আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনা

‘শিল্পের বিচারে কালোত্তীর্র্ণ সবাই হতে পারেন না’ : প্রাবন্ধিক গবেষক মফিদুল হকের সঙ্গে একান্ত আলাপচারিতায় রনজু রাইম

প্রচ্ছদ রচনা : মুখোমুখি মফিদুল হক

[মফিদুল ১৯৪৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর গ্রামের বাড়ি বিক্রমপুরে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজতত্ত্ব বিষয়ে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি দেশের একজন খ্যাতিমান প্রাবন্ধিক, গবেষক ও প্রকাশক। তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের একজন প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি, জাদুঘরের শিক্ষার্থী প্রকল্পের একজন পরিচালক, প্রকাশনা সংস্থা সাহিত্য প্রকাশের পরিচালক এবং আন্তর্জাতিক থিয়েটার ইনস্টিটিউট-ইউনেস্কো প্রকাশিত দ্বিবার্ষিক সংকলন ‘ওয়ার্ল্ড অব থিয়েটার’-এর অন্যতম সম্পাদক।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সাংগঠনিকভাবে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চে তিনি ঢাকা ত্যাগ করেন কিন্তু ১৪ এপ্রিল ঢাকা ফিরে ছাত্র ইউনিয়ন ও কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা তৎপরতায় সহযোগিতা করা শুরু করেন। এ সময় তিনিসহ নূহ-উল-আলম লেনিন, নিজাম উদ্দিন আজাদসহ আরও অনেকে একটি নেটওয়ার্ক গঠন করেন যার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের পক্ষের ব্যক্তিদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, গেরিলাদের আশ্রয়ের স্থান নির্ধারণ, মুক্তিযুদ্ধ নামক পত্রিকা বিতরণ করতেন।

তাঁর প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে : মনোজগতে উপনিবেশ: তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত ও তৃতীয় দুনিয়া, আবুল হাশিম, পূর্ণেন্দু দস্তিদার, দেশভাগ, সাম্প্রদায়িকতা এবং সম্প্রীতির ভাবনা, বঙ্গবন্ধুবিষয়ক আর একটি বই, লালনকে কে বাঁচাবে : সংস্কৃতি-জিজ্ঞাসা, ধানের সংস্কৃতি, বাংলাদেশ ও ইতিহাসের বিস্তার, বাংলাদেশের মুক্তিসাধনা : টুকরো কথার ঝাঁপি।

পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০১৩, একুশে পদক ২০১৬ ও শহিদ আলতাফ মাহমুদ পদকসহ বহু পুরস্কার]

―শব্দঘর-এর পক্ষে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কবি রনজু রাইম

প্রশ্ন : শুভেচ্ছা জানবেন। বলা হয়ে থাকে, সাহিত্য সমাজের দর্পণ―সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যে এ কথার সত্যতা কতখানি প্রতিফলিত।

উত্তর : কথাটা জীবনের এক বড় সত্য, তবে এর কোনও সহজ ব্যাখ্যা নেই। এই উক্তির পরতে পরতে জড়িয়ে আছে অনেক প্রশ্ন, একের পর এক জেগে ওঠা বহু জটিল জিজ্ঞাসা। ফলে চট করে এমন প্রশ্নের জবাব দিতে আমি অপারগ। এটুকু কেবল বলা যায়―সাহিত্য মানবমনের আন্তর্তাগিদের এমন এক প্রকাশ যা কেবল শিল্পের এই বিশেষ রূপে ব্যক্ত করা সম্ভব। মানব-অস্তিত্ব যেমন বিশালতার অংশ, তেমনি ধারণ করে বহুরূপত্ব, সেই সঙ্গে রয়েছে এর নিত্য-প্রবহমানতা। অন্যদিকে মানুষ সর্বকালে সর্বস্থানে চারপাশের জীবন ও মহাজীবনের মাঝখানে নিজেকে খুঁজে পায়। তাঁর জীবনযাপন সময়ের সঙ্গে যোগ ও সময়হীনতায় অবগাহনের আকুতি মন-মানসে যে বোধ তৈরি করে এর ভাষারূপ মেলে সাহিত্যে। আর তাই সাহিত্য সময় ও সমাজের সঙ্গে যুক্ত, সেই সঙ্গে এক ধরনের বিযুক্তিও সেখানে থাকে। ফলে সাহিত্য সমাজের দর্পণ বটে, কিন্তু তা বড় অর্থে প্রযোজ্য। সাহিত্য কীভাবে সমাজকে প্রতিফলিত করে, সেই প্রশ্নের জবাব অনেকটা মিলবে সাহিত্যের পাঠ আপনি কীভাবে নেবেন, তার ওপর। ষাটের দশকে লেখা সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুখুজ্যের সঙ্গে আলাপ’ দীর্ঘ-কবিতার বয়ান স্মরণযোগ্য, যেখানে কবি বলছেন যে, আয়নায় যেভাবে বামকে ডান ও ডানকে বাম করে দেয় সেটা তার পছন্দ নয়। দর্পণেও রয়েছে বিভ্রম, সাহিত্যেও তাই মিলবে ধোঁয়াশা।

