আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনাপ্রবন্ধ

সংস্কৃতিসাধক মফিদুল হক : বিশ্বজিৎ ঘোষ

মফিদুল হকের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

বাংলাদেশের সংস্কৃতিভুবনের এক বিশিষ্ট নাম মফিদুল হক। লেখক, গবেষক, সম্পাদক, প্রকাশক, সংস্কৃতি-সংগঠক, বীর মুক্তিযোদ্ধা―কত তাঁর পরিচয়। আত্মপ্রচারবিমুখ নীরব এক সংস্কৃতিসাধক মফিদুল হক। লোভ-প্রলোভন আর যেন-তেন উপায়ে অর্থ লাভের বিপরীত প্রান্তের মানুষ তিনি। হতে পারতেন অনেক কিছু, কিন্তু কিছুই তিনি হতে চাননি―চেয়েছেন কেবল মানবিক সংস্কৃতির উন্নয়ন, আর সে-লক্ষ্যেই বিরামহীন কাজ করে চলছেন মফিদুল হক। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা মফিদুল হকের চেতনায় থাকে সর্বদা ক্রিয়াশীল। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ে অজানা বেশ কিছু ব্যতিক্রমী গবেষণা করেছেন তিনি। সব মিলিয়ে পণ্যপূজাশাসিত এই সময়-সংক্রান্তিতে মফিদুল হক, প্রকৃত অর্থেই, একজন ব্যতিক্রমী মানুষ, সাহসী যোদ্ধা, মানবিক সংস্কৃতির সাধক।

ব্যক্ত হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় সদা-উদ্ভাসিত মফিদুল হকের মানসলোক। সদর্থক, ইতিবাচক এবং সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির সমর্থক ছিলেন মফিদুল হক―ছিলেন বাম-রাজনীতির অন্যতম সংগঠক। বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন মফিদুল হক। সদর্থক এবং সমাজবাদী রাজনৈতিক বিশ্বাস থেকেই তিনি বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করলে ২৫ মার্চের রাতেই তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৪ এপ্রিল তিনি মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের জন্য ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে গেরিলা ব্রিগেড গঠনের কাজ শুরু হয়। মফিদুল হক এই উদ্যোগে গভীরভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠেন। ছাত্রনেতা নূহ-উল-আলম লেনিন, নিজামউদ্দিন আজাদ, মফিদুল হকসহ আরও অনেকে একটি গোপন নেটওয়ার্ক গঠন করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তরুণ শিক্ষার্থীদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য এই নেটওয়ার্ক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, গেরিলাদের থাকা-খাবারের ব্যবস্থা, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক পত্রিকা মুক্তিযুদ্ধ প্রকাশ―এসব কাজে মফিদুল হক তখন নিরলস পরিশ্রম করেছেন―জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নানা কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছেন।

একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের এই ধারাবাহিকতায় উত্তরকালে মফিদুল হক আরও গুরুত্বপূর্ণ এক কাজে নিজেকে সমর্পণ করেছেন। উত্তর-প্রবংশকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শানিত করার লক্ষ্যে কয়েকজন সহযোদ্ধাকে নিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর। মফিদুল হক মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শিক্ষার্থী প্রকল্পের একজন পরিচালকও তিনি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সঙ্গে তাঁর সংযোগ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাঁর অবিচল আস্থারই স্মারক। প্রসঙ্গত এক সাক্ষাৎকারে এ বিষয়ে তিনি বলেছেন :

বলতে গেলে একাত্তর আমাকে এবং আমাদের জেনারেশনের সবার মধ্যে বলবার অনেক আকুতি তৈরি করেছে, তবে সেটা যথাযথ ভাব ও ভাষায় প্রকাশ করা খুব কঠিন কাজ। অনেকে অনেকভাবে এর প্রকাশ ঘটিয়েছেন, আমি তাঁদের ঈর্ষা করি, সেই সঙ্গে নিজের সীমাবদ্ধতাও উপলব্ধি করি। শিল্পিত এইসব প্রকাশের মধ্যে সেই সময়কে নানা ভাবে খুঁজে পাই। আমার নিজের ক্ষেত্রে আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্যে বুঝি, একাত্তর আমাকে দায়বদ্ধ করেছে। সেই দায়মোচনের বড় সুযোগ মিলেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সুবাদে।

