অনুবাদ গল্পআর্কাইভ

অনুবাদ গল্প : বিবস্ত্র স্বরেরা

মূল : সাদাত হাসান মান্টো

বাংলা অনুবাদ : প্রবাল দাশগুপ্ত

[সাদাত হাসান মান্টো ১৯১২ সালের ১১ মে পাঞ্জাব লুধিয়ানার পাপরউদি গ্রামের ব্যারিস্টার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মান্টোর পূর্বপুরুষ কাশ্মিরী বংশোদ্ভূত ছিলেন। মান্টোর পিতা ছিলেন একজন আদালতের বিচারক। কঠোর শাসনেও মান্টো ছোটবেলা থেকে বোহেমিয়ান হয়ে ওঠেন। লেখাপড়ার হাতেখড়ি অমৃতসরের মুসলিম হাই স্কুলে। কিন্তু স্কুলের গণ্ডিতে তাঁর মন-প্রাণ হাঁপিয়ে উঠত। পড়ালেখায় অমনোযোগিতার কারণে স্বভাবতই দুবার এন্ট্রান্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ হন। কিন্তু স্কুলের পাঠ্যবহির্ভূত গল্প-উপন্যাসের বই পড়ার প্রবল আগ্রহ তাঁকে তরুণ বয়সেই অমৃতসর রেল স্টেশনের হুইলার বুকস্টল থেকে বই চুরিতে প্রলুব্ধ করেছিল। ১৯৩১ সালে কলেজে পাঠকালীন অবিভক্ত ভারতে স্বাধীনতা সংগ্রামের অশান্ত পরিবেশে মান্টোর লেখাপড়ার ব্যাঘাত ঘটে। ১৯৩২ সালে পিতার মৃত্যুর পর মান্টো আরও অসহায় হয়ে পড়েন। পরিবারের অর্থকষ্ট লাঘবের জন্যে তখন থেকেই তিনি আয়-উপার্জনের পথ খুঁজতে থাকেন। সে সময় তার্কিক লেখক লেখক বারি আলিগের সঙ্গে মান্টোর সাক্ষাৎ ঘটে। এই সাক্ষাৎ সাদাত হাসান মান্টোর জীবনে একটি মাইলফলক।]

ভোলু আর গামা। দুই ভাই। খুব কর্মিষ্ঠ দুজনেই। ভোলু টিনের সামগ্রী ফেরি করত। রাংঝাল করার যন্ত্রটা মাথায় নিয়ে রোজ সকালে বেরিয়ে শহরের রাস্তা, গলিঘুঁজি বেয়ে হাঁক পাড়ত বাসনপত্র ঝালাই করানোর জন্য। সন্ধ্যাবেলায় যখন সে বাড়ি ফিরত, কোঁচড়ে বেশ কিছু রোজগার ঠাঁই পেত।

গামাও ওই ফেরিওয়ালাই। মাথায় ঝাঁকা, পথে পথে সেও ঘুরে বেড়াত। রোজগার তারও হতো বেশ কিন্তু মাল খাবার বদভ্যাস ছিল। প্রতি সন্ধ্যায় খাবারদাবারের সঙ্গে এক পাঁইট দিশি তার চাইই চাই। আর ওই দিশিটা ওর মাথায় চড়ত। সবাই জানত ও নেশা করার জন্য বাঁচে।

দু’ বছরের বড় গামাকে শোধরানোর বহু চেষ্টা করত ভোলু। মদ খাওয়া ভালো নয়, তুমি একজন বিবাহিত পুরুষ, কেন টাকা নয়ছয় করছো ? তোমার স্ত্রী ওই টাকা হাতে পেলে কত সুন্দর জীবন কাটাত বলো তো ? তুমি কি চাও তোমার বউ ওই ন্যাতা পরে অর্ধ উলঙ্গ হয়ে ঘুরুক ? এই সব বলত ভোলু।

এক কান দিয়ে ঢুকে এসব কথা আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেত গামার। শেষ অবধি ভোলু হেরে গেছিল। আর কিছু বলা ছেড়ে দেয়।

দুজনেই রিফিউজি। চাকর-বাকরদের থাকার জন্য অন্যদের সঙ্গে অনেক ঘরওয়ালা একটা বিরাট বাড়ি জুটেছিল ওদের। অন্যান্য অনেক ভবঘুরে মতোই তিনতলায় একটা ঘর দখল করেছিল দুই ভাই। ওটাই ছিল ওদের বাড়ি।

