আর্কাইভপ্রচ্ছদ রচনাপ্রবন্ধ

বিশ্বব্যাংক ও বঙ্গবন্ধু : মর্যাদার সমীকরণ : মফিদুল হক

আবার পড়ি : মফিদুল হকের প্রবন্ধ

১৯৭৩ সালের মার্চ মাস, দেশজুড়ে ছড়িয়ে থাকা ধ্বংসের ছাপ তখনও সাক্ষ্য দিচ্ছে ভয়াবহ ট্র্যাজেডির, বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় অকালে হারিয়ে-যাওয়া লক্ষ প্রাণের গুমরে-ওঠা কান্না, দেশ কীভাবে আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে সেই ভাবনার তল খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। এমন এক সময়ে, বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল এসেছিল ঢাকায়। আজকের দিনে সেই ঘটনাধারার দিকে আবারও ফিরে তাকিয়ে আমরা বোঝার চেষ্টা করতে পারি কী ছিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ভিত্তি। সেজন্য বর্তমান ও অতীতের পটভূমির কিঞ্চিৎ পরিচয় গ্রহণ জরুরি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা ও আর্থিক বিকাশের জন্য সবচেয়ে তাৎপর্যবহ ও বৃহত্তম প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণ ঘিরে বিশ্বব্যাংকের আচরণ দেশবাসীর কাছে এক ধাঁধা হয়ে আছে। এমন মাত্রার প্রকল্প প্রণয়ন শেষে তা  বাস্তবায়নের কাজ শুরুর আগে পোড়াতে হয় বিস্তর কাঠ ও খড়। তবে আধমণ তেল পোড়ানো হলেও রাধা আর নাচেনি, বিশ্বব্যাংকের সভাপতি তাঁর মেয়াদ ফুরাবার আগে সর্বশেষ কার্যদিবসে কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে ব্যাংকের সরে দাঁড়াবার সিদ্ধান্ত জারি করে যান। বিশ্বব্যাংকের জন্য এই সিদ্ধান্ত ছিল স্বীয় আর্থিক কর্মধারার প্রতি বিরাট এক ধাক্কা, অর্থ বিনিয়োগ ও জোগানদাতা হিসেবে কাজ করছে যে প্রতিষ্ঠান, তার কার্যকারিতা ও যোগ্যতা তো নিরূপিত হয় অর্থব্যয় তথা ডিসবার্সমেন্ট দ্বারা। এক্ষেত্রে ব্যাংক নিজের পায়ে নিজে কুড়াল দিয়ে আঘাত করবার মতো অস্বাভাবিক কাজটি করেছিল নিয়ম-বহির্ভূত প্রক্রিয়ায়, প্রতিষ্ঠানের জন্য গুরুত্ববহ সিদ্ধান্ত পরিচালনা বোর্ডে আলাপ-আলোচনা ব্যতিরেকেই গ্রহণ করলেন প্রতিষ্ঠান-প্রধান। তবে বিশ্বব্যাংক বিশালাকারের আর্থিক প্রতিষ্ঠান, স্বাভাবিক বিনিয়োগ প্রবাহ এতে বিঘ্নিত হলেও সেটা সামলে-ওঠা ব্যাংকের জন্য কোনও বড় ইস্যু ছিল না, কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে এ-ছিল সবচেয়ে বড় আর্থিক চ্যালেঞ্জ, বড় হয়ে দেখা দিল প্রশ্ন, বাংলাদেশ এখন কী করবে ?

বাংলাদেশের জন্য পৃথক তবে সমচরিত্রের আরেক বিশাল চ্যালেঞ্জ ছিল সদ্য-স্বাধীন দেশে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও উন্নয়ন ধারায় ব্যাংকের বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যায় সেই প্রশ্ন। বাংলাদেশের সরকারি কোষাগার ছিল শূন্য, বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা ছিল তীব্র এবং দেশটির বাঁচা-মরা নির্ভর করছিল আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর। সেটা কেবল কথার কথা ছিল না, ছিল নির্মম বাস্তব সত্য। রাস্তাঘাট-সেতু বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে আছে, সমুদ্রবন্দর চলাচল অনুপযোগী রয়েছে ডুবন্ত জাহাজ ও পাকিস্তানিদের পোঁতা মাইনের কারণে, খাদ্য-ঘাটতি মোকাবিলায় মার্কিন খয়রাতি গমের চালানের দিকে হা-পিত্যেশ করে তাকিয়ে থাকতে হয় বাংলাদেশকে। অথচ মার্কিন প্রশাসন দেশটির প্রতি মোটেই সদয় নয়, আরব দুনিয়াসহ চীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি, জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রবেশের দ্বার হয়ে আছে রুদ্ধ। এমতাবস্থায় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যকার সমীকরণ ছিল অতীব গুরুত্ববহ এবং কীভাবে ও কোন ভিত্তিতে তা প্রতিষ্ঠিত হলো সেটা দাবি করে বিশেষ বিবেচনা। বর্তমান নিবন্ধে এই দিকটায় সামান্য আলোকপাতের চেষ্টা আমরা নেব বিশ্বব্যাংকের আর্কাইভের দলিলপত্রের ভিত্তিতে।

