আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনাপ্রবন্ধ

মফিদুল হকের ‘ধানের সংস্কৃতি, বাংলাদেশ ও ইতিহাসের বিস্তার’ : পবিত্র সরকার

মফিদুল হকের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা

দুই বাংলার সম্মানিত মননকর্মী মফিদুল হকের এ বইটি একটি বিশিষ্ট ও বহু মানুষের কাছে অবশ্যপাঠ্য প্রকাশনা বলেই গণ্য হবে। কারণটি আর কিছু নয়―তিনি যে বিষয়গুলি বেছে নিয়েছেন অনুসন্ধান আর লেখার জন্য সে বিষয়গুলি বেশির ভাগ নিয়ে এ পর্যন্ত কেউ লেখেননি, সেটা একটা কথা; দ্বিতীয় হলো, চর্চিত বিষয়ও কিছু আছে, কিন্তু তিনি যেভাবে আগের বিষয়গুলির মতোই এগুলিকেও দেখেছেন, বিচার করেছেন―সে ভাবেও কেউ এ পর্যন্ত করেননি। বলা বাহুল্য, তাঁর কাছে এ রকমই আমাদের প্রত্যাশা থাকে। এ বইটি এগারোটি প্রবন্ধের একটি সংকলন, শেষ প্রবন্ধটি, ‘বৈশাখ-বন্দনা’র চারটি ভাঁজ আছে, কিন্তু তুলনায় ক্ষুদ্রতর হলেও চারটি পৃথক প্রবন্ধের একটি চতুষ্ক। 

বাকি প্রবন্ধগুলির দিকে আমরা একটু তাকাই। আমরা সেগুলির মধ্যে মূলত দুটি ভাগ দেখতে পাই। কয়েকটি আছে ঘটে-যাওয়া ইতিহাসের সম্পূর্ণ নিজস্ব ব্যাখ্যা, যেমন প্রথম প্রবন্ধ ‘পূর্ব এশিয়ার উত্থান, ধান্যসংস্কৃতির জাগরণ এবং বাংলাদেশ’। যাকে মার্কসবাদে ভিত্তি বা অধোগঠন বলি আমরা, সেই কৃষিকর্মের ভূসংস্কৃতিকে অবলম্বন করে যে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করা যায় তা বাংলায় বোধ হয় প্রথম দেখালেন মফিদুল হক। আধুনিক পৃথিবীতে চাল-উৎপাদক আর ভাতখেকো দেশগুলি যে বিশ্বের রাজনীতি-অর্থনীতিতে একটি বড় ভূমিকা নিতে চলেছে, এবং বাংলাদেশের অভ্যুদয় যে এই সামগ্রিক ছবির সঙ্গে যুক্ত, এ কথা লেখকের আগে আর কেউ বলেছেন কি না জানি না। জাপান, চিন, কোরিয়া থেকে শুরু করে ভারত পর্যন্ত যে বৃহৎ অন্নভোজী ভূখণ্ড, পৃথিবীতে এ অংশ ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে, এবং তার মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থানও উজ্জ্বল, লেখকের এই সিদ্ধান্ত আমাদের সচকিত করে এবং গভীর অভিনিবেশ দাবি করে। সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের উন্নয়নের ত্বরিত গতি লেখকের এই সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে। 