শীত সহজেই পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গ্রীষ্ম বেচারি গামাকে অসুবিধেয় ফেলল। ভোলু ছাদে বিছানা পেতে আরামে ঘুমাতো। কিন্তু গামা ? তার কী হবে ? কী করবে ও ? তার তো স্ত্রী আছে! আর ওপরে, ছাদে তো কোনও পর্দা নেই! গামা অবশ্য একলা নয়। বিবাহিত যারাই ওই বাড়িতে থাকত সবারই ওই একই সমস্যা, সংকট, দ্বিধা।

কালান একদিন দারুণ এক আইডিয়া নিয়ে এল। তার খাটটা চট দিয়ে ঘিরে আড়াল তৈরি করে ফেলল। অন্যরাও চট করে আইডিয়াটা গ্রহণ করে যে যার খাট চট দিয়ে ঘিরে ফেলল―যারা বিবাহিত। ভোলু এগিয়ে এল। দুই ভাই মিলে বাঁশের খুঁটি পুঁতে চট আর পুরনো কাঁথা কম্বলের পর্দা টাঙিয়ে দিল গামার খাটের চারধারে। হ্যাঁ, হাওয়া আটকে গেলেও নীচে, কোয়ার্টারে যে নরক, তার থেকে বোধ হয় ভালো ছিল এই বন্দোবস্ত।

ছাদে শোয়া শুরু করাতে ভোলুর চরিত্রে কিন্তু একটা বিচিত্র পরিবর্তন এল। এতদিন বিয়েটিয়েতে ওর আস্থা ছিল না। সত্যি বলতে কী, ও ঠিকই করে ফেলেছিল ওই ফাঁদে কোনওদিনই পড়বে না। গামা বিয়ের প্রসঙ্গ তুললেই ও বলত, না ভাই, অযথা সমস্যায় আমি পড়তে চাই না। কিন্তু গ্রীষ্মের আগমনে এবং দশ পনের দিন ছাদে শোয়ার পর ওর মন পাল্টে গেছিল। এক সন্ধ্যাবেলায় ভাইকে বলেছিল, আমার বিয়ে দাও নয়তো আমি পাগল হয়ে যাব।

মজা করছিস ? গামা জিজ্ঞাসা করেছিল।

আরও গম্ভীর হয়ে ভোলু জবাব দিয়েছিল, তুমি জানো না…পনেরো দিন আমি ঘুমাতে পারিনি।

কেন ? কী হয়েছিল ?

তেমন কিছু নয়, শুধু ওই লেফট, রাইট… প্রত্যেক কোণে কিছু একটা ঘটছিল… বিচিত্র স্বর এবং অদ্ভুত সব ধ্বনি আসছিল চতুর্দিক থেকে। এর মধ্যে কেউ ঘুমাতে পারে ?

মোটা গোঁফের আড়াল থেকে অট্টহাসিতে ফেটে পড়েছিল গামা।

একটু অপ্রতিভ হয়ে পড়েছিল ভোলু। তারপর বলে ওঠে, ওই কালান, ওটা একটা চরম! এত্ত রাবিশ বকে সারা রাত… আর ওরবউ… সেও অনর্গল, থামে না। পাশে বাচ্চাটা ঘুমোচ্ছে, কোনও হুঁশ আছে ওদের ?

নিত্যকার মতোই, গামা মাল টেনে চলেছিল। ভোলু চলে গেলে ইয়ার দোস্তদের ডেকে গামা রসিয়ে রসিয়ে বলেছিল এ কদিন ভোলু কেমন ঘুমাতে পারেনি এবং কেন। এবং কারণটা যখন বিশদে বলল তার অননুকরণীয় ভঙ্গিমায়, বন্ধুরা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে বিমল আনন্দে। শুধু তাই নয়, পরে যখন ভোলুর সঙ্গে মোলাকাত হতে থাকে, এই সব ইয়ার দোস্তরা তাকে নিষ্ঠুরভাবে উত্ত্যক্ত করতে থাকে। কেউ বলে, আরে বল না কালান বউকে কী বলে রে ? আর কেউ বলে ওঠে, বিনি পয়সায় রোমান্স, কেয়া বাত…সারা রাত ফিলিম…! অন্যরা আরও নোংরা কথা বলে। এই সব জঘন্য রসিকতা ভোলু নিতে পারে না। বিরক্ত হয়।