বিশ্বব্যাংক প্রতিষ্ঠার ৫০ বছর উদযাপনার্থে ব্যাংকের পক্ষ থেকে ইতিহাসের উপাদান আহরণের প্রচেষ্টা হিসেবে ব্যাপকভাবে সাক্ষাৎকার গ্রহণের প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। ব্যাংকের বিভিন্ন সময়ের প্রেসিডেন্ট ও কর্মকর্তা ছাড়াও বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি, অর্থমন্ত্রী ও গবেষকদের ইন্টারভিউ নেওয়া হয় এবং তাদের খোলামেলা কথা রেকর্ডভুক্ত হয়। ১৯৯১ সালে নেওয়া এইসব সাক্ষাৎকার পরে লিপিবদ্ধ করেছিল ব্যাংক এবং সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের আর্কাইভসে সেসব বক্তব্যের লিখিত রূপ অবমুক্ত করা হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে যাঁদের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অধ্যাপক রেহমান সোবহান, এম. সাইদুজ্জামান, কাজী ফজলুর রহমান, ড. মুহম্মদ ইউনূস, গোলাম কিবরিয়া প্রমুখ। মুক্তিযুদ্ধ ও পরবর্তীকালে ব্যাংকের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বপালনকারী রবার্ট ম্যাকনামারার রয়েছে দীর্ঘ সাক্ষাৎকার। এখানে স্মর্তব্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে বিশ্বব্যাংকের ও মার্কিন প্রশাসনের অবস্থানের মধ্যে ফারাক ঘটেছিল এবং এটা ছিল ব্যাংকের ইতিহাসে প্রথম এমন ঘটনা। একাত্তরের জুন মাসে বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদল ঢাকা এসেছিল অবস্থা সরেজমিন দেখে রিপোর্ট প্রদানের জন্য। তরুণ ওলন্দাজ অর্থনীতিবিদ হেনড্রিক ভ্যান ডের হেইজডেন প্রণীত সেই রিপোর্টে পাকবাহিনীর নৃশংসতার নানা পরিচয় মেলে ধরে পাকিস্তানে ব্যাংকের সহায়তা আপাতভাবে বন্ধ রাখার সুপারিশ করা হয়। সেই মোতাবেক বিশ্বব্যাংক পাকিস্তানকে ঋণের কিস্তি জোগানো সাময়িকভাবে স্থগিত করেছিল, যা পাকিস্তানি জেনারেলদের গালে ছিল অকল্পনীয় এক চপেটাঘাত। নিক্সন-কিসিঞ্জার পরিচালিত পাকিস্তানের দিকে ঝুঁকে পড়া মার্কিন নীতির বিপরীতে ছিল ব্যাংকের এই অবস্থান। এক্ষেত্রে রবার্ট ম্যাকনামারার ভূমিকার স্বীকৃতি না দিয়ে আমাদের উপায় নেই।

রবার্ট ম্যাকনামারার সাক্ষাৎকারের সময় তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল ১৯৭১-৭২ সালে মার্কিন প্রশাসনের নিরিখে বিশ্বব্যাংকের অবস্থান সম্পর্কে। ম্যাকনামারার তখন অনেক বয়স হয়েছে, সব কথা ভালোভাবে স্মরণ করতে পারেন না, তারপরও তিনি একটা ঘটনার উল্লেখ করেছিলেন খোলাখুলিভাবে। তিনি বলেন :

