকে ডাকে। তপন একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকে।

মঙ্গলা কাছে এলে রূপনা বলে, ‘কাইল মায়রে যদি হাসপাতালে না আনতা তয় মায় বাঁচত না। তুমারে  কেমনে কি সকালে যদি কিছু খাওয়াইতে পারতাম। রাইতের কালেও তো কিছু খাও নাই।’

ধুরও পাগল। আমি খাইয়া লমুনে । মঙ্গলা পকেট থেকে টাকা বের করে রূপনার দিকে এগিয়ে দেয়, ‘ধর তুই কিছু খাইয়া লইস।’

রূপনা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে মঙ্গলার মুখের দিকে। যেন এ মুখ তার অচেনা। মনে হয় এ মমতা সে কোনও দিন পায়নি। মঙ্গলা ফিরে হাঁটতে থাকলে তার কান্না পায়। মনে হয় যেন খুব নিকটজন তাকে একা ফেলে দূরে কোথাও চলে যাচ্ছে। একটা ভালো লাগা বোধ কাজ করে। সেটা যে কতটা সুখের তা রূপনা কাউকে বোঝাতে পারবে না।

সাত

মঙ্গলা অনেক দিন যাবৎ শত্রুদের গতিবিধি বুঝতে পারছিল না। কিন্তু ব্যাপারটা এমন হয়ে যাবে সে কল্পনাই করতে পারেনি। তাই নতুন আক্রমণের জন্য সতর্কতা অবলম্বন করছিল। দিনে দিনে এক শ্রেণির মানুষ তাকে আর রূপনাকে নিয়ে যে অশ্লীল মুখরোচক বাক্য খাদ্য হিসেবে চর্বণ করছিল, তা যেন সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিল। রূপনার মা মুষড়ে পড়েছিলেন। মঙ্গলার মুখের ওপর তিনি নিষেধাজ্ঞাও দিতে পারেন না, আবার লোকের কথাও হজম করতে পারেন না। রূপনার মায়ের হাবভাব দেখে যেন বুঝেই যায় মঙ্গলা, এতদিনের ভালোবাসায় চিড় ধরেছে। সেখানে আস্তে আস্তে ঘৃণা জন্ম নিচ্ছে। মনে হয় সে আর এ বাড়িতে আসতে পারবে না। সে কথাই তিনি মঙ্গলাকে বলেন কোনও এক রাতে।

তখন বাজার ফেরত মানুষ সবাই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিল। রূপনার মা মঙ্গলার হাত ধরে কেঁদে ফেললেন। নিজের ছেলের মতো কোলেপিঠে করে মানুষ করেছেন মঙ্গলাকে। মঙ্গলারও চোখের কোণে জল এল। কিন্তু সে জল সে মাটিতে পড়তে দিল না। নীরবে মেনে নিল এক অসহায় মায়ের করুণ মিনতি।

রূপনার মাকে যারা বলেছে, তারাই এসে রূপনাকে লাগিয়েছে। রূপনা সে ফাঁদে পা দিয়েছে। বুঝতে পারেনি সে মঙ্গলাকে। মঙ্গলা এমনই, কেউ সহজে বোঝে না। সবাই কম বেশি ওকে মাথা মোটা গোঁয়ারও বলে। বলে বলুক, ক্ষতি নাই মঙ্গলার, শুধু যেন রূপনাই ভুল না বোঝে। কারণ এক রূপনার মুখের কাছেই মঙ্গলার ফেরা। যখন সে সমুদ্রে থাকে তখন ওই মুখটা দেখার জন্য ছটফট করে। কিন্তু চারদিকে শুধু লবণাক্ত জল আর জল। যেমন নৌকায় যদি খাবার পানি ফুরিয়ে যায় যখন আর খাওয়ার পানি থাকে না, তখন একটা ত্রাহি অবস্থা। বিধাতার কি পরিহাস, পানি আছে কিন্তু তা খাবার যোগ্য নয়। ঠিক তেমনি মঙ্গলার বুকের ভেতরটাও খাঁখাঁ করতে থাকে যখন রূপনার মুখের মুখোমুখি না হয়।

কিন্তু কে বা কারা তাদের সম্পর্কে এমন ফাটল ধরাতে ব্যস্ত, তা কি উদ্ধার করতে পারবে মঙ্গলা? মঙ্গলা পারলেও রূপনা নয়। কারণ রূপনাকে সবসময় গ্রামের মহিলাদের সঙ্গেই ওঠাবসা করতে হয়। কুটনা-কথা চালাচালির মানুষের অভাব নেই। একটু পান তামাক আর একটু চায়ের স্বাদ জিহ্বাতে ঠেকাতে পারলেই জিব দিয়ে বিষ ঢেলে দেবে কিছু লোক। হলোও তাই। সম্পর্কে ফাটল ধরাতে তারা সফল হলো। অনেকটা ঝগড়ার মতো হয়ে গেল ব্যাপারটা। রূপনাকে এসে অনেকেই বলেছে, মঙ্গলা এখন মদ খায়, বাজারে মেয়েমানুষের বুকের তলায় ওম খোঁজে। এ নিয়ে মঙ্গলার সঙ্গে রূপনার তুমুল ঝগড়া। মঙ্গলাও কম যায় না, সেও চেঁচামেচি করে। মুখ দিয়ে নানারকম আকথা-কুকথা বেরিয়ে যায়।