অপ্রমত্ত গামাকে পরের দিন ধরে বসল ভোলু। তুই তো আমাকে জোকার বানালি! দ্যাখ, আমি যা তোকে বলেছি সেগুলো লেশমাত্র আমার কল্পনা নয়। আমি একটা মানুষ। ভগবানের দিব্যি তোকে বলছি, আমি ঘুমোতে পারছি না। প্রায় কুড়ি দিন হলো আমি বিনিদ্র। শিগগির আমার বিয়ে না দিলে, আমি শপথ করছি, আমি কিন্তু যা তা করে ফেলব। তোমার বউয়ের কাছে আমার জমানো পাঁচশ টাকা আছে… ওটা খরচ করে সব বন্দোবস্ত করো।

গোঁফে তা দিতে দিতে চিন্তিত গামা আশ্বাস দেয় : আচ্ছা ঠিক আছে, সব হয়ে যাবে। আজ রাতে গিন্নিকে বলব তার বন্ধুবান্ধবের মধ্যে একটা উপযুক্ত মেয়ে জোগাড় করতে।

মাস দেড়েকের মধ্যে পাত্রী জুটে গেল আর বন্দোবস্তও হলো। টিনমিস্ত্রি সামাদের মেয়ে আয়শাকে গামার বউই জোগাড় করল। আয়শা সুন্দরী, গৃহকর্মে নিপুণা আর সামাদও বেশ সভ্য ভদ্র। মহল্লার লোকেরা ওকে সম্মান করত। এদিকে ভোলুও ভালো পাত্র―পরিশ্রমী, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী। জুন মাসের মাঝামাঝি তারিখ ঠিক হলো। সামাদ আপত্তি করেছিল অত গরম বলে। কিন্তু গামা জোর করল। আপত্তি টিকল না।

বিয়ের চারদিন আগে ভোলু কনের জন্য বন্দোবস্ত করে ফেলল। ছাদে খাটের চারদিক ঘিরে দিল চটের বস্তা দিয়ে। বাঁশের খুঁটিপুঁতে দারুণ শক্তপোক্তভাবে চট বেঁধেছিল। শুধু তাই নয়, খাটের পাশে কুঁজো, গেলাস রেখেছিল। দারুণ যত্ন ও উৎসাহ নিয়ে এসব করেছিল ভোলু।

প্রথম রাত চটের আড়ালে শুয়ে একটু অস্বস্তিই হলো ওর। টাটকা, শীতল বাতাসে ওর অভ্যাস। কিন্তু কী আর করা, ও চাইছিল এতেই অভ্যস্ত হতে, বিয়ের চার দিন আগে থেকেই। প্রথম রাতে ছাদে শুয়ে ও যখন ওর ভাবি বউয়ের কথা ভাবছিল, ঘেমে গেছিল। শব্দরা ওর কানে প্রতিধ্বনি তুলেছিল― শব্দরা―যে শব্দরা তাকে নিদ্রাহীন করেছিল―শব্দরা―যে শব্দরা চিন্তার দৌড় তুলেছিল তার মস্তিষ্কে।

আমরাও কি একই রকমের শব্দ সৃষ্টি করতে চলেছি ? চারপাশের লোকেরা কি আমাদের শব্দ শুনবে ? ওরাও কি জেগে থাকবে সারা রাত আমাদের শব্দের কারণে ? দেখবে আমাদের ? উঁকি মেরে ? ভোলু এইসব ভাবছিল শুয়ে শুয়ে।

যতই ভাবছিল ততই উত্তেজিত হচ্ছিল সে। শুধু একটা প্রশ্ন তাকে ঘুণপোকার মত বিব্রত করছিল : চটের কাপড় কি যথেষ্ট আবরণ ? চতুর্দিকে কেউ না কেউ, সামান্য একটি মর্মর, রাতের স্তব্ধতায় মুখর হয়ে উঠবে না ? এমন উলঙ্গ জীবন মানুষ কী করে যাপন করে ? চারিদিকে অগুনতি চোখ, কান। দেখতে যদি না-ও পাওয়া যায়, শোনা তো যাবে ? ন্যূনতম শব্দ একটি দৃশ্যকে প্রাণ দেবে… চটের পর্দা কী করতে পারে ? সূর্য উঠলে সব প্রকাশ্য…ওই তো কালান বউয়ের বুক মথিত করছে…আর ঐদিকে ওর ভাই গামা। সব খুলে গেছে, উলঙ্গ। ওখানে শান্তা―ইদুর অবিবাহিত কন্যা―তার অনাবৃত পেট চটের ফাঁক দিয়ে দৃশ্যমান।