“আমি আপনাকে একটি ঘটনার কথা বলতে পারি। ধরে নিতে পারি এসব কথা মনের ভেতরকার ভাবের প্রবাহের স্বাধীন প্রকাশ, আপনার রিপোর্টে উদ্ধৃত করা ঠিক হবে না। আপনি যা জানতে চাইছেন সেটা হলো ব্যাংকের সঙ্গে প্রধান স্টেকহোল্ডারদের বিদেশ নীতির কোনও যোগ আছে কিনা, ব্যাংক তা সমর্থন করে কি না, সেই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা পরিচালিত হয় কিনা। আপনি জানেন প্রতি মঙ্গলবার আমাদের বোর্ড-সভা অনুষ্ঠিত হয়। ঋণ ও কর্জ প্রদানসংক্রান্ত সকল সিদ্ধান্ত বোর্ডে পেশ করতে হয়। তো এক শুক্রবার বিল রজার্স, অর্থনীতিবিদ রজার্স নয়, অন্যজন যিনি বিদেশ-মন্ত্রী, তিনি ফোন করে বললেন, ‘বব, ভারতের ঋণ মঞ্জুরসংক্রান্ত যে দুটি বিষয় রয়েছে তা বুধবারের সভার আলোচ্য-সূচি থেকে বাদ দিতে হবে’।”

আমি বলি, ‘কেন ?’

তিনি জানান, ‘সে-দুটো ঋণ-প্রস্তাব মোটেই ভালো কিছু নয়।’

‘ভালো নয় বলতে কি বোঝাতে চাইছেন ? আমার জানা মতে সেসব তো উত্তম প্রস্তাব।’

তিনি বললেন, ‘এমন কথা বলবেন না। আপনি দেখছি ভারতের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন।’

সেটা ছিল এমন এক সময় যখন আমেরিকা বিভিন্নভাবে পাকিস্তানকে সাহায্য করতে চেষ্টা করছিল। আমি বলি, ‘চুলোয় যাক সেসব। আপনারা পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাতমূলক এবং জানেন না কীভাবে এগোতে হবে। আমাদের বিবেচনায় ঋণ প্রস্তাবগুলো ভালো এবং আমি এজেন্ডা থেকে তা তুলে নিতে অপারগ।’

তিনি বলেন, ‘এটা আমি হতে দিতে পারি না।’

আমি বলি, ‘কী বলছেন আপনি, হতে দিতে পারি না মানে ?’

তিনি বললেন, ‘আমরা এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে দেব না।’

আমি জানাই, ‘আপনি দেখুন কত ভোট পান, আমিও আমারটা দেখি।’

অবশ্যই আমরা জয়ী হয়েছিলাম।’

রবার্ট ম্যাকনামারা ১৯৭২ সালের গোড়ায় সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই সময়ে তিনি ভারতে এসেছিলেন পূর্বনির্ধারিত সফরে, সেখান থেকে সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকা এসেছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করেছিলেন। এই সফরের পেছনে বিশ্বব্যাংকের স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত ছিল। কেননা যুদ্ধাবসানে এখন পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যাংকের স্বাভাবিক সম্পর্ক স্থাপিত হবে, সেক্ষেত্রে পাকিস্তানের নেওয়া ঋণ কীভাবে ভাগ-বাটোয়ারা হবে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে তা স্থির করা জরুরি ছিল। তবে ম্যাকনামারার এই সফর বাংলাদেশের জন্য গুরুত্ববহ ছিল এবং নিক্সন-কিসিঞ্জারের অবস্থানের বিপরীতে সদ্য-স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্টের আগমন আন্তর্জাতিকভাবেও ছিল গুরুত্বপূর্ণ। রবার্ট ম্যাকনামারা বলেছেন :

‘তারিখ আমার সঠিকভাবে মনে নেই। তবে বাণিজ্যিক বিমান যোগাযোগ তখনও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। আমাকে সেখানে যেতে বিমান চার্টার করতে হয়েছিল কেননা আমি মনে করেছিলাম এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ যে দৃশ্যত যেন মনে হয় বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল, তারা দূরে দাঁড়িয়ে নেই। আমি সেই সময়কার সব রাজনীতি বিস্মৃত হয়েছিলাম। তবে এমন মানুষ অনেক ছিল যাঁরা চাইছিল আমরা তফাতে দাঁড়িয়ে থাকি। এমন মানুষ ছিল যারা এর বিরোধিতা করেছিল, গোড়ায় তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব  পাকিস্তানের আলাদা হয়ে যাওয়ার বিরোধিতা করেছিল, এবং যখন বাংলাদেশ কার্যত স্বাধীন হয়ে গেল তখন এই দেশকে আশু সমর্থন জোগানোর বিরোধিতা করেছিল। এছাড়া বিতর্ক ছিল বিশ্বব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের দায় কীভাবে বাটোয়ারা হবে তা নিয়ে। সব মিলিয়ে বিভিন্নজনের ছিল বিভিন্ন অবস্থান। তবে তারা সবাই চাইছিল বাংলাদেশের সঙ্গে আশু কোনও যোগাযোগ যেন না ঘটে। আমি ভেবেছিলাম আমরা যদি এসব থেকে দূরে থাকি তবে এটা আমাদের জন্য খুব কঠিন হয়ে পড়বে―মনে হবে আমরা বৃহৎ শক্তির কারও কারও হয়ে কাজ করছি। তাতে এসব মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের জন্য দুরূহ হয়ে উঠবে। তাই ভেবেছিলাম যত আগে সম্ভব আমি সেখানে যাই এবং সেটাই আমি করেছিলাম। বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সুসম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।’