মঙ্গলা কিছুতেই বোঝাতে পারে না রূপনাকে এ তার শত্রুদের নতুন খেলা। তবে মঙ্গলাকে তপন যে কথা বলে সেটা হলো, মঙ্গলাকে কিছুদিন চুপচাপ থাকতে হবে। থাকলে কি হবে? তখন রূপনা তার ভুল বুঝতে পারবে। আর তখন তাদের সব বিবাদ মিটে যাবে। কিন্তু এ বিবাদ কীভাবে মিটবে মঙ্গলা বোঝে না। তার শত্রুরা যদি এর পরে আরও জটিল করে তোলে বিষয়টা। তখন কী হবে? রূপনা যদি সব কিছু বিশ্বাস করে ওদের সম্পর্কটা ভেঙে দেয়! মঙ্গলা আশংকার কথা মুখে আনে না। বুকের ভেতরই জমা রাখে। আস্তে আস্তে মেঘ জমে ওঠে। মঙ্গলার সহ্যের বাইরে চলে যায়। ছটফট করে তার বুক।

মন খারাপ করে এমনি শুয়ে ছিল মঙ্গলা ঘাটে। রাত তখন অনেক হয়েছে। তখনই খবর নিয়ে এল তপন। কে বা কারা রূপনার মুখ পুড়িয়ে দিয়েছে। অন্ধকারে দেখা যায়নি। সবাই বলাবলি করছে, এটা মঙ্গলার কাজ। লোকজন রূপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেছে। কথা শুনে মঙ্গলার মাথায় দাউ দাউ করে আগুন জ¦লে। এ মিথ্যের গণ্ডি সে ছিঁড়বে কেমন করে? শত্রুপক্ষের অসাধারণ চালটা এবার বুঝতে দেরি হলো না মঙ্গলার। ওরা এ গ্রাম থেকে ওকে তাড়াতে চায়। ওরা আসগর মহাজনের ক্ষতি করতে চায়। ওরা রূপনার ক্ষতি করতে চায়। ওদের চাল খুবই সূক্ষ্ম। কারও বোঝার সাধ্য নেই। এ জাল কেটে বের হতে তার সময় লাগবে। কিন্তু ততদিনে রূপনাকে কি সে হারিয়ে ফেলবে না? এখন সে কি করবে?

তপন বলছে, ‘কেউ যদি পুলিশে খবর দেয়?’

‘পুলিশে খবর দিবে কেডা?’

রাইচরণের মানুষই পুলিশ ডেকে আনবে। টাকা পয়সা যাই লাগুক এটাই এখন সত্য যে মঙ্গলাকে ধরতে হবে। কারণ সে রূপনার মুখ পুড়িয়ে দিয়েছে। অপরাধীকে ধরে আগে শাস্তি দিতে হবে। ক্ষুব্ধ লোকজন তাকে পেলে ভর্তা বানিয়ে ফেলবে। কিন্তু মঙ্গলার যে এখনি রূপনাকে দেখতে ইচ্ছে করছে। ঝগড়া লাগার পর কয়েক দিন হলো সে রূপনাকে দেখেনি। মনটা ছটফট করছে রূপনার জন্য। একবার রূপনার সঙ্গে দেখা করে বলা তো উচিত ওকে, এ কাজ সে কোনওদিনও করেনি। করতে পারে না। কিন্তু কীভাবে, কী করবে, বুঝে উঠতে পারছে না মঙ্গলা।

একগাছি নৌকাটার ওপর শুয়ে শুয়ে রূপনার পোড়ামুখ কল্পনা করে মঙ্গলা। তপন বকবক করে অনেক কথাই বলে যায়। তার কিছু ঢোকে বাকি সব উড়ে যায় মাথার ওপর দিয়ে। জেলেপাড়া থেকে কে যেন খবর আনে পাড়ায় পুলিশ এসেছে। ওরা মঙ্গলাকে খুঁজছে। রাইচরণের মানুষ মঙ্গলাকে খুঁজে বের করে দেবে। কী করবে এখন মঙ্গলা? তপন কয়েকবার ডাক দিল মঙ্গলা উত্তর দিল না। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে রূপনার মুখের ভেতর ডুবে আছে। মানুষ এমনই বুঝি। শান্তিতে থাকতে চায় না। নিরপরাধ মঙ্গলাকে এমন করে ফাঁসিয়ে দিল?

মঙ্গলার ভেতর এখন ঘৃণা ক্রোধ কিছুই কাজ করে না। একটা ভয় এসে বাসা বাধে। সে এমন ভীতু হলো কবে থেকে? অবাক হয় নিজে নিজেই। তার ভেতরের সেই চিৎকারটা কোথায় গেল ? প্রতিবাদী আর দৃঢ়চেতা মনোবল কেন সে খুঁজে পাচ্ছে না?

পুলিশ মনে হয় খুব কাছেই চলে এসেছে। ছেলেটিকে তাড়িয়ে দিয়ে তপন নিজেই নৌকায় ওঠে। একগাছি নৌকাটিকে ভাসিয়ে দিয়ে বৈঠা তুলে নেয়। মঙ্গলা শোকের ধাক্কাটা সামলে উঠুক। তার আগে ওকে পুলিশের হাত থেকে বাঁচাতে হবে।

মঙ্গলার চোখে রূপনার পোড়ামুখ আরও রূপবতী হয়ে সমস্ত আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। মঙ্গলা সেদিকেই নিথর তাকিয়ে থাকে। তপনের কর্মকাণ্ড কিছুই তার চোখে পড়ে না।

সচিত্রকরণ : রজত  

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button