আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনাপ্রবন্ধ

মফিদুল হক : মননের সৃজনে আলোকিত একজন : নাসির আহমেদ

মফিদুল হকের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

দূরে এবং কাছে থেকে দেখার অভিজ্ঞতায় যদি বলি, তাহলে বলতে হয় মফিদুল হককে চিনি প্রায় অর্ধ শতাব্দী। প্রগতিশীল রাজনৈতিক আদর্শে ছাত্র ইউনিয়নের অবিচল কর্মী-সংগঠক হিসেবে যেমন, তেমনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব এবং পরবর্তী গণতান্ত্রিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও সমান সক্রিয় নীতিনিষ্ঠ-আদর্শবাদী মানুষ তিনি।

অত্যন্ত পরিমার্জিত, রুচিবান, মিতভাষী, জ্ঞানপিপাসু এই মানুষটিকে নানাভাবে চিনি। সেই চেনা ব্যক্তিগত যতটা না, তার চেয়ে অনেক বেশি একজন মননশীল গদ্যলেখক হিসেবে।

তাই বলে কি সৃজনশীল রচনায় তিনি অনুপস্থিত ?

না, তা-ও বলা যাবে না। পঠন-পাঠনে ঋদ্ধ একজন চিন্তাশীল প্রাবন্ধিক হিসেবে তিনি যেমন অনেক পাঠকের মনে শ্রদ্ধার আসনে, তেমনি বহু সৃজনশীল রচনারই পরিচয় উৎকীর্ণ হয়ে আছে তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থে। যারা তাঁর আশেক লেনের গৃহ ও অন্যান্য কিংবা অভাজনের রবীন্দ্রনাথ পড়েছেন, তারা উপলব্ধি করতে পারবেন সৃজনশীলতা এবং মননশীলতার চেতনাস্রোত একই লেখকের মধ্যে কী অনায়াসে প্রবাহিত! গবেষক, সমালোচক তথা মননশীল লেখকদের অনেকের পক্ষেই সৃজনশীলতার পরিচয় দেওয়া  সম্ভব হয়নি। কোথায় যেন মননশীলতার সঙ্গে সৃজনশীলতার একটা বিরোধ! এই দুইয়ের সম্মিলন ঘটাতে পেরেছেন কম সংখ্যক লেখক। যেমন সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, মনজুরে মওলা, আবদুল মান্নান সৈয়দ, হুমায়ুন আজাদদের মতো হাতেগোনা কয়েকজন লেখক একই সঙ্গে সৃজনশীল এবং মননশীলতার চর্চায় সফল হয়েছেন। আমি সেই স্বল্পসংখ্যকের পঙ্ক্তিতেই মফিদুল হককে বিবেচনা করতে চাই।

মফিদুল হক বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অনুরুদ্ধ হয়ে অনেক তাৎক্ষণিক প্রবন্ধ বা স্বল্পপরিসর কলামধর্মী রচনা লিখেছেন। এরকম একটি রচনা ‘এলিজি : ১৫ আগস্ট’ থেকে একটি প্যারা উদ্ধৃত করছি :

‘টুঙ্গিপাড়ার গ্রামীণ পরিবারের এই সন্তান এখন আবার টুঙ্গিপাড়ার মাটির নিচেই শুয়ে আছেন নিথর। সেখানে এখনও পাখি ডাকে, পাতার মর্মর বেজে চলে, মৃদু বর্ষণের পর সোঁদামাটির গন্ধ বাতাস ভরে তোলে। আবার খরার দিনের প্রচণ্ড দাবদাহে চৌচির ক্ষেত ও নিদাঘের দুপুরের হাহাকার যেন মাটির বুকে শায়িত এই মানুষটির নির্মম হত্যাকাণ্ডের জন্য প্রকৃতির বেদনা ও আক্রোশ বহন করে চলেছে।’ (‘আরও একটি বঙ্গবন্ধু বিষয়ক বই’/পৃষ্ঠা ১১)।