এখানে স্মরণ করতে হয় বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠার পথে বিশেষ জটিলতা ছিল পাকিস্তান আমলে নেওয়া ঋণের দায়ভার বাংলাদেশ কতটা নেবে সেই প্রশ্ন ঘিরে। দেশের পক্ষে এসব ঋণ পাকিস্তান গ্রহণ করেছিল বটে কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাঙালির কোনও ভূমিকা ছিল না, অর্থ কোথায় কীভাবে ব্যয়িত হয়েছে তার কোনও হিসাবও পূর্ব পাকিস্তানে ছিল না। তদুপরি বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। আর তাই বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান আমলে বিশ্বব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের কোনও দায়-দায়িত্ব নিতে সম্মত ছিলেন না। এর ফলে খাদ্য ও অন্যান্য জরুরি খাতে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেও উন্নয়ন খাতে কোনও বরাদ্দ মিলছিল না। অতীত ঋণের দায় সম্পর্কে কোনও ফয়সালা ছাড়া বিশ্বব্যাংক উন্নয়ন তহবিল ছাড় করতে রাজি ছিল না।

এমনি পটভূমিকায় ১৯৭৩ সালের মার্চ মাসে বিশ্বব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে আসে ঋণের বিষয়ে ফয়সালা করার জন্য। প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে ছিলেন ব্যাংকের পদস্থ কর্মকর্তা পিটার কারগিল। বঙ্গবন্ধুর সরকার এই আলোচনায় দুটি ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান স্পষ্টভাবে মেলে ধরেন। এর একটি ছিল নৈতিক অবস্থান, যেহেতু বাংলাদেশ এইড গ্রুপের সভা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাই সভাপতিত্ব করার অধিকার বাংলাদেশের ওপর বর্তায় এবং বাংলাদেশ সেটা দৃঢ়ভাবে মেলে ধরে। অনেক আলাপ-আলোচনা শেষে বিশ্বব্যাংক এই দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় এবং বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্ল্যানিং কমিশনের উপ-প্রধান অর্থনীতিবিদ নূরুল ইসলাম সভায় সভাপতিত্ব করেন। যুদ্ধ-বিধ্বস্ত, পশ্চাৎপদ, দরিদ্র দেশ বটে বাংলাদেশ তবে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনের দাবি নিয়ে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম নিয়েছে এই রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশের মর্যাদা রক্ষায় বঙ্গবন্ধু ছিলেন দৃঢ়চেতা, তাই চরম প্রতিকূল পরিবেশেও তিনি ছিলেন দেশের মর্যাদা বিষয়ে সজাগ ও সক্রিয়।

বাংলাদেশের জন্য তখন ঘোর দুর্দিন চলছে, অর্থনীতি সচল রাখা ও উন্নয়নের ধারা সূচিত  করতে বিদেশি সহায়তা ছিল একান্ত জরুরি, সেজন্য বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে পাকিস্তানি ঋণের প্রশ্নে দ্রুত সুরাহা দরকার ছিল। এ ক্ষেত্রেও সরকার নিয়েছিল নীতিগত অবস্থান, যেহেতু ঋণ নিয়েছিল পাকিস্তান সরকার, ঋণশোধের দায়-দায়িত্বও তাদের। শেষ পর্যন্ত কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই সভা সমাপ্ত হয়। ফলে খাদ্য ও মানবিক সহায়তার প্রতিশ্রুতি মিললেও উন্নয়ন সহায়তা কিছুই মেলেনি, ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশের অঙ্গীকার ছাড়া বিশ্বব্যাংকও কোনও ছাড় দিতে প্রস্তুত ছিল না। তাদের বক্তব্য ছিল যেহেতু ঋণের অর্থ পূর্ব পাকিস্তানেও ব্যয় হয়েছে, তাই তৎকালীন পাকিস্তানের অংশ হিসেবে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশকেও এর দায়-দায়িত্ব নিতে হবে।