বিয়ের দিন। ভোলু পালাতে চাইছিল, কিন্তু কোথায় ? নিজের তৈরি ফাঁদে পড়ে আজ সে অচল। যদি সে পালাতে পারত, আত্মহত্যা করত। কিন্তু তারপর ? বেচারি মেয়েটির কী হতো ? আর অন্যরা তো এই নিয়ে তুমুল হৈ চৈ লাগাত।

ঠিক আছে। যা হয় হবে। সবাই তো এরকমই করছে, আমারও অভ্যাস হয়ে যাবে―নিজেকে সাহস জোগাল ভোলু। বউ ঘরে এল।

কোয়ার্টার জুড়ে উত্তেজনার তরঙ্গ। মানুষজন ভোলু আর গামা দুজনকেই অভিনন্দন জানাল। ভোলুর নিকট বন্ধুরা ঠাট্টা করল, সোহাগ-রাতের দুয়েকটা খেলও শিখিয়ে দিল কেউ কেউ। ভোলু সব শুনল চুপ করে। চটের পর্দার পেছনে গামার বউ নতুন বিছানা পাতল, বালিশের পাশে জুঁই ফুলের চারটে মালা রাখল গামা। জিলিপি আনল কোনও বন্ধু।

নববিবাহিত বউয়ের সঙ্গে নিচে, কোয়ার্টারে, অনেকক্ষণ বসে রইল ভোলু। বেচারি নববধূ কনের সাজের পুঁটলির মধ্যে মাথা মুড়েও ঝুঁকিয়ে চুপ করে বসেছিল। গরম অসহ্য। ভোলুর কুর্তা পায়জামা গায়ের সঙ্গে ঘামে সেঁটে গিয়েছিল। প্রথমটা ও ভেবেছিল ছাদে যাবে না, কোয়ার্টারেই রাত কাটাবে। কিন্তু প্রাণান্তকর গরম হওয়াতে বউ নিয়ে ছাদের দিকে হাঁটা দিল।

ছাদে পৌঁছল ওরা। চারিদিকে নিঝুম নিস্তব্ধ। অচপল পায়ে পায়ে বউ হেঁটে গেল বিছানার দিকে। প্রতিটি ভীরু, লাজুক পদক্ষেপের কথা নূপুর বলে উঠেছিল। ভোলুর মনে হচ্ছিল আবৃত সুপ্তি যেন ধাক্কা খেয়ে জীবন পাচ্ছিল। ওদিকে জনগণ তাদের খাটে এপাশ-ওপাশ করছিল, আন্দোলিত হচ্ছিল। কাশছিল কেউ কেউ, গলাও ঝাড়ছিল অন্যরা। অস্ফুট আওয়াজ, ফিসফিসানি ফাঁপা বাতাসে ঘুরছিল। বিচলিত ভোলু বউয়ের হাত ধরে ত্বরিত গতিতে টান মারল চটের পর্দার দিকে। মুখচাপা হাসি কানে এল ওর। আশঙ্কা আরও বেড়ে গেল। চেষ্টা করল বউয়ের সঙ্গে কথা বলার কিন্তু চারদিকের ফিসফিসানি বেড়েই চলল। দূরের কোণে কালানের খাট থেকে আওয়াজ ভেসে আসছিল: চুর-চু, চুর-চু। সেই শব্দ স্তিমিত হয়ে এল আর গামার লোহার খাট কথা বলতে শুরু করল।