মৌলিক লেখালেখির পাশাপাশি বেশ কিছু অনুবাদও করেছেন মফিদুল হক। অনুবাদও যে কতটা সৃজনশীল হতে পারে তার পরিচয় পাওয়া যাবে হ্যান্স এন্ডার্সন থেকে অনূদিত ছোটদের জন্য ‘কুচ্ছিত হাঁসের ছানা’য়।

আবার মনোজগতে উপনিবেশ : তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত ও তৃতীয় দুনিয়া পড়লে পরিচয় পাওয়া যায় তাঁর মননশীলতার এবং একই সঙ্গে প্রজ্ঞা ও পাণ্ডিত্যের।

প্রসঙ্গে বলতে চাই সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে তাঁর কলম সবসময় সোচ্চার। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাবার পরে আমাদের অনেক বামপন্থি নেতা-কর্মীর ডিগবাজির দৃশ্য দেখা গেছে। তাদের কেউ কেউ সাম্রাজ্যবাদের তল্পিবাহকও হয়েছেন। কিন্তু মফিদুল হক সামাজিক সাম্য তথা সমাজতান্ত্রিক সমতার সমাজ বিনির্মাণের আদর্শ এবং বিশ্বাস থেকে এক চুলও সরেননি।

ব্যক্তিগত পরিচয় দীর্ঘদিনের হলেও আমি তাঁর সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই। ’৭৬/’৭৭ সালের দিকে সম্ভবত প্রথম তাঁকে দেখি সংবাদ অফিসে, বংশালে। আমি তখন ৯১ নবাবপুর রোড থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক গণমুক্তি পত্রিকায় কাজ করছি। সংবাদের খেলাঘর পাতায় লিখতাম। মাঝে মাঝে খেলাঘরের সাহিত্য আসরেও গিয়েছি। যদ্দুর মনে পড়ে মফিদুল ভাইয়ের অধিকাংশ লেখা সংবাদ সাময়িকীতে ছাপা হতো। পরিচয় দীর্ঘ দিনের হলেও ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বা অন্তরঙ্গতা বলতে যা বোঝায়, তেমন সম্পর্ক তাঁর সঙ্গে আমার ছিল না, অনেক বছর পরোক্ষই ছিল।

শামসুর রাহমান ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠজন। দৈনিক বাংলার স্বনামধন্য সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীবের সহকারী হিসেবে কাজ করার সুবাদে তাঁকে কখনও সখনও দেখেছি। ১৯৯৩ সালে দৈনিক জনকণ্ঠে যোগদানের পর সেখানে তিনি পরোক্ষেই ছিলেন। সাহিত্যের পাতা দেখতাম আমি, বিশেষ সংখ্যার লেখক সূচি এবং পরিকল্পনা উপদেষ্টা সম্পাদক তোয়াব খানের সঙ্গে পরামর্শ করে তৈরি করতাম আমি, কিন্তু অনেক খ্যাতনামা লেখক ফিচার সম্পাদক এখলাস উদ্দিন আহমেদের কাছেই লেখা দিয়ে যেতেন। শুধু আসা-যাওয়ার পথে কুশল বিনিময়, হাই-হ্যালো। তিনি তা আমাকে হস্তান্তর করতেন। ফলে সেভাবেই জনকণ্ঠে ১৫ বছর আমি পরোক্ষে ছিলাম। তবে এই সময়টাতেই সংস্কৃতিক অঙ্গনের বিভিন্ন সভাসমিতি সেমিনারে অংশগ্রহণের সুবাদে মফিদুল ভাইকে জানার সুযোগ আমার বেশি হয়েছে, এতে সন্দেহ নেই।