শেষ পর্যন্ত সুরাহা একটা হলো এবং এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর প্রজ্ঞা ও বুদ্ধি বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। এম. সাইদুজ্জামান প্রাক্তন অর্থ উপদেষ্টা এবং বিশ্বব্যাংকে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে আলোচনায় তিনি বিশেষভাবে অংশ নেন, অন্যদিকে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকেও তিনি হাজির থাকেন। বিশ্বব্যাংকের কাছে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন :

“ঋণ-সমস্যার সমাধান কীভাবে ঘটলো সেটা বেশ ইন্টারেস্টিং। এটা দীর্ঘ প্রক্রিয়া, তবে আমি সংক্ষেপে আপনাকে বলতে পারি। সেই সময় শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের প্রধানমন্ত্রী। তিনি ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আকর্ষণীয় নেতা, জাতির পিতা, এবং তখন দেশে আমরা সবাই তাকিয়ে থাকতাম তাঁর দিকে, যিনি আমাদের মহান নেতা, তাঁকে বলতাম ‘বঙ্গবন্ধু’, জাতির জনক। এদিকে আর্থিক পরিস্থিতি নাজুক হয়ে উঠছিল, একদিন প্রধানমন্ত্রীর সামনেই এসব বিষয়ে আলাপ হচ্ছিল তাঁর বাসভবনে। উপস্থিত ছিলেন প্ল্যানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম, অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ এবং অফিসারদের আরও কেউ কেউ, আমরা ব্যাখ্যা করে বলছিলাম যে, বিষয়টা আইনগত প্রশ্ন। আইনগতভাবে এই ঋণের গ্রহিতা পাকিস্তান, যদিও ঋণের অর্থের একাংশ এখানে ব্যয় হয়েছে। তবে বাংলাদেশে আমরা এর দায়ভার নিতে পারি না, কেননা আমরা জানি না কোথায় কীভাবে টাকা খরচ করা হয়েছে।

এরপর এক নাটকীয় ঘটনা ঘটলো, আমরা যখন প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছিলাম, তিনি ওপরে দাঁড়িয়ে পাইপ টানছিলেন, হঠাৎ তিনি বললেন, ‘আচ্ছা, বিদেশি ঋণের টাকায় যেসব প্রকল্প নির্মিত হয়েছে, আমরা বিদেশি অর্থে যা নির্মাণ করেছি, সেসব কি এখনও বাংলাদেশে রয়েছে ? যদি বাংলাদেশে দৃশ্যমান হয়ে থাকে, তবে আমি তার দায়-দায়িত্ব নিতে পারি। যদি দেশের মাটিতে এসব প্রকল্প দৃশ্যমান না হয়, তবে আমার আর কিছুই করার নেই।’

এখান থেকে আমরা দিকনির্দেশনা পাই এবং সেভাবে অগ্রসর হই। আমরা বলি যে, প্রকল্প ঋণের দায় আমরা নেব তবে কর্মসূচি বাবদ প্রদত্ত ঋণের নয়।”

এরপরই বার্তা রটে যায় যে, বাংলাদেশ সরকার দেশের ভেতর দৃশ্যমান প্রকল্পের ঋণ ও অন্যান্য দায়ভার গ্রহণে সম্মত রয়েছে। এর ফলে সুফল বয়ে আসতে সময় লাগেনি, নতুন করে আলোচনা শুরু হয় এবং দ্রুত পৌঁছে যাওয়া যায় সমাধানে।