প্রশ্ন : ‘সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি।’ তেমনি বলা যেতে পারে সকলেই লেখক নয়, কেউ কেউ লেখক। একজন সাধারণ পাঠকের কাছে এ কথার ভিত্তি কতটুকু ? লেখক ও অলেখকের পার্থক্য নিরূপণ করবেন কীভাবে ?

উত্তর : লেখালেখির উৎপাদনশীলতা ও সাহিত্যের সৃজনশীলতা এক নয়। প্রত্যেক কালে বহু মানুষ সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে প্রাণের আকুতি প্রকাশে সক্রিয় হয়। অনেকে আবার যশ, স্বীকৃতি, জনপ্রিয়তা কিংবা গ্রন্থের প্রলোভন দ্বারা প্ররোচিত হয়ে সাহিত্যশিল্পের সাধনায় ব্রতী হয়। শিল্পের বিচারে কালোত্তীর্র্ণ সবাই হতে পারেন না, যে পারে সে পারে, কীভাবে পারে তা সে-ই জানে। আর তাই সকলে নয়, কেউ কেউ সাহিত্যশিল্পের সাধক। প্রচলিত ধারায় সাহিত্য উৎপাদন যদি আজ অনেক বেশি পরিমাণে হয়ে থাকে, তাতে বিড়ম্বিত হওয়ার কারণ নেই। কোনটা কাচকাটা হীরে, কোনটা সত্যিকারের রত্ন সেটা তো পাঠকেরাই যাচাই-বাছাই করবেন। সেই বাছাইয়ে সাময়িকভাবে ভুল হতে পারে, কিন্তু কালের বিচারে শিল্প-রায় ঠিকভাবেই মেলে। সেজন্য পাঠক-সমালোচক- লেখক মেলবন্ধনে চর্চার মাধ্যমে সাহিত্য-বোধ সমাজে নানাভাবে পরিব্যাপ্ত করা দরকার।

প্রশ্ন : বাংলা প্রবন্ধ কিংবা সমালোচনা সাহিত্য প্রাপ্তবয়স্ক―নাকি এখনও হামাগুড়ির শৈশব অতিক্রম করার চেষ্টা করছে ?

উত্তর : দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাংলাদেশে সমকালীন সাহিত্য নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ আলোচনা-সমালোচনা বিশেষ প্রাধান্য অর্জন করেনি। সাহিত্যের আলোচনা খুব কমই মেলে, যেটুকু আমরা দেখি তার অধিকাংশই, প্রাবন্ধিক যতীন সরকারের ভাষায়, আলোচনা নয়, ‘ভালোচনা’― নিতান্তই প্রশস্তিমূলক রচনা। তবে এর বিপরীত ছবিও রয়েছে, বাংলাদেশে এখন বেশ কয়েকটি নিয়মিত সাহিত্য মাসিক প্রকাশিত হচ্ছে, একান্তভাবে বই নিয়ে প্রকাশিত লিটল ম্যাগাজিন ও অনিয়মিত প্রকাশনাও রয়েছে। প্রবন্ধ সাহিত্যেও এসেছে বৈচিত্র্য, বিজ্ঞান-বিষয়ক রচনা ক্রমে পুষ্ট হচ্ছে। হামাগুড়ি কথাটা তাই এখানে একেবারেই অপ্রযোজ্য।

প্রশ্ন : পাশ্চাত্য ফর্ম ও তত্ত্বের আড়ালে বাংলা প্রবন্ধসাহিত্যের স্বাতন্ত্র্য বিনষ্ট হচ্ছে কি ?