২০০৮ সালের জানুয়ারিতে সমকালে যোগদানের পর সাময়িকী ‘কালের খেলা’য় দেখতাম, পূর্ব পরিচয়ের সুবাদে যখনই লেখার আমন্ত্রণ জানিয়েছি তিনি সানন্দে সাড়া দিয়েছেন কিন্তু সাহিত্য সম্পাদক আর লেখকের পারস্পরিক সম্পর্কের চেয়ে বেশি ঘনিষ্ঠ তিনি আমার কাছে তার লেখার গুণেই।

তাকে দেখা বা পরিচয়ের আগেই আমি তার লেখা পড়েছি। পাঠক হিসেবে তার সঙ্গে যোগাযোগ আমার অনেক পুরোনো। তাই পাঠকের দৃষ্টিতেই তাঁর লেখালেখি বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করতে চাই।

প্রবন্ধ, অনুবাদ, শিশুকিশোরপাঠ্য রচনা, মুক্তিযুদ্ধ গবেষণা ইত্যাদি বিচিত্র রচনার পাশাপাশি একক এবং যৌথভাবে মফিদুল হক সম্পাদনা করেছেন কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংকলনগ্রন্থ।

এরকম একটি সম্পাদনা সমাজ, সংস্কৃতি, নারী: সেলিনা বাহার জামান স্মারক বক্তৃতা সংকলন। জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ ৫ সদস্যের সম্পাদনা পরিষদে মফিদুল হক একজন। এই স্মারক বক্তৃতা গ্রন্থে তাঁর নিজের একটি রচনা আছে, যার শিরোনাম ‘সেলিনা বাহার জামান এবং পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক জাগরণ’। আলোকিত নারী অধ্যাপক সেলিনা বাহার জামানের জীবন ও কর্মের বিশ্লেষণ করতে গিয়ে ওই প্রবন্ধে মফিদুল হক যেভাবে পূর্ববাংলার সাংস্কৃতিক ইতিহাস অনুসন্ধান করেছেন তা সংস্কৃতি-অনুরগী পাঠক- মাত্রকেই আকৃষ্ট করবে। ব্যক্তিগতভাবে এই স্মারকবক্তৃতা পড়ে আমি ঋদ্ধ হয়েছি।

পশ্চিমা বিশ্বের নামকরা পত্রিকাসমূহে অবিচ্যুয়ারি অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করা হয়, যা পড়লে প্রয়াত ব্যক্তির জীবন আর কর্মসাধনার বিস্তারিত জানার সুযোগ থাকে। একটা সময় পর্যন্ত এ দেশের সাহিত্য পত্রিকায় এবং দৈনিকের সাহিত্য সাময়িকীতে প্রয়াত বিশিষ্টজনদের নিয়ে লেখা দীর্ঘ পরিসরেও ছাপা হতো, কিন্তু আজকাল পত্র-পত্রিকার সংখ্যা বহু গুণ বাড়লেও কমে গেছে সাহিত্য পাতার পরিসর। ভালো অবিচ্যুয়ারি আর তেমন একটা চোখে পড়ে না। মফিদুল হক সমাজ-সংস্কৃতির বিখ্যাতজনদের নিয়ে বিভিন্ন সময়ে অবিচুয়্যারি লিখেছেন। শামসুর রাহমানের এ ধরনের একটি গ্রন্থের শিরোনাম অন্যের মানসে বসবাস। মফিদুল হকেরও সে ধরনের একটি বই, যার শিরোনাম প্রতিকৃতি ও প্রয়াতজনকথা।

মাওলা ব্রাদার্স থেকে প্রকাশিত বইটি আমাদের সাহিত্য-শিল্প, চিত্রকলা, সংগীত তথা সংস্কৃতি অঙ্গনের প্রায় ৩০-৩৫ জন অবিস্মরণীয় ব্যক্তিত্বের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে লেখা প্রবন্ধের সংকলন। পাশাপাশি নোবেল বিজয়ী সাহিত্যিকসহ বিশ্বের বহুল পরিচিত কয়েকজন ব্যক্তিত্বের জীবন ও কর্মসাধনার বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করেছেন মফিদুল হক।

আমাদের দেশে অনেক গুণী মানুষ আছেন যাঁরা নিভৃতে সমাজের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন, গণমাধ্যমের ফোকাসও তাঁদের ওপর তেমন একটা পড়ে না। মফিদুল হকের বইটি পড়ে এমন কয়েকজন অসাধারণ গুণী মানুষের জীবন ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মপরিচয় জেনেছি, যাঁদের নামটি পর্যন্ত এর আগে কখনও শুনিনি! আমার এ ধরনের অজ্ঞতা দূর হয়েছে তাঁর এই বই পড়ে। এঁদেরই একজন আণবিক শক্তি কমিশনের মুখ্য বিজ্ঞান কর্মকর্তা জ্ঞানপিপাসু ড. শহিদুল্লাহ মৃধা যিনি অসাধারণ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন এবং বিজ্ঞান-গবেষণা করেছেন। অল্প বয়সে প্রয়াত এই জ্ঞানপিপাসু মানুষটি শুধু দেশের অভ্যন্তরেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার যোগ্য ছিলেন কিন্তু অকালমৃত্যু সেই সুযোগ তাঁকে দেয়নি। আরেকজন পণ্ডিত ব্যক্তির পরিচয় পেয়েছি তাঁর বই পড়ে, তিনি বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞান লেখক এম আকবর আলী (ডক্টর আকবর আলি খান নন)। বিজ্ঞানের বিচিত্র শাখা নিয়ে তিনি অবিস্মরণীয় কিছু বই রচনা করেছেন যার কয়েকটি খণ্ড বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রদ্ধা জাগানিয়া এমন নিভৃতচারী মানুষের পাশাপাশি বহুল পরিচিত বিখ্যাত ব্যক্তিদের ওপর অত্যন্ত তথ্যসমৃদ্ধ এবং একই সঙ্গে স্মৃতিচারণমূলক অবিচ্যুয়ারি রচনা করেছেন মফিদুল হক।

অভাজনের রবীন্দ্রনাথ বইটির কথা আলোচনার শুরুতেই উল্লেখ করেছিলাম। বইটি বিভিন্ন পত্রিকা ও সংগঠনের আমন্ত্রণে লেখা ছোট ছোট লেখার সংকলন। কয়েকটি বড় লেখাও আছে। ১৬ টি প্রবন্ধ। ‘স্বদেশী যুগ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও ইতিহাসের শিক্ষা’ শীর্ষক প্রবন্ধ দিয়ে বইটির শুরু আর শেষ প্রবন্ধ ‘চে গুয়েভারা : রবীন্দ্রনাথের গানের আলোয়’। মাঝখানের চৌদ্দটি প্রবন্ধে বিশ্বকবির সামাজিক সাংস্কৃতিক বহু বিচিত্র ভূমিকা যেমন পর্যালোচনা করেছেন মফিদুল হক, এমনি তাঁর সাহিত্যকর্ম নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ করেছেন। প্রথম প্রবন্ধটিতে বঙ্গভঙ্গসহ ব্রিটিশ-শাসিত এই উপমহাদেশের যে রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহ তা রবীন্দ্রনাথকে কীভাবে কতখানি আলোড়িত করেছে, তা যেমন আমরা জানতে পারি মফিদুলের বিশ্লেষণে, একইভাবে জানতে পারি পূর্ববঙ্গের মানুষ ও প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, গীতাঞ্জলি এবং ছিন্নপত্রের ভাষা, ভাবনা ও দার্শনিক উপলব্ধির যোগসূত্র। বিষয়টি নতুন নয়, কিন্তু মফিদুল হকের বিশ্লেষণ ভিন্নতর।

রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন রচনার সূত্র ধরে এগিয়েছে প্রথম প্রবন্ধের আলোচনা। মফিদুল হক লিখেছেন : ‘বাউলের গান’ নিবন্ধের আরেক উপলব্ধি এখানে উল্লেখ করা যায়, যার তাৎপর্য পরবর্তীকালে বাস্তব হয়ে উঠেছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন, ‘ভাবের ভাষার অনুবাদ চলে না। ছাঁচে ঢালিয়া শুষ্ক জ্ঞানের ভাষার জ্ঞানের প্রতিরূপ নির্মাণ করা যায়; কিন্তু ভাবের ভাষা হৃদয়ের স্তন্য পান করিয়া হৃদয়ের দোলায় দুলিয়া মানুষ হইতে থাকে। ..নির্জীব প্রতিমা … চলিয়া ফিরিয়া বেড়াইতে পারে না ও হৃদয়ের মধ্যে পাষাণ ভারের মতো চাপিয়া পড়িয়া থাকে’।

কবির এই বক্তব্যের সূত্রে মফিদুল হক লিখেছেন :

‘এই যে উপলব্ধি, যার মধ্যে শিলাইদহের বিশিষ্ট গ্রাম- প্রকৃতির ছায়াপাত আমরা অনুমান করতে পারি, তা সত্যরূপ পেয়েছিল আরও অনেক পরে, ১৯১১-১২ সালে, যখন শিলাইদহে বসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এক তাৎপর্যময় সাহিত্যিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে হাত দেন। গীতাঞ্জলির কিছু কিছু রচনা অন্যরা অনুবাদ করেছিলেন কিন্তু সেই অনুবাদ নিয়ে রবীন্দ্রনাথের অস্বস্তি কিছুতেই দূর হচ্ছিল না। কবিতার ছন্দে গীতাঞ্জলির ভাবরূপ ইংরেজিতে যেন ফুটে উঠছিল না। শিলাইদহে বসে তিনি নিজে অনুবাদ করার সিদ্ধান্ত নেন এবং এর ফলাফল সাহিত্যের ইতিহাসে মাইল ফলক হয়ে রইল।’

উদ্ধৃতি প্রলম্বিত না করে শুধু এইটুকু বলা কি দীর্ঘ প্রবন্ধ, কি স্বল্পায়তন নিবন্ধ সকল রচনাতেই তথ্যের সঙ্গে সৃজনশীলতা আর জ্ঞানের যোগ আমরা লক্ষ করি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকের মহান বিপ্লবী চে গুয়েভারা ইতিহাসের সেই অবিস্মরণীয় চরিত্র, যিনি মানবমুক্তির সংগ্রামে জীবন উৎসর্গ করে গেছেন, সাম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে কিউবার মুক্তির সংগ্রামে উজ্জ্বল ভূমিকা রাখার পর চেয়েছিলেন বলিভিয়াও মুক্ত হোক। মানবমুক্তির অদম্য তৃষ্ণায় লড়তে গিয়ে বলিভিয়ার দুর্গম জঙ্গলে নির্মমভাবে নিহত হয়েছিলেন। এই তথ্য আমাদের সকলেরই জানা।

মাত্র চার পৃষ্ঠার নিবন্ধে মফিদুল হক রবীন্দ্রনাথের কয়েকটি গানের বাণীর সঙ্গে চে গুয়েভারার যে মুক্তিপিপাসায় অদম্য ছুটে চলা, তার অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছেন।

মফিদুল হক রবীন্দ্রনাথের গানের একটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত  করে লিখছেন : “বিশ্বস্ত কতক সঙ্গী নিয়ে বলিভিয়ার কৃষকদের ওপর ভরসা করে যে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের প্রয়াস তিনি নিয়েছিলেন, তার বাস্তব ভিত্তি সম্পর্কে অনেক সংশয় থেকে যায়, কিন্তু মানবমুক্তির লক্ষ্যে ঘরছাড়া হয়ে সর্বস্ব-পণে তো কোনও খাদ ছিল না। ঘরে আর ফেরা হয় না এই মানুষদের, ‘ঘরের মুখে আর কি রে/ কোনদিন সে যাবে ফিরে।’ পথহীনতার মধ্যে পথ খোঁজার তাগিদে তারা যখন ঘরছাড়া তখন তাদের সামনে থেকে সরে যায় বাধার প্রাচীর, ‘দেয়াল যত সব গেল টুটে’। অঝোর বর্ষণধারায় সিক্ত এমন প্রদোষকালেই নিজেকে বুঝি মনে হয়, বিপ্লবের পতাকাবাহক বলরাম-এর শিষ্য।”