পরের প্রবন্ধ ‘কল্পিত জনগোষ্ঠী, জাতিসত্তা ও মুক্তিচেতনা’-র সূত্রপাত, অনুমানযোগ্যভাবেই বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ‘রসধমরহবফ পড়সসঁহরঃু’ কথাটি থেকে, যা ‘জাতি’ বা ‘নেশন’-এর সংজ্ঞা হিসেবে এখন খুবই চলছে। মফিদুল খুবই বিচক্ষণতার সঙ্গে এর অপূর্ণতার দিকটি আমাদের কাছে ধরিয়ে দিয়েছেন। যে প্রশ্নগুলি তিনি তুলেছেন, তা আমাদের বুঝিয়ে দেয় যে, ওই সংজ্ঞাটি কোনও ধ্রুব, চিরস্থায়ী সংজ্ঞা হতে পারে না একটি জাতির; তা অবস্থার তাড়নে বিবর্তিত হতে থাকে। তা ছাড়া রসধমরহবফ―এই ভাববাচ্যমূলক বিশেষণ যতটা নির্দোষ শোনায় ততটা নির্দোষ তো নয়! ‘ওসধমরহব’ কে করছে, আর তার চেয়েও বড় কথা, কে করতে প্ররোচিত বা বাধ্য করছে―আধিপত্য-পরম্পরার শীর্ষে যে আছে তার ভূমিকা কী, সে প্রশ্নটা তো করতে হবে! একজন বা একাধিক মানুষ তো কোনও সকালবেলায় বসে সিদ্ধান্ত করে না যে, এসো, আমরা নিজেদের একটা জাতি হিসেবে কল্পনা করি! তার পিছনে সংগঠিত পরিকল্পনা আর উদ্যোগ থাকে। মুহাম্মদ আলি জিন্নাহ এই ভাবে এক ভিত্তিতে জাতির সংজ্ঞা খাড়া করেছিলেন, দল হিসেবে মুসলিম লীগ তা অন্যদের ‘খাইয়েছিল’, পরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের গৌরবময় আবির্ভাব সেই কল্পনাকে নস্যাৎ করেছে। মুজিবের নেতৃত্বে এক অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার নির্মাণ ঘটেছিল, তাই লেখকের মতে ‘বাঙালির জাতীয়তাবোধের সঙ্গে সেকুলারিজম বা অসাম্প্রদায়িক চেতনার যে নিবিড় যোগ তা আজকের বিশ্বে আরও প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে।’ এবং তিনি এও বলেন যে, অ্যান্ডারসনের জাতীয়তার ধারণা উপনিবেশের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদের যে উত্থানের ইতিহাস, সেই দিকটির প্রতি যথেষ্ট মনোযোগ দেয় না। লেখকের বিশ্লেষণের সঙ্গে সকলে একমত না হতে পারেন, কিন্তু তাঁর কথা যে যথেষ্ট অভিনিবেশের যোগ্য তাতে কোনও সন্দেহ নেই।

একাধিক প্রবন্ধ প্রায় সম্পূর্ণ অজ্ঞাত বিষয়কে সকলের গোচরে তুলে আনা। যেমন ‘কিতাবিস্তান : পার্টিশন ট্র্যাজেডির অজানা অধ্যায়’ আর ‘দিলীপকুমার রায় ও শাহিদ সুরাবর্দি : বিভাজিত সত্তা’; সেই সঙ্গে ‘রবীন্দ্রনাথ ও রিজাল : বি-ঔপনিবেশীকরণের দুই উদ্গাতা’, ‘আমার দেশ ও আমানুল হক’ প্রবন্ধ দুটিও।  তিনি যে-সব ইতিহাস উদ্ধার এবং বাঙালি সাধারণ পাঠকের কাছে হাজির করেছেন তাকে ‘অণু-ইতিহাস’ বলতে পারি, যা বৃহৎ ইতিহাস গ্রন্থে জায়গা পায় না। সবগুলিতে নতুন ইতিহাসের উদ্ধার ঘটেছে তা নয়, কিন্তু দুটি ভিন্ন ইতিহাসের তুলনাও এক হিসাবে ইতিহাসকে আলোকিত করে। তা বৃহৎ ইতিহাসের নানা সূত্র সম্বন্ধে প্রশ্ন তোলে এবং তাকে আমাদের কাছে স্পষ্ট আর নতুনভাবে বোধগম্য করে। ভারতের এলাহাবাদের দেশভাগ-পূর্ব বিখ্যাত প্রকাশনা-প্রতিষ্ঠান কিতাবিস্তানের আখ্যান। যা পণ্ডিত জওহরলাল নেহরুর একাধিক গ্রন্থের প্রকাশক ছিল এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি ও বিস্তার পেয়েছিল, দেশভাগের সঙ্গে তার বিলয়ের ইতিবৃত্ত গাঁথা হয়ে যায়।  এই করুণ বৃত্তান্তটিকে মফিদুল উদ্ধার করে আমাদের সামনে তুলে ধরেছেন, নইলে আমাদের জানবার আর কোনও উপায় থাকত না। তেমনই দিলীপকুমার রায় আর শাহিদ সুরাবর্দির বন্ধুত্ব আর সহমর্মিতার অতিশয় মানবিক কাহিনিও আমাদের সম্পূর্ণ অজানা থেকে যেত, যদি না মফিদুলভাই এমন মর্মগ্রাহী করে তা আমাদের জানাতেন। দেশভাগ আর সাম্প্রদায়িক বিভেদের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে এই আখ্যানগুলি ইতিহাসের ওই অভিমুখ নিয়েই প্রশ্ন তোলে।   