বিশ্ব-পুঁজিবাদ এবং পুঁজিবাদী বিশ্বায়ন নীতি মফিদুল হক চমৎকারভাবে ব্যাখ্যা করে আমাদের বুঝিয়ে দিয়েছেন কীভাবে এই দুই শক্তি মানবসমাজকে বিপন্ন করে তুলছে। উত্তর-ঔপনিবেশিক জ্ঞানকাণ্ড ধরিয়ে দিচ্ছে পৃথিবীর দেশে-দেশে প্রতিরোধের শক্তির উত্থান। মফিদুল হক এসব তাত্ত্বিক কাঠামোর আলোয় বাংলাদেশের সনাতন সংস্কৃতি এবং বর্তমান প্রবণতার দিকে দৃষ্টিপাত করেছেন এবং পাঠককেও সে-বিষয়ে সচেতন করে তুলেছেন। সাবলীলভাবে সহজ কথায় জটিল কোনও বিষয় উপস্থাপনে এক পারঙ্গম শিল্পী মফিদুল হক। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ, নব্য-উপনিবেশবাদ উপনিবেশিত দেশগুলোর ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে নিজেদের ধ্যান বিশ্বাস ও সংস্কৃতিকে বিজিত জনগোষ্ঠীর ওপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। উপনিবেশিত দেশের বুদ্ধিজীবীদের নিজেদের দলে নেওয়ার চেষ্টা করে ঔপনিবেশিক শক্তি, প্রচার মাধ্যমকে তারা করে কুক্ষিগত। উপনিবেশিতের সাংস্কৃতিক জীবনে অনাকাক্সিক্ষত হস্তক্ষেপই হয় উপনিবেশী শক্তির সহজাত প্রবণতা। মনোজগতে উপনিবেশ : তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত গ্রন্থে এ কথাই ব্যাখ্যা করে মফিদুল হক লিখেছেন :

বিশ্বব্যাপী তথ্য আধিপত্যের সঙ্গে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক আধিপত্যের রয়েছে খুব নিবিড় ও অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক। তৃতীয় বিশ্বের নামে গোটা বিশ্বের অর্থনীতি আজ যে একক নয়া-উপনিবেশবাদী অর্থনৈতিক শোষণে বশীভূত, তার অনুষঙ্গ হিসেবেই গোটা বিশ্বের তথ্য-কাঠামোকে একটি এক-কেন্দ্রের অধীনস্থ রাখার সর্বাত্মক প্রয়াস চলছে। এর জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন দেশের জাতীয় সংস্কৃতিকে বিনষ্ট করে একটি তথাকথিত পশ্চিমী ছাঁচে ঢাকা আধুনিক সংস্কৃতির অবয়ব প্রতিষ্ঠা। পত্রিকান্তরে সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে এক খবর―পেরুর ট্রজিল্লো শহরের ২০০ তরুণ তাদের নাসিকা সার্জারির সহায়তার মার্কিন পপগানের জনপ্রিয় গায়ক মাইকেল জ্যাকসনের নাকের আদলে করে নিয়েছেন। খবরটা হাস্যকর আবার ভয়ংকরও বটে। বস্তুত গোটা তৃতীয় বিশ্বজুড়ে জাতীয় সংস্কৃতির এমনি নাসিকা কর্তন আজ অব্যাহত গতিতে চলছে।

গণহত্যা বা জেনোসাইড প্রসঙ্গ মফিদুল হকের লেখায় বার বার ঘুরে-ফিরে এসেছে। বিশ্বব্যাপী গণহত্যার মৌল কারণ উন্মোচনে তিনি নিরলস পরিশ্রমী। পশ্চিমা বিশ্ব মুখে মানবাধিকারের কথা বললেও পৃথিবীজুড়ে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। একাত্তর সালে গণহত্যার ভয়াবহতা বাঙালি জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। একাত্তরের সেই নৃশংস গণহত্যার কথা বলতে গিয়ে মফিদুল হক জানাচ্ছেন এই কথা :

বহুভাবে আমাদের একাত্তরের কথা বলে যেতে হবে। গণহত্যা এর একটি বড় দিক, এটা কোনও বিশেষ সময়ে বিশেষ স্থানে সংঘটিত হলেও গোটা মানবসভ্যতার সঙ্গে তা সম্পর্কিত। এমন ভয়াবহ নৃশংসতা কীভাবে সংঘটিত হতে পারে, মানুষকে কীভাবে দানবে রূপান্তর করে চরম বর্বরতায় প্ররোচিত করা যায়, তার হদিশ করা এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ একান্ত জরুরি। …ব্যাপক ও বর্বর নৃশংসতার কার্যকারণ হদিশ করা এবং জেনোসাইড প্রতিরোধ তাই সভ্যতার দায়, নানাভাবে এই দায়িত্বপালন জরুরি। আমরা জেনোসাইডের ভুক্তভোগী দেশ, তাই রয়েছে বিশেষ দায়।