নিবন্ধের শেষ তিনটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করি : ‘…চে গুয়েভারার জীবন মানব মুক্তির সেই আকুতিরই বাহক, অনন্ত-নাগ হয়ে যা রক্ষা করবে মুক্তির স্বপ্ন, দানবের প্রবল আধিপত্যকারী বর্তমানের বাস্তবতা পেরিয়ে। সেখানে বুঝি মিলেমিশে যায় রবীন্দ্রনাথের গান এবং চে-র আত্মদান।’

বাংলার লোকসাহিত্য আর লোকসংস্কৃতি ছেনে ছেনে রচনা করেছেন আরেকটি প্রবন্ধ সংকলন লালনকে কে বাঁচাবে : সংস্কৃতি জিজ্ঞাসা। লালনের অধ্যাত্ম দর্শন এবং বাউলবিরোধী ধর্মান্ধ অপসংস্কৃতির সংঘাত, বাংলার কবি ও কবিয়াল যাত্রাপালা মুক্তিযুদ্ধে যাত্রাশিল্পী, বাংলার মঞ্চনাটক, নাট্য সংস্কৃতি, বৃক্ষের সংস্কৃতি সংস্কৃতির বটবৃক্ষ ইত্যাদি বিচিত্র বিষয় তিনি এই গ্রন্থে লিপিবদ্ধ করেছেন। যা কেবল মুগ্ধতা ছড়ায় প্রগতিশীল সংস্কৃতিকর্মীদের মনে। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখতে হবে, মফিদুল হক নিজেও একজন সাংস্কৃতিক যোদ্ধা। ছায়ানট থেকে শুরু করে দেশের প্রগতিশীল সমস্ত সাংস্কৃতিক সংগঠনে তিনি নানা ভূমিকায় নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন অর্ধশতাব্দীর অধিককাল ধরে। একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার কিংবা শাহবাগের মানব মিছিলে আমরা তাকে যেমন পাই, তেমনি পাই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথের গণতান্ত্রিক সংগ্রামে। বাংলাদেশের মুক্তিসাধনা: টুকরো কথার ঝাঁপিতে যেমন তাকে চিনে নিতে পারি, বাংলাদেশে গণহত্যা ও ন্যায়রথের অভিযাত্রা গ্রন্থের মধ্য দিয়েও আমরা তাঁর সাংস্কৃতিক সত্তা এবং রাজনৈতিক চেতনাকে বুঝে নিতে পারি। একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে বহু লেখা লিখেছেন তিনি।

তার লেখা জেনোসাইড নিছক গণহত্যা নয়: মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ, যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যার বিচার-প্রসঙ্গ বইটিতে যে আন্তরিকতায় এবং সাহসের সঙ্গে তিনি এই অপশক্তির বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন তা নতুন করে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার আনন্দ বেদনার একাত্তরকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

এই লেখা মফিদুল হকের প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাহিত্য বিচার বিশ্লেষণ নয়, তার জন্য দীর্ঘ পরিসর এবং বিস্তারিত আলোচনা উদ্ধৃতি প্রয়োজন। এ লেখা মফিদুল হকের একজন অনুরাগী পাঠকের অনুভূতি মাত্র। জয়তু মফিদুল হক। আপনার সৃজনমুখর জীবন দীর্ঘায়ু হোক।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button