উত্তর : সাহিত্য বিতর্ককে সবসময়েই স্বাগত জানাতে হয়। ফর্ম ও কনটেন্ট-বিতর্ক এক সময় খুব প্রবল ছিল, এখন অনেক সেকেলে হয়ে গেছে। সেই জায়গায় উত্তর-আধুনিকতা, ডিকন্সট্রাকশন ইত্যাদি নানা অভিধা নিয়ে বিতর্ক চলছে। আমরা চাইব এমন বিতর্ক আরও তুমুল হোক, হাতাহাতি না হলেই হয়। নানা কোণ থেকে আলো ফেলে দেখার চেষ্টা হোক মানবচিত্তের আলো-আঁধারময় পরিসর। বিতর্ক যখন প্রচল ভাঙার তাগিদ বহন করে তখন সেটা বিশেষভাবে কাম্য। আমার বিশেষ সৌভাগ্য হয়েছে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সঙ্গে পরিচিত ও তাঁর প্রীতিধন্য হওয়ার। তাঁকে তো বলা হয় ডিকন্সট্রাকশন তত্ত্বের জনক। তিনি বলেছিলেন, কেমব্রিজ ডিকশনারি অব লিটারেরি টার্মস তাঁকে এই অভিধা দিয়েছে। ডি-কন্সট্রাকশনের মানে জানতে চাইলে তিনি আমাকে বলেছিলেন, বিষয়টির ভেতরে প্রবেশ করো, একেবারে গভীরে চলে যাও, তারপর নাড়া দিয়ে সব এলোমেলো করে ফেলো, এই হলো ডিকনন্সট্রাকশন। নিউ ইয়র্কের হারলেমে এক রেস্তোরাঁয় বসে তাঁর বলা এই কথাগুলো আজ স্মরণ করি।

প্রশ্ন : বাংলা প্রবন্ধ সাহিত্যের ইতিহাসের নিরিখে সবচেয়ে উজ্জ্বল সময় কোনটি এবং কেন ?

উত্তর : কোনও বিশেষ কাল উজ্জ্বল হয় নানা কারণে। বাংলাদেশের প্রবন্ধসাহিত্যের ক্ষেত্রে আমি বলব বিগত শতকের পঞ্চাশের ও ষাটের দশক ছিল এক উজ্জ্বল সময়, যখন নিজের অস্তিত্ব বুঝে নেওয়ার জন্য জাতির আকুতি নানাভাবে প্রবন্ধ সাহিত্যে রূপায়িত হয়েছিল। স্মরণ করতে হয় ভাষা আন্দোলনের সৈনিক হাসান হাফিজুর রহমানের বিশাল গ্রন্থ আধুনিক কবি ও কবিতা, কিংবা ঔপন্যাসিক আলাউদ্দিন আল আজাদের ক্ষুদ্রাকার মৌলিক প্রবন্ধ ‘আমপাতা জামপাতা আন্দোলন’, কিংবা আনিসুজ্জামান সম্পাদিত রবীন্দ্রনাথ, যেখানে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর চার পাতার ছোট রচনা ছিল মননশীলতায় ঠাসা, রবীন্দ্রচেতনায় সুফি প্রভাব বিষয়ে তাঁর আলোচনা।

প্রশ্ন : একজন সমালোচক বা প্রাবন্ধিকের প্রস্তুতি কী রকম হওয়া সমীচীন ?

উত্তর : প্রস্তুতি ছাড়া জীবনে কোনও কাজই সম্ভব নয়, আর সমালোচক ও প্রাবন্ধিকের প্রস্তুতি তো নানামুখী এবং সেখানে মননসাধনার পাশাপাশি ভাষাচর্চাও গুরুত্বপূর্ণ। আপনি কী বলতে চাইছেন সেটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে কীভাবে বলবেন। সব মিলিয়েই তো এই প্রস্তুতি, যা এক নিরন্তর প্রয়াস।

প্রশ্ন : সময় বড় বলবান। একাত্তর এমনই এক মহার্ঘ সময়। একাত্তর আপনার প্রবন্ধ সাহিত্যকে কতখানি আন্দোলিত করেছে বলে মনে করেন ?