‘রবীন্দ্রনাথ ও রিজাল’ প্রবন্ধটিও এক অভাবনীয় সাদৃশ্যের উন্মোচন। ঔপনিবেশিকতা-নিয়ন্ত্রিত ইয়োরোপমুখী বিদ্যাচর্চা করা ও দেখার অভ্যাসে ব্যতিক্রম ঘটিয়েছেন মফিদুল, তিনি রবীন্দ্র সমসাময়িক ফিলিপিনসের এক উপনিবেশবিরোধী নেতা হোসে রিজালের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের নানা সাদৃশ্য দেখিয়েছেন, স্প্যানিশের বদলে মাতৃভাষাপ্রেম (ফিলিপিনসের বহুভাষী অস্তিত্ব সত্ত্বেও), দরিদ্র মানুষের জীবনের উন্নয়ন, আর উপনিবেশের বিরোধিতায়। ফলে ঔপনিবেশিত পৃথিবীতে উপনিবেশবিরোধী এলিট বা অভিজনদের উদ্ভব আর বিবর্তনের একটা সূত্র যেন ধরবার চেষ্টা করেছেন। ঐতিহাসিকের কাছে এর মূল্য কম নয়। এই রকম আর-একটি প্রবন্ধ বাংলাদেশের প্রসিদ্ধ, কিন্তু অপেক্ষাকৃত অনালোচিত আলোকচিত্রী আমানুল হক বিষয়ে।  ক্যামেরায় ছবি তোলা যে একটি দেশকে ভালোবাসার কাজ হতে পারে আমানুল হকের জীবনী তার প্রমাণ, এবং তাঁর জীবন আর কর্মের এই মমতাময় প্রতিবেদন আমাদের কাছে তুলে ধরে মফিদুল একটি মহৎ দায় পালন করেছেন। ‘রবীন্দ্রনাথ ও সভ্যতার সংকট’ প্রবন্ধটিতে আবার তিনি প্রবেশ করেছেন তার অন্তর্দেশে―যেখানে পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রতি আস্থা হারানোকে অতিক্রম করে জেগে উঠেছে রবীন্দ্রনাথের ‘মানুষে’র প্রতি আশা আর আস্থা (সবিনয়ে যোগ করি, এই আস্থার নির্ভর কোনও ‘ঈশ্বর’ হননি এখানে) এবং মানুষের ভবিষ্যৎ উজ্জীবনের স্বপ্ন। এ কি কবির কল্পনা ? মফিদুল তা মনে করেন না, কারণ মানুষের ইতিহাস নতুন নতুন সংকট যেমন সৃষ্টি করেছে, তেমনই আবার, বারবার, সংকটকে পরাস্তও করেছে। এ প্রবন্ধের এই আশ্বাসের দিকটা যেন ইতিহাসের একটি আদল তুলে ধরে, সর্বকালের জন্য তাই তা ব্যবহার্যতা অর্জন করে।

দেশভাগ, জাতীয়তা, নতুন দেশের উদ্ভব―এই বৃহৎ চিন্তাপরিসরের সঙ্গেই যুক্ত বাকি প্রবন্ধগুলিও, যদিও তার তিনটি মূলত ব্যক্তির আলোচনা। কিন্তু ব্যক্তির আলোচনার সঙ্গেই তাঁর কর্ম আর যাপনদৃষ্টির পরিচয় জড়িত, এবং সেই পরিচয় আবার বাংলাদেশের অভ্যুদয় আর অস্তিত্বের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে আছে। এই বিষয়টির সুর যেন মফিদুল বেঁধে দেন তাঁর স্বনামধন্য লেখক শওকত ওসমানকে বইটি উৎসর্গের কথাগুলির মধ্যে। সেখানে ‘ইতিহাসের বিস্তার’ এই শব্দবন্ধের ব্যবহারের মধ্যেই যেন লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিটি ধরা দেয়। ফলে শুধু ভূমিকায় কথিত ‘মাঠকর্মীর উপলব্ধি’ নয়, এ প্রবন্ধগুলি পঠন, অভিজ্ঞতা, ইতিহাসদৃষ্টি, অন্তর্গত আবেগ ও বিচার-বিচক্ষণতায় মণ্ডিত অতিশয় গভীর ও শিক্ষাপ্রদ রচনা। সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক, মননসাধক আনিসুজ্জামান এবং সমাজসচেতন প্রজ্ঞাজীবী সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী―এই তিন স্রষ্টার সৃষ্টিতে নিজের দেশকালের প্রতি দায়পালনের স্বাতন্ত্র্য ও নিজস্বতা মফিদুল চমৎকারভাবে দেখিয়েছেন। সৈয়দ হক যেমন সারা বিশ্ব পরিক্রমা করে তাঁর কুড়িগ্রামের মধ্যে নিজের সত্তার আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিলেন, তেমনই আনিসুজ্জামান বাঙালি সংস্কৃতির উৎস সন্ধান করেছেন হাজার বছরের কাল-পরিক্রমাতে। আবার সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী তাঁর ইতিহাসসচেতন প্রখর গদ্যে সৃষ্টি ও স্রষ্টাদের বিচার করে বাঙালির সাংস্কৃতিক ইতিহাসকেই নিজস্ব ভঙ্গিতে পুনর্লিখন করেন। 

পয়লা বৈশাখ সংক্রান্ত চারটি রচনা কেবল বাঙালির নববর্ষকে নিয়ে সিক্ত উচ্ছ্বাস মাত্র নয়। এখানে এসেছে হান্টিংটনের ‘ক্ল্যাশেস অফ সিভিলাইজেশন’-এর কথা, যাতে মানব-পৃথিবীকে দুটো সরল ভাগ করে দুয়ের দ্বন্দ্ব এবং তার মধ্যে পাশ্চাত্যের শ্রেষ্ঠত্ব দেখানো হয়েছিল। মফিদুল তার প্রতিবাদে অমর্ত্য সেনের দৃষ্টান্তগুলি তুলেছেন, বলেছেন, ইসলামি জগৎকে তাতে একপেশে এবং পক্ষপাতদুষ্ট চোখে দেখা হয়েছে।  প্রসঙ্গসূত্রে এসেছে ইউনেস্কোর স্বীকৃতির কথা। এই সব আলোচনার মধ্য থেকে লেখকের যে কথাগুলি বেরিয়ে আসে তা হলো বাংলাদেশের নববর্ষ উৎসবের বহুত্ববাদী অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠা। পয়লা বৈশাখের আলোচনায় আবার ফিরে এসেছে সেই ধান ও শস্যের সংস্কৃতি―যেখানে আকবরের হস্তক্ষেপে বাংলার নববর্ষের দিন বদলে দেওয়া হয়েছিল। ফলে এ লেখাটিতে লেখক তাঁর ধান্যোপজীবী সংস্কৃতিচর্চার বৃত্তটিকে সম্পূর্ণ করেন বলে মনে হয়।

আমি নিজে এ বইটি পড়ে সমৃদ্ধ ও পুরস্কৃত বোধ করেছি। 

 লেখক : ভাষাতত্ত্ববিদ, সাবেক উপাচার্য

রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button