বাংলাদেশের কাছে বিশ্বব্যাংকের দাবি ছিল ১২০ কোটি ডলারের পরিমাণ ঋণ পরিশোধের। কর্মসূচি খাতে যে ঋণ তার দায়ভার নিতে বাংলাদেশ অস্বীকার করে। এর বড় অংশ ছিল কৃষিখাতে ঋণ, যে-অর্থ বিতরণের পর চাষি হয়তো পাওয়ার টিলার কিংবা ট্রাক্টর কিনেছে। বাংলাদেশের যুক্তি ছিল ঋণ-গ্রহিতা কৃষক তো তাদের দেনা-পাওনা সরকারের কাছে পরিশোধ করেছে। এখন পাকিস্তান সরকার যদি বিশ্বব্যাংককে তাদের প্রাপ্য কিস্তি পরিশোধ না করে থাকে তবে সেটা পাকিস্তান সরকারের ব্যাপার, বাংলাদেশ এর দায়-দায়িত্ব নেবে না। শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাংক এই যুক্তি মানতে সম্মত হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বাংলাদেশ প্রকল্প ঋণের দায়িত্ব নেবে তবে কেবল সেইসব প্রকল্পের যা বাংলাদেশে দৃশ্যমান। হিসাব-পত্র করে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দৃশ্যমান প্রকল্প ঋণ বাবদ প্রাপ্য দাঁড়ায় ৪০ কোটি ডলারে। এর ৮৪ শতাংশ আবার বিশেষ খাতের ঋণ হিসেবে তামাদি বা মওকুফ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ফলে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেষ পর্যন্ত দেয় অর্থের পরিমাণ দাঁড়ায় ৬.৪ কোটি ডলার। এভাবে বিশ্বব্যাংকও সংবেদনশীলভাবে বিচার করে বাংলাদেশ সমস্যা এবং সম্মানজনক সুরাহা অর্জনে আর বিলম্ব ঘটেনি।

উপসংহার

বাংলাদেশের স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী বছরগুলোতে, এক কঠিন সময়ে, বঙ্গবন্ধু যেসব রাষ্ট্রনায়কোচিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন তার একটি দিক প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের সার্বভৌম ভিত্তি রচনার মাধ্যমে। বিশ্বব্যাংকের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা মার্কিন প্রশাসনের খবরদারিত্ব পরিহার করে সময়োচিত ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু অবশ্য বাংলাদেশকে গড়ে তুলবার মতো ফুরসত পাননি, তবে বিশ্বসভায় বাঙালির তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আসন তিনি নিশ্চিত করেছিলেন, ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের আসন-লাভ ছিল বিপুল বাধার বিরুদ্ধে এমনি অর্জনের অনুপম প্রকাশ। কিন্তু ১৯৭৫-এর আগস্টের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড এই অধ্যায় ইতি টেনে দেয়।

এরপর বুড়িগঙ্গা ও পোটোমাক নদী দিয়ে জল গড়িয়েছে অনেক। একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে বাংলাদেশ পরিণত হলো নিম্ন মধ্য আয়ের দেশে, বিকশিত হওয়ার নানা লক্ষণে বঙ্গসমাজ এখন অধীর, এই নতুন সম্ভাবনা ব্যাপক মানুষের জীবনে যেন সুফল বয়ে আনতে পারে, তেমনি চালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছে দেশ। এমন পটভূমিকায় অর্থনীতির জন্য সবিশেষ তাৎপর্য বহন করে পদ্মা সেতু নির্মাণ, যা থেকে অজ্ঞাত কারণে সরে দাঁড়িয়েছে বিশ্বব্যাংক। তারপরেও মাওয়া ও জাজিরা পয়েন্টে চলছে ধুন্ধুমার কাণ্ড, এগিয়ে চলছে সেতু নির্মাণের মহাপ্রকল্প, নিজস্ব অর্থায়নে, নিজ শক্তিতে। সেই ক্ষমতাবলে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে যোগ্য-বিবেচিত আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে, যুক্ত হয়েছে দেশজ নানা প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশের সেতু। ইতিপূর্বে এমনি প্রকল্পের অর্থের একাংশ চলে যেত বিদেশি পরামর্শকদের পকেটে। এবার ঘটছে তার ব্যত্যয়। জাতীয় ক্ষমতা ও দক্ষতার এই যে প্রকাশ তা বহন করে সেতুর চাইতেও বড় তাৎপর্য। এই তাৎপর্যের মূল উপাদান হচ্ছে বাংলাদেশের স্বনির্ভর হয়ে-ওঠা, স্ব-শক্তিতে বিকশিত হওয়া। আন্তর্জাতিক সহায়তা থাকবে, কিন্তু তা প্রদত্ত হবে বাংলাদেশের চাহিদা-মতো, বাংলাদেশের শর্তে। সেই ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সম্পর্কের নতুন সমীকরণ তৈরি করতে চলেছে। বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ কৌশিক বসুর সাম্প্রতিক ঢাকা সফর ও বক্তব্য সেই সাক্ষ্যই দেয়।

এমন ঐতিহাসিক পর্বান্তরের কালে আমরা নিশ্চয়ই স্মরণ করব বাংলাদেশের যাত্রাকালে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের মর্যাদার সমীকরণ ঘটাতে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Back to top button