শান্তা অনেকবার জল খেতে উঠছিল আর প্রত্যেকবারই ওর গেলাস আর কুঁজোর ঠোকাঠুকির আওয়াজ ভোলুর কানে আসছিল বিস্ফোরণের শব্দ হয়ে। খায়রির খাট থেকে সমানে দেশলাই জ্বালানোর আওয়াজ। নববধূর সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা ত্যাগ করল ভোলু। তার আশঙ্কা হলো চারপাশের কানেরা তার কথাগুলি গিলবে আর সবকটা খাট সমবেত শব্দ করে উঠবে, চুর-চু, চুর-চু। নিঃশ্বাস চেপে রেখে ভোলু নিঃসাড়ে শুয়ে রইল। মাঝে মাঝে চোরা চাহনিতে স্ত্রীকে দেখছিল। কাপড়ের বস্তার মধ্যে পাশে খাটে শুয়েছিল নববিবাহিতা। কিছুক্ষণ জেগে থাকার পর অবশ্য ঘুমিয়ে পড়েছিল সে।

ভোলু ঘুমোতে চেষ্টা করছিল। পারেনি। একটু পরে পরেই কোনও না কোনও শব্দ তার কানে আছড়ে পড়ছিল… প্রত্যেকটা শব্দ যেন প্রমাণ সাইজ চিত্রকলা থেকে জীবন, জীবন্ত হয়ে উঠছিল।

বিয়ের প্রত্যাশা, সম্ভাবনা ভোলুর মন আশায় ভরে দিয়েছিল, ভরেছিল উত্তেজনায়। যেদিন ও মনস্থ করে বিয়ে করবে, সেদিন থেকে মাথাটা মোহময় আনন্দে রিমঝিম করছিল―সেই সব আনন্দ, যাদের সঙ্গে সে পরিচিত ছিল না। তৃপ্তিকর একটা তাপ তার দেহ গ্রাস করছিল। কিন্তু, এখন, প্রথম রাতের অভিজ্ঞতায় ও শীতল। অনেকবার ও চেষ্টা করল সেই তাপ ফিরিয়ে আনতে, আবার নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করতে, কিন্তু সেই ছবি-আঁকা স্বরগুলি, শব্দগুলি চুরমার করে দিচ্ছিল তার সব প্রচেষ্টা। নিজেকে উলঙ্গ মনে হচ্ছিল, সম্পুর্ণ উলঙ্গ, আর সবাই যেন বিরাট বিরাট চোখ নিয়ে ওকে ঘিরে দাঁড়িয়ে হাসছিল।

ভোর চারটেয় ভোলু উঠে পড়ে এক গ্লাস জল খেল। একটু যেন চিন্তা করল। কঠোরভাবে চেষ্টা করল আশঙ্কাগুলি তাড়াতে। ঠান্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। কালানের কোণটার দিকে তাকাল সে। হাওয়ায় চটের ছেঁড়া প্রান্তগুলি দুলছিল। স্ত্রীর পাশে কালান সম্পুর্ণ উলঙ্গ, ঘুমাচ্ছিল। বমি পেল ভোলুর; রাগও হলো : এরকম সব ছাদে বাতাস বইবে কেন ? আর যদি বা বয়, এমন করে চটের পর্দাকে উত্ত্যক্ত করবে কেন ? ওর মনে হলো সমস্ত পর্দা ছিঁড়ে ফেলে, সরিয়ে দেয় সবার সমস্ত আব্রু। আর নিজেও উলঙ্গ হয়ে সারা ছাদে নেচে বেড়ায়।

কিন্তু এসব সে করল না। যেমন কাজে বেরোয়, বেরোলো। বন্ধুরা সব জিজ্ঞাসা করছিল প্রথম রাতের কথা। দর্জি ফুজি চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করল, কেমন হলো ভাই ? আমাদের নাম ডোবাওনি তো ?

কিছুক্ষণ পর এক টিন মিস্ত্রির সঙ্গে দেখা হওয়াতে সে রহস্যপূর্ণভাবে বলেছিল, দ্যাখ ভাই, কিছু ভুলভাল হলে বলিস। আমার কাছে হেভি ব্যবস্থা আছে। দুর্দান্ত কাজ করবে। আরেকজন কাঁধ চাপড়ে বলল, এই যে পালোয়ান, খেপ কেমন হলো ?