উত্তর : বলতে গেলে একাত্তর আমাকে কিংবা আমাদের জেনারেশনের সবার মধ্যে বলবার অনেক আকুতি তৈরি করেছে, তবে সেটা যথাযথ ভাব ও ভাষায় প্রকাশ করা খুব কঠিন কাজ। অনেকে অনেকভাবে এর প্রকাশ ঘটিয়েছেন, আমি তাঁদের ঈর্ষা করি, সেই সঙ্গে নিজের সীমাবদ্ধতাও উপলব্ধি করি। শিল্পিত এইসব প্রকাশের মধ্যে সেই সময়কে নানাভাবে খুঁজে পাই। আমার নিজের ক্ষেত্রে আমার ক্ষুদ্র সামর্থ্যে বুঝি, একাত্তর আমাকে দায়বদ্ধ করেছে। সেই দায়মোচনের বড় সুযোগ মিলেছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের সুবাদে।

প্রশ্ন : আপনার প্রবন্ধ একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যার প্রামাণ্য দলিল। একাত্তরের গণহত্যার নিষ্ঠুরতার বার্তা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য লেখালেখি ছাড়া আর কী কী উপায় আছে বলে মনে করেন।

উত্তর : বহুভাবে আমাদের একাত্তরের কথা বলে যেতে হবে। গণহত্যা এর একটি বড় দিক, এটা কোনও বিশেষ সময়ে বিশেষ স্থানে সংঘটিত হলেও গোটা মানবসভ্যতার সঙ্গে তা সম্পর্কিত। এমন ভয়াবহ নৃশংসতা কীভাবে সংঘটিত হতে পারে, মানুষকে কীভাবে দানবে রূপান্তর করে চরম বর্বরতায় প্ররোচিত করা যায়, তার হদিশ করা এবং সেখান থেকে শিক্ষা গ্রহণ একান্ত জরুরি। হাননা আরেন্ড-এর ‘দি ব্যানালিটি অব ইভিল’ কিংবা ‘আইখম্যান ইন জেরুজালেম’ এক্ষেত্রে পথ-প্রদর্শনমূলক কাজ। তবে তারপরও মানবগোষ্ঠী সেখান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করেছে বলে মনে হয় না। জেনোসাইড বা নৃশংসভাবে গোটা জাতিকে আক্রমণ ও নিধন তো অব্যাহত রয়েছে। মানুষকে ব্যক্তিগতভাবে আঘাত করা হচ্ছে না, তাকে বিশেষ কোনও গোষ্ঠীর সদস্য হিসেবে উৎখাত করতে অপরের কোনও দ্বিধা থাকছে না। এমন ব্যাপক ও বর্বর নৃশংসতার কার্যকারণ হদিশ করা এবং জেনোসাইড প্রতিরোধ তাই সভ্যতার দায়, নানাভাবে এই দায়িত্ব পালন জরুরি। আমরা জেনোসাইডের ভুক্তভোগী দেশ, আমাদের তাই রয়েছে বিশেষ কর্তব্য।

প্রশ্ন : পাঠকের কাছে লেখকের প্রত্যাশা কী ?

উত্তর : পাঠক হচ্ছে লেখকের আরাধ্য দেবতা, লেখালেখি তো পাঠকদেবতার ভোগের উপাচার। প্রত্যাশাও সেই মাত্রার, দেবানুকুল্য লাভ। লেখালেখি সাধনা বটে, তবে গীতার নিষ্কাম সাধনা তো সহজে আয়ত্ত করা যায় না। লেখকের জন্য স্বীকৃতি গুরুত্বপূর্ণ, এর অর্থমূল্য, পুরস্কার বা সামাজিক মর্যাদার চাইতে গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে স্বীকৃতি। লেখককে পাঠকদের কাছে পৌঁছতে সাহায্য করে। তবে জনপ্রিয়তা, অর্থ, পুরস্কার কিংবা সামাজিক মর্যাদা কোনও কিছুই লেখককে কালোত্তীর্ণ করে না, সবার পক্ষে সেই অর্জন সম্ভবও নয়, সেজন্য লেখালেখিটাই প্রধান, অন্য সব গৌণ। সব লেখককেই শেষ পর্যন্ত সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হয়। এই জায়গায় লেখক একান্ত নিঃসঙ্গ, তাঁর সিদ্ধান্ত তাঁকেই নিতে হয়।

প্রশ্ন : দুই বাংলার ভাষা ও সাহিত্যের মৌলিক পার্থক্য কী ?

উত্তর : বাঙালির রাষ্ট্ররূপ ও বাঙালির সাহিত্যরূপ দুইয়ের মধ্যে ফারাক রয়েছে। রাষ্ট্রসত্তা বিভাজিত করে, সাহিত্যসৃষ্টি একত্র করে। এক ভাষাভাষী জাতিগোষ্ঠী নানা রাষ্ট্রে বাস করতে পারে, কিন্তু সাহিত্যিক হিসেবে শেষ বিচারে তিনি সমগ্র ভাষাগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর রাষ্ট্রপরিচয় তাতে মুছে যায় না; তবে সাহিত্য পরিচয়েই তিনি উদ্ভাসিত হন। রাষ্ট্র নাগরিককে সীমাবদ্ধ করে রাষ্ট্রসীমায়, সাহিত্য ভাষা পরিচয়ে নাগরিকদের বিস্তার ঘটায়, একত্র করে। সেটা স্মরণে রেখে অন্যান্য পরিচয় ও বিভাজন বিবেচনা করতে হবে। এখন প্রায় দুই কোটি বাঙালি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে আছে, অনেকে ভিন্ন রাষ্ট্রের নাগরিকও হয়েছেন, তাদের পরবর্তী প্রজন্মের সঙ্গে দেশ ও ভাষার যোগ ক্ষীণ হয়ে আসছে। দুই বাংলার বাইরের এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবন-বাস্তবতা তো তাদের সৃষ্ট সাহিত্যে প্রতিফলিত হচ্ছে বা হবে। সেটা কি দুই বাংলার বাইরে ‘প্রবাসী বাংলা সাহিত্য’ হিসেবে আলাদাভাবে চিহ্নিত হবে কিংবা হবে না ? সব মিলিয়ে ভাষাভিত্তিক সাহিত্যের যে অভিন্নতা সেটা ভুলে গেলে চলবে না।

প্রশ্ন : মিডিয়ার ম্যানিপুলেশনে লেখক বড় বা ছোট হয় কি ? প্রকৃত লেখকের প্রস্তুতি কী রকম হওয়া সমীচীন ?

উত্তর : এখন সমাজ অনেক বেশি বিত্ত-শাসিত হয়ে পড়েছে, ফলে করপোরেট বা বৃহৎ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানের সামাজিক কর্তৃত্ব নানাভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাহিত্যে এর বিভিন্ন ফলাফল আমরা দেখছি। বড় দৈনিকের সাহিত্য পাতার ধরন বিশ্লেষণ কিংবা পরিবর্তনময়তা দেখলে সেটা বোঝা যাবে। বাজারের সঙ্গে সৃজনকর্মের সম্পর্ক তো অনেক পুরোনো ও জটিল, কাজী নজরুল ইসলাম গ্রামোফোন কোম্পানির চাকরির সুবাদে ফরমায়েশি গান লিখেছেন, রমজানের রোজা শেষের ইদের গান তো বাঙালির অন্তর আলোড়িত ও আলোকিত করেছিল বিপুলভাবে। কিন্তু সৃজনশীলতা ক্রমে বাজার-শাসিত হয়ে বিনোদন বা এনটারটেইনমেন্ট ইন্ডাস্ট্রির জন্ম দিয়েছে। মিডিয়াও এখন এনটারটেইনমেন্টের লক্ষ্যবাহী হয়ে উঠেছে। লেখককে তারা তাদের ছাঁচে গড়েপিটে নিতে চাইছে, অনেকে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে সেই পথের অনুগামী হচ্ছেন। সাহিত্য সম্পাদক বলে দিতে পারেন কবিরা এখন বসন্তের গীত গাইবেন কিংবা বর্ষার, চাহিদামাফিক কবিতাও আপনি পেয়ে যাবেন সাপ্লাই সাইড চেইন অনুসারে। কিংবা তিনি বলতে পারেন গল্প হতে হবে বারোশ শব্দের মধ্যে, নবীন গল্পকারেরা সেইমতো গল্প সাপ্লাইয়ে তৈরি থাকেন। তবে আশার কথা, সকলেই নন, কেউ কেউ কবি, আর তারাই বাঁচিয়ে রাখেন সৃজনধারা। তাই দেখি বিকল্প সাহিত্যধারা হিসেবে লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনা থেমে নেই, বরং আকারে ও বৈচিত্র্যে তা ক্রমবৃদ্ধিমান।

প্রশ্ন : প্রথম বই প্রকাশের অনুভূতি জানাবেন।

উত্তর : একান্ত দ্বিধার সঙ্গে বই প্রকাশে অগ্রসর হয়েছিলাম। পড়াশোনাতেই আমার আনন্দ, ‘মনোজগতে উপনিবেশ’ লেখার জন্য বিস্তর বইপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়েছিল, দশটি বই পড়ে একটি বই লেখার মতো। মনে পড়ে তখনকার ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি ছিল অত্যন্ত সমৃদ্ধ, হালফিল সাময়িকী থেকে আকরগ্রন্থ সবই পাওয়া যেত সেখানে, এখনকার মতো ইংরেজি শিক্ষা বিক্রয় ও ব্রিটিশ বিদ্যালয়ে ভর্তিবিষয়ক কেন্দ্র হয়ে ওঠেনি। তো সেই বই, মনোজগতে উপনিবেশ : তথ্য সাম্রাজ্যবাদের ইতিবৃত্ত কেউ কেউ পছন্দ করেছিলেন, সেটা আমার বড় পাওয়া।

প্রশ্ন : স্যোসাল মিডিয়া লেখালেখির জন্য কতখানি আশীর্বাদ বা অভিশাপ ?

উত্তর : সোশ্যাল মিডিয়া হালের এক অভিনব স্পেস। মানুষের সঙ্গে মানুষের সংযোগের নতুন এই চিত্তাকর্ষক মাধ্যম আশীর্বাদ না অভিশাপ হয়ে উঠবে তা নির্ভর করবে মানুষ এর ব্যবহার কীভাবে করছে অথবা এর দ্বারা নিজে কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে, তার ওপর। এই টানাপড়েন চলছে, বোঝাপড়া এখনও হয়নি।

প্রশ্ন : গ্লোবালাইজেশনের চাপ থেকে মুক্তির পথ কি ?

উত্তর : দাওয়াই বাতলাবার মতো চিকিৎসক আমি নই। তবে এটা বুঝি, বিশ্বসংস্কৃতি বহু বর্ণের রঙধনু, সেখানে বাঙালি সংস্কৃতি একটি রঙ যোগ করে বহুবর্ণিলতা উজ্জ্বল করছে। স্বকীয়তা বিসর্জন দিয়ে তো সেই বর্ণবৈভব অর্জন সম্ভব নয়।

প্রশ্ন : রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে আপনার বিস্তর লেখালেখি আছে। আমাদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও জীবনযাপনকে রবীন্দ্রনাথ কিংবা রবীন্দ্রসাহিত্য কতখানি প্রভাবিত করে।

উত্তর : রবীন্দ্রনাথকে নতুন করে পাওয়া, ফিরে ফিরে পাওয়ার রয়েছে। সেই দৃষ্টিতে রবীন্দ্রনাথের দিকে তাকালে আমরা পাই আজকের চলার পথের সাথীকে। এমন প্রাসঙ্গিকতাই রবীন্দ্রনাথের শক্তি এবং আমাদের জন্য রবীন্দ্রনাথের কাছে প্রাপ্তির সুযোগ। সেজন্য রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখালেখি কিংবা ছায়ানট অথবা জাতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদ ঘিরে কাজ করবার প্রেরণা খুঁজে পাই।

প্রশ্ন : ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদকে রাষ্ট্র কি পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে ? ধর্ম ও মৌলবাদ লেখকের স্বাধীনতার জন্য কি হুমকিস্বরূপ ?

উত্তর : ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদ এই ভূখণ্ডে একাত্তরের ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে এনেছিল, ৩০ লক্ষ মানুষের জীবনহরণ করেছিল. লক্ষ লক্ষ পরিবারের জীবন তছনছ করে দিয়েছিল। এর বিপরীতে বাঙালির জাতিসত্তা ও অসাম্প্রদায়িক উদার সম্প্রীতির আদর্শ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লড়াই করে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছি। সেই রাষ্ট্র নানা ঘাত-প্রতিঘাতের পর আজ আবার মুক্তিযুদ্ধের পথে ফিরে আসার জন্য উদ্যমী ও উদ্যোগী হয়েছে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দ্বিধা কিংবা আপসকামিতা যেমন দুঃখজনক, তেমনি সমাজে মৌলবাদ ও ধর্মান্ধ কূপমণ্ডুক চিন্তার প্রসার কাম্য নয়। শিল্প-সাহিত্য সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে যথাযথ ভূমিকা পালন করবে, এটা আমাদের ন্যায়সঙ্গত প্রত্যাশা। এক্ষেত্রে তরুণ-প্রজন্মের লেখক-শিল্পীদের অবদান ও অংশগ্রহণ পালন করবে বিশেষ ভূমিকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button