অসাম্প্রদায়িক চেতনা মফিদুল হকের জীবনাদর্শের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তিনি স্বপ্ন দেখেন মিলিত জনগোষ্ঠীর মানবিক সংস্কৃতির, কামনা করেন মিলিত সংস্কৃতিঋদ্ধ প্রকৃত মানুষের উত্থান। ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ কীভাবে আমাদের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতে চায়, কীভাবে তা একাত্তরে ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল, মফিদুল হক তা ব্যাখ্যা করেছেন এভাবে :

ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ এই ভূখণ্ডে একাত্তরের ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল, ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনহরণ করেছিল, লক্ষ লক্ষ পরিবারের জীবন তছনছ করে দিয়েছিল। এর বিপরীতে বাঙালির জাতিসত্তা ও অসাম্প্রদায়িক উদার সম্প্রীতির আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লড়াই করে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই রাষ্ট্র নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর আজ আবার মুক্তিযুদ্ধের পথে ফিরে আসার জন্য উদ্যমী ও উদ্যোগী হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা কিংবা আপসকামিতা যেমন দুঃখজনক, তেমনি সমাজে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধ কূপমণ্ডূক চিন্তার প্রসার কাম্য নয়। শিল্প-সাহিত্য সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে।

মফিদুল হক সৃজনশীল প্রকাশক, মফিদুল হক ব্যতিক্রমী চিন্তাঋদ্ধ সম্পাদক। সাহিত্য প্রকাশ-এর পরিচালক হিসেবে তিনি প্রকাশনা ক্ষেত্রে সুরুচি ও সৃজনশীলতার পরিচয় দিয়ে চলছেন। একজন চিন্তাঋদ্ধ ও মননশীল লেখক হিসেবে মফিদুল হকের কৃতি বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। সাহিত্য-সমাজ- সংস্কৃতির বিচিত্র বিষয়ে তিনি লিখেছেন। তাঁর লেখায় আছে নিজস্ব চিন্তার ছাপ। মনোজগতে উপনিবেশ : তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, আবুল হাশিম, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা ও সম্প্রীতির ভাবনা, বঙ্গবন্ধু-বিষয়ক বই, লালনকে কে বাঁচাবে, সংস্কৃতি-জিজ্ঞাসা, ধানের সংস্কৃতি, বাংলাদেশ ও ইতিহাসের বিস্তার, বাংলাদেশের মুক্তি-সাধনা : টুকরো কথার ঝাঁপি―এসব বই লেখক হিসেবে মফিদুল হকের প্রাতিস্বিকতার স্বাক্ষর বহন করছে। অনন্যসাধারণ লেখার জন্য তিনি অর্জন করেছেন ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’ (২০১৩), অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় ‘একুশে পদক’ (২০১৬)।

সংস্কৃতিসাধনায় মফিদুল হকের অন্যতম আগ্রহের বিষয় বাঙালির চিরায়ত নাট্যসংস্কৃতি। নাটকের মধ্য দিয়ে তিনি দর্শকচিত্তে সঞ্চার করতে চান সদর্থক বাঙালি চেতনা। এক্ষেত্রেও তাঁর প্রয়াস বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। মফিদুল হকের এই সাধনা নিয়ে এসেছে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট ও ইউনেস্কোর যৌথ প্রকাশনা ‘ওয়ার্ল্ড অব থিয়েটার’ সংকলনের তিনি অন্যতম সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

মফিদুল হক আলোকিত মানুষ― মফিদুল হক সৃজনশীল মানুষ। একজন মানুষ সাধারণ আচরণের মধ্য দিয়েও কীভাবে অসাধারণ হয়ে উঠতে পারেন, তাঁর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আমাদের মফিদুল ভাই। এমন মুক্তমনের মানুষ আমাদের সমাজে তেমন নেই। মফিদুল হক সৃজনশীল সাধনা দিয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে আরও ঋদ্ধ করে তুলুন―এই-ই আমাদের আত্যন্তিক আকাক্সক্ষা।

লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button