ভোলু কাউকেই জবাব দিল না।

রীতি অনুযায়ী ভোলুর বউ দিন পাঁচ ছয় বাপের বাড়ি কাটিয়ে এল। ফিরে এলে ভোলু আরেকবার ধন্ধে পড়ল। সেই একই চিন্তায়। মনে হতে লাগল যারা ছাদে শোয় তাদের প্রত্যেকে অপেক্ষা করছিল তার বউ কবে ফিরবে। গত কয়েক রাত শান্ত ছিল। কিন্তু যে-রাতে ভোলু বউকে নিয়ে ছাদে এল, চতুর্দিকে সেই একই ঘটনাগুলো, শব্দগুলো প্রাণ পেল: ফিসফিসানি, অস্ফুট আওয়াজ, চুর-চু, চুর-চু, কাশি আর গলা সাফ করা, কুঁজোর সঙ্গে গেলাসের সংঘাত, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দওয়ালা খাটে পাশ ফেরা বা আন্দোলিত হওয়া, মুখচাপা হাসি। ভোলু সারা রাত আকাশ দেখে কাটিয়ে দিল। ক্বচিৎ হয়তো বা ওর দীর্ঘশ্বাস পড়ছিল, বাসনাপূর্ণ দৃষ্টি পড়ছিল বউয়ের দিকে আর তখনই নিজের ওপর বিরক্ত হচ্ছিল ও… কী হয়েছে আমার… কী হলো আমার, ওহ…

এরকম সাতদিন চলল। ভোলু হতাশায় বউকে আবার বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দিল। আরও কুড়ি দিন পেরিয়ে গিয়েছিল। একদিন গামা ডেকে বলল ওকে, অদ্ভুত মানুষ তো তুই! নতুন বউকে বাপের বাড়ি পাঠাস কী বলে ? কতদিন হয়ে গেল ও গেছে, একা একা বিছানা ভালো লাগে ?

ও ঠিক আছে।

কী ঠিক আছে ? আমায় বল কী হয়েছে। আয়শাকে পছন্দ নয় ?

না, তা নয়।

তাহলে কী ?

ভোলু আর উত্তর দেয় না। দিন কয়েক পর গামা আবার প্রসঙ্গটি তুলেছিল। ভোলু কোয়ার্টার ছেড়ে উঠে বেরিয়ে যায়। বাইরে একটা চৌকি পাতা ছিল। ভোলু তার ওপর গিয়ে বসেছিল। বৌদির কথা শুনতে পাচ্ছিল। বৌদি গামাকে বলছিল, ভোলু আয়শাকে পছন্দ করে না, এটা ঠিক কথা নয়।

তাহলে ব্যাপারটা কী ? ওর তো আয়শাতে কোনও দিলচসপিই নেই―গামা শুধিয়েছিল।

দিলচসপি থাকবে কেন ?

থাকবে নাই বা কেন ?

বৌদি এর কী জবাব দিয়েছিল ভোলু শুনতে পায়নি। কিন্তু তাও মনে হচ্ছিল ওর অস্তিত্বকে, ব্যক্তিত্বকে, সত্তাকে কেউ যেন হামানদিস্তায় পিষে কুটিকুটি করে ফেলছে।

এর পর গামার উচ্চকণ্ঠ ভেসে আসে, না না, এসব কে বলল তোমাকে ?

আয়শা ওর এক বান্ধবীকে বলেছে। আমার কাছে কথাটা ঘুরপথে এসেছে।

এ তো সাংঘাতিক―গামা বলেছিল।

বাইরে বসে ভোলুর মনে হলো একটা ছুরি ওর হৃদয়ে বিঁধল। কিছু একটা যেন বিকল হয়ে গেল শরীরের ভেতর। উঠে দাঁড়াল ও। ছাদে গেল। সমস্ত চটের পর্দা ছিঁড়তে শুরু করল। লোকজন দৌড়ে এল। ওকে থামাতে চেষ্টা করল কিন্তু ও মারামারি শুরু করে দিয়েছিল। কুৎসিত পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল সব কিছু। কালান একটা বাঁশ তুলে নিয়ে ওর মাথায় মারতে ও বেহুঁশ হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিল। যখন জ্ঞান ফিরল, মস্তিষ্ক ফিরল না।

ভোলু এখন রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। সম্পুর্ণ উলঙ্গ। যদি চটের কোনও পর্দা চোখে পড়ে, সেটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওটা টুকরো টুকরো করে দেয়।

সচিত্রকরণ : সচিত্রকরণ : শতাব্দী জাহিদ

 লেখক : রম্যলেখক, অনুবাদক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button