আমার বন্ধু মফিদুল : রামেন্দু মজুমদার
মফিদুল হকের সাহিত্যকর্ম : আলোচনা
মাঝে মাঝে সাক্ষাৎকারগ্রহীতারা আমাকে প্রশ্ন করেন, আপনার বন্ধু কারা ? জবাবে আমি বলি, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বন্ধু বদলায়। স্কুলে এক ধরনের বন্ধু, কলেজে নতুন বন্ধু হয়, বিশ্ববিদ্যালয়ে বন্ধুবলয় বদলে যায়। কর্মজীবনের বন্ধুরা পেশাগত নৈকট্যের কারণেই হয়ে থাকে। শেষ বিচারে তারাই বন্ধু যাদের সঙ্গে কথা বলে, সময় কাটিয়ে আনন্দ পাওয়া যায়। আমার বর্তমান বন্ধুতালিকার প্রথমেই আমি মফিদুল হকের নাম বলে থাকি।
মফিদুল বয়সে আমার চেয়ে সাত বছরের ছোট, কিন্তু পাণ্ডিত্যে অনেক এগিয়ে। ওর সঙ্গে আমার পরিচয় হয় বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর। সম্ভবত গণসাহিত্য পত্রিকাকে কেন্দ্র করে আবুল হাসনাত ও মফিদুলের সঙ্গে আমার সখ্য গড়ে ওঠে। তখন আমার নিয়মিত আড্ডাখানা ছিল মফিদুলের পুরানা পল্টনের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের অফিস। সেখানেই অনেক জ্ঞানী-গুণী মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। একাধিকবার জ্ঞানতাপস অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সান্নিধ্য লাভ করেছি সেখানে। একদিন তিনি বলছিলেন, ‘কোনও নতুন দেশে গেলে দুইটা জায়গায় যাইবেন―কাঁচাবাজার আর বইয়ের দোকান। দেখবেন ওরা কী খায় আর কী পড়ে।’ কী চমৎকার কথা। আমি মনে করি মফিদুল আমাদের সময়ের অন্যতম সেরা শক্তিশালী গদ্যলেখক। ওর লেখায় চমৎকার বিশ্লেষণ থাকে, কোনও না কোনও নতুন তথ্য পরিবেশন করে। ওর লেখা পড়লেই বোঝা যায় ওর পড়ালেখার ব্যাপ্তি। কত দ্রুত যে মফিদুল একটা লেখা শেষ করতে পারে তা দেখে বিস্মিত হই। তবে লেখা শুরু করবে একবারে শেষ মুহূর্তে। এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে ওর মিল আছে। একবার কোথায় যেন আমরা দুজনে একসঙ্গে বক্তৃতা করতে যাচ্ছি। যে প্রবন্ধটা মফিদুল সেখানে পড়বে, তা কম্পোজ করতে দিয়ে ও রওয়ানা হয়েছে। পথে যেতে যেতে মোবাইলে ও প্রুফ দেখছে এবং ভাগ্যিস গন্তব্যে পৌঁছার আগে লেখাটার টাইপ করা শেষ হয়েছে। ওখানে পৌঁছে ও কম্পিউটার থেকে প্রিন্ট নিয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করল।
মফিদুল কত যে স্মারক বক্তৃতা লিখেছে, তার হিসাব নিশ্চয়ই তার কাছে নেই। একদিনের মধ্যেই একটা কঠিন বিষয়ে স্মারক বক্তৃতা লিখে ফেলতে পারে মফিদুল। ওর এই ক্ষমতা ঈশ্বরপ্রদত্ত। ওর অফিসে যখন আমরা আড্ডা দিতে যাই, তখন কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে কিন্তু ও লেখা বা প্রুফ দেখার কাজ চালিয়ে যায়। মফিদুলের হাতের লেখা অবশ্য সবার বোধগম্য হবে না। দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত হয়েছি বলে আমি এখন তা উদ্ধার করতে পারি। আমার বাবার হাতের লেখাও উনি এবং ওর এক মুহুরি ছাড়া কেউ পড়তে পারতেন না। তেমনই জটিল ছিল আমাদের বন্ধু আবদুল্লাহ আল-মামুনের লেখা। অনেক সময় ও নিজেও পড়ে উদ্ধার করতে পারত না কী লিখেছে।
আমাদের সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের যত ঘোষণাপত্র রয়েছে, তার বেশির ভাগই মফিদুলের রচনা। কোনও তাত্ত্বিক বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে আমরা মফিদুলের ওপর নির্ভর করি। জোটের পথচলায় মফিদুলের অনেক অবদান রয়েছে। সম্মিলিতভাবে পরপর দুবার একুশে ফেব্রুয়ারি উদ্যাপনের পর ১৯৮৪তে সাংস্কৃতিক সংগঠনসমূহের নেতৃবৃন্দ সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। ফয়েজ আহমদকে আহ্বায়ক করে জোটের প্রথম যে ১০ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠিত হয় তার অন্যতম সদস্য ছিল মফিদুল হক। ১৯৮১ পর্যন্ত সে কমিটিই দায়িত্ব পালন করে। পরবর্তী সব নির্বাহী পরিষদেই মফিদুল যুক্ত ছিল এবং এখনও রয়েছে।
আমাদের ইন্টারন্যাশনাল থিয়েটার ইন্সটিটিউট (আইটিআই)-এর কাজে আমি মফিদুলকে খুব আগ্রহভরে যুক্ত করি। বেশ কয়েকটি বিশ্ব কংগ্রেস ও আন্তর্জাতিক সেমিনারে মফিদুল আমাদের সঙ্গী ছিল। সব ক্ষেত্রেই মফিদুলের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। আইটিআই-র দ্বিবার্ষিক যে প্রধান প্রকাশনা ‘ওয়ার্ল্ড অব থিয়েটার’ তার ইংরেজি সংস্করণের সম্পাদক ছিলাম আমরা দুজন―আমি এবং মফিদুল। আমরা বাংলাদেশ থেকে গত কয়েক বছরে ১২টি ভলিউম বের করেছি। মফিদুল তার সম্পাদনা ও প্রকাশনা দক্ষতা দিয়ে এ প্রকাশনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। প্রকাশনাটি ছিল আইটিআই-র কমিউনিকেশান কমিটির (যার নাম বদলে এখন হয়েছে পাবলিকেশান কমিটি) অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। কয়েকবার এ কমিটির সভাপতি থাকার পর কংগ্রেসে আমি মফিদুলের নাম প্রস্তাব করি পরবর্তী সভাপতি হিসেবে। সবাই সানন্দে তা গ্রহণ করেন। তারপর সভাপতি হিসেবে মফিদুলও বেশ কয়েক বছর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ওর সভাপতিত্বে কয়েকটি সেমিনার হয়েছে যেখানে ওর বক্তব্য সবাই গুরুত্বের সাথে শুনেছেন। কংগ্রেস উপলক্ষে আগত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের সাথে মফিদুল খুব সহজেই মিশতে পারত।
মফিদুল অস্ত্র হাতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কিন্তু কখনও আগ বাড়িয়ে সে কথা বলে না। স্বভাবসুলভভাবেই ও নেপথ্যচারী। মফিদুলের অন্যতম বড় কীর্তি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা। ওরা আট বন্ধু মিলে যে বিশাল কাজ করেছে, যুগ যুগ ধরে তা আমাদের জাতির গৌরবকে ধারণ করবে। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি হিসেবে শুরু থেকে এখনও প্রতিদিন জাদুঘরের কাজে মফিদুল যে সময় ব্যয় করে নিজের প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানেও এত সময় দেয় না। জাদুঘরের কাজে জড়িত থেকে ও নানা দেশের জাদুঘর ও গণহত্যাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির সঙ্গে একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। মফিদুলকে এখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একজন ‘জেনোসাইড স্কলার’ হিসেবে গণ্য করা হয়। প্রায়ই ও বিভিন্ন দেশে গণহত্যাবিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারে গিয়ে বক্তব্য রাখে। ইউনেস্কো যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিয়েছে, তার পেছনে গবেষণা ও দলিল তৈরি করার ক্ষেত্রে মফিদুলের একটা বড় ভূমিকা ছিল।
বাংলাদেশে সৃজনশীল প্রকাশনার ক্ষেত্রে মফিদুলের প্রভূত অবদান রয়েছে। ওর প্রকাশনালয় সাহিত্যপ্রকাশ থেকে প্রচুর মানসম্পন্ন গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। মুক্তিযুদ্ধের ওপর বইয়ের সংখ্যাও এখানে অনেক। বই প্রকাশনার ক্ষেত্রে মফিদুল চলতি হাওয়ায় গা ভাসায়নি। এমন সব বই সাহিত্যপ্রকাশ থেকে বেরিয়েছে যা আমাদের জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চাকে সমৃদ্ধ করেছে। লেখালেখির পাশাপাশি মফিদুল প্রচুর দেশি-বিদেশি বই পড়ে। ওর সঙ্গে আমি অনেক দেশ ঘুরেছি, বেশ কয়েক জায়গায় আমরা একই ঘরে থেকেছি। সুযোগ পেলেই মফিদুল বইয়ের দোকানে গেছে, অন্য কাজে না থাকলে আমিও ওর সঙ্গী হয়েছি। এই বছরের মার্চে দিল্লিতে এক সম্মেলনে আমরা একসঙ্গে গিয়েছিলাম। একদিন সময় করে দিল্লির খান মার্কেটের একটি বড় দোকান থেকে মফিদুল প্রচুর বই কিনল, বেশির ভাগই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং ভারত- বাংলাদেশের সম্পর্কবিষয়ক। আমিও আমার পছন্দমতো কয়েকটা বই কিনলাম। ওর বাড়িতে বইয়ের যে বিশাল সংগ্রহ, এত বড় ব্যক্তিগত সংগ্রহ আর কারও আছে কী না সন্দেহ!
ব্যক্তিগত জীবনে মফিদুল বন্ধুবৎসল, বিনয়ী ও উদার মানসিকতাসম্পন্নমানুষ। কীভাবে যে এত কাজ ও একসঙ্গে করে তা দেখে আমি বিস্মিত হই। একই সঙ্গে ওর স্ত্রী সীমার প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্বের কমতি নেই। আমার স্ত্রী ফেরদৌসীর লেখালেখির ব্যাপারে মফিদুল অনেক উৎসাহ দেয়। ওর রসবোধও প্রচণ্ড। মুখ গম্ভীর করে মাঝে মাঝে এমন সব মজার কথা বলে, শুনে আমরা সবাই খুব আনন্দ লাভ করি। আবুল হাসনাত বেঁচে থাকতে আমরা তিনজনে অল্প হলেও অনেক আনন্দময় সময় কাটিয়েছি। হাসনাতের সঙ্গে আমাদের ঠাট্টা জমতো খুব। একবার আমাদের অনুজপ্রতিম বাবুল বিশ্বাস মফিদুলের কাছে এসে আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ওর পিএইচডি করার সুসংবাদ দিল। মফিদুল গম্ভীর মুখে বলল, ওখানে কি কম খরচে পিএইচডি পাওয়া যায় ? মফিদুলের সঙ্গ একাধারে উপভোগ্য ও শিক্ষণীয়। অনেক বিষয় আমি বুঝতে না পারলে ওর সাহায্য নিই। বিদেশে বক্তৃতা দেবার আগে ওর কাছ থেকে টকিং পয়েন্ট নিয়েছি। প্রয়াত শামসুজ্জামান খান মাঝে মাঝেই আমার ও মফিদুলের সঙ্গে একান্ত আড্ডায় সময় কাটিয়েছেন। তিনি বলতেন, সবার সঙ্গে তো মন খুলে কথা বলতে পারি না।
মফিদুলের সঙ্গে এই নিঃস্বার্থ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আমার জীবনের পরম প্রাপ্তি। চারদিকে প্রায় সকলকেই দেখি একটা মুখোশ নিয়ে ঘুরে বেড়ায়, সব কাজের পেছনেই একটা স্বার্থ কাজ করে। মফিদুল এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। মফিদুল দীর্ঘদিন সুস্থ শরীরে আরও অনেক লেখালেখি করে সমাজকে আলোকিত করুক―এ কামনাই করি।
লেখক : নাট্যব্যক্তিত্ব, প্রাবন